সম্পাদকীয়
ফাল্গুন মাস। রবি মৌসুমের শেষান্তে। শীতে ম্রিয়মাণ প্রকৃতি বসন্তের জাদুময়ী স্পর্শে হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। এ সময় আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি গাছ মুকুলে ভরে যায় এবং মুকুলের গন্ধে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকে। প্রকৃতির সাথে আমাদের জনজীবনেও কাজের আগমন ঘটে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বীর কৃষিজীবী ভাইবোনেরা পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কৃষিভুবনে কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত সবার জন্য ফাল্গুনের শুভেচ্ছা। সবার জীবন ফুলের পাপড়ির মতো শোভা ও সৌন্দর্যে ভরে উঠুক।
বাংলাদেশের মসলা খুবই জনপ্রিয়। খাবার ও মসলা একটি অপরটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। খাবারে স্বাদ, গন্ধ ও সজ্জায় ভিন্নতা আনতে বাঙালিরা হরেক রকমের মসলা ব্যবহার করে আসছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে সার্বিকভাবে শরীর সুস্থ রাখতে অতিরিক্ত তেলজাতীয় ও মসলাদার খাবার না খাওয়াই ভালো। তবে গবেষণা থেকে জানা যায় মসলায় কিছু ঔষধি গুণাবলি রয়েছে। দেশে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ, কালোজিরা, ধনিয়া প্রভৃতি প্রধান মসলা হিসেবে চাষাবাদ করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মসলার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫২.২৯৪ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্জিত হয়েছে ৫৩.৪৩১ লক্ষ মেট্রিক টন, যা চাহিদা অনুযায়ী অর্জন সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে দেশের চাহিদা মিটিয়ে মসলা (আস্ত, গুঁড়া, মিক্সিং) রপ্তানি করা হচ্ছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণাগার না থাকায় পেঁয়াজসহ বিভিন্ন মসলা আমদানি করতে হয়। কৃষি বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত গবেষণা করে ফসলের আধুনিক জাত উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টটিউট, বগুড়া কর্তৃক বারি আলুবোখারা-১ নামক একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। আলুবোখারা বাংলাদেশের স্বল্প ব্যবহৃত একটি উচ্চমূল্যের ফলজাতীয় মসলা ফসল। ফল প্রধানত মসলা হিসেবে বা চাটনিতে ব্যবহার করা হয়। এ সম্পর্কে ‘বারি আলুবোখারা-১ এর আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি’ তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবারের কৃষিকথায়।
এ ছাড়াও কৃষি বিশেষজ্ঞদের সময়োপযোগী প্রবন্ধ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ, আগামীর কৃষি ভাবনা, সফল কৃষকের গল্প ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এ সংখ্যা। কৃষিকথায় এসব মানসম্পন্ন ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক লেখা দিয়ে যারা সমৃদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রইল। আশা করি কৃষিকথার এবারের সংখ্যা কৃষির উন্নয়নে কাজে লাগবে।
মুগডালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
এবং চাষাবাদ পদ্ধতি
ড. এম. মনজুরুল আলম মন্ডল
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র। এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি স্বল্পতা দূর করতে, মাটির হারানো উর্বরশক্তি ফিরে পেতে, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে মুগ চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। এ দেশের সাধারণ গরিব মানুষের পক্ষে প্রাণিজ আমিষের উৎস মাছ এবং মাংস ক্রয় করা বেশ ব্যয়বহুল এবং কষ্টসাধ্য। অপরদিকে তুলনামূলভাবে ডাল ফসলের মূল্য কম এবং সহজলভ্য। তাই সাধারণ গরিব মানুষ তাদের আমিষ ঘাটতি ডাল হতে পুষিয়ে নিতে পারে বলে ডালকে গরিবের মাংস বলা হয়।
মানুষের খাদ্য তালিকায় আমিষের উৎস হিসেবে মুগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অঙ্কুরিত মুগডাল ভিটামিন সি এর কার্যকরী উৎস। ডাল ফসল জমিতে জৈবসার এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ করে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। মুগডাল চাষে জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ে হেক্টরপ্রতি ২৫-৬৩ কেজি। সুতরাং শস্যপর্যায়ে মুগডাল জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ডালজাতীয় ফসলের মধ্যে একমাত্র মুগডালের জীবনকাল সবচেয়ে কম, মাত্র ৭০-৭৫ দিন, যা অন্যান্য ডালজাতীয় ফসল যথা- মসুর, খেসারি ও ছোলা থেকে প্রায় একমাস আগে পাকে ফলে তিন ফসল ও চার ফসল শস্যবিন্যাসে সহজেই মুগডাল অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। মুগডাল চাষাবাদে খরচ অন্যান্য ডাল ফসলের চেয়ে অনেক কম। দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের ৪ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর জমি শুষ্ক মৌসুমে আমন ধান কাটার পরে অনাবাদি থাকে। অর্থাৎ ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আমন ধান কাটার পর এই বিশাল পরিমাণ জমি ৫-৬ মাসেরও বেশি সময় পতিত থাকে। মুগডাল খরা সহিষ্ণু ফসল বিধায় মুগ ফসল চাষাবাদে সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় সহজেই এ সকল পতিত জমিতে মুগডাল চাষাবাদ করে কৃষক অর্থনৈতিক লাভবান হবে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গম কাটার পর থেকে আমন ধান রোপণের পূর্ব পর্যন্ত অধিকাংশ জমি পতিত থাকে। কিন্তু মুগ চাষের মাধ্যমে অতি সহজেই এসব পতিত জমি ব্যবহার করা সম্ভব। দেশে মোট ডাল ফসলের মধ্যে ৮০% ডাল ফসল রবি মৌসুমে চাষ হয়। ফলে রবি মৌসুমে চাষকৃত অন্যান্য ফসল যথা- ধান, গম, ভুট্টা ও সবজি এর সাথে শীতকালে চাষকৃত ডাল ফসল (মসুর, মটর, ছোলা, খেসারি) প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে শীতকালীন ডাল ফসলের চাষাবাদ এলাকা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। অপরদিকে এক মাত্র মুগডাল খরিফ-১ (ফাল্গুন-চৈত্র-বৈশাখ) মৌসুমে চাষ করা হয়। এই সময়ে স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন শীতকালীন ফসল (সরিষা, আলু, গম, মসুর, ছোলা, গাজর, পাতাকপি, ফুলকপি, লেটুস, মুলা ইত্যাদি) মাঠে থাকে না এবং ঐ জমি আমন ধান লাগানোর আগ পর্যন্ত পতিত থাকে। জমিতে সহজেই মুগডাল চাষ করা সম্ভব। এছাড়া মুগডালের বাজারমূল্য অন্যান্য যে কোন ডালের চেয়ে (মাষকলাই ব্যতীত) বাজার মূল্য বেশি (১৫০-১৭০ টাকা/কেজি), ফলে কৃষক মুগডালের চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হবেন। এছাড়া মুগডাল খেলে হজমেও সমস্যা হয় না। এতে ফ্যাট বা কার্বোহাইড্রেট একদমই থাকে না বলে এটি ওজন কমাতেও বেশ সাহায্য করে। বিভিন্ন সমস্যায় মসুর ডাল এড়িয়ে যেতে বলা হলেও, মুগডাল এড়িয়ে চলার কথা বলা হয় না।
মুগডালের উন্নত জাত
এ যাবত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ০৯টি, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৩টি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ০৪টি মুগডালের মোট ২৬টি স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। তন্মধ্যে বারিমুগ-৬ এবং বিনামুগ-৮ সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত। তবে জাত দুইটি অনেক পুরাতন জাত, ফলে পোকা ও রোগ বালাইয়ের আক্রমণ বেশি হচ্ছে বিধায় কৃষিবিদগণ বারি উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন উচ্চফলনশীন জাত বারিমুগ-৭ ও বারিমুগ-৮ এবং বিনা উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন উচ্চফলনশীন জাত বিনামুগ-১১ ও বিনামুগ-১২ চাষ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। বারিমুগ-৮ এর বীজ ছোট ও আকর্ষণীয় রঙের বিধায় ক্রেতার চাহিদা বেশি এবং অধিক লাভের জন্য বারিমুগ-৮ চাষ করার জন্য উত্তম।
চাষাবাদ পদ্ধতি ও চাষের জন্য উপযুক্ত অঞ্চল
দক্ষিণাঞ্চল
বিলম্ব রবি : বৃহত্তর বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলে মাঘ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত (জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত) মুগের বীজ বপন করে থাকে। বর্তমানে মোট মুগডালের ৮৩% এ অঞ্চলে উৎপাদিত হয়ে থাকে।
উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল
খরিফ ১ : বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া ও রাজশাহীর বিভাগের পাবনা, নাটোর ও রাজশাহী জেলায় ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত (ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত) মুগের বীজ বপন করে থাকে।
দক্ষিণা-পশ্চিমাঞ্চল
খরিফ-২ : খুলনা জেলার উত্তরাঞ্চল ও বৃহত্তর যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায় শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে আশ্বিন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত (আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত) সোনা মুগের বীজ বপন করে থাকে। বর্তমানে খরিফ-২ মৌসুমে মুগের চাষ খুবই সীমিত।
মাটির ধরন
সব ধরনের মাটিতেই মুগডাল চাষ করা যেতে পারে। সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ মাটিতে এই ফসল ভাল জন্মে থাকে।
জমি তৈরি
জমির অবস্থাভেদে ২-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। শীতকালীন ফসল তোলার পর মুগ চাষের জন্য ১-২টি চাষই যথেষ্ট তবে পতিত জমির জন্য ৩-৪টি চাষ লাগে। জমিতে পানির অভাব হলে বীজের অঙ্কুরোদগমের সুবিধার জন্য একটি হালকা সেচ দেয়া প্রয়োজন।
সার প্রয়োগ
জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে সারের মাত্রার তারতম্য করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সার সুপারিশমালা অনুসরণ করতে হবে। তবে সাধারণভাবে একরে ১২-১৫ কেজি ইউরিয়া, ২৮-৩০ কেজি টিএসপি, ১৫-২০ কেজি এমওপি ও ১৫ কেজি জিপসাম সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা যেতে পারে। দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একর প্রতি ৩-৪ কেজি বরিক এসিড শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে।
বপন পদ্ধতি ও বীজের পরিমাণ
মুগ কালাই সাধারণত ছিটিয়ে বপন করা হয়। বপনের পর ভালভাবে মই দিয়ে বীজগুলো ঢেকে দিতে হবে। তবে সারিতে বপন করলে ব্যবস্থাপনায় সুবধিা হয় ও ফলন বেশি হয়। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি হতে হবে। একরে ১০-১২ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
আগাছা দমন
চারা গজানোর পরে জমিতে আগাছা দেখা দিলে ১৫-২০ দিন পর নিড়ানি দিয়ে হালকাভাবে আগাছাগুলো পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। এতে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
পানি সেচ
মুগকালাই চাষাবাদের জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় পানি সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে জমিতে অত্যধিক পানির অভাব হলে একবার সেচ দেয়া বাঞ্ছনীয়। এতে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
রোগ ও পোকামাকড় দমন
মুগে যেসব রোগ হয়, তার মধ্যে হলুদ মোজাইক ভাইরাস, পাতায় দাগ ও পাউডারি মিলডিউ বেশি ক্ষতিকারক। তবে মুগের আধুনিক জাতগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন। মোজাইক ভাইরাস রোগ দেখা দেয়া মাত্র গাছ উপড়ে ফেলতে হবে। পাতায় দাগ রোগের আক্রমণ হলে ব্যাভিস্টিন বা ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২বার স্প্রে করতে হবে। পাউডারি মিলডিউ রোগ হলে টিল্ট-২৫০ ইসি. ০.৫ মিলি. বা থায়োভিট ২ গ্রাম প্রতি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করতে হবে।
মুগে যেসব পোকার আক্রমণ হয়, তাদের মধ্যে জাবপোকা, সাদামাছি, বিছাপোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা এবং থ্রিপস বেশি ক্ষতিকারক। জাবপোকার আক্রমণে প্রতিরোধক হিসেবে প্রতি লিটার পানিতে সুমিথিয়ন বা মেলাথিয়ন ২.০০ মিলি. ওষুধ মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বিছা পোকার আক্রমণ হলে গাছের পাতার নিচের দিকে ডিম পাড়া অবস্থায় বা ডিম থেকে শুঁককীট বের হয়ে চলাচল শুরু করার আগেই আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পা দিয়ে চেপে মেরে ফেলতে হবে। থ্রিপস ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হলে সাইপার মেথ্রিন গ্রুপের যেমন রিপকর্ড ১০ ইসি প্রতিলিটার পানিতে ১.০ মিলিলিটার ওষুধ মিশিয়ে ছিটিয়ে দিলে এ পোকা সহজে দমন করা যায়।
ফসল সংগ্রহ, মাড়াই ও সংরক্ষণ
মুগকালাই এর শুটি ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা খুবই অসুবিধাজনক। কারণ দেশে যে সকল প্রচলিত জাত আছে সেগুলোর ফল একসাথে পাকে না বিধায় কয়েকবার সংগ্রহ করতে হয়। শুঁটি বা পড বাদামি বা কালচে রঙ ধারণ করলে বুঝতে হবে মুগ পরিপক্ব হয়েছে। তখন পরিষ্কার সূর্যালোকের দিনে মুগের ফল সংগ্রহ করে শুষ্ক ও পরিষ্কার স্থানে রৌদ্রে শুকিয়ে মাড়াই করতে হবে। প্রথমবার ফল/গুটি সংগ্রহের পর ৮-১২ দিন পর দ্বিতীয়বার গুটি সংগ্রহ করে ভালভাবে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বীজ সংগ্রহ করতে হয়। এ পর বীজগুলো পরিষ্কার করে এবং ভালভাবে রৌদ্রে শুকিয়ে মাটি বা টিনের পাত্রে মুখ বন্ধ করে সংরক্ষণ করা হলে অনেকদিন পর্যন্ত বীজ ভাল থাকে।
লেখক : চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইল : ০১৭১৬৭৪৯৪২৯
পরিবর্তিত জলবায়ুতে টেকসই
মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা
হাছিনা আকতার
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু কৃষি জমির উপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অব্যাহত চাপ, প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে নানা প্রকারের দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে যেমন- অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, উজানের ঢল, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের কৃষিকে হুমকি দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের এ পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। ক্রমবর্ধমান এ জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অধিক ফসল ফলনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এমতাবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী কৃষির জন্য সঠিক ও টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা হল মাটিকে রক্ষা করার জন্য এবং এর কার্যকারিতা (যেমন: মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনক্ষমতা) উন্নত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম অনুশীলন এবং চিকিৎসার প্রয়োগ। অঞ্চল বিশেষে ব্যবহার উপযোগী বিজ্ঞানসম্মত অভিযোজন কৌশলই হবে জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষাকবজ। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিতে নানা রকম বৈচিত্র্য রয়েছে। এই বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতি ও পরিবর্তিত জলবায়ুতে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যে টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক সেগুলো নিম্নরূপ-
