শীতকালীন সবজি ও ফুল চাষ
কৃষিবিদ সিলমিন জাহান ইলমা
সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাস শীতকালীন সবজি ও ফুল চাষের উপযুক্ত সময়। তবে চাইলে আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বীজ থেকে চারা তৈরি করে রোপণ করা যায়।
পুঁইশাক, কলমিশাক, লালশাক, ধনেপাতা, ডাঁটা, পালংশাক, বথুয়া শাক, লেটুস, মুলা, বিট, শালগম, গাজর, আলু, পিয়াজ, রসুন, বেগুন, মরিচ, ক্যাপসিকাম, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, ওলকপি, শিম, লাউ, স্কোয়াশ, শসা, করলা ইত্যাদি। শীতকালীন সবজি চাষাবাদ করা হয়। অনুরূপভাবে গাঁদা, জিনিয়া, কসমস, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, ভারবেনা, ক্যালেন্ডুলা, মেলাম্পোডিয়াম, পিটুনিয়া, ডায়ান্থাস, ফ্লক্স, স্যালভিয়া, নয়নতারা, গোলাপ ইত্যাদি শীতকালীন ফুল চাষ করা হয়।
তাছাড়া, এই সময় করমচা, কাউফল, বিলাতিগাব, আমলকী, শরিফা, ডালিম, কামরাঙ্গা, অড়বরই, বহেরা, তাল ইত্যাদি ফলের বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়।
বীজ/ চারা নির্বাচন
ভালো জাতের বীজ বা চারা নির্বাচন জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারি হর্টিকালচার সেন্টার বা বিশ^স্ত নার্সারি থেকে বীজ/ চারা সংগ্রহ করতে হবে। বীজ এর জন্য যে কোন ভালো ব্র্যান্ড যেমন- লালতীর, এসিআই, মেটাল, ইউনাইটেড, মল্লিকার যে কোন সবজি বীজ সংগ্রহ করা যেতে পারে।
বীজ থেকে চারা করার পদ্ধতি
৫০ ভাগ কোকোপিট ও ৫০ ভাগ অন্যান্য সার, বালু ও মাটির মিশ্রণ পটিং মিডিয়া হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। মরিচ, ক্যাপসিকাম, বেগুন, করলা- এসব বীজ ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে দ্রুত অঙ্কুরোদগম হয়। শসা, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, শিম ইত্যাদি বীজ ১২ ঘণ্টা ভিজালেই হবে। তারপর বীজ হালকা একটু শুকিয়ে নিয়ে পটিং মিডিয়ায় পাতলা করে ছড়িয়ে দিন। তার ওপর হালকা করে পটিং মিডিয়া দিয়ে একটি পলিথিন শিট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
বিকল্পভাবে, আপনি একটি ভেজা কাগজের তোয়ালের মধ্যে বীজ মুড়ে রেখে একটি সিলবিহীন প্লাস্টিকের ব্যাগে কাগজের তোয়ালে রেখে বীজ অঙ্কুরিত করতে পারেন। ব্যাগটি একটি ছোট গ্রিনহাউজ হিসেবে কাজ করবে, তাপ এবং আর্দ্রতা ধরে রাখবে। বীজকে অঙ্কুরিত হতে উৎসাহিত করবে। বেশির ভাগ বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গেলে সাবধানে বীজগুলোকে একটি ট্রেতে স্থানান্তর করুন। প্রতিটি চারা ১/৪ থেকে ১/২ ইঞ্চি গভীরে রোপণ করুন।
বেগুন, মরিচ, ক্যাপসিকাম ১ মাস পর মাঠে রোপণের জন্য উপযুক্ত হয়। শিম, ফ্রেঞ্চবিন, লাউ, স্কোয়াশ, শসা, করলা, বরবটি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, ওলকপি, শালগম, লেটুস, টমেটো অঙ্কুরোদগম হতে ৩-৪ দিন সময় লাগে এবং ২০-২৫ দিন পর মাঠে চারা রোপণ করা যায়।
চার রোপণ
চারা রোপণের জন্য জমিতে গোবর সার ও অন্যান্য জৈবসারসহ ইউরিয়া, টিএসপি, ও এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে জমি ভালোভাবে মই দিয়ে সমান করে নিতে হবে। তারপর নির্দিষ্ট দূরত্বে গাছ লাগাতে হবে। ছাদবাগানের জন্য বেগুন, মরিচ, ক্যাপসিকাম, টমেটো ও ঢ্যাঁড়সগাছের জন্য ১০-১২ ইঞ্চি টব বা জিও ব্যাগ ব্যবহার করতে পারেন। চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, লাউ, শিম, বরবটি, করলা ইত্যাদি গাছের জন্য হাফ ড্রাম বা ২০-২৪ ইঞ্চি জিও ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে।
