Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সূচিপত্র
সূচিপত্র
নিবন্ধ/প্রবন্ধ
 চিনিফসল সম্প্রসারণে বিএসআরআই জাত ও প্রযুক্তি ৩
ড. মোঃ ওমর আলী, ড. মোঃ শফিকুল ইসলাম
 কাঁচা কাঁঠালের অপার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ৫
ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী, মো. হাফিজুল হক খান
 গ্রীষ্মকালীন শিম উৎপাদন প্রযুক্তি ৭
অধ্যাপক  ড. মো: শহীদুল ইসলাম
 আউশ ধানের আবাদ ও ফলন বৃদ্ধিতে করণীয় ১০
কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন
 আমের জাতসমূহের পরিপক্বতা ও সংগ্রহের সময়সূচি ১২
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন, ড. মোঃ উবায়দুল্লাহ কায়ছার
 মুগ ও মাসকলাইয়ের পোকামাকড় পরিচিতি ও দমন ব্যবস্থাপনা ১৩
ড. মোঃ আলতাফ হোসেন
 অপুষ্টিজনিত ‘গুপ্ত ক্ষুধা’ নিরাময়ের বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক রাইস ১৬
কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন 
 কম খরচে তুলা চাষের আধুনিক প্রযুক্তি ১৮
ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজা, অসীম চন্দ্র শিকদার
 ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে কৃষক সেবা ২১
ড. মো: নূরুল হুদা আল মামুন
আগামীর কৃষি ভাবনা
 জৈব কৃষি ব্যবস্থাপনায় ছাই ব্যবহার ২৩
মুন্সী আবু আল মো. জিহাদ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ
 অধিক উৎপাদনশীল সুবর্ণ রুই মাছ চাষ পদ্ধতি ২৫
মোঃ মাসুদ রানা
 ডিমের খোসার ব্যবহার ২৭
মোঃ আকতার হোসেন
সফল কৃষকের গল্প
 গ্রামীণপর্যায়ে উন্নতমানের বীজের চাহিদা পূরণে কৃষকদের উদ্যোগ ২৮
ধীবা রানী রায়
নিয়মিত বিভাগ
 প্রশ্নোত্তর ২৯
কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন
 জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি ৩১
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
বিস্তারিত
চিনিফসল সম্প্রসারণে বিএসআরআই জাত ও প্রযুক্তি

চিনিফসল সম্প্রসারণে বিএসআরআই 
জাত ও প্রযুক্তি
ড. মোঃ ওমর আলী১  ড. মোঃ শফিকুল ইসলাম২
পরিবর্তিত আবহাওয়া এবং জলবায়ুতে দেশের মানুষের মিষ্টিজাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের স্বার্থে আখের পাশাপাশি অন্যান্য চিনিফসল যেমন- তাল, খেজুর, গোলপাতা, স্টিভিয়া, যষ্টিমধু এবং মধুর ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিগত ৯ নভেম্বর ২০১৫ খ্রি. থেকে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) রাখা হয়। প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তনের পর থেকে সকল ধরনের চিনিফসলের গবেষণার মান উন্নয়ন এবং মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়সহ অধিনস্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যান্য শিল্প কারখানার সঙ্গে চিনিকলগুলো জাতীয়করণ করেন যাতে আখচাষিদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হয়। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি ও উচ্চমূল্যের ফসলের প্রভাবের কারণে দিন দিন মিল এলাকায় আখের চাষের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কৃষকপর্যায়ে আখের ফলন বৃদ্ধি এবং আখ চাষের নতুন অঞ্চল সৃষ্টির লক্ষ্যে বিএসআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বিএসআরআই হতে ইতোমধ্যে ৪৮টি আধুনিক আখের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং নতুন করে আরো দুটি আধুনিক আখ জাত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আধুনিক আখের এ জাতগুলো বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা এবং লবণাক্ত অবস্থায় টিকে থাকতে পারে। এর মধ্যে ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ৩৫, ঈশ্বরদী ৩৬, ঈশ্বরদী ৩৭, ঈশ্বরদী ৩৮ এবং ঈশ্বরদী ৪০ বিশেষভাবে খরা সহনশীল জাত। সর্বাধিক পরিচিত বন্যা এবং জলাবদ্ধতা সহনশীল জাতগুলো হলো ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ৩২, ঈশ্বরদী ৩৪, ঈশ্বরদী ৩৫, ঈশ্বরদী ৩৬, ঈশ্বরদী ৩৭, ঈশ্বরদী ৩৮, ঈশ্বরদী ৩৯, ঈশ্বরদী ৪০ বিএসআরআই আখ ৪৩, বিএসআরআই আখ ৪৪, বিএসআরআই আখ ৪৬ এবং বিএসআরআই আখ ৪৮। লবণাক্ততাসহনশীল জাতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঈশ্বরদী ৩৭, ঈশ্বরদী ৩৮, ঈশ্বরদী ৩৯, ঈশ্বরদী ৪০ এবং বিএসআরআই আখ ৪৫, যা আখ চাষিরা উল্লেখযোগ্যভাবে জমিতে ব্যবহার করেছেন। 
বিগত রোপণ মৌসুমে (২০২২-২৩) বিএসআরআই এ চলমান রোগমুক্ত পরিচ্ছন্ন বীজ উৎপাদন কর্মসূচি এবং সাথী ফসল প্রকল্পের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের মিল এবং মিল-বহির্ভূত এলাকায় প্রায় ২২০০ এর অধিক সংখ্যক আধুনিক আখ জাতের প্রদর্শনী প্লট বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং আনুমানিক ১৫ লক্ষ সংখ্যক রোগমুক্ত পরিচ্ছন্ন বীজ আখ উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস, সেমিনার এবং ওয়ার্কশপ এর মাধ্যমে বিএসআরআই এর উদ্ভাবিত আধুনিক আখের জাতের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেছে প্রায় ৫০০০ জন কৃষক এবং আনুমানিক ২০০ জন কর্মকর্তা। এছাড়া  মিল-বহির্ভূত এলাকায় বিএসআরআই উদ্ভাবিত চিবিয়ে খাওয়া আখের জাত যেমন বিএসআরআই আখ ৪১, বিএসআরআই আখ ৪২ এবং বিএসআরআই আখ ৪৭ জাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ হচ্ছে বিশেষ করে দেশের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে। যার ফলে আখের ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকরা পূর্বের তুলনায় অধিক মুনাফা অর্জন করছে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে।  
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশনাকে সামনে রেখে আখের দুই নালার মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় সাথীফসল হিসেবে উচ্চমূল্যের বিভিন্ন ফসল চাষের গবেষণা বিএসআরআই এ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া বিএসআরআই উদ্ভাবিত আখের সাথে সাথীফসল চাষের বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তিসমূহ যেমন আখের সাথে সাথীফসল হিসেবে আলু, পেঁয়াজ, রসুন, গাজর, মসুর, টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি ফসল কৃষকপর্যায়ে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। এ সকল সাথীফসল চাষ করে কৃষকরা বিঘাপ্রতি ১ থেকে ১.৫ লক্ষ টাকা বাড়তি আয় করছে। তাছাড়া কৃষকের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে ডাল, সবজি, এবং মসলা জাতীয় ফসলের চাহিদা পূরণে অবদান রাখা সম্ভব হচ্ছে। অন্যদিকে ডাল জাতীয় ফসল চাষের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোপা এবং মুড়ি আখ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে ফলে স্বল্প খরচে আখ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে এবং এ প্রযুক্তি গ্রহণকারী কৃষকরা লাভবান হচ্ছে।
বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে গুড় খাওয়া জনপ্রিয় যার কারণে এর দাম তুলনামূলক বেশি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে গুড় পাওয়া যায় না বলে আমদানি থেকে গুড়ের ঘাটতি পূরণ করা যায় না। বাংলাদেশে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে  ৩.০৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে উৎপাদিত আখের ২৬ ভাগ চিনি, ৫৯ ভাগ গুড় এবং ১৫ ভাগ বীজ তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে উৎপাদিত আখের সিংহভাগ ব্যবহৃত হয় গুড় তৈরিতে। কৃষক হতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিঘাপ্রতি গুড় বিক্রি করে কৃষকরা প্রায় ৮০-৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত মুনাফা করছে। বিএসআরআই ইতোমধ্যে আখ হতে দানাগুড় উৎপাদন, প্যাকেটজাত ও সংরক্ষণ করার পদ্ধতি উদ্বাবন করেছে। আমাদের দেশের সঠিক উপায়ে প্রস্তুতকৃত দানাদার গুড় পলিথিন প্যাকেটে প্যাকেটজাত করে কক্ষ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করে সারা বছর বিপণন করার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। এই দানাদার গুড় উৎপাদন করে আমাদের দেশের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব যা থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যেতে পারে। দানাদার গুড় উৎপাদনের জন্য বিএসআরআই উদ্ভাবিত ঈশ্বরদী ৩৬, ঈশ্বরদী ৩৭, ঈশ্বরদী ৩৮, ঈশ্বরদী ৩৯, ঈশ্বরদী ৪০ বিএসআরআই আখ ৪৩, বিএসআরআই আখ ৪৪, বিএসআরআই আখ ৪৬ এবং বিএসআরআই আখ ৪৮ বিশেষভাবে উপযোগী এবং এ জাতগুলো হতে অধিক গুড় উৎপাদন করা সম্ভব। স্থানীয় জাতের গুড়ের পরিমাণ যেখানে শতকরা ৮-৯ ভাগ সেখানে বিএসআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত আখের জাতের গুড়ের পরিমাণ শতকরা ১৪-১৫ ভাগ অর্থাৎ প্রায় ৪০ ভাগ বেশি। একইভাবে বিএসআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত আধুনিক ক্রাশার মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে প্রচলিত ক্রাশার মেশিন থেকে ২৫-৩০ ভাগ পর্যন্ত বেশি আখের রস আহরণ করা সম্ভব। তাছাড়া ক্ষতিকর কেমিক্যাল হাইড্রোসের বিকল্প হিসেবে বন ঢেঁড়স ও উলট কম্বল ব্যবহারের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন মাঠ দিবস এবং প্রশিক্ষণে কৃষকদের সম্যক ধারণা দেয়া হচ্ছে।   
আখ ছাড়াও তাল এবং খেজুর গাছ সম্প্রসারণে বিএসআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রযুক্তির ভূমিকা অপরিসীম। বিএসআরআই এর প্রধান কার্যালয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে প্রায় এক লক্ষ তালের চারা উৎপাদন করা হয়েছে যার মধ্যে ৬০ হাজার তালের চারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বিতরণ করা হয়েছে। আরবীয় খেজুর গাছ এর প্রায় ৫০টি আধুনিক জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে নতুন খেজুর বাগান নির্মাণ করা হয়েছে যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আরবীয় খেজুরের জাত মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। খেজুরের গুড়, তালমিছরি, তালের মাস্কিট ইত্যাদি তৈরির আধুনিক প্রযুক্তি ইতোমধ্যে উদ্ভাবন করা হয়েছে। মধু গবেষণার মান উন্নয়নের জন্য আধুনিক মৌ-বক্স তৈরি করা হয়েছে এবং এগুলো মৌ-চাষিদের মাঝে সরবরাহ করা হচ্ছে যার ফলে পূর্বের তুলনায় বৈজ্ঞানিক এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মৌ-চাষিরা অধিক মধু আহরণ করতে পারছে যাতে তাদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। চিনির গুড়ার সাহায্যে মৌমাছির ভারোয়া মাইট দমন ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা হয়েছে। 
চিনির বিকল্প ফসল স্টিভিয়ার আধুনিক প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের মাঝে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। স্টিভিয়া চাষাবাদ সংক্রান্ত নিয়মিত মাঠ দিবস এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে যার মাধ্যমে কৃষকরা স্টিভিয়া চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছে তাছাড়া বিএসআরআই কর্তৃক স্টিভিয়ার টি ব্যাগ, স্টিভিয়ার পাউডার ইত্যাদি পণ্য তৈরি ও ব্যবহারের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে যার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরি করা সম্ভব হবে। 
বিএসআরআই এর আঞ্চলিক এবং উপকেন্দ্রগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নতুন আঞ্চলিক কেন্দ্র সুবর্ণচর, নোয়াখালী যেটি ১০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে মাটি, কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সমস্যার উপর ভিত্তি করে গবেষণা কার্যক্রম বর্তমানে চলমান রয়েছে। বিএসআরআই উদ্ভাবিত ৩০টি আধুনিক আখের জাত নিয়ে মিউজিয়াম প্লট স্থাপন করা হয়েছে। ফলে কৃষকরা আধুনিক আখের জাত, পোকামাকড় ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণা লাভ করছে। 
বজ্রপাত প্রতিরোধক প্রায় ১০ হাজার পলিব্যাগ তালের চারা উৎপাদন করা হয়েছে এবং সরকারি, আধা-সরকারি ও এনজিও প্রতিনিধির সহায়তায় সেগুলো নোয়াখালী অঞ্চলের উপযুক্ত বিভিন্ন জায়গা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। একইভাবে বিএসআরআই এর গাজীপুর এবং ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক কেন্দ্রের গবেষণার মান উন্নয়নে জোর দেয়া হচ্ছে। এছাড়া নতুন প্রতিষ্ঠিত গাইবান্ধা এবং বান্দরবান উপকেন্দ্রে বিএসআরআই এর সকল বিভাগ হতে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে। পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন বীজ বিতরণ কর্মসূচি এবং আখের সাথে সাথী ফসল প্রকল্পের আওতায় চাষিদের নিজস্ব জমিতে আখের বিভিন্ন জাতের প্রদর্শনী প্লট দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে উপকেন্দ্রেগুলোতে আখ, স্টেভিয়া, তাল ও খেজুর চারা উৎপাদন ও চাষাবাদ কলাকৌশল বিষয়ে মাঠ দিবস ও কৃষক প্রশিক্ষণ আয়োজনের মাধ্যমে কৃষকদের হাতে কলমে আখ, স্টেভিয়া, তাল ও খেজুর চাষে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেয়া হচ্ছে। এতে করে উপকেন্দ্র আওতাভুক্ত এলাকায় আখসহ অন্যান্য মিষ্টিজাতীয় ফসলের ফলন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি কৃষকরা লাভবান হচ্ছে এবং চিনিফসলের নতুন নতুন অঞ্চল সৃষ্টি হচ্ছে।   
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বিএসআরআই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও চিনিশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায়, পুষ্টি নিরাপত্তায় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অসামান্য ভূমিকা রাখবে এটা আশা করাই যায়। তবে চিনিফসলের প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও গবেষণার মান উন্নয়নে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়সহ অধিনস্ত অধিদপ্তরগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।    
লেখক : ১মহাপরিচালক, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই), ঈশ^রদী-৬৬২০, পাবনা, মোবাইল: ০১৭১২-৫৪৩৭২০; ই-মেইল:bsridg123@gmail.com, ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই), ঈশ^রদী-৬৬২০, পাবনা, মোবাইল: ০১৭০৪-৭৭৮৯২৯ 

বিস্তারিত
কাঁচা কাঁঠালের অপার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

কাঁচা কাঁঠালের অপার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী১ মো. হাফিজুল হক খান২
বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। পুষ্টিগুণে ভরপুর সেই কারণে এটি ফলের মধ্যে গুণের রাজা হিসেবে স্বীকৃত। কাঁঠালে আছে অধিক পরিমাণে আমিষ, শর্করা, বিভিন্ন ভিটামিন যা মানব দেহের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। পুষ্টিবিদদের মতে, কাঁঠালে আছে সাপোনিল ফ্লেবোনয়েড এবং ট্যানিন এই ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা আমাদের বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে রক্ষা করে। যেমন- হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। আমাদের দেশে প্রায় সব এলাকায় কম বেশি কাঁঠাল উৎপাদিত হয়ে থাকে তবে ময়মনসিংহ, রাজশাহী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, যশোর, খুলনা, সুনামগঞ্জ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য ও উৎকৃষ্টমানের কাঁঠাল উৎপন্ন হয়ে থাকে। ভরা মৌসুমে দেশের সর্বত্র আনাচে-কানাচে রাস্তাঘাটের ভ্যানে ও রাস্তার মোড়, ক্ষুদ্র চাষি আড়তদার, পাইকারি, বিক্রেতাদের কাঁঠাল স্তুপ করে বিক্রি করতে দেখা যায়।  বিভিন্ন কাঁঠাল চাষিদের সাথে মতবিনিময় করে জানা যায়, তারা কাঁঠালের প্রকৃত দাম পায় না বলে লাভবান হন না। এ ছাড়াও আমাদের কাঁঠাল বৈশাখ মাসে বেশি উৎপাদিত হয় তাই কম দাম থাকে। বিভিন্ন ফলের ভিড়ে অনেকেই এ ফল খেতে অনীহা প্রকাশ করে। গত কয়েক বছরের তথ্য মোতাবেক, বাজারে উৎকৃষ্টমানের কাঁঠালের অভাব রয়েছে আবার যা পাওয়া যায় তা কৃত্রিম উপায়ে অপরিপুষ্ট কাঁঠালকে পাকানো হয় ফলে গুণগতমানের কাঁঠাল ক্রেতারা পান না। এতে করে অনেকেই এ ফল থেকে বিমুখ হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ অন্যান্য গবেষণা প্রতিবেদনে লক্ষ করা যায়, দেশে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়ে থাকে এবং উৎপাদিত কাঁঠালের শতকরা ২৫ থেকে ৪৫ ভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে নষ্ট হয়। এ অপচয়ের পরিমাণ  টাকার অঙ্কে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার উপরে। কাঁঠালকে কাঁচা থেকে ব্যবহার শুরু করলে বিরাট অপচয় রোধ করা সম্ভব। 
কাঁঠাল সর্বগুণে গুণান্বিত একটি ফল। অন্যান্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি ও পণ্য সম্পর্কে ধারণা বা না জানার কারণে দেশের মানুষ শুধু পাকা কাঁঠালই খেতে পছন্দ করে। কিন্তু কাঁচা কাঁঠালের যে অনেক ব্যবহার আছে এবং এটি দিয়ে বহুবিধ খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা যায়, তা অনেকের নিকট অজানা। তাই কাঁঠাল অপচয়রোধে প্রথমেই গাছ হতে এক-তৃতীয়াংশ কাঁচা কাঁঠাল সংগ্রহ করে বহুমুখী ব্যবহার শুরু করতে হবে। এতে কাঁঠাল চাষির ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতেও সহায়তা করবে। বিজ্ঞানীদের গবেষণা তথ্য মতে, কাঁঠালে যে পুষ্টিগুণ রয়েছে তা অন্য ফলে নেই বা একসঙ্গে পাওয়া যাবে না এবং এর শক্তির পরিমাণ অনেক বেশি। এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবারও রয়েছে। কাঁঠালকে বহুমুখী ব্যবহার করা হলে এটি সহজলভ্য হবে এবং সারা বছর পাওয়া যাবে। বিএআরআই এর উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত কাঁঠালের ৬টি জাত উদ্ভাবন করেছে বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২, বারি কাঁঠাল-৩, বারি কাঁঠাল-৪, বারি কাঁঠাল-৫ ও বারি কাঁঠাল-৬। জাতগুলো আগাম, অসময়, বারোমাসি ও আঠাবিহীন। এতে করে কাঁঠাল চাষি, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা সারা বছরই কাঁঠাল সরবরাহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে সক্ষম হবেন।  এরই মধ্যে কাঁঠালের জাতগুলো হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় (ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী ও খাগড়াছড়ি উল্লেখযোগ্য) বাগান তৈরি করা হয়েছে এবং কৃষককে সরাসরি সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে কাঁচামাল হিসেবে কাঁঠাল বছরব্যাপী সহজলভ্য হবে এবং উদ্যোক্তা ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান কাঁঠালের খাদ্য সামগ্রী তৈরিতে সক্ষম হবে নিঃসন্দেহে। 
পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন ও কৃষি মন্ত্রণালয় এর অর্থায়নে গত ২০১৮ সাল থেকে ৬টিরও অধিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ১২টির উপরে খাদ্যদ্রব্যের উপকরণ তৈরি করেছেন। যেমন-কাঁঠালের ভেজিটেবল মিট বা ফ্রেশ-কাট, রেডি-টু-কুক, রেডি-টু-ইট, ভ্যাকুয়াম ফ্রাইড চিপ্স, কাঁঠালসত্ত্ব, আচার, শুকনো পণ্য, ফ্রোজেন পণ্যসহ সিংগারা, সমুচা, বার্গার, ভেজিটেবল রোল, স্যান্ডউইচ, কাটলেট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ পণ্যগুলো দেশের অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা বাসাবাড়িতে তৈরি করছেন এবং সরাসরি নিকটবর্তী বিপণিবিতান, সুপারশপ,         কৃষকের বাজার ও অনলাইনে বিক্রয় করছেন। কাঁচা কাঁঠালের ফ্রেশকাট বা রেডি-টু-কুক পণ্য তৈরিতে ৫-৬ সপ্তাহের কাঁঠালকে বেঁেছ নিতে হবে। অতঃপর কোষগুলো মাংসের ন্যায় কেটে টুকরো করে ৫০০-৭৫০ পিপিএম পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইট মিশ্রিত পানিতে টুকরোর আকৃতি ও ওজন অনুযায়ী ব্লাঞ্চিং করতে হবে যাতে এনজাইম নিষ্ক্রিয় হয়। অতঃপর স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে ১০-১৫ মিনিটি রেখে পরে মোড়কজাত করতে হবে। এভাবে সংরক্ষণকৃত কাঁচা কাঁঠালের ভেজিটেবল মিট বা ফ্রেশ-কাট পণ্য কুল বক্সে ২-৩ দিন, রেফ্রিজারেটরে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত গুণগতমান বজায় রেখে এবং    ডিপ-ফ্রিজে ৬ মাসের অধিক সময় সংরক্ষণ করা যায়। 
দেশের বাইরে উৎকৃষ্টমানের পরিপুষ্ট কাঁঠাল ও ভেজিটেবল মিট হিসেবে কাঁচা কাঁঠালের চাহিদা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইতালি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল ও যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে। উল্লেখ্য যে, গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ হতে প্রায় ২১০০ মেট্রিক টন কাঁঠাল বিদেশে রপ্তানি করা হয়, যা পূর্বের বছরের চেয়ে কিছুটা কম যেখানে গত ২০২৩ এ বিশ^ব্যাপী কাঁঠালের মার্কেটের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩২৪ মিলিয়ন ইউএস ডলার এবং ২০৩২ এ মার্কেটের সম্ভাব্য পরিমাণ হবে প্রায় ৩৯৬ মিলিয়ন ইউএস ডলার। দেশের বাইরে কাঁঠালের খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকডোনাল্ড কাঁঠালের বার্গার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান শুকনো চিপস, কাঁঠালের বারবিকিউ, জুস ইত্যাদি তৈরি করছে। গতবছর যুক্তরাজ্যের বাজারে ২-৩ কেজি ওজনের একটি কাঁঠাল ২০০-২৩০ পাউন্ডে বিক্রয় হয়েছে বলে দেশে পত্রিকা মারফত জানা যায়। 
কাঁঠালকে বাণিজ্যিকীকরণ করতে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চিপস, রেডি-টু-কুক, ভেজিটেবল মিট, কাঁঠালের বার্গার তৈরি ও বিপণনের উদ্যোগ নিচ্ছে। বিএআরআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্প্রতি পিকেএসএফ এর সহায়তায় সিদীপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৪ লাখ কাঁঠারের বার্গার আইসল্যান্ডের একটি সুপারশপে সরবরাহ করবে বলে জানা গিয়েছে যা উদ্যোক্তাদের মাঝে আশার সঞ্চার সৃষ্টি করেছে। কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে তৈরি করা যাবে বার্গার যেখানে প্রথমেই পেটি তৈরি করতে সিদ্ধকৃত কাঁঠালের কোষের সাথে কর্ণফ্লাওয়ারসহ (৩:২) বিভিন্ন মসলা যুক্ত করতে হবে। গবেষণা তথ্য মোতাবেক, কাঁঠালের বার্গারের পেটিতে প্রতি ১০০ গ্রামে রয়েছে ৯.৭৮ গ্রাম শর্করা, ১০.৮৭ গ্রাম আমিষ, ৮.৪৭ গ্রাম চর্বি, ১৯.৩২ গ্রাম ডায়েটরি ফাইবার ও ১৫৯ কিলোক্যালরি শক্তি যা আমাদের শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে নিঃসন্দেহে। কাঁচা কাঁঠালের ১০০ এর অধিক খাদ্যদ্রব্য ভারতের কেরালায় সারা বছর পাওয়া যায় সেখানে ভেজিটেবল মিট হিসেবে মাংসের বিকল্প হিসেবে খাওয়া হয়। আবার বার্মাতে কাঁঠালের বিরানির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। শ্রীলংকা ও নেপালসহ এশিয়ার অনেক দেশেই কাঁচা কাঁঠালকে খাদ্যদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার অনেক আগে থেকেই প্রচলন আছে। 
কৃষিবান্ধব সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন উদ্যোক্তারা উৎসাহী হচ্ছেন এবং বর্তমানে কাঁঠালের তৈরিকৃত খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়াও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘এক দেশ এক অগ্রাধিকার পণ্য’ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য কাঁঠালকে নির্বাচন করা হয়েছে এবং উক্ত সংস্থা জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও কাঁঠালের প্রযুক্তিগুলো প্রসারের ব্যবস্থা নেয়ার কর্মকা- পরিচালনা করছে। এতে কাঁঠালকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। অধিকন্তু উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, অর্থসহায়তা, যন্ত্রপাতি ও মোড়কজাত দ্রব্য সরবরাহ, কাঁচামাল সহজলভ্য করা, বিপণনের ব্যবস্থা ও রেজিস্ট্রেশন সহজলভ্য করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষকের বাজার সৃষ্টি করার মাধ্যমে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের বিপণনের ব্যবস্থা করা হলে এ প্রক্রিয়াটি আরও গতিশীল হবে। ফলশ্রুতিতে কাঁচা কাঁঠাল পুষ্টির নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
 