ভূমি ক্ষয়রোধ : ভূমি ক্ষয়রোধ করার জন্য কনজার্ভেশন পদ্ধতিতে চাষাবাদ অর্থাৎ শূন্য কর্ষণ পদ্ধতি অনুশীলন করতে হবে। মাটিকে যথাসম্ভব কম আলোড়িত করতে হবে। মাটির উপরিভাগে সাধারণত ৭-৮ ইঞ্চি গভীরতা পর্যন্ত ফসলের পুষ্টি উপাদান থাকে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, পানি প্রবাহ, বাতাসের গতি ইত্যাদির কারণে উপরিভাগের মাটি স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে সঞ্চিত পুষ্টি উপাদান বিনষ্ট হয়ে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। তাই বৃষ্টি ও বন্যার পানি গড়ানোর সময় যাতে জমির উপরিভাগের মাটি অপসারিত না হয় এবং নালা ও খাদের সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ : উদ্ভিদ পুষ্টির জন্য মাটি থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান গ্রহণ করে বিধায় বিভিন্ন ফসল আবাদের ফলে মাটির উর্বরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। বিভিন্ন ফসল মাটি থেকে বিভিন্ন পরিমাণে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে। তাই মাটির পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পূরণের জন্য জমিতে জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে।
জৈব পদার্থ ব্যবহার : মাটির ভৌতিক ও রাসায়নিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য জৈব পদার্থের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জৈব পদার্থ মাটির দৃঢ়তা কমিয়ে, মাটিকে ঝুরঝুর করে। ফলে গাছের শিকড় সহজে প্রবেশ করতে পারে, মাটিতে বায়ুচলাচল বৃদ্ধি করে, পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এক হেক্টর জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১% বৃদ্ধি করলে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার লিটার পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বীজের অংকুরোদগম বৃদ্ধি পায়, অনুজৈবিক কার্যকলাপকে বৃদ্ধি করে। এনজাইম উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে পুষ্টি উপাদান সহজলভ্য করে, সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। ইউরেজ এনজাইম ইউরিয়া সারকে নাইট্রেট ও এমোনিয়াম আয়নে পরিণত করে গাছের জন্য গ্রহণ উপযোগী করে। একইভাবে ফসফাটেজ এনজাইম টিএসপি ও ডিএপি সারকে গাছের জন্য গ্রহণ উপযোগী করে। ফলে সারের অপচয় কমায় এবং বায়ুম-লে নাইট্রাস অক্সাইড ও অ্যামোনিয়া গ্যাসের নির্গমন কমায়। নাইট্রাস অক্সাইড একটি অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস যার স্থায়িত্ব ১১৪ বছর এবং যা গত ১০০ বছর ধরে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি তাপ ধরে রাখছে যা জলবায়ু পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
জৈব পদার্থ উদ্ভিদের গৌণ খাদ্যোপাদান সরবরাহ, মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারকত্বের তারতম্য অর্থাৎ বাফারিং ক্ষমতা রক্ষা এবং মাটির রাসায়নিক কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। বেশি পরিমাণে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহারজনিত বিষাক্ততা হ্রাস করে। ক্ষতিকারক রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কমায়, মাটির দলা গঠনের মাধ্যমে মাটির ক্ষয় রোধ করে। আদর্শ মাটিতে কমপক্ষে ৫% জৈব পদার্থ থাকা উচিত। ন্যূনতম ২ শতাংশ থাকলে সেটিকে ধরা হয় মোটামুটি মানের। কিন্তু দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এখন গড়ে ২ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে এমনকি কোথাও কোথাও ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। জৈব উপাদানকে মাটির প্রাণ বলে। পুষ্টি উপাদানের আধার/গুদাম ঘর বলা হয়। সুতরাং জমিতে পর্যাপ্ত পরিমানে জৈবসার নিয়মিতভাবে প্রয়োগ করতে হবে। জৈবসার হিসেবে গোবর সার, কম্পোস্ট, খামারজাত সার, খৈল, ট্রাইকো কম্পোস্ট, বোনমিল, ফিসমিল, ভার্মি কম্পোস্ট, হাঁস-মুরগির বিষ্টা, বায়োস্লারী, বায়োচার ইত্যাদি প্রয়োগ করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করতে হবে।
উপযুক্ত শস্য বিন্যাস অনুসরণ : জমিতে প্রতি বছর একই ফসল বা একই ধরনের ফসলের চাষ করলে একটি নির্দিষ্ট স্তরের নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান ক্ষয় হয়ে উর্বরতা বিনষ্ট হয়। তাই পর্যায়ক্রমে গুচ্ছমূল জাতীয় ফসলের পর প্রধান মূলজাতীয় ফসল, একবীজপত্রীর পর দ্বিবীজপত্রীর ফসল এবং অধিক খাদ্য গ্রহণকারীর পর স্বল্পখাদ্য গ্রহণকারী ফসল আবাদ করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। মাটির প্রকৃতি এবং ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে উপযুক্ত শস্যবিন্যাস অনুসরণ করতে হবে।
ডাল জাতীয় ও সবুজসার ফসলের চাষ : বিভিন্ন ধরনের ফসল মাটি থেকে অধিক পরিমাণ নাইট্রোজেন গ্রহণ করে। ফলে মাটিতে দ্রুত এর অভাব দেখা দেয়। জমিতে মাঝে মধ্যে ডালজাতীয় ফসল চাষ করে এ ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ করা যায়। কারণ এগুলোর শিকড়ের গুঁটিতে রাইজোবিয়াম নামক ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে এবং বায়ু থেকে নাইট্রোজেন আহরণ পূর্বক গুটিতে সঞ্চয় করে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। ধৈঞ্চা ও শিমজাতীয় শস্য চাষ করে সবুজ অবস্থায় মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। বছরে অন্তত একবার সবুজ সার তৈরি করা উচিত।
আচ্ছাদন শস্যের চাষ : কিছু কিছু পুষ্টি উপাদান রোদের তাপে নষ্ট হয়। এসব ক্ষেত্রে জমি লতাপাতায় ঢেকে থাকে এমন শস্য (যেমন-শসা, বাংগি, তরমুজ, আলু, মিষ্টিকুমড়া, ক্ষিরা ইত্যাদি) চাষ করলে ঐসব পুষ্টি উপাদন মাটিতে সংরক্ষিত থাকে।
মালচ বা জাবরা প্রয়োগ : কিছু কিছু ফসলে (আলু) জাবরা প্রয়োগ করতে হয়। এতে জাবরা দ্বারা মাটি ঢাকা থাকে ফলে পুষ্টির অপচয় হয় না, আর্দ্রতা সংরক্ষণ করে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং আগাছা দমন করে।
দেশী জাতের শস্যের চাষ : হাইব্রিড বা উচ্চফলনশীল জাতের শস্য মাটি থেকে প্রচুর পুষ্টি উপাদান শোষণ করে মাটিকে অনুর্বর করে। অপর দিকে দেশী জাতের শস্য কম পুষ্টি শোষণ করে।
শস্যের অবশিষ্টাংশ জমিতে রাখা : জমি থেকে শুধু ফসল সংগ্রহ করার পর খড় বা শাখা-প্রশাখা-লতাপাতা জমিতে রাখলে পরবর্তীতে শস্যচাষ করার সময় মাটিতে মিশালে মাটি উর্বর হয়।
শস্য বহুমুখীকরণ : শস্যাবর্তন, আন্তঃফসল চাষ, রিলে ক্রপিং ইত্যাদি অনুসরণ করতে হবে যা মাটির ক্ষয় রোধ করে, বিভিন্ন পুষ্টি যোগায় এবং রোগজীবাণু ও কীটপতঙ্গের চক্র ভাঙতে সাহায্য করে।
জমিকে বিশ্রাম দেয়া : দীর্ঘদিন ধরে একই জমিতে কোনোরূপ বিশ্রাম ছাড়া নিবিড় চাষাবাদ করা হলে মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলির অবনতি ঘটে। তাই কয়েক বছর পর অন্তত এক মৌসুমের জন্য জমি পতিত রেখে বিশ্রাম দেয়া প্রয়োজন। অবশ্য এ সময়ে জমিতে সবুজ সারের চাষ বা নিয়মিত পশুচারণের ব্যবস্থা করলে ভূমির উর্বরতা আরো বৃদ্ধি পায়।
জীবাণু সারের ব্যবহার : ইউরিয়া সারের পরিবর্তে জীবাণু সার ব্যবহার করলে রাইজোবিয়াম ব্যাক্টেরিয়া বাতাস থেকে নাইট্রোজেন শোষণ করে মাটিকে উর্বর করে এবং ট্রাইকোডার্মা সার নাইট্রোজেন যোগ করার পাশাপাশি জীবাণুনাশক হিসেবেও কাজ করে।
মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারকত্ব নিয়ন্ত্রণ : মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারকত্ব অতিরিক্ত বেড়ে গেলে উর্বরতা হ্রাস পায় এবং ঐ অবস্থায় অনেক খাদ্যোপাদান ফসলের গ্রহণ উপযোগী হয় না। তাই অম্লীয় মাটিতে চুন এবং ক্ষারীয় বা লবণাক্ত মাটিতে জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে।
চাষাবাদ পদ্ধতির উন্নয়ন : ত্রুটিপূর্ণ চাষাবাদ পদ্ধতি মাটির উর্বরতা বিনষ্ট করে। কিন্তু উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করে ভূমির উর্বরতা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা সম্ভব। জমি সবসময় একই গভীরতায় কর্ষণ করলে ঐ গভীরতার নিচে একটা শক্ত স্তরের সৃষ্টি হয় এবং ওই স্তরের নিচ থেকে খাদ্যোপাদান আহরণ করা সম্ভব হয় না। তাই ভূমি কর্ষণের গভীরতা ও অন্যান্য আবাদ প্রক্রিয়া মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা উর্বরতা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য সহায়ক।
সুষ্ঠু পানি সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা : সুষ্ঠু সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে জমির উর্বরতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই জমিতে পরিমিত সেচ দেয়া ও অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। পানির অপচয় কমাতে এবং মাটির ক্ষয় কমাতে দক্ষ সেচ পদ্ধতি যেমন: ড্রিপ সেচ বা বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করতে হবে।
ক্ষতিকারক রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন : মাটিতে অনেক সময় ক্ষতিকর রোগ ও কীটের জীবাণু বা ডিম থাকে এবং ফসল উৎপাদনকালে সেগুলো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পর্যায়ক্রমে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে জমি চাষ করলে এবং মাটি রোদে শুকিয়ে নিলে সেগুলো বিনষ্ট হয়ে যায় এবং মাটির উন্নয়ন সাধিত হয়। প্রয়োজনে সঠিক সময়ে সঠিক কৌশলে উপযুক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।
আগাছা দমন : আগাছা মাটি থেকে খাবার গ্রহণপূর্বক ভূমির উর্বরতা খর্ব করে ও শস্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়। তাই জমিতে কখনও আগাছা জন্মাতে না দেয়া ও সর্বদা পরিষ্কার রাখা আবশ্যক।
মৃত্তিকা জীবাণু সংরক্ষণ : মাটিতে অসংখ্য উপকারী জীবাণু থাকে এবং এরা ফসফরাস, লৌহ প্রভৃতি অদ্রবণীয় পদার্থসমূহকে পানিতে দ্রবণীয় অবস্থায় রূপান্তর ও বায়ু থেকে মাটিতে নাইট্রোজেন সংযুক্ত করে ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। তাই মাটিকে এমনভাবে পরিচর্যা করা দরকার যেন মৃত্তিকা জীবাণুসমূহের বসবাসের পরিবেশ সমুন্নত থাকে।
পক মাটি ব্যবহার : সাধারণত বৃষ্টিপাত ও বন্যার পানির সাথে মাটির উপরিভাগের পুষ্টি উপাদান ও জৈব পদার্থ অপসারিত হয়ে পথিমধ্যে পুকুর, ডোবা, নালা প্রভৃতির তলদেশে জমা হয়। এ ভাবে জমাকৃত মাটিকে পক মাটি বলে এবং এটা খুবই উর্বর হয়। শুষ্ক মৌসুমে ঐ মাটি কেটে আবাদি জমিতে মিশিয়ে দিলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
মাটি পরীক্ষা এবং পুষ্টি ব্যবস্থাপনা : অতিরিক্ত সার প্রয়োগ এড়াতে এবং পুষ্টির সুষম মাত্রা নিশ্চিত করতে নিয়মিত মাটি পরীক্ষা করে পুষ্টির মাত্রা, পিএইচ এবং জৈব পদার্থের পরিমাণ জেনে নিতে হবে এবং সুপারিশকৃত মাত্রা প্রয়োগ করতে হবে।
জীববৈচিত্র্য : উপকারী জীবকে সমর্থন এবং বাস্তুতন্ত্রের পরিষেবাগুলো উন্নত করে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল বজায় রাখতে হবে বা তৈরি করতে হবে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক গবেষণাগার, গোপালগঞ্জ। মোবাইল : ০১৯১১৬২১৪১৫, ই-মেইল :hasinasrdi@gmail.com
লিচুর গান্ধী পোকার ক্ষতি ও প্রতিকার
শ্রীমা মন্ডল বর্ষা১ ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ২
লিচু বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ও সুস্বাদু গ্রীষ্মকালীন ফল, যা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলায় বেশি পরিমাণে লিচু উৎপন্ন হয়। তবে বর্তমানে লিচু চাষে অন্যতম প্রধান বাধা হলো লিচুর গান্ধী পোকা। এই পোকাটি বিশেষ করে গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলে লিচু গাছের ওপর আক্রমণ করে থাকে। লিচুর গান্ধী পোকার বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে, এদের মধ্যে ঞবংংধৎধঃড়সধ লধাধহরপধ প্রজাতিটির আক্রমণ বাংলাদেশে দেখা গিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয়, এই প্রজাতিটি আফ্রিকার কিছু অংশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি হেমিপটেরা বর্গের অন্তর্ভুক্ত। লিচু গাছ ছাড়াও কাঠলিচু, ডালিম, পামেলো, মহুয়া, কুসুম, রাম্বুটান, ক্যাস্টর এবং ইউক্যালিপটাস গাছে এই পোকা আক্রমণ করে।
বাদামি বা লালচে বাদামি রঙের এই পোকা লিচুর কুঁড়ি, ফুল এবং ফল আক্রমণ করে এবং রস শোষণ করে। পোকাটি যখন গাছে আক্রমণ করে তখন লিচুর কুঁড়ি ও ফুল শুকিয়ে যায় এবং ফল ঝরে পড়ে। এর ফলে ফলের গুণগত মান ও উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হয়। পোকার প্রভাব বেশি হলে পুরো গাছও শুকিয়ে যেতে পারে। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে এরা বেশি সক্রিয় থাকে, যখন গাছে ফুল ও কচি ফল থাকে। পোকাটি গাছের বিভিন্ন অংশ আক্রমণ করার সময় একটি বিশেষ ধরনের গন্ধ ছড়ায়, যা অন্যান্য পোকা থেকে এটিকে আলাদা করে। লিচুর গান্ধী পোকা নিয়ন্ত্রণে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হলেও, প্রাকৃতিক পদ্ধতি (যেমন প্রাকৃতিক শত্রু পোকা ব্যবহার ও জৈবিক কীটনাশক) পরিবেশের জন্য বেশি উপযোগী। এই পোকার প্রাদুর্ভাব একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি এবং লিচু ফল রক্ষার জন্য কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবনের জন্য জরুরি প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন। নিয়মিত বাগানের পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লিচুর গান্ধী পোকা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
লিচুর গান্ধী পোকার জীবনচক্র
লিচুর গান্ধী পোকার জীবনচক্র মোট তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়। ডিম, নিম্ফ এবং পূর্ণবয়স্ক পোকার পর্যায়।
ডিম : গান্ধী পোকা সাধারণত গাছের পাতা বা ফলের উপরের বা নিচের অংশে গুচ্ছাকারে ডিম পাড়ে। সাধারণত প্রতি গুচ্ছে ৩-৪টি সারিতে ১১-১৪টি ডিম থাকে। ডিমগুলো গোলাকার এবং ফ্যাকাশে গোলাপি বা বাদামি রঙের হয়। সাধারণত ১২-১৪ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
নিম্ফ: নিম্ফ পর্যায়টি পূর্ণাঙ্গ পোকায় রূপান্তরের আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ডিম ফুটে বের হলে, এটি এ পর্যায়ে প্রবেশ করে। নিম্ফের বৃদ্ধি স্বতন্ত্র পাঁচটি ধাপে ঘটে। নিম্ফগুলো ধীরে ধীরে আকারে বৃদ্ধি পায়। এরা সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে খুব ছোট, প্রায় ৩- ৪ মিমি লম্বা। পরবর্তীতে ২০ মিমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। নিম্ফ পূর্ণবয়স্ক পোকাগুলোর মতো নয় এবং তাদের দৈহিক বৈশিষ্ট্যেও পার্থক্য দেখা যায়। নিম্ফদের ডানা থাকে না বা থাকলেও তা অসম্পূর্ণ এবং ছোট আকারের। ডানাগুলো কেবলমাত্র পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় সম্পূর্ণভাবে গড়ে ওঠে। নিম্ফের দেহে দাগ বা চিহ্ন দেখা যায়। নিম্ফ সাধারণত গাছের পাতায় বা ফলের উপর থাকে এবং এই সময়ে এটি গাছের রস শোষণ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে এরা একত্রে থাকে এবং গাছের নির্দিষ্ট অংশে আক্রমণ করে, যা গাছের ক্ষতি বাড়িয়ে তোলে। নিম্ফগুলো পূর্ণবয়স্ক পোকায় রূপান্তরিত হওয়ার আগে একাধিকবার ত্বক পরবর্তন করে। প্রতিটি ত্বক পরিবর্তনের পর তারা ধীরে ধীরে আকারে এবং রঙে পরিবর্তিত হয়। নিম্ফ পর্যায়টি সাধারণত ২ মাস স্থায়ী হয়, যা তাপমাত্রা এবং পরিবেশের উপর নির্ভর করে। এই সময়ের মধ্যে তারা পাঁচটি স্তর অতিক্রম করে, যা তাদের পূর্ণবয়স্ক পোকায় রূপান্তরিত হতে সাহায্য করে।
