মুগডালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
এবং চাষাবাদ পদ্ধতি
ড. এম. মনজুরুল আলম মন্ডল
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র। এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি স্বল্পতা দূর করতে, মাটির হারানো উর্বরশক্তি ফিরে পেতে, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে মুগ চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। এ দেশের সাধারণ গরিব মানুষের পক্ষে প্রাণিজ আমিষের উৎস মাছ এবং মাংস ক্রয় করা বেশ ব্যয়বহুল এবং কষ্টসাধ্য। অপরদিকে তুলনামূলভাবে ডাল ফসলের মূল্য কম এবং সহজলভ্য। তাই সাধারণ গরিব মানুষ তাদের আমিষ ঘাটতি ডাল হতে পুষিয়ে নিতে পারে বলে ডালকে গরিবের মাংস বলা হয়।
মানুষের খাদ্য তালিকায় আমিষের উৎস হিসেবে মুগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অঙ্কুরিত মুগডাল ভিটামিন সি এর কার্যকরী উৎস। ডাল ফসল জমিতে জৈবসার এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ করে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। মুগডাল চাষে জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ে হেক্টরপ্রতি ২৫-৬৩ কেজি। সুতরাং শস্যপর্যায়ে মুগডাল জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ডালজাতীয় ফসলের মধ্যে একমাত্র মুগডালের জীবনকাল সবচেয়ে কম, মাত্র ৭০-৭৫ দিন, যা অন্যান্য ডালজাতীয় ফসল যথা- মসুর, খেসারি ও ছোলা থেকে প্রায় একমাস আগে পাকে ফলে তিন ফসল ও চার ফসল শস্যবিন্যাসে সহজেই মুগডাল অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। মুগডাল চাষাবাদে খরচ অন্যান্য ডাল ফসলের চেয়ে অনেক কম। দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের ৪ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর জমি শুষ্ক মৌসুমে আমন ধান কাটার পরে অনাবাদি থাকে। অর্থাৎ ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আমন ধান কাটার পর এই বিশাল পরিমাণ জমি ৫-৬ মাসেরও বেশি সময় পতিত থাকে। মুগডাল খরা সহিষ্ণু ফসল বিধায় মুগ ফসল চাষাবাদে সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় সহজেই এ সকল পতিত জমিতে মুগডাল চাষাবাদ করে কৃষক অর্থনৈতিক লাভবান হবে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গম কাটার পর থেকে আমন ধান রোপণের পূর্ব পর্যন্ত অধিকাংশ জমি পতিত থাকে। কিন্তু মুগ চাষের মাধ্যমে অতি সহজেই এসব পতিত জমি ব্যবহার করা সম্ভব। দেশে মোট ডাল ফসলের মধ্যে ৮০% ডাল ফসল রবি মৌসুমে চাষ হয়। ফলে রবি মৌসুমে চাষকৃত অন্যান্য ফসল যথা- ধান, গম, ভুট্টা ও সবজি এর সাথে শীতকালে চাষকৃত ডাল ফসল (মসুর, মটর, ছোলা, খেসারি) প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে শীতকালীন ডাল ফসলের চাষাবাদ এলাকা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। অপরদিকে এক মাত্র মুগডাল খরিফ-১ (ফাল্গুন-চৈত্র-বৈশাখ) মৌসুমে চাষ করা হয়। এই সময়ে স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন শীতকালীন ফসল (সরিষা, আলু, গম, মসুর, ছোলা, গাজর, পাতাকপি, ফুলকপি, লেটুস, মুলা ইত্যাদি) মাঠে থাকে না এবং ঐ জমি আমন ধান লাগানোর আগ পর্যন্ত পতিত থাকে। জমিতে সহজেই মুগডাল চাষ করা সম্ভব। এছাড়া মুগডালের বাজারমূল্য অন্যান্য যে কোন ডালের চেয়ে (মাষকলাই ব্যতীত) বাজার মূল্য বেশি (১৫০-১৭০ টাকা/কেজি), ফলে কৃষক মুগডালের চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হবেন। এছাড়া মুগডাল খেলে হজমেও সমস্যা হয় না। এতে ফ্যাট বা কার্বোহাইড্রেট একদমই থাকে না বলে এটি ওজন কমাতেও বেশ সাহায্য করে। বিভিন্ন সমস্যায় মসুর ডাল এড়িয়ে যেতে বলা হলেও, মুগডাল এড়িয়ে চলার কথা বলা হয় না।
মুগডালের উন্নত জাত
এ যাবত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ০৯টি, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৩টি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ০৪টি মুগডালের মোট ২৬টি স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। তন্মধ্যে বারিমুগ-৬ এবং বিনামুগ-৮ সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত। তবে জাত দুইটি অনেক পুরাতন জাত, ফলে পোকা ও রোগ বালাইয়ের আক্রমণ বেশি হচ্ছে বিধায় কৃষিবিদগণ বারি উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন উচ্চফলনশীন জাত বারিমুগ-৭ ও বারিমুগ-৮ এবং বিনা উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন উচ্চফলনশীন জাত বিনামুগ-১১ ও বিনামুগ-১২ চাষ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। বারিমুগ-৮ এর বীজ ছোট ও আকর্ষণীয় রঙের বিধায় ক্রেতার চাহিদা বেশি এবং অধিক লাভের জন্য বারিমুগ-৮ চাষ করার জন্য উত্তম।
চাষাবাদ পদ্ধতি ও চাষের জন্য উপযুক্ত অঞ্চল
দক্ষিণাঞ্চল
বিলম্ব রবি : বৃহত্তর বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলে মাঘ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত (জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত) মুগের বীজ বপন করে থাকে। বর্তমানে মোট মুগডালের ৮৩% এ অঞ্চলে উৎপাদিত হয়ে থাকে।
উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল
খরিফ ১ : বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া ও রাজশাহীর বিভাগের পাবনা, নাটোর ও রাজশাহী জেলায় ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত (ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত) মুগের বীজ বপন করে থাকে।
দক্ষিণা-পশ্চিমাঞ্চল
খরিফ-২ : খুলনা জেলার উত্তরাঞ্চল ও বৃহত্তর যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায় শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে আশ্বিন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত (আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত) সোনা মুগের বীজ বপন করে থাকে। বর্তমানে খরিফ-২ মৌসুমে মুগের চাষ খুবই সীমিত।
মাটির ধরন
সব ধরনের মাটিতেই মুগডাল চাষ করা যেতে পারে। সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ মাটিতে এই ফসল ভাল জন্মে থাকে।
জমি তৈরি
জমির অবস্থাভেদে ২-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। শীতকালীন ফসল তোলার পর মুগ চাষের জন্য ১-২টি চাষই যথেষ্ট তবে পতিত জমির জন্য ৩-৪টি চাষ লাগে। জমিতে পানির অভাব হলে বীজের অঙ্কুরোদগমের সুবিধার জন্য একটি হালকা সেচ দেয়া প্রয়োজন।
সার প্রয়োগ
জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে সারের মাত্রার তারতম্য করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সার সুপারিশমালা অনুসরণ করতে হবে। তবে সাধারণভাবে একরে ১২-১৫ কেজি ইউরিয়া, ২৮-৩০ কেজি টিএসপি, ১৫-২০ কেজি এমওপি ও ১৫ কেজি জিপসাম সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা যেতে পারে। দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একর প্রতি ৩-৪ কেজি বরিক এসিড শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে।
বপন পদ্ধতি ও বীজের পরিমাণ
মুগ কালাই সাধারণত ছিটিয়ে বপন করা হয়। বপনের পর ভালভাবে মই দিয়ে বীজগুলো ঢেকে দিতে হবে। তবে সারিতে বপন করলে ব্যবস্থাপনায় সুবধিা হয় ও ফলন বেশি হয়। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি হতে হবে। একরে ১০-১২ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
আগাছা দমন
চারা গজানোর পরে জমিতে আগাছা দেখা দিলে ১৫-২০ দিন পর নিড়ানি দিয়ে হালকাভাবে আগাছাগুলো পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। এতে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
পানি সেচ
মুগকালাই চাষাবাদের জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় পানি সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে জমিতে অত্যধিক পানির অভাব হলে একবার সেচ দেয়া বাঞ্ছনীয়। এতে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
রোগ ও পোকামাকড় দমন
মুগে যেসব রোগ হয়, তার মধ্যে হলুদ মোজাইক ভাইরাস, পাতায় দাগ ও পাউডারি মিলডিউ বেশি ক্ষতিকারক। তবে মুগের আধুনিক জাতগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন। মোজাইক ভাইরাস রোগ দেখা দেয়া মাত্র গাছ উপড়ে ফেলতে হবে। পাতায় দাগ রোগের আক্রমণ হলে ব্যাভিস্টিন বা ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২বার স্প্রে করতে হবে। পাউডারি মিলডিউ রোগ হলে টিল্ট-২৫০ ইসি. ০.৫ মিলি. বা থায়োভিট ২ গ্রাম প্রতি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করতে হবে।
মুগে যেসব পোকার আক্রমণ হয়, তাদের মধ্যে জাবপোকা, সাদামাছি, বিছাপোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা এবং থ্রিপস বেশি ক্ষতিকারক। জাবপোকার আক্রমণে প্রতিরোধক হিসেবে প্রতি লিটার পানিতে সুমিথিয়ন বা মেলাথিয়ন ২.০০ মিলি. ওষুধ মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বিছা পোকার আক্রমণ হলে গাছের পাতার নিচের দিকে ডিম পাড়া অবস্থায় বা ডিম থেকে শুঁককীট বের হয়ে চলাচল শুরু করার আগেই আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পা দিয়ে চেপে মেরে ফেলতে হবে। থ্রিপস ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হলে সাইপার মেথ্রিন গ্রুপের যেমন রিপকর্ড ১০ ইসি প্রতিলিটার পানিতে ১.০ মিলিলিটার ওষুধ মিশিয়ে ছিটিয়ে দিলে এ পোকা সহজে দমন করা যায়।
ফসল সংগ্রহ, মাড়াই ও সংরক্ষণ
মুগকালাই এর শুটি ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা খুবই অসুবিধাজনক। কারণ দেশে যে সকল প্রচলিত জাত আছে সেগুলোর ফল একসাথে পাকে না বিধায় কয়েকবার সংগ্রহ করতে হয়। শুঁটি বা পড বাদামি বা কালচে রঙ ধারণ করলে বুঝতে হবে মুগ পরিপক্ব হয়েছে। তখন পরিষ্কার সূর্যালোকের দিনে মুগের ফল সংগ্রহ করে শুষ্ক ও পরিষ্কার স্থানে রৌদ্রে শুকিয়ে মাড়াই করতে হবে। প্রথমবার ফল/গুটি সংগ্রহের পর ৮-১২ দিন পর দ্বিতীয়বার গুটি সংগ্রহ করে ভালভাবে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বীজ সংগ্রহ করতে হয়। এ পর বীজগুলো পরিষ্কার করে এবং ভালভাবে রৌদ্রে শুকিয়ে মাটি বা টিনের পাত্রে মুখ বন্ধ করে সংরক্ষণ করা হলে অনেকদিন পর্যন্ত বীজ ভাল থাকে।
লেখক : চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইল : ০১৭১৬৭৪৯৪২৯