Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা (আশ্বিন ১৪২৩)

পৃথিবীর সব স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে শতকরা ৪২ ভাগ ইঁদুরজাতীয় প্রাণী। ইঁদুরজাতীয় প্রাণী রোডেন্টসিয়া (Rodentia) বর্গের  ও মিউরিডি (Muridae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সারা পৃথিবীতে ২৭০০টির অধিক ইঁদুরজাতীয় প্রজাতি আছে। এ প্রাণীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের দাঁতের বিশেষ গঠন ও তার বিন্যাস। ১৬টি দাঁত থাকে। মাংসাশী ও প্রেষণ পূর্ব দাঁত নেই। তবে উভয় পাটিতে সামনে একজোড়া করে ছেদন দাঁত যা অত্যন্ত তীক্ষè ও ধারালো বাটালির মতো। ছেদন দাঁত গজানোর পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বাড়ে। কাটাকাটি না করতে পারলে দাঁত বেড়ে চোয়াল দিয়ে বেড় হয়ে যায় এবং ইঁদুরের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দাঁত ঠিক রাখার জন্য শক্ত জিনিস সর্বদা কাটাকাটি করে। ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, সজারু ইঁদুরজাতীয় প্রাণী। চিকা ইঁদুরজাতীয় প্রাণী নয়। ইঁদুর সর্বভুক, নিশাচর এবং স্তন্যপায়ীদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম প্রাণী। এর উপকারী ও অপকারী  উভয় ভূমিকা রয়েছে। তবে ক্ষতিকারক ভূমিকাই বেশি ।
ইঁদুরের আচরণের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যাবলি
যে কোনো পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে; খাদ্য, পানি ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা পেলে বাচ্চার সংখ্যা বাড়ানো ও কমানোর ক্ষমতা আছে; গর্ভধারণকাল প্রজাতিভেদে ১৮-২২ দিন, বাচ্চা প্রসবের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আবার গর্ভধারণ করে; সার্বক্ষণিক কৌতূহলি এবং অনুসন্ধানকারী স্বভাব থাকে। সবাইকে শত্রুভাবে; খাদ্য, পানি ও বাসস্থানের একটির অভাব হলে স্থান পরিবর্তন করে; ইঁদুরের স্মরণশক্তি (৬০ দিন মনে থাকে), ঘ্রাণশক্তি প্রখর, জিহ্বার স্বাদ মানুষের মতো (তিতা, মিষ্টি) এবং রঙ শনাক্ত করতে পারে না; ইঁদুরের খাদ্যভ্যাস প্রজাতি ও একই গোত্রভেদে ভিন্ন হয়; বাচ্চাদের অসুবিধা বা বিপদ অনুভব করলে নিজের বাচ্চা খেয়ে ফেলে; ইঁদুর সন্ধ্যা ও ভোর রাতে খাদ্য গ্রহণ ও সংগ্রহ এবং প্রজননে বেশি সক্রিয় হয়; খাদ্য, বাসস্থান ও পানির প্রাপ্যতার ওপর বংশবিস্তার নির্ভর করে।
 ইঁদুরের পপুলেশন বেশি হওয়ার কারণ
যেখানে  সারা বছর খাদ্য, বাসস্থান ও পানির নিশ্চয়তা  প্রদানের  স্থায়ী পরিবেশ রয়েছে  সেখানে ইঁদুরের সংখ্যা বেশি। যেমন শহরে গ্রামের চেয়ে ইঁদুরের সংখ্যা বেশি। শহরের ডাস্টবিন ইঁদুরকে সারা বছর খাদ্য ও বাসস্থানের স্থায়ী নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ড্রেন ও ছিদ্র পাইপ ইঁদুরকে পানির নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। অনেক পতিত উঁচু ভূমি রয়েছে যেখানে বেশি জোয়ারের সময় ইঁদুর আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। এখানে রয়েছে নারিকেল, সুপারি,  খেজুর, কলাগাছ, বরই, আম, মান্দারসহ ইত্যাদি গাছ  যা ইঁদুর জোয়ারের সময় আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। হোগলাপাতা, কচুরিপানা, কচুগাছ, ঢোলকলমি রয়েছে যেখানে ইঁদুর আশ্রয় নিতে পারে। এছাড়া এর আগে এখানে কোনো রকম দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ধান ফসলের থোড় থেকে পাকা পর্যন্ত সময়ে প্রজনন করে। প্রজননের সময়ে একটি স্ত্রী ইঁদুর নিধন করতে পারলে ৩৫টি ইঁদুর নিধনের সমান ফল পাওয়া যাবে। গম, ভুট্টা, গোলআলু, নানা রকম ডাল ও তেলজাতীয় ফসলের চাষ হয়, যা ইঁদুরের বংশবিস্তারের সহায়ক।  
বিস্তৃতি (Distribution) : বাংলাদেশে নিচু এলাকায় জলাভূমিতে এদের উপস্থিতি আছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল এলাকায় যেমন মনপুরা দ্বীপ ও নিঝুম দ্বীপে এদের উপস্থিতি রয়েছে।
 ইঁদুরের নিবাস : বর্ষা মৌসুমে মাঠের ফসল সম্পূর্ণভাবে ডুবে যায়। এ সময় ইঁদুর উঁচু স্থানগুলো আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
১. ছোট-বড় অধিক উঁচু পতিত ভূমি ও ভিটাবাড়ি রয়েছে, সেখানে বর্ষাকালে আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব পতিত উঁচু ভূমিতে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ৪০-৫০টির বেশি নতুন ইঁদুরের গর্ত পাওয়া গেছে।
২. মাঠে ও বসতবাড়ির পাশে হোগলাপাতার বাগানে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে;
৩. পুকুর ও খালে প্রচুর কচুরিপানা রয়েছে । এ সব স্থান ইঁদুরের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে;
৪.  খালের পাড়, উঁচু রাস্তায় বর্ষার সময় গর্ত খুঁড়ে বাস করে থাকে;
৫.  ঢোলকলমি, কচুগাছ, ছন ও অন্যান্য আগাছা প্রচুর পরিমাণে আছে যে স্থানগুলো ইঁদুর আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে;
৬. খামারের নারিকেল, সুপারি, আম, জাম, মান্দারগাছ, কলা, খেজুর গাছ, বনজ বৃক্ষগুলো ইঁদুর আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে;
৭.  বন্যা হলে কচুরিপানা ও কাঠের সাথে এক স্থান হতে অন্য স্থানে ইঁদুরের বিস্তার ঘটে।
ইঁদুর দমনের প্রয়োজনীয়তা
১. বাংলাদেশে প্রতি বছর ইঁদুর দ্বারা ১২-১৫ লাখ মেট্রিক টনের অধিক খাদ্যশস্য ক্ষতি করে;
২. প্রতিটি নারিকেল গাছের ১০-১২টি কচি নারিকেল প্রতি বছর ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। সুপারি ও শাকসবজি (গোলআলু), ডাল এবং    তেল ফসলের অনেক ক্ষতি করে;
৩. রাস্তাঘাট, বাঁধ, সেচ নালা, বসতবাড়ি, দালানকোঠা এসব অবকাঠামোর গর্ত খননের ফলে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয় এবং ১৫ শতাংশ সেচের পানির অপচয় হয়;
৪. ইঁদুর ৬০টির বেশি রোগের জীবাণু বহন ও বিস্তারকারী। এদের মাধমে অনেক ধরনের জুনোটিক রোগ যেমন- প্লেগ, অ্যাইরোসিস। এছাড়া নানা প্রকার চর্মরোগ, কৃমিরোগ, হানটাভাইরাস,  মিউরিন টাইফাস, স্পটেড জ্বর, লেপটোস্পাইরোসিস, ইঁদুরের  কামড়ানো জ্বর, জ-িস রোগের জীবাণু ইঁদুর দ্বারা বিস্তার ঘটে। এসব রোগের জীবাণু ইঁদুরের মলমূত্র, লোমের মাধ্যমে বিস্তার ঘটে;  
৫.ইঁদুর খাদ্যের বিষক্রিয়া ও পরিবেশের দূষণ ঘটিয়ে থাকে;
৬.হাঁস-মুরগির খামারে ইঁদুর মুরগির বাচ্চা ও খাদ্য খেয়ে ক্ষতি করে। এছাড়া হাঁস-মুরগির বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটিয়ে থাকে। বাংলাদেশে হাঁস-মুরগি খামারে ইঁদুর একটি প্রধান সমস্যা;
৭. ইঁদুরের উপস্থিতি স্থানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পদ এবং জিনিসপত্রের কমবেশি ক্ষতি হবেই। এজন্য ইঁদুরের উপস্থিতি দেখামাত্র মারার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

গর্ত পদ্ধতি (Burrow system) : গর্ত পদ্ধতিতে অনেক মুখ (৩-৫টি) থাকে। গর্ত পদ্ধতি সাধারণত খোলা রাখে এবং আবার অনেক বন্ধ করে রাখে। গর্তের মুখে ধানের শীষ বা খাদ্যের আবর্জনা  রাখতে দেখা গেছে। গর্তে খাদ্য মজুদ করে না। একটি গবেষণার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাত্রিকালীন গতিবিধি প্রায় ২৫০ মিটার দূরে গিয়ে খাদ্য গ্রহণ করে ফেরত আসে। গর্ত থেকে অনেক দূর পর্যন্ত ইঁদুর চলাচলের রাস্তা সহজেই চোখে পড়ে। একটি গর্তে একত্রে পুরুষ ও স্ত্রী দুইটি ইঁদুর পাওয়া যায়।  

শস্যের ক্ষতি (Damage to crops) বাংলাদেশে মাঠের কালো ইঁদুর সব প্রকার মাঠ ফসলের ও গুদামজাত শস্যের এক নম্বর ক্ষতিকারক প্রজতি। একটি ইঁদুর প্রতি রাতে ১০০-২০০টি কুশি কাটতে পারে। আমনধানের শতকরা ১০-১৫ ভাগ এবং গম ফসলের ১৫-২০ ভাগ বা তারও বেশি ক্ষতি করে থাকে। বাংলাদেশে গুদামজাত খাদ্যশস্যের ১২-১৫ শতাংশ বেশি মাঠের কালো ইঁদুর দ্বারা প্রতি বছর ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে যখন ফসলের মাঠ পানিতে ডুবে যায় তখন বেড়িবাঁধ, রাস্তাঘাটে গর্ত করে আশ্রয় নিয়ে থাকে, এর ফলে কোটি কোটি টাকার রাস্তাঘাটের  প্রতি বছর ক্ষতি হয়। সেচের নালায় গর্ত খননের ফলে ১০-১ শতাংশ পানির অপচয় হয়।
ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতি (Estimate rat damage)
ইঁদুর দ্বারা ফসল ও সম্পদের প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়। সব ফসল ও সম্পদের ক্ষতি সঠিকভাবে নির্ণয় করা বাস্তবে সম্ভব হয় না। পৃথিবীতে প্রতি বছর ইঁদুর দ্বারা যে  পরিমাণ ক্ষতি হয়  তার পরিমাণ ২৫টি গরিব দেশের মোট জিডিপির সমান হবে। ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে উপস্থিত ইঁদুরের সংখ্যার নিবিড়তার ওপর। বেশি ইঁদুরের উপস্থিতি মানে ফসল ও সম্পদের ক্ষতি বেড়ে যাবে। কারণ প্রতিটি ইঁদুর তার দেহের ওজনের ১০ শতাংশ খাদ্য প্রতিদিন গ্রহণ করে। সাধারণত বড় ইঁদুর প্রতিদিন ২৩-৫৮ গ্রাম এবং ছোট ইঁদুর ৩-৫ গ্রাম খেয়ে থাকে। এছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে ৭-৮ গুণ নষ্ট করে।
ইঁদুরের উপদ্রবের তীব্রতা তিন প্রকারের হয়। যথা-
ক. অল্প (Few) : ঘরে বা গুদামে ছোট অথবা বড় ইঁদুরের মল চোখে পড়বে। জীবন্ত ইঁদুর চোখে পড়বে না। ফসলের মাঠে ক্ষতির লক্ষণ বা ইঁদুরের গর্ত কদাচিৎ চোখে ধরা পড়বে।
খ. মধ্যম (Medium) : খাদ্যশস্যের মধ্যে ইঁদুরের মল, লোম পাওয়া যাবে। জিনিসে ক্ষতির চিহ্ন, জীবন্ত ইঁদুর দেখা যাবে এবং অল্প গর্ত দেখা যাবে। মাঠের ফসলে ইঁদুরের ক্ষতি ও গর্ত চোখে পড়বে।
গ. ব্যাপক (Severe) : অনেক মল যত্রতত্র দেখা যাবে। জীবন্ত ইঁদুর চোখে পড়বে। ইঁদুরের গর্ত দেখা যাবে । ইঁদুর দ্বারা ক্ষতির চিহ্ন দেখা যাবে।
পরিবেশবান্ধব ইঁদুর ব্যবস্থাপনা
ইঁদুরজাতীয় প্রাণী দমনের ক্ষেত্রে কোনো ম্যাজিক বুলেট নেই কারণ এদের ২০০ এর ওপরে ক্ষতিকারক প্রজাতি রয়েছে যাদের প্রত্যেকের আলাদা আচরণ, নিবাসন ও খাদ্যাভাসে ভিন্নতা বিদ্যমান। এজন্য একটি পদ্ধতি দ্বারা এদের দমন বা ক্ষতির পরিমাণ কমানো বাস্তবে সম্ভব নয়। প্রত্যেক ইঁদুরজাতীয় প্রজাতির ভিন্ন ইকোলজি রয়েছে । এ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করার সময় এ বিষয়টি সবসময় বিবেচনায় রাখতে হবে। ইঁদুর দমনের বিষয়টি সার প্রয়োগের মতো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। ফসলে অত্যধিক বেশি বা কম এবং অসময়ে সার প্রয়োগ করা হলে অর্থনৈতিক অপচয় ও পরিশ্রম বিফলে যায়। যে কোনো ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে একই রকম ঘটনা ঘটে থাকে।
ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় ও কলাকৌশল
১. যে কোনো ফসল রোপণ বা বপনের সময় মাঠের ও আইলের ইঁদুর মারতে হবে;
২. জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত জোয়ারের পানিতে  সব মাঠ পানিতে ডুবে যায়। দিনে বেশি জোয়ারের সময় মাঠের ইঁদুরগুলো হোগলাপাতা, ঢোলকলমি, কচুরিপানার দলে, উঁচু ভূমি এবং গাছে  আশ্রয় নিয়ে থাকে। এ সময় নৌকায় দলবেঁধে গিয়ে ওই সব স্থানের ইঁদুর টেঁটা ও লাঠি দিয়ে মারতে হবে। মাঠের বড় কালো ইঁদুর ডুব দিয়ে ও সাঁতার কেটে অনেক দূর যেতে পারে। এজন্য দলবেঁধে মাঠের ইঁদুরের সম্ভাব্য সব আশ্রয়স্থান ধ্বংস হবে। এতে পরবর্তীতে আমন ফসলে ইঁদুরের সংখ্যা ও ক্ষতি কম হবে;
৩. বর্ষাকালে সব রাস্তাঘাট, খালের পাড় ও উঁচু পতিত ভূমির ইঁদুর বিষটোপ প্রয়োগ করে মারতে হবে;
৪. ফসলের থোড় স্তরে ইঁদুরের প্রজনন কার্যকারিতা আরম্ভ হয়। অক্টোবর মাসের  প্রথম সপ্তাহে ৯৫ শতাংশ বেশি স্ত্রী ইঁদুর গর্ভধারণ অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাই, সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বেশি ইঁদুর মারা হলে পরে ইঁদুরের সংখ্যা কম থাকবে। এ সময় একটি স্ত্রী ইঁদুর মারতে পারলে পরবর্তীতে ৩৫টি  ইঁদুর মারার সমান উপকার হবে।
গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর নিধন
 উঁচু ভূমি ও রাস্তাঘাটের, খালের পাড়ে ইঁদুর গর্ত খুঁড়ে বের করা খুব কঠিন। যেখানে ইঁদুরের গর্তের পরিধি কম সেখানে গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর নিধন করা যায়। গর্ত খোঁড়ার সময় গর্তের চারদিক জাল দ্বারা ঘিরে নিলে ইঁদুর সহজে পালাতে পারে না।
ফাঁদ পেতে ইঁদুর দমন  
নানা রকমের ফাঁদ বাজারের পাওয়া যায় যেমন জীবন্ত ইঁদুর ধরার ফাঁদ (তারের খাঁচা ফাঁদ ও কাঠে তৈরি ফাঁদ) এবং কেচিকল (Snap trap) এবং বাঁশের তৈরি ফাঁদ । স্থান কাল পাত্রভেদে এসব ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। ফাঁদে টোপ হিসেবে নারিকেল ও শুঁটকি মাছ ব্যবহার করা যেতে পারে।
গর্তে পানি ঢেলে ইঁদুর নিধন : গর্তে পানি ঢেলে ইঁদুর দমন করা বাস্তবে অনেক কঠিন। কারণ মাঠের বড় কালো ইঁদুর  ও মাঠের কালো ইঁদুরের গর্তের দৈর্ঘ্য ও গভীরতা অনেক বেশি। ফসল কাটার পর গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর মারা যায়। এতে কোনো লাভ হয় না।  প্রজাতি শনাক্তকরণের জন্য ফসল কাটার পর কিছুসংখ্যক গর্ত খুড়ে ইঁদুর সংগ্রহ করা যেতে পারে, যা ইঁদুর দমনের পরিকল্পনায় কাজে লাগবে।
গ্লুবোর্ড ব্যবহার : বাজারে তৈরি ইঁদুর নিধনের গ্লুবোর্ড পাওয়া যায়। বাসাবাড়ি ও অফিসে গ্লুবোর্ড ব্যবহার করে ছোট-বড় ইঁদুর নিধন করা যায়। ইঁদুর গ্লুবোর্ডে আটকা পড়ার পর তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলতে হবে, কারণ অন্য ইঁদুর আটকানো  ইঁদুরকে দেখতে পেলে গ্লুবোর্ডের কাছে যাবে না।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে ইঁদুর দমনের জন্য তীব্র বিষ বা একমাত্রা বিষ (যেমন-জিংক ফসফাইড), দীর্ঘস্থায়ী বিষ (যেমন-ল্যানির‌্যাট, ব্রমাপয়েন্ট, ক্লেরাট) এবং গ্যাসবড়ি (অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড) ব্যবহার হয়। এ বিষটোপ  ব্যবহারের ক্ষেত্র সমস্যা হচ্ছে  ইঁদুরের বিষটোপ লাজুকতা সমস্যা রয়েছে। এখানে টোপ হিসেবে শামুক, চিংড়ি, চাল বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব টোপের মধ্যে চিংড়ি মাছ ও শামুকের তৈরি বিষটোপ ইঁদুর বেশি খেয়েছে। এ বিষটোপ আমন ধানের থোড় আসার আগ পর্যন্ত প্রয়োগ করা হয়েছে।
গ্যাসবড়ি ইঁদুরের প্রজনন সময়ে ও ফসলের থোড় হতে পাকা স্তরে প্রতিটি নতুন গর্তে একটি গ্যাসবড়ি প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে ইঁদুরের বাচ্চাসহ মারা যায় বলে ইঁদুরের পপুলেশন বাড়তে পারে না। গর্ত পদ্ধতিতে দমনে অনেক নতুন মুখ থাকে। সব গর্তের মুখ নরম বা কাদামাটি দিয়ে ভালোভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। গ্যাসবড়ি প্রয়োগকৃত গর্তের মুখ পর দিন খোলা পেলে একইভাবে একটি গ্যাসবড়ি প্রয়োগ করতে হবে।
ধাতব প্রতিরোধক (Metal Proofed) : টিনের পাত লাগানোর আগে গাছকে ইঁদুরমুক্ত করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় মরা ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে এবং অন্য গাছের সাথে লেগে থাকা ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে যাতে অন্য গাছ হতে ইঁদুর আসতে না পারে। নারিকেল, সুপারি গাছসহ ফল উৎপাদনকারী গাছের গোড়া গর্তে ২ মিটার ওপরে গাছের খাঁড়া কাণ্ডের চারদিকে ৫০ সেমি. প্রশস্ত টিনের পাত শক্তভাবে কাণ্ডের সাথে আটকিয়ে দিতে হবে। এতে ইঁদুর নিচ থেকে গাছের ওপরে উঠতে পারে না।
ইঁদুরভোজী প্রাণী : অনেক বন্যপ্রাণী (যেমন-বনবিড়াল, শিয়াল) এবং নিশাচর পাখি (যেমন- পেঁচা) ও সাপ (যেমন-গুঁইসাপ) এদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ইঁদুর। এদের বংশবিস্তারের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ইঁদুর নিধনে সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করতে হবে।
ইঁদুর দমন প্রযুক্তি পোকামাকড়, আগাছা বা অন্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইঁদুর দমন অভিযানের কর্মসূচি সফল করতে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এক ফসলের পরিবর্তে বহু ফসলের চাষ হচ্ছে। তাই ইঁদুর সারা বছর প্রজনন করার সুযোগ পাচ্ছে। ইঁদুর দমনের জন্য লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে মশা নিধনের কর্মসূচি রয়েছে, কিন্তু ইঁদুর নিধনের কোনো কর্মসূচি নেই। শহরের ইঁদুর দ্বারা পানি ও গর্ত খুঁড়ে ও ড্রেনে মাটি ফেলে প্রতিনিয়ত যে  পরিমাণ ক্ষতি করছে তা কয়েক শত কোটির কম হবে না। শহরের পরিবেশের দূষণ ও রোগ জীবাণু বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে মশা নিধনের মতো ইঁদুর দমন কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন।