পূর্ণবয়স্ক পোকা : পূর্ণবয়স্ক লিচুর গান্ধী পোকা সাধারণত ২৪ থেকে ২৮ মিমি লম্বা হয়। এদের দেহ চ্যাপ্টা ও প্রশস্ত, যা দেখতে ঢাল আকৃতির। দেহের ওপরের অংশটি চামড়ার মতো মসৃণ এবং কিছুটা শক্ত। পোকার দেহের রঙ সাধারণত বাদামি এবং কিছু পোকা লালচে বাদামি বা কমলা রঙেরও হতে পারে। পূর্ণবয়স্ক পোকাটির মাথা ছোট এবং এতে একটি শুঁড় থাকে, যা লম্বা ও সূচালো। এই শুঁড়ের সাহায্যে তারা গাছের পাতা, ফুল, এবং ফলের রস শোষণ করে। শুঁড়টি প্রয়োজন অনুসারে ভাঁজ করে রাখা যায় এবং এটি পোকাটির খাদ্য সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। পূর্ণবয়স্ক পোকার ডানা থাকে এবং তারা উড়তে সক্ষম। ডানাগুলো স্বচ্ছ বা হালকা বাদামি রঙের হয় এবং পোকার দেহের প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এরা ডানার সাহায্যে গাছের বিভিন্ন অংশে চলাফেরা করতে এবং খাদ্যের উৎস খুঁজে নিতে পারে। এদের শরীর থেকে এক ধরনের দুর্গন্ধযুক্ত রাসায়নিক নির্গত হয়, যা তাদের আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। পূর্ণবয়স্ক পোকা সাধারণত ৬০-৬৫ দিন বয়সে বাচ্চা দেয় এবং এই সময়ের মধ্যে অনেক লিচুর ক্ষতি করতে পারে।
ক্ষতির ধরন: লিচুর গান্ধী পোকার আক্রমণে লিচু চাষিরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। এই পোকা লিচু গাছের ফুল এবং কুঁড়ির রস শোষণ করে, ফলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। পোকাটি ফলের রস শোষণ করার ফলে লিচুর আকার ছোট হয়ে যায় এবং রঙ পরিবর্তিত হয়। ফল দেখতে অনাকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ও লিচুর স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, যা বাজারমূল্য কমিয়ে দেয়। গাছের কুঁড়ি, ফুল, এবং পাতা আক্রমণ করার ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং সম্পূর্ণ গাছটি শুকিয়ে যেতে পারে। এরা লিচুর রস শোষণ করার সময় একটি বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে, যা গাছের কোষগুলোকে নষ্ট করে দেয়, এর ফলে গাছের বৃদ্ধি বাধা পায়। এরা দিনের বেলায় খুব সক্রিয় থাকে এবং বিশেষ করে সকালে ও বিকালে লিচুর গাছে আক্রমণ করে।
লিচুর গান্ধী পোকা সাধারণত মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে লিচু গাছে আক্রমণ করে। এই সময়ে লিচু গাছে ফুল ফোটে এবং ফল ধরা শুরু হয়, যা পোকার জন্য আদর্শ খাবারের উৎস তৈরি করে। এ কারণে চাষিদের এসময় গাছের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে। এরা গরম ও শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে, তাই তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার পরিবর্তন পোকার আক্রমণের সময় ও তীব্রতার উপর প্রভাব ফেলে। তাপমাত্রা যত বেশি থাকে, ততই পোকাটি সক্রিয় থাকে এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। বাণিজ্যিকভাবে যারা লিচু চাষ করেন, তাদের জন্য গান্ধী পোকার আক্রমণ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যখন পোকার সংখ্যা বেশি হয়, তখন লিচুর উৎপাদন এবং মান কমে যাওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয়।
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: লিচু গাছের নিচের অংশ এবং আশপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখতে হবে। আগাছা এবং পাতা পোকা বাসা বাঁধার জন্য আদর্শ স্থান, তাই এগুলো পরিষ্কার রাখা উচিত। গাছের কুঁড়ি, ফুল এবং পাতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পোকার আক্রমণ শুরু হলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছকে সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত সার ও পানি সরবরাহ করতে হবে। এতে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং পোকার আক্রমণ কম হয়।
যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ : বাগানে নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং গাছের পাতা বা ফুলের উপর থাকা পোকাগুলো সংগ্রহ করে ধ্বংস করা একটি সহজ পদ্ধতি। সকাল বা বিকাল বেলা এই কাজ করা সবচেয়ে কার্যকর।
জৈবিক নিয়ন্ত্রণ: গান্ধী পোকার প্রাকৃতিক শক্র যেমন পাখি, ব্যাঙ, লাল পিঁপড়া এবং কিছু বিশেষ ধরনের পোকা বাগানে আনায়ন করা যেতে পারে। এরা গান্ধী পোকার ডিম ও লার্ভা খেয়ে ফেলে, যা পোকার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এছাড়া কিছু জৈবিক কীটনাশক যেমন নিম তেল ব্যবহার করে গান্ধী পোকার আক্রমণ কমানো যায়। এগুলো ব্যবহার করলে গাছের উপর খারাপ প্রভাব পড়ে না এবং ফলের গুণমান অক্ষুণœ থাকে।
রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ : যখন গান্ধী পোকার আক্রমণ অনেক বেশি হয়ে যায় এবং জৈবিক বা প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি কার্যকর হয় না, তখন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে, রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের সময় সঠিক ডোজ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। কিছু সাধারণ রাসায়নিক কীটনাশক রয়েছে যা গান্ধী পোকা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। ক্লোরপাইরিফোস এবং সাইপারমেথ্রিনের মিশ্রণ(১০:১) লিচুর গান্ধী পোকার নিম্ফ এবং পূর্ণাঙ্গ পোকার নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী এবং অত্যন্ত কার্যকর কীটনাশক।
এটি গাছের রসে প্রবেশ করে এবং পোকা মেরে ফেলে। তবে এটি ব্যবহারের সময় সাবধান থাকতে হবে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে পরিবেশের ক্ষতি না হয় ও অন্য উপকারী পোকামাকড়ের ক্ষতি না হয়।
তবে, যে কোন কীটনাশক প্রয়োগের আগে ও প্রয়োগের সময়ে লেবেলে উল্লেখিত সতর্কতা অবলম্বেন করতে হবে। এ ছাড়া প্রি-হারভেস্ট ইন্টারভ্যাল মেনে চলতে হবে।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা : এ পদ্ধতিতে পরিচ্ছন্ন বাগান, জৈবিক ও রাসায়নিক কীটনাশকের সমন্বয় করে পোকা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা এবং প্রাকৃতিক শক্র পোকা ব্যবহারের মাধ্যমে লিচুর গান্ধী পোকা নিয়ন্ত্রণে অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যাতে লিচু চাষিরা দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হতে পারে এবং দেশের লিচু উৎপাদন সুরক্ষিত থাকে।
লেখক: ১শিক্ষার্থী (এমএস), ২অধ্যাপক, ল্যাবরেটরি অব অ্যাপ্লাইড এন্টোমলজি এন্ড একারোলজি, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২। মোবাইল: ০১৭১১৪৫২৪৯৬। ই-মেইল :ullahipm@bau.edu.bd
পাটের ফলন বৃদ্ধি ও পরিবেশ ভারসাম্য
রক্ষায় ন্যানো সারের ব্যবহার
ড. মো. আবু সায়েম জিকু
বাংলাদেশে পাট ফসল আবাদ করার জন্য বপনের সময়, জমি নির্বাচন, জলবায়ু, সঠিক আন্তঃপরিচর্যা এবং পরিমাণ মতো সার প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। অন্যথায় পাট ফসলের কাক্সিক্ষত ফলন সম্ভব নয়। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন, চরম আবহাওয়া, শিল্পায়ন, সেইসাথে ক্রমবর্ধমান মানব জনসংখ্যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি স্থায়িত্বের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহার অর্থনৈতিক বোঝা, মাটি, পানি এবং বায়ুম-লীয় দূষণ বৃদ্ধি করে। ন্যানো-সারগুলো মাটির উর্বরতা, শস্য উৎপাদন এবং ন্যূনতম বা কোন পরিবেশগত লেনদেন ছাড়াই তাদের টেকসই ব্যবহারের জন্য দুর্দান্ত সম্ভাবনা রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে, ন্যানো-সারগুলো সরবরাহযোগ্য ‘পুষ্টির স্মার্ট সিস্টেম’ হিসেবে বিবেচিত হয়।
কৃষি-ইকোসিস্টেমের সমস্যাগুলো বিদ্যমান উন্নয়নের চেয়ে বিস্তৃত। উদাহরণস্বরূপ মাটি, আর্দ্রতা এবং অন্যান্য কৃষি-বাস্তÍসংস্থানিক অবস্থার বিভিন্ন ভৌত রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যে পুষ্টি সরবরাহ করা এখনও বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ।
ন্যানো সার হলো অত্যাধুনিক কৃষি প্রযুক্তির একটি উদ্ভাবন, যা মূলত প্রচলিত সারের চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র কণার আকারে তৈরি করা হয় এবং সারের কণাগুলো সাধারণত ১০০ ন্যানোমিটারের (১ ন্যানোমিটার = ১ঢ১০-৯ মিটার) চেয়ে ছোট হয়। এটি উদ্ভিদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে পুষ্টি সরবরাহ করে, ফলে ফলন ও গুণগত মান উন্নত হয়। তথ্য মতে, ১৯৯০-এর দশকে, ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উন্নয়ন বৃদ্ধি পায় এবং ২০০০-এর দশকের শুরুতে, কৃষি বিজ্ঞানীরা ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভিদের পুষ্টি শোষণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে কৃষি গবেষণায় এর ব্যবহার শুরু করেন। এই ন্যানো সার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমন-
ন্যানো-ফসফেট : উদ্ভিদের ফসফরাসের চাহিদা পূরণ করে।
ন্যানো-জিঙ্ক : উদ্ভিদের জিঙ্কের চাহিদা পূরণ করে, যা পাতা ও শিকড়ের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ন্যানো-আয়রন : উদ্ভিদের আয়রনের চাহিদা পূরণ করে, যা ক্লোরোফিল উৎপাদনে সহায়তা করে।
ন্যানো-নাইট্রোজেন : উদ্ভিদের নাইট্রোজেনের চাহিদা পূরণ করে, যা প্রোটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিডের উৎপাদনে সহায়তা করে।
পাটের জমিতে ন্যানো সার প্রয়োগের সঠিক পদ্ধতি উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও ফলন বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যানো সারের ব্যবহার এবং প্রয়োগ পদ্ধতি সাধারণ সারের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।
পাটের জমিতে ন্যানো ফারটিলাইজার প্রয়োগের কিছু সাধারণ নির্দেশনা
এটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে জমি ভালোভাবে চাষ দিতে হবে এবং মাটি সমানভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। মাটির পিএইচ, পুষ্টি স্তর এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নেয়া ভালো। সারের উপাদান এবং মাত্রা সম্পর্কে জেনে নিয়ে ফসলের প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত ন্যানো সার নির্বাচন করতে হবে (যেমন : ন্যানো-ফসফেট, ন্যানো-জিঙ্ক, ন্যানো-আয়রন, ন্যানো-নাইট্রোজেন)। নির্দিষ্ট মাত্রায় ন্যানো সার পানিতে মিশ্রিত করে স্প্রে বা ড্রিপ সিস্টেমের মাধ্যমে প্রয়োগ করা যায়। সাধারণত প্রতি লিটার পানিতে ১-১০ গ্রাম ন্যানো সার মিশ্রিত করা হয়। ন্যানো সারের দ্রবণ স্প্রে মেশিনের সাহায্যে পাটের গাছে সকালে বা সন্ধ্যায় স্প্রে করতে হবে। কারণ এই সময় তাপমাত্রা কম থাকে এবং বাষ্পীভবন কম হয়। এ ছাড়াও ড্রিপ ইরিগেশন সিস্টেমের মাধ্যমে ন্যানো সারের দ্রবণ সরাসরি মাটিতে প্রয়োগ করা যায়। কারণ ড্রিপ সিস্টেম মাটির গভীরে পুষ্টি সরবরাহ করে এবং পুষ্টি অপচয় কমায়। তবে পাট গাছের বৃদ্ধি এবং বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে ন্যানো সার প্রয়োগ করা ভালো তবে বীজ রোপণের আগে, গাছের চারা অবস্থায় এবং গাছ পূর্ণবয়স্ক হলে বিভিন্ন সময়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
পাটের ফলন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ন্যানো সার
ন্যানো সার পাটের উৎপাদনশীলতা ও গুণগত মান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি পাট চাষের বিভিন্ন ধাপে প্রয়োগ করে ফলন বৃদ্ধি এবং ফসলের মান উন্নত করতে সহায়তা করে। নি¤েœ ন্যানো সারের ভূমিকা বিশদভাবে আলোচনা করা হলো-
পুষ্টি সরবরাহের কার্যকারিতা বৃদ্ধি : ন্যানো সারের কণাগুলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র হওয়ায় উদ্ভিদ সহজেই এটি শোষণ করতে পারে। ফলে উদ্ভিদ পুষ্টি দ্রুত ও কার্যকরভাবে গ্রহণ করে, যা পাটের বৃদ্ধি এবং ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। ন্যানো সার ধীরে ধীরে মাটিতে পুষ্টি সরবরাহ করে, যা দীর্ঘ সময় ধরে উদ্ভিদকে পুষ্টির জোগান দেয়। এটি পাটের সুষম বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
মাটির পুষ্টি ধরে রাখা এবং উন্নতি : ন্যানো সার মাটির পুষ্টি ধরে রাখে এবং মাটির উর্বরতা বাড়ায়, যা পাটের শিকড়ের উন্নতিতে সহায়ক হয়। এ ছাড়াও ন্যানো সার মাটির পিএইচ সমন্বয় করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি : ন্যানো সার উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ন্যানো সার উদ্ভিদের শিকড়ের শক্তি বৃদ্ধি করে, পাটের স্থায়িত্ব ও স্থায়িত্বশীলতা বাড়ায় ফলে উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি।
পরিবেশ সংরক্ষণ : ন্যানো সার পরিবেশবান্ধব হওয়ায় মাটিতে কম পরিমাণে জমা হয় এবং কম দূষণ সৃষ্টি করে। এটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল উৎপাদনশীলতা ও পরিবেশ সংরক্ষণ করে। পাশাপাশি মাটির জীবাণু এবং মাইক্রোবায়াল কার্যকলাপ বাড়ায়।
অর্থনৈতিক সুবিধা : ন্যানো সার প্রচলিত সারের তুলনায় কম পরিমাণে ব্যবহার করতে হয়। ফলে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে।
ন্যানো সারের ব্যবহারে পাটের ফলন বৃদ্ধি নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা এবং পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া গেছে, উল্লেখযোগ্য কিছু গবেষণা ফলাফল দেওয়া হলো :
ভারতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থা (ওঈঅজ) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ন্যানো সার প্রয়োগ করলে পাটের উৎপাদনশীলতা ২০-২৫% বৃদ্ধি পেতে পারে। এই গবেষণায় ন্যানো-জিঙ্ক এবং ন্যানো-নাইট্রোজেনের ব্যবহার উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা পাটের পুষ্টি শোষণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইঅট) পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ন্যানো সার ব্যবহারে পাটের ফলন ও গুণগত মান উন্নত হয়েছে। পাটের জমিতে ন্যানো সার প্রয়োগ করে ১৫-২০% বেশি ফলন পাওয়া গেছে এবং গাছের উচ্চতা ও তন্তুর মান উন্নত হয়েছে।
পরিশেষে ন্যানো-সার ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির ক্ষয়রোধ ও রাসায়নিক ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। সেই সাথে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার (পানি, সার ও অন্যান্য), টেকসই কৃষি অনুশীলনে দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনশীলতা এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্য উন্নত হবে। মূলত কেমিক্যাল সারের ব্যবহারকে প্রশমিত করে ন্যানো সারের ব্যবহারকে উদ্বুদ্ধ করবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা বিজ্ঞান শাখা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৭১৭৫৬২৬৭৩, ই-মেইল :jikuly@gmail.com or sayem@bjri.gov.bd
পুষ্টিমানে ভরপুর লাভজনক ফসল চিচিঙ্গা
কৃষিবিদ মনিরুল হক রোমেল
চিচিঙ্গা বাংলাদেশের সকলের নিকট প্রিয় অন্যতম প্রধান গ্রীষ্মকালীন সবজি। এর অনেক ঔষধী গুণ আছে। এটা মূলত কুমড়াগোত্রীয় সবজি। চিচিংগা তরকারি, ভাজি ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় রান্না করে খাওয়া হয়। চিচিংগার ১০০ ভাগ ভক্ষণযোগ্য অংশে ৯৫ ভাগ পানি, ৩.২-৩.৭ গ্রাম শর্করা, ০.৪-০.৭ গ্রাম আমিষ, ৩৫-৪০ মিগ্রা. ক্যালসিয়াম, ০.৫-০.৭ মিগ্রা. লৌহ এবং ৫-৮ মিগ্রা. খাদ্যপ্রাণ সি আছে।
আমাদের অপরিপক্ব দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বেশকিছু উপকারী সবজি একদমই পাত্তা পায় না। আর এমনই এক সবজি হল চিচিঙ্গা। তবে এই সবজিটির গুণাগুণ বলে শেষ করা যায় না। পুষ্টিবিদদের কথায়, চিচিঙ্গাতে রয়েছে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি৬, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজসহ একাধিক জরুরি খনিজ এবং ভিটামিন। তাই নিয়মিত এই সবজি খেলে যে বহু রোগব্যধি দূরে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।
