Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

ফলের উৎপাদন বাড়াতে ক্রপজোনিং সিস্টেম অনুসরণ

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। আর্দ্র ও অব-উষ্ণম-লীয় এ দেশে ফলের সর্বাধিক উৎপাদন হয় গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমে। জ্যৈষ্ঠ মাস মধু মাস বলে সব বাঙালির কাছে পরিচিত। এ দেশের চাষযোগ্য ফলের সংখ্যা প্রায় ৭০টি এবং বৈশাখ থেকে শ্রাবণ এ চার মাস দেশের মোট ফলের ৫৪ শতাংশ উৎপাদিত হয়ে থাকে। বাকি আট মাস মিলে ৪৬ শতাংশ ফল পাওয়া যায়। ফল আমাদের দেশের একটি জনপ্রিয় উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল। রঙ, গন্ধ, স্বাদ ও পুষ্টির বিবেচনায় বাংলাদেশের ফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময়। বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের সবচেয়ে সহজ উৎস হলো ফল। ফল রান্না ছাড়া সরাসরি খাওয়া যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফলের অবদান উল্লেখযোগ্য। এ দেশের মোট চাষভুক্ত জমির মধ্যে ফলের আওতায় ১ থেকে ২ শতাংশ জমি রয়েছে অথচ জাতীয় অর্থনীতিতে মোট ফসলভিত্তিক আয়ের ১০ শতাংশ আসে ফল থেকে।

বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ফলগুলো হলো আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, কুল, সফেদা, তরমুজ, আনারস, লিচু, কমলা, জাম্বুরা, পেয়ারা, নারিকেল, তাল, খেজুর প্রভৃতি। এ দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল উৎপাদিত না হওয়ায় এর চাহিদা ও দাম বেশি থাকে। অন্যান্য শস্যের চেয়ে ফলের দাম সাধারণত বেশি হয় বলে ফল চাষিদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে  উৎপাদন মৌসুমের পরে সংরক্ষিত ফল অধিক দামে বিক্রি করা সম্ভব এবং উদ্বৃত্ত ফল ও ফলজাত দ্রব্য বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়। তাই এ দেশে অধিক চাহিদার কারণে অধিক ফল উৎপাদনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি, আবহাওয়া ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে ক্রপিং সিস্টেম বা ফসল উৎপাদন এলাকা তৈরি করা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে কিছু এলাকায় বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ফল যেমন- আম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, কুল, তরমুজ, নারিকেল প্রভৃতি ব্যাপকভাবে চাষ হয়ে আসছে। বিশেষ বিশেষ এলাকার ফলগুলোর উৎপাদন ও গুণগতমানে স্বকীয়তা রয়েছে। অনুন্নত জাত ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা ফলবাগানে ভালো ফলন হয় না কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা দ্বারা এ বাগানগুলোকে লাভজনক করা সম্ভব। প্রতিদিন জনপ্রতি প্রায় ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও আমরা পাচ্ছি মাত্র ৪৫ গ্রাম। তবে আশার কথা, বেশ কিছু ফলের আবাদ দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। যেমন- পেয়ারা, কুল, তরমুজ, লিচু প্রভৃতি। ফল গাছে বিশেষ করে বসতবাড়ির আনাচে-কানাচের ফলগাছগুলো একটু পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। ফলের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ও আয় অন্যান্য মাঠ ফসলের তুলনায় অনেক বেশি। এক হেক্টর জমিতে ধানের উৎপাদন যেখানে ৩.০ থেকে ৪.০ মেট্রিক টন সেখানে একই পরিমাণ জমিতে কলার উৎপাদন হচ্ছে হেক্টরপ্রতি প্রায় ২০ মেট্রিক টন। একইভাবে উৎপাদিত ফল থেকে আয়ের পরিমাণও প্রধান ফসল ধানের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি। কাজেই স্বল্প পরিসরে ফল চাষ করে দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব।

ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলকে মানুষের মাঝে পরিচিত করা, তাদের গুণাগুণ তুলে ধরা, ফল চাষাবাদে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং ফল চাষের আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল জনগণের মাঝে সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে বিগত কয়েক বছর ধরে জাতীয় ফল মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। বনজ ও ঔষধি গাছের পাশাপাশি ফলদ বৃক্ষ রোপণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ১৬ থেকে ৩০ জুন ‘ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ’ উদযাপন করা হচ্ছে। এবারের মূল প্রতিপাদ্য হলো- ‘দিন বদলের বাংলাদেশ-ফল বৃক্ষে ভরবো দেশ’। সেই সঙ্গে জাতীয় ফল প্রদর্শনী-২০১৫ এর আয়োজন ফলদ বৃক্ষ রোপণ আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে। ফল চাষাবাদে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং ফল চাষের আধুনিক কলাকৌশল জনগণের মাঝে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে জাতীয় ফল প্রদর্শনী ২০১৫ এর আয়োজন করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর চলমান বৃক্ষ রোপণ মৌসুমে ফলদ ও ঔষধিসহ মোট ১,০২,৩৯৬০০টি চারা রোপণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
 

ফল একটি পচনশীল পণ্য। ফলের বাজারদর হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। ফল সঠিকভাবে উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফল ভিত্তিক খাদ্য পণ্য (জ্যাম, জেলি ইত্যাদি) তৈরি, মোড়কজাত ও বাজারজাতকরণ এবং রফতানির মাধ্যমে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি লাভজনক উপায়ে করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ফলের বিশেষায়িত অঞ্চল গড়ে তুলতে পারলে ফল চাষের বিভিন্ন উপকরণ, উৎপাদিত ফলের বাছাই, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ এবং বড় পরিসরে যান্ত্রিক-বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফল চাষ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃৃদ্ধি ও বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের জন্য ফলের সরবরাহ ও রফতানির বৃদ্ধি, ফল উৎপাদন বিষয়ক কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং সংযোগ চাষিদের দল গঠন প্রভৃতি কার্যক্রম সম্পন্ন করাও সুবিধাজনক হবে।

বাংলাদেশের রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, খুলনা এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা আম চাষের জন্য প্রসিদ্ধ, উল্লিখিত এলাকায় আম উৎপাদনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ-কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। দিনাজপুর, ঈশ্বরদী, রাজশাহী, পাবনা, নারায়ণগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় লিচু উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এসব এলাকায় লিচু চাষ সম্প্রসারণ এর জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করার মাধ্যমে লিচুর উৎপাদন বহুলাংশে বাড়ানো সম্ভব। মধুপুর অঞ্চল, সিলেট ও পাবর্ত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে আনারস চাষের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে নাটোর, রাজশাহী, ঈশ্বরদী, পাবনা ও বরিশাল অঞ্চল পেয়ারা চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী বিধায় এসব এলাকায় পেয়ারা উৎপাদন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ (জ্যাম, জেলি, জুস ইত্যাদি) কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।

সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, নোয়াখালী, ও কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে নারিকেল উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। বাংলাদেশের এক দশমাংশ এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান এলাকা রয়েছে। উল্লিখিত এলাকায় আম, আনারস এবং পেয়ারার বাণিজ্যিক উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেট, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল ও পঞ্চগড় এ কমলা চাষের জন্য যথেষ্ট উপযোগী যেখানে কমলা চাষের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। পুষ্টিমান ও বৈশিষ্ট্যগত কারণে কাঁঠাল একটি সম্ভাবনাময় ফল। উন্নত পুষ্টিমানের পাশাপাশি কাঁচা কাঁঠাল ও বিচি উপাদেয় তরকারি। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এ ফল গাছ থেকে উন্নতমানের কাঠও পাওয়া যায়। কাঁঠালের অভক্ষণ যোগ্য অংশ উত্তম গো-খাদ্য ও কাঁঠাল পাতা ছাগলের প্রিয় খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইহা গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। পরাগায়নজনিত সমস্যা ও সুষ্ঠু পরিচর্যার অভাবে অনেক সময় কাঁঠালের ফলন ও আকার-আকৃতি ভাল হয় না। উঁচু ও সুনিষ্কাশিত অম্ল দো-আঁশ মাটিতে কাঁঠাল ভালো হয়। দ্রুত নগরায়ন ও শিল্পায়নের দরুন অনেক কাঁঠাল বাগান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কাঁঠালের রসের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন জ্যাম-জেলি তৈরি করতে পারলে সারা বছর ব্যবহার, বাজারজাতকরণ ও রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে। ছোট আকার ও গুণগত মান সম্পন্ন রোয়া পাওয়া এমন জাত নির্বাচন-উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ দরকার। সুষম সার প্রয়োগ ও আন্তঃপরিচর্যার মাধ্যমে কাঁঠালের ফলন বহুলাংশে বৃদ্ধি সম্ভব। বাংলাদেশের ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, সিলেট, রাজশাহী, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলা ও যশোরে কাঁঠাল ভালো জন্মায়।

উপযুক্ত পরিবহন ব্যবস্থা, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের অভাবে প্রায়শই ন্যায্য বাজার মূল্য পান না চাষিরা। ফলে প্রায় ৪০ শতাংশ ফল সংগ্রহোত্তর নষ্ট হয়ে যায়। অন্য দিকে ফল সংগ্রহ ব্যবস্থাও আধুনিক না হওয়ায় ক্ষতজনিত কারণে তাড়াতাড়ি সংক্রমণ ঘটে ও নষ্ট হয়ে যায়। ভরা মৌসুমে সব ফলের বিপুল সমারোহ ঘটে, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার দরুন দাম কমে যায়। চাষিরা লোকসানের সম্মুখীন হন এবং ফল চাষে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। আধুনিক উপায়ে ফলের জুস, জ্যাম, জেলি, আচার প্রভৃতি তৈরি করে সংরক্ষণ ও রফতানি করতে পারলে ফল চাষে আরও অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। বহিঃবিশ্বে প্রায় ৮০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন। তাই দেশের বাইরেও বাংলাদেশী ফলের বেশ চাহিদা আছে। ওষুধ ও প্রসাধনী শিল্পেও ফলের ব্যবহার রয়েছে। এ দেশে ফল উৎপাদন মৌসুমভিত্তিক। অধিকাংশ ফলই যেমন- আম, কাঁঠাল, লিচু ও আনারস বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে পরিপক্ব হয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই এদের প্রাপ্যতা শেষ হয়ে যায়। অনেক অপ্রচলিত ও স্বল্পপ্রচলিত ফল যেমন- কুল, আমড়া, আমলকী, জলপাই, বেল, সফেদা, ডালিম, কামরাঙা ইত্যাদি রয়েছে যেগুলো বছরের বিভিন্ন সময়ে উৎপাদিত  হয়ে থাকে। অতএব মিশ্র ফল বাগান বা মৌসুমভিত্তিক একক ফল বাগান সৃজন করে সারা বছর পুষ্টি জোগান দেয়ার জন্য ফল উৎপাদন প্রয়োজন। আমরা অনেকেই চাহিদা মোতাবেক ফল খেতে পারি না। তাছাড়া বছরের কিছু সময় বিশেষ করে মধু মাসে বিভিন্ন ফলের সমারোহ থাকলেও সারা বছর কিন্তু ফলের প্রাচুর্য থাকে না। আমদানি করা বাহারি ফল কিছু কিছু দোকানে শোভা পেলেও তা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে না। অথচ আমাদের ফলের চাহিদা নিত্যদিনের। ফল কম খাওয়ার কারণে একদিকে যেমনÑ স্বাভাবিক খাবারে বাড়তি চাপ পড়ছে, অন্যদিকে অপুষ্টিজনিত কারণে বিশাল জনগোষ্ঠী নানা রকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশজ ফলের পুষ্টিমান আমদানিকৃত বিদেশি ফলের চাইতে কোন অংশেই কম নয়। আপেল-আঙুরের চেয়ে পেয়ারা, আমলকী, বেল, কলা, জাম ইত্যাদিতে খনিজ এবং ভিটামিন অধিক মাত্রায় রয়েছে। দেশজ ফলে পোকা ও অন্যান্য রোগ বালাইয়ের প্রকোপ কম হয় এবং আবহাওয়ার বৈরী পরিবেশেও খাপ খাওয়াতে পারে। প্রচলিত ফলের মতো অপ্রচলিত ফল চাষের তেমন গুরুত্ব না পাওয়ার দরুন দেশ থেকে অনেক প্রজাতির ঐতিহ্যবাহী ফল বিলুপ্তি হতে চলেছে। এসব ফল রক্ষা করার লক্ষ্যে হাইব্রিড উন্নতজাতের চারা-কলমের পাশাপাশি এগুলোর চাষে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার।

উন্নতজাত, মান সম্পন্ন চারা-কলম ও নিবিড় পরিচর্যার অভাব এবং বৈরী আবহাওয়ার দরুন আমাদের দেশে ফলের কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় না। ফলের উন্নত এবং স্থান-অঞ্চল উপযোগী জাত, আধুনিক পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি সারা দেশের ফল চাষিদের দোরগোড়ার পৌঁছানোর মাধ্যমে দেশে ফলের উৎপাদান বহুলাংশে বাড়ানো সম্ভব। পরিবেশ সংরক্ষণ, জনগণের পুষ্টি নিশ্চিত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বনজ বৃক্ষের পাশাপাশি দেশে আরও অধিক হারে ফলদ বৃক্ষ রোপণ করা দরকার। বসতবাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ সহজে জন্মে। দেশের ২ কোটি ২৫ লাখ বসতবাড়িতে ক্ষুদ্র পরিসরে ফল বাগান স্থাপন করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণসহ বাড়তি আয়ের সুযোগ রয়েছে।  গ্রামের পাশাপাশি শহরাঞ্চলের বসতবাড়ি ও ছাদে ফল বাগান স্থাপন দিনদিন জনপ্রিয় হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পে বনায়নের ক্ষেত্রে শুধু টিম্বার বা কাঠ উৎপাদনশীল বিদেশি গাছের পরিবর্তে  কাঠ ও ফল দুটোই পাওয়া যায় এমন দেশি গাছ রোপণকে অগ্রাধিকার দেয়া যেতে পারে। বর্তমান কৃষকবান্ধব সরকার খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। বিদেশি ফলের আমদানি নির্ভরশীলতা কমানোর লক্ষ্যে এরই মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সমন্বিত মানসম্মত উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের লক্ষ্যে বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। অধিদফতর ৭২টি হর্টিকালচার সেন্টারে চারা কলম উৎপাদন, বৃক্ষ ও ফল মেলা উদযাপন এবং বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রদর্শনী স্থাপন ও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ফলের আবাদ বৃদ্ধির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন বৃক্ষ রোপণের কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো বাগানের পরিচর্যার লক্ষ্যে বৃক্ষ রোপণ আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করা, সম্ভাবনাময় এলাকায় ফল উৎপাদনের বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাণিজ্যিক ফল বাগান স্থাপন এবং বসতবাড়িতে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। উল্লিখিত কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।

জেড এম মমতাজুল করিম*

*মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

 

বিস্তারিত
আম উৎপাদন সংগ্রহ সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ

আম বাংলাদেশের প্রধান ফল, গ্রীষ্ম প্রধান দেশে ফলের মধ্যে আম সবার সেরা, ফলের রাজা। নানা আকারের বাহারি আম অতি সুস্বাদু ও পুষ্টিতে ভরপুর। আমে রয়েছে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিশেষ করে এতে ভিটামিনস ও মিনারেলসের পরিমাণ অনেক বেশি। এককালে বৃহত্তর রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর ও রংপুর জেলা উন্নতমানের আমের জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব এলাকা প্রধানত ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ফজলি, হিমসাগর, মোহনভোগ, গোলাপ খাস, সূর্যপুরি, মিসরি ভোগ, আশ্বিনাসহ প্রায় কয়েক শ’ জাতের আম উৎপাদনে অগ্রগামী ছিল। দেশের অন্য প্রান্তের জনসাধারণ মধুর মাস জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়-শ্রাবণে রাজশাহী অঞ্চলের সেরা আমের জন্য অপেক্ষা করত। পরে আম সম্প্রসারণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ কর্মসূচিতে আম্রপলি জাতের আমটিকে দেশের সব প্রান্তে সম্প্রসারণে প্রাধান্য দেয়া হয়। ফলে দেশের শুধু উত্তরাঞ্চলে নয়, বর্তমানে বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগাম এবং বরিশাল অঞ্চলের জেলাগুলোতেও এ জাতের আম প্রচুর উৎপাদন হচ্ছে। এ বিশেষ কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে বর্তমানে মোট যে আম উৎপাদন হচ্ছে তার প্রায় শতকরা ৪০-৪৫ ভাগই আম্রপলি জাতের আম।

 
কয়েক বছর ধরে আম্রপলি জাতের আমের পাশাপাশি যেসব জাতের আম চাষে অনেকেই আগ্রহী হচ্ছে তার মধ্যে রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা, ঠাকুরগাঁওয়ের বান্দিগুড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গৌরমতি, বারি উদ্ভাবিত বারি-৪, বাউ উদ্ভাবিত বাউ-১৪ (ব্যানানা ম্যাংগো),  ‘রাংগুয়াই’ (বার্মা), পলিমার (ভারত), নান ডকমাই (থাই) অন্যতম।
 
আম ফলের অবদান : আম ফল চাষে অগ্রগামী জেলাগুলোতে বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মৌসুমে ৩-৪ মাসব্যাপী আম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণসহ সংশ্লিষ্ট কাজে সব শ্রেণী ও বয়সের ছেলেমেয়ে, পুরুষ, মহিলা প্রচুর কাজের সুযোগ পায়, আয় বাড়ে, পারিবারিক সচ্ছলতা আসে। স্থানীয় পরিবহন (রিকশা, বাইসাইকেল, অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, মিনিট্রাক-পিকআপ) খাতে আয়  বৃদ্ধিসহ সংশ্লিষ্ট সবার যথেষ্ট আয় বাড়ে। এ ছাড়া আন্তঃজেলা পরিবহনে (বাস, ট্রাক, ট্রেন, ট্রলার, কুরিয়ার সার্ভিস) সঙ্গে জড়িত সবার প্রচুর আয় বৃদ্ধি পায় ।
 
আম উৎপাদনকারী এসব এলাকা ঝড় বাতাসে ঝরে পড়া কাঁচা-পাকা আম খাওয়ার প্রচুর সুযোগ পায়। এ সময় বেশি আম খাওয়ার প্রভাবে  সবার স্বাস্থ্য ভালো হয়, দৈনন্দিন ভাত আহার করার প্রবণতা অনেক কমে যায়। মৌমাছির আনাগোনা বেড়ে যায়, এ সময় তাদের বেশি মধু আহরণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। আম মৌসুমে এলাকায় হরেক রকম পাখির (বাদুড়, কাক, কোকিল, ঘুঘু ইত্যাদি) আনাগোনা বেড়ে যায়। এ সময় তাদের খাদ্য, আশ্রয় ও বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এছাড়াও বন্য ও গৃহপালিত পশুদের কাঁচা-পাকা আম ও পরিত্যক্ত অংশ (ছিলকা, আঁটি) খাবার সুযোগ বাড়ে, ফলে সবাই সুস্বাস্থ্য ফিরে পায়।
 
কাঁচা-পাকা আম থেকে আমচুর, আমসত্ত্বসহ নানা রকম আচার তৈরির কাজে এলাকায় হিড়িক পড়ে যায়। রান্নায় প্রাধান্য পায় আম-বেগুন-বড়ির তৈরি তরকারি, ডালে আম, সজিনায় আম এ এক মধুর ব্যাঞ্জন। স্থানীয়ভাবে তৈরি আমের জ্যাম, জেলি এলাকাবাসী নিজেরা খায়, অন্য জেলার আত্মীয়স্বজনকে সরবরাহ করে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান (প্রাণ, এসিআই, স্কয়ার) কাঁচা-পাকা আম সংগ্রহ করে। এগুলো তারা প্রক্রিয়াজাত করে উৎপাদিত হরেক রকম প্রডাক্টস সারা বছরব্যাপী দেশে-বিদেশে বাজারজাত করে প্রচুর আয় করে।
 
