Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সূচিপত্র
সূচিপত্র
নিবন্ধ/প্রবন্ধ
খাদ্যের অধিকার নিশ্চিতে টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনা ৩
মো: ছাইফুল আলম
 পুষ্টি নিরাপত্তার অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ৫
ড. নাজমুন নাহার করিম
 সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য চালভিত্তিক সুষম খাদ্যের অধিকার ৭
কৃষিবিদ ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান,  কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন
 বৈশি^ক খাদ্য অপচয় ও নষ্ট হওয়া রোধে কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজন ৯
ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী, মো. হাফিজুল হক খান
 খাদ্য-পুষ্টি নিরাপত্তায় আন্তঃফসল ও সাথীফসলের চাষ ১১
ড. মো. আলতাফ হোসেন
 সুস্বাস্থ্যে পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য ১৩
তাসনীমা মাহজাবীন
 গমের আধুনিক জাতসমূহ ও উৎপাদন  কৌশল ১৪
ড. মোহাম্মদ রেজাউল কবীর
 তেলজাতীয় ফসল সরিষার গুরুত্ব এবং চাষাবাদ পদ্ধতি ১৬
ড. মোছাঃ খাদিজা খাতুন
 ফসলের আইলে পাট জাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি ১৯
ড. মোঃ বাবুল হোসেন
 শীতকালীন সবজি ও ফুল চাষ ২১
কৃষিবিদ সিলমিন জাহান ইলমা
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ
 নিরাপদ মাছ উৎপাদনে মৎস্য অধিদপ্তর ২৩
মোঃ জিল্লুর রহমান
 দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণিসম্পদ খাত ২৫
ড. হোসেন মোঃ সেলিম
আগামীর কৃষি ভাবনা
 পুষ্টি নিরাপত্তায় এবং শিল্প সম্ভাবনায় ভুট্টা ফসল ২৭
কৃষিবিদ ড. মোহাম্মদ মোবারক হোসেন
নিয়মিত বিভাগ
 প্রশ্নোত্তর ৩০
কৃষিবিদ ড. আকলিমা খাতুন
 অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি (১৬ নভেম্বর-১৫ ডিসেম্বর) ৩২
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
বিস্তারিত
সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

খাদ্য প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার সব মানুষের ক্ষুধা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং অপুষ্টি থেকে মুক্ত থাকার অধিকারকে রক্ষা করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) পৃথিবীর সব মানুষের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জোগান নিশ্চিতকরণ, পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ এবং দরিদ্রতার মূলোৎপাটন করে ক্ষুধামুক্ত নির্মল পৃথিবী গড়ার কাজে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং ১৯৪৫ সাল থেকে ১৬ অক্টোবরকে বিশ^ খাদ্য দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। প্রতিবারের মতো এবারও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কৃষি মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৪। ১৯৮১ সাল থেকে বিশ^ খাদ্য দিবস প্রতিপাদ্যভিত্তিক পালিত হয়ে আসছে। এ বছর প্রতিপাদ্য Right to foods for a better life and a better future  এর ভাবার্থ  উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার । যা বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সময়োপযোগী ও অর্থবহ। 
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির বাস্তবতায় খাদ্য নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কৃষিই দারিদ্র্যহ্রাসকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রযাত্রার নিয়ামক। কৃষি জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চয়তা প্রদান করে। এ ছাড়াও কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল সরবরাহ করে। দেশ আজ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ফসলের পাশাপাশি প্রাণিজ আমিষ খাতেও সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ^ব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক মন্দা, বৈষম্য এবং মহামারী চ্যালেঞ্জগুলোর প্রেক্ষাপটে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায়  বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদন শুরু থেকে খাবারের টেবিল পর্যন্ত খাদ্যের নিরাপদতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একই সাথে বিজ্ঞানমনস্ক খাদ্যাভ্যাসেও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য অপচয় রোধের বিকল্প নেই।  
প্রিয় পাঠক, বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৪ উপলক্ষ্যে মাসিক কৃষিকথার বিশেষ সংখ্যা মুদ্রণ করা হচ্ছে। কৃষিকথা বিশেষ সংখ্যায় দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে মানসম্পন্ন ও তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধ সংযোজন করা হয়েছে। এ ছাড়াও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের কৃষিকথা। যারা এসব লেখা দিয়ে কৃষিকথা সমৃদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আশা করি তথ্য সংবলিত লেখাগুলো বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যের সফল বাস্তবায়নে একসাথে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করবে।

বিস্তারিত
খাদ্যের-অধিকার-নিশ্চিতে-টেকসই- কৃষি ব্যবস্থাপনা

খাদ্যের অধিকার নিশ্চিতে টেকসই 
কৃষি ব্যবস্থাপনা
মো: ছাইফুল আলম
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রধান মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য। তাই সুস্থ সবল ও উন্নত জাতি গঠনে খাদ্যের অধিকার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অন্যদিকে খাদ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক মানবাধিকার যা ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৫/১ ধারায় প্রত্যেক মানুষের খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণার আলোকে ১৯৬৬ সালে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে খাদ্য অধিকারকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বিশাল পৃথিবীর সব মানুষের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পুষ্টিহীনতা দূর ও দরিদ্রতার মূলোৎপাটন করে ক্ষুধামুক্ত নির্মল পৃথিবী গড়ার কাজে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবাযু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ খাদ্য সুরক্ষা এবং কৃষির বিভিন্ন দিকগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য “উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার” নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ উদ্যোগে বিশ্বের অন্যান্য সদস্য দেশের মতো বাংলাদেশও ১৬ই অক্টোবর ২০২৪ তারিখে বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন করতে যাচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 
বর্তমানে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও কৃষিজমির ক্রমহ্রাসমান অবস্থার সাথে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রতিকূলতা আমাদের কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এমন বাস্তবতায় ১৮ কোটি মানুষের নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য যোগান নিশ্চিত করার পাশাপাশি কৃষিতে নিয়োজিত মানুষের জীবনমান বৃদ্ধি করা সরকারের অঙ্গীকার। এছাড়া দেশে উদ্ভাবিত ফসলের নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। সে লক্ষেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সেই সাথে খাদ্যের স্থায়িত্বশীলতা অর্থাৎ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাদ্যের অধিকার ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। 
টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনা মূলত চাষের একটি পদ্ধতি যা                 কৃষকদের জন্য পরিবেশবান্ধব, সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ এবং অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর উপায়ে খাদ্য উৎপাদনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার মূল দিকগুলো হলো:
উত্তম মাটি ব্যবস্থাপনা : মাটির উর্বরতা শক্তি ও উৎপাদনশীলতা রক্ষা করতে মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে ফসলে সময়মতো এবং নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে মাটিতে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।  বিভিন্ন ফসলের গাছের মূল মাটিতে বিভিন্ন গভীরতায় প্রবেশ করার কারণে মাটির বিভিন্ন স্তর থেকে খাদ্য উৎপাদন অপসারিত হয়। তাই মাটির উর্বরতা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে রাখতে পর্যায়ক্রমিক ফসলের চাষ করতে হবে। এই শস্যচক্রে শিমজাতীয় একটি ফসল চাষ করলে বায়ুম-লের মুক্ত নাইট্রোজেন শিকড়স্থিত নডিউল ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে মাটিতে যুক্ত হয়। মাটির সংরক্ষণ ও ক্ষয়রোধ করতে আচ্ছাদন জাতীয় ফসলের চাষ, বায়ু রোধকারী বৃক্ষ রোপণ, ফালি চাষ, মালচিং এবং জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করা যায়। উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন প্রযুক্তিতে উৎপাদিত জৈবসার ফল, শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়ামের সঙ্গে অণুখাদ্যের জোগান দেয়। মাটিতে বিদ্যমান খাদ্যসামগ্রী ও সারের মাধ্যমে প্রয়োগকৃত উপাদানগুলো ফসলের গ্রহণযোগ্য পর্যায় তৈরির জন্য চাহিদা অনুসারে সময়মতো ও পরিমিত পানি সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। সঠিক নিয়মে সুপারিশকৃত মাত্রায় ডলোচুন ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির অম্লত্ব দূর করা যায়। 
উত্তম ফসল ব্যবস্থাপনা :  ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ফসলের বীজবপন অথবা চারা রোপণের পর থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত সকল পর্যায়ে আধুনিক চাষ প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে উত্তম ও নিরাপদ ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা অতীব জরুরি। বর্ধিত ফসল উৎপাদন করার জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের ফসল এবং পরিবেশবান্ধব ও অর্থসাশ্রয়ী আধুনিক লাগসই প্রযুক্তিগুলো মাঠপর্যায়ে অতি দ্রুত সম্প্রসারণের কাজ চলমান রয়েছে। উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে শ্রমিক স্বল্পতার অভাব দূর করা  ছাড়াও জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে আকস্মিক বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের ফলে শস্যহানির ঝুঁকি এড়াতে যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য। হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ ও অবশিষ্ট এলাকায় ৫০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তা/ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কম মূল্যে পাওয়ার টিলার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, রিপার, কম্বাইন হারভেস্টার, পাওয়ার টিলারচালিত সিডার, পাওয়ার থ্রেসার ও ফুটপাম্প কৃষি যন্ত্রপাতি প্রদান করা হচ্ছে। বিভিন্ন কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কর্মসূচির ফলে দেশে কৃষি জমি চাষে ৯০%, আগাছা দমনে ৬৫%, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০%, সেচকার্জে ৯৫% এবং ফসল মাড়াইয়ের কাজে ৭০% যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। একক জমিতে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে একফসলি জমিতেও সারাদেশে আবাদ হচ্ছে গড়ে দুটি ফসল। এলাকাভেদে এ চাষাবাদ গড়িয়েছে তিন থেকে চার ফসলেও। এতে দেশে বর্তমানে ফসলের নিবিড়তা বেড়ে হয়েছে ২১৪ ভাগ (কৃষি শুমারি-২০০৯,বিবিএস-২০২২)। এছাড়াও ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি এবং বহুমুখী শস্য আবাদ এলাকা বৃদ্ধি করতে অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। দেশের সার্বিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে অনাবাদি পতিত জমিকে চাষের আওতাভুক্ত করতে সারা বছর বসতবাড়ির আঙ্গিনায় শাকসবজি এবং মসলাজাতীয় ফসল ও ফলফলাদি চাষের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। উদ্যান ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ বছরব্যাপী প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের উৎপাদন বাড়াতে সমতল ও পাহাড়ি জমি এবং উপকূলীয় ও অন্যান্য অঞ্চলের অব্যবহৃত জমি চাষের আওতায় আনা হচ্ছে। পাশাপাশি বসতবাড়ির পতিত জমিকে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের অন্তর্ভুক্ত করায় বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে।
উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) অনুসরণ করে মানসম্মত আমের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততাসহিষ্ণু ফসলের উপযুক্ত জাত, বিস্তৃত অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্যান ফসলের চাষ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভাসমান চাষ, বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন, মানসম্মত বীজ, যথাযথ মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, জৈবসার ও জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা, কৃষিতাত্ত্বিক পরিচর্যা এবং সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিভিন্ন ফসলের গড় ফলন পার্থক্য হ্রাস করাসহ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তাছাড়া কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাত শিল্প স্থাপনে এবং এর বিপণনে কৃষকদের বিশেষ সহায়তা প্রদানের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
উত্তম পানি ব্যবস্থাপনা : মাটিতে ফসলের সুষম বৃদ্ধির জন্য, সেচ বা নিষ্কাশনের মাধ্যমে মাটিস্থ পানিকে গাছের জন্য সহজলভ্য করা, মাটির লবণাক্ততা হ্রাস ও আগাছা নিয়ন্ত্রণে সঠিক উপায়ে পানি ব্যবস্থাপনা জরুরি।  গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, বেড পদ্ধতিতে ফসল চাষে ৪২ ভাগ সেচ পানি সাশ্রয় হয়। ধানের ফলন ২০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধিসহ ১৮-২০ ভাগ ইউরিয়া সার কম লাগে। টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থাপনার জন্য ভূগর্ভস্থ পানির সংরক্ষণ এবং ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি ও রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্রযুক্তি সম্প্রসারণ হচ্ছে। পাশাপাশি সেচ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, সেচ দক্ষতা বৃদ্ধি, সেচপানির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও সেচপাম্প চালনায় সৌরশক্তি ব্যবহারসহ যৌথভাবে সার ব্যবস্থাপনার কাজ চলমান রয়েছে। সে সাথে সার্বিকভাবে সব উপকরণ ব্যবহারের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য  মাঠপর্যায়ে সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। মাটির উৎপাদনশীলতা উন্নয়নের জন্য আধুনিক পানি সাশ্রয়ী বিভিন্ন চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তার মধ্যে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের জন্য একটি লাভজনক সেচ পদ্ধতি  হলো ফার্টিগেশন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে কেবলমাত্র পানিতে দ্রবণীয়  রাসায়নিক সার যেমন-ইউরিয়া, পটাশ (প্রতি ১৪০ লিটার পানিতে ১ কেজি) পানিতে মিশিয়ে একই সঙ্গে সার প্রয়োগ ও সেচের কাজ করা যায়। সেচ সঙ্কট এলাকা, লবণাক্ত অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় রাসায়নিক সার মিশ্রিত ড্রিপ সেচ পদ্ধতি অত্যন্ত উপযোগী। ফুল, ফল ও ফসলের জমিতে সরাসরি রুট জোনে পানি পৌঁছে দিতে আধুনিক স্প্রিংলার ইরিগেশন ব্যবস্থায় পানি সেচ একটি দক্ষ সেচ পদ্ধতি। 
উত্তম বালাই ব্যবস্থাপনা : ক্ষতিকর পোকা ও কীটপতঙ্গের আক্রমণের কারণে বার্ষিক ফলন হ্রাস ধানের ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ, গমের জন্য ১১ শতাংশ, আখের ২০ শতাংশ, সবজির জন্য ২৫ শতাংশ, পাটের জন্য ১৫ শতাংশ এবং ডাল ফসলের জন্য ২৫ শতাংশ হয়ে থাকে। জৈবসার প্রয়োগ ও জৈব কীটনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন খরচ শতকরা ২৫-৩০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব। ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (আইপিএম) বা সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রযুক্তি। আইপিএম দেশের কৃষক, নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচুর সচেতনতা তৈরি করেছে। জাতীয় কৃষি নীতি (ন্যাপ) ধারা ৭.১-এর অধীনে নির্ধারণ করেছে যে কীট এবং রোগ নিয়ন্ত্রণে আইপিএমই হবে মূলনীতি। আইপিএম গ্রহণের ফলে উপকারী পোকামাকড়, মাছ, ব্যাঙ, পশু, পাখি ও গুইসাপ প্রভৃতি সংরক্ষণ করা যায়, কীটনাশকের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় এবং যথেচ্ছ ব্যবহার না হওয়ায় উৎপাদন খরচ কমে ফলে কৃষক অধিক লাভবান হয়। এ ছাড়া বালাইনাশকের পরবর্তী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রোধ করা সম্ভব হয়।
জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি নিরসনে চলমান কৃষি উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে টেকসই কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ এবং কৃষিপণ্যের আধুনিক বাজারজাতকরণ ও বিপণনের মাধ্যমে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে কৃষককে লাভবান করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হ্রাস ও পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণ, বাণিজ্যিক কৃষিতে কৃষকের দক্ষতা বৃদ্ধি, কৃষকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত, তরুণ উদ্যোক্তাদের কৃষির মূলধারায় অন্তর্ভুক্তকরণ এবং বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন কৌশল অনুসরণের মাধ্যমে কৃষিকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব।

লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। ফোন : ০২৫৫০২৮৩৭০, ই-মেইল : dg@dae.gov.bd 

বিস্তারিত
পুষ্টি-নিরাপত্তার-অগ্রযাত্রায়-বাংলাদেশ- কৃষি-গবেষণা-কাউন্সিল

পুষ্টি নিরাপত্তার অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ 
কৃষি গবেষণা কাউন্সিল 
ড. নাজমুন নাহার করিম
পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক। স্বাস্থ্যের সাথে পুষ্টি আর পুষ্টির সাথে খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নও অবিচ্ছেদ্য। সুস্থ, সবল ও  মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে পুষ্টিসম্মত নিরাপদ খাদ্যের কোনো বিকল্প নাই। দেহের গঠন, বৃদ্ধি ও শক্তি উৎপাদনসহ দেহকে রোগ সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে খাদ্য। সুস্থ সবল দেহের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান গ্রহণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান নিশ্চিত করা খাদ্য গ্রহণের অন্যতম লক্ষ্য। এই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ অত্যাবশ্যক। মানবজাতির অস্তিত্বেও প্রশ্নে খাদ্যের অপরিহার্যতা, ব্যাপ্তি, সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রতি বছর ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ পালন করে আসছে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশও প্রতি বছর ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ পালন করে থাকে। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য- ‘জরমযঃ ঃRight to foods for a better life and a better future অর্থাৎ ‘উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার’ যা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও যথার্থ।       
স্বাধীনতার সময় ১৯৭০ সালে এ দেশে দানাজাতীয় খাদ্যশস্যের (ধান ও গম) মোট উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১৯ লক্ষ টন। তখন প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য খাদ্য জোগানে ঘাটতি ছিল। বর্তমানে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৮৭ লক্ষ টন। দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পর থেকে দেশের মানুষ বেড়েছে প্রায় ২.২৫ গুণ, সেইসাথে খাদ্যশস্য উৎপাদনও বেড়েছে প্রায় ৩.২৫ গুণ। অর্থাৎ জনপ্রতি খাদ্যশস্যের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। ফলে মাথাপিছু ক্যালরি প্রাপ্তির নিরিখে বাংলাদেশ আজ দানাজাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এভাবেই দানাজাতীয় খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ (বিবিএস, ২০২১)।                       
তবে শুধু ক্যালরি প্রাপ্তি নিশ্চিতই যথেষ্ট নয়, একজন মানুষের সুস্থতার জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার বিশেষ করে ফল, সবজি, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম খাওয়া প্রয়োজন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সত্তরের দশকের তুলনায় পুষ্টি সমৃদ্ধ এসব কৃষিপণ্যের উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭০ সালে ফলের উৎপাদন ছিল ১৭ লক্ষ টন, যা বর্তমানে (৩ গুণ) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ লক্ষ টনে। সেইসময় উৎপাদিত ৯ লক্ষ টনের সবজি বর্তমানে (৫.১ গুণ) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ লক্ষ টনে। একইভাবে ডাল ও তেলজাতীয় শস্যের উৎপাদন যথাক্রমে ১.৫ ও ৩.৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ৪.৩ ও ৯.৯ লক্ষ টনে দাঁড়িয়েছে। মাছ, গোশত ও দুধ উৎপাদন যথাক্রমে ৩০, ৩৩.৬  ও ১০.৮ গুণ বেড়ে বর্তমানে ৪৫, ৮৪ এবং ১১৯ লক্ষ টনে উন্নীত হয়েছে (বিবিএস, ২০২১)। বর্তমানে আমরা জনপ্রতি দৈনিক প্রয়োজনীয়তার হিসেবে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাত, মাছ, গোশত ও ডিম পাই যদিও দুধ ও ফল-সবজিতে পিছিয়ে আছি। বর্তমানে জনপ্রতি  দৈনিক ৪৯৬, ৬৩ ও ১২০ গ্রাম চাল, মাছ ও গোশতের প্রয়োজনের বিপরীতে আমরা পাচ্ছি যথাক্রমে ৬২০, ৭৪ ও ১৩৮ গ্রাম। ডিমও জনপ্রতি বার্ষিক ১০৪টির বিপরীতে ১২৩টি করে পাচ্ছি। তবে জনপ্রতি দৈনিক দুধ ও ফল-সবজি এর প্রয়োজনীয়তার (যথাক্রমে ২৫০ মিলি ও ৪০০ গ্রাম) বিপরীতে আমরা পাচ্ছি ২৩৪.৪৫ মিলি ও ২৯২ গ্রাম (এফএও ও ডব্লিউএইচও, ২০১৪ এবং বিবিএস ২০২১, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ২০২৪)।            
একদিকে কৃষিজমি কমে যাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব অন্যদিকে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পরও দানাজাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। নিত্যনতুন গবেষণা, উচ্চফলনশীল জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উন্নত মানের বীজ, ভর্তুকি মূল্যে সার-সেচের প্রাপ্যতা, কৃষি যন্ত্রের আধুনিকায়ন এবং কৃষি খাতে বর্তমান সরকারের নানামুখী সুবিধাদি প্রদানের কারণেই ক্রমহ্রাসমান  কৃষিজমিতে ধারাবাহিকভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।     
তবে উৎপাদিত শস্যের একটা বড় অংশ কর্তন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার অভাবে নষ্ট হচ্ছে, যা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা এবং আর্থিক বিবেচনায় ব্যাপক। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেশে ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় ও ক্ষতির পরিমাণের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে আম, কলা, পেঁপে, পেয়ারা ও লিচুতে ২৫-৩৫%, চালে  ৬-৭%, ডালে ৬-৭%, আদায় ৫-৭% এবং আলুতে ১০% হারে সংগ্রহোত্তর অপচয় ও ক্ষতি হয়। উৎপাদিত এই ১০টি ফসলের ৫২.৫৭ মিলিয়ন টনের মধ্যে সম্মিলিত অপচয় ও ক্ষতির পরিমাণ ৫.১৩ মিলিয়ন টন (ভূঁইয়া, ২০২৩)। তবে ফসল সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এই অপচয় ও ক্ষতি কাক্সিক্ষত মাত্রায় কমিয়ে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বাড়ানো সম্ভব।          
কৃষিতে সমন্বিতভাবে টেকসই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের মানুষের খাদ্য-পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অনেকাংশে সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদাপূরণ, সুস্বাস্থ্য, কৃষকের আয় বৃদ্ধি, দরিদ্রতা বিমোচন ও বেঁচে থাকার জন্য অনুকূল পরিবেশ, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণে সমন্বয়সহ নিজস্ব কার্যক্রমের মাধ্যমে অবদান রাখছে। খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ায় বিএআরসি শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা জোরদারকরণে গবেষণা অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছে। তদানুযায়ী নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে উন্নত জাত ও লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং মাঠে তা সম্প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টিসমৃদ্ধ দেশ গঠনে সহায়তা করছে।     
বিএআরসি বাংলাদেশে ব্রয়লার মুরগির মাংসে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমে এন্টিবায়োটিক ও হেভি মেটালের উপস্থিতি সর্বনিম্ন সহনীয় মাত্রার নিচে থাকায় ব্রয়লার মাংস খাদ্য হিসেবে সবার জন্য নিরাপদ ঘোষণা করেছে। এতে সাধারণ মানুষের ব্রয়লার মুরগি খাওয়ার আগ্রহ বাড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষেরও প্রাণিজ পুষ্টির নিশ্চয়তা অনেকাংশে পূরণ হচ্ছে। একই ধরনের গবেষণা দুধেও করা হয়েছে। আমসহ অন্যান্য শাকসবজিতে ফরমালিনের মাত্রা নির্ণয় করা হয়েছে। জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রোগ্রামের (এনএটিপি) আওতায় শস্য, প্রাণিসম্পদ এবং মৎস্য চাষের জন্য ১৬৬টি হস্তান্তরযোগ্য প্রযুক্তি কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিএআরসি পুষ্টি-সংবেদনশীল কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ফসল সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং পুষ্টিবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সচেতনতামূলক কর্মসূচি বিশেষ করে নিয়মিতভাবে স্কুলের কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টিবিষয়ক প্রচারাভিযান করে থাকে। 
দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদাপূরণ, সুস্বাস্থ্য, কৃষকের আয়বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রমেও বিএআরসির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রেখে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিএআরসি প্রোগ্রাম অন অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ (পার্টনার) প্রকল্পের মাধ্যমে স্কিমওনার হিসেবে ফল ও সবজি উৎপাদনে উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) মানদ- ও প্রটোকল প্রণয়ন করছে। এই উত্তম কৃষি চর্চা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।         
বিএআরসি ক্রপ জোনিং প্রকল্পের মাধ্যমে জলবায়ু ও মাটির গুণাগুণ এর সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা বিবেচনায় ফসলের অধিকতর ফলন উপযোগী এলাকা চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি তথা টেকসই কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ফসল উৎপাদন এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে বিএআরসি টেকসই কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি উন্নয়ন ও মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এযাবৎ দেশের ৪২০টি উপজেলায় ৭৬টি ফসলের ক্রপ জোনিং সম্পন্ন করেছে। 
বিএআরসি স্বনামধন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা CGIAR, ACIAR, AFACI, USAID, GIFS BIMSTEC, etc.) এবং বিশ্ববিদ্যালয় (University of Saskatchewan, Wageningen University and Research, Cornell University, Michigan State University, etc.)  এর সাথে সহযোগিতামূলক প্রকল্প এবং কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ধারাবাহিকভাবে অবদান রেখে চলেছে।        
সর্বোপরি, বর্তমানে দেশের দানাজাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদন সন্তোষজনক হলেও ফল, সবজি, ডাল, তেলসহ অন্যান্য শস্য উৎপাদনে আমরা পিছিয়ে আছি, যা আমাদের পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রতিবন্ধক। পাশাপাশি ভবিষ্যতে জলবায়ুর প্রভাব, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও কৃষিজমি কমে যাওয়ার চাপ টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে যা মোকাবিলা করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কাজেই টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্য এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন উচ্চফলনশীল ও পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষকের মাঠে যথাযথভাবে তা সম্প্রসারণে সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের ক্রপ জোনিং এবং ফসলের উপযোগিতা ও গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক (বরেন্দ্র, হাওর, চর, পার্বত্য, উপকূল ইত্যাদি) সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে এমন একটি যুগোপযোগী উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যার যথাযথ বাস্তবায়ন টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিকভাবে পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসলের উৎপাদন বাড়ানোসহ দানাজাতীয় শস্যে পুষ্টিমান বাড়ানোর গবেষণা জোরদার করতে হবে। পতিত জমিকে আবাদের আওতায় আনা এবং এক ও দুই ফসলি জমিগুলোকে তিন বা চার ফসলি জমিতে পরিণত করে শস্যের নিবিড়তা উন্নীত করতে হবে। বিশেষ করে ভোক্তাপর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে শস্য উৎপাদন, সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণসহ খাদ্য শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে নিরাপদ খাদ্য ও এর পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং একইসাথে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পরিশেষে, আসুন আমরা সবাই মিলে সমন্বিতভাবে টেকসই নিরাপদ ও পুষ্টি গুণসম্পন্ন খাদ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।             

