Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সম্পাদকীয়

ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুসহ বাংলা ভাষা মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষা শহীদদের গভীরভাবে স্মরণ করছি এবং জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের কৃষি, সংস্কৃতি, অর্থনীতির ভিত্তিই হচ্ছে কৃষি। ফাল্গুন রবি মৌসুমের শেষ মাস। এ সময় বিভিন্ন ফসল চাষাবাদের পাশাপাশি শাকসবজির প্রাধান্য থাকে মাঠে ও স্থানীয় বাজারগুলোতে। শাকসবজি মোট উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ রবি মৌসুমে হয়ে থাকে। শাকসবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খণিজ পদার্থসহ অন্যান্য অনেক পুষ্টি উপাদান। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রায় ১৩১টি জাত এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত জাত মিলে দেশে প্রায় ১৮২ জাতের সবজি উৎপাদন হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে শাকসবিজর উৎপাদন হয়েছে ২১৬.৭০ লক্ষ মে.টন। বিগত ১২ বছরে শাকসবজির উৎপাদন প্রায় ৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে (ডিএই)। যার ফলে শাকসবজি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।
স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি সাথে সাথে খাদ্য তালিকায় নিরাপদ সবজির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী সংঘাত, মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানামুখী বিরূপ সংকট বিরাজমান। এ অনাগত সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি জনগণের পুষ্টি স্তর উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম অভীষ্ট। সে লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সকল অংশীজনের অংশগ্রহণে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে নিরাপদ সবজি উৎপাদন, সংগ্রহোত্তর ও বাজার ব্যবস্থাপনা এবং রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধিতে অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব ও আধুনিক প্যাকিং হাউজ সক্ষমতাসহ নানামুখী কার্যক্রম অব্যাহত আছে। ‘বাংলাদেশের নিবিড় সবজি উৎপাদনে সাফল্য’ নিবন্ধটিতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবারে কৃষিকথায়। এ ছাড়াও কৃষি বিশেষষ্ণগণের সময়োপযোগী প্রবন্ধ, নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এ বারের সংখ্যা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পরবর্তী কৃষির উন্নয়নে ১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর পদ মর্যাদা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু এ অবদান স্মরণীয় করে রাখতে ২০১১ সাল থেকে কৃষিবিদরা এ দিনটিকে  কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। সবার জন্য রইল কৃষিবিদ দিবস ও ফাল্গুনের শুভেচ্ছা।

বিস্তারিত
সূচিপত্র

 

নিবন্ধ
    
   নিরাপদ সবজি চাষ ও পুষ্টি নিরাপত্তা    ০৩    
    ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার, ড. সুস্মিতা দাস
    বাংলাদেশে নিবিড় সবজি উৎপাদনে সাফল্য    ০৫    
    বাদল চন্দ্র বিশ্বাস
    বাংলার পাটজাত পণ্য : বর্ষপণ্য ২০২৩    ০৭
    ড. মো: আব্দুল আউয়াল, কৃষিবিদ ড. মো: আল-মামুন
    ট্রেড ফেসিলিটেশন সহজীকরণে কোয়ারেন্টাইন ল্যাবরেটরির (ওঝঙ-১৭০২৫:২০১৭) এক্রিডিটেশনের গুরুত্ব    ০৯    
    ড. জগৎ চাঁদ মালাকার
    কলা, সবজি ও ভার্মিকম্পোস্টের সমন্বিত খামারের মাধ্যমে কৃষকের আর্থিক লাভ    ১১    
    ড. মো: আজিজুল হক, কামরুন নাহার    
    চরাঞ্চলের বসতবাড়িতে নিবিড় সবজি চাষ    ১৪
    ড. মোঃ শামীম হোসেন মোল্লা, ড. মোঃ জান্নাতুল ফেরদৌস, ড. মোঃ আল-আমিন হোসেন তালুকদার    
    আমের ফুল ও ফল উৎপাদনের সমস্যা ও সমাধান    ১৬
    ড. মো. সদরুল আমিন
    পশুর খাদ্য তালিকায় কাঁচাঘাস    ১৭
    ডা: সুচয়ন চৌধুরী    
    নতুন জাতের মাছ সুবর্ণ রুই ব্যাপক সম্ভাবনার হাতছানি    ১৯
    মোঃ তোফাজউদ্দীন আহ্মেদ
আগামীর কৃষি ভাবনা

    সবজি রপ্তানি বৃদ্ধিতে উত্তম কৃষি চর্চা     ২২    
    প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
    বাংলাদেশে লিলিয়াম চাষ : বাণিজ্যিক সম্ভাবনা    ২৪
    ড. ফারজানা নাসরীন খান, আফরোজ নাজনীন, কারিমাতুল আম্বিয়া

উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ
    তরমুজের আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল    ২৬    
    ড. একেএম কামরুজ্জামান
সফল কৃষকের গল্প
    গ্রীষ্মকালীন টমেটোর নীরব বিপ্লব    ২৮    
    ড. মো. জামাল উদ্দিন
নিয়মিত বিভাগ
    ফাল্গুন মাসের তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা    ৩০    
    কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন    
    প্রশ্নোত্তর    ৩১
    কৃষিবিদ মোঃ আবু জাফর আল মুনছুর
    চৈত্র মাসের কৃষি (১৫ মার্চ-১৩ এপ্রিল)    ৩২
    কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম

 