চিচিঙ্গা হলো একটি লো ক্যালোরি সবজি র্অথাৎ এই সবজি পেট ভরে খেলেও ওজন বাড়ার আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে। এছাড়া চিচিঙ্গাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটরি ফাইবার। আর এই উপাদান কিন্তু ওজন নিয়ন্ত্রণের কাজে সিদ্ধহস্ত। আসলে এই ফাইবার অন্ত্রে দীর্ঘক্ষণ উপস্থিত থাকে ফলে সহজে ক্ষুধা পায় না। আর ক্ষুধা না পেলে স্বভাবতই কম খাওয়া হয়। আর তাতেই ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। দেশজুড়ে ক্রমেই বাড়ছে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা। এক্ষেত্রে ফাইবার, সবজি যত বেশি খাওয়া যাবে ততই কিন্তু উপকার পাওয়া যাবে। চিচিঙ্গার তরকারি রোজ মেনুতে রাখা গেলে এতে ওজনও কমবে আর ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে থাকবে ।
চিচিঙ্গা উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি
জলবায়ু ও মাটি এদেশে চিচিঙ্গা প্রধানত খরিফ মৌসুমেই চাষ হয়ে থাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে যে কোন সময় চিচিঙ্গার বীজ বোনা যেতে পারে।
উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় চিচিঙ্গা ভাল জন্মে। শীতের দুই তিন মাস বাদ দিলে বাংলাদেশে বছরের যেকোন সময় চিচিঙ্গা জন্মানো যায়। সব রকম মাটিতে চিচিঙ্গার চাষ করা যায় তবে জৈবসার সমৃদ্ধ দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটিতে ভালো জন্মে। বারি চিচিঙ্গা-১, ঝুম লং, সাদা সাভারী, তিস্তা, তুরাগ, সুরমা, রূপসা, সুপ্রিম, ধবল, আশা, মধুমতি, ট্রনিক, পদ্ম, চিত্রা, ঢাকা গ্রীন, ইনানী ইত্যাদি জাতসমূহের চাষাবাদ করা হয়। মোট জীবনকাল প্রায় পাঁচ মাস। তবে জাত ও আবহাওয়া ভেদে সময় কমবেশি হতে পারে। চিচিঙ্গার জন্য হেক্টরপ্রতি ৪-৫ কেজি (১৬-২০ গ্রাম/শতাংশ) বীজের প্রয়োজন হয়।
জমি তৈরি ও বপন পদ্ধতি
খরিফ মৌসুমে চাষ হয় বলে চিচিঙ্গার জন্য এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে যেখানে পানি জমার সম্ভাবনা নেই। বসতবাড়িতে চাষ করতে হলে দু-চারটি মাদায় বীজ বুনে গাছ বেয়ে উঠতে পারে এমন ব্যবস্থা করলেই হয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য প্রথমে সম্পূর্ণ জমি ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে প্রস্তুত করে নিতে হয় যাতে শিকড় সহজেই ছড়াতে পারে। জমি বড় হলে নির্দিষ্ট দূরত্বে নালা কেটে লম্বায় কয়েক ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। বেডের প্রস্থ হবে ১.০মিটার এবং দু-বেডের মাঝে ৩০ সেমি নালা থাকবে। চিচিঙ্গার বীজ সরাসরি মাদায় বোনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি মাদায় কমপক্ষে ২টি বীজ বপন করতে হবে। তাছাড়া পলিব্যাগে (১০ী ১২ সেমি.) ১৫-২০ দিন বয়সের চারা উৎপাদন করে নেওয়া যেতে পারে। চিচিঙ্গার জন্য ১.৫ মিটার দূরত্বে মাদা তৈরি করতে হবে। চারা গজানোর পর একের অধিক গাছ তুলে ফেলে দিতে হবে। বীজের ত্বক শক্ত ও পুরু বিধায় বোনার পূর্বে বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে নিলে বীজ তাড়াতাড়ি অঙ্কুরিত হয়। মাদায় বীজ বুনতে বা চারা রোপণ করতে হলে অন্তত ১০ দিন আগে মাদায় নির্ধারিত সার প্রয়োগ করে তৈরি করে নিতে হবে। মাদার আয়তন হবে ৪০ী৪০ী৪০ সেমি.।
মাদায় চারা রোপণের পূর্বে সার দেয়ার পর পানি দিয়ে মাদার মাটি ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। অতঃপর মাটিতে ‘জো’ এলে ৭-১০ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
আগাছা সবসময় পরিষ্কার করে সাথে সাথে মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। খরা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। জুন-জুলাই মাস থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আর সেচের প্রয়োজন হয় না। পানির অভাব হলে গাছের বৃদ্ধির বিভিন্ন অবস্থায় এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন প্রাথমিক অবস্থায় চারার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া, পরবর্তীকালে ফুল ঝরে যাওয়া, ফলের বৃদ্ধি বন্ধ হওয়া ও ঝরে যাওয়া ইত্যাদি। চিচিংগার বীজ উৎপাদনের সময় খেয়াল রাখতে হবে ফল পরিপক্ব হওয়া শুরু হলে সেচ দেয়া বন্ধ করে দিতে হবে।
বাউনি
বাউনি দেয়া চিচিংগার প্রধান পরিচর্যা। চারা ২০-২৫ সেমি উঁচু হতেই ১.০-১.৫ মিটার উঁচু মাচা তৈরি করতে হবে। বাউনি দিলে ফলন বেশি ও ফলের গুণগত মানও ভালো হয়। গাছের গোড়া থেকে ডালপালা বের হলে সেগুলো কেটে দিতে হয় এতে গোড়া পরিষ্কার থাকে, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উৎপাত কম হয়। জুন-জুলাই মাস থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আর সেচের প্রয়োজন হয় না। জমির পানি নিকাশ নিশ্চিত করার জন্য বেড ও নিকাশ নালা সর্বদা পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
চারা গজানোর ৬০-৭০ দিন পর চিচিঙ্গার গাছ ফল দিতে থাকে। স্ত্রীফুলের পরাগায়নের ১০-১৩ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। ফল আহরণ একবার শুরু হলে তা দুই আড়াই মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে চিচিঙ্গার হেক্টর প্রতি ফলন ২৫-৩০ টন (১০০-১২০ কেজি/শতাংশ) অর্থাৎ বিঘায় ফলন ৩.৩-৩.৫ টন/হে. হয়ে থাকে।
বীজ উৎপাদনে করণীয়
কৃত্রিম পরাগায়ন
বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আশপাশে অন্য জাতের চিচিংগার গাছ থাকলে নির্বাচিত গাছের পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটার আগে (সকাল ৯ঃ০০ ঘটিকা থেকে দুপুর ২ঃ০০ ঘটিকার মধ্যে) পেপার ব্যাগ দ্বারা বেঁধে নিতে হবে। অতঃপর ফুল ফোটার পর কৃত্রিম পরাগায়ণ করতে হবে এবং পরাগায়ণ শেষে স্ত্রী ফুলটি আবার ব্যাগিং করে রাখতে হবে। ৩-৪ দিন পর ব্যাগ খুলে ফেলা যাবে। কৃত্রিম পরাগায়ণ অবশ্যই সকাল ৬টা থেকে ৯টার মধ্যেই সমাপ্ত করতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগবালাই
ফলের মাছি পোকা : স্ত্রী মাছি কচি ফলে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়াগুলো ফলের শাঁস খায়, ফল পচে যায় এবং অকালে ঝরে পড়ে।
প্রতিকার : পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ এবং আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদের যৌথ ব্যবহার করে পোকা ভালোভাবে দমন করা যায়। বিষটোপের জন্য থেতলানো ১০০ গ্রাম পাকা মিষ্টি কুমড়ার সাথে ০.২৫ গ্রাম সেভিন ৮৫ পাউডার মিশিয়ে ব্যবহার করতে হয়। বিষটোপ ৩-৪ দিন পরপর পরিবর্তন করতে হয়।
পাম্পকিন বিটল : পূর্ণাঙ্গ পোকা চারা গাছের পাতায় ছিদ্র করে খায়। কীড়া গাছের গোড়ায় মাটিতে বাস করে এবং গাছের শিকড়ের ক্ষতি করে, বড় গাছ মেরে ফেলতে পারে।
প্রতিকার : আক্রান্ত গাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ পোকা হাতে ধরে মেরে ফেলা। চারা অবস্থায় ২০-২৫ দিন চারা মশারির জাল দিয়ে ঢেকে রাখা। প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম সেভিন/কার্বারিল-৮৫ ডব্লিউপি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। কীড়া
দমনের জন্য প্রতি গাছের গোড়ায় ২-৫ গ্রাম বাসুডিন/ডায়াজিনন-১০ জি/ডায়াজন ১০ জি/রাজদান ১০ জি/ডাইজল ১০ জি আর মিশিয়ে সেচ দিতে হবে।
এপিল্যাকনা বিটল : পাতায় সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে এবং আক্রান্ত পাতাগুলো বিবর্ণের মতো দেখায়, পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে এবং গাছ পাতাশূন্য হতে পারে।
প্রতিকার : প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম কার্বারিল-৮৫/সেভিন ডব্লিউপি অথবা ২ মিলি সুমিথিয়ন/ফাইফানন-৫৭ ইসি/সাইফানন ৫৭ ইসি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
জাব পোকা : জাব পোকা দলবদ্ধভাবে পাতার রস চুষে খায়। ফলে বাড়ন্ত ডগা ও পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে, পাতা বিকৃত হয়ে বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং পাতা নিচের দিকে কুঁকড়িয়ে যায়।
প্রতিকার : আক্রান্ত পাতা ও ডগার জাব পোকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে। নিমবীজের দ্রবণ (কেজি পরিমাণ অর্ধভাঙা নিমবীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে) বা সাবান গুলা পানি (প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২ চা চামচ গুঁড়া সাবান মেশাতে হবে) স্প্রে করেও এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়। লেডিবার্ড বিটলের পূর্ণাঙ্গ পোকা ও কীড়া এবং সিরফিড ফ্লাই-এর কীড়া জাবপোকা খেয়ে প্রাকৃতিকভাবে দমন করে। সুতরাং উপরোক্ত বন্ধু পোকাসমূহ সংরক্ষণ করলে এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কম হয়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ফাইফানন-৫৭ ইসি/সাইফানন ৫৭ ইসি/ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি/আসাটন ৫৭ ইসি/টাফগর ৪০ ইসি/ স্টার্টার ৪০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
জৈব কীটনাশক হিসেবে ইকোম্যাক ১.৮ ইসি ১ মিলি. প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। এ ছাড়া হলুদ আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করলে জাব পোকা সহজে দমন করা যায়।
রোগবালাই
পাউডারি মিলডিউ বা গাদা গুঁড়া রোগ : পাতার উভয় পাশে প্রথমে সাদা সাদা পাউডার বা গুঁড়া দেখা যায়। ধীরে ধীরে এ দাগগুলো বড় হয়। ফলে গাছ বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া দাগগুলো বাদামি হয়ে শুকিয়ে যায়। কোন একটি লতার পাতায় আক্রমণ বেশি হলে ধীরে ধীরে সেই লতা ও পরে পুরো গাছই মরে যেতে পারে। এমনকি ফল ঝরে যেতে পারে। যদি আগাম চাষ করা হয় তবে এ রোগের লক্ষণ বেশি দেখা যায়।
প্রতিকার : এ রোগের প্রতিকারের জন্য আক্রান্ত পাতা ও গাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তাছাড়া ২ গ্রাম থিয়োভিট ৮০ ডব্লিউপি অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি অথবা সালফোলাক্স/কুমুলাস ০.৫ মিলি অথবা ১ গ্রাম ক্যালিক্সিন প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। জৈব ছত্রাকনাশক হিসেবে লাইকোম্যাক্স বা ডাইনামিক ব্যবহার করা যেতে পারে।
অ্যানথ্রাকনোজ বা ফলপচা : পাতায় গোলাকৃতি দাগ দেখা যায়। বৃষ্টিতে পাতার পচন লক্ষ করা যায়। প্রথমে ছোট কালো দাগ যার মধ্যাংশ ছত্রাকের জালি ও অণুজীব দ্বারা ঢাকা থাকে। আক্রান্ত ফলের বীজও ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কমে যায়।
প্রতিকার : রোগমুক্ত ভাল বীজ ব্যবহার করতে হবে। ঝরণা দিয়ে গাছে পানি বা সেচ দেওয়া যাবে না। অনুমোদিত ছত্রাকনাশক অটোস্টিন/নোইন বা একোনাজল আক্রমণের শুরুতেই ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০দিন অন্তর স্প্রে করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। চিচিঙ্গার বীজ-ফলে অব্যশই ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে বীজ রোগমুক্ত রাখতে হবে। জৈব ছত্রাকনাশক হিসেবে ডাইনামিক ব্যবহার করা যেতে পারে।
মোজাইক ভাইরাস : পাতায় হলদে ছোপ ছোপ দেখা দেয় ও পাতা কুঁকড়ে যায়। ফলে ফলন বহুলাংশে কমে যায়।
প্রতিকার : ভাইরাস দেখা মাত্র আক্রান্ত গাছ ধ্বংস করে ফেলতে হবে। ভাইরাসের বাহক সাদা মাছি দমন করার জন্য হলুদ আঁঠালো ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে।
লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, কুমিল্লা, মোবাইল : ০১৬৮১৬৮৩৩৪২, ই-মেইল :monirulromel@gmail.com
জারা লেবুর উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা
ডিপ্লোমা কৃষিবিদ মো: জুলফিকার আলী
জারা লেবু অত্যন্ত জনপ্রিয় ও রপ্তানিযোগ্য ফসল। সাধারণ লেবুর চেয়ে জারা লেবু একটু ব্যতিক্রমই বটে। জারা লেবুর রস নয় মূলত বাকল খাওয়া হয়। খাবার টেবিলে জারা লেবুর সালাদের বেশ কদর রয়েছে। লেবুটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর আকার সাধারণ লেবুর চেয়ে বেশ বড়, এক একটি লেবুর ওজন প্রায় দুই থেকে চার কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর চামড়া বেশ পুরু তবে রসের পরিমাণ খুবই কম। লেবুটির চামড়ার একটি বিশেষ মিষ্টি গন্ধ রয়েছে, যার কারণে ভোক্তাদের কাছে প্রিয়। এর খোসা দিয়ে আচারও তৈরি করা হয়। এ লেবুটি বিদেশে রপ্তানি হয়। প্রবাসী বাংলাদেশীরা এ লেবুর প্রধান ভোক্তা। বর্তমানে সিলেট অঞ্চলসহ বাংলাদেশের সব এলাকায় এ লেবুর ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জারা লেবুর বাজারমূল্য বেশ চড়া, একেকটি লেবুর দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। সিলেট অঞ্চল বিশেষ করে সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর উপজেলায় জারা লেবুর চাষ করা হচ্ছে।
জলবায়ু ও মাটি : আর্দ্র ও উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে জারা লেবু ভালো জন্মে। প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এমন পাহাড়ি অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনযুক্ত অম্লীয় মাটি চাষের জন্য বেশি উপযোগী। উৎপাদনের জন্য বছরে ১৫০০-২০০০ মিলি লিটার বৃষ্টিপাত এবং ২৫-৩০ সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা প্রয়োজন। মাটির অম্লত্ব ক্ষারত্ব মান ৫-৬ হলে ভালো হয়।
বংশবিস্তার : বীজ (চারা) ও অঙ্গজ (কলম) দুইভাবে বংশবিস্তার করা যায়। খুব ভালো মাতৃগুণ সম্পন্ন চারা পেতে কলমের চারা উত্তম। সাধারণত গুটি কলম দিয়ে বংশবিস্তার করা হয়। অঙ্গজ উপায়ে উৎপাদিত গাছে মাতৃগাছের গুণাগুণ বজায় থাকে। অঙ্গজ উপায়ে উৎপন্ন চারায় ২ থেকে ৩ বছরেই ফল ধরতে শুরু করে। তাই চারার চেয়ে গুণগত কলম লাগানো উত্তম।
মাদা তৈরি : চারা বা কলম রোপণ করার ১৫-২০ দিন আগে ২.৫ মিটার থেকে ৩.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, ৬০ সেন্টিমিটার প্রস্থ এবং ৬০ সেন্টিমিটার গভীরতা বিশিষ্ট গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের ওপরের মাটির সাথে ২০ কেজি জৈবসার, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে। প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১৫০০টি চারা রোপণ করা যায়।
রোপণ পদ্ধতি : লেবুর চারা বা কলম সারি বা বর্গাকার পদ্ধতিতে লাগানো উচিত। এর ফলে বাগানের আন্তঃপরিচর্যা ও ফল সংগ্রহ করা সহজ হয়। তা ছাড়া পাহাড়ি ঢালু জমিতে আড়াআড়ি লাইনে বা সারি করে কলম বা চারা রোপণ করা ভালো। এতে করে পাহাড়ের মাটি ক্ষয় কম হয়।
রোপণ সময় : বর্ষাকাল চারা বা কলম লাগানোর উৎকৃষ্ট সময়। এক্ষেত্রে মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চারা লাগানো যেতে পারে। তবে যদি সেচ সুবিধা থাকে তাহলে সারা বছরই চারা লাগানো যায়।
চারা/কলম রোপণ ও পরিচর্যা : মাদা তৈরি করার ১৫-২০ দিন পর চারা বা কলম লাগাতে হয়। চারা বা কলম গর্তের ঠিক মাঝখানে খাঁড়াভাবে লাগাতে হবে এবং চারা বা কলমের চারদিকের মাটি হাত দিয়ে চেপে ভালোভাবে বসিয়ে দিতে হবে। চারার গোড়ায় ঝাঁঝরি দিয়ে পানি দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি চারায় পৃথকভাবে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
গাছে সার প্রয়োগ : চারা লাগানোর পর ভালো ফলন পেতে হলে নিয়মিতভাবে সময়মতো সার প্রয়োগ করতে হবে। নি¤েœ বয়স অনুপাতে গাছ প্রতি সারের পরিমাণ সারণি দ্রষ্টব্য।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : ছকে বর্ণিত সার তিন কিস্তিতে গাছের গোড়া হতে কিছু দূরে ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে মাটি সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালে ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বর্ষার প্রারম্ভে অর্থাৎ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং দ্বিতীয় কিস্তি মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাসে এবং তৃতীয় কিস্তি মাঘ-ফাল্গুন মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
