Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষি এখন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা। অধিকাংশ জনগণই জীবন জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। এ দেশের আবহাওয়া ও উর্বর জমি সারা বছর ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যত অর্জন আছে, তার মধ্যে ফসলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য। ফসল উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ। কৃষিক্ষেত্রে এ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে বর্তমান সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিকনির্দেশনা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সময়োপযোগী কার্যক্রম পাশাপাশি কৃষি বিজ্ঞানি, কৃষিবিদ, সুশীলসমাজ ও  কৃষকসমাজের নিবিড় অংশগ্রহণে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতিতে এসেছে বৈচিত্র্য। প্রতিকূল আবহাওয়ার পাশাপাশি রয়েছে পোকামাকড়, রোগবালাই ও ইঁদুরের উপদ্রব। আশ্বিন মাস ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময়। ইঁদুর একটি চতুর, সর্বভুক, নিশাচর ও নীরব ধ্বংসকারী প্রাণী। এটি ছোট হলেও ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক। যেকোন পরিবেশে যেকোন খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। প্রতি বছর কৃষকের উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। শুধু ফসল নয়, ইঁদুর মানুষের স্বাস্থ্য পরিবেশ সম্পদেরও ক্ষতি করে। ইকোসিস্টেম রক্ষা করে ইঁদুর প্রতিরোধে কোনো একক পদ্ধতি শতভাগ কার্যকর নয়। ইঁদুর সমস্যা সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে ১৯৮৩ সাল থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে ইঁদুর নিধন অভিযান মাসব্যাপী সারাদেশে একযোগে পরিচালনা করে আসছে। এ বছরও সমন্বিতভাবে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২৩ পরিচালিত হচ্ছে।
ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২৩ উপলক্ষ্যে কৃষি তথ্য সার্ভিস কৃষিকথা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এ সংখ্যায় ইকোসিস্টেম রক্ষা করে ইঁদুর নিধনের তথ্য উপাত্তসমৃদ্ধ প্রবন্ধ, সময়োপযোগী নিবন্ধ, কবিতা ও নিয়মিত বিভাগের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আশা করি  কৃষিকথা সকল স্তরের জনগণকে ইঁদুর নিধন কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। দেশ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে সফলকাম হবে।

বিস্তারিত
সূচিপত্র

৮৩তম বর্ষ ড় ৬ষ্ঠ সংখ্যা ড় আশি^ন-১৪৩০ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০২৩)

সূচিপত্র

নিবন্ধ/প্রবন্ধ
    জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানে জনগণের স্বতঃস্ফূর্র্ত অংশগ্রহণ    ০৩    
    বাদল চন্দ্র বিশ^াস
    জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২৩    ০৪
    মোঃ ফরিদুল হাসান
    শাকসবজি ও ফলে ইঁদুরের ক্ষতির ধরন ও আধুনিক দমন ব্যবস্থাপনা    ০৬    
    ড. মোঃ শাহ আলম
    ইঁদুরের সাথে চিরন্তন লড়াই    ০৯
    মো: মোসাদ্দেক হোসেন, ড. শেখ শামিউল হক, ড. মো: মোফাজ্জল হোসেন
    মানসম্পন্ন বীজ এবং ধানের সংগ্রহোত্তর অপচয় কমাতে হারমেটিক স্টোরেজ      ১১    
    কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন        
    ইঁদুরের প্রজনন মৌসুম    ১৩
    ড. সন্তোষ কুমার সরকার    
    জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ভাবনায় ইঁদুর গবেষণা    ১৪
    ড. মোঃ জাকির হোসেন
    বীজ উৎপাদনে অনুসরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ    ১৫
    ড. মো: আব্দুল মালেক
    সাথী ফসল হিসেবে আমনের সাথে সরিষার আবাদ এবং সরিষার তেলের গুণাগুণ    ১৭
    কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি
    পরিবেশ সুরক্ষায় প্লাস্টিক দূষণ রোধে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার    ১৯
    কৃষিবিদ ড. মোঃ আল-মামুন
    পলিনেট হাউজ আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য কৃষি প্রযুক্তি    ২০
    মোছলেহ উদ্দিন সিদ্দিকী
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ
    মিশ্রচাষে তারা বাইম অধিক লাভের নিশ্চয়তা দেয়    ২১    
    মোঃ তোফাজউদ্দীন আহমেদ
    পোল্ট্রি উৎপাদনে ইঁদুর হুমকি    ২৩
    ডা: মোহাম্মদ মিজানুর রহমান
কৃষির সাফল্য কথা

    আমন ও বোরো মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারে সাশ্রয়ের পরিমাণ প্রায় ২,৭১৪ কোটি টাকা    ২৫    
    তারিক মাহমুদুল ইসলাম
    ইঁদুর দমন করে স্থানীয় কৃষকের বন্ধু হয়েছেন ডুমুরিয়ার এইচ এম সিদ্দিকুর রহমান    ২৬    
     কৃষিবিদ শারমিনা শামিম, মো: আবদুর রহমান
কবিতা
    রোগ ও বালাই
    কে এম বদরুল হক শাহীন
 ক্ষতিকর ইঁদুর    ২৮    
    মোঃ মাজেদুল ইসলাম (মিন্টু)
        ২৮    
নিয়মিত বিভাগ
    প্রশ্নোত্তর    ২৯    
    কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন
    কার্তিক মাসের কৃষি (১৭ অক্টোবর- ১৫ নভেম্বর)    ৩১
    কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম

বিস্তারিত
জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ

জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানে
জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ
বাদল চন্দ্র বিশ^াস
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। বর্তমান সরকারও কৃষিবান্ধব সরকার। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জমি হ্রাসের প্রেক্ষাপটে মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের জন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে দানাজাতীয় শস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি খাদ্যশস্য রপ্তানিও করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ভৌগোলিকভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব বেশি। তবে এত প্রতিকূলতার মাঝেও কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষিবিদ তথা কৃষি বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু দেখা যায় প্রতি বছর কৃষকের উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। ইঁদুর মাঠ থেকে শুরু করে ফসল কর্তনের পরেও গুদামজাত অবস্থায় বা গোলায় তোলার পরও ক্ষতি করে। সুতরাং ইঁদুর আমাদের ফসলের এমন একটি অনিষ্টকারী বালাই যা সর্বাবস্থায় কৃষির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ইঁদুর শুধু  ফসল নয় মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ, সম্পদেরও ক্ষতি করে এবং রোগজীবাণুর বাহক হিসাবে কাজ করে।
ইঁদুর একটি চতুর ও নীরব ধ্বংসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইঁদুর প্রাণীটি  ছোট  হলেও  ক্ষতির  ব্যাপকতা  অনেক। এরা  যে  কোন  খাদ্য  খেয়ে  বাঁচতে  পারে।  যে  কোন  পরিবেশে  মানিয়ে  নিতে  পারে। অল্প  বয়সে  বাচ্চা  দিতে  পারে। ফসলের জন্য ক্ষতিকর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ইঁদুর প্রধান শত্রু। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ইঁদুর অন্যতম একটি সমস্যা। বাংলাদেশে প্রায় ৫-৭ শতাংশ ধান ও ৪-১২ শতাংশ গম ইঁদুর নষ্ট করে । ইঁদুর যতটা না খায় তার চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ নষ্ট করে। প্রতি বছর দেশে ইঁদুরের কারণে গড়ে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়ে থাকে। তাছাড়া ইঁদুর মুরগীর খামারে গর্ত করে, খাবার খেয়ে, ডিম ও বাচ্চা খেয়ে বছরে প্রায় খামার প্রতি ১৮০০০ টাকার ক্ষতি করে।
বেশির ভাগ ইঁদুর গর্তে বাস করে বলে সম্পূর্ণভাবে দমন বা নির্মূল করা সম্ভব হয় না। ইঁদুরের সমস্যা দীর্ঘদিনের। এ সমস্যা পূর্বেও যেমন ছিল, বর্তমানেও রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং অংশগ্রহণ। এককভাবে ইঁদুর নিধন করার পাশাপাশি অন্যদেরকেও ইঁদুর নিধনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। এককভাবে ইঁদুর নিধন করলে সাময়িকভাবে এ সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়, তবে অল্প কিছুদিন পরেই আবার নতুন করে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়। ইঁদুর নিধন অভিযানের সফলতা নির্ভর করে সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপর। ঘরবাড়ি, গুদাম, হাঁস-মুরগির খামার, অফিস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিনিয়ত ইঁদুরের উপস্থিতি যাচাই করে জৈবিক দমন ব্যবস্থাপনাসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় ইঁদুর নিধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আমি জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২৩ এর সার্বিক সাফল্য কামনা করি।

লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ওয়েবসাইট:www.dae.gov.bd

বিস্তারিত
জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২৩

জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২৩
মোঃ ফরিদুল হাসান
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১১.৫২ শতাংশ। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় এই খাতের  ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু  ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি থেকে দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য জোগান বর্তমানে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বন্যা, খরা, ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগবালাই ছাড়াও ইঁদুর প্রতিনিয়তই কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল এর ব্যাপক ক্ষতি করছে। কৃষকসমাজ তাদের সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেখা যায় কৃষকের উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। ইঁদুর মাঠ থেকে শুরু করে ফসল কর্তনের পরেও গুদামজাত অবস্থায় বা গোলায় তোলার পরেও ক্ষতি করে। ইঁদুর যে শুধু ফসলের ক্ষতি করে তা না মানুষেরও ব্যাপক ক্ষতি করে এবং রোগজীবাণুর বাহক হিসেবেও কাজ করে। এ ছাড়া সারাবিশ্বে বর্তমানে পোলট্্ির শিল্প ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১৯৮৩ সাল থেকেই” ইঁদুর নিধন অভিযান” পরিচালনার  মাধ্যমে  কৃষকদের ফসলের মাঠে সময়মতো ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করে আসছে। বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতি বছরই ইঁদুর নিধন কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে।
ইঁদুর খুব চতুরপ্রাণী। এই অনিষ্টকারী মেরুদ-ী প্রাণীটি ছোট হলেও ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক। একটি ইঁদুর প্রতিদিন তার দেহের ওজনের ১০ ভাগ খাদ্য গ্রহণ করে। এরা যা খায় তার ৪/৫ গুণ নষ্ট করে। ইঁদুরের অনবরত কাটাকাটির অভ্যাস রয়েছে। এর সদা বর্ধিষ্ণু দাঁত রয়েছে, ক্ষয়ের মাধ্যমে দাঁতের এই বৃদ্ধিরোধ করার জন্য ইঁদুর সবসময় কাটাকাটি করে। এক গবেষণায় জানা যায় বাংলাদেশে ইঁদুর প্রায় ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। এরা যে শুধু কাটাকুটি করে আমাদের ক্ষতি করে তাই নয়, এরা মানুষ ও পশুপাখির মধ্যে প্লেগ, জন্ডিস, টাইফয়েড, চর্মরোগ, আমাশয়, জ্বর,কৃমিসহ প্রায় ৬০ প্রকার রোগ জীবাণুর বাহক ও বিস্তারকারী। ইঁদুর দ্বারা ফসলের ক্ষতি কমানো গেলে একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অন্য দিকে তেমনি খাদ্যে মলমূত্র ও লোম সংমিশ্রণ বন্ধ করা গেলে স্বাস্থ্য, নিরাপদ খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চিতের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের বিস্তারও কমে যাবে। ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা আপাত খুব কঠিন মনে হলেও সম্মিলিত ও সমন্বিতভাবে সঠিক কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে এদের সংখ্যা কার্যকরভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব।
ইঁদুর  সর্বভুক ও নিশাচর প্রাণী, এরা যে কোন পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপখাইয়ে নিয়ে দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। অনুকূল পরিবেশে এক জোড়া প্রাপ্তবয়স্ক ইঁদুর বছরে প্রায় ১৫০০-২০০০টি বংশধর সৃষ্টি করতে পারে এবং প্রতিবারে ৪-১২টি বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চা প্রসবের ২ দিনের মধ্যেই স্ত্রী ইঁদুর পুনরায় গর্ভধারণ করতে পারে। বছরে প্রায় ৬-৮ বার বাচ্চা দেয়, ইঁদুরই একমাত্র প্রাণী যা যেকোন পরিস্থিতির আলোকে বাচ্চা জন্মদান বাড়াতে বা কমাতে সক্ষম। জন্মের ৪৫-৫০ দিনের মধ্যেই বাচ্চা ইঁদুর পূর্ণবয়স্ক হয়ে প্রজননে সক্ষমতা লাভ করে। দ্রুত বংশবিস্তারকারী স্তন্যপায়ী এ প্রাণীটি আমাদের বিভিন্ন মাঠ ফসলসহ বিভিন্ন ফল ও শাকসবজির মাঠে এবং গুদামে ব্যাপক ক্ষতি করছে। আমাদের বাসাবাড়ির বইপত্র, কাপড় চোপড় আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতি করছে। এর পাশাপাশি বাঁধ, রেললাইন, জাহাজ, বন্দর, অফিস, মাতৃসদন সেচের  নালাসহ  সর্বত্র ইঁদুরের  বিচরণ রয়েছে। ধান উৎপাদনকারী  প্রতিটি দেশে কৃষক, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা ইঁদুরকে গুরুত্বপূর্ণ বালাই হিসেবে বিবেচনা করে। বিভিন্ন দেশে শুধু ধান কর্তন থেকে গুদামে রাখা অবস্থায় ২-২৫ ভাগ পর্যন্ত ইঁদুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বৃষ্টিনির্ভর ও সেচ সুবিধাযুক্ত ধানের জমিতে ফসল কাটার পূর্বে শতকরা ৫-১৭ ভাগ ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গমে ৪-১২ ভাগ, গোলআলুর ৫-৭ ভাগ, আনারসের ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭% এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫% ক্ষতি করে। এ ছাড়া ইঁদুর বর্তমানে পোলট্রি ফার্মে ছোট বাচ্চা ও ডিম খেয়ে ফার্মের মালিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পোলট্রি শিল্পে ইঁদুর দ্বারা ক্ষতির দিকে লক্ষ রেখে মুরগীর খামারিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমনে অংশগ্রহণ করতে হবে। কাজেই স্থানকাল পাত্রভেদে সঠিক কৌশলগত ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করতে হবে এবং এর মাধ্যমে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুর বাহিত রোগ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে।          
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক বিগত পাঁচ বছরে ইঁদুর নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে আমন ফসল রক্ষার পরিমাণ নি¤েœ দেয়া হলো :
ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলাফল
ইঁদুর  নিধন  অভিযান  ২০২৩ এর  উদ্দেশ্য
   কৃষক, কৃষাণী, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি  প্রতিষ্ঠান, আইপিএম/আইসিএম এসব ক্লাবের সদস্য, সিআইজি, ডিএই এর বিভিন্ন কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোসহ সর্বস্তরের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা;
    ইঁদুর দমনের জৈবিক ব্যবস্থাপনাসহ লাগসই প্রযুক্তি কৃষি কর্মীদের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো;
    ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্পকারখানা ও হাঁস-মুরগির খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা;
    আমন ফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে রাখা;
    গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধ করা;
    রাস্তাঘাট ও বাঁধের ইঁদুর নিধনের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা;
    ইঁদুরবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা;
    সম্ভাব্য ক্ষেত্রে গণযোগাযোগ বিশেষ করে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারের ব্যাপারে জোর দেয়া।
অভিযানের সময় ও উদ্বোধন
এক মাসব্যাপী ইঁদুর নিধন অভিযান সারাদেশে একযোগে পরিচালনা করা হয়। জাতীয়পর্যায়ে ইঁদুর নিধন অভিযান, ২০২৩ এর উদ্বোধনের পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অঞ্চল, জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে উদ্বোধন করা হবে। গত বছরের অভিযানের  উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইঁদুর নিধনকারীদের মাঝে পুরস্কার  প্রদান করা হবে। অঞ্চল, জেলাপর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট জেলার সংসদ সদস্য/চেয়ারম্যান, পার্বত্য জেলা পরিষদ/জেলা পরিষদ/প্রশাসক/উপজেলা চেয়ারম্যান/পৌরসভার চেয়ারম্যান/মেয়র অথবা তার মনোনীত ব্যক্তি দ্বারা করতে হবে। উপজেলাপর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য/উপজেলা চেয়ারম্যান/তার মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা করতে হবে।
ইঁদুর নিধনে পুরস্কার প্রদান
জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২ বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয় ও আঞ্চলিক  পর্যায়ে পুরস্কার দেয়া হবে। অঞ্চলে অতিরিক্ত পরিচালকগণ  নিজ  অঞ্চলের পুরস্কার পাবারযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই-বাছাইপূর্বক মনোনয়নের তালিকা সদর দপ্তরে প্রেরণ করেন। পরবর্র্তীতে সদর দপ্তরে প্রেরিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে জাতীয় ও অঞ্চলপর্যায়ের পুরস্কারের প্রাথমিক মনোনয়ন প্রদান করা হয় যা জাতীয় কমিটির মাধ্যমে  চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। জাতীয়পর্যায়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গত বছরের ইঁদুর নিধনকারীদের কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে ০৫টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদান করা হবে। যারা পুরস্কারের  জন্য নির্বাচিত হন তাদের ক্রমানুসারে ১টি ক্রেস্ট, ১টি সনদপত্র ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদান করা হবে।
ইঁদুর জীব বৈচিত্র্যের অংশ হলেও আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং নিরাপদ পরিবেশের জন্য এটি দমন অত্যন্ত জরুরি। ইঁদুরের সমস্যা দীর্ঘদিনের, এ সমস্যা পূর্বেও ছিল, বর্তমানেও রয়েছে। ইঁদুর দমন পদ্ধতি পোকা ও রোগবালাই দমন পদ্ধতির চেয়ে  সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ ইঁদুর অত্যন্ত চতুর এবং এখানে বিষটোপ ও ফাঁদ লাজুকতার সমস্যা রয়েছে। ইঁদুর সর্বদা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য স্থান পরিবর্তন করে তাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সঠিক পদ্ধতি, সঠিক স্থান ও সঠিক সময়ে একযোগে ইঁদুর নিধন করা প্রয়োজন। এককভাবে ইঁদুর নিধন করলে দমন ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও গণচীনে নির্দিষ্ট  দিনে ও নির্দিষ্ট সময়ে এভাবে ইঁদুর নিধন করা হয়। ইঁদুর দমনের বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে সকলকে অবহিত করার জন্য এই পুস্তিকায় ইঁদুর দমন প্রযুক্তি সম্পর্কিত তথ্য সহজভাবে এবং সংক্ষিপ্ত আকারে সংযোজন করা হয়েছে। ইঁদুর দমনের কলাকৌশল অধিক সংখ্যক কৃষকের নিকট পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তার ব্লকের কমপক্ষে ৬০০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন। একা ইঁদুর নিধন করার সাথে সাথে অন্যদেরও ইঁদুর নিধনে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। একা ইঁদুর নিধন করলে সাময়িকভাবে এ সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে, তবে অল্প কিছুদিন পরই আবার অন্যস্থানের ইঁদুর এসে সমস্যার সৃষ্টি করবে। কাজেই ফসল ও সম্পদের ক্ষতিরোধ, জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও দূষণমুক্ত পরিবেশের স্বার্থে ইঁদুর সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ক্ষেত-খামার, বসতবাড়িসহ সর্বত্র ইঁদুরের উপস্থিতি যাচাই করে ইঁদুর দমনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে।

লেখক : পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৭১২২১৮৮৭০  ই-মেইল : dppw@dae.gov.bd