ড. সন্তোষ কুমার সরকার*
* মুখ্য প্রশিক্ষক (অব.), ডিএই, মোবাইল : ০১৭১৪২২২১৫৭

বিস্তারিত
ইঁদুর নিধন অভিযান ২০১৬

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ ও শ্রমশক্তির ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি উন্নয়ন কৃষিভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি এবং এটি বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ এবং সে সাথে একটি সম্ভাবনাময় বড় বাজার। আর সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, সিডর, আইলা ইত্যাদি এবং সেই সাথে ফসলের বালাই ও ইঁদুরের আক্রমণের ফলে খাদ্য এবং অর্থকরী ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায়।
ইঁদুর নামক প্রাণীটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। অনেকেই এ প্রাণীটির ক্ষতিকর দিকটি গ্রাহ্য না করায় এর দমন ব্যবস্থার প্রতি সচেতনতা দেখান না। তবে যারা একবার প্রাণীটি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা এর দমন বা নিধনের ব্যাপারে সজাগ। প্রাণীটি ক্ষুদ্র হলেও এর ক্ষতিকর দিকটি বিশাল। ইঁদুরের বিচরণ ক্ষেত্র ফসলের ক্ষেত থেকে শুরু করে বাড়ির শোয়ার ঘর পর্যন্ত সর্বত্র। আর তাই এদের ক্ষতির ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। এরা মাঠের ফসল, গুদামজাত শস্য, ফল, শাকসবজি, সংরক্ষিত বীজ, কাপড়-চোপড়, কাগজ, লেপ-তোষক ইত্যাদি কাটাকুটি করে আমাদের প্রচুর ক্ষতি করে। এরা যে শুধুই কাটাকুটি করে আমাদের ক্ষতি করে তাই নয়, এরা মানুষ ও পশুপাখির মধ্যে প্লে­গ, জ-িস, টাইফয়েড, চর্মরোগ, আমাশয়, জ্বর, কৃমিসহ প্রায় ৬০ প্রকার রোগজীবাণুর বাহক ও বিস্তারকারী। একটি ইঁদুর প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ গ্রাম খাদ্য খেয়ে থাকে।
ইঁদুরের উভয় দন্তপাটিতে সামনে এক জোড়া করে খুব তীক্ষè দাঁত আছে, যা জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বাড়তেই থাকে। আর এ সদা বর্ধিষ্ণু দাঁতকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখার জন্য ইঁদুর সর্বদা কাটাকুটি করতে থাকে। ফলে ইঁদুর যা খায় তার চেয়ে চার-পাঁচগুণ খাবার নষ্ট করে থাকে। তাই ইঁদুরের ক্ষতি এত ভয়াবহ। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪১০০টির মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে যার মধ্যে ১৭০০টির মতো ইঁদুরের প্রজাতি পাওয়া গেছে। তবে এদের সবগুলোই মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। ২০টির মতো প্রজাতিকে ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রজাতিভেদে ইঁদুর ১৫-৪১ সেমি. লম্বা এবং ওজনে ১৫-৩২৬ গ্রাম হয়ে থাকে। আমাদের দেশে যেসব প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায় সেগুলো মধ্যে নরওয়ে বা বাদামি ইঁদুর, বাতি বা সোলাই ইঁদুর, মাঠের কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, মাঠের নেংটি ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর এবং প্যাসিফিক ইঁদুর উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে নরওয়ে বা বাদামি ইঁদুর ঘরের ও গুদামজাত শস্যের ক্ষতি করে থাকে, ঘরের ইঁদুর বা গেছো ইঁদুর গুদামজাত শস্য, ফলজাতীয় ফসল এবং আসবাবপত্রের ক্ষতি করে, বাতি বা সোলাই ইঁদুর ঘরের বইপত্র, কাপড়-চোপড় এবং শস্যদানা নষ্ট করে থাকে, মাঠের কালো ইঁদুর সব ধরনের মাঠ ফসল ও গুদামজাত ফসলের ক্ষতি করে থাকে, মাঠের বড় কালো ইঁদুর জলী আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে, মাঠের নেংটি ইঁদুর মাঠের দানা জাতীয় ফসল পাকার পর ফসলের ক্ষতি করে থাকে, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর ধান গম বার্লির ক্ষতি করে থাকে এবং প্যাসিফিক ইঁদুর ফলজ গাছ বিশেষ করে নারিকেল গাছের ক্ষতি করে থাকে।
ইঁদুর প্রাণীটি অতি ক্ষুদ্র হলে কি হবে, এদের ঘ্রাণ, আস্বাদন ও শ্রবণ শক্তি অতি প্রবল। ইঁদুর বর্তমানে পোলট্রি ফার্মে ছোট বাচ্চা ও ডিম খেয়ে ফার্মের মালিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঠের ফসল ছাড়াও সেচের নালায় গর্ত করার মাধ্যমে সেচের পানির ব্যাপক অপচয় ঘটায়। শুধু তাই নয় সড়ক, মহাসড়ক, বাঁধ এসব স্থানেও গর্ত খোঁড়ার ফলে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে থাকে। সুতরাং প্রাণীটি ক্ষুদ্র হলেও এর ক্ষতিকর দিকটি বিশাল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক গত ৫ বছরে ইঁদুর নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে কী পরিমাণ আমন-বোরো ফসল রক্ষা পেয়েছে তার হিসাব হলো।
ইঁদুর নিধন অভিযান ২০১৬ এর উদ্দেশ্য
-কৃষক, কৃষাণী, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইপিএম/আইসিএম এসব ক্লাবের সদস্য, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোসহ সর্বস্তরের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা;
-ইঁদুর দমনের লাগসই প্রযুক্তি কৃষি কর্মীদের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো;
-ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্পকারখানা ও হাঁস মুরগির খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা;
-আমন ফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে রাখা;
-গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধ করা;
-রাস্তাঘাট ও বাঁধের ইঁদুর নিধনের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা;
-ইঁদুরবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা।
কর্মসূচির সময়
এক মাসব্যাপী ইঁদুর নিধন অভিযান সারা দেশে একযোগে পরিচালনা করা হবে। জাতীয় পর্যায়ে ইঁদুর নিধন অভিযান, ২০১৬ এর উদ্বোধনের পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অঞ্চল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে উদ্বোধন করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের দিনে বিগত অভিযানের জাতীয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ সংখ্যক ইঁদুর নিধনকারীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হবে। অঞ্চল, জেলা পর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট জেলার সংসদ সদস্য-উপজেলা চেয়ারম্যন- সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ-পৌরসভার চেয়ারম্যান-  মেয়র অথবা তার মনোনীত ব্যক্তি দ্বারা করাতে হবে। উপজেলা পর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য-উপজেলা চেয়ারম্যান-সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অথবা তার মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা করাতে হবে।
ইঁদুর দমন পদ্ধতি পোকা ও রোগবালাই দমন পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ এখানে বিষটোপ ও ফাঁদ লাজুকতার সমস্যা রয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতি ও সঠিক স্থানে দমন পদ্ধতি গ্রহণ না করা হলে দমন ব্যবস্থা ততটা কার্যকর হয় না। একা ইঁদুর মারলে দমন ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ ইঁদুর সর্বদা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য স্থান পরিবর্তন করে থাকে। এজন্য পাড়া-প্রতিবেশীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একই দিনে ও একই সময়ে ইঁদুর নিধন করা প্রয়োজন। ইঁদুর দমনের কলাকৌশল অধিক সংখ্যক কৃষকের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তার ব্লকের ৬০০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন। এ বছর ১৫,০০০ কর্মসূচি পুস্তিকা ও ১০,০০০ পোস্টার মুদ্রণ করে অঞ্চল, জেলা ও উপজেলায় পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কর্মসূচি পুস্তিকায় ইঁদুর দমন প্রযুক্তি সংক্ষিপ্ত আকারে সংযোজিত করা হয়েছে। এছাড়া সরকার অনুমোদিত ব্রমাডিওলেন ও জিংক ফসফাইড গ্রুপর ইঁদুরনাশক (যেমন- ল্যানিরাট, ব্রমাপয়েন্ট  ল্যানির‌্যাট, রেটক্স, জিংক ফসফাইড এসব) বিষটোপ যথেষ্ট পরিমাণে বালাইনাশক ডিলারের দোকানে মজুদ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ইঁদুর সমস্যা দীর্ঘদিনের এ সমস্যা আগে যেমন ছিল বর্তমানেও রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং অংশীদারিত্ব। ঘরবাড়ি, গুদাম, হাঁস-মুরগির খামার, অফিস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিনিয়ত ইঁদুরের উপস্থিতি যাচাই করে ইঁদুর নিধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইঁদুর নিধন অভিযানের সফলতা নির্ভর করে সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপর। ইঁদুরকে একটা সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এর সমাধান সামাজিকভাবেই করতে হবে, যাতে ইঁদুর দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারায় কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে।

এ জেড এম ছাব্বির ইব্নে জাহান*
*পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
ইঁদুর দমনের কলাকৌশল