অঙ্গ ছাঁটাই : গাছের গোড়ার দিকে জল শোধক শাখা বের হলেই কেটে ফেলতে হবে। এছাড়া গাছের ভেতরের দিকে দুর্বল ডালপালা মধ্য কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে ছাঁটাই করে দিতে হবে। ডালপালা ছাঁটাই করার পর কর্তিত স্থানে বোর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে যাতে ছত্রাক আক্রমণ করতে না পারে। ডালপালা ছাঁটাই করলে গাছ আলো বাতাস ঠিকমতো পাবে। তাতে গাছে ফলন বৃদ্ধি পায়।
পানি সেচ ও নিষ্কাশন : খরা মৌসুমে ২-৩ বার সেচ প্রয়োগ করা দরকার। লেবু জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না তাই বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেজন্য নালা করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
জারা লেবুর পোকামাকড় ও রোগ ব্যবস্থাপনা : সিলেট অঞ্চলে লেবু ফসলে প্রায় ১৬ প্রজাতির পোকামাকড় আক্রমণ করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লেবুর প্রজাপতি পোকা, লিফ মাইনার, সাইলিড বাগ, থ্রিপস, ছাতরা পোকা, কা- ছিদ্রকারী পোকা। এসব পোকামাকড় লেবু ফসলের ক্ষতি করে।
লেবুর প্রজাপতি পোকা : লেবুর প্রজাপতি পোকার কীড়া পাতার কিনারা থেকে খাওয়া শুরু করে। এ পোকা মূলত নার্সারিতে ও ছোট গাছে আক্রমণ করে। সাধারণত ফেব্রুয়ারি, জুলাই ও আগস্ট মাসে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। প্রতিকার হিসেবে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে। সম্ভব হলে ডিম ও কীড়াসহ পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আলোক ফাঁদ দ্বারা পূর্ণাঙ্গ পোকা ধরে মেরে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে কচি পাতায় স্পর্শ ও পাকস্থলী বিষ (সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি, ফেনিট্রোথিয়ন ৫০ ইসি) অথবা অন্তর্বাহী বা প্রবাহমান বিষ (ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি, কার্বোসালফান ২০ ইসি) জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি/লিটার পানি বা ১ গ্রাম/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ৩-৪ বার গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
লেবু পাতার ছোট সুড়ঙ্গকারী পোকা : লিফ মাইনার বা সুড়ঙ্গকারী পোকার কীড়াগুলো পাতার উপত্বকের ঠিক নিচের সবুজ অংশ খেয়ে আঁকা-বাঁকা সুড়ঙ্গের মতো সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে গাছের পাতার কিনারার দিক মুড়ে পুত্তলিতে পরিণত হয়। আক্রমণের মাত্রা তীব্র হলে গাছের পাতা কুঁকড়ে যায় ও বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে ঝরে পড়ে। আগস্ট ও অক্টোবর মাসে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। প্রতিকার হিসেবে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে। সম্ভব হলে ডিম ও কীড়াসহ পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গ্রীষ্ম ও শরৎকালে নতুন পাতা গজানোর সময় কচি পাতায় স্পর্শ ও পাকস্থলী বিষ (সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি, ফেনিট্রোথিয়ন ৫০ ইসি) অথবা অন্তর্বাহী বা প্রবাহমান বিষ (ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি, কার্বোসালফান ২০ ইসি) জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি/লিটার পানি বা ১ গ্রাম/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ৩-৪ বার গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
লেবুর থ্রিপস পোকা : লেবুর থ্রিপস পোকা লেবুর কচিপাতা ও কচি ফলের রস চুষে খায়। আক্রান্ত পাতা ওপরের দিকে বেঁকে নৌকার মতো আকৃতি ধারণ করে এবং পাতা খসখসে ও পুরু হয়ে যায়। আক্রান্ত ফল বড় হওয়ার সাথে সাথে ধূসর বা রূপালি বর্নের দাগ পড়ে এবং খসখসে হয়ে যায়। প্রতিকার হিসেবে সাদা আাঠালো ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে কচি পাতায় স্পর্শ ও পাকস্থলী বিষ (সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি, ফেনিট্রেথিয়ন ৫০ ইসি) অথবা অন্তর্বাহী বা প্রবাহমান বিষ (ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি, কার্বোসালফান ২০ ইসি) জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি/লিটার পানি বা ১ গ্রাম/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ৩-৪ বার গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া আক্রান্ত গাছে ফিপ্রোনিল ১ মিলি হারে মিশিয়ে অথবা ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে।
লাল পিঁপড়া : লাল পিঁপড়া কয়েকটি পাতা একত্র করে বাসা তৈরি করে। এতে গাছের পাতা নষ্ট হয়ে যায় এবং সালোক সংশ্লেষণ ব্যাহত হয়। এসব বাসায় মিলিবাগ আক্রমণ করে, ফলে গাছে শুটিমোল্ড রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। গাছ থেকে পিঁপড়ার বাসা অপসারণ করতে হবে। প্রয়োজনে সেভিন ৮৫ এসপি ২ মিলি/লিটার পানি বা ডারসবান ২০ ইসি ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে পিঁপড়ার বাসায় প্রয়োগ করতে হবে।
জারা লেবুর রোগ ব্যবস্থাপনা
ক্যাঙ্কার : এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। কচি পাতা, বাড়ন্ত কুঁড়ি, পাতা ও ফলে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। আক্রান্ত পাতার উভয় পাশে খসখসে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ক্ষত অংশের চারদিকে গোলাকার হলুদ কিনারা দেখা যায়। পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে এবং আক্রান্ত ডগা ওপর দিক থেকে মরতে থাকে। ফলের ওপর আক্রমণ বেশি হলে ফল ফেটে যায় ও ঝরে পড়ে। ঘন ঘন বৃষ্টি হলে এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত বাতাসজনিত কারণে ও লিফ মাইনার পোকার আক্রমণে গাছের ডাল ও পাতায় যে ক্ষতের সৃষ্টি হয় তার ভেতর দিয়ে রোগ জীবাণু প্রবেশ করে এ রোগের সৃষ্টি করে।
প্রতিকার : পরিকল্পিতভাবে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদের মাধ্যমে জারা লেবুর বাগান করতে হবে। রোগের প্রাদুর্ভাব প্রকট হলে কুপ্রাভিট ৮০ ডব্লিউপি (কপার অক্সিক্লোরাইড) প্রতি লিটার পানিতে ৭ গ্রাম হারে ১০-১৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে। বোর্দোমিশ্রণ (১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন প্রতিলিটার পানিতে মিশিয়ে) ৭-১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
স্ক্যাব : লেবুর চামড়ার ওপর ছোট ছোট বাদামি বা লালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। এ দাগগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে খসখসে হয়ে যায় যা দেখতে অনেকটা দাদ রোগের মতো মনে হয়। কিছু কিছু দাগ গভীর হয় আবার কিছু কিছু দাগ বাইরের দিকে খাঁড়া থাকে। এ রোগ ব্যবস্থাপনায় ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম হারে ১০-১৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে। (তথ্য সূত্র : সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র, সিলেট)
লেখক : কৃষি তথ্য কেন্দ্র সংগঠক (এআইসিও), কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট, মোবাইল : ০১৭২৩-৮৫০৮৯২ ই-মেইল-md.zulfikarali22@gmail.com
মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি পূরণে
গোবর সার ও পোল্ট্রি ম্যানিওর
ডা: মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল এবং কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটিরও বেশি। দেশের প্রায় ৬৪ শতাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল (বিশ^ব্যাংক, ২০১৭)। আর কৃষি উৎপাদনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত মাটির গুণাগুণ। আমাদের দেশের মাটিতে জলবায়ুগতভাবেই জৈব পদার্থের পরিমাণ কম এবং দিন দিন এর পরিমাণ আরও কমে যাচ্ছে, ফলে হ্রাস পাচ্ছে মাটির উর্বরতা। বাড়ছে মানুষ, সাথে সাথে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে খাদ্যের চাহিদা। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফসল উৎপাদন। কৃষিনীতি, কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনা, গবেষণা, সম্প্রসারণ সর্বোপরি কৃষকের পরিশ্রমের ফলে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ক্রমবর্ধমান ফসল উৎপাদন করতে বাড়ছে ফসলের নিবিড়তা, বাড়ছে সার, সেচ ও কীটনাশকসহ নানা প্রকার রাসায়নিকের প্রয়োগ। এভাবেই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ, বাড়ছে মাটির অম্লত্ব, মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতা।
মাটির উর্বরতা হারানোর অন্যতম কারণ হলো মাটিতে জৈবসার ও সবুজ সারের কম ব্যবহার। একই জমিতে বছরে একের অধিক ফসল চাষের ফলে ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে না পচিয়ে জমি থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া দেশের উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে ব্যবহৃত জৈবসার বা ফসলের অবশিষ্টাংশ খুব দ্রুত পঁচে যায়। যার ফলে জমিতে ব্যবহৃত জৈবসারও জমিতে বেশি দিন থাকে না বা দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে বারবার জৈব সার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। আর দেশের প্রান্তিক কৃষকের পক্ষে বারবার অর্থ খরচ করে সার ক্রয় করাও সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে জমিতে জৈব পদার্থের উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে গবাদিপশুর গোবর এবং পোল্ট্রি ম্যানিওর।
মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি পূরণে গোবর সার
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং জমিতে জৈব পদার্থের উৎস হিসেবে এদেশে আবহমানকাল থেকে গোবর ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গবাদিপশুর খাবারের প্রায় ৫৫ শতাংশই গোবরে পরিণত হয়। সুতরাং, গোবর একটি উৎকৃষ্ট যৌগ যাতে কৃষি কাজের উপযোগী এবং ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি রয়েছে। কিন্তু মোট উৎপাদিত গোবরের তুলনায় এর ব্যবহার খুবই কম। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২.৫ কোটি গরু রয়েছে (বিবিএস, ২০১৯) এবং প্রতিদিন গড়ে ২৩০ মিলিয়ন কেজি গোবর উৎপাদন হয় (ওখগগ চড়ষরপু, ২০১৫)। প্রতি কেজি গোবর হতে ৫০-৫২% কেঁচো সার উৎপাদন করা যায়, সে মোতাবেক দৈনিক এক লাখ পঞ্চাশ হাজার মেট্রিক টন কেঁচো সার পাওয়া সম্ভব। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক গরু হতে প্রতিদিন গড়ে ৬-১২ লিটার মূত্র পাওয়া যায়, সে হিসেবে দেশের ২.৫ কোটি গরু হতে প্রতিদিন প্রায় ২২.৫ কোটি লিটার গোমূত্র উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতি লিটার গোমূত্রে ২.৫% ইউরিয়া থাকে, সে হিসাবে দৈনিক ৫ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন ইউরিয়া উৎপাদন করা যেতে পারে। দেশে প্রতি বছর ২৯ মেট্রিক টন ইউরিয়া চাহিদা থাকলেও উৎপাদিত হয় ৭ লক্ষ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। সুতবাং গোবর ও গোমূত্রের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে সারের চাহিদা পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও গোবরের এরূপ ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস-অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস নির্গমন কম হয় এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দূষণের প্রভাব কমে যায়। উল্লেখ্য, গোখাদ্যের উচ্ছিষ্ট বর্জ্যও একটি নির্দিষ্ট স্থানে পচিয়ে গোবরের সাথে মিশিয়ে কেঁচো সার উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। একটি গরু দিনে গড়ে প্রায় ২.৫ কেজি খাবার নষ্ট করে যা বর্জ্য হিসেবে থেকে যায়। সুতরাং উচ্ছিষ্ট খাবার থেকে সৃষ্ট বর্জ্যরে পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ৬০ হাজার টন। এসব বর্জ্য থেকে উৎপাদিত কেচো সার কৃষি জমিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ব্যবহারের সুযোগ আছে। রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে শুধু মাটির গুণাগুণই নষ্ট হয় না, উক্ত রাসায়নিক পদার্থের অবশিষ্টাংশ নদী, পুকুর, খাল-বিল ইত্যাদিতে মিশে পানি দূষিত করে। ফলে মাছসহ জীব-বৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশে উৎপাদিত গোবরকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে কেঁচো সার উৎপাদন করে জমিতে ব্যবহার করলে তা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যেমন সহায়তা করবে, তেমনি মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধিসহ পরিবেশ সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও জৈব পদার্থের ঘাটতি পূরণে পোল্ট্রি ম্যানিওর
গোবরের পাশাপাশি পোল্ট্রি ম্যানিওর জৈবসারের একটি অন্যতম উৎস হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। আমাদের দেশে হাজার হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছে। এসব খামার থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পোল্ট্রি ম্যানিওর উৎপন্ন হয়। এসব পোল্ট্রি ম্যানিওর জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করলে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, ফলে মাটির উর্বরতাও বাড়বে। পোল্ট্রি ম্যানিওর একটি উৎকৃষ্ট মানের জৈবসার। মাটিতে পোল্ট্রি ম্যানিওর প্রয়োগ করলে মাটির অম্লত্ব দূর হয় বিধায় অম্ল মাটিতে চুন প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। আর অম্লত্ব দূর হওয়ার কারণে অন্যান্য পুষ্টি উপাদান গ্রহণেও ফসলের সুবিধা হয়।
পোল্ট্রি ম্যানিওর-এ উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় ১৩ ধরনের অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এগুলো হলো, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, জিংক, ক্লোরিন, বোরন, আয়রন, এবং মলিবডেনাম। পোল্ট্রি ম্যানিওর প্রয়োগ করলে জমিতে প্রচুর পরিমাণ ফসফরাস সার যোগ হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যদি জমিতে বছরে হেক্টরপ্রতি ১-১.৫ টন বা প্রতি শতাংশ জমিতে ৪-৬ কেজি পোল্ট্রি ম্যানিওর প্রয়োগ করা হয় তবে সে জমিতে আর বাড়তি টিএসপি সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। এছাড়া এ পরিমাণ পোল্ট্রি ম্যানিওর ব্যবহারে হেক্টরপ্রতি ২০-২৫ কেজি ইউরিয়া জমিতে যোগ হয়। অর্থ্যাৎ পোল্ট্রি ম্যানিওর নাইট্রোজেনেরও একটি ভাল জৈব উৎস।
প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকার মাটি অম্লীয়। বিভিন্ন কারণে মাটিতে অম্লত্ব দেখা দেয়। যেমন, দীর্ঘদিন যাবৎ জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, চাষাবাদের নিবিড়তা বৃদ্ধি, উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ফসল আবাদ, অতি বৃষ্টি, মাটির বুনট, জৈব পদার্থের পচন এবং প্রাকৃতিক কিছু কারণেও মাটিতে অম্লত্ব দেখা দিতে পারে। মাটির অম্লত্ব বেড়ে গেলে গাছ মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে না। অম্ল মাটিতে পরিমিত পরিমাণে সার প্রয়োগ করেও কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় না। মাটির অম্লত্ব দূর করার জন্য প্রচুর পরিমাণ চুন জাতীয় পদার্থ প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে। আর পোল্ট্রি ম্যানিওরে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম বা চুন জাতীয় পদার্থ থাকায় এ জৈবসারের প্রয়োগ মাটির অম্লত্ব দূর করে।