বিস্তারিত
শাকসবজি ও ফলে ইঁদুরের ক্ষতির ধরন ও আধুনিক দমন ব্যবস্থাপনা

শাকসবজি ও ফলে ইঁদুরের ক্ষতির ধরন
ও আধুনিক দমন ব্যবস্থাপনা
ড. মোঃ শাহ আলম
শাকসবজি ও ফলে প্রধানত দুই জাতের ইঁদুর বেশি ক্ষতি করে থাকে যাহা মাঠের কালো ইঁদুর ও গেছো ইঁদুর/ ঘরের ইঁদুর। মাঠের কালো ইঁদুর মাঠ ও গুদামে উভয় স্থানেই গর্ত করে, ফসল কেটে, খেয়ে, গর্তে নিয়ে যায়। গুদামে খেয়ে, পায়খানা প্রশ্রাব ও পশম, মাটি ও শস্যের সাথে মিশিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। গেছো ইঁদুর মাটিতে গর্ত না করে ঘরের মাচায় বা গুপ্ত স্থানে গাছে বাসা তৈরি করে বংশবৃদ্ধি করে।  
সবজিতে ইঁদুরের ক্ষতির ধরন
মিষ্টিকুমড়া, করলা, তরমুজ, বাঙ্গি, লাউ, শসা ইত্যাদি কুমড়াজাতীয় সবজি ক্ষেতে ইঁদুর প্রথমে এলোমেলো ভাবে গর্ত করে মাটি উঠিয়ে ডিবি করে। গাছের লতাপাতা কেটে দেয় ও গর্তে নিয়ে জমা করে। পরবর্তী পর্যায়ে যখন গাছে ফল ধরলে  ইঁদুর ফল খেয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে ও ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়।
এভাবে ইঁদুর সবজি ক্ষেতে ক্ষতি করে থাকে। মাঠের কালো ইঁদুর সবজি ক্ষেতে প্রধানত বেশি ক্ষতি করে থাকে। মিষ্টি মরিচের ও ভাসমান বেডে সবজির অনেক ক্ষতি করে থাকে। গেছো ইঁদুর পেপের চারা গাছেরও ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে।
গোলআলুর ক্ষেতে গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধির সময় ইঁদুর প্রথমে মাঠে ২/১টি গর্ত করে মাটি উপরে উঠিয়ে ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর আলুর মাটির উপরের কা- ও ডগা কেটে  দেয়। আলু ধরার সময় ইঁদুর গাছের শিকড় কেটে দেয়। তার পর আলু যখন বড় হয় তখন ইঁদুর মাটির নিচের আলু গর্ত করে  খেয়ে ও ক্ষতি করে থাকে। সাধারণত ইঁদুর আলুর শতকরা ৫-৭ ভাগ ক্ষতি করে থাকে। মিষ্টিআলুর ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ আলু থেকে বেশি দেখা যায়। মিষ্টিআলুর ক্ষেত লতায় ঢেকে যায় ফলে ইঁদুর প্রচুর সংখ্যক গর্ত করে ডগা ও লতা কেটে গর্তে নিয়ে যায়। ক্ষেতে গর্ত করে মাটির ঢিবি তৈরি করে। অর্ধ পরিপক্ব মিষ্টিআলু কামড়িয়ে খেয়ে ক্ষত সৃষ্টি  করে প্রচুর পরিমাণে ক্ষতি করে থাকে। ফলে মিষ্টিআলুর ফলন কমে যায়। এভাবে ইঁদুর মাঠ ও গুদামে আলু ও মিষ্টিআলুতে ক্ষতি করে থাকে।
ইঁদুর দ্বারা ফল গাছে ক্ষতির ধরন
নারিকেল, কমলালেবু, জম্বুরা, আনারস, পেপে ইত্যাদি ফলে ইঁদুর অনেক ক্ষতি করে। বিভিন্ন ফলের চারা গাছ এবং পরিপক্ব ফলে অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে। পেঁপে ও নারিকেলের চারা ইঁদুর দ্বারা অনেকটা ক্ষতি সাধন হয়।  চারা অবস্থায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০-৫০% পর্যন্ত হয়ে থাকে। কমলালেবু, জাম্বুরা, মাল্টা ফলের শাস খেয়ে ফেলে যার ফলে খাবারের অনুপযোগী ও বাজারমূল্য কমে যায়।
নারিকেলের ক্ষতির নমুনা : সাধারণত গেছো ইঁদুর নারিকেলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। একটি জরিপে দেখা গিয়েছে যে পরিপক্ব নারিকেলের চেয়ে কচি ডাবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। ফলে ডাব ছিদ্র যুক্ত হয়ে যায় এবং গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পড়ে। ফলে নারিকেল পরিপক্ব হতে পারে না এবং ফলন অনেক কমে যায়। বাংলাদেশে দক্ষিণ অঞ্চলে বরিশাল, খুলনায়, নারিকেলের বেশি ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত জরিপে দেখা গেছে গড়ে বছরে গাছ প্রতি ১৫-২০টি নারিকেল ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি বা নষ্ট হয় যার আনুমানিক মূল্য ১৫০০-২০০০ টাকা।
আনারসে ক্ষতির নমুনা : দুই ধরনের ইঁদুর আনারসের ক্ষতি করে থাকে। সাধারণত আনারসের নিচের দিকে যেখান থেকে পাকা আরম্ভ করে সেখান থেকে ২-৩ ব্যসার্ধের বাঁকানো গর্ত করে আনারসের ক্ষতি করে থাকে। ফল বাজারে এর দাম কমে যায় এবং এই আক্রমণের ফলে আনারসের ছত্রাক রোগ হয়ে পচে নষ্ট হয়। এভাবে আনারসে প্রায় শতকরা ৬ -৯ ভাগ ক্ষতি করে থাকে।
সমন্বিত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা  
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুধাবন করা প্রযোজন যে, ইঁদুর দমন একটি পরিবেশগত কৌশল যে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা, কিন্তু কোন প্রজাতিকে ধ্বংস করা নয়। ইঁদুর দমনের সবচেয়ে ভাল উপায় হল, ইঁদুরের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য ও বাসস্থান সম্পর্কে জানা এবং এই সব উপাদান সীমিত করা, যা ইঁদুরের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ইঁদুর দমন পদ্ধতিসমূহকে আমরা সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। (ক) পরিবেশসম্মতভাবে ইঁদুর দমন বা ভৌত ও যান্ত্রিক পদ্ধতি পদ্ধতি (খ) বালাইনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুর দমন বা রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুুর দমন ।
ক) পরিবেশসম্মতভাবে দমন : কোন রকম বালাইনাশক ব্যবহার না করে অর্থাৎ পরিবেশের কোন ক্ষতি না করে ইঁদুর দমনই হলো পরিবেশ সম্মতভাবে ইঁদুর দমন বা ভৌত ও যান্ত্রিক পদ্ধতি পদ্ধতি। বিভিন্ন ভাবে এটা করা যায়। যেমন-
পরিদর্শন ও সজাগ দৃষ্টির মাধ্যমে : ইঁদুর দমনের সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এ সমস্যা সম্মন্ধে সর্বদা সজাগ থাকা যার অর্থ হচ্ছে ঘর বাড়িতে বা ক্ষেত খামারে ইঁদুরের উপস্থিতি, গতিবিধি এবং আক্রমণের তীব্রতার উপর সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং নিয়মিত পরিদর্শন করা। ইঁদুরের উপস্থিতির কোন চিহ্ন দেখা মাত্র তাকে খুঁজে বের করে যে কোন উপায়ে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা উচিত। এ পরিদর্শন কোন এলাকার ইঁদুর দমন পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রতিবন্ধকতা : ধাতব পাত দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে করা যায়। ফল গাছ যেমন : নারিকেল গাছ সহ অন্যান্য গাছে ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে ধাতব পাত দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ফল গাছে সাফল্যজনকভাবে ইঁদুর দমন করা যায়। এ ক্ষেত্রে টিনের পাত লাগানোর পূর্বে গাছকে ইঁদুর মুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব কমপক্ষে ৫ ফুট বা ২ মিটার ব্যবধান হতে হবে। যাতে ইঁদুর অন্য গাছ থেকে ডাল বেয়ে টিন লাগানোর  গাছে না আসতে পারে। নারিকেল, সুপারি গাছসহ ফল উৎপাদনকারী গাছের গোড়া হতে ২ মিটার উপরে গাছের খাঁড়া কা-ের চারিদিকে  টিনের পাত শক্তভাবে আটকিয়ে দিতে হয়। ফলে ইঁদুর গাছের গোড়া (নিচ) থেকে উপরে উঠতে যেয়ে টিনের পাত কিছুটা মসৃন হওয়ার বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফসকে পড়ে যায় ফলে উপরে উঠতে পারে না। এই পদ্ধতি অরাসায়নিক হওয়ায় পরিবেশ দূষণমুক্ত, অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী ও লাভজনক। সাধারণত এ পদ্ধতি ব্যবহারে ১টি নারিকেল গাছে ১৫০-২৫০ টাকা খরচ হয়। একবার টিনের পাত লাগালে ৪-৫ বৎসর পর্যন্ত কার্যকর থাকে।
জৈব নিয়ন্ত্রণ বা পরভোজী প্রাণীর মাধ্যমে ইঁদুর দমন : জীবিত কোনো প্রাণীকে অন্য কোনো জীবিত প্রাণী দ্বারা নিয়ন্ত্রণকেই জৈব নিয়ন্ত্রণ বলে। অন্যান্য প্রাণীর মতো ইঁদুর জাতীয় প্রাণীরও পরভোজী প্রাণী আছে, তন্মধ্যে বিড়াল, বনবিড়াল, কুকুর, খেকশিয়াল, পাতিশিয়াল, বাজপাখী, চিল, পেচা, বেজি, সাপ, গুইসাপ ইত্যাদি প্রাণী ইঁদুর খায়। যদি এ সমস্ত উপকারী পরভোজী প্রাণী মেরে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
নিবিড়ভাবে ফাঁদ পাতার মাধ্যমে ইঁদুর দমন : নিবিড়ভাবে বিভিন্ন রকমের জীবন্ত ও মরন ফাঁদ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা যায়। ফাঁদে ইঁদুরকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্য টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সহজে স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় এমন খাদ্যই টোপ হিসাবে ব্যবহার করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ শুঁটকি মাছ, বিস্কুট, আলু, পাউরুটি ইত্যাদি।
ফাঁদ স্থাপনের কৌশল : সাধারণত যেখানে ইঁদুর দেখা যায় এবং যেখান দিয়ে ইঁদুর চলাফেরা করে যেমন দেয়ালের পার্শ্ব, চালের উপর, গাছের ওপর বা গর্তের কাছাকাছি সেখানে ফাঁদ স্থাপন করা উচিত।
সতেজ গর্তে কাঁচা গোবরের মিশ্রণ দিয়ে ইঁদুর দমন : সতেজ গর্তে গোবরের মিশ্রণ (২০-৩০%) দিয়েও  ইঁদুর দমন করা যায়।
(খ) রাসায়নিক দমন বা ইঁদুর নাশক দিয়ে দমন
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন  (ঈযবসরপধষ ঈড়হঃৎড়ষ গবঃযড়ফ) পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই বহু যুগ ধরে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন চলে আসছে। ইঁদুরনাশক বিষ ক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে রাসায়নিক পদ্ধতিকে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে, (ক) তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ  (খ) বহুমাত্রা বা দীর্ঘমেয়াদি বিষ ।
ক. তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ  : যে সমস্ত বিষ খেলে ইঁদুরের মৃত্যু ঘটায় তাদেরকে তীব্র  বিষ বলা হয়। যেমন- জিংক ফসফাইড, বেরিয়াম কার্বনেট, আরসেনিক ট্রাইঅক্সাইড, ব্রোমেথিলিন ইত্যাদি। একমাত্র ‘জিংক ফসফাইড’ সরকার অনুমোদিত একমাত্রা বা তাৎক্ষণিক বা তীব্র বিষ। বিষটোপ তৈরিও খুব সহজ। তাই অতি সহজে কৃষক ভাইরা জিংক ফসফাইড বিষটোপ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করতে পারে। এই বিষ থেকে তৈরি বিষটোপ খেয়ে ইঁদুর সাথে সাথেই মারা যায়। কিন্তু এই বিষটোপের প্রধান অসুবিধা হলো বিষটোপ লাজুকতা। বিষটোপ ব্যবহারের পূর্বে ২-৩ দিন বিষহীন টোপ ব্যবহার করে ইঁদুরকে টোপ খেতে অভ্যস্ত করে নিলে ইঁদুর দমনে সফলতার হার অনেক বেড়ে যায়। তবে কোনো ক্রমেই পর পর দু-তিন রাত বিষটোপ ব্যবহারের পর ঐ স্থানে এক মাস আর এ বিষ ব্যবহার না করাই ভাল।
(খ) দীর্ঘমেয়াদি বিষ   : যে সমস্ত বিষ খেলে ইঁদুর তাৎক্ষণিকভাবে বিষক্রিয়ায় মারা না গেলেও ধীরে ধীরে অসুস্থ বা দুর্বল হয়ে ২-১৪ দিনের মধ্যে মারা যায় তাদেরকে  দীর্ঘমেয়াদি বিষ বলা হয়। ইঁদুর এ ধরনের বিষ খেয়ে আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে গর্তের ভেতর মারা যায়, সেজন্য মৃত ইঁদুর সচরাচর চোখে পড়ে না। এ ধরনের বিষ খেলে সহসা কোনো আক্রান্ত লক্ষণ ধরা পড়ে না বিধায় পরিবারের অন্য ইঁদুররাও এ ধরনের বিষটোপ খেতে কোনো কুণ্ঠা/দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। ফলে একসাথে অনেক ইঁদুর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ধরনের বিষটোপে বিষটোপ লাজুকতা দেখা যায় না। পরীক্ষামূলকভাবে মাঠে এ জাতীয় বিষ দ্বারা শতকরা নব্বই ভাগ ইঁদুর মারা সম্ভব। এদেশে ল্যানির‌্যাট, রোমা, ব্রোমাপয়েন্ট নামে বিভিন্ন কীটনশকের দোকানে পাওয়া যায়।
বিষটোপ প্রয়োগ পদ্ধতি : মাঠে যেখানে ইঁদুরের উপস্থিতি বুঝা যায় সেখানে বা ইঁদুর চলাচলের রাস্তায় বা সতেজ গর্তের আশেপাশে জিংক ফসফাইড বিষটোপ কোন পাত্রে রেখে দিতে হবে। তাই জমির উপরে বিষটোপ না দিয়ে ৩-৪ গ্রাম বিষটোপ  একটি কাগজ দিয়ে পুঁটলি বেঁধে সতেজ গর্তের মুখ পরিষ্কার করে গর্তের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে হবে। তবে সব সময় লক্ষ রাখতে হবে কাগজটি যেন কখনো মাটির নিচে চাপা না পড়ে। এরপর গর্তের মুখ হালকাভাবে মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে । জমির উপর ও গাছে বিষটোপ ব্যবহারের সময় বেইট স্টেশনের ভেতর প্রয়োগ করলে সফলতা অনেক বেশি হয়।
গ্যাসবড়ি দিয়ে ইঁদুর দমন : বিষটোপ ছাড়া এক প্রকার গ্যাসবড়ি দিয়েও ইঁদুর দমন করা যায়। যেমন-এ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেট বাজারে ফসটক্সিন, কুইকফিউম, কুইকফস, এলুমফস, এগ্রিফস, গ্যাসটক্সিন নামে পরিচিত। ইঁদুর আছে এমন  গর্তের  মুখের মাটি  সরিয়ে  প্রতিটি সতেজ গর্তের ভেতর একটি করে বড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে গর্তের মুখ ভালভাবে বন্ধ করে দিতে হবে।
বেশির ভাগ ইঁদুর গর্তে বাস করে বলে সম্পূর্ণভাবে দমন বা নির্মূল করা সম্ভব হয় না। তাই এদের সংখ্যা কমিয়ে মূল্যবান ফসল রক্ষা করে খাদ্যাভাব দূর করার চেষ্টা করতে হবে। কোন  নির্দিষ্ট  একক  পদ্ধতি  ইঁদুর  দমনের  জন্য  যথেষ্ট নয়। ইঁদুর  দমনের  সফলতা  নির্ভর  করে  সকলের  সম্মিলিত  প্রচেষ্টা এবং বিভিন্ন সময়োপযোগী পদ্ধতি ব্যবহারের  উপর। অতএব, সম্মিলিত এবং সময়োপযোগী দমন পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই ইঁদুরের উপদ্রব কমানো সম্ভব।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, অনিষ্টকারী মেরুদ-ী প্রাণী বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৯১১৮৫৭৫৮৬, ই-মেইল :alamvpd@gmail.com

 

বিস্তারিত
ইঁদুরের সাথে চিরন্তন লড়াই

ইঁদুরের সাথে চিরন্তন লড়াই
মো: মোসাদ্দেক হোসেন১ ড. শেখ শামিউল হক২ ড. মো: মোফাজ্জল হোসেন৩
মানুষের সাথে ইঁদুরের লড়াই বহু বছরের পুরনো। সম্ভবত নব্য প্রস্তর যুগ থেকে চলে আসছে এই লড়াই। এই দুই প্রজাতি সব সময় পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলতে চেয়েছে। উজাড় করে দিতে চেয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে। কিন্তু পরিহাস, তারা বসবাসও করছে সবচেয়ে পাশাপাশি, বলতে গেলে গলায় গলায়। ইঁদুর মানুষকে ধ্বংস করতে চেয়েছে নানা রকম রোগ ছড়িয়ে। ইতিহাসে অন্তত দুবার প্লেগের কবলে পড়ে মানবজাতির প্রায় উজাড় হওয়ার দশা হয়েছিল। প্লেগ ছাড়াও আরও বিচিত্র রকম রোগ শরীরে নিয়ে ঘোরাফেরা করে ইঁদুর।
বর্তমান সময়েও ইঁদুরের উৎপাতে পড়ে নাই এমন মানুষ বোধ হয় খুব কম পাওয়া যাবে। এমন কিছু নেই, যা ইঁদুর নষ্ট করে না। বইপুস্তক, কাপড়চোপড়, দলিল-দস্তাবেজ, বিছানা-বালিশ, খাদ্যশস্য সবকিছুই ইঁদুরের দাঁতের শিকার হয়। কেটেকুটে নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু এসবের অধিকাংশই ইঁদুরের খাদ্য নয়। বরং সে যা খায়, তার চেয়ে নষ্ট করে প্রায় দশগুণ। ইঁদুরের চোয়ালের ওপর-নিচে মিলিয়ে মোট দুজোড়া দাঁত থাকে। একে বলে কৃদন্ত  কৃদন্তের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই দাঁত সবসময় বাড়তে থাকে। এমনকি ইঁদুরের দৈহিক বৃদ্ধি শেষ হয়ে গেলেও এগুলো বাড়তে থাকে । দাঁতগুলো বেশি বড় হয়ে গেলে সেগুলো ইঁদুরের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই দাঁতগুলোকে ব্যবহার উপযোগী রাখতে ইঁদুরকে বাধ্য হয়ে সেগুলো ছোট রাখতে হয়। আর সেগুলোকে ছোট রাখার উপায় হচ্ছে সবসময় কিছু না কিছু কাটাকুটি করা। কোনো বস্তু কাটার ফলে তাদের দাঁতের সঙ্গে সেই বস্তুর ঘষায় দাঁতের দৈর্ঘ্য সবসময় ঠিক থাকে। যে অংশটা বাড়ত, সেটা এই ঘর্ষণে ক্ষয়ে যায়। আর তাতে দাঁতও থাকে ধারালো ও কার্যকরী। তাই ইঁদুর সময় সুযোগ পেলেই কাটাকুটি খেলায় মেতে ওঠে।
ইঁদুর (জধঃ) হলো কর্ডাটা শ্রেণিভুক্ত রোডেনশিয়া (জড়ফবহঃরধ) বর্গের মিউরিডি (গঁৎরফধব) গোত্রের লম্বা লেজবিশিষ্ট একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইঁদুর জধঃঃঁং ও এর নিকট সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি গণের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতি। ইঁদুর সব ধরনের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারে এবং কুমেরু ছাড়া পৃথিবীর স্থলভাগের সর্বত্র  বিস্তৃৃত। সব ধরনের খাদ্যে অভ্যস্ত হওয়ার সামর্থ্য ও অত্যধিক প্রজনন ক্ষমতার দারুণ পরিবর্তনশীল পরিবেশে অভিযোজনে দক্ষতা রোডেনশিয়া বর্গের সাফল্যের মূল কারণ। চোয়ালের পেশীবিন্যাস ও করোটির নানা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে রোডেন্ট বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের তিনটি দলে ভাগ করা হয়: কাঠবিড়ালীসদৃশ, ক্যাভিসদৃশ (গিনিপিগ ও অন্যান্য) ও ইঁদুরসদৃশ। স্তন্যপায়ীদের সর্বমোট প্রজাতির এক-চতুর্থাংশের বেশি তৃতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত। মিউরিডি গোত্রের সহস্রাধিক প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে আছে ১৮টির অধিক প্রজাতির ইঁদুর।
সারা বিশ্বে বছরে ৩০ ভাগ ফসল ইঁদুর দ্বারা ক্ষতির শিকার হয়। ইঁদুররা বার্ষিক ভিত্তিতে বিশ্বের অন্তত এক শতাংশ দানাশস্য ধ্বংস করে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে এই সংখ্যা ৩-৫ শতাংশের উপরে। ভারতে, আনুমানিক ২৫-৩০ শতাংশ ফসল কাটা-পরবর্তী শস্য প্রতি বছর ইঁদুরের কারণে নষ্ট  হয়ে যায়। ভারত মহাসাগরের নিকটবর্তী অন্য দেশগুলোতেও ইঁদুর এখনও একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা মনে করা হয়। ধান কাটার পূর্বেই ইঁদুরের কাছে হারানো ধানের পরিমাণ হলো মালয়েশিয়াতে           ৪-৫ শতাংশ, ফিলিপাইনে ৩-৫ শতাংশ (বিকল্প উৎস ৩০-৩৫ শতাংশ দাবি করে), থাইল্যান্ডে ৬-৭ শতাংশ, ভিয়েতনামে ১০-৩৫ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ৫-৩০ শতাংশ। বাংলাদেশে ইঁদুর ১২ থেকে ১৫ লাখ মেট্রিক টনের অধিক খাদ্যশস্য প্রতি বছর ক্ষতি করে (ডিএই, ২০১৩)। এভাবে ইঁদুর প্রায় সব দেশেই খাদ্য নিরাপত্তাকে বাধাগ্রস্ত করে। ভিটামিন এবং প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবারের ভোক্তা হিসাবে, ইঁদুর প্রায়ই ফসলের ভ্রƒণকে খায় এবং এই প্রক্রিয়ায় অঙ্কুরোদগমের ক্ষমতা এবং পুষ্টিকে ছিনিয়ে নেয়। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে দূষিত করে। ইঁদুর প্রতিদিন প্রায় ২৫ গ্রাম ধান বা চাল খায়। মানুষের এই খাদ্য সরবরাহ গ্রাস করার সময়, ইঁদুররা প্রস্রাব, মল এবং রোগজীবাণু জমা রেখে যায় যা মানুষের জন্য খাদ্যকে অখাদ্য করে।
আমাদের দেশে খাদ্য নিরাপত্তার সাথে ধান ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই ধানকে ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা করা ইঁদুর দমনের প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। বিভিন্ন ধরনের ইঁদুরের মধ্যে কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত মাঠের ইঁদুর ও ছোট লেজযুক্ত ইঁদুর ধানের ক্ষতি করে। এদের মধ্যে কালো ইঁদুর মাঠে ও গুদামে এবং মাঠের বড় কালো ইঁদুর নিম্ন ভূমির জমিতে  বেশি আক্রমণ করে। এই ধরনের ইঁদুরের উপস্থিতি সাধারণত কাদার পদচিহ্ন এবং নালায় গর্ত দ্বারা বুঝা যায়। এই প্রাণীর উপদ্রব মাঠে ধান ফসলের পাশাপাশি কর্তন পরবর্তী গুদামজাতকরণ ও সরবরাহের জন্য বড় ক্ষতির কারণ।
পোকামাকড়ের তুলনায় ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা আপাতত খুব কঠিন মনে হলেও অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় সঠিক জ্ঞান এবং কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে এর সংখ্যা লাগসইভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব।  ইঁদুরের সমস্যা গ্রামের লোকজন সঠিকভাবে বুঝতে পারে না, সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয় কোন পদ্ধতিও পর্যাপ্ত হয় না। তাই ইঁদুর সৃষ্ট এই ক্ষতি স্বাভাবিক হিসেবেই গ্রহণ করে থাকে। গ্রামীণ মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর ইঁদুর কি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা সঠিকভাবে বুঝে সঠিক সময়ে উপযুক্ত দমন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে পারাই বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
যুগ যুগ ধরে, ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা টোপযুক্ত, কৌশলগতভাবে স্থাপন করা ফাঁদ ব্যবহার করে ইঁদুরের সংখ্যা নির্মূল করার চেষ্টা করেছেন। এর ধারাবাহিকতায় এই  উপদ্রব প্রতিরোধের প্রচেষ্টাকে পরিবেশভিত্তিক ইঁদুর ব্যবস্থাপনা (ঊপড়ষড়মরপধষষু-নধংবফ জড়ফবহঃ গধহধমবসবহঃ, ঊইজগ) নামে পরিচিত একটি সিস্টেম হিসেবে  নামকরণ করা হয়েছে, যেখানে ইঁদুর এবং ইঁদুরের আবাসস্থল এবং কৃষি ব্যবস্থাকে বিবেচনা করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ওজজও) এক সময়ের বন্যপ্রাণী গবেষক ড. গ্রান্ট সিঙ্গেলটনের মতে, ইবিআরএম হলো অত্যাবশ্যকীয় সম্পদ-যেমন খাদ্য এবং বাসা বাঁধার জায়গাকে কমানোর একটি প্রচেষ্টা যা ইঁদুরের বছরের পর বছর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। এখানে নিরাপত্তা, আর্থিক লাভ এবং স্থায়ী দমন ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। যদিও সিস্টেমটি এখনও কিছু পরিমাণে ইঁদুরনাশকের উপর নির্ভর করে, এই রাসায়নিকগুলোকে আরও পরিবেশগতভাবে নিরাপদ এবং অ-লক্ষ্য (হড়হ-ঃধৎমবঃ) প্রাণীদের প্রতি বিপদমুক্ত করতে গবেষণা অব্যাহত আছে। আমাদের দেশে ইঁদুর দমনের জন্য মূলত বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ও রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সঠিকভাবে প্রয়োগ না করার কারণে ইঁদুর দমন কার্যক্রম ফলপ্রসূ হয় না। প্রাথমিকভাবে রাসায়নিক বালাইনাশককে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের ফলাফল প্রায়ই ব্যর্থ হয়। ইহার  কারণ হলো সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার না করা, রাসায়নিক বিষে ইঁদুর প্রতিরোধী হয়ে যাওয়া এবং বিষটোপ লাজুকতা দেখা দেওয়া । ফাঁদ ও রাসায়নিক বিষের সাথে সাথে অন্যান্য পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারলে আর্থিক ও পরিবেশগত দিক থেকে ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা টেকসই হবে।
ইঁদুর দমনের পদ্ধতিসমূহকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১) ভৌত ও যান্ত্রিক কলাকৌশলের মাধ্যমে দমন পদ্ধতি ২) রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন এবং ৩) জৈবিক পদ্ধতিতে দমন।
ভৌত ও যান্ত্রিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুরের আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। যেমন- গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলা। ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে এবং মরিচ/খড়/সালফারের ধোঁয়া দিয়ে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলা। জমির আইল চিকন রাখা (যেমন ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি), রোপণ দূরত্ব বাড়ানো। বাঁশের, কাঠের, লোহার ও মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করা। যেমন- কেঁচিকল , বাঁশের কল, বাঁশের ফাঁদ, জীবন্ত ইঁদুর ধরার ফাঁদ, মাটির ফাঁদ। উক্ত ফাঁদগুলো আবার দুই ধরনের-জীবন্ত ও মৃত  ফাঁদ। জীবন্ত ফাঁদ ব্যবহার করে ব্রি-র মাঠে কার্যকরভাবে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। ফাঁদে খাবার হিসেবে ধান বা চালের সাথে নারিকেল তৈলের মিশ্রণ তৈরি করে নাইলন বা মশারির কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে টোপ হিসেবে দিতে হয়। এ ছাড়াও শুঁটকি মাছ, চিংড়ি মাছ, শামুকের মাংসল অংশ ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যাপকভাবে ফাঁদ ব্যবহার কষ্টসাধ্য হলেও ইহার মাধ্যমে ইঁদুরের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। বন্যাপ্রবণ এলাকায় কলা গাছের ভেলার উপর ফাঁদ স্থাপন করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। যখন দলগত বা সামাজিকভাবে বৃহৎ এলাকায় ফাঁদ ব্যবহার করা হয় তখন ইহা খুবই কার্যকরী হয়। ফাঁদ দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় এবং রাসায়নিক ইঁদুরনাশক ব্যবহারের তুলনায় সাশ্রয়ী হয়। যে কোন খাদ্য ও তার অবশিষ্টাংশ অবশ্যই ঢেকে রাখতে হবে, পশুখাদ্য খোলাস্থানে রাখা যাবে না। একই এলাকার ধান ফসল একই সময়ে লাগানো ও কর্তন করতে হবে।
কৃষিক্ষেত্রে অল্প এলাকায় ব্যবহার করা যায়। একটি টোপ  ফাঁদ ফসল (আগাম পাকে) চাষ করে ইঁদুর ঢুকতে না পারে এরকম বেড়া দিয়ে এবং বেড়ার মাঝে মাঝে ফাঁক তৈরি করলে ফাঁকের ভেতরের দিকে এক সাথে অনেক ইঁদুর ধরা পড়ে। এভাবে ইঁদুর খাবারের আকর্ষণে ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করলে ধরা পড়বে। এই পদ্ধতির সফলতা পেতে হলে কাছাকাছি  সময়ে (১৫ দিনের মধ্যে) আশেপাশের সকল কৃষক এক সাথে ফসল লাগাতে হবে। বেড়ার টোপে ফসল আগাম পাকতে হয়। এই টোপ ফাঁদ বেড়া পদ্ধতি তৈরি করতে যে খরচ হবে তা সকল কৃষক ভাগ করে নিলে খরচ কম হয়। কোন এলাকায় প্রতি বছর ইঁদুরের দ্বারা ১০ ভাগের বেশি ক্ষতি হলে ট্র্যাপ ব্যারিয়ার সিস্টেম গ্রহণ করা দরকার।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন, ইঁদুরকে আমাদের পরিবেশের জীববৈচিত্র্য এবং খাদ্য শৃংখলের অংশ বিবেচনা করে ইঁদুর দমন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয় প্রজন্মের ইঁদুরনাশক (ক্লের‌্যাট, ল্যানির‌্যাট, ব্রোমাপয়েন্ট) ব্যবহারে খুব সতর্ক থাকতে হতে হবে। কারণ এই ইঁদুরনাশকগুলোর দীর্ঘস্থায়ী অবশেষ থাকা এবং কোষকলায় সঞ্চয়নের কারণে আমাদের পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিশেষ করে পাখির জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি তৈরি করে।

লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মোবাইল : ০১৭১২৬২৬৪৫০, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং প্রধান, মোবাইল : ০১৭১৫০১১৩৫১, ৩মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মোবাইল : ০১৭৩১৩৮৬১১৩, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বিআরআরআই, গাজীপুর-১৭০১, ই- মেইল : shamiulent@gmail.com

বিস্তারিত
মানসম্পন্ন বীজ এবং ধানের সংগ্রহোত্তর অপচয় কমাতে হারমেটিক স্টোরেজ

মানসম্পন্ন বীজ এবং ধানের সংগ্রহোত্তর অপচয় কমাতে হারমেটিক স্টোরেজ
কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন
পৃথিবীর ইতিহাস পরিবর্তনে যে ক’জন মহান নেতা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে মনের অজান্তেই চলে আসে একটি নাম, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারাজীবন জাতির জন্য সংগ্রাম এবং মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনের মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বে এক অনুকরণীয় নেতায় পরিণত হন।
বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন যে, কৃষির উন্নয়নের মধ্য দিয়েই কেবল বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আসতে পারে। আর সে কারণেই সাড়ে তিন বছরের শাসন সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের কৃষি উন্নয়নের জন্য গড়ে তোলেন বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালে দেশে তুলার চাষ সম্প্রসারণ করার জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। পুনর্গঠন করেন হর্টিকালচার বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি ও রাবার উন্নয়ন কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধু কৃষিতে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বীজ ও সার সরবরাহের প্রতিষ্ঠান বিএডিসিকে পুনর্গঠন করে সারাদেশে বীজকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য ১৯৭৩ সালে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৩ সালে কৃষিতে গবেষণা সমন্বয়ের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং নতুন নামে পুনর্গঠন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। এগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে উন্নীত করেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট হিসেবে। এছাড়া তিনি ঈশ্বরদীতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিষ্ঠা করেন পরামাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উন্নতির জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর পথ অনুসরণ করে তিনিও কৃষি উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছেন। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নের্তৃত্বে কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বে অনন্য রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বিবেচনায় প্রতি বছর সাড়ে তিন থেকে চার কোটি টন খাদ্যের চাহিদা রয়েছে যার পুরোটাই অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থা (এফএও) এর মিটিং দ্য আন্ডার নিউট্রিশন চ্যালেঞ্জ প্রকল্পের সিনিয়র এসডিজি স্পেশালিস্ট খাদ্য নষ্ট ও অপচয় বিষয়ে বলেন, সারাবিশ্বে প্রতি বছর উৎপাদন, পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যায়ে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ খাদ্য নষ্ট হয় যার আর্থিকমূল্য দাঁড়ায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার। বিক্রেতা ও ভোক্তাপর্যায়ে কী পরিমাণ খাদ্য অপচয় হচ্ছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি। তিনি আরো বলেন, যখন খাদ্য নষ্ট হয় তখন আসলে খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত অন্যান্য সম্পদ যেমন পানি, ভূমি, বিদ্যুৎ, শ্রম, পুঁজি ইত্যাদিরও অপচয় হয়।
মহামারী, যুদ্ধ সেইসাথে জলবায়ুর চরম বিরূপ ইত্যাদি কারণে বিশ্বে খাদ্য সংকটের ঘণ্টা বেজে উঠছে যখন বিশ্বে খাদ্যের অপচয়ও বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে বছরে খাদ্যের অপচয় ১ দশমিক ৪৫ কোটি টন যার অর্থ ক্ষুধার আসন্ন হুমকি। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, যদি অপচয় না করা হয় তাহলে এই পরিমাণ খাদ্য দিয়ে তিন মাসের জন্য ১৭ কোটি মানুষের খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট।
খাদ্যের অপচয় এমন একপর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যখন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতির বিষয়ে সতর্ক করেছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও জনগণকে সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের বিষয়ে সতর্ক করেন এবং দেশের প্রতি ইঞ্চি খালি জমি যাতে কৃষির আওতায় আসে সেজন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। কৃষিতে বাংলাদেশের ব্যাপক অগ্রগতি। প্রধান খাদ্যশস্য ধান ও গমের উৎপাদন গত অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯০ কোটি টন যা গত ১১ বছরের মধ্যে ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। এই সময়ে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ যা কিছু অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদিত হয় তার একটা ভালো অংশ ক্ষেত থেকে শুরু করে টেবিল পর্যন্ত একাধিকপর্যায়ে নষ্ট হয়। পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির খাদ্য অপচয়ের তথ্য অনুসারে, দেশে মাঠ থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত যাত্রাপথে প্রতি বছর ৩৭ লাখ টনেরও বেশি খাবার নষ্ট হয়। বাড়িতে বার্ষিক খাদ্য বর্জ্য প্রায় ১.০৭ কোটি টন, কারন মোট বার্ষিক ক্ষতি এবং বর্জ্যরে পরিমাণ ১.৪৫ কোটি টন।
বাংলাদেশ প্রধানত একটি ধান উৎপাদনকারী দেশ এবং চাল প্রধান খাদ্য। দেশের মোট ফসলি জমির ৮০ শতাংশ ধান চাষের অধীনে এবং বছরে ৩ মৌসুমে ধান চাষ করা হয়। সুতরাং দেশের মানুষের জীবিকা নির্বাহে ধান একটি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় মোট ক্যালরি সরবরাহের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এবং মোট প্রোটিন গ্রহণের প্রায় অর্ধেক আসে চাল থেকে।
বাংলাদেশে ধান সংগ্রহের পর সংরক্ষণের জন্য সাধারণত ডোল, বের, গোলা, মটকা, স্টিলের ড্রাম, প্লাস্টিকের ব্যাগ, প্লাস্টিকের ড্রাম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এ সমস্ত স্টোরেজ সিস্টেমে চাল বা ধানে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয় এবং বীজের ক্ষেত্রে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নিম্নপর্যায়ে নেমে আসে। দেশের এ সকল সনাতনী প্রথায় সংরক্ষণ করা ধান বা চালে পোকামাকড়ের আক্রমণের কারণে সবচেয়ে বেশি খাদ্যের অপচয় হচ্ছে। শুধুমাত্র আধুনিক স্টোরেজ ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারলেই অপচয়ের বিরাট অংশ রোধ করা সম্ভব।
বিশ্বে প্রতি ৯ জন মানুষের মধ্যে ১ জন অপুষ্টির শিকার অথচ প্রতি বছর ১ বিলিয়ন টনেরও বেশি উৎপাদিত খাদ্য সারাবিশ্বে নষ্ট হয়। জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের ২০২১ খাদ্য বর্জ্য সূচক রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি বছর মাথাপিছু ৬৫ কেজি খাদ্য বর্জ্য তৈরি হয় যা অনেক উন্নত দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশী। খাদ্য বর্জ্যরে পরিমাণ প্রতি বছর মাথাপিছু যুক্তরাষ্ট্রে ৫৯ কেজি, রাশিয়ায় ৩৩ কেজি, আয়ারল্যান্ডে ৫৫ কেজি, নিউজিল্যান্ডে ৬১ কেজি এবং জাপানে ৬৪ কেজি। দেশের খাদ্য উৎপাদন ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করার চেয়ে অনেক কম প্রচেষ্টায় খাদ্যের অপচয় ৫ শতাংশ কমানো সম্ভব। আর এর একটি সহজ উপায় হচ্ছে-হারমেটিক স্টোরেজ।
হারমেটিক স্টোরেজ যা “সিলড স্টোরেজ” বা “এয়ারটাইট স্টোরেজ” নামেও পরিচিত। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্যশস্য, ডাল, কফি এবং কোকো বিনের স্টোরেজ পদ্ধতি হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। পদ্ধতিটি সিল করা বায়ুরোধী ব্যাগ বা কাঠামো ব্যবহার করে উচ্চ কার্বন ডাই-অক্সাইড ঘনত্বের একটি স্বয়ংক্রিয় পরিবর্তিত বায়ুম-ল তৈরি করে। যেহেতু কাঠামোটি বায়ুরোধী সে কারণে শস্যের জৈব অংশ যেমন পোকামাকড়, বায়বীয় অনুজীব সময়ের সাথে সাথে শ্বসন বিপাকের কারণে কার্বন ডাই-অক্সাইড ঘনত্ব বৃদ্ধি করে। ফলে ভেতরের পোকামাকড় ও অনুজীব অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। এতে শস্যে আলফা টক্সিন উৎপাদন ক্ষমতাও হ্রাস পায়।
হারমেটিক স্টোরেজের জন্য বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত ব্যাগ বা কনটোইনার ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের মধ্যে সুপার গ্রেইন ব্যাগ, গ্রেইনপ্রো ব্যাগ, কোকুন (৫-৫০ টনের জন্য), বাংকারস, পিটস টানেল, সাইলো ব্যাগ, জিরোফ্লাই ব্যাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। হারমেটিক স্টোরেজে এসব ব্যাগ ব্যবহার করে শস্যবীজের বিশেষ করে ধানের ক্ষেত্রে বীজের অঙ্কুরোদগমের হার ৯৮-৯৯ শতাংশ পাওয়া যায়, যা আমাদের দেশের সনাতনী পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পাওয়া সম্ভব। সুতরাং গুণগত মানসম্পন্ন সতেজ বীজ নিশ্চিত করতে হলে হারমেটিক ব্যাগের কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে দেশের ক্ষুদ্র চাষিপর্যায়ে মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার বাড়াতে হলে হারমেটিক স্টোরেজ পদ্ধতির ব্যবহার অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি ধানের সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্লেটে নেয়া পর্যন্ত সংগ্রহোত্তর অপচয় রোধ করার জন্যও হারমেটিক স্টোরেজ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।
হারমেটিক স্টোরেজে যে সকল পলিপ্রপিলিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয় এদের একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পোকামাকড় বা ইদুর এ সমস্ত ব্যাগ কাটতে বা ছিদ্র করতে সক্ষম যার ফলে ব্যাগের ভেতর ও বাইরের আবহাওয়াগত পরিবেশ একই রকম হয়ে যায় এবং এতে হারমেটিক স্টোরেজের সুফল পাওয়া যায় না। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর  ড. আব্দুল আউয়াল এবং তার বিশেষজ্ঞ দল গবেষণা করে বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য উপযোগী ধাতব কনটোইনারে হারমেটিক স্টোরেজের গুণাবলি যুক্ত করেছেন যা পোকামাকড় বা ইঁদুর কাটতে বা ছিদ্র করতে পারবে না এবং এর ব্যবহার অনেক বছর পর্যন্ত করা সম্ভব হবে। ড. আউয়ালের মতে, এই ধরনের মেটালিক হারমেটিক স্টোরেজ দেশের ক্ষুদ্র কৃষকপর্যায়ে ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ে কৃষকদের দিয়ে বীজ উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে আসছে এবং কৃষকপর্যায়ে মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারে উৎসাহিত করছে। এক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত এই স্টোরেজ পদ্ধতিটি মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে কৃষকপর্যায়ে সুস্থ, সবল, নিরোগ বীজের ব্যবহার বাড়বে যা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি খাদ্যের জন্য ব্যবহৃত ধানের অপচয় কমানোর জন্য বিভিন্ন আকারের কোকুন ব্যবহার কৃষকপর্যায়ে বাড়াতে পারলে সংরক্ষিত ধানের অপচয় অনেক পরিমাণে কমে আসবে।

লেখক : কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ, মোবাইল : ০১৭১১৯৮৭১১৩, মেইল :monir.uddin@rookctonail.com

বিস্তারিত
ইঁদুরের প্রজনন মৌসুম

ইঁদুরের প্রজনন মৌসুম
ড. সন্তোষ কুমার সরকার
যেকোনো প্রযুক্তি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হলে দমন প্রযুক্তি ও বালাইয়ের জীবনচক্র ও পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে  ১৩ প্রজাতির ক্ষতিকারক ইঁদুরের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে । এদের মধ্যে চারটি প্রজাতি ফসল ও সম্পদের বেশি ক্ষতিকারক। এরা হচ্ছে: (ক) মাঠের বড় কালো ইঁদুর (খ) মাঠের কালো ইঁদুর  (গ) গেছু ইঁদুর ঘ) সলই বা বাতি ইঁদুর। এদের মধ্যে  মাঠের বড় কালো  ইঁদুরের সামদ্রিক অঞ্চলে ও নিচু ভূমি  হাওরবাওর এলাকায় এদের উপস্থিতি বেশি রয়েছে। মাঠের কালো ইঁদুর (ইষধপশ ঋরবষফ জধঃ) বাংলাদেশে কৃষি ফসল, গুদাম, গ্রাম ও শহর এলাকাসহ সর্বত্র একটি প্রধান ক্ষতিকারক বালাই। গেছো ইঁদুর ঘরের সিলিং এবং নারিকেলসহ অন্যান্য ফলের গাছে বাস করে। খাদ্যগুদামে ও সিলিংয়ে এদের বেশি দেখা যায়। এরা গর্তে থাকে না। গ্রামের আবাস ভূমির অব্যবহিত দূরে গাছের ঝাড়ে এবং উঁচু ভূমিতে পাওয়া যায়। এরা এক গাছ হতে অন্য গাছে সহজেই যেতে পারে। একত্রে অনেকগুলো ইঁদুর বাস করে। সলই ইঁদুর আকারে ছোট হলেও খাদ্যশস্যের ঘরের জিনিসপত্র এবং দানাদার শস্যের প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে। ইঁদুর দমনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফসলের ক্ষতি কম রাখা। ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে গেলে ফসলের ও সম্পদের ক্ষতি বেশি হবে। মাঠ ফসলে সঠিকভাবে দমন প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য ইঁদুরের প্রজননের সময় জানা প্রয়োজন। প্রজনন শুরু হওয়ার আগে ইঁদুর দমন করা হলে ইঁদুরের সংখ্যা কম রাখা সম্ভব হবে। ইঁদুর দমন ব্যবস্থা ভাল কাজ করবে।
প্রজনন মৌসুম আরম্ভ ও বিরতি
প্রথম সফলভাবে যৌন মিলনের পর হতে প্রজননবিহীন পর্যন্ত সময়কালকে একটি পপুলেশনের প্রজনন মৌসুম বলে। একটি প্রজাতির গর্ভধারণকাল হলো পূর্ববর্তী ইঁদুরের আনুমানিক গর্ভধারণ তারিখ হতে ট্রাইমেস্টারের উন্নত হওয়া পর্যন্ত যাহা অর্থাৎ গর্ববতী ইঁদুরের ট্রাইমেস্টার উন্নত হওয়ার পেছন দিকের গর্ভধারণ তারিখ পর্যন্ত গণনা দ্বারা নির্ণয় করা হয়। প্রজনন মৌসুম শেষ হয় যখন সর্বশেষ লিটারের বাচ্চা স্তন্যপান মাকে ছেড়ে যায়। অসংখ্য গর্ত খনন ও বাচ্চাদের বর্ধনস্তরের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ দ্বারা ইহা নির্ণয় করা যাবে।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্য থেকে জানা গেছে যে, ইঁদুরের প্রজনন নির্ভর করে শস্যের নিবিড়তার উপর। যেখানে বছরে একটি ধান ফসল চাষ হয় সেখানে ইঁদুরের একটি প্রজনন হয়। আবার যেখানে বছরে তিনটি ফসল হয় সেখানে ইঁদুর তিনবার প্রজনন করে থাকে। বাংলাদেশে তিনবার ধান ফসলের চাষ হয়ে থাকে, তাই ইঁদুরের তিনবার প্রজনন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে এবিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
 দশমিনা বীজ বর্ধন খামারের মাঠের বড় কালো ইঁদুরের একটি প্রজনন মৌসুম পাওয়া গেছে অক্টোবর হতে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। মাঠের কালো ইঁদুর গ্রামের পপুলেশনের প্রজনন তৎপরতা মৌসুমভিত্তিক এবং শস্যের বিশেষ করে আমন ধানের পরিপক্বতার সময়ে সর্বোচ্চ তৎপড়তা সংঘটিত হয়। এজন্য থোর হওয়ার পূর্বে ইঁদুর দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। খাদ্যশস্যের গুদামে সারা বছর ধরে প্রজনন ঘটে থাকে কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে সর্বোচ্চ পরিমাণে দেখা যায়। বাংলাদেশ ও ভারতে এ চার প্রজাতি ইঁদুরের হ্রাস-বৃদ্ধি শস্যচক্রের সাথে জড়িত, কারণ দুইটি ধান শস্যের ক্ষেত্রে ইঁদুরের দুইবার সর্বোচ্চ প্রদর্শিত করে থাকে। বাংলাদেশে গম ফসলে একবার এবং দ্বিতীয় আমন ফসলে সর্বোচ্চ পর্যায় দেখা যায়। এজন্য বাংলাদেশে দুই বার ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করা হতো। বর্তমানে শুধু আমন মৌসুমে জনগণের ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বছরে একবার ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করা হয়। আমাদের দেশে সারা বছরই মাঠে ফসল থাকে,তাই সারা বছরই ইঁদুর বংশ বিস্তার করার সুযোগ পাচ্ছে। পরিববর্তীতে জলবায়ুর কারণে রয়েছে। খরা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, মাঠে ইঁদুর বেশি দিন বংশবিস্তারের সুযোগ রয়েছে। তাই আমন ফসলে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অতিবৃষ্টি, বন্যা বা বর্ষার পানি বেশি হলে ইঁদুরের সংখ্যা কমে যায়।
কার্যকর বালাই দমন প্রযুক্তি প্রতিদিন বৈজ্ঞানিকদের পক্ষে উদ্ভাবন করা সম্ভব হয় না। দীর্ঘদিন ল্যাবরেটরি ও ফসলের মাঠে এবং বসতবাড়িতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সুপারিশ প্রদান করে থাকেন। কার্যকর দমন পদ্ধতি ও সঠিক সময়, সঠিক স্থানে, সঠিকভাবে, সঠিক পরিমাণে প্রয়োগ না করলে কার্যকর হয় না। একই দমন পদ্ধতি সব স্থানে ও সকল বালাইয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকর হয় না। ইঁদুরজাতীয় প্রাণির ক্ষেত্রে এ সমস্যা প্রকট। এজন্য কৃষকদের বলতে শোনা যায় ইঁদুর দমন বিষ খেয়ে ইঁদুর মরে না, খায় না এবং ফাঁদে পড়ে না।
রোডেন্ট নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমগুলো অধিক শ্রমনির্ভর, ব্যয়বহুল এবং সময়ের প্রয়োজন হয়। জড়িত ইঁদুরের প্রজাতি শনাক্ত করা প্রয়োজন। মাঠের কোন কোন এলাকায় ও ফসলে বেশি আক্রমণ হয়েছে তা নিরূপণ করতে হবে। মাঠশস্য ও গুদামজাত শস্যের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে দমন প্রযুক্তি ঠিক করা প্রয়োজন। কারণ সঠিক দমন প্রযুক্তি নির্বাচন ও সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন করা হলে দমন খরচ কম হয় এবং ফসলের ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। একা ইঁদুর না মেরে সকলে মিলে একই সময়ে বেশি জায়গায় ইঁঁদুর দমন প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে।

