তুলা ফসলের বহুমুখী ব্যবহার
ও অমিত সম্ভাবনা
১ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজা ২ড. মোঃ কামরুল ইসলাম ৩অসীম চন্দ্র শিকদার
বিশ^ব্যাপী তুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল এবং আন্তর্জাতিক শিল্প ফসল, যা বিশ^ব্যাপী ‘সাদা সোনা’ হিসেবে পরিচিত। অন্নের পরই বস্ত্রের অবস্থান। আর এই বস্ত্রের মূল উপাদান হল তুলা। বর্তমানে বাংলাদেশে তুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল এবং বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি শিল্প বস্ত্রশিল্পের প্রধান কাঁচা মাল। বস্ত্রশিল্প ছাড়াও তুলা ফসলের আরও নানাবিধ ব্যবহার বা উপযোগিতা রয়েছে যার অর্থনৈতিক গুরুত্বও কম নয়।
তুলাচাষ
বাংলাদেশে মূলত সমভূমি জাতের এবং সীমিত আকারে পাহাড়ী জাতের তুলার চাষ হয়ে থাকে। প্রধানত যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ অঞ্চলের বন্যামুক্ত সমভূমিতে এবং বন্যামুক্ত চরাঞ্চলে তুলা চাষ হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে পাহাড়ি অঞ্চলের সমতল ভূমিতেও সমভূমির জাতের তুলা চাষ হচ্ছে। যেহেতু তুলা একটি খরা ও লবন সহনশীল ফসল, তাই কম বৃষ্টি প্রবণ রাজশাহী ও রংপুরের বরেন্দ্র অঞ্চলে এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত ভূমিতে তুলা চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সমভূমি অঞ্চলে তুলাচাষ নির্ভরই আমাদের বস্ত্র শিল্প। বস্ত্র শিল্পের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তুলা চাষে আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল প্রয়োগ এবং নতুন নতুন চাষ এলাকা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। তুলা চাষের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো বাংলাদেশের নারীরা তুলা উৎপাদনে অধিক হারে অংশগ্রহণ করে থাকে; এর প্রধান কারণ তুলাচাষ কঠিন শ্রমঘন ফসল নয়। তুলাবীজ বপন, নিড়ানি, তুলা উঠানো কোন কঠিন কাজ নয়। বিশেষ করে গাছ থেকে তুলা উঠানো একটি ছেলে মেয়েদের জন্য আনন্দদায়ক কাজ।
ইতোমধ্যে দেশে উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের পাশাপাশি হাইব্রিড এবং বিটি কটন জাতের তুলাচাষ শুরু হয়েছে। বর্তমানে উচ্চফলনশীল জাতের তুলার ফলন বিঘা প্রতি ১২ থেকে ১৫ মন আর হাইব্রিড ও বিটি কটন জাতের তুলার ফলন বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ মন পর্যন্ত হয়ে থাকে, যার বাজার মূল্য বর্তমানে মন প্রতি (৪০ কেজি) ৩৯০০.০০ টাকা হিসেবে যথাক্রমে ৪৬,৮০০.০০ টাকা থেকে ৫৮,৫০০.০০ টাকা এবং ৫৮,৫৫০.০০ টাকা থেকে ৭৮,০০০ টাকা। সুতরাং তুলাচাষ একটি লাভজনক ফসল। এ ছাড়া তুলার সাথে স্বল্পমেয়াদী সাথী ফসল চাষেরও সুযোগ আছে, আর নিয়মিত তুলা চাষে জমি উর্বর হয়।
তুলা ফসলের বহুমুখী ব্যবহার
তুলার মুখ্য ব্যবহার আমাদের বস্ত্র শিল্পে। তুলা দিয়ে সুতা, কাপড় এবং পোষাক প্রস্তুত করা হয়; যা থেকে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এ ছাড়া তুলা ফসলের আরো গুরুত্ব পূর্ণ ব্যবহার রয়েছে। নি¤েœ সেসব নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
তুলাবীজ : বীজতুলা জিনিং-এর পর আঁশ এবং বীজ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে চাষকৃত তুলার জিওটি সাধারণত ৪০% অর্থাৎ ১০০ কেজি বীজতুলা থেকে ৪০ কেজি আঁশ এবং ৬০ কেজি বীজ পাওয়া যায়। এই আঁশই বস্ত্র শিল্পের প্রধান কাঁচা মাল। এই আঁশ থেকে সুতা কাটার পর অবশিষ্ট তুলা লেপ তৈরিসহ আরও অনেক কাজে ব্যবহার হয়। তুলা বীজের গায়ে লেগে থাকা আঁশকে ফাঁজ বলা হয়। এই ফাঁজ থেকে বিভিন্ন ডাক্তারি তুলা প্রস্তুত করা হয়। যেমন-অস্ত্রোপচারের ব্যান্ডেজ, মেডিকেল তুলা, গজ ইত্যাদি।
তুলাবীজের তেল : বীজতুলা থেকে প্রাপ্ত তুল বীজের বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। কুষ্টিয়ায় ১৬টি জিনিং ফ্যাক্টরি রয়েছে, যেখানে জিনাররা জিনিং মেশিনের সাহায্যে বীজতুলা থেকে আঁঁশ ও বীজ আলাদা করেন। সুতা তৈরির জন্য আঁশ পাঠানো হয় স্পিনিং মিলগুলিতে। আর তুলাবীজ থেকে মেশিনে পিষে অপরিশোধিত তেল ও খৈল উৎপান করা হয়। কুষ্টিয়ায় তুলাবীজ থেকে অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের কয়েকটি কারখানা রয়েছে। বছরে সেখানে প্রায় ৫০০ টন অপরিশোধিত তুলাবীজের তেল উৎপাদন হয়, যা উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বীজ থেকে ১৮ থেকে ২০ ভাগ তেল পাওয়া যায়। অবশ্য এটি তুলাবীজের আকার, বীজের ওজন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। এই তেল সাধারণত সাবান তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ঐ তেল পরিশোধন করে খাবার উপযোগী করার জন্য রয়েছে আলাদা একটি কারখানা।