লেখক : ১ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞানী ও খাদ্য প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষক, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ই-মেইল:ferdous613@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১২২৭১১৬৩; ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ই-মেইল: cso.pht@bari.gov.bd, ফোন: ০২-৪৯২৭০১৭৬, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১।

 

বিস্তারিত
গ্রীষ্মকালীন-শিম-উৎপাদন-প্রযুক্তি

গ্রীষ্মকালীন শিম উৎপাদন প্রযুক্তি
অধ্যাপক  ড. মো: শহীদুল ইসলাম
শিম বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সবজি ফসল, যা প্রধানত শীতকালে চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতে শীতকালে অন্তত একটি হলেও শিমের মাচা দেখতে পাওয়া যায়। সিলেট, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, ঈশ্বরদী, পাবনাসহ প্রায় সকল জেলাতে শিম বাণিজ্যিকভাবে চাষ হতে দেখা যায়। শিম একটি আমিষসমৃদ্ধ শীতকালীন সবজি যার ফুল ও ফল ধারণ খাটো দিবসের  উপর নির্ভর করে। ফসলটি আলো সংবেদনশীল  হওয়ায় এর প্রাপ্যতা প্রধানত শীতকালে সীমাবদ্ধ। এ ফসলের অধিকাংশ জাতের বীজ যখনই বপন করা হোক না কেন, এদের ফুল ছোট দিবস না আসা পর্যন্ত অর্থাৎ অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ এর আগে ফুল বা ফল ধরে না। তবে কিছু কিছু আগাম জাত রয়েছে সেগুলোও সাধারণত আগস্ট মাসের আগে বাজারজাত করা সম্ভব হয় না। এ জাতগুলোর ফুল ও ফল ঝরে পড়ার প্রবণতাও অনেক বেশি। যেহেতু শিম একটি আমিষ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি তাই গ্রীষ্মকালীন সময়ে এ ফসলটি চাষ করতে পারলে আপামর জনগোষ্ঠীর পুষ্টির উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব।
শিমের পুষ্টিমান
শিম খেতে সুস্বাদু ও একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি। ১০০ গ্রাম ভক্ষণোপযোগী কচি শিমে ৮৫ গ্রাম জলীয় অংশ, আমিষ ৩.৮ গ্রাম, শ্বেতসার ৮.০ গ্রাম, আঁশ ১.৮ গ্রাম, ¯েœহ ০.৭ গ্রাম,  ক্যারোটিন ৪৮ আইইউ, থায়ামিন ০.১ মি.গ্রা., রাইবোফ্লাবিন ০.০৬ মি.গ্রা., নায়াসিন ০.৭ মি.গ্রা., ভিটামিন সি ৯.০ মি.গ্রা.,  ক্যালসিয়াম ২১০ মি.গ্রা. এবং লৌহ ১.৭ মি.গ্রা.। পুষ্টিমানের হিসেবে জাত, উৎপাদন মৌসুম, মাটির গুণাগুণ, এলাকাভেদে কিছুটা পার্থক্য হতে পারে।
গ্রীষ্মকালীন শিমের জাত
বাংলাদেশে শিমের বেশ কয়েকটি জাত গ্রীষ্মকালে চাষ হয়ে থাকে। জনপ্রিয় জাতগুলো হলো- সিকৃবি শিম-১ (সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিম-১), সিকৃবি শিম-২, বারি  শিম-৭, ইপসা শিম-২ ইত্যাদি। শিম একটি শীতকালীন সবজি তাই গ্রীষ্মকালীন বা ফটো-ইনসেনসিটিভ (আলো অসংবেদনশীল) শিমের জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ২০০৫ সালে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা হয়। এজাত উদ্ভাবনে সংকরায়নের পর সেগ্রিগেটিং বংশধর থেকে একক গাছ নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রথমত বেশ কিছু জাতের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে ভ্যারিয়াবিলিটি  (বৈচিত্র্যতা) তৈরি করে ভ্যারিয়েশন থেকে ৬ বছর একক গাছ যাচাই-বাছাই এর মাধ্যমে ৬-৭ টি অগ্রবর্তী লাইন নির্বাচন করা হয়, যা গ্রীষ্ম বা বর্ষাকালে ফুল ও ফল ধারণে সক্ষম। অতপর ২০১১ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিটিউট থেকে বারি শিম-৭ নামে একটি জাত উৎপাদনের জন্য মুক্তায়ন করা হয়। পরবর্তীতে অধিকতর গবেষণা কর্ম সম্পাদন শেষে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে সিকৃবি শিম-১ ও সিকৃবি শিম-২ নামে দুটি জাত কৃষক পর্যায়ে উৎপাদনের জন্য নিবন্ধিত হয়। সিকৃবি শিম-১ ও সিকৃবি শিম-২ জাত দুটি মার্চ-এপ্রিল মাসে বা শীতের পরপর বপন করলে ৮০-৮৫ দিন পর অর্থাৎ জুন-জুলাই মাস থেকেই কচি ফল আহরণ শুরু হয়। কম বৃষ্টিবহুল অঞ্চল ও উপকূলবর্তী অঞ্চলসহ দেশের সব এলাকায় চাষ করা যায়। জাতগুলোর ভালো ফলাফল পাওয়ার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। জাত দুটির বৈশিষ্ট্যাবলী নি¤েœর সারণি দ্রষ্টব্য।
সিকৃবি শিম-১

গ্রীষ্মকালীন শিম চাষের উৎপাদন প্রযুক্তি
মাটি ও জলবায়ু : বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি গ্রীষ্মকালীন শিম চাষের জন্য খুব উপযোগী। ফসলটি দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। এঁটেল মাটিতে চাষ করলে পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা থাকতে হবে।
জমি তৈরি : মূল জমি ৪-৫ বার চাষ দিয়ে তৈরি করতে হয়। এরপর নির্দিষ্ট মাপের উঁচু বেড তৈরি করে তাতে নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত বা পিট তৈরি করে বীজ বপন বা চারা রোপণ করতে হয়।
একক বা দ্বৈত সারি পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালে শিম চাষ করা যায়। সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধার জন্য প্রতিটি বেড ১৫-২০ সেমি. উঁচু ও ১.০ বা ২.০ মি. প্রশস্ত করতে হয়। বেড কাজের সুবিধা অনুযায়ী লম্বা করে নেওয়া যায়।
একক সারি পদ্ধতিতে ১.০ মিটার প্রস্থের ১৫ সেমি. উঁচু বেড তৈরি ও বেডের উভয় পাশে ৫০ সেমি. ড্রেন রাখতে হবে যাতে সহজেই বৃষ্টির পানি বের হয়ে যেতে পারে। প্রতিটি বেডের মধ্যে ১.৫ মিটার দূরে দূরে ৪০দ্ধ৪০দ্ধ৪০ সেমি. সাইজের পিট বা গর্ত তৈরি করে গর্তে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করে বীজ বা চারা রোপণের উপযোগী করতে হয়। এ পদ্ধতিতে গাছের পরিচর্যা ও ফসল উত্তোলন সহজ হয়।
সার প্রয়োগ : শিম লিগুমিনেসী (ডাল) পরিবারের সবজি বলে এটি বাতাস থেকে মাটিতে নাইট্রোজেন সংযোজন করতে পারে বিধায় নাইট্রোজেন জাতীয় সারের পরিমাণ কম লাগে। নিচে প্রতি শতাংশ জমিতে সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি সারণি দ্রষ্টব্য। মাটির উর্বরতাভেদে সারের মাত্রা কম বেশি হতে পারে।
সিলেট অঞ্চলের মাটি অম্ল প্রকৃতির হওয়ায় প্রতি শতক জমির জন্য ৪.০ কেজি ডলোচুন বীজ বপন বা চারা রোপণের ২০-২৫ দিন আগে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে সেচ প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
বীজ বপন : গ্রীষ্ম বা বর্ষাকালে শিম চাষের জন্য মার্চ বা এপ্রিল মাসে প্রস্তুতকৃত জমিতে সরাসরি বীজ বপন করা যায়। এক্ষেত্রে প্রতিটি গর্তে ৩টি করে বীজ দিতে হয়। তবে পলিব্যাগে চারা তৈরি করা উত্তম। প্রতি শতাংশ জমিতে ৩০-৩৫ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ বপনের দূরত্ব লাইন থেকে লাইন ১.৫ -২.০ মিটার ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১.৫ মিটার হলে ভালো হয়। পলিব্যাগের ১০-১২ দিন বয়সের চারা রোপণ করা উত্তম। এসময় মাটিতে রস না থাকলে পানি দিতে হয়।
খুঁটি/মাচা দেওয়া : শিম একটি লতানো জাতীয় উদ্ভিদ এবং বেয়ে উপরে উঠার জন্য সাপোর্ট বা ঠেকনা প্রদান করতে হয়। শিম চাষে মাচা তৈরিতে বাঁশ, সুতলী, রশি, তার ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মাচার পরিবর্তে গাছের গোড়ায় শাখা প্রশাখাযুক্ত বাঁশের আগা পুঁতে শিম চাষ বেশ কার্যকর। এক্ষেত্রে লম্বা বেডের দুইপ্রান্তে মোটা বাঁশ পুঁতে তার দিয়ে বেঁধে দিতে হয়। গাছের গোড়ায় পুঁতে দেওয়া বাশের আগা  তারের সাথে আটকিয়ে দিতে হয়। এতে শিমের পরিচর্যা ও শিম আহরণ বেশ সুবিধাজনক।       
পরিচর্যা : চারা গজানোর ৮-১০ দিনের মধ্যে প্রতি গর্তে দু’টি করে চারা রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হয়। গাছের গোড়াসহ বেডের মাটি কোদাল দিয়ে উল্টিয়ে দিতে হবে। এসময় আগাছা তুলে ফেলতে হয়। বেশি বৃষ্টি হলে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে হয়। মাটিতে রস না থাকলে ১০-১২ দিন পর পর জমিতে সেচ প্রদান করতে হয়। গাছের বৃদ্ধি বেশি হলে পুরাতন পাতা ও ফুলবিহীন শাখা কেটে ফেলা উত্তম।
ফসল সংগ্রহ :  গ্রীষ্মকালীন জাতগুলো বছরের যে সময়ই বপন করা হোক না কেন বীজ বপনের ৪৮-৫০ দিনের মধ্যেই ফুল ফোটে এবং বীজ বপনের ৮০-৮৫ দিনের মধ্যে শিম উত্তোলন শুরু হয়। ৫-৭ দিন পর পর কচি শিম মাঠ থেকে তোলা হয়ে থাকে। 
রোগ ও পোকামাকড় : গ্রীষ্মকালে শিম চাষে যে সকল রোগ ও পোকামাকড় দেখ যায় তাদের লক্ষণ ও দমন ব্যবস্থাপনা নি¤েœ বর্ণনা করা হলো :
শিমের ভাইরাস রোগ
এ রোগে কচি ডগা ও পাতা হলুদ হতে থাকে। জাব পোকা দিয়ে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এ রোগ দমনে আক্রান্ত গাছ বা ডগা পাতা ইত্যাদি তুলে পুতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। শিমের ভাইরাস রোগ দমনে এ পদ্ধতিটি খুব কার্যকরী। বাহক পোকা দমনে গাছের বয়স ২০ দিন হলে ৭-১০ দিন পরপর দু-তিন বার কীটনাশক যেমন- অ্যাডমায়ার, রিপকর্ড ইত্যাদি স্প্রে করে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকনো যায়। তবে ফুল ও ফল ধারণের পর কীটনাশক প্রয়োগ না করাই উত্তম।
কা-ের গোড়া পচা রোগ
গাছের গোড়ায় আর্দ্রতা বা পানি জমলে ছত্রাকের আক্রমণে গোড়া পচা রোগ দেখা দিতে পারে। ছত্রাকনাশক যেমন অটিস্টিন বা ইন্ডোফিল প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম পরিমাণ মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
জাবপোকা
জাবপোকা গাছের নতুন ডগা, পাতা, ফুল, ইত্যাদিও রস চুষে খায়। গাছের বৃদ্ধি ও ফলনে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। এ পোকা মোজাইক জাতীয় ভাইরাস রোগ ছড়াতে সহায়তা করে। মেঘলা, কুয়াশাচ্ছন্ন এবং ঠা-া আবহাওয়ায় জাবপোকার বংশবৃদ্ধি পায়। 
এ পোকা দমনে প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত লতা, পাতা, ডগা বা ফল সংগ্রহ করে পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে যা অত্যন্ত কার্যকরী পদ্ধতি। এক কেজি আধাভাঙ্গা নিমবীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে সেই দ্রবণ বা সাবান গোলা পানি (১০ লিটার পানিতে ২ চা চামুচ গুঁড়া সাবান) স্প্রে করে এ পোকার আক্রমণ কমানো যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে স্বল্পমেয়াদি বিষক্রিয়া সম্পন্ন কীটনাশক যেমন- ম্যালাডান (২ মিলি/লিটার পানি) বা পিরিমর ৫০ ডিপি (১ গ্রাম/ লিটার পানি) ৭-১০ দিন পরপর দুইবার স্প্রে করতে হবে। তবে ফলন্ত গাছে স্প্রে না করায় উত্তম।
শিমের ফল ছিদ্রকারী পোকা
এ পোকার কীড়া ফুল ও কচি ফল ছিদ্র করে ভিতরের শাঁস নষ্ট করে ফেলে। ফুল কচি ফল ঝরে পড়তে দেখা যায়। পোকাটি দমনের জন্য একদিন পর পর আক্রান্ত ফুল ও ফল সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। শিমের ক্ষেত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে অন্তঃবাহী কীটনাশক শিম সংগ্রহের পর স্প্রে করতে হবে এবং বিষ প্রয়োগের দুই সপ্তাহের মধ্যে খাওয়ার জন্য কোন শিম সংগ্রহ করা যাবে না।
ফলন : গ্রীষ্মকালে শিম চাষ করলে প্রতি শতকে ৪৫-৫৫ কেজি (১২-১৪ টন/হেক্টর) কচি শিম সংগ্রহ করা যায় যা শীতকালের চেয়ে কিছুটা কম হলেও উচ্চমূল্যের কারণে সে ক্ষতি পূরণ হয়।
বীজ উৎপাদন : গ্রীষ্মকালীন শিম জাতের বীজ উৎপাদন একটি গুরুত্ব বিষয়। গ্রীষ্মকালে চাষকৃত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ সমীচীন নয়। এত করে জাত ডিজেনারেশনের মাধ্যমে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গ্রীষ্মের অধিক তাপ ও আর্দ্রতা বীজের গুণাগুণ নষ্ট করে। তাই শীতকাল বীজ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত সময়। এজন্য অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মাঠে বীজ বপন করতে হয়। শিম শুকে গেলে গাছ থেকে কয়েক বারে সংগ্রহ করে বীজ বের করে রোদে ভালো করে শুকাতে হবে। এরপর কোন পাত্র বা ব্যাগে সেভিন পাউডার, শুকনো বীষকাটালি পাতা বা নিমপাতা সহযোগে রাখা যেতে পারে। বীজ প্যাকেটবদ্ধ করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়।

লেখক : উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট,ই-মেইলshahidul.hrt@sau.ac.bd; মোবাইল: ০১৯১৬৬৬২৪২১।