লেখক : মুখ্য প্রশিক্ষক (অব.), ডিএই, মোবাই: ০১৭১৪২২২১৫৭, ই-মেইল :santoshsarker10@gmail.com

বিস্তারিত
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ভাবনায় ইঁদুর গবেষণা

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ভাবনায় ইঁদুর গবেষণা
ড. মোঃ জাকির হোসেন
ইঁদুর একটি চতুর ও নীরব ধ্বংসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী। প্রাণী হিসেবে ইঁদুর আকারে সাধারণত ছোট হলেও ক্ষতি করার সক্ষমতা ব্যাপক। এদের অভিযোজন ক্ষমতা অনেক বেশি। এরা যে কোনো খাদ্য খেয়ে বাঁচতে পারে এবং যে কোনো পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে।
এক গবেষণা মতে, এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যা ধান-চাল খেয়ে নষ্ট করে তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। ইঁদুর বছরে ধান ও গমের প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন পর্যন্ত ক্ষতি করে থাকে যার মূল্য আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। তাছাড়া ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে, খাবার খেয়ে ডিম ও ছোট মুরগি খেয়ে প্রতি বছর খামারপ্রতি প্রায় ১৮ হাজার টাকা ক্ষতি করে থাকে। প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন গুদামজাত শস্য ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি হয়ে থাকে। ইঁদুর মাঠের দানাজাতীয়, শাকসবজি, মূলজাতীয়, ফলজাতীয় ফসলের ক্ষতি করে থাকে। আবার গুদামঘরে সংরক্ষিত ফসলেরও মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে (প্রায় শতকরা ২০ ভাগ)। ক্ষতির এই ব্যাপকতার কারনে এ অঞ্চলে ইঁদুর নিধনে প্রতি বছরে বিভিন্ন প্রতিপাদ্য হয়ে থাকে।
ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি সংক্রান্ত সমস্যাটি যেহেতু বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের জন্য ব্যাপক, তাই এর সমাধানে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোকেই  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন। আসলে গবেষণার কোন বিকল্প নেই। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের জেনেটিক্সের প্রফেসর সিনক্লেইয়ার এবং সেন্টার ফর বায়োলজি অব এজিং রিসার্চের সমন্বয়ক পল এফ গেন দেখেছেন, প্রাণিদেহে বার্ধক্য একটি পরিবর্তনযোগ্য প্রক্রিয়া। চাইলে বার্ধক্যকে বিপরীত দিকে পরিবর্তন করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের এক ল্যাবে ঘটেছে বিস্ময়কর এক ঘটনা। একটি বৃদ্ধ অন্ধ ইঁদুর তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে। শুধু তাই নয়, একইভাবে তারুণ্য ফিরে পেয়েছে ইঁদুরটি। ফিরে পেয়েছে হারানো স্বাস্থ্য। কিডনি, মস্তিকসহ তার সবকিছুই আগের চেয়ে বেশি সচল হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ, ইঁদুরের বয়স বাড়ানো-কমানো সম্ভব হয়েছে ল্যাবেই। সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
ইঁদুরের প্রসঙ্গটি এসেছে আমেরিকান বিজ্ঞানী জন ক্যালহুনের একটি গবেষণার সূত্রে। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর গবেষণাপত্রে বলেছেন, ইঁদুরের বসবাস ও চলাফেরার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার তুলনায় সংখ্যা খুব বেশি বেড়ে গেলে পুরুষ ইঁদুর ভীষণ হিং¯্র হয়ে ওঠে এবং সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে পরস্পরকে কামড়ায়। এখন যদি মনে করি, এমন একটি পুরুষ হিং¯্র ইঁদুরের কামড়ের কারণে বা প্রজননের কারণে দাঁতবিহীন নতুন বাচ্চা জন্মাতে লাগল, তাহলে ইঁদুর দিয়েই ইঁদুর দমন করতে পারব। এরকম শত শত চিন্তার সমন্বয়ে শত শত প্রযুক্তি প্রতিদান হিসেবে আসবে।
বারবার কীটনাশক ব্যবহারে মাধ্যমে শুধু ইঁদুর নয়, মশা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের প্রতিরোধের বিকাশ ঘটায়। যাহা তাদেরকে বিভিন্ন রোগের বাহক বা ভেক্টর হিসেবে আরো শক্তিশালী হওয়ার চাপ আরোপ করে। উপরন্তু রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ। এ সকল চাপ মোকাবিলায় নতুন নতুন শরীরবৃত্তীয় উপায়ের মাধ্যমে উচ্চ অভিযোজিত ভেক্টরে পরিণত হচ্ছে ইঁদুর, মশা ও অন্যান্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ। প্রয়োজনে বিবর্তন বা মহাদেশীয় স্থানান্তরের মাধ্যমে এক স্থান থেকে বহুগুণে শক্তিশালী হয়ে স্থানান্তরিত হয়ে (আফ্রিকান ডেঙ্গু মশার স্থানান্তর) নতুন ঠিকানায় আশ্রয় বা পোষক হয়ে ওঠছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে করোনা ভাইরাস, ডেঙ্গু, সার্সসহ নতুন নতুন বালাই এর আবির্ভাব ঘটছে। এই শতাব্দির ভয়াবহ করোনা মহামারি আমাদের নাজুক অবস্থা দেখিয়ে দিয়েছে। একমাত্র          কৃষি ব্যবস্থা টিকে থাকার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে ছিল। তাই কৃষি গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিষয়ে আরো মনোনিবেশ করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সব অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শস্যের নিবিড়তা বেড়েই চলেছে। তারই নির্দেশনায় আজ এক ইঞ্চি জমিও আমরা খালি রাখছি না। তার পরেও অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে মোকাবিলা করতে ইঁদুরের মুখের খাবারকে ভোক্তার খাবারে রূপান্তর করতে পারলে আমাদের খাদ্য আমদানি বন্ধ করে, খাদ্য আমদানির হুমকিতে থাকা দেশগুলোতে অধিক কৃষিপণ্য রপ্তানি করার মাধ্যমে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারব।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা শাখা, পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইল : ০১৩০৬৭৬৯৯০০, ই-মেইলঃzakirbjri@gmail.com

বিস্তারিত
বীজ উৎপাদনে অনুসরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ

বীজ উৎপাদনে অনুসরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ
ড. মো: আব্দুল মালেক
কৃষির উন্নয়নে প্রধান ও মুখ্য উপকরণই হচ্ছে বীজ আর লাভজনক ফসল উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে বীজ। গবেষণায় দেখা গেছে একমাত্র উন্নত মানের ও মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের ফলন শতকরা ২০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব।  
মানসম্পন্ন তথা উন্নত মানের বীজের বৈশিষ্ট্য
প্রচলিত একটি স্লোগান আছে ‘ভালো বীজে ভালো ফসল’। আর এ ভালো বীজ মানেই গুণগত মানসম্পন্ন ও উন্নতমানের বীজ। মানসম্পন্ন বীজ বিভিন্ন শ্রেণির হতে পারে যেমন- নিউক্লিয়াস বা মৌল বীজ, প্রজনন বীজ, ভিত্তি বীজ ও প্রত্যায়িত বীজ।
উন্নত গুণাগুণের মানসম্পন্ন বীজ : উন্নত গুণাগুণের মানসম্পন্ন বীজের বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
   বিশুদ্ধ  বীজ হতে হবে কৌলিতাত্ত্বিকভাবে বিশুদ্ধ;
    বাহ্যিকভাবে দেখতে উজ্জ্বল বর্ণের হবে যা ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে;
    ভালো বীজ অবশ্যই সকল ধরনের মিশ্রণ হতে মুক্ত হতে হবে অর্থাৎ বীজ জড় পদার্থ, আগাছা বীজ, অন্য ফসল বা জাতের বীজের মিশ্রণ থাকা চলবে না;
    বীজ হতে হবে পুষ্ট ও তুলনামূলকভাবে ভারী, যে বীজে খাদ্যের মজুদ থাকবে বেশি ফলে বীজ গজাবে দ্রুত, বেশি হবে প্রাথমিক বৃদ্ধি, চারা হবে সুস্থ, সবল ও রোগ-বালাইয়ের প্রতিরোধী, কুশি/ডালপালার সংখ্যা হবে বেশি, প্রতি গাছে দানা/বীজের সংখ্যা হবে বেশি আর সর্বোপরি ফলন দিবে বেশি, কৃষি হবে লাভজনক আর বাড়বে দেশের মোট উৎপাদন আর অবদান রাখবে দেশের কাক্সিক্ষত খাদ্য ও পুষ্ট নিরাপত্তায়;
    জাত ভিত্তিক বীজের আকার ও আয়তন তথা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও ওজন থাকবে নির্দিষ্ট;
    বীজের আর্দ্রতা থাকবে নির্ধারিত মাত্রায় (ধান, গম ও ভুট্টায় ১২, ডালজাতীয় শস্যে ৯, পাটে ৯ ও সরিষায় ৮%);
    বীজ হবে ক্ষতিকারক রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে মুক্ত ও নীরোগ; এবং
    সর্বোপরি বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা হতে হবে নির্ধারিত মানের যেমন ধানে সর্বনিম্ন ৮০%, গমে ৮৫%, ডাল শস্যে ৭৫-৮৫% আর শাক-সবজির বীজে ৭০-৭৫%।
উল্লিখিত উন্নত গুণাগুনের মানসম্পন্ন বীজ পেতে হলে বীজের পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যথা বীজ উৎপাদনের জন্য এলাকা ও জমি নির্বাচনসহ সার্বিক কৃষি পরিচর্যা, বীজ ফসল সংগ্রহ, মাড়াই, মাড়াই পরবর্তী প্রক্রিয়াজাতকরণ যেমন: বীজ ঝাড়াই, শুকানো, পুষ্ট বীজ বাছাই/পৃথককরণ ও বীজ সংরক্ষণে সতর্কতাস্বরূপ মেনে চলতে হবে।
এলাকা ও জমি নির্বাচন
কোন ফসল সারা দেশের জন্য চাষাবাদের উপযোগী হলেও উন্নত মানের ও মানসম্পন্ন বীজ দেশের সকল অঞ্চল বা এলাকা হতে পাওয়া যাবে না। তাই কোন নির্দিষ্ট ফসলের বীজ উৎপাদন নির্দিষ্ট এলাকা/এলাকাসমূহে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
বীজ উৎপাদন এলাকা নির্দিষ্ট করার পর জমি নির্বাচনের সময় বিবেচনা করতে হবে যে জমিতে পূর্বের বছরে একই ফসলের অন্যকোন জাত চাষ করে থাকলে সে জমি বীজ উৎপাদনের জন্য নির্বাচন করা যাবে না; বীজ উৎপাদনের জন্য নির্বাচন করতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও উর্বর জমি; এবং পরিহার করতে হবে ছায়াযুক্ত স্থান, কারণ ছায়াযুক্ত স্থানে সালোক সংশ্লেষণ কম হবে এবং গাছ হবে দুর্বল যা সামান্য ঝড় বা প্রতিকূলতায় হেলে পড়বে ফলে বীজ হবে অপুষ্ট ও কম অংকুরোদগম ক্ষমতার।    
উপরোল্লিখিত বিষয়সমূহ মেনে চললে বীজের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা রক্ষাসহ পাওয়া যাবে উজ্জল বর্ণের শতভাগ পুষ্ট উচ্চ অংকুরোদগম ক্ষমতাসম্পন্ন বীজ।
পৃথকীকরণ দুরত্ব
কোন ফসলের জাতের বীজ উৎপাদন প্লট অন্য জাত হতে অবশ্যই নির্দিষ্ট পৃথকীকরণ দূরত্বে স্থাপন করতে হবে।
বীজ উৎপাদনে পৃথকীকরণ দূরত্ব ফসলের পরাগায়ন পদ্ধতি ও বীজের শ্রেণির উপর নির্ভর করে। যেমন স্বপরাগায়িত  ধানের প্রজনন বীজ, ভিত্তি বীজ ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনে প্রতিক্ষেত্রে পৃথকীকরণ দূরত্ব ৩ মিটার হলেও স্বপরাগায়িত তিলের ক্ষেত্রে এ দূরত্ব হলো যথাক্রমে ২০০, ১০০ ও ৫০ মিটার এবং টমেটোতে যথাক্রমে ৫০, ৫০ ও ২৫ মিটার ।
বীজের কৌলিতাত্বিক বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে পৃথকীকরণ দূরত্ব অবশ্যই মেনে চলতে হবে, কারণ পৃথকীকরণ দূরত্ব বজায় রাখতে পারলেই দূর করা যাবে অনাকাংখিত পরাগায়ন ও নিশ্চিত হবে কাক্সিক্ষত পরাগায়ন এবং রক্ষিত হবে বীজের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা যা ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
রোপণ/বপন দূরত্ব
চারা রোপণে বা বীজ বপনে বা এমন দূরত্ব রাখতে হবে যাতে বীজ উৎপাদন প্লটে প্রতিটি গাছ পর্যাপ্ত আলো পায় এবং বাতাস চলাচল সহজতর হওয়ার পাশাপাশি পরিদর্শনসহ আন্তঃপরিচর্যা সহজতরভাবে করা সম্ভব হয়।
এজন্য সারি হতে সারির দূরত্ব স্বাভাবিক ফসল উৎপাদনের চেয়ে একটু বেশি রাখতে হবে যাতে রগিং বা বিজাত বাছাই তথা মিশ্রিত গাছসহ রোগ ও পোকায় আক্রান্ত গাছ এবং মিশ্রিত অন্যান্য ফসলের গাছ শনাক্তকরণ ও অপসারণ সহজতর হয়।
উপরোল্লিখিত বিষয় দু’টি মেনে চললে বীজের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা রক্ষা হবে, বীজে আগাছা ও অন্যান্য বীজের মিশ্রণ এবং বীজ রোগ ও পোকার আক্রমণমুক্ত হবে এবং শতভাগ পুষ্ট বীজ পাওয়া যাবে।
বিজাত বাছাই/রগিং
জাতের কৌলিক বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে রগিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচিত জাতের সহিত সাদৃশ্যপূর্ণ নয় এসব গাছ তুলে সরিয়ে ফেলা নিশ্চিত করতে হবে;  
রগিং বা বিজাত বাছাই বৃদ্ধির ৩টি ভিন্ন ধাপে সম্পন্ন করতে হবে। যথা : ক. অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায়, খ. ফুল আসার সময় এবং গ. পরিপক্ব পর্যায়ে।
ফসলের বৃদ্ধির তিনটি ধাপে সম্পন্ন করা হলেও অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায়ে রগিং বেশি কার্যকর, কারণ এতে জাতের কৌলিক বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য কার্যকরী উপায় তথা শতভাগ অনাকাক্সিক্ষত পরাগায়ন রোধ করা যায়।
সংগ্রহ, মাড়াই, শুকানো ও সংরক্ষণ
    বীজ সংগ্রহ ও মাড়াই কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে ও পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হতে হবে যাতে অন্য জাতের বীজ পূর্ব হতে যন্ত্রের গায়ে বা ভিতরে লেগে না থাকে।
    বীজের মিশ্রণ রোধে একাধিক জাতের মাড়াইয়ের স্থানের দূরত্ব পর্যাপ্ত রাখতে হবে, যাতে মাড়াইয়ের সময় বীজ ছিটকে অন্য জাতের সহিত মিশ্রিত হতে না পারে।
    বীজ শুকানো মেঝেতে যাতে গর্ত বা ফাটল না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা, আর থাকলেও তাতে যেন অন্য কোন বীজ ঢুকে না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
    শুকানোর সময় যাতে অন্য জাত বা অন্য ফসলের বীজের সহিত মিশ্রিত না হয় সেজন্য বীজ শুকানোর কাজে ব্যবহৃত ত্রিপল/নেট/কাপড় পরীক্ষা করে দেখা, যাতে এগুলোর গায়ে অন্য জাতের বা ফসলে বীজে লেগে না থাকে।
    কড়া রোদে বীজ প্রতিদিন ২-৩ তিন ঘণ্টা করে কয়েক দিন শুকানো যাতে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে না যায়।
    বীজ সরাসরি সিমেন্টের তৈরি খোলায় বা মেঝেতে না শুকিয়ে ত্রিপল বা চাটাইয়ের উপর শুকাতে হবে।
    বীজ এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে ফসলভিত্তিক বীজের আর্দ্রতা নির্ধারিত আর্দ্রতার চেয়ে বেশি না থাকে (ধান বীজে ১২%, সরিষা বীজে ৮%, তিল বীজে ৯% এবং সয়াবিন বীজে ১২% থাকা প্রয়োজন)।
    শুকানোর পর বীজ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে এবং অপুষ্ট বীজ আলাদা করে তা বাদ দিতে হবে, কারণ অপুষ্ট বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কম থাকে, অংকুরোদগম বিলম্বিত হয়, চারা/গাছ দুর্বল হওয়ার রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে না আর সর্বোপরি উৎপাদনশীলতাও কমে যায়।   
    মিশ্রণমুক্ত, নির্দিষ্ট আর্দ্রতায় শুকানো পরিষ্কার ও পুষ্ট বীজ গরম অবস্থায় সংরক্ষণ না করে ঠা-া অবস্থায় বায়োরোধী পাত্রে ঘরের তুলনামূলকভাবে ঠা-া জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।
    সংরক্ষণের পূর্বে অবশ্যই বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
উল্লিখিত নিয়ম মেনে সংগৃহীত, মাড়াইকৃত, শুকানো, বাছাইকৃত ও সংরক্ষিত বীজ অন্য জাত/ফসলের বীজের মিশ্রণমুক্ত, পুষ্ট ও উচ্চ অংকুরোদগম ক্ষমতাসম্পন্ন হবে। বীজ উৎপাদনের প্লটটি যদি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা হেলে পড়ে এবং যদি একসাথে ফুল না আসে বা অন্য কোন উপায়ে নষ্ট হয়ে যায় বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব না হয় তবে বীজের প্লটটিকে বাতিল করতে হবে।

লেখক :  পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ-২২০২, মোবাইল : ০১৭১২-১০৬৬২০; ই-মেইল: malekbina@gmail.com

