কৃষি পেশাকে সম্মানজনক অবস্থায় পরিচিত করানোই মানিক রাজার আশা
মোঃ আবদুর রহমান
প্রতিটি পেশাকে কেন্দ্র করে উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব। একজন উদ্যোক্তা আত্মনির্ভরশীল হন এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন। কৃষিকে উদ্যোগ হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন। একজন কৃষি উদ্যোক্তার মূল লক্ষ্য বাজারজাতকরণ ও মুনাফা তৈরি। তাই একজন কৃষি উদ্যোক্তাকে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির হতে হয় এবং তার কাজে প্রচুর ঝুঁকি থাকে। বিপুল জনসংখ্যা, কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস, বেকারত্ব এ সবকিছুর ভিতরে একজন নব উদ্যোক্তা কৃষিকে প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করছেন। শিক্ষিত তরুণদের কৃষিক্ষেত্রে পরিকল্পিত উদ্যোগ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পেছনে ছুটবে, চাকরি করবে! চাকরি না করলে লেখাপড়া বৃথা এমন ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন একজন শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা মানিক রাজা। যশোর জেলার শার্শা উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামের মানিক ২০১৮ সালে পাকশিয়া আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর জীবিকার প্রয়োজনে মালয়েশিয়াতে শ্রমিক ভিসায় যান। ২০২১ সালে ছুটিতে দেশে এসে মহামারী করোনার প্রকোপে আর বিদেশে যাওয়া হয়নি। বন্ধুরা কেউ পড়াশোনা করছে কেউ চাকরি করছে আর তিনি বেকার হয়ে ঘুরছেন বিষয়টি তাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দেয়। এসময়ে নানান ব্যবসার কথা তার মাথায় আসে, কিন্তু বাকি/বকেয়া ও নানা সমস্যার বিষয়টি চিন্তা করে আর আগানো হয়ে ওঠেনি। তখন বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল বিভিন্ন উদ্যোক্তার কাহিনী তাকে বেশ প্রভাবিত করে, এবং কৃষি পেশাকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তার সেজ ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে উচ্চমূল্যের ফসল চাষের প্রতি আগ্রহী হন।
ক্যাপসিকাম চাষের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন প্রথম পর্যায়ে তিনি ফসলের বাজার মূল্যের প্রতি লক্ষ্য করেন। তখন তিনি দেখেন যে ক্যাপসিকামের মূল্য মৌসুমেই ১৫০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হয় এবং সেটি পরবর্তীতে ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ শত টাকা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি হয়। এর দাম সবসময়ই অন্য সবজির থেকে বেশি থাকে। তাছাড়া এটি বেশির ভাগই বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আমদানি হয়। এটিও চিন্তা করেন যে এ ফসল চাষে তিনি সফল হলে কিছুটা হলেও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে তাছাড়া কিছু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও তিনি করতে পারবেন। এসব দিক বিবেচনা করে তিনি ক্যাপসিকাম চাষের প্রতি আগ্রহী হন।
মানিক ২০২২ সালে নিজেদের পৈত্রিক আড়াই বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলক ক্যাপসিকাম চাষ করেন। এর মধ্যে ২০ শতক জমিতে লাকি মরিচ জাতের চাষ করেন। তিনি জানান, এটি বেশ আকর্ষণীয় মরিচ। এটি দেখতে সুন্দর এবং ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয় ও সব মৌসুমেই চাষ করা যায়। এটি আবাদে প্রথম বছর বেশ লাভবান হয়েছিলেন। এছাড়া ১ বিঘা জমিতে মালচিং পেপার ছাড়া ও বাকি জমিতে মালচিং পেপার দিয়ে ক্যাপসিকাম চাষ করেন। মালচিং পেপার বিহীনসহ ক্যাপসিকাম চাষে ভালো ফল পাননি কিন্তু যেটিতে মালচিং পেপার দিয়েছিলেন সেখানে ভালো ফল পেয়েছিলেন। তিনি মূলত আশা ও রেজোয়ান ভারতীয় জাতের ক্যাপসিকাম চাষ করেন। তার ভাই আবু সাঈদ আমদানি/রপ্তানির ব্যবসা করেন। তার মাধ্যমেই বিশ্বস্ত বীজ প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি এসব বীজ ক্রয় করে থাকেন।
তিনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানতে পারেন যে নেট হাউজ বা পলিনেটে এ ফসল চাষাবাদে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এছাড়া এটিও জানতে পারেন যে, থ্রিপস নামক পোকাটির হাত থেকে এ ফসলকে রক্ষা করতে নেট বা পলিনেটের কোন বিকল্প নেই। এ কারণে প্রথমেই ২ বিঘা জমিতে বাঁশের খুঁটি দিয়ে বাহিরে ৩-৪ জিআই নেট ও ভেতর পাশে দেশি নেট দিয়ে হাউজ নির্মাণ করেন। এতে শ্রমিক, মালামালসহ তার খরচ হয় প্রায় ৪ লক্ষ টাকা। এ বছর সবমিলিয়ে মোট ৬ লক্ষ টাকার ফসল তিনি বিক্রি করে ২ লক্ষ টাকা লাভবান হন। ফলে ফসলটি চাষে দারুণভাবে উৎসাহিত হন। ২০২২ সালের শেষ দিকে মানিক তার ভাইয়ের সহযোগিতায় ৯ বিঘা জমিতে নেট হাউজ নির্মাণ করেন। এর মধ্যে ২৫ শতক জমিতে পলিনেট হাউজ তৈরি করেন। এতে তার ব্যয় হয় ৩১ লক্ষ টাকা। ২০২৩ সালে মানিক এর থেকে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকার ফসল বিক্রি করেন। ফলে তার সম্পূর্ণ বিনিয়োগ উঠে লাভের মুখ দেখেন তিনি। মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে মানিক জানান, ক্যাপসিকাম চাষের গ্যাপ পিরিয়ডে স্কোয়াশ, বিট কপি, অফসিজন তরমুজসহ বিভিন্ন উচ্চমূল্যের ফসল চাষ করেন। এ ছাড়া ক্যাপসিকামের জমিতে তিনি রেস্ট পিরিয়ডে ধান ও ধৈঞ্চা বীজ বুনে দেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন ফলে এটি জৈবসারের কাজ করে। এ বাদেও তিনি টমেটো, ব্রোকলি, রঙিন বাঁধাকপি, শসা, বিটসহ যেসব সবজির উচ্চমূল্য পাওয়া যায় সেগুলোর চাষ করে থাকেন।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে তিনি বিভিন্ন সময়ে নানা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং ফসল চাষাবাদে প্রযুক্তি বিষয়ক পরামর্শ গ্রহণ করেন। তার একটি নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে যা দেখে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেকেই চাষাবাদ বিষয়ক নানান পরামর্শ গ্রহণ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক নতুন উদ্যোক্তা তার ফসলের মাঠ পরিদর্শন করেন। স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ এবং সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাগণ তার ফসল ক্ষেত পরিদর্শন করে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বলে মানিক রাজা জানিয়েছেন।
সম্প্রতি মানিক শেডের ভেতর ১০ শতক জমিতে পান চাষ করেছেন। এ প্রসংগে তিনি জানান, শেডের ভেতর যদি জিআই পিলার কিংবা ঢালাই পিলারের সাথে তারের ব্যবহারের মাধ্যমে পান চাষ করা যায় তাহলে বরজ দীর্ঘস্থায়ী হয় ও লাভের পরিমাণ বাড়ে। তিনি বলেন, তিন মাস বয়েসেই আমার শেডে পান পাতার যে আকার হয়েছে তাতে আমি ভীষণ খুশি ও পান চাষে আমি দারুণ অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। এভাবে চাষ করলে পান চাষে লাভের পরিমাণ অনেক বাড়বে। মানিকের ফসল চাষের বিনিয়োগ ও লাভের পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি বলেন বছরে প্রায় কোটি টাকার ফসল বেচাকেনা করেন তিনি।
যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিতে প্রযুক্তির বিস্তার ঘটেছে ও এর মাধ্যমে চাষাবাদে লাভের পরিমাণ বেড়েছে বলে জানান মানিক রাজা। তিনি ড্রিপ সেচ পদ্ধতি, পলি মালচিং, পলি নেট হাউজে চাষাবাদে নানা কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার করে থাকেন। রপ্তানিমুখী ও নিরাপদ ফসল উৎপাদনে এবং আধুনিক কৃষিকে এগিয়ে নিতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই বলে মনে করেন মানিক।
মানিক বলেন, কৃষিকে লাভজনক করতে হলে এলাকা ও সময়োপযোগী ফসল নির্বাচনের উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। চাকরির পেছনে না ছুটে বেকার সমস্যার জন্য প্রতিবাদ না করে নিজস্ব ধ্যান ধারণা ও সৎ সাহস নিয়ে সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। মানিক মনে করেন, টেকসই কৃষি কৃষকের জন্য লাভজনক, নিজে উদ্যোক্তা হলে তিনি কিছু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন।কৃষি পেশাকে সম্মানজনক অবস্থায় পরিচিত করানোই মানিক রাজার আশা।
গ্রামীণ কৃষি ক্ষেত্রে শিক্ষিত উদ্যোক্তা এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। (বিশেষ করে পণ্য সরবরাহ, আর্থিক লেনদেন, হাঁস-মুরগির খামার, গবাদিপশুর খামার, নার্সারি, ফুলের চাষ, মাশরুম চাষ, শুঁটকি, গরু মোটাতাজাকরণ ইত্যাদি)। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিমাণ দেশের সামগ্রিক বাজার চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট অপ্রতুল। এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। আমরা জানি, উচ্চফলনশীল ফসল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রেখে চলেছে। মূলত অধিক ফলন সম্ভাবনাসম্পন্ন বীজ, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন এবং সার সেচব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে সম্ভব হয়েছে এ উন্নয়ন।
বাংলাদেশ এখনো কৃষিনির্ভর। কৃষি খাতে দক্ষ উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে কৃষিকে আধুনিক ও সম্মানজনক পেশায় পরিণত করা আবশ্যক যাতে শিক্ষিত যুবকরা নির্দ্বিধায় এ পেশায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।
লেখক : এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, খুলনা। মোবাইলঃ ০১৯৪৩৫১৭৫০৬