আম বাজারজাতকরণ পরিস্থিতি ও প্রভাব : এককালে আম চাষে অগ্রগামী বৃহত্তর রাজশাহীর আমচাষিরা বড় বড় বজরা-নৌকা দিয়ে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে আম বাজারজাত করত। পরে সহজ এ রুট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ট্রাক, বাস, ট্রেন, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে  আম বাজারজাতকরণের বিকল্প পরিবহন ব্যবহার হয়ে আসছে। আমচাষিদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ বছর আগে কোনো রকম কেমিক্যাল ব্যবহার ছাড়া ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়  পরিপক্ব কাঁচা আম বাজারজাত করার প্রচলন ছিল। পাকা আমের সেলফ লাইফ কম হওয়ায় ব্যবসায়ীদের পক্ষে তা দূর-দূরান্তে বেচার সুযোগ থাকে না। কাজেই স্থানীয়ভাবে খুব কম দামে স্থানীয় এলাকাবাসী পাকা আম কেনার সুযোগ পান। বিগত ৫ থেকে ৭ বছর ধরে আম ব্যবসায়ীদের মাঝে ঢাকাসহ অন্য জেলাগুলোতে আম বাজারজাত করতে আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগেছে। আমকে সমভাবে পাকাতে ও আকর্ষণীয় রঙ হতে ও কিছুটা আয়ু (সেলফ লাইফ) বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কিছু আম ব্যবসায়ীর আমে কয়েক ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ইথোফেন, ফরমালিন ও কার্বাইড অন্যতম। আম ফলে এসব রাসায়নিকের প্রভাব সম্বন্ধে কোনো প্রকার জ্ঞান বা ধারণা আহরণ না করেই অনেক পরিবেশবাদী, বুদ্ধিজীবী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিভিন্ন মিডিয়া কেমিক্যাল ব্যবহারের কুফল সম্বন্ধে অপপ্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ প্রচারণার কুফলে আম ফলের প্রতি অনুরাগী ভোক্তার মনে ভয় ঢুকেছে, বাজারের আম কিনতে তারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের টিকে থাকাই বর্তমানে কঠিন হয়ে পড়েছে। বৃহত্তর রাজশাহীসহ অন্য অধিক আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোতে মুকুল আসার শুরুতে এমনকি তার অনেক আগেই ২ থেকে ৫ বছরের জন্য আম বাগান কিনে নিতে প্রয়াসী ছিল। এ ব্যবস্থায় আমচাষিদের বাগান অনেক আগেই কিনে নিতো। বেশি লাভের আশায় তারা কেনা বাগানের সঠিক পরিচর্যা ও রোগ পোকামাকড় দমন করে বেশি আম উৎপাদন পদক্ষেপ নিতো। তাতে বাগানের মালিক ও ক্রেতা উভয়েই বেশি  লাভবান হতো। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতায় এসব আম ব্যবসায়ী বাগান কেনায় নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে। আমচাষিরা এ খাতে অধিক আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নতুন আম বাগান সৃষ্টি হুমকির মুখে পড়েছে। এমনকি পুরনো বাগানগুলো রাখা যাবে কিনা এ চিন্তায় বাগানীর মাথায় হাত।
 
প্রশিক্ষণ : বিভিন্ন মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, পরিবেশবাদীদের অপপ্রচারে অনুপ্রাণিত হয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আম ফল নিধনে অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছে। কয়েক বছর ধরে তাদের তৎপরতায় কত হাজার টন যে আম নিধন হয়েছে তার প্রকৃতি তথ্য দেয়া কঠিন। অথচ যারা এ দায়িত্বে আছেন তাদের ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য সম্বন্ধে কোনো প্রশিক্ষণ বা ধারণা দেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। আমে ব্যবহৃত কেমিক্যাল ব্যবহারে পূর্ণ ধারণার অভাবের কারণে আমচাষি ও আম ব্যবসায়ীর বর্তমানে বেহাল অবস্থা। বিরাজিত পরিস্থিতি থেকে আম সম্পদ ও আমচাষিদের বাঁচাতে এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা নেয়া অত্যাবশ্যক।
 
রাসায়নিক পরীক্ষা যন্ত্র : ক্ষেত্র বিশেষে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি নিরূপণে যে যন্ত্র ব্যবহার করছে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও গবেষকদের কাছে প্রতীয়মাণ হয়েছে যে তা ডিফেক্টিভ, তা থেকে প্রকৃত ফল পাওয়া যায় না। তাই এ যন্ত্রের ওপর নির্ভর করে আমচাষি-ব্যবসায়ীদের আম নিধন করার এখতিয়ার বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সর্বোপরি এসব রাসায়নিক (ফরমালিন, ইথোফেন, কার্বাইড) মানবদেহের জন্য গ্রহণযোগ্য বা সহনীয় মাত্রা সম্বন্ধে গবেষক কর্তৃক তাদের ধারণা দেয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
 
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দলে বিশেষজ্ঞের অন্তর্ভুক্তিকরণ : সীমিত ধারণা নিয়ে আমচাষি-ব্যবসায়ীদের ওপর ঢালাওভাবে আম নিধন, জরিমানা, জুলুম ও হয়রানি নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি টিমে একজন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ-বিজ্ঞানী-অভিজ্ঞ সম্প্রসারণ কর্মকর্তাকে সম্পৃক্ত করা অত্যাবশ্যক। অন্যথায় অসহায় আমচাষি আর্থিক ক্ষতি ও বিব্রতকর বিভিন্ন পরিস্থিতি থেকে অব্যাহতি পেতে হয়তো তারা তাদের প্রিয় আম বাগানটিকে নিধন করতে বাধ্য হবে। এর প্রভাবে প্রাণিকূলের চাহিদাকৃত অক্সিজেন সঙ্কট দেখা দেবে, দেশে পরিবেশ বিপর্যয় হওয়ার আশঙ্কা হবে, বাজারে আমের সরবরাহ কমে যাবে, আম ফল অনুরাগীদের তা ক্রয়ে সুযোগ ব্যাহত হবে।
 
আমে ব্যবহৃত সম্ভাব্য রাসায়নিক দ্রব্য
১। ইথোফেন-ইথরেল (২ ক্লোরোইথেন ফসফরিক এসিড) : ইথোফেন একটি প্লান্ট গ্রোথ হরমোন, তবে ইহা পরিপক্ব ফলকে পাকাতে এবং সংরক্ষণে ব্যবহার প্রচলন সারা পৃথিবীতে রয়েছে। গবেষকেরা বিভিন্ন মাত্রায় (২৫০-১০০০০ পিপিএম) ইথোফেন পরিপক্ব কাঁচা আমে স্প্রে করার ২৪ ঘণ্টা পর পুনরায় তার উপস্থিতি মাত্রা নির্ণয় করতে গিয়ে দেখতে পান যে উহা দ্রুত ফলের উপরিভাগ থেকে উড়ে যায়। তবে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা ঋঅঙ/ডঐঙ কর্তৃক নির্ধারিত গ্রহণযোগ্যতা মাত্রার (এমআরএল-২পিপিএম) অনেক নিচে নেমে যায়। তাই ইথোফেন দিয়ে ফল পাকানোর স্বাস্থ্যগত কোনো ঝুঁকি নেই বলে বিজ্ঞানীদের মতামত। তবে আম চাষিরা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহার না করে এবং উহা কেবলমাত্র পুষ্ট কাঁচা আমে ব্যবহার করে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান ও বহুল প্রচার ব্যবস্থা নেয়া অত্যাবশ্যক।
 
২। ফরমালিন : আমের স্বাস্থ্য, উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি ও আয়ু (সেলফ-লাইফ) বৃদ্ধির জন্য কোনো কোনো আম ব্যবসায়ী কাঁচা আমে ফরমালিন ব্যবহার করে থাকে। তবে ব্যবহারের ৫-৭ দিন পর এ ধরনের ফরমালিনের তেমন কোনো প্রভাব থাকে না বলে গবেষকদের অভিমত। অধিকন্তু আমের বাইরের চামড়া বা ছিলকা পুরু হওয়ার কারণে আমের আহার্য অংশে তা প্রবেশ সম্ভবনা খুবই কম। ফরমালিনের উপস্থিতি নির্ণয়ে বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে যে ফরমালডিহাইড টেস্ট মিটার (জেড-৩০০) ব্যবহার করা হচ্ছে তার কার্যকারিতা নিরূপণে গবেষকরা ব্যবস্থা নেন। ইথোফেন মিশ্রিত পানিতে এবং ফরমালিন মিশ্রিত পানিতে আম চুবানোর একদিন পর এ টেস্ট মিটার দিয়ে তারা পরীক্ষায় একই ফল দেখতে পান। কাজেই ফরমালডিহাইড মিটার (জেড-৩০০) দিয়ে ফরমালিন মাপা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে তাদের অভিমত। প্রকৃত পক্ষে ফরমালিন হলো ৩৭% ফরমালডিহাইড। মানবদেহে প্রতি মিলিলিটার রক্তে প্রকৃতিগতভাবে সর্বোচ্চ ২.৫ মাইক্রোগ্রাম ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মানবদেহে মেটাবিলিজম প্রক্রিয়ায় ফরমালডিহাইড প্রয়োজন। হজম প্রক্রিয়ায় উহা ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয় এবং তা প্রস্রাবের সাথে এবং সামান্য অবশিষ্ট অংশ নিশ্বাসের সাথে কার্বনডাইঅক্সাইড আকারে বের হয়ে যায়। এমনকি তা দেহের চর্বিতে ও জমা থাকে না। ফরমালিন পানিতে দ্রুত গলে বা মিশে যায় এবং কর্পুরের মতো বাতাসে উড়ে যায়। গবেষকেরা বিভিন্ন ফলবাজার ঘুরে সংগৃহীত নমুনায় কোনো ফরমালিনের উপস্থিতি পাননি। তথাপি সন্দেহ হলে আহারের আগে ফলকে পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে একদিন পরে তা আহার করলে নিরাপদ বলে বিবেচিত। তাই আমে ফরমালিনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে যে নানামুনি নানা প্রচারণা ছড়াচ্ছে তা ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মাণ হয়।
 
৩। ক্যালসিয়াম কার্বাইড : পরিপক্ব ও অপরিপক্ব উভয় ধরনের আমে কার্বাইড ব্যবহার করলে তাতে ফলের উপরিভাগে পাকা আমের মত রঙ আসে। অপরিপক্ব টমেটোতে ইহা প্রয়োগ করে আগাম পাকানোর প্রচলন দেখা যায়। তবে অপরিপক্ব আমে কার্বাইডের ব্যবহার তেমন একটা লক্ষ করা যায় না। কোনো কোনো অসাধু আম ব্যবসায়ী পরিপক্ব কাঁচা আম ঝুড়িতে রাখার আগে ৫ থেকে ৭ গ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড কাপড়ের পুঁটলিতে বেঁধে ঝুড়ির তলায় রেখে আম দিয়ে ঝুড়ি ভর্তি করে। এতে ঝুড়ির ভেতর গ্যাস তৈরি হয়। ভেতর গরম হয় এবং আমের গায়ে ঘাম ঝরে। এ আমের ঝুড়ি নির্দিষ্ট বাজারে পৌঁছলে তা খুলে দিলে গ্যাস আকারে (কার্বন মনোঅক্সাইড) উড়ে যায়। মার্চ এপ্রিল মাসে দেশের আগাম জাতগুলো (গোপালভোগ, হিমসাগর, খুদিখিরসা, গোলাপ খাস) অপরিপক্ব থেকে যায়। তবে মে মাসের প্রথম ভাগে সাতক্ষীরা বেল্টের আম থেকে রাজশাহী অঞ্চলে আগাম জাতের আম পরিপক্ব হতে প্রায় ৩ সপ্তাহ বেশী সময় লাগে। তাই আগাম জোনের (সাতক্ষীরা, যশোহর, কুষ্টিয়া) এ ধরনের আগাম জাতের আম মে মাস থেকে এবং রাজশাহী জোনের আম মে মাসের শেষ ভাগে কাঁচা আম পরিপক্ব হয়। মার্চ-এপ্রিল মাসে এসব আগাম জাতের স্থানীয় আম বাজারে পাওয়া গেলে ধরে নিতে হবে তা কার্বাইড দিয়ে পাকানো। কাজেই এ সময়ে বাজারে প্রাপ্ত আম খাওয়া কোনো মতেই ঠিক হবে না। ফল পাকাতে কোনোক্রমেই যেন ক্যালসিয়াম কার্বাইড বা কার্বাইড ব্যবহার না করে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা আনায়ন দরকার। কেননা ক্যালসিয়াম কার্বাইড মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক।
 
আম শোধনে রাসায়নিক ব্যবহার : গাছ থেকে আম পাড়ার পর আমের কস বা দুধ বের হয়ে গেলে আম শোধন উপযোগী হবে। প্রতি লিটার পানিতে ০.৫৫ মি.লি. ‘প্লোক্লোরাজ’ নামক রাসায়নিক দ্রব্য মিশানো পানিতে আম ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। এভাবে আম শোধনে আমের পচন রোধ হয় ও উজ্জ্বলতা বজায় থাকে। অধিকন্তু, আম পাড়া থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত আমের জীবনী (সেলফ লাইফ) ২-৩ সপ্তাহ বজায় থাকে। আম রপ্তানিকারক সব দেশেই এ পদ্ধতির ব্যবহার প্রচলন আছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫-১.০০ গ্রাম ‘বেনোমিল’ নামক রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে তাতে একইভাবে আম শোধন করা যাবে। এ পদ্ধতিতে আম শোধন ব্যবস্থা ভারতে অতি জনপ্রিয়। অধুনা, কিছু সচেতন আমচাষি ভারত থেকে ‘বেনোমিল’ এনে আম শোধন করে সুফল পেয়ে আসছে।

গরম পানিতে আম শোধন : গরম পানিতে পরিপক্ব কাঁচা আম শোধন করা হলে, আমের গায়ে লেগে থাকা রোগ জীবাণু ও পোকা মুক্ত হবে। গ্রাহকের কাছে অন্য আমের তুলনায় এ শোধিত আমের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে। মৌসুমে পরিপক্ব পুষ্ট কাঁচা আম গাছ থেকে সাবধানে পেড়ে তা আগে পরিষ্কার পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর কোন পাত্রে ৫২০- ৫৫০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি (পানিতে হাত ডুবালে সহনীয়মাত্রায়) গরম হলে তাতে পরিষ্কার করা আমগুলো ঠিক ৫ মিনিট রেখে এক সাথে উঠিয়ে নিতে হবে। আমের গা থেকে পানি শুকিয়ে গেলে স্বাভাবিক নিয়মে আমগুলো প্যাকিং করে বাজারজাত করতে হবে। এ ব্যবস্থায় আমের জাতের প্রকারভেদে সাধারণ আমের (নন ট্রিটেট) চেয়ে গরম পানিতে শোধন করা আমের আয়ু (সেলফ লাইফ) ১০ থেকে ১৫ দিন বেড়ে যাবে। তবে এ পদ্ধতি প্রয়োগ সীমিত পরিমাণ আমের জন্য প্রযোজ্য।
 
এম এনামুল হক*
সামিনা হক**
* প্রাক্তন ডিজি, ডিএই; ** সহকারী অধ্যাপক, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ধানমন্ডি, ঢাকা
বিস্তারিত
রফতানি বৃদ্ধিতে মানসম্পন্ন ফলের উৎপাদন নিশ্চিতকরণ

মানবজাতির সৃষ্টি ও বিকাশের সাথে ফল অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আদি মানব, আদম ও হাওয়া সৃষ্টির পর বাগানে বিচরণ করতেন এবং বিভিন্ন ফল আহার করতেন। বাগানে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার অপরাধেই মানবজাতির এ সুন্দর পৃথিবীতে আগমন। পৃথিবীতে এসেও প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকা ফলমূল আহরণ ও ভক্ষণ করেই তাদের বাঁচতে হয়েছে। ফলে তারা এসব ফলের পরিচর্যা শুরু করে দেয়। কাজেই ইতিহাসের দিক থেকেও বিবেচনা করলে ফল তথা উদ্যান বিজ্ঞানের বিকাশ কৃষি বিজ্ঞানেরও আগে। আর এ প্রাচীনতম বিজ্ঞানকে যারা দৈনন্দিন ও জাতীয় জীবনে যথার্থ স্থান দিয়েছে তারাই দুনিয়াতে স্বাধীন ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

প্রকৃতিতে যত প্রকার খাদ্যদ্রব্য উৎপাদিত হয় তার মধ্যে ফলই সবচেয়ে বেশি পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু। এর মধ্যে রয়েছে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় সব গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। ফল বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের সর্বোৎকৃষ্ট উৎস। এটি রান্না ছাড়া সরাসরি খাওয়া হয় বলে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানগুলোর সবটুকুই দেহ গ্রহণ করতে পারে। এসব উপাদান দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধিসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিধায় এদের প্রটেকটিভ ফুড বা প্রতিরক্ষাকারী খাদ্যও বলা হয়। পুষ্টি উপাদান ছাড়াও ফলে এমন কিছু জৈব এসিড ও এনজাইম আছে, যা আমাদের হজমে সহায়তা করে। যেমন- লেবু জাতীয় ফলে সাইট্রিক এসিড, আঙুর ও তেঁতুলে টারটারিক এসিড আছে। পেঁপেতে রয়েছে পেঁপেইন নামক হজমকারী এনজাইম। এ ছাড়াও চাল বা গম অপেক্ষা ফল চাষ করে অধিক শক্তি পাওয়া যায়। তাই সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম এবং মেধাবী জাতি গঠনে সুষম খাদ্য তথা ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই দানাজাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনের পাশাপাশি ফলের সার্বিক উন্নয়নেও সমগুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন যাতে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
 
বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ফলের অবদান কম নয়। বাংলাদেশে ফলের আওতায় মোট আবাদি-চাষভুক্ত জমির পরিমাণ শতকরা ১.৬৬ ভাগ। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে মোট ফসলভিত্তিক আয়ে প্রায় শতকরা ১০ ভাগ আসে ফল থেকে। অধিকন্তু, বিদেশে তাজা-টাটকা ফল ও প্রক্রিয়াজাতকৃত-মূল্যসংযোজিত ফলজাত দ্রব্যাদির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। আমদানিকারক দেশের চাহিদা অনুযায়ী নিরাপদ ও গুণগতমানসম্পন্ন তাজা ফল ও প্রক্রিয়াজাতকৃত-মূল্যসংযোজিত ফলজাত দ্রব্যাদি উৎপাদন করে রফতানির মাধ্যমে অধিকহারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
 
ফল চাষের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে প্রায় ৭০ রকমের প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফল জন্মে থাকে। প্রচলিত ফলের মধ্যে কলা, আম, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, পেঁপে, লেবু, বাতাবিলেবু, লিচু, কুল এবং নারিকেল উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে কামরাঙা, লটকন, সাতকরা, তৈকর, আতা, শরিফা, জলপাই, বেল, আমড়া, কদবেল, আমলকী, জাম, ডালিম, সফেদা, জামরুল, গোলাপজাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য অপ্রচলিত ফল। স্থানীয় ও বিদেশি ফল এ দেশের উষ্ণ-অব উষ্ণ জলবায়ুতে জন্মে বিধায় স্বাদে, গন্ধে, আকারে ও ফলনে নানা বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে বহু রকম ফল উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মাথাপিছু দৈনিক ফলের প্রাপ্যতা মাত্র ৭৮ গ্রাম, যা পুষ্টি বিজ্ঞানীদের সুপারিশকৃত ন্যূনতম চাহিদা মাত্রার (১১৫ গ্রাম) অনেক কম। বর্তমানে বাংলাদেশে ২ লাখ ৪৩ হাজার হেক্টর জমি থেকে ৪৫.২ লাখ টন ফল উৎপাদন হয় অথচ আমাদের দরকার ৬৭.২০ লাখ টন। ফলের উৎপাদন ন্যূনতম চাহিদার তুলনায় প্রায় ২২.০০ লাখ টন কম। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ফলের মাথাপিছু প্রাপ্যতার পরিমাণ বাড়াতে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।
 
ফল উৎপাদনের সমস্যা
উচ্চফলনশীল উন্নত জাতের অপ্রতুলতা অঞ্চলভিত্তিক উন্নত জাতের অভাব অনিয়মিত ফল ধারণ মৌসুমভিত্তিক প্রাপ্যতার তারতম্য উন্নত গুণাগুণসম্পন্ন চারা/কলমের অভাব ফল গাছের অপর্যাপ্ত পুষ্টি, সেচ ও ফসল ব্যবস্থাপনা রোগ ও পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব বাজারজাতকরণের প্রতিবন্ধকতা ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় নিরাপদ ফল চাষে কৃষকদের সচেতনতার অভাব।
 