ইঁদুর একটি চতুর ও নীরব ধ্বংসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইঁদুর প্রাণীটি  ছোট  হলেও  ক্ষতির  ব্যাপকতা  অনেক। এরা  যে  কোনো  খাদ্য  খেয়ে  বাঁচতে  পারে।  যে  কোনো  পরিবেশে  মানিয়ে  নিতে  পারে। অল্প  বয়সে  বাচ্চা  দিতে  পারে। ১৭০০টি ইঁদুরজাতীয় প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে ২২টির অধিক ক্ষতিকারক ইঁদুরজাতীয় প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত  ইঁদুর  আমাদের  উৎপাদিত  ফসলকে  নষ্ট  করছে। ক্রমবর্ধমান হারে  খাদ্যের  প্রয়োজনে দেশে বর্তমানে  এক  ফসলের  পরিবর্তে  বহুবিধ  ফসলের  চাষাবাদ  হচ্ছে।  এর  ফলে  ইঁদুর  মাঠেই  খাদ্য  পাচ্ছে। বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ৪-১২ ভাগ, আলু ৫-৭ ভাগ, আনারস ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭ শতাংশ এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫ শতাংশ ক্ষতি করে।  ইঁদুর শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচ নালাও নষ্ট করে থাকে। সেটা ফসলের উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে। ইরির ২০১৩ সালের এক গবেষণা  মতে, এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যা ধান-চাল খেয়ে নষ্ট করে তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে।
ইঁদুর  শুধু  আমাদের  খাদ্যশস্য  খেয়ে  নষ্ট  করে  না  বরং  তা  কেটে কুটে  অনেক  ধ্বংস  করে।  এদের  মলমূত্র,  লোম  খাদ্য  দ্রব্যের  সাথে  মিশে  টাইফয়েড,  জন্ডিস,  চর্মরোগ  ও  ক্রিমিরোগসহ  ৬০  ধরনের  রোগ  ছড়ায়।  প্লেগ  নামক  মারাত্মক  রোগের  বাহক  হচ্ছে  ইঁদুর।  ইঁদুর  মাঠের  ও  ঘরের  শস্য  নষ্ট  ছাড়াও  বৈদ্যুতিক  তার, টেলিফোন  তার  ও  কম্পিউটার  যন্ত্র  কেটে  নষ্ট  করে। এছাড়া  বড় সড়ক  বাঁধ,  রেললাইনে  গর্ত  করে  তা  ক্ষতিগ্রস্ত করে।  বন্যার  পানি  ঢুকে  তা  নষ্ট  হয়।  এ জন্য এর ক্ষতির পরিমাণ পরিসংখ্যানগতভাবে নির্ণয় করা কঠিন। কাজেই ফসল ও সম্পদের ক্ষতি রোধ, জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও দূষণমুক্ত পরিবেশের স্বার্থে ইঁদুর সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ক্ষেত-খামার, বসতবাড়িসহ সর্বত্র ইঁদুরমুক্ত করার লক্ষ্যে ইঁদুর নিধনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে।
ইঁদুরের উপস্থিতির লক্ষণ
কর্তনের শব্দ, নখের দ্বারা আঁচড়ানো শব্দ, কোনো কিছু বেয়ে ওঠার অথবা নামার শব্দ, ক্ষণস্থায়ী চিচি শব্দ, চলাচলের  রাস্তায় মল, নোংরা দাগ, পায়ের ছাপ, ইঁদুর যাতায়াত পথের সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি দ্বারা ইঁদুরের উপস্থিতি বোঝা যায়। ইঁদুরের বাসা এবং তার আশপাশে ছড়ানো ছিটানো খাদ্যাংশ দেখে ইঁদুরের উপস্থিতি জানা যায়। ইঁদুরের গন্ধ এবং পোষা প্রাণির লাফঝাপ বা অদ্ভুত আচরণ বা উত্তেজনা ইঁদুরের উপস্থিতি নির্দেশ করে।
ইঁদুরের স্বভাবই হলো কাটাকুটি করা। কাঠের গুঁড়া, দরজা, জানালা, ফ্রেম, গুদামের জিনিসে ক্ষতির চিহ্ন দেখে এর আক্রমণের লক্ষণ বুঝা যায়।  এছাড়া আক্রান্ত আনারস, নারিকেল, আখ, ঘর বা গুদামে রক্ষিত ধান, চাল, গম রাখার বস্তা কাটা দেখে, ইঁদুরের খাওয়া ধানের তুষ দেখে এদের উপস্থিতি বোঝা যায়। ঘরে বা তার পাশে ইঁদুরের নতুন মাটি অথবা গর্ত, ফসলের মাঠে, আইলে ও জমিতে ছোট রাস্তা, বাঁধ, পুল প্রভৃতির পাশে গর্ত দেখে ইঁদুরের উপস্থিতি ও সংখ্যা নির্ণয় করা যায়।
ইঁদুর দমনের স্থান, সময় ও ফসলের স্তর
১. ধানের জন্য বীজতলায় এবং ধানের কুশি স্তর থেকে ধানের থোড় হওয়ার আগে পর্যন্ত।  এ সময় ইঁদুরের সংখ্যা কম থাকে এবং মাঠে খাদ্যও কম থাকে। আমন ফসলে আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত;
২. গমের জন্য থোড় হওয়ার আগে, ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে;
৩. সবজি, বাদাম, আলু ফসলের ক্ষেত্রে ফসল লাগানোর সময় এবং ফসল ধরার আগে দমন ব্যবস্থাপনা নিতে হবে;
৪. আখের ক্ষেত্রে চারা রোপণের আগে মাটি ও আইলে দমন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে;
৫. নারিকেল, আম, জাম্বুরা, আনারস ও অন্যান্য ফলের বেলায় ফল ধরার আগ থেকে কর্তনের আগ পর্যন্ত গাছের চারপাশে ও আক্রান্ত ফলের পাশে দমন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে;
৬. গভীর ও অগভীর নলকূপের নালায়।
ইঁদুর  দমন  ব্যবস্থাপনা
ইঁদুর  একটি  অত্যন্ত  ক্ষতিকর  প্রাণী। একটি মাত্র  পদ্ধতি  দ্বারা  ইঁদুর  দমন  করা বাস্তবে  সম্ভব  নয়।  ইঁদুর  দমন  পদ্ধতি সঠিক  স্থানে,  সঠিক  সময়ে  ও  সঠিকভাবে  প্রয়োগ  করতে  হবে।
ইঁদুর মারার কলাকৌশল  
ইঁদুর সাধারণত দুইভাবে দমন করা যায়।
১. অরাসায়নিক দমন ব্যবস্থা ও ২. রাসায়নিক দমন ব্যবস্থা।
অরাসায়নিক দমন ব্যবস্থা
১. ঘরবাড়ি ও ক্ষেতের আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা;
২. গুদামঘর পরিষ্কার রাখা এবং গুদামের দরজার ফাঁক দিয়ে যেন ইঁদুর ঢুকতে না পারে তেমন ব্যবস্থা করা। এছাড়া গুদামঘরের ছিদ্র বা ফাটল সিমেন্ট দিয়ে ভালোভাবে বন্ধ করে দেয়া;
৩. ধান, গম ইত্যাদির গোলা বা ডোল সরাসরি মাটিতে না রেখে মাচার ওপর ঘরে রাখা এবং মাচার প্রতিটি পিলার মসৃণ টিন দিয়ে এমনভাবে জড়িয়ে দেয়া যেন ইঁদুর তা বেয়ে উঠতে না পারে। গুদামের শস্য টিনের পাত্রে সংরক্ষণ করা;
০৪. নারিকেল গাছের গোড়ায় টিনের মসৃণ পাত এমনভাবে জড়িয়ে দেয়া যেন ইঁদুর তা বেয়ে উঠতে না পারে;
৫. ইঁদুর ভক্ষণকারী প্রাণীকে সংরক্ষণ করা;
৬. ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে, গর্তে পানি ঢেলে ইঁদুরকে  বের করে পিটিয়ে মারা;
৭. ইঁদুরের গর্তে মরিচ পোড়ার ধোঁয়া দিয়ে ইঁদুরকে মারার ব্যবস্থা করা;
৮.বিভিন্ন প্রকার ফাঁদ পেতে ইঁদুর মারার ব্যবস্থা নেয়া।
রাসায়নিক দমন পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে ইঁদুরকে দমনের জন্য দুই ধরনের ইঁদুরনাশক ব্যবহার করা হয়। যথাÑ
১. তীব্র বিষ (Acute poison) : তীব্র বিষ খাওয়ার সাথে সাথে ইঁদুর মারা যায়। তীব্র বিষ হচ্ছে জিংক ফসফাইড। তীব্র বিষ ব্যবহারের কিছু কিছু অসুবিধা আছে তা হচ্ছে, জিংক ফসফাইড দ্বারা তৈরিকৃত বিষটোপ ইঁদুর পরিমিত মাত্রায়  খাওয়ার আগে অল্প কিছুটা মুখে দিয়ে পরখ করে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে কিন্তু মরে না। আবার পরিমিত মাত্রায় বিষটোপ খাওয়ার পর একসাথে অনেক ইঁদুর মারা যেতে দেখে বিষটোপের প্রতি অনীহা লক্ষ করা যায়।
২. দীর্ঘস্থায়ী বিষ (Chronic poison) দীর্ঘস্থায়ী বিষ খাওয়ার সাথে সাথে ইঁদুর মারা যায় না, ইঁদুর মারা যেতে ৫ থেকে ১৩ দিন সময় লাগে। দীর্ঘস্থায়ী বিষ দিয়ে তৈরিকৃত বিষটোপ ইঁদুর খাওয়ার পর ইঁদুরের রক্ত জমাট বাঁধার  ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়, ফলে ইঁদুরের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে ও ক্রমেই ইঁদুর দুর্বল হতে থাকে এবং ৫-১৩ দিনের মধ্যে ইঁদুর মারা যায়। দীর্ঘস্থায়ী বিষ প্রয়োগ করে অনেক ইঁদুর মারা সম্ভব। ৯০-১০০ শতাংশ ইঁদুর মারা যাবে (খুবই কার্যকর)। দমন খরচ বেশি। কারণ বেশি দিন বিষটোপ প্রয়োগ করতে হয়।
৩. ইঁদুরের গর্তে বিষবাষ্প প্রয়োগ করেও ইঁদুরকে মারা যায়। যথা- সাইনোগ্যাস, ফসটক্সসিন ট্যাবলেট।
বিষটোপ প্রয়োগ
১.ঘরে অথবা গুদামে অথবা দোকানে যদি গর্ত থাকে তবে নতুন গর্তের সম্মুখে পাত্রে বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে। যদি গর্ত না থাকে তবে ইঁদুরের সম্ভাব্য উপস্থিতির স্থানগেুলোতে বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে;
২.বিষটোপ একই পাত্রে একই স্থানে কমপেক্ষ ৩-৪ রাত্র রাখতে হবে;
৩. গুদামে অথবা ঘরে ১০ হাত পরপর নতুন গর্তের মুখে একটি বিষটোপ পাত্র রাখতে হবে;
৪. বিষটোপ পাত্র হিসেবে নারিকেলের খোলস, কলাগাছের খোলস, মাটির ছোট ছোট পাত্র, বাঁশ অথবা পাইপ ব্যবহার করা যেতে পারে;
৫. প্রতিটি পাত্রে ৫০-১০০ গ্রাম বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে;
৬. বহুমাত্রা বিষটোপের ক্ষেত্রে যতদিন ইঁদুর খাওয়া বন্ধ না করে ততদিন পাত্রে বিষটোপ রাখতে হবে;
৭. ঘরবাড়ি, গুদাম অথবা দোকানে কমপক্ষে ২০-৩০ দিন পরপর বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে।
৮. জিংক ফসফাইড বিষটোপ ঘন ঘন ব্যবহার করা উচিত না;
৯. গুদামে অথবা শিল্পকারখানায় ইঁদুরের উপদ্রব থাকলে স্থায়ী কয়েকটি বিষটোপ পাত্র রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বহুমাত্রা বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে;
১০.আনারস বাগানে ফল ধরার সময় ১২টি বিষটোপ পাত্র প্রতি একরে স্থাপন করতে হবে। প্রতি পাত্রে দীর্ঘমেয়াদি  ৫০ গ্রাম করে বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে। বিষ পাত্র ফল তোলার আগে পর্যন্ত আনারস বাগানে রাখতে হবে;
১১.নারিকেল গাছের মাথায় বিষটোপ ছোট পলিথিনে করে সুঁতা দিয়ে মুখ বেঁধে রাখতে হবে। নারিকেল বাগান হলে প্রত্যেক গাছে বিষটোপ প্রয়োগ না করে প্রতি ১০টি নারিকেল গাছের জন্য একটি গাছে বিষটোপ মাসে একবার প্রয়োগ করতে হবে।
সঠিক স্থানে এবং সঠিক পদ্ধতিতে বিষটোপ প্রয়োগ না করলে দমন ব্যবস্থা ততটা কার্যকর হয় না।
বিষটোপ ও ফাঁদ দ্বারা ইঁদুর দমন ব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ার কারণ
১. বিষটোপ পাত্র একই স্থানে কম দিন রাখলে। ইদুর যতদিন খায় তত দিন খাওয়াতে হবে;
২. অতি অল্পসংখ্যক বিষটোপ পাত্র প্রয়োগ করলে এবং বিষপাত্র বিষটোপবিহীন রাখলে;
৩. নতুন স্থান থেকে ইঁদুরের আগমন ঘটলে;
৪. বিষটোপ পাত্র সঠিক স্থানে না রাখলে;
৫. টোপ যদি পুরনো, খারাপ ও মোল্ডযুক্ত হয়;
৬. ফসলের থোড় ও পাকা অবস্থায় দমন ব্যবস্থা করা হলে এ সময় মাঠে প্রাকৃতিক খাদ্য বেশি থাকে;
৯. ফাঁদের সংখ্যা কম হলে;
১০.ফাদে ইঁদুর পড়ার পর তাড়াতাড়ি না সরালে;
১১. একটি দমন ব্যবস্থা বারবার প্রয়োগ করলে;
১২. একমাত্রা বিষটোপ বারবার প্রয়োগ করলে।
জৈবিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল, গুঁইসাপ, পেঁচা ইত্যাদি প্রাণী ইঁদুর মেরে থাকে। সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এদের সংরক্ষণ ও বংশবিস্তারের সুযোগ করে দিয়ে প্রাকৃতিকভাবেই ইঁদুর দমন করতে হবে।
সাবধানতা
ইঁদুর মারা বিষ খুবই মারাত্মক। বিষ প্রয়োগের সময় পানাহার বা ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। কাজের শেষে হাত মুখ এবং শরীরের অনাবৃত অংশ ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। মানুষ বা পশু খাদ্যের সাথে ইঁদুরের বিষ পরিবহন বা গুদামজাত করা এবং বিষের খালি প্যাকেট অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
কৃষক  পর্যায়ে  ইঁদুর  দমন
বাংলাদেশের কৃষক ১০-১২ ধরনের ফাঁদ  ব্যবহার  করে  ইঁদুর  ধরে  থাকেন।  যেমন- বাঁশের  তৈরি  ফাঁদ,  কাঠের তৈরি ফাঁদ, ইঁদুর ধরার  লোহার তৈরি  কল ইত্যাদি। এছাড়া  বাসাবাড়িতে  ইঁদুর  ধরার জন্য গ্লুবোর্ড  ব্যবহার  করে  ছোট  বড় ৫-১০টি  ইঁদুর  মারা  যায়। জুম ফসল রক্ষার  জন্য  বাঁশের  বেড়া  দিয়ে  বাঁশের  ফাঁদ  পাতা  হয়।  দক্ষিণ  অঞ্চলে  জোয়ারের সময় টেঁটা দিয়ে  ইঁদুর  মারা  যায়। জোয়ারে  ধান  ফসল ডুবে  গেলে  ইঁদুর  কচুরিপানা, হোগলা  গাছে ও মাঠে আশ্রয়  নিলে  তখন  সম্মিলিতভাবে  ইঁদুর দমন করা উচিত। ইঁদুর  মারার  প্রকৃত  বিষ হচ্ছে জিংক  ফসফাইড। কৃষক  এ  বিষ  বিভিন্ন খাদ্যের সাথে মিশিয়ে বিষটোপ তৈরি  করেন। খাদ্যের সাথে বিষ ২ শতাংশ  মিশ্রিত  না হলে ইঁদুর  খায়  না এবং  খেলেও মরে না। খাদ্য  হিসেবে  শুঁটকি, চিংড়ি, শামুক, কাঁকড়া ভালো  কাজ  করে। বাজারে  ল্যানির‌্যাট ও  ব্রমাপয়েন্ট  পাওয়া  যায়, যা ভালো কাজ করে। ৩ গ্রাম ওজনের অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের গ্যাসবড়ি  ইঁদুরের  গর্তে  দিয়ে  ভালোভাবেই  ইঁদুর দমন  করা  যায়।
সম্মিলিতভাবে  ইঁদুর  দমন
নিজের  বাড়ির ইঁদুর  নিজেকেই  মারতে  হবে। এটি  বাস্তব  কথা  কিন্তু  একা  ইঁদুর  দমন  করা  সম্ভব  নয়।  ইঁদুর  সমস্যা  একটি  সামাজিক  সমস্যা। সমাজের  সবার  সহযোগিতা ছাড়া ইঁদুর  দমন  সম্ভব  নয়। ইঁদুর  দমন  প্রযুক্তি  বিষয়ে  প্রশিক্ষণ  ও  উপকরণ  দিয়ে  সহায়তা ও  ইঁদুর  দমন  কর্মসূচির  জন্য  দক্ষ  জনশক্তি  গড়ে  তোলা  প্রয়োজন।

 

* উপপরিচালক (আইপিএম), উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

 

বিস্তারিত
ইঁদুর ব্যবস্থাপনায় পেঁচা : পরিবেশসম্মত প্রাকৃতিক উপায়

ইঁদুর আমাদের বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের একটি প্রাণী। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে ইঁদুরের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সময়ে সময়ে ইঁদুর ফসল ও কৃষকের শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়। জমির শস্য ও গোলার ফসল রক্ষার্থে ইঁদুর দমন করতে হয়। আমরা জানি ইঁদুরের প্রধান শত্রু পেঁচা, চিল, সাপ, বিড়াল প্রভৃতি। পেঁচা দিয়ে জৈবিক উপায়ে ইঁদুর দমন করা গেলে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা পাবে। সেই সাথে কৃষকও স্বল্প খরচায় ফসলি জমির ও গোলার শস্য ইঁদুরের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারবে।
ইঁদুরের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ
বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রুত এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। ফসলের মাঠ ছাড়াও এ অববাহিকায় অবস্থিত হাট-বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের দাপট বেশি দেখা যায় (ইউএসডিএ, ২০১০)।
সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, প্রতি বছর ২ হাজার কোটি টাকার শস্য ইঁদুরের পেটে চলে যাচ্ছে। ইঁদুর যে শুধু দানাদার ফসলের ক্ষতি করে তা নয়, এরা অন্যান্য ফসল ও ফলমূল (যেমন- নারিকেল, আলু, ডাল, অন্যান্য সবজি) এবং আসবাবপত্রের ক্ষতি করে।  বৈদ্যুতিক তার ও যন্ত্রপাতি এর হাত থেকে রেহাই পায় না। কাটাকাটির স্বভাব তার প্রকৃতিগত।  এদের মুখের সামনের দিকে নিচের ও ওপরের পাটিতে একজোড়া করে কর্তন দন্ত থাকে, যার কোনো রুট ক্যানেল নেই। তাই সাড়া জীবন ধরেই তা বাড়তে থাকে। দাঁত ছোট রাখার জন্য এরা প্রতিনিয়তই কাটাকাটি করে। এক হিসাবে দেখা গেছে যে, ইঁদুর যে পরিমাণ খায় তার প্রায় দশগুণ সে কেটে নষ্ট করে।    
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ৪-১২ ভাগ, গোলআলু ৫-৭ ভাগ, আনারস ৬-৯ ভাগ ফসল নষ্ট করে। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭ শতাংশ এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫ শতাংশ ক্ষতি করে।  ইঁদুর শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচ নালাও নষ্ট করে থাকে। যা ফসলের উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে। তাছাড়া ইঁদুরের মাধ্যমে মোট ৬০ ধরনের রোগ ছড়ায়। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে মুরগির ডিম ও ছোট বাচ্চা খেয়ে ফেলে। বারি এর  মেরুদ-ী প্রাণী বিভাগের হিসাবে ইঁদুর দেশের প্রতিটি মুরগির খামারে বছরে ১৮ হাজার টাকার ক্ষতি করে।
ইঁদুর ব্যবস্থাপনায় জৈবিক দমন
প্রক্রিয়ায় ইঁদুর ব্যবস্থাপনায় পেঁচা,  বেজি, বিড়াল, গুঁইসাপ এবং কুকুরের ব্যবহার অপরিসীম। বর্তমানে বেজি বা গুঁইসাপের পরিবেশ বিপন্ন। গুঁইসাপের চামড়া মূল্যবান হওয়ায় এদের সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে ইঁদুর ব্যবস্থাপনায় বিড়াল এবং কুকুরের ব্যবহার অপর্যাপ্ত। কারণ বিড়াল বা কুকুরকে ইঁদুর শিকার করতে হলে দীর্ঘ সময় নিয়ে ‘ক্ষেপ’ ধরতে বা ঊসনড়ংং করতে হয়। ফলে এদের ক্ষেত্রে ইঁদুর ধরার সফলতা কম। এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে যে, পেঁচার খাদ্যাভাসে বা  খাদ্য-শিকলে ইঁদুরের দেহাবশেষ সর্বোচ্চ, শতকরা প্রায় ৯৪ ভাগ অর্থাৎ খাদ্য-শিকলের ৯৪ ভাগ ইঁদুরের দখলে। শুধু তাই নয়, ইঁদুরের আবাসস্থল খুঁজে পেঁচা শিকার করে বিধায় এর শিকার-সফলতাও অনেক বেশি। তাছাড়া রাতে ইঁদুর ও পেঁচা দুটোই সক্রিয় হয় বলে মাঠের ইঁদুর ব্যবস্থাপনায় পেঁচার শিকার কৌশল ইঁদুরের নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে।
ইঁদুরের নীরব ঘাতক পেঁচা
প্রকৃতিতে ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা একটি বড় সমস্যা। কিন্তু পেঁচা (Barn Owl) প্রাকৃতিকভাবে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের কৌশল প্রয়োগ করে। Owl মানে গোলাবাড়ি বা গোলাঘর এবং ঙষি মানে পেঁচা। ধারণা করা হয় যে, আগে গবাদিপশু বা ঘোড়ার আশ্রয়ের জন্য তৈরিকৃত গোলাবাড়িতে বা গোলাঘরে পেঁচা বাস করত বিধায় এদের নাম হয়েছে Barn Owl
 পেঁচার শিকার কৌশল
পেঁচার শিকার কৌশলের দিকগুলো হলো এর অভিযোজিত চক্ষু, কানের ত্রিমাত্রিক শ্রবণ, তীক্ষè দৃষ্টি এবং পাখার গঠন। ইঁদুর বা ইঁদুরজাতীয় প্রাণীগুলো রাতে গোপনীয়ভাবে চলাফেরা করে কিন্তু রাতের অন্ধকারে চলাচলের এ কৌশল পেঁচার হাত থেকে এদের রক্ষা করতে পারে না। পেঁচার আছে বড় আকারের বিশেষভাবে অভিযোজিত চক্ষু, যার মাধ্যমে এরা অন্ধকারেও দেখতে পায়। শুধু তাই নয়, এরা দিনের বেলায় মানুষের চেয়ে স্পষ্ট দেখতে পায়। অন্যটি হলো কানের ত্রিমাত্রিক শ্রবণ। পেঁচার মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ ত্রিমাত্রিকভাবে শোনার জন্য কাজ করে। এর ফলে সৃষ্ট শব্দ এবং তার অবস্থান, অন্য যে কোনো পাখির তুলনায় এরা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে। পালক দিয়ে তৈরি পেঁচার চ্যাপ্টা; হৃদপি-াকৃতির মুখের ডিস্কটি রাডারের মতো কাজ করে। ফলে পেঁচার কানে আসা শব্দটির উৎপত্তি এবং দিক নির্ণয় করতে পারে। পেঁচা তার বিশেষ ধরনের মাংসপেশির সাহায্যে ডিস্কের আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে। ফলে ইঁদুরজাতীয় প্রাণী কর্তৃক সৃষ্ট কিচিরমিচির বা অন্য যে কোনো শব্দের শব্দতরঙ্গের অবস্থান অন্ধকারের মধ্যে প্রায় ৩০ মিটার দূর হতে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারে। কানে শব্দ পৌঁছার সাথে সাথে পেঁচা সেদিকেই দৃষ্টি ফেরায়, ফলে শিকারটি মাথার সামনের দিকে অবস্থান করে বিধায় পেঁচার সহজেই শিকার ধরতে পারে । রাতে বিচরণকারী অন্যান্য পেঁচার তুলনায়, বার্ন (Barn) পেঁচার দুই কানেই এক সেট করে উন্নত অংশ রয়েছে, যার খোলা স্থানটি ভিন্ন ভিন্ন কোণে থাকায় ইঁদুর কর্তৃক উৎপন্ন উচ্চ বা নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সির যে কোনো শব্দ, তা কোনো দিক থেকে (ডান-বাম-ওপর-নিচ) এবং কতদূর  থেকে আসছে তা সঠিকভাবে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেও নির্ণয় করতে পারে।
Barn Owl কেবল নিশাচরই নয়, তীক্ষè দৃষ্টির কারণে দিনেও এরা শিকার করতে সক্ষম। বিশেষ করে তাদের ক্ষুধার্ত বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য। শিকার ধরার সময় পেঁচা ইঁদুরের ওপর থাবা দিয়ে প্রথমে পায়ের নখর বা টেলনগুলোকে বাড়িয়ে দেয়, এরপর মুখের সামনের ঠোঁটের সাহায্যে শিকারের ঘাড়টি ভেঙে ফেলে এবং ফলে শিকারটি (ইঁদুরটি) মারা যায়। পেঁচার শিকার ধরার সফলতার আর একটি বিশেষ দিক হলো তাদের পাখা গঠন। এদের পাখার পালকগুলো প্রসারিত ও গোলাকার হওয়ায়, এরা কম পরিশ্রমে বেশি জায়গা (Area) নিয়ে এবং বেশি সময় ধরে নিঃশব্দে উড়তে পারে বিধায় এদের শিকার ধরা সহজ হয়।
পৃথিবীর সর্বত্রই Barn Owl বা পেঁচাজাতীয় প্রাণীকে বিভিন্ন ধরনের আবাসস্থলে বিশেষ করে যেখানে ইঁদুরজাতীয় প্রাণীদের অবস্থান সেখানেই দেখতে পাওয়া যায়। তাই উন্মত এবং উন্নয়নশীল দেশের কৃষক মাঠ ফসলের ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের জন্য পেঁচাকে ব্যবহার করছে। পেঁচার বসবাসকে উৎসাহিত করার জন্য কৃষক জমিতে পেঁচার ঘর (Nest-box) এবং রাতে পেঁচা বসার জন্য টাওয়ারের ব্যবস্থা করছে এবং কাক্সিক্ষত মাত্রার সুফলও পাচ্ছে। এরই আলোকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগ মাঠ ফসলের ধান, ইঁদুরের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য গবেষণা প্লটের সেচনালার ওপর দিয়ে ১৫ মিটার পরপর ১০-১২ ফিট উচ্চতায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের ব্যবস্থা করেছে। এতে রাতে পেঁচা বসে এবং খুঁটিকে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার (Watch Tower) হিসেবে ব্যবহার করে। শিকার ধরার আগে পেঁচা এর আগে গৃহীত বা ভক্ষণকৃত ইঁদুরটিকে পিলেট (Pellet) আকারে বমি (Regurgitated) করে। বমিকৃত পিলেট সংগ্রহ করে শুকিয়ে নিয়ে ০.৫ নরমাল naOH দ্রবণে ভিজালে ইঁদুরের চামড়া, হাড় এবং মাথার খুলি পৃথক হয় এবং খাওয়া ইঁদুর বা ইঁদুর প্রজাতির শনাক্তকরণ সম্ভব হয়।
পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে রাতে পেঁচা বসে মাঠের ইঁদুর নীরবে নিঃশব্দে ধরে খায়। এরা ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম ওজনের ইঁদুর বেশি পছন্দ করে। কারণ পেঁচা আস্তঃপুরো ইঁদুরটি গিলে ফেলতে বেশি আগ্রহী, তবে শিকারকৃত ইঁদুরের আকার বা তার ওজন বেশি হলে এরা প্রথমে ইঁদুরের মাথা এবং পরে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। তাই জৈব পদ্ধতির অংশ হিসেবে পেঁচা লালন-পালন বা প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে ইঁদুর ব্যবস্থাপনা করা যায়।
পেঁচার বিচরণ এলাকা
পেঁচার বিচরণ কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ নয়। সাধারণত এরা যখন যেখানে বা যে এলাকায় থাকে সেখানকার নেস্ট বক্স (Nest box) ব্যবহার করে। এরা ডজন ডজন বা কলোনি করে গ্রুপে কোনো এলাকায় থাকতে পছন্দ করে। এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, ৪৮টি Nest box এ বসবাসকারী পেঁচাগুলো ৮ সপ্তাহে প্রায় ১৭০০ ইঁদুর বা ইঁদুরজাতীয় প্রাণী মারতে সক্ষম হয়েছে। সেজন্য বলা হয় যে, কোনো ফার্মে/এলাকায় একটি পেঁচা রাখার চেয়ে কলোনি আকারে সংরক্ষণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কারণ বড় এলাকা নিয়ে তখন এরা শিকার কার্যক্রম চালায়। শিকারের সন্ধানে এরা ৩-৪ কিমি. পর্যন্ত উড়তে পারে। এভাবে Barn Owl-এর একটি কলোনি কোনো এলাকার ইঁদুরের আক্রমণকে দারুণভাবে কমিয়ে দিতে পারে। এর ফলে কোনো এলাকায় হঠাৎ আবির্ভূত ইঁদুর বন্যাও প্রতিহত হয়। পাহাড়ি বাঁশের ইঁদুর বন্যায় ইধৎহ ঙষি-এর কলোনির ব্যবহার সুফল আনতে পারে কিন্তু এরা আক্রান্ত এলাকার সব ইঁদুরকে দমন করতে পারে না। এভাবে পেঁচা সব ইঁদুর ধ্বংস না করে ভারসাম্য অবস্থায় ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত অনুপাতে সংরক্ষণ করে এবং প্রকৃতিতে ভারসাম্য বজায় রাখে।
পেঁচা ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা
পেঁচা ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পেঁচার চাহনি এবং তার মুখাকৃতি দেখে মানুষ ভয় পায়। পেঁচার ডাককে  শুভ বা অশুভ কোনো কিছুর পূর্বলক্ষণ যা মৃত্যু বা দুর্ভাগ্যের প্রতীক বলা হয়েছে। এদের নিঃশব্দে উড়া, অন্ধকারের মধ্যে সাদা মুখাকৃতি নিয়ে আবির্ভূত হওয়া এবং ভয় দেখানোর মতো আতঙ্কজনক শব্দ করা- বিশ্বব্যাপী অশুভ ঐশ্বরীয় শক্তির উৎস বলে আখ্যায়িত। সে কারণে পার্চিং (Perching) এবং নেস্ট বক্স (Nest box) স্থাপনের মাধ্যমে মাঠে পেঁচা বসার-থাকার সুযোগ সৃষ্টি করে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি স্থানীয় কৃষক অত্যন্ত নেতিবাচক মনে করছে। কারণ তাদের কাছে পেঁচা হলো শয়তানের দাসী বা ডাইনি, যা মানুষের দুর্ভাগ্য আনায়নকারী এবং বাচ্চাদের অসুস্থতাকারী বা রোগ সৃষ্টিকারী। মানুষের তথা কৃষক এসব ধারণা দূরীকরণের জন্য কৃষককে প্রত্যক্ষভাবে পেঁচা ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জড়িত করা প্রয়োজন। এজন্য কৃষককে পেঁচা ব্যবহারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং পেঁচার জীবন-বৃত্তান্ত এবং তার পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার তথ্যাদি লিফলেট, বুকলেট বা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জ্ঞাত করা প্রয়োজন। যাতে কৃষক বুঝতে পারেন যে, পেঁচার তুলনায় ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি।
এ কথাটি স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, পেঁচার খাদ্যাভাসে বা খাদ্য-শিকলে ইঁদুরের দেহাবশেষ সর্বোচ্চ, শতকরা প্রায় ৯৪ ভাগ। রাতে ইঁদুর ও পেঁচা দুটিই সক্রিয় হয় এবং পেঁচা ইঁদুরের আবাসস্থল খুঁজে শিকার করে। তাই এর শিকার-সফলতা অনান্য প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি। মাঠের ইঁদুর ব্যবস্থাপনায় পেঁচা নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে।
এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে মাঠ ফসলের ইঁদুর ব্যবস্থাপনা হবে দূষণমুক্ত ও পরিবেশসম্মত, সাশ্রয়ী হবে কৃষি উৎপাদন এবং রক্ষা পাবে বিপুল অর্থসম্পদ।

