Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কাঁচা কাঁঠালের অপার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

কাঁচা কাঁঠালের অপার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী১ মো. হাফিজুল হক খান২
বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। পুষ্টিগুণে ভরপুর সেই কারণে এটি ফলের মধ্যে গুণের রাজা হিসেবে স্বীকৃত। কাঁঠালে আছে অধিক পরিমাণে আমিষ, শর্করা, বিভিন্ন ভিটামিন যা মানব দেহের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। পুষ্টিবিদদের মতে, কাঁঠালে আছে সাপোনিল ফ্লেবোনয়েড এবং ট্যানিন এই ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা আমাদের বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে রক্ষা করে। যেমন- হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। আমাদের দেশে প্রায় সব এলাকায় কম বেশি কাঁঠাল উৎপাদিত হয়ে থাকে তবে ময়মনসিংহ, রাজশাহী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, যশোর, খুলনা, সুনামগঞ্জ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য ও উৎকৃষ্টমানের কাঁঠাল উৎপন্ন হয়ে থাকে। ভরা মৌসুমে দেশের সর্বত্র আনাচে-কানাচে রাস্তাঘাটের ভ্যানে ও রাস্তার মোড়, ক্ষুদ্র চাষি আড়তদার, পাইকারি, বিক্রেতাদের কাঁঠাল স্তুপ করে বিক্রি করতে দেখা যায়।  বিভিন্ন কাঁঠাল চাষিদের সাথে মতবিনিময় করে জানা যায়, তারা কাঁঠালের প্রকৃত দাম পায় না বলে লাভবান হন না। এ ছাড়াও আমাদের কাঁঠাল বৈশাখ মাসে বেশি উৎপাদিত হয় তাই কম দাম থাকে। বিভিন্ন ফলের ভিড়ে অনেকেই এ ফল খেতে অনীহা প্রকাশ করে। গত কয়েক বছরের তথ্য মোতাবেক, বাজারে উৎকৃষ্টমানের কাঁঠালের অভাব রয়েছে আবার যা পাওয়া যায় তা কৃত্রিম উপায়ে অপরিপুষ্ট কাঁঠালকে পাকানো হয় ফলে গুণগতমানের কাঁঠাল ক্রেতারা পান না। এতে করে অনেকেই এ ফল থেকে বিমুখ হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ অন্যান্য গবেষণা প্রতিবেদনে লক্ষ করা যায়, দেশে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়ে থাকে এবং উৎপাদিত কাঁঠালের শতকরা ২৫ থেকে ৪৫ ভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে নষ্ট হয়। এ অপচয়ের পরিমাণ  টাকার অঙ্কে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার উপরে। কাঁঠালকে কাঁচা থেকে ব্যবহার শুরু করলে বিরাট অপচয় রোধ করা সম্ভব। 
কাঁঠাল সর্বগুণে গুণান্বিত একটি ফল। অন্যান্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি ও পণ্য সম্পর্কে ধারণা বা না জানার কারণে দেশের মানুষ শুধু পাকা কাঁঠালই খেতে পছন্দ করে। কিন্তু কাঁচা কাঁঠালের যে অনেক ব্যবহার আছে এবং এটি দিয়ে বহুবিধ খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা যায়, তা অনেকের নিকট অজানা। তাই কাঁঠাল অপচয়রোধে প্রথমেই গাছ হতে এক-তৃতীয়াংশ কাঁচা কাঁঠাল সংগ্রহ করে বহুমুখী ব্যবহার শুরু করতে হবে। এতে কাঁঠাল চাষির ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতেও সহায়তা করবে। বিজ্ঞানীদের গবেষণা তথ্য মতে, কাঁঠালে যে পুষ্টিগুণ রয়েছে তা অন্য ফলে নেই বা একসঙ্গে পাওয়া যাবে না এবং এর শক্তির পরিমাণ অনেক বেশি। এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবারও রয়েছে। কাঁঠালকে বহুমুখী ব্যবহার করা হলে এটি সহজলভ্য হবে এবং সারা বছর পাওয়া যাবে। বিএআরআই এর উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত কাঁঠালের ৬টি জাত উদ্ভাবন করেছে বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২, বারি কাঁঠাল-৩, বারি কাঁঠাল-৪, বারি কাঁঠাল-৫ ও বারি কাঁঠাল-৬। জাতগুলো আগাম, অসময়, বারোমাসি ও আঠাবিহীন। এতে করে কাঁঠাল চাষি, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা সারা বছরই কাঁঠাল সরবরাহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে সক্ষম হবেন।  