অনেকের ধারণা, পোল্ট্রি ম্যানিওর-এ হেভি মেটাল বা দূষক পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকে। যার ফলে জমিতে পোল্ট্রি ম্যানিওর ব্যবহারে উৎসাহ দেখান না। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ পোল্ট্রি ম্যানিওর হেভি মেটাল বা দূষক পদার্থের পরিমাণ সরকার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে কম। লেখক : ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল: ০১৮১১-৯৮৬৬০৫, ইমেইল:smmohibullah@gmail.com
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও) ব্যবহারে
কৃষিক্ষেত্রে বাড়বে উৎপাদনশীলতা
ড. মোঃ কামরুজ্জামান১ সৌরভ অধিকারী২
বাংলাদেশের কৃষি খাত দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি। কৃষিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ। যেমন : জনসংখ্যা ১.২০% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনঘটিত প্রতিকূলতা যেমন-লবণাক্ততা, খরা, বন্যা ইত্যাদির কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। মাটির অম্লতা, রোগবালাই, পানি সেচের অভাব ইত্যাদি কারণে কৃষির উৎপাদন প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। কৃষি মৌসুমে শ্রমিকের ঘাটতি এ খাতকে দিন দিন আরো চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে। কৃষির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও)। এর মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা অও হলো এমন প্রযুক্তি যা মানুষের বুদ্ধিমত্তার কার্যক্রম কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে অনুকরণ করে। এটি মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং এবং অন্যান্য উন্নত অ্যালগরিদমের মাধ্যমে কাজ করে। কৃষিসংক্রান্ত তথ্যউপাত্ত খুব সহজে ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে মেশিন লার্নিং বা উন্নত অ্যালগরিদমের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করে অর্থবোধক ফলাফল দিয়ে কৃষিকাজে সাহায্য করতে পারে। এর ব্যবহার কৃষিকাজকে সহজ করেছে, উৎপাদন অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন, ভারতসহ অনেক দেশ কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু করেছে। বাংলাদেশেও এর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
কৃষিক্ষেত্রে অও প্রযুক্তি প্রয়োগের কিছু সফলতা ও সম্ভাবনা
বীজ নির্বাচন ও চাষাবাদ : ফসলের ভালো জাত, বীজের বিশুদ্ধতা, পুষ্টতা ইত্যাদির উপর অধিক ফলন নির্ভর করে। তবে এসব কাজ বেশ শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার যা উন্নতবিশ্বে অও এর মাধ্যমে সহজে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য ক্লাইমেট করপোরেশনের ‘ঋরবষফঠরব’ি প্লাটফর্মটি অও টুল ব্যবহার করে প্রিসিশন ফার্মিংয়ের জন্য নানা রকম তথ্য দিয়ে কৃষকদের সহায়তা করছে। এটি শস্য ও জমির ওপর ভিত্তি করে সেই অনুযায়ী বীজ বপনের হার, চারার দূরত্ব ইত্যাদি তথ্য দিয়ে ফসল চাষাবাদে সহায়তা করে। এই টুল চারা রোপণের ঘনত্ব, ফলনের হার-এসব নিয়ে আগাম সংকেতও দিতে পারে। এই প্লাটফর্মটির সাথে মেশিন লার্নিংয়ের আরও কিছু ফিচার যোগ করলে বীজের রং, আকার-আকৃতিও নির্ণয় করা যাবে। এতে করে জাতের বা বীজের বিশুদ্ধতা সহজেই রক্ষা করা যাবে। এমনকি প্রযুক্তিটির দ্বারা নির্ভুল ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফল ও সবজির গ্রেডিংও করা সম্ভব হবে যা এতদিন সম্পূর্ণ ম্যানুয়ালি বা সেমিঅটোমেটেড পদ্ধতিতে করা হতো। বীজ রোপণ ও জমিচাষের জন্য যুক্তরাজ্যে একজন কৃষক অও প্রযুক্তির চালকবিহীন ট্রাক্টর ব্যবহার করছেন। চালকবিহীন ট্রাক্টরে রাডার, আলট্রাসাউন্ড ও সেন্সর রয়েছে। এর ফলে কোনো বস্তুর সংস্পর্শে এলেই তা তৎক্ষণাৎ থেমে যায়। আর এর দ্বারা জমির ক্ষতিও খুব কম হয়। যন্ত্রটি হালকা হওয়ার কারণে গভীরের মাটি সুরক্ষিত থাকে। চাষাবাদের কাজে কৃষি শ্রমিকের ঘাটতির চাহিদা পূরণের জন্য অদূর ভবিষ্যৎ এরকম ‘রোবট’-ই প্রয়োজন হতে পারে।
স্মার্ট ফার্মিং : আবাদি জমির পরিমাপ অও এর মাধ্যমে নিখুঁতভাবে নিরূপণ করা সম্ভব। এ ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘খধহফংপধঢ়ব টহফবৎংঃধহফরহম’। এই প্রক্রিয়ায় স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি নিয়ে মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে জমির সীমানা শনাক্ত করা হয়। এভাবে ভূমিতে জমির বিভিন্ন খ-গুলোকে আলাদা করা হয়। এরপর মাপা হয় জমির সীমানা, আলাদা করা হয় আবাদযোগ্য জমি, অনুর্বর জমি, বনাঞ্চল, জলাভূমি, নদী ইত্যাদি। এরপর সেই তথ্য ব্যবহার করে সাধারণ চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে। কোথায় উঁচু, কোথায় মধ্যম উঁচু এবং নিচু জমি রয়েছে, কোথায় চরাঞ্চল, কোথায় বন্যাপ্রবণ সেসব জানা যাবে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। জমিতে ফলন কেমন হতে পারে তাও এ সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়।
বাংলাদেশে বর্তমানে ফসলের নিবিড়তা ২১৪%, যা আরও বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা রয়েছে। অও এর মাধ্যমে কোন জমিতে কোন ফসল উপযোগি, কোনটি এক ফসলী জমি, কোনটি দুই, তিন বা ততোধিক ফসল চাষযোগ্য এসব ম্যাপিং করা সম্ভব। এছাড়া বিভিন্ন ফসল চাষের তথ্যাদি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এ সিস্টেমের দ্বারা সারাবছর একটি জমিকে কিভাবে চাষের আওতায় আনা যায় সেরূপ একটি মডেলও তৈরি করা সম্ভব। এতে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির পরিকল্পনা নির্ভুলভাবে করা সম্ভব। খরাকালীন উপযুক্ত একটি সেচ পরিকল্পনা গ্রহণ করার প্রয়োজন হতে পারে, যা করে দিতে পারবে অও। কোথায় কূপ খনন করলে বা কোথা থেকে পানি আনলে সবচেয়ে কম সময়ে, কম খরচে সব জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পৌঁছানো যাবে সেটা বলে দিবে। ‘খধহফংপধঢ়ব গড়হরঃড়ৎরহম’-এর জন্যও বিভিন্ন মডেল তৈরি করছে গুগল। এ মডেলের কাজ জমির জন্য বিস্তারিত তথ্য তৈরি করা। এ থেকে কৃষকেরা জমির বর্তমান ফলন, উর্বরতার বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যতে জমিতে আর কোন কোন ধরনের সার, জৈব উপাদান ও রাসায়নিক প্রয়োজন হবে-এসব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। এ ধরনের ফিউচার ল্যান্ডস্কেপ মনিটরিং মডেলগুলো রোপিত শস্য, পানির উৎস থেকে জমির দূরত্ব, কৃষিসংক্রান্ত যাবতীয় আরও অনেক তথ্য নিয়ে কাজ করতে পারবে। এসব তথ্য এই অও-এর কাছে জমাও থাকবে। এতে ভবিষ্যতে ওই জমিতে চাষাবাদের পূর্বেই অও এর অতীতের তথ্য-উপাত্ত থেকে কৃষককে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবে এবং বন্যা-খরার মতো বৈরী আবহাওয়া থেকে জমিকে সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রেও সহায়তা করতে পারবে। মাঠের এসব ব্যবহার ছাড়াও অও ভিত্তিক কৃষি-সংক্রান্ত অনলাইন চ্যাটের জন্য মাইক্রোসফটের ‘ঋধৎসঠরনবং.নড়ঃ’ নামে একটি চ্যাটবট রয়েছে যা কৃষকদের ফসল, জমি ও আবহাওয়া বিবেচনা করে ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ প্রদান করে।
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন : রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ ফসলের ফলন কমে যাওয়ার জন্য দায়ী। তবে সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও পোকামাকড় শনাক্ত করা গেলে ক্ষতির পরিমাণ বহুলাংশে কমানো সম্ভব। অও প্রযুক্তি ফসলের রোগ ও পোকামাকড় শনাক্তকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাঠে গিয়ে রোগ আক্রান্ত নমুনা বা পোকামাকড়ের ছবি অ্যাপ্লিকেশন এ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দ্রুত ও সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ও পোকামাকড় শনাক্ত করা যাবে। অও এটাও বলতে পারে, কীভাবে এই রোগ বা পোকামাকড় প্রতিরোধ করা যায় এবং ছড়িয়ে পড়া বা বংশবিস্তার থেকে আটকানো যায়। তাছাড়া এ প্রযুক্তি কীটনাশক এর সঠিক মাত্রা নিরূপণ করে এবং তার অপচয় রোধ করে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, কৃষিতে অও ব্যবহারে কীটনাশক ব্যবহার প্রায় ৬০% কমানো সম্ভব। অও-চালিত এ রকম আর একটি অ্যাপ্লিকেশন হলো প্ল্যান্টিক্স (চষধহঃরী)। অ্যাপ্লিকেশনটি পুষ্টিঘাটতি শনাক্ত করার পাশাপাশি জমিতে ফসলের কী কী রোগ হতে পারে, কতটুকু সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে তার উপদেশ দিতে পারে। এ জন্য কৃষককে শুধু তার ফসলের কয়েকটি ছবি তুলে দিলেই হয়। অও ব্যবহার করে বাকি কাজ নিজে থেকেই করে দেবে অ্যাপ্লিকেশনটি।
আগাছা নিধন : আগাছা নিধনেও অও ব্যবহার শুরু করেছে বেশ কিছু কোম্পানি। এদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি বাজারে এনেছে ব্লু-রিভার টেকনোলজি। তাদের ‘সি অ্যান্ড স্প্রে’ মেশিন কম্পিউটার ভিশন ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে জমিতে ফসল ও আগাছা আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারে। এরপর শুধু যে জায়গাটুকুতে আগাছা রয়েছে, সেখানে আগাছানাশক প্রয়োগ করে আগাছা নিধন করে।
পানি ব্যবস্থাপনা : গবেষণা বলছে কৃষিতে অও ব্যবহারে সেচের জন্য পানির ব্যবহার অর্ধেকে কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। অও বা ওড়ঞ (ওহঃবৎহবঃ ড়ভ ঞযরহমং) ভিত্তিক সিস্টেমগুলো মাটি ও আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে গাছের জন্য সঠিক পরিমাণ পানি দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারে। এই সিস্টেমগুলো মাঠে ও ছাদবাগানে খুবই কার্যকরী। ফসলের মাঠ বা ছাদবাগানে গাছের বৃদ্ধির জন্য পরিমিত পানির প্রয়োজন। পানি অতিরিক্ত বেশি বা কম হওয়া গাছের জন্য ক্ষতিকর। অও বা ওড়ঞ সিস্টেমগুলোতে সঠিক পরিমাণ পানির জন্য প্রোগ্রাম করা হয়। পানি অতিরিক্ত হলে বা খরায় মাটি শুকিয়ে গেলে সিস্টেমগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতিরিক্ত পানি বের করার জন্য নির্দেশ প্রদান বা উৎস হতে পানি গাছে বয়ে নিয়ে আসবে। মাঠে বা ছাদবাগানে না গিয়ে বিশ্বের যেকোনো স্থানে বসেই এ সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে করে অপচয় কমে মূল্যবান ভূগর্ভস্থ পানির, নিশ্চিত হয় গাছের সঠিক বৃদ্ধি এবং পানি দেয়ার জন্য অতিরিক্ত শ্রমেরও প্রয়োজন হয় না।
মাটির উর্বরতা ও পুষ্টিগুণ নিরূপণ : নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রোকেয়ারস ‘নিউট্রিয়েন্ট স্ক্যানার’ নামক একটি টুল তৈরি করেছে। টুলটি জমির মাটি নমুনা হিসেবে নিয়ে তাতে কোন কোন উপাদানের ঘাটতি আছে, তা জানিয়ে দিতে পারে। এতে কৃষক আগে থেকেই তার জমি চাষের জন্য যথাযথ সার দিয়ে প্রস্তুত করতে পারবেন।
বাজার বিশ্লেষণ : অও ভিত্তিক অ্যানালিটিক্স কৃষককে বাজারের চাহিদা এবং মূল্য বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে, যা কৃষকের বিক্রয় পরিকল্পনা উন্নত করে। কৃষিপণ্যের বিপণন ও সরবরাহ চেইনকে আরো কার্যকর করতে, স্বয়ংক্রিয় বিশ্লেষণ, বাজার প্রবণতা শনাক্তকরণে এ প্রযুক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে।
অও প্রয়োগের চ্যালেঞ্জসমূহ
প্রযুক্তির উচ্চ খরচ : অও প্রযুক্তির উচ্চ খরচ কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই খরচের ব্যয়ভার করার জন্য সরকারের সহায়তা ও প্রণাদনা প্রয়োজন।
প্রশিক্ষণের অভাব : অও প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ ছাড়া প্রযুক্তির পূর্ণ সুবিধা পাওয়া সম্ভব নয়।
প্রযুক্তির প্রতি অনীহা : কিছু কৃষক নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে অনিচ্ছুক, যা প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা কমাতে পারে।
অও প্রয়োগের সুপারিশসমূহ
প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি : কৃষকদের অও প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।
সরকারি সহায়তা ও প্রণোদনা : কৃষি প্রযুক্তির জন্য সরকারের আর্থিক সহায়তা ও প্রণোদনা বৃদ্ধি করা উচিত।
নির্ভরযোগ্য অবকাঠামো উন্নয়ন : অও প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও ইন্টারনেট সংযোগ উন্নত করা।
বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে অও ব্যবহার একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, ক্ষতির পরিমাণ কমানো এবং কৃষি পদ্ধতির উন্নতি সম্ভব। ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের কৃষি খাত একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে। অও প্রযুক্তি কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : ১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিনা উপকেন্দ্র, গোপালগঞ্জ; ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিনা উপকেন্দ্র, গোপালগঞ্জ, মোবাইল : ০১৭৭৬৯৬০৭৬৯, ই-মেইল : kamruzzaman_bina2013@yahoo.com;
তুলা ফসলের বহুমুখী ব্যবহার
ও অমিত সম্ভাবনা
১ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজা ২ড. মোঃ কামরুল ইসলাম ৩অসীম চন্দ্র শিকদার
বিশ^ব্যাপী তুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল এবং আন্তর্জাতিক শিল্প ফসল, যা বিশ^ব্যাপী ‘সাদা সোনা’ হিসেবে পরিচিত। অন্নের পরই বস্ত্রের অবস্থান। আর এই বস্ত্রের মূল উপাদান হল তুলা। বর্তমানে বাংলাদেশে তুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল এবং বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি শিল্প বস্ত্রশিল্পের প্রধান কাঁচা মাল। বস্ত্রশিল্প ছাড়াও তুলা ফসলের আরও নানাবিধ ব্যবহার বা উপযোগিতা রয়েছে যার অর্থনৈতিক গুরুত্বও কম নয়।
তুলাচাষ
বাংলাদেশে মূলত সমভূমি জাতের এবং সীমিত আকারে পাহাড়ী জাতের তুলার চাষ হয়ে থাকে। প্রধানত যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ অঞ্চলের বন্যামুক্ত সমভূমিতে এবং বন্যামুক্ত চরাঞ্চলে তুলা চাষ হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে পাহাড়ি অঞ্চলের সমতল ভূমিতেও সমভূমির জাতের তুলা চাষ হচ্ছে। যেহেতু তুলা একটি খরা ও লবন সহনশীল ফসল, তাই কম বৃষ্টি প্রবণ রাজশাহী ও রংপুরের বরেন্দ্র অঞ্চলে এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত ভূমিতে তুলা চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সমভূমি অঞ্চলে তুলাচাষ নির্ভরই আমাদের বস্ত্র শিল্প। বস্ত্র শিল্পের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তুলা চাষে আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল প্রয়োগ এবং নতুন নতুন চাষ এলাকা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। তুলা চাষের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো বাংলাদেশের নারীরা তুলা উৎপাদনে অধিক হারে অংশগ্রহণ করে থাকে; এর প্রধান কারণ তুলাচাষ কঠিন শ্রমঘন ফসল নয়। তুলাবীজ বপন, নিড়ানি, তুলা উঠানো কোন কঠিন কাজ নয়। বিশেষ করে গাছ থেকে তুলা উঠানো একটি ছেলে মেয়েদের জন্য আনন্দদায়ক কাজ।
ইতোমধ্যে দেশে উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের পাশাপাশি হাইব্রিড এবং বিটি কটন জাতের তুলাচাষ শুরু হয়েছে। বর্তমানে উচ্চফলনশীল জাতের তুলার ফলন বিঘা প্রতি ১২ থেকে ১৫ মন আর হাইব্রিড ও বিটি কটন জাতের তুলার ফলন বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ মন পর্যন্ত হয়ে থাকে, যার বাজার মূল্য বর্তমানে মন প্রতি (৪০ কেজি) ৩৯০০.০০ টাকা হিসেবে যথাক্রমে ৪৬,৮০০.০০ টাকা থেকে ৫৮,৫০০.০০ টাকা এবং ৫৮,৫৫০.০০ টাকা থেকে ৭৮,০০০ টাকা। সুতরাং তুলাচাষ একটি লাভজনক ফসল। এ ছাড়া তুলার সাথে স্বল্পমেয়াদী সাথী ফসল চাষেরও সুযোগ আছে, আর নিয়মিত তুলা চাষে জমি উর্বর হয়।
তুলা ফসলের বহুমুখী ব্যবহার