ড. মো. মোফাজ্জল হোসেন*, ড. শেখ শামিউল হক**  মীর মনিরুজ্জামান কবীর***

*প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বিআরআরআই, গাজীপুর- ১৭০১; **প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বিআরআরআই, গাজীপুর- ১৭০১; ***বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বিআরআরআই, গাজীপুর- ১৭০১

বিস্তারিত
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে তালমিলিয়ে দেশে পোলট্রি এবং মৎস্য উৎপাদন দ্রুত বাড়লেও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবে প্রাণিসম্পদ বিশেষ করে ছাগলের উৎপাদন  তেমনটা আশানুরূপ বাড়েনি। এদেশে প্রাপ্ত প্রায় ২০ মিলিয়ন ছাগলের প্রায় ৯৩ শতাংশ পালন করে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ধরনের খামারিরা। অথচ গবাদি প্রাণিকুলের মধ্যে ছাগল পালন যতটা লাভজনক ও সহজ অন্যগুলো তেমন নয়। ছাগলের যেসব জাত আছে যেমন অ্যাংগোরা, বারবারি, বিটাল, যমুনাপারি, সুরতি, মারওয়ারি, মালবারি, গাড্ডি, কাশ্মিরী, পশমিনা, সানেন, টুগেনবার্গ, অরপাইন, মোহসানা, ফিজি, অ্যাংলোলু। এসবের মধ্যে বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল বিশ্বমানের বিশ্ব সেরা। এসব ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংস যেমন সুস্বাদু, চামড়া তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে উন্নতমানের বলে স্বীকৃত। তাছাড়া ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতা অধিক এবং তারা দেশীয় জলবায়ুতে বিশেষভাবে উৎপাদন উপযোগী। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল প্রধানত গোশত ও চামড়া উৎপাদনকারী জাত হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃত। এজন্য আমরা খুব গর্ব করে বলতে পারি ব্ল্যাক বেঙ্গল আমাদের ছাগলের জাত। এদের গড় ওজন ১৫-২০ কেজি। কখনও কখনও ৩০-৩২ কেজি পর্যন্ত হয়।  দৈনিক ওজন বৃদ্ধির হার দৈনিক ২০-৪০ গ্রাম। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ছাগল পালনের মাধ্যমে একজন ভূমিহীন বা প্রান্তিক খামারি বাড়তি আয় করতে পারেন। এমনও প্রমাণ আছে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করে অনেক আশাতীত সফলতা পেয়েছেন। সুতরাং ক্ষুদে মাঝারি কিংবা বড় খামারিদের জন্য ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন একটি নিশ্চিত লাভজনক কার্যক্রম।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের পশ্চিম বাংলা, আসাম ও অন্যান্য রাজ্যে পাওয়া যায়। আকারে ছোট ও বড় দুই রকমের হয়। এজন্য বয়স্ক পুরুষ ও স্ত্রী ছাগলের ওজনের তারতম্য দেখা যায়। এদের ঘাড় এবং পেছনের অংশ উচ্চতায় প্রায় সমান থাকে। বুক প্রশস্ত। পাগুলো ছোট ছোট। ছাগ এবং ছাগীর শিং আছে। শিং ছোট বা মাঝারি আকারের হতে পারে। লম্বায় ৫-১০ সেন্টিমিটার হয়। শিং ওপরের দিক থেকে পেছনে বাঁকানো থাকে। কানের আকার ছোট ও মাঝারি কিছুটা ওপরের দিকে থাকে। দেহের গড়ন আঁটসাঁট। গায়ের রঙ সাধারণত কালো। তবে ধূসর সাদা বা বাদামি রঙেরও হতে পারে। গায়ের লোম ছোট ও মসৃণ। বছরে দুইবার এবং এক সাথে একাধিক বাচ্চা উৎপাদন করে। তবে দুধ উৎপাদন ক্ষমতা তুলনামূলক কম। স্ত্রী ছাগল ৯-১০ মাস বয়স হলেই প্রজননের যোগ্য হয় এবং ১৪-১৫ মাস বয়সে প্রথম বাচ্চা প্রসব করে। বলা যায়,  গোশতের জন্য ব্ল্যাক বেঙ্গল সর্বোৎকৃষ্ট। তবে দুধের জন্য যমুনাপারি, বারবারি ভালো। আর পশমের জন্য গাড্ডি ও অ্যাংগোরা ভালো।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনে সুবিধাদি-
০ পারিবারিক আয় বাড়ে;
০ আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, পরিবারের গোশত ও দুধের চাহিদা মেটে;
০ পারিবারিক আমিষের চাহিদা পূরণ হয়;
০ চামড়া রফতানির মাধ্যমে অধিকতর আয় বাড়ে;
০ ছাগলের দুধ খুবই পুষ্টিকর এবং এলার্জি উপসর্গ উপশমকারী;
০ ব্ল্যাক বেঙ্গলের গোশত সুস্বাদু ও চামড়া আন্তর্জাতিকভাবে উন্নতমানের বলে স্বীকৃত;
০ অধিক বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এবং দেশীয় জলবায়ুতে বিশেষভাবে উৎপাদন উপযোগী;
০ ছাগল পালনে অল্প জায়গার প্রয়োজন হয়, পারিবারিক যে কোনো সদস্য দেখাশোনা করতে পারেন;
০ শয়ন ঘরে বা রান্না ঘরে কিংবা শয়ন ঘরের পাশে সাধারণ মানের কম খরচি ঘরে রাখা যায়;
০ দ্রুত বংশ বৃদ্ধি ঘটে বলে অল্প সময়ে সুফল পাওয়া যায়;
০ সব ধর্মালম্বী লোকদের জন্য ছাগলের গোশত সমাদৃত;
০ ছাগল পালনে অন্যান্য পশুর মতো আলাদ বিশেষ গোচারণভূমির প্রয়োজন হয় না;
০ ক্ষেতের আইলের, রাস্তার ধারে, বাড়ির আশপাশের অনাবাদি জায়গার ঘাস লতাপাতা খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে;
০ বাড়ির আঙিনার আশপাশের গাছগাছড়ার লতাপাতা ছাগলের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়;
০ অল্প পুঁজিতে লালন পালন করা যায়;
০ গবাদিপশুর মতো উন্নতমানের খাদ্য আবাসন বা অন্যান্য বিশেষ যতেœর প্রয়োজন হয় না।
প্রযুক্তির বিশেষ বৈশিষ্ট্য : সাধারণ পদ্ধতি প্রযুক্তির বাইরে আরও কিছু বিশেষ প্রযুক্তি পদ্ধতি আছে, যা অনুসরণ করলে ছাগল পালন আরও বেশি লাভজনক হয়। নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী ছাগল পালন করলে ছাগলের দৈনিক গড় ওজন বাড়ে, গর্ভধারণের জন্য কমসংখ্যক পালের প্রয়োজন হয় ও অল্প সময়ে অধিক বাচ্চা উৎপাদন করা সম্ভব। এছাড়া বয়স্ক ছাগী ও বাচ্চার মৃত্যুর হারও কমে যায়। মোটকথা আসল লাভ বেশি হয়।
খাদ্য ও খাওয়ানো পদ্ধতি : ফলপ্রসূ উৎপাদনের জন্য সঠিক পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ অত্যন্ত জরুরি। কাক্সিক্ষত লাভ পাওয়ার জন্য  ছাগলকে দুই ধরনের খাদ্য সরবরাহ করা উচিত; যেমন- আঁশযুক্ত বা আঁশজাতীয় খাদ্য ও দানাদার খাদ্য।
ক. আঁশযুক্ত খাদ্য : গ্রামাঞ্চলে সাধারণত মুক্ত চারণ পদ্ধতির মাধ্যমে ছাগল পালন করা হয়। কাজেই আঁশজাতীয় খাবার সরবরাহের প্রয়োজন হয় না। কারণ, চড়ে খাওয়ার সময় ছাগল দিনভর তার নিজের পছন্দ ও প্রয়োজন অনুযায়ী আঁশজাতীয় রকমারি খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। তবে মুক্তচারণ পদ্ধতি সব সময় কাজে লাগানো যায় না। এজন্য বিশেষ সময় পরিকল্পিতভাবে খামারিদের আঁশযুক্ত খাবার অবশ্যই সরবরাহ করতে হবে।
শস্য মৌসুমে যখন ক্ষেতে ফসল থাকে তখন মুক্ত চারণের ফলে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ থেকে ঝগড়া বিবাদের সৃষ্টি হয়। কাজেই, এ সময় ছাগলকে মাঠে বা রাস্তার ধারে বেঁধে চড়ানো উচিত। তবে বেঁধে চরালে ছাগল প্রয়োজন অনুযায়ী আঁশযুক্ত খাবার পায় না। তাই এ সময় ছাগলকে পরিকল্পিত মাত্রা অনুযায়ী আঁশযুক্ত খাবার সরবরাহ করতে হবে।
বর্ষা মৌসুমে ছাগলকে পুরোপুরি আবদ্ধ অবস্থায় পালন করতে হয়। এ সময়ে অবশ্যই আঁশযুক্ত খাবার হিসেবে বিভিন্ন গাছের পাতা ও সবুজ ঘাস দেয়া যেতে পারে। শুকনো মৌসুমে অর্থাৎ যে সময়ে ক্ষেতে  ফসল থাকে সে সময়ে ৫০ ভাগ গাছের পাতার সাথে ৫০ ভাগ সবুজ ঘাস সরবরাহ করলে ভালো উৎপাদন পাওয়া যাবে। ক্ষুদ্র খামারিরা বাড়ির আঙিনা, জমির আইল ও রাস্তার পাশে নেপিয়ার, আলফালফা, শিম, ইপিল ইপিল, কাঁঠালপাতা এসবের চারা রোপণ করতে পারেন। এ থেকে সারা বছর আঁশযুক্ত খাবার সংগ্রহ করা সহজ হবে।
খ. দানাদার খাদ্য : শুধু আঁশযুক্ত খাবার ছাগলের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের চাহিদা মেটাতে পারে না। আশানুরূপ উৎপাদন পেতে হলে আঁশযুক্ত খাবারের সাথে দানাদার খাবার অবশ্যই সরবরাহ করা প্রয়োজন। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট হারে দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ ব্যবহার করলে ছাগল থেকে ভালো উৎপাদন-ফলাফল পাওয়া সম্ভব। খাবার যাই-ই প্রয়োজন হোক না কেন যে কোনো দানাদার খাদ্যের মিশ্রণে শতকরা হারে হবে চাল-ভুট্টা-গমের ভুষি ৪৫ ভাগ, চালের কুঁড়া ২০ ভাগ, খেসারি ভাঙা ১৮ ভাগ,  তিলের খৈল ১৬ ভাগ, লবণ ০.৯ ভাগ, এমবাভিট ০.১ ভাগসহ যেন মোট ১০০ ভাগ হয়। লক্ষ রাখতে হবে যাতে এ খাবারের মিশ্রণে শতকরা ১৬ ভাগ অপরিশোধিত আমিষ থাকে। তা না হলে সেটাকে সুষম খাবার বলা যাবে না। দানাদার খাদ্যের মধ্যে চালের ক্ষুদ-কুঁড়া, গম ও ভুট্টা চূর্ণ, গমের ভুষি, ছোলা-খেসারি ভাঙা, সরিষার খৈল, তিলের খৈল, ভিটামিন, শুঁটকির গুঁড়া ও খনিজ লবণ, আয়োডিনযুক্ত লবণ এগুলো মাত্রা ও অনুপাত অনুযায়ী খাওয়ালে লাভ বেশি হবে।
খাওয়ানো পদ্ধতি : পর্যাপ্ত পরিমাণ আঁশযুক্ত খাবার সুবিধামতো সময়ে দিনে দুই বা ততোধিক বারে সরবরাহ করলেই চলবে। আর দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতি ছাগীকে প্রতিদিন ১৬০ গ্রাম অর্ধেক করে সকালে ৮০ গ্রাম  এবং বিকালে ৮০ গ্রাম খাওয়াতে হবে এবং তিন মাস বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ছাগলের বাচ্চাকে প্রতিদিন ১০০ গ্রাম (৫০ গ্রাম সকালে ও ৫০ গ্রাম বিকালে) সরবরাহ করতে হবে।
 ছাগল থেকে কাক্সিক্ষত উৎপাদন পেতে হলে খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। সব সময় বয়স অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ দিতে হবে। ছাগলের খাদ্য তালিকায় স্টাটার খাদ্য, বাড়ন্ত খাদ্য এবং প্রাপ্ত বয়স্ক ছাগলের খাদ্য এ তিন ধরনের খাদ্য মাত্রা নিশ্চিত করতে হবে বয়স অনুযায়ী। ১ দিন থেকে ৩ মাস, ৩ মাস থেকে ১ বছর এবং ১ বছরের বেশি বয়স্কদের জন্য তিন ধরনের খাদ্য সরবরাহ দিতে হবে।
পানি : পানির অপর নাম জীবন। আরও ভালোভাবে বলা দরকার বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। পানি সব প্রাণীর মতো ছাগলের জন্যও পরিমিত পরিমাণে সরবরাহ থাকা দরকার। খেয়াল রাখতে হবে পানি যেন বিশুদ্ধ হয়। সে জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ছাগল পালন ঘরের খুব কাছেই যেন বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বাসস্থান : পারিবারিক পর্যায়ে ছাগল পালন ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে পারলে কম সময়ে যেমন ছাগল পালন সহজ হয় তেমনি উৎপাদনও বেশি পাওয়া যায়। একসাথে অনেক ছাগল পালন করলে বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনায় বাসস্থান তৈরি খুব জরুরি। গ্রামাঞ্চলে মুক্তচারণ পদ্ধতিতে ছাগল পালন করা হয়। এজন্য দিনে বাসস্থানের তেমন কোনো চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। শুধু রাতে নিরাপদে বাসস্থানে রাখার প্রয়োজন হয়। এজন্য সম্পূর্ণ আলাদা স্থানে অথবা শোয়ার ঘরের একপাশে বা বারান্দায়ও রাখার ব্যবস্থা করা যায়। ছাগলের ঘরের চাল হিসেবে টিন, টাইল, ছন, গোলপাতা, খড় বা গাছের পাতা ব্যবহার করা যায়। আলাদা ঘর নির্মাণের সময় অবশ্যই উঁচু স্থান যেখানে বৃষ্টির পানি জমে না এবং পর্যাপ্ত আলো বাতাস পাওয়া যায় এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে। স্যাঁতসেঁতে ভিজা জায়গায় ছাগল থাকতে চায় না। তাছাড়া এসব জায়গায় পরজীবী ও জীবাণু আক্রমণ করে। সেজন্য শুকনা জায়গার প্রয়োজন হয়। ছাগলের বাসস্থান দুই রকমের হয়। ভূমি সমতল ঘর এবং খুঁটির ওপর ঘর। তবে ছাগলের ঘরে মাচা আবশ্যকীয়। মাচার উচ্চতা ৪-৫ ফুট এবং মাচা থেকে ছাদের উচ্চতা ৬-৮ ফুট হওয়া দরকার। মাচার বাঁশ বা কাঠের মধ্যে ফাঁকা রাখতে হবে। এতে ছাগলের পায়খানা প্রস্রাব সহজেই নিচে পড়ে যাবে মাচা জীবাণুমুক্ত থাকবে। প্রতিদিন সকাল বেলা ছাগলের বাসস্থান পরিষ্কার করতে হবে। বাসস্থানটি যাতে ভেজা ও স্যাঁতসেঁতে না থাকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ছাগলের প্রধান শত্রু ঠাণ্ডা । এজন্য শীতকালে বেশি ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করার জন্য ছাগলের ঘরে প্রয়োজন অনুযায়ী চট পলিথিন দিয়ে পর্দার ব্যবস্থা করতে হবে। শীতকালে বাচ্চাকে রাতে মায়ের সাথে ব্রুডিং প্যানে রাখতে হবে।
ছাগলের বাচ্চার যত্ন : শুকনা জায়গায় ছাগলের বাচ্চা প্রসবের ব্যবস্থা করতে হবে। বাচ্চা প্রসবের পর বাচ্চার পুরো শরীর ভালোভাবে পরিষ্কার করে নাভির নিচের নাড়ি কেটে দিতে হবে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাচ্চাকে শাল দুধ অর্থাৎ মায়ের ওলান থেকে নিঃসৃত প্রথম দুধ খাওয়াতে হবে। কারণ এতে বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। জন্মের পর বাচ্চার নাভি টিংচার আয়োডিন দিয়ে মুছে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। মায়ের দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণ না হলে কৃত্রিমভাবে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথম সপ্তাহ বাচ্চাকে ৫ ঘণ্টা পরপর খাওয়াতে হবে। পরবর্তী সপ্তাহে দিনে ৪ বার খাওয়ালেই চলবে। উল্লেখ্য যে, কৃত্রিমভাবে দুধ খাওয়াতে হলে বোতল ও নিপল অবশ্যই পরিষ্কার রাখতে হবে। জন্মের ২-৩ সপ্তাহ পর হতেই দানাদার ও আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করাতে হবে। মোটকথা বয়স্ক ছাগলের চেয়ে বাচ্চা ছাগলের প্রতি একটু বেশি নজর দিতে হবে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
ছাগলের রোগ : ছাগল নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যেসব রোগ দেখা যায় তার মধ্যে আছে সংক্রামক রোগ, পরজীবীজনিত রোগ, অসংক্রামক রোগ, অপুষ্টিজনিত রোগ, বিপাকীয় রোগ। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকারক রোগ হলো পিপিআর, গোট পক্স, একথাইমা, নিউমোনিয়া, ক্রিমি এসব। তাছাড়া আছে তাড়কা ওলান প্রদাহ, ধনুস্টংকার, গর্ভপাত, ক্ষুরা রোগ, জলাতংক, মাইকোপ্লাজমোডিসিস, পায়ের ক্ষত রোগ, পেটের পীড়া, সালমোনেলাসিস এসব। ছাগলকে রোগমুক্ত রাখতে না পারলে ছাগল পালন করে লাভবান হওয়া সম্ভব নয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাই রোগবালাই থেকেমুক্ত রাখার প্রধান উপায়। ছাগলকে রোগমুক্ত রাখতে হলে যেসব বিষয়গুলোর প্রতি অবশ্যই যতœবান হতে হবে সেগুলো হলো-
ছাগলের ঘর নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। ঘর যাতে ভেজা স্যাঁতসেঁতে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে;
ছাগলের খাবার ও পানিতে যাতে রোগজীবাণু না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে;
নতুন ছাগল কেনার পর অন্তত ৭ দিন আলাদা করে রাখতে হবে। যেসব রোগের টিকা পাওয়া যায় সেসব টিকা দিতে হবে;
কোনো রোগের লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্র রোগাক্রান্ত ছাগলকে আলাদা করে রাখতে হবে। রোগাক্রান্ত ছাগলকে দ্রুত কাছের পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে এবং চিকিৎসা প্রদান করতে হবে;
রোগের কারণে মৃত ছাগলগুলোকে মাটিতে পুঁতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে;
নিয়মিত ও পরিমিত ছাগলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে;
মনে রাখতে হবে চিকিৎসার চেয়ে নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অধিক গ্রহণযোগ্য। তাই নিয়মিত টিকা দিতে হবে।
কৃমি দমন : কৃমি ছাগলের মারাত্মক সমস্যা। বয়স্ক ছাগল ও বাচ্চার কৃমি দমনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ ও উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই আশানুরূপ উৎপাদন পাওয়া যায় না। কৃমির জন্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। কাজেই কাছের প্রাণিসম্পদ হাসপাতাল থেকে ছাগলের মল পরীক্ষা করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ছাগলকে নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণা করে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ২, ৩ বা ৪টি ছাগল পালন করলে বছরে গড়ে যথাক্রমে ৩১৫০, ৪১৫০ বা ৫৩৭৩ টাকা আয় করা যায়। আমাদের দেশের দরিদ্র খামারি ও দুস্থ মহিলারা এ নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে ছাগল পালন করলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনি রয়েছে নিজের অবস্থার উন্নয়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। কম সময়ে দ্রুত আয়ের জন্য ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন পারিবারিকভাবে নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে। অল্প কিংবা বেশি ছাগলের খামার প্রতিষ্ঠা করে বহুমুখী আয়ের পথ সুগম করা যায়। এখানে পুঁজিও তুলনামূলকভাবে কম লাগে। আর পারিবারিকভাবে সবাই অংশগ্রহণ করে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করতে পারে। প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি কৃষকের জন্য এটি একটি দারুণ লাভজনক আয়ের পথ-কৌশল হতে পারে। এ ব্যাপারে যে কোনো সুপরামর্শের জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত ও পরিমিত যোগাযোগ নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে।