লেখক : নির্বাহী চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব), বিএআরসি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭১৫০১৩০৩৩,        ই-মেইল : ec.barc@gov.bd

বিস্তারিত
সমৃদ্ধ-ভবিষ্যতের-জন্য-চালভিত্তিক-সুষম-খাদ্যের-অধিকার

সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য চালভিত্তিক
সুষম খাদ্যের অধিকার
কৃষিবিদ ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান১ কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন২
বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২৪ উদযাপন উপলক্ষ্যে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার’। মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম মৌলিক অধিকার হলো খাদ্য। মূলত আমাদের অস্তিত্ব খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। তাই সুস্থ সবল জাতি গঠনে খাদ্যের সহজলভ্যতা, পুষ্টিগুণ ও নিরাপদতা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৫/১ ধারায় প্রত্যেক মানুষের খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ আছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) ও ১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য খাদ্যের মৌলিক চাহিদা পূরণ আবশ্যক। বিগত দশকে বাংলাদেশে খাদ্য ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, যেখানে দারিদ্র্যপীড়িত ও দুস্থ পরিবারসমূহের জন্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পুষ্টিকর নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে আমরা ইতোমধ্যে ধানভিত্তিক খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। তবে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত করা এখন আমাদের নতুন চ্যালেঞ্জ। 
ক্ষুধা নিয়ে বাংলাদেশে আপাতত কোন দুশ্চিন্তা নেই কিন্তু চিন্তা এখন অদৃশ্য ক্ষুধা বা অপুষ্টিকে ঘিরে। ক্ষুধা নিবারণে আমাদের দেশের কৃষকরা প্রতিবছর প্রায় চার কোটি মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করছেন, অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকা সত্ত্বেও এটা আমাদের বিশাল সাফল্য; কিন্তু খাদ্য হিসেবে আমাদের শুধু কার্বহাইড্রেট বা শর্করা খেলে তো হবে না, আমাদের প্রয়োজন সুষম খাদ্য। 
সুষম খাদ্য বলতে আমরা বুঝি শর্করা, আমিষ, স্নেহ, খনিজ লবণ, ভিটামিন ও পানি সবকিছুর স¤িœলন। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আর্থিক অসচ্ছলতা বা সচেতনতার অভাবে বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার যেমন-মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, কলা, আঙুর, আপেল ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করতে পারে না বা পরিমাণে কম গ্রহণ করছেন। এ অবস্থায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা মেটানো সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনগণের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন- জিংক, আয়রন, প্রোটিন, মিনারেলস্সহ শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে চালে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কাজ করছে। পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবনে বিশ্বের সর্বাধুনিক বায়োফর্টিফিকেশন ও জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। 
ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। অন্য পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে না পারলেও দু বা তিন বেলা ভাতের সংস্থান প্রায় সকলেরই সামর্থ্যরে মধ্যে। সুনিদিষ্ট করে বলতে গেলে, প্রতি ১০০ গ্রাম চাল থেকে আমরা মোটামুটি ১২৯ কিলোক্যালরি শক্তি, ৭৮.০৯ গ্রাম শর্করা, ৭.১২ গ্রাম প্রোটিন, ০.২৮ গ্রাম চর্বি, ১.৩০ গ্রাম আঁশ ০.০৭ মি.গ্রাম থায়ামিন, ০.০১৫ মি. গ্রাম রিভোপ্লাবিন, ১.০৯মি. গ্রাম জিংক, ২৮ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮০ মি. গ্রাম আয়রন, ২৫ মি. গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপোদান থাকে (ইউএসএইড পুষ্টি ডেটাবেজ)। 
মানব শরীরের জন্য জিংক খুব প্রয়োজনীয় একটি খনিজ উপাদান। মানবদেহে ২০০ এরও বেশি এনজাইমের নিঃসরণে অংশগ্রহণ করে যেগুলো দেহের অনেক বিপাকীয় কাজে এটি অংশ নেয়। এছাড়া দেহে এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, শর্করার ভাঙনে, দেহ কোষের বৃদ্ধিতে এবং পলিপেটাইড, গ্যাসটিন নিঃসরণের এর মাধ্যমেই স্বাদের অনুভূতি বা রুচি বাড়াতে ভূমিকা রাখে। জিংক ডিএনএ ও আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের একটি আবশ্যক উপাদান। হাড়ের বৃদ্ধির জন্য কেরাটিন তৈরি ও তার পরিপক্বতা, ত্বকের ক্ষত সারানো, আবরনি কোষের রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কাজে মানব শরীরে জিংকের প্রয়োজন হয়। উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে উঠার ব্যপারে জিংকের অভাব হলে শিশু-কিশোররা বেটে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু জিংক সমৃদ্ধ জাতের ভাত খেলে শরীরে জিংকের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটে যাবে এবং বেটে হবার সম্ভানা থাকবে না।ব্রির বিজ্ঞানীরা বিশ্বের সর্বপ্রথম জিংক সমৃদ্ধ্ ধানের জাত ব্রি ধান৬২ উদ্ভাবন করেন।
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের শরীরে জিংকের দৈনিক চাহিদা ১৫ মিলিগ্রাম এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর দৈনিক চাহিদা ১২ মিলিগ্রাম। ব্রি ধান৬২ তে জিংক এর পরিমাণ ১৯ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ মানুষের শরীরে জিংকের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে তার পুরোটাই মিটাতে পারে ব্রি ধান৬২ জাতের চাল। সাধারণত লাল মাংস, কাঠবাদাম, চিনাবাদাম, সয়া, দুগ্ধজাত খাবার, মাশরুম, যকৃত এবং সূর্যমুখীর বীজ জিংকের চমৎকার উৎস কিন্তু ভাতের ন্যায় এগুলো সহজলভ্য নয়। পরবর্তীতে ব্রি জিংক সমৃদ্ধ আরো ছয়টি জাত যেমন- ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৭২,  ব্রি ধান৭৪ এবং ব্রি ধান৮৪, ব্রি ধান১০০ ও ১০২ অবমুক্ত করে। এই জাতগুলো মানব দেহের জিংকের চাহিদা মেটাতে আদর্শ অপশন হতে পারে।
অনুরূপভাবে, প্রোটিন বা আমিষের অভাবে দেহে সুনির্দিষ্ট অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দেয়। শরীরের প্রতিকেজি ওজনের জন্য পূর্ণ বয়স্কদের ক্ষেত্রে ১ গ্রাম, শিশুদের জন্য ২-৩ গ্রাম আমিষের প্রয়োজন। গবেষণায় দেখা গেছে যদি ১% প্রোটিনের পরিমাণ চালে বৃদ্ধি করা যায়, তবে মানব শরীরে ৬.৫% বেশি চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। আমাদের পুরানো ধানের জাতগুলোর প্রোটিনের মাত্রা ছিল মাত্র ৮ থেকে ৯% তবে আমাদের নতুন জাতগুলোর প্রোটিনের পরিমাণ ৯ থেকে ১০%। উদাহরণস্বরূপ- ব্রি ধান৬২ তে প্রোটিনের পরিমাণ ৯%, ব্রি ধান৮১ তে ১০.৩%, ব্রি ধান৮৬ তে প্রোটিনের পরিমাণ ১০.১%, ব্রি ধান৯০ তে ১০.৩ %, ব্রি ধান৯৬ তে ১০.৮%, ব্রি ধান৯৮ তে ৯.৫%, এবং ব্রি ধান১০৬ তে ৮.৫ %। মাছ, মাংস ও ডাল প্রোটিনের অন্যতম উৎস হলেও এসব খাবার ভাতের ন্যায় সহজলভ্য নয়। ব্রি উদ্ভাবিত প্রোটিনসমৃদ্ধ জাতগুলোতে যে পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে তা আমাদের প্রোটিনের চাহিদার ৬০ ভাগ পূরণ করতে সক্ষম। ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ১২ থেকে ১৩% প্রোটিন সমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করা যাতে আমরা চাল থেকে প্রতিদিনের প্রোটিন চাহিদার কমপক্ষে ৮০% প্রয়োজন পূরণ করতে পারি। 
আমাদের নতুন জাত ব্রি ধান৮৪ তে আয়রনের পরিমাণ ১০ পিপিএম; আগে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোতে আয়রনের পরিমাণ ছিল ৩ থেকে ৫ পিপিএম। ব্রির ‘হেলদিয়ার রাইস’ গবেষণা কর্মসূচির অধীনে এখন ৪৫ পিপিএম জিংক এবং ১৫ পিপিএম আয়রন সমৃদ্ধ দ্বৈত সুবিধার নতুন জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা যাতে মানব শরীরের মোট চাহিদার কমপক্ষে ৮০% জিংক এবং ৫০% আয়রনের চাহিদা চালের মাধ্যমে পূরণ করা যায়। 
ডায়াবেটিস বিশ্বব্যাপি একটি মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪২২ মিলিয়ন লোক ডায়াবেটিক আক্রান্ত, এর বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বাস করে। বিশ্বে প্রতি বছর ১.৫ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে মারা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখের ওপরে। দেশে প্রতি ১১জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে লো-জিআই ধানের জাত বিআর১৬, ব্রি ধান৪৬, ব্রি ধান৬৯ ও ব্রি ধান১০৫ উদ্ভাবন করেছে ব্রি। ভাত হল শর্করার প্রধান উৎস এবং বাংলাদেশী মানুষের প্রধান খাদ্য। কিন্তু বাজারে প্রচলিত জনপ্রিয় ধানের জাতসমূহ উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (এও) সম্পন্ন হওয়ায় প্রচলিত চালের ভাত খেলে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি করে। কিন্তু উচ্চফলনশীল ও লো-এও (৫৫) চালের ভাত খেলে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার নিঃসরন কম হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ঢাকা পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে শিশু কিশোরদের আঠার শতাংশের বেশি বিষণœতায় আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে বড় সংকটের তৈরি করতে যাচ্ছে এই বিষণœতা। গবেষক ও চিকিৎসকরা মনে করে সাধারণভাবে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন তার জীবদ্দশায় কখনো না কখনো বিষণœতায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন বা হতে পারেন। বিষণœতা প্রশমনে এন্টি ডিপ্রেসিভ উপাদান এঅইঅ (এধসসধ অসরহড় ইঁঃুৎরপ অপরফ) সমৃদ্ধ ব্রি ধান৩১ উদ্ভাবন করেছেন ব্রির বিজ্ঞানীগণ।
এছাড়া আমরা জানি ভিটামিন-এ এর ঘাটতি এখনো বাংলাদেশের একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। দেশের প্রি-স্কুল এবং স্কুল-বয়সী শিশুদের ২০% এর বেশি এবং গ্রামাঞ্চলে ২৫% গর্ভবতী মহিলা ও স্তন্যদানকারী মা এই সমস্যায়  ভোগেন। অবমুক্তির অপেক্ষায় থাকা ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ধান গোল্ডেন রাইস আমাদের এই সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে। আশা করা যাচ্ছে, গোল্ডেন রাইস অনুমোদিত ও অবমুক্ত হলে ভিটামিন এ এর চাহিদার ৩০-৫০% পর্যন্ত পূরণ করতে পারবে। কেননা গ্রামাঞ্চলের মানুষ দৈনিক ২-৩ বার ভাত খেয়ে থাকেন।
চালকে প্রধান খাদ্যশস্য বিবেচনায় রাখতে হলে আমাদের কমপক্ষে ৭০ থেকে ৭৫% কার্বোহাইড্রেট বা ক্যালরি চাল থেকে নিতে হবে। তা না হলে ডায়াবেটিক, স্থুলতাসহ বিভিন্ন জীবনাচরিত (লাইফ স্টাইল) রোগ বেড়ে যাবে। সে হিসেবে মাথাপিছু চালের গ্রহণ জনপ্রতি ১৩৪ কেজি নিচে আসা উচিত হবে না। অথচ ইদানীং দেখা যাচ্ছে, অনেকে ওজন কমানোর জন্য খাদ্যতালিকা থেকে ভাত বাদ দিচ্ছেন। ভাতের পরিবর্তে তারা ফাস্ট ফুডের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন, যা ভাতের তুলনায় আরও বেশি ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার। 
অনেকের মতে নিয়মিত ভাত খেলে লাইফস্টাইল রোগ বাড়ে। এটা আসলে সত্যি নয় বরং আমরা প্রতিনিয়ত বাইরে যেসব স্ট্রিট ফুড বা মূখরোচক খাবার খাই, সেসব খাবারের সঙ্গে ট্রান্স ফ্যাট খাচ্ছি এগুলোই লাইফস্টাইল রোগের জন্য অনেকখানি দায়ী। এখন আসি এই ট্রান্স ফ্যাট আসলে কী? এটা এক ধরনের ক্ষতিকারক চর্বি, যা তেলে ভাজা খাবারের মচমচে ভাব বাড়ায় এবং খাদ্য বেশি সময় ধরে সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। এই চর্বি খাবারের স্বাদ বাড়ায় এবং টেক্সচার ধরে রাখে। এটি আমাদের দেশে ডালডা বা বনস্পতি হিসেবে অধিক পরিচিত; এর আসল নাম হাইড্রোজিনেটেড অয়েল। অতিরিক্ত ভাজা তেলে ট্রান্স ফ্যাট পাওয়া যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। 
সাধারণত দুধ ও পশুর মাংসে এই ট্রান্স ফ্যাট পাওয়া যায়, যা ১ শতাংশেরও কম। সুতরাং এটা ক্ষতির কারণ নয়, কিন্তু কৃত্রিমভাবে এ ফ্যাট অসম্পৃক্ত তেলের সঙ্গে হাইড্রোজেন যোগ করে সম্পৃক্ত করার সময় তৈরি হয়, যা সাধারণ তাপমাত্রায় জমাট বাঁধে। সাধারণত আমাদের দেশে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চানাচুর, শিঙ্গাড়া, পেঁয়াজু, ফাস্টফুড, ক্র্যাকারস, টোস্ট বিস্কুট ইত্যাদি তৈরিতে এই ট্রান্স ফ্যাট ব্যবহার করা হয়। বেশি পরিমাণ ট্রান্স ফ্যাট আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, কারণ নিয়মিত এই ফ্যাটযুক্ত খাবার আমাদের শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) বাড়ায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) এর পরিমাণ কমায় যার কারণে আমাদের রক্তনালিতে চর্বি জমা হয় এবং স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এই ট্রান্স ফ্যাট রক্তনালির মধ্যে মধ্যে জমে এর সংকোচন পরিমাণ বাড়ায়। এটি করোনারি হার্ট ডিজিজের অন্যতম প্রধান কারণ।
পরিশেষে বলতে চাই, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য গ্রহণে আমাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। এ জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষিত ও সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোকে এ বিষয়ে জনমত তৈরিতে সচেষ্ট থাকতে হবে। তাহলেই কেবল জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়নের মাধ্যমে জনস্বাস্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

লেখক : ১মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১। ২ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১, মোবাইল : ০১৭১৬৫৪০৩৮০, ই-মেইল:smmomin80@gmail.com