বিস্তারিত
নিরাপদ সবজি চাষ ও পুষ্টি নিরাপত্তা

নিরাপদ সবজি চাষ ও পুষ্টি নিরাপত্তা
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার১ ড. সুস্মিতা দাস২
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কৃষিতে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দূরদর্শী নেতৃত্বে এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগোপযোগী কার্যক্রমের সমন্বয়ে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বৈশ্বিক মহামারীতে বিশ্ব যখন স্থবির তখনও দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলার কৃষি। গত এক যুগে সবজি উৎপাদনে দেশে বিপ্লব ঘটেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সবজির আবাদি জমি বেড়েছে বাংলাদেশে। বর্তমানে দেশের প্রায় সব অঞ্চলে সবজি চাষ হচ্ছে। সাধারণত শীতমৌসুমে উৎপাদিত সবজি এখন গ্রীষ্মকালেও পাওয়া যাচ্ছে। দেশে ২০০ জাতের মোট ৬০ ধরনের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ০.৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়।  বাংলাদেশে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বিশ্বে এখন তৃতীয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) এর  হিসাব মতে পূর্বে দেশে দৈনিক মাথাপিছু সবজি ভোগের পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম কিন্তু বর্তমানে তা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের  হিসাব অনুসারে প্রায় ১০০ গ্রাম। সবজি উৎপাদনের বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। বাংলাদেশ খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তরণ ঘটিয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো উৎপাদনের গুণগতমান নিশ্চিত করে রপ্তানিমুখী কৃষিতে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান করে নেওয়া।
বর্তমানে উৎপাদিত ব্যাপক শাকসবজি খাদ্য চাহিদা পূরণ করে জনগণের পুষ্টিমান রক্ষা করছে এবং টেকসই উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। কর্মসংস্থান সহ গ্রামীণ অর্থনীতিতেও সবজি উৎপাদন ব্যাপক প্রভাব। অধিক বাণিজ্যিকরণের জন্য প্রয়োজন নিরাপদ সবজি চাষ ও সঠিক রপ্তানিকরণ।
এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ১০টি এবং এর অন্তর্গত ৩৩টি টার্গেটের সঙ্গে  কৃষি খাতের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও কৃষি উৎপাদকদের আয় বৃদ্ধি অপরিহার্য। জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য এসডিজিতে ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে কৃষি সম্পর্কিত অন্যতম অভীষ্ট হলো অভীষ্ট-২: ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার। ২০৩০ সালের মধ্যে ফসলের উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে।  বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের সাথে সাথে খাদ্য নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলদেশের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানে কৃষির ভূমিকা অনেক। উৎপাদিত কৃষিপণ্য সঠিকভাবে রপ্তানি করতে পারলে আয় ও সক্ষমতা বাড়বে। তখন মানুষের নিরাপদ ও পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের হারও বাড়বে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে পতিত জমিতে সবজি উৎপাদনের বিকল্প নেই।
আর এই জন্য প্রয়োজন উন্নত মানের হাইব্রিড বীজ। সরকার ৯০ এর দশকের শেষের দিকে হাইব্রিড ফসলের সূচনা করে এবং এটি দেশে হাইব্রিড সবজি উৎপাদনের সূত্রপাত। বেসরকারি খাত বিশেষ করে লাল তীর, এসিআই, মেটালএগ্রো এবং আরো কিছু প্রতিষ্ঠান প্রধানত হাইব্রিড ফসল নিয়ে গবেষণা করছে। বেসরকারি খাতের সবজির বীজ বেশির ভাগই উৎপাদনে প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ও  কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্বারা শাকসবজির গবেষণা ও উন্নয়ন করার কাজ অব্যাহত রয়েছে। বিএআরআই এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন্ জাতের সবজি অবমুক্ত করেছে।  দেশে গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারিভাবে উদ্ভাবিত হাইব্রিড বীজ থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। নার্স প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞানীরা হাইব্রিড বীজ আবিষ্কারের গবেষণা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হাইব্রিড বীজ জাতের উপর গবেষণা জোরদার করেছে। হাইব্রিড বীজ এর প্রসার ঘটাতে  প্রয়োজন দক্ষ সবজি প্রজননবিদ। যাদের পর্যাপ্ত উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। ডড়ৎষফ ঠবমবঃধনষব ঈবহঃৎব একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান যা বিএআরআই-এর সাথে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা ছিল। এটি বাংলাদেশে প্রযুক্তি স্থানান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। এই সহযোগিতা সবজির উন্নয়নে জোরদার করতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল নার্স প্রতিষ্ঠান এপেক্স বডি  হিসেবে অন্যান্য নার্স প্রতিষ্ঠান সাথে সবজির গবেষণা ও উন্নয়েন কর্মকা- অব্যাহত রেখেছে। এরই অংশ হিসাবে সম্প্রতি বিএআরসি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ‘ঋবধংরনরষরঃু ংঃঁফু ওড়ঃ নধংবফ চৎবপরংরড়হ ধমৎরপঁষঃঁৎব ভড়ৎ ংঁংঃধরহধনষব পৎড়ঢ় ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ  রহ ইধহমষধফবংয’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার, পানি এবং কীটনাশকের ভারসাম্যহীন ব্যবহার।
বর্তমানে ফসলে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে অনেকক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। বিরাজমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে সারের পূর্বাভাস দেয়ার জন্য এবং ইন্টারনেট অব থিংসভিত্তিক মেশিন লার্নিং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সঠিক সার, পানি ও কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বাড়ানো। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরাপদ সবজির উৎপাদন বাড়বে।
বাণিজ্যিক নগর ভার্টিক্যাল ডিভাইস, গ্রিনহাউজ হাইড্রোপনিক, একুয়াপনিক্স ছাড়া স্মার্ট ফার্মিং ডিভাইস, স্বয়ংক্রিয় সেচসমৃদ্ধ ভার্টিক্যাল লাইন ডিভাইস, স্বয়ংক্রিয়  ছাদ-বাগান ঠান্ডাকরণ ডিভাইস ব্যবহার করে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বিদেশি ব্রাসেলস স্প্রাউট, লেটুস, লাল টমেটো, কালো টমেটো, শসা, লালশাক, ডাঁটাশাক, ধনিয়াপাতা, ক্যাপসিকাম, চাইনিজ বাঁধাকপি, ছাড়াও পুদিনা, সেলেরি, পিয়াজপাতা সবজি চাষাবাদ এখন আমাদের দেশেই সম্ভব ।
 বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা মডিউলে রাসায়নিক সার ও মাটিতে সংযোজিত অন্যান্য বস্তু ব্যবহার করার সময় বাগানি বা কৃষককে মাটি জীবাণুমুক্ত করা, ভারী ধাতুর উপস্থিতি পরীক্ষা করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি সংকটপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সবজি চাষের ক্ষেত্রে মাটি শোধনের পাশাপাশি গ্রোয়িং মিডিয়ার গুণাগুণ ও স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হবে। ভার্মিকম্পোস্ট, রান্নাঘর ও খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে বানানো সার, চা-কম্পোস্ট, ডিম খোসা ভাঙা মিশানো, নতুন মাশরুম কম্পোস্ট, নিমখৈল, সরিষাখৈল, ইত্যাদি ছাড়াও যে কোন বায়োলজিক্যাল কম্পোস্ট উৎস সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে ব্যবহার করতে হবে। রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহারের ক্ষেত্রে বোতলের গায়ের নিয়মাবলি কঠোরভাবে পালন করতে হবে। বালাইনাশক ব্যবহারের পর পাতা ও ফলজাতীয় সবজি আহরণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করতে হবে। পোকা দমনে ফ্লাইং ইনসেক্টের জন্য ফেরোমন ট্রাপ, সোলার লাইট ট্রাপ, আঠালো ট্রাপ, পেঁয়াজ পাতার ও ছোলা পেস্ট বা নির্যাস, রসুন, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা ফুলের নির্যাস ভালো কাজ করবে।
কৃষিতে বায়োটেকনোলজি ও ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার বাড়ানো, নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ, রোগবালাই প্রতিরোধী উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এড়ড়ফ অমৎরপঁষঃঁৎধষ চৎধপঃরপবং (এঅচ)  অনুযায়ী সবজি উৎপাদন ব্যবস্থা ও রপ্তানি ক্ষেত্রে মাননিয়ন্ত্রণ এবং সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । সবজি সংরক্ষণ পদ্ধতি, কোল্ড চেইন ও ফসল সংগ্রহপরবর্তী ব্যবস্থাপনা, কীটপতঙ্গ ও রোগ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ উৎপাদন পদ্ধতি, জেনেটিক সম্পদ সংরক্ষণ, এবং ব্যবহারী সবজির রপ্তানি বৃদ্ধি, মূল্যসংযোজনসহ অন্যান্য দিকে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিকতা বাড়াতে হবে। এছাড়াও ফসলের বছরব্যাপী নিয়ন্ত্রিত চাষাবাদ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি।
রূপকল্প ২০৪১  বাস্তবায়নের মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারি- বেসরকারি, সুশীল সমাজ আসুন সম্মিলিতভাবে কাজ করি।

লেখক : নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, প্রধান ডকুমন্টেশস কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, মোবাইল : ০১৭১১১০২১৯৮, ই-মেইল :susmitabarc@gmail.com