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫;subornoml@gmail.com

বিস্তারিত
মুরগির খামারে ইঁদুরের সমস্যা ও ব্যবস্থাপনা

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করার জন্য বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে মুরগির (poultry) উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া মুরগির কম মূল্য ও আয় বৃদ্ধির কারণে জনপ্রতি মুরগির মাংস গ্রহণের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে নিম্ন মধ্যম আয়ের কৃষক মুরগির খামারকে বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং এ শিল্প আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে গড়ে উঠছে। প্রতি বছর ২-৩ শতাংশ হারে এ শিল্পের প্রসার ঘটছে এবং অদূর ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি বাড়তে। ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের ডিম উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৬৫.৫ মিলিয়ন টন এবং এশিয়ার ডিম উৎপাদনের পরিমাণ ৩৮.৩ মিলিয়ন টন (৫৮.৫%) ২০১২-১৩ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর এর ৫১৩৪ মিলিয়ন ডিম উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্প জিডিপিতে ১ শতাংশ এবং প্রায় ৬০ লাখ লোক এ শিল্পের সাথে জড়িত। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১,১৫,০০০ হাজার মুরগির খামার ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে এর পরিমাণ মাত্র ৬৬,০০০ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৩)। ৫৫,০০০ মুরগির খামার বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবে কারণে কমে গেছে। (ডেইলি স্টার ২০১৩)। এত বড় পোলট্রি শিল্পের মুরগির জন্য নিবিড় পরিচর্যা করা প্রয়োজন যাতে ডিম ও মাংসের উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো যায়। মুরগির খামারের আশপাশে ময়লা আবর্জনা, বিষ্টা, মৃত মুরগি এসব থাকে যা ইঁদুর ও অন্যান্য পোকা মাকড়ের প্রধান আবাসস্থল।
পরজীবী ও মাটি উপরে অবস্থানকারী উভয় ধরনের বালাই পোলট্রি পরিবেশে দেখা যায়। বহিঃপরজীবী জীব হলো মাইট, লাইস, ফ্লি ও টিকস এবং বহিভাগে অবস্থানকারী জীব হলো বিটল, ফ্লাইস, মথ, তেলেপোকাও ইঁদুর। মুরগির খামারের কাচা ভিটি, নোংরা পরিবেশ, নিকটস্থ ফসলের মাঠ ইত্যাদির কারণে এ সব জীব মুরগীর খামারের স্থানান্তরিত হয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি করে থাকে। এসব বালাইয়ের মধ্যে ইঁদুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। ইঁদুর গর্ত তৈরি ও কাটাকুটি স্বভাবের মাধ্যমে মুরগির খামারের কাঠামো ক্ষতি করে। এরা ডিম, মুরগির বাচ্চা ও মুরগির খাবার খেয়ে ক্ষতি করে, তাছাড়া ইঁদুরের মলমূত্র ও পশম মুরগির খাবারের সাথে মিশে পরোক্ষভাবে ক্ষতি করে। তদুপরি মুরগি ও মুরগির বাচ্চা এবং খামারের কর্মীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রোগ বিস্তার করে।
মুরগির খামারে ইঁদুরের প্রজাতি
সারাবিশ্বে ইঁদুর মুরগির খামারে মারাত্মক ক্ষতি করে, মুরগির খামারে ইঁদুর দমন করতে প্রথমে কি কি প্রজাতির ইঁদুর আছে তাদের জীবন বৃত্তান্ত জানা জরুরি। কার্যকরী দমন ব্যবস্থা গ্রহণ বা পরিকল্পনা করা যায় যদি ইঁদুরের প্রজাতি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায়। মুরগির খামার তিন প্রজাতির ইঁদুর বেশি ক্ষতি করে থাকে। এরা হলো মাঠের কালো ইঁদুর,  গেছো ইঁদুর ও নেংটি ইঁদুর।
ছোট ব্যান্ডিকুট ইঁদুর/ছোট কালো ইঁদুর
ছোট ব্যান্ডিকুট/কালো ইঁদুর ফসলের ক্ষেত থেকে শুরু শহরের সব এলাকায় এদের দেখা যায়। এরা মোটাসোটা আকারের ইঁদুর। এদের শরীরের ওজন ২০০-৩০০ গ্রাম এদের মাথা গোলকার ও চওড়া। লেজ, মাথা ও শরীরের তুলনায় ছোট এবং পৃষ্ঠ দেশের রঙ বাদামি ও মোটা পশমযুক্ত। এদের বিভিন্ন পরিবেশ দেখা যায়। ব্যান্ডিকুট নিশাচর এবং গর্ত খননে পটু। এরা তাদের নিজস¦ তৈরি গর্তে বাস করে এবং মুরগির খামারে  প্রচুর পরিমাণে ক্ষতি করে।
গেছো ইঁদুর : গেছো ইঁদুর ছোট আকারের ইঁদুর
এদের ওজন ৮০-১২০ গ্রাম। এদের লেজ দুই রঙওয়ালা, পেচানো, লম্বা এবং মাথা ও শরীরের তুলনায় অনেক বড় । এরা সাধারণত বসতবাড়ির ওপরের অংশে বাস করে অনেক সময় পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপেও এরা বাস করে। এদের কালো ইঁদুর, ঘরের ইঁদুর বা জাহাজের ইঁদুরও বলা হয়। এরা নিশাচর প্রাণী। বেশির ভাগ সময় এদের রাতে চলাচল করতে দেখা যায় এবং এদের চলাচল ৩০ মিটার এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে।
ঘরের নেংটি ইঁদুর : নেংটি ইঁদুর ছোট আকারের ইঁদুর। এদের ওজন প্রায় ১৫ গ্রাম, নাক কিছুটা সরু, লেজ পশমহীন কিন্তু বৃত্তাকার আঁশযুক্ত। লেজ তিন রঙের মিশ্রণ মাথা ও শরীরের তুলনায় লেজ বড়। নেংটি ইঁদুর দালান কোটা ও বাসাবাড়িতে দেখা যায়। এরা দেয়ালে, কুঠরি পুরাতন আসবাবপত্র ও গুদামে বাসা তৈরি করে। এরা মুরগির খামারে খাবার খেয়ে, ডিম নষ্ট করে এবং বিভিন্ন রোগ ছড়ায়। এরা ৩ থেকে ১০ মিটার দূরত্বের মধ্যে চলাচল করে থাকে।        
মুরগির খামারের ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতি
ক. মুরগির খাবারের ক্ষতি