তুলার মুখ্য ব্যবহার আমাদের বস্ত্র শিল্পে। তুলা দিয়ে সুতা, কাপড় এবং পোষাক প্রস্তুত করা হয়; যা থেকে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এ ছাড়া তুলা ফসলের আরো গুরুত্ব পূর্ণ ব্যবহার রয়েছে। নি¤েœ সেসব নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
তুলাবীজ : বীজতুলা জিনিং-এর পর আঁশ এবং বীজ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে চাষকৃত তুলার জিওটি সাধারণত ৪০% অর্থাৎ ১০০ কেজি বীজতুলা থেকে ৪০ কেজি আঁশ এবং ৬০ কেজি বীজ পাওয়া যায়। এই আঁশই বস্ত্র শিল্পের প্রধান কাঁচা মাল। এই আঁশ থেকে সুতা কাটার পর অবশিষ্ট তুলা লেপ তৈরিসহ আরও অনেক কাজে ব্যবহার হয়। তুলা বীজের গায়ে লেগে থাকা আঁশকে ফাঁজ বলা হয়। এই ফাঁজ থেকে বিভিন্ন ডাক্তারি তুলা প্রস্তুত করা হয়। যেমন-অস্ত্রোপচারের ব্যান্ডেজ, মেডিকেল তুলা, গজ ইত্যাদি।
তুলাবীজের তেল : বীজতুলা থেকে প্রাপ্ত তুল বীজের বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। কুষ্টিয়ায় ১৬টি জিনিং ফ্যাক্টরি রয়েছে, যেখানে জিনাররা জিনিং মেশিনের সাহায্যে বীজতুলা থেকে আঁঁশ ও বীজ আলাদা করেন। সুতা তৈরির জন্য আঁশ পাঠানো হয় স্পিনিং মিলগুলিতে। আর তুলাবীজ থেকে মেশিনে পিষে অপরিশোধিত তেল ও খৈল উৎপান করা হয়। কুষ্টিয়ায় তুলাবীজ থেকে অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের কয়েকটি কারখানা রয়েছে। বছরে সেখানে প্রায় ৫০০ টন অপরিশোধিত তুলাবীজের তেল উৎপাদন হয়, যা উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বীজ থেকে ১৮ থেকে ২০ ভাগ তেল পাওয়া যায়। অবশ্য এটি তুলাবীজের আকার, বীজের ওজন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। এই তেল সাধারণত সাবান তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ঐ তেল পরিশোধন করে খাবার উপযোগী করার জন্য রয়েছে আলাদা একটি কারখানা।
তুলাবীজের তেলে গসিপল নামক বিষাক্ত পদার্থ থাকে, যা মানব দেহের জন্য বিপজ্জনক কিন্তু প্রাকৃতিক পোকামাকড়ের বিরোধ্যে কাজ করে। গসিপল হল একটি বিষাক্ত হলুদ পলিফেনলিক যৌগ যেটি তুলা সহ ম্যালভেসি বর্গের উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রজাতির দ্বারা উৎপাদিত হয়। তাই তুলাবীজের তেল কীটনাশক প্রস্তুতে ব্যবহার হয়ে থাকে।
তবে এই তেল খাবার উপযোগী করার জন্য তেলের মধ্যে বিষাক্ত গসিপল সরিয়ে ফেলার জন্য পরিশোধন করে নিতে হয়। এই পরিশোধনের মূল ধাপ ব্লিচিং এবং দুর্গন্ধমুক্তকরণ। পরিশোধিত তেল একটি সুস্বাদু উদ্ভিজ্জ তেল যার রং হালকা হলুদ বা হালকা সোনালি রঙের হয়ে থাকে। তবে রং নির্ভর করে পরিশোধনের পরিমাণের উপর। রিফাইনারিতে ১০০ কেজি অপরিশোধিত তেল থেকে ৭৮ থেকে ৮০ কেজি পরিশোধিত তেল উত্তোলন করতে পারে। এই তেল সয়াবিন তেলের চাইতেও পুষ্টিকর। তুলাবীজের তেলে কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন, খনিজ, লেসিথিন, স্টেরল প্রভৃতি রয়েছে যা মানবদেহের জন্য আবশ্যক। এ ছাড়া তেলে প্রচুর মানবদেহের প্রয়োজনীয় অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড (৭০%) থাকে, যা মানবদেহে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে এবং ভালো কোলেস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া তেলে প্রচুর লিনোলিক অ্যাসিড থাকায় মানব দেহে খারাপ কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে কার্যকর ভাবে বাধা দেয় এবং মানব দেহের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে। তুলাবীজের তেল বাংলাদেশে ভোজ্যতেল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তুলাবীজের খৈল : তুলাবীজের খৈল উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ। তুলাবীজের খৈলে রয়েছে ২৪ শতাংশ প্রোটিন ও ২০ শতাংশ ফ্যাট, যা গবাদিপশু ও মৎস্য খাদ্যের জন্য উৎকৃষ্ট। এছাড়া জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে তুলাবীজের খৈল ব্যবহার করা হয়।
তুলাগাছ : তুলাগাছ গ্রাম্য পারিবারিক জ¦ালানির একটি ভালো উৎস। বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ মন জ¦ালানি পাওয়া যায়, যা দিয়ে একটি পরিবারের ছয় মাসের জ¦ালানির চাহিদা মেটে। এছাড়া শুকনো তুলা গাছ কাগজ শিল্পেও ব্যবহার করা হয়। তুলা গাছের পাতা এক সময় গাছ থেকে ঝড়ে পরে। এ পাতা মাটিতে মিশে মাটিতে জৈবসারের যোগান দেয়। তুলা গভীরমূলী ফসল বিধায় মাটির উপরিভাগের খাদ্য অব্যবহৃত থেকে যায়, তুলাগাছ মাটির গভীর হতে খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। ফলে তুলা পরবর্তী ফসলের চাষে বাড়তি সার প্রয়োগের তেমন প্রয়োজন হয় না। অনুর্বর জমিতে নিয়মিত তুলাচাষ করলে জমি উর্বর হয়।
বাংলাদেশে তুলাচাষের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো গ্রামের নারীদের অংশ গ্রহণ। এতে বাড়তি শ্রম দেশের অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। এ ছাড়া তুলা ফসলের মত এত বহুমুখী ব্যবহার বা উপযোগিতা অনেক ফসলেই নাই। তাই তুলাচাষ আমাদের অর্থনীতি এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ। এই লাভ জনক এবং বহুমুখী ব্যবহার যোগ্য তুলা ফসলটি কৃষক ভাই ও বোনদের যতেœর সঙ্গে চাষ করা উচিত। এতে আমাদের অর্থনীতি যেমন উপকৃত হবে তেমনি দৈনন্দিন বিভিন্ন চাহিদাও পূরণ হবে সেই সাথে তুলা উৎপাদনকারী কৃষকের লাভ উত্তর উত্তর বৃদ্ধি ঘটবে।
॥ দেশের মঙ্গল তুলা চাষে-বস্ত্রশিল্প তুলার আঁশে ॥
লেখক : ১ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজা, মৃত্তিকা উর্বরতা ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। ২ড. মোঃ কামরুল ইসলাম, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। ৩অসীম চন্দ্র শিকদার, কটন ইউনিট অফিসার (অব:) তুলা উন্নয়ন বোড, তুলা ভবন, কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৫৫২-৩৬২৯০১, ১০৪/১ (বি-২), শেরেবাংলা রোড (কাটাসুর), জাফরাবাদ, মোহাম্মদপুর-১২০৭। ইমেইল :asim,cdb@gmail.com
কৃষি পেশাকে সম্মানজনক অবস্থায় পরিচিত করানোই মানিক রাজার আশা
মোঃ আবদুর রহমান
প্রতিটি পেশাকে কেন্দ্র করে উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব। একজন উদ্যোক্তা আত্মনির্ভরশীল হন এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন। কৃষিকে উদ্যোগ হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন। একজন কৃষি উদ্যোক্তার মূল লক্ষ্য বাজারজাতকরণ ও মুনাফা তৈরি। তাই একজন কৃষি উদ্যোক্তাকে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির হতে হয় এবং তার কাজে প্রচুর ঝুঁকি থাকে। বিপুল জনসংখ্যা, কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস, বেকারত্ব এ সবকিছুর ভিতরে একজন নব উদ্যোক্তা কৃষিকে প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করছেন। শিক্ষিত তরুণদের কৃষিক্ষেত্রে পরিকল্পিত উদ্যোগ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পেছনে ছুটবে, চাকরি করবে! চাকরি না করলে লেখাপড়া বৃথা এমন ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন একজন শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা মানিক রাজা। যশোর জেলার শার্শা উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামের মানিক ২০১৮ সালে পাকশিয়া আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর জীবিকার প্রয়োজনে মালয়েশিয়াতে শ্রমিক ভিসায় যান। ২০২১ সালে ছুটিতে দেশে এসে মহামারী করোনার প্রকোপে আর বিদেশে যাওয়া হয়নি। বন্ধুরা কেউ পড়াশোনা করছে কেউ চাকরি করছে আর তিনি বেকার হয়ে ঘুরছেন বিষয়টি তাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দেয়। এসময়ে নানান ব্যবসার কথা তার মাথায় আসে, কিন্তু বাকি/বকেয়া ও নানা সমস্যার বিষয়টি চিন্তা করে আর আগানো হয়ে ওঠেনি। তখন বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল বিভিন্ন উদ্যোক্তার কাহিনী তাকে বেশ প্রভাবিত করে, এবং কৃষি পেশাকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তার সেজ ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে উচ্চমূল্যের ফসল চাষের প্রতি আগ্রহী হন।
ক্যাপসিকাম চাষের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন প্রথম পর্যায়ে তিনি ফসলের বাজার মূল্যের প্রতি লক্ষ্য করেন। তখন তিনি দেখেন যে ক্যাপসিকামের মূল্য মৌসুমেই ১৫০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হয় এবং সেটি পরবর্তীতে ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ শত টাকা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি হয়। এর দাম সবসময়ই অন্য সবজির থেকে বেশি থাকে। তাছাড়া এটি বেশির ভাগই বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আমদানি হয়। এটিও চিন্তা করেন যে এ ফসল চাষে তিনি সফল হলে কিছুটা হলেও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে তাছাড়া কিছু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও তিনি করতে পারবেন। এসব দিক বিবেচনা করে তিনি ক্যাপসিকাম চাষের প্রতি আগ্রহী হন।
মানিক ২০২২ সালে নিজেদের পৈত্রিক আড়াই বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলক ক্যাপসিকাম চাষ করেন। এর মধ্যে ২০ শতক জমিতে লাকি মরিচ জাতের চাষ করেন। তিনি জানান, এটি বেশ আকর্ষণীয় মরিচ। এটি দেখতে সুন্দর এবং ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয় ও সব মৌসুমেই চাষ করা যায়। এটি আবাদে প্রথম বছর বেশ লাভবান হয়েছিলেন। এছাড়া ১ বিঘা জমিতে মালচিং পেপার ছাড়া ও বাকি জমিতে মালচিং পেপার দিয়ে ক্যাপসিকাম চাষ করেন। মালচিং পেপার বিহীনসহ ক্যাপসিকাম চাষে ভালো ফল পাননি কিন্তু যেটিতে মালচিং পেপার দিয়েছিলেন সেখানে ভালো ফল পেয়েছিলেন। তিনি মূলত আশা ও রেজোয়ান ভারতীয় জাতের ক্যাপসিকাম চাষ করেন। তার ভাই আবু সাঈদ আমদানি/রপ্তানির ব্যবসা করেন। তার মাধ্যমেই বিশ্বস্ত বীজ প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি এসব বীজ ক্রয় করে থাকেন।
তিনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানতে পারেন যে নেট হাউজ বা পলিনেটে এ ফসল চাষাবাদে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এছাড়া এটিও জানতে পারেন যে, থ্রিপস নামক পোকাটির হাত থেকে এ ফসলকে রক্ষা করতে নেট বা পলিনেটের কোন বিকল্প নেই। এ কারণে প্রথমেই ২ বিঘা জমিতে বাঁশের খুঁটি দিয়ে বাহিরে ৩-৪ জিআই নেট ও ভেতর পাশে দেশি নেট দিয়ে হাউজ নির্মাণ করেন। এতে শ্রমিক, মালামালসহ তার খরচ হয় প্রায় ৪ লক্ষ টাকা। এ বছর সবমিলিয়ে মোট ৬ লক্ষ টাকার ফসল তিনি বিক্রি করে ২ লক্ষ টাকা লাভবান হন। ফলে ফসলটি চাষে দারুণভাবে উৎসাহিত হন। ২০২২ সালের শেষ দিকে মানিক তার ভাইয়ের সহযোগিতায় ৯ বিঘা জমিতে নেট হাউজ নির্মাণ করেন। এর মধ্যে ২৫ শতক জমিতে পলিনেট হাউজ তৈরি করেন। এতে তার ব্যয় হয় ৩১ লক্ষ টাকা। ২০২৩ সালে মানিক এর থেকে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকার ফসল বিক্রি করেন। ফলে তার সম্পূর্ণ বিনিয়োগ উঠে লাভের মুখ দেখেন তিনি। মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে মানিক জানান, ক্যাপসিকাম চাষের গ্যাপ পিরিয়ডে স্কোয়াশ, বিট কপি, অফসিজন তরমুজসহ বিভিন্ন উচ্চমূল্যের ফসল চাষ করেন। এ ছাড়া ক্যাপসিকামের জমিতে তিনি রেস্ট পিরিয়ডে ধান ও ধৈঞ্চা বীজ বুনে দেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন ফলে এটি জৈবসারের কাজ করে। এ বাদেও তিনি টমেটো, ব্রোকলি, রঙিন বাঁধাকপি, শসা, বিটসহ যেসব সবজির উচ্চমূল্য পাওয়া যায় সেগুলোর চাষ করে থাকেন।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে তিনি বিভিন্ন সময়ে নানা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং ফসল চাষাবাদে প্রযুক্তি বিষয়ক পরামর্শ গ্রহণ করেন। তার একটি নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে যা দেখে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেকেই চাষাবাদ বিষয়ক নানান পরামর্শ গ্রহণ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক নতুন উদ্যোক্তা তার ফসলের মাঠ পরিদর্শন করেন। স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ এবং সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাগণ তার ফসল ক্ষেত পরিদর্শন করে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বলে মানিক রাজা জানিয়েছেন।
সম্প্রতি মানিক শেডের ভেতর ১০ শতক জমিতে পান চাষ করেছেন। এ প্রসংগে তিনি জানান, শেডের ভেতর যদি জিআই পিলার কিংবা ঢালাই পিলারের সাথে তারের ব্যবহারের মাধ্যমে পান চাষ করা যায় তাহলে বরজ দীর্ঘস্থায়ী হয় ও লাভের পরিমাণ বাড়ে। তিনি বলেন, তিন মাস বয়েসেই আমার শেডে পান পাতার যে আকার হয়েছে তাতে আমি ভীষণ খুশি ও পান চাষে আমি দারুণ অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। এভাবে চাষ করলে পান চাষে লাভের পরিমাণ অনেক বাড়বে। মানিকের ফসল চাষের বিনিয়োগ ও লাভের পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি বলেন বছরে প্রায় কোটি টাকার ফসল বেচাকেনা করেন তিনি।
যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিতে প্রযুক্তির বিস্তার ঘটেছে ও এর মাধ্যমে চাষাবাদে লাভের পরিমাণ বেড়েছে বলে জানান মানিক রাজা। তিনি ড্রিপ সেচ পদ্ধতি, পলি মালচিং, পলি নেট হাউজে চাষাবাদে নানা কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার করে থাকেন। রপ্তানিমুখী ও নিরাপদ ফসল উৎপাদনে এবং আধুনিক কৃষিকে এগিয়ে নিতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই বলে মনে করেন মানিক।
মানিক বলেন, কৃষিকে লাভজনক করতে হলে এলাকা ও সময়োপযোগী ফসল নির্বাচনের উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। চাকরির পেছনে না ছুটে বেকার সমস্যার জন্য প্রতিবাদ না করে নিজস্ব ধ্যান ধারণা ও সৎ সাহস নিয়ে সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। মানিক মনে করেন, টেকসই কৃষি কৃষকের জন্য লাভজনক, নিজে উদ্যোক্তা হলে তিনি কিছু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন।কৃষি পেশাকে সম্মানজনক অবস্থায় পরিচিত করানোই মানিক রাজার আশা।
গ্রামীণ কৃষি ক্ষেত্রে শিক্ষিত উদ্যোক্তা এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। (বিশেষ করে পণ্য সরবরাহ, আর্থিক লেনদেন, হাঁস-মুরগির খামার, গবাদিপশুর খামার, নার্সারি, ফুলের চাষ, মাশরুম চাষ, শুঁটকি, গরু মোটাতাজাকরণ ইত্যাদি)। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিমাণ দেশের সামগ্রিক বাজার চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট অপ্রতুল। এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। আমরা জানি, উচ্চফলনশীল ফসল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রেখে চলেছে। মূলত অধিক ফলন সম্ভাবনাসম্পন্ন বীজ, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন এবং সার সেচব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে সম্ভব হয়েছে এ উন্নয়ন।
বাংলাদেশ এখনো কৃষিনির্ভর। কৃষি খাতে দক্ষ উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে কৃষিকে আধুনিক ও সম্মানজনক পেশায় পরিণত করা আবশ্যক যাতে শিক্ষিত যুবকরা নির্দ্বিধায় এ পেশায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।
লেখক : এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, খুলনা। মোবাইলঃ ০১৯৪৩৫১৭৫০৬
প্রশ্নোত্তর
কৃষিবিদ ড. আকলিমা খাতুন
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
জনাব মো: মমিনুল ইসলাম, উপজেলা : কিশোরগঞ্জ সদর, জেলা : কিশোরগঞ্জ
প্রশ্ন : তরমুজ চারার গোড়ার দিকে পানি ভেজা দাগ এবং শিকড় পচে যাচ্ছে এবং চারা নেতিয়ে পড়ে গাছ মারা যাচ্ছে, প্রতিকার কী?