বিস্তারিত
বৈশি^ক-খাদ্য-অপচয়-ও-নষ্ট-হওয়া-রোধে-কৃষিপণ্যে-মূল্য-সংযোজন

বৈশি^ক খাদ্য অপচয় ও নষ্ট হওয়া রোধে কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজন
ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী১  মো. হাফিজুল হক খান২
পরিমিত পরিমাণে খাদ্য আমাদের শরীরের সুস্থতা ও শক্তি প্রদানের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচ্য। শরীরকে ঠিক রাখতে বিভিন্ন খাদ্যপ্রাণ, খনিজ পদার্থ, শর্করা, ¯েœহজাতীয় উপাদানসহ ফাইটোক্যামিক্যালস্ প্রতিনিয়ত আমাদের প্রয়োজন হয়। পুষ্টি নিরাপত্তায়ও খাদ্য বিশেষ করে ফলমূল ও শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও/ডব্লিউএইচও, ২০১৪) সুপারিশ অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের জন্য গড়ে প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া অত্যাবশ্যক। কিন্তু আমরা দৈনন্দিন প্রায় ২০৪ গ্রাম (২০৮ কিলোক্যালরি) পরিমাণ ফলমূল ও শাকসবজি খেয়ে থাকি, যা প্রায় অর্ধেক পরিমাণ। তন্মধ্যে ১৬৭ গ্রাম শাকসবজি ও বাকি অংশ ফলমূল। বর্তমানে ১৫০ ধরনের উপরে ফলমূল ও শাকসবজি আমাদের দেশে বছর জুড়ে উৎপাদিত হচ্ছে এবং মোট উৎপাদনের শতকরা প্রায় ১ ভাগ প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা খুবই কম অথচ উন্নত দেশে এটি প্রায় শতকরা ৭০-৮৩ ভাগ। 
ফলমূল ও শাকসবজিতে অধিক পরিমাণে পানি বিদ্যমান থাকায় খুবই পচনশীল পণ্য হিসেবে দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় না। ফসল কর্তন বা সংগ্রহের পর এর দ্রুত শ^সন চলতে থাকে এবং শরীরবৃত্তিয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সংগ্রহ থেকে বিপণন পর্যন্ত যেকোন স্তরে একটু ক্ষত, থেঁতলে যাওয়া, চাপ খাওয়া বা যেকোনভাবে আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে শ^সনপ্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হয় ফলে প্রচুর গুণাগুণ অপচয়ের কারণে নষ্ট হতে শুরু করে। যথাযথ পরিচর্যা, উপযুক্ত পরিপক্বতায় ফসল সংগ্রহ না করা, যথাযথ মোড়কে না রাখা, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখাসহ উপযুক্ত পরিবহনে স্থানান্তর না করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ ও ক্ষতি হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ এর মতে বিশে^ প্রতিবছর প্রায় ২.৫ বিলিয়ন টন খাবার নষ্ট হচ্ছে যা আর্থিক মূল্য ২৩০ বিলিয়ন ইউ.এস ডলার। আমাদের দেশে প্রতি বছর উৎপাদিত প্রায় ৯৪ মিলিয়ন টন কৃষিপণ্যের মধ্যে যে সংগ্রহোত্তর অপচয় হচ্ছে তা টাকার অংকে ৩০ হাজার কোটি টাকার উপরে (বিবিএস, ২০২৩)। উন্নত দেশে এই ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হলেও উন্নয়নশীল দেশে প্রায় মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ। ভরা মৌসুমে সংরক্ষণের অভাবে অপচয়ের পরিমাণ অধিক হয়ে থাকে। কৃষক উৎপাদনের খরচ তুলতে না পারায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরে‌্যা ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তথ্য মোতাবেক আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ১.৪৫ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়। সংগ্রহ থেকে রান্না করা পর্যন্ত নষ্ট হয় ৩৭ লক্ষ টন। উৎপাদন থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত আসতে শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ এবং বাসাবাড়ি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান এবং রেস্তোরাঁয় শতকরা প্রায় ১৭ ভাগ খাবার নষ্ট হচ্ছে। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অপচয় কমানোর কোন বিকল্প নেই। গত ২০১৪ থেকে পৃথিবীতে ক্ষুধার্থ মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এফএও ২০২৩ এর তথ্য মোতাবেক পৃথিবীর প্রায় ৭৩৫ মিলিয়ন মানুষ চরমভাবে প্রতিদিন ক্ষুধার সম্মুখীন হচ্ছে। শুধুমাত্র এক-চতুর্থাংশ খাবার যদি নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করা যেত তা দিয়ে ৮৭০ মিলিয়ন মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব হতো। উল্লেখ্য যে, আমরা দৈনন্দিন দোকান হতে খাবার হিসেবে যা ক্রয় করছি তারও শতকরা প্রায় ৫.৫ ভাগ নষ্ট করছি যেখানে শতকরা প্রায় ৩ ভাগ খাদ্য ক্রয় ও খাদ্য তৈরির সময় এবং অবশিষ্ট শতকরা প্রায় ২.৫ ভাগ খাবার সরবরাহ ও খাবার প্লেটে নষ্ট হচ্ছে শুধুমাত্র সচেতনতা ও অপ্রয়োজন বা অবজ্ঞায়, যা খুবই দুঃখজনক। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির তথ্য মতে, আমাদের দেশে প্রতি জন মানুষ গড়ে প্রতি বছর ৬৫ কিলোগ্রাম খাবার নষ্ট করে থাকে। সব চেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয় আফগানিস্তানে (৮২ কিলোগ্রাম) এর পরে রয়েছে নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ রাষ্ট্রে (৭১-৭৯ কিলোগ্রাম)। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও নিউজিল্যান্ড এ নষ্ট হয় ৫৯-৬৪ কিলোগ্রাম খাদ্য এবং সবচেয়ে কম খাবার নষ্ট হয়ে থাকে ভারত, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, অস্ট্র্রিয়া ও রাশিয়ায় ৩৩-৫০ কিলোগ্রাম। খাদ্য অপচয় বা নষ্ট হওয়া রোধে ৮টি বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই পরিমিত খাবার গ্রহণ বিষয়ে নিজে সচেতন হওয়া, খাদ্য গ্রহণের পর অতিরিক্ত খাবার সংরক্ষণ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা, প্রয়োজনীয় খাবার ক্রয় করা, কোন খাদ্যদ্রব্যকেই ক্রয়ের সময় অবজ্ঞা না করা, রেফ্রিজারেটরের ভেতরের তাপমাত্রা যথাযথ আছে কি না তা লক্ষ্য করা, যে খাদ্য দ্রব্যগুলো পূর্বেই সংরক্ষণ করা হয়েছে তা প্রথমেই ব্যবহার করা, খাদ্যদ্রব্য ক্রয়ের তারিখ লক্ষ্য রেখে ক্রয় ও ব্যবহার নিশ্চিত করা, বর্জ্য বা উচ্ছিষ্ট খাদ্যদ্রব্য যথাযথভাবে রেখে কম্পোস্টে রূপান্তরিত করা। এছাড়াও পচনশীল পণ্যগুলোতে মূল্য সংযোজন করার উদ্যোগ নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফলমূল ও শাকসবজি শুকিয়ে, পাউডার, জুস, ফলসত্ব, ফ্রাইড চিপ্স, চকোলেট ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে সহজলভ্য কৃষিপণ্যের অপচয় থেকে রক্ষা করা যায়। আবার কৃষিপণ্য ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্য তৈরির পাশাপাশি উচ্ছিষ্টাংশ থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরি করা সম্ভব। পেকটিন, স্টার্চ, ফুড গ্রেড কালার বা রং, ইথানল, ভিনেগার, সুগন্ধি, ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ইত্যাদি যেমন তৈরি করা যাবে তেমনি রেডি-টু-কুক, রেডি-টু-ইট, ফ্রেশ-কাট, প্রিজার্ভ পণ্যসহ বহুবিধ খাদ্যসামগ্রী অনায়াসে প্রস্তুত করা যায় এবং এগুলো দৈনন্দিন জীবনে সহজলভ্য করা প্রয়োজন। গ্রামীণ জনসাধারণ থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের উদ্যোক্তা লবণ-ভিনেগার দ্রবণ ব্যবহার করে কাঁচা ফলমূল ও শাকসবজি কম খরচে ৬-৮ মাস সহজেই সংরক্ষণ করতে পারে। আবার ফলমূলের পাল্প সংরক্ষণ করা, ভিনেগার দ্রবণে রেখে ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, শসা ইত্যাদি পিকলিং করা লাভজনক এবং বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সাথে ব্যবহার করা যায়। সতেজ ফলমূল (২-৩ মিনিট) ও শাকসবজি (৩০-৪৫ সেকেন্ড বা ১ মিনিট) পরিমিত তাপমাত্রার গরম পানিতে (হাত সহনীয়) শোধন বা স্যানিটাইজিং করে পরে কিছুসময় স্বাভাবিক তাপামাত্রার পানিতে রাখলে এনজাইম নিষ্ক্রিয় হবে এবং পরিমিত পরিমাণে লবণ, অ্যাসিটিক এসিড বা ভিনেগার, সংরক্ষক যুক্ত করলে গুণগতমানও অক্ষুন্নœ থাকবে যা কাঁচামাল তৈরির উৎস হিসেবেও বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে। 
পরিশেষে, খাদ্য পণ্যের যথাযথ ব্যবহার ও জনসচেতনতা সৃষ্টিই অপচয় ও নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম ও একমাত্র উপায়, যা সমগ্র বিশে^ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় অনস্বীকার্য।  

লেখক : ১খাদ্য প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,  মোবাইল: ০১৭১২২৭১১৬৩  ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ই-মেইল: cso.pht@bari.gov.bd ফোন: ০২-৪৯২৭০১৭৬, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১।

বিস্তারিত
খাদ্য-পুষ্টি-নিরাপত্তায়-আন্তঃফসল-ও-সাথীফসলের-চাষ

খাদ্য-পুষ্টি নিরাপত্তায় আন্তঃফসল 
ও সাথীফসলের চাষ
ড. মো. আলতাফ হোসেন
আন্তঃফসল চাষ এমন একটি প্রযুক্তি যেখানে এক বা একাধিক ফসল একত্রে উৎপাদন করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায় এবং ফসলহানির ঝুঁকিও এড়ানো যায়। দীর্ঘমেয়াদি ফসল চাষের ক্ষেত্রে আন্তঃফসল চাষ প্রযুক্তি এখন সময় ও চাহিদার দাবি। আর সাথী ফসলের চাষ একটি ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি, এতে প্রথম ফসলটি মাঠ  থেকে সংগ্রহের পূর্বেই দ্বিতীয় ফসলটি বপন/রোপণ করা হয়। এর ফলে দ্বিতীয় ফসলটি সঠিক সময়ে বপন/রোপণ করা যায়, এতে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয় এবং ফসলের উৎপাদন খরচ কমে যায়। সর্বোপরি আবহাওয়ার বৈরী অবস্থাকে মোকাবিলা করে সঠিক সময়ে ফসল উৎপাদন করা যায় এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং আন্তঃফসল ও সাথী ফসলের চাষ কিভাবে দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারে তার কিছু লাগসই প্রযুক্তি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
রবি মৌসুমে ব্যবহারযোগ্য আন্তঃফসল ও সাথীফসলের লাগসই প্রযুক্তিসমূহ
বাংলাদেশে প্রায় ৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে গম চাষ হয়ে থাকে (বিবিএস ২০২২-২৩)। গমের সাথে আন্তঃফসল হিসেবে ২ঃ১, ২ঃ২, ৩ঃ১ এবং ৩ঃ২ সারি বিন্যাসে ছোলা/তিসি/ধনিয়া/ কালোজিরা ইত্যাদি ফসল সন্তোষজনকভাবে চাষ করে ফসলের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় এবং আবহাওয়াগত ও প্রাকৃতিক কারণে ফসলহানির ঝুঁকিও এড়ানো যায়।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে  পটোলের চাষ হয়ে থাকে (বিবিএস ২০২২-২৩)। বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর ইত্যাদি জেলায় উল্লেখ্যযোগ্যভাবে এর আবাদ হয়ে থাকে। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ১ মিটার দূরত্বে পটলের মাতৃগাছের লতা রোপণের পরপরই পটোলের সারির মাঝে প্রথম আন্তঃফসল হিসেবে সাফল্যজনকভাবে মসুর চাষ করা যায়। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে মসুর সংগ্রহের পর দুই সারি পটোল গাছের মাঝে দ্বিতীয় আন্তঃফসল হিসেবে হলুদ রোপণ করে সেচ প্রদান করতে হয়। হলুদ যেহেতু একটি আংশিক ছায়া পছন্দকারী ফসল, তাই পটোলের মাচার নিচে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েও ভালো ফলন দেয়। আর পটোল যেহেতু মাচায় থাকে তাই হলুদ চাষের ফলে পটোলের ফলনের উপর কোন প্রভাব পড়ে না। গবেষণায় দেখা গেছে যে, একক ফসল হিসেবে পটোল চাষে হেক্টরপ্রতি ২.৬৪,০০০/- টাকা মুনাফা পাওয়া যায় অথচ পটোল+মসুর+হলুদ আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং হেক্টরপ্রতি ৪,৫০,০০০/- থেকে ৫,৩০,০০০/- টাকা পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়। 
আবার দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ১ মিটার দূরত্বের সারিতে পটোলের         মাতৃগাছের লতা রোপণের সাথেসাথেই দুই সারি পটোলের মাঝে প্রথম আন্তঃফসল হিসেবে লালশাক বা পালংশাক বপন করা যায়। লালশাক বা পালংশাক ২৫-৩০ দিনের মাথায় সংগ্রহের পর দ্বিতীয়বার সাথী ফসল হিসেবে লালশাক বা পালংশাক বপন করতে হয়। দ্বিতীয় লালশাক বা পালংশাক সংগ্রহের পর ১৫-৩০ মার্চের মধ্যে দুই সারি পটোলের মাঝে ৩০ সেমি. দূরত্বে তৃতীয় সাথী ফসল হিসেবে দুই সারি হলুদ/আদা রোপণ করা যায়। এই পদ্ধতিতে পটোলের সাথে লালশাক/পালংশাক এবং হলুদ/আদা আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৫,৬০,০০০/- থেকে ৭,০৯,০০০/- টাকা পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়।
চলনবিলসহ অন্যান্য বিল এলাকায় মাঝারি উঁচু থেকে নিচু আমন ধানের জমিতে অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে সাথী ফসল হিসেবে স্বল্পকালীন সরিষার জাত যেমন বারি সরিষা-১৪ চাষ করা যায় এবং জানুয়ারি মাসের মধ্যেই সরিষা সংগ্রহের পর ফেব্রুয়ারি মাসে সেখানে বোরোধান চাষ করে বোনাস ফসল হিসেবে প্রতি হেক্টরে ১২০০-১৫০০ কেজি সরিষা পাওয়া যায়। চলনবিলসহ অন্যান্য বিল এলাকায় এই প্রযুক্তিটি লাগসই প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ব্যাপক এলাকায় সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করলে সরিষার উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া এলাকা ও অবস্থানভেদে আমন ধানের জমিতে সাথী ফসল হিসেবে গম চাষও করা যায় তবে এক্ষেত্রে গম কাটার পরে আর বোরো ধান রোপণ করার সুযোগ থাকে না। আবার আমন ধানের সাথে সাথী ফসল হিসেবে জমি নরম অবস্থায় ডিবলিং পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ করে বিনা চাষে সঠিক সময়ে ভুট্টা বপন করে সাফল্যজনকভাবে ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। 
এ ছাড়া চলনবিল এলাকায় বিশেষ করে নাটোর ও পাবনা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বিনাচাষে রসুন উৎপাদন একটি লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এসব এলাকার বোনা আমন ও রোপা আমন ধানের মাঝারি উঁচু থেকে নিচু জমিতে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে কাদায় বিনাচাষে রসুন বপন করা হয় এবং সেখানে সাথীফসল হিসেবে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে তরমুজ/বাঙ্গি/খিরা/করলা ইত্যাদি চাষ করা হয়। একক ফসল হিসেবে রসুন চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৪,৫০,০০০/- থেকে ৫,০০,০০০/- টাকা লাভ হয় কিন্তু রসুনের সাথে সাথীফসল হিসেবে উল্লেখিত ফসলগুলো চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ১০,০০,০০০/- থেকে ১১,০০,০০০/- টাকা লাভ পাওয়া যায়।
আবার স্বাভাবিকভাবে মাঝারি উঁচু এলাকা থেকে নিচু এলাকায় আমন ধানের সাথে সাথী ফসল হিসেবে ডাল জাতীয় ফসল যেমন- খেসারি, মসুর, মটর চাষ হয়ে থাকে। বিস্তীর্ণ এলাকা পতিতও পড়ে থাকে। সকল চাষাবাদকৃত এবং পতিত জমিতে সাথীফসল হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসমূহ কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল খেসারি, মসুর ও মটর চাষ করতে পারলে একদিকে যেমন চাষের এলাকা বৃদ্ধি পাবে আবার অন্যদিকে উচ্চফলনশীল জাত চাষ করায় ডালের উৎপাদন ১.৫ থেকে ২.০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব যা- মাটি, মানুষ ও গবাদির পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। 
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়ে থাকে (বিবিএস ২০২২-২৩)। আখ চাষের উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে আগাম রোপণ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) ও মধ্যম রোপণ (নভেম্বর-ডিসেম্বর) সময়ে আখের সাথে প্রথম সাথী ফসল হিসেবে মসুর/ছোলা/মটর/পেঁয়াজ/ রসুন/ধনিয়া/ আলু/ফুলকপি/টমেটো ইত্যাদি চাষ করে দ্বিতীয় সাথী ফসল হিসেবে মুগডাল চাষ করলে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি জমির উর্বরতাও বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া শস্য নিবিড়তাও বাড়ে এবং কৃষকরা অধিক লাভবান হতে পারেন। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ^রদী, পাবনা কর্তৃক পরিচালিত আখের সাথে সাথীফসল হিসেবে ডাল, মসলা ও সবজিজাতীয় ফসল উৎপাদন প্রকল্প থেকে পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, এককভাবে আখচাষ করলে হেক্টরপ্রতি প্রায় ২,০০,০০০/- টাকা লাভ হয় আর সেখানে উল্লেখিত ফসলগুলোকে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করলে ফসলভেদে হেক্টরপ্রতি ৩,৮০,০০০ থেকে ৮,৭০,০০০ টাকা পর্যন্ত লাভ পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, প্রথম সাথী ফসল হিসেবে টমেটো চাষে সর্বাধিক লাভ পাওয়া যায়।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো যেমন- বৃহত্তম চট্টগ্রাম ও বরিশাল জেলাগুলোতে আমন ধানের সাথে সাথীফসল হিসেবে স্থানীয় জাতের পরিবর্তে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ফেলন চাষ করে ডালের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, যা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। 
খরিফ মৌসুমে ব্যবহারযোগ্য আন্তঃফসল ও সাথীফসলের লাগসই প্রযুক্তিসমূহ 
বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়ে থাকে (বিবিএস ২০২২-২৩)। এই বৃহৎ এলাকায় খরিফ-১ ও খরিফ-২ উভয় মৌসুমে ভুট্টার সাথে আন্তঃফসল হিসেবে মুগ ও মাসকলাইয়ের চাষ করে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করা যায়, যা একটি অত্যন্ত লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তি। 
বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে মুখীকচুর চাষ হয়ে থাকে (বিবিএস ২০২২-২৩)। খরিফ-১ মৌসুমে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়কালে মুখীকচুর সাথে তিলের আন্তঃফসল চাষ একটি লাগসই ও লাভজনক প্রযুক্তি। এক্ষেত্রে ১০০% তিল ছিটিয়ে বপনের পর একক সারি বা দ্বৈত সারি পদ্ধতিতে মুখীকচুর কন্দ (বীজ) বপন করতে হয়। গবেষণায় দেখা যায় যে, একক ফসল হিসেবে মুখীকচু চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৯৫,০০০/- টাকা মুনাফা পাওয়া যায় আর একক ফসল হিসেবে তিল চাষ করলে ২৩,০০০/- টাকা মুনাফা পাওয়া যায়। অথচ বিভিন্ন সারি বিন্যাসে মুখীকচু ও তিলের আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করলে ১,১৮,০০০/- থেকে ১,৩৪,০০০/- টাকা পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়। 
বাংলাদেশে খরিফ-১ মৌসুমে বৃহত্তর রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও যশোর এলাকায় ব্যাপকভাবে মুগ চাষ হয়ে থাকে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ে ৩০ সেমি. দূরত্বে ২ঃ১, ২ঃ২, ৩ঃ১ এবং ৩ঃ২ সারি বিন্যাসে মুগের সাথে তিলের আন্তঃফসল চাষও একটি লাগসই ও লাভজনক প্রযুক্তি। একক ফসল হিসেবে মুগ চাষ করলে অনেক সময় অতি বৃষ্টিতে মুগ গাছের অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে ফুল ও ফল ধারণ কমে যাওয়ায় ফলন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। সেক্ষেত্রে মুগ ও তিলের আন্তঃফসল চাষ করলে মুগের ফুলের থ্রিপস ও ফলছেদক পোকার আক্রমণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি ফসল উৎপাদনের ঝুঁকি কমে যায়, আবার সামগ্রিক উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় দেখা যায় যে, এককভাবে মুগ চাষ করলে যেখানে ১ টাকা খরচে গড়ে ১.৪৪ টাকা মুনাফা পাওয়া যায় সেখানে মুগ ও তিলের আন্তঃফসল চাষ করলে প্রতি টাকায় গড়ে ১.৮৭ টাকা মুনাফা পাওয়া যায়। 
এছাড়া দেশে বিভিন্ন এলাকায় স্থাপনকৃত (বিশেষ করে নতুন স্থাপনকৃত) বিভিন্ন ধরনের ফলবাগান যেমন- কলা, পেঁপে, কুল, ড্রাগন, লেবু, কমলা, মাল্টা, আম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদির মধ্যেকার ফাঁকা জায়গায় অনায়াসেই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ডাল, তেল ও মসলাজাতীয় ফসলের চাষ করা যায়। এতে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার সুনিশ্চিত হয়, শস্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে নিবিড়তা বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অধিক লাভবান হওয়া যায়। 
উপরের আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যমান ফসল ধারাকে ব্যাহত না করে আন্তঃফসল ও সাথীফসলের চাষ বৃদ্ধি করে ফসলের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সুপরিকল্পিত ও আন্তরিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে আন্তঃফসল ও সাথীফসলের আবাদ সম্প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। 

লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ডাল গবেষণা কেন্দ্র ও আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা, মোবাইল : ০১৭২৫-০৩৪৫৯৫, ই-মেইল : hossain.draltaf@gmail.com