ইঁদুর মুরগির  খাবার খায় এবং খাবার নষ্ট করে এবং যে পরিমাণ খায় তার চেয়ে বেশি নষ্ট করে থাকে। ইঁদুর তার শরীরের ওজনের তুলনায় ১০ শতাংশ খাবার খায় এবং প্রতিদিন ২৫ গ্রাম এবং বছরের ৯.১ কেজি খাবার খায়, গড়ে প্রতি দিন একটি মুরগির খামারে ৮.৬ গ্রাম মুরগি খাবার খেয়ে থাকে। বিভিন্ন  পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে যে, মুরগির খামারে প্রতি দিন প্রায় ২-৫০ কেজি খাবার খেয়ে এবং খাবারে ব্যাগ কেটে নষ্ট করে থাকে। ইঁদুরের মলমূত্র ও পশমের মাধ্যমে মুরগির খাবার  দূষিত করে এবং এর পরিমাণ প্রায় ০.৪- ৩.৩%। ইঁদুর দ্বারা মুরগির খাবার নষ্ট একটি অর্থনৈতিক ক্ষতি যার পরিমাণ চলমান খরচের প্রায় ৫০-৭৫%।
খ. মুরগির ডিমের ক্ষতি
বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে, ইঁদুর দ্বারা ডিমের ক্ষতির পরিমাণ ০৫% এবং তা ১০% পর্যন্ত হতে পারে যদি সংরক্ষণের অবস্থা দুর্বল থাকে। ডিমের  প্লাস্টিক ট্রে ও ইঁদুর কেটে নষ্ট করে। ইঁদুর প্রায়ই ৩০ দিন বয়স পর্যন্ত বাচ্চাকে আক্রমণ করে এবং প্রায় একটি খামারে ৫.৯% বাচ্চাকে মেরে ফেলে। ইঁদুর প্রায়ই মুরগিকে ভয় দেখায় ও কামড় দিয়ে থাকে এবং মুরগির ডিম পাড়া, বৃদ্ধি ও খাদ্য গ্রহণে প্রভাব ফেলে থাকে। বাংলাদেশে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া, শ্রীপুর ও কালীগঞ্জ এলাকায় জরিপে দেখা গেছে যে, প্রতি মুরগির খামারে মাসে প্রায় ২৫০ টাকার ডিম নষ্ট করে থাকে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রতিটি মুরগীর খামারে প্রায় ১৮,০০০ টাকার ক্ষতি করে থাকে।
গ. অবকাঠামোর ক্ষতি
খামারের ঘর ও যন্ত্রপাতির নষ্ট করার মাধ্যমে বাস্তবিক পক্ষে ক্ষতি অনেক ব্যয়বহুল। ইঁদুরের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সবসময় কাটাকুটি করা। ইঁদুরের ওপরের অংশের ছেদন দন্ত প্রতি দিন প্রায় ০.৪ মিমি. হারে বৃদ্ধি পায়। এই দাঁতের বৃদ্ধি রোধ করার জন্য ইঁদুর প্রতিদিন কিছু না কিছু কেটে থাকে, এর ফল হিসেবে খাদ্য ছাড়া অন্য দ্রব্যাদিও কেটে থাকে। ইঁদুরের কাটাকুটি  স্বভাবের জন্য মুরগির ঘর ও দেয়াল দুর্বল হতে পারে। তারা খাবারের পাত্র, পানির পাত্র কেটে নষ্ট করে। মুরগির খামারের মেঝেতে প্রচুর গর্ত তৈরি করে যা বর্ষাকালে ঘরে পানি ঢুকে এবং অবকাঠামো দুর্বল হয়ে পরে। ইউএসএইডের হিসাব মতে, প্রতি বছর ইঁদুর দ্বারা নষ্ট খাবার ঘর ও যন্ত্রপাতির ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫ ইউএস ডলার (দুই হাজার টাকা)। ইঁদুর বৈদ্যুতিক ইনসুলেটর ও তার কেটে শর্টসার্কিট সৃষ্টির মাধ্যমে খামারের ক্ষতি করে থাকে।             
ঘ. বিভিন্ন রোগের বাহক ও সংরক্ষক
ইঁদুর বিভিন্ন সংক্রামক রোগের বাহক ও সংরক্ষক হিসাবে কাজ করে । ইঁদুর প্রাথমিকভাবে মলমূত্র ও পশমের মাধ্যমে মুরগির খাবার সংক্রমিত হয়। ইঁদুর প্রায় ৬০ ধরনের বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে থাকে যা দ্বারা মুরগির ও খামার কর্মী আক্রান্ত হয়ে থাকে। ইঁদুর বিভিন্ন মুরগির রোগ যেমন- সালমোনেলোসিস, কলিব্যক্সিলোসিস, মাইকোপ্লাজমেসিস ইত্যাদি, ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত রোগগুলো হলো লেপটোসপাইরোস, টিউবারকোলোসিস, ফাউল কলেরা, ফাউল টাইফয়েড, এভিয়ান প্যারাটাইফয়েড, ভাইরাল ডিজিজ, ক্যাটল ডিজিজ, এবং প্রটোজোয়ান  সংক্রমণ যেমন টক্সোপ্লাজমোসিস, কক্সিডোসিস এসব রোগ ছড়িয়ে থাকে। সবগুলো রোগ মুরগির ডিম, মাংস উৎপাদনের মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে এ রোগ গুলোর মধ্যে সালমোনেলা ও ফাউল কলেরা মুরগির খামার উৎপাদনকারীদের জন্য একটি বড় দুশ্চিন্তার কারণ। ইঁদুর বিভিন্ন পরজীবী যেমনÑ লাইস, ফ্লি এবং মাইটসের আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে থাকে। সালমোনেলা এমন একটি  ক্ষতিকর রোগ যা মুরগির এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তর হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রকার রোগের আক্রমণের ফলে প্রায়ই মুরগি মারা যায়। মুরগির খাবারে খাওয়ার ক্ষমতা কমে যায় এবং বাজারে আক্রান্ত মুরগির বাজার মূল্য কমে যায়। কাজেই ইঁদুর দ্বারা খাবার সংক্রমণ হওয়া কমানো এবং ইঁদুরের সংখ্য কমানোই হল মুরগির খামারির প্রধান কৌশল।
ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা
ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা
নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পনার মধ্যে মুরগির খামারের অবস্থা পরিদর্শন এবং  ইঁদুরের উপদ্রব বা উপস্থিতির পরিমাণ নির্ধারণ।
মুরগির খামারের অবস্থা পরিদর্শন
প্রথম  ধাপ হলো প্রত্যক্ষভাবে খামারের অবস্থা পরিদর্শন করা। এই পরিদর্শনের উদ্দেশ্য হলো এখানে কোনো ইঁদুরের উৎপাত আছে কিনা যার মাধ্যমে ইঁদুরের নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ক্ষতি করতে পারে। ইঁদুর  প্রত্যক্ষকরণ, ইঁদুরের মল, পায়ের চিহ্ন, গর্ত, চলাচলের রাস্তা, নতুন কাটাকুটির চিহ্ন এবং মৃত ইঁদুর লক্ষ্য করা ইত্যাদি তথ্যের মাধ্যমে ইঁদুরের উপস্থিতি বুঝা যায়। পরিদর্শনের মধ্যে ময়লার স্তূপ, ড্রেন, চ্যানেল, পাইপ, গর্ত, বৈদ্যুতিক বা টেলিফোনের তার দরজার মধ্যে ফাঁকা স্থান, পানির পাইপ ইত্যাদি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
ইঁদুরের উপস্থিতি বা ক্ষতির মাত্রা বিভিন্ন পদ্ধতিতে যাচাই করা যায় যেমন-
১. প্রত্যক্ষ দর্শন
২. ট্রেপিং ইনডেক্স
৩. ইঁদুরের পায়ের চিহ্ন
৪. সতেজ গর্ত পর্যবেক্ষণ
ইঁদুর দমন
মুরগির খামারিরা ইঁদুরের আক্রমণ বা উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন নয় এবং পোলট্রি ও জনগণের স্বাস্থ্য বিষয় কমই নজর দিয়ে থাকে। কার্যকরী ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে পরিদর্শন, প্রতিবন্ধকতা এবং  ইঁদুর দমন ব্যবস্থার ওপর।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা
ইঁদুর পরিষ্কার পরিবেশ পছন্দ করে না । খামারের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার রাখা, আগাছা, আবর্জনার স্তূপ পরিষ্কার করে ইঁদুরের উপদ্রব কমানো যায়। খামারের আশপাশে গাছ ও গাছের ডালপালা কেটে পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে ইঁদুর বাসা তৈরি করতে না পারে।
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা
সমতল টিনের শিট ব্যবহার করে লম্বালম্বিভাবে ইঁদুরের চলাচল বন্ধ করা যায়। খামারে মেঝে ইটের কনক্রিট দিয়ে তৈরি করতে হবে দেয়াল এবং দরজার বড় ছিদ্র ও ফাঁকা বন্ধ করতে হবে। খামারের বাহিরের অংশ ঢালু রাখতে হবে যাতে ইঁদুর উঠতে না পারে।
ইঁদুরের প্রতিবন্ধকতা সব সময় কার্যকর নয় তখন দমন ব্যবস্থাপনা অন্যান্য পদ্ধতি  বিবেচনায় আনতে হবে যেমন ফাঁদ ও রাসায়নিক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। মুরগির খামারে জৈবিক পদ্ধতি বা আলট্রাসনিক সাউন্ড পদ্ধতি খুব একটা কার্যকরী হবে না।
ফাঁদ (Trapping)
ফাঁদ হল একটি দ্রুত কার্যকরী এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি, মুরগির খামারে ইঁদুর ধরার জন্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করা হয় সেগুলো হলো, গ্লু-ট্র্যাপ, মরণফাঁদ, জীবন্তফাঁদ এসব। সট্র্যাপ, গ্লু-বোর্ড সাধারণ কাডবোর্ড শিট বা প্লাস্টিক শিটের হয়ে থাকে যেখানে উচ্চ মাত্রার আঠা ব্যবহার করা হয় সেখানে ইঁদুর আটকে থাকে। গ্লু-বোর্ড নেংটি ইঁদুরের জন্য বেশি কার্যকর। ভিজা এবং ময়লা আবর্জনাযুক্ত জায়গায় গ্লু-বোর্ড দেয়া যাবে না।
মরণফাঁদ (Kill/snap trap)
এ ধরনের ফাঁদ কাঠের ও ধাতব পাতের হয়ে থাকে এ ফাঁদ সাধারণ, কম খরচ এবং কার্যকরী হয়ে থাকে যদি ভালোভাবে পাতা হয়। এ ধরনের ফাঁদ লেয়ার হাউসে ব্যবহার করা উচিত সেখানে মুরগির খাচার ভেতর নিরাপদে থাকে। ফাঁদ সাধারণত ইঁদুরের চলাচলের পথে এবং দেয়াল ঘেসে পাততে হবে কারণ ইঁদুর দেয়াল ঘেসে চলাচল করে। টোপ হিসেবে শুঁটকি মাছ, আলু, নারিকেল, পাউরুটি এসব ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।  
জীবন্তফাঁদ  (Live trap)
জীবন্ত ইঁদুর ধরার জন্য এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। জীবন্ত ফাঁদের ইঁদুর ধরে এদের না মেরে  ছেড়ে দেয়া যাবে না কারণ ছেড়ে দিলে ইঁদুরের হোম রেঞ্জের মধ্যে আবার খামারে চলে আসবে। এ জন্য জীবন্তফাঁদ কয়েক মিনিট পানিতে ডুবিয়ে রাখলে ইঁদুর মারা যাবে। জীবন্তফাঁদ ও ইঁদুরের চলাচলের রাস্তায় ও দেয়াল ঘেসে স্থাপন করতে হবে। তাছাড়া বাঁশের ফাঁদ, টিনের ফাঁদ নামে স্থানীয়ভাবে পাওয়া যাবে। ফাঁদ ব্যবহারে পরিবেশের কোনো  ক্ষতি করে না এবং পরিবেশ দূষণ করে না।     
রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন  
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন হল সারাবিশ্বে সবচেয়ে পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। বড় খামারে এবং বাণিজ্যিকভাবে ইঁদুর দমনের  জন্য রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সারাবিশ্বে অনেক ইঁদুরনাশকের বিভিন্ন ফরমুলেশনের  পরীক্ষা করা হয়েছে এবং ব্যবহার করা হচ্ছে। যখন ইঁদুরের সংখ্যা বেশি থাকে তখন বিষটোপ দিয়ে ইঁদুর দমন সবচেয়ে ভালো উপায়। ইঁদুর দমনের জন্য সাধারণত দুই ধরনের ইঁদুরনাশক ব্যবহার করা হয়।
১. তাৎক্ষণিক বা তীব্র ইঁদুরনাশক (Acute rodenticide) যেমন- অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড, জিংক ফসফাইড ইত্যাদি।
২. দীর্ঘমেয়াদি ইঁদুরনাশক (Chronic rodenticide) যেমন- ওয়ারফারিন, ব্রোমাডিয়োলন ইত্যাদি।
দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপের মধ্যে একক মাত্রার বিষটোপ (ব্রোমাডিওলন, ব্রডিফেকাম এবং ফ্লোকোমাফিন) বহুমাত্রার বিষটোপ হতে বেশি কার্যকর এবং পৃথিবীব্যাপী বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ক. তীব্র/তাৎক্ষণিক ইঁদুরনাশক : তাৎক্ষণিক ইঁদুরনাশক দ্রুত কার্যকর এবং সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইঁদুর মারা যায়। দুটি অজৈব রাসায়নিক দ্রব্য এই ইঁদুরনাশকের অন্তর্ভুক্ত। তারা হলো বেরিনাম কার্বোনেট এবং জিঙ্ক ফসফাইড। তাদের মধ্যে ফসফাইড বেশি ব্যবহৃত হয়।
জিঙ্ক ফসফাইড : জিঙ্ক ফসফাইড ধূসর কাল রঙের। রসুনের মতো গন্ধ, পাউডার আকৃতি, সরাসরি জিঙ্ক ও ফসফাইড সমন¦য়ে গঠিত। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত তীব্র ইঁদুরনাশক। এটি পানি এবং অ্যালকোহলে অদ্রবণীয়। শুষ্ক অবস্থায় অপরিবর্তনীয়। আর্দ্র আবহাওয়ায় আস্তে আস্তে কার্যকরিতা কমে যায়। এ বিষ এসিড মাধ্যমে দ্রুত কার্যকরী হয়ে প্রাণঘাতী ফসফিন গ্যাসে পরিবর্তিত হয় যা স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্য খুবই বিষাক্ত। বিষটোপ সাবধানে সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হবে যেন মুরগি খেতে না পারে।
খ. দীর্ঘস্থায়ী ইঁদুরনাশক (Anticoagulants)
আস্তে আস্তে কার্যকরী সব ইঁদুরনাশক দীর্ঘমেয়াদি বিষের অন্তর্ভুক্ত। যা প্রাথমিকভাবে রক্ত জমাট বাধতে বাধা সৃষ্টি করে। এর সুবিধা হল এ যে এ বিষ প্রতিরোধ ক্ষমতা গঠনকারী প্রজাতির উপর ভালোভাবে কাজ করে মেরে ফেলে এবং পরিমাণ ও কম লাগে।
সারাবিশ্বে পোলট্রি শিল্প ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং পোলট্রি উৎপাদনকারীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। পোলট্রি শিল্পে ইঁদুর দ্বারা অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে লক্ষ্য রেখে মুরগির খামারিদের  মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমন করে এবং খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন প্রতিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করার পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং বিভিন্ন ফাঁদ ও ইঁদুরনাশক প্রয়োগ করে ইঁদুর দমন করা। বিভিন্ন পদ্ধতির সমন্বয় করে সম্মিলিত উপায়ে ইঁদুর দমন করলেই মুরগির খামারে ইঁদুরের উপদ্রব কমানো সম্ভব।

ড. মো. শাহ আলম* ড. গোবিন্দ চন্দ্র বিশ্বাস**
*ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা **প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, অনিষ্টকারী মেরুদ-ী প্রাণী বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর

বিস্তারিত
আয় বাড়াতে কাঁকড়া চাষ

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী উপাদানগুলোর মধ্যে কাঁকড়ার অবদান ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ দেশের রপ্তানিকৃত মৎস্য সম্পদের মধ্যে চিংড়ির পরেই কাঁকড়ার স্থান। আমাদের দেশে বর্তমানে উৎপাদিত কাঁকড়ার পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও কাঁকড়া রপ্তানি থেকে প্রতি বছর প্রায় ২৫ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে।  প্রজাতিভিত্তিক মিঠা ও লোনা পানির উভয় পরিবেশে কাঁকড়া বেঁচে থাকে। মিঠা পানির কাঁকড়া আকারে ছোট এবং লোনা পানির কাঁকড়া আকারে বেশ বড় হয়। এ দেশের প্রাপ্ত সর্বমোট ১৫টি প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে ৪ প্রজাতির সাধু বা মিঠা পানির কাঁকড়া এবং ১১টি প্রজাতি সামুদ্রিক। সামুদ্রিক প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁকড়া হলো ম্যাডক্র্যাব। এটি অন্যান্য প্রজাতির কাঁকড়ার তুলনায় আকারে সবচেয়ে বড় হয়ে থাকে। সেন্টমার্টিন ব্যতীত কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরিশাল, সাতক্ষীরা ও খুলনার উপকূলীয় নদীগুলো এবং মহেষখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, দুবলারচর এলাকা, উপকূলীয় চিংড়ির খামার, সমুদ্রের মোহনা, নদী এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল (সুন্দরবন) অঞ্চলে কাঁকড়ার বিস্তৃতি দেখা যায়। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত কাঁকড়া উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত পানিতে বাগদা চিংড়ির খামারে একই পরিবেশে বাগদা চিংড়ির সাথে বড় হয়ে থাকে। চিংড়ির খামারে অবাঞ্ছিত প্রাণী হিসেবে উৎপাদিত কাঁকড়া বিগত কয়েক বছর ধরে চিংড়ির মতো বিদেশে রপ্তানি শুরু হওয়ায় উপকূলবাসীর মধ্যে কাঁকড়ার চাষ সম্পর্কে গভীর আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত কাঁকড়া পরিকল্পিতভাবে চাষ করা উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মাঠ পর্যায়ে আমাদের দেশে এখনও ব্যাপকভাবে কাঁকড়ার চাষ শুরু হয়নি।
কাঁকড়া চাষের প্রধান সুবিধাগুলো
০ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কাঁকড়া চাষের পরিবেশ বিদ্যমান;
০ আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা থাকায় এর উৎপাদন লাভজনক;
০ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক পোনা (কিশোর কাঁকড়া) পাওয়া যায়;
০ কাঁকড়ার খাবার স্বল্পমূল্যে সংগ্রহ করা যায়;
০ ওজন হিসেবে কাঁকড়ার বাড়বাড়তির হার বেশি;
০ কাঁকড়া রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়;
০ কাঁকড়া পানি ব্যতীত অনেকক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে এবং প্রতিকূল পরিবেশ সহ্য করতে পারে;
০ পচা আর্বজনা খেয়ে পরিবেশ বিশুদ্ধ করে।
কাঁকড়া চাষের উপযুক্ত পরিবেশ
বাগদা চিংড়ির মতো কাঁকড়া উপকূলীয় লবণাক্ত পানিতে চাষ করা যায়। কাঁকড়া চাষের মাটি ও পানির গুণাবলি নিম্নরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মাটির গুণাবলি
০ নরম দো-আঁশ বা এঁটেল মাটি;
০ হাইড্রাজেন সালফাইড ও এমোনিয়া গ্যাসযুক্ত মাটি;
০ জৈব পদার্থ ৭% থেকে ১২%;
০ এসিড সালফেটমুক্ত মাটি;
০ হালকা শ্যাওলা ও জলজ আগাছামুক্ত পরিবেশ।
পানির গুণাবলি
০ লবণাক্ততা : ১০-২৫ পিপিটি
০ তাপমাত্রা   : ২৫-৩২ সে.
০ পিএইচ      : ৭.৫-৮.৫
০ অ্যালকালিনিটি  :  ৮০ মিগ্রা/লি.
০ হার্ডনেস : ৪০-১০০ পিপিএম
০ দ্রবীভূত অক্সিজেন  : ৪ পিপিএমের ঊর্ধ্বে
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি
কাঁকড়ার জন্য দো-আঁশ বা পলি দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে ভালো। পুকুরের আয়তন ০.২-১.০ হেক্টরের মধ্যে হলে ব্যবস্থাপনা দিক থেকে ভালো হয়। পুকুরের গভীরতা ১.০-১.৫ মিটার রাখা ভালো। জোয়ার ভাটার পানি পরিবর্তন করা যায় এমন পুকুর কাঁকড়া চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। পুকুর শুকানোর পর পাড় ভালোভাবে মেরামত করতে হবে। পুকুরে পানি প্রবেশ ও নির্গমনের জন্য পৃথক গেট থাকলে ভালো হয়। কাঁকড়ার পলায়ন স্বভাব রোধকল্পে পুকুরের চারদিকে বানা দিয়ে ঘিরে ফেলতে হবে। খরচ কমানের জন্য বানার পরিবর্তে নাইলন নেটও ব্যবহার করা যায়। মাটির পিএইচের ওপর ভিত্তি করে গুঁড়া করা পাথুরে চুন সারা পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। মাটির পিএইচ ৭-৭.৫ এর মধ্যে হলে হেক্টরপ্রতি ১২৫ কেজি চুন দিতে হবে। চুন প্রয়োগের এক দিনের মধ্যেই পুকুরের পানি তুলে ফেলতে হবে এবং ৭ দিন পর হেক্টরপ্রতি ২০-২৫ কেজি ইউরিয়া এবং ১৫ কেজি টিএসপি সার ছিটিয়ে দিতে হবে। অজৈব সার প্রয়োগের ৩ দিন পর হেক্টরপ্রতি ৭৫০ কেজি জৈবসার (গোবর) প্রয়োগ করতে হবে।
কাঁকড়া মজুদ
জৈবসার প্রয়োগের ৩ দিন পর কাঁকড়া মজুদ করতে হয়। বর্তমানে কাঁকড়া চাষ বলতে কাঁকড়া মোটাতাজাকরণকেই বোঝায়। কিশোর কাঁকড়া বাঁশের চাই বা ফাঁদ, পাতা জাল, থলে জাল দিয়ে ধরা যায়। ২০-৪০ গ্রাম ওজনের স্ত্রী ও পুরুষ কাঁকড়া মজুদের জন্য নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে স্ত্রী ও পুরুষের অনুপাত হলো ৯:১ বা ৯০% স্ত্রী এবং ১০% পুরুষ কাঁকড়া মজুদ করা হলে ভালো হয়। রপ্তানির জন্য গোনাড বিশিষ্ট স্ত্রী কাঁকড়াগুলো শনাক্ত করতে হয়। সংখ্যার দিক দিয়ে হেক্টরপ্রতি স্ত্রী ও পুরুষ কাঁকড়া প্রতি হেক্টরে মজুদের হার হলো আট থেকে দশ হাজার। কাঁকড়া সাধারণত বাঁধন কেটে বিকেল বেলা মজুদ করতে হয়।
খাদ্য প্রয়োগ
কাঁকড়া সর্বভুক প্রাণী। কাঁকড়া সাধারণত মাংসাশী জলজ প্রাণী। শামুক, ঝিনুক, ছোট কাঁকড়া এবং ছোট মাছ কাঁকড়ার প্রিয় খাবার। শামুক ঝিনুকের নরম মাংসল অংশ খেয়ে কাঁকড়ার গোনাড দ্রুত তৈরি হয়, তাছাড়া খরচও কম পড়ে। তবে শামুক ঝিনুকের বহুবিধ ব্যবহার যেমন- গলদা চিংড়ি, গামুর ও হাঁসের খাবার হিসেবে ব্যবহার এবং সর্বোপরি অঞ্চলভিত্তিক অপর্যাপ্ত প্রাপ্ততার জন্য এগুলো সর্বত্র ব্যবহার সম্ভব হয়ে ওঠে না। গবেষণাপ্রাপ্ত ফলে জানা যায়, সস্তা ও সহজলভ্যতার দিক দিয়ে মাছ ট্রাশ ফিশের বিকল্প খাবার হিসেবে আংশিকভাবে গরু ছাগলের ভুঁড়ি ও চিংড়ির মাথা (মাংসল অংশ) ফ্যাটিনিংয়ের বিভিন্ন অনুপাতে কাঁকড়ার খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যেমন- গরু-ছাগলের ভুঁড়ি ৫০-৭০% এবং ট্রাশ ফিশ ২৫-৫০%, চিংড়ির মাথা ৫০%। গবেষণাপ্রাপ্ত ফলে জানা যায়, এ খাদ্যানুপাতগুলোতে স্ত্রী কাঁকড়ার গোনাড সম্পূর্ণভাবে তৈরি হতে সময় লাগে ১৭-২১ দিন। ওই খাদ্য অনুপাতগুলোর যে কোনো একটি প্রথম দিকে প্রতিদিন কাঁকড়ার দৈহিক ওজনের ৮% হারে এবং শেষের দিকে ৫% হারে সরবরাহ করতে হবে। খাবার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ৩ ভাগ করে ১ ভাগ খাবার খুব ভোরে এবং অবশিষ্ট ২ ভাগ সন্ধ্যায় পুকুরে সরবরাহ করতে হবে।
পানি ব্যবস্থাপনা
কাঁকড়ার পুকুরে খাবার হিসেবে প্রচুর পরিমাণে প্রাণিজ মাংস সরবরাহ করতে হয়। যা দ্রুত পচনশীল, তাই কাঁকড়ার পুকুরের পানির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কাঁকড়ার ফ্যাটিনিংয়ের সময় পানির গুণাগুণ যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। অতিরিক্ত খাবার সরবরাহ করা হলেও পানি নষ্ট হতে পারে। পানির গুণাগুণ ভালো রাখতে হলে অমাবস্যা বা পূর্ণিমার জোয়ারের সময় পুকুরের পানি কিছুটা পরিবর্তন করতে হয়।
কাঁকড়া মজুদের ১০ দিন পর থেকেই কাঁকড়ার গোনাড সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়েছে কিনা তা ২-৩ দিন পর পর পরীক্ষা করতে হবে। কাঁকড়াকে বৈদ্যুতিক বাল্বের সম্মুখে ধরে দেখতে হবে কাঁকড়ার দেহের ভেতর দিকে কোনো আলো অতিক্রম করে কি না। যদি আলো অতিক্রম না করে তা হলে বুঝতে হবে কাঁকড়ার গোনাড সম্পূর্ণভাব তৈরি হয়েছে। তাছাড়া গোনাড সম্পূর্ণভাবে তৈরি হলে পুকুরে পানি উঠানোর সময় কাঁকড়া গেটের কাছে এসে ভিড় জমায়।
আহরণ ও বাজারজাতকরণ
কাঁকড়া মজুদের ৩-৪ মাস পর আহরণ করা যায়। আমাদের দেশে মার্চ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত কাঁকড়া আহরণের উপযুক্ত সময়। কারণ এ সময় পানির গুণাগুণ ও তাপমাত্রা উপযুক্ত পর্যায়ে থাকে।  কাঁকড়া ধরার আগেই পুকুরে খাবার সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে। এছাড়া স্ত্রী কাঁকড়ার গোনাড তৈরি হলে আহরণ করতে হবে। কাঁকড়া আহরণের লক্ষ্যে পুকুরে পানি প্রবেশ করাতে হবে যাতে কাঁকড়া স্রোতের বিপরীতে গেটের কাছে এসে ভিড় করে। এ সময়ে থোপা (লাঠির মাথায় সুতা দিয়ে বাঁধা মাছের মাথা, ব্যাঙ বা গরু-ছাগলের চামড়াকে স্থানীয় ভাষায় থোপা বলে) দিয়ে কাঁকড়াকে প্রলুব্ধ করে হাতজাল দিয়ে ধরতে হবে। কাঁকড়া ধরার সাথে সাথে বিশেষ নিয়মে কাঁকড়ার পাসহ বেঁধে ফেলতে হবে। ধৃত কাঁকড়া ডিপোতে বাছাই করে গ্রেডিং অনুযায়ী বিক্রি করতে হবে।
কাঁকড়া চাষের উপযুক্ত পরিবেশ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে রয়েছে। সঠিক ব্যবস্থাপনায় চাষ করা গেলে প্রতি কেজি কাঁকড়া অধিক মূল্যে বিক্রি করা যায়। বা বিদেশে রপ্তানি করে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উপযুক্ত কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে সঠিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় কাঁকড়া সম্পদকে লাভজনক শিল্পে পরিণত করা যাবে।