উত্তর : এটি তরমুজের গোড়া পচা রোগ। এ রোগে আক্রান্ত চারার গোড়ার দিকে পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। গোড়ায় সাদা ছত্রাকের জালি এবং অনেক সময় সরিষার মতো ছত্রাকের অনুবীজ পাওয়া যায়। শিকড় পচে যায় চারা নেতিয়ে পড়ে গাছ মারা যায়। স্যাঁতস্যেঁতে মাটি ও মাটির উপরিভাগ শক্ত হলে এ রোগের প্রকোপ বাড়ে। প্রতিকার হিসেবে পরিমিত সেচ ও পর্যাপ্ত জৈবসার প্রদান করা এবং পানি নিষ্কাশনের ভাল ব্যবস্থা রাখতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ইপ্রোডিয়ন বা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন- রোভরাল ২ গ্রাম বা ব্যাভিস্টিন ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করে মাটিসহ ভিজিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়াও সরিষার খৈল ৩০০ কেজি হেক্টর হারে জমিতে প্রয়োগ করেও ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। একই জমিতে বার বার তরমুজ চাষ হতে বিরত থাকতে হবে।
জনাব মো: রাজিব মিয়া, উপজেলা : মিরসরাই, জেলা : চট্টগ্রাম
প্রশ্ন : করলা গাছের পাতা কুঁকড়িয়ে যাচ্ছে এবং গাছ খাটো হয়ে যাচ্ছে, প্রতিকার কী?
উত্তর : এটি করলার লিফ কার্ল রোগ। এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। সাদা মাছি দ্বারা ভাইরাস এক গাছ হতে অন্য গাছে ছড়ায়। আক্রান্ত গাছ খর্বাকৃতি হয়। পাতার গায়ে ঢেউয়ের মতো ভাজের সৃষ্টি হয় এবং কুঁচকে যায়। বয়স্ক পাতা পুরু ও মচমচে হয়ে যায়। অতিরিক্ত শাখা প্রশাখা বের হয় এবং ফুল ফল ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। প্রতিকার হিসেবে আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। ভাইরাসের বাহক পোকা দমনের জন্য ডায়মেথয়েট গ্রুপের টাফগর ৪০ ইসি বা ইমিডাক্লোরপিড গ্রুপের টিডো বা এসিফেট গ্রুপের এসাটাফ ৭৫ এসপি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে বিকালে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পর পর ৩ বার এবং জমিতে সুষম সার ব্যবহার করতে হবে।
জনাব আলম মিয়া, উপজেলা : পীরগঞ্জ, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : আমের পাতায় দাগ দেখা যাচ্ছে এবং আমের মুকুল কাল হয়ে যাচ্ছে সাথে গুটিও ঝরে যাচ্ছে। এ অবস্থায় করণীয় কী?
উত্তর : এটি আমের এ্যানথ্রাকনোজ বা ফোস্কা রোগ নামে পরিচিতি। এই রোগ আম গাছের পাতা, বোঁটা, ডাল, পুষ্প মঞ্জরি ও ফলে আক্রমণ করে। পাতা ও ডালে বাদামি দাগ দেখা যায়। দাগগুলো পুরাতন হলে ফোস্কার মতো মনে হয়। আক্রান্ত স্থান কাল হয়ে শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত ফলের গুটি ঝরে যায়। এক্ষেত্রে সময়মতো প্রুনিং করে গাছ ও বাগান পরিষ্কার রাখতে হবে। আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে। এই রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি টিল্ট (প্রোপিকোনাজল) বা ১ গ্রাম নোইন (কার্বোন্ডাজিম) বা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ (ম্যানকোজেব) মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
জনাব আব্দুল আলীম, উপজেলা : ভালুকা, জেলা : ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : চিচিঙ্গা চাষে শতক প্রতি বীজের পরিমাণ এবং মাদা তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : চিচিঙ্গা চাষের জন্য শতাংশ প্রতি ১৬-২০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। চিচিঙ্গার বীজ সরাসরি মাদায় বোনা যায়। এক্ষেত্রে প্রতি মাদায় কমপক্ষে ২টি বীজ বপন করতে হবে। তাছাড়া পলিব্যাগে (১০ী১২ সেমি.) ১৫-২০ দিন বয়সের চারা উৎপাদন করে নিলে বীজ কম নষ্ট হয়। চিচিঙ্গার জন্য ১.৫ মিটার দূরত্বে মাদা তৈরি করতে হবে। মাদায় বীজ বুনতে বা চারা রোপণ করতে হলে অন্তত ১০ দিন আগে মাদায় নির্ধারিত সার প্রয়োগ করে নিতে হবে। মাদার আয়তন হবে ৪০ী৪০ী৪০ সেমি.। চারা গজানোর পর একের অধিক গাছ তুলে ফেলতে হবে। বপনের আগে বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে নিলে বীজ তাড়াতাড়ি অঙ্কুরিত হবে।
জনাব প্রসান্ত কুমার, উপজেলা : বীরগঞ্জ, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : ধানের পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে এবং ছড়া বের হতে পারছেনা, ভিতরে মোচড়ানো অবস্থায় থাকছে, কী করণীয়?
উত্তর : এটি ধানের কৃমিজনিত রোগ, উফরা রোগ নামে পরিচিত। এটি মাটি, নাড়া ও খড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এ কৃমি ধান গাছের আগার কচি অংশের রস শুষে খায়, ফলে প্রথম পাতার গোড়ায় অর্থাৎ পাতা ও খোলের সংযোগস্থলে সাদা ছিটা ফোটা দাগের মতো দেখা যায়। সাদা দাগ ক্রমেই বাদামি রঙের হয় এবং পরে দাগগুলো বেড়ে সম্পূর্ণ পাতাটা শুকিয়ে ফেলে। ফলে অনেক সময় থোড় বা ছড়া বের হতে পারে না। অথবা ছড়া ভিতরে কুঁচকানো বা মোচড়ানো অবস্থায় থাকে। এ রোগ দমন করার জন্য ফসল কাটার পর আক্রান্ত ক্ষেতের নাড়া পুড়ে নষ্ট করতে হবে। বৎসরে ১ম বৃষ্টির পর জমি চাষ দিয়ে ১৫-২০ দিন ফেলে রাখলে কৃমি মারা যায়।
জনাব আলমগীর হোসেন, উপজেলা : বোদা, জেলা : পঞ্চগড়
প্রশ্ন : কাঁঠাল গাছে মুচি ছোট অবস্থায় পচে যাচ্ছে এবং ঝরে পড়তেছে। এ অবস্থায় করণীয় কী?
উত্তর : এটি কাঁঠালের একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের কারণে ছোট অবস্থায় মুচি পচে যায় এবং ঝরে পড়ে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত মুচি ছিঁড়ে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে। গাছ এবং গাছের নিচে জমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার বোর্দোমিকচার বা ম্যানকোজেব গ্রুপের ডায়থেন এম-৪৫ অথবা (ম্যানকোজেব+ মেটালঅক্সিল) গ্রুপের রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া টেবুকোনজল গ্রুপের ফলিকুর নামক ছত্রাকনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছে ফুল আসার পর থেকে ১৫ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
জনাব হাবিবুর রহমান, উপজেলা : সিরাজদিখান, জেলা : মুন্সীগঞ্জ
প্রশ্ন : শসা গাছের পাতার উপরিভাগ সাদা পাউডারের মতো আবরণ দিয়ে ভরে গেছে। পাতা হলুদ হয়ে মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় করণীয় কী?
উত্তর : এটি শসার পাউডারি মিলডিউ রোগ এবং এটি ছত্রাকজনিত। এ ছত্রাকের আক্রমণে পাতা ও গাছের গায়ে সাদা পাউডারের মতো দাগ দেখা যায়, যা ধীরে ধীরে সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে পাতা হলুদ বা কালো হয়ে মারা যায়। এক্ষেত্রে সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক (যেমন কুমুলাস ৪০ গ্রাম বা মনোভিট ২০ গ্রাম) অথবা কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক (যেমন- গোল্ডাজিম ৫ মিলি. বা কমপ্যানিয়ন ২০ গ্রাম) প্রতি ১০ লি. পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর আক্রমণের শুরু থেকে মোট ২-৩ বার প্রয়োগ করতে হবে।
জনাব আরেফীন শিকদার, উপজেলা : সরিষাবাড়ী, জেলা : জামালপুর
প্রশ্ন : আমার আলু গাছের গোড়া এক ধরনের পোকা কেটে দিচ্ছে। আক্রমণে গাছ নষ্ট হয় এবং অনেক কীড়া আলু ছিদ্র করে দিচ্ছে।
উত্তর : এটি আলু কাটুই পোকার আক্রমণে হয়েছে। আক্রান্ত কাটা আলু গাছ দেখে তার কাছাকাছি মাটি উল্টে পাল্টে কীড়া খুঁজে সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানির সাথে ক্লোরোপাইরিফস গ্রুপের কীটনাশক যেমন ডার্সবান ২০ ইসি ৫ মিলি হারে গাছের গোড়া ও মাটিতে স্প্রে করে ভিজিয়ে দিতে হবে। ১০ দিন পর পর ২-৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে। আলু লাগানোর ৩০-৪০ দিন পর স্প্রে করতে হবে। কাটুই পোকার উপদ্রব খুব বেশি হলে ফেরোমনট্রাপ ব্যবহার করতে হবে। পোকার সংখ্যা বেশি হলে ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ১০ দিন পর পর ৩ বার ব্যবহার করুন।
জনাব কবির হোসেন, উপজেলা : সোনাগাজী, জেলা : ফেনী
প্রশ্ন : আমার কুল গাছের পাতার উপর সাদা সাদা ধূসর পাউডারের মতো দেখা যাচ্ছে এবং পাতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি কুল গাছের পাউডারি মিলডিউ রোগ এটি ঙরফরঁস ংঢ় নামক ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে প্রোপিকোনজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়াও বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সুষম সার ব্যবহার করতে হবে এবং গাছের পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
লেখক : তথ্য অফিসার (উদ্ভিদ সংরক্ষণ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২; ই-মেইল : aklimadae@gmail.com
চৈত্র মাসের কৃষি
(১৫ মার্চ-১৩ এপ্রিল)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
চৈত্র মাস। ১৪৩০ বঙ্গাব্দের শেষ মাস। এ সময় বসন্ত ঋতু নতুন করে সাজিয়ে দেয় প্রকৃতিকে। চৈতালী হাওয়া জানান দেয় গ্রীষ্মের আগমন। এ মাসে রবি ফসল ও গ্রীষ্মকালীন ফসলের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম একসাথে করতে হয় বলে কৃষকের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন আসুন আমরা জেনে নেই এ মাসের কৃষিতে আমাদের করণীয় কাজগুলো।
বোরো ধান
যারা শীতের কারণে দেরিতে চারা রোপণ করেছেন তাদের ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। জমিতে যদি সালফার ও দস্তা সারের অভাব থাকে এবং জমি তৈরির সময় এ সারগুলো না দেয়া হয়ে থাকে তবে ফসলে পুষ্টির অভাবজনিত লক্ষণ পরীক্ষা করে শতাংশপ্রতি ২৫০ গ্রাম জিপসাম ও ৪০ গ্রাম দস্তা সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩-৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ধান উৎপাদনে সেচের পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি (অডউ) ব্যবহার করা যেতে পারে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাইমুক্ত করতে পারেন।
এসব পন্থায় রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া নিচু এলাকায় আউশ ও বোনা আমন চাষের এটি উপযুক্ত সময়।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করে ফেলতে হবে। সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। মোচা সংগ্রহের পর উঠানে পাটি বিছিয়ে তার উপর শুকানো যায় অথবা জোড়া জোড়া বেঁধে দড়ি বা বাঁশের সাথে অথবা টিনের চাল বা ঘরের বারান্দায় ঝুলিয়ে শুকানোর কাজটি করা যায়। মোচা থেকে দানা সংগ্রহ করতে প্রয়োজনে ভুট্টা মাড়াইযন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।
ভুট্টা (খরিফ)
গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ মাসে বীজ বপন করতে হবে। খরিফ মৌসুমের জন্য ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৭ প্রভৃতি। শতাংশপ্রতি বীজ লাগবে ১০০-১২০ গ্রাম।
পাট
চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপন করা যায়। বপন উপযোগী পাটের ভালো জাতগুলো হলো সিসি-৪৫, বিজেআরআই দেশী পাটশাক-১ (বিজেসি-৩৯০), ফাল্গুনী তোষা (ও-৯৮৯৭), বিজেআরআই তোষা পাট-৪ (ও-৭২), বিজেআরআই তোষা পাট-৯, বিজেআরআই তোষা পাট-৬, বিজেআরআই তোষা পাট-৭, বিজেআরআই তোষা পাট-৮, বিজেআরআই তোষা পাট-৯। পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫-৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ২৫ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার (প্রায় ১ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭ সেন্টিমিটার (প্রায় ৩ ইঞ্চি) রাখা ভালো। ভালো ফলনের জন্য প্রতি একরে ৭০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি, ১২ কেজি এমওপি, ১৮ কেজি জিপসাম এবং প্রায় ৪.৫ কেজি জিংকসালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে।
অন্যান্য মাঠ ফসল
রবি ফসলের মধ্যে চিনা, কাউন, আলু, মিষ্টিআলু, চীনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন যদি এখনো মাঠে থাকে তবে দেরি না করে সাবধানে তুলে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এ সময়ে বা সামান্য পরে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য পচনশীল ফসল তাড়াতাড়ি কেটে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
শাকসবজি
এ মাসেই গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির বীজ বপন বা চারা রোপণ শুরু করা প্রয়োজন। এ সময় গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ঢেঁড়স, বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, শসা, ওলকচু, পটোল, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লালশাক, পুঁইশাক এসব সবজি চাষ করতে পারেন। ধৈঞ্চা, শন, বরবটি, মাষকলাই, অড়হর, ছোলা এসবের গাছ দিয়ে সবুজ সার তৈরি করা যেতে পারে। সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে জৈবসার ব্যবহার করলে সবজি ক্ষেতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না। নিরাপদ সবজি উৎপাদনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ও উত্তম কৃষি চর্চা মেনে শাকসবজি আবাদ করতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক সম্প্রতি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতসমূহ বারি ডাটা-৪, বারি হাইব্রিড ধুন্দুল-২, বারি হাইব্রিড শঁসা-১, বারি লাউ-৬ প্রভৃতি।
গাছপালা
এ সময় বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রসের পরিমাণ কমে আসে। আম গাছে হপার পোকার আক্রমণ হলে অনুমোদিত কীটনাশক যেমন- সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ফাইটার ২.৫ ইসি প্রভৃতি প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ফাইটার ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করা প্রয়োজন। এ সময় আমে পাউডারি মিলডিউ ও এ্যান্থ্রাকনোজ রোগ দেখা দিতে পারে। টিল্ট, রিডোমিল গোল্ড, কানজা বা ডায়থেন এম ৪৫ অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
কাঁঠালের ফল পচা বা মুচি ঝরা সমস্যা এখন দেখা দিতে পারে। কাঁঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার বোর্দো মিশ্রণ বা মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
গ্রাফটিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করতে পারেন। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হবে এবং পরে উন্নত বরই গাছের বাডিং বা চোখ দেশি জাতের গাছে সংযোজন করতে হবে।
কলা গাছের পার্শ্ব চারা, মরা পাতা কেটে দিতে হবে। পেঁপের চারা রোপণ করতে পারেন এ মাসে। এসময় থেকে ফলগাছে নিয়মিত কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ও মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে। বাঁশঝাড়ে এ সময় নতুন চারা গজাবে। তাই বাঁশঝাড়ের গোড়ায় মাটি এবং গোবর বা আবর্জনা পচা সার দেওয়া প্রয়োজন।
সুপ্রিয় পাঠক, কৃষিকথায় প্রতি বাংলা মাসে কৃষি কাজে অনুসরণীয় কাজগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়। আরও বিস্তারিত ও তথ্য জানার জন্য আপনার নিকটস্থ কৃষি বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে পারেন। এ ছাড়াও কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করে জেনে নিতে পারেন। আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের শীর্ষে। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা, টেলিফোন: ০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল: editor@ais.gov.bd