বিস্তারিত
সুস্বাস্থ্যে-পুষ্টিকর-ও-নিরাপদ-খাদ্য
সুস্বাস্থ্যে পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য
তাসনীমা মাহজাবীন
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। খাদ্যশস্য ও প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে কিন্তু পুষ্টির সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে পুষ্টিবিষয়ক কাযর্ক্রম আরও জোরদার করতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪১৮ মেট্রিক টন চাল উৎপন্ন হয়েছে, ২২৫ লক্ষ মেট্রিক টন শাকসবজি, ৩৬ লক্ষ মেট্রিক টন ফল, ৮ লক্ষ মেট্রিক টন ডাল ও ১৬ লক্ষ মেট্রিক টন তেলবীজ উৎপাদিত হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৮৭.১০ লক্ষ মেট্রিক টন মাংস, ২৩৩৭.৬৩ কোটি ডিম ও ১৪০.৬৮ লক্ষ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদিত হয়েছে। সবজি, মাছ, মাংস প্রভৃতি খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও মানুষের সামর্থ ও সচেতনতার অভাবে পুষ্টি উন্নয়নবিষয়ক বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। 
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত, সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ মনের জন্য পুষ্টিকর খাবার অবশ্য প্রয়োজনীয়। খানার আয় ব্যয় ও জরিপ (ঐওঊঝ) ২০২২ অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের একজন মানুষের দৈনিক গড় ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ২৩৯৩ কিলোক্যালরি, তারমধ্যে দেখা যায় গ্রামের মানুষ ২৪২৪ কিলোক্যালরি গ্রহণ করে আর শহরের মানুষ গ্রহণ করে ২৩৯৩ কিলোক্যালরি।
আমাদের দেশে দৈনিক মাথাপিছু দানাদার খাদ্য যেমন চাল ও গম গ্রহণের পরিমাণ যথাক্রমে ৩২৮ গ্রাম এবং ২২.৯ গ্রাম, মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬৭.৮ গ্রাম এবং মাংস গ্রহণ করা হয় ৪০ গ্রাম। এছাড়া এবং গড়ে প্রতিদিন একজন মানুষ ১২.৭ গ্রাম ডিম ও ৩৪.১ গ্রাম দুধ গ্রহণ করে থাকে। শাকসবজি গ্রহণের পরিমাণ বিগত বছরের তুলনায় বেড়েছে তবে জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী দৈনিক অন্তত ১০০ গ্রাম বা ১ আঁটি শাক এবং ২০০ গ্রাম বা ২ কাপ সবজি এবং ১০০ গ্রাম ফল (একটি টক ও একটি মিষ্টি) গ্রহণ করার বিষয়ে নির্দেশনা থাকলেও বর্তমানে দৈনিক গড় শাকসবজি ও ফল গ্রহণের পরিমাণ যথাক্রমে ২০১.৯ গ্রাম ও ৯৫.৪ গ্রাম।
বাংলাদেশের পারিবারিক খাদ্যভাস এর কারণে প্রতিদিনের খাবারে অনুপুষ্টি উপাদান কম থাকে, কিংবা থাকলেও ঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না করার কারণে এবং খাবারের বৈচিত্র্যতা কম থাকায় মানবদেহে আয়োডিন, জিংক, ভিটামিন-এ এবং আয়রনের অভাব ব্যাপক প্রতিফলিত হচ্ছে বিশেষ করে গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েরা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ লবণের অভাবে ভুগছেন। এ জন্য প্রতিদিনের খাদ্য তালিকাতে বিভিন্ন রঙিন শাকসবজি ও ফলমূল রাখতে হবে। 
জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা ২০২০ অনুযায়ী বাংলাদেশের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের গড়ে দৈনিক ২৪৩০ কিলোক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করা উচিত এবং উক্ত ক্যালরীর উপরভিত্তি করে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার এর সমন্বয়ে প্রতিদিনের খাদ্য খাবারের প্লেট সাজানো যেতে পারে যেমন : খাবরের প্লেটে অর্ধেকটা ভাত,মিক্সড সব্জি, ডাল ,মাছ/মাংস/ডিম এবং শাক সাথে কাঁচামরিচ বা লেবু যোগ করা যেতে পারে। এছাড়া খাবার পরে একটা টক বা মিষ্টি জাতীয় ফল খাওয়া যেতে পারে। 
একটি দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি নির্ণয়ের অন্যতম নিয়ামক হলো পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা। ২০২২ এর বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (ইউঐঝ)১ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর উচ্চমাত্রায় অপুষ্টির চিত্র হলো খর্বতা ২৪%, কৃশতা ১১%, কম ওজন ২২%। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা লক্ষ্য-২ এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ এর পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নয়নে ২০৩০ সালের মধ্যে খর্বতা ১৫%, কৃশতা ৮%, কম ওজন ১০% নামিয়ে আনতে হবে। এর জন্য পুষ্টি প্রত্যক্ষ এবং পুষ্টি পরোক্ষ উভয় ধরনের কার্যক্রমের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। খাদ্য পুষ্টিকর এবং নিরাপদ হতে হবে, খাদ্য উৎপাদনের শুরু থেকে খাবারের থালা পর্যন্ত খাদ্যের নিরাপদতা নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য ও পানি নিরাপদ না হওয়ার কারণে বিভিন্ন রোগজীবাণুর আক্রমণ হয়, সংক্রামক রোগ দেখা দেয় সেই সাথে পুষ্টি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। পারিবারিক পর্যায়ে খাদ্য নিরাপদ রাখার বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা ৫টি চাবিকাঠি সুপারিশ করেছে সেগুলো হলো-
 পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে যেমন : পরিচ্ছন্নতার খাবারের আগে ও পরে, টয়লেট থেকে ফিরে সাবান দিয়ে হাত ধৌতকরণ; তৈজসপত্র ও থালা-বাসন ভালোভাবে পরিচ্ছন্ন, রাখা ইত্যাদি। 
 কাঁচা ও রান্না করা খাবার আলাদা রাখতে হবে (কাঁচা মাছ/মাংস, ফলমূল বা শাকসবজি আলাদা রাখতে হবে; যাতে এক খাবারের জীবাণু অন্য খাবারে না যেতে পারে)।
 সঠিক তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে খাবার রান্না করতে হবে (সঠিক তাপে ভালভাবে সিদ্ধ করে খাবার রান্না করতে হবে, খাবার ঢাকনা দিয়ে রান্না করতে হবে)।  
 নিরাপদ তাপমাত্রায় খাদ্য সংরক্ষণ করতে হবে যেমন রান্না করা খাবার ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর নিচে সংরক্ষণ করা উচিত এবং সংরক্ষণ করা খাবার পরিবেশনের আগে ভালভাবে গরম করা উচিত)। 
 নিরাপদ পানি ও খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করতে হবে (রান্না ও খাবারে অবশ্যই নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে হবে, ফলমূল ও শাকসবজি নিরাপদ পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে)
সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকাতে পুষ্টি 
সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন খাদ্য সন্নিবেশ করতে হবে। খাদ্য নির্বাচন, প্রস্তুতকরণ, খাদ্য গ্রহণ এবং খাদ্য সংরক্ষণ ইত্যাদি সব বিষয়ে ফলিতপুষ্টি বিষয়ক জ্ঞানকে প্রধান্য দিতে হবে। এতে পারিবারিক খাদ্যাভ্যাস উন্নত হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নয়নেও সাহায্য করবে।
 
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ফলিতপুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান), মোবাইল : ০১৭৮১৮৮৭৮৮৫
বিস্তারিত
গমের-আধুনিক-জাতসমূহ-ও-উৎপাদন-কৌশল
গমের আধুনিক জাতসমূহ ও 
উৎপাদন  কৌশল
ড. মোহাম্মদ রেজাউল কবীর
গম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দানাজাতীয় খাদ্যশস্য। দানাজাতীয় খাদ্যশস্যের মধ্যে ধান ও ভুট্টার পরেই গমের অবস্থান। গম অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন, কৃষি উপকরণ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব একটি ফসল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের খাদ্যভ্যাস পরিবর্তনের ফলে প্রতি বছর গমের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া গম চাষের জন্য উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও উপযুক্ত মূল্যের অভাব এবং শীতকালীন অন্যান্য ফসলের সাথে প্রতিযোগিতার ফলে গম চাষের আওতায় এলাকা কমে যাচ্ছে। অপরদিকে আশাব্যঞ্জক খবর হলো দেশে গমের গড় হেক্টরপ্রতি ফলন প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত ২০০৫-০৬ মৌসুমে দেশে হেক্টরপ্রতি গমের গড় ফলন ছিল ১.৫৩ টন যা বর্তমানে বেড়ে ৩.৮৩ টনে উন্নীত হয়েছে। এতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে দেশে লাভজনকভাবে গম চাষ করার জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া এবং উচ্চফলনশীল জাত বিদ্যমান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ১৯৯৮-৯৯ উৎপাদন মৌসুমে দেশে প্রায় ২০ লক্ষ মেট্রিক গম উৎপাদিত হয়েছিল। সঠিক জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দেশে ২০ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি গম উৎপাদন করা সম্ভব। 
গমের অধুনিক ও উচ্চফলনশীল জাতসমূহ
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউ এ পর্যন্ত ৩৮ গমের জাত উদ্ভাবন করেছে। এদের মধ্যে বারি গম ২৫, বারি গম ২৮, বারি গম ৩০, বারি গম ৩২, বারি গম ৩৩, বিডাব্লিউএমআরআই গম ১, বিডাব্লিউএমআরআই গম ২, বিডাব্লিউএমআরআই গম ৩, বিডাব্লিউএমআরআই গম ৪ এবং বিডাব্লিউএমআরআই গম ৫ অন্যতম। নি¤েœ উপযোগিতা অনুসারে গমের জাতসমূহের বিভাজন উল্লেখ করা হলো:
া উত্তরাঞ্চলের হালকা বুনটের মাটিতে আগাম আলুর পর বপনের উপযোগী গমের জাতসমূহ: বারি গম ৩২, বিডাব্লিউএমআরআই গম ১, বিডাব্লিউএমআরআই গম ৪
া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের ব্লাস্ট প্রবন এলাকায় বপনের উপযোগী গমের জাতসমূহ: বারি গম ৩৩,  বিডাব্লিউএমআরআই গম ৩ এবং বিডাব্লিউএমআরআই গম ৫
া আমন ধান কাটার পর দেরীতে বপনের উপযোগী গমের জাতসমূহ: বারি গম ২৮, বারি গম ৩০, বারি গম ৩২ ও বিডাব্লিউএমআরআই গম ১
া উপকূলীয় লবণাক্ততা প্রবণ এলাকায় বপনের উপযোগী গমের জাতসমূহ: বারি গম ২৫ ও বিডাব্লিউএমআরআই গম ৪
া জিংক সমৃদ্ধ গমের জাতসমূহ: বারি গম ৩৩, বিডাব্লিউএমআরআই গম ৩
া তাপ সহিষ্ণু গমের জাত সমূহ: বারি গম ২৮, বারি গম ৩০, বারি গম ৩২, বিডাব্লিউএমআরআই গম ১, বিডাব্লিউএমআরআই গম ২ এবং বিডাব্লিউএমআরআই গম ৪ 
গম উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল 
বপনের সময় : গমের দানার আকার, আকৃতি, পুষ্টতা ও অন্যান্য গুণাগুণ বজায় রাখতে উপযুক্ত সময়ে গম বপন করতে হবে। গম বপনের উপযুক্ত সময় নভেম্বর মাসের ১৫ থেকে ৩০ পর্যন্ত (অগ্রহায়ণ মাসের ১ম থেকে ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত)। 
বীজের হার ও বীজ শোধন : গজানোর ক্ষমতা শতকরা ৮০ ভাগ ও তার বেশি হলে হেক্টর প্রতি ১২০ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে। তবে কাক্সিক্ষত ফলন পেতে বারি গম ৩৩ জাতের গমের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ১৪০ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে। বপনের পূর্বে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা পরীক্ষা করে নিতে হবে এবং কার্যকর ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধন করলে বীজ বাহিত রোগ দমন হয় এবং বীজ গজানোর ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ চারা সবল ও সতেজ হয় । বীজ শোধন করলে ফলন শতকরা ১০-১২ ভাগ বৃদ্ধি পাবে।
বপন পদ্ধতি : সারিতে অথবা ছিটিয়ে গম বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপনের জন্য জমি তৈরির পর ছোট লাঙ্গল বা বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে ২০ সেমি. বা ৮ ইঞ্চি দুরে দুরে সারিতে এবং ৪-৫ সেমি. গভীরে বীজ বুনতে হবে। ধান কাটার পর পরই পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে স্বল্পতম সময়ে গম বোনা যায়। এ যন্ত্রের সাহায্যে একসঙ্গে জমি চাষ, সারিতে বীজ বপন ও মইয়ের কাজ করা যাবে। 
সার প্রয়োগ : জমি চাষের শুরুতে হেক্টরপ্রতি ৫-১০ টন গোবর/কম্পোস্ট জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করা উত্তম। শেষ চাষের পূর্বে জমিতে হেক্টরপ্রতি ১৫০-১৭৫ কেজি ইউরিয়া, ১৩৫-১৫০ কেজি টিএসপি, ১০০-১১০ কেজি পটাশ ও             ১১০-১২৫ কেজি জিপসাম সার সমান ভাবে ছিটিয়ে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। 
সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে চারার তিন পাতা বয়সে প্রথম সেচের পর দুপুর বেলা মাটি ভেজা থাকা অবস্থায় প্রতি হেক্টরে  ৭৫-৯০ কেজি ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। জমিতে প্রায়শ বোরন সারের ঘাটতি দেখা যায় বলে প্রতি হেক্টরে ৬.৫ কেজি হারে বরিক এসিড শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে।  যে সব জমিতে দস্তা সারের ঘাটতি রয়েছে এবং পূর্ববর্তী ফসলে দস্তা প্রয়োগ করা হয়নি সে সব জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টরপ্রতি ১২.৫ কেজি দস্তা সার যথা জিংক সালফেট (মনোহাইড্রেট শতকরা ৩৬ ভাগ জিংক সম্বলিত) শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করা ভাল। 
জমিতে অম্লীয় মাত্রা ৫.৫ এর নিচে হলে হেক্টরপ্রতি ১০০০ কেজি হারে ডলোচুন গম বপনের কমপক্ষে দু’সপ্তাহ আগে মাটিতে ‘জো’ থাকা অবস্থায় প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি ৩ বছরে একবার ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ প্রয়োগ : মাটির প্রকার ভেদে গম আবাদে ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রথম সেচ চারার তিন পাতার সময় (বপনের ১৭-২১ দিন পর) দ্বিতীয় সেচ শীষ বের হওয়ার সময় (বপনের ৫০-৫৫ দিন পর) এবং তৃতীয় সেচ দানা গঠনের সময় (বপনের ৭৫-৮০ দিন পর) দিতে হবে। তবে মাটির প্রকারভেদে ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভাল ফলনের জন্য অতিরিক্ত এক বা একাধিক সেচ দেয়া ভাল। প্রথম সেচটি খুবই হালকা ভাবে দিতে হবে। তা না হলে অতিরিক্ত পানিতে চারার পাতা হলুদ যায় এবং চারা সম্পূর্ণ বা আংশিক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেচের পর পরই জমি থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে। তাই বপনের পর জমির ঢাল বুঝে ২০-২৫ ফুট অস্তর অন্তর নালা কেটে রাখতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা : বীজ বপনের পর ১০-১২ দিন পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে বীজ বা চারার সংখ্যা সঠিক থাকে। বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে জমিতে ‘জো’ অবস্থায় আগাছা দমনের জন্য নিড়ানি দিতে হবে। চওড়া পাতা জাতীয় আগাছা (বথুয়া ও কাকরি) দমনের জন্য এফিনিটি নামক আগাছা নাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২৫ গ্রাম হিসেবে ভাল ভাবে মিশিয়ে ¯েপ্র মেশিনের সাহায্যে মেঘমুক্ত দিনে ৫  শতাংশ জমিতে একবার প্রয়োগ করতে হবে  অথবা হ্যামার নামক আগাছা নাশক প্রতি ১৫ লিটার পানিতে ৫মিলি ভালভাবে মিশিয়ে মেঘমুক্ত দিনে ১২ শতাংশ জমিতে একবার প্রয়োগ করতে হবে । সময় মত আগাছা দমন করলে ফলন শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ শুরু হলে ফাঁদ পেতে বা বিষটোপ (জিঙ্ক ফসফাইড বা ল্যানিরেট) দিয়ে দমন করতে হবে। 
গমের ব্লাস্ট ও অন্যান্য রোগ দমনের জন্য প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং তার ১২-১৫ দিন পর আরেকবার ফলিকুর, নাটিভো ৭৫ ডব্লিউ জি, ইত্যাদি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। 
ভিন্ন জাত বাছাইকরণ বা রোগিং : বীজের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করণের জন্য শীষ বের হওয়ার পর হতে পাকা পর্যন্ত কয়েকবার অন্য জাতের মিশ্রণ, রোগাক্রান্ত গাছ এবং আগাছা গোড়াসহ উপড়ে ফেলতে হবে। বীজ উৎপাদনের জন্য এ কাজগুলো সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে করলে বীজের মান নিশ্চিত হবে।
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ : গম গাছ সম্পূর্ণরূপে পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করলে কাটার উপযুক্ত সময় হিসেবে গন্য হবে। গম পাকার পর বেশি দিন ক্ষেতে থাকলে ঝড়/শিলা বৃষ্টিতে যথেষ্ট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সকালের দিকে গম কেটে দুপুরে মাড়াই করা উত্তম। মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে সহজে গম মাড়াই করা যায়। বীজ সংগ্রহের জন্য গম পাকার পর হলুদ হওয়া মাত্রই কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে আলাদা করে মাড়াই করতে হবে এবং মাড়াইয়ের পর কয়েক দিন বীজ শুকানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগ বা তার নিচে রাখতে হবে। দানা দাঁতের নিচে চাপ দিলে কট করে শব্দ হলে বুঝতে হবে যে, উক্ত বীজ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত। সংরক্ষণের পূর্বে পুষ্ট বীজ চালনি দিয়ে চেলে বাছাই করে নিতে হবে। 
প্লাস্টিক ড্রাম, ড্রাম, চটের বস্তÍÍার মধ্যে পলিথিন ব্যাগে বীজ সংরক্ষণ করা যায়। লক্ষ্য রাখতে হবে বীজ সংরক্ষণের পাত্র যেন ছিদ্রমুক্ত হয়। বীজ ভর্তির পর পাত্রের ভেতরে যেন কোন ফাঁকা জায়গা না থাকে। পাত্র সম্পূর্ণভাবে বীজ ভর্তির পর শক্ত করে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে যাতে বাইরের বাতাস ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। পলিথিন বা প্লাস্টিক জাতীয় পাত্রে সংরক্ষণের জন্য শুকানো বীজ ১০-১২ ঘণ্টা ছায়ায় ঠা-া করে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ সংরক্ষিত পাত্র সরাসরি মেঝেতে না রেখে মাচার উপরে এবং ঘরের দেয়াল/বেড়া থেকে একটু দূরে রাখা উত্তম। খেয়াল রাখতে হবে যেন বীজসহ পাত্রগুলো মাটির সংস্পর্শে না আসে। মাটির সংস্পর্শে এলে বীজের আর্দ্রতা বেড়ে বীজ নষ্ট হতে হয়ে যাবে।
 