বিমল চন্দ্র সরকার*
* সাবেক সহকারী তথ্য অফিসার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, আঞ্চলিক অফিস, বরিশাল, মোবাইল : ০১৭১৮-৫০৬৭৬১

বিস্তারিত
কবিতা ১৪২৩

ইঁদুর
মো. দুলা মিঞা*

রোডেনসিয়া বর্গ তাদের মিউরিডি পরিবার,
ছেদনদন্ত আছে ওদের, এই পরিচয় তাদের।
স্বভাব তাদের কাটাকাটি, মলত্যাগ বারবার,
রাত্রিবেলা আড়াল পথে নিরাপদে চলবার।
আসবাবপত্র, কাপড়চোপড়, নালায়, চালায়
টাকা, বই, দলিলেও বারে বারে দন্তচালায়।
কাটে বাঁধ, ভীত আর ক্যাবল শুধু নয়
নালা কেটে করে তারা সেচের অপচয়।
ঘরে কাটে, মাঠে কাটে, গাছে কাটে ভাই
ফল আর ফসল শুধু নয়, সবই কাটা চাই।
কেটে করে সর্বনাশ অর্থ, সম্পদ, ফসলের
মল তাদের কারণ হয় পরিবেশ দূষণের।
রোগ বিস্তার করে ক্রান্ত কপাল ভাঙে কৃষকের
আরামের ঘুম হারাম করে সর্বস্তরের মানুষের।
ঘরের ইঁদুর, গাছের ইঁদুর, মাঠের ইঁদুর ভাই
সবাই মোদের জ্ঞাত শত্রু, কাউকে খাতির নাই।
ইঁদুরকুলের চিরশত্রু মোদের বন্ধু ভাই
সাপ, গুঁইসাপ, শেয়াল, বেজি, পেঁচককে বাঁচাই।
বিড়াল পোষে, ফাঁদ পেতে ইঁদুর মারায় নেই লাজ,
ইঁদুরনাশক ব্যবহারে ইঁদুর মারা সহজ কাজ।
হ্যামিলনের বংশীবাদক ইঁদুরের এখন নয় জম,
দামালদের লাঠির আঘাতেই ইঁদুর বেটারা হয় খতম।
ইঁদুর করে অপচয়, হয় রোগের কারণ
সবে মিলে চল ভাই, করি ইঁদুর নিধন॥

 

দাওয়াত মেহমান ইঁদুর
মো. আনোয়ার উদ্দিন
**
খাদ্য প্রনালি ভিন্ন ধারায় ভিন্ন-ভিন্ন কালে
কেমন জনে কেমন খাবে, জিজ্ঞাসিব নতুন হালে
অতি স্মরণীয় রবির ছোঁয়ায় কেন আহাজারি?
বর্গা চাষিদের ভেঙে দাঁত টিকে রাখি সোনালি শাড়ি।
দাওয়াতবিহীন জামাই বাবু দেয় চুপি দুয়ারে দুয়ারে,
যোগ্য মাত্রা উৎসব কয়টিতে করে মিছিল গম-ধান মাড়াতে।
চলার পথে যদিও জানি তারা বামপন্থী,
মিষ্টিভাষায় মধ্যাহ্নভোজে রাখি তাদের সরল নীতি।
কুশলাদি শুরুতে জিং ফসফেট দেই ধরিতে টুথ ব্রাশ,
ধ্বনী শুনি করুণ সুরে বলে তারা দাওনা প্রাণের অবকাশ।
প্রেক্ষাপটে বলি তাদের, ডাক্তার বলেন খেতে তা ভরা পেটে,
করেছি ভুল, দিয়েছি শুল, খেতে দিয়ে তোদের খালি পেটে॥

 

ইঁদুর দমন
বিজয় কুমার দেব***

ও আমার চাষি ভাই
ইঁদুরকে নিধন করা চাই
তাহারে আর কোন ক্ষমা নাইরে, চাষি ভাই
ইঁদুরকে নিধন করা চাই।।
বারো লক্ষ টন খাদ্যশস্য
ইঁদুরে ভাই করে নষ্ট
তাহারে আর কোন রক্ষা নাইরে, চাষি ভাই
ইঁদুরকে নিধন করা চাই।।
বাচ্চা প্রসবের দুই মাস পরে
ইঁদুর গর্ভধারণ করতে পারে
এক বছরে তিন হাজার বাচ্চা দিতে পারে তাইরে, চাষি ভাই
ইঁদুরকে নিধন করা চাই।।
আইলের ধারে, বাঁধের ধারে
ইঁদুর থাকে ঝোপ জঙ্গলে
সমন্বিত হয়ে সবাই ইঁদুর মারা চাইরে চাষি ভাই
ইঁদুরকে নিধন করা চাই।।
প্লেগ রোগেরই প্রথম শত্রু
ইঁদুরে ভাই ছড়ায় কিন্তু
তাইতো ইঁদুর নিধন করতে পণ থাকা চাইরে, চাষি ভাই
ইঁদুরকে নিধন করা চাই।।
কাঁথা কাটে বালিশ কাটে
খাবার দাবার নষ্ট করে
ইঁদুর যা খায় তার বেশি ছড়ায়রে, চাষি ভাই
ইঁদুরকে নিধন করা চাই।।
ইঁদুরের আছে অনেক জাত
বাতিয়ারা ইঁদুর বড়ই বজ্জাত
ঘরের পণ্য নষ্ট করতে সে খুবই ওস্তাদরে, চাষি ভাই
ইঁদুরকে নিধন করা চাই।।
ইঁদুর মারার পণ
রাখতে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ
ইঁদুর মেরে সোনার ফসল তুলব যে সবাইরে, চাষি ভাই
ইঁদুরকে নিধন করা চাই॥


*উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা। ** ইঁদুর নিধন সনদপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী, গণপূর্ত বিভাগ-১, শে.বা.ন., জাতীয় সংসদ সচিবালয়, ঢাকা। ***বিজয় কুমার দেব, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, রাজনগর, মৌলভীবাজার।

বিস্তারিত
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC)

(সাত বছরের সাফল্য)
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও সহযোগী সংস্থাগুলোকে জাতীয় নীতিমালার ভিত্তিতে গবেষণা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ, গবেষণা কর্মকা- পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন, কর্মসূচি সমন্বয় এবং কৃষি গবেষণার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করে থাকে। দেশের সামগ্রিক কৃষি গবেষণাকে অধিকতর গতিশীল, যুগোপযোগী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কার্যপরিধি বর্ধিত, সুসংহত ও জোরদার করে কাউন্সিলকে অধিকতর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কাউন্সিল খাদ্য উৎপাদন ও দারিদ্র্য নিরসনে বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ ও অগ্রাধিকারের আলোকে সরকারকে পরামর্শ প্রদান করে আসছে। এছাড়া কাউন্সিল কৃষি গবেষণা সিস্টেমের গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের মানবসম্পদ উন্নয়নের কাজ সম্পাদন করে থাকে।
কোর গবেষণা, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন
এ সময়ে কৃষি গবেষণাসহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ৭০টি কোর গবেষণা ও প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ১৫টি জাতসহ দক্ষিণাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চলে চাষাবাদের উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। এ ছাড়া ৪৩ জন বিজ্ঞানীকে দেশের অভ্যন্তরে পিএইচডি অধ্যয়নের সুযোগ দেয়া হয়েছে। তদুপরি দেশীয় প্রশিক্ষণ, কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে মোট ১ হাজার বিজ্ঞানী/সম্প্রসারণবিদ/ কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
ধান ও ডাল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কর্মসূচি
এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ধান ও ডাল ফসলের উন্নত প্রযুক্তি, সমন্বিত শস্য উৎপাদন ও বালাইব্যবস্থাপনা, মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও বিতরণ এবং ডালের সাথে উন্নত শস্যবিন্যাস প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ধান ও ডাল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে ওই ফসলগুলোর উৎপাদন যথাক্রমে  ১৭.৫% ও ১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।
এগ্রিকালচারাল বায়োটেকনোলজি সাপোর্ট প্রজেক্ট (Agriculter Biotechnology Support Project)
কাউন্সিল ২০০৫ সাল থেকে এ প্রকল্পের বাংলাদেশ অংশের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছে। এ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক সরকারের অনুমোদনক্রমে ৪টি বিটি বেগুনের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে ও এগুলো সম্প্রসারণের কার্যক্রম চলছে।
এশিয়ান ফুড সিকিউরিটি প্রকল্প
এশিয়ান ফুড সিকিউরিটি (আফাসি) শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১০ সাল থেকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ধান ও গমের প্রতিকূল আবহাওয়ার জাত উন্নয়নসহ পরিচর্যা কলাকৌশল নির্ধারণপূর্বক বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকের মাঝে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক ধান ও গমের মাঠ প্রদর্শনী এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক ধান ও গমের বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাপসহিষ্ণু গমের জাত (বারিগম-২৫, ২৬) এবং ধানের জাতসহ (ব্রিধান-৪৭, ব্রিধান-৫৫ এবং বিনাধান-৮) বেশ কিছু উন্নত প্রযুক্তি দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্প-১
জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্প (National Agriculter Technology Project (NATP) শীর্ষক প্রকল্পটির আওতায় দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দ্বারা ১০৮টি গবেষণা কার্যক্রম (শস্য, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য, খাদ্য পুষ্টি, আর্থসামাজিক ও বাজার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি) মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন হয়েছে। এনএটিপি-১ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার মাধ্যমে ৫০টিরও অধিক সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২৯ জন বিজ্ঞানীকে বিদেশে পিএইচডি, ১০ জনকে বিদেশে পোস্ট-ডক্টোরাল এবং ৭৯ জনকে দেশে পিএইচডি অধ্যয়নের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে।
প্রতিযোগিতামূলক গবেষণা কার্যক্রম
কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কোম্পানি আইনের আওতায় কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (KGF) গঠন করা হয়। বিএআরসি কর্তৃক কৃষি গবেষণার অগ্রাধিকার নির্ধারিত হওয়ার পর কেজিএফ বোর্ড ২০০৯ সাল থেকে দুই পর্যায়ে অদ্যাবধি ১০১টি প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করে। এ কার্যক্রমের আওতায় এ পর্যন্ত মসুর ও রসুনের ৩টি নতুন জাত উদ্ভাবনসহ লবণাক্ত, খরা ও পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি নির্বাচন করা হয়েছে।
কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তর প্রকল্প
এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রযুক্তি বিশোধন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের আওতায় শস্য, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য সম্পদ ও কৃষি বনায়ন কার্যক্রমে মোট ৫৫টি প্রযুক্তি ৪৩টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। উপযুক্ত প্রযুক্তির ওপর ১৬,৭৪৪ জন  কৃষককে প্রশিক্ষণ, ১১,৮৪০টি মাঠ দিবস আয়োজন এবং ৭৬৭টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
নীতিনির্ধারণী ডকুমেন্ট, আইন ও গাইডলাইন প্রণয়ন
কাউন্সিল বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে জাতীয় কৃষিনীতি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল আইন ২০১২, মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০২৫, কৃষি গবেষণা অগ্রাধিকার ও ভিশন ডকুমেন্ট ২০৩০, নার্সারি আইন/গাইডলাইন-২০০৭, Intellectual Property Rights (IPR) Rules এবং Biotechnology and Biosafety Regulation & Act, Crop Zoning ম্যাপসহ বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী ডকুমেন্ট প্রণয়নসহ তথ্য ও পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে সরকারকে সক্রিয় সহায়তা করছে।
জমির উপযোগিতাভিত্তিক ক্রপ জোনিং ম্যাপ প্রণয়ন
মাটি, জলবায়ু ও এলাকা উপযোগী ফসল নির্বাচন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশে ক্রপ জোনিং ম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। এনএআরএস প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে এসআরডিআই, বিএআরআই এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় বিএআরসি কর্তৃক এ ম্যাপ তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এ ম্যাপ অনুসরণ করে এলাকাভিত্তিক উপযোগী ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করার কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
সার এবং সারজাতীয় দ্রব্যের মান নির্ধারণ
বিগত ২০০৭ সালে থেকে হাল নাগাদ বিএআরসি কর্তৃক জৈবসার ৭০টি; রাসায়নিক সার ২টি ও চএজ: ৮টি মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং জাতীয় সার প্রমিতকরণ কমিটি কর্তৃক  অনুমোদিত ও দেশে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত  করা হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রম
কাউন্সিল জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কৃষি গবেষণা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের তথ্য/উপাত্ত যেমন- গবেষণালব্ধ ফলাফল/প্রযুক্তি, অর্থ ব্যবস্থাপনা, ক্রয়, মানবসম্পদ, প্রকাশনা ইত্যাদি ডাটাবেজ স্থাপনের মাধ্যমে সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং তা সরবরাহ সেবা প্রদান করে থাকে। তথ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম কার্যকরীভাবে পরিচালনা করার মাধ্যমে ICTকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে কাউন্সিলসহ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে ICT এবং MIS Cell গঠন করা হয়েছে এবং এর বাস্তবায়নের জন্য কাউন্সিলে ডাটা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কাউন্সিলে জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমের (GIS) কাজ অব্যাহত আছে।
ডিজিটাল  ডিসপ্লে কেন্দ্র স্থাপন   
কৃষির ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাফল্যগাথা, কৃষি উপকরণ, ফসলের জাত, উৎপাদন কলাকৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে ছাত্র-শিক্ষক, বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণবিদ, কৃষকসহ দেশি-বিদেশি পরিদর্শকদের মাঝে বাস্তব ধারণা দেয়ার মাধ্যমে কৃষি বিষয়ে আগ্রহ তৈরি এবং উদ্বুদ্ধকরণে বিএআরসির চত্বরে জাতীয় কৃষি প্রদর্শনী কেন্দ্র (NADC) স্থাপন করা হয়েছে, যা কৃষি বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
ফসলের জাত ছাড়করণ, বীজ উৎপাদন ও মান নিশ্চিতকরণ
বিগত ৭ বছরে এই কমিটির মাধ্যমে বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত ১৭০টিরও বেশি জাত ছাড়করণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

