Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

দেশের-খাদ্য-ও-পুষ্টি-নিরাপত্তায়-প্রাণিসম্পদ-খাত

দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণিসম্পদ খাত
ড. হোসেন মোঃ সেলিম
প্রাণিসম্পদ খাত হলো দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধান। পাশাপাশি বেকার সমস্যার সমাধান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, সাধারণ জণগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য খাত। দেশের ক্রমবর্ধমান প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির টেকসই জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ এবং রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গুণগত উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষিজ জিডিপিতে স্থিরমূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৬.৩৩%, দেশজ উৎপাদনে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান প্রায় ১.৮৫%, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.১৫% এবং বর্তমান বাজারমূল্যে জিডিপির আকার প্রায় ৮২,০৪১ কোটি টাকা। জনসংখ্যার প্রায় ২০% প্রত্যক্ষ এবং ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের উপর নির্ভরশীল। দেশের প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৭০-৭৫% আমিষ এ প্রাণিসম্পদ খাত থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। সর্বোপরি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি নিয়োগ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভ্যালু চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি, মানসম্মত প্রাণিজাত পণ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ) অর্জন লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। নি¤েœ দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান এবং প্রাণিজ আমিষের গুরুত্ব উপস্থাপন করা হলো:
দুধের উৎপাদন ও পুষ্টিগুণ 
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারাদেশে মোট ১৫০.৪৪ লক্ষ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদিত হয়েছে। যার ফলে দেশে মাথাপিছু দৈনিক ২৫০ মিলি দুধের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ২৩৪.৪৫ মিলি দুধ সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে, যার পরিমাণ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, সরবরাহকৃত ২৩৪.৪৫ মিলি দুধের মধ্যে তরল দুধ এবং দুধ হতে উৎপাদিত পণ্য যেমন: দই, ছানা, মিষ্টি, আইসক্রিম, পনির, ঘি, মাঠা ও অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য রয়েছে, যা খুবই পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত। দুধ একটি সম্পূর্ণ আদর্শ খাদ্য এবং ইহা উৎকৃষ্ট আমিষ ও ক্যালসিয়ামের উৎস্য। আয়রন ছাড়া সকল প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেলস দুধে বিদ্যমান। দুধে এল-ট্রিপটোফেন নামক এমিনো এসিড থাকে বিধায় দুধ খেলে ভালো ঘুম হয়। দুধ থেকে তৈরি ইউগার্ট প্রবায়োটিক হিসেবে কাজ করে যা হজম শক্তি এবং শরীরের ইমিউন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। পুষ্টি ভ্যালু হিসেবে এক কাপ দুধে প্রায় ১৪০-১৫০ কিলোক্যালরি শক্তি,   ৮-১০ মিলিগ্রাম মানসম্মত ফ্যাট, ৮-১০ মিলিগ্রাম উন্নত প্রোটিন, ১৩-১৫ মিলিগ্রাম শর্করা, ২৪-২৫ মিলিগ্রাম ঝুঁকিবিহীন কোলেস্টেরল, ৯৮-১০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে। 
মাংসের উৎপাদন ও পুষ্টিগুণ 
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারাদেশে মোট ৯২.২৫ লক্ষ মেট্রিক টন মাংস উৎপাদিত হয়েছে। যারফলে দেশে মাথাপিছু দৈনিক ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ১৪৩.৭৭ গ্রাম মাংস সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে, যার পরিমাণ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, সরবরাহকৃত ১৪৩.৭৭ গ্রাম মাংসের মধ্যে মাংস এবং মাংস হতে উৎপাদিত পণ্য যেমন: মিট বল, মিট বার্গার, মিট কাটলেট, চিকেন বার্গার, চিকেন নাগেট, ফ্রাইড চিকেন, চিকেন স্যান্ডউইচ ও অন্যান্য মাংস জাত খাদ্য পণ্য রয়েছে, যা খুবই পুষ্টিকর, উপাদেয় এবং স্বাস্থ্যসম্মত। মাংস একটি উচ্চ আমিষের উৎস্য যেখানে সকল এমিনো এসিড বিদ্যমান। মাংস মানবদেহের অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও মিনারেলস এর চাহিদা পূরণ করে। বয়স্কদের অস্থি ক্ষয়রোধ ও দুর্বলতা প্রতিরোধ করে। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশ ঘটায়। পুষ্টি বিবেচনায় প্রতি ১০০ গ্রাম মাংসে প্রায় ২২-২৬ গ্রাম মানসম্মত প্রোটিন, ৩-৪ গ্রাম উন্নত ফ্যাট, ১৪০-১৫০ কিলোক্যালরি শক্তি,               ৭০-৭৫ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল, ৫৫-৬০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে। 