ফলের মৌসুমভিত্তিক প্রাপ্যতা
আমাদের দেশে প্রচলিত ফলের প্রাপ্তির সময় খুবই সংক্ষিপ্ত অর্থাৎ মধ্য মে থেকে মধ্য আগস্ট মাস পর্যন্ত। এ সময় মোট ফল উৎপাদনের শতকরা ৫৪ ভাগ ফল পাওয়া যায় এবং বাকি আট মাস শতকরা ৪৬ ভাগ ফল পাওয়া যায়। আমাদের দেশে ফলের ভরা মৌসুমে অর্থাৎ মধ্য মে থেকে মধ্য আগস্ট মাসে দেশীয় ফলের প্রাপ্যতা মোটামুটি সন্তোষজনক থাকলেও অন্য সময়ে দেশের চাহিদা পূরণ করতে আমদানির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে। সেজন্য দেশীয় ফলের প্রাপ্যতার সময় বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। ফলের প্রাপ্যতার সময় বৃদ্ধিকরণের মাধ্যমে দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর পুষ্টি ঘাটতি পূরণের সাথে সাথে জনসাধারণের আয় ও কাজের সুযোগও সৃষ্টি করা সম্ভব। আগাম, নাবী ও লিন পিরিয়ডে ফলের (সেপ্টেম্বর-এপ্রিল) উপযুক্ত জাত নির্বাচনের মাধ্যমে ফলের প্রাপ্যতার সময় বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ফল উৎপাদনের সম্ভাবনা
মাটি ও জলবায়ু : বাংলাদেশ আর্দ্র ও উষ্ণম-লীয় দেশ। এ দেশের অত্যন্ত উর্বর ও গভীর মাটি প্রায় সব ধরনের গ্রীষ্ম ও অবগ্রীষ্ম মণ্ডলীয় ফল চাষের অনুকূল।
 
জনপ্রতি প্রাপ্যতা : বর্তমানে এ দেশে যে পরিমাণ ফল উৎপাদিত হচ্ছে তা পুষ্টি বিজ্ঞানীদের সুপারিশকৃত মাত্রার প্রায় ৬৮% পূরণ করতে পারে। অবশিষ্ট ৩২% ঘাটতি পূরণে প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।
 
আবাদি-চাষভুক্ত জমি বৃদ্ধি : বর্তমানে এ দেশে মোট চাষযোগ্য জমির মাত্র ১.৬৬% জমিতে ফল ও ফলদ বৃক্ষের চাষ হয়ে থাকে। সম্প্রসারণ কাজের মাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চল, পতিত জমি, বসতবাড়ি, পুকুর পাড়, রাস্তার ধার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চত্বর, অফিস এলাকা প্রভৃতি জায়গায় প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলগাছ লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।
 
ফলন বৃদ্ধি : উন্নত জাতের চাষ, উন্নত চাষাবাদ ও নিবিড় পরিচর্যা, সঠিক রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা এবং দক্ষ সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
 
ফল রপ্তানি
বিশ্বের ফল বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবদান খুবই কম। বিদেশে তাজা-টাটকা ফল ও প্রক্রিয়াজাতকৃত-মূল্যসংযোজিত ফলজাত দ্রব্যাদির প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে সীমিত আকারে টাটকা ফল রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে ফল রপ্তানি হলেও যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং ওমান উল্লেখযোগ্য। অধিক পরিমাণ ফল রপ্তানি করতে হলে আমদানিকারক দেশের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন, প্যাকেজিং ও পরিবহন ব্যবস্থা বিন্যস্ত করতে হবে। রপ্তানিকৃত উল্লেখযোগ্য ফলগুলো হলো- কাঁঠাল, আম, আনারস, জারা লেবু, এলাচি লেবু, আমড়া, জলপাই, পেয়ারা, সাতকরা, তৈকর, লটকন, কামরাঙা, বেল, কদবেল, আমলকী, বাতাবি লেবু, তেঁতুল ও চালতা। প্রবাসী বাংলাদেশী, পাকিস্তানি এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের মাঝে বাংলাদেশী টাটকা ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আকর্ষণীয় রঙ, সমআকার, আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং ব্যবহারের কারণে থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, চীন ও আফ্রিকান দেশগুলোর ফলের চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি।
 
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত ফলের পরিমাণ ও মূল্য সারণি-১ এ উল্লেখ করা হলো :
সারণি-১: ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ফল রপ্তানির পরিমাণ ও মূল্য

তথ্যসূত্র : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং হর্টেক্স ফাউন্ডেশন ২০১৫

*রপ্তানিকৃত ফলের গড় মূল্য ৩২০৫ ইউএস ডলার/মে.টন হিসেবে পরিমাণ নির্ণয় (২০১০-১১ অর্থবছরের ভিত্তিতে) করা হয়েছে।
টাটকা ফল রপ্তানি ছাড়াও হিমায়িত ফল (সাতকরা, কাঁঠালের বীজ, কাঁচাকলা, লেবু, জলপাই, আমড়া ইত্যাদি) ইতালি, জার্মানি, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান এবং বাহরাইনে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। ফলের বর্তমান গড় ফলন ও বৈদেশিক বাজারের মূল্য বিবেচনায় সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করলে অদূর ভবিষ্যতে ফল ও ফলজাত দ্রব্যাদির রপ্তানি করে বর্তমানের চেয়ে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব, যা দেশের অর্থনৈতিক আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্যবিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

ফল রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতা
অঞ্চলভিত্তিক রপ্তানি উপযোগী ফল জাতের অপ্রতুলতা।
আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদানুযায়ী গুণগত মানসম্পন্ন ফলের অভাব।
ফলের অনিয়মিত সরবরাহ।
সঠিক পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনার অভাব।
সঠিক সংগ্রহ কলাকৌশল এবং সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার অভাব।
আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্যাকেজিংয়ের অভাব।
অন্যান্য দেশের তুলনায় বিমান ভাড়া বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন।
স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিবহন সমস্যা
বিমানবন্দরের ভেতরে হিমাগারের অভাব।  
সঠিক প্যাক-হাউস এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহনের অভাব।
গুণগতমান রক্ষাকল্পে সঠিক উৎপাদন ও সংগ্রহোত্তর কলাকৌশল সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব।
 
ফল রপ্তানির সম্ভাবনা
এ দেশের মাটি, জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থান উপযোল উৎপাদন করে রপ্তানির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের অভিজ্ঞতা এবং কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মাণ হয়েছে যে, উত্তম কৃষি পদ্ধতি (GAP) অনুসরণের মাধ্যমে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত গুণগতমানসম্পন্ন ফল উৎপাদন, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, মোড়ক উন্নয়ন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মধ্যমে ethnic and mainstream market এ বাংলাদেশের তাজা-টাটকা ফল রপ্তানির অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান। তাছাড়া, হিমায়িত এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত ফলজাত দ্রব্যাদি রপ্তানির সম্ভাবনাও প্রচুর। অদূর ভবিষ্যতে জৈব কৃষি পদ্ধতিতে উৎপাদিত তাজা ফল রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের ফলের চাহিদা না থাকলেও আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, লেবুজাতীয় ফল, লিচু ও পেয়ারার ব্যাপক চাহিদা বিদ্যমান। উল্লেখ্য, হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অর্থায়নে ২০১৫ সালে উত্তম কৃষি পদ্ধতি ব্যবস্থা অনুসরণপূর্বক নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও আন্তর্জাতিক বাজারের মানসম্পন্ন আম উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচগী হওয়ায় আন্তর্জাতিক মানের ফরা পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টে (ASDA) বাংলাদেশের আম প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যে রপ্তানি শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা মোতাবেক গুণগতমানসম্পন্ন ফল উৎপাদন সাপেক্ষে আগামী দিনে বাংলাদেশ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডসসহ অন্যান্য দেশে বিভিন্ন প্রকার মৌসুমী ফল রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন কলাকৌশল
অঞ্চলভিত্তিক রফতানি উপযোগী জাতের ব্যবহার
ফল উৎপাদনে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে জাতের উৎকৃষ্টতা। কেননা ভালো জাত ভালো ফসলের অন্যতম প্রধান উপাদান। সঠিকভাবে জাত নির্বাচনের ওপর এর ফলন এবং লাভ-লোকসান অনেকাংশে নির্ভর করে। কাজেই ফলচাষিরা অঞ্চলভিত্তিক রফতানি উপযোগী ভালো জাত সরবরাহ করার সাথে সাথে চাষের প্রয়োজনীয় উৎপাদন কলাকৌশল সম্পর্কে অবহিত করতে হবে এবং ভালোজাতের চারা রোপণের জন্য পরামর্শ দিতে হবে।
 
উন্নত গুণাগুণসম্পন্ন কলমের চারা ব্যবহার
ফলগাছের চারা মূলত যৌন এবং অযৌন প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়ে থাকে। বীজ থেকে উৎপাদিত চারায় মাতৃগাছের গুণাগুণ অক্ষুন্ন থাকে না কিন্তু অঙ্গজ পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারায় মাতৃগাছের বৈশিষ্ট্যগুলো বজায় থাকে। কাজেই ফলগাছ রোপণের পূর্বে সঠিক চারা নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা বাংলাদেশে ফলের নিম্ন ফলন ও নিম্নমানের ফল উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কারণ বীজের চারা ব্যবহার। উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন কলমের চারার অপর্যাপ্ত সরবরাহের জন্য কৃষকরা অধিকাংশ সময়ই বীজের চারা রোপণ করে থাকেন। ফলে সেই চারা বা গাছ থেকে কাক্ষিত মাত্রায় উন্নত মানের ফল এবং ফলন পাওয়া যায় না। কলমের চারা নির্বাচনে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনা করা দরকার-
কলম উন্নত জাতের হতে হবে (অনুমোদিত বা স্থানীয়)।
নিজের তৈরি বা পরিচিত নার্সারি থেকে কলমের চারা সংগ্রহ করতে হবে।  সুস্থ, সবল অর্থাৎ রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত হতে হবে।
গাঢ় ঘন সবুজ পাতাবিশিষ্ট ও কোমল, বর্ধিষ্ণু, সোজা ও তেজদীপ্ত হতে হবে।
সঠিক বয়সের হতে হবে।
ফলচাষিকে উন্নত গুণাগুণসম্পন্ন ভালোজাতের কলম সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং এর উপকারিতা সম্পর্কে সর্বদা অবহিত করতে হবে।
উপযুক্ত স্থান নির্বাচন
ফল বাগানের স্থান নির্বাচন ভুল হলে তা শোধরানো কঠিন তাই ফল বাগানের স্থান সঠিকভাবে নির্বাচন করা প্রয়োজন।
ফল চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে যেখানে সারাদিন সূর্যের আলো পড়ে পাহাড়ি এলাকায় জমির ঢাল ৪৫ ডিগ্রির কম হতে হবে।

জলবায়ু ও মাটি ছাড়াও বাণিজ্যিক ফল বাগানের এলাকা এবং স্থান নির্বাচনে যে বিষয়সমূহ বিবেচনা করা উচিত তা হচ্ছে- ক) বাজারের নৈকট্য, খ) যোগাযোগ ব্যবস্থা, গ) সেচের ব্যবস্থা, ঘ) সার ও ফল সংরক্ষণের ব্যবস্থা, ঙ) জমির মূল্য, চ) শ্রমিক, যন্ত্রপাতি ও উপকরণের সহজলভ্যতা ইত্যাদি।
 
চারা রোপণের সঠিক নিয়মনীতি অনুসরণ
ফলের চারা লাগানোর স্থান নির্ধারণের পর চারার জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বে সঠিক আকারের গর্ত করতে হবে এবং গর্তের উপরের স্তরের মাটি এক পাশে, বাকি অর্ধেক আলাদা করে রাখতে হবে। চারা রোপণের অন্তত তিন সপ্তাহ আগে সঠিক মাত্রায় সার উপরের অংশের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভর্তি করতে হবে। চারা উপযুক্ত সময়ে সঠিকভাবে রোপণ করতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ চাষিরাই চারা রোপণের জন্য সঠিক নিয়মনীতি অনুসরণ করেন না বিধায় গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ায় ফলের ফলন কমে যায়। তাই ফল চাষিদের ফলের চারা রোপণের সঠিক নিয়মনীতি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

ছাঁটাইকরণ
গাছের বৃদ্ধির প্রাথমিক অবস্থায় গাছের একটা সুন্দর, মজবুত কাঠামো বা গঠন তৈরির জন্য যে ছাঁটাই করা হয়ে থাকে তাকে ইংরেজিতে ‘ট্রেনিং’ এবং বাংলায় ‘ছাঁটাই’ বলা হয়ে থাকে। ফল গাছের প্রজাতিভেদে গাছের কা-টা যাতে সোজাভাবে প্রায় ০.৭৫ মিটার থেকে ১.৫ মিটার লম্বা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং গাছের গোড়ার অপ্রয়োজনীয় ডালপালা গজালে নিয়মিত ছাঁটাই করতে হবে। (চলবে)
 
ড. মো. আবদুল জলিল ভূঁঞা*
মিটুল কুমার সাহা**
* ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ** সহকারী মহাব্যবস্থাপক, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, সেচ ভবন (৪র্থ তলা), ২২ মানিক মিয়া এভিনিউ, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭
বিস্তারিত
দৈনন্দিন পুষ্টি পূরণে দেশি ফল

ফল, আল্লাহর এক অপূর্ব নিয়ামত। কথায় আছে ‘ফলই বল’। আদিকালে মানুষ বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত এবং ফল খেয়েই জীবনধারণ করত। বর্তমান সোগ্লান হচ্ছে  

    দেশি ফলে পুষ্টি বেশি
    অর্থ খাদ্যে পাই তুষ্টি।
দেশি ফল পুষ্টিতে ভরপুর। বর্তমানে ফল অর্থকরী ফসল। ফল গাছ কাঠ দেয়, ছায়া দেয় এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। ফলের রয়েছে ভেষজ বা ঔষধি গুণ। নিয়মিত ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ সবল জীবন লাভ করা যায়।
খনার বচনে আছে, বারো মাসে বারো ফল
            না খেলে যায় রসাতল।
তাই বলব, সুস্থ সবল জীবন চান
         হরহামেশা ফল খান।
আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক পুষ্টিহীনতার শিকার। এখানকার প্রায় ৮৮ ভাগ লোক ভিটামিন-এ, ৯০ ভাগ লোক ভিটামিন-সি, ৯৩ ভাগ লোক ক্যালসিয়ামের অভাবে ভোগে। এ ছাড়া প্রায় ৭০ ভাগ পুরুষ, ৭৩ ভাগ শিশু ও ৭৫ ভাগ মহিলা রক্তাল্পতা রোগে ভোগে। আমাদের এ পুষ্টি ঘাটতি পূরণে ফল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
 
পুষ্টিবিদদের মতে, সুস্থ সবল দেহের জন্য দৈনিক জনপ্রতি ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। তা জোগান দেয়া সম্ভব না হলে কমপক্ষে ৬০ গ্রাম ফল খাওয়া বাঞ্ছনীয়।
বয়স অনুপাতে দৈনিক খাদ্য তালিকায় ফলের চাহিদা
বয়স    ফলের পরিমাণ (মাথাপিছু গ্রহণ হার
শিশু                               ৩০ গ্রাম
কিশোর (১৩-১৯ বছর)    ৬০ গ্রাম
প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ              ৬০ গ্রাম
গর্ভবতী মহিলা                 ৯০ গ্রাম
সূত্র : পুষ্টি প্রশিক্ষণ সহায়িকা, জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
 
দেশি ফলে বেশি বল
আমাদের দেশে বিভিন্ন মৌসুমে বাহারি ফল জন্মে। এসব দেশি ফল বিদেশি ফলের চেয়ে কোন  অংশে কম নয়। শুধু স্বাদে, গন্ধেই নয় পুষ্টি মানের বিচারেও উৎকৃষ্ট। আজকাল অনেক দেশি ফলের নাম শুনলে নাক ছিটকান। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাচ্চাদেরকে নামি-দামি বিদেশি ফল-আপেল, আঙুর, মাল্টা খাওয়ান। অথচ দেশি ফলে পুষ্টি উপাদান বেশি। বিদেশি ফল আপেলে ভিটামিন-সি আছে খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে মাত্র ৩.৫ মিলিগ্রাম। অপরদিকে বাংলার আপেল বলে খ্যাত পেয়ারায় ভিটামিন-সি আছে ২১০ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ পেয়ারায় আপেলের চেয়ে ৫০ গুণেরও বেশি ভিটামিন-সি আছে। আঙুরে খাদ্যশক্তি আছে ১৭ কিলোক্যালরি আর কুলে খাদ্যশক্তি আছে ১০৪ কিলোক্যালরি যা ৬ গুণেরও বেশি। আঙুরে ভিটামিন সি আছে ২৮.৫ মিলিগ্রাম, কুলে ভিটামিন সি আছে ৫১ মিলিগ্রাম অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। পাকা আমে ক্যারোটিন আছে ৮৩০০ মাইক্রোগ্রাম, পেঁপের মধ্যে আছে ৮১০০ মাইক্রোগ্রাম, কাঁঠালে আছে ৪৭০০ মাইক্রোগ্রাম (ফল পরিচিতি ও চাষাবাদ কৌশল, কৃতসা)। সে তুলনায় আঙুর, আপেল, নাশপাতি, বেদানায় ক্যারোটিন আদৌ নেই। বিদেশি ফল মাল্টা ক্যারোটিন শূন্য অথচ দেশি কমলায় ক্যারোটিনের পরিমাণ ৩৬২ মাইক্রোগ্রাম (কৃষি কথা, আষাঢ় ১৪২১)। সুতরাং-

আর নয় বিদেশি ফল
খাবো কেবল দেশি ফল।
 
অপুষ্টিজনিত রোগবালাই প্রতিরোধে দেশি ফল
ভিটামিন-এ’র অভাবে শিশুদের রাতকানা, অন্ধত্ব রোগ দেখা দেয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার শিশু অন্ধত্ব বরণ করে এবং রাতকানা রোগে ভোগে প্রায় পাঁচ লাখ শিশু। হলদে বা লালচে রঙিন ফল যেমন- পাকা আম, পাকা পেঁপে, পাকা কাঁঠাল ক্যারোটিন সমৃদ্ধ। এ ক্যারোটিন প্রায় ৬ ভাগের এক ভাগ ভিটামিন-এ তে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের শরীরে কাজে লাগে। এসব ফল অন্যান্য পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। তাই শিশুসহ সব বয়সী লোকদের উচিত দৈনিক বেশি করে ফল খাওয়ার অভ্যাস করা। ভিটামিন-সি ত্বককে মসৃণ করে, দাঁতের মাঢ়িকে মজবুত করে ও সর্দি কাশি থেকে রক্ষা করে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।  ভিটামিন-সি রান্নার তাপে প্রায় ৮০% নষ্ট হয়ে যায়। ফল সরাসরি খাওয়া হয় বলে ভিটামিন-সি নষ্ট হয় না। ফল বিশেষ করে টক জাতীয় ফল ভিটামিন-সি’র রাজা। আমলকী ও অরবরই ভিটামিন-সি’র গুদাম ঘর। ভিটামিন-সি দৈনিক খেতে হয়। খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম আমলকীতে ভিটামিন-সি থাকে ৪৬৩ মিলিগ্রাম আর অরবরইয়ে আছে ৪৬৩ মিলিগ্রাম। লেবুতে ৪৭ মাইক্রোগ্রাম, কমলা লেবুতে ৪০ মাইক্রোগ্রাম, বাতাবি লেবুতে ১০৫ মাইক্রোগ্রাম, আমড়ায় ৯২ মাইক্রোগ্রাম, কামরাঙায়-৬১ মাইক্রোগ্রাম, জামে ৬০ মাইক্রোগ্রাম, জলপাইয়ে ৩৯ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-সি বিদ্যমান। ভাতের সঙ্গে একটু লেবুর রসেই ভিটামিন-সি’র চাহিদা পূরণ হতে পারে। অন্যগুলো সামান্য একটু খেলেই দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ হবে। লৌহ ঘাটতিজনিত রক্তাল্পতার কারণে শিশু, কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, জ্ঞান বিকাশ কমে যায়।
গর্ভকালীন রক্ত স্বল্পতার কারণে প্রসব-উত্তর রক্তক্ষরণের সময় মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ফলের অবদান যথেষ্ট। বিশেষ করে কালো জাম, খেঁজুর, কাঁচকলা, পাকা তেঁতুল, তরমুজ লৌহ ঘাটতি পূরণে সহায়ক। ডায়রিয়া ও পেটের পীড়ায় ডাবের বিশুদ্ধ পানি খুবই উপকারী। এতে আছে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও ফসফরাসের মতো পুষ্টিকর উপাদান। ঘন ঘন পাতলা পায়খানা ও বমির ফলে দেহে যে পানির অভাব হয় সে ক্ষেত্রে গ্লুকোজ স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে ডাবের পানি অতুলনীয়। দৈনিক ডাবের পানি ডায়াবেটিস রোগীর জন্যও হিতকর।
 
ভিটামিন-বি২ এর অভাবে মুখের কোণে ও ঠোঁটে ঘা হয়, ত্বকের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়। এছাড়া নাকের দুইপাশে চর্মরোগ হয়। এসবের অভাব পূরণে ফল চমৎকার কাজ করে। কাঁঠাল, লটকন, ডেউয়া, আতা, শরীফা ও অন্যান্য ফল ভিটামিন-বি২ এর অভাব পূরণে সহায়ক। এসব ফল বেশি বেশি খাওয়া দরকার।

দৈনন্দিন ফল প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা ও করণীয়
বাংলাদেশে প্রায় ১৩০ রকম ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার মধ্যে প্রায় ৭০ রকম প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের ভাণ্ডার রয়েছে। এসব ফল সারা বছর সমান হারে পাওয়া যায় না। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ-এ ৪ মাসে ৫৪% ফলের প্রাচুর্য দেখা যায়। বাকি ৮ মাসে পাওয়া যায় মাত্র ৪৬% ফল। আবার জ্যৈষ্ঠে অর্থাৎ মধুমাসে ১৪% ও আষাঢ় মাসে ১৭% ফল উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ মোট উৎপাদনের ৩১% ফল পাওয়া যায় এ দুইমাসে। তাই বছরের বেশিরভাগ সময়ই আমরা দেশি ফল খেতে পাই না।

এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো প্রতি নজর দিতে পারি :
১. ভর মৌসুমে আম, লিচু, পেয়ারা, আনারস পচে বিনষ্ট হয়। আমের জুস, আমসত্ত্ব, মোরব্বা, চাটনি তৈরি করে সংরক্ষণ করা যায়। আনারস টিনজাত করে রাখা যায়। পেয়ারার জ্যাম, জেলি, আমড়ার জেলি, তালের জ্যাম, জামের স্কোয়াশ, কুল থেকে আচার, চাটনি, পেঁপের জুস তৈরি করে সংরক্ষণ করলে পরবর্তীতে অমৌসুমে খাওয়া যায়।
২. সারা বছর যাতে আম, লিচু, কাঁঠাল, কুল, আনারস ও অন্যান্য ফল পাওয়া যায় সেজন্য বারোমাসি জাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা জোরদার করা দরকার।
৩. এরই মধ্যে বারোমাসি আমড়া, বারোমাসী কামরাঙার প্রচলন হয়েছে। এগুলোর চাষাবাদ সম্প্রসারণ করা দরকার।
৪. কলা, পেঁপে, নারিকেল সারা বছরই জন্মে। তাই এগুলোর আবাদ ব্যাপক সম্প্রসারণ করা দরকার।
৫. আজকাল বসতবাড়িতেও বনজ গাছ দেখা যায়। বনজ গাছ দ্রুত বর্ধনশীল। এগুলো ফলগাছের ওপর ছায়া  বিস্তার করে যা ফল গাছের জন্য যম স্বরূপ। এতে ফলের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এ অবস্থায় গ্রাম বাংলার প্রতিটি বসতবাড়িতে শুধু ফল চাষ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাহলে ফল গাছ থেকে আমরা পাবো খাদ্য, পুষ্টি, অর্থ ও সুন্দর পরিবেশ। এভাবে গড়ে উঠুক সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
 
মু. ফজলুল হক রিকাবদার*
* প্রাক্তন পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
বিস্তারিত
বিলুপ্তপ্রায় ফল গবেষণা সংরক্ষণ..

যেসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন চোখে পড়ে না; দেশের সব এলাকায় জন্মে না; গাছের দেখা মেলে খুব অল্প; চাহিদা কম, প্রাপ্যতা কম, এদের অনেকে বনে বাদাড়ে নিতান্ত অনাদরে অবহেলায়  বেড়ে ওঠে; প্রগতির ধারায় কেউ এদের পরিকল্পনায় আনে না; চাষাবাদ দূরে থাক প্রয়োজনীয় খাবার কিংবা পানিও অনেকের ভাগ্যে জোটে না; কোনো কোনোটার ঔষধিগুণ ও মানুষের জন্য উপকারী নিয়ামক, ধাতব ও অন্যান্য প্রাণরাসায়নিক দ্রব্যদিতে সমৃদ্ধ হলেও মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করতে পারছে না; অতীতে ফলের সংখ্যা আরও বেশি ছিল। নানা কারণে এবং আমাদের অসচেতনতায় সেসব ফলের অনেকই দেশ থেকে বিল্প্তু হয়ে যাচ্ছে। এরা দিন দিন বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে; এমন  ফলকে বিলুপ্তপ্রায় ফল বলা হয়। যেমন- টাকিটুকি, পানকি, চুনকি, লুকলুকি, উড়িআম, বৈঁচি, চামফল, নোয়াল, রক্তগোটা, মাখনা, আমঝুম, মুড়মুড়ি, তিনকরা, সাতকরা, তৈকর, আদা জামির, ডেফল, কাউফল, বনলেবু, চালতা ইত্যাদি।

কিছু কিছু ফল আছে যেগুলোর স্বাদ অনেকের কাছে ভালো লাগে আবার অনেকের কাছে ভালো লাগে না যেমন- ডেওয়া। কলা বা আমের মতো সর্বজনীন আবেদন নিয়ে টেবিলে আসতে পারছে না বলে এরা অচ্ছুত হয়ে পড়েছে। তাই এরা বিলুপ্তির পথে আগাচ্ছে।
 
ওয়ার্ল্ড কনজার্ভেশন ইউনিয়েনের মতে, পৃথিবীতে প্রায় ৮০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন প্রায়। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর বনভূমি বিলিন হচ্ছে। চলতি সময়ে গবেষকরা বলছেন, প্রায় ২২ থেকে ৪৭ শতাংশ উদ্ভিদ প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। সম্ভবত  এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ঘটছে। এসব গাছ খরা, ঘূর্র্ণিঝড় ও তাপমাত্রায় প্রতি খুবই সংবেদনশীল, সুতরাং বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদগুলোকে যত্ন নিয়ে সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো- বৈরী জলবায়ু (সামঞ্জস্যহীন আবহাওয়া, মাটির পিএইচের পরিবর্তন, ভারি ধাতব পদার্থের চাপ, খরা, লবণাক্ততা, অতিরিক্ত তাপমাত্রা) এবং মানুষ্যজনিত কার্যকলাপ (নিজের স্বার্থে ভূমির অতিরিক্ত ব্যবহার, আবাসভূমি ধ্বংস, নগরায়ন বৃদ্ধি, শিল্পায়ন বৃদ্ধি, কৌলিতাত্ত্বিক ক্ষয়, প্রাকৃতিকভাবে ভূমির ক্ষয়, উচ্চতা হ্রাস, বায়ু দূষণ, জীবনযাপনের পরিবর্তন, আধুনিকায়ন ও ভূমির যথাযথ ব্যবহারে পরিবর্তন ইত্যাদি)।
 
বাংলাদেশে বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এসব ফলকে আমরা  অনেকেই চিনি না, যেমন- লুকলুকি, ডেওয়া, ডেফল, কড়মচা, জঙ্গি বাদাম, কাঠ বাদাম, কাজু বাদাম, গোলাপ জাম, পানি জাম, কালো জাম, তুঁত, তিনকরা, অবরবই, সাতকরা, আদা জামির, কাটালেবু, শাঁসনিলেবু, গ্রেপফ্রুট, তাবা, ত্রিপত্রিকলেবু, জামির, স্টার আপেল,  মনফল, আঁশফল, তারকা ফল, দেশি গাব, বিলাতি গাব, আতা, শরিফা, কাউফল, তৈকর, গুটি জাম, খেজুর, জাম, জামরুল, আমলকী, চেস্টনাট, তরমুজ লালিম, টক লেবু, চালতা, ডুমুর, বৈঁচি, টক আতা, তেঁতুল, পানি ফল, সিঙ্গাড়া ফল, দেশি আমড়া, বন্য ডুমুর, বাঙি, চাপালিশ, জিলাপি ফল, পদ্মফল, মাখনা, রুটি ফল, বকুল, ফলসা, ট্যাংফল, চুকুর, রাম কলা, কেন ফল, চিনার, রক্ত গোটা, চিকান, পানকি, চুনকি, টুকটুকি বা টাকিটাকি, আমরুল, পেয়ালাগোটা, চিনাডুলি, লতা ডুমুর, বুদুমচোরা, টমিটমি, কোয়াগোলা, গুটগুটি, বিলিম্বি, কেক ফল, অমৃত ফল, চাউর, আলুবোখারা, চেরি, লকুয়াট, খিরনী, বকুল, ফলসা, বহেড়া, হরীতকী, মহুয়া, পানিফল, মাখনা, পদ্ম ফল ইত্যাদি অন্যতম । এ ফলগুলোর অধিকাংশই এখন বিপন্ন। বসতবাড়িতে দু-একটি গাছ রয়েছে, বনে জঙ্গলেও কিছু আছে। অথচ পুষ্টিগুণ এবং ভেষজ মূল্য একেক ফলে  একেক রকম। অথচ এক রকম অবহেলা করেই আমরা আমাদের এসব ফলকে হারাতে বসেছি। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে, এখনও অল্প স্বল্প হলেও এর অনেক ফলই দেশের মাটিতে টিকে আছে।
 
একদিকে প্রধান ফলের চাষ ও উৎপাদন বাড়াতে হবে এ কথা যেমন সত্য তেমনি আমাদের বৈচিত্র্যময় ফলের ভাণ্ডারকেও ধরে রাখতে হবে। এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে, আজকের একটি বিলুপ্ত প্রায় ফল আবার আগামী দিনের প্রধান  ফল হিসেবে গণ্য হয়ে উঠতে পারে। অনেক স্বল্প পরিচিত অপরিচিত ফলেরও যথেষ্ট বাণিজ্যিক এমনকি রফতানি সম্ভাবনা রয়েছে। সুযোগ রয়েছে জাত উন্নয়নের। লটকন ফলটি এরই মধ্যে ধীরে ধীরে সে জায়গা করে নিচ্ছে। নরসিংদী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ইত্যাদি এলাকায় এখন অনেকেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লটকনের চাষ করে লাখোপতি হয়ে গেছেন। থাইল্যান্ড আঁশফলের মতো অবহেলার এক ফলকে নিয়ে গবেষণা করে এমন রসাল, সুস্বাদু ও অধিক শাঁস বিশিষ্ট জাত উদ্ভাবন করেছে যা রফতানি করে তারা এখন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। থাই লংগানের কথা এখন কে না জানে। টক তেঁতুলকেও তারা মিষ্টি তেঁতুলে পরিণত করে কিছু এলাকায় তার নিবিড় উৎপাদন এলাকা গড়ে তুলেছে থাইল্যান্ড। বহু দেশে রফতানি করছে। ওরা পারে, আমরা পারছি না। অথচ ফল বৈচিত্র্যে আমাদের ঐতিহ্যের অহঙ্কার ওদের চেয়ে কম ছিল না। তাই আমরাও যদি বিলুপ্ত প্রায় কিছু ফল নিয়ে এ ধরনের গবেষণা করতে পারি তাহলে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরাও তাদের মতো মিষ্টি অড়বরই, ম্যাঙ্গোস্টিন, বড় বড় রসাল শাঁসের আঁশফল, হেযারি লিচু রাম্বুটান, ডুরিয়ান, সালাক, ল্যাংসাট, পার্সিমন ইত্যাদি সৃষ্টি করতে পারবেন।
 
ফল থেকে জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চাটনি এমনকি আস্ত ফল ক্যানিং (টিনে সংরক্ষণ) ব্যবস্থা নেয়া হলে, অসময়ে দীর্ঘ কাল ধরে খাবার-বাজারজাত করার সুবিধা হবে। মৌসুমে ফলের অপচয় রোধ হবে, বেশি দাম পাওয়া (ভ্যালুঅ্যাড) যাবে। আম, আনারসসহ বেশ কিছু ফল প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রির প্রবণাতা বাড়লেও, কাঁঠাল কলার মতো গুরুত্বপূর্ণ ফল দুটি প্রক্রিয়াজাতকরণের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বিপন্ন প্রজাতির ফলগুলোকে সংরক্ষণ করে গবেষণার মাধ্যমে উন্নত জাতে রূপান্তরিত করে প্রক্রিয়াজতের মাধ্যমে  খাবার-বাজারজাত করার দিকে এগোতে হবে। ফল রফতানির সুযোগ আহরণ করা উচিত। প্রয়োজনে রফতানিকারককে সম্ভাব্য সব ধরনের সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিলে উৎপাদক ভালো মূল্য পাবে, ফল উৎপাদন সম্প্রসারণে উৎসাহিত হবে, সর্বোপরি বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সুযোগ বাড়বে। বর্তমানে আনারস (হানিকুইন), আম, পেঁপে, লটকন, লেবু, সাতকড়া, বরই, জলপাই, আমড়া, এসব ফল বিদেশে (যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, জাপান, কানাডা, আরব ইত্যাদি দেশে রফতানি হচ্ছে। তবে কাঁঠাল ও কলার মতো গুরুত্বপূর্ণ ফল দুটি রফতানির তেমন উদ্যোগ নেই। টিন জাত বা জুস করে ফল রফতানির সুযোগ যথেষ্ট রয়েছে।  গবেষকরা মনে করে, বিপন্ন প্রজাতির ফলগুলোর অনেক ফলেরই দেশে এবং বিদেশে  অনেক চাহিদা আছে, শুধু দরকার সংরক্ষণ, গবেষণা, উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ।
 
তবে এখন যেটা জরুরি, সেটা হলো- এসব বিলুপ্তপ্রায় ও বিপন্ন প্রায় প্রজাতির জার্মপ্লাজমকে দেশের মধ্যে টিকিয়ে রাখা। বিলুপ্ত হওয়ার আগেই পদক্ষেপ নেয়া দরকার। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. এম এ রহিমের প্রচেষ্টায় সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের অর্থায়নে ইন্টার কোঅপারেশন-এগ্রো ফরেস্ট্রি ইমপ্রুভমেন্ট পার্টনারশিপের ব্যবস্থাপনায় একটি ফলের জার্মপ্লাজম সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে, গবেষণাও চলছে সেখানে। বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাংলাদেশে কৃষি  বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সেন্টারটির রটি গোড়াপত্তন হয় ১৯৯১ সনে। তখন প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ফ্রুট স্টাডিজ, পরবর্তীকালে এ প্রকল্পের নাম দেয়া হয়, ফল গাছ উন্নয়ন প্রকল্প, এখন এটাকে ফলদ বৃক্ষের ‘জার্মপ্ল­াজম সেন্টার’ বলা হয়। বর্তমানে এ সেন্টারটি বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফলদ বৃক্ষের সংগ্রহশালা।  ১৯৯১ সনে প্রকল্পটি মাত্র এক একর জায়গা নিয়ে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে কর্মমুখর হয়ে ওঠে, যার ফলাফল ক্রমেই ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কৃষির উন্নয়নে গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণের বিকাশের অগ্রযাত্রায় বিগত ২৮/৭/২০০৭  অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ২৭৮তম অধিবেশনে গৃহীত ৩০নং সিদ্ধান্ত মূলে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির নানা ধরনের ফলের জাত সংগ্রহ, সংরক্ষণ, মূল্যায়ন বৈশিষ্ট্যায়ন, নিশ্চিতকরণ, বংশ বৃদ্ধিকরণ ও সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে ‘বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার’ নামে একটি সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়।  এ সেন্টারটি ৩২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে এ সেন্টারে ১৮১ প্রজাতির ১১৮৫ জাতের ১০,২৭৩টি মাতৃগাছ আছে। প্রধানত চার ধরনের ফল নিয়ে এ সেন্টারটি তার মূল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন- ১. দেশি প্রধান ফল ২. দেশি অপ্রধান ফল (বিলুপ্তপ্রায় ফলগুলো)   ৩. বিদেশি ফল এবং ৪. ঔষধি ফল গাছ।  বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টারের মাধ্যমে উন্নত জাত ও লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন এ দেশের সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক পরিবর্তন ও পুষ্টির অভাব দূরীকরণে একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টারে  প্যাসন ফল, জাবাটিকাবা, শানতোল, রাম্বুটান, লংগান, ম্যাঙ্গোস্টিন, সিডলেস লিচু, ডুরিয়ান, অ্যাভোকেডো ইত্যাদি ফল বা ফলের গাছ নিয়ে গবেষণা করছেন ভবিষ্যতে নতুন জাত হিসেবে এ দেশে মুক্তি দিতে।
 
উপরোল্লিখিত বিলুপ্ত-বিপন্ন প্রায় সব ফলগুলো বাউ-জামপ্লাজম সেন্টার বন, জঙ্গল, পাহাড়, বসতভিটাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সন্ধানের মাধ্যমে সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে এবং এর ওপর নিবিড় গবেষণা  চালিয়ে যাচ্ছে। এটি আশার কথা। সরকারও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব ফলকে জনপ্রিয় ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর জাতীয় পর্যায়ে ফল প্রদর্শনীর আয়োজন করছেন। দেশের প্রতিটি বাড়িতে এ বৃক্ষ রোপণ মৌসুমে বিলুপ্ত প্রায় ফলের অন্তত একটি চারা রোপণ করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তা হলে হয়তো খুব অল্প সময়েই জেগে উঠতে পারে হারানো ফলের হারানো রাজ্য, বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে অনেক ফল প্রজাতি। তবে তার আগে যেটা দরকার সেটা হল বিলুপ্ত প্রায় ফলগুলো চিহ্নিত করা এবং এগুলোর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করা, যেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পথে সেগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করা। আর যেগুলো অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে আছে তাদের উপরে তোলার পথ খোঁজা।
 
এসব বিলুপ্ত-বিপন্ন প্রায় ফলকে অন্যন্যা বাণিজ্যিক ফলের মতো সঠিকভাবে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা মাফিক চাষ করতে পারলে এসব ফল বিদেশে রফতানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আসতে পারে। এজন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে-
 
অপ্রচলিত ফলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, মূল্যায়ন ও সমপ্রসারণ করা।
প্রচলিত চাষ ব্যবস্থা পরিবর্তন করে পরিকল্পনা মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্দিষ্ট ফলের জন্য নির্দিষ্ট উৎপাদন এলাকা গড়ে তুলতে হবে। যেমন- বরিশালে আমড়া, সাতক্ষীরায় ক্ষীরনী, সিলেটে লেবু, বাগেরহাটে কাউফল ইত্যাদি। সেসব অঞ্চলেই এসব ফলভিত্তিক শিল্প কারখানা ও প্রক্রিয়াজতকরণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। বিদ্যমান শিল্পকারখানাগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে।
অপ্রচলিত ফলের প্রতি গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
আধুনিক প্রযুক্তিতে ফল চাষের ওপর জোর দিতে হবে। এজন্য জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা ও প্রযুক্তি, তথ্য সম্প্রসারণে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে।
গতানুগতিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার বদলে বাজারমুখী উৎপাদনের দিকে জোড় দিতে হবে।
ফলের সুষ্ঠু প্রক্রিয়াজাতকরণ, গেডিং, প্যাকিং ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
উপযুক্ত বিপণন কাঠামো ও নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিপমেন্ট, ওয়্যারহাউস, বিদেশে বাজার খোঁজ ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।
দেশেই এ ফলের অধিক মূল্য সংযোজনের জন্য ফলভিত্তিক শিল্প কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত করতে হবে।
এ ফলের মানসম্মত চারা-কলম তৈরির জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য বাজারের সাথে তাল রেখে সঠিক প্রজাতি ও জাত নির্বাচন, মাতৃগাছ নির্বাচন, বর্ধন ও সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে।
উপযুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা গঠন ও আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি করতে হবে।
ফল উৎপাদনে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন ‘ভূমি সংস্কার নীতি’ ‘কৃষি নীতি’ মৃত্তিকা স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
উন্নত ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি উৎপাদনে ঝুঁকি বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ মৌসুমে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, রোগবালাই, বন্যা ইত্যাদির ফলে কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা হতে পারে। তাই উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। ঝুঁকি কমানো জন্য বীমা প্রচলন করতে হবে। ঝুঁকি বিবেচনা করে জাত নির্বাচন, করতে হবে।
প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিকল্পিতভাবে অধিক পরিমাণ জমি সেচের আওতায় আনতে হবে। পানি সেচের উৎসে পানি ধরে রাখার প্রয়োজনীয ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন অনুসারে সেচ প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে।
উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি প্রভৃতি বাজারে সহজলভ্য হতে হবে। এছাড়াও কৃষকরা যাতে কৃষি উপকরণাদি ন্যায্য মূল্যে পেতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
টিস্যু কালচারের মাধ্যেমে বিপন্ন প্রজাতিকে ধরে রাখা সম্ভব। এজন্য এ পদ্ধিতির সম্প্রসারণ হওয়া উচিত।
বৈরী আবহাওয়ায় যেসব প্রজাতি যেসব এলাকায় জন্মানো কঠিন ওইসব এলাকায় টিস্যু কালচার ও ক্রাইয়োপ্রিজারভেশনের মাধ্যমে ওই প্রজাতিকে সংরক্ষণ করে গবেষণার মাধ্যমে অনুপোযোগী এলাকার জাত উদ্ভাবন সম্ভব।
এতে কৌলিতাত্ত্বিক ক্ষয় রোধে সহায়ক হবে। বায়োডাইভার্সিটি নিয়ন্ত্রণে আসবে। পুষ্টিমান সম্পন্ন জাত উদ্ভাবন সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।