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, দিনাজপুর, মোবাইল : ০১৭৯৬৫৮৬০৩৯, ইমেইল: rezaulwrc@gmail.com
বিস্তারিত
তেলজাতীয়-ফসল-সরিষার- গুরুত্ব-এবং-চাষাবাদ-পদ্ধতি
তেলজাতীয় ফসল সরিষার 
গুরুত্ব এবং চাষাবাদ পদ্ধতি
ড. মোছাঃ খাদিজা খাতুন
বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে সরিষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাই ভোজ্যতেলের  চাহিদা মেটাতে সরিষার আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৬.১০৬ লক্ষ হে. জমিতে ৮.২৪৩ লক্ষ টন সরিষা উৎপাদিত হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর হিসাবানুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে ২১ লাখ ৩৬ হাজার টন ভোজ্যতেল (পাম ওয়েল ও সয়াবিন) আমদানি করা হয়। যার ফলে ব্যয় হয় ১৮৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার বা প্রায় ১৬ হাজার কোটি বাংলাদেশী মুদ্রা (টাকা)।
দেশের বেশির ভাগ জমিতে কৃষকরা দুটি ফসল চাষ করে থাকে। আমন ধান কাটার পর দুই-তিন মাস পর্যন্ত জমি পতিত থাকে। এই সময়ে সরিষা চাষ করলে ওই জমিতে তিনটি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। এতে একদিকে কৃষক যেমন-লাভবান হবেন, অন্যদিকে পুষ্টিকর ভোজ্যতেলের চাহিদাও মিটবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে তেলজাতীয় ফসলের আওতায় আবাদকৃত জমির পরিমাণ ১০.০৩৪ লক্ষ হে.। সরিষাই যেহেতু এদেশের প্রধান তেলজাতীয় ফসল, তাই দেশের ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরিষা চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বৃদ্ধিসহ উচ্চফলনশীল জাতের দ্রুত সম্প্রসারণ ও উৎপাদন কলাকৌশলে আধুনিক পদ্ধতির অনুসরণই একমাত্র উপায়।
আমাদের দেশে একমাত্র রবি মৌসুমেই (অক্টোবরের চতুর্থ সপ্তাহ হতে মধ্য নভেম্বর) সরিষার চাষ করা হয় এবং দেশের প্রায় সব জেলাতেই সরিষা আবাদ হলেও মাগুরা, যশোর, শেরপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, রংপুর, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, খাগড়াছড়ি ইত্যাদি জেলায় বেশি পরিমাণে সরিষা আবাদ হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সরিষার স্বল্প জীবনকালের, উচ্চফলনশীল ও সর্বাধিক প্রচলিত জনপ্রিয় জাতসমূহ হচ্ছে- বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-১৮, বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১০, বিনাসরিষা-১১, বিনাসরিষা-১২ ইত্যাদি, যেগুলোর জীবনকাল ৮০-৮৮ দিন এবং গড় ফলন ১.৭-২.০ মে. টন/হে.। নি¤েœ সরিষার জনপ্রিয় জাতসমূহের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো:
বারি সরিষা ১৪ : বর্তমানে সরিষার উচ্চফলনশীল জাত হিসেবে বারি সরিষা ১৪ খুবই জনপ্রিয় এবং এই জাত চাষ করে কৃষকরা আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হচ্ছেন। এর বীজে তেলের পরিমাণ ৪৩ থেকে ৪৪ শতাংশ, এই জাতটি টরি-৭ এর বিকল্প জাত হিসেবে চাষ করা যায় এবং এই জাতের শুঁটি ৪ প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট হয়।
বারি সরিষা -১৫ : এক হাজার (১০০০) বীজের ওজন ৩.২৫-৩.৫০ গ্রাম। ফসল ৮০-৮৫ দিনে পাকে। প্রতি হেক্টরে ১.৫৫-১.৬৫ টন ফলন পাওয়া যায়। আমন ধান কাটার পর স্বল্প মেয়াদি জাত হিসেবে চাষ করে বোরো ধান রোপণ করা যায়।
বারি সরিষা-১৭ : এক হাজার (১০০০) বীজের ওজন ৩.০-৩.৪ গ্রাম। ফসল ৮২-৮৬ দিনে পাকে। প্রতি হেক্টরে ১.৭-১.৮ টন ফলন পাওয়া যায়। জাতটি স্বল্প মেয়াদি হওয়ায় রোপা আমন-সরিষা-বোরো ধান শস্যবিন্যাসের জন্য উপযুক্ত। 
বারি সরিষা -১৮ : এটি ক্রসিফেরি পরিবারের ব্রাসিকা ন্যাপাস প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশে উদ্ভাবিত প্রথম ‘ক্যানোলা’ বৈশিষ্টে জাত। জাতটির  জীবনকাল ৯৫-১০০ দিন। এ জাতের তেলে ইরোসিক এসিডের পরিমাণ ১.০৬% যেখানে বর্তমানে বাংলাদেশে চাষকৃত অন্যান্য উন্নত সরিষার জাতে ইরোসিক এসিডের পরিমাণ ৩৫-৪০% এবং গ্লুকোসিনোলেটের পরিমাণ ১৪ মাইক্রোমোল (প্রচলিত জাতে ২৫-৩০ মাইক্রোমোল)। এ জাতের গড় ফলন ২.০০-২.৫০ টন/হেক্টর। এ জাতে তেলের পরিমাণ ৪০-৪২%। 
বিনা সরিষা-৪ : এক হাজার (১০০০) বীজের ওজন ৩.৫০-৩.৮০ গ্রাম। বীজের রঙ লালচে কালো এবং বীজে তেলের পরিমাণ ৪৪% । জীবনকাল ৮০-৮৫ দিন। সর্বোচ্চ ২.৪০ টন/হেক্টর ফলন পাওয়া যায়। তবে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১.৭০ টন।
বিনা সরিষা-৯ : জাতটি অল্টারনারিয়াজনিত পাতা ও ফলের ঝলসানো রোগ এবং বৃষ্টিজনিত সাময়িক জলাবদ্ধতা  সহনশীল। বীজে তেলের পরিমাণ ৪৩%। জীবনকাল ৮০-৮৪ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন গড়ে ১.৭০-২.০ টন। জাতটি লবণাক্ততা সহনশীল হওয়ায় দেশের সমুদ্র উপকূল এলাকায় চাষের জন্য উপযোগী। জাতটি শূন্য চাষে আবাদ করা যায়,  যেসব জমিতে জো অবস্থা আসতে বিলম্ব হয় সেসব জমিতে কাদা অবস্থায় সরিষার বীজ বপন করলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায়।
বিনা সরিষা-১০ : বীজে তেলের পরিমাণ ৪২%। জীবনকাল ৭৫-৮০ দিন। হেক্টরপ্রতি ফলন ১.৫ টন। জাতটি স্বল্প মেয়াদি হওয়ায় রোপা আমন-সরিষা-বোরো ধান শস্যবিন্যাসের জন্য উপযুক্ত।
বিনা সরিষা-১১ : ফল চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট এবং বীজ হলুদ বর্ণের। ১০০০ বীজের ওজন ৩.৫-৪.৫ গ্রাম। বীজে তেলের পরিমাণ ৪৪%। জীবনকাল: ৭৮-৮২দিন। হেক্টর প্রতি গড় ফলন ১.৬ টন। জাতটি স্বল্প মেয়াদি হওয়ায় রোপা আমন-সরিষা-বোরো ধান শস্যবিন্যাসের জন্য উপযুক্ত।
বিনা সরিষা-১২: পুষ্পমঞ্জরির মাথায় সুস্পষ্ট ঝুঁটি আছে, সব ফল মোটামুটি একই সাথে পাকে। বীজে তেলের পরিমাণ ৩৮%, তেলে ইরুসিক এসিডের পরিমাণ >২৬%। জীবনকাল ৮২-৮৬ দিন। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ২.০ টন। নি¤েœ সরিষার চাষাবাদ পদ্ধতি আলোচনা করা হলো।
জমি নির্বাচন : সব ধরনের জমিতে চাষ করা যায় তবে বেলে দো-আঁশ হতে এটেল দো-আঁশ মাটিতে জাতটি ভাল জন্মে।
জমি তৈরি : সরিষার বীজ ছোট বিধায় ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। জমিতে যাতে বড় বড় ঢিলা ও আগাছা না থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
বীজ বপনকাল : সাধারণত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ হতে মধ্য নভেম্বর (কার্তিকের দ্বিতীয় হতে শেষ সপ্তাহ) পর্যন্ত এ জাতের সরিষা বপন করার উপযুক্ত সময়। তবে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ (পৌষের প্রথম সপ্তাহ) পর্যন্ত বীজ বপন করলেও সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়।
বীজ হার ও বপন পদ্ধতি : সরিষার বীজ সাধারণত ছিটিয়ে  এবং সারিতে উভয় পদ্ধতিতেই বপন করা যেতে পারে। তবে সারিতে বুনলে সার ও সেচ প্রয়োগ এবং নিড়ানি দিতে সুবিধা হয়। বীজ ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি বীজ হার ৭.৫ কেজি (একর প্রতি ২.৮-৩.০ কেজি)। সারিতে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি বীজ হার অপেক্ষাকৃত কম লাগে, হেক্টরপ্রতি বীজ হার ৬.০ কেজি (একরপ্রতি ২.২-২.৫ কেজি)। তবে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কম হলে বা জমিতে রসের ঘাটতি হলে, বীজের হার বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তবে অধিক হারে বীজ বপনের ফলে জমিতে অধিক সংখ্যক গাছ জন্মালে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফল কম ধরে ও ফলন কমে যায়।
বপন দূরত্ব : সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সেমি. এবং সারিতে চারার দূরত্ব অর্থাৎ গাছ থেকে গাছের দূরত ¡৩-৫ সেমি.।
বীজ শোধন : অল্টারনারিয়া ব্লাইট সরিষার প্রধান রোগ যা বীজবাহিত। প্রতি কেজি বীজে ২-৩ গ্রাম প্রোভ্যাক্স-২০০ ছত্রাকনাশক দিয়ে শোধন করে লাগালে এই রোগটি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
সারের পরিমাণ : কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা কম-বেশি হয়। সরিষার জাতসমূহ চাষের জন্য একর (১০০ শতাংশ) প্রতি অনুমোদিত সারের মাত্রা সারণি দ্রষ্টব্য।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি :  অর্ধেক পরিমাণ ইউরিয়া এবং অন্যান্য সারের সবটুকু জমি তৈরির শেষ চাষের সময় মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর অর্থাৎ ফুল আসার আগেই উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা : চারা গজানোর ২০-২৫ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ এবং প্রয়োজনে ফুল ফোটা শেষ হলে দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে। তবে জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে সেচ দেয়ার প্রয়োজন নেই। চারা গজানোর ১৫-২০ দিনের মধ্যে একবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা এবং অতিরিক্ত চারা উঠিয়ে ফেলতে হবে।
বালাই ব্যবস্থাপনা : পাতা ও ফলের ঝলসানো বা অলটারনারিয়া ব্লাইট রোগ এবং জাবপোকা সরিষা চাষের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে অলটারনারিয়া ব্লাইট রোগের প্রকোপ বেড়ে গেলে প্রতি লিটার পানিতে ২-৩ গ্রাম রোভরাল-৫০ ডব্লিউপি ৮-১০ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
জাবপোকার আক্রমণে গাছ দুর্বল হয়ে যায় এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এ পোকা দমনে ম্যালাথিয়ন-৫৭ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২.০ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে সম্পূর্ণ গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। আগাম চাষ করে জাবপোকার আক্রমণ কমানো যায়।
ফসল কর্তন, মাড়াই এবং সংরক্ষণ : উপযুক্ত সময়ে ফসল কর্তনের ব্যাপারে অধিক যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। যখন গাছের পাতার রং হলুদ, ফল নাড়াচাড়া করলে শব্দ হয়, তখন ফসল কর্তনের উপযুক্ত সময়। নেপাস প্রজাতির বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১৮ এর অধিকাংশ গাছ খড়ের রং ধারণ করলে এবং ৭০-৮০% ফল পেকে গেলে সকাল বেলা আর্দ্র আবহাওয়ায় ফসল কর্তন করতে হবে। কারণ এ জাতের সরিষা বেশি পেকে গেলে নিচের দিকের ফল ফেটে বীজ ঝরে যেতে পারে। তবে অন্যান্য জাতের ক্ষেত্রে ৮০-৯০% ফল পেকে খড়ের রং ধারণ করলেকর্তন করতে হবে। কর্তিত ফসল ২-৩ দিন স্তূপ করে রেখে পরবর্তিতে রৌদ্রে শুকিয়ে মাড়াই করতে হবে। উল্লেখ্য যে, গাদা অবস্থায় ৩ দিনের বেশি থাকলে অংকুরোদগম ক্ষমতা কমে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। মাড়াই করা বীজ ভালোভাবে সংরক্ষণের জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে:
মাড়াই করার পর বীজ বিশেষ যত্ন সহকারে শুকাতে হবে। মনে রাখতে হবে কড়া রোদে একটানা অনেকক্ষণ ধরে শুকালে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই প্রতিদিন ২-৩ ঘন্টা করে একটানা কয়েক দিন শুকাতে হবে। শীতকালে যখন রোদের তাপ কম থাকে তখন একটানা ৪-৫ ঘণ্টা ধরে শুকালেও কোন ক্ষতি হয় না। বীজ সরাসরি সিমেন্টের তৈরি খোলায় না শুকিয়ে ত্রিপল বা চাটাইয়ের উপর শুকাতে হবে। বীজ এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে বীজের আর্দ্রতা ৮% এর বেশি না থাকে। শুকনো বীজ দাঁত দিয়ে কামড় দিলে যদি ‘কট’ শবাদ করে বীজ ভেঙে যায় তবে বুঝতে হবে যে বীজ ভালোভাবে শুকিয়েছে।
 শুকানোর পর বীজ ভালোভাবে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে।
 বীজ রাখার জন্য পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক/ টিনের ড্রাম, আলকাতরা মাখা মাটির মটকা/কলসী, বিস্কুটের টিন ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মোটা পলিথিন ব্যাগে বীজ রেখে মুখ খুব শক্ত করে বেঁধে নিয়ে তা একটি চটের বস্তায় ভরে রাখলেও বীজ ভালো থাকে। পলিথিনের ব্যাগ বা ধাতব পাত্রের মুখ খুব ভালোভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে যেন ভেতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। মনে রাখতে হবে বীজ শুকানোর পর গরম অবস্থায় সংরক্ষণ না করে ঠা-া হলে সংরক্ষণ করতে হবে।
 বীজের পাত্র অবশ্যই ঠা-া ও শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে এবং সরাসরি মেঝেতে না রেখে মাচা বা কাঠের উপর রাখতে হবে। 
 সংরক্ষিত বীজের আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেলে প্রয়োজনমতো রোদে শুকিয়ে পূর্বের নিয়মে সংরক্ষণ করতে হবে।
 
লেখক :  ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিনা, ময়মনসিংহ-২২০২, বাংলাদেশ। মোবাইল : ০১৭১৭৯৭৫৯২৬, ই-মেইল : khadija_bina@gmail.com
বিস্তারিত
ফসলের-আইলে-পাট-জাতীয়-ফসলের-বীজ-উৎপাদন-প্রযুক্তি
ফসলের আইলে পাট জাতীয় ফসলের 
বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি
ড. মোঃ বাবুল হোসেন
বাংলাদেশে জমির সীমানা নির্ধারণ করার জন্য ৬ ইঞ্চি হতে ২৪ ইঞ্চি (২ ফুট) বা তারও বেশি প্রস্থতার আইল ব্যবহৃত হয়। এই আইল সীমানা নির্ধারণ করা ছাড়াও চলাফেরার কাজে ব্যবহৃত হয়। অপরদিকে একখ- জমি বর্তমানে যে মালিকানা নিয়ে টিকে আছে, কয়েক বছর যেতে না যেতেই মালিকানা আরো বেড়ে খ- বিখ- হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক মালিক আবার সীমানা নির্ণয় করতে গিয়ে, জমির সীমানায় আইল তৈরি করছেন। এতে যত আইল বাড়ছে, বাংলাদেশের মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আইলে কৃষি জমির এই উৎপাদন বিমুখতা তাতে এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এতে প্রভাব পড়ছে আবাদে। ফলে ঐ সীমানার আইলে আবাদি জমিতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কৃষি বর্ষগ্রন্থ ২০২১ এর সূত্র মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৮.১৭৯৩৫ লাখ হেক্টর। জমি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জমির মালিকানা নির্ধারণে সীমানা করতে গিয়ে আইলের জন্য যে পরিমাণ জমি যাচ্ছে তার পরিমাণ মোট জমির প্রায় ২ ভাগ (রায়, ২০২২)। সে হিসাবে আইলের ব্যবহার হয়েছে এমন জমির পরিমাণ প্রায় ১.৭৬ লাখ হেক্টর। আবার অনেক সময় মৌখিকভাবে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের সব আইলের আয়তন এক করলে প্রায় বগুড়া (২.৯২ লাখ হেক্টর) জেলার সমান হবে (কামাল, ২০১১)। 
পাট বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪.০-৪.৫ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট ও এ জাতীয় ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের রপ্তানি আয় হয়েছে ৯১২.২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। উক্ত সময়ের মোট রপ্তানি আয়ে এখাতের অবদান ছিল শতকরা ১.৬৪ ভাগ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৭.৫৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসল চাষ হয়। যার মধ্যে দেশি পাট ০.২৮৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষের জন্য বীজ প্রয়োজন ২৩০ মে. টন (বীজ হার প্রতি হেক্টরে ৮ কেজি); তোষা পাট ৬.৭৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষের জন্য বীজ প্রয়োজন ৪০৬৬ মে. টন (বীজ হার প্রতি হেক্টরে ৬ কেজি); মেস্তা ০.১৮৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষের জন্য বীজ প্রয়োজন ২১৯ মে. টন (বীজ হার প্রতি হেক্টরে ১২ কেজি) এবং কেনাফ ০.২৮৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষের জন্য বীজ প্রয়োজন ৪৩০ মে. টন (বীজ হার প্রতি হেক্টরে ১৫ কেজি)। এছাড়াও সংরক্ষণজনিত কারণে ক্ষতি এবং বীজ ফসল ও পাটশাক চাষের জন্য অতিরিক্ত আরো বীজ প্রয়োজন হয়। উপরোক্ত আলোচনা ও হিসাব হতে বলা যায় বাংলাদেশে প্রতি বছর পাট ও পাট জাতীয় ফসলের ৫৫০০ থেকে ৬০০০ মে. টন বীজ প্রয়োজন। আর উক্ত পরিমাণ পাট ও পাটজাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদন করতে প্রায় ৮০০০-১০০০০ হেক্টর জমি প্রয়োজন। 
জুলাই-আগস্ট (আষাঢ়-ভাদ্র) মাসে মাঝারি উঁচু জমিতে পাট বীজ চাষের উপযুক্ত সময়। কিন্তু উক্ত সময়ে কৃষক মাঝারি উঁচু জমিতে রোপা আমন ধান ও সবজিজাতীয় উচ্চমূল্যের ফসল চাষ করতে আগ্রহী। আবার পাট বীজ ফসল দীর্ঘমেয়াদি এবং সময় ও জমির ভিত্তিতে আমন ও রবি ফসলের সাথে প্রতিযোগিতা করে। ফলে একক ফসল হিসাবে শুধুমাত্র পাট বীজ উৎপাদন কৃষকের নিকট লাভজনক নয়। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), পাট অধিদপ্তর, বিভিন্ন বীজ কো: লি., কৃষকসহ সবাই মিলে বিজেআরআই উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের উৎপাদিত বীজে আঁশ উৎপাদন হয় মাত্র শতকরা ২৫-৩০ ভাগ। অপর দিকে পাট শিল্পের সাথে জড়িত অভিজ্ঞদের মতে বিজেআরআই উদ্ভাবিত জাত থেকে উপাদিত আঁশ গুণগতমান ভাল এবং লাভজনক।
এমন প্রেক্ষাপটে রোপা আমন ধান ও সবজি পরিবেশে অব্যবহৃত জমির আইলে ও আইল বরাবর জমিতে আমন ধান ও সবজির আবাদে কোন পরিবর্তন না করেই পাট ও পাটজাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রযুক্তিতে কৃষক রোপা আমন ধান বা বেগুন, টমেটো, ঢেঁড়স, মরিচ ইত্যাদির পাশাপাশি নিজের প্রয়োজনীয় পাট বীজ উৎপানের জন্য ঐ সকল জমির আইল বা আইল বরাবর জমিতে পাট বীজ ফসল উৎপাদন করতে পারে। ফলে আমন ধান বা সবজি (বেগুন, টমেটো, ঢেঁড়স, মরিচ ইত্যাদি) উৎপাদনে তেমন পরিবর্তন না করেই প্রয়োজনীয় পাট বা কেনাফ বীজ উৎপাদন করা সম্ভব।
প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য
া বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলার মাঝারি উঁচু ও উঁচু জমিতে এই প্রযুক্তি অনুসরণযোগ্য।
া জমি ব্যবহার না করে ১ বিঘা জমির ১০০ হতে ১২০ মিটার লম্বা আইলের অর্ধেক ব্যবহার করে ১ বিঘা জমিতে প্রয়োজনীয় ৭০০-৮০০ গ্রাম তোষা পাটের বীজ পাওয়া যায়।
া ১ বিঘা জমির ১০০ হতে ১২০ মিটার লম্বা আইল ব্যবহার করে ১ বিঘা জমিতে কেনাফ চাষের প্রয়োজনীয় ১.৫-২.০  কেজি বীজ পাওয়া যায়। 
া সবজি বা আমন ধানের জমি সরাসরি ব্যবহার হচ্ছে না বা খুবই কম ব্যবহার হচ্ছে বলে পাট বা কেনাফ বীজ চাষে কৃষক সহজেই উৎসাহিত হবে।
া এ প্রযুক্তিতে পাট বীজের সমতুল্য মোট ফলন ১০-১৫ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। 
া বাজার থেকে কেনা নিম্নমানের বীজের পরিবর্তে কৃষকের নিজের উৎপাদিত পর্যাপ্ত গুণগতমান সম্পন্ন পাট বা কেনাফের বীজ ব্যবহার করতে পারবে।
া নিম্নমানের ও কম অংকুরোদম ক্ষমতা সম্পন্ন বীজের কারণে ফসল ক্ষতির ঝুঁকি থাকবে না।
া পাট ও পাটজাতীয় ফসলের বীজের আমদানি নির্ভরতা কমে যাবে।
া এ প্রযুক্তিতে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে।
জমি নির্বাচন : রোপা আমন বা সবজি চাষ করা হয় এমন মাঝারি উঁচু জমির যে সকল আইল চলাফেরা বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা হয় না এবং পানি জমে থাকে না সেই সকল আইল পাট বা কেনাফের বীজ চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। অথবা জমির একপার্শ্বে আইল বরাবর দেড় (১.৫০) মিটার চওড়া জমি উপআইল দিয়ে পৃথক করে নিতে হবে।
চাষ পদ্ধতি  
সরাসরি বপন : পাট বা কেনাফের বীজ জো জমিতে চাষ করে অথবা সুনিষ্কাশিত কাদা করা জমিতে সরাসরি বীজ বপন করে চাষ করা যায়।
ডগা (কাটিং) রোপণ : উত্তম জো অবস্থায় জমি চাষ ও মই দিয়ে তোষা পাটের ডগা রোপণ করতে হবে। তবে কাদাকরা জমিতে তোষা পাটের ডগা রোপণ করলে অধিকাংশ ডগা মারা যায় তাই তোষা পাটের ডগা কাদাকরা জমিতে রোপণ না করে জো জমিতে ঝুরঝুরে মাটিতে রোপণ করা উচিত। এক্ষেত্রে ১০০-১১০ দিন বয়সের মাতৃ গাছের ডগা (কাটিং) ৫-৭ ইঞ্চি লম্বা (২-৩টি গিটসহ) তেছড়াভাবে কেটে উত্তর-দক্ষিণ দিকে ৪৫ ডিগ্রি হেলানোভাবে রোপণ করতে হবে।
চারা রোপণ : বৃষ্টি বা সেচের কারণে চাষকৃত জমি কর্দমাক্ত নরম হলে ৩০-৪০ দিন বয়সের পাট বা কেনাফের চারা রোপণ করে বীজ ফসল চাষ করা যায়। এক্ষেত্রে চারা হতে চারা ৮-১০ সেমি. পরপর এবং ৩০ সেমি পরপর সারি করে রোপণ করতে হবে।
পাট বা কেনাফের বীজতলা তৈরি : রোপণ পদ্ধতিতে বীজ চাষের জন্য জুলাই-আগস্ট মাসে চাষকৃত জমি হতে পাতলাকরণকৃত চারা বা বীজতলার ৩০-৪০ দিন বয়সের চারা ব্যবহার করা যায়। প্রতি শতাংশে পাট বা কেনাফের চারা রোপণ করার জন্য ১২০০-১৫০০ চারা প্রয়োজন হয়। 
চাষের সময় : বীজ বপন বা ডগা রোপণ করার ক্ষেত্রে জুলাই-আগস্ট মাস উত্তম। মধ্য আগস্ট-মধ্য সেপ্টেম্বর ৩০-৪০ দিনের চারা রোপণ করা যায়। পাট বা কেনাফের চারা সংগ্রহ করে ঐ দিনেই রোপণ করতে হবে। 
জাত নির্বাচন : তোষা জাত : ও-৯৮৯৭, বিজেআরআই তোষা পাট ৬, বিজেআরআই তোষা পাট ৮, বিজেআরআই তোষা পাট ৯; কেনাফ জাত: এইচসি-৯৫, বিজেআরআই কেনাফ ৩, বিজেআরআই কেনাফ ৪ এবং দেশী জাত: সিভিএল-১, বিজেআরআই দেশি পাট ৫, বিজেআরআই দেশি পাট ৮, বিজেআরআই দেশি পাট ৯, বিজেআরআই দেশি পাট ১০। সার প্রয়োগ : জমির উর্বরতা বিবেচনায় সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতাংশে টিএসপি ২৫০-৩০০ গ্রাম, এমওপি ৩০০-৩৫০ গ্রাম, জিপসাম ৪০০-৪৫০ গ্রাম, জিংক সালফেট ৪০-৪৫ গ্রাম হারে শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতাংশে ইউরিয়া ৪০০-৪৫০ গ্রাম সমান দুই ভাগে ভাগ করে বীজ বপন, ডগা বা চারা রোপণের ১৫-২০ দিন ও ৪০-৪৫ দিন হলে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
পাতলাকরণ ও আগাছা পরিষ্কার : পাতলাকরণ ও আগাছা পরিষ্কার করার পরে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। জমিতে জো আসার সাথে সাথে আঁচড়া বা নিড়ি দিয়ে জমির মাটি আগলা বা ঝুরঝুরে করে দিলে মাটিতে আর্র্দ্রতা সংরক্ষিত থাকবে।
নিষ্কাশন ব্যবস্থা : পাট বা কেনাফ ফসল দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। আবার স্যাঁতস্যেঁতে জমিতে ফসলের বৃদ্ধি ভালো হয় না। তাই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে জমিতে জো অবস্থা বিরাজ করে।
রোগ ও পোকামাকড় দমন : রোগ ও পোকামাকড় ক্ষতির পর্যায়ে যাওয়ার আগেই দমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা : রোপা আমন বা সবজির সাথে চাষকৃত পাট বা কেনাফ বীজ ফসল চার দিকে বাঁশের খুঁটি পুঁতে নেট দিয়ে ঘিরে দিয়ে ক্ষতি বা হেলে পড়া হতে রক্ষা করতে হবে। 
বীজ ফসল কাটা : পাট বা কেনাফের ফল ৭০-৮০ ভাগ (ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে মধ্য জানুয়ারি মাসে) খয়েরি রং ধারণ করলে ফলসহ ডগার অংশ কেটে নিতে হবে। বাড়িতে গোবর লেপা উঠান বা চটের উপর পাতলা করে বিছিয়ে শুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কোন অবস্থায় স্তূপ করে রাখা যাবে না। রোদে শুকানো বীজ গাছ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বীজ আলাদা করতে হবে। মাড়াইকৃত বীজ পরিষ্কার করে ও শুকিয়ে (৮-১০ ভাগ আর্দ্রতায়: দুই দাঁতের মাঝে কট শব্দ হয়) বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। 
প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ : পাট বা কেনাফের ভালো বৃদ্ধির জন্য জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে; কর্দমাক্ত আইলে চারা রোপণ পদ্ধতিতে ৩০-৪০ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে; মাঝারি উঁচু জমিতে চাষকৃত আমন ধানের জমির যে সকল আইল চলাফেরার কাজে ব্যবহার হয় না কেবল সেই সব আইলে পাট বা কেনাফের চারা রোপণ করতে হবে; রোপণের সময় উত্তম জো অবস্থা বজায় রাখা যায় এমন জমিতেই কেবল তোষা পাটের ডগা রোপণ করতে হবে; আইলের প্রস্থতার উপর ভিত্তি করে এক বা দুই সারিতে চারা রোপণ করা যায়; পাট বা কেনাফের গাছ যাতে হেলে না পড়ে তার জন্য আইলের মাঝে খুঁটি পুঁতে রশির মাধ্যমে খাঁড়া করে রাখতে হবে।
 
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জুট ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইল: ০১৭১৯ ৩৬২১৬১ (নগদ), ই-মেইল:babulbjri@yahoo.com
বিস্তারিত
শীতকালীন-সবজি-ও-ফুল-চাষ

শীতকালীন সবজি ও ফুল চাষ
কৃষিবিদ সিলমিন জাহান ইলমা
সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাস শীতকালীন সবজি ও ফুল চাষের উপযুক্ত সময়। তবে চাইলে আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বীজ থেকে চারা তৈরি করে রোপণ করা যায়। 
পুঁইশাক, কলমিশাক, লালশাক, ধনেপাতা, ডাঁটা, পালংশাক, বথুয়া শাক, লেটুস, মুলা, বিট, শালগম, গাজর, আলু, পিয়াজ, রসুন, বেগুন, মরিচ, ক্যাপসিকাম, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, ওলকপি, শিম, লাউ, স্কোয়াশ, শসা, করলা ইত্যাদি। শীতকালীন সবজি চাষাবাদ করা হয়। অনুরূপভাবে গাঁদা, জিনিয়া, কসমস, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, ভারবেনা, ক্যালেন্ডুলা, মেলাম্পোডিয়াম, পিটুনিয়া, ডায়ান্থাস, ফ্লক্স, স্যালভিয়া, নয়নতারা, গোলাপ ইত্যাদি শীতকালীন ফুল চাষ করা হয়। 
তাছাড়া, এই সময় করমচা, কাউফল, বিলাতিগাব, আমলকী, শরিফা, ডালিম, কামরাঙ্গা, অড়বরই, বহেরা, তাল ইত্যাদি ফলের বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়। 
বীজ/ চারা নির্বাচন
ভালো জাতের বীজ বা চারা নির্বাচন জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারি হর্টিকালচার সেন্টার বা বিশ^স্ত নার্সারি থেকে বীজ/ চারা সংগ্রহ করতে হবে। বীজ এর জন্য যে কোন ভালো ব্র্যান্ড যেমন- লালতীর, এসিআই, মেটাল, ইউনাইটেড, মল্লিকার যে কোন সবজি বীজ সংগ্রহ করা যেতে পারে। 
বীজ থেকে চারা করার পদ্ধতি
৫০ ভাগ কোকোপিট ও ৫০ ভাগ অন্যান্য সার, বালু ও মাটির মিশ্রণ পটিং মিডিয়া হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। মরিচ, ক্যাপসিকাম, বেগুন, করলা- এসব বীজ ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে দ্রুত অঙ্কুরোদগম হয়। শসা, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, শিম ইত্যাদি বীজ ১২ ঘণ্টা ভিজালেই হবে। তারপর বীজ হালকা একটু শুকিয়ে নিয়ে পটিং মিডিয়ায় পাতলা করে ছড়িয়ে দিন। তার ওপর হালকা করে পটিং মিডিয়া দিয়ে একটি পলিথিন শিট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। 
বিকল্পভাবে, আপনি একটি ভেজা কাগজের তোয়ালের মধ্যে বীজ মুড়ে রেখে একটি সিলবিহীন প্লাস্টিকের ব্যাগে কাগজের তোয়ালে রেখে বীজ অঙ্কুরিত করতে পারেন। ব্যাগটি একটি ছোট গ্রিনহাউজ হিসেবে কাজ করবে, তাপ এবং আর্দ্রতা ধরে রাখবে। বীজকে অঙ্কুরিত হতে উৎসাহিত করবে। বেশির ভাগ বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গেলে সাবধানে বীজগুলোকে একটি ট্রেতে স্থানান্তর করুন। প্রতিটি চারা ১/৪ থেকে ১/২ ইঞ্চি গভীরে রোপণ করুন।  
বেগুন, মরিচ, ক্যাপসিকাম ১ মাস পর মাঠে রোপণের জন্য উপযুক্ত হয়। শিম, ফ্রেঞ্চবিন, লাউ, স্কোয়াশ, শসা, করলা, বরবটি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, ওলকপি, শালগম, লেটুস, টমেটো অঙ্কুরোদগম হতে ৩-৪ দিন সময় লাগে এবং ২০-২৫ দিন পর মাঠে চারা রোপণ করা যায়।  
চার রোপণ
চারা রোপণের জন্য জমিতে গোবর সার ও অন্যান্য জৈবসারসহ ইউরিয়া, টিএসপি, ও এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে জমি ভালোভাবে মই দিয়ে সমান করে নিতে হবে। তারপর নির্দিষ্ট দূরত্বে গাছ লাগাতে হবে। ছাদবাগানের জন্য বেগুন, মরিচ, ক্যাপসিকাম, টমেটো ও ঢ্যাঁড়সগাছের জন্য ১০-১২ ইঞ্চি টব বা জিও ব্যাগ ব্যবহার করতে পারেন। চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, লাউ, শিম, বরবটি, করলা ইত্যাদি গাছের জন্য হাফ ড্রাম বা ২০-২৪ ইঞ্চি জিও ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। 
শাকবীজ বপণের জন্য বীজতলায় বীজ ছিটিয়ে দিতে হবে। পুঁইশাক, কলমিশাক, লেটুস ইত্যাদি লাইনে বপন করা ভালো। এমনভাবে বপন করতে হবে যেন প্রতি ইঞ্চিতে তিন-চারটি বীজ পড়ে। প্রয়োজনে বীজের সাথে কিছু জৈবসার বা মাটি ঝুরঝুরে করে মিশিয়ে দিলে ছোট ছোট বীজ বপন করা সহজ হয়। চারা না বের হওয়া পর্যন্ত মাটি হালকা ভেজা রাখতে হবে। পাখির উপদ্রব থেকে বাঁচতে নেট ব্যবহার করতে পারেন। বীজ অধিক পরিমাণ অঙ্কুরিত হলে কিছু শাক সময়ে সময়ে পাতলা করে দিতে হবে। ছাদে বানানো বেড বা বয়া বা ক্যারেট বা জিও ব্যাগ বেডে ১ ফুট গভীর মাটি থাকলেই চলবে।
সেচ ব্যবস্থাপনা
শীতকালে কুয়াশা কাটিয়ে যখন রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ তৈরি হবে, তখন পানি সেচ দেওয়া উত্তম। ছাদবাগানের ক্ষেত্রে সাধারণত টবের মাটির ওপরের অংশ দুই ইঞ্চি শুকালে পুনরায় পানি দিতে হয়। অতিরিক্ত বা অতি কম পানি উভয়ই গাছের জন্য ক্ষতিকর। শাকসবজির গাছ পানির অভাব একেবারেই সহ্য করতে পারে না। লাউ, শিম, বরবটি, করলাজাতীয় গাছের জন্য বেশি পানির প্রয়োজন হয়। তাই ঘন ঘন পানি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। গাছ পানিশূন্যতায় থাকলে  প্রাথমিকভাবে পাতা নিচের দিকে কুঁচকে যায়, গাছ নেতিয়ে যেতে থাকে। এসময় হঠাৎ করে অতিরিক্ত পানি না দিয়ে অল্প অল্প করে পানি দিতে হবে। হঠাৎ অতিরিক্ত পানিতে গাছের ক্ষতি হয়। গাছে ফল থাকলে ফল ফেটে যেতে পারে। 
সার ব্যবস্থাপনা
ঢাকনাসহ একটি ড্রামে ১ কেজি খৈল ও ৫ কেজি গোবর ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে কমপক্ষে ১৫ দিন পচাতে হবে। সাথে এক মুঠো পটাশ সার ও এক মুঠো ফসফরাস সার মিশ্রিত করা যেতে পারে। প্রতিদিন একটি বড় লাঠি দিয়ে নাড়িয়ে দিতে হবে। খৈলপচা পানি নাড়িয়ে পুনরায় ড্রাম ঢেকে দিতে হবে। এতে করে পোকা হবে না এবং দীর্ঘদিন (প্রয়োজনে এক বছর) এই পানি ব্যবহার করা যাবে। খৈলপচানো পানির সাথে দশ গুণ পরিমাণ পানি মিশিয়ে ৮-১০ দিন পরপর গাছে প্রয়োগ করা যেতে পারে। খৈল সার দেওয়ার পরই নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে পানি দিতে হবে। ছাদবাগানে বারোমাসি গাছের জন্য দুটি সিলভামিক্স ট্যাবলেট সার দেওয়া যেতে পারে। তবে মৌসুমি জাতের জন্য সিলভামিক্স ট্যাবলেট সারের প্রয়োজন নেই। শাকজাতীয় গাছের ক্ষেত্রে কিছুটা ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে খৈল ছাড়াও আরও কিছু জৈবসার ঘরে বানিয়ে প্রয়োগ করতে পারেন। তারপরও যদি উদ্ভিদের কোনো পুষ্টি উপাদানের অভাব হয়, তবে সারের অভাবজনিত লক্ষণ দেখে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা 
বাগান করার পর থেকে যদি আপনি কিছু হলুদ আঠালো কাগজ, ফেরোমন ট্র্যাপ, বিশেষ করে লাউজাতীয় গাছ, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, আম, পেয়ারা, কমলাগাছের পাশে ব্যবহার করা যায়, ৮-১০ দিন পরপর ঘরে বানানো কীটনাশক স্প্রে করে করা হয়, প্রুনিং করে গাছকে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা হয়, মালচিং, ডিপটিং ও রিপটিং এবং সুষম সার, সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ পানি সেচ দেওয়া হয়, তবে বাগানে এমনিতেই পোকামাকড়ের আক্রমণ সহনশীল পর্যায়ে থাকবে। তা ছাড়া গাছে ফল ধরার পর ফল ব্যাগিং করে দিলে ফলের ভেতর ফ্রুট ফ্লাই তার অভিপজিটর দিয়ে ডিম পাড়তে পারে না বিধায় ফলের ভেতর কিড়া হয় না। শুধু আম, পেয়ারা নয়, বরং লাউ, শসা, কুমড়া, করলা- এ সবই ফ্রুট ব্যাগিংয়ের মাধ্যমে  ফলে রক্ষা করা যায়।
বাড়িতে তৈরি কিছু কীটনাশক
সাবান : এক লিটার পানিতে দেড় চা-চামচ তরল সাবান ঝাঁকিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।
নিম তেল : দুই চা-চামচ নিম তেল ও এক চা-চামচ তরল সাবান এক লিটার পানির সাথে ভালোভাবে মিশ্রিত করে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করা যেতে পারে।
মরিচের গুঁড়া : এক চা-চামচ শুকনা মরিচের গুঁড়া, এক চা-চামচ পেঁয়াজ/রসুনের রস ও কয়েক ফোঁটা তরল সাবান এক লিটার পানির সাথে ভালোভাবে মিশ্রিত করে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করা যেতে পারে।
প্রুনিং ও পিঞ্চিং
পিঞ্চিং ও প্রুনিং করলে গাছ ঝোপালো হয় এবং ফুল ও ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চারা ৬-৮ ইঞ্চি হলে গাছের পাতা বা কুঁড়ির শেষ অংশটি সরিয়ে ফেলাকে পিঞ্চিং বলে। এতে করে গাছে দুই-তিনটি পাশর্^ীয় কা- বের হয়। যার ফলে আরও পাতা ও ফুল হয়। ফুল গাছের ক্ষেত্রে ফুল ধরার পর শুকিয়ে যাওয়ার আগেই কেটে দিলে ফুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। 
মালচিং
জৈব উপাদান, যেমন-গাছের বাকল, পাতা, কাঠের টুুকরো এবং অজৈব উপাদান, যেমন পাথর বা ইটের টুকরো দ্বারা গাছের শিকড়ের চারপাশে ফুল/সবজিচারার ক্ষেত্রে এক ইঞ্চি ফাঁকা রেখে বাকি অংশে ১- ১.৫ ইঞ্চি পুরু করে ঢেকে দেওয়া হয়। ক্ষতিকর পোকামাকড় থেকে গাছকে বাঁচাতে নিমখৈল বা দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন। এভাবে মালচিং করলে জৈব উপাদান মাটির সাথে মিশে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করে, মাটিতে পানি ধরে রাখে, মাটির অপচয় রোধ করে, আগাছা জন্মানো রোধ করে এবং উপকারী পোকা ও মাকড়ের জন্য খাদ্যের জোগান দেয়।
কুমড়াজাতীয় ফসলের হাত পরাগায়ন
হাত দিয়ে কুমড়াজাতীয় ফসলে পরাগায়ন করাকে হাত পরাগায়ন বলে। পুরুষ ফুলের পরাগধানীতে পরাগরেণু থাকে। পরাগায়নের জন্য পরাগরেণু স্ত্রী ফুলের গর্ভমু-ে স্থানান্তর করতে হবে এবং তাতেই দেখবেন ফল ধারণ করবে। তবে খেয়াল রাখবেন, পরাগায়ন যেন সঠিকভাবে হয়।
শসা : পুরুষ ও স্ত্রী ফুল উভয়ই সকালে ফোটে। পুরুষ ফুলের পরাগরেণু সর্বোচ্চ বেলা দুইটা পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকে এবং বেলা বাড়ার সাথে সাথে নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। স্ত্রী ফুলের গর্ভমু- খুব কম সময়ের জন্যই সক্রিয় থাকে। তাই স্ত্রী ফুল ফোটার দুই ঘণ্টার মধ্যে পরাগায়ন করতে হবে।
করলা : সকাল ৬টা থেকে সকাল ৯টা।
লাউ : বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা।
ফল সংগ্রহ
সবজির ফল যথেষ্ট কচি অবস্থায় পরিপূর্ণ আকার ও রং প্রাপ্তির পর সংগ্রহ করতে হবে।

লেখক : সিনিয়র উদ্যানতত্ত্ববিদ, বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প, হর্টিকালচার সেন্টার, ফলবীথি, আসাদগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৪৯০১৭৬৫৭

বিস্তারিত
নিরাপদ-মাছ-উৎপাদনে- মৎস্য-অধিদপ্তর

নিরাপদ মাছ উৎপাদনে 
মৎস্য অধিদপ্তর
মোঃ জিল্লুর রহমান
বাংলাদেশের মৎস্য খাত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ খাত শুধু দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাচ্ছে না, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমেও বিশেষ অবদান রাখছে। তবে নিরাপদ মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করাও একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এই ক্ষেত্রে মৎস্য অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মাছের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং রপ্তানি কার্যক্রমে মৎস্য অধিদপ্তর নির্দিষ্ট মানদ- নিশ্চিত করে চলেছে, যা আন্তর্জাতিক মানের সাথে সঙ্গতি রেখে খাদ্য নিরাপত্তার চারটি মূল স্তম্ভ-ক্রয়ক্ষমতা, প্রাপ্যতা, মান এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ‘সকলের জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ নিশ্চিতকরণ’ মৎস্য অধিদপ্তরের অন্যতম অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকার পূরণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। 
বাংলাদেশের মৎস্য খাত বর্তমানে একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ খাত হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট ৪৯.১৫ লক্ষ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় উল্লেযোগ্য পরিমাণে বেশি। গত এক দশকে এটি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সুবিস্তৃত মুক্ত জলাশয়, অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় এবং সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ আজ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের মোট জিডিপির ২.৫৩ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২২.২৬ শতাংশ মৎস্য উপখাতের অবদান। মৎস্য খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২.৮১ শতাংশ (বিবিএস ২০২৪)। মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের পরিমাণ চাহিদার চেয়ে (৬০ গ্রাাম/দিন/জন) বৃদ্ধি পেয়ে ৬৭.৮০ গ্রামে উন্নীত হয়েছে (ঐওঊঝ, ২০২২)। মৎস্য খাতে বাংলাদেশের সাফল্য আজ আন্তর্জাতিক পরিম-লেও সর্বজনবিদিত। 
সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ঋঅঙ) ঞযব ঝঃধঃব ড়ভ ডড়ৎষফ ঋরংযবৎরবং ধহফ অয়ঁধপঁষঃঁৎব ২০২৪ এর প্্রতিবেদন অনুযায়ী মিঠা পানির মাছ আহরণে বাংলাদেশ বিশ্বে ২য় অবস্থানে উঠে এসেছে এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে ৫ম স্থান ধরে রেখেছে যা মৎস্যখাতে বর্তমান বাংলাদেশের একটি অভাবনীয় সাফল্য। এছাড়াও ক্রাস্টাশিয়ান্স আহরণে বাংলাদেশ বিশ্বে ৮ম এবং কোস্টাল ও সামুদ্রিক মাছ আহরণে ১৪তম স্থান অর্জন করেছে। বিশ্বে ইলিশ আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান ১ম, তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে ৪র্থ এবং এশিয়ায় ৩য়। দেশের প্রায় ১৪ লক্ষ নারীসহ ২ কোটি অর্থাৎ প্রায় ১২ শতাংশের অধিক জনগোষ্ঠী এ সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। বাংলাদেশের মৎস্য খাত শুধু দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণে নয়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্ত্বেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৭,৪০৭.৯৪ মে.টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ৪,৪৯৬.৩৮ কোটি টাকা অর্জিত হয়েছে। চিংড়ি ও সাদা মাছের মতো পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এখন আমাদের রপ্তানি বৈচিত্র্য বৃদ্ধি ও নতুন বাজার অনুসন্ধান প্রয়োজন।
মৎস্য খাতে উৎপাদন এবং ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে সরবরাহ, মূল্যসংযোজন, মাননিয়ন্ত্রণ, প্রক্রিয়াকরণ ও বণ্টন প্রক্রিয়া অন্যান্য খাতের চেয়ে ভিন্ন ও জটিল এবং অনেক কুশীলব সম্পৃক্ত। এ প্রক্রিয়া সমন্বিতভাবে গড়ে তুলতে না পারলে উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত একটি সুস্থিত সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব এবং নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ সরবরাহের বিষয়টিও ঝুঁকিতে পরবে।
উৎপাদন ব্যাবস্থার সাথে সাথে খাদ্য নিরাপত্তার ৪টি মৌলিক স্তম্ভ-ক্রয়ক্ষমতা, প্রাপ্যতা, মান ও নিরাপদতা (ঝধভবঃু) গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। উৎপাদনে যথেষ্ট সফলতা থাকলেও এষড়নধষ ঋড়ড়ফ ঝবপঁৎরঃু ওহফবী, জবঢ়ড়ৎঃ ২০২২ অনুযায়ী ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০ তম। কাজেই ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সকলের জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ নিশ্চিতকরণে সকল পক্ষকেইে একসাথে কাজ করে যেতে হবে।
মৎস্য ও মৎস্যপণ্য বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে নিরাপদ ও মানসম্মত মৎস্যপণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা মৎস্য অধিদপ্তরের মূল দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, মৎস্য অধিদপ্তর তিনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অ্যাক্রিডেটেড মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি পরিচালনা করছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্যপণ্য সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশে চিংড়ি উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত, যেখানে নিরাপদ উৎপাদন পদ্ধতির জন্য উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন (এঅচ) এবং ঐধুধৎফ অহধষুংরং ্ ঈৎরঃরপধষ ঈড়হঃৎড়ষ চড়রহঃ (ঐঅঈঈচ) ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাগুলো চিংড়ির উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ এবং রপ্তানি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য ২০১০ সালে মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন এবং মৎস্যখাদ্য বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, যা ২০২০ সালে আরও সম্প্রসারিত করে মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন প্রক্রিয়া আরো সহজতর হয়েছে এবং সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিরাপদ এবং মানসম্মত চিংড়ি উৎপাদনের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর (ঝঙচ) ম্যানুয়াল প্রণয়ন করা হয়েছে।
মৎস্যচাষ পর্যায়ে ঔষধের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘অ্যাকুয়াকালচার মেডিসিনাল প্রোডাক্টস নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকা’ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এটি বর্তমানে মাঠপর্যায়ে সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই নির্দেশিকার মাধ্যমে মৎস্যচাষে ক্ষতিকারক ও নিষিদ্ধ ঔষধ ও রাসায়নিক ব্যবহারের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। এটি মাছের স্বাস্থ্য এবং গুণগত মান রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা নিরাপদ মৎস্য উৎপাদনের জন্য একটি আবশ্যক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
মৎস্য হ্যাচারি থেকে শুরু করে মাছ চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ প্রতিটি ধাপে কার্যকর পরিদর্শনের জন্য ফিশ এন্ড ফিশারি প্রডোক্টস অফিসিয়াল কন্ট্রোল প্রটোকল অনুসরণ করা হচ্ছে। এর ফলে, মৎস্যচাষ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ কারখানা এবং মাছের আহরণ-পরবর্তী সরবরাহ চেইনের স্থাপনা যেমন-আড়ত, ডিপো, বরফ কল ইত্যাদি নিয়মিত পরিদর্শন করা হয় এবং সঠিক লাইসেন্স প্রদান বা নবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। রপ্তানিযোগ্য কনসাইনমেন্টের নমুনা পরীক্ষণ করে স্বাস্থ্যসনদ জারি করা হয়, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের মৎস্য ও চিংড়ি গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্যপণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে প্রতি বছর ২০০৮ সাল থেকে ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান (ঘজঈচ) প্রণয়ন করা হয়। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে মাছ ও চিংড়িতে নিষিদ্ধ অ্যান্টিবায়োটিক এবং ক্ষতিকারক রাসায়নিকের উপস্থিতি নিয়মিতভাবে মনিটরিং করা হয় এবং যথাযথভাবে পরীক্ষণ করা হয়। এভাবে উৎপাদন থেকে ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত নিরাপদ মৎস্য সরবরাহের লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। 
সম্প্রতি, ২০২৩ সালের ০৪-১৫ ডিসেম্বর ঊট উএ ঝধহঃব অঁফরঃ মিশন বাংলাদেশের মৎস্যপণ্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াকরণের ওপর একটি বিস্তারিত অডিট পরিচালনা করেছে। এই অডিট মিশনটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এবং মৎস্য অধিদপ্তরের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করে। এই অডিট মিশন বাংলাদেশে মৎস্য উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হয়েছে বলে প্রশংসা করেছে, যা দেশের মৎস্যপণ্য রপ্তানি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
এ ছাড়াও মাছের খামার, প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট, মৎস্য অবতরণকেন্দ্র ও মাছ শিকারের সামুদ্রিক নৌযানের ওপর নিয়মিত তদারকি ও কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। এর ফলে পানির গুণগত মাননিয়ন্ত্রণ, সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা, রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে উল্লেযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। মাছ চাষিদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগের মাধ্যমে তাদের নিরাপদ উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হচ্ছে।
নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন পদ্ধতি নিশ্চিত করতে ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম প্রয়োগ করা হয়েছে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে মৎস্যপণ্যের উৎপত্তি এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়, যা ভোক্তাদের আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এ ধরনের পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের মৎস্যপণ্যের গ্রহণযোগ্যতা এবং সুনাম বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।
যদিও এসব উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান। মৎস্য উৎপাদনে অ্যান্টিবায়োটিক এবং ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়েছে। কঠোর তদারকি ও পর্যবেক্ষণের অভাবে এটি পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। মৎস্য উৎপাদনে অতিরিক্ত ভারী ধাতু ও দূষকের উপস্থিতি এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিকারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। 
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো মৎস্যচাষি এবং ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব। টেকসই মাছ ধরার অভ্যাস, সঠিক পরিবহন এবং সংরক্ষণের জন্য সচেতনতামূলক প্রচারণা এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। মৎস্যচাষিদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ভোক্তাদের শিক্ষিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ নিরাপদ এবং টেকসই মৎস্য উৎপাদন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি বাজারে নিরাপদ মাছের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে।
মৎস্য অধিদপ্তর বাংলাদেশের মৎস্য খাতকে নিরাপদ, সুষ্ঠু এবং মানসম্পন্ন একটি খাত হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। নিরাপদ মাছ উৎপাদন, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও তদারকি এবং মৎস্যচাষিদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে মৎস্য খাতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা হয়েছে। এর ফলে দেশজুড়ে পুষ্টি নিরাপত্তা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্যখাতের অবদান অপরিসীম।