বৃহত্তর বরিশাল ও সিলেট জেলার পতিত জমির পরিমাণ নির্ধারণ ও ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা
দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণকল্পে কিছু এলাকার পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় এনে উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। লাগসই কৃষি প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় এনে উৎপাদন বৃদ্ধি করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জীবন ও জীবিকার মান উন্নয়ন করাই এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য।
গবেষণা-সম্প্রসারণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রম সমন্বয়
গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে কাউন্সিলের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কৃষি কারিগরি সমন্বয় কমিটি (National Agricultural Technical Coordination Committee-NATCC গঠিত আছে। এই কমিটি বিভিন্ন কৃষি কারিগরি কমিটির (Agricultural Technical Committee) কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে।
আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা
কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সম্প্রতি আমেরিকা, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ভুটান, ভিয়েতনামের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে।  তাছাড়া আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা সংস্থাসমূহ যেমন- (IRRI, CIMMYT, World Fish ইত্যাদির সাথে সহযোগিতামূলক কর্মকা- জোরদার করা হয়েছে। এ সহযোগিতার মাধ্যমে জার্মপ্লাজম এবং দক্ষতা উন্নয়ন ও কারিগরি জ্ঞান বিনিময়ে প্রতিটি দেশ উপকৃত হচ্ছে।
নিরাপদ ও সুষম খাবার গ্রহণে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ‘ফুড প্লেট’ তৈরি
পুষ্টি জ্ঞানের প্রচার, প্রসার ও নিরাপদ খাদ্য গ্রহণে জন সচেতনতা সৃষ্টিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের  পুষ্টি ইউনিট একটি সচিত্র ‘ফুড প্লেট’ তৈরি করেছে। সুস্থ, সবল থাকতে ও অসুখ-বিসুখ হতে রক্ষা পেতে সুষম খাবার গ্রহণের অত্যাবশ্যকতা ও নিরাপদ খাদ্য গ্রহণে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ইতোমধ্যে এ ‘ফুড প্লেট’ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারসহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিতরণ ও প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং যা ইতোমধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
অন্যান্য  প্রকাশনা
গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য জমির স্থানীয় তথ্যের ভিত্তিতে সার সুপারিশমালা (Fertilizer Recommendation Guide-2012) প্রণীত হয়েছে। দারিদ্র্যবিমোচনে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ পুস্তক প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ফসল নিবিড়তা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ‘দক্ষিণাঞ্চলের উপযোগী কৃষি প্রযুক্তি’ শীর্ষক একটি পুস্তক প্রকাশ করা হয়েছে।
বিভিন্ন ফসলের উন্নত জাত এবং এগুলোর পরিচিতি ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনা সমন্বয়ে  ‘Plant vatieties developed by NARS institutes and Agrictural universities’ শীর্ষক একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়েছে। বিভিন্ন কৃষি প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে প্রসারের লক্ষ্যে ‘Hand book of Agricultural Technology’ শীর্ষক একটি পুস্তক প্রকাশ করা হয়েছে। পতিত জমির ব্যবহারের লক্ষ্যে বৃহত্তর বরিশাল ও সিলেট জেলার পতিত জমির পরিমাণ নির্ধারণ ও ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা বিষয়ে ডকুমেন্ট প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে বিএআরসি কর্তৃক Mature Technologies of the NARS Institutes শীর্ষক একটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

*সংকলিত, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫; www.barc.gov.bd

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর নিয়মিত (বিভাগ)

মো. শরিফুল ইসলাম
গ্রাম-পানচুর
উপজেলা-লোহাগড়া
জেলা-নড়াইল
প্রশ্ন : আদা গাছের গোড়া পচে যাচ্ছে, কী করব?
উত্তর : আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে বা নষ্ট করে ফেলতে হবে। রোগমুক্ত গাছ থেকে কন্দ সংগ্রহ করতে হবে। কাঁচা গোবর পানিতে গুলে কন্দ শোধন করে ছায়ায় শুকিয়ে ব্যবহার করতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম কম্প্যানিয়ন বা নোইন বা রিডোমিল গল্ড বা ডাইথেন এম-৪৫ বা ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট বা ১% বর্দোমিশ্রণ মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
দীপঙ্কর সরকার
গ্রাম-লতাখামার
উপজেলা-দৌলতপুর
জেলা-খুলনা
প্রশ্ন : করলা গাছের পাতা গুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে এবং গাছ বাড়ছে না, কী করব?
উত্তর : আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে নষ্ট বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। ক্ষেতের আশপাশের আগাছা  পরিষ্কার করতে হবে। বাহক পোকা ধ্বংস করার জন্য বালাইনাশক যেমন- এসাটাফ, টিডো, এডমায়ার প্রয়োগ করতে হবে। টেট্টাসাইক্লিন বা লেডার মাইসিন (৫০০ পিপিএম বা ০.৫ গ্রাম/ লিটার পানি) ছিটিয়ে রোগ দমনে ভালো ফল পাওয়া যায়।
সফিকুল ইসলাম
জেলা-পঞ্চগড়
উপজেলা-দেবীগঞ্জ
গ্রাম-শালডাঙ্গা
প্রশ্ন : মাছ চাষ পানির পিএইচ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে?
উত্তর : পুকুর বা খামার তৈরির সময়  কেজি/প্রতি শতকে ১ কেজি হারে চুন ৩-৫ ফুট পানির গভীরতায় প্রয়োগ করতে হবে। মজুদ পরবর্তীতে প্রতি শতকে ২৫০-৫০০ গ্রাম/প্রতি শতকে হারে প্রয়োগ করতে হবে। পানির পিএইচ পরীক্ষা করে যদি ৬ এর নিচে থাকে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
চুনের পরিবর্তে জিওটক্স/জিওলাইট শতাংশে ২৫০ গ্রাম/ প্রয়োগ করা যেতে পারে।
এছাড়াও বায়োকেয়ার প্রতি ৭ দিন অন্তর ৮০-১২০ মিলি./প্রতি শতকে হারে দিতে হবে প্রতিষেধক হিসেবে। আর নিরাময়ের জন্য পর পর ২ দিন ১২০-১৬০ মিলি./প্রতি শতকে হারে প্রয়োগ করতে হবে।
আবদুর রহিম
জেলা-চাঁদপুর
উপজেলা-ফরিদগঞ্জ
গ্রাম-কড়ইতলী
প্রশ্ন : পুকুরের পানি ঘোলা হলে কী কী করণীয়?
উত্তর : পোড়া চুন ১-২ কেজি/প্রতি শতকে বা জিপসাম ১.৫-২ কেজি/ শতক হারে প্রয়োগ করতে হবে। ফিটকিরি ২৪০-২৪৫ গ্রাম/ প্রতি শতকে  ৩০ সেমি. গভীরতায় প্রয়োগ করতে হবে। পানি পরিবর্তন করা বা খাদ্য কমিয়ে দিতে হবে। পুকুর তৈরির সময় জৈবসার বেশি ব্যবহার করতে হবে। পানি পরিবর্তন বা নতুন পানি সংযোগ করতে হবে।
আবদুল রফিক
গ্রাম-পূর্ব তিমিরপুর
উপজেলা-নবীগঞ্জ
জেলা-হবিগঞ্জ
প্রশ্ন : পটোল গাছের কা- থেকে আঠা ঝরছে, এবং বাকল ফেটে কষ পড়ছে। কী করণীয়?
উত্তর : এটি পটোলের ছত্রাকজনিত রোগ        এজন্য-
-  আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট করতে হবে।
- আক্রান্ত কাণ্ডে বর্দোমিশ্রণ (১%) বা কুপ্রাভিট (০.৪%) স্প্রে করতে হবে;
-  রোগমুক্ত গাছ থেকে কাটিং সংগ্রহ করতে হবে।
কানাইলাল বিশ্বাস
গ্রাম-করগাদি
উপজেলা-মধুখালি
জেলা-ফরিদপুর
প্রশ্ন : ধানের গুদামে ইঁদুরের আক্রমণে ধানের ক্ষতি হচ্ছে। ইঁদুর দমনে কী করণীয়?
উত্তর :
- ঘরবাড়ি, গুদাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা;
- সম্ভব হলে শস্য টিনের পাত্রে সংরক্ষণ করা;
- ড্রাম বা গোলা মাচার ওপর সংরক্ষণ করা;
- বিভিন্ন প্রকার ফাঁদ ব্যবহার করা;
- গ্লুবোর্ড (আঠা বোর্ড) ব্যবহার করা;
- তীব্র বিষ হিসেবে জিংক ফসফাইড (২%) বিষটোপ হিসেবে ব্যবহার করা।
মমতাজ বেগম
গ্রাম-শালগাড়িয়া
উপজেলা-পাবনা সদর
জেলা-পাবনা
প্রশ্ন : আম গাছের বয়স ২/৩ বছর। হঠাৎ করে চারা গাছের আগা শুকিয়ে আসছে। কী করলে উপকার পাবো।
উত্তর : এ রোগটি আম গাছের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক ও অধিকাংশ জাতে কমবেশি দেখা যায়। গাছের যে কোনো বয়সে এ রোগটি হতে পারে। আক্রান্ত গাছের আগা মরে যায় যাকে ডাইব্যাক বলে। কচি পাতা শাখা-প্রশাখা, কা-, মুকুল ও ফল আক্রান্ত হয়।
রোগাক্রান্ত ডালপালা কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত পাতা দেখলেই ব্যাভিস্টিন বা নোইন ২০ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
লিটন রায়
গ্রাম-বেলাই
উপজেলা-দিনাজপুর সদর
জেলা-দিনাজপুর

প্রশ্ন : পেঁপে গাছের ফল পচে ঝরে যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটা পেঁপের ফল পচা বা পেঁপের অ্যানথ্রাক্সনোজ রোগ। পাতা, বোঁটা, ফলে বাদামি দাগ দেখা যায়। পাকা ফলে কালো দাগ হয়। আক্রান্ত অংশগুলো সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে বা পুড়ে ফেলতে হবে। গাছে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম কার্বেনন্ডাজিম (ব্যাভিস্টিন বা নোইন) জাতীয় ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ১০-১২ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে। ফল সংগ্রহের অন্তত ২০ দিন আগে স্প্রে বন্ধ করতে হবে।
সুমন
গ্রাম-নকীপুর
উপজেলা-শ্যামনগর
জেলা-সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : গরুকে পাগলা কুকুর কামড় দিয়েছে। কী করব?
উত্তর : কামড়ানো জায়গা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণ দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। রেবিসিন ১০ সিসি ১০০ কেজি ওজনের জন্য ১ম দিন ৪ সিসি, ৭ম দিন ৩ সিসি এবং ২১তম দিন  ৩ সিসি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে।
আরিফ
গ্রাম-লেবুখালী
উপজেলা-দুমকী
জেলা-পটুয়াখালী
প্রশ্ন : আর্থ্রাইটিস/ গিরা ফোলা রোগে কী করব?
উত্তর : এ রোগের আক্রমণে : পায়ের গিরা ফুলে যায়, পানি জমে থাকে, ব্যথা হয়, খুঁড়িয়ে হাঁটে।
- অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক এসিড প্রতিবার ১ গ্রাম করে দিনে ২-৩ বার খাওয়ানো যেতে পারে।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম, নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, পর্যাপ্ত সুষম খাদ্য এবং ওষুধ প্রয়োগ করে এ রোগের চিকিৎসা করা যায়।
- ডিসপিরিন ট্যাবলেট ০.৩ গ্রাম হিসেবে দিনে ৩ বার খাওয়ার পর দেয়া যেতে পারে।

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
*সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫  ধরড়পঢ়@ধরং.মড়া.নফ

বিস্তারিত
কার্তিক মাসের কৃষি

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সবাইকে হৈমন্তীয় শুভেচ্ছা। হেমন্ত বাংলা ঋতুচক্রের এক কাব্যিক উপাখ্যান। সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যে হেমন্ত যেমন সুন্দরের কাব্য শশি তেমনি কৃষি ভুবনের চৌহদ্দিতে কাজে কর্মে ব্যস্ততায় এক স্বপ্নীল মধুমাখা আবাহনের অবতারণা করে। সোনালী ধানের সম্ভার সৃঘ্রাণে ভরে থাকে বাংলার মাঠ প্রান্তর। কৃষক মেতে ওঠে ঘাম ঝরানো সোনালী ফসল কেটে মাড়াই ঝাড়াই করে শুকিয়ে গোলা ভরতে আর সাথে সাথে শীতকালীন ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো শুরু করতে। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই কার্তিক মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।

আমন ধান

  • এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে।
  • আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ্য সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালমত শুকাতে হবে।
  • শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিস্কার করতে হবে এবং ছায়ায় রেখে ঠান্ডা করতে হবে।
  • পরিস্কার ঠান্ডা ধান বায়ু রোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
  • বীজ রাখার পাত্র টিকে মাটি বা মেঝের উপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখতে হবে।
  • পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে হলে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুড়ো করে মিশিয়ে দিতে হবে।

গম

  • কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিতে হয়।
  • দো-আঁশ মাটিতে গম ভাল হয়।
  • অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিত জাত যেমন- আনন্দ, বরকত, কাঞ্চন, সৌরভ, গৌরব রোপন করতে হবে।
  • বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাক নাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে।
  • সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘা প্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে।
  • ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরীর শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
  • বীজ বপনের ১৩-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভাল ফলন পাওয়া যায়।

আখ

  • এখন আখের চারা রোপনের উপযুক্ত সময়।
  • ভালভাবে জমি তৈরী করে আখের চারা রোপন করা উচিত।
  • আখ রোপনের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সে.মি থেকে ১২০ সে.মি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সে.মি। এভাবে চারা রোপন করলে বিঘাপ্রতি ২২০০-২৫০০ চারার প্রয়োজন হয়।

ভুট্টা

  • ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে এবং জমি তৈরি করে  বীজ বপন করতে হবে।
  • ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫ এসব।

সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল

  • কার্তিক মাস সরিষা চাষেরও উপযুক্ত সময়।
  • সরিষার প্রচলিত জাতগুলোর মধ্যে টরি-৭, রাই-৫, কল্যাণীয়া, সোনালি, সম্পদ, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭, বারি সরিষা-৮ উল্লেখযোগ্য।
  • বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে টরি-৭, বারি সারিষা-৯ বা কল্যাণীয়া টিএস-৭২ রোপণ করুন।
  • জাতভেদে সামান্য তারতম্য হলেও বিঘাপ্রতি গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি সরিষার বীজ প্রয়োজন হয়।
  • বিঘা প্রতি ৩৩-৩৭ কেজি ইউরিয়া, ২২-২৪ কেজি টিএসপি, ১১-১৩ কেজি এমওপি, ২০-২৪ কেজি জিপসার ও ১ কেজি দস্তা সারের প্রয়োজন হয়।
  • সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসল যেমন- তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী এ সময় চাষ করা যায়।

আলু

  • আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত সময় এ মাসেই।
  • হালকা প্রকৃতির মাটি অর্থাৎ বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী।
  • ভাল ফলনের জন্য বীজ আলু হিসেবে যে জাতগুলো উপযুক্ত তাহলো ডায়মন্ড, মুল্টা, কার্ডিনাল, প্যাট্রেনিজ, হীরা, মরিণ, অরিগো, আইলশা, ক্লিওপেট্রা, গ্রানোলা, বিনেলা, কুফরীসুন্দরী এসব।
  • প্রতি বিঘা জমি আবাদ করতে ৬০০-৮০০ কেজি বীজ আলুর দরকার হয়।
  • এক বিঘা জমিতে আলু আবদ করতে ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি, ১০০ কেজি এমওপি, ৬০ কেজি জিপসাম এবং ৬ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন হয়। তবে এ সারের পরিমান জমির অবস্থাভেদে কম-বেশি হতে পারে। তাছাড়া বিঘাপ্রতি ৪-৫ টন জৈব সার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়।
  • আলু উৎপাদনে আগাছা পরিস্কার, সেচ, সারের উপরি প্রয়োগ, মাটি অলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যকীয় কাজ।
  • বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে মালচিং দিয়ে আলু আবাদ করা যায়।

মিষ্টি আলু

  • নদীর ধারে পলি মাটিযুক্ত জমি এবং বেলে দো-আঁশ প্রকুতির মাটিতে মিষ্টি আলু ভাল ফলন দেয়।
  • তৃপ্তি, কমলা সুন্দরী, দৌলতপুরী, বারি মিষ্টি আলু-৪, বারি মিষ্টি আলু-৫, বারি মিষ্টি আলু-৬, বারি মিষ্টি আলু-৭, বারি মিষ্টি আলু-৮, বারি মিষ্টি আলু-৯, বারি মিষ্টি আলু-১০, বারি মিষ্টি আলু-১১, বারি মিষ্টি আলু-১২ ও বারি মিষ্টি আলু-১৩ আধুনিক মিষ্টি আলুর জাত।
  • প্রতি বিঘা জমির জন্য তিন গিটযুক্ত ২২৫০-২৫০০ খন্ড লতা পর্যাপ্ত।
  • বিঘাপ্রতি ৪-৫টন গোবর/জৈবসার, ১৬ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে।

ডাল ফসল

  • মুসুর, মুগ, মাসকলাই, খেসারি, ফেলন, অড়হর, সয়াবিন, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল এসময় চাষ করতে পারেন।
  • এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময় মত বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে।

শাক-সবজি

  • শীতকালীন শাকসবজি চাষের উপযুক্ত সময় এখন।
  • যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীজতলায় উন্নতজাতের দেশী-বিদেশী ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, বাটিশাক, টমাটো, বেগুন এসবের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে।
  • আর গত মাসে চারা উৎপাদন করে থাকলে এখন মূল জমিতে চারা রোপন করতে পারেন।
  • মাটিতে জোঁ আসার সাথে সাথে শীতকালীন শাকসবজি রোপণ করতে হবে।
  • এ মাসে হঠাৎ বৃষ্টিতে রোপণকৃত শাকসবজির চারা নষ্ট হতে পারে। এ জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • রোপনের পর আগাছা পরিস্কার, সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।
  • তাছাড়া লালশাক, মূলাশাক, গাজর, মটরসুটির বীজ এ সময় বপন করতে পারেন।

অন্যান্য ফসল

  • অন্যান্য ফসলের মধ্যে এ সময় পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ধনিয়া, কুসুম, জোয়ার এসবের চাষ করা যায়।
  • সাথী বা মিশ্র ফসল হিসেবেও এসবের চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়।
  • বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে জমিতে পানি কচু বপন করতে পারেন।
  • সেচ নালা সংস্কার ও মেরামত করতে হবে।

প্রাণিসম্পদ

  • সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায়।
  • রাণীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড,  বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • গত মাসে ফুটানো মুরগির বাচ্চার ককসিডিয়া রোগ হতে পারে। রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসা করাতে হবে।
  • গবাদিপ্রাণির আবাসস্থল মেরামত করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
  • গবাদিপ্রাণিকে খরের সাথে তাজা ঘাস খাওয়াতে হবে।
  • ভুট্টা, মাসকালাই, খেসারি রাস্তার ধারে বা পতিতজায়গায় বপন করে গবাদিপ্রাণিকে খাওয়ালে স্বাস্থ্য ও দুধ দুটোই বাড়ে।
  • রাতে অবশ্যই গবাদিপ্রাণিকে বাহিরে না রেখে ঘরের ভিতরে রাখতে হবে। তা নাহলে কুয়াশায় ক্ষতি হবে।
  • গবাদিপ্রাণিকে এ সময় কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে।
  • এছাড়া তড়কা, গলাফুলা রোগের বিষয়ে সচেতন থাকলে মারাত্মক সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।

মৎস্যসম্পদ

  • এ সময় পুকুরে আগাছা পরিস্কার, সম্পূরক খাবার ও সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • জাল টেনে মাছের স্বাস্থ পরীক্ষা করাও জরুরী।
  • রোগ প্রতিরোধের জন্য একরপ্রতি ৪৫-৬০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে পারেন।
  • অংশঅদ্বারিত্বের জন্য যেখানে যৌথ মাছ চাষ সম্ভব নয় সেখানে খুব সহজে খাঁচায় বা প্যানে মাছ চাষ করতে পারেন।
  • এছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোন পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি নিশ্চিত মৌসুম। যতবেশি যৌক্তিক বিনিয়োগ করতে পারবেন লাভও পাবেন তত বেশি। শুকনো মৌসুম বলে মাটিতে রস কম থাকে। তাই যদি প্রতি ফসলে চাহিদা মাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে আপনার জমির ফলন অনেক বেড়ে যাবে। একমাত্র কৃষির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক কৃষির সবকটি কৌশল সঠিক সময়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত গস্তব্যে পৌছতে পাবরো। কৃষির যে কোন সমস্যায় ১৬১২৩ নম্বরে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন

তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত