গমের আধুনিক জাতসমূহ ও
উৎপাদন কৌশল
ড. মোহাম্মদ রেজাউল কবীর
গম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দানাজাতীয় খাদ্যশস্য। দানাজাতীয় খাদ্যশস্যের মধ্যে ধান ও ভুট্টার পরেই গমের অবস্থান। গম অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন, কৃষি উপকরণ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব একটি ফসল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের খাদ্যভ্যাস পরিবর্তনের ফলে প্রতি বছর গমের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া গম চাষের জন্য উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও উপযুক্ত মূল্যের অভাব এবং শীতকালীন অন্যান্য ফসলের সাথে প্রতিযোগিতার ফলে গম চাষের আওতায় এলাকা কমে যাচ্ছে। অপরদিকে আশাব্যঞ্জক খবর হলো দেশে গমের গড় হেক্টরপ্রতি ফলন প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত ২০০৫-০৬ মৌসুমে দেশে হেক্টরপ্রতি গমের গড় ফলন ছিল ১.৫৩ টন যা বর্তমানে বেড়ে ৩.৮৩ টনে উন্নীত হয়েছে। এতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে দেশে লাভজনকভাবে গম চাষ করার জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া এবং উচ্চফলনশীল জাত বিদ্যমান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ১৯৯৮-৯৯ উৎপাদন মৌসুমে দেশে প্রায় ২০ লক্ষ মেট্রিক গম উৎপাদিত হয়েছিল। সঠিক জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দেশে ২০ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি গম উৎপাদন করা সম্ভব।
গমের অধুনিক ও উচ্চফলনশীল জাতসমূহ
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউ এ পর্যন্ত ৩৮ গমের জাত উদ্ভাবন করেছে। এদের মধ্যে বারি গম ২৫, বারি গম ২৮, বারি গম ৩০, বারি গম ৩২, বারি গম ৩৩, বিডাব্লিউএমআরআই গম ১, বিডাব্লিউএমআরআই গম ২, বিডাব্লিউএমআরআই গম ৩, বিডাব্লিউএমআরআই গম ৪ এবং বিডাব্লিউএমআরআই গম ৫ অন্যতম। নি¤েœ উপযোগিতা অনুসারে গমের জাতসমূহের বিভাজন উল্লেখ করা হলো:
া উত্তরাঞ্চলের হালকা বুনটের মাটিতে আগাম আলুর পর বপনের উপযোগী গমের জাতসমূহ: বারি গম ৩২, বিডাব্লিউএমআরআই গম ১, বিডাব্লিউএমআরআই গম ৪
া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের ব্লাস্ট প্রবন এলাকায় বপনের উপযোগী গমের জাতসমূহ: বারি গম ৩৩, বিডাব্লিউএমআরআই গম ৩ এবং বিডাব্লিউএমআরআই গম ৫
া আমন ধান কাটার পর দেরীতে বপনের উপযোগী গমের জাতসমূহ: বারি গম ২৮, বারি গম ৩০, বারি গম ৩২ ও বিডাব্লিউএমআরআই গম ১
া উপকূলীয় লবণাক্ততা প্রবণ এলাকায় বপনের উপযোগী গমের জাতসমূহ: বারি গম ২৫ ও বিডাব্লিউএমআরআই গম ৪
া জিংক সমৃদ্ধ গমের জাতসমূহ: বারি গম ৩৩, বিডাব্লিউএমআরআই গম ৩
া তাপ সহিষ্ণু গমের জাত সমূহ: বারি গম ২৮, বারি গম ৩০, বারি গম ৩২, বিডাব্লিউএমআরআই গম ১, বিডাব্লিউএমআরআই গম ২ এবং বিডাব্লিউএমআরআই গম ৪
গম উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল
বপনের সময় : গমের দানার আকার, আকৃতি, পুষ্টতা ও অন্যান্য গুণাগুণ বজায় রাখতে উপযুক্ত সময়ে গম বপন করতে হবে। গম বপনের উপযুক্ত সময় নভেম্বর মাসের ১৫ থেকে ৩০ পর্যন্ত (অগ্রহায়ণ মাসের ১ম থেকে ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত)।