ডিমের উৎপাদন ও পুষ্টিগুণ 
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারাদেশে মোট ২৩৭৪.৯৭ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। যার ফলে দেশে মাথাপিছু বছরে ১০৪টি ডিমের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ১৩৫টি ডিম সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে, যার পরিমাণ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। তবে সামগ্রিকভাবে দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, সাধারণ জণগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ডিমের চাহিদা ও গ্রহণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং সে অনুযায়ী প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিমের এ চাহিদা পুনরায় নির্ধারণ করেছে। এ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বছরে মাথাপিছু ২০৮টি ডিমের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ হিসেবে জনপ্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪টি ডিম এবং ডিম হতে উৎপাদিত পণ্য যেমন-পুডিং, কেক, এগ এলবুমিন, এগ ইয়ক পাউডার ইত্যাদি গ্রহণ করবে, যা খুবই পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত। ডিম একটি সম্পূর্ণ নিউট্রিয়েন্ট পিল। ডিমের আয়রন হিম পদ্ধতিতে থাকে বিধায় মানব শরীরের রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে দ্রুত সহায়তা করে। ডিম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে ও শরীরের ওজন কমায় চামড়া মসৃণ রাখে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। ডিম খেলে  দৃষ্টিশক্তি এবং স্মৃতিশক্তি প্রখর থাকে। ডিমের স্যাটাইটি ভ্যালু বেশি বিধায় ডিম খেলে পরিতৃপ্তি নিশ্চিত হওয়ার কারণে অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ কম হয়ে থাকে। পুষ্টি বিবেচনায় একটি সম্পূর্ণ ডিমে প্রায় ৬ গ্রাম মানসম্মত প্রোটিন,  ৫ গ্রাম উন্নত ফ্যাটি এসিড, ৭০-৭৭ কিলোক্যালরি শক্তি,  ১৭৫-২১০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল, ১০০-১৪০ মিলিগ্রাম কোলিন, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে। 
সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে প্রাণিজ আমিষের (দুধ, ডিম ও মাংস) উপযোগিতা নিম্নরূপ:
শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশ ঘটায়
 মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
 মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও মিনারেলস এর চাহিদা পূরণ করে
 বয়স্কদের অস্থি ক্ষয়রোধ ও দুর্বলতা প্রতিরোধ করে
 স্ট্রোক, হৃদরোগ, আত্রাইটিস ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়
 মানব দেহের ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে
 রক্তের ক্ষতিকর ট্রাইগ্লিসারাইডের উপস্থিতি হ্রাস করে
 মানুষের দৃষ্টিশক্তি ও গ্রাণশক্তি বৃদ্ধি করে
 সুস্থ সবল মেধাবী জাতি গঠনে সহায়তা করে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভিশন হচ্ছে ‘সকলের জন্য পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ’ করা এবং মিশন হচ্ছে ‘প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং ভ্যালু এডিশনের মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ’। তাই বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও আপামর মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ৫০ বছরের প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা (২০১৭-২০৬৬) এবং জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও কৌশল অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় এবং প্রাণিজ আমিষের গুণগতমান বজায় রাখাসহ সার্বিক নিরাপদতায়  প্রাণিসম্পদ সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
 
লেখক : উপপরিচালক (প্রাণিসম্পদ পরিসংখ্যান), পরিকল্পনা শাখা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯৪৬৯৫২০১১,   ই-মেইল :hmsalim72@yahoo.com