বিস্তারিত
সাথী ফসল হিসেবে আমনের সাথে সরিষার আবাদ এবং সরিষার তেলের গুণাগুণ

সাথী ফসল হিসেবে আমনের সাথে সরিষার আবাদ এবং সরিষার তেলের গুণাগুণ
কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি
সরিষার তেল গ্রাম বাংলার একমাত্র ভোজ্যতেল ছিল। এর ওষুধি গুণাগুণের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে এ তেল। দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন ভোজ্যতেল প্রয়োজন হয়। পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও বৈশি^ক পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশের ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল রাখাসহ আমদানি নির্ভরতা কমাতে চাহিদার ৪০ শতাংশ ভোজ্যতেল স্থানীয়ভাবেই উৎপাদনের লক্ষ্যে সরিষা আবাদ বাড়ানোর কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
রিলে ফসল হিসেবে আমন ধানের সাথে সরিষার চাষ
এই চাষ পদ্ধতিতে আমন ধান কর্তনের দুই সপ্তাহ আগে সরিষার জন্য বেসাল ডোজ সার দিয়ে ৪-৫ দিন পর অর্থাৎ ধান কাটার ১০ দিন পূর্বে ধানের জমিতে বারি সরিষা১৪, বারি সরিষা১৭ বা বারি সরিষা২০ জাতের বীজ বপন করতে হবে। যে সকল জমি আমন ধান কর্তনের পর ‘জো’ আসে না, জমিতে পানি জমে থাকে না কিন্তু কাদাভাব থাকে সে সমস্ত জমিতে সরিষা চাষ না করে কয়েক মাস পতিত রেখে তারপর বোরো ধান চাষ করা হয়, সে সকল জমি রিলে পদ্ধতিতে সহজেই সরিষা চাষের আওতায় আনা যায়। রিলে বা সাথী পদ্ধতিতে ফসল চাষ করতে হলে খেয়াল রাখতে হবে যে, জমিতে যেন পানি জমে না থাকে এবং মাটি কাদা কাদা অবস্থায় থাকে।
ধান কাটার ১০-১৫ দিন পূর্বে সরিষা চাষের জন্য ধানের জমিতে সার ছিটিয়ে দিতে হবে। ছিটানো সারের পরিমাণ হলো: প্রতি শতকে টিএসপি ৭০০-৮০০ গ্রাম, এমওপি ৫০০ গ্রাম, জিপসাম ৬০০-৭০০ গ্রাম, জিংক বা দস্তা সার ২০-২৫ গ্রাম, বোরন ৩০-৩৫ গ্রাম। সার ছিটিয়ে ৪-৫ দিন পর অর্থাৎ ধান কর্তনের ৮-১০ দিন পূর্বে আমন ধানের জমিতে বিঘাপ্রতি ১ কেজি সরিষা বীজ ছিটিয়ে বপন করতে হবে। বীজ বপনের ৮-১০ দিন পর ধান কাটতে হবে। তবে ধান কাটার সময় যদি ধানের খড় ১২ ইঞ্চি উঁচু রেখে কাটা হয় তবে তা সরিষার বৃদ্ধির জন্য উপকার হবে। ধান কেটে তা বেশি দিন জমিতে না রেখে ২-৩ দিনের মধ্যে সরিয়ে ফেলতে হবে। এতে সরিষা গাছ পর্যাপ্ত আলো বাতাস পেয়ে পরিমিত খাদ্য তৈরি করতে পারবে।
কাটা ধান সরিয়ে নেবার পর অর্থাৎ ২-৩ দিন পর সরিষার জমিতে প্রতি শতকে ইউরিয়া ৩০০ গ্রাম হিসেবে ছিটিয়ে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে জমিতে রসের পরিমাণ কম থাকলে বিকেলে ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিতে হবে। গাছের বয়স ২৫-৩০ দিন হলে যদি জমিতে অতিরিক্ত ঘাস থাকে তবে নিড়ানি দিতে হবে। এরপর প্রতি শতকে ইউরিয়া ৩০০-৩৫০ গ্রাম উপরিপ্রয়োগ করতে হবে এবং বাকি ইউরিয়া ফুল আসলে প্রতি শতকে ইউরিয়া ৩০০-৩৫০ গ্রাম উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার উপরিপ্রয়োগের সময় জমিতে রস থাকা দরকার। প্রয়োজনে হালকা সেচ প্রদান করা যেতে পারে।
সরিষাতে তেমন রোগ ও পোকার আক্রমণ হয় না। তবে দেরিতে বুনলে জাব পোকার আক্রমণ হয়। আশ্বিনের শেষ ভাগ ও মধ্য-কার্তিক (অক্টোবর) অর্থাৎ আগাম সরিষা বপন করলে জাব পোকার আক্রমণের আশঙ্কা কম থাকে। প্রতি গাছে ৫০টির বেশি পোকা থাকলে ম্যালাথিয়ন-৫৭ ইসি বা সুমিথিয়ন-৫৭ ইসি বা ফলিথিয়ন-৫৭ ইসি বা একোথিয়ন-৫৭ ইসি, ডায়াজিনন ৬০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে বিকেলে স্প্রে করতে হবে।
৮০% সরিষা পেকে গেলে সকালের দিকে কর্তন করতে হবে। সরিষা কাটার পর জাগ দিয়ে রাখতে হবে। তারপর শুকিয়ে মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানো কাজ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে চাষ করলে বিঘাপ্রতি ৩-৪ মণ সরিষার ফলন পাওয়া যায়।
সাধারণত এক কেজি সরিষা থেকে ৩৫০-৪০০ গ্রাম তেল উৎপাদন হয়, অর্থাৎ বোরো ধান চাষের আগে জমি পতিত না রেখে আমনের সাথে সরিষা রিলে আবাদ করে প্রতি বিঘায় প্রায় ৫০-৬০ কেজি তেল পাওয়া যায়। এতে করে একটি পরিবারে সারা বছরের তেলের চাহিদা পূরণ হবে।
আমনের জাত পরিবর্তন করে সরিষা চাষ
 ব্রি ধান৩৯ এর পরিবর্তে স্বল্প জীবনকালীন ধান ব্রি ধান৭৫ (জীবনকাল ১১৫ দিন) জাত চাষ করতে হবে; ব্রি ধান৪৯ এর পরিবর্তে জীবনকালীন ধান ব্রি ধান৭৫ (জীবনকাল ১১৫ দিন) বা ব্রি ধান৮৭ (জীবনকাল ১২৭ দিন) বা বিনা ধান১৬/বিনা ধান১৭/বিনা ধান২২ (১১৫ দিন) জাত চাষ করা; স্বর্ণা জাতের পরিবর্তে ব্রি ধান৭৫ বা ব্রি ধান৯৫ অথবা বিনা ধান১৬, বিনা ধান১৭, বিনা ধান১৯, বিনা ধান২২ জাতের চাষ; এছাড়াও মধ্যমেয়াদি আমনের নতুন জাত ব্রি ধান১০৩ চাষ করেও স্বলপমেয়াদি সরিষার চাষ করে বোরো ধান করা যায়।
শস্যবিন্যাস পরিবর্তন করে সরিষা আবাদ বৃদ্ধি শস্যবিন্যাস নি¤েœ দেওয়া হলো : রোপা আমন ধান-পতিত-বোরো ধান শস্যবিন্যাসকে রোপা আমন ধান-সরিষা-বোরে ধান; বছরব্যাপী আখ শস্যবিন্যাসকে আখ+সরিষা; ফল বাগান শস্যবিন্যাসকে ফল বাগান+সরিষা ; রোপা আমন-পতিত-পতিত শস্যবিন্যাসকে রোপা আমন-সরিষা-পতিত ; পতিত-বোরো-পতিত শস্যবিন্যাসকে সরিষা-বোরো-পতিত; পতিত-বোরো-আউশ শস্যবিন্যাসকে সরিষা-বোরো-আউশ।
সরিষার তেলের উপকারিতা
হার্টের কর্মক্ষমতা বাড়ায় : সরিষার তেলের মধ্যে স্যাচুয়েটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (ঝঅঋ) এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের ভারসাম্য বজায় থাকে। এছাড়া সরিষার তেল হচ্ছে ওলেইক অ্যাসিড সমৃদ্ধ এবং এর মধ্যে লিনোলেনিক এবং লিনোলেইক অ্যাসিডের ভারসাম্য আছে, যেগুলো হার্টের পক্ষে ভাল। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সরিষার তেল চড়া তাপমাত্রায় রান্নার সময় স্থিতিশীল থাকে এবং নিয়মিত সরিষার তেল গ্রহন করলে ৭১% হৃদরোগের আশঙ্কা কমে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল হিসাবে সরিষার তেল : সরিষার তেল অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল হিসাবে কাজ করে। এটি ব্যাকটিরিয়াল ঝিল্লির কোশের (সেল মেমব্রেন) ক্ষতি করে এবং দেখা গিয়েছে সাধারণ সংক্রামক ব্যাকটিরিয়া যেসন- এসোরিকিয়া কোলি যা থেকে মূত্রনালীর সংক্রামণ এবং ডায়রিয়া হয় এবং টাইফয়েডের জন্য জন্য দায়ি সালমোনেলা টাইফির বিরুদ্ধে এটির সম্ভাব্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রক্রিয়া কাজ করে।
শ্বাসকষ্ট দূর হয় : একাধিক গবেষণায় একথা প্রমাণিত হয়েছে যে শ্বাসকষ্ট সম্পর্কিত যে কোনো ধরনের সমস্যা কমাতে সরিষার তেলের কোনও বিকল্প নাই।
আর্থ্রাইটিস রোগের কষ্ট কমায় : সেলেনিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম নামক দুটি খনিজ পদার্থ সরিষার তেলে খুব বেশি পরিমাণ থাকে, যা আর্থ্রাইটিসের প্রদাহ কমানোর পাশাপাশি এই রোগের প্রকোপ হ্রাসেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
মাইগ্রেনের কষ্ট কমায় : মাইগ্রেনের কষ্ট কমাতে ম্যাগনেসিয়াম দারুণ কাজে করে। তাই এই তেলে রান্না করা খাবার খেলে মাইগ্রেনের কষ্ট কমতে পারে। সরিষার তেলে ভাজা মাছ খেলে শরীরে ওমাগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে : ডার্মাফাইট হচ্ছে এমন ধরনের ছত্রাকের জীবাণু যা ত্বক এবং চুলে সংক্রামণ ঘটায়। কিছু ডার্মাফাইট যেমন মাইক্রোসপোরাম ক্যানিস এবং ট্রিকোফাইটোন রাবরাম এর বিরুদ্ধে সরিষার তেলের একটি বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া আছে। সরিষার তেল, নারিকেল তেল এবং আমলা তেলের ওপর একটি প্রিক্লিনিক্যাল সমীক্ষায় জানা গিয়েছে চুল বৃদ্ধির জন্য সরিষার তেল সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। সরিষার তেলে প্রচুর বিটা ক্যারোটিন ভিটামিন-এ তে রূপান্তরিত হয়ে চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়াও এতে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফ্যাটি এসিড ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে যা চুলের বৃদ্ধিতে অনেক সাহায্য করে।
সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে : সরিষার তেলে থাকা অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এজেন্ট দেহের ভেতরে জীবাণুদের প্রবেশ করতে দেয় না। আর যদি কোনো ক্ষতিকর এজেন্ট প্রবেশ করে তবে তাকে মেরে ফেলে। সরিষার তেল খেলে বিশেষ করে কোলন এবং ইন্টেস্টাইনে ইনফেকশন কম হয়।
ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখে : সরিষার তেলে রয়েছে কপার, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং সেলেনিয়াম। এই খনিজগুলো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
প্রাকৃতিক লোশন : গায়ের তাপমাত্রা কমাতে সরিষার তেল বেশ কার্যকরী। সরিষার তেলে রয়েছে গ্লুকোসিনোলেট, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং ছত্রাক প্রতিরোধক উপাদান। যা রক্ষা করে ছোঁয়াচে জাতীয় রোগ থেকে ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে থাকে।
ত্বকের তামাটেভাব দূর করে : দই, বেসন, সরিষার তেল ও কয়েকফোঁটা লেবুর রস একত্রে মিশিয়ে তা ত্বকে লাগাতে হবে এরপর ১০-১৫ মিনিট পরে ঠা-া পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এভাবে সপ্তাহে ৩ বার ব্যবহার করলে ভাল ফল পেতে পারেন।
প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন : সরিষার তেলে উচ্চমাত্রার ভিটামিন-ই থাকায় ক্ষতিকর আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ থেকে ত্বককে সুরক্ষা করে। ভিটামিন-ই বলিরেখা ও বয়সের ছাপ দূর করতেও সাহায্য করে। তাই সানস্ক্রিন লোশনের মতোই ব্যবহার করতে পারেন।
ক্ষুধা বৃদ্ধি করে : পাকস্থলীর পাচক রস উদ্দীপিত করার মাধ্যমে ক্ষুধা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে সরিষার তেল। যাদের ক্ষুধার সমস্যা আছে তারা রান্নার সময় সরিষায় তেল ব্যবহার করতে পারেন।
উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে
সরিষার তেল পরিপাক, রক্ত সংবহন ও রেচনতন্ত্রের শক্তিশালী উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া খাওয়ার পাশাপাশি বাহ্যিকভাবে শরীরে ম্যাসাজ করলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন এবং ঘর্ম গ্রন্থি উদ্দীপিত হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় : সরিষার তেলে গ্লুকোসিনোলেট ও মিরোসিনেস নামক উপাদান থাকে যা অ্যান্টিকারসিনোজেনিক উপাদান হিসেবে পরিচিত। এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কোলোরেক্টাল ও গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ক্যান্সার থেকে সুরক্ষাও প্রদান করে।
আসুন সরিষা আবাদ বৃদ্ধি করে দেশকে তেল ফসলে সমৃদ্ধ করি। বর্তমানে আবাদকৃত টরি-৭, মাঘী, ডুপিসহ স্থানীয় জাতের পরিবর্তে উচ্চফলনশীল সরিষার জাত বিনা-৪, বারি সরিষা৯, বারি সরিষা১৪, বারি সরিষা১৭, বারি সরিষা২০         প্রভৃতি জাত সম্প্রসারণ করতে করি। এ ছাড়া অনাবাদি পতিত, অনাবাদি চরাঞ্চল, উপকূলের লবণাক্ত, হাওর ও পাহাড়ি অঞ্চলকে তেলজাতীয় ফসল চাষের আওতায় আনতে সচেষ্ট হই। এভাবেই বাংলাদেশে সরিষাসহ অন্যান্য তেল উৎপাদনে নতুন সূর্য উদিত হতে পারে।

লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী, মোবাইল : ০১৮১৯৯২২৬১৩ 

বিস্তারিত
পরিবেশ সুরক্ষায় প্লাস্টিক দূষণ রোধে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার

পরিবেশ সুরক্ষায় প্লাস্টিক দূষণ রোধে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার
কৃষিবিদ ড. মোঃ আল-মামুন
বিজ্ঞানের অন্যান্য আবিষ্কারের মতো প্লাস্টিকের আবিষ্কারও ছিল চমকপ্রদ ও কল্যাণকর। তবে প্লাস্টিক বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা আজ মানবসভ্যতাকে ফেলেছে এক ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে। প্লাস্টিক ও ন্যানো প্লাস্টিক বর্জ্য নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ জীবের শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তন এবং ক্যান্সারসহ নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ হতে পারে।
প্লাস্টিক হচ্ছে কৃত্রিমভাবে তৈরি পলিমার, যা মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে রাসায়নিক উপায়ে তৈরি যেকোনো দ্রব্যের চেয়ে সস্তা, ব্যবহারবান্ধব এবং দীর্ঘস্থায়ী। ফলে বিদ্যুৎগতিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে এবং অবচেতন মনেই আমরা জল, স্থল ও অন্তরীক্ষের সবকিছুকে প্লাস্টিক দূষণে দূষিত করে ফেলছি। বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আগামী ২০৩১ সাল নাগাদ পৃথিবীতে প্লাস্টিকের দ্রব্য উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হবে। পরিবেশে অপচনশীল নানা রকম প্লাস্টিক বর্জ্যের সঙ্গে অতিবেগুনি রশ্মি এবং পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের মিথস্ক্রিয়ার ফলে মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিকের কণা এবং নানা রকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, যেমন বিসফেনল-এ, ফথেলেটস, বিসফেনোন, অর্গানোটিনস এবং ব্রোমিনেটেড ফেইম রিটারডেন্টস পরিবেশে নির্গত হয়। এসব প্লাস্টিক ন্যানো কণা এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মানুষ ও অন্যান্য জীবের কোষাভ্যন্তরে অবস্থিত ডিএনএ ও আরএনএ অণুর মধ্যে পরিবর্তন করে ক্যান্সার বা স্নায়ুতন্ত্র বিকল এবং প্রজননক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে।
প্লাস্টিক বর্জ্যরে মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করছে প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন ব্যাগ। পৃথিবীজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিক ব্যাগ আমরা ব্যবহারের পর ফেলে দিচ্ছি। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর মোট খনিজ তেলের ৪% ব্যবহৃত হয়। প্লাস্টিক ব্যাগ জৈববিয়োজনশীল নয়। এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পুরালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ ও ১৩৪০ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড মেশে। প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে সামুদ্রিক প্রতিবেশ। এর ফলে প্রতিবছর ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি এবং ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মৃত্যুবরণ করে। সামুদ্রিক প্রাণী ও মাছের শরীরে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ সঞ্চিত হয়ে তা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, প্রতিদিন ৮০ লাখ টুকরা প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পতিত হচ্ছে। এভাবে জমতে জমতে বড় বড় মহাসাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য জমাকৃত এলাকা (প্যাচ) তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রশান্ত মহাসাগরে বর্তমানে প্লাস্টিক বর্জ্যরে প্যাচের আয়তন প্রায় ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। অনুরূপ প্লাস্টিক বর্জ্য জমাকৃত এলাকা অন্যান্য মহাসাগর এবং সাগরেও সৃষ্টি হয়েছে। শুধু সমুদ্রের তলদেশ নয়, সমুদ্রের পানির উপরিস্তরের প্রায় শতকরা ৮৮ ভাগ কমবেশি প্লাস্টিক দূষণে দূষিত।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বের জন্য দুটি বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবেশে পচনরোধী প্লাস্টিকজাতীয় দ্রব্য, উপজাত, কণিকা বা প্লাস্টিকের দ্রব্য নিঃসরিত অণুর সংযোজন; যা মাটি, পানি, বায়ুম-ল, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও মানবস্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নত বিশ্বেও পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে মাটি, পানি ও বায়ু দূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত তৈরি হয়েছে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে পৃথিবীর সর্বাধিক প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারকারী দেশ ইতালি। প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা দেশের মধ্যে আছে ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকাসহ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন রাজ্য। এ তালিকা প্রতি বছরই বাড়ছে। ওয়ালমার্ট, টেসকোর মতো বৃহৎ চেইন শপগুলো পাটের ব্যাগ ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব জানার সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকের বিকল্প সন্ধান করা হচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণ রোধে প্রাকৃতিক পলিমারের মাধ্যমে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য সচেতনভাবে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে বাণিজ্যিক পূর্ণচক্রায়ণ, প্লাস্টিকের বিকল্প পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার, একক ব্যবহার পলিথিন ব্যবহারের পরিবর্তে কাপড়ের, কাগজের কিংবা বহুবার ব্যবহারযোগ্য ব্যাগের ব্যবহার এবং প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে তথ্য সংযোজনের মাধ্যমে সচেতন নাগরিক তৈরি কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের উষ্ণায়নের ১০-১৩ শতাংশ অবদান হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর মাধ্যমে। এসব ক্ষতিকারক বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কজাত করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।
প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহারে মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পাটের সুতা মূলত সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ ও লিগনিন দ্বারা গঠিত। সেজন্য পাটজাত দ্রব্যের বর্জ্য সহজে পরিবেশে পচে মৃত্তিকার উর্বরা শক্তি বাড়ায়। পাট ও পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে পাটপণ্যকে ‘বর্ষপণ্য ২০২৩’ ঘোষণা করেছে সরকার। বাংলাদেশের সোনালি আঁশের মাধ্যমে তৈরি সোনালি ব্যাগসহ প্লাস্টিকের বিকল্প অন্যান্য পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারে জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য সরকার, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে। সর্বত্র পাটজাত পণ্যের প্রাপ্তি সুলভ করতে সরকার এসব পণ্য উৎপাদনে ভর্তুকি প্রদান করে উৎপাদনকারীদের উৎসাহী করে তুলতে পারে।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইল : ০১৭১১১৮৬০৫১, ই-মেইল : almamunbjri@gmail.com

বিস্তারিত
পলিনেট হাউজ আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য কৃষি প্রযুক্তি

পলিনেট হাউজ আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য কৃষি প্রযুক্তি
মোছলেহ উদ্দিন সিদ্দিকী
পলিনেট হাউজ। উন্নতমানের পলি ওয়েলপেপারে আবৃত চাষযোগ্য কৃষি ঘর। সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি নিয়ন্ত্রণ, অত্যাধুনিক সেচ ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিকর পোকার প্রবেশ রুখে দিয়ে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের এক আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি। এ প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে বছরব্যাপী উচ্চমূল্যের ফসল ফলানো যায়। এ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত ফসল  প্রাকৃতিক দুর্যোগেও নিরাপদ ও অক্ষত রাখা যায়। পলিনেট হাউজে আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সুবিধা থাকায় ফল-ফসল ও সবজি চারা আগাম উৎপাদন করা সম্ভব। এতে কৃষক অধিক লাভবান হয়ে থাকেন।    
দিনের বেলায় সূর্যরশ্মির শতকরা ৫০ ভাগ নিয়ন্ত্রণের সুবিধা এতে থাকে। পলিনেট হাউজে সেচ ব্যবস্থাপনা খুবই আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। এতে ড্রিপ সেচ এবং স্প্রিংকলার ইরিগেশন সুবিধা বিদ্যমান। স্প্রিংকলার ইরিগেশন সিস্টেম পলিনেট হাউজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। কোন কারণে পলিনেট হাউজে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে এই স্প্রিংকলার ইরিগেশন সিস্টেম সহজে এর ভেতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে এনে ফসলের উপযোগী ও স্বাভাবিক করে তোলে। আবার ড্রিপ সেচ প্রযুক্তি গাছের গোড়ায় সাশ্রয়ীভাবে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করে। এতে ফসল যথাযথভাবে বেড়ে উঠে এবং ফলন আশানুরূপ হয়।
পলিনেট হাউজে পোকামাকড়ের আক্রমণ হওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না। তাই বালাইনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। এর ফলে বিষমুক্ত নিরাপদ ফসল উৎপাদন নিশ্চিত হয়। বিশেষ করে উচ্চমূল্যের বিষমুক্ত ও নিরাপদ সবজি উৎপাদনের নির্ভরযোগ্য কৌশল হলো পলিনেট হাউজ।
বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার “বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের” মাধ্যমে এ প্রযুক্তি ও কৌশল সম্প্রসারণ সফলভাবে করে যাচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় নির্বাচিত সফল কৃষকদের ১০ শতাংশ জমিতে পলিনেট হাউজ তৈরিসহ চলমান উৎপাদন কার্যক্রমে সব রকমের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। কৃষক এবং মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাগণের দক্ষতা ও কারিগরি জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশি ও বিদেশী প্রশিক্ষক দ্বারা নিবিড় প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাংলাদেশের বিভিন্ন  অঞ্চলে পলিনেট হাউজ নির্মাণে  কৃষককে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া-ই পলিনেট হাউজ প্রযুক্তির মূল উদ্দেশ্য। যেহেতু এটি নিয়ন্ত্রিত চাষ ব্যবস্থাপনা, তাই এতে শীতের তীব্রতা, ভারী বৃষ্টি অথবা গ্রীষ্মের খরতাপজনিত ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। পলিনেট হাউজে সবসময় অনুকূল আবহাওয়া বিরাজমান রাখা যায় বিধায়, শীতকালীন সবজি যেমন গ্রীষ্মকালে, তেমনি গ্রীষ্মকালীন সবজি শীতকালে উৎপাদন করা যায়।
সব ধরনের উচ্চমূল্যের ফসল চাষ এবং চারা উৎপাদন পলিনেট হাউজে করা সম্ভব। এসবের মাঝে আছে-ক্যাপসিকাম, টমেটো, ফুলকপি, রঙিন ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, স্কোয়াশ, স্ট্রবেরি, মেলন, শসা, লেটুসসহ উচ্চমূল্যের নানা রকম শাকসবজি।
পলিনেট হাউজে যেকোন সময় যেকোন ফসলের চারা উৎপাদনের কাজটি সহজে করা যায়। কারণ এটিতে কৃষক তার ইচ্ছা অনুযায়ী অনুকূল আবহাওয়া বিরাজমান রাখতে পারেন। তাপ নিয়ন্ত্রণের কাজটি যেহেতু হাতের মুঠোয় সেহেতু যেকোন সময় অধিক সংখ্যক চারা উৎপাদন করে বিক্রি করতে পারেন।  
পলিনেট হাউজ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য কৃষি প্রযুক্তি। পলিনেট হাউজের আধুনিক প্রযুক্তির সাফল্য বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকের মাঝে ব্যাপক সারা জাগিয়েছে। কারণ, প্রকৃতির বিরূপতাকে পেছনে ফেলে কৃষক তার চাষের ইচ্ছেগুলো সাজাতে পারছেন নিজের মতো করে। এখানে ফসল চাষে নেই সময়ের বাধ্যবাধকতা, নেই প্রকৃতির বিরূপতা। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উচ্চমূল্যের ফসল চাষ এবং আগাম চারা উৎপাদনের কাজ নিশ্চিত হওয়ায় বাংলাদেশের কৃষি ক্রমে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার প্রাণস্পর্শে।   
(বি. দ্র. : কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্তৃক তৈরিকৃত ডকুমেন্টারি)