তুলাবীজের তেলে গসিপল নামক বিষাক্ত পদার্থ থাকে, যা মানব দেহের জন্য বিপজ্জনক কিন্তু প্রাকৃতিক পোকামাকড়ের বিরোধ্যে কাজ করে। গসিপল হল একটি বিষাক্ত হলুদ পলিফেনলিক যৌগ যেটি তুলা সহ ম্যালভেসি বর্গের উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রজাতির দ্বারা উৎপাদিত হয়। তাই তুলাবীজের তেল কীটনাশক প্রস্তুতে ব্যবহার হয়ে থাকে।
তবে এই তেল খাবার উপযোগী করার জন্য তেলের মধ্যে বিষাক্ত গসিপল সরিয়ে ফেলার জন্য পরিশোধন করে নিতে হয়। এই পরিশোধনের মূল ধাপ ব্লিচিং এবং দুর্গন্ধমুক্তকরণ। পরিশোধিত তেল একটি সুস্বাদু উদ্ভিজ্জ তেল যার রং হালকা হলুদ বা হালকা সোনালি রঙের হয়ে থাকে। তবে রং নির্ভর করে পরিশোধনের পরিমাণের উপর। রিফাইনারিতে ১০০ কেজি অপরিশোধিত তেল থেকে ৭৮ থেকে ৮০ কেজি পরিশোধিত তেল উত্তোলন করতে পারে। এই তেল সয়াবিন তেলের চাইতেও পুষ্টিকর। তুলাবীজের তেলে কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন, খনিজ, লেসিথিন, স্টেরল প্রভৃতি রয়েছে যা মানবদেহের জন্য আবশ্যক। এ ছাড়া তেলে প্রচুর মানবদেহের প্রয়োজনীয় অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড (৭০%) থাকে, যা মানবদেহে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে এবং ভালো কোলেস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া তেলে প্রচুর লিনোলিক অ্যাসিড থাকায় মানব দেহে খারাপ কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে কার্যকর ভাবে বাধা দেয় এবং মানব দেহের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে। তুলাবীজের তেল বাংলাদেশে ভোজ্যতেল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তুলাবীজের খৈল : তুলাবীজের খৈল উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ। তুলাবীজের খৈলে রয়েছে ২৪ শতাংশ প্রোটিন ও ২০ শতাংশ ফ্যাট, যা গবাদিপশু ও মৎস্য খাদ্যের জন্য উৎকৃষ্ট। এছাড়া জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে তুলাবীজের খৈল ব্যবহার করা হয়।
তুলাগাছ : তুলাগাছ গ্রাম্য পারিবারিক জ¦ালানির একটি ভালো উৎস। বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ মন জ¦ালানি পাওয়া যায়, যা দিয়ে একটি পরিবারের ছয় মাসের জ¦ালানির চাহিদা মেটে। এছাড়া শুকনো তুলা গাছ কাগজ শিল্পেও ব্যবহার করা হয়। তুলা গাছের পাতা এক সময় গাছ থেকে ঝড়ে পরে। এ পাতা মাটিতে মিশে মাটিতে জৈবসারের যোগান দেয়। তুলা গভীরমূলী ফসল বিধায় মাটির উপরিভাগের খাদ্য অব্যবহৃত থেকে যায়, তুলাগাছ মাটির গভীর হতে খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। ফলে তুলা পরবর্তী ফসলের চাষে বাড়তি সার প্রয়োগের তেমন প্রয়োজন হয় না। অনুর্বর জমিতে নিয়মিত তুলাচাষ করলে জমি উর্বর হয়।
বাংলাদেশে তুলাচাষের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো গ্রামের নারীদের অংশ গ্রহণ। এতে বাড়তি শ্রম দেশের অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। এ ছাড়া তুলা ফসলের মত এত বহুমুখী ব্যবহার বা উপযোগিতা অনেক ফসলেই নাই। তাই তুলাচাষ আমাদের অর্থনীতি এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ। এই লাভ জনক এবং বহুমুখী ব্যবহার যোগ্য তুলা ফসলটি কৃষক ভাই ও বোনদের যতেœর সঙ্গে চাষ করা উচিত। এতে আমাদের অর্থনীতি যেমন উপকৃত হবে তেমনি দৈনন্দিন বিভিন্ন চাহিদাও পূরণ হবে সেই সাথে তুলা উৎপাদনকারী কৃষকের লাভ উত্তর উত্তর বৃদ্ধি ঘটবে।
॥ দেশের মঙ্গল তুলা চাষে-বস্ত্রশিল্প তুলার আঁশে ॥
লেখক : ১ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজা, মৃত্তিকা উর্বরতা ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। ২ড. মোঃ কামরুল ইসলাম, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। ৩অসীম চন্দ্র শিকদার, কটন ইউনিট অফিসার (অব:) তুলা উন্নয়ন বোড, তুলা ভবন, কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৫৫২-৩৬২৯০১, ১০৪/১ (বি-২), শেরেবাংলা রোড (কাটাসুর), জাফরাবাদ, মোহাম্মদপুর-১২০৭। ইমেইল :asim,cdb@gmail.com