বীজের হার ও বীজ শোধন : গজানোর ক্ষমতা শতকরা ৮০ ভাগ ও তার বেশি হলে হেক্টর প্রতি ১২০ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে। তবে কাক্সিক্ষত ফলন পেতে বারি গম ৩৩ জাতের গমের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ১৪০ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে। বপনের পূর্বে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা পরীক্ষা করে নিতে হবে এবং কার্যকর ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধন করলে বীজ বাহিত রোগ দমন হয় এবং বীজ গজানোর ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ চারা সবল ও সতেজ হয় । বীজ শোধন করলে ফলন শতকরা ১০-১২ ভাগ বৃদ্ধি পাবে।
বপন পদ্ধতি : সারিতে অথবা ছিটিয়ে গম বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপনের জন্য জমি তৈরির পর ছোট লাঙ্গল বা বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে ২০ সেমি. বা ৮ ইঞ্চি দুরে দুরে সারিতে এবং ৪-৫ সেমি. গভীরে বীজ বুনতে হবে। ধান কাটার পর পরই পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে স্বল্পতম সময়ে গম বোনা যায়। এ যন্ত্রের সাহায্যে একসঙ্গে জমি চাষ, সারিতে বীজ বপন ও মইয়ের কাজ করা যাবে।
সার প্রয়োগ : জমি চাষের শুরুতে হেক্টরপ্রতি ৫-১০ টন গোবর/কম্পোস্ট জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করা উত্তম। শেষ চাষের পূর্বে জমিতে হেক্টরপ্রতি ১৫০-১৭৫ কেজি ইউরিয়া, ১৩৫-১৫০ কেজি টিএসপি, ১০০-১১০ কেজি পটাশ ও ১১০-১২৫ কেজি জিপসাম সার সমান ভাবে ছিটিয়ে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে চারার তিন পাতা বয়সে প্রথম সেচের পর দুপুর বেলা মাটি ভেজা থাকা অবস্থায় প্রতি হেক্টরে ৭৫-৯০ কেজি ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। জমিতে প্রায়শ বোরন সারের ঘাটতি দেখা যায় বলে প্রতি হেক্টরে ৬.৫ কেজি হারে বরিক এসিড শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। যে সব জমিতে দস্তা সারের ঘাটতি রয়েছে এবং পূর্ববর্তী ফসলে দস্তা প্রয়োগ করা হয়নি সে সব জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টরপ্রতি ১২.৫ কেজি দস্তা সার যথা জিংক সালফেট (মনোহাইড্রেট শতকরা ৩৬ ভাগ জিংক সম্বলিত) শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করা ভাল।
জমিতে অম্লীয় মাত্রা ৫.৫ এর নিচে হলে হেক্টরপ্রতি ১০০০ কেজি হারে ডলোচুন গম বপনের কমপক্ষে দু’সপ্তাহ আগে মাটিতে ‘জো’ থাকা অবস্থায় প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি ৩ বছরে একবার ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ প্রয়োগ : মাটির প্রকার ভেদে গম আবাদে ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রথম সেচ চারার তিন পাতার সময় (বপনের ১৭-২১ দিন পর) দ্বিতীয় সেচ শীষ বের হওয়ার সময় (বপনের ৫০-৫৫ দিন পর) এবং তৃতীয় সেচ দানা গঠনের সময় (বপনের ৭৫-৮০ দিন পর) দিতে হবে। তবে মাটির প্রকারভেদে ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভাল ফলনের জন্য অতিরিক্ত এক বা একাধিক সেচ দেয়া ভাল। প্রথম সেচটি খুবই হালকা ভাবে দিতে হবে। তা না হলে অতিরিক্ত পানিতে চারার পাতা হলুদ যায় এবং চারা সম্পূর্ণ বা আংশিক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেচের পর পরই জমি থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে। তাই বপনের পর জমির ঢাল বুঝে ২০-২৫ ফুট অস্তর অন্তর নালা কেটে রাখতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা : বীজ বপনের পর ১০-১২ দিন পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে বীজ বা চারার সংখ্যা