পতিত জমির সদ্য ব্যবহার : চাষযোগ্য পতিত ৩.২৩ লাখ হেক্টর জমিসহ পাহাড়ি, সমুদ্র উপকূলবর্তী ২০ লাখ হেক্টর এবং চর এলাকার প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চাষাবাদের আওতায় আনা যায়।
সমবায় সমিতির প্রবর্তন ও চাষিদের অবস্থার উন্নতি সাধন করে আমারা সুফল পেতে পারি। বাংলাদেশে বহুপতিত জমি, খাল-বিল, ডোবা, পাহাড়, চরাঞ্চল, বরেন্দ্র, সমুদ্র উপকূলীয় অধিকাংশ এলাকা এখন অনাবাদি। এগুলো চাষোপযোগী করলে আমারা অধিক পরিমাণে খাদ্য ফলাতে পারি।
খাল কেটে পানি সরবরাহ, পানি নিষ্কাশন, পোকামাকড় ধ্বংস, প্লাবন ও লোনা পানির হাত হতে ফসল রক্ষ করতে পারেলে খাদ্য ঘাটতি বহুল পরিমাণে হ্রাস করা সম্ভব।
গবেষণা-সম্প্রসারণ-কৃষক-বাজার সংযোগ শক্তিশালী করা। মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি।
উদ্ভিাবিত নতুন প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষণ, প্রদর্শনীর ব্যবস্থা ইত্যাদি।

 
প্রফেসর ড. এম এ রহিম*
ড. মো. শামছুল আলম মিঠু**
*পরিচালক, বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার **সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি, ময়মনসিংহ
বিস্তারিত
দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ

বাংলাদেশে দেশীয় ফলের প্রচুর বৈচিত্র্য বিদ্যমান। এদেশে প্রায় ৭০ প্রজাতির ফল জন্মে এবং প্রতিটি প্রজাতিতে আবার প্রচুর ভিন্নতা (variability) রয়েছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের অভাবে কিছু প্রজাতি এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেশে বিদ্যমান এসব মূল্যবান জার্মপ্লাজম থেকেই উন্নতমানের জাত উন্নয়ন সম্ভব। ফলের জাত উন্নয়নের জন্য যেসব পদ্ধতি সচরাচর অবলম্বন করা হয় সেগুলো সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণনা করা হলো-

 
জার্মপ্লাজম সম্পদ এবং তার ব্যবহার
ফল ফসল হচ্ছে অত্যন্ত অসম গ্রুপের গাছ যাতে রয়েছে বৃক্ষ, গুল্ম, আরোহী এবং বহুবর্ষজীবী লতা। এসব ফল বিভিন্ন জলবায়ু যেমন- উষ্ণ ও অবউষ্ণম-লীয় এবং সুমদ্রপৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন উচ্চতায় জন্মাতে পারে। অন্যদিকে ফল ফসল তাদের উৎস, নামকরণ এবং প্রজনন পদ্ধতি ভেদে বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে।
 
ফল গাছের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দীর্ঘ জীবন চক্র। অধিকাংশ ফলই একে অপর থেকে উচ্চ মাত্রায় ভিন্নতর (heterogenous) এবং এ কারণে অযৌন উপায়ে বংশ বিস্তারের মাধ্যমে এদের চাষাবাদ করা হয়। বর্তমান তথ্য অনুসারে জানা যায় যে, প্রাচীন রোমান সাম্রজ্যে এবং গ্রিসে ফলের চাষ তুলনামূলকভাবে অধিক আধুনিক ছিল। অপরদিকে, প্রধান ফলসমূহের চাষাবাদের ইতিহাস অত্যন্ত সমসাময়িক। এরই মধ্যে নতুন কিছু ফলেরও চাষাবাদ আমাদের দেশে শুরু হয়েছে যেমন- ড্রাগন ফল, স্ট্রবেরি ইত্যাদি।
 
প্রকৃতিতে বেশ কিছু বহুবর্ষজীবী ফলের প্রজাতি রয়েছে যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে খাওয়া হয়ে থাকে যেমন- লুকলুকি, বৈচী, কাউয়া, করমচা, কদবেল, আমলকী, অড়বরই ইত্যাদি।
 
এখন পর্যন্ত যে পর্যাপ্ত তথ্য (literature) রয়েছে তা বাণিজ্যিক ফলের উন্নয়নে (improvement) এর অতি প্রাচীন (primitive) জাত এবং অন্য প্রজাতিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ করে।
 
চাষযোগ্য ফলগুলোর প্রকৃত উৎস
বিশ্বের উষ্ণম-লীয় অঞ্চল থেকে অধিকাংশ উষ্ণ ও অব-উষ্ণম-লীয় ফলগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। লেবু জাতীয় ফলের (Citrus) গণের (genus) বেশ কিছু প্রজাতি (species) যেগুলো, লেবু জাতীয় ফলকে বাণিজ্যিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, তাদের অধিকাংশেরই আদি উৎপত্তি হচ্ছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া (Swingle and Reece, ১৯৬৭)
 
দেশি ফলের জার্মপ্লাজম খোঁজ করা ও সংগ্রহ করা
আমাদের প্রধান খাদ্য শস্যের তুলনায় ফল ফসলের কৌলিসম্পদের ভিন্নতা নিরূপণ ও উন্নয়নের জন্য খুবই কম গবেষণা করা হয়েছে। সৃষ্টির পরে মানুষ যখন ফলের ব্যবহার সম্পর্কে কিছু জানতো না তখনও অনেক জার্মপ্লাজম পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। প্রচুর জার্মপ্লাজম সংগ্রহের পরও অনেক সময় বিজ্ঞানীরা বিশেষ করে প্রজননবিদরা যখন তাদের কাক্ষিত বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান না তখন অনেক জার্মপ্লাজম ব্রিডার কর্তৃক হারিয়ে যায়।
 
দেশীয় ফলের শুধু ভালো গুণাবলি দেখে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করলেই চলবে না, দৈবচয়নের (randomly) মাধ্যমেও কোনো কোনো সময় জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করতে হবে। যেহেতু ফল অত্যন্ত বিষম প্রকৃতির (heterogygous) তাই এতে প্রচ্ছন্ন (recessive) জিন থাকে যা পরবর্তীতে সংকরায়নের ফলে কোন না কোন সময় প্রকাশ পেতে পারে। যেহেতু এ প্রক্রিয়ায় অনেক বেশি সময় লাগে তাই দ্রুত জার্মপ্লাজম সংগ্রহ ও মূল্যায়নের জন্য পক্ষপাতমূলক নির্বাচন (biased) পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় বীজ বা অযৌন উভয় পদ্ধতিতেই জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করা যেতে পারে। দেশীয় ফলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহের জন্য অযৌন উপায়ে বংশবিস্তার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, কারণ এতে মাতৃ গুণাগুণ বজায় থাকে।
 
ফলের কৌলিসম্পদ সংরক্ষণ
ঐতিহ্যগতভাবে (Traditionally) সারা বিশ্বে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে যেসব ফল গাছ সংগ্রহ করে থাকে সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে। এ সংগ্রহগুলো সচরাচর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় বাণিজ্যিক জাত হিসেবে মুক্তায়নের লক্ষ্যে যথাযথভাবে পরীক্ষা করার জন্য অথবা সংকরায়ন কর্মসূচিতে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।
অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কোনো জার্মপ্লাজমের এর মূল্য সমসাময়িকভাবে হয়ত ততটা প্রশংসনীয় নয় তাই কোনো কোনো সময় ওই সব জার্মপ্লাজমকে কেটে ফেলা হয়। এ প্রক্রিয়া এখনও চলমান আছে যার অন্যতম কারণ হচ্ছে স্থান ও অর্থায়ন সমস্যা। বর্তমানে ফলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ বলতে প্রধানত যেসব প্রজাতির চাষ হচ্ছে সেগুলোকে সংগ্রহ করা বুঝায়। এক্ষেত্রে প্রচলিত প্রজাতিগুলোর পাশাপাশি অতি প্রাচীন প্রজাতিগুলোও সুষ্ঠুভাবে রক্ষা করা দরকার। এছাড়া আলাদাভাবে প্রতিটি জেনোটাইপ সংরক্ষণের চেয়ে জিন পুল সংরক্ষণ করা উত্তম। দেশীয় ফলের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য আমাদের বর্তমানে যেসব জার্মপ্লাজমের বৈচিত্র্য রয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে সংরক্ষণ করা দরকার। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন- পোকা ও রোগবালাই প্রতিরোধী, বন্যা, খরা এবং লবণাক্ততা প্রতিরোধী ফলের জাত উন্নয়নে আমাদের দেশে চাষ হচ্ছে এমন ফলগুলো বন্য প্রজাতিগুলো যাতে প্রচুর কৌলিতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য রয়েছে, সেগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে।
 
জার্মপ্লাজম ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ
ফলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, চাষ ও ব্যবস্থাপনা মানুষকে ১০০০ বছর আগের অনিশ্চিত কৃষি থেকে আজকের সময়ের জন্য উপযুক্ত একটি আধুনিক কৃষি ও সভ্যতায় রূপান্তরিত হতে সমর্থ করেছে। দেশীয় ফলের ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ আমাদের দেশে এখনও ততটা পরিকল্পিত নয়। কিছু কিছু দেশীয় মূল্যবান জার্মপ্লাজম প্রায় বিলুপ্তির পথে, সেগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ এসব জার্মপ্লাজমের সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতে উন্নত ফলের জাত মুক্তায়ন করা সম্ভব হবে এবং দেশীয়ভাবেই আমাদের ফলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বর্তমানে দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড় ও বিএআরআই, গাজীপুর এ দুটি ফলের জার্মপ্লাজম রিপোজিটোরি প্রতিষ্ঠা করেছে। এগুলোতে বিভিন্ন প্রকার ফলের গুরুত্বপূর্ণ জার্মপ্লাজম সংরক্ষিত আছে। এ রিপোজিটোরিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ফলের জাতগুলো আছে। ফল উন্নয়নের অন্যতম একটি উপায় হলো প্রজনন।
 
প্রজনন (breeding)
পরাগরেণু এবং বীজ ব্যবস্থাপনা
ফলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (critical) কার্যক্রমগুলো হচ্ছে পরাগরেণু নির্বাচন, প্রস্তুতকরণ এবং পরাগরেণু (pollen) ও বীজের সংরক্ষণ। ফলের প্রজনন কার্যক্রমের সফলতার জন্য বীজের দ্রুত ও সুষম অংকুরোদগম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
 
পরাগধানী থেকে পরাগরেণু বের হওয়া বিভিন্ন ফলের পরিবারে বিভিন্ন রকম। তাই সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে পরাগরেণু সংগ্রহ করতে হবে এবং পরবর্তীতে পূর্ব থেকে প্রস্তুত করে রাখা (ফুল ফোটার পূর্বে অর্থাৎ পরাগধানী (anther) ফেটে যাওয়ার (dehiscence) আগেই অপসারণ করতে হবে) স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে পরাগরেণু স্থাপন করতে হবে এবং ব্যাগ দিয়ে পুষ্পমঞ্জুরিটিকে ঢেকে দিতে হবে। পরবর্তীতে ফল ধারণ হয়ে গেলে ব্যাগটি খুলে দিতে হবে।
 
স্বাভাবিকভাবে, প্রজনন এর জন্য পরাগায়নকৃত মা গাছ থেকে সংগৃহীত সম্পূর্ণ অথবা অতিরিক্ত পাকা ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে যথাযথভাবে আলাদা আলাদা পাত্রে স্থাপন করতে হবে এবং নিবিড়ভাবে যত্ন করতে হবে।
 
সংকরায়ন (hybridization)
ফলের দুটি মাতৃ গাছের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে উৎপন্ন স্বাতন্ত্র উদ্ভিদগোষ্ঠীর চারা থেকে ফলের উন্নয়নের তথা ভালো জাত উন্নয়নের জন্য উন্নতমানের ফল গাছ পাওয়া যেতে পারে, যা ভবিষ্যতে ফলের উচ্চফলনশীল, উন্নত গুণগতমানসম্পন্ন, রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী এবং প্রতিকূল পরিবেশে (বন্যা, খরা এবং লবণাক্ততা) খাপ খাওয়ানো উপযোগী জাত হিসেবে মুক্তায়ন করা সম্ভব হবে। সংকরায়নের সাফল্য ফলের ফ্লোরাল বায়োলজি, সংশ্লিষ্ট ফল সম্পর্কে সম্যক ধারণা, আবহাওয়াগত কারণ (যেমন- তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, সূর্যকিরণের তীব্রতা, বাতাস), মৃত্তিকাজনিত কারণ (ভূমির ধরন, মাটির প্রকৃতি ইত্যাদি), রোগবালাই, পোকামাকড় ইত্যাদির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সংকরায়নের মাধ্যমে ফলের গুণগতমান বা অন্যান্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য পরবর্তী বংশধরে (offspring) স্থানান্তর করা হয়। এক্ষেত্রে যেসব গুণাবলি পরবর্তী প্রজন্মে (offspring) স্থানান্তর করতে হবে সেসব গুণাবলিসম্পন্ন মাতৃগাছ নির্বাচন করতে হবে।
 
মিউটেশন ব্রিডিং
কোন জেনেটিক মেটেরিয়াল এ হঠাৎ এবং বংশানুক্রমিক স্থানান্তরযোগ্য পরিবর্তন ঘটানোর জন্য মিউটেশন হলো অন্যতম মূল ভিত্তি। ফলের প্রজননবিদরা (breeders) প্রধানত জিন ও ক্রোমোসোম মিউটেশন বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু ফল গাছে জিনোম ও সাইটোপ্লাজমিক মিউটেশন ও ঘটে থাকে। কোনো একটি প্লান্ট পপুলেশনে মিউটেশনের মাধ্যমে বৈচিত্র্য-বিভিন্নতা (variation) সৃষ্টি করা হয় যা নির্বাচনের একটি অন্যতম ভিত্তি। কিছু কিছু ফলে প্রচলিত (conventional) প্রজনন প্রক্রিয়া প্রযোজ্য নয়। এছাড়া যেসব ফল গাছ বন্ধ্যা ফল তথা জাইগোটিক ভ্রƒণসহ বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম নয় সেসব ফলের জাত উন্নয়নের একমাত্র পদ্ধতি হলো মিউটেশন প্রজনন। লেবুজাতীয় ফলের কিছু জাত এ এপোমিক্সিস প্রধানত দেখা যায়।
 
ফলের প্রচলিত প্রজনন পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে মিউটেশন প্রজনন কাজ করতে পারে-
১. প্রকৃতিতে ফলের কোনো প্রজাতির যদি কম বৈচিত্র্য থাকে, ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে জাত উন্নয়নের সুযোগ কম থাকে, তখন বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য;
২. কোনো নতুন বৈশিষ্ট্য যেমন- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কাক্সিক্ষত বৃদ্ধির ধরন অথবা স্ব-অসামঞ্জস্যতা (self-incompatibility) ঘটানোর (induce) জন্য;
৩. অঙ্গজ বংশবিস্তারের মাধ্যমে উৎপন্ন ও সংরক্ষণ করা;
৪. কোনো অপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে স্থাপিত সংযোগ ভেঙে দেয়ার জন্য;
৫. দূরবর্তী সম্পর্কযুক্ত মাতৃগাছ (parent) এর মধ্যে অসামঞ্জস্যতা দূর করার জন্য এবং
৬. হ্যাপলয়েড তৈরি করার জন্য।

অধিকাংশ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যেমন- বৃদ্ধি, ফলন, ফলের আগাম পরিপক্বতা ইত্যাদি একাধিক জিন (polygenic) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এক্ষেত্রে নির্বাচন এর দক্ষতা কার্যকারিতা কম কিন্তু মিউটেশনের কার্যকারিতা (efficiency) বেশি। প্রকৃতিগতভাবে ফল গাছে মিউটেশন ঘটে থাকে এবং এর ফলে ফলের বেশ কিছু বাণিজ্যিক জাত বিশেষত লেবুজাতীয় ফলে সৃষ্টি হয়েছে যা পূর্ববর্তী জাতকে সম্পূর্ণভাবে স্থানান্তরিত করেছে। এটি ফলের উন্নয়নে মিউটেশন ব্রিডিংয়ের গুরুত্বকে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাই মিউটেশন পরবর্তীতে ফলের মিউটেন্ট নির্বাচন  ফলের জাত উন্নয়নের একটি শক্তিশালী টুল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
 
নির্বাচন (Selection)
প্রকৃতিতে জন্মানো অতি উত্তম গুণাবলসম্পন্ন চারা চাহিদানুযায়ী বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সংগ্রহ করে জন্মানো সেগুলোকে যথাযথভাবে বৈশিষ্ট্যিকীকরণ এবং মূল্যায়নের মাধ্যমে নির্বাচিত জার্মপ্লাজমকে জাত হিসেবে মুক্তায়নই হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে জাত উদ্ভাবনের জন্য উত্তম প্রজনন স্টক অপরিহার্য।
 
১. প্রকৃতিতে যেসব অতি উত্তম গুণাবলি সম্পন্ন চারা দেখতে পাওয়া যায় (phenotype) সেগুলো নির্বাচন করা।
২. সবচেয়ে ভালো নির্বাচিত জার্মপ্লাজম-জাতসমূহের অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করা।
৩. নির্বাচিত জাতগুলোর আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি যা তাদের ফলন ও অন্যান্য গুণাবলি বৃদ্ধি করবে তার উদ্ভাবন তথা উন্নয়ন করা।
৪. সবচেয়ে ভালো নির্বাচনগুলোর মধ্যে সংকরায়ন করা এবং পুনরায় উত্তম প্রজন্মকে জাত হিসেবে ব্যবহারের জন্য নির্বাচন করা এবং পরে মাতৃ (parent) গাছ হিসেবে ব্যবহার করা এবং এ প্রক্রিয়া পুনঃপুনঃঅনুসরণ করা।
 
ফলের প্রজনন স্টকের (বিভিন্ন ক্রস থেকে পাওয়া পরিবারগুলো) পরিমাণগত জেনেটিক্স থেকে জানা যায় যে, ফলের উন্নয়নের জন্য এতে প্রচুর জেনেটিক পটেনশিয়াল রয়েছে এবং এক্ষেত্রে নির্বাচন হচ্ছে ফলের জাত উন্নয়নের জন্য একটি সবচেয়ে দক্ষ পদ্ধতি। অনেক প্রাচীন দেশীয় ফলের জাত রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী জিন বহন করে। সেসব জিনকে প্রচলিত প্রজনন প্রক্রিয়ায় সংবেদনশীল জাতে স্থানান্তর করে ফলের রোগ পোকামাকড় প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা যেতে পারে।
 
বালাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট অদ্যাবধি বিভিন্ন দেশীয় ফল যেমন- আম-১০টি, কাঁঠাল-৪টি, কলা-৪টি, পেঁপে-১টি, লিচু-৫টি, লেবু-৩টি, বাতাবিলেবু-৪টি, মাল্টা-১টি, কমলালেবু-২টি, সাতকরা-১টি, কুল-৪টি, সফেদা-৩টি, নারিকেল-২টি, পেঁপে-১টি, আমড়া-১টি, কদবেল-১টি, কামরাঙা-১টি, লটকন-১টি, জামরুল-২টি, আঁশফল-২টি, আমলকী-১টি, বিলাতিগাব-১টি, তৈকর-১টি এবং জলপাই-১টি সর্বমোট ৫৭টি ফলের জাত উদ্ভাবন করেছে। সংকরায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবিত বারি আম-৪সহ অধিকাংশ জাত বর্তমানে সারাদেশে সমাদৃত হয়েছে।
 
সম্প্রসারণ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বিএডিসি, এনজিও, প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি নার্সারিগুলোর মাধ্যমে উন্নত জাতের গুণগতমানসম্পন্ন কলম-চারা উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষকের জন্য সহজলভ্য করতে হবে।
 
ফলের চাষ সম্প্রসারণ তথা ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফলের আধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কিত প্রযুক্তি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে।
 
গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বিএডিসির মধ্যে সমন্বয় এবং সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এখন পর্যন্ত মোট ৩১টি বিভিন্ন ফলের যে ৭০টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে, সেগুলোর মাতৃবাগান ডিএই এবং বিএডিসির হর্টিকালচার সেন্টারগুলো স্থাপন এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সেখান থেকে প্রতি বছর পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদিত ফলের উন্নত জাতের মান সম্পন্ন কলমের চারা বিক্রয় করবে।  
 
মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের আধুনিক পদ্ধতিতে ফল চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে যা দেশে ফল চাষ সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
 
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নার্সারিম্যান ও কৃষকদের সঠিক ও গুণগতমানসম্পন্ন কলম-চারা উৎপাদন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
 
বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রচুর নার্সারি রয়েছে, যেখানে অধিকাংশেরই ফলের উন্নত জাতের মাতৃবাগানের অভাব রয়েছে। ফলে প্রায়শই কৃষকরা সঠিক জাতের কলম-চারা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। ব্যক্তিমালিকানাধীন নার্সারিতে ফলের উন্নত জাতের মাতৃগাছের বাগান তৈরিতে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে যাতে করে কৃষকরা উন্নত জাতের মানসম্পন্ন কলম-চারা পেতে পারেন।
 
বীজ থেকে উৎপাদিত ফল গাছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাতৃগুণাগুণ বজায় থাকে না, তাছাড়া বীজের গাছ থেকে ফল পেতে প্রাথমিক সময়ও অনেক বেশি লাগে। ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও উন্নত গুণগতমানসম্পন্ন ফল পেতে হলে অঙ্গজ বংশবিস্তার পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা বেশি করে রোপণ করতে হবে। এতে করে সারাদেশে উন্নত গুণগতমানসম্পন্ন ফলের চাষ দ্রুত সম্প্রসারিত হবে। কৃষকরা যেন কলমের চারা রোপণ করেন সে বিষয়ে তাদের সচেতন করতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাঠকর্মীদের মাধ্যমে এ কাজটি দ্রুততম সময়ে সুচারুরূপে সম্পন্ন করা যেতে পারে।
 
বাংলাদেশে পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর পতিত জমি রয়েছে যেখানে অনায়াসেই উন্নত জাতের ফল আবাদের মাধ্যমে এর সম্প্রসারণ করা সম্ভব। একক জমিতে দানাজাতীয় ফসলের চেয়ে ফলের ফলন বেশি এবং ফল চাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় বাংলাদেশের অনেক এলাকায় কৃষকরা তাদের দানাজাতীয় ফসলের জমিতে নতুন নতুন ফলের বাগান গড়ে তুলছেন, যা বাংলাদেশে ফলের আবাদকে সম্প্রসারিত করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট চাষযোগ্য জমির মাত্র ১.৬৬ শতাংশ জমিতে ফল চাষ করা হয়ে থাকে। সম্প্রসারণ কার্যক্রম দ্বারা ফল চাষের আওতাধীন এ জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়াও, বসতবাড়ি, পুকুরপাড়, রাস্তার ধার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চত্বর, অফিস এলাকা ইত্যাদি জায়গায় পতিত জমিতে  অনায়াসে ফল চাষ করা সম্ভব।
 
শহরাঞ্চলের বসতবাড়ি ও ছাদে ফল চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। বনায়নের ক্ষেত্রে, শুধু কাঠ উৎপাদনশীল গাছের পরিবর্তে ফল ও কাঠ দুটোই পাওয়া যায় এমন ফল গাছ  বেশি করে রোপণ করতে হবে। ফল বাগানের জন্য জমির প্রাপ্যতা কষ্টসাধ্য হওয়ায় একই জমিতে একক ফল চাষের আওতাধীন পরিবর্তে বিভিন্ন ফল ও ফসলের সমন্বিত চাষের মাধ্যমে বছরব্যাপী ফল সংগ্রহ করা সম্ভব। বহুস্তরবিশিষ্ট অর্থাৎ বিভিন্ন উচ্চতার যেমন-নারিকেল বাগানে লেবু, লটকন, লিচু, আনারস ইত্যাদি ফলের মিশ্র বাগানে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারও নিশ্চিত করা সম্ভব।  এছাড়া বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে ফল চাষ সম্প্রসারণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা বিশেষ প্রয়োজন।
 
বছরের মাত্র ৪ মাস সময়ে (মে-আগস্ট) দেশে মোট ফলের ৬১ ভাগ উৎপাদিত হয় কিন্তু অবশিষ্ট ৮ মাস সময়ে  (সেপ্টেম্বর-এপ্রিল) ফলের প্রাপ্যতা খুবই কম থাকে। তাই সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল এ সময়ে জন্মে এমন সব দেশীয় ফলের আবাদে কৃষকদের বেশি করে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এতে করে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বছরব্যাপী ফলের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে। বেশিরভাগ দেশীয় অপ্রচলিত ফল বছরের এমন সময় উৎপাদিত হয় যখন অন্যান্য প্রধান ফলের প্রাপ্যতা খুবই কম থাকে বা থাকে না। তাই অপ্রচলিত ফল সারা বছর পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ফল চাষ সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। অপরদিকে অমৌসুমে জন্মানোর কারণে অপ্রচলিত ফলের বাজার মূল্য বেশি পাওয়া যাবে।
 
ফলের সংগ্রহোত্তর অপচয় (২৫ থেকে ৪০ শতাংশ) রোধ ও সঠিক গুণগতমান বজায় রাখার জন্য লাগসই উন্নতমানের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার মাধ্যমে ফল যথাযথভাবে সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে শস্য সংগ্রহোত্তর ক্ষতি (Postharvest loss) অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে ও ফলের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষকগণ বেশি করে ফল চাষে আগ্রহী হবে।
 
দেশে ১ কোটি ৯৪ লাখ বসতবাড়ির আওতাধীন জমির পরিমাণ ৪.৫ লাখ হেক্টর। বেশি করে ফল বৃক্ষের বাগান তৈরিতে কৃষকদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। বসতবাড়ির পাশাপাশি-বাড়ির আঙিনায় পরিকল্পিতভাবে উন্নত জাতের বিভিন্ন ফল গাছ লাগাতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অধিকন্তু ফলের পুষ্টিগুণ ও অর্থনৈতিক লাভ সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করতে হবে। আমাদের দেশে উৎপাদিত মোট ফলের প্রায় ৫৩ শতাংশ বসতবাড়ি থেকে আসে। পরিকল্পিতভাবে একটি বাড়ি, একটি খামার ব্যবস্থাপনায় ফলদ বৃক্ষ রোপণ করা হলে ফল চাষ সম্প্রসারণের পাশাপশি পুষ্টি সমস্যার সমাধান, বাড়তি আয় এবং মহিলাদের কর্মসংস্থানর সৃষ্টি হবে ।  
 
পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সিলেট, চট্টগ্রাম, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় অনেক পতিত জমি পড়ে আছে যেখানে উপযুক্ত কার্যকর পরিকল্পনার দ্বারা ফল বাগান স্থাপন করে পতিত জমি চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে ফল চাষ সম্প্রসারণ এবং ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
 
 বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ইত্যাদি প্রতিকুল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এমন সব ফসলের সঠিক জাত (যেমন- লবণাক্ত ও খরাযুক্ত এলাকায় কুলের চাষ) নির্বাচন ও রোপণ করতে হবে। এর ফলে ফলের সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ও ফলের চাষ সম্প্রসারিত হবে। অধিকন্তু, ফলের চাষ সম্প্রসারণের জন্য ফলের উদ্ভাবিত উন্নতজাতগুলো ও এদের উৎপাদন কলাকৌশল মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য কৃষকদের মাঠে প্রদর্শনী বাগান স্থাপন, গবেষণা কেন্দ্রে মাঠ দিবসের আয়োজন এবং ফল উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কিত লিফলেট-ফোল্ডার-বুকলেট ফল চাষিদের মাঝে বিতরণের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
 
পরিশেষে বলা যায়, দেশি ফলের উন্নত জাত উদ্ভাবন ও এসব উন্নত গুণগতমানসম্পন্ন জাতের চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টিচাহিদা মিটানোর পাশাপাশি, বাড়তি আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব হবে।
 
ড. মদন গোপাল সাহা*

ড. বাবুল চন্দ্র সরকার**

*মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, **প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর
বিস্তারিত
ফলের সালতামামি
বারো মাসে বারো ফল না খেলে যায় রসাতল। ফল খাওয়া দরকার বোঝা গেল কিন্তু পাব কোথায়? যদিও ফল ভুবনে অনেক আমদানি নির্ভর বাংলাদেশে ১২ মাসে ১২ ফল কেন তার চেয়েও বেশি সংখ্যক ফল আমাদের বাহারি ফলের দোকানে রসে টলমল করে ঝুলছে আর ক্রেতাদের আকর্ষণ করছে বছরের প্রতিটি দিন। ফলের মৌ মৌ গন্ধে মাতোয়ারা করে পথচারীকে। আমরা যদি আমাদের নিজেকে প্রশ্ন করি বিদেশি ফলের বাজার এত চড়া কেন? এত জনপ্রিয় তথা প্রধান বিবেচনা প্রসূত কেন? কোনো সদুত্তর পাওয়া যাবে না। বরং বিজ্ঞাপনের মতো বলতেই হয় এমনিতে এমনিতেই খাই।
সৎ সাহস নিয়ে বলা যায়, আমরা অনেকেই পুষ্টির জন্য ফল খাই না। ধারণাটি এমন সবাই খায় আমরাও মৌসুমে মৌসুমে ফল খাই। কিন্তু প্রশ্ন আসে এদেশে প্রচলিত ও অপ্রচলিত মিলিয়ে যে শতাধিক রকমের ঐতিহ্যবাহী ফল পাওয়া যায় তার কোনোটিই পুষ্টিতে তুষ্টিতে গুণেমানে কম নয়, ফেলে দেয়ার মতো নয়। শুধু দাম দেয় না বলে দাম পায় না। মুরব্বিদের কাছে শোনা যায় আগেকার দিনে এত বেশি ফল পাওয়া যেত যে, খেয়ে শেষ করা যেত না। গাছের নিছে পড়ে পচে থাকত। হ্যাঁ বিশ্বাস করতেই হয়। ফল বেশি মানুষ কম সুতরাং খেতে পারতেন বেশি। আর পুষ্টিসমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী কাক্সিক্ষত পরিমাণ ফল খেয়ে তারা দেহে, চেহারায়, শক্তিতে, সুস্থতায়, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। রোগশোকে কম ভুগতেন। এখন আর সে রকম নয় আমরা সে রকম নই বলে। আমাদের জনপ্রতি দৈনিক ৩৫ থেকে ৪৫ গ্রাম হারে বার্ষিক মোট প্রয়োজন প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ লাখ মেট্রিক টনের মতো। এখনও আমাদের বছরে ফল ঘাটতি ২৫ লাখ মেট্রিক টনের ওপরে।
 
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এম এ রহিম জানান বাংলা বছরের বৈশাখ-শ্রাবণ এ ৪ মাসে আমাদের মোট উৎপাদিত ফলের ৫৬ শতাংশ পাওয়া যায়। আর বছরের বাকি ৮ মাস অর্থাৎ ভাদ্র-চৈত্র মোট ফলের ৪৬ শতাংশ পাওয়া যায়। অর্থাৎ বছরের কিছু সময় অতিপ্রাপ্যতা এবং বেশি সময় প্রাপ্তির স্বল্পতা। কিন্তু এ কথা তো ঠিক যে, বছরের এমন কোনো মাস নেই যে যখন বাজারে কোনো ফল পাওয়া যায় না। কিন্তু একবারে ফলবিহীন কোনো মাস নেই বাংলার বর্ষপঞ্জিতে বা ষড়ঋতুতে। ইচ্ছে করলেই বছরের প্রতিদিন প্রতি বেলায় আমরা ফল খেতে পারি অনায়াসে। বছরের প্রতিটি দিন কিছু না কিছু ফল পাওয়া যাবেই। হয়তো অনাগত ভবিষ্যতে আমাদের ফল বিজ্ঞানীরা এমনভাবে ফলের জাত উদ্ভাবন করবেন যেন বছরের সব সময় সমান হারে মৌসুমভিত্তিক ফল পাওয়া যাবে। তাছাড়া বছরব্যাপী ফলের প্রাপ্যতা, সুষ্ঠু বিতরণ, মাসভিত্তিক উৎপাদন কৌশলসহ সব অন্যান্য কৌশলাদি আবিষ্কার করবেন। কিন্তু চলমান সময়ে আমাদের বহুমুখী দৈন্যতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে বেশি ফল খাওয়া দরকার, যা আছে নিজেদের তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা দরকার। ভাবতেই কষ্ট হয় এখনও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কোনো মেহমান কোথায়ও বেড়াতে গেলে আপেল আঙুর কমলা নিয়ে গেলে যেমন কদর পায় অন্যান্য দেশি ফল নিয়ে গেলে তেমন কদর বা দাম পায়না। জাম, জামরুল, কদবেল, ডেউয়া, ডেওফল, লুকলুকি, আতা, শরিফা, কাউ, ক্ষুদিজাম, কামরাঙা, বিলিম্বি, করমচা, চালতা, গাব, অড়বরই জলপাই এসব নিয়ে কেউ বেড়াতে গেলে ধুয়ো ধ্বনী দিয়ে তাকে অপমান করবে। কবে আমাদের এ হীনমন্যতা দূর হবে। ...বাড়ির পাশে আরশিনগর সেথা পরশি... বসত করে ...আমি একদিন না দেখিলাম তারে...
ফলভিত্তিক কৌশল
জানা মতে, এ যাবত প্রচলিত অপ্রচলিত মিলে শতাধিক ফলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট,  বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিএসএমআরইউসহ অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠান মিলে উদ্ভাবন করেছেন)। যা এ দেশের চাহিদা প্রাপ্তি প্রয়োজনের জন্য নেহায়েত কম নয়। গুণেমানে ভরপুর এসব ফল আবাদ করে উৎপাদন করে খেয়েও আমাদের দৈন্য কেন কমেনি তার কারণ উদ্ঘাটন করা গেল না আজ অবধি। আমাদের ভাবতে হবে এখন পর্যন্ত এদেশের মোট উৎপাদিত ফলের মাত্র ৩০ শতাংশ আসে পরিকল্পিত বাগান থেকে। আর বাকি ৭০ শতাংশ আসে বসতবাড়ির আঙিনায় স্থাপিত অপরিকল্পিত ফলবীথি থেকে। তাহলে একথা স্পষ্ট হয়ে গেল আমরা যদি আসল অর্থে দেশের ফল ভুবনকে সমৃদ্ধ করতে চাই তাহলে বসতবাড়িভিত্তিক ফল বাগানকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা বাণিজ্যিক বাগানভিত্তিক ফল বাগান প্রতিষ্ঠা করা আমাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব না। কিন্তু এমন কোনো বসতবাড়ি নেই যেখানে দু-চারটি ফল-ফলাদির গাছ না আছে। আমরা তো জানি সে কবিতার মতো... আম গাছ জাম গাছ বাঁশ গাছ যেন মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন..। না বাগান স্থাপন করতে দূরত্বের ব্যাপারে গায়ে গায়ে লেগে থাকা গা-ছোঁয়া পদ্ধতি অনুসরণ করলে চলবে না। বরং চাহিদা প্রয়োজনীয়তা হিসাব করে নির্দিষ্ট দূরত্বে ফল গাছের চারা পরিকল্পনা মোতাবেক লাগাতে হবে। আমাদের দেশের ২ কোটি বসতবাড়িতে যদি পরিকল্পিতভাবে ফলের বাগান স্থাপন করতে পারি এবং প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারি তাহলে ভাবতে পারি ফলে সমৃদ্ধ করে এদেশটিকে কোথায়  নিয়ে যেতে পারব আমরা?
 
প্রাসঙ্গিকভাবেই বহুস্তরি ফল বাগানের কথা আসে। বসতবাড়ির জন্য যেমন জায়গা বাঁচাতে বহুতল বিশিষ্ট দালানঘর তৈরি জরুরি তেমনি কম জায়গা থেকে নিবিড় আবাদের ম্যাধমে বেশি লাভবান হতে আমাদের খুব দরকার বহুস্তরি ফল বাগান স্থাপন। কেননা এসব বাগানে একই সাথে হরেক রকমের ফল গাছের বাগান তো করা যায়ই উপরন্তু বিভিন্ন স্তরে অন্যান্য গাছের ফসলের সন্নিবেস করে বেশি উপার্জন আয় করা সম্ভব অনায়াসেই। ড. এম এ রহিমের মতে, তিনস্তরি বাগানে নিচু স্তরে ১ মিটার কম উচ্চতা বিশিষ্ট গাছ যেমন আনারস, শাকসবজি, ঔষধি গাছ, আদা, হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, কচু, রসুন, পেঁয়াজ; ১ থেকে ৩ মিটার উচ্চতায়  কলা, পেঁপে, পেয়ারা,  লেবু, ডালিম, আতা, শরিফা, কুল এসবের আবাদ করা যায়। ১০ থেকে ১২ মিটার উচ্চতায় কলমের আম, জাম, জামরুল, লিচু, সফেদা এবং ২৫ মিটার উঁচুতে আম, কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারি, নিম, শিশু, মেহগনি লাগানো যায়। ফল খেতে হলে ফল পেতে হবে। আর ফল পেতে হলে পরিকল্পিতভাবে ফলের আবাদ বাড়াতে হবে তবেই কেবল আমরা আমাদের চাহিদা অনুসারে ফলের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পারব।

আমাদের বাউকুল, থাইকুল, কচুয়া কুল, নারিকেলি কুল ঢাকা ৯০ জগৎ সেরা। এদের স্বাদ, গুণমান কোনোটা বিশ্ব বাজারের সাথে তুলনীয় নয়। আমরা জানি, এদেশে কুলচাষ করে লিচু চাষ করে, আম চাষ করে বছরে কোটি টাকা আয় করেছেন অনেকে। তাহলে আমাদের দেশের এসব ফল বিদেশি ফলের সাথে কেন তুলনীয় হবে না। এদেশের লিচুর রঙ স্বাদ, গুণ কোনোটি বিশ্বকে চমক দেয়ার মতো নয়? বাংলার লিচুর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো যখন লিচু পেকে বাজারে আসে তখন সারা বিশ্বে অন্যান্য জনপ্রিয় ফলের তেমন প্রাপ্যতা থাকে না। সুতরাং আমরা আমাদের রসালো লিচু দিয়ে ফলের পৃথিবীকে মাতোয়ারা করতে পারব। প্রয়োজন শুধু আমাদের সম্মলিত কার্যকর প্রচেষ্টার।
 
ফলের পুষ্টিভিত্তিক গুরুত্ব
ফলের গুরুত্ব বা ধারণা আমাদের সবার আছে। কিন্তু আমাদের স্বীকার করতেই হবে ফল খাদ্য পুষ্টি ঔষধিগুণসহ আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য আবশ্যকীয়। আমাদের প্রায় সব ফলের স্বাদ, গন্ধ, মান, গুণ, পুষ্টি বিশ্বে যে কোনো ফলের চেয়ে কোনো অংশেই কম না বরং বেশি। তাছাড়া অনেক দেশের ক্রেতারা আমাদের দেশের ফলকে দারুণভাবে পছন্দ করে। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রতিদিন মাথা পিছু কমপক্ষে ১১৫ থেকে ১৩৫ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। অথচ আমরা গড়ে খেতে পারছি মাত্র ৪৫ (প্রয়োজনের ৪১ শতাংশ) গ্রাম। মানে মোট প্রয়োজনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ। তাহলে এখনও অনেক বাকি। পুষ্টি মিটোতেই আরও বেশি ফলের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। একটি বদ্ধমূল ভুল ধারণার কথা বলি, এ যে পুষ্টির জন্য ১৩৫ গ্রাম ফল প্রতিদিন খাওয়া দরকার তা কিন্তু আমাদের আম, জাম, কলা, লেবু, লিচু, ডেউয়া, লটকন, লুকলুকি, লটকন, কাউ এসব দিয়ে নয়। খেতে হলে খান্দানি বিদেশি ফল খেতে হবে। অথচ আমরা বিশ্বাস করতেই পারি না এদেশের এসব ঐতিহ্যবাহী ফলেরও আছে অনেক বহুমাত্রিক গুণ। শুধু অভ্যাস আর আমাদের হীনমানসিকতা এর জন্য দায়ী। ওই যে ... যেসব বঙ্গতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী সেব কাহার জন্ম নির্নয় জানি...
লেবুতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন আছে যা আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানের একটি। কিন্তু ভিটামিন সি স্টক করে জমা রাখার কোনো উপায় নেই কিংবা এমন নয় যে একদিন খেলে ১০ দিন চলে যাবে। প্রতিদিনই খেতে হবে পরিমাণ মতো। সেজন্য যদি কারোর বাড়িতে ২ থেকে ১টি লেবু গাছ থাকে তাহলে যে কোনো সময় মন চাইলেই লেবু খাওয়া যায়। এরকম পেয়ারাসহ অন্যান্য কত শত ফলের নাম উল্লেখ করা যায়। সুতরাং খাদ্য পুষ্টি অর্থ এসবের জন্য হলেও ফল নিয়ে আমাদের খুব ভাবা দরকার। আমাদের অপুষ্টি (৭৫% শিশু), অন্ধত্ব (প্রতি বছর ৩০ হাজার যোগ হয়) ক্যালরি (৭৬% পরিবার) সমস্যা, অসুস্থতা, গলাফুলা (১০ মিলিয়ন লোক আক্রান্ত) রোগ, ভিটামিন সি’র (৯৩% পরিবার) জোগানসহ নানা পুষ্টিহীনতায় ফলের গুরুত্ব সর্বাধিক। আমরা সবাই জানি ফলের মূল্য বেশি, ফলন বেশি, আয় বেশি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ওষুধ শিল্পে অবদান সব ক্ষেত্রে ফলের অবদান গুরুত্ব অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় অনেক বেশি।