বিস্তারিত
বাংলাদেশে নিবিড় সবজি উৎপাদনে সাফল্য

বাংলাদেশে নিবিড় সবজি
উৎপাদনে সাফল্য
বাদল চন্দ্র বিশ্বাস
কৃষি ও কৃষক বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিগত ৪০ বছরে খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও সময়োপযোগী বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য সহায়ক। শাকসবজিতে সাধারণত বিভিন্ন খনিজ লবণ এবং ভিটামিন প্রচুর পরিমাণে থাকে। এ জন্য শাকসবজিকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য বলা হয়। এতে ক্যালরির ও আমিষের পরিমাণ খুব কম। গাঢ় হলুদ ও সবুজ শাকসবজিতে বেশি পরিমাণে ক্যারোটিন বা প্রাক ভিটামিন ‘এ’ থাকে যা খাওয়ার পর ক্ষুদ্রান্তে ভিটামিন ‘এ’ তে রূপান্তরিত হয়। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন খাবারের সাথে সবজির ব্যবহার জনপ্রিয় করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে চাষকৃত প্রচলিত অপচলিত সবজির সংখ্যা প্রায় ৯০টি যার মধ্যে ৩০-৩৫টিকে প্রধান সবজি ধরা যায়। দেশে জমিতে যে পরিমাণ সবজি চাষ করা হচ্ছে তার মাধ্যমে মাথাপিছু ১২৫ গ্রাম সবজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। একজন সুস্থ সবল মানুষের জন্য  প্রতিদিন ২২০ গ্রাম (সূত্র : এফএও, ডিএই) সবজি গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্য তালিকায় সবজির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির অধিকতর বিকাশসহ শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য মানবদেহের অতীব প্রয়োজনীয় দুটি খাদ্য উপাদান বিভিন্ন প্রকার খনিজ লবণ ও ভিটামিন এর সবচেয়ে সহজলভ্য উৎস হলো বিভিন্ন প্রকারের সবজি। বাংলাদেশে অপুষ্টি একটি অন্যতম সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে সুষম খাবারের নিশ্চয়তা দিতে বিভিন্ন প্রকারের শাকসবজি গুরুত্ব ভূমিকা রাখতে পারে। তাই বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদন করার মাধ্যমে সারা বছরের খাদ্যের নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা মিটানো সম্ভব।
সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। সবজি চাষে রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও পোকামাকড় দমনে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। তাছাড়া অনেকেই অতি লাভের আশায় বাজারে বিক্রির জন্য সবজির মাঠে কীটনাশক প্রয়োগ করে অল্প সময়ের মধ্যে সবজি সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে কীটনাশক প্রয়োগ ও প্রয়োগমাত্রা সম্পর্কে ধারণা না থাকার জন্য নিরাপদ সবজি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক উপাদান মানুষের দেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির কারণ। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ, উপযুক্ত সময় ও নির্ধারিত মাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার এবং সঠিক সময়ে সবজি সংগ্রহের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ১০.৩৪২ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ করা হয়। যেখান থেকে ২১৬.৭০ লাখ মে. টন সবজি উৎপাদিত হয়। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে আলুসহ সবজির উৎপাদন ছিল ৮১.৭৭ লাখ মেট্রিক টন, বর্তমানে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বেড়ে প্রায় ৩২৪.৪১৭ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। প্রবৃদ্ধির হার ৭৪৯%। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে সবজি রপ্তানি করছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে বাংলাদেশ বর্তমানে সবজি উৎপাদনে বিশ্বে ৩য় এবং আলু উৎপাদনে বিশ্বে ৮ম। বিগত ৫ বছরে বাংলাদেশের সবজি ও কন্দাল ফসলের উৎপাদনের তথ্যাবলি (সারণি দ্রষ্টব্য)।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষি ক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে খোরপোশের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে দেশে কর্মসংস্থান সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে সারা বছরের পুষ্টি চাহিদা পূরণে সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারাদেশে বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
নিরাপদ সবজি উৎপাদনে চাষিদের প্রশিক্ষণ প্রদান; নিরাপদ সবজি উৎপাদনের কলাকৌশল হাতে-কলমে দেখানো; নিরাপদ সবজি উৎপাদনের প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুুদ্ধকরণ; জৈব কৃষি তথা ফেরোমন ফাঁদ, আইপিএম, আইসিএম, উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) ইত্যাদি কৌশলের মাধ্যমে যথাসম্ভব বালাইনাশকের ব্যবহার নিশ্চিত করা; সঠিক সময় ও গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা; বছরব্যাপী সবজি উৎপাদন সম্পর্কে কৃষককে পরামর্শ প্রদান।
সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি জন্য সবজি চাষে রাসায়নিক সারে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও পোকামাকড় দমন ও রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য নানারকম বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করা হয়। তাছাড়া জমিতে জৈবসার, কম্পোস্ট, ভার্মিকম্পোস্ট প্রয়োগ করলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। বালাইনাশকের ক্ষেত্রে নিম, নিশিন্দা, বিষকাটালী ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এতে কৃষকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে না। নিরাপদ সবজি উৎপাদনে যে সকল বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, তা হচ্ছে-
উচ্চমূল্যের ফসলের চাষ : উচ্চমূল্যের ফসল সারা বছর চাষের মাধ্যমে বছরব্যাপী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হলে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং দরিদ্রতা দূর করে। উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে গ্রীষ্মকালীন শিম, মরিচ, পেঁপে, মাশরুম চাষ করা যায়।
সর্জান পদ্ধতিতে সবজি চাষ : সাধারণত যে জমি জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় বা বছরের বেশির ভাগ সময় পানি জমে থাকে সে জমিতে সর্জান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা যায়। পাশাপাশি দুটি বেডের মাঝের মাটি কেটে উঁচু বেড তৈরি করে ফসল চাষ করাই সর্জান পদ্ধতি। মধ্য জানুয়ারি থেকে মাধ্য মার্চ (মাঘ-ফাল্গুন) মাসে সর্জান বেড তৈরি করা যায়। প্রায় ২৮ মিটার লম্বা এবং ১১ মিটার চওড়া একখ- জমিতে ১০ঢ২ বর্গমিটার আকারের ৫টি বেড তৈরি করা যেতে পারে। বেডের উচ্চতা কমপক্ষে ১ মিটার হলে ভালো হয়। সর্জান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে বছরব্যাপী পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ : জলবায়ু বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বন্যা/জলমগ্ন অবস্থার সাথে খাপখাওয়ানোর জন্য কৃষকরা স্থানীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উদ্ভাবিত ভাসমান কৃষি পদ্ধতিতে (যা স্থানীয়ভাবে ভাসমান/ধাপ চাষ নামে পরিচিত) কমপক্ষে প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে ফসল উৎপাদন করে আসছে। বর্তমানে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ -পশ্চিমাঞ্চলের গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর এবং বরিশাল জেলায় বর্ষাকালে নিচু জলমগ্ন এলাকাসমূহে মূলত ভাসমান চাষ করা হয়। গোপালগঞ্জ জেলার সকল উপজেলা এবং বরিশালের উজিরপুর ও আগৈলঝড়া উপজেলায় শুধু কচুরিপানা, দুলালীলতা, টোপাপানা দিয়ে তৈরি ভাসমান বেডে শাকসবজি ও মসলাজাতীয় ফসলের চারা উৎপাদন করে পার্শ্ববর্তী এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর নিচু থেকে অতি নিচুভূমি আছে যা দেশের মোট আয়তনের ২১% (বিএআরসি,২০০৬)। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ০.২৫ মিলিয়ন হেক্টর প্লাবিত ভূমি রয়েছে। অন্যদিকে সারা দেশে প্রায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে যার আয়তন প্রায় ৮.৫৮ লাখ হেক্টর। বর্ষাকালে প্লাবন/জলমগ্নতার কারণে এ সকল ভূমির একটা বড় অংশ অনাবাদি বা পতিত থাকে। গবেষণার মাধ্যমে উপযুক্ত ও লাগসই ভাসমান কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব প্লাবিত পতিত ভূমি সহজেই ফসল উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যায়। প্রযুক্তিটি পরিবেশবান্ধব এবং বাংলাদেশের পরিবর্তিত জলবায়ুগত পরিস্থিতিতে কৃষি অভিযোজনের জন্য উপযোগী।
ছাদ কৃষি : গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ টাটকা শাকসবজি গ্রহণের সুযোগ পেলেও শহরের বিপুল জনগোষ্ঠী সেই সুযোগ থেকে প্রায়ই বঞ্চিত। তাই ছাদ বাগানে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে নগরজীবনে সারা বছরের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। শহরের ভবনগুলোতে ছাদবাগান স্থাপনের ফলে একদিকে যেমন শহরের জনগণ টাটকা ও নিরাপদ সবজি খেতে পারছে অন্যদিকে এটি ভবনের অতিরিক্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে।
মাশরুম চাষ : মাশরুম বাংলাদেশে অত্যন্ত সম্ভাবনাময়, পুষ্টিকর, সুস্বাস্থ্য ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন সবজি, মাশরুম একটি স্বল্প ক্যালরিযুক্ত খাবার হলেও এতে রয়েছে অতি উন্নতমানের আমিষ যা কোন উদ্ভিদজাত খাবারে তো নয়ই, অনেক প্রাণীজ আমিষের থেকেও দুষ্কর। তাই মাশরুম মানসম্পন্ন আমিষের একটি বিকল্প উৎস হিসেবে বিবেচিত। বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদের বৈচিত্র্য সেই সাথে নানা ধরনের ঔষধিগুণের সমারোহের কারণে সবজি হিসেবে মাশরুম অনন্য। তাই বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি হিসেবে সারা বছর মাশরুম চাষের মাধ্যমে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
শস্যের বৈচিত্র্যতা তথা কৃষি উন্নয়নের প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের জনগণের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা বিধানকল্পে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য বছরব্যাপী সবজি উৎপাদনের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। নিরাপদ সবজি উৎপাদনকে ভবিষ্যৎ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সাথে মিল রেখে বিভিন্ন মেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরি। দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার টেকসই রূপ দিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ অংশীজনের অংশগ্রহণে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এরই মাধ্যমে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে উঠবে। দেশ ও জাতি পাবে স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী সুনাগরিক।

লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। ফোন : ৫৫০২৮৩৬৯, ই- মেইল : dg@dae.gov.bd

বিস্তারিত
বাংলার পাটজাত পণ্য : বর্ষপণ্য ২০২৩

বাংলার পাটজাত পণ্য : বর্ষপণ্য ২০২৩
ড. মো: আব্দুল আউয়াল১ কৃষিবিদ ড. মো: আল-মামুন২
পাট কেবল আমাদের সোনালি আঁশ নয়, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের এক সোনালি অধ্যায়। স্বাধীনতার পরে পাট ছিল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় পরিবেশবান্ধব তন্তু হিসেবে আবার পাটের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মানের পাট উৎপাদিত হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ লাখ ২১ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বছরে দেশে ৮৫ থেকে ৯০ লাখ বেল কাঁচাপাট উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে বেসরকারি পাটকলগুলোর জন্য বছরে ৬০ লাখ বেল কাঁচাপাট প্রয়োজন। আর গৃহস্থালিতে ব্যবহারের জন্য দরকার পাঁচ লাখ বেল। পাট খাতের বৈশ্বিক রপ্তানি আয়ের ৭২ শতাংশ এখন বাংলাদেশের দখলে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। এর মধ্যে কাঁচাপাট রপ্তানি থেকে এসেছে ২১ কোটি ৬১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে কেবল পাটজাত ব্যাগের চাহিদা ১০ কোটি থেকে ৭০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে এবং অন্যান্য পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৭১৭ কোটি টাকার।
পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য গৃহীত হয়েছে সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ। পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ বা বর্ষপণ্য এবং পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাট কৃষিজাত পণ্য হিসেবে বিবেচিত হলে চাষিরা কৃষিঋণের মতো পাটঋণ এবং পণ্য রপ্তানিতে পাবেন সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিজেএমসি এর অধীন বন্ধঘোষিত মিলগুলোর পাওনা ও অন্যান্য দায়-দেনা পরিশোধে ৫৭৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও প্রসার, গবেষণা ও পাট চাষে উদ্বুদ্ধকরণে পাট আইন-২০১৫, পাটনীতি-২০১৫, বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠান আইন-২০১৫ ও বস্ত্রনীতি-২০১৫ প্রণয়নের উদ্যোগ অন্যতম। পাটচাষিদের সহায়তা করার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে পাটের বীজ উৎপাদনে ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় সার, চিনি, ধান, চালসহ ১৭টি পণ্য বিক্রয়, বিতরণ ও সরবরাহে বাধ্যতামূলক পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিত কল্পে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ প্রণীত হয়েছে। পাটকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে ঢাকার বুকে তেজগাঁওয়ে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারে (জেডিপিসি) প্রায় ২৫০ প্রকার বহুমুখী পাটপণ্যের স্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র চালু হয়েছে। রপ্তানিমুখী পাটপণ্য বহুমুখীকরণে নগদ সহায়তা বৃদ্ধি করে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করে ইউরোপের দেশগুলোতে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়নের ধারা বেগবান করা এবং পাটজাত বহুমুখী পণ্যকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দিতে প্রতি বছরের ন্যায় ৬ মার্চ ২০২৩ দেশজুড়ে পালিত হতে যাচ্ছে জাতীয় পাট দিবস।
ঢাকাই মসলিন, সিল্কের শাড়ি কিংবা কাপড় যেমন নামে-ডাকে গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক পাটের তৈরি অনেক জিনিসপত্রও এখন দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পাট ও পাটজাত বর্জ্যরে সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব বিশেষ সোনালি ব্যাগ, পাটের তৈরি জিন্স (ডেনিম), পাট ও তুলার মিশ্রণে তৈরি বিশেষ সুতা (ভেসিকল), পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সাথে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত জুট জিওটেক্সটাইল, পাটখড়ি হতে উৎপাদিত ছাপাখানার বিশেষ কালি (চারকোল) ও পাট পাতা থেকে উৎপাদিত ভেষজ পানীয় দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। পাট দিয়ে তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আল্পনা, দৃশ্যাবলী, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গয়না ও গয়নার বক্সসহ ২৩৫ রকমের আকর্ষণীয় ও মূল্যবান পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনস্যুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে।    
পাট ও পাটপণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয় এটা পরিবেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়কারী কৃত্রিমতন্তুর জনপ্রিয়তা বা ব্যবহার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে পানি, মাটি ও বায়ু দূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র জনমত তৈরি হয়েছে। তাছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক ২০০৯ সালকে ‘আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তু বর্ষ’ হিসেবে ঘোষিত ও পালিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার আরও উৎসাহিত হয়েছে। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক পাখি ও জলজ প্রাণী। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে শুধু ঢাকাতেই মাসে প্রায় ৪১ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার ফলে পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর শিল্প-রাসায়নিক দ্রব্যসামগ্রীর পরিবর্তে অর্গানিক বা পচনশীল ও নবায়নযোগ্য দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। সাম্প্রতিক ইতালি, ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশ বিনাশী অন্যান্য উপাদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। এ ক্ষেত্রে পাটই হয়ে উঠেছে বিকল্প অবলম্বন। বিশ্বে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পাটের ব্যাগ ও ৩২ মিলিয়ন ফুড গ্রেড পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। এর ১০ শতাংশ বাজার দখল করতে পারলে বছরে আয় করা সম্ভব ৫০ হাজার কোটি টাকা। তা ছাড়া বিলাসবহুল মোটরগাড়ি নির্মাণ করে এমন পাঁচটি বড় কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে, তারা তাদের গাড়ির অভ্যন্তরীণ কাঠামোর একটি বড় অংশ তৈরি করবে পাটজাত পণ্য দিয়ে। বিশ্বের এই চাহিদা মেটাতে, পাটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আমাদের কাজ করতে হবে।
অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও মাটি পাট উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের তৈরি পণ্যের বিকল্প হিসেবে আমরা পাট ব্যবহার করলে একদিকে পরিবেশ, অন্যদিকে পাটকলগুলো রক্ষা পাবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাট চাষের উন্নয়ন ও পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এর আধুনিকায়নের কোন বিকল্প নেই। পণ্য বৈচিত্র্যকরণে সরকারি পাটকলগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন এবং উৎপাদন স্থিতিশীল রাখার জন্য পাটের ন্যূনতম বাজারমূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট খাতের ওপর নির্ভরশীল। এ খাতে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে হবে এবং ছোট কারখানাগুলোকে সমবায়ের মাধ্যমে বড় আকারের উৎপাদনে কাজে লাগাতে হবে।
ধারণা করা হচ্ছে, পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই সারা বিশ্বে তিনগুণ বেড়ে যাবে। ফলত পাটপণ্যের বাজারই সৃষ্টি হবে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়নের। দুনিয়াব্যাপী পাটের ব্যাগের চাহিদা বৃদ্ধি ও আমাদের দেশের উন্নতমানের পাট এ দুই হাতিয়ার কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশেরও সফলতা আসতে পারে। যে দেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কার করতে পারেন, যে দেশ বহির্বিশ্বে সোনালি আঁশের দেশ হিসেবে পরিচিত, সেই দেশের পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা কঠিন নয়। মানসম্মত পাট উৎপাদন ও পণ্য বহুমুখীকরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে স্বদেশী পাটপণ্যের কার্যকর ব্রান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেয়া এবং পাটপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গ্রিন ইকোনমি ও সবুজ পৃথিবীর বাস্তবতায় বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায়, সোনালি আঁশের হারানো সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