শাকবীজ বপণের জন্য বীজতলায় বীজ ছিটিয়ে দিতে হবে। পুঁইশাক, কলমিশাক, লেটুস ইত্যাদি লাইনে বপন করা ভালো। এমনভাবে বপন করতে হবে যেন প্রতি ইঞ্চিতে তিন-চারটি বীজ পড়ে। প্রয়োজনে বীজের সাথে কিছু জৈবসার বা মাটি ঝুরঝুরে করে মিশিয়ে দিলে ছোট ছোট বীজ বপন করা সহজ হয়। চারা না বের হওয়া পর্যন্ত মাটি হালকা ভেজা রাখতে হবে। পাখির উপদ্রব থেকে বাঁচতে নেট ব্যবহার করতে পারেন। বীজ অধিক পরিমাণ অঙ্কুরিত হলে কিছু শাক সময়ে সময়ে পাতলা করে দিতে হবে। ছাদে বানানো বেড বা বয়া বা ক্যারেট বা জিও ব্যাগ বেডে ১ ফুট গভীর মাটি থাকলেই চলবে।
সেচ ব্যবস্থাপনা
শীতকালে কুয়াশা কাটিয়ে যখন রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ তৈরি হবে, তখন পানি সেচ দেওয়া উত্তম। ছাদবাগানের ক্ষেত্রে সাধারণত টবের মাটির ওপরের অংশ দুই ইঞ্চি শুকালে পুনরায় পানি দিতে হয়। অতিরিক্ত বা অতি কম পানি উভয়ই গাছের জন্য ক্ষতিকর। শাকসবজির গাছ পানির অভাব একেবারেই সহ্য করতে পারে না। লাউ, শিম, বরবটি, করলাজাতীয় গাছের জন্য বেশি পানির প্রয়োজন হয়। তাই ঘন ঘন পানি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। গাছ পানিশূন্যতায় থাকলে প্রাথমিকভাবে পাতা নিচের দিকে কুঁচকে যায়, গাছ নেতিয়ে যেতে থাকে। এসময় হঠাৎ করে অতিরিক্ত পানি না দিয়ে অল্প অল্প করে পানি দিতে হবে। হঠাৎ অতিরিক্ত পানিতে গাছের ক্ষতি হয়। গাছে ফল থাকলে ফল ফেটে যেতে পারে।
সার ব্যবস্থাপনা
ঢাকনাসহ একটি ড্রামে ১ কেজি খৈল ও ৫ কেজি গোবর ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে কমপক্ষে ১৫ দিন পচাতে হবে। সাথে এক মুঠো পটাশ সার ও এক মুঠো ফসফরাস সার মিশ্রিত করা যেতে পারে। প্রতিদিন একটি বড় লাঠি দিয়ে নাড়িয়ে দিতে হবে। খৈলপচা পানি নাড়িয়ে পুনরায় ড্রাম ঢেকে দিতে হবে। এতে করে পোকা হবে না এবং দীর্ঘদিন (প্রয়োজনে এক বছর) এই পানি ব্যবহার করা যাবে। খৈলপচানো পানির সাথে দশ গুণ পরিমাণ পানি মিশিয়ে ৮-১০ দিন পরপর গাছে প্রয়োগ করা যেতে পারে। খৈল সার দেওয়ার পরই নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে পানি দিতে হবে। ছাদবাগানে বারোমাসি গাছের জন্য দুটি সিলভামিক্স ট্যাবলেট সার দেওয়া যেতে পারে। তবে মৌসুমি জাতের জন্য সিলভামিক্স ট্যাবলেট সারের প্রয়োজন নেই। শাকজাতীয় গাছের ক্ষেত্রে কিছুটা ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে খৈল ছাড়াও আরও কিছু জৈবসার ঘরে বানিয়ে প্রয়োগ করতে পারেন। তারপরও যদি উদ্ভিদের কোনো পুষ্টি উপাদানের অভাব হয়, তবে সারের অভাবজনিত লক্ষণ দেখে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
বাগান করার পর থেকে যদি আপনি কিছু হলুদ আঠালো কাগজ, ফেরোমন ট্র্যাপ, বিশেষ করে লাউজাতীয় গাছ, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, আম, পেয়ারা, কমলাগাছের পাশে ব্যবহার করা যায়, ৮-১০ দিন পরপর ঘরে বানানো কীটনাশক স্প্রে করে করা হয়, প্রুনিং করে গাছকে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা হয়, মালচিং, ডিপটিং ও রিপটিং এবং সুষম সার, সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ পানি সেচ দেওয়া হয়, তবে বাগানে এমনিতেই পোকামাকড়ের আক্রমণ সহনশীল পর্যায়ে থাকবে। তা ছাড়া গাছে ফল ধরার পর ফল ব্যাগিং করে দিলে ফলের ভেতর ফ্রুট ফ্লাই তার অভিপজিটর দিয়ে ডিম পাড়তে পারে না বিধায় ফলের ভেতর কিড়া হয় না। শুধু আম, পেয়ারা নয়, বরং লাউ, শসা, কুমড়া, করলা- এ সবই ফ্রুট ব্যাগিংয়ের মাধ্যমে ফলে রক্ষা করা যায়।