বিস্তারিত
আউশ ধানের আবাদ ও ফলন বৃদ্ধিতে করণীয়

আউশ ধানের আবাদ ও ফলন বৃদ্ধিতে করণীয়
কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন
আউশ আবাদ স্থানীয় জাতনির্ভর ছিল। স্থানীয় জাতের গড় ফলন ছিল হেক্টরপ্রতি ২.০০ টন থেকে ২.৩৫ টন পর্যন্ত। ব্যতিক্রম ছিল কেবল কটকতারা, যার এর হেক্টরপ্রতি ফলন ছিল ৩.৩৫ টন। তবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট (ব্রি) এখন পর্যন্ত ২৭টি বোনা এবং রোপা আউশ মওসুম উপযোগী জাত উদ্ভাবন করেছে। দুই রকমের আউশ হয়। যথা- বোনা ও রোপা আউশ। বোনা আউশে সাধারণত মাঠের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের ২৫ তারিখের মধ্যে (১০ই চৈত্র হতে ১০ই বৈশাখ) বীজ বপন করতে হয় এবং রোপা আউশের বীজ বপন সময় ১৫ চৈত্র হতে ৫ বৈশাখ (৩০ মার্চ-১৫ এপ্রিল) এবং চারা রোপণের সময় ৫-৩০ বৈশাখ (১৫ এপ্রিল-১০ মে)। তবে বোনা আউশে আগাছার উৎপাত রোপা ধানের তুলনায় অনেক বেশি। এ জন্য মৌসুম শুরুর আগেই শুকনো জমিতে ২-৩টি চাষের পর মই না দিয়ে জমি খোলা অবস্থায় রেখে দিতে হবে। এতে মাটি ভালোভাবে শুকিয়ে যাবে ফলে অনেক আগাছা এবং পোকামাকড় ও রোগজীবাণু মরে যায়। তাছাড়া এ অবস্থায় বৃষ্টি হলে জমিতে আগাছার বীজ সহজেই গজাতে পারে। জমির আগাছা গজানো সম্পন্ন হলে আবারও চাষ ও মই দিয়ে (জো থাকা অবস্থায়) মাটিকে ঝুরঝুরে তৈরি করতে হবে। এবার দেরি না করে বীজ বুনে ফেলতে হবে।
জাত নির্বাচন
আউশ মওসুমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বোনা আউশ জাত- বিআর২০, বিআর২১, বিআর২৪, ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৪৩ ও ব্রি ধান৮৩ এবং রোপা হিসেবে বিআর২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৮২ ব্রি ধান৮৫, ব্রি ধান৯৮, ব্রি ধান১০৬ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৭সহ ১৪টি জাত এখন মাঠপর্যায়ে চাষ হচ্ছে যার প্রত্যেকটি জাতের ফলন কটকতারার চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়াও বোরো মওসুমের অনেকগুলো জাত আউশ মওসুমে ভালোভাবে চাষ করা যায়। এগুলোর ফলন ৩.৫-৫টন/হে.। নতুন জাতগুলোর মধ্যে ব্রি ধান৯৮ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৭ গত আউশ মওসুমে       কৃষকপর্যায়ে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। এর মধ্যে ব্রি ধান৯৮ এর ফলন প্রতি বিঘায় ২২ মণ। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এটি প্রতি বিঘায় ২৫ মণ পর্যন্ত ফলন দিতে পারে। এর দানা লম্বা ও চিকন, রং সোনালি। এ জাতের জীবনকাল ১১২ দিন, এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ২২.৬ গ্রাম। ধানের দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৭.৯ ভাগ এবং প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৯.৫ ভাগ। ভাত ঝরঝরে ও সু-স্বাদু। 
এ ছাড়া আউশে এখন পর্যন্ত একমাত্র হাইব্রিড জাত ব্রি হাইব্রিড ধান৭। এই ধানের জীবনকাল ১১৫ দিন, গড় ফলনপ্রতি বিঘায় ২৩ মণ। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এটি প্রতি বিঘায় এই জাত ২৭ মণ পর্যন্ত ফলন দিতে পারে। এর দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ প্রচলিত অন্যান্য হাইব্রিড ধানের তুলনায় বেশি তাই ভাত ঝরঝরে ও খেতেও বেশ সু-স্বাদু হয়।
বীজ বপন
বোনা আউশের বীজ তিনভাবে বপন করা যায়-
ছিটিয়ে- এতে শতকরা ৮০ ভাগ অঙ্কুরোদগম সম্পন্ন ভাল বীজ হেক্টরপ্রতি ৭০-৮০ কেজি হারে বুনে দিতে হবে, এরপর হাল্কাভাবে একটা চাষ ও মই দ্বারা মাটি সমান করতে হবে।
সারি করে- এতে ২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে ৪-৫ সেমি. গভীর করে সারি তৈরি করতে হবে এবং হেক্টরপ্রতি ৪৫-৫০ কেজি হারে বীজ বপন করতে হবে। এবার মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে।
ডিবলিং পদ্ধতিতে- এতে বাঁশ বা কাঠের দ- দিয়ে ২০ সেন্টিমিটার পর পর মাটিতে গর্ত করে গর্ত প্রতি ২/৩টি করে বীজ বপন করে মই দিয়ে মাটি সমান করে দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে বপনের জন্য বীজের হার হলো হেক্টরপ্রতি ২৫-৩০ কেজি।
তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোন বীজ মাটির উপরে না থাকে। আবার বেশি গভীর ধান বপন করা হলে অনেক ধান ঠিকমতো গজাতে পারে না। জমিতে রস না থাকলে বীজ বপন না করাই ভালো। এতে কিছু সংখ্যক বীজ গজানোর পর মাটিতে রসের অভাবে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। চারা গজানোর এক সপ্তাহ পর আচড়া দিয়ে জমির মাটি আলগা করে দিতে হবে। এতে চারার ঘনত্ব ঠিক থাকে, গাছের বাড়-বাড়তিও ভালো হয় এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
সার ব্যবস্থাপনা
মাটির উর্বরতার মান যাচাই এবং ফলন মাত্রার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা প্রয়োজন। বোনা/রোপা আউশে ইউরিয়া- টিএসপি-এমওপি-জিপসাম-দস্তা (মনোহাইড্রেট) হেক্টরপ্রতি  ১৩৫-৫৫-৭৫-৩৫-৫ হারে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষের সময় বোনা আউশের সব সারই প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টিবহুল বোনা আউশে ইউরিয়া সমান দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করলে গাছের বাড় বাড়তি ভালো হয় ও ফলন বৃদ্ধি পায়। ১ম কিস্তি শেষ চাষের সময় ও ২য় কিস্তি ধান বপনের ৩০-৪০ দিন পর। রোপা আউশে ইউরিয়া ১ কিস্তি (১/৩) শেষ চাষের সময়, ২য় কিস্তি (১/৩) ৪-৫ টি কুশি দেখা দিলে (সাধারণত রোপণের ১৫-১৮ দিন পর) এবং ৩য় কিস্তি (১/৩) ইউরিয়া কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে গন্ধক এবং দস্তার অভাব থাকলে শুধুমাত্র  জিপসাম এবং দস্তা (মনোহাইড্রেট) প্রয়োগ করতে হবে।
সম্পূরক সেচ : আউশ চাষাবাদ পুরোটাই বৃষ্টিনির্ভর। তবে প্রতি বছর সকল স্থানে বৃষ্টিপাতের ধরন এক রকম হয় না। এমন কি একই বছরে একই স্থানে সবসময় সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। বিশেষত বোনা আউশে একটি বৃষ্টিপাতের পর জমিতে জো আসলে বীজ ছিটানো হয়। যদি সময়মতো বৃষ্টিপাত না হয় তাহলে যেকোন পর্যায়ে সাময়িকভাবে বৃষ্টির অভাব দেখা দিলে অবশ্যই সম্পূরক সেচ দিতে হবে। একইভাবে রোপা আউশের সময়ও যদি প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হয় তবে বৃষ্টির আশায় না থেকে প্রয়োজনে একাধিক সম্পূরক সেচ দেয়া যেতে পারে। এজন্য আউশ মওসুমে নিশ্চিত ভালো ফলনের জন্য ধান জমিতে প্রতিষ্ঠিত করতে সম্পূরক সেচের প্রয়োজন পড়ে।
আগাছা ব্যবস্থাপনা
উচ্চতাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে বোনা আউশ ধানে আগাছার খুবই উপদ্রব হয়। সময়মতো আগাছা দমন না করলে শতকরা ৮০-১০০ ভাগ ফলন কমে যায়। বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর প্রথমবার এবং ৩৫-৪০দিন পর দ্বিতীয়বার আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। সারি করে বপন বা রোপণ না করলে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা যায় না। আগাছানাশক ব্যবহারের মাধ্যমে আগাছা দমন করা সহজ ও সাশ্রয়ী। এক্ষেত্রে বোনা আউশের জন্য প্রি-ইমারজেন্স আগাছানাশক হিসেবে পেনডামিথাইলিন, অক্সাডায়ারজিল এবং অক্সাডায়াজন গ্রুপের যে কোন আগাছানাশক বপনের ২/৩ দিনের মধ্যে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে জমি ভেজা থাকলেও কোন দাঁড়ানো পানি রাখা যাবে না। রোপা আউশ ধানের ক্ষেত্রে প্রি-ইমারজেন্স আগাছানাশক হিসেবে বেনসালফিউরান মিথাইল+ এসিটাফ্লোর, মেফেনেসেট+বেনসালফিউরান মিথাইল, সালফেনট্রাজোন ইত্যাদি গ্রুপের আগাছা নাশক রোপণের ৩ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
নিবিড় চাষাবাদের কারণে আউশে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ক্ষতিকর পোকা দমন এবং ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। আউশে মুখ্য পোকাগুলো হলো- মাজরা পোকা, নলি মাছি, পাতা মাছি, পামরী পোকা ইত্যাদি পোকার ক্ষতির মাত্রা পোকার প্রজাতি, পোকার সংখ্যা, এলাকার সামগ্রিক পরিবেশ, জমি বা তার আশেপাশের অবস্থা, ধানের জাত, ধান গাছের বয়স, উপকারী পরভোজী ও পরজীবী পোকামাকড়ের সংখ্যা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। ধানক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা দেখা গেলে এর সাথে বন্ধু পোকা, যেমন- মাকড়সা, লেডি-বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল সহ অনেক পরজীবী ও পরভোজী পোকামাকড় কি পরিমাণে আছে তা দেখতে হবে এবং শুধু প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। 
ফসল কাটা, মাড়াই 
শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শীষ ভেঙে যায়, শীষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে ফসল পাকা পরীক্ষা করতে হবে। শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ এবং শীষের নিচের অংশে শতকরা ২০ ভাগ ধানের চাল আংশিক শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। এ সময়ে ফসল কেটে মাঠেই বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে। তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াইযন্ত্র ব্যবহার করা যায়।
ধানের বীজ সংরক্ষণ
ভালো ফলন পেতে হলে ভালো বীজের প্রয়োজন। এ কথা মনে রেখেই কৃষকভাইদের ঠিক করতে হবে কোন জমির ধান বীজ হিসেবে রাখবেন। যে জমির ধান ভালোভাব পেকেছে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সে জমির ধান বীজ হিসেবে রাখতে হবে। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে গাছের আকার-আকৃতি ও রঙ, ফুল ফোটার সময় ও শীষের ধরন, ধানের আকার আকৃতি, রঙ ও শুঙ এবং সর্বশেষ ধান পাকার সময় আগে-পিছে হলেই তা বিজাতীয় গাছ। সকল রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ করতে হবে। এরপর বীজ হিসেবে ফসল কেটে এবং আলাদা মাড়াই, ঝাড়াই ও ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে মজুদ করুন। বীজ ধান সংরক্ষণে যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত সেগুলো হলো-
মাড়াইয়ের পর থেকে ৫-৬ রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে যেন বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। দাঁত দিয়ে বীজ কাটলে যদি কটকট শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে বীজ ঠিকমতো শুকিয়েছে; পুষ্ট ধান বাছাই করতে কুলা দিয়ে কমপক্ষে দুবার ঝেড়ে নেয়া যেতে পারে; বায়ুরোধী পাত্রে বীজ রাখা উচিত। বীজ রাখার জন্য ড্রাম ও বিস্কুট বা কেরোসিনের টিন ব্যবহার করা ভালো। পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিতে হবে; ধাতব অথবা প্লাস্টিক ড্রাম ব্যবহার করা সম্ভব না হলে, মাটির মটকা, কলস বা মোটা পলিথিনের থলি ব্যবহার করা যেতে পারে। মাটির পাত্র হলে পাত্রের বাইরের গায়ে দুবার আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে; রোদে শুকানো বীজ ঠা-া করে পাত্রে ভরতে হবে। পাত্রটি সম্পূর্ণ বীজ দিয়ে ভরে রাখতে হবে। যদি বীজের পরিমাণ কম হয় তবে বীজের উপর কাগজ বিছিয়ে তার উপর শুকনো বালু দিয়ে পাত্র পরিপূর্ণ করতে হবে; পাত্রের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যেন বাতাস ঢুকতে না পারে। বীজ পাত্র মাচায় রাখা ভালো, যাতে পাত্রের তলা মাটির সংস্পর্শে না আসে; গোলায় ধান রাখলে ১ মণ ধানের জন্য আনুমানিক ১২০ গ্রাম নিম বা নিশিন্দা অথবা বিষকাটালীর পাতা গুঁড়া করে মিশিয়ে দিয়ে সংরক্ষণ করলে পোকার আক্রমণ প্রতিহত হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট থেকে জানা যায়, দেশে মোট আবাদযোগ্য জমি ৮৮.২৯ লক্ষ হেক্টর, মোট সেচকৃত জমি ৭৮.৭৯ লক্ষ হেক্টর, আবাদযোগ্য পতিত জমি আছে প্রায় ৪.৩১ লক্ষ হেক্টর। সেচনির্ভর জমি বোরো উৎপাদনে ছেড়ে দিলেও দেশজুড়ে থাকা আবাদযোগ্য পতিত জমিতে আউশ আবাদ সম্প্রসারণ করা গেলে গড় ফলন ৩.০টন/হে. ধরলেও বর্তমানের চেয়ে প্রায় ১৩ লক্ষ টন অতরিক্তি ফলন জাতীয় উৎপাদনে যোগ করা সম্ভব হবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণ বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ইমেইল smmomin80@gmail.com, ফোন-০১৭১৬৫৪০৩৮০।

বিস্তারিত
আমের-জাতসমূহের-পরিপক্বতা-ও-সংগ্রহের-সময়সূচি

আমের জাতসমূহের পরিপক্বতা 
ও সংগ্রহের সময়সূচি
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন১ ড. মোঃ উবায়দুল্লাহ কায়ছার২
গুণগত মানসম্পন্ন উৎপাদিত ফল হতে প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে উপযুক্ত পরিপক্বতা ও সংগ্রহের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন আমের জাত হতে প্রকৃত স্বাদ ও পুষ্টি পেতে হলে সঠিক পরিপক্বতায় আম সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে। আম একটি ক্লাইমেকটেরিক ফল। সুতরাং সংগ্রহের পর ঘরে রেখে পাকালে স্বাদ ও মিষ্টতা বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৪-২৫টি জাত বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয়। এর মধ্যে ৮-৯টি জাত রপ্তানি হচ্ছে। প্রত্যেকটি জাতের রয়েছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আকার, রঙ, স্বাদ ও ঘ্রাণ। এদেশে জন্মানো জাতগুলো আগাম, মধ্যম ও নাবী প্রকৃতির। তবে সম্প্রতি বারোমাসি যেমন বারি আম-১১ এবং কাটিমন আমের চাষ বাণিজ্যিভাবে শুরু হয়েছে। আমের স্বাদ মূলত নির্ভর করে আমের পরিপক্বতা ও সংগ্রহের উপর। ফলে প্রত্যেক জাতের আসল স্বাদ পেতে হলে উপযুক্ত সময়ে সংগ্রহ করা জরুরি। 
বাংলাদেশে ২১ ডিগ্রি হতে ২৬ ডিগ্রি অক্ষাংশে আমের চাষ হয় এবং প্রতি ডিগ্রি অক্ষাংশ বৃদ্ধির জন্য আমের সংগ্রহ গড়ে ২.৫ দিন পিছিয়ে যায় বা দেরীতে পাকে। আমের ফল ধারণের পর আবহাওয়াগত বিষয়টিও আমের পরিপক্বতাকে প্রভাবিত করে। দেশিয় আমের জাতগুলো পরিপক্ব হলে রঙের তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না। তবে যে কোন জাতের ব্যাগিংকৃত আম হলুদ রঙের হয়ে থাকে। সুতরাং শুধুমাত্র রঙ দেখে পরিপক্বতা নির্ধারণ করা সঠিক নয়। আমের ফল ধারণ হতে পরিপক্ব হতে একটি নির্দিষ্ট সময় লাগে এবং সেটি অনুসরণ করে পরিপক্বতা নির্ধারণ করলে তাকে অধ্বংসাত্মক (হড়হ-ফবংঃৎঁপঃরাব) পদ্ধতি বলে। তবে আম কেটে পরিপক্বতা নির্ধারণকে(destructive) পদ্ধতি বলে। আমের সঠিক পরিপক্বতা নির্ধারণে সকল বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নি¤েœ বিভিন্ন জাতের পরিপক্বতা ও সংগ্রহ সময়সূচি সারণি দ্রষ্টব্য।
এখানে উল্লেখ্য যে, উল্লিখিত জাতসমূহে ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে সংরক্ষণকাল সাধারণ আমের চেয়ে ৩-৪ দিন বৃদ্ধি পায়। তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেলে বা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি হলে আমের সংগ্রহ ২-৪ দিন এগিয়ে আসতে পারে।
ফল বিজ্ঞানীবৃন্দের আশাবাদ, ক্রেতা সাধারণের প্রত্যেক জাতের পরিপক্বতা ও সংগ্রহ বিষয়ে আগাম ধারণা থাকলে বাজার হতে আম কিনে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা কমবে এবং খাওয়ার সময় প্রত্যেক জাতের প্রকৃত স্বাদ পাবেন। এ তথ্যগুলো আম রপ্তানি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ রপ্তানি পরিকল্পনা তৈরি করতে কাজে লাগাতে পারবেন।  

লেখক : ১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২১৫৭৯৮৯, ই-মেইল:sorofu@yahoo.com