লেখক : ১মহাপরিচালক, বিজেআরআই, ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইল : ০১৭১১১৮৬০৫১, ই-মেইল : almamunbjri@gmail.com

বিস্তারিত
ট্রেড ফেসিলিটেশন সহজীকরণে কোয়ারেন্টাইন ল্যাবরেটরির (ওঝঙ-১৭০২৫:২০১৭) এক্রিডিটেশনের গুরুত্ব

ট্রেড ফেসিলিটেশন সহজীকরণে কোয়ারেন্টাইন ল্যাবরেটরির (ওঝঙ-১৭০২৫:২০১৭) এক্রিডিটেশনের গুরুত্ব
ড. জগৎ চাঁদ মালাকার
কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে  কয়েকটি নতুন আইটেমসহ প্রায় শতাধিক কৃষি পণ্য সফলতার সাথে সর্বনিম্ন Non Compliance  এর মাধ্যমে ইউরোপের  ১০টি  দেশে রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে । এ রপ্তানির পরিমাণ ও পণ্যের সুনাম ওইসব দেশে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সকলের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে এবং কৃষি মন্ত্রনালয়, কৃষক ও রপ্তানিকারসহ সংশ্লিষ্টদের পূর্ণ সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের পরে রপ্তানির ক্ষেত্রে তাজা শাকসবজি ও ফলমূলের অবস্থান হবে বলে আশা করা যায়। বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির কারণে দানাদার খাদ্যশস্যের পাশাপাশি শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনে দেশে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য রপ্তানির এক বিশাল সম্ভবনা থাকলেও সেই সুযোগ আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ সংরক্ষণ সম্মেলন এ স্বাক্ষরকারী দেশ। তাই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যা নিরাপত্তার জন্য দেশের কৃষিকে রক্ষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে WTO-SPS Agreement Ges (IPPC) এর বিধিবিধান অনুসরণ করা সকল দেশের জন্য বাধ্যতামূলক।
২০২১-২০২২ অর্থ বছরে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ০১ বিলিয়ন ডলার আয় করে যদিও তার মধ্যে তাজা শাকসবজি থেকে আয় মাত্র ০৫ মিলিয়ন ডলার যা অত্যন্ত নগণ্য। যদি রপ্তানির শর্ত মেনে শাকসবজি উৎপাদন ও আইএসও             স্বীকৃত  ল্যাবরেটরিতে টেস্টের মাধ্যমে রপ্তানি করা গেলে তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এখানে উল্লেখ্য যে অধিকাংশ উন্নত দেশ কৃষি পণ্য রপ্তানিতে গ্রিণ চ্যানেলের সুবিধা পেতে চায় তাহলে চুক্তিবদ্ধ কৃষকের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করতে হবে, উৎপাদনকালীন সময়ে উত্তম কৃষি চর্চা/ (GAP) নিশ্চিতকরণ এবং আইএসও স্বীকৃত  ল্যাবরেটরিতে টেস্ট সম্পন্নের মাধ্যমে রপ্তানি করতে হবে।
উন্নত দেশে বাধাহীনভাবে কৃষি পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যে বর্তমান সরকার কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্প হাতে নিয়েছে।    
এ প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কার্যক্রমে বালাই শনাক্তকরণ আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি স্থাপনের নিমিত্ত কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের বিদ্যমান ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করা এবং কৃষি পণ্য রপ্তানি ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করা সম্ভব হবে।
পাশাপাশি উদ্ভিদ সংগনিরোধের জন্য আন্তর্জাতিক মানের অপপৎবফরঃবফ ল্যাবরেটরি স্থাপনের মাধ্যমে আমদানিকারক দেশের আমদানি শর্তানুযায়ী ২৫-৩০% রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে;
বালাই নির্ণয় ও শনাক্তকরণের সক্ষমতা অর্জনসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগী প্রায় ৪০ জন দক্ষ জনবল তৈরি করা যাহা কৃষিপণ্য আমদানি ও রপ্তানি কাজ চলমান রাখবে।    
কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা স্থাপনের মাধ্যমে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গধৎশবঃ অপপবংং নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
ইতোমধ্যে প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামোর কাজ সমাপ্তির পথে। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি ক্রয় ও সংস্থাপন করা গেলে অতি সত্ত্বর ল্যাবরেটরিটি চালু করা সম্ভব হবে।
বর্তমানে রপ্তানীকৃত কৃষিপণ্যসমূহ কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের আওতায় শাকসবজি, ফলমূল চাষাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়াও কনট্রাক্ট ফার্মিং বহির্ভুত ফলমূল যেমন : তাল, আমড়া, জলপাই, বেল, আমলকি, তেঁতুল, চালতা, কদবেল, সফেদা, চুকর ফল, তৈকর, ডেফল চাষাবাদ করা হচ্ছে। বছরভিত্তিক সবজি, ফল রপ্তানি ও রাজস্ব আহরণ সারণি-১ এবং রপ্তানিকৃত কৃষিপণ্যসমূহ ও উৎপাদিত এলাকা সারণি-২ দ্রষ্টব্য।
উল্লেখযোগ্য অর্জনসমূহ
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ, শ্যামপুর, ঢাকা এর মাধ্যমে ২০১৭ সালে ইউরোপের ১০টি দেশে মান সম্মত উদ্ভিদ ও উদ্ভিদ জাত পণ্য সুষ্ঠুভাবে সটিং, গ্রেডিং করে রপ্তানি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ প্রতিষ্ঠার আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেখানে প্রতি বছর  প্রায় ১২০-১৭০টি ঘড়হ ঈড়সঢ়ষরধহপব ঘড়ঃরভরপধঃরড়হ হতো সেখানে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ প্রতিষ্ঠার পর প্রতি বছর গড়ে ১০টির বেশি ঘড়হ ঈড়সঢ়ষরধহপব ঘড়ঃরভরপধঃরড়হ হচ্ছে না। বিগত ২০১৭-১৮ সাল থেকে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ, শ্যামপুর, ঢাকা, মাধ্যমে ১০০% কম্পিউটারাইজড পিসি প্রদান করে কাজ নিশ্চিত করা হয়েছে। রপ্তানির বিভিন্ন বিষয়ে  কৃষক/কৃষানি, কর্মকর্তা/কর্মচারিদের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে একটি এক্রিডিয়েটেড ল্যাব স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ হতে নিজস্ব তালা ও সিলগালা ব্যবহারের মাধ্যমে প্যাকিং হাউজ হতে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত রপ্তানিকৃত পণ্য নিরাপদে পরিবহন করা নিশ্চিত কার হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহে তাজা ফলমূল ও শাকসবজির রপ্তানির পরিমাণ ও পণ্যের গুণগত মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের কৃষিজাত পণ্যের বিদেশে ব্যাপক চাহিদা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে কাংঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যহত হচ্ছে। যার মধ্যে কাচা শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদির উৎপাদন পর্যায়ে মানসম্মত উৎপাদন কলাকৌশল গ্রহণ না করা, পরিবহন সমস্যা, নিম্নমানের মোড়ক ও প্যাকেটজাতকরণ এবং মান সম্মত পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকা। ভেপার হিট ট্রিটম্যান্ট এর ব্যবস্থা না থাকায় জাপানসহ কয়েকটি দেশে আম রপ্তানি করা যায় না।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়ে আগামীতে খাদ্য সংকট হতে পারে মর্মে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে সতর্ক করেছেন। কৃষি মন্ত্রালয়ের দায়িত্বে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয় করোনাকালীন সময়ে খাদ্য সমস্যা মোকাবিলার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। আগামী দিনের কৃষিতেও করোনার মতো অজানা রোগজীবাণু সংক্রমণের ভয়াল থাবায় খাদ্য সমস্যা প্রকটতর পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কৃষিপণ্য অধিকতর আমাদানি ও রপ্তানির লক্ষ্যে নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান করা জরুরি। রপ্তানি সংক্রান্তÍ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নির্দেশনা, সিদ্ধান্তসমূহ, বিভিন্ন চুক্তি, পলিসি সংক্রান্ত সকল বিষয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অবহিতকরণের ব্যবস্থা করে চলমান বিশ্বে পাশ্ববর্তী দেশসমূহের সাথে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো পরিস্থিতি নিশ্চিতকরন প্রয়োজন। কার্গো বিমান/ চার্টাড বিমানের ব্যবস্থাসহ বিমানের স্পেস সহজলভ্যকরন ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সাথে সমন্বয় করে বিমান ভাড়া নির্ধারণ প্রয়োজন। সুতরাং বিশ^ বাজারে আমাদের কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে হলে উৎপাদনকালিন সময়ে উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) নিশ্চিত করা এবং ঝুঁকিমুক্ত ভাবে আমদানি রপ্তানি সহজিকরণের লক্ষ্যে ঙহব ঝঃড়ঢ় ওঝঙ-১৭০২৫:২০১৭ কোয়ারেনটাইন ল্যাবরেটরি স্থাপন একান্তভাবে জরুরি। যাহাতে দ্রুত পরীক্ষা পদ্ধতি ও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ইকোইপমেন্টের মাধ্যমে টেস্ট করার সক্ষমতা থাকবে।