সঠিক থাকে। বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে জমিতে ‘জো’ অবস্থায় আগাছা দমনের জন্য নিড়ানি দিতে হবে। চওড়া পাতা জাতীয় আগাছা (বথুয়া ও কাকরি) দমনের জন্য এফিনিটি নামক আগাছা নাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২৫ গ্রাম হিসেবে ভাল ভাবে মিশিয়ে ¯েপ্র মেশিনের সাহায্যে মেঘমুক্ত দিনে ৫ শতাংশ জমিতে একবার প্রয়োগ করতে হবে অথবা হ্যামার নামক আগাছা নাশক প্রতি ১৫ লিটার পানিতে ৫মিলি ভালভাবে মিশিয়ে মেঘমুক্ত দিনে ১২ শতাংশ জমিতে একবার প্রয়োগ করতে হবে । সময় মত আগাছা দমন করলে ফলন শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ শুরু হলে ফাঁদ পেতে বা বিষটোপ (জিঙ্ক ফসফাইড বা ল্যানিরেট) দিয়ে দমন করতে হবে।
গমের ব্লাস্ট ও অন্যান্য রোগ দমনের জন্য প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং তার ১২-১৫ দিন পর আরেকবার ফলিকুর, নাটিভো ৭৫ ডব্লিউ জি, ইত্যাদি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
ভিন্ন জাত বাছাইকরণ বা রোগিং : বীজের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করণের জন্য শীষ বের হওয়ার পর হতে পাকা পর্যন্ত কয়েকবার অন্য জাতের মিশ্রণ, রোগাক্রান্ত গাছ এবং আগাছা গোড়াসহ উপড়ে ফেলতে হবে। বীজ উৎপাদনের জন্য এ কাজগুলো সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে করলে বীজের মান নিশ্চিত হবে।
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ : গম গাছ সম্পূর্ণরূপে পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করলে কাটার উপযুক্ত সময় হিসেবে গন্য হবে। গম পাকার পর বেশি দিন ক্ষেতে থাকলে ঝড়/শিলা বৃষ্টিতে যথেষ্ট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সকালের দিকে গম কেটে দুপুরে মাড়াই করা উত্তম। মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে সহজে গম মাড়াই করা যায়। বীজ সংগ্রহের জন্য গম পাকার পর হলুদ হওয়া মাত্রই কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে আলাদা করে মাড়াই করতে হবে এবং মাড়াইয়ের পর কয়েক দিন বীজ শুকানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগ বা তার নিচে রাখতে হবে। দানা দাঁতের নিচে চাপ দিলে কট করে শব্দ হলে বুঝতে হবে যে, উক্ত বীজ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত। সংরক্ষণের পূর্বে পুষ্ট বীজ চালনি দিয়ে চেলে বাছাই করে নিতে হবে।
প্লাস্টিক ড্রাম, ড্রাম, চটের বস্তÍÍার মধ্যে পলিথিন ব্যাগে বীজ সংরক্ষণ করা যায়। লক্ষ্য রাখতে হবে বীজ সংরক্ষণের পাত্র যেন ছিদ্রমুক্ত হয়। বীজ ভর্তির পর পাত্রের ভেতরে যেন কোন ফাঁকা জায়গা না থাকে। পাত্র সম্পূর্ণভাবে বীজ ভর্তির পর শক্ত করে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে যাতে বাইরের বাতাস ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। পলিথিন বা প্লাস্টিক জাতীয় পাত্রে সংরক্ষণের জন্য শুকানো বীজ ১০-১২ ঘণ্টা ছায়ায় ঠা-া করে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ সংরক্ষিত পাত্র সরাসরি মেঝেতে না রেখে মাচার উপরে এবং ঘরের দেয়াল/বেড়া থেকে একটু দূরে রাখা উত্তম। খেয়াল রাখতে হবে যেন বীজসহ পাত্রগুলো মাটির সংস্পর্শে না আসে। মাটির সংস্পর্শে এলে বীজের আর্দ্রতা বেড়ে বীজ নষ্ট হতে হয়ে যাবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, দিনাজপুর, মোবাইল : ০১৭৯৬৫৮৬০৩৯, ইমেইল: rezaulwrc@gmail.com