এরই মধ্যে কাঁঠালের জাতগুলো হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় (ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী ও খাগড়াছড়ি উল্লেখযোগ্য) বাগান তৈরি করা হয়েছে এবং কৃষককে সরাসরি সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে কাঁচামাল হিসেবে কাঁঠাল বছরব্যাপী সহজলভ্য হবে এবং উদ্যোক্তা ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান কাঁঠালের খাদ্য সামগ্রী তৈরিতে সক্ষম হবে নিঃসন্দেহে। 
পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন ও কৃষি মন্ত্রণালয় এর অর্থায়নে গত ২০১৮ সাল থেকে ৬টিরও অধিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ১২টির উপরে খাদ্যদ্রব্যের উপকরণ তৈরি করেছেন। যেমন-কাঁঠালের ভেজিটেবল মিট বা ফ্রেশ-কাট, রেডি-টু-কুক, রেডি-টু-ইট, ভ্যাকুয়াম ফ্রাইড চিপ্স, কাঁঠালসত্ত্ব, আচার, শুকনো পণ্য, ফ্রোজেন পণ্যসহ সিংগারা, সমুচা, বার্গার, ভেজিটেবল রোল, স্যান্ডউইচ, কাটলেট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ পণ্যগুলো দেশের অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা বাসাবাড়িতে তৈরি করছেন এবং সরাসরি নিকটবর্তী বিপণিবিতান, সুপারশপ,         কৃষকের বাজার ও অনলাইনে বিক্রয় করছেন। কাঁচা কাঁঠালের ফ্রেশকাট বা রেডি-টু-কুক পণ্য তৈরিতে ৫-৬ সপ্তাহের কাঁঠালকে বেঁেছ নিতে হবে। অতঃপর কোষগুলো মাংসের ন্যায় কেটে টুকরো করে ৫০০-৭৫০ পিপিএম পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইট মিশ্রিত পানিতে টুকরোর আকৃতি ও ওজন অনুযায়ী ব্লাঞ্চিং করতে হবে যাতে এনজাইম নিষ্ক্রিয় হয়। অতঃপর স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে ১০-১৫ মিনিটি রেখে পরে মোড়কজাত করতে হবে। এভাবে সংরক্ষণকৃত কাঁচা কাঁঠালের ভেজিটেবল মিট বা ফ্রেশ-কাট পণ্য কুল বক্সে ২-৩ দিন, রেফ্রিজারেটরে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত গুণগতমান বজায় রেখে এবং    ডিপ-ফ্রিজে ৬ মাসের অধিক সময় সংরক্ষণ করা যায়। 
দেশের বাইরে উৎকৃষ্টমানের পরিপুষ্ট কাঁঠাল ও ভেজিটেবল মিট হিসেবে কাঁচা কাঁঠালের চাহিদা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইতালি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল ও যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে। উল্লেখ্য যে, গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ হতে প্রায় ২১০০ মেট্রিক টন কাঁঠাল বিদেশে রপ্তানি করা হয়, যা পূর্বের বছরের চেয়ে কিছুটা কম যেখানে গত ২০২৩ এ বিশ^ব্যাপী কাঁঠালের মার্কেটের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩২৪ মিলিয়ন ইউএস ডলার এবং ২০৩২ এ মার্কেটের সম্ভাব্য পরিমাণ হবে প্রায় ৩৯৬ মিলিয়ন ইউএস ডলার। দেশের বাইরে কাঁঠালের খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকডোনাল্ড কাঁঠালের বার্গার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান শুকনো চিপস, কাঁঠালের বারবিকিউ, জুস ইত্যাদি তৈরি করছে। গতবছর যুক্তরাজ্যের বাজারে ২-৩ কেজি ওজনের একটি কাঁঠাল ২০০-২৩০ পাউন্ডে বিক্রয় হয়েছে বলে দেশে পত্রিকা মারফত জানা যায়। 