লেখক : প্রকল্প পরিচালক, কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্প। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭১৬০০৪৪০০। ই-মেইল : jogot_mala@@yahoo.com

বিস্তারিত
কলা, সবজি ও ভার্মিকম্পোস্টের সমন্বিত খামারের মাধ্যমে কৃষকের আর্থিক লাভ

কলা, সবজি ও ভার্মিকম্পোস্টের সমন্বিত
খামারের মাধ্যমে কৃষকের আর্থিক লাভ
ড. মো: আজিজুল হক১ কামরুন নাহার২
জৈবসার হিসেবে ভার্মিকম্পোস্ট বেশ উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও জৈব পদার্থের উৎস অপ্রতুল হওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়। আমাদের দেশের কৃষকরা সাধারণত ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাঁচামাল হিসেবে গোবর ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু অনেক সময় গোবরের স্বল্পতার কারণে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির কাজ বিঘিœত হয়। এ জন্য গোবরের পাশাপাশি বিকল্প জৈব পদার্থ ব্যবহার করতে হবে যাতে কম গোবর ব্যবহার করেও ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করা যায়। এ কাজে গোবরের সাথে কলা গাছ ব্যবহার করে গোবর সাশ্রয় করে ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করা যেতে পারে। ভার্মিকম্পোস্ট তৈরিতে কলাগাছ সংগ্রহের জন্য একটি উপযুক্ত জাতের কলা বাগান স্থাপন করতে হবে এবং তার সাথে আন্তঃফসল হিসেবে সবজি উৎপাদন করে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করতে পারে। প্রধান ফসল হিসেবে  কলা বাগান স্থাপন, আন্তঃফসল হিসেবে সবজি চাষ ও কলাগাছ ব্যবহার করে ভার্মিকম্পোষ্ট তৈরির সমন্বিত পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করা হলো-
কলা বাগান স্থাপন
কলার চারা ৩ মৌসুমে রোপণ করা যায়,  ১ম রোপণ : আশ্বিন- কার্তিক (মধ্য সেপ্টেম্বর-মধ্য নভেম্বর), ২য় রোপণ : মাঘ-ফাল্গুন (মধ্য জানুয়ারি-মধ্য মার্চ) এবং  ৩য় রোপণ : চৈত্র-বৈশাখ (মধ্য মার্চ-মধ্য মে) মাসে করা যায়। যেসব কলার জাত দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং একই গাছকে গোড়া থেকে বার বার কর্তন করলেও পুনরায় দ্রুত গাছ জন্মায় এমন জাত নির্বাচন করতে হবে। চাষ-মই ও সার প্রয়োগ করে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সারিতে (সারি-সারি ৪ মিটার এবং গাছ-গাছ ৪ মিটার দূরত্ব) ৩০-৪০ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। ২ফুটদ্ধ২ফুট আকারের গর্ত করে চারা লাগানো যেতে পারে। প্রতি গর্তে ইউরিয়া ৫০০-৬৫০ গ্রাম, টিএসপি ২৫০-৪০০ গ্রাম, এমওপি ২৫০-৩০০ গ্রাম, ভার্মিকম্পোস্ট ৪-৫ কেজি প্রয়োগ করা যেতে পারে। কলা বাগানে আন্তঃফসল হিসেবে সবজি চাষ করা হবে বিধায় কলার রোপণ দূরত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি দিতে হয়। আন্তঃফসল হিসেবে বছরব্যাপী মৌসুমভিত্তিক সবজি উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত সবজি জাত নির্বাচন করতে হবে। আন্তঃফসল আবাদকালীন বিশেষ করে রবি মৌসুমে কলাগাছের ছায়া যাতে কম পড়ে এ জন্য কলার পাতা উপরের দিকে ৩টি রেখে বাকিগুলো ছাঁটাই করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিনা) ময়মনসিংহ অঞ্চলের সহজলভ্য স্থানীয় গেরা বা গেরা সুন্দরী কলার বাগান স্থাপন করা হয় (বাগানটির আয়তন : ৪০দ্ধ১৫ ব.মি বা ১৫ শতাংশ) এবং এতে আন্তঃফসল হিসেবে বিভিন্ন সবজি চাষ করা হয়। কলা বাগানে আন্তঃফসল হিসেবে প্রথম বছর জায়ান্ট লজ্জাবতী এবং সবজি হিসেবে পাটশাক চাষ করা হয়। মাটির উর্বতা বৃদ্ধির জন্য জায়ান্ট লজ্জাবতীর চাষ করা হয় এবং ৩-৪বার  জায়ান্ট লজ্জাবতী কর্তন বা সংগ্রহ করে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করা হয়। দ্বিতীয় বছর পর্যায়ক্রমে মৌসুমভিত্তিক মুলা, লালশাক, মিষ্টি কুমড়া, গাজর, টমেটো, বেগুন, ঢেঁড়স, পুঁইশাক, ডাটা ইত্যাদি চাষ করা হয়। রোপণের একবছর পর থেকেই পরিপক্ব কলা সংগ্রহ করা হয় এবং কলা সংগ্রহের পরে কলাগাছ ভার্মিকম্পোষ্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়াও কলার ছোপ বা ঝাড়ের পার্শ্ব থেকে গজানো চারা বা পোয়াসমূহ ৫-৬ফুট লম্বা হলেই তা মাটি থেকে ৪-৫ ইঞ্চি উপর থেকে কেটে ভার্মিকম্পোষ্ট তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়। কর্তনকৃত গাছ থেকে পুনরায় কলাগাছ জন্মায় যা আবার ২-৩ মাস পরেই কর্তন করা হয় (একই কলা গাছ ৪-৫ বার কর্তন করলেও পুনরায় সেখান থেকে কলাগাছ জন্মায়)। এভাবে প্রচুর পরিমাণে কলাগাছের বায়োমাস সংগ্রহ করা হয় (১৫ শতাংশ জমি থেকে প্রতি বছর প্রায় ( ১২-১৩ টন) এবং তা ভার্মিকম্পোষ্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। তবে কলার ছোপ বা ঝাড়ে পর্যায়ক্রমে ছোট, মাঝারি, বড় এ তিন ধরনের ৩টি কলা গাছ সব সময় রেখে বাকিগুলো উপরের নিয়মে কাটা হয়। এভাবে কলাবাগান থেকে পরিপক্ব কলা, কলাগাছ ও আন্তঃফসল হিসেবে সবজি সংগ্রহ করা হয় এবং উৎপাদিত কলা গাছ ব্যবহার করে ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করা হয়।
কলা গাছ ও গোবর দিয়ে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির পদ্ধতি