বিস্তারিত
মুগ ও মাসকলাইয়ের পোকামাকড় পরিচিতি ও দমন ব্যবস্থাপনা
মুগ ও মাসকলাইয়ের পোকামাকড় 
পরিচিতি ও দমন ব্যবস্থাপনা
ড. মোঃ আলতাফ হোসেন
ডাল ফসল সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদপুষ্ট ফসল। মাটি, গবাদি ও মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তায় এবং স্বাস্থ্যসুরক্ষায় ডালের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ সাধারণত গ্রীষ্মকালে মুগ ও মাসকলাইয়ের চাষ হয়ে থাকে। এ ফসলগুলো প্রায় ১২ প্রজাতির পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। সুতরাং টেকসই উৎপাদন স্থিতিশীলতায় পোকামাকড়ের আক্রমণ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। এজন্য কাক্সিক্ষত উৎপাদন নিশ্চিতকরণে আক্রমণকারী বিভিন্ন পোকামাকড় পরিচিতি, তাদের ক্ষতির ধরন ও প্রকৃতি, ব্যাপকতা এবং দমন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক। আর সেই ধারণা দিতেই আক্রমণকারী বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের পরিচিতি ও ব্যবস্থাপনা কৌশল নি¤েœ উল্লেখ করা হলো। 
ফ্লি-বিটল 
দু’টি প্রজাতির ফ্লি-বিটল যথা ক্রুসিফার ফ্লি-বিটল এবং স্ট্রাইপ ফ্লি-বিটল ডাল ফসলের ক্ষতি করে থাকে। এদের কীড়া গাছের শিকড় খেয়ে এবং পূর্ণবয়স্ক পোকা পাতা খেয়ে ক্ষতি করে। কীড়া মাটিতে বসবাস করে এবং পোষক গাছের শিকড় খেয়ে ক্ষতি করে থাকে। পূর্ণবয়স্ক পোকা অঙ্কুরোদগমকৃত কচি চারার বীজপত্র এবং কচি পাতা অসম গোলাকার ছিদ্র করে খায়। এমনকি এরা কচি চারার বর্ধিষ্ণু ডগাটিও নষ্ট করে থাকে, এতে চারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে না। বয়স্ক পাতায় আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে পাতা শুকিয়ে গিয়ে গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এবং ফলন কমে যায়। 
দমন ব্যবস্থাপনা 
 ফসলের জমিকে অবশ্যই আগাছামুক্ত রাখতে হবে। এতে পোকার আশ্রয়ের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি হয়ে পোকার সংখ্যা কমে যাবে। 
য় আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে ডাইমেথয়েট যেমন- টাফগর ৪০ ইসি অথবা কার্বোসালফান যেমন- মার্শাল ২০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করে পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
চারার থ্রিপস্ 
অপূর্ণ বয়স্ক থ্রিপস ছোট আকৃতির লম্বাটে পোকা, যারা দৈর্ঘ্য প্রায় ০.৫-১.২ মিলিমিটার। পূর্ণবয়স্ক থ্রিপস আকারে প্রায় ২ মিলিমিটার, গায়ের রং হালকা হলুদ থেকে গাঢ় বাদামি। চারা বের হওয়ার পরপরই চারার থ্রিপস পোকার আক্রমণের সূত্রপাত হয়। তবে লক্ষণ প্রকাশ পায় প্রথম বের হওয়া ত্রিপত্রক পাতায়। গ্রীষ্মকালীন মুগে এদের আক্রমণের তীব্রতা অনেক বেশি হয়ে থাকে। আক্রান্ত পাতা কুঁকড়ে উপরের দিকে বাঁকিয়ে যায়।  প্রাথমিক অবস্থায় দমনব্যবস্থা না নিতে পাড়লে চারার বৃদ্ধি দারুণভাবে ব্যাহত হয় এবং ফলন মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে।
দমন ব্যবস্থাপনা
আঠাযুক্ত নীল, হলুদ অথবা সাদা ফাঁদ ব্যবহার করে থ্রিপসের আক্রমণের তীব্রতা কমানো যায়। 
আক্রমণের শুরুতে জৈব বালাইনাশক যেমন- বায়োম্যাক্স এম ১.২ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। 
মারাত্মক আক্রমণে অন্তর্বাহী গুণসম্পন্ন ডাইমেথয়েট জাতীয় কীটনাশক যেমন- টাফগর ৪০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ৩ বার। 
জাবপোকা 
 জাবপোকা নাসপাতিসদৃশ ছোট আকারের পোকা, লম্বায় ২.০-২.৫ মিলিমিটার। পূর্ণবয়স্ক জাবপোকা উজ্জ্বল কালো রংয়ের কিন্তু নিম্ফ (বাচ্চা) ফিকে নিলাভ ধূসর বর্ণের। এরা পাকাযুক্ত ও পাখাবিহীন উভয় ধরনের হতে পারে। জাবপোকা ফসলের চারা অবস্থা থেকে শুরু করে পরিপক্ব হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যেকোন সময় আক্রমণ করতে পারে। সাধারণত পুষ্পায়ন দশা থেকে বীজের বৃদ্ধি পর্যায় পর্যন্ত এদের আক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হয়। তবে চারা ও বাড়ন্ত গাছেও এদের আক্রমণ হতে পারে। এরা পাতা, ডগা, কা-, ফুল ও ফলকে আক্রমণ করে সেখান থেকে রস চুষে খায়। পাতা, ডগা ও কা-ে আক্রমণের ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং গাছ বিকৃত ও খর্বাকৃতির হয়। পুষ্পমঞ্জরি ও ফুলে আক্রমণ হলে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং ফলধারণ হয় না বা খুব কম হয়। পডে (ফল) আক্রমণ হলে পড বিকৃত হয়ে যায় এবং বীজের আকার খুব ছোট হয়ে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। জাবপোকা নিঃসৃত মধুরসে শুটিমোল্ড ছত্রাকের সংক্রমণ হয় এবং পাতার উপর কালো প্রলেপ পড়ে গাছের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং গাছ দুর্বল হয়ে ফলন কমে যায়। এ ছাড়াও জাবপোকা বিভিন্ন ভাইরাস রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে অসুস্থ গাছ থেকে সুস্থ গাছে ভাইরাস রোগ ছড়িয়ে ক্ষতি করে থাকে।
দমন ব্যবস্থাপনা
পরভোজী বন্ধুপোকা যেমন- লেডিবার্ড বিটল ও সিরফিড ফ্লাই ইত্যাদি জাবপোকাদের খেয়ে এদের দমনের সহায়তা করে বিধায়, প্রকৃতিতে বন্ধুপোকাদের সংরক্ষণে সজাগ থাকতে হবে। কেননা শস্যক্ষেতে এসব বন্ধুপোকাদের আধিক্য বেশি থাকলে এমনিতেই প্রাকৃতিকভাবে জাবপোকা নিয়ন্ত্রিত থাকে। 
জাবপোকার আক্রমণের শুরুতে নিমঘটিত কীটনাশক যেমন- বায়োনিম প্লাস ১ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করে আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। 
মারাত্মকভাবে জাবপোকা আক্রান্ত জমিতে ইমিডাক্লোরাপিড জাতীয় কীটনাশক যেমন- টিডো প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করে আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।  
বিছাপোকা 
পূর্ণবয়স্ক বিছাপোকা হলদে বাদামি বর্ণের মাঝারি আকারের (২.৫-৩.০ সেমি) মথ। এদের পাখায় কালো ফুটকি দাগ আছে। স্ত্রীমথ রাত্রে সক্রিয় থাকে এবং পাতার নিচে গাদা করে ৫০০-১০০০টি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়া বের হয়ে পাতায় একত্রে গাদাগাদি করে অবস্থান করে এবং পাতার সবুজ অংশ খেয়ে বড় হতে থাকে। আক্রান্ত পাতা জালের মতো হয়ে যায় এবং দূর থেকে দেখেই সেটা চেনা যায়। কীড়া ছোট অবস্থায় প্রথম ৩টি দশায় পাতায় গাদাগাদি করে থাকে কিন্তু বড় হলে অর্থাৎ চতুর্থ ও পঞ্চম দশায় সমস্ত ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে এবং পাতা খেয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে থাকে। এদের মারাত্মক আক্রমণে গাছ পাতা শূন্য হয়ে মারা যায়। বিছাপোকা সাধারণত বৃষ্টিবহুল মৌসুমে ডাল ফসলের জন্য একটি মারাত্মক ক্ষতিকারক পোকা।
দমন ব্যবস্থাপনা
ডিমগাদা এবং গাদাগাদি করে থাকা ছোট কীড়াসহ পাতা সংগ্রহ করে ধ্বংস করে অনায়াসেই এই পোকা দমন করা যায়।
জমিতে ডাল বা কঞ্চি পুঁতে পোকাভোজি পাখি বসার ব্যবস্থা করে পোকার সংখ্যা কমানো যায়।
মারাত্মকভাবে আক্রান্ত জমিতে সাইপারমেথ্রিন (যেমন- কট্ ১০ ইসি) অথবা ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন (যেমন- ক্যারাটে ২.৫ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে মাসে ৩ বার স্প্রে করে বিছাপোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
পাতা মোড়ানো পোকা 
পাতা মোড়ানো পূর্ণাঙ্গপোকা বাদামি বর্ণের বড় আকৃতির মথ। স্ত্রীমথ রাতের বেলা পাতায় ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বের হওয়া ছোট কীড়াগুলো বিবর্ণ সবুজ বর্ণের এবং কালো মাথা বিশিষ্ট হয়। পোকার কীড়া জালবুনে পাতা মুড়িয়ে ভেতরে বাস করে এবং ঐ পাতাটির সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। মোড়ানো পাতা এবং সেই পাতায় পোকার বিষ্ঠা দেখে এদের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়। এদের মারাত্মক আক্রমণে আক্রান্তপাতা শুকিয়ে যায় এবং বর্ধনশীল গাছের বৃদ্ধি দারুণভাবে ব্যাহত হয় এবং ফলন কমে যায়।
দমন ব্যবস্থাপনা
মোড়ানো পাতা হাতদিয়ে সংগ্রহ করে ভেতরের কীড়া ধ্বংস করে পোকার সংখ্যা কমানো যেতে পারে।
আক্রমণের শুরুতে ক্লোরোপাইরিফস ও সাইপারমেথ্রিন এর মিশ্রণ কীটনাশক যেমন- নাইট্রো ৫০৫ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করে পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সাদামাছি 
পূর্ণবয়স্ক সাদামাছি প্রায় ১ মিলিমিটার লম্বা, সাদা পাখা বিশিষ্ট নরমদেহী  এবং দেহ মোমসদৃশ্য সাদা পাউডারে আবৃত। পূর্ণবয়স্ক পোকা ও নিম্ফ উভয়েই পাতা থেকে রস চুষে খায়। এতে পাতার সজীবতা কমে যায় এবং গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। এদের নিঃসৃত মধুরসে পাতার উপর শুটিমোল্ড ছত্রাক জন্মে গাছের খাদ্য তৈরি বিঘিœত হয়। সাদামাছি সবচেয়ে ক্ষতি করে হলুদ মোজাইক রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। এরা ভাইরাসযুক্ত অসুস্থ গাছ থেকে রস খেয়ে যখন আবার সুস্থ গাছের রস খায় তখন এদের লালার মাধ্যমে সুস্থ গাছে ভাইরাস সংক্রমিত হয়। হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগের কারণে মুগ ও মাসকলাইয়ের ফলনে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। তবে সুখের কথা এই যে, বারি মুগ-৬ এবং বারি মাস-৩ ও বারি মাস-৪ জাতগুলোতে হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগের প্রতি সহনশীলতা রয়েছে। 
দমন ব্যবস্থাপনা
বিকল্প পোষক হিসেবে বিশেষ করে মুগ ও মাসকলাইয়ের জমিতে বা তার আশেপাশে থাকা বিভিন্ন আগাছা যেমন- বনমরিচ, শিয়ালমূত্রা ইত্যাদি যেন না থাকে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। 
আঠালো হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করে পোকার সংখ্যা কমানো যেতে পারে। 
আক্রমণের মাত্রা কম থাকলে বায়োম্যাক্স এম ১.২ ইসি (১ মিলি/লিটার), ডিটারজেন্ট মিশ্রিত পানি (২ গ্রাম/লিটার) অথবা নিমবীজ নির্যাস (৫০ গ্রাম/লিটার) স্প্রে করা যেতে পারে। 
আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে অ্যাসিটামিপ্রিড জাতীয় কীটনাশক যেমন- তুন্দ্রা ২০ এসপি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করে সাদামাছির আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ফুলের থ্রিপস্
ফুলের থ্রিপস ছোট চুরুট আকৃতির বাদামি থেকে কালচে রঙের সরু পাখাযুক্ত পোকা, লম্বায় ১.৫-২.০ মিলিমিটার। প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক উভয় থ্রিপসই ফুলের কুঁড়ি ও ফুল থেকে রস শোষণ করে খায় এমনকি এরা পরাগরেণুও খেয়ে ফেলে। ফলশ্রুতিতে মারাত্মক আক্রমণে কুঁড়ি ও ফুল শুকিয়ে ঝরে পড়ে এবং ফলধারণ দারুণভাবে কমে যেতে পারে। বর্ধনশীল পডও এদের আক্রমণে বিকৃত হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালীন ডাল ফসল যেমন- মুগ, মাসকলাই ও অড়হরের উৎপাদনশীলতায় ফুলের থ্রিপস পোকার আক্রমণ অন্যতম প্রধান সমস্যা। শুষ্ক ও গরম আবহাওয়ায় এদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটে। বাহ্যিকভাবে এদের আক্রমণ তেমনটা বোঝা যায় না। সাদা কাগজের উপর ফুটন্ত ফুল ছিড়ে এদের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায় এবং সেটা করতে গেলে এরা বিরক্ত হয়ে উড়ে পালায়।
দমন ব্যবস্থাপনা
আঠাযুক্ত নীল, সাদা ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করে পোকার সংখ্যা কমানো যেতে পারে। 
উদ্ভিদজাত কীটনাশক যেমন- নিমবীজ/নিমপাতা/তামাক পাতার নির্যাস ব্যবহার করা যেতে পারে।
আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে (গড়ে একটি ফুলে ৪টি বা বেশি পোকা থাকলে) ইমিডাক্লোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক যেমন- ইমিটাফ ২০ এসএল প্রতিলিটার পানিতে ০.৫ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে বারি মুগ-৬ এর ক্ষেত্রে শতকরা ১০০ ভাগ গাছে ফুল আসলে অর্থাৎ বপনের ৩৩-৩৫ দিন পর ১ টি স্প্রে এবং শতকরা ১০০ ভাগ গাছে ফল আসলে অর্থাৎ বপনের ৪০-৪২ দিন পর আর একটি স্প্রে দিয়ে ফুলের থ্রিপস্রে আক্রমণ কার্যকরী ও লাভজনকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ফুল ও ফল ছেদক পোকা 
তিনটি প্রজাতির ফুল ও ফল ছেদক পোকা যেমন- গধৎঁপধ ারঃৎধঃধ , ঊঁপযৎুংড়ঢ়ং পহবলঁং ধহফ ঐবষরপড়াবৎঢ়ধ ধৎসরমবৎধ মুগ ও মাসকলাই ফসলে আক্রমণ করে থাকে। স্ত্রীমথ রাতের বেলা পাতার নিচের পৃষ্ঠে, ফুলের কুঁড়িতে এবং মাঝেমধ্যে ছোট কচি ফলে এককভাবে অথবা ২-১০টি সাদা স্বচ্ছ ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে ৩-৪ দিন পর কীড়া বের হয় এবং ৫টি দশার মাধ্যমে কীড়াধাপ সম্পন্ন করে। পোকার কীড়া কচি ডগা, ফুলের কুঁড়ি, ফুল ও ফলে আক্রমণ করে থাকে। এরা ফুলের কুঁড়ি ও ফুটন্ত ফুলকে মুড়িয়ে খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। এছাড়া ফল ধরা শুরু করলে ফলের মধ্যে বর্ধনশীল বীজকে খেয়ে ফেলে। এদের মারাত্মক আক্রমণে ফুল ও ফল উভয়ই নষ্ট হয়ে যায় এবং ফলন দারুণভাবে ব্যাহত হয়। এরা পুষ্পায়ন ও ফলধারণ অবস্থায় সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতিকারক পোকা। 
দমন ব্যবস্থাপনা
গাছের সক্রিয় বৃদ্ধিপর্যায় থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পুরুষ মথকে ধরে স্ত্রী মথের সাথে মিলিত হতে না দিয়ে সহজেই ফলছেদক পোকার আক্রমণ কমানো যেতে পারে। 
হাত বাছাইয়ের মাধ্যমে কীড়ার সংখ্যা কমানো যেতে পারে। 
ক্ষেতে ডাল-পালা ও কঞ্চি পুঁতে পতঙ্গভুক পাখী (শালিক, ফিঙ্গে ইত্যাদি) বসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ফলছেদক পোকার ডিম ও কীড়া নষ্টকারী পরজীবী পোকা যেমন- ট্রাইকোগ্রামা ও ব্রাকন মুক্তায়িত করা যেতে পারে। 
আক্রমণের মাত্রা মারাত্মক মনে হলে ক্লোরানট্রানিলিপ্রোল (কোরাজেন ১৮.৫ এসসি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে অথবা থায়ামিথক্সাম+ক্লোরানট্রানিলিপ্রোল এর মিশ্রণ কীটনাশক  যেমন- ভিরতাকো ৪০ ডব্লিউ জি প্রতি লিটার পানিতে ০.১৫-০.২০ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করে ফলছেদক পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
 
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ডাল গবেষণা কেন্দ্র ও আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইল : ০১৭২৫-০৩৪৫৯৫,E-mail: hossain.draltaf@gmail.com
বিস্তারিত
অপুষ্টিজনিত ‘গুপ্ত ক্ষুধা’ নিরাময়ের বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক রাইস
 অপুষ্টিজনিত ‘গুপ্ত ক্ষুধা’ নিরাময়ের
বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক রাইস 
কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন 
বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ১৯৩টি দেশ তথা বিশ্বের মধ্যে ২৫তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে ঘুরে দাঁড়াবে।  
অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার ফলে কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। ২০২০ সালের করোনাকালীন সময়ে গোটা বিশ্ব যখন খাদ্য উৎপাদনে পিছিয়ে। দেশে দেশে যখন দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব, সে সময়ে বাংলাদেশে শুধূমাত্র দানাজাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৪৩ মিলিয়ন টন যার মধ্যে শুধু চালের উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৬ মিলিয়ন টন। কৃষিবান্ধব সরকারের সুদুরপ্রসারী ও সময়োপযোগী কর্মসূচি গ্রহণ, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরলস প্রচেষ্টা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম জোরদারকরণ ও তদারকি এবং দেশের কৃষককুলের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কৃষির এই অর্জনে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ।
দ্রুত খাবার খাওয়ার ফলে ক্ষুধা মেটানো যায়, তবে ’গোপন ক্ষুধা’ এর গভীর সমস্যা রয়েছে যা পুষ্টিগতভাবে সমৃদ্ধ খাবারের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়। বিশ্বব্যাপী সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য সুষম খাবার গ্রহণ করা হলো একটি সুদূর স্বপ্ন। বিশ্ব জুড়ে চাল, গম ও ভুট্টা প্রধান কার্বহাইড্রেটযুক্ত খাবার খাওয়া হয় এবং ক্ষুধার সমস্যা সমাধানে অবদান রাখে, তবে ‘গোপন ক্ষুধা’ এখনও বিশ্বে অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বে তিনজনের মধ্যে একজন মানুষ ’লুকানো ক্ষুধা’ নামক মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টজনিত ঘাটতিতে ভোগেন। এই ‘গোপন ক্ষুধার’ কারণ হলো দেহ প্রয়োজনীয় মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট থেকে বঞ্চিত হয়। দেহে প্রয়োজনীয় মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের অভাব একটি নীরব মহামারী অবস্থা যা আস্তে আস্তে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল করে দেয়, শারীরিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে। মানবদেহে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টস বিশেষ করে আয়োডিন, আয়রন, ভিটামিন-এ এবং জিঙ্কের ঘাটতি ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং এর ফলে গুরুতর পরিণতি ঘটে। ’লুকানো ক্ষুধা’ এবং অপুষ্টিজনিত কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন ২৪ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। মানবদেহে তাই এই সমস্ত মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টসগুলোর ঘাটতি মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন জৈবিক এবং রাসায়নিকভাবে পুষ্টি উপাদানগুলো যুক্ত করে প্রয়োজনীয় বা প্রধান খাদ্যকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে বিশ্বব্যাপী।
বায়োফর্টিফিকেশন, অর্থাৎ ফসলের ব্রিডিং বা প্রজননের মাধ্যমে প্রধান খাদ্যের মধ্যে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টস এর পরিমাণ বৃদ্ধি করা যাতে কৃষিভিত্তিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের স্বাস্থ্যের অন্যতম বাধা অপুষ্টিজনিত সমস্যাকে দূরীভূত করা। গত দুই দশকে মানব শরীরে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি কমানোর জন্য গতানুগতিক খাদ্য পরিপুরক গ্রহণ, খাদ্যে ফর্টিফিকেশন এবং খাদ্য তালিকার বহুমুখীকরনের চেয়ে প্রধান খাদ্য মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ করার জন্য বায়োফর্টিফিকেশন এর উপর কাজ করা হয়েছে। বিশ্বে খাদ্যে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট এর ঘাটতির প্রেক্ষাপটে জিনগত যেমন উদ্ভিদ প্রজনন ও   কৃষিতাত্ত্বিক কলাকৌশলের মাধ্যমে বায়োফর্টিফাইড প্রধান খাদ্য গ্রহণের পরিমান বাড়িয়ে দরিদ্র মানুষের মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি পূরণে সহায়ক হতে পারে।
জিঙ্ক মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট। বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানব শরীরে জিঙ্কের ঘাটতি প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষের জন্য বিরাট একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। এর অধিকাংশ হলো গর্ভবতী মহিলা ও পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা। সেই সমস্ত অঞ্চলে মানব শরীরে জিঙ্কের সমস্যা বেশি যেখানে মাটিতে জিঙ্কের পরিমাণ কম থাকে। গবেষণায় আরো জানা যায় যে, মানব শরীরে জিঙ্কের ঘাটতির অন্যতম কারণ হলো সাধারণত বেশি পরিমাণে দানাজাতীয় খাবার গ্রহণ ও কম পরিমাণে প্রাণিজ খাদ্য গ্রহণ। 
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশ অর্থাৎ ৯০ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে জিঙ্কের অভাব রয়েছে। প্রাক-স্কুল বয়সী শিশুদের ৪৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন এবং ৫৭ শতাংশ গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী অর্থাৎ প্রায় ২০ মিলিয়ন মহিলাদের মধ্যে জিঙ্কের ঘাটতি রয়েছে যার কারণে এরা খর্বাকৃতির হয়ে যাচ্ছে এবং প্রায়ই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। দেশের ৫ বছরের কম বয়সী ৪১ শতাংশ অর্থাৎ ৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন শিশু জিঙ্কের ঘাটতিজনিত কারণে খর্বাকৃতির হচ্ছে।
যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের ভাতভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছে তাই ভাতের মাধ্যমে যাতে অধিক পুষ্টির জোগান পায় বিশেষ করে জিঙ্কের ঘাটতি পূরণের জন্য বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি মোট ৭টি বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। ভাত বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য এবং নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতিদিন ভাতের জন্য চাল দরকার হয় ৩৯০ গ্রাম থেকে সর্বাধিক ৪৫০ গ্রাম। এক্ষেত্রে ব্রির উদ্ভাবিত বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ জাতগুলো মানুষের প্রতিদিনের জিঙ্ক চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম।
ব্রি ধান৬২ : আমন মৌসুমের সবচেয়ে আগাম বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত। চাল সরু আকৃতির এবং এতে উচ্চমাত্রার প্রোটিন ও মধ্যম মাত্রার জিঙ্ক রয়েছে। এর জীবনকাল ১০০ দিন যা ব্রি ধান৩৩ এর চেয়েও ১০-১২ দিন আগে আসে। আশ্বিনের শেষ সপ্তাহে ধান কেটে আলু বা অন্যান্য রবিশস্য করা যায়। ১ কেজি চালে জিঙ্কের পরিমাণ ১৯.৮ মিলিগ্রাম।
ব্রি ধান৭২ : জিঙ্ক সমৃদ্ধ আমনের একটি আগাম জাত। জীবনকাল ১২৫ দিন। আশ্বিনের শেষে ধান কাটার পর সহজেই রবিশস্য চাষ করা যায়। চাল লম্বা ও মোটা এবং ১ কেজি চালে জিঙ্কের পরিমান ২২.৮ মিলিগ্রাম।
ব্রি ধান৭৪ : বোরো মৌসুমের বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত জীবনকাল ১৪০ দিন। ১ কেজি চালে জিঙ্কের পরিমাণ ২৪.২ মিলিগ্রাম।
ব্রি ধান৮৪ : বোরো মৌসুমের বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত জীবনকাল ১৪৫ দিন। ১ কেজি চালে জিঙ্কের পরিমান ২৭.৬ মিলিগ্রাম।
বঙ্গবন্ধু ধান১০০ : বোরো মৌসুমে চাষাবাদযোগ্য জিংক-এর পরিমাণ ২৫.৭ মি. গ্রাম/কেজি। গড় জীবনকাল ১৪৮ দিন।
ব্রি ধান১০২ : বোরো মৌসুমে চাষাবাদযোগ্য। জিংকের পরিমাণ ২৫.৫ মি. গ্রাম কেজি। এ জাতের গড় জীবনকাল ১৪০ দিন।
বিনা ধান-২০ : আমন মৌসুমে চাষাবাদযোগ্য। প্রতি ১০০ গ্রাম চালে ২.৭৫ মি. গ্রাম জিংক এবং ২.০-৩.১ মিলি গ্রাম আয়রণ থাকে। গড় জীবনকাল ১২৫-১৩০ দিন।
আমন মৌসুমের বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাতগুলো হেক্টরে ৪.৫ টন থেকে ৬.৫ টন ফলন দিতে সক্ষম। বোরো মৌসুমের জিঙ্ক জাতের ধানের ফলন হেক্টরে ৬.৫ টন থেকে ৮.৫ টন। যদিও বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক রাইসের মাধ্যমে দেশের মানুষের জিঙ্কের ঘাটতি পূরণে একটি প্রতিশ্রুতবদ্ধ সমাধান। 
জিঙ্ক মানুষের ইমিউনিটি ফাংশন বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা ভাইরাস এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক স্বাস্থ্য হুমকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রথম সারির হাতিয়ার। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক ১১-১২ মিলিগ্রাম জিঙ্কের দরকার হয় যার ৪০-৫০ শতাংশ বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল থেকে পূরণ করা যায়। কারণ জিঙ্ক সমৃদ্ধ জাতগুলোতে সাধারণ জাতের তুলনায় ৫০ শতাংশ জিঙ্ক বেশি থাকে। দেশের শিশু ও মহিলাসহ বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে জিঙ্কের ঘাটতিজনিত অপুষ্টি দূর করতে জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাতগুলোর মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের কোন বিকল্প নেই। 
মাঠপর্যায়ে সফলভাবে এই জাতগুলো সম্প্রসারণের জন্য যা করণীয়
য় প্রথমেই যে কাজটি করা জরুরি সেটি হচ্ছে, জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে মানব শরীরে জিঙ্কের গুরুত্ব, জিঙ্ক সমৃদ্ধ চালের গুণাবলি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। কৃষকদের মাঝে ভর্তুকি মূল্যে জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের বীজ সরবরাহ করে এই ধান চাষে কৃষকদেরকে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা নিলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।
য় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে জিঙ্ক ধানের প্রদর্শনী স্থাপন করে মাঠ দিবসের আয়োজন করার মধ্য দিয়ে প্রচার করা এবং কৃষকদেরকে এই ধান চাষে উৎসাহিত করা।
য় সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে সাধারণ চালের পরিবর্তে বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এর ফলে দেশে জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের চাষ অনেক সহজেই বেড়ে যাবে। সরকারি এই সমস্ত কর্মসূচির একটি বড় সুবিধা হলো যে, এর মাধ্যমে নিম্ন আয়ের পরিবারকে চাল সহায়তা দেয়া হয় যাদের মধ্যে জিঙ্কের ঘাটতি অত্যন্ত বেশি। যদি এই সমস্ত পরিবার জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল পায় তবে তাদের দেহের জিঙ্ক ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে।
য় মিলারদের মাধ্যমে জিঙ্ক জাতের চালের বিশেষ ব্র্যান্ডিং করে বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করা যার মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে এই চালের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করতে সহায়ক হবে। এই বিশেষ প্যাকেটজাত জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল শহরের দোকানগুলোতে পাওয়া গেলে উচ্চ আয়ের গ্রাহকগণ প্রয়োজনে কিছুটা বেশি মূল্য দিয়ে হলেও কিনতে আগ্রহী হবে। জিঙ্ক চাল বাজারে ব্র্যান্ড হিসাবে চালু করতে পারলে এর চাহিদা বেড়ে যাবে যার ফলে মিলাররাও আগ্রহী হবে এই জিঙ্ক চালের আলাদা ব্র্যান্ড ও প্যাকেট করতে। এভাবেই চাহিদা বাড়তে থাকলে কৃষকেরাও বাণিজ্যিকভাবে এই সমস্ত জিঙ্ক ধানের চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবে যা সর্বোপরি দেশের মানুষের জিঙ্কের ঘাটতিজনিত অপুষ্টি দুরীভুত হবে।
দেশে দক্ষ জনবল তৈরি হবে, দেশের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতে অগ্রগতির ধারায় আরো গতি আসবে। এভাবেই বাংলাদেশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন-২০৪১ অর্থাৎ উন্নত দেশে পরিণত হবে। আর এই অগ্রগতির জন্য সুস্থ শক্তিশালী জাতি গঠনের জন্য নিশ্চিত করার প্রয়োজন হবে দেশের মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা। এক্ষেত্রে বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল সেই পুষ্টি নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সুরক্ষার মাধ্যমে সুস্থ সবল জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
  