কাঁঠালকে বাণিজ্যিকীকরণ করতে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চিপস, রেডি-টু-কুক, ভেজিটেবল মিট, কাঁঠালের বার্গার তৈরি ও বিপণনের উদ্যোগ নিচ্ছে। বিএআরআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্প্রতি পিকেএসএফ এর সহায়তায় সিদীপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৪ লাখ কাঁঠারের বার্গার আইসল্যান্ডের একটি সুপারশপে সরবরাহ করবে বলে জানা গিয়েছে যা উদ্যোক্তাদের মাঝে আশার সঞ্চার সৃষ্টি করেছে। কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে তৈরি করা যাবে বার্গার যেখানে প্রথমেই পেটি তৈরি করতে সিদ্ধকৃত কাঁঠালের কোষের সাথে কর্ণফ্লাওয়ারসহ (৩:২) বিভিন্ন মসলা যুক্ত করতে হবে। গবেষণা তথ্য মোতাবেক, কাঁঠালের বার্গারের পেটিতে প্রতি ১০০ গ্রামে রয়েছে ৯.৭৮ গ্রাম শর্করা, ১০.৮৭ গ্রাম আমিষ, ৮.৪৭ গ্রাম চর্বি, ১৯.৩২ গ্রাম ডায়েটরি ফাইবার ও ১৫৯ কিলোক্যালরি শক্তি যা আমাদের শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে নিঃসন্দেহে। কাঁচা কাঁঠালের ১০০ এর অধিক খাদ্যদ্রব্য ভারতের কেরালায় সারা বছর পাওয়া যায় সেখানে ভেজিটেবল মিট হিসেবে মাংসের বিকল্প হিসেবে খাওয়া হয়। আবার বার্মাতে কাঁঠালের বিরানির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। শ্রীলংকা ও নেপালসহ এশিয়ার অনেক দেশেই কাঁচা কাঁঠালকে খাদ্যদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার অনেক আগে থেকেই প্রচলন আছে। 
কৃষিবান্ধব সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন উদ্যোক্তারা উৎসাহী হচ্ছেন এবং বর্তমানে কাঁঠালের তৈরিকৃত খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়াও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘এক দেশ এক অগ্রাধিকার পণ্য’ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য কাঁঠালকে নির্বাচন করা হয়েছে এবং উক্ত সংস্থা জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও কাঁঠালের প্রযুক্তিগুলো প্রসারের ব্যবস্থা নেয়ার কর্মকা- পরিচালনা করছে। এতে কাঁঠালকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। অধিকন্তু উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, অর্থসহায়তা, যন্ত্রপাতি ও মোড়কজাত দ্রব্য সরবরাহ, কাঁচামাল সহজলভ্য করা, বিপণনের ব্যবস্থা ও রেজিস্ট্রেশন সহজলভ্য করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষকের বাজার সৃষ্টি করার মাধ্যমে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের বিপণনের ব্যবস্থা করা হলে এ প্রক্রিয়াটি আরও গতিশীল হবে। ফলশ্রুতিতে কাঁচা কাঁঠাল পুষ্টির নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
 
লেখক : ১ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞানী ও খাদ্য প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষক, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ই-মেইল:ferdous613@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১২২৭১১৬৩; ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ই-মেইল: cso.pht@bari.gov.bd, ফোন: ০২-৪৯২৭০১৭৬, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১।