সারা বিশ্বে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করা হয়। খরচ, জিনিসপত্রের সহজলভ্যতা, উদ্দেশ্য, উৎপাদনের পরিমাণ, বিরাজমান পরিবেশ প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে ভার্মিকম্পোস্টিং পদ্ধতি নির্বাচন করা হয়। সিমেন্টের রিং (উচ্চতা ১ হতে ২ ফুট এবং ব্যাস ২.৫ হতে ৩ ফুট), সিমেন্টের চারি (উচ্চতা ১.৫ ফুট এবং ব্যাস বা চওড়া ২.৫ ফুট), ইটের স্থায়ী ট্যাংক/বক্স/আয়তকার চৌবাচ্চা (২.৫ ফুট উচ্চতা ও ২.৫ ফুট প্রস্থ এবং প্রয়োজনমাফিক দীর্ঘ) এবং প্লাস্টিকের ট্যাংক/ড্রাম/ট্রে প্রভৃতি হাউজ হিসেবে ব্যবহার করে ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করা যায়। ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদনের মাত্রার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন আকারের ঘর বা শেড সহজ লভ্য জিনিসপত্র যেমন-টিন, বাঁশ, কাঠ প্রভৃতির সমন্বয়ে নির্মাণ করা যায় যাতে ভার্মিকম্পোস্ট বেড বা হাউজ রোদ ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়। তবে যেভাবেই ঘর বা শেড নির্মাণ করা হোক না কেন তাতে যেন ছায়াযুক্ত শীতল পরিবেশ থাকে। এ জন্য গাছের ছায়াযুক্ত স্থান নির্বাচন করা যেতে পারে। অসংখ্য জৈব পদার্থ ও তাদের মিশ্রণ হাউজসমূহে ভরাট করে ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করা যায়। এখানে কলাগাছ ও গোবর স্তরে স্তরে স্থাপন করে হাউজ ভরাট করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করার প্রক্রিয়া টেবিল-২ দ্রষ্টব্য।
টেবিল-২ : ভার্মিকম্পোস্ট তৈরিতে গোবর ও কলাগাছের স্তর
এভাবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্তর মোট ২.৫- ৩ ফুট পর্যন্ত উঁচু করে (অর্থাৎ মোট স্তর ১৫-১৮টি) অথবা হাউজের উচ্চতা অনুযায়ী ভরাট করতে হবে। তবে সবার উপরের স্তর অবশ্যই গোবর দিয়ে শেষ করতে হবে।
৩০-৩৫ দিন পর্যন্ত গাদা ঢেকে রাখতে হবে এবং মাঝে মধ্যে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। এ সময় বেশ তাপ তৈরি হয়। এ জন্য এ ধাপে মাদায় কেঁচো ছাড়া যাবে না।
অত:পর কম্পোষ্ট গাদা ওলট-পালট করে উপরে সমান করে পুণরায় ১-১.৫ ইঞ্চি পুরু গোবর দিয়ে প্রতি ৪ বর্গফুটে টি-২৫০-৩০০টি কেঁচো ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। তবে ওলট-পালট না করেও সরাসরি গাদাতে কেঁচো প্রয়োগ করা যায়। যখন কোন রকম দুর্গন্ধ থাকে না এবং জৈব পদার্থ কালো-বাদামি বর্ণের ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে ভার্মি কম্পোষ্ট সংগ্রহের উপযুক্ত হয়েছে। চালুনি দ্বারা কেঁচো ও কম্পোস্ট পৃথক করা যেতে পারে। অপচনকৃত দ্রব্য পুনরায় গাদা করে অবশিষ্টাংশটাও ভার্মি কম্পোষ্টে পরিণত করতে হবে। এ ভাবে কলাগাছসহ অন্যান্য জৈব পদার্থ ও গোবরের মিশ্রণে কেঁচো প্রয়োগ করে ভার্মি কম্পোষ্ট তৈরি করা যায়।
ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি কালীন আন্তঃপরিচর্চা
সুষ্ঠভাবে পরিচর্চার জন্য কিছু বিষয়গুলো গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন : ১) পর্যাপ্ত ঠা-া/ছায়াযুক্ত শীতল স্থান বা পরিবেশ বজায় রাখা, ২) পর্যাপ্ত অন্ধকার ও বায়ুচলাচল অবস্থা বজায় রাখা। চটের ছালা হাউজের বা রিং বা চারি বা চৌবাচ্চার উপরে বিছিয়ে দিতে হবে। এ কাজে পলিথিন বা মোটা মেট ব্যবহার করা হলে যেন তা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রযুক্ত হয়। ৩) উপযুক্ত নিষ্কাশন অবস্থা বজায় রাখা, ৮) দুর্গন্ধ মুক্ত রাখা। তীব্র দূর্গন্ধ তৈরি হলে জৈব পদার্থ ওলট-পালট করে দেওয়া যেতে পারে, ৯)  আদর্শ তাপমাত্রা (২০-৩০ ডিগ্রি সে.) বজায় রাখা।
ভার্মি কম্পোস্টিং-এর জন্য ক্ষতিকর উপাদান সমূহ
ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির সময়কালীন ক্ষতিকর বিষয় সমূহ থেকে ভার্মি কম্পোস্টকে রক্ষা করে তৈরি প্রক্রিয়াকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হবে। যেমন : ১) উচ্চ তাপমাত্রা/সরাসরি সূর্যের আলো, ২) অতিরিক্ত পানি/বৃষ্টির পানি জমে থাকা, ৩) বায়ু চলাচলহীন অবস্থা, ৪) হাঁস-মুরগি, পাখি, ইঁদুর, চীকা, সজারু, বেজী প্রভৃতি, ৫) পিঁপড়া বিশেষ করে লাল পিঁপড়া, সাদা ও লাল মাকড়/মাকড়াসা, কেঁল্লা, উরচুঙ্গা, তেলাপোকা, সাপ, ব্যাঙ প্রভৃতি, ৬) টক/এসিড তৈরি করে এমন দ্রব্য (যেমন-কাঁচা আনারসের ছোবরা, ফ্রেস কিচেন ওয়েস্ট) থেকে বিরত রাখা।
আয়, ব্যয় ও লাভ
গবেষণায় দেখা যায় ১৫ শতাংশ জমি থেকে কলা, সবজি ও ভার্মিকম্পোস্টের সমন্বিত খামারের মাধ্যমে ১ম বছর মোট আয় হয় ৩৯,২৭০/- টাকা এবং মোট ব্যয় বাদ দিয়ে নীট লাভ হয় ১১,৭২৫ টাকা এবং ২য় বছর মোট আয় বেড়ে হয় ১,৪৩,০২০ টাকা এবং মোট ব্যয় বাদ দিয়ে নীট লাভ হয় ৫৫,৯৪০ টাকা। সুতরাং কলা বাগান, আন্ত:ফসল হিসেবে সবজি চাষ ও ভার্মিকম্পোস্টের সমন্বিত খামার লাভজনক যা কৃষকের আয় ও পুষ্টি নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
কলা ও সবজির সমন্বিত আবাদের মাধ্যমে উৎপাদিত কলা গাছ ব্যবহার করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করা হলে তা কলা ও সবজিসহ বিভিন্ন ফসলে ব্যবহার করে রাসায়নিক সার সাশ্রয় করা যায়। এতে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা হয়, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, জৈব পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, পরিবেশ উন্নত হয়, গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এবং সর্বোপরি কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
“জৈব পদার্থ যার ভার্মিকম্পোস্ট তার”