বাড়িতে তৈরি কিছু কীটনাশক
সাবান : এক লিটার পানিতে দেড় চা-চামচ তরল সাবান ঝাঁকিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।
নিম তেল : দুই চা-চামচ নিম তেল ও এক চা-চামচ তরল সাবান এক লিটার পানির সাথে ভালোভাবে মিশ্রিত করে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করা যেতে পারে।
মরিচের গুঁড়া : এক চা-চামচ শুকনা মরিচের গুঁড়া, এক চা-চামচ পেঁয়াজ/রসুনের রস ও কয়েক ফোঁটা তরল সাবান এক লিটার পানির সাথে ভালোভাবে মিশ্রিত করে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করা যেতে পারে।
প্রুনিং ও পিঞ্চিং
পিঞ্চিং ও প্রুনিং করলে গাছ ঝোপালো হয় এবং ফুল ও ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চারা ৬-৮ ইঞ্চি হলে গাছের পাতা বা কুঁড়ির শেষ অংশটি সরিয়ে ফেলাকে পিঞ্চিং বলে। এতে করে গাছে দুই-তিনটি পাশর্^ীয় কা- বের হয়। যার ফলে আরও পাতা ও ফুল হয়। ফুল গাছের ক্ষেত্রে ফুল ধরার পর শুকিয়ে যাওয়ার আগেই কেটে দিলে ফুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
মালচিং
জৈব উপাদান, যেমন-গাছের বাকল, পাতা, কাঠের টুুকরো এবং অজৈব উপাদান, যেমন পাথর বা ইটের টুকরো দ্বারা গাছের শিকড়ের চারপাশে ফুল/সবজিচারার ক্ষেত্রে এক ইঞ্চি ফাঁকা রেখে বাকি অংশে ১- ১.৫ ইঞ্চি পুরু করে ঢেকে দেওয়া হয়। ক্ষতিকর পোকামাকড় থেকে গাছকে বাঁচাতে নিমখৈল বা দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন। এভাবে মালচিং করলে জৈব উপাদান মাটির সাথে মিশে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করে, মাটিতে পানি ধরে রাখে, মাটির অপচয় রোধ করে, আগাছা জন্মানো রোধ করে এবং উপকারী পোকা ও মাকড়ের জন্য খাদ্যের জোগান দেয়।
কুমড়াজাতীয় ফসলের হাত পরাগায়ন
হাত দিয়ে কুমড়াজাতীয় ফসলে পরাগায়ন করাকে হাত পরাগায়ন বলে। পুরুষ ফুলের পরাগধানীতে পরাগরেণু থাকে। পরাগায়নের জন্য পরাগরেণু স্ত্রী ফুলের গর্ভমু-ে স্থানান্তর করতে হবে এবং তাতেই দেখবেন ফল ধারণ করবে। তবে খেয়াল রাখবেন, পরাগায়ন যেন সঠিকভাবে হয়।
শসা : পুরুষ ও স্ত্রী ফুল উভয়ই সকালে ফোটে। পুরুষ ফুলের পরাগরেণু সর্বোচ্চ বেলা দুইটা পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকে এবং বেলা বাড়ার সাথে সাথে নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। স্ত্রী ফুলের গর্ভমু- খুব কম সময়ের জন্যই সক্রিয় থাকে। তাই স্ত্রী ফুল ফোটার দুই ঘণ্টার মধ্যে পরাগায়ন করতে হবে।
করলা : সকাল ৬টা থেকে সকাল ৯টা।
লাউ : বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা।
ফল সংগ্রহ
সবজির ফল যথেষ্ট কচি অবস্থায় পরিপূর্ণ আকার ও রং প্রাপ্তির পর সংগ্রহ করতে হবে।
লেখক : সিনিয়র উদ্যানতত্ত্ববিদ, বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প, হর্টিকালচার সেন্টার, ফলবীথি, আসাদগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৪৯০১৭৬৫৭