                                               
লেখক : কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ, মোবাইলঃ ০১৭১১৯৮৭১১৩, ই-মেইল :monir.uddin@rocketmail.com
বিস্তারিত
কম খরচে তুলা চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কম খরচে তুলা চাষের 
আধুনিক প্রযুক্তি
ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজা১ অসীম চন্দ্র শিকদার২
বর্তমান বিশ্বে তুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ আঁশজাতীয় ফসল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হচ্ছে বস্ত্র ও গার্মেন্ট খাত। তাই অর্থনৈতিক স্বার্থে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি একান্ত জরুরি। বাংলাদেশে মূলত সমভূমি জাতের এবং সীমিত আকারে পাহাড়ি জাতের তুলার চাষ হয়ে থাকে। তবে পাহাড়ি অঞ্চলের সমতল ভূমিতে ও পাহাড়ের ঢালেও সমভূমির জাতের তুলাচাষ হচ্ছে। সমভূমি জাতের তুলাচাষ নির্ভরই আমাদের বস্ত্র শিল্প। তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন নতুন চাষ এলাকা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া এবং তুলা চাষে আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল প্রয়োগ চলছে।
তুলাচাষ এলাকা বৃদ্ধির উপায়
মাঠ ফসলের তুলনায় তুলা চাষে কম সেচের প্রয়োজন হয়। তাই তুলাচাষ সম্প্রসারণের একটি সম্ভাবনাময় এলাকা হলো রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল। এ অঞ্চলে ৫.৮২ লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি রয়েছে; যার মধ্যে ৮৪% এক ফসলি জমি। এ অঞ্চলে ফসলের নিবিড়তা মাত্র ১১৭%। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়া এবং সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়াই বরেন্দ্র অঞ্চল খরাপ্রবণতার প্রধান কারণ। তুলা চাষ উপযোগী সময় খরিপ-২ (জুলাই-অক্টোবর) মাসে এ অঞ্চলে বৃষ্টিনির্ভর আমন ধানের চাষ হয়ে থাকে। তাই এ অঞ্চলে হালকা নিয়ন্ত্রিত সেচের মাধ্যমে তুলা চাষ সম্প্রসারণ চলছে। 
স্বাভাবিক বন্যামুক্ত চরগুলো তুলা চাষের আওতায় আনার কাজ চলছে। ঐ সব জমির উপরি ভাগে বালু থাকে বিধায় অন্যান্য ফসল চাষের পরিবর্তে গভীরমূলী তুলা চাষের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। তবে চর এলাকায় বন্যার ঝুঁকি রয়েছে বিধায় ব্যয়বহুল হাইব্রিড জাতের তুলা চাষের পরিবর্তে আধুনিক জাতের তুলাচাষ করতে হবে। আর বন্যা প্রবণ চরগুলোতে তুলা বপনের সময় কোন ব্যাসাল সার দেয়া যাবে না। প্রাথমিক বন্যায় যদি ফসল বিনষ্ট না হয়, তবে বন্যার ঝুঁকি চলে যাওয়ার পর পরই সার প্রয়োগ সহ দ্রুত অন্যান্য পরিচর্যা করতে হবে। চরগুলোর বালুর স্তরের নিচেই পলির স্তর রয়েছে, তুলার শিকড় পলির স্তরে পৌঁছে বাড়তি পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারে। বর্তমানে টাঙ্গাইলের লাউহাটি, কেদারপুর, পাবনার হেমায়েতপুর, নাটোরের লালপুর এবং জামালপুরের পাথালিয়ার চরে সফলভাবে তুলা চাষ করা হচ্ছে।
বন্ধ চিনির মিলগুলোর আওতাধীন জমিও তুলা চাষের আওতায় আনা যেতে পারে। রংপুর অঞ্চলের এবং পার্বত্য অঞ্চলের তামাক চাষের জমিগুলো তুলা চাষের আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মিল-ইন্ডাস্ট্রির পরিত্যাক্ত জমি তুলা চাষের আওতায় আনা যেতে পারে। 
দক্ষিণাঞ্চলে তুলাচাষ সম্প্রসারণ কাজ শুরু করা হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ হেক্টর লবণাক্ত জমি রয়েছে, যা ডিসেম্বর-মে পর্যন্ত পতিত থাকে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ ফসল লবণাক্ততা সংবেদনশীল হওয়ার কারণে         কৃষি কাজে ঐ সব জমির ব্যবহার কম হয়। তবে অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় জলাবদ্ধতার কারণে খরিপ-২ মৌসুমে এ অঞ্চলে তুলা চাষের উপযোগিতা কম। তবে খরিপ-১ অর্থাৎ গ্রীষ্মকালীন সময়ে তুলার চাষ করা যেতে পারে। এ অঞ্চলের উপযোগী পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করে গ্রীষ্মকালে তুলা চাষ করার পদ্ধতি এরই মধ্যে উদ্ভাবন করা হয়েছে। ভারতের সুন্দরবন অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে হাইডেনসিটি প্লান্টিং সিস্টেমের মাধ্যমে তুলা চাষের মতো আমাদের দেশেও করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
ইতোমধ্যে খরা, লবণাক্ত, চর ও পাহাড়ি এলাকার উপত্যকার সমতল ভূমিতে আপল্যান্ড তুলাচাষ সম্প্রসারণের জন্য ভিত্তিবীজ ও মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদন করে তা চাষিপর্যায়ে স্বল্পমূল্যে/বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সাফল্য পেলে বাংলাদেশে তুলা চাষে বিপ্লব ঘটে যাবে।
জমি নির্বাচন ও প্রস্তুতকরণ
তুলা চাষের উৎকৃষ্ট মাটি হলো দো-আঁশ এবং বেলে দো-আঁশ, তবে পর্যাপ্ত জৈব সার যুক্ত যে কোন মাটিতেই তুলা চাষ করা সম্ভব। কর্দমাক্ত এঁটেল মাটিতে তুলা চাষ না করাই ভালো। উঁচু, সমতল, বর্ষার পানি উঠে না, বৃষ্টির পানি দাঁড়ায় না, প্রয়োজনে হালকা সেচের সুবিধা আছে, মাটির পিএইচ মান ৬.০ থেকে ৭.৫ ছায়া মুক্ত এমন জমিই তুলা চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। তবে তুলাবীজ বপনের এক মাস পূর্বে অধিক অম্ল মাটিতে চুন প্রয়োগ করে তুলা চাষের উপযোগী করে নেয়া যেতে পারে। তুলা চাষের পূর্বে সময় থাকলে জমিতে সবুজসার যোগ করার জন্য দ্রুত পচনশীল শিমজাতীয় উদ্ভিদ যেমন- ধইঞ্চা, শন, মটরশুঁটি, বরবটি চাষ করে ফুল ফোটার সাথে সাথে চাষ দিয়ে সবুজ অবস্থায় মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে তা দ্রুত পচে মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করবে। এ সকল উদ্ভিদ মাটিতে কেবল জৈব পদার্থইযোগ করে না, পর্যাপ্ত নাইট্রোজেনও সরবরাহ করে। সবুজ উদ্ভিদ মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার ১৫-২০ দিন পর তুলাবীজ বপন করতে হবে।
তুলার জাত ও বীজ হার 
জমির ধরন অনুসারে চাষিদের সঠিক তুলার জাত নির্বাচন করতে হবে। এ ব্যাপারে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ কর্মকর্তাদের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। হেক্টরপ্রতি তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড একটি হাইব্রিড, ১টি মিউটেন্ট এবং ২৩টি আধুনিক জাত উদ্ভাবন ও চাষিদের নিকট হস্তান্তর করেছে; এ ছাড়া বেসরকারি বীজ কোম্পানি কর্তৃক আমদানিকৃত হাইব্রিড রূপালী-১, ডিএম-৪, হোয়াইট গোল্ড-১,২ জাতের তুলার চাষ করারও সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে চর্বনকারী পোকা/বোলওয়ার্ম প্রতিরোধী বিটি কটনের দু’টি হাইব্রিড জাত চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
ফাজ যুক্ত বীজ হলে বিঘা (৩৩ শতাংশ) প্রতি ১.৫-২.০ কেজি, ডিলিন্টেড বীজ হলে বিঘা প্রতি ০.৬০০-০.৭০০ কেজি বীজের প্রয়োজন হবে। হাইব্রিড ডিলিন্টেড বীজের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি ৬০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হবে। তবে বন্যামুক্ত উর্বর জমিতে হাইব্রিড জাতের বীজ বপন করাই উত্তম। কোনভাবেই হাইব্রিড তুলা চাষে অবহেলা করা যাবে না।
জমি তৈরি ও বীজ বপন
তুলা চাষের উপযুক্ত সময় হলো আষাঢ় থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত। তবে ঢাকা অঞ্চলে ভাদ্র মাসের ১৫ পর্যন্ত তুলা চাষ করা যায়। তুলা বীজ বপনের সময় যেহেতু ঘন ঘন বৃষ্টি হয়ে থাকে তাই ২/১টি চাষ ও মই দিয়েই তুলা বীজ বপন করতে হবে। তবে তুলা গভীরমূলী ফসল বিধায় কমপক্ষে একটি চাষ গভীরভাবে দেয়া দরকার। সময়মতো তুলাবীজ বপন করাই মুখ্য, পরে পরিচর্যার মাধ্যমে চাষের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। 
বীজ বপন করতে হয় ডিবলিং পদ্ধতিতে। তুলাবীজ উত্তর দক্ষিণে সারি করে বপন করতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সেমি. এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ৩০-৩৫ সেমি. রাখতে হবে। জমির উর্বরতা এবং জাতের উপর ভিত্তি করে এর সামান্য কম বেশি করা যেতে পারে। প্রতি মাদায় ফাজি বীজ হলে ২/৩টি, হাইব্রিড ডিলিন্টেড বীজ হলে ২টি বীজ ১ থেকে ১.৫ ইঞ্চি মাটির গভীরে বপন করতে হবে। কোনভাবেই ১.৫ ইঞ্চির বেশি গভীরে বীজ বপন করা যাবে না। ফাজি বীজ বপনের পূর্বে পানিতে ভিজিয়ে পরে ছাই বা মাটি দ্বারা ঘষে প্রস্তুত করে নিলে ভালো হয়। এতে বীজ বপনে যেমন সুবিধা হবে তেমনি দ্রুত বীজ গাজাতেও সাহায্য করবে। বপনের পূর্বে ফাজি বীজ ছত্রাকনাশক (প্রতি কেজি তুলা বীজের সাথে ৩ গ্রাম ভিটাভেক্স/ব্যাডিস্টিন/গাউচু/টিল্ট) ভালোভাবে বীজের সাথে মিশিয়ে শোধন করে ১ ঘণ্টা ছায়ায় বীজ শুকিয়ে বপন করলে বীজবাহিত রোগ থেকে তুলা ফসল রক্ষা পাবে। তুলা বপনের পরপরই জমির পানি নিকাশের জন্য নালা কেটে রাখতে হবে। কারণ তুলা ফসল দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। তুলাবীজ বপনের সময় তুলা জমির লাইনের ফাঁকে অথবা পলিব্যাগে কিছু তুলা বীজ বপন করে রাখলে প্রয়োজনে সেই চারা দিয়ে গ্যাপ পূরণ করা যাবে। ভালো ফলন পেতে হলে বিঘাপ্রতি ৪০০০-৪৫০০টি তুলাগাছ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে সময় মতো তুলা বীজ বপন করতে না পারলে অথবা বন্যাপ্রবণ এলাকার জমির জন্য পলিব্যাগে সময়মতো বীজ বপন করে রাখলে পরে জোঁ-মতো সেই চারা জমিতে রোপন করা যায়। এতে যদিও খরচ কিছুটা বেশি হয় কিন্তু তুলার ফলনের কোন ব্যাঘাত হয় না। তুলা যেহেতু একটি লাভজনক ফসল, তাই প্রয়োজনে বাড়তি খরচ করা যেতেই পারে।
সাথী ফসল চাষ 
জমি উর্বর হলে তুলার লাইনের ফাঁকে ফাঁকে সল্পমেয়াদি সাথী ফসল যেমন-লালশাক, কলমিশাক, মুলাশাক, মুগকালাই, চীনাবাদাম, পাটবীজ ফসল ইত্যাদি চাষ করে বাড়তি আয় করা যায়। সাথী ফসল যেন মূল ফসলের সাথে সার, আলো এবং বাতাস নিয়ে প্রতিযোগিতা না করে সে দিকে নজর রাখতে হবে। অর্থাৎ তুলা ফসলের নিরাপদ দূর দিয়ে সাথী ফসল চাষ করতে হবে। তুলার লাইন থেকে ১৫ সেমি. করে বাদ দিয়ে মাঝের ৬০ সেমি. এর মধ্যে সাথী ফসল চাষ করা যেতে পারে। এ ছাড়া গম, ভুট্টা রিলে ফসল হিসেবেও চাষ করা যায়। 
সার ব্যবস্থাপনা
প্রতি বিঘায় সার প্রয়োগের পরিমাণ সারণি দ্রষ্টব্য। সারের মাত্রা জমির উর্বরতা এবং জাতের উপর ভিত্তি করে কম/বেশি করতে হবে পোলট্রি লিটার (হাঁসমুরগির বিষ্ঠা)। এ ছাড়া পোলট্রি ম্যানিউর ব্যবহার করলে সব ধরনের রাসায়নিক সার কম প্রয়োজন হয়। রাসায়নিক সার একাধিকবার প্রয়োগ করতে হয়। সব ধরনের জৈবসারই জমির শেষ চাষের পূর্বে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। ব্যাসাল সার বীজ বপনের সময় তুলার লাইন থেকে ৫-৬ সেমি. দূরে নালা কেটে পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে। আন্তঃপ্রয়োগ সারও পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে। হাইব্রিড জাতের তুলায় সব ধরনের সার ২০ শতাংশ বেশি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। অম্ল যুক্ত মাটিতে চুন তুলা বপনের এক মাস পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। তুলা বপনের পূর্বে সবুজ সার চাষ করলে তুলা বপনের কমপক্ষে ১৫ দিন পূর্বে সবুজ অবস্থায় মাটির সথে মিশিয়ে দিতে হবে।

লেখক : ১মৃত্তিকা উর্বরতা ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, খামারবাড়ি, ঢাকা। ২কটন ইউনিট অফিসার (অব:), তুলা উন্নয়ন বোর্ড, মোবাইল : ০১৯২৩-৪১২২৫৬; ১০৪/১ (বি-২), শের-এ-বাংলা রোড, রায়ের বাজার, জাফরাবাদ, মোহাম্মদপুর-১২০৭।  ইমেইল :asim,cdb@gmail.com