লেখক : সিএসও এবং এসও, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), বাকৃবি ক্যাম্পাস, ময়মনসিংহ। মোবাইল: ০১৭১৬৬২৭৩০৩; ই-মেইল : azizul_bina@yahoo.com

বিস্তারিত
চরাঞ্চলের বসতবাড়িতে নিবিড় সবজি চাষ

চরাঞ্চলের বসতবাড়িতে নিবিড় সবজি চাষ
ড. মোঃ শামীম হোসেন মোল্লা১ ড. মোঃ জান্নাতুল ফেরদৌস২ ড. মোঃ আল-আমিন হোসেন তালুকদার৩
বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো ক্রমাগতভাবে শুকিয়ে বা তলানি পড়ে যে চর তৈরি হচ্ছে, তাতে গড়ে উঠছে অসংখ্য বসতবাড়ি। চরাঞ্চলে শাকসবজি ও ফলমূলের উৎপাদন ও প্রাপ্যতা দুই-ই কম। ফলে এখানকার মানুষ নানাবিধ পুষ্টিহীনতার শিকার। অথচ পরিকল্পিতভাবে আবাদ করলে পুষ্টিকর, নিরাপদ এবং টাটকা শাকসবজি ও ফলমূলের সহজলভ্য ও উত্তম উৎস হতে পারে এ বসতবাড়ি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানীগণ দীর্ঘদিন থেকে বসতবাড়িতে ফসল উৎপাদনে বৈজ্ঞানিক ব্যবহার নিয়ে কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘রংপুর চর মডেল’ উদ্ভাবন করা হয়। এই মডেলে একটি বসতবাড়িকে ১০টি উৎপাদনক্ষম স্থানে ভাগ করে প্রতিটি স্থানের জন্য উপযোগী ফসল নির্বাচন করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বছরব্যাপী চাষ করা হয়।
চরাঞ্চলের বসতবাড়ির উৎপাদনযোগ্য স্থানসমূহ ও ফসলবিন্যাস
বসতবাড়ির সম্ভাব্য ১০টি উৎপাদনযোগ্য স্থানের প্রতিটির পরিমাণ বাড়ির আঙ্গিনার আকার অনুযায়ী কম বেশি হতে পারে। এমনকি উৎপাদন স্থানের সংখ্যাও বাড়িভেদে কম বেশি হতে পারে। আর এ সমস্ত স্থানের ফসল কৃষকের পছন্দ অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে।
উন্মুক্ত স্থান
বাড়ির আঙ্গিনার উৎপাদনযোগ্য রৌদ্রোজ্জ¦ল খোলামেলা সুনিষ্কাশিত উঁচু জায়গা নিবিড় সবজি চাষ করার জন্য উপযোগী। এ স্থানে ১ মিটার প্রস্থ এবং ৩-৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে পাঁচটি বেড পাশাপাশি বা সামনাসামনি তৈরি করে নিম্নের বিন্যাস অনুসরণে সারা বছর সবজি চাষ করা হয়।
বেড়া
গরু, ছাগল, হাস-মুরগি ইত্যাদির ক্ষতি হতে উন্মুক্ত স্থানের বেডের সবজি ও অন্যান্য ফসল রক্ষা করার জন্য বেড়ার ব্যবস্থা করে তাতে সবজি উৎপাদনে বিন্যাস হলো শিম/করলা-ঝিঙা/বরবটি-করলা। উন্মুক্ত স্থানের বেড়ার ভেতরে চতুর পাশে প্রতি ১.৫ মিটার অন্তর অন্তর মাদা তৈরি করে তাতে লতানো সবজির বীজ লাগাতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে যাতে বর্ষাকালে পানি না জমে।
মাচা  
মাচার সবজি বিন্যাস হলো লাউ/শিম-মিষ্টি কুমড়া/ধুন্দুল/ চিচিঙ্গা। বসতবাড়িতে অনেক জায়গায় ফাঁকা পড়ে থাকে যেখানে কোন কিছু করা যায় না যেমন-ঘরের আশে পাশের ফাঁকা জায়গা, পুকুরপাড়, বাড়ির ঢাল ইত্যাদি যেখানে পর্যাপ্ত রোদ পড়ে এমন জায়গায় মাচা তৈরি করা যেতে পারে। চরাঞ্চলের বসতবাড়ি যেহেতু আকস্মিক বড় বন্যায় ডুবে যেতে পারে সেহেতু বস্তার মাটিতে বীজ বা চারা লাগানো যেতে পারে। এজন্য প্লাস্টিকের বস্তায় অর্ধেক মাটি ও অর্ধেক কম্পোস্ট মিশিয়ে তাতে লতানো সবজি উৎপাদন করলে বন্যার সময় প্রয়োজনে বস্তাসহ গাছ উপড়ে উঠিয়ে মাচায় ঝুলিয়ে দেয়া যায়।
বাড়ির ঢাল
চরাঞ্চলের বসতবাড়ি প্রায়ই আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়ে থাকে। কাজেই বন্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য বসতভিটা যথেষ্ট উচু করতে হয়। এ কারণে চরাঞ্চলে প্রায় বাড়িতেই দেখা যায় বসতভিটার চারদিকে ঢাল থাকে। এ ঢালকে ফেলে না রেখে পরিকল্পিতভাবে নাপিয়ার ঘাস আবাদ করলে বাড়ির ঢাল অধিক স্থায়ী হবে, পাশাপাশি উৎপাদিত হবে গৃহপালিত পশুর উত্তম গোখাদ্য। এছাড়া এ স্থানে লতানো সবজি লাউ-মিষ্টি কুমড়া উৎপাদন করা যেতে পারে।
ঘরের চাল
বসতবাড়িতে নানান ধরনের ঘরের চালা থাকে যেমন- থাকার ঘর, রান্না ঘর, গোয়াল ঘর, কম্পোস্ট পিটের চালা ইত্যাদি। এ সমস্ত ঘরের চালা ক্রমান্বয়ে লাউ/শিম-চালকুমড়া/মিষ্টি কুমড়া সবজি চাষের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। চারা গাছকে লম্বা কোন বাউনির সাহায্যে চালায় তুলে দিতে হবে। চালা যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য ছোট গাছের ডাল বা পাটখড়ি দিয়ে হালকা চালের উপর বাহন তৈরি করে দিতে হবে।
স্যাঁতসে্যঁতে স্থান
টিউবওয়েল বা ট্রেডল পাম্প (পা চালিত যন্ত্র) এর