লেখক : ফিল্ম প্রোডাকশন অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, ঢাকা, মোবাইল : ০১৫৫৬৩৩২৯৬৯ ই-মেইল : fpo@ais.gov.bd

বিস্তারিত
মিশ্রচাষে তারা বাইম অধিক লাভের নিশ্চয়তা দেয়

মিশ্রচাষে তারা বাইম অধিক লাভের নিশ্চয়তা দেয়
মোঃ তোফাজউদ্দীন আহমেদ
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্য চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণভাবে বিশে^র অন্যতম প্রধান মৎস্য উৎপাদনকারী দেশ। এফএও অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশে^র ৬ষ্ঠ বৃহত্তম মৎস্য উৎপাদনকারী দেশ। জাতীয় আয় ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মৎস্য চাষ ও খাদ্যাভাস গড়ে তোলার প্রভাব রয়েছে। মৎস্যখাত বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি। আর এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে তারা বাইম চাষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ মাছ অধিকাংশ সময় গলিত ও পচা জৈব পদার্থ খেয়ে বড় হয়। এ মাছ পানির তলদেশে কাদার ভেতর লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। এ মাছ সাধারণত প্রবাহমান এবং স্থির স্বাদু পানিতে বাস করে এবং ছোট আকারের খাল-নদী, জলাধার, বিল-প্লাবনভূমিতে এবং পুকুর-দীঘিতে বসবাস করে। কচুরিপানা তথা জলজ আগাছার মধ্যে ডিম দেয়। বর্তমান সময়ে তারা বাইম মাছ সাথী ফসল হিসেবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ হচ্ছে। হ্যাচারিতে এ মাছের প্রণোদিত প্রজনন সম্ভব হয়েছে এবং বাণিজ্যিকভাবে পোনা উৎপাদন শুরু হয়েছে। বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ছোট প্রজাতির মাছের ভেতরে এ মাছটির বাণিজ্যিক গুরুত্ব খুবই বেশি। সুস্বাদু এ মাছ বেশ জনপ্রিয় এবং বাজারে বেশ চড়া দামে বিক্রয় হয়। এ মাছ দৈর্ঘ্য প্রায় ২০-২৫ সেমি. হতে দেখা যায়। তারা বাইম মাছ সর্পিলাকার, শরীরের রং হলুদাভ হয়ে থাকে এবং এ মাছের লেজের দিকে গোলাকার তারার মতো কালো দাগ থাকে বলে এ মাছটিকে তারা বাইম নামে ডাকা হয়।
তারা বাইম মাছ চাষের সুবিধা
এ মাছটি চাষের বেশ কয়েকটি সুবিধা রয়েছে যেমন- এ মাছটি রাক্ষুসে স্বভাবের নয় বিধায় অন্য মাছের সাথে, মিশ্রভাবে চাষ করা যেতে পারে; এ মাছের অক্সিজেন স্বল্পতাজনিত সমস্যা তেমন হয় না; বর্তমানে এ মাছের পোনা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে; সাথী ফসল হিসেবে বাড়তি খাবার ছাড়াও চাষ করা যায়।
চাষের পুকুর নির্বাচন : মাছচাষের সফলতা, সঠিকভাবে চাষের জলাশয় নির্বাচনের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। তারা বাইম মাছ ছোট বড় সব ধরনের পুকুরে চাষ করা যেতে পারে। তবে ছোট পুকুরেই চাষ করা ভাল। তারা বাইম মাছ পুকুরের তলদেশে কাদার ভিতর থাকে বিধায় এ মাছ ধরার জন্য পানি সেচের প্রয়োজন হয়। পুকুরের পাড় যথেষ্ট চওড়া হতে হবে যাতে বর্ষার সময় মাছ কাকড়ার গর্ত দিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে। পুকুরের পানির গভীরতা ৪-৫ ফুট হতে হবে। স্বল্প গভীর পুকুরের তলদেশে সূর্যের আলো প্রবেশ করে যা তারা বাইম মাছ সহ্য করতে পারে না। পুকুরটি মাঠের মধ্যে খোলামেলা স্থানে হলে ভাল হয়। পুকুরের তলদেশ বালুকাময় বা কিছুটা কাদা থাকাতে হবে কারণ এ মাছ স্বভাবগতভাবে কাদার ভেতরে অবস্থান করে। তবে ৫-৬ ইঞ্চির বেশি অতিরিক্ত কাদা থাকা ঠিক নয়।
চাষের পদ্ধতি নির্ধারণ : লাভজনক মাছ চাষের জন্য সঠিক মাছ চাষ পদ্ধতি নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য সঠিকভাবে পুকুর নির্বাচনের পরে চাষের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। তারা বাইম মাছচাষের বিষয়ে যতটুকু জানা গেছে তাতে এ মাছ এককভাবে চাষ করার চেয়ে অন্য মাছের সাথে মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ করায় ভাল। এ মাছ পানির তলদেশে বাস করে। একক চাষ করলে পুকুরের উপরের স্তরসমূহ অব্যবহৃত থেকে যাবে। যারা এ মাছচাষে সফল হয়েছেন তারা সকলে মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ করেছেন। সাধারণভাবে রুইজাতীয় মাছ, পাবদা-গুলশা, গলদা চিংড়ি ও তেলাপিয়া মাছের সাথে এ মাছচাষ করা যেতে পারে। যে সকল মাছ চাষের সময় পুকুরের পানি অধিকতর সবুজ হয়ে যায় (যেমন থাই কৈ, পাংগাস ইত্যাদি) সে সব মাছের সাথে তারা বাইম মাছ চাষ না করা ভাল।
চাষের পুকুর প্রস্তুতি : আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তারা বাইম মাছের একক চাষের তেমন প্রচলন নাই। সাধারণত রুইজাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। কার্পজাতীয় মাছের চাষের জন্য যেভাবে পুকুর প্রস্তুত করতে হয় সেভাবেই এ মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুত করতে হবে। বিশেষ করে পুকুরের ভেতরের পাড় ভালভাবে মেরামত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে পুকুরের পাড়ে যেন কোন সুড়ং বা গর্ত না থাকে। পুকুরে পানি প্রবেশের বা বের করে দেবার জন্য কোন প্রকার নালা রাখা যাবে না। কারণ নালার মুখে যত ঘন নেটের বেড়া দেয়া হোকনা কেন তারা বাইম মাছ ছোট ফাঁক দিয়েও বের হয়ে যেতে পারে। পুকুর সেচ দিয়ে সকল ধরনের মাছ ধরে ফেলতে হবে এবং সুযোগ থাকলে পুকুরটি শুকিয়ে নিতে হবে। পুকুর শুকানোর পর নিয়মমাফিক শতকে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে তবে পুকুর সেচ দিয়ে তৈরি করলে পানি প্রবেশের আগে ৫০০ গ্রাম এবং পানি প্রবেশের পরে বাকি ৫০০ গ্রাম চুন পানিতে ভাল করে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুুকুরের পানির গভীরতা ৪-৫ ফুট রাখতে হবে। চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পরে শতকপ্রতি ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১৫০ গ্রাম হারে টিএসপি প্রয়োগ করে পুকুরে মাছের জন্য             প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদন করে নিতে হবে।
পুকুরের ভেতরের পাড় ঘেঁষে নেট স্থাপন : যেসব পুকুরের পাড় যথেষ্ট চৌড়া নয় বা যেসব পুকুরের পাড় নিরাপদ নয় বলে মনে হলে পুকুরের পাড়ের ভেতরের অংশে নীল নেট পাড় ঘেঁষে সুন্দরভাবে আটকিয়ে দিতে হবে। আবার এখানে উল্লেখ থাকে যে তারা বাইম সাধারণত পুকুরের পাড়ের গর্ত দিয়ে বের হয়ে যাবার প্রবণতা আছে এবং এরা দিনের বেলা নিজেকে গর্তের ভেতর বা আবর্জনা ও ডুবন্ত জলজ আগাছার নিচে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। অর্থাৎ এ মাছ আলোর আড়ালে থাকতে পছন্দ করে এ জন্য পুকুরের এক পাশে কিছু কচুরীপানা রাখা যেতে পারে। যাতে প্রয়োজনের সময় এ মাছ তার তলে আশ্রয় নিতে পারে। তা ছাড়াও এ মাছের আশ্রয়স্থল হিসেবে পুকুরের তলদেশে ভাংগা হাড়ি, প্লাস্টিকের বিভিন্ন আকারের পাইপ, বাঁশ বা বাঁশের কুঞ্চির আঁটি দেয়া যেতে পারে।
পোনা মজুদ : মূল মাছের পোনা মজুদের কয়েক দিন পরে তারা বাইম মাছের পোনা মজুদ করতে হবে। বর্তমানে ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায় এ মাছের পোনা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। আগে দাম বেশি থাকলেও বর্তমানে বেশ কম দামে এ পোনা সংগ্রহ করা যাচ্ছে। সাথী ফসল হিসেবে চাষ করলে ৩৩ শতক পুকুরে ৩-৪ হাজার পোনা দেয়া যেতে পারে। তবে এর বেশিও ছাড়া যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে পুকুরের তলদেশে বাস করে যেমন মৃগেল, কার্পিও, বাটা এ ধরনের মাছ কম ছাড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে একয় আয়তনের পুকুরে ১০ হাজারটি পর্যন্ত ছাড়া যেতে পারে। চেষ্টা করতে হবে পুকুরে ২-৩ ইঞ্চি আকার বা তার বড় আকারের পোনা মজুদ করার জন্য।
মাছের খাদ্য প্রদান : সাধারণত পুকুরে মূল যে মাছ চাষ করা হচ্ছে সে মাছের জন্য খাবার দিলে চলে। খাবার হাতে বানানো ভিজা খাবার, বাজারের পিলেট খাবার যে কোন খাবার দেয়া যেতে পারে। তবে পাবদা হলে উক্ত মাছের জন্য বাজারে যে ভাসমান খাবার পাওয়া যায় সে খাবার ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা বাইম মাছের জন্য আলাদা খাবার দিতে হয় না। তবে অধিক হারে ছাড়লে (৩৩ শতকে ৩-৪ হাজারের বেশি) তারা বাইম মাছকে আলাদা খাবার দিতে হবে। তারা বাইম মাছ পুকুরের তলদেশে বাস করে এবং এরা ডুবন্ত খাবার খেতে পারে। এ মাছের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এরা নিশাচর (ঘড়পঃঁৎহধষ ঋববফরহম ঐধনরঃং) মাছ সাধারণত এরা রাতে এবং খুব ভোরে খাবার সংগ্রহ করে। এ জন্য এদের সন্ধ্যার পরে এবং ভোর রাতে খাবার দিতে হবে। বাজারে প্রাপ্ত ৩০% আমিষ সমেৃদ্ধ খাবার বিশেষ করে চিংড়ির জন্য ব্যবহৃত পিলেট খাবার এদের জন্য খুবই উপযোগী। সন্ধ্যার পরে পুকুরের কিনার ঘেঁষে অগভীর অংশে খাবার দিতে হবে। এ মাছ প্রাকৃতিকভাবে জৈব পচনশীল দ্রব্য খায় এ জন্য পুকুরে মাঝে মধ্যে অর্ধপচা কচুরিপানা প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ জন্য পুকুরের এক কর্নারে পানির উপরের অংশে কচুরিপানা বা টোপাপানা মজুদ করে কালো পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখলে অর্ধপচা কচুরিপানা পাওয়া যেতে পারে। এটি কার্পজাতীয় অনেক মাছেও খেয়ে থাকে।
অন্যান্য পরিচর্যা : মাছকে নিয়মিত খাবার প্রদানের পাশাপাশি পুকুরে প্রাকৃতিক খাবারের উপস্থিতির বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এ জন্য নিয়মিত বিরতিতে পুকুরে ইউরিয়া ও টিএসপি সার দিতে হবে। পুকুরের পানির গভীরতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রচুর্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রিবায়োটিক্স তথা শতকে ১৫০ গ্রাম অটোকুড়া, ১৫০ গ্রাম চিটাগুড় এবং ৫ গ্রাম ইস্ট পর্যাপ্ত পানিতে ২৪-৪৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে পুকুরে প্রয়োগ করা। প্রিবায়োটিক্স প্রয়োগ করলে পুকুরে প্রচুর পরিমাণে জু-প্লাংকটন তৈরি হয় এবং পুকুরের পানিতে এ্যামোনিয়াজনিত সমস্যা দূর হয়।
সতর্কতা : বর্ষার পানিতে পুকুরের পানি বেড়ে গেলে এ মাছ বের হয়ে যাচ্ছে কি না খেয়াল রাখতে হবে। পুকুরের পাড়ের গর্ত নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পুকুরের পানি গাঢ় সবুজ হয়ে যাওয়াটা সব সময় মাছচাষের জন্য ক্ষতিকর এ জন্য এ মাছের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টিতে নজর রাখতে হবে। চাষ চলাকালে চুন প্রয়োগের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে শতকে ১০০-১৫০ গ্রামের অধিক চুন প্রয়োগ না করা ভাল।
মাছ আহরণ : তারা বাইম মাছ ধরা কঠিন বলে অনেকের মনে করে থাকেন। এ মাছ ধরার জন্য ভোর বেলা অন্ধকার থাকা অবস্থায় জাল দিয়ে প্রায় ৫০% পর্যন্ত মাছ ধরা যায়। বাকি মাছ পুকুরের পানি সেচ দিয়ে ধরতে হয়। পুকুর সেচ দিলে পুকুরের তলার নিচু অংশে কাদার ভেতর এ মাছ জমে। এ কাদা অংশে ইউরিয়া তুতের সাথে পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে অথবা মাছ মারার জন্য ব্যবহৃত রোটেনন পাউডার পানির সাথে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে তা হলে সমস্ত মাছ কাদা থেকে বের হয়ে আসবে এবং পুকুর থেকে শিং মাছ ধরার অনুরূপে মাছ ধরতে হবে।
মাছচাষে আগের মতো আর লাভ হচ্ছে না ঠিকই কিন্তু এর মাঝেও অনেকে সফলতার সাথে মাছচাষ করছেন এবং লাভবান হচ্ছেন। বর্তমান সময়ে একটু চিন্তাভাবনা করে মাছচাষে যারা সফল হচ্ছেন তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, বুঝে বুদ্ধিমত্ত্যার সাথে মাছ চাষ করলে অবশ্যই মাছচাষে লাভবান হওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। মনে রাখতে হবে নতুন প্রজাতির মাছচাষের হাত ধরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি গোষ্ঠী জীবনের সফলতা নিশ্চিত করেছেন। সময়  মতো সুযোগ গ্রহণ না করে যখন সকলে চাষ শুরু করবে এবং বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে সে মাছের দাম কমিয়ে দেয় তখন আর চাষ করে অন্যদের মতো আর্থিক সফলতা অর্জন করা যায় না।

লেখক : বিভাগীয় উপপরিচালক (অব.), মৎস্য অধিদপ্তর, মোবাইল : ০১৭৫১৯৩৯৯৩২, ই-মেইল : ঃtofaz2010@gmail.com

বিস্তারিত
পোলট্রি উৎপাদনে ইঁদুর হুমকি

পোলট্রি উৎপাদনে ইঁদুর হুমকি
ডা: মোহাম্মদ মিজানুর রহমান
যেখানে খাদ্য ও আবাসস্থলের প্রতুলতা আছে সেইসব স্থানে ইঁদুর (জধঃ ্ সরপব) একটি বড় সমস্যা। পশুপাখি বা মানুষের খাবার বা এর উচ্ছিষ্টাংশকে এরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং সংক্রমিত করে (আমেরিকায় যার ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২৫ টঝউ সমপরিমাণ শস্য/ইঁদুর/বছর)। এইসকল প্রাণীর অবিশ্বাস্য অভিযোজন ক্ষমতা এবং চলন গতি দ্রুততার জন্য এদের থেকে পরিত্রাণ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। ইঁদুর উলম্ব পৃষ্ঠে দৌড়াতে পারে, সরু তারের উপর দিয়ে অনায়াসে চলতে পারে এবং ভূমি হতে ১ ফুট পর্যন্ত লাফ দিতে পারে। বাংলাদেশে সাধারণত ২ ধরনের ইঁদুর খামারে বেশি দেখা যায় যেমনঃ ধেড়ে ইঁদুর এবং নেংটি ইঁদুর
ইঁদুরের উপস্থিতি
খামারে ইঁদুরের উপস্থিতি সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমেরিকার ওন্টারিও তে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৮০% পোল্ট্রি খামারি এবং ৮৯% শুকর খামারে ইঁদুরের সমস্যা বিদ্যমান। অধিকাংশ খামার বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারগুলোতে ইঁদুর উপদ্রব বেশি এবং অনেকক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন। ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে খামারে ইঁদুরের উপস্থিতি তদারকি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
খামার ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণসমূহ
   চলাচল, দেয়ালে আরোহণের শব্দ, চিঁ-চিঁ শব্দ এবং ধুলোযুক্ত অংশে চলাচলের চিহ্ন
    দেয়ালে, বিভিন্ন বস্তুর পেছনে এবং খাদ্যের কাছাকাছি মলের উপস্থিতি
    মেঝে বা খামারের আশপাশে সদ্য মাটি খোঁড়ার চিহ্ন ইঁদুরের গর্ত নির্দেশ করে।
    কামড় বা চিবানোর চিহ্ন এবং বোর্ড বা কাঠের উপর, খুঁটি, মাচা, কার্নিশে কাঠের গুঁড়া দেখা যাবে।
    ইঁদুরের উটকো গন্ধ সার্বক্ষণিক ইঁদুরের উপস্থিতির একটি লক্ষণ।
    চোখে দেখে সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলে দিনের আলোতে প্রায়ই ইঁদুর দেখা যায়। প্রচলিত একটি থাম্বরুল (ঞযঁসন জঁষব) যে, যদি একটি ইঁদুর দেখা যায় তার মানে ঐখানে ২০-২৫টি ইঁদুর (জধঃ/গরপব) আছে।
ইঁদ্ুর যেভাবে ক্ষতি করে-
    আবাসনের বা খামারের ক্ষতি : এরা খামার স্থাপনার কাঠ এবং বৈদ্যুতিক সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইঁদুর (জড়ফবহঃং) ঘর এবং ফার্ম বিল্ডিং এবং খাদ্য সংরক্ষণাগারের কাঠামো এবং ঘরের অভ্যন্তরস্থ উপাদানের প্রভূত/গুরুতর ক্ষতিসাধন করে
    ইনসুলেশন এর ক্ষতি : খামারের সবধরনের আস্তরণ করে বাসস্থান অল্পসময়ে নষ্ট করে ফেলে।
    খাদ্য গ্রহণ : ১০০টি ইঁদুর বছরে ১ টনের অধিক খাদ্য গ্রহণ করতে পারে
    খাদ্য সংক্রমিত/নোংরা করে : প্রাণীর জন্য সরবরাহকৃত খাদ্য ও সংরক্ষিত শস্য গ্রহণ এবং দূষিত করার জন্য ইঁদুর কুখ্যাত। একটি ইঁদুর যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে তার ১০ গুণ খাদ্য এদের মলমূত্র এবং লোম দ্বারা নোংরা বা সংক্রমিত করে। একটি ধেড়ে ইঁদুর বছরে ২৫,০০০ এবং নেংটি ইঁদুর ১৭,০০০ মল তৈরি করতে পারে! যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ইঁদুর ২ বিলিয়ন টঝউ এর সমপরিমাণ খাদ্যশস্য ক্ষতিগ্রস্ত করে।
    জীবনিরাপত্তা ব্যাহত করে : গবাদিপশু ও পোল্ট্রিতে ইঁঁদুর কমপক্ষে ৪৫টি রোগের বাহক হিসেবে স্বীকৃত, যেমন- সালমোনেলোসিস, পাস্চুরেলোসিস, লেপটোস্পাইরোসিস, সোয়াইন ডিসেন্ট্রি, ট্রাইচিনোসিস, টক্রোপ্লাজমোসিস এবং জলাতঙ্ক। এরা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে সাধারণত এদের পায়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়।
    জুনুটিক রোগসমূহ : ইঁদুর মানুষে বিভিন্ন রোগের জীবাণু নিজে আক্রান্ত হয়ে বা বাহক হিসেবে ছড়িয়ে মানব স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি হিসেবে কাজ করতে পারে। যেমন: প্লেগ, সালমোনেলোসিস, ই-কোলাইজনিত ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস-ই, অ্যামিবিক আমাশয় ইত্যাদি।
নিয়ন্ত্রণ
ইঁদুর-প্রতিরোধী খামার স্থাপনা : খামার করার আগে ধারণাগত ও কাঠামোগত জীব-নিরাপত্তার অংশ হিসেবে ইঁদুর প্রতিরোধী খামার স্থাপনা করতে পারলে পরবর্তীতে খামারকে ইঁদুরের প্রবেশ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। ইঁদুর দ্বারা সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে ইঁদুর-নিরোধী স্থাপনা। গবেষণায় দেখা যায়, ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে যদি অসুরক্ষিত ফাঁকা জায়গা বা ছিদ্র থাকে তবে খামারে ইঁদুর পুনঃআক্রমণ করবে। ইঁদুরের লুকানোর জায়গাগুলো দূর করতে হবে।
গুদামঘর, খাদ্য-কক্ষ, সংযুক্ত থাকার জায়গা এবং যেখানে নির্মাণকাজ দুর্বল সেসব জায়গা দেয়াল, মেঝে বা চিলে-কোঠা দিয়ে ইঁদুর প্রবেশ করতে পারে। তাই নির্মাণসামগ্রী ভালো মানের ব্যবহার করে যদি নির্মাণকৌশল ত্রুটিপূর্ণ হয় তবে খামার ইঁদুর-নিরোধী হলেও পরবর্তীতে এরা প্রবেশ করতে পারে। ইঁদুরের বেয়ে উঠা প্রতিরোধ করতে ঘরের কোনায় (১২-১৮ ইঞ্চি) বা বাইরের দিকে ভূমি হতে বাইরের দেয়ালে ৩৬ ইঞ্চি (বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রচলিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি লেয়ার মুরগির ফার্মে) এলুমিনিয়াম শিট মেটাল ব্যান্ড স্থাপন করলে ইঁদুরের প্রবেশ সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা
খামারির মালিককে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে কার্যকর ইঁদুর নিরোধন ব্যবস্থা ইঁদুর-মুক্ত খামার স্থাপনার নিশ্চয়তা প্রদান করবে না। ইঁদুর হয়তো চিবিয়ে, ক্ষয় করে নতুন প্রবেশপথ তৈরি করে বা এমনকি কোন তৈজসপত্র বা বাক্সের মাধ্যমে খামার স্থাপনায় প্রবেশ করতে পারে। তাই ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে যার মধ্যে নিয়মিত নজরদারি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, এবং সংখ্যা বা বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ অন্তর্ভুক্ত।
খামারে বিদ্যমান ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ
ফাঁদ  : ¯œ্যাপ বা বক্স ফাঁদ বেশি ব্যবহৃত হয়। ফাঁদের ভেতরে ইঁদুরের পছন্দনীয় খাবার যেমন পাউরুটি, আলু, শুঁটকি মাছ, মাংস, মাখন, চিজ বা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
গ্লু বোর্ড  : এই পদ্ধতি নেংটি ইঁদুরের বিরুদ্ধে খুবই কার্যকর। একটি মাঝারি আকারের পোল্ট্রি বা ডেইরি ফার্মের জন্য অন্তত ৫০-১০০টি গ্লুবোর্ড স্থাপন করতে হয়।
শিকারি প্রাণি : যেমনঃ বিড়াল; এই পদ্ধতিতে অল্প ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
সাউন্ড ও আল্ট্রাসাউন্ড যন্ত্র  : বাণিজ্যিক মুরগির খামারে এই পদ্ধতি কার্যকর নয় কারণ অতিরিক্ত শব্দে মুরগি ভয় পায় ফলে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে।
সর্বোপরি ইঁদুর দ্বারা প্রতি বছর লাইভস্টক এবং পোল্ট্রি খামারের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের দেশে প্রতি বছর জাতীয় ইঁদুর নিধন কার্যক্রম হয়ে থাকে। সে লক্ষ্যে লাইভস্টক এবং পোলট্রি খাবারের ইঁদুর দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করা জরুরি। জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২৩ সফল হোক।