বিস্তারিত
ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে কৃষক সেবা

ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের 
মাধ্যমে কৃষক সেবা
ড. মো: নূরুল হুদা আল মামুন
ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলার ভাংনামারির চর এলাকার মোঃ ভুলু মিয়া বেশ কয়েক বছর ধরে মাটি পরীক্ষা করে ফসলের জমিতে সার দেন। তিনি বলেন, ‘আগে জমিতে এলাকার অন্যান্যদের মত অনুমান কইরা অনেক বেশি সার দিতাম। কতেক সার আদৌ দিতাম না । এতে ভাল ফলন পাইতাম না। অহন ভ্রাম্যমাণ মাটির গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা কইরা সার দেই। এতে আগে চেয়ে খরচ কম লাগে আবার অনেক বেশি ফলন পাই’। 
অনুরূপভাবে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার একজন আদর্শ কৃষক আব্দুল ওয়াদুদ মিয়া। তিনি বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে মাটি পরীক্ষা করে সার দেন। তিনি বলেন, ‘আমি ফরিদপুর মৃত্তিকা গবেষণাগারে গিয়ে ও ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করিয়ে দানা পিয়াজে, ধানের জমিতে স্যারদের পরামর্শে সার দেই। আমি ভাল লাভবান হয়েছি’। 
একইভাবে জামালপুর জেলার চর যথার্থপুর গ্রামের আদর আলী বিগত কয়েক বছর ধরে মাটি পরীক্ষা করে সার দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের চর যথার্থপুর গ্রামে প্রচুর সবজি চাষ হয়। আমাদের এলাকায় কেউ মাটি পরীক্ষার বিষয় জানত না, পরে জামালপুর গবেষণাগার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সবজি চাষ করি। আমরা কম সার দিয়ে ভাল ফলন পাচ্ছি’। 
ভুলু মিয়া, আদর আলী আর ওয়াদুদ মিয়ার  মতো অনেক স্মার্ট চাষিরা এখন নিয়মিত মাটি পরীক্ষা করে ফসল আবাদ করেন। এমন সফলতার গল্প এখন সারা দেশের কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ স্থায়ী মৃত্তিকা গবেষণাগার আবার কেউ ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করছেন। আসুন এ সফলতার পেছনের রহস্যটা জেনে নেওয়া যাক। 
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাবার প্রয়োজন তেমনি সব গাছেরও খাবারের প্রয়োজন হয়। আমরা জানি, যে কোনো ফসলের জীবনচক্রে (বীজ থেকে বীজ) উদ্ভিদের যেসব খাদ্যোপাদানের দরকার হয় তার মধ্যে ১৭টা খাদ্যোপাদান অত্যন্ত জরুরি। যদিও ১৭টি খাদ্যোপাদানের বাইরে আরো অনেক উপাদান আছে, তবে সেগুলো বিশেষভাবে জরুরি নয়। ১৭ টি খাদ্যোপাদানের মধ্যে মাত্র ৩টি খাদ্য প্রকৃতি থেকে উদ্ভিদ পেয়ে থাকে। গাছ আলোর উপস্থিতিতে বায়ুম-ল থেকে কার্বন ও অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং পানির মাধ্যমে হাইড্রোজেন নিয়ে নিজের খাবার নিজে তৈরি করে। গাছের বৃদ্ধি ও জীবন চক্রের উন্নতি অর্থাৎ ফুল ফলের মাধ্যমে পরিসমাপ্তির জন্য আরো ১৪টি পুষ্টি উপাদান আবশ্যক যা শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। এগুলোর মধ্যে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, সালফার, ম্যাগনেসিয়ামকে ম্যাক্রো বা প্রাথমিক জরুরি খাদ্য উপাদান বলা হয়। এ ছাড়া অনুখাদ্য হিসেবে লোহা, বোরন, ক্লোরিন, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, তামা, মলিবডেনাম, নিকেল ইত্যাদিও উদ্ভিদ মাটির থেকে খনিজ লবণের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। 
ক্রমাগতভাবে ফসল চাষ করার ফলে মাটি হতে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো আস্তে আস্তে কমে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মোট কৃষিজমির শতকরা ৭৫ ভাগ তার উর্বরতা হারিয়েছে। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে মাটিতে মৌলিক উপাদানের ঘাটতি দেখা যায়। বাংলাদেশের মাটিতে নাইট্রোজেনের ঘাটতি দেখা দেয় ১৯৫১ সালে। এরপর ১৯৫৭ সাল থেকে ঘাটতির তালিকায় নাইট্রোজেনের সাথে ফসফরাস যুক্ত হয়। এ তালিকায় পটাশিয়াম যুক্ত হয় ১৯৬০ সালের দিকে। ১৯৮০ সাল থেকে সালফারের ঘাটতি দেখা দেয়। ১৯৮২ সাল থেকে জিঙ্ক ঘাটতি তালিকায় যুক্ত হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে বোরণ ঘাটতি দেখা দেয়। এখন আটটি মৌলিক পদার্থ যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিঙ্ক, বোরণ, ম্যাগনেসিয়াম এবং মলিবডেনামের ঘাটতি নিয়ে চলছে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন। এখন যেভাবে চলছে এ ভাবে কৃত্রিম সার নির্ভর         কৃষি উৎপাদন পরিচালিত হলে অদূর ভবিষ্যতে অন্তত ১৭টি মৌলিক পুষ্টি উপাদান তথা সার প্রয়োগ করে এ দেশে ফসল উৎপাদন করতে হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। যে কারণে ফসলের খাবার জোগান দেয়ার জন্য জমিতে কৃত্রিম উপায়ে খাবার বা সার দেওয়া দরকার। একজন কৃষক বহু বছর ধরে চাষ করছেন, বছরের পর বছর একটার পর একটা ফসলের চাষ করছেন, ফলে জমি বিশ্রাম পাচ্ছে না। প্রতিটি চাষের সময় নানা রকমের রাসায়নিক সারের ব্যবহার করছেন। মাঝে মধ্যে জৈবসারও দেয়া হচ্ছে যদিও তা প্রয়োজনের চেয়েও কম মাত্রায়। বেশির ভাগ কৃষক জৈবসার ব্যবহার কম করে থাকেন, ফলে মাটির চরিত্র বদলে যাচ্ছে। অধিক মুনাফার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন। সুষম ও পরিমিত মাত্রায় সার ব্যবহার করছেন না। ফলে দিনের পর দিন এভাবে চলার ফলে জমির উর্বরাশক্তি কমে যাচ্ছে, ফলে ফলন কম হচ্ছে।
মাটি পরীক্ষার গুরুত্ব : যে মাটিকে কেন্দ্র করে চাষাবাদ করা হচ্ছে তার স্বাস্থ্যের খবর রাখছেন না অনেকেই। এর জন্য দরকার নিয়মিত কৃষি জমির মাটি পরীক্ষা করা। মাটি পরীক্ষা করলে জানা যাবে কী কী খাদ্যোপাদান কী পরিমাণে আছে। কী পরিমাণে বাড়তি সার বা খাদ্য উপাদান দিতে হবে। এমনও দেখা যায় বছরের পর বছর মাত্রানুযায়ী নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম জমিতে দেওয়া হচ্ছে-কিন্তু মাটি পরীক্ষার পর দেখা গেল ফসফেটের মাত্রা অতি উচ্চ, পটাশের মাত্রাও অনেক বেশি-আবার অন্যান্য খাদ্যোপাদানের মাত্রা বেশ কম রয়েছে। কৃষক ফসল অনুযায়ী তার প্রয়োজনীয় মাত্রায় সারের ব্যবহার করেছেন, মাটি পরীক্ষার পর জানা যায় বেশ কিছু সারের অপব্যবহার হয়েছে। তাই প্রত্যেকটি জমির বছরে অন্তত একবার মাটি পরীক্ষা করতে হবে। সম্ভব না হলে কমপক্ষে       ৩-৪ বছর পরপর মাটি পরীক্ষা করা উচিত। এর ফলে শুধু সারের অপব্যবহারই কমবে তাই নয়, সেইসাথে বেশি মাত্রায় বারবার সারের ব্যবহারে জমিতে সেইসব খাদ্যগুণ জমে অন্য খাদ্যকেও অগ্রহণযোগ্য করে দেয়। মাটিতে বিষাক্ততা তৈরি হয়। বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সারের ব্যবহারে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুর সংখ্যাও কমতে থাকে ফলে ফসলের ফলন কমে যায় এবং মাটি মৃত হয়ে যায়, যেমন মরুভূমির মাটিকে মৃত মাটি ধরা হয়। মাটি পরীক্ষা করে মাটির স্বাস্থ্য জানার পর সুষম সার ব্যবহার করলে শুধুমাত্র যে অর্থের সাশ্রয় হবে তা নয়, মাটির স্বাস্থ্য ভাল থাকবে, পরিবেশ ভাল থাকবে। যখন জানা যাবে মাটিতে জৈব পদার্থের উপস্থিতি তলানিতে নেমেছে, তখন মাটি ও ফসল বাঁচাতে কৃষক উঠে পড়ে লাগলেও মাটির স্বাস্থ্য পুনুরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন খরচ শতকরা ১৫-২৫ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। এসব কারণে মাটি পরীক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প উপায় নেই।
কোথায় মাটি পরীক্ষা করা যায় : প্রধানত মাটির ঢ়ঐ (অম্ল/ক্ষারের পরিমাণ), ঊঈ বা লবণের পরিমাণ, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, বোরন ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। বাংলাদেশে দুই ধরনের গবেষণাগারে মাটি পরীক্ষা করা হয়। স্থায়ী গবেষণাগার এবং ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সার সুপারিশ কার্ড দেওয়া হয় । কৃষি মন্ত্রণালয় অধীন মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ৭টি বিভাগীয় গবেষণাগার, ১৬টি আঞ্চলিক গবেষণাগার রয়েছে। বিভাগীয় এসব গবেষণাগারগুলো ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর এবং বরিশাল অবস্থিত। আঞ্চলিক গবেষণাগারগুলো ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাংগাইল, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাংগামাটি এবং পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত। এসব স্থায়ী গবেষণাগারের মাধ্যমে বছরের যে কোন সময়ে ৬৩ টাকার বিনিময়ে মাটির প্রায় সকল উপাদান পরীক্ষা করা যায়।
এ ছাড়া জনগণের দোরগোড়ায় কৃষক সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে এবং মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে ১৯৯৬ সাল থেকে ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষা গবেষণাগার চালু করা হয়। বর্তমানে দেশব্যাপী যমুনা, তিতাস, তিস্তা, রূপসা, মধুমতি, কর্ণফুলী, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, করতোয়া, এবং কীর্তনখোলা নামে ১০টি ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষা গবেষণাগার চালু রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ এসব পরীক্ষাগারের মাধ্যমে বছরের রবি ও খরিপ এই দুই মৌসুমে সরেজমিন মাটি পরীক্ষা করে সার সুপারিশ কার্ড প্রদান করা হয়। এ সময় এসব ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগার থেকে নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (সাধারণত ৩-৫ দিন) অবস্থান করে এবং মাটি পরীক্ষা করে ফসলের সুষম মাত্রার সার সুপারিশ কার্ড প্রদান করা হয়। এসব উপজেলার আগ্রহী কৃষকরা নমুনা প্রতি মাত্র ২৫ টাকা হারে নির্ধারিত ফি প্রদান করে (যদিও মৃত্তিকা নমুনা বিশ্লেষণের প্রকৃত খরচ ৪৪০ টাকা মাত্র) মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সুষম মাত্রার সার সুপারিশ কার্ড নিতে পারেন। মাটি পরীক্ষার জন্য সঠিক নিয়মে মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ করে উপজেলা কৃষি অফিসে জমা দিতে হয়। সংগৃহীত ওই মৃত্তিকা নমুনা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ পরীক্ষা করে সার সুপারিশ কার্ড প্রণয়ন ও বিতরণ করে থাকেন।  
পরিশেষে, দেশের কৃষি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অধিক ফসল উৎপাদন করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করতে ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষা গবেষণাগারের মাধ্যমে সরেজমিন দ্রুত মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। এ ভাবে মৃত্তিকা সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখা আমাদের একান্ত কর্তব্য। 

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক গবেষণাগার, ফরিদপুর। মোবাইল: ০১৭১১-৪৬৯৫০৯, ইমেইল :nhalmamun@gmail.com 

বিস্তারিত
জৈব কৃষি ব্যবস্থাপনায় ছাই ব্যবহার

জৈব কৃষি ব্যবস্থাপনায় 
ছাই ব্যবহার
মুন্সী আবু আল মো. জিহাদ
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরাপদ, লাভজনক ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে। পাশাপাশি ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে বিদ্যমান প্রযুক্তির সাহায্যে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে এ উন্নয়নের ধারা বজায় রাখা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মাটির উর্বরতা সমস্যার কারণে কৃষি জমির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনুৎপাদনশীল থেকে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি ইঞ্চি জায়গা চাষের আওতায় আনতে আবাদি জমি বা বাড়ির আঙিনা সর্বত্রই মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে হবে। ১৯৬০ এর দশকে, সবুজ বিপ্লবের সূচনার সাথে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পূর্বের কৃষি নীতি অনুসরণ করার জন্য, কিছু কৃষক রাসায়নিক সার ব্যবহার শুরু করে। কোন কোন কৃষক আবার রাসায়নিক সার ও জৈবসার উভয়ই ব্যবহার করা শুরু করে, এ ছাড়াও অধিকাংশ কৃষক রক্ষণশীল হওয়ায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করেনি। রাসায়নিক সার প্রয়োগ করায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় বটে কিন্তু মাটির উর্বরতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
রাসায়নিক সার প্রবর্তনের আগে, বাংলাদেশের কৃষি জমিকে উর্বর করার জন্য সারের জৈব উৎসের (প্রাণিজ সার, ছাই, ফসলের অবশিষ্টাংশ এবং গৃহস্থালির বর্জ্য) উপর স¤পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। খামারের অথবা বসতবাড়ির বায়ো-মাস এ্যাশ তথা ছাই একটি চমৎকার জৈব কীটনাশক এবং উচ্চ পুষ্টি উপাদানের কারণে রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এটি হতে পারে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)র দ্বিতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার একটি হাতিয়ার। যেখানে ক্ষুধাকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, উন্নত পুষ্টি নিশ্চিত করার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা তথা কৃষিকাজে লাগসই প্রযুক্তি ও পদ্ধতির প্রয়োগ অত্যাবশ্যকীয়। বাংলাদেশে উন্নত ফসল উৎপাদন এবং একইসাথে মাটির উর্বরতা হ্রাসের বর্তমান চ্যালেঞ্জ সমাধানে ছাইয়ের বহুমাত্রিক ব্যবহার অদূর ভবিষ্যতে সমূহ সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য  কৃষিকাজে ছাই ব্যবহার প্রযুক্তি, রাসায়নিক সার ব্যবহার করে চাষাবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি স্বস্তিদায়ক সমাধান। পরিবেশবান্ধব চাষাবাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে প্রাকৃতিক ও কৃষি সম্পদের রক্ষা করার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত সহনশীলতা অর্জন করা। যদিও উত্তরের উন্নত দেশগুলো এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোর জৈব কৃষিতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান বিদ্যমান, বাংলাদেশে জৈব কৃষিতে এমন কোনও মান নেই। বলা হয়ে থাকে আদর্শ মাটিতে কমপক্ষে ৩.৫ শতাংশ বা এর চেয়ে বেশি জৈব পদার্থ থাকা বাঞ্ছনীয়, অথচ বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থ রয়েছে ২ শতাংশের চেয়েও কম। তারপরেও বর্তমানে সারা দেশে কৃষিতে সীমিত আকারে ছাই ব্যবহার করা হচ্ছে মূলত জৈবসার ও জৈব কীটনাশক হিসেবে। যদিও একসময় ছাইকে নিতান্তই এক প্রকার আবর্জনা এবং অপ্রয়োজনীয় হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এটি রাসায়নিক সার ব্যবহারের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবেও কার্যকর এবং সামাজিকভাবেও স্বীকৃত। 
কৃষি জমিতে ছাই ব্যবহারের উপকারিতা
ছাই মূলত মাটি শুষ্ক ও ঝুরঝুরে রাখতে ব্যবহৃত হয়। দোআঁশ মাটি এবং মাঝারি নিচু জমি যেখানে জলাবদ্ধতা সমস্যার হুমকি রয়েছে সেখানে ছাই ব্যবহার সবচেয়ে উপযুক্ত। এছাড়া মাঝারি উঁচু ও উঁচু জমি হওয়া সত্ত্বেও ময়মনসিংহ ও রাজশাহী অঞ্চলের বেশকিছু স্থানে ঐতিহ্যগতভাবে কৃষি ও উদ্যান জাতীয় ফসল উভয় ক্ষেত্রেই ছাইকে সার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসকল জমি উঁচু হওয়ায় সাধারণত বন্যার কোনো সুযোগ নেই। আলগা মাটি এবং কাদামাটি উভয় ধরনের মাটিই এখানে পাওয়া যায়। মাঝারি বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা এই মাটিকে যথেষ্ট উর্বর করে তোলে। টাঙ্গাইল জেলায় এসব ছাই বেশির ভাগই সবজি বাগানে ব্যবহৃত হয়। আজকাল, আবাদি জমিতে ছাইয়ের কিছু উপকারী প্রভাবের কারণে কৃষিক্ষেত্রে ছাই সার ব্যবহার আশ্চর্যজনকভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে ধান ক্ষেত এবং বাড়ির উঠানে সবজি চাষাবাদে এটি একটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ সার এবং বালাইনাশক হতে পারে। গবেষনায় দেখা গেছে যদি প্রতি একরে পাঁচ টন ছাই প্রয়োগ করা হয়, তবে এটি প্রায় এক টন ক্যালসিয়াম প্রয়োগ করবে। ক্যালসিয়ামের তুলনায়, অন্যান্য পুষ্টি উপাদান অনেক কম পরিমাণে উপস্থিত থাকে। কাঠের ছাই প্রায় চার শতাংশ পটাশিয়াম এবং দুই শতাংশের কম ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম এবং সোডিয়ামের যোগান দেয়। সময়ের সাথে সাথে, ফসলের ফলন বজায় রাখার জন্য মাটিতে ফসফরাস এবং পটাশিয়াম যোগ করতে হবে। তদুপরি ছাই পটাশিয়ামের জোগান দেয় বলে পটাশ সারও তুলনামূলক কম ব্যবহার করা যায়। 
অল্প সংখ্যক প্রকাশিত গবেষণায় এটি দেখানো হয়েছে যে দোআঁশ মাটিতে ছাই যোগ করা হলে তা জৈবপদার্থ উৎপাদনে সীমিত প্রভাব ফেলে, যদি না অতিরিক্ত নাইট্রোজেন পাওয়া যায়। কাঠের ছাইয়ের পানি শোষণের সময় কাঠামোগত পরিবর্তনগুলো বিশ্লেষণ করে বলা হয় যে, ছাই মূলত হাইড্রোফিলিক এবং অক্সাইডের হাইড্রেশনের রাসায়নিক পরিবর্তনের সাথে সমসাময়িকভাবে কৈশিক ক্রিয়া দ্বারা ছিদ্রগুলোতে পানি শোষণ করে। তবে বাংলাদেশে ছাই ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি ফসল উৎপাদনের জন্য টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার উপর অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক গবেষণা রয়েছে। “বোরো ধান চাষে মাটিতে ছাই ব্যবহারের অর্থনৈতিক প্রভাব” শিরোনামে গবেষণালব্ধ ফলাফলে (অপ্রকাশিত) দেখা যায়, ছাই ব্যবহারকারী কৃষকদের নিট আয় এবং আয়-ব্যয় অনুপাত সাধারণ কৃষকদের তুলনায় যথাক্রমে প্রায় ১.৫৫ গুণ ও ১.১৭ গুণ বেশি। মূলত ছাই ব্যবহারে রাসায়নিক সারের খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষক লাভবান হয়।
ছাই ব্যবহার মাটির জন্য ক্ষতিকর কোন পদার্থ নেই।
ছাই-এর সাথে হলুদ ও চুন মিশিয়ে গাছের উপর স্প্রে করলে গাছকে বিভিন্ন রোগ ও কীটপতঙ্গ থেকে বাঁচানো যায়। কাঠের ছাই জৈবসার রূপে মাটির পুষ্টি উপাদান বৃদ্ধি করতে ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে ছাই পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম কার্বনেটের উৎস হিসেবে কাজ করে। ক্যালসিয়াম কার্বনেট মাটির অ¤¬ত্ব প্রশমনে ক্ষারকরূপে কাজ করে থাকে। 
বাগানের মাটিতেও ছাই ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া ছাই কিছুটা ফলন বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে। মাটিতে দুর্গন্ধ হওয়া রোধ করতে ছাই বিশেষ উপকারী (বিশেষ করে কম্পোস্ট করার ক্ষেত্রে)। ছাই মাটির এসিডিটি কমাতে সাহায্য করে।
ছাই এর সবচেয়ে সাধারণ উৎস হচ্ছে, জ্বালানি হিসাবে পোড়ানো গোবর, ফসলের খড় (ধান, গম ইত্যাদি), ডালপালা, পাতা, পাটের কাঠি, বাঁশ, ধানের তুষ, আগুন কাঠের অবশিষ্টাংশ ইত্যাদি। এ ছাড়াও বিভিন্ন চালকলে প্রাপ্ত ধানের ভুসি ছাই সুপরিচিত একটি কৃষি বর্জ্য পদার্থ। তবে যেহেতু বেশিরভাগ ছাই বাড়ি থেকেই সরবরাহ করা হয় সেহেতু ছাইয়ের জন্য খরচ খুব কম হলেও বৃহৎ পরিসরে ব্যবহারের  মতো ছাইয়ের জোগান দেওয়া সম্ভবপর নয়। অধিকাংশ কৃষকেরই এ বিষয়ে কোনো প্রযুক্তিগত জ্ঞান নেই। স¤পূর্ণ অবৈজ্ঞানিকভাবে, শুধুমাত্র বংশাণুক্রমিকভাবে দেখে আসা প্রযুক্তি হিসেবেই সীমিত পরিসরে ছাই ব্যবহার করে আসছে বছরের পর বছর । কখনও কখনও ছাই এর পুষ্টিগুণ স¤পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞানের কারণে এটি ব্যবহারে বাধা হতে পারে। 
বিবিধ ইতিবাচক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও ছাইয়ের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবের ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। নমুনা পরীক্ষায় কাঠের ছাইতে ভারী ধাতুও পাওয়া যেতে পারে বলে ধারনা করা হয়। প্রয়োজনীয় পরীক্ষগার বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত বের করা জরুরি। 
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কে ২০২১ সালে এবং বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটকে ২০২২ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান সরকার কৃষি বিষয়ক গবেষণার সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষক। সুতরাং যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে ছাইয়ের মধ্যে মাটির স্বাস্থ্যগত কোন কোন বিষয় জড়িত, এতে কি কি সম্ভাবনা ও ঝুঁকি রয়েছে তা চিহ্নিত করে এবং ঝুঁকিগুলোকে সুযোগে রুপান্তর করার মাধ্যমে বসতবাড়ির এই আবর্জনাকে স¤পদে পরিণত করা যেতে পারে। সহজলভ্য এই ছাই-কৃষির মাধ্যমে রক্ষনশীল কৃষি নিশ্চিত করা সহজ হবে। পাশাপাশি জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে নাজুক কৃষি ব্যবস্থার আশু সমাধান ত্বরান্বিত হবে।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর। মোবাইল : ০১৬৮০৩২৬০২৫,    ই-মেইল :zihad327@gmail.com