ফলের জাত ও উৎস
আমাদের এমনিতেই শতাধিক জাতের ফল আছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে অনেক ফলের জাত আবিষ্কার করে অবমুক্ত করেছেন যা বিদেশি যে কোনো ফলের সাথে শত ভাগ তুলনীয়। তাছাড়া সময়ক্ষণ বুঝে উৎপাদন কৌশলও সহজ সরলভাবে উদ্ভাবন করেছেন। প্রয়োজন শুধু এসব জাতের কার্যকর বিস্তৃৃতি। দেশব্যাপী যখন ফল উৎপাদনকারীরা ও আগ্রহী কৃষকরা এসব প্রতিশ্রুতিশীল জাতের বীজ-কলম পান তাহলে তারা ফল উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধি আনতে পারবেন। গত কয়েক বছর ধরে মাতৃগাছ তৈরি, সম্প্রসারণ, ভালো উৎস খুঁজে জাতের সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলছে। এসব কার্যক্রমের গতি বিস্তৃৃতি কৃষকদের প্রয়োজন আর চাহিদা অনুযায়ী করতে পারলে বাজিমাত করা যাবে ফল উৎপাদনে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছেন। আমাদের প্রয়োজন শুধু তাদের কাজে যথাযথ গতি বাড়ানো এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা।
 
ফল উৎপাদন কৌশল
ফলের সর্বাধিক প্রাপ্তির জন্য পরিকল্পিতভাবে ফলের আবাদ বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত জাত নির্বাচন থেকে চারা তৈরি কলম তৈরি, গর্ত তৈরি, গর্তে প্রাথমিক ও সুষম সারের উপরিপ্রয়োগ, চারা-কলম রোপণ, বেড়া-খাঁচা দিয়ে চারা-কলম রক্ষা, আন্তঃপরিচর্যা, সার প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনা, সেচ প্রদান, অঙ্গ ছাঁটাই, রোগ পোকা ব্যবস্থাপনা, ফল সংগ্রহ এসবের কৌশল পদ্ধতি সহজ সরলভাবেই বিস্তার করার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। কৌশল অবলম্বন করে উৎপাদন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে ফলের দেশ বাংলাদেশকে নতুনভাবে পরিচয় করানো যাবে। প্রেক্ষিতে ফলভিত্তিক সমস্যার মধ্যে মানসম্মত কাক্সিক্ষত আধুনিক জাত, অঞ্চলভিত্তিক জাত, অনিয়মিত ফল ধারণ, মৌসুমভিত্তিক ফলের প্রাপ্যতা বিতরণ, বালাইয়ের আক্রমণ, ফল সংগ্রহ উত্তর অপচয়, কৃষকদের অসচেতনতা, বাজারজাতকরণের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হবে এবং জরুরিভিত্তিতে সুষ্ঠু সমাধান বের করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে।
 
ফল শিল্প
দেশে কত শত শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে প্রতিনিয়ত। সম্ভাবনাবিহীন জনক্ষতিকর কম প্রয়োজনীয় শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অগণিত। অথচ আমাদের অপার সম্ভাবনার ফলের ওপর তেমন কোনো শিল্প কারখানা গড়ে উঠেনি এ বাংলার সীমায়। ফিলিপাইনে শুধু নারিকেলের ওপর কয়েক ডজন কারখানা আছে। নারিকেলের তৈরি অন্তত ডজনেরও বেশি লোভনীয় সুস্বাদু আইটেম দেশে বিদেশে বিকাচ্ছে জনপ্রিয়তার আকর্ষণে। আনারসের মৌসুমে টাঙ্গাইল, সিলেট মৌলভীবাজার, পাহাড়ি অঞ্চলের আনারস চাষিরা পানির দামে আনারস বিক্রি করেন। সে আনারস যখন শহরে আসে ফলের দোকানে স্থান পায় তখন কয়েকগুণ দামে পুষ্ট হয়ে ক্রেতাদের ঘরে আসে। শুধু তাই? হাজার সহস্র টাকার আনারস পচে গলে মাটির সাথে মিশে যায়। একই কথা প্রযোজ্য বরিশালে ও পটিয়ার পেয়ারা, পাহাড়ি লেবু, কাপাসিয়ার ভালুকা জৈনাবাজারের কাঁঠালের ক্ষেত্রেও। ছোট, মাঝারি এবং ক্ষেত্র বিশেষে বড় শিল্পকারখানা গড়ে এসবের নান্দনিক, লাভজনক এবং প্রতিশ্রুতিশীল আয়ের গর্বিত পথের সন্ধান অনায়াসে পাওয়া যায়। জ্যাম জেলি আচার চাটনি কত শত নামের স্বাদের আইটেম তৈরি করে নিজেদেরে খাওয়া চলে দেশীয় বাণিজ্য চলে এবং বিদেশে রফতানি করে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব। এত কম দামে শিল্প উপকরণ এবং শ্রমিক বিশ্বের আর কোথাও নেই। সুতরাং পরিকল্পিকভাবে ভাবলে কাজ করলে অগণিত এবং বহুমুখী লাভ আমাদের আসবেই।
ফল সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাতকরণ
মৌসুমে অধিক প্রাপ্যতার জন্য ফল খেয়ে শেষ করা যায় না। এজন্য ফল নষ্ট হয় অনেক। আমরা ইচ্ছা করলেই অতিরিক্ত এসব ফল ভাণ্ডারকে দারুণভাবে কাজে লাগাতে পারি। আমের আমসত্ত্ব, তালসত্ত্ব, কাঁঠালসত্ত্ব এসব ফল দীর্ঘদিন রেখে খাওয়ার যৌক্তিক প্রক্রিয়া। তাছাড়া আমচুর, ফলি আচার চাটনি জ্যাম জেলি মোরব্বা তেল লবণে ভিনেগারে সংরক্ষণসহ কত রকমের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে তার শেষ নেই। আমাদের ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ বিজ্ঞানীরাও নানাবিদ কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। এখন প্রয়োজন এসবের প্রচার এবং উপযুক্ত প্রসার। খুব জরুরি দরকার সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর কার্যকর আন্তরিকতার সাথে ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের। যথোপযুক্তভাবে আমাদের বাংলার ফলকে উৎপাদন সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিশ্ব ফল বাজার আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারব। ফলশ্রুতিতে ফলভিত্তিক অর্থনৈতিক আয় সমৃদ্ধি অনেক বাড়বে।
 
ফল প্রচারণা
আমরা তো জানি প্রচারেই প্রসার। ফলসমৃদ্ধ দেশ গড়তে সর্বাধিক প্রচার সর্বোতভাবে চালাতে হবে দেশব্যাপী এবং বছরব্যাপী। প্রিন্ট মিডিয়া, বেতার, টেলিভিশন, আইসিটি, মাল্টি মিডিয়াসহ সব প্রচার মাধ্যমে যদি এক সাথে প্রয়োজন মাফিক সময়োপযোগী প্রচার করা যায় তাহলে ফলভিত্তিক প্রচারণা, স্লোগান, প্রতিপাদ্য, অভিযান সফল হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় আঞ্চলিক স্থানীয় ফল মেলা ফল প্রদর্শনী দারুণ সাড়া জাগায়। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, গবেষক, সম্প্রসারণবিদ, অভিজ্ঞ, বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ফলভিত্তিক প্রয়োজনীয় কমিটি ফোরাম সংগঠন গড়ে তাদের সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে হবে। তদারকি মূল্যায়নের মাধ্যমে সময়ে সময়ে কাজের গতি সফলতা পর্যবেক্ষণ করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ফল কৌশল প্রযুক্তি প্রচারণার জন্য বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। কখনো সরাসরি ব্যবহারিক পদ্ধতি গান নাটিকা প্রামাণ্যচিত্রসহ বিনোদনভিত্তিক প্রচারণা বেশি ফলপ্রসূ। সুতরাং যারা প্রচারের সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের  এসব ভেবে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।

ফল বাজার
আমাদের কৃষকরা যা-ই উৎপাদন করেন না কেন তার উপযুক্ত দাম পান না বলে পরবর্তীতে উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এর প্রধান কারণ আমাদের বাজারের অব্যবস্থাপনা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এরই মধ্যে প্রমাণ করেছেন কৃষক নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনা কৃষকদের পণ্য বিক্রিতে লাভ পেতে দারুণভাবে সহায়তা করছে। কৃষি বাজারের সরলিকীকরণ হওয়াতে এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ থাকাতে তারা তাদের বিক্রিমূল্য আগের চেয়ে অনেক বেশি পাচ্ছেন। সুতরাং এ পরিকল্পিত বাজার কৌশল সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে সুষ্ঠুভাবে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা আমাদের কৃষি উৎপাদন উন্নয়কে অনেক বেশি বেগবান ও সমৃদ্ধ করবে। একই সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে কর্তন প্রক্রিয়া, গ্রেডিং, প্যাকেজিংসহ সংশিষ্ট কার্যক্রমে যদি আধুনিক এবং মানসম্মত পদ্ধতি কৌশল বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে আন্তর্জাতিক মানে আমরা ফল বাজারে এগিয়ে যেতে পারবো। এ ব্যাপারে হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। সুতরাং তাদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে তাদের একাজে নেতৃত্বের দায়িত্ব দিতে হবে। তবেই দেশের ফল বাজার আসল অর্থে চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কৃষক তার ন্যায্য মূল্য পাবে দেশ সমৃদ্ধ হবে।
 
শেষ কথা
কৃষি প্রধান এদেশে ফলের বাহারে বাংলার ভুবন মাতোয়ারা। আমরা কাছে আছি বলে আমাদের মন বিবেক চেতনায় তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু ভেবে দেখেছি কি? সুষ্ঠু পরিকল্পনা যথোপযুক্ত বাস্তবায়ন কৌশল এবং প্রাসঙ্গিক কার্যক্রম আমাদের ঐতিহ্যবাহী এসব ফল আমাদের কোন আলোর সন্ধানে নিয়ে যেতে পারে? সেজন্য আমাদের সম্মিলিত পথচলা খুব বেশি প্রয়োজন। রাজশাহীসহ সব উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা প্রমাণ করে দিয়েছেন মাঠ ফসলের জমিতেও কি অনায়াসে ফলবীথি গড়ে তুলে অতিরিক্ত লাভ ঘরে তোলা যায়। ফল গবেষণা জোরদারকরণ, দেশব্যাপী মাতৃগাছ তৈরি ও ব্যবস্থাপনা, মানসম্মত চারা কলম উৎপাদন ও বিতরণ, আধুনিক কৌশল অবলম্বন করে ফল উৎপাদন ও ব্যবস্থাপন, মিশ্র ও বহুস্তরি ফল বাগান প্রতিষ্ঠা, ফলের বাজার ব্যবস্থাপনা, ফল রফতানি, ফলভিত্তিক প্রচারণা, ফলভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠা, মেলা, প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণ, ফল হিমাগার স্থাপন এসব করতে হবে সম্মিলিতভাবে পরিকল্পিতভাবে এবং অবশ্যই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে। তবেই ফলভিত্তিক ফল আসবে অনায়াসে আকাক্সক্ষার সীমানা ছাড়িয়ে। ফলের দেশ গড়তে ফল পরিকল্পনা, ফলের জাত উন্নয়ন উৎপাদন, বিপণন এবং সার্বিক প্রচার প্রচারণা যথোপযুক্তভাবে করতে হবে। তবেই কেবল আমরা গর্ব করতে পারব। এবারের ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ ২০১৫ এর প্রতিপাদ্য দিন বদলের বাংলাদেশ, ফল বৃক্ষে ভরবো দেশ। প্রতিপাদ্যকে সফল করতে হলে বিনয়ের সাথে আহ্বান জানানো যায় আসুন দেশীয় ফলের দেশ গড়ি  হাতে হাত ধরি ধরি।
 

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*

* উপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ subornoml@gmail.com
বিস্তারিত
দেশি ফলের চাষ সম্প্রসারণে নার্সারির ভূমিকা
কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বর্তমানে নার্সারির ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিবেশ সংরক্ষণেও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নার্সারি হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফলদ, বনজ, ফুল ও সবজির চারা কলম উৎপাদন ও বিতরণ করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) আওতায় প্রথম নার্সারির যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে। এর সফলতা দেখে কিছু উদ্যোক্তা এগিয়ে আসলে তাদের এ দফতর থেকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে মাতৃগাছ, সায়ন, বীজ, চারা-কলম ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হয়। মহিলাদেরও এর সাথে সম্পৃক্ত করলে সবাই এ ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করেন। নার্সারি ব্যবসার সফলতার জন্য অনেক নারী-পুরুষকে বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার প্রদান করা হয়। নার্সারি ব্যবসা লাভজনক হওয়ার কারণে দ্রুত এর ব্যপ্তি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এখন বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের নিবন্ধনকৃত নার্সারির সংখ্যা ১৮০০০টির বেশি। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২০০০ কোটি টাকার বেশি। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ এ খাতের সাথে সম্পৃক্ত। নার্সারি করে গ্রামের বহু দরিদ্র মানুষ লাখ লাখ টাকার মালিক হয়েছেন। নার্সারি ব্যবসার সফলতা দেখে কয়েকটি বড় বড় এনজিও এখানে বিনিযোগ করেছে। সরকারি কয়েকটি নার্সারির মতো তারাও উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে চারা-কলম উৎপাদন করছে। বাংলাদেশে সারা বছর কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ কোটি ফলদ, বনদ, ভেষজ, ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছের চারা বিক্রি হয়। ব্যবসাটি দেশের পরিবেশ উন্নয়নেও যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। নার্সারিতে এখন যে শুধু চারা-কলম পাওয়া যায় তাই-ই নয়। এ সংশ্লিষ্ট কর্মকা- সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য টবে চারা সংরক্ষণ ও পরিচর্যা, ফুলদানি সাজানো, জৈব সার ব্যবহার এবং ফল-ফুল বাগান পরিচর্যা বিষয়ক বইপুস্তক পাওয়া যায়। ডিএই এর হর্টিকালচার উইং এর আওতায় সারা দেশের উদ্যান ফসল সম্প্রসারণ, মাতৃবাগান সৃজন, জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ, মান সম্পন্ন বীজ-চারা-কলম উৎপাদন এবং সুলভ মূল্যে তা সরবরাহের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় ৭৩টি হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে দেশি ফলের পরিচিতি বাড়ানো ও বারো মাস ফল প্রাপ্যতার কৌশল নির্ধারণ করে মাঠ পর্যায়ে বাণিজ্যিক নার্সারি স্থাপনে সহযোগিতা ও নার্সারি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসব নার্সারির কার্যক্রমকে মানুষের নজরে আনা ও বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে চারা-কলম লাগানোর প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে ও সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ডিএই এর উদ্যোগে প্রতি বছর ফল মেলা, বৃক্ষ মেলার আয়োজন করা হয়। প্রতি বছর নিয়মিতভাবে এ উইংয়ের মাধ্যমে দেশব্যাপী ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ উদযাপন করে থাকে। এ উপলক্ষে জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ফল মেলার অয়োজন করা হয়। ওইসব মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদিত প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফল প্রদর্শনের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয় এবং কৃষক পর্যায়ে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে ফলের চারা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। নতুন ফল বাগান সৃজন ও তা ব্যবস্থাপনা এবং  বাংলাদেশে উদ্যান ফসল উৎপাদনের ওপর সভা সমাবেশ করা হয়। এছাড়া ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষ রোপণে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কৃষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হয়ে থাকে।
 
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে উপকূল এলাকার মানুষ সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। এসব এলাকায় নারিকেল চাষ সবচেয়ে ভালো ও বেশি হয়। কিন্ত ঘূর্ণিঝড়ে তা ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হয় লম্বা জাতের নারিকেল গাছের কারণে। ঝড়ে একবার কচিপাতা ভেঙে গেলে পরবর্তী তিন-চার বছর আর ফল ধরে না। এ দিকটি বিবেচনায় রেখে, কৃষি ও কৃষকের একান্ত আপনজন কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সুযোগ্য মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি এবার সারা দেশে বিশেষকরে উপকূলবর্তী এলাকায় খাটো (ডর্ফ) জাতের নারিকেলের চারা লাগানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এরই মধ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। অন্য সবাই এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলমান কার্যক্রমে শরিক হবেন এ আশা রাখি।
 
ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষরোপণে বিগত ০৬ বছরে ডিএই এর চারা-কলম রোপণের লক্ষ্যমাত্রা ও অর্জন নিম্নের ছকে দেখানো হলো-  
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৭০ ভাগই কর্মক্ষম (১৫-৫৯ বছর বয়সী)। প্রতি বছর দেশের শ্রমবাজারের জন্য ২২ লাখ মানুষ তৈরি হয়; কিন্ত কাজে প্রবেশের সুযোগ পায় মাত্র ১০ লাখ মানুষ। বাকি ১২ লাখ মানুষের একটা অংশ এ শিল্পে জোগানদানের সুযোগ হতে পারে। এখানে এসব কথা বিশেষভাবে না বললেই নয় যে, মূলত সরকারি হর্টিকালচার সেন্টার ও বেসরকারি নার্সারির মাধ্যমেই সারা দেশে আমের চারা কলম উৎপাদনে এক ধরনের বিপ্লব ঘটে গেছে। এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের আম এখন বিশ্বের নামিদামি খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি হচ্ছে। ডিএই-এর হিসাবে ২০১২ সনে দেশে ৩৭ হাজার হেক্টর জমিতে আমের বাগান ছিল, উৎপাদন হয়েছিল ৮ লাখ ৯০ হাজার টন, গত বছর বাংলাদেশে আম উৎপাদন হয়েছিল ৯ লাখ ৪৫ হাজার টন। আর এ বছর চাষ হয়েছে ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদন ১০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বে আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হারে আম চাষের এলাকা ও উৎপাদন বাড়ছে। এফএএও এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১২ সনে আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল অষ্টম, গত বছর বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে চলে  এসেছে। এ বছরের পূর্বে বাংলাদেশের ফল ও শাকসবজির প্রধান ক্রেতা ছিল বিদেশে অবস্থানরত দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ান অঞ্চলের মানুষজন। কিন্তু এ বছর থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, এফএও এবং হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের যৌথ প্রচেষ্টায় আমেরিকার বিখ্যাত চেইন সুপার খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়ালমার্ট’ বাংলাদেশে উৎপাদিত হিমসাগর, ল্যাংড়া এবং আম্রপলি এ তিন প্রজাতীর আম তাদের সর্বশ্রেণীর ক্রেতার জন্য বিক্রি করবে। প্রথম যাবে লন্ডনের মার্কেটে। এরপর থেকে  ইউরোপ এবং আমেরিকার মার্কেটেও  বিক্রি হবে। এরই মধ্যে দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে ও বসতবাড়ির আশপাশে আমগাছ লাগানোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। প্রতি বছর আরও চার লাখ টন আমের বাড়তি উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এজন্য যত চারা-কলম ও কারিগরি সহায়তা দরকার তা ডিএইএ’র হর্টিকালচার সেন্টার ও বেসরকারি নার্সারির মাধ্যমেই সরবরাহ করার প্রস্তুতি চলছে। শুধু আম নয়, আরও অনেক ধরনের গাছ লাগানোর সুযোগ এখনও অনেক বাকি আছে। যে কারণে নার্সারির বিকাশেরও  যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে ফল, ফুল কাঠের চাহিদাও বাড়ছে। কাজেই মানুষ যত দিন বেঁচে থাকবে, নার্সারিও ততদিন থাকবে। আর একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, পূর্বের তুলনায় বিদেশি ফলের চাহিদা কমার সাথে সাথে দেশি ফলের চাহিদা বাড়ছে। যে কারণে দেশি ফলের চাষ সম্প্রসারণে নার্সারির ভূমিকাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নার্সারির উন্নয়ন ও আরও বিকাশের জন্য দেশের যুব সমাজকে এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রদান আরও সহজীকরণ করতে হবে। উদ্বুদ্ধ জনগণকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের জন্য ডিএই সবসময় প্রস্তুত আছে। উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে গুণগতমানসম্পন্ন চারা-কলম উৎপাদনের জন্য এককালীন মূলধন প্রয়োজন। যুব সমাজকে প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহ করে এ পেশায় সম্পৃক্ত করতে পারলে ভবিষ্যতে নার্সারি শিল্প সত্যিকারভাবে শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।  ফলের মতো দেশের চাহিদা মিটিয়ে নার্সারি পণ্য বিদেশেও রফতানি হতে পারে। 
 