লেখক : মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব), মৎস্য অধিদপ্তর। ফোন : ৫৫০১২৫৪৬১, ই-মেইল : dg@fisherics.gov.bd

বিস্তারিত
দেশের-খাদ্য-ও-পুষ্টি-নিরাপত্তায়-প্রাণিসম্পদ-খাত
দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণিসম্পদ খাত
ড. হোসেন মোঃ সেলিম
প্রাণিসম্পদ খাত হলো দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধান। পাশাপাশি বেকার সমস্যার সমাধান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, সাধারণ জণগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য খাত। দেশের ক্রমবর্ধমান প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির টেকসই জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ এবং রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গুণগত উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষিজ জিডিপিতে স্থিরমূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৬.৩৩%, দেশজ উৎপাদনে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান প্রায় ১.৮৫%, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.১৫% এবং বর্তমান বাজারমূল্যে জিডিপির আকার প্রায় ৮২,০৪১ কোটি টাকা। জনসংখ্যার প্রায় ২০% প্রত্যক্ষ এবং ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের উপর নির্ভরশীল। দেশের প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৭০-৭৫% আমিষ এ প্রাণিসম্পদ খাত থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। সর্বোপরি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি নিয়োগ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভ্যালু চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি, মানসম্মত প্রাণিজাত পণ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ) অর্জন লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। নি¤েœ দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান এবং প্রাণিজ আমিষের গুরুত্ব উপস্থাপন করা হলো:
দুধের উৎপাদন ও পুষ্টিগুণ 
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারাদেশে মোট ১৫০.৪৪ লক্ষ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদিত হয়েছে। যার ফলে দেশে মাথাপিছু দৈনিক ২৫০ মিলি দুধের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ২৩৪.৪৫ মিলি দুধ সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে, যার পরিমাণ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, সরবরাহকৃত ২৩৪.৪৫ মিলি দুধের মধ্যে তরল দুধ এবং দুধ হতে উৎপাদিত পণ্য যেমন: দই, ছানা, মিষ্টি, আইসক্রিম, পনির, ঘি, মাঠা ও অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য রয়েছে, যা খুবই পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত। দুধ একটি সম্পূর্ণ আদর্শ খাদ্য এবং ইহা উৎকৃষ্ট আমিষ ও ক্যালসিয়ামের উৎস্য। আয়রন ছাড়া সকল প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেলস দুধে বিদ্যমান। দুধে এল-ট্রিপটোফেন নামক এমিনো এসিড থাকে বিধায় দুধ খেলে ভালো ঘুম হয়। দুধ থেকে তৈরি ইউগার্ট প্রবায়োটিক হিসেবে কাজ করে যা হজম শক্তি এবং শরীরের ইমিউন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। পুষ্টি ভ্যালু হিসেবে এক কাপ দুধে প্রায় ১৪০-১৫০ কিলোক্যালরি শক্তি,   ৮-১০ মিলিগ্রাম মানসম্মত ফ্যাট, ৮-১০ মিলিগ্রাম উন্নত প্রোটিন, ১৩-১৫ মিলিগ্রাম শর্করা, ২৪-২৫ মিলিগ্রাম ঝুঁকিবিহীন কোলেস্টেরল, ৯৮-১০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে। 
মাংসের উৎপাদন ও পুষ্টিগুণ 
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারাদেশে মোট ৯২.২৫ লক্ষ মেট্রিক টন মাংস উৎপাদিত হয়েছে। যারফলে দেশে মাথাপিছু দৈনিক ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ১৪৩.৭৭ গ্রাম মাংস সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে, যার পরিমাণ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, সরবরাহকৃত ১৪৩.৭৭ গ্রাম মাংসের মধ্যে মাংস এবং মাংস হতে উৎপাদিত পণ্য যেমন: মিট বল, মিট বার্গার, মিট কাটলেট, চিকেন বার্গার, চিকেন নাগেট, ফ্রাইড চিকেন, চিকেন স্যান্ডউইচ ও অন্যান্য মাংস জাত খাদ্য পণ্য রয়েছে, যা খুবই পুষ্টিকর, উপাদেয় এবং স্বাস্থ্যসম্মত। মাংস একটি উচ্চ আমিষের উৎস্য যেখানে সকল এমিনো এসিড বিদ্যমান। মাংস মানবদেহের অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও মিনারেলস এর চাহিদা পূরণ করে। বয়স্কদের অস্থি ক্ষয়রোধ ও দুর্বলতা প্রতিরোধ করে। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশ ঘটায়। পুষ্টি বিবেচনায় প্রতি ১০০ গ্রাম মাংসে প্রায় ২২-২৬ গ্রাম মানসম্মত প্রোটিন, ৩-৪ গ্রাম উন্নত ফ্যাট, ১৪০-১৫০ কিলোক্যালরি শক্তি,               ৭০-৭৫ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল, ৫৫-৬০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে। 
ডিমের উৎপাদন ও পুষ্টিগুণ 
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারাদেশে মোট ২৩৭৪.৯৭ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। যার ফলে দেশে মাথাপিছু বছরে ১০৪টি ডিমের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ১৩৫টি ডিম সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে, যার পরিমাণ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। তবে সামগ্রিকভাবে দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, সাধারণ জণগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ডিমের চাহিদা ও গ্রহণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং সে অনুযায়ী প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিমের এ চাহিদা পুনরায় নির্ধারণ করেছে। এ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বছরে মাথাপিছু ২০৮টি ডিমের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ হিসেবে জনপ্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪টি ডিম এবং ডিম হতে উৎপাদিত পণ্য যেমন-পুডিং, কেক, এগ এলবুমিন, এগ ইয়ক পাউডার ইত্যাদি গ্রহণ করবে, যা খুবই পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত। ডিম একটি সম্পূর্ণ নিউট্রিয়েন্ট পিল। ডিমের আয়রন হিম পদ্ধতিতে থাকে বিধায় মানব শরীরের রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে দ্রুত সহায়তা করে। ডিম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে ও শরীরের ওজন কমায় চামড়া মসৃণ রাখে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। ডিম খেলে  দৃষ্টিশক্তি এবং স্মৃতিশক্তি প্রখর থাকে। ডিমের স্যাটাইটি ভ্যালু বেশি বিধায় ডিম খেলে পরিতৃপ্তি নিশ্চিত হওয়ার কারণে অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ কম হয়ে থাকে। পুষ্টি বিবেচনায় একটি সম্পূর্ণ ডিমে প্রায় ৬ গ্রাম মানসম্মত প্রোটিন,  ৫ গ্রাম উন্নত ফ্যাটি এসিড, ৭০-৭৭ কিলোক্যালরি শক্তি,  ১৭৫-২১০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল, ১০০-১৪০ মিলিগ্রাম কোলিন, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে। 
সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে প্রাণিজ আমিষের (দুধ, ডিম ও মাংস) উপযোগিতা নিম্নরূপ:
শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশ ঘটায়
 মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
 মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও মিনারেলস এর চাহিদা পূরণ করে
 বয়স্কদের অস্থি ক্ষয়রোধ ও দুর্বলতা প্রতিরোধ করে
 স্ট্রোক, হৃদরোগ, আত্রাইটিস ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়
 মানব দেহের ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে
 রক্তের ক্ষতিকর ট্রাইগ্লিসারাইডের উপস্থিতি হ্রাস করে
 মানুষের দৃষ্টিশক্তি ও গ্রাণশক্তি বৃদ্ধি করে
 সুস্থ সবল মেধাবী জাতি গঠনে সহায়তা করে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভিশন হচ্ছে ‘সকলের জন্য পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ’ করা এবং মিশন হচ্ছে ‘প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং ভ্যালু এডিশনের মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ’। তাই বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও আপামর মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ৫০ বছরের প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা (২০১৭-২০৬৬) এবং জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও কৌশল অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় এবং প্রাণিজ আমিষের গুণগতমান বজায় রাখাসহ সার্বিক নিরাপদতায়  প্রাণিসম্পদ সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
 
লেখক : উপপরিচালক (প্রাণিসম্পদ পরিসংখ্যান), পরিকল্পনা শাখা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯৪৬৯৫২০১১,   ই-মেইল :hmsalim72@yahoo.com
বিস্তারিত
পুষ্টি-নিরাপত্তায়-এবং-শিল্প-সম্ভাবনায়-ভুট্টা-ফসল
পুষ্টি নিরাপত্তায় এবং শিল্প 
সম্ভাবনায় ভুট্টা ফসল 
কৃষিবিদ ড. মোহাম্মদ মোবারক হোসেন
ভুট্টা ভারি মজার ফসল, সারা বছর ফলে;
নিজের খাবার, প্রাণীর খাবার, জ¦ালানিও মেলে।
ধানের পরে ভুট্টা বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পুষ্টিকর খাদ্যশস্য। প্রতি ১০০ গ্রাম পরিপক্ব ভুট্টার বীজে ৯.৪ গ্রাম প্রোটিন, ৭৪.৩ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ০.৬৫ গ্রাম চিনি, ৭.৩ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার ও ৩৬৫ কিলোক্যালরি শক্তি রয়েছে। ভুট্টা এলডিএল কোলেস্টেরল কমায় এবং উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন, এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ভুট্টা কিডনির কার্যকারিতা এবং হাড়ের স্বাস্থ্য বাড়াতে সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে । এসব স্বাস্থ্য উপকারিতা দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। বর্তমানে বাংলাদেশে ভুট্টার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন, কিন্তু উৎপাদন মাত্র ১২ লাখ। যা চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে একটি বড় ব্যবধান। প্রতি বছর দেশে ৮ থেকে ১০ লাখ টন হারে ভুট্টার চাহিদা বাড়ছে। চাহিদা মেটাতে ভুট্টার বীজ এবং মানব ও প্রাণী খাদ্যসামগ্রীসহ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হচ্ছে। 
ভুট্টা চাষের মোট আয় বোরো ধানের চেয়ে আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি । তাছাড়া গম ও অন্যান্য শীতকালীন ফসলের তুলনায় এর চাষে কম পানির প্রয়োজন, পরিবেশবান্ধব, উচ্চ পুষ্টিমান, বৈচিত্র্যময় ব্যবহার ইত্যাদি সুবিধা আছে। উপরন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়া ভুট্টা উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ভুট্টার ব্যাপক জিনগত পরিবর্তনশীলতার জন্য বাংলাদেশের যেকোনো পরিবেশে সফলভাবে ফলানো যায় । এটি রবি, খরিফ উভয় মৌসুমে চাষ করে বেশ ভালো ফলন পাওয়া যায়। এই বিবেচনায় ভুট্টা বাংলাদেশের শস্য বৈচিত্র্যের জন্য সর্বোত্তম বিকল্প হবে।
বাংলাদেশে ভুট্টা চাষের সম্ভাবনা
বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভুট্টা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল এবং ভুট্টা চাষের এক অসাধারণ সম্ভাবনা রয়েছে। ভুট্টা উৎপাদনের যুক্তিসঙ্গত কারণগুলো হলো :
া সম্প্রতি দেশে পোলট্রি, মৎস্য ও গবাদি পশু শিল্পের সংখ্যা বার্ষিক ২০% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যার প্রধান কাঁচামাল হলো ভুট্টা। ফলে দিন দিন ভুট্টার চাহিদা বাড়ছে।
া শীতকালীন ভুট্টা চাষের মোট আয় বোরো ধানের চেয়ে আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি । আবার গ্রীষ্মকালীন ভুট্টার আর্থিক আয় আউশ ধানের তুলনায় দশ গুণ বেশি লাভজনক। দেশে ভুট্টা উৎপাদনে গড় নিট আয় ৩২,৩৯৯ টাকা/ একর এবং লাভ-ব্যয়ের অনুপাত দুই শতাংশের বেশি। ভুট্টার নিট আয় মুগডাল ও সূর্যমুখীর তুলনায়ও অনেক বেশি।
া দেশের জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ ভালোভাবে নিষ্কাশিত, গভীর মাটি ভুট্টা চাষের জন্য ভালো। বিস্তৃত পতিত জমিতে এমনকি মাঝারি অ্যাসিডযুক্ত মাটিতেও সফলভাবে জন্মায়। উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকা, চর এলাকা, পার্বত্য এলাকাতেও এটি চাষ করা যায়। ভুট্টা চাষের জন্য ন্যূনতম দৈনিক তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস যথেষ্ট। তাই শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমেই ভুট্টা চাষ করা যেতে পারে । 
া দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করে সহজেই ভুট্টা চাষ করা যায় বিধায় উৎপাদন খরচ কম হয়। তাই ভুট্টা উৎপাদন আমদানির তুলনায় তুলনামূলক লাভজনক।
া উচ্চ চাহিদা,  উচ্চফলন, উচ্চ মুনাফা, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপখাইয়ে নেওয়ার সুবিধা রয়েছে ভুট্টা চাষে। এছাড়াও বপন থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রম যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে করা যায় বলে প্রতিকূল জলবায়ুর সাথে সম্পর্কিত ঝুঁকি এড়ানো যায়, শ্রম এবং চাষের ব্যয় সাশ্রয় করে।  
া ভুট্টাকে সহজেই তিন বা চার ফসলি শস্যবিন্যাসে ফিট করা যায় বিধায় শস্য বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধিতে এক অনন্য ফসল।
া শূন্য চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে চাষ করলেও ভ্ট্টুা বেশ ভালো ফলন দিতে সক্ষম। এই ব্যবস্থায় বপনের সময়কে এগিয়ে আনা যায়, সেচ, জ্বালানি সাশ্রয় করে, চাষের ব্যয় হ্রাস করে লাভ বাড়ায়, মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি করে এবং মাটির ক্ষয় হ্রাস করে।
ভুট্টা উৎপাদনের বর্তমান পরিস্থিতি
১৯৭০-৮০-এর দশকে বাংলাদেশে ভুট্টার স্থানীয় বিপণন এবং ব্যবহার খুবই কম থাকায় মাত্র কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ করা হত। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে মধ্য, উত্তর এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের কয়েকটি নির্বাচিত অঞ্চলে হাইব্রিড ভুট্টা প্রবর্তনের পরেই এর আবাদ বাড়তে থাকে। ২০০৪ সালে বারি হাইব্রিড ভুট্টা ৫ জাতের মুক্তির পর, উৎপাদন এবং ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ২০১০ সালে মোট ২.২৭ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছিল। উৎপাদন এবং ব্যবহার ছিল যথাক্রমে ১৫.৫ এবং ২৩.০ লাখ টন। চাহিদা মেটাতে অতিরিক্ত ৭.৫১  লাখ টন ভুট্টা আমদানি করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে ব্যবহার ২১৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে যার পরিমাণ ৭২.৫ লাখ টন । একই সময়ে আয়তন এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭০ ভাগ যা যথাক্রমে ৫.৭০ লাখ হেক্টর এবং ৪৯.৫ লাখ টন এবং আমদানি হয়েছে ২৩.০ লাখ টন যা ২০১০ সালের তুলনায় ২০৭ ভাগ বেশি। দেশের পোলট্রি, মৎস্য ও গবাদি পশু শিল্পগুলোতে ভ্ট্টুাজাত খাদ্য চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।  ২০২৩ সালে ব্যবহৃত ভুট্টাজাত খাদ্য ব্যবহারের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ লাখ টনে, যা ২০১০ সালের তুলনায় ২৪০ ভাগ বেশি যা তখন ছিল ১৬ লাখ টন (চিত্র ১ ও চিত্র ২ দৃষ্টব্য)।
ভুট্টা চাষের বেশির ভাগ উৎপাদন দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, রংপুর ও বগুড়ায় সম্প্রসারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ডিএই, সিমিট ও অন্যান্য এনজিও, বেসরকারি উদ্যোক্তা এবং বীজ কোম্পানিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যদিও গত কয়েক বছর ধরে ভুট্টার চাষ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু প্রতি একক জমিতে ভুট্টার ফলন সামান্তরালে আছে  এবং ভবিষ্যতে তা হ্রাস পেতে পারে। দেশের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রতি বছর ১% হারে কমছে। অন্যদিকে খাদ্যের চাহিদা প্রতি বছর প্রায় ১৫% বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই চাহিদা মেটাতে উচ্চফলনশীল শস্য উৎপাদন এবং উচ্চফলন অর্জন ও অব্যাহত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানসম্মত ও উপযুক্ত বীজের অভাব, মাটির উর্বরতা হ্রাস, সারের ভারসাম্যহীন ব্যবহার, কম সেচ দেয়া এবং শীতের মৌসুমে দেরিতে লাগানো ফলন কমার কারণ। ভুট্টার উচ্চফলন অব্যাহত রাখতে এবং বাড়াতে এই সমস্যাগুলোর যথাযথ সমাধান করতে হবে।
ভুট্টা চাষের প্রধান সমস্যাসমুহ
া বাংলাদেশের ভুট্টা উৎপাদনে বীজের উচ্চমূল্য সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা। ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতি টন ভুট্টা বীজের বর্তমান দাম ২৪৮.৭ ডলার থেকে বেড়ে ২৬৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের জন্য দেশে ভুট্টার বীজের দাম বেড়েছে। দেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক প্রাথমিক পর্যায়ে বেশি বিনিয়োগ করতে চান না। উপরন্তু চাহিদা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। বাংলাদেশে ভুট্টার উৎপাদন সম্প্রসারণের জন্য যখন প্রয়োজন তখন ন্যায্যমূল্যে বীজ সরবরাহ অপরিহার্য।
া স্বল্পমেয়াদী উচ্চফলনশীল খাটো জাতের ভুট্টার বিপুল চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এজাতগুলো অপ্রতুল। উচ্চতায় খাট জাতগুলো শক্তিশালী বলে প্রবল বাতাস সহ্য করতে পারে যার ফলে ঢলে পড়েনা। এছাড়াও, উচ্চফলনশীল খাটো জাতগুলো পরিপক্ব হতে কম সময় নেয়, সহজেই মোচা সংগ্রহ করা যায় ফলে সময় ও শ্রমিক সাশ্রয় করে।  তাছাড়া ভুট্টা একটি দীর্ঘমেয়াদি (প্রায় ১৫০ দিন) ফসল। ধান ছাড়া অন্য কোন দীর্ঘমেয়াদি ফসলের আন্তপরিচর্যা করতে কৃষকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। 
া সাম্প্রতিককালে ভুট্টার ফল আর্মি ওয়ার্ম পোকা এবং ফিউজারিয়াম স্টক রট রোগ আরেকটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যেগুলো কিনা ভুট্টার  ফলনকে ১০০% ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
া বাংলাদেশে খুব অস্থিতিশীল বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা দেখা দেয় যা ভুট্টা উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। দেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে খুবই অনিশ্চয়তা রয়েছে। ফলে কৃষকরা ফসল চাষের যেকোন সময় অত্যন্ত অনুপযুক্ত আবহাওয়ার সম্মুখীন হন। রবি মৌসুমে অত্যাধিক ঠা-া আর খরিফ মৌসুমে ঝড়ো আবহাওয়া ও বন্যা ভুট্টা উৎপাদনে একটি বড় বাধা। 
া সঠিক কারিগরি জ্ঞানের অভাবে ভুট্টা চাষিরা চাষের উপযুক্ত মৌসুম, সঠিক জাত নির্বাচন, বীজের হার, বীজ বপনের পদ্ধতি, যথাযথ কীটনাশক ও সার, ফসল সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর কার্যক্রম এবং বিপণন ব্যবস্থাসহ বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। 
া বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক নগদ অর্থের অভাবে নিম্নমানের ইনপুট ক্রয় এবং ফসল কাটার পর অনুপযুক্ত ব্যবস্থাপনার ফলে ফলন অনেক কমে যায়। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার আর্থিক সহায়তার অভাবে ভুট্টা উৎপাদন ও সম্প্রসারণ অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে ।  
া ফসল উৎপাদনে সার ও বালাইনাশক অপরিহার্য। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী ফসল উৎপাদনের সময় সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। তাছাড়া লাইসেন্সবিহীন ভেজাল সার, বালাইনাশক বিক্রি করে। এসব ভেজাল ইনপুট ব্যবহার করার ফলে ভুট্টা উৎপাদন অনেকাংশে ব্যর্থ হতে পারে। 
া শক্তিশালী বাজার নেটওয়ার্ক তৈরি হয়নি বলে ভুট্টার বাম্পার উৎপাদন সত্ত্বেও বিক্রির জন্য ফরিয়া/ মধ্যস্থতাকারীদের উপর নির্ভর করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে, কৃষকরা বাজারের প্রকৃত পরিস্থিতি নিয়ে অন্ধকারে রয়েছে বলা যায়। তাছাড়া সরকারিভাবে ভুট্টা ক্রয়ের কোন পরিকল্পনা/উদ্যোগ এখন  পর্যন্ত দেখা যায় নি। ফলে          কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে প্রতিনিয়তই বঞ্চিত হচ্ছে
ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভবিষ্যৎ করণীয়
বাংলাদেশে ভুট্টার উৎপাদন ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য নিচের বিষয়গুলো গুরুত্বে সাথে বিবেচনা করা যেতে পারে :
া তাপ, খরা ও লবণাক্ত প্রতিরোধী খাটো জাত, অপ্রচলিত এলাকায় (চরাঞ্চল, হাওর অঞ্চল ও পার্বত্য অঞ্চল) এবং লবণাক্ত অঞ্চলের (দেশের দক্ষিণাঞ্চল) উপযোগী জাতের দ্রুত উদ্ভাবন করা ।
া উপযোগিতা যাচাইপূর্বক নিবিড় উৎপাদন, এলাকাভিত্তিক প্রদর্শন, সম্প্রসারণ, মানসম্মত বীজ উৎপাদন ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ সম্পর্কিত গবেষণাগুলোর ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখা।
া অনাকাক্সিক্ষত ও আচমকা রোগবালাই, কীটপতঙ্গের আক্রমণ দেখা দিলে আবশ্যিকভাবে তার প্রতিকার উদ্ভাবনের জন্য উপযুক্ত ও কার্যকর জাত এবং দমন ব্যবস্থার উদ্ভাবন করতে হবে। যেমন- সাম্প্রতিককালে ভুট্টার ফল আর্মি ওয়ার্ম এবং ফিউজারিয়াম স্টক রট দমন ব্যবস্থাপনা নির্দেশিত হয়েছে।
া দেশের দক্ষিণাঞ্চল, চরাঞ্চল, সিলেট ও ময়মনসিংহের হাওর অঞ্চলসহ রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবনের পার্বত্য অঞ্চলের অপ্রচলিত ও নতুন জমি ভুট্টা চাষের আওতায় আনার জন্য উপযুক্ত জাত চিহ্নিত করে বীজ সরবরাহ করা, সঠিক প্রায়োগিক ফসল বিন্যাস বাস্তবায়ন করা, টেকসই সমন্বিত প্রযুক্তি ব্যবহার ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা জোরালো করা।
া ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোক্তা, পোলট্রি, মৎস্য এবং ভুট্টাভিত্তিক নতুন শিল্পের যেমন কর্ন ফ্লেক্স, কর্ন স্টার্চ, কর্ন অয়েল প্রভৃতি ধরনের শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করা। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠায় সরকারি সহযোগিতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।
া চাষিদের ভুট্টা উৎপাদন কলাকৌশলসহ যাবতীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি ভুট্টার মানসম্পন্ন বীজ চাষিদের কাছে সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং ভুট্টাভিত্তিক টেকসই ও লাভজনক ফসলবিন্যাস চিহ্নিত করা।
া ভ্ট্টুার মূল্য নির্ধারণ করে চুক্তিভিত্তিক চাষির মাধ্যমে দেশে ভুট্টা চাষের এলাকা ও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বিপণন ব্যাবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে কৃষকদের উৎপাদিত বীজ/পণ্য বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে।
া ভুট্টা উৎপাদনের কারিগরি বিষয়গুলোর নজরদারি বাড়ানোসহ আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় অধিকতর জোরালো করা। সরকারি ভর্তুকি ও প্রণোদনা, ফসল ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ সঠিক সময়ে কৃষকের কাছে পৌঁছানো। 
উল্লিখিত প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষকপর্যায়ে ভুট্টা উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হবে। অন্যদিকে দেশে ভুট্টাভিত্তিক খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন এবং এদের শিল্পভিত্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। এতে প্রয়োজনীয় ভুট্টা আমদানি হ্রাস পাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে কৃষকের আয় বৃদ্ধিসহ জাতীয় প্রবৃদ্ধি এবং জীবনমান উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখবে।
রব।ে
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ গম ও ভ্ট্টুা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর-৫২০০, মোবাইল : ০১৭১৪-৭৮২৭০৪, ইমেইল :mobarak.hossain@bwmri.gov.bd
বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর

কৃষিবিদ ড. আকলিমা খাতুন

নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।

জনাব সবুজ মিয়া, উপজেলা : পীরগঞ্জ, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : ক্যাপসিকাম বা মিষ্টিমরিচ লাগানোর নিয়ম সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : ক্যাপসিকাম বা মিষ্টিমরিচ চাষের জন্য দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি ভাল। এটি খরা ও গোড়ায় পানি জমা কোনটাই সহ্য করতে পারেনা। অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস ক্যাপসিকাম এর বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। প্রতি শতকের জন্য এক গ্রাম বীজ দরকার হয়। বীজ থেকে প্রথমে চারা তৈরি করা হয়। এর জন্য বীজগুলোকে ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে বীজতলায় ১০ সেমি. দূরে দূরে লাইন করে বীজ বুনতে হবে। সাত থেকে দশ দিন পর চারা ৩-৪ পাতা হলে চারা পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। এরপর মূল জমি চাষ ও মই দিয়ে বেড তৈরি করে নিতে হবে। প্রতিটি বেড চওড়া ২.৫ ফুট রাখতে হবে। দুই বেডের মাঝখানে নালা রাখতে হবে। প্রতি শতক জমির জন্য গোবর ৪০ কেজি, ইউরিয়া ১ কেজি, টিএসপি ১.৪ কেজি, এমওপি ১ কেজি, দস্তা ২০ গ্রাম জিপসাম ৪৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। এর মধ্যে অর্ধেক গোবর সার জমি তৈরির সময়, বাকি অর্ধেক গোবর সম্পূর্ণ টিএসপি, দস্তা, জিপসাম, ১/৩ ভাগ এমওপি এবং ১/৩ ভাগ ইউরিয়া চারা রোপণের গর্তে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ২/৩ ভাগ ইউরিয়া এবং ২/৩ ভাগ এমওপি দুইভাগ করে চারা রোপণের ২৫ এবং ৫০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত ৩০ দিন বয়সের চারা বেডে ১.৫ ফুট দূরে লাইনে রোপণ করতে হয়। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারি প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রাতের তাপমাত্রা অনেক কমে যায় বলে পলিথিনের ছাউনি দিলে ভেতরের তাপমাত্রা বেশি থাকে।  
জনাব মো: ফারুক, উপজেলা : ঈশ্বরদী, জেলা : পাবনা  
প্রশ্ন : মসুরের গাছ গোড়া পচে মারা যাচ্ছে। করণীয় কি?
উত্তর : গোড়া পচা মসুরের একটি ক্ষতিকর রোগ। এটি মূলত চারা আক্রমণকারী একটি ছত্রাকজনিত রোগ। সাধারণত এক মাস বা তার চেয়ে কম বয়সের চারাকে এটি আক্রমণ করে থাকে। অতি অল্প বয়সে আক্রান্ত হলে চারা হঠাৎ নেতিয়ে পড়ে এবং শুকিয়ে খড়ের রং ধারণ করে মারা যায়। বয়স্ক চারা আক্রান্ত হলে হলুদ হয়ে যায় ও শুকিয়ে যায়। গাছের মূল এবং শিকড় আক্রান্ত হলে গাছের আকার খাটো হয় এবং গাছ ঢলে পড়ে যায়। বপনের সময় জমিতে যাতে অতিরিক্ত রস না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে কারণ রস বেশি থাকলে জমিতে গোড়া পচা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। রোপণের পূর্বে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি বীজের সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে নিলে রোগের প্রকোপ অনেকাংশে হ্রাস পায়। এছাড়া রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউজি (কার্বেন্ডাজিম) ২ গ্রাম/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। 
জনাব আব্দুল হাকিম, উপজেলা : শ্রীপুর, জেলা : গাজীপুর
প্রশ্ন : ধনিয়ার উন্নত জাত এবং এর ফলন সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : ধনিয়ার উচ্চফলনশীল জাতের মধ্যে বারি ধনিয়া-১, বারি ধনিয়া-২, এলবি-৬০, এলবি-৬৫, সুগন্ধা, বারি বিলাতি ধনিয়া-১ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। লাইন বা বেড পদ্ধতিতে বীজ বোনার জন্য বিঘা প্রতি ১.৩-১.৬ কেজি বীজ প্রয়োজন। ছিটিয়ে বোনার জন্য দ্বিগুণ বীজ প্রয়োজন। জাতভেদে শতকপ্রতি ফলন পাতা             ১৪-১৬ কেজি এবং ধনিয়া ৬.৮-৮.০ কেজি। বিলাতি ধনিয়া-১ এর ফলন প্রায় ১২১-২০২ কেজি পাতা ও বীজ ১.৬১-২.০২ কেজি/শতক।
জনাব আনিসুর রহমান, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : আলুর জমিতে সার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর :
গোরব, অর্ধেক ইউরিয়া, টিএপি, এমওপি, জিপসাম ও জিংক সালফেট রোপণের সময় জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া রোপণের ৩০-৩৫ পর অর্থাৎ দ্বিতীয়বার মাটি তোলার সময় প্রয়োগ করতে হবে। অম্লীয় বেলে মাটির জন্য ৩৫০ গ্রাম/শতক ম্যাগনেসিয়াম সালফেট এবং বেলে মাটির জন্য বোরন প্রতি শতকে ৩৫ গ্রাম প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
জনাব মাহমুদুল হাসান, উপজেলা : ফুলবাড়ী, জেলা : কুড়িগ্রাম
প্রশ্ন : গাজরের চারা ঢলে পড়ছে, কী করতে হবে?
উত্তর : এই রোগে আক্রান্ত চারার গোড়ায় চারদিকে পানিভেজা দাগ দেখা যায়। গোড়ায় সাদা ছত্রাক জেলি ও অনেক সময় সরিষার মতো ছত্রাকের অনুবীজ দেখা যায়। এর ফলে শিকড় পচে যায়, চারা নেতিয়ে পড়ে গাছ মারা যায়। এ রোগ থেকে রক্ষা পেতে পরিমিত সেচ ও পর্যাপ্ত জৈবসার প্রদান করা ও পানি নিষ্কাশনের ভাল ব্যবস্থা রাখতে হবে। সরিষার খৈল ৩০০ কেজি/ হেক্টর হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিলিটার পানিতে ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের রোভরাল  ২ গ্রাম বা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ব্যাভিস্টিন ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করে মাটিসহ ভিজিয়ে দিতে হবে। বপনের আগে প্রতি কেজি বীজ ২-৩  গ্রাম প্রোভ্যাক্স বা কার্বেন্ডাজিম মিশিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে।
জনাব মঞ্জুরুল, উপজেলা : মানিকছড়ি, জেলা : খাগড়াছড়ি
প্রশ্ন : সরিষা বীজ বপনের সময় ও বীজের হার সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : বপনের সময় : বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য ও জমির জো অবস্থা অনুসারে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯, টরি-৭, কল্যানীয়া, সোনালী সরিষা, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭ ও বারি সরিষা-৮ এর বীজ মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য কার্তিক মাস (অক্টোবর) পর্যন্ত বোনা যায়। রাই-৫ এবং দৌলত কার্তিক থেকে অগ্রহায়ন (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর) মাস পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে। বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য ও জমির জো অবস্থা অনুসারে বারি সরিষা-১৩ জাতের বীজ কার্তিক মাসের ১ম সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর) বপনের উপযুক্ত সময়।
বীজের হার : সরিষার জাত টরি-৭, কল্যানীয়া, সোনালী সরিষা, ধলি, বারি সরিষা-৭ ও বারি সরিষা-৮ এর জন্য প্রতি হেক্টরে ৮-১০ কেজি বীজ লাগে। রাই ও দৌলত সরিষার জন্য প্রতি হেক্টরে ৭-৯ কেজি বীজের প্রয়োজন। বারি সরিষা-১৩ চাষের জন্য প্রতি হেক্টর জমিতে ৮ থেকে ১০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
জনাব সামাদ আলী, উপজেলা : ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : আমন ধানের বীজ সংগ্রহ করার জন্য কী করণীয় জানতে চাই। 
উত্তর :  ধান বীজ সংগ্রহ করার জন্য বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে আদ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে আনতে হবে। পুষ্ট ধান বীজ কুলা দিয়ে ঝেড়ে বাছাই করতে হবে। বীজ রাখার জন্য ড্রাম, বিস্কুট বা কেরোসিনের টিন ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাটির পাত্র ব্যবহার করলে পাত্রের গায়ে দুবার আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে শুকিয়ে নিতে  হবে। রোদে শুকানো বীজ ঠা-া করে পাত্রে ভরতে হবে। পুরো পাত্রটি বীজ দিয়ে ভরে রাখতে হবে। যদি বীজে পাত্র না ভরে তাহলে  বীজের উপর কাগজ বিছিয়ে তার উপর শুকনো বালি দিয়ে পাত্র পরিপূর্ণ করতে হবে। পাত্রের মুখ ভালভাবে বন্ধ করতে হবে যেন বাতাস না ঢুকতে পারে। এবার এমন জায়গায় রাখতে হবে যেন পাত্রের তলা মাটির সংস্পর্শে না আসে। প্রতি টন ধানে ৩.২৫ কেজি নিম, নিশিন্দা বা বিশ কাটালি পাতার গুঁড়া মিশিয়ে গোলাজাত করলে পোকার আক্রমণ হয় না।
জনাব রফিকুল ইসলাম, উপজেলা : বাঘা, জেলা : রাজশাহী
প্রশ্ন : আখ চাষ করতে সারের পরিমাণ ও আন্তঃপরিচর্যা বিষয়ে জানতে চাই।
উত্তর : আখ চাষ করতে প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া ১২০-১৫০ কেজি, টিএসপি ৮০-১১০ কেজি, এমওপি ১০০-১৪০ কেজি, জিপসাম ৫০-৬০ কেজি, জিংক সালফেট ১০-১৫ কেজি, ডলোচুন  ১০০-১৫০ কেজি, জৈবসার ২-৩ টন প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ও এমওপি সার ছাড়া অন্যান্য সব সার শেষ চাষের সময় মাটিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি নালায় দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া ও এমওপি চারা রোপণের পর কুঁশি গজানো পর্যায়ে (১২০-১৫০ দিন) উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। গাছ যাতে হেলে না পড়ে সেজন্য আখ গাছ বেঁধে দিতে হবে। গাছের বয়স ৭-৮ সপ্তাহ হলে প্রথমবার এবং ১২-১৪ সপ্তাহ হলে দ্বিতীয়বার মাটি উঠিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজন হলে বাঁশের সাহায্যে গাছে ঠেস দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনমতো আগাছা দমন ও সেচ দিতে হবে।
জনাব রাকিব, উপজেলা : বীরগঞ্জ, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : ফুলকপির পাতায় হালকা বাদামি থেকে ছাই রংয়ের দাগ দেখা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : ফুলকপির পাতা ব্লাক রট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত পাতায় হালকা বাদামি থেকে ধুসর ছাই রংয়ের দাগ দেখা যায়। ধীরে ধীরে দাগ বড় হয় ও মধ্য শিরার দিকে অগ্রসর হলে অনেকটা ইংরেজি ভি অক্ষরের মতো আকার ধারন করে। দাগের কিনারা হলুদ থাকে। ফুলকপি লাগানোর সময় রোগমুক্ত বীজ বা চারা ব্যবহার করতে হবে। বপনের পূর্বে ৫০ সে. তাপমাত্রার গরম পানিতে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। ফসলের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করতে হবে। লাল মাটির ক্ষেত্রে ৩ বছর পর পর প্রতি শতকে চার কেজি হারে ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে (মেনকোজেব+ মেটালেক্সিন) গ্রুপের রিডোমিল গোল্ড ২ গ্রাম/প্রতি লিটার পানি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার ১৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যাবে না। 

লেখক : তথ্য অফিসার (উদ্ভিদ সংরক্ষণ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২; ই-মেইল : aklimadae@gmail.com

বিস্তারিত
অগ্রহায়ণ-মাসের-কৃষি-(১৬-নভেম্বর-১৫-ডিসেম্বর)

অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি
(১৬ নভেম্বর-১৫ ডিসেম্বর)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
অগ্রহায়ণ। এ মাসের শেষের মধ্য দিয়ে হেমন্তের বিদায় নেয়ার পালা। হেমন্ত ঋতুর বড় আয়োজন নবান্ন। ঘরে ঘরে সোনালী ফসল তোলার মহা আয়োজন।               কৃষকদের মুখে দেখা দেয় অনাবিল সুখের হাসি। উৎসবমুখর পরিবেশের সমান্তরালে খাদ্য উৎপাদনের মূল কারিগর কৃষক-কৃষাণী ব্যস্ত থাকেন নিরাপদ পুষ্টি খাদ্য সরবরাহে। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিতে আমাদের করণীয় কাজগুলো।
আমন ধান
এ মাসে প্রায় আমন ধান পেকে যাবে। তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় আমন ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে কেটে ফেলা ভালো। শ্রম, সময় ও খরচ সাশ্রয়ে প্রয়োজনে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে সুস্থ সবল ভালো ফসল কেটে, মাড়াইঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিষ্কার করে এবং ছায়ায় রেখে ঠা-া করতে হয়। পরিষ্কার ঠা-া বায়ুরোধী পাত্রে ধান সংরক্ষণ করতে হবে। 
বোরো ধান
বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হয়। যেসব এলাকায় ঠা-ার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রতি দুই প্লটের মাঝে  ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে। বোরো মওসুমের পানি সাশ্রয়ী জিংকসমৃদ্ধ জাত ছাড়াও এলাকাভিত্তিক আধুনিক উচ্চফলনশীল ও ব্রি হাইব্রিড ধানের জাত নির্বাচন করতে পারেন। বীজ বপন করার আগে ৬০-৭০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে রাখতে হবে। এ সময় ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ৮০-১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। 
গম
অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে। দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য এলাকাভিত্তিক ও ঘাতসহিষ্ণু আধুনিক উচ্চফলনশীল গমের জাত বপন করতে হবে।
ভুট্টা
ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে এলাকাভিত্তিক ও ঘাতসহিষ্ণু আধুনিক উচ্চফলনশীল জাতের বীজ বপন করতে হবে।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। তাছাড়া বাদাম, সূর্যমুখী এসব আবাদ করতে পারেন। সরিষা গাছে ফুল আসার সময় শতাংশপ্রতি ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার উপরিপ্রয়োগের পর হালকা একটি সেচ দিতে হবে। মাটিতে রস কমে গেলে ২০-২৫ দিন পর আবারো একটি সেচ দিতে হবে। 
আলু
উপকূলীয় অঞ্চলে এ মাসেও আলু আবাদ শুরু করা যায়। অন্যান্য স্থানে রোপণকৃত আলু ফসলের যত্ন নিতে হবে। মাটির কেইল বেঁধে দিতে হবে এবং কেইলে মাটি তুলে দিতে হবে। সারের উপরিপ্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেচ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
শাকসবজি : মাঠে এখন অনেক সবজি বাড়ন্ত পর্যায়ে আছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এসব বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারার বয়স           ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হয়। সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন। এতে পোকা দমনের সাথে সাথে পরিবেশও ভালো থাকবে। জমিতে প্রয়োজনে সেচ প্রদান করতে হবে। টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙ্গে দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে ঘেরের বেড়িবাঁধে টমেটো, মিষ্টিকুমড়া চাষ করতে পারেন। মিষ্টি আলু, চীনা, কাউন, পেঁয়াজ, রসুন, মরিসচসহ অনেক অত্যাবশ্যকীয় ফসলের প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়। এসব ফসলের কোনটি এখনো না লাগিয়ে থাকলে দেরি না করে চারা লাগাতে হবে। 
ছোলা, মুগ ও তিসি
এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত খরা সহনশীল ছোলা, মুগ, তিসি এসব বপন করা যায়।
গাছপালা
এবারের বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা বনজ গাছের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দেয়া যেতে পারে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সংক্ষেপে আগামী তথা অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি উপস্থাপন করা হলো। এ মাসে ৫ অক্টোবর বিশ^ মৃত্তিকা দিবস ২০২৩ উদ্যাপিত হবে। ফসল উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি সুষম সার প্রয়োগসহ টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও বিস্তারিত কৌশল জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উপজেলা কৃষি অফিসার, তাছাড়া কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করে তাৎক্ষণিক পরামর্শ পেতে পারেন। মনে রাখতে হবে আমাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণই নিয়ে আসবে কৃষির কাক্সিক্ষত সাফল্য। 

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল : editor@ais.gov.bd

বিস্তারিত