বিস্তারিত
অধিক উৎপাদনশীল সুবর্ণ রুই মাছ চাষ পদ্ধতি

অধিক উৎপাদনশীল সুবর্ণ রুই মাছ চাষ পদ্ধতি
মোঃ মাসুদ রানা
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, এ দেশে ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় ৭০০টি নদী রয়েছে। নদ নদী ছাড়াও বিল, প্লাবনভূমিসহ সব মিলিয়ে আমাদের রয়েছে প্রায় ৩৮,৬০,৪৬৬ হেক্টর মুক্ত জলাশয় এবং ৮,৪৩, ৭২৯ হেক্টর বদ্ধ জলাশয়। এসব জলাশয়ে রয়েছে প্রায় ২৬০ প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের মাছ। আমরা মাছে ভাতে বাঙ্গালী, মাছ ছাড়া আমাদের অস্তিত্বের মিল পাওয়া যায় না তাই তো এ দেশে জন্মানো প্রতিটি মানুষের সাথেই মাছ সরাসরিভাবে জড়িত। বালাদেশ ও ভারতে বহুল পরিচিত মাছ গুলোর মধ্যে রুই মাছ অন্যতম যার স্থানীয় নাম রুহিত, রাউ, নলা, গরমা, উই ইত্যাদি। রুই মাছের বৈজ্ঞানিক নাম খধনবড় ৎড়যরঃধ। বাজারে ভাল দাম থাকায় চাষী পর্যায়ে মাছটির চাহিদা ব্যাপক। রুই মাছ অনান্য কার্প জাতীয় মাছের তুলনায় কিছুটা কম বর্ধনশীল হওয়ায় উৎপাদন তুলনামূলক কম। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট দীর্ঘদিন গবেষণা করে দ্রুত বর্ধনশীল  ৪র্থ প্রজন্মেও রুই (সুবর্ন রুই) মাছের জাত উদ্ভাবন করেছে যার সফলতা এসেছে স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তীতে তাই বিএফআরআই মাছটির নামকরণ করেছে সুবর্ন রুই। মাছটির গায়ের রং আকর্ষণীয় এবং পাখনার রং লালচে-গোলাপি যা যে কাউকে বিমোহিত করবে। মাছটির দৈহিক বৃদ্ধি সাধারণ রুই মাছ হতে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি ফলশ্রুতিতে চাষিরা অল্প সময়ে অধিক উৎপাদন পাবে যা তাদের কাক্সিক্ষত মুনাফা অর্জনে সহায়তা করবে। সুবর্ন রুই মাছটি অন্যান্য কার্প জাতীয় মাছের সাথে একত্রে চাষ করতে হয়, নিচে যেভাবে সুবর্ন রুই চাষ করলে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়া যায় সে সর্ম্পকে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
পুকুর নির্বাচন : সুবর্ণ রুই ও অনান্য কার্পজাতীয় মাছ একত্রে চাষ করার জন্য এমন একটি পুকুর নির্বাচন করা প্রয়োজন যার আয়তন ১-৩ একরের মধ্যে হয়, যার গড় গভীরতা ৫-৮ ফিট ও পাড়ের ঢালুত্ব ১.৫ঃ১.০ হলে ভাল। যে পুকুরটি নির্বাচন করা হবে সেটি যেন বন্যামুক্ত হয় এবং পুকুরটিতে যেন কমপক্ষে দিনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় রোদ পড়ে এবং পুকুরটিতে যাতায়াতের সুব্যবস্থা থাকে।
পুকুর প্রস্তুতি/মজুদ পূর্ববর্তী ব্যবস্থাপনা :  কার্পজাতীয় মাছের চাষ করার জন্য শুরুতেই পুকুরটি শুকিয়ে নিতে পারলে ভালো হয়। পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে পুকুরের সকল আগাছা দূর করতে হবে। যদি সম্ভব হয় পুকুরের সকল রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করার জন্য রোটেনন ব্যবহার করা যেতে পারে (২৫ গ্রাম/শতাংশ/৫ ফিট পানি)। পুকুরের পানির ঘোলাত্ব দূরীকরণ, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, পানির গুণগত মান  বজায় রাখা ও জীবাণু ধ্বংস করতে গড় গভীরতা ৫-৬ ফিট হলে শতাংশ প্রতি ১ কেজি চুন, ৫০০ গ্রাম লবণ ও ১০ গ্রাম পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট একত্রে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। চুন প্রয়োগের  ২-৩ দিন পর পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য শতাংশ প্রতি ৩৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৩৫০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের ২ দিন পর থেকে পুকুরে পানি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং দেখতে হবে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হচ্ছে কিনা এ কাজটি করার জন্য সেকি ডিক্স ব্যবহার করা যেতে পারে সম্ভব না হলে হাতের তালুতে নিয়ে বা স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসে পুকুরের পানি নিয়ে দেখতে হবে যে পানিতে সুজি দানার মত কোন কিছু পরিলক্ষিত হয় কিনা, যদি হয় বুঝতে হবে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন হয়েছে  এবং এখন মাছ মজুদ করা যাবে।
মজুদ কালীন ব্যবস্থাপনা : সুবর্ন রুই একক চাষ ও মিশ্র চাষ দুটোই করা সম্ভব তবে জলাশয়ের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে মিশ্্র চাষ করলে ভাল ফলাফল পাওয়া সম্ভব। সুবর্ন রুই মাছের পোনার জন্য বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রদত্ত পোনা নিয়ে যারা নাসিং করেছে বা যারা বিএফআরআই হতে ব্রুড নিয়ে পোনা উৎপাদন করেছে তাদের নিকট থেকে পোনা সংগ্রহ করলে প্রজাতির বিশুদ্ধতা পাওয়া যাবে যা চাষির কাক্সিক্ষত উৎপাদন পেতে সহায়তা করবে। মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে সকল পোনার গড় ওজন ২৫০ গ্রামের উর্ধ্বে হলে ভাল ফলাফল পাওয়া সম্ভব। মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে সুবর্ন রুইয়ের সাথে কাতলা, মৃগেল, গ্রাস কার্প, সিলভার/বিগহেড কার্প, কালিবাউস একসাথে চাষ করা যায়। মিশ্র চাষের ক্ষেএে পুকুরের সর্বমোট যত পোনা মজুদ করা যাবে তার ৩৫-৪০ শতাংশ সুবর্ণ রুই ছাড়লে ভাল ফল পাওয়া যাবে। 
মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা : পোনা মজুদের পর থেকে চাষকালীন পুরো সময় নি¤েœাক্ত বিষয়গুলি যথাযথ অনুসরণ করতে হবে-
খাবার ব্যবস্থাপনা : রুইজাতীয় মাছের মিশ্্র চাষের ক্ষেত্রে ভাসমান ও ডুবন্ত উভয় প্রকার খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে তবে সর্বপ্রথম খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করে নিতে হবে। রুইজাতীয় মাছ চাষে ২২-২৩% আমিষযুক্ত খাবার মজুদকৃত মোট মাছের দৈহিক ওজনের ৩-৪% হারে মজুদ পরবর্তী সময় থেকে প্রয়োগ করতে হবে। খামারি যদি ৭০% ভাসমান খাবার ও ৩০% ডুবন্ত খাবার খাওয়ান তাহলে ভাল ফল পাবেন। খেয়াল রাখতে হবে যে টার্গেট প্রজাতি সুবর্ণ রুই যেন পুকুরের মাঝের স্তরের খাবার খায়। যদি ডুবন্ত খাবার দেওয়া হয় তাহলে পুকুরের পানির ১ ফিট নিচে ট্রে স্থাপন করে তাতে ডুবন্ত খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে তাহলে একদিকে খাবার কম নষ্ট হবে অন্যদিকে মাছের সঠিক পুষ্টি সরবরাহ করা যাবে। মাছের খাদ্য সাধারণত দিনের ২ সময়, সকাল ও বিকেল বেলা প্রয়োগ করতে হবে তবে আবহাওয়ার উপর খেয়াল রেখে খাবার প্রয়োগ করা উচিত। 
চুন ও সার প্রয়োগ : অনান্য কার্প জাতীয় মাছের মত সুবর্ন রুই মাছেও ক্ষত রোগের সম্ভাবনা আছে তাই পুকুরের পানির জীবাণু ধ্বংস ও পানির গুণগত মান অক্ষুণœ রাখার জন্য নিয়মিত (মাসে একবার চুন ৪৫০ গ্রাম, লবণ ৩০০ গ্রাম ও পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট ১০ গ্রাম/ শতাংশ/৫-৬ফিট পানি) চুন ও লবণ   প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পানির পি এইচ জেনে প্রয়োগ করতে হবে। যেহেতু সুবর্ন রুই মাছ অনান্য কার্প মাছের সাথে একত্রে চাষ করা হবে তাই প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রতি মাসে একবার শতাংশ প্রতি সরিষা খৈল ৩.৫ কেজি, ইউরিয়া ৩৫০ গ্রাম ও টিএসপি ৩৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে  পানির রং ও অনান্য প্যারামিটারের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে যাতে অধিক পুষ্টির কারণে পানির রং পরিবর্তন বা ব্লুম তৈরি না হয়।
নিয়মিত নমুনায়ন : মাছ মজুদ করার পর থেকে ১৫ দিন পরপর অথবা মাসে অন্তত একবার জাল টেনে মাছের দৈহিক বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী খাবার সিডিউল তৈরি করতে হবে। মাছের নমুনায়ন না করলে মাছের খাদ্যের হিসাব করা সম্ভব নয় এবং মাছ কোন রোগে আক্রান্ত হলো কিনা তা জানা ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে না। নিয়মিত জাল টানলে যেমন মাছের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা যায় তেমনি জাল টানার সময় মাছের চাঞ্চল্য বৃদ্ধি পায় যা মাছের দৈহিক বৃদ্ধিতে সহায়ক পাশাপাশি পুকুরে জাল টানলে মাটি ও পানির পুষ্টিমান মিলিত হয় ও মাছের শরীরে কোন পরজীবী লেগে থাকলে তা খুলে পরে।
ঔষধ প্রয়োগ : মাছের নমুনায়ন করার সময় কোন রোগ পরিলক্ষিত হলে সে অনুযায়ী ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে পাশাপাশি মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও দৈহিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য প্রতি কেজি খাবারের সাথে ৫ গ্রাম ভিটামিন সি ও ১ মিলি ভিটামিন বি- কমপ্লেক্স ব্যবহার করা যেতে পারে ১৫ দিন পর পর। মাছের লিভার ঠিক রাখার জন্য ও হজম প্রক্রিয়া বৃদ্ধির জন্য প্রতি কেজি খাবারের সাথে ২ গ্রাম গাট প্রোবায়োটিক, ৩ মিলি কালোজিরার তেল ও ২ মিলি রসুনের জুস ১৮-২০ দিন অন্তর অন্তর ব্যবহার করা যেতে পারে।
মাছ আহরণ : কার্পজাতীয় মাছের সাথে সঠিক ঘনত্ব মেনে মজুদ করলে এবং মাছের পুষ্টি চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করতে পারলে সুবর্ন রুই এক বছর চাষ করলে ৩-৪ কেজি পর্যন্ত ওজন হতে পারে। কাতলা, কালিবাউস, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্পসহ অন্যান্য মাছের সাথে সুবর্ন রুই মাছের উৎপাদন যদি ৩০-৩৫ শতাংশ বেশি হয় তাহলে খামারির মোট উৎপাদন বাড়বে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের সুবর্ন জয়ন্তীতে উদ্ভাবিত সুবর্ন রুই মাছ চাষ করলে আমাদের  দেশের মাছের মোট উৎপাদন বাড়বে যা শুধু চাষি বা খামারির অর্থনৈতিক উন্নতিতে সহায়তা করবে ন্ াবরং দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট ইকোনমিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ফিশারিজ, একোয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৭৪৫৬২৬১৫৩, ই-মেইল : ranadof@gmail.com

বিস্তারিত
ডিমের খোসার ব্যবহার

ডিমের খোসার ব্যবহার
মোঃ আকতার হোসেন
ডিমকে বলা হয় সুপার ফুড। আমাদের দেশে ডিমের বাৎসরিক প্রাপ্যতা মাথাপিছু ১৩৬ টি। বর্তমানে দেশে ডিমের বাৎসরিক চাহিদা এক হাজার ৮০৬ কোটি পিস আর ডিমের বার্ষিক উৎপাদন দুই হাজার ৩৩৭ কোটি পিস। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতিটি মানুষের বছরে ন্যূনতম ১০৪ টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। 
ডিমের পুষ্টির পাশাপাশি ডিমের খোসার পাউডার প্রাকৃতিক ক্যালসিয়ামের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এই ডিমের খোসাতে ৬.১৭ গ্রামের মধ্যে ক্যালসিয়াম থাকে ২.২৮ গ্রাম এবং ফসফরাস ০.০০৬ গ্রাম। ডিমের খোসাতে ২% পানি এবং ৯৮% শুষ্ক পদার্থ থাকে। এই ৯৮ ভাগ ড্রাই মেটারের মধ্যে ৫% থাকে ক্রুড প্রোটিন এবং ৯৩% অ্যাশ। সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি ডিমের খোসাতে প্রায় ৪০% ক্যালসিয়াম থাকে আর এটা থাকে মূলত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট হিসেবে। একজন মানুষের জন্য দৈনিক ক্যালসিয়াম প্রয়োজন হয় প্রায় ১ গ্রাম। আর ১টি ডিমের খোসা হতে পাওয়া যায় ২ গ্রামের এরও বেশি ক্যালসিয়াম। 
ব্রয়লার ব্রিডার হতে প্রাপ্ত ভাল মানের ডিমের খোসায় ২-২.২ গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট ক্রিস্টাল আকারে। আদর্শ ডিমের খোসাতে প্রায় ০.৩% ফসফরাস, ০.৩% ম্যাগনেসিয়াম এবং সামান্য পরিমাণে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন ও কপার থাকে। ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের জন্যই ডিমের খোসা শক্ত অনুভূত হয়ে থাকে। বিশুদ্ধ ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের তুলনায় ডিমের খোসা হতে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম দেহে অধিক হারে শোষিত হয়। পশুপাখির খাদ্যে ডিমের খোসা ব্যবহার করা যায়(Oliveira,D.A.et al.(2013) A literature review on adding value to solid residues: egg shells. Journal of Cleaner Production, Amsterdam, v.46, p.42-47, 2013.)| 
ডিমের খোসার গুঁড়া ডিম সিদ্ধ করার পর ছাড়ানো খোসা হতে তৈরি করা হয়। এটি গাছে ক্যালসিয়াম সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। ডিমের খোসার গুঁড়া দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের সাথে মাটিতে পিএইচ বাড়ায়। ছাদবাগান থেকে শামুক তাড়াতে ডিমের খোসা কার্যকর। অর্ধেক করে ভাঙ্গা ডিমের খোসা গাছের টবে রেখে দিলে তাতে করে শামুক আহত হয়ে টব ত্যাগ করে। টবের তলায় ডিমের খোসা দেয়া হলে পানি নিষ্কাশনের কাজ সহজ হয়। ৫০% মাটি, ২৫% ভার্মি কম্পোস্ট ও ২৫% ডিমের খোসা দিয়ে টবের মাটি তৈরি করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। টবের গাছের গোড়া মালচিং করতে ডিমের খোসা কার্যকর উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ৫ মিলিলিটার ভিনেগার, ৫ গ্রাম ডিমের খোসার পাউডার এর সাথে মিশিয়ে আধা ঘণ্টা রেখে দিয়ে সেই পানি দুই লিটার পানির সাথে মিশিয়ে গাছে প্রয়োগ করলে গাছ পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাবে। 
মুরগির ডিমের খোসার রাসায়নিক গঠনের সাথে অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের মিল রয়েছে। ভারতের গুজরাট প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সিভিল প্রকৌশল বিভাগের গবেষণায় নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত সিমেন্টের কাঁচামাল হিসেবে ১০% পর্যন্ত ডিমের খোসার পাউডার ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। সয়েল স্টেবিলাইজেশনের কাজেও ডিমের খোসার পাউডার ব্যবহার করা যায়। দেয়ালের টাইলস তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ভারত ও ব্রাজিলে ডিমের খোসার পাউডার ব্যবহার করার কাজ চলছে। সয়েল স্টেবিলাইজার হিসেবে ৩% পর্যন্ত ডিমের খোসার পাউডার টাইলসের কাঁচামালের সাথে ব্যবহার করা যায়। টুথ পেস্টেও এটা ব্যবহার করা যায়। (Gajera, et.al.2015. A review of utilization of Egg Shell Waste In Concrete and Soil Stabilization. INDIAN JOURNAL OF APPLIED RESEARCH,3(1):67-69, ISSN - 2249-555X)|
মানুষের খাবার হিসেবে স্যুপ, তরল পানীয়, বিস্কুটে ডিমের খোসার পাউডার ব্যবহার করা হয়। মিসরের কৃষি গবেষণা সেন্টারের সুপারিশ অনুসারে বিস্কুট প্রস্তুতের জন্য ব্যবহৃত কাঁচামাল ময়দার সাথে ৬% পর্যন্ত ডিমের খোসার পাউডার ব্যবহার করা হলে এর স্বাদ, গন্ধের কোন তারতম্য হয় না অধিকন্তু ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। চকোলেট কেকের সাথেও এটা ব্যবহার করা যায়। হাইড্রক্সি এপাটাইট এর মতো গুরত্বপূর্ণ উপাদান ডিমের খোসা হতে সিনথেসিসের মতো গবেষণা ব্রাজিলে চলমান রয়েছে। হাইড্রক্সিএপাটাইট হলো ক্যালসিয়াম এপাটাইটের একটি  প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন খনিজ ফর্ম। ক্যালসিয়াম ফসফেট মিনারেল বা হাইড্রক্সিএপাটাইট বা হ্যাপ এর সাথে মানুষের হাঁড় ও হার্ড টিস্যুর উপাদানের মিল রয়েছে।
ডিমের খোসার ভিতরের দিকের সাদা মেমব্রেন পৃথক করে ডিমের খোসা ফুটন্ত পানিতে ২০ মিনিট ফুটিয়ে ৩ দিন রোদে পুরোপুরি শুকিয়ে পাউডার করে বিউটি পার্লারে ফেইস প্যাক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একটি ডিমের সাদা অংশ তার সাথে ৩ গ্রাম ডিমের খোসার পাউডার ও এক চা চামচ মধু বা গোলাপজল এই তিনটি উপাদান মিশিয়ে ফেইস প্যাক তৈরি করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে ডিমের খোসার পাউডার প্রস্তুত করার জন্য ১০ লিটার পানিতে ৫০ মিলিলিটার ভিনেগার মিশিয়ে সেই পানিতে ১০ মিনিট ডিমের খোসা চুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর ২০ মিনিটের জন্য ফুটন্ত পানিতে রাখতে হবে। তারপর সেখান থেকে ডিমের খোসা নিয়ে রোদে পূর্ণরূপে শুকিয়ে তারপর পাউডার করতে হবে। 
উল্লেখ্য, পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের তথ্য অনুসারে ২০২৩ সালে সাধারণভাবে প্রতিদিনের ডিমের চাহিদা ৪ কোটি আর উৎপাদন হয় ৫ কোটি অর্থাৎ দেশে ডিমের কোনো সংকট নেই। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ বাস্তবায়নে জনপ্রতি ডিমের প্রাপ্যতা বছরে ১৬৫ টি নির্ধারণ করা হয়েছে আর আমাদের রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে ২০৮টি ডিম/বছর/জন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। 
সুতরাং ডিমের উৎপাদনের পাশাপাশি ডিমের খোসার পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে (যেহেতু ডিমের খোসার ওজন ডিমের ওজনের ১১ শতাংশ)। তাছাড়া ডিমের খোসার বৈচিত্র্যময় উপযোগিতা ও বহুমুখী ব্যবহার পরিবেশ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই ডিমের খোসাকে আবর্জনার স্তূপে না ফেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগানো যেতে পারে।

লেখক : প্রশিক্ষক (প্রাণিসম্পদ), ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৬৩৬৩২৪৬৬, ই-মেইল :3800sb@gmail.com

বিস্তারিত
গ্রামীণপর্যায়ে উন্নতমানের বীজের চাহিদা পূরণে কৃষকদের উদ্যোগ

গ্রামীণপর্যায়ে উন্নতমানের বীজের চাহিদা 
পূরণে কৃষকদের উদ্যোগ
ধীবা রানী রায়
‘বীজ আনো খুঁজি
নয় যাবে পুঁজি’- খনার বচন
বীজ ফসল উৎপাদনের অন্যতম হাতিয়ার। বীজ ব্যতীত শস্য উৎপাদন অসম্ভব। এক কথায় সভ্যতা টিকে থাকার অন্যতম হাতিয়ার বীজ। উন্নত জাতের বীজ- যেই বীজ যা প্রচলিত জাতের চেয়ে ভালো ফলন দেয় অথবা বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা সহনশীল (ঝঃৎবংং ঃড়ষবৎধহঃ) হচ্ছে উন্নত কৃষির অন্যতম বাহক। বর্তমান সময়ে ভালো বা উন্নত বীজের সংকট কৃষি অগ্রগতির জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রাম বাংলায় বীজ সংরক্ষণের ইতিহাস রয়েছে। কৃষক নিজে বীজ সংরক্ষণ করত পরবর্তী মৌসুমে বপনের জন্য। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে বীজের বাণিজ্যিকীকরণ এর হাত ধরে কৃষকের কাছে সুফলের সাথে এনেছে বিপদ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হচ্ছে চকচকে মোড়কের আড়ালে নিম্নমানের বীজের কারণে। বিশেষ করে অসচেতন গরিব কৃষক। এজন্য গ্রামীণ পর্যায়ে উন্নত মানের বীজের চাহিদা পূরণে প্রয়োজন কৃষকদের উদ্যোগ। 
তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার মৌলভীপাড়ার আরিফ হোসেনের গল্প একরকমই একজন বীজ উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার। আরিফ হোসেন, পিতা : মৃত: মর্তুজা আলী। কম বয়সেই পিতৃহারা আরিফ আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী একজন মানুষ। 
কৃষিতে নতুন কিছু করার আগ্রহ তার সব সময়। তারাগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ ও সহযোগিতায় বীজ উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার গল্প এবার শুনি। সাধারণ খোরপোষ কৃষির চেয়ে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করার কৃষিকে লাভজনক করার উদ্দেশ্যে বীজ বিক্রয় ব্যবসাকে গ্রহণ করে আরিফ হোসেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণে একজন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে প্রদর্শনী প্রদান করা হয় আরিফকে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকপর্যায়ে ধান, গম, পাটবীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের সহযোগিতায় তাকে ৫ একর জমিতে রোপা আমন ধানের প্রদর্শনীর বীজ, সার, বীজ সংরক্ষণের পাত্র, কোকুন, ওজন মেশিন, বীজ উৎপাদন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণসহ সকল সহযোগিতা প্রদান করা হয়। উক্ত প্রকল্পের সহযোগিতায় তিনি বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির সনদ প্রাপ্ত কৃষক।
মাঠে বীজ উৎপাদন কীভাবে করেছেন প্রশ্নের উত্তরে বীজ উদ্যোক্তা আরিফ জানান, গ্রুপে সবার সহযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমনের বীজ উৎপাদন করে। বীজের মান সঠিক রাখতে বীজ শোধন, আদর্শ বীজতলায় বপন, সারিতে রোপণ, আগাছা দমন, বালাইনাশক স্প্রে, বিজাত বাছাইসহ সকল কার্যক্রম নিষ্ঠার সাথে পালন করে। এভাবে সয়ার ব্লকের সাথে সাথে পুরো তারাগঞ্জ উপজেলার ভালো বীজের উৎস হিসেবে আরিফ পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। রোপা আমন ধান বীজের চাহিদা দেখে অন্যান্য মৌসুমেও বীজ ধান উৎপাদনের প্রতি উৎসাহ বোধ করেন। 
তিনি রোপা আমনের আধুনিক জাত ব্রি ধান৮৭, বিনাধান-১৭, ব্রি ধান১০৩ এর বীজ উৎপাদন করে বিক্রয় করে। এ ছাড়া বোরো মৌসুমের উন্নত জাত ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, বঙ্গবন্ধু ধান ১০০, ব্রি ধান১০২ এর বীজ উৎপাদন ও বিক্রয়ের সাথে জড়িত। শুধুমাত্র গত এক বছরে আমন ধান বীজ, বোরো ধান বীজ বিভিন্ন ক্রেতার কাছে বিক্রয় করে লাভের পরিমাণ সারিণ দ্রষ্টব্য। শুধু ধান বীজ নয়, আরিফ আলু বীজ উৎপাদন ও বিক্রয় করে থাকেন।
বীজের ব্যবসা আরিফের জীবনে নতুন ধারা নিয়ে এসেছে। একই সাথে তার আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার  কৃষকের জন্য তিনি নির্ভরশীলতার নাম হয়েছেন। 
তারাগঞ্জ উপজেলার বীজের চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য উপজেলা এবং এমনকি অন্যান্য বীজ বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে বীজ সরবরাহ করে থাকেন। বর্তমানে আরিফ তার বীজ ব্যবসাকে আরো বর্ধিত করার জন্য জমি লিজ নিয়ে ধান বীজের পাশাপাশি অন্যান্য বীজ উৎপাদন ও বিক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছেন। আরিফসহ অন্যান্য  কৃষকের সকল উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে পাশে আছে উপজেলা কৃষি অফিস, তারাগঞ্জ।

লেখক : অতিরিক্ত কৃষি অফিসার, তারাগঞ্জ, রংপুর। মোবাইল : ০১৭৩৭৮৩৫৭৮০, ই-মেইল : dhiba92dhiba@gmail.com

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর

কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন

নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন। 
সবুজ আলম, উপজেলা : রায়পুরা, জেলা : নরসিংদী
প্রশ্ন : খিরা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে এবং হলুদ হয়ে পচে ঝরে যাচ্ছে। এ অবস্থায় করণীয় কী?
উত্তর : খিরায় সাধারণত মাছি পোকার আক্রমণে এই ধরনের লক্ষণগুলো দেখা যায়। স্ত্রী মাছি কচি ফলের নিচের দিকে ওভিপজিটর ঢুকিয়ে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার স্থান থেকে পানির মতো তরল পদার্থ বেরিয়ে আসে যা শুকিয়ে বাদামি রঙ ধারণ করে। ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের শাস খেতে শুরু করে এবং এতে ফলের আকার বিকৃত হয়ে যায় এবং ফল হলুদ হয়ে পঁচে ঝড়ে যায়। এই রোগে আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ফল বা ফুল সংগ্রহ করে ধ্বংস বা পুড়ে ফেলতে হবে। কচি ফল কাগজ বা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। প্রথম ফুল আসা মাত্র প্রতি ১০ শতাংশের জন্য ৩টি হারে ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। আম বা খেজুরের রসে সামান্য বিষ মিশিয়ে তা বোতলে রেখে জানালা কেটে দিয়ে ক্ষেতের মাঝে মাঝে স্থাপন করা যায়। এ ছাড়া কুমড়াজাতীয় ফল ১০০ গ্রাম কুচি কুচি করে কেটে তাতে সামান্য বিষ যেমন : সপসিন  ০.২৫ গ্রাম (আইসোপ্রোকার্ব) মিশিয়ে তা দিয়ে বিষটোপ তৈরি করে মাটির পাত্রে করে ক্ষেতের মাঝে মাঝে স্থাপন করা যায়। সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ১ মিলি./লি. হারে পানিতে মিশিয়ে ক্ষেতে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পর পর ৩ বার।
গফুর মিয়া, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : ধানের পাতায় লালচে রঙ এর দাগ দেখা যাচ্ছে এবং সম্পূর্ণ পাতাই বাদামি রংয়ের হচ্ছে। এখন কি করতে পারি?
উত্তর : ধানের পাতার লালচে রেখা রোগ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। এই রোগ সাধারণত পত্র ফলকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রথমে শিরাসমূহের মধ্যে সরু ও হালকা দাগ পড়ে। ক্রমান্বয়ে দাগগুলো বড় হয়ে বাদামি রঙ ধারণ করে। পরবর্তীতে আক্রান্ত ধানের পাতা পুরোটাই বাদামি রঙের হয়ে যায়। এ রোগের দমন ব্যবস্থাপনা হচ্ছে ফসল কাটার পর নাড়া পুড়ে ফেলা। ৫৪ ডিগ্রি সে: তাপমাত্রার পানিতে ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে বীজ ব্যাকটেরিয়ামুক্ত হয়। ক্ষেতের পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার পানি দিতে হবে। পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে (৫-৬ কেজি/বিঘা)। আক্রান্ত গাছে ৫০-১০০ গ্রাম পটাশ সার ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে বিকালে স্প্রে করা। এ ছাড়া প্রতি লিটার পানিতে ৪-৫ গ্রাম কপার অক্সিক্লোরাইড বা ২ গ্রাম চ্যাম্পিয়ন মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে ৭ দিন পর পর ৩ বার।
আলীম হোসেন, উপজেলা : শিবালয়, জেলা : মানিকগঞ্জ
প্রশ্ন : আমের হপার পোকার আক্রমণে করণীয় কী?
উত্তর : পূর্ণ বয়স্ক হপার পোকা ও নিম্ন (বাচ্চা) উভয়ই আমের কচি অংশ মুকুল থেকে রস চুষে খায়। পোকার আক্রমণে মুকুলের ফুল শুকিয়ে যায়। মুকুলের রস চোষার সময় পোকা প্রচুর পরিমাণ মধুরস ছেড়ে দেয় এর ফলে পাতায় শুঁটিমোল্ড ছত্রাক আক্রমণ করে পাতা কালো  বর্ণ করে ফেলে। এ রোগের প্রতিকার হলো বাগান সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। শুধুমাত্র পানি ও জৈব বালাইনাশক স্প্রে করা। ছায়াযুক্ত ও ঘন গাছসমূহ ছাঁটাই করে রৌদ্র চলাচলের ব্যবস্থা করা। আম মটর দানাকৃতির হলেই ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ০.৫  মিলি. হারে, সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. হারে অথবা ডেসিস  ডেল্টামেথ্রিন) ২.৫ ইসি ০.৫ মিলি. হারে সম্পূর্ণ গাছে স্প্রে করতে হবে। আমের পোকার আক্রমণে যেহেতু শুঁটিমোল্ড রোগের আক্রমণ ঘটে তাই এটা দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন: থিওভিট, কুমুলাস ইত্যাদি ব্যবহার্য কীটনাশকের সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
মো: আমিনুল ইসলাম,  উপজেলা : গোদাগাড়ী, জেলা : রাজশাহী
প্রশ্ন : গ্লাডিওলাস ফুলের জাবপোকার আক্রমণ হলে কি করতে হবে?
উত্তর : এদের দমনের প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত  পাতা বা ফুল ছিঁড়ে পোকাসহ ধ্বংস করতে হবে। হলুদ রঙের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া সাবান গুঁড়া ৫ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর (২-৩) বার স্প্রে করেও এ পোকা দমন করা যায়। আক্রমণ বেশি হলে ডাইমেথয়েট গ্রুপের কীটনাশক (পারফেকথিয়ন/মানগর/ টাফব্রার ৪০ ইসি) ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর (২-৩) বার স্প্রে করতে হবে।
তানজিলা, উপজেলা : রংপুর সদর, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : গোলমরিচ চাষে সারের পরিমাণ জানতে চাই।
উত্তর : গোলমরিচ সারের পরিমাণ নি¤েœ দেয়া হলো-
বয়স অনুযায়ী গাছপ্রতি সারের পরিমাণ ও প্রয়োগের  সময় নিচে দেয়া হলো :
সার প্রয়োগ : প্রথমবারের সার প্রয়োগ করতে হবে বর্ষা শুরু হওয়ার পূর্বে অথবা বৈশাখ মাসে (মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে) এবং ২য় বার বর্ষার শেষে অর্থাৎ আশ্বিন (মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবর)। গর্তগুলো (১০-১২) দিন খোলা রাখার পর প্রতি গর্তে ১০ কেজি পচা গোবর ও ২৫০ গ্রাম টিএসপি সার গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে পূর্ণ করে রাখতে হবে।
রাফিদ, উপজেলা : কাহারোল, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : লিচু গাছে মাকড় হলে কি করতে হবে?
উত্তর : ফল সংগ্রহের সময় মাকড় আক্রান্ত পাতা ডালসহ ভেঙ্গে মুড়িয়ে ফেলতে হবে। মাকড়নাশক ভার্টিমেক প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ মিলি পরিমাণে মিশিয়ে নতুন পাতায় ১৫ দিন পর পর (২-৩) বার স্প্রে করতে হবে।
মো: মজিবুর রহমান, উপজেলা : চিরির বন্দর, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : পেঁপের কা- পচে যাচ্ছে কী করণীয়?
উত্তর : পেঁপের কা- পচা রোগ Pythium apheridermatum নামক ছত্রাক দ্বারা হয়। এ রোগের জীবাণুর আক্রমণ হলে চারা গজানোর আগেই বীজ পচে যায়। আক্রান্ত অংশের আঁশ পচে যায় এবং সামান্য বাতাসে গাছ ভেঙ্গে পড়ে। রোগাক্রান্ত চারা দেখামাত্র তুলে ধ্বংস করতে হবে। গাছের গোড়ায় পানি নিকাশের ভাল ব্যবস্থা করতে হবে। বীজতলার মাটি ৫% ফরমালিন দ্বারা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এ রোগের লক্ষণ  দেখা দিলে গাছের কা-ের চারিদিকে ১% বর্দোমিকচার বা কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রুপের ছত্রাকনাশক সালকক্স (০.৪%) বা রিডোমিল গোল্ড (০.২%) স্প্রে করতে হবে।
আব্দুল মুমিন, উপজেলা : ফুলবাড়ী, জেলা : কুড়িগ্রাম
প্রশ্ন : মিষ্টি আলুর গাছ ঢলে পড়ছে, কী করতে হবে?
উত্তর : মিষ্টি আলুর ঢলে পড়া রোগ Fusarium sp. ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগে আলু লতা ঢলে পড়ে। আলুর লতার ভেতরের নালীসমূহ আটকিয়ে গাছের রস সরবরাহ বন্ধ করে। পরবর্তীতে গাছ শুকিয়ে মারা যায়। আক্রান্ত গাছ নষ্ট বা পুড়ে ফেলতে হবে। ব্যাভিস্টিন ৩ গ্রাম প্রতিলিটার পানিতে   মিশিয়ে শোধন করতে হবে। কার্বোডাজিম ১ গ্রাম বা কপার অক্সিক্লোরাইড-৪ গ্রাম প্রতিলিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে ৭ দিন পর পর ৩ বার।
মো: হেলাল উদ্দীন, উপজেলা : আত্রাই, জেলা : নওগাঁ
প্রশ্ন : ঢেড়স গাছের পাতা ছোট, খর্বাকৃতি হচ্ছে এবং শিকড়ে গিঁট রয়েছে, কী করণীয়?
উত্তর : ঢেঁড়সের শিকড়ের গিঁট রোগMelidogyne Javarica কৃমিজনিত রোগ। এ রোগের কারণে শিকড়ে ছোট ছোট গিঁট দেখা যায় এবং আস্তে আস্তে বড় হয়। রোগাক্রান্ত শিকড়ে  সহজেই পচন ধরে। গাছের পতা ছোট, খর্বাকৃতি হয়। এর ফলে গাছ বাড়ে না, ফুল ও ফল ধরে না এবং ফলন কমে যায়। পরিশেষে গাছ মরেও যেতে পারে। আক্রান্ত গাছ দেখামাত্র তুলে ধ্বংস করতে হবে। একই জমিতে বারবার এ ফসল চাষ না করা।  চারা রোপণের ৮-১০ দিন পূর্বে মাটিতে ট্রাইকো কম্পোস্ট হেক্টরপ্রতি ২.৫ টন হিসেবে প্রয়োগ করলে ঢেঁড়সের কৃমিজনিত শিকড় গিঁট রোগ কার্যকরীভাবে দমন করা যাবে।
ফারুক আহমেদ, উপজেলা : আত্রাই, জেলা : নওগাঁ
প্রশ্ন : আমার করলা গাছের পাতায় সাদা পাউডারের মতো আবরণ দেখা যাচ্ছে করণীয় কী?
উত্তর : এটি করলার পাউডারি মিলডিউ রোগ। এই রোগটি odium sp. নামক ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। আক্রমণ বেশি হলে পাতা নষ্ট ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। ফুল ও ফল কম হয়। এই রোগটি দেখা দিলে প্রোপিকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি অথবা সালফার ৮০% (থিয়োভিট) ২ গ্রাম/প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়াও গাছের পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট  করতে হবে।

লেখক : তথ্য অফিসার (উদ্ভিদ সংরক্ষণ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২; ই-মেইল :aklimadae@gmail.com

বিস্তারিত
জ্যৈষ্ঠ-মাসের-কৃষি -(১৫-মে-১৪-জুন)

জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি 
(১৫ মে- ১৪ জুন)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
জ্যৈষ্ঠ মাস। মজার মজার ফলের পাশাপাশি এসময় ফসলের প্রাপ্তিযোগের কারণে কৃষক-কৃষানি ভাইবোনদের মনপ্রাণ আনন্দরসে ভরপুর থাকে। কৃষিজীবী ভাইবোনেরাই কৃষির অগ্রযাত্রার হাতিয়ার। বর্তমান সরকার এর লক্ষ্য কৃষকের পাশে থেকে কৃষকের সাথে থেকে কৃষিকে টেকসই, আধুনিকীকরণ ও স্মার্ট কৃষি গড়ার। আর তাই প্রিয় পাঠক চলুন, এক পলকে জেনে নেই জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি ভুবনের কাজগুলো।
বোরো ধান
জমির ধান শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে ধান সংগ্রহ করে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে সময়, শ্রম ও অর্থসাশ্রয়ী শুকনো বীজ ছায়ায় ঠা-া করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি এসবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। 
আউশ ধান 
এখনো আউশের বীজ বোনা না হয়ে থাকলে অতিদ্রুত বীজ বপন করতে হবে। এখনো আউশের বীজ বোনা না হয়ে থাকলে অতিদ্রুত বীজ বপন করতে হবে। আউশের উচ্চফলনশীল ব্রিধান২১, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪৩, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৬৫, ব্রি ধান৮৩, ব্রি ধান৮৫, ব্রি ধান৯৮, ব্রি ধান১০৬, বিনা ধান ১৯ এসব জাতগুলো চাষ উপযোগী। চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের প্রথম কিস্তি হিসেবে একরপ্রতি ১৮ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এর ১৫ দিন পর একই মাত্রায় দ্বিতীয় কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে জমিতে সার প্রয়োগের সময় ছিপছিপে পানি রাখাসহ জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
আমন ধান
নিচু এলাকায় বোরো ধান কাটার ৭-১০ দিন আগে বোনা আমনের বীজ ছিটিয়ে দিলে বা বোরো ধান কাটার সাথে সাথে আমন ধানের চারা রোপণ করলে বন্যা বা বর্ষার পানি আসার আগেই চারা সতেজ হয়ে ওঠে এবং পানি বাড়ার সাথে সাথে সমান তালে বাড়ে। চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া ছিটিয়ে দিলে চারা তাড়াতাড়ি বাড়ে, ফলন ভালো হয়।
এ মাসের মধ্যেই রোপা আমনের জন্য বীজতলা তৈরি করতে হবে। এ ছাড়াও স্বল্প সময়ে, অধিক জায়গায় ধানের চারা নির্দিষ্ট, দূরত্বে, সারিবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট সংখ্যায়, নির্দিষ্ট গভীরতায় লাগানোর জন্য রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার করা প্রয়োজন। এ যন্ত্র দ্বারা চারা রোপণের জন্য ট্রে অথবা পলিথিন সিটের উপর চারা উৎপাদন করতে হয়। ৩-৪ পাতা বিশিষ্ট ২০-২২ দিন বয়সের চারা এ যন্ত্রের সাহায্যে জমিতে রোপণ করা যায়। জমি উর্বর হলে সাধারণত কোনো রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না, তবে অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি জৈবসার মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি বর্গমিটার জমির জন্য ৮০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। 
বীজ বোনার আগে অংকুরিত করে নিলে তাড়াতাড়ি চারা গজায়, এতে পাখি বা অন্য কারণে ক্ষতি কম হয়। ভালো চারা পাওয়ার জন্য বীজতলায় নিয়মিত সেচ দেয়া, অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করা, আগাছা দমন, সবুজ পাতাফড়িং ও থ্রিপসের আক্রমণ প্রতিহত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সতর্কতার সাথে করতে হবে। 
জ্যৈষ্ঠ মাসে আউশ ও বোনা আমনের জমিতে পামরী পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। পামরী পোকা ও এর কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে গাছের অনেক ক্ষতি করে। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতজাল, গামছা, লুঙ্গি, মশারি দিয়ে পামরী পোকা ধরে মেরে ফেলে আক্রমণ কমানো যায়। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের গোড়া থেকে ৫ সেন্টিমিটার (২ ইঞ্চি) রেখে বাকি অংশ কেটে কীড়া ও পোকা ধ্বংস করা যায়। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
পাট
পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন ও দুর্বল চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে। ফাল্গুনি তোষা জাতের জন্য একরপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে বা দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে হালকা সেচ দিতে হবে এবং বৃষ্টির কারণে পানি জমে থাকলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। পাটশাক যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। তাই নিড়ানির সময় তোলা অতিরিক্ত পাটের চারা ফেলে না দিয়ে শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
এ মাসে পাটের বিছাপোকা এবং ঘোড়াপোকা জমিতে আক্রমণ করে থাকে। বিছাপোকা দলবদ্ধভাবে পাতা ও ডগা খায়, ঘোড়াপোকা গাছের কচিপাতা ও ডগা খেয়ে পাটের অনেক ক্ষতি করে থাকে। বিছাপোকা ও ঘোড়াপোকার আক্রমণ রোধ করতে পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমিতে ডালপালা পুঁতে দিলে পোকা খাদক পাখি যেমন- শালিক, ফিঙ্গে এসব পোকা খেয়ে আমাদের দারুণ উপকার করে। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
তুলা
আগামী আষাঢ়-শ্রাবণ মাস তুলাবীজ বপনের উপযুক্ত সময়। আপনার যদি তুলাচাষ উপযোগী উঁচু জমি থাকে এবং আপনি তুলাচাষে আগ্রহী হোন তাহলে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিকটবর্তী অফিস/ইউনিট অফিসে যোগাযোগ করুন।
শাকসবজি
মাঠে বা বসতবাড়ির আঙ্গিনায় গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির পরিচর্যা সতর্কতার সাথে করতে হবে। এ সময় সারের উপরিপ্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, লতাজাতীয় সবজির জন্য বাউনি বা মাচার ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতার ১৫-২০ শতাংশের কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে। 
কুমড়াজাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
এ মাসে কুমড়াজাতীয় ফসলে মাছি পোকা দারুণভাবে ক্ষতি করে থাকে। এ ক্ষেত্রে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এ ছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়। সবজিতে ফল ছিদ্রকারী পোকা, জাবপোকা, বিভিন্ন বিটল পোকা সবুজ পাতা খেয়ে ফেলতে পারে। হাত বাছাই, পোকা ধরার ফাঁদ, ছাই ব্যবহার করে এসব পোকা দমন করা যায়। তা ছাড়া আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে এবং সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। মাটির জো অবস্থা বুঝে প্রয়োজনে হালকা সেচ দিতে হবে। সে সাথে পানি নিকাশের ব্যবস্থা সতর্কতার সাথে অনুসরণ করতে হবে।
বিবিধ
বাড়ির কাছাকাছি উঁচু এমনকি আধা ছায়াযুক্ত জায়গায় আদা হলুদের চাষ করতে পারেন। মাঠের মিষ্টি আলু, চীনাবাদাম বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই তুলে ফেলতে হবে। গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষও এ মাসে করতে পারেন। পতিত বা আধা ছায়াযুক্ত স্থানে অনায়াসে লতিরাজ বা পানিকচু বা অন্যান্য উপযোগী কচুর চাষ করতে পারেন। যারা সবুজ সার করার জন্য ধইঞ্চা বা অন্য গাছ লাগিয়ে ছিলেন, তাদের চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সবুজসার মাটিতে মেশানোর ৭-১০ দিন পরই ধান বা অন্যান্য চারা রোপণ করতে পারবেন।
গাছপালা
আগামী মাসে চারা লাগানোর জন্য জায়গা নির্বাচন, গর্ত তৈরি ও গর্ত প্রস্তুতি, সারের প্রাথমিক প্রয়োগ, চারা নির্বাচন এ কাজগুলো এ মাসেই শেষ করে ফেলতে হবে। উপযুক্ত মাতৃগাছ থেকে ভালোবীজ সংগ্রহ করে নারকেল, সুপারির বীজ বীজতলায় এখন লাগাতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের কল্যাণে ও সফলতার জন্য আমরা এক মাস আগেই আগামী মাসের কৃষির করণীয় দিকগুলো স্মরণ করিয়ে দেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিলে আরও বেশি লাভবান হবেন। এছাড়াও কৃষিবিষয়ক তথ্য জানতে ১৬১২৩ নম্বরে কল করে জেনে নিতে পারেন।

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল : editor@ais.gov.bd

বিস্তারিত