সুনীল চন্দ্র ধর
*পরিচালক, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
বিস্তারিত
খাটো জাতের হাইব্রিড নারিকেল চাষে করণীয়
পরিচিতি : নারিকেল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। ব্যবহার বৈচিত্র্যে এটি একটি অতুলনীয় উদ্ভিদ। তবে আমাদের দেশে বর্তমানে যে প্রচলিত নারিকেলগুলো রয়েছে তা থেকে ফলন পেতে স্বাভাবিকভাবে ৭ থেকে ৮ বছর সময় লাগে। তাই নারিকেলের ফলন যাতে তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় তাই নতুন এ ‘ডিজে সম্পূর্ণ ডোয়ার্ফ (খাটো)’ জাতের নারিকেল আবাদের ব্যাপারে জোর দেয়া হচ্ছে। নতুন জাতের এ নারিকেল গাছ থেকে যথাযথ পরিচর্যা করলে ২৮ মাসেই ফলন আসবে। ফলনের পরিমাণ আমাদের দেশের জাতের থেকে প্রায় তিনগুণ। উপযুক্ত পরিচর্যা করলে প্রতি বছর প্রায় ২৫০টি নারিকেল পাওয়া যায়। উন্নত এ জাতের সম্প্রসারণ করা গেলে আমাদের দেশের নারিকেলের উৎপাদন প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি পাবে।
 
জাত : ডিজে সম্পূর্ণ ডোয়ার্ফ হাইব্রিড নারিকেল।

উৎপাদন প্রযুক্তি
মাটি
: নিকাশযুক্ত দো-আঁশ থেকে বেলে দো-আঁশ মাটি।

রোপণের সময় : জুন-সেপ্টেম্বর।

রোপণের দূরত্ব : ৬ x ৬ মিটার হিসেবে হেক্টরপ্রতি ২৭৮টি চারা প্রয়োজন।

পিট তৈরি : আদর্শ পিটের মাপ হবে ৩ ফুট x ৩ ফুট x ৩ ফুট। গর্ত তৈরির পর প্রতি গর্তে ১৫ থেকে ২০ কেজি পচা গোবর অথবা আবর্জনা পচা সার দিতে হবে। মাটিতে অবস্থানরত পোকার আক্রমণ থেকে চারা রক্ষার জন্য প্রতি গর্তে ৫০ গ্রাম বাসুডিন প্রয়োগ করতে হবে। সব কিছু মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে। ভরাটের পর পানি দিয়ে গর্তটাকে ভিজিয়ে দিতে হবে যাতে সব সার ও অন্যান্য উপাদান মাটির সঙ্গে মিশে যায় যা চারা গাছের শিকড়ের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।

চারা রোপণ : গর্তের মাঝখানে নারিকেল চারা এমনভাবে রোপণ করতে হবে যাতে নারিকেলের খোসা সংলগ্ন চারার গোড়ার অংশ মাটির ওপরে থাকে। চারা রোপণের সময় মাটি নিচের দিকে ভালোভাবে চাপ দিতে হবে যাতে চারাটি শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
 
আন্তঃপরিচর্যা
* ১ম মাস : চারা রোপণের পর চারার চারপাশের মাটি ভালোভাবে চাপ দিয়ে শক্ত করে দিতে হবে। এরপর সেচ দিতে হবে। নারিকেল ফসলের জন্য সেচ ও নিষ্কাশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শুষ্ক মৌসুমে প্রতিদিন সেচ এবং বর্ষার সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২০ দিন পর আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। ছত্রাক জাতীয় রোগ থেকে মুক্তির জন্য ১৫ দিন পরপর ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
 
* ২য় ও ৩য় মাস : নিয়ম অনুযায়ী যথাযথ সেচ প্রদান করতে হবে। পোকামাকড় ও রোগবালাই আক্রমণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ছত্রাক রোগ দমনে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। নিয়মিত মাটি নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে।

* ৪র্থ মাস : নিয়মিত ছত্রাকনাশক স্প্রে ও আগাছা দমন করতে হবে। শিকড় বৃদ্ধির জন্য মাটির আর্দ্রতা সবসময় ৪০% থেকে ৮০% এ রাখতে হবে। এ মাসে প্রথম ডোজের সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা প্রতি ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০ গ্রাম এমওপি এবং ১০ কেজি গোবরজাত সার ভালোভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে। এ সময় চারা থেকে পাতা ছড়ানো শুরু হবে।
 
* ৫ম ও ৬ষ্ঠ মাস : নিয়মিত ছত্রাকনাশক স্প্রে এবং আগাছা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময়ে গণ্ডার পোকা দমনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
 
* ৭ম মাস : অন্যান্য মাসের মতো নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। এ সময় থেকে গাছের গোড়া থেকে ১ ফুট দূরত্বে সেচ ও সার প্রয়োগ করতে হবে।
 
* ৮ম মাস : নির্ধারিত মাত্রার পানি সেচ এবং বালাইনাশকের ব্যবহার অব্যাহত রাখতে হবে। বিভিন্ন পোকামাকড় এবং রোগবালাইয়ের আক্রমণের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ মাসে সারের ২য় ডোজ দিতে হবে। চারা প্রতি ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০ গ্রাম এমওপি এবং ১০ কেজি গোবরজাত সার ভালোভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দেয়া প্রয়োজন।

* ৯ম মাস : এ সময়ে ছত্রাকের আক্রমণ কমতে থাকে বিধায় ছত্রাকনাশকের ব্যবহার কমানো যেতে পারে। তবে পাতা কাটা পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে।

* ১০ম ও ১১তম মাস : যথাযথ বৃদ্ধির জন্য গাছের গোড়ার মাটির আর্দ্রতা ৪০% থেকে ৮০% এর মধ্যে রাখতে হবে। রোগবালাই ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে।
 
* ১২তম মাস : এ মাসে ৩য় সারের ডোজ দিতে হবে। পূর্বের মতো চারা প্রতি ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০ গ্রাম এমওপি, ৫০ গ্রাম বোরন এবং ১০ কেজি গোবরজাত সার ভালোভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে। গাছের বৃদ্ধির প্রতি লক্ষ্য রাখলে দেখা যাবে যে, এ সময়ে গাছের উচ্চতা ১২.৫ ফুট, গোড়া ২.৯ ফুট এবং পাতার মাপ হবে ৯.৫ ফুট। পাতার সংখ্যা হবে ১৫ টি।
 
* ১৩তম ও ১৪তম মাস : সাধারণ পরিচর্যা করতে হবে এবং পোকামাকড়ের আক্রমণের দিকে লক্ষ রাখতে হবে।

* ১৫তম মাস : এ মাসে পরিচর্যার ক্ষেত্রে গাছের বেসিন এরিয়া বাড়াতে হবে ৫ ফুট পর্যন্ত এবং ৪র্থ ডোজের সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছপ্রতি ৫৪০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৭৫০ গ্রাম এমওপি সার এবং ২০ কেজি গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে।
 
* ১৬তম মাস : এ মাসে নারিকেল গাছের ট্রাঙ্ক দেখা যেতে পারে। তাই এ সময়ে বিশেষ যতœ নিতে হবে। বিটলের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য গাছ প্রতি বাসুডিন (১০জি) ২০ গ্রাম, নিম কেক ও নদীর বালুর সাথে মিশিয়ে গাছের ৩-৪টি পাতার খাঁজের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে। পরিমিত সেচ প্রদান করতে হবে।
 
১৭তম মাস : গাছের গোড়া নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। পরিমিত সেচের মাধ্যমে মাটির আর্দ্রতা ঠিক রাখতে হবে।

* ১৮তম মাস : এ মাসে ৫ম ডোজের সার দিতে হবে। গাছপ্রতি ইউরিয়া ৬৫০ গ্রাম, টিএসপি ১২৫০ গ্রাম, ৮৫০ গ্রাম এমওপি এবং ১০০ গ্রাম বোরন প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে। পোকামাকড়ের আক্রমণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
 
* ১৯তম মাস : পরিমিত সেচ এবং রোগবালাইয়ের আক্রমণের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

* ২০তম মাস : গাছের গোড়ার চারপাশের ১ ফুট উঁচু করে সবুজ লতাপাতা জমিয়ে পচাতে হবে যাতে মাটির হিউমাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এতে গাছের বৃদ্ধি যথাযথ হবে। মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে।

* ২১তম মাস : এ মাসে ৬ষ্ঠ ডোজের সার দিতে হবে। গাছ প্রতি ইউরিয়া ৬৫০ গ্রাম, টিএসপি ১২৫০ গ্রাম এবং ৮৫০ গ্রাম এমওপি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে। পোকামাকড়ের আক্রমণের দিকে লক্ষ রাখতে হবে।

* ২২তম মাস : গাছের এ বয়সে বেসিনের আকার ৬ ফুট পর্যন্ত বাড়াতে হবে। এর মধ্যে গাছের গোড়ার ২ ফুট স্থান অব্যবহৃত রাখতে হবে এবং বাকি ৪ ফুটের মধ্যে সার ও সেচ প্রয়োগ করতে হবে।

* ২৩তম মাস : এ সময়ে গাছের সঠিক পরিচর্যা করতে হবে। যথাযথ সার ও সেচ দিতে হবে। গাছের গোড়ার ২ ফুটের মধ্যে যাতে পানি ও সার দেয়া না হয় তা বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
 
* ২৪তম মাস : এ বয়সে নারিকেল গাছ পূর্ণ বয়স্ক গাছ হিসেবে ধরা যায়। তাই এ সময়ে পরিপূর্ণ মাত্রার সার ব্যবহার করতে হবে। ৭ম ডোজ হিসেবে গাছ প্রতি ইউরিয়া ৮০০ গ্রাম, টিএসপি ২০০০ গ্রাম এবং ১১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। এ সময়ে কিছু গাছে ফুল আসতে শুরু হবে এবং ২৮-৩০ মাসে প্রায় সব গাছে ফুল আসবে। ফুল আসার পর মুকুল ঝড়ার পরিমাণ বেশি হলে ১০ গ্রাম-লিটার হিসেবে বোরাক্স সার স্প্রে করতে হবে।
 
* গাছের ২৪ মাস বয়সের পর প্রতি গাছে বছরে ৫.৫ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি এবং ৭ কেজি এমওপি সার ও ৫০ কেজি গোবর সার প্রতি  বছর চার ভাগে ৩ মাস পরপর গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে। অন্যান্য সারের ক্ষেত্রে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ১৫০ গ্রাম করে প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর এবং বোরন সার ১০০ গ্রাম করে প্রতি বছর ২ বার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
 
রোগ ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
বাড রট-কুঁড়ি পচা : রোগের প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে ৪ থেকে ৫ গ্রাম প্রপিনেব ও ম্যানকোজেব গ্রুপের রোগনাশক সিকিউর মিশিয়ে কুঁড়ির গোড়ায় স্প্রে করতে হবে ২১ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার।
ফল পচা রোগ : প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে ম্যানকোজেব গ্রুপের রোগনাশক মিশিয়ে আক্রান্ত ফলে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
 
পাতার ব্লাইট : পরিমিত সার প্রয়োগ করলেও যথা সময়ে সেচ এবং নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে রোগের আক্রমণ কম হয়। আক্রমণ বেশি হলে প্রোপিকেনাজল গ্রুপের রোগনাশক ১৫ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
 
গণ্ডার পোকা : আক্রান্ত গাছের ছিদ্র পথে লোহার শিক ঢুকিয়ে সহজেই পোকা বের করা যায় বা মারা যায়। ছিদ্র পথে সিরিঞ্জ দিয়ে অরগানো ফসফরাস গ্রুপের কীটনাশক প্রবেশ করালে পোকা মারা যাবে।
 
নারিকেলের মাইট : গাছ পরিষ্কার করে প্রোপারজাইট গ্রুপের ভার্টিমেক-ওমাইট ৪.৫ মিলি থেকে ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। 
বিঃ দ্রঃ এ জাতের নারিকেল হাইব্রিড বিধায় এর বীজ দ্বারা চারা উৎপাদন করা যাবে না।  
      
প্রচারে : কৃষি তথ্য সার্ভিস, সহযোগিতায় : হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, খামারবাড়ি, ঢাকা
বিস্তারিত
আম-ধৌতকরণ-ও-শোধনে-হট-ওয়াটার-প্রযুক্তি

(Hot Water Treatment Technology for Mango)
আম একটি দ্রুত পচনশীল ফল। সংগ্রহ মৌসুমে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা উভয়ই বেশি থাকে বলে আম পচা ত্বরান্বিত হয়। আমাদের দেশে উৎপাদিত মোট আমের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে নষ্ট হয়। প্রধানত বোঁটা পচা ও অ্যানথ্রাকনোজ রোগের কারণে আম নষ্ট হয়। আম সংগ্রহকালীন ভাঙা বা কাটা বোঁটা থেকে কষ বেরিয়ে ফলত্বকে দৃষ্টিকটু দাগ পড়ে । ফলত্বকে নানা রকম রোগজীবাণুও লেগে থাকতে পারে এবং লেগে থাকা কষ রোগ সংক্রমণে সহায়তা করতে পারে। এজন্য আম পরিষ্কার পানি দ্বারা ধোয়া অত্যন্ত  গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঠাণ্ডা পানিতে ধুলে কষ দূর হলেও রোগাক্রমণ খুব একটা নিয়ন্ত্রিত হয় না। সেজন্য আম হালকা গরম পানিতে ধোয়া উচিত। রোগ নিয়ন্ত্রণ, গুণাগুণ রক্ষা, সুষ্ঠুভাবে পাকা ও সংরক্ষণশীলতা বৃদ্ধিতে আমের হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট বেশ কার্যকরী। আবার ঠাণ্ডা বা গরম পানিতে নির্ধারিত মাত্রায় সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড মিশিয়ে ওই মিশ্রণে আম চুবিয়ে রেখেও ধৌতকরণ করা যায় এবং ভালো ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের পরীক্ষায় ‘ফজলি’ আমের ক্ষেত্রে গরম পানিতে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড মিশিয়ে কার্যকরিতা অধিক পাওয়া গেছে। গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, জাতের ওপর নির্ভর করে ৫২ থেকে ৫৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার গরম পানিতে ৫ মিনিট ধরে আম শোধন করলে বোঁটা পচা রোগ ও অ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমন করা যায়। এভাবে আম নষ্ট হওয়া প্রতিরোধ করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতি কাজে লাগানোর জন্য গরম পানিতে আম শোধন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

যন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো
২ কিলোওয়াট ক্ষমতার ৮টি বৈদ্যুতিক ওয়াটার হিটারের মাধ্যমে পানি গরম করা হয়।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক ব্যবহার করা হয়।
আম ভর্তি প্লাস্টিক ক্রেট বহনের জন্য মটরচালিত কনভেয়ার রোলার ব্যবহার করা হয়।
যন্ত্রটি দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে আম শোধন করা যায়। যন্ত্রটি চালানোর জন্য ছয়জন লোকের প্রয়োজন হয়। এ যন্ত্র দ্বারা আমকে সুষমভাবে ৫২ থেকে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে ৫ থেকে ৭ মিনিট ডুবিয়ে শোধন করা হয়।
গরম পানিতে ডুবিয়ে রাখা আমের গায়ে লেগে থাকা পচনে সাহায্যকারী জীবাণু মারা যায়।
শোধনকৃত আম ৫ থেকে ৬ দিনের পরিবর্তে ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত টাটকা থাকে এবং আমের রঙ উজ্জ্বল হয়। যন্ত্রটি দিয়ে ঘণ্টায় ১০০০ কেজি আম শোধন করা যায়।
উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় প্রতি কেজির শোধন খরচ মাত্র ৫০ পয়সা। যন্ত্রটির বাজার মূল্য ১,৩৫,০০০ টাকা।     

হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট পদ্ধতি : বড় কোনো খোলা মুখওয়ালা পাত্রে পানি রেখে তাপ দিতে হবে। পানির তাপমাত্রা ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে ওই পানিতে আম ৫ মিনিট চুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর পানি থেকে আম উঠিয়ে বাতাসে শুকিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট প্রসেসিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে উদ্ভাবিত হট ওয়াটার প্লান্ট ব্যবহার করে উল্লিখিত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে সুষমভাবে একসাথে অনেক আমের হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট করা যায়।
 
* প্রচারে : কৃষি তথ্য সার্ভিস, সহযোগিতায় : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
বিস্তারিত
সম্পাদকীয় অাষাঢ়-১৪২২
তুমি যদি জানো আগামীকাল কিয়ামত হবে তবুও আজ একটি গাছের চারা রোপণ কর। আমাদের প্রিয় নবী, আল্লাহর প্রেরিত রাসূলের এ অমূল্য বাণী থেকে বৃক্ষ রোপণের গুরুত্ব যে কেউ অতি সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ফলদ বৃক্ষ হলে তো কথাই নেই। ফলদ বৃক্ষ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, কেউ যদি একটি ফলদ বৃক্ষ রোপণ করে এবং সে বৃক্ষের ফল পাখি কিংবা মানুষে খায় এমনকি যদি চুরি করেও খায় তবুও ওই বৃক্ষের মালিক সদকার সওয়াব পাবেন। এছাড়া হাদিসে আরও বলা হয়েছে বৃক্ষ রোপণ সদকায়ে জারিয়ার কাজ। অর্থাৎ কেউ বৃক্ষ রোপণ করে মারা গেলে তিনি মৃত্যুর পরও সওয়াব পেতে থাকবেন। হাদিসের অমূল্য বাণীগুলো থেকে আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি যে, ফলদ, বনজ কিংবা ভেষজ বৃক্ষ রোপণ করা কত বড় মহৎ ও সওয়াবের কাজ। শুধু তাই নয়, বৃক্ষের উপকারিতার কথাতো বলে শেষ করা যাবে না। এক কথায় বলা যায়, পৃথিবীকে মানুষ ও প্রাণীর বাসযোগ্য করতে এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপকরণ সরবরাহ করতে বৃক্ষের জুড়ি নেই। বৃক্ষ ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব চিন্তাই করা যায় না। বৃক্ষ বিশেষ করে ফলদ বৃক্ষের উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রতি বছর আষাঢ়ের প্রথমপক্ষকে ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ হিসেবে পালন করে আসছে। এ পক্ষ পালনের মাধ্যমে দেশের মানুষকে বৃক্ষ রোপণের গুরুত্ব, উপকারিতা, প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করা হয় এবং সেসঙ্গে দেশের বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ ও জাতীয় ফল প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এ বছরও কৃষিকথার বিশেষ সংখ্যাসহ পোস্টার, লিফলেট, বুকলেট, জাতীয় দৈনিকে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়াও আয়োজন করা হয়েছে র‌্যালি ও সেমিনার। ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ ও জাতীয় ফল প্রদর্শনী উপলক্ষে কৃষি তথ্য সার্ভিস ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টার সঙ্গে শরিক হয়ে ‘দিন বদলের বাংলাদেশ, ফল বৃক্ষে ভরবো দেশ’-এ স্লোগানকে সার্থক করতে সবাই অবদান রাখুন এটাই আমাদের কামনা।
 
প্রিয় লেখক, পাঠক, গ্রাহক ও শুভানুধ্যায়ী ভাই ও বোনেরা, আপনারা জানেন কৃষিকথা এবার ৭৫তম বছরে পদার্পণ করল। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কৃষিকথা আমাদের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে যে অবদান রেখেছে তা অতুলনীয়। তাই কৃষিকথার ৭৫তম বছরে পদার্পণ উপলক্ষে আবারও জানাই স্বাগতম।  কৃষিকথার চলতি সংখ্যায় ফলদ বৃক্ষ সম্পর্কিত বিশেষ লেখা দিয়ে যারা সংখ্যাটিকে মানসম্পন্ন ও সময়োপযোগী করতে সহযোগিতা করেছেন তাদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।
বিস্তারিত