লেখক : উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (এল/আর), আঞ্চলিক প্রাণিরোগ অনুসন্ধান গবেষণাগার (এফডিআইএল), সিরাজগঞ্জ। মোবাইল : ০১৭১৬৪৬০৮৫৩ ই-মেইল :shahinmr1978@gmail.com

বিস্তারিত
আমন ও বোরো মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারে সাশ্রয়ের পরিমাণ প্রায় ২,৭১৪ কোটি টাকা

আমন ও বোরো মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারে সাশ্রয়ের পরিমাণ প্রায় ২,৭১৪ কোটি টাকা
তারিক মাহমুদুল ইসলাম
ষক রত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় কৃষিমন্ত্রী জনাব ড. মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক এমপি এর তত্ত্বাবধায়নে ২০২১ এর বোরো মৌসুম থেকেই বাংলাদেশে নেওয়া হয় এক বিপ্লবী পরিকল্পনা যন্ত্রায়ন ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প, যা বাংলাদেশে স্মার্ট কৃষির ভিত্তিস্থাপন করে। ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার এই প্রকল্প আনুষ্ঠানিক ৩ বছর পার করছে জুন ২০২৩। যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের কৃষির কার্যক্রম সম্পাদন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে কম্বাইন হারভেস্টার অন্যতম। এরই মধ্যে গত আমন ও বোরো মৌসুমে অভাবনীয় সফলতা দেখিয়েছে কম্বাইন হারভেস্টর। কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার কারণে কৃষকের প্রায় ২,৭১৪ কোটি টাকা অর্থ সাশ্রয় হয়েছে।  প্রকল্পে ডিপিপিতে বলা হয়েছে ৫ বছরে অর্থ ২০% সাশ্রয়, সময় ৫০%। প্রকল্প ইতিমধ্যেই ৮০% অর্থ সাশ্রয়, ১৫০% সময় সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। এই প্রকল্প থেকে গত তিন বছরে কৃষকের মাঝে ৯,০০০টি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করা হয়েছে। কম্বাইন হারভেস্টার দ্বারা সমস্ত প্রক্রিয়া (ধান কাটা, ঝাড়াই, মাড়াই, বস্তাবন্দী) করে কৃষক বাজারে ধান বিক্রয় করতে সক্ষম হচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় দেখা যায় এক সাথে ধান সিদ্ধ করা হচ্ছে। সাশ্রয়কৃত সময় কৃষকরা শিল্প কারখানায় কাজ করে বাংলাদেশকে উন্নত ও শিল্প সমৃদ্ধের দেশ গড়ে তুলছে। কম্বাইন হারভেস্টারসহ কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে ঘিরে সারা দেশে খুচরা যন্ত্রাংশের বিশাল বাজার সৃষ্টি হচ্ছে।  যা গ্রামীণ অর্থনৈতিকে এক অন্যূন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে।
কম্বাইন হারভেস্টারের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদনের দেশ হবে বাংলাদেশ। প্রদিবেদনে উল্লেখ করা হয় চীন ও ভারতের পর  তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। দেশের কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে নতুন ধানের জাতসহ যন্ত্রনির্ভরতা বাড়ায় উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিমন্ত্রী জনাব ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি জানান ধান কাটার ক্ষেত্রে সরকার যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর ফলে এমন সফলতা।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা হতো ৪%। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দাড়িয়েছে আমন মৌসুমে ১১.২২% বোরো মৌসুমে ২২.১৭%। গড়ে ১৬.৬%। কিছু দিন আগেও এ আধুনিক যন্ত্র সম্পর্কে অনেকের ধারণা ছিল না। ছিল সংশয় ও ভীতি। বর্তমানে সে অবস্থা থেকে বেড়িয়ে এসেছে কৃষক।
ইতিহাস বলছে ষাটের দশক থেকে এ দেশে পাওয়ার টিলার, সেচ মেশিন কাজ শুরু করেছে। এই মেশিনগুলো ৯০ এর দশকে এসে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। একটি প্রযুক্তি চালু করে কৃষকের কাছে জনপ্রিয়তা করতে ৩০ বছর সময় লেগেছে। কিন্তু  প্রযুক্তিগতভাবে জটিল আধুনিক মেশিন কম্বাইন্ড হারভেস্টার মাত্র ৩-৪ বছরে কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। বিশেষ করে গত দুই বছরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ডিএইর এক জরিপে পর্যালোচনা করে দেখা যায় সনাতন পদ্ধতিতে ১ একর ধান কাটা, ঝাড়াই, মাড়াই, বস্তাবন্দী করতে শ্রমিকের সময় লাগে (১৮ জন, ৮ ঘণ্টা হিসাবে) ১৪৪ ঘণ্টা। অর্থের হিসাবে ১৪,৪০০ টাকা। সাথে কৃষক-কৃষাণির পরিশ্রম। কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে পরিশ্রম ছাড়া সকল কাজ মাত্র ১ ঘণ্টা সম্ভব। খরচ পড়ে ৬,০০০ টাকা।
বাংলাদেশের হাওর এলাকা আমন ও বোরো মৌসুমে ৩৮০০টি কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে মোট জমি ৭০% ধান কাটা হয়। ধান কাটার জন্য বন্ধ করে দেয়া হতো স্থানীয় বালু মহলগুলো। তবে এ বছরের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। হাওরে তেমন কোনো শ্রমিক সংকট ছিল না।
কম্বাইন হারভেস্টার আমন ও বোরো মৌসুমে  কর্তনকৃত জমির পরিমাণ ১৭,৪২,০৩৮ হে.। আমন ও বোরো মৌসুমে শস্যের অপচয় রোধ ৪,১৩,৭১৬ টন যার বাজারমূল্য প্রায় ১০১৮ কোটি। কম্বাইন হারভেস্টার দ্বারা আমন ও বোরো মৌসুমে ধান কর্তনে সাশ্রয়ের পরিমাণ প্রায় ১,৬৯৫ কোটি। মোট সাশ্রয়ের পরিমান ২,৭১৪ কোটি টাকা।  
২০২২-২০২৩ অর্থবছর ঘূর্ণিঝড় মোখার ফসল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষায় কম্বাইন হারভেসটার সারা বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা রেখেছে। ঐ সময় কৃষকের খেতে পাকা ধান ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস ও শ্রমিক সংকটের মধ্যেমে কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কেটে, মাড়াই ও ঝাড়াই করে কৃষকের ঘরে ধান তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে সন্তষ্টি প্রকাশ করেছে কৃষক।
যন্ত্র ব্যবহারের ফলে ফসল উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায় এবং একটি ফসল থেকে আর একটি ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময় কমে যাওয়ায় কৃষকরা বছরে ১টি ফসলের স্থানে ২টি ফসল, ২টা ফসলের স্থানে ৩টা ফসল অনায়াসেই করতে পারছে। কম্বাইন হারভেস্টার কৃষিতে যে অবদান রাখছে তার একটি সঠিক গবেষণা চালিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে দেখা যাবে কম্বাইন হারভেস্টার কৃষিতে জাদুকরী পরিবর্তন এনেছে। কম্বাইন হারভেস্টার শুধু যে ধান কাটার মাঝে সীমাবদ্ধ তাই নয়। এখন গম, সরিষা মাড়াই কাজও ব্যবহার হচ্ছে।
বাড়ছে ফলন, কমছে উৎপাদন খরচ, কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ঘটছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সহায়তা করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি,  কৃষক, কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য অংশীজনের সহায়তায়, প্রকল্পটি বাংলাদেশের কৃষির আদল পরিবর্তনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। সর্বোপরি কম্বাইন হারভেস্টার কৃষকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করছে।

লেখক : প্রকল্প পরিচালক, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প, মোবাইল : ০১৭১৮১১৪৪৮০ ই-মেইল : mechanizafiondae@gmail.com

 

বিস্তারিত
ইঁদুর দমন করে স্থানীয় কৃষকের বন্ধু হয়েছেন ডুমুরিয়ার এইচ এম সিদ্দিকুর রহমান

ইঁদুর দমন করে স্থানীয় কৃষকের বন্ধু হয়েছেন ডুমুরিয়ার এইচ এম সিদ্দিকুর রহমান
কৃষিবিদ শারমিনা শামিম১ মো: আবদুর রহমান২
কৃষি বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষি আমাদের প্রধান অবলম্বন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি শিক্ষিত শ্রেণীও এখন কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে। গড়ে তুলছে মাঠ ফসল, ফলফলাদিসহ মৎস্য, পোল্ট্রি ও গবাদিপশুর খামার।
দেশে বর্তমানে পোল্ট্রি শিল্প অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। মানব দেহে আমিষের চাহিদা পূরণে পোল্ট্রি বিশেষ অবদান রাখছে। করোনার কারণে খামারিদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার খামারিদের প্রণোদনা প্রদান করেছেন। বাজারের অস্থিতিশীল অবস্থাসহ বেশ কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। এসবের মধ্যে ইঁদুরের উৎপাত একটি অন্যতম সমস্যা। এর কারণে প্রতি বছর প্রাণিসম্পদে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অনেকগুণ বেড়ে যায়। ইঁদুর দ্বারা খামারের খাবার নষ্ট, খাবারের গুণগতমান নষ্ট করাসহ নানান রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। প্রাণিসম্পদের প্রায় সকল প্রজাতির জন্যই ইঁদুর অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষ করে পোল্ট্রি খামার এবং গবাদিপ্রাণি পালনে বেশি ক্ষতি করে থাকে।
খুলনার ডুমুরিয়ার আরশনগরের এইচ এম সিদ্দিকুর রহমান একজন পোল্ট্রি হ্যাচারি ব্যবসায়ী। তার ১৯৯০ সালে খুলনা শহরে কেডিএ এভিনিউতে তার বোনের জমিতে পোল্ট্রি ফার্মস ফিডের ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে সেখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের কারণে ব্যবসা অনত্র সরিয়ে নেন। তখন তিনি চিন্তা করেন মুরগির খাবারের পাশাপাশি তিনি বাচ্চা উৎপাদন করবেন। এ সময়ে ডুমুরিয়ার আরশনগরে পৈতৃক জমিতে তিনি নিজেই ছোট পরিসরে মুরগী পালনের পাশাপাশি হ্যাচারিতে (খামারে) ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা উৎপাদন শুরু করেন।
মাঠের মাঝে খামার তৈরিতে সিদ্দিক সাহেব মাঠ লেভেলের থেকে ৫ ফুট উঁচু করে ভিত তৈরি করেন এবং সেটা প্লাস্টার করে নেট ফিনিশিং করে দেন। খামারের ভেতরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য কিছুদূর পর পর মাঠ লেভেলে ৩ ইঞ্চি ব্যাসের ছিদ্র রাখেন। মুরগির খাবারের উচ্ছিষ্টগুলো নিচে পড়ার কারণে মাঠের ইঁদুর সেগুলো খেতে আসে। খাবারের লোভে ইঁদুরগুলো তখন তিন ইঞ্চি ব্যাসের ছিদ্রপথে ঢুকে যায় এবং খামারের ভিথের দেওয়াল নেট ফিনিশিং থাকার কারণে বেয়ে উপরে উঠতে পারে না। ফলে ছিদ্র পথেই থেকে যায়। তখন সিদ্দিক সাহেব ও খামারের কর্মচারীগণ ঐ সব ছিদ্রের মুখগুলো আটকিয়ে দেন এবং খামারের উপর থেকে পানি প্রয়োগ করেন। ফলে ইঁদুর পানিতে ডুবে মারা যায়। প্রথম অবস্থায় মৃত ইঁদুর গুলিকে বস্তায় ভরে মাটিতে পুঁতে ফেলতেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইঁদুর নিধন কর্মসূচিতে কিভাবে অনুপ্রাণিত হলেন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, কয়েক বছর আগে তার ছোট ভাই নিধনকৃত ইঁদুরের ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেন এবং ইঁদুরের সেইসব ছবি ভাইরাল হয়। নিধনকৃত ইঁদুরের ছবি দেখে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ খুলনার জেলা ও উপজেলা  কৃষি অফিসার মহোদয়ের সংগে তার যোগযোগ হয়। ঊর্ধ্বতন  কৃষি কর্মকর্তাগণ তার ফার্ম ভিজিট করেন এবং ইঁদুর নিধনের কৌশল প্রত্যক্ষ করেন। পরবর্তীতে উপজেলা কৃষি অফিসার মহোদয়ের পরামর্শমতো নিধনকৃত ইঁদুরের লেজ সংগ্রহ করে উপজেলা কৃষি অফিসে জমা দেন। এভাবে তিনি মাঝেমধ্যেই তার ফার্মে ইঁদুর মারা কার্যক্রম  পরিচালনা করে থাকেন।
ইঁদুর শুধু খাবারই খায় না বরং পোল্ট্রির বেশ কিছু রোগের বিস্তার ঘটায়, এ কারণে তিনি মাঝে মধ্যেই এ কার্যক্রম চালান। ঝড় বর্ষার সময়ে মাঠের সব ইঁদুর তার ফার্মে এসে আশ্রয় নেয় এবং এসময়েই সবচেয়ে বেশি ইঁদুর মারা পড়ে। আরেকটি বিষয় হলো তার ফার্ম ও হ্যাচারির অবস্থান মাঠের মধ্যে এ কারণে ঐ মাঠে ইঁদুরের দ্বারা কোন ফসলই নষ্ট হয় না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পোল্ট্রি ব্যবসার পাশাপাশি তার নিজস্ব প্রায় আট বিঘা জমিতে নানা প্রকার মৌসুমি সবজির চাষ করেন। সিদ্দিক জানান, তার ফার্মে বছরের পরিত্যক্ত লিটার সবজির জমিতে প্রয়োগ করেন। অন্য কোন রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেন না। এ কারণে উৎপাদিত সবজির রং ও স্বাদ ভালো হয়। সবজির বালাই দমনের বিষয়ে জানান, তেমন পোকামাকড় লাগে না, আর যদিও দু-একটা লাগে সেক্ষেত্রে হাত দিয়ে দমন করেন ও কৃষি বিভাগের পরামর্শ গ্রহণ করেন। কোন প্রকার রাসয়নিক কীটনাশক ব্যবহার করেন না। উৎপাদিত সবজি নিজস্ব প্রয়োজন মিটিয়ে স্থানীয় বাজারে তিনি বিক্রি করেন। বাজারে তার উৎপাদিত সবজির চাহিদাও প্রচুর এবং ভালো দামে বিক্রি হয়। অনেক সময়ে সবজি পাইকারগণ তার ফার্মে এসে সবজি কিনে নিয়ে যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে স্বীকৃতি বিষয়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ইঁদুর নিধনের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন। তবে গত বছর জাতীয় পর্যায়ে তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন।
এইচ এম সিদ্দিকুর রহমানের ফার্মস পোল্ট্রি হ্যাচারিতে ৩৫০ ফুট বাই ৫০ ফুটের ৩টি শেড রয়েছে, যার দুইটি শেডে মুরগী পালন করেন ও ১টি শেডে ব্রয়লার মুরগীর বাচ্চা উৎপাদন করেন। তিনি ইনকিউবেটর মেশিনে মুরগীর বাচ্চা উৎপাদন এবং পোল্ট্রি সেক্টরের যাবতীয় সামগ্রী উৎপাদন করেন। উৎপাদিত ব্রয়লার মুরগীর এক/দুই দিনের বাচ্চা খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরসহ উত্তরবঙ্গের প্রায় সব জেলায় সরবরাহ করে থাকেন। এছাড়া বরিশাল, ভোলা, সিলেট ও নোয়াখালীতেও বাচ্চা সরবরাহ করেন। তার হ্যাচারিতে বছরে প্রায় ৩০ থেকে ৩২ লাখ মুরগীর বাচ্চা উৎপাদিত হয়ে থাকে। হ্যাচারি ও পোল্ট্রি খামারের বাজার মূল্য ১৫ কোটি টাকারও বেশি।
ফার্মস পোল্ট্রি হ্যাচারির পাশে তার দেড় বিঘার একটি পুকুরও রয়েছে যেখানে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া মাছের চাষও রয়েছে। নিজেকে একজন চাষা হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে তিনি বলেন, আমি একজন নামকরা চাষা কারণ আমার ফার্মে উৎপাদিত সবগুলো পণ্যই জৈবপদ্ধতিতে উৎপাদন করা হয়। সেইসাথে আমার উৎপাদিত কৃষি পণ্যের বাজারমূল্যও অন্যদের তুলনায় অনেক ভালো পাই।
এইচ এম সিদ্দিকুর রহমান মনে করেন, শিক্ষিত যুবকেরা কৃষি কাজে আরো বেশি আত্মনিয়োগ করলে টোটাল কৃষি সেক্টরের উন্নতি আরো ত্বরান্বিত হবে। যেখানে কৃষির সর্বশেষ প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে আধুনিক ও স্মার্ট কৃষি গড়ে উঠবে। কৃষির বিভিন্ন পণ্য জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত হবে এবং সেইসাথে রপ্তনিমূখী কৃষি প্রসার ঘটবে। কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকারের বাণিজ্যিক  কৃষির বাস্তবায়ন হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং ১৯৮৩ সাল থেকে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করে আসছে। জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২১ বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে পুরস্কার দেয়া হবে। জাতীয় পর্যায়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গত বছরের ইঁদুর নিধনকারীদের কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে ৫টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদান করা হবে। ইঁদুর নিধন অভিযান-২০২৩ এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় জাতীয়পর্যায়ে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২ এর কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে ৫টি ক্যাটাগরীতে পুরস্কারের জন্য মনোনীত তালিকা সারণি দ্রষ্টব্য। তালিকা অনুযায়ী এইচ এম সিদ্দিকুর রহমান কৃষক ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনিসহ জাতীয়পর্যায়ে পুরস্কার প্রাপ্তদের জানাই অভিনন্দন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা ।

লেখক : ১আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, ২এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, খুলনা। মোবা: ০১৯৪৩-৫১৭৫০৬, ই-মেইল :­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­ khulna@ais.gov.bd

বিস্তারিত
রোগ ও বালাই

রোগ ও বালাই
কে এম বদরুল হক শাহীন
ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, নেমাটোড আর ফাঙ্গাস
এই চার জীবাণুর সাথেই মোদের বসবাস।
কেউবা পাতায়, কেউবা গোড়ায়
কখনো কা-ে, কখনো শীষে
প্রতিনিয়ত বাসা বাঁধে।
কেউবা পাতা হলুদ করে কেউবা গোড়ায় গিটঁ বাঁধে
কেহ পাতা ঝলসে দেয়
কেহ পাতা কেটে দেয়।
মাজরা, পামরী, লেদাপোকা
ফসলের প্রধান শত্রু তারা।
ডিগ মরা, সাদাপাতা, গুচ্ছপাতা
প্রকাশ পায় লক্ষণ দ্বারা।
ইঁদুর বড়ই ক্ষতিকর প্রাণী,
মাঠের শস্য করে হানি।  
বিষটোপ, গ্যাস ট্যাবলেট আর কেঁচিকল,
এদিয়ে আমরা বাঁচাই ফসল।
চাষিদের মাঝে সচেতন যারা
ফসল ঘরে তোলে তাঁরা।
যারা করে অবহেলা
নিত্য অভাব দেয় ধরা।
নষ্ট হলে সর্বনাশ
দুঃখ রবে বারোমাস।
লেখক : উপপরিচালক (এলআর), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১১৫৮৩৩১০।

বিস্তারিত
কবিতা

কবিতা
ক্ষতিকর ইঁদুর
মোঃ মাজেদুল ইসলাম (মিন্টু)
ইঁদুরের বংশ বৃদ্ধি দ্রুত বাড়ে
 যেকোন পরিবেশে খাপখাওয়াতে পারে।
জন্ম থেকে যৌবন পায় তিন মাস পর,
তারপর জোড়ায় জোড়ায় বাঁধে তারা ঘর।
গর্ভধারণ হয় প্রসবের পর দুই দিন,
প্রতিবারে বাচ্চা দেয় কমপক্ষে তিন।
ইঁদুরের শ্রবণশক্তি প্রখর যেমন,
ঘ্রাণশক্তি আছে তার প্রকট তেমন।
ইঁদুরের সামনের দাঁত জন্ম থেকে বাড়ে,
কাটাকাটি ছেড়ে তাই থাকতে না পারে।
ইঁদুর ফসল খেয়ে করে দেয় নষ্ট,
তাই তারা প্রাণীকুলে সবচেয়ে দুষ্ট।
খায় যত, নষ্ট করে দশগুণ তার,
প্রাণীকূলে নেই তার কোন উপকার।
ইঁদুর খুব চালাক, নিশাচর সৃষ্টি,
দিনের বেলায় তাদের ক্ষীণ দৃষ্টি।
সব জাতের ইঁদুর সাঁতরাতে পারে,
নেংটি ইঁদুর ঘরের মাঝে ছোটাছুটি করে।
বিদ্যুতের তার কাটে বাঁধ ভেঙে দেয়,
দুরারোগ্য রোগব্যাধি সমাজে ছড়ায়।
গম কাটে, পাট কাটে, কাটে গোলার ধান,
ক্ষেতে কাটে লাউ, কুমড়া দিয়া মন প্রাণ।
রাতে বসে গর্ত করে পানি সেচের খাল,
দিনদুপুরে ঘরে বসে কাটে জেলের জাল।
গ্রাম শহর সবখানে তার সমান বিচরণ,
সর্বলোকে জানে তার কেমন আচরণ।
ইঁদুর মারার উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল,
যখন ডুবে যায় মাঠ, ঘাট আর খাল।
ইঁদুর ক্ষতি করে সর্ব অবস্থায়,
এদের নিধন করি এসো সবাই।
ক্ষতিকর ইঁদুর মেরে করবো শেষ,
সুন্দরভাবে গড়বো সোনার বাংলাদেশ।

লেখকঃউপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার়।উপজেলা কৃষি অফিসারের কাযালয়।ভাঙ্গুড়া পাবনা।মোবাইলঃ০১৭১৭৪৬৬৯৯৮

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর

কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন

নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
তামিম, উপজেলা : বীরগঞ্জ, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : নারিকেল গাছের ছোট ছোট নারিকেল ঝরে পড়ে যাচ্ছে। এর সমাধান কী?
উত্তর : নারিকেল গাছের ছোট নারিকেল ঝরে পড়ার মূল কারণসমূহ হলো ফুলে পরাগ সংযোগ না হওয়া, পোকার আক্রমণ হলে, মাটিতে পটাশ সারের অভাব হলে। এ জন্য একাধিক গাছ লাগাতে হবে যাতে পরাগায়ন হয়। নারিকেল গাছে পটাশ সার তুলনামূলক বেশি লাগে। এ ছাড়া বোরন স্প্রে করতে হবে। পূর্ণবয়স্ক গাছে ২ কেজি পটাশ ও বোরন ২ মিলি প্রতি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে দিয়ে স্প্রে করতে হবে। মাটিতে মাকড়ের আক্রমণে সালফার (কুমুলাস পাউডার স্প্রে করতে হবে)।
সোহেল, উপজেলা : বাকেরগঞ্জ, জেলা : বরিশাল
প্রশ্ন : টমেটো গাছের পাতা ও কা- ঢলে পড়ে এবং পরবর্তীতে গাছ মারা যায়। করণীয় কী?
উত্তর : রালস্টোনিয়া নামক মাটিবাহিত ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে টমেটো গাছের পাতা ও কা- ঢলে পড়ে এবং গাছ মারা যায়। এই রোগ দমনে প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ শ্রেয়। মাটিবাহিত রোগ বিধায় রোগের জীবাণু মাটিতে থাকে। তাই প্লাবন সেচ দেয়া যাবে না। জমি চাষের সময় ব্লিচিং পাউডার ১৫-২০ কেজি প্রতি হেক্টরে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে মাটিতে বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। রোগাক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে এবং সেখানকার মাটি সরিয়ে নতুন মাটি দিয়ে নতুন গাছ লাগাতে হবে। লাগানোর আগে ব্যাকটেরিয়ানাশক দ্রবণে ১৫-২০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে লাগাতে হবে। এ ছাড়া বিসমার্থিওজল গ্রুপের ব্যাকট্রোল/ব্যাকট্রোবান/অটোব্যাক ২ গ্রাম প্রতি লিটারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
যাকারিয়া, উপজেলা : ভেড়ামারা, জেলা : কুষ্টিয়া
প্রশ্ন : ধানের পাতা লম্বালম্বিভাবে মুড়িয়ে যায় ও পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। করণীয় কী?
উত্তর : ধান উৎপাদনে যে সব পোকার আক্রমণ হয় তার মধ্যে ক্ষতিকারক পোকা হচ্ছে পাতামোড়ানো পোকা। পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী পোকা পাতার মধ্যশিরার কাছে ডিম পাড়ে। কীড়াগুলো পাতার সবুজ অংশ খায় এবং বড় হওয়ার সাথে সাথে তারা পাতা লম্বালম্বিভাবে মুড়িয়ে নলের মতো করে। মাটিতে অতিরিক্ত মাত্রায় নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করলে এই আক্রমণ হয়। এ ছাড়া বৃষ্টির পর টানা ২-৩ দিন প্রখর রৌদ্র হলেও আক্রমণ বাড়ে। প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত গাছ থেকে পোকার ডিম বা কীড়াসহ পাতা সংগ্রহ করে ধ্বংস করা যায়। আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে পূর্ণবয়স্ক মথ ধরে দমন করা যায়। ডালপালা পুঁতে পার্চিং এর ব্যবস্থা করে পাখি বসার ব্যবস্থা করলে পূর্ণবয়স্ক মথ ধ্বংস করা যায়। আগাছামুক্ত রাখতে হবে চারা রোপণের পর ৪০ দিন পর্যন্ত। এ ছাড়া শতকরা ২৫ ভাগ পাতা আক্রান্ত হলে ঔষধ ব্যবহার করতে হবে। সেক্ষেত্রে ক্লোপাইরিফস জাতীয় কীটনাশক (ডারসবান ২০ ইসি), ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক (ফাইফানন ২৫ মিলি) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার বিকেলে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া স্থানীয় কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
হেমায়েত উদ্দীন, উপজেলা : হাটহাজারী, জেলা : চট্টগ্রাম
প্রশ্ন : আম গাছে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হয়?
উত্তর : আম গাছের বয়স অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। আম গাছে সাধারণত বছরে ২ বার সার দিতে হবে। বর্ষার আগে ও বর্ষার পরে (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ও আশি^ন মাসে)। সারের পরিমাণ সারণি দ্রষ্টব্য।
উল্লেখিত সার ২ ভাগ করে প্রথম ভাগ জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে এবং ২য় ভাগ আশ্বিন মাসে প্রয়োগ করতে হবে। জিপসাম ও জিংক সালফেট ১ বছর পর পর প্রয়োগ করলেই চলবে।
জুলহাস, উপজেলা : দেওয়ানগঞ্জ, জেলা : জামালপুর
প্রশ্ন : শীতকালীন টমেটোর জাত কী কী?
উত্তর : বর্তমানে টমেটো সারা বছর উৎপাদন করা যায়। শীতকালীন টমেটো তিন রকমের জাত দেখা যায়।
আগাম জাত : জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে রোপণ করা হয়। এতে আগাম ফল আসে। বারি টমেটো ৪, বারি টমেটো ৫, টিপু সুলতান, নিউ রূপালী এফ ১ ইত্যাদি।
ভরা মৌসুম জাত : অক্টোবর-নভেম্বর মাসে রোপণ করা হয়। মানিক, রতন, বারি টমেটো ৩, বারি টমেটো ৬, বারি টমেটো ৭, বারি টমেটো ৯, বারি টমেটো ১৮, বারি টমেটো ২১, বিনা টমেটো ১০, বাহার, মহুয়া ইত্যাদি।
নাবি শীত মৌসুমী জাত : জানুয়ারিতে বোনা হয়। ফল আসে মার্চ-এপ্রিল মাসে। এদের মধ্যে বাহার, রাজা, সুরক্ষা অন্যতম।
শফিক, উপজেলা : শিবগঞ্জ, জেলা : বগুড়া
প্রশ্ন : সবুজ পাতা (বিলাতি) ধনিয়া পাতার জন্য কোন মাসে বীজ বপন করতে হবে। ধনিয়ার সাথে কী কী সাথী ফসল করা যায়?
উত্তর : ধনিয়া দৈনন্দিন খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে তোলে। ধনিয়া পাতা সালাদসহ সব তরকারিতেই ব্যবহার করা যায়। সবুজ পাতার জন্য সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বীজ বপন করা যায়। শাক, সবজি (ওলকপি), আখ, আলু, ডালজাতীয় ফসলের সাথে ধনিয়া সাথী ফসল করা যায়।
ফাহিম, উপজেলা : বদরগঞ্জ, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : কলাগাছে কী পরিমাণ সার দিতে হয়?
উত্তর : কলা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি পুষ্টিকর ফল। নিয়মিত কলা খেলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। পাকা কলায় প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে। হৃদযন্ত্র ভালো থাকে। কলা এনার্জি বাড়াতে এর কোন জুরি নেই।                                                                                         
কলাগাছের সার ব্যবস্থাপনা
১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম জিপসাম জমি তৈরির সময় এবং বাকি অর্ধেক গোবর সার ও টিএসপি, জিপসাম ও ১৫০ গ্রাম পটাশ গর্তে দিতে হবে। রোপণের ২ মাস পর ১২৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ১৫০ গ্রাম পটাশ সার জমিতে ছিটিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এর ২ মাস পরপর গাছপ্রতি ৫০ গ্রাম পটাশ ও ৭৫ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। ফুল আসার পর এই পরিমাণ দ্বিগুন করতে হবে।  
রিপন, উপজেলা : পবা, জেলা : রাজশাহী
প্রশ্ন : কচুর পাতায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাল মাকড়ের আক্রমণ। করণীয় কী?  
উত্তর : সবজি হিসেবে কচু বেশ পরিচিত ও পুষ্টিকর। সাধারণত সবজি ও ঔষধি হিসেবে কচু ব্যবহৃত হয়। পাতার নিচে লাল রং এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাকড়ের আক্রমণ হয়, যা হাত দিয়ে নষ্ট করা যায়। এ ছাড়া কীটনাশক হিসেবে এবামেকটিন গ্রুপের ভার্টিমেক ১.৫ মিলি, প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর অথবা সালফার গ্রুপের কুমুলাস পাউডার ২ গ্রাম প্রতি লিটারে মিলিয়ে ১০ দিন পরপর বিকেলে স্প্রে করতে হবে।
হিরা, উপজেলা : সদর, জেলা : কুমিল্লা
প্রশ্ন : লটকনের ফল ছোট অবস্থায় ফলের খোসা ছিদ্র করে ডিম পাড়ে এবং শাঁস খেয়ে ফেলে। করণীয় কী?
উত্তর : লটকন বাংলাদেশের সুপরিচিত একটি অপ্রচলিত ফল। টক-মিষ্টি স্বাদ যুক্ত। লটকন ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ একটি ফল। ১ লিটার পানিতে ২ মিলি হারে পারফেকথিয়ন বা লিবাসিড ৫০ ইসি মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
আব্দুর রহিম, উপজেলা : গফরগাঁও, জেলা : ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : ঢেঁড়সের শিকড়ের গিঁট রোগ, পাতা ছোট এবং গাছ খর্বাকৃতি হয়। করণীয় কী?
উত্তর : মেলোয়ভোগাইন প্রজাতির কৃমির আক্রমণে ঢেঁড়সের শিকড়ের গিট রোগ হয় এবং পাতা ও গাছ খর্বাকৃতির হয়। তাই আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে। প্রতিকার হিসেবে একই জমিতে বার বার একই ফসল চাষ করা যাবে না। জমি গভীরভাবে চাষ দিতে হবে। চারা রোপণের ৮-১০ দিন পূর্বে ট্রাইকো কম্পোস্ট ২.৫ টন প্রতি হেক্টরে প্রয়োগ করতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা গেলে কার্বোফুরান গ্রুপের ফুরাডান ৫ জি, ৪০ কেজি প্রতি হেক্টর মাটিতে ছিটিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে হালকা সেচ দিতে হবে।
এছাড়াও কৃষি বিষয়ক তথ্য জানতে কল করুন কৃষি তথ্য সার্ভিসের ১৬১২৩ নম্বরে।

লেখক : তথ্য অফিসার (পিপি), কৃষি তথ্য সার্ভিস,
খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২;
ই- মেইল : aklimadae@gmail.com

বিস্তারিত
কার্তিক মাসের কৃষি ১৭ অক্টোবর-১৫ নভেম্বর

কার্তিক মাসের কৃষি
১৭ অক্টোবর-১৫ নভেম্বর
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
কার্তিক মাস। দুই ঋতুর মোহনা। এসময় বাংলাদেশের  প্রকৃতিতে প্রগাঢ় সবুজ যেমন পাওয়া যায়। তেমনি পাওয়া যায় শীতের আমেজও। বাংলার মাঠ প্রান্তরে সোনালী নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে ছড়িয়ে পড়ে। মাঠে বীর কৃষকরাও ব্যস্ত থাকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই কার্তিক মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
আমন ধান
এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াইঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। এসব কাজে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। শুকানো গরম ধান ঝেড়ে পরিষ্কার করে ছায়ায় রেখে ঠা-া করে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের উপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে মিশিয়ে দিতে হবে।
গম
কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিতে হয়। দো-আঁশ মাটিতে গম ভাল হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন: বারি গম-২৫, বারি গম-২৮, বারি গম-৩০, বারি গম-৩২, বারি গম-৩৩, ডাব্লিউএমআরআই গম-১, ডাব্লিউএমআরআই গম-২, ডাব্লিউএমআরআই গম-৩ এবং লবণাক্ততাসহিষ্ণু বিনা গম-১ রোপণ করতে পারেন। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশকের নাম দিলে ভালো হয়। দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘা প্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ১৩-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি  ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভালো ফলন পাওয়া যায়। উল্লেখ্য চাষে বেড প্লান্টার যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। এই যন্ত্র ব্যবহার সেচ খরচ ও সময় ২৫% কমে।
আখ
এখন আখের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ভালোভাবে জমি তৈরি করে আখের চারা রোপণ করা উচিত। আখ রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সেমি. থেকে ১২০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সেমি. রাখতে হয়। এভাবে চারা রোপণ করলে বিঘাপ্রতি ২২০০-২৫০০টি চারার প্রয়োজন হয়।
ভুট্টা
ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ সময় যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে এবং জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো খই ভুট্টা, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৭ বারি মিষ্টি ভুট্টা-১, বারি বেবি কর্ন-১ ইত্যাদি। প্রভৃতি খরা প্রধান এলাকা ও সাদা দানার ক্ষেত্রে বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩, ঝড় বাতাসে হেলে ও  ভেঙে পড়া প্রতিরোধী জাত ডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা ১ ডাব্লিউএমআরআই বেবি কর্ণ ১ আবাদ করতে পারেন।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
কার্তিক মাস সরিষা চাষেরও উপযুক্ত সময়। সরিষার প্রচলিত স্বল্পমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনা সরিষা-১০, বিনা সরিষা-১১ ইত্যাদি। দীর্ঘমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৬, বারি সরিষা-১৮, উল্লেখযোগ্য। জাতভেদে সামান্য তারতম্য হলেও বিঘাপ্রতি গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি সরিষার বীজ প্রয়োজন হয়। বিঘাপ্রতি ৩৩-৩৭ কেজি ইউরিয়া, ২২-২৪ কেজি টিএসপি, ১১-১৩ কেজি এমওপি,           ২০-২৪ কেজি জিপসার ও ১ কেজি দস্তা সারের প্রয়োজন হয়। সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসল যেমন- তিল, তিসি, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী এ সময় চাষ করা যায়।
তুলা
এ সময় শেষ বারের মতো তুলা ফসলের আগাছা দমন করতে হবে। বিঘাপ্রতি ৭-৭.৫ কেজি ইউরিয়া সারের তিন কিস্তির শেষ কিস্তি পাশর্^ প্রয়োগ করতে (গাছ থেকে ৫-৬ সেমি. দূরত্বে) হবে। গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে; যাতে বাতাসে গাছ হেলে না পড়ে। এসময় জ্যাসিড ও এফিডের পাশাপাশি আঁচা পোকা (ঝঢ়ড়ফড়ঢ়ঃবৎধ), বোলওয়ার্ম এবং রোগের মধ্যে পাতা ঝলসানো, এনথ্রাকনোজ, নেতিয়ে পড়া রোগের আক্রমণ হতে পারে। হাত বাছাই করে আঁচা পোকা ও বোলওয়ার্মের ক্রীড়া দমন করে জ্যাসিড ও এফিডের জন্য সিস্টেমিক, আঁচ পোকা ও বোলওয়ার্মের জন্য স্পর্ম কীটনাশক এবং রোগের জন্য ৫% কপার অক্সিক্লোরাইড বা ২.৫ ডাইথেন এমএ-৪৫ মাত্রা অনুযায়ী জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। অধিক ফসলের জন্য ফলিয়ার স্প্রে এবং হরমোন যেমন-প্লানোফিক্স/ফ্লোরা স্প্রে করা যেতে পারে। ফলিয়ার স্প্রে বলতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার যেমন-ইউরিয়া/ডিএপি ২% হারে (১০ লিটার পানিতে ২০০ গ্রাম), পটাশ ১% হারে (১০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম) এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যেমন: সলুবর বোরণ, জিঙ্কসালফেট ০.১০-০.১৫% হারে (১০ লিটার পানিতে ১০-১৫ গ্রাম), পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রেমেশিনের সাহায্যে পাতায় প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ৫০-৬০ দিনের পর থেকে পরবর্তী ১০০ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ৩-৪ বার ফলিয়ার স্প্রে করা যায়। এতে বোলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বোল আকারে বড় হয়, ফলে ফলন ৪-৫% বৃদ্ধি পায়। পোকামাকড় দমনের জন্য আইপিএম অথবা শুধু ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করলে তুলার উৎপাদন খরচ অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। সিড ব্লগ হলেও এ মাসেই রগিং এর কাজ শেষ করতে হবে।
আলু
আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত সময় এ মাসেই। হালকা প্রকৃতির মাটি অর্থাৎ বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বারি কর্তৃক উদ্ভাবিত আগাম জাত ও উচ্চফলনশীল জাতগুলো নির্বাচন করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ও খাবার উপযোগী জাত নির্বাচন করা প্রয়োজন। প্রতি একর জমি আবাদ করতে ৬০০ কেজি বীজ আলুর দরকার হয়। এক একর জমিতে আলু আবাদ করতে ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি, ১০০ কেজি এমওপি, ৬০ কেজি জিপসাম এবং ৬ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন হয়। তবে এ সারের পরিমাণ জমির অবস্থাভেদে কমবেশি হতে পারে। তাছাড়া একরপ্রতি ৪-৫ টন জৈবসার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়। আলু উৎপাদনে আগাছা পরিষ্কার, সেচ, সারের উপরিপ্রয়োগ, মাটি আলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যকীয় কাজ। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে মালচিং দিয়ে আলু আবাদ করা যায়।
মিষ্টিআলু
নদীর ধারে পলি মাটিযুক্ত জমি এবং বেলে দো-আঁশ প্রকৃতির মাটিতে মিষ্টিআলু ভালো ফলন দেয়। কমলা সুন্দরী, বারি মিষ্টিআলু-১২, বারি মিষ্টিআলু-১৪, বারি মিষ্টিআলু-১৫ ও বারি মিষ্টিআলু-১৬ আধুনিক মিষ্টিআলুর জাত। প্রতি বিঘা জমির জন্য তিন গিঁটযুক্ত ২২৫০-২৫০০ খ- লতা পর্যাপ্ত। বিঘাপ্রতি ৪-৫টন গোবর/জৈবসার, ১৬ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে।
ডাল ফসল
মুসুর, মুগ, মাসকলাই, খেসারি, ফেলন, অড়হর, সয়াবিন, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল এসময় চাষ করতে পারেন। এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময়মতো বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে।
শাকসবজি
শীতকালীন শাকসবজি চাষের উপযুক্ত সময় এখন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীজতলায় উন্নতজাতের দেশি-বিদেশি ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, বাটিশাক, টমেটো, বেগুন এসবের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। আর গত মাসে চারা উৎপাদন করে থাকলে এখন মূল জমিতে চারা রোপণ করতে পারেন। মাটিতে জোঁ আসার সাথে সাথে শীতকালীন শাকসবজি রোপণ করতে হবে। এ মাসে হঠাৎ বৃষ্টিতে রোপণকৃত শাকসবজির চারা নষ্ট হতে পারে। এ জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। রোপণের পর আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে। তাছাড়া লালশাক, মুলাশাক, গাজর, মটরশুঁটির বীজ এ সময় বপন করতে পারেন।
কলা : কলার চারা বছরে এ মৌসুমে রোপণ করা যায়। প্রথম রোপণের সময় আশি^ন-কার্তিক (মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য নভেম্বর)। বারি কলা-১, বারি কলা-২, বারি কলা-৩, বারি কলা-৪, বারি কলা-৫ দেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী। রোপণের জন্য অসি তেউড় (ংড়িৎফ ংঁবফবৎ) উত্তম। তিন মাস বয়স্ক সুস্থ সবল রোগমুক্ত বাগান থেকে সংগ্রহ করা ভালো। সাধারণত খাটো জাতের গাছের ৩৫-৪৫ সেমি. ও লম্বা জাতের গাছের ৫০-৬০ সেমি. দৈর্ঘ্যরে তেউর ব্যবহার করা হয়।
গাছপ্রতি সারের পরিমাণ জৈবসার ১৫-২০ কেজি, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ৬০০ গ্রাম, ইউরিয়া ৫০০-৬৫০ গ্রাম, জিপসাম ২০০-৩০০ গ্রাম দেয়া প্রয়োজন। তবে সারের ৫০% গোবর, টিএসপি ও জিপসাম জমি তৈরির সময় এবং বাকি ৫০% গোবর, টিএসপি ও জিপসাম এবং ২৫% এমওপি গর্তে দিতে হবে। রোপণের দেড় থেকে দুই মাস পর ২৫% ইউরিয়া ও ২৫% এমওপি জমিতে ছিটিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এর ২ মাস পরপর গাছপ্রতি ৫০ গ্রাম এমওপি ও ৭৫ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। ফুল আসার পরই পরিমাণ দ্বিগুণ করতে হবে।
গাছপালার অন্যান্য পরিচর্যা : সাধারণত ফল গাছপালা কিস্তিতে পরিমাণ মতো সার প্রয়োগ করতে হয়। বর্ষার মৌসুমে আরম্ভ হওয়ায় পূর্বে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং পরবর্তী কিস্তি বর্ষার শেষে আশি^ন-কার্তিক মাসে বয়ষ্ক গাছের ফল সংগ্রহের পর এসময় অঙ্গ ছাটাই করা ভালো। অঙ্গ ছাটাই করলে গাছে নতুন ডালপালা গজায় এবং তাতে প্রচুর ফল ধরে। শুষ্ক মৌসুমে বিশেষত চারা গাছে এবং বয়ষ্ক গাছে সেচের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

লেখক :  সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন :০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল: editor@ais.gov.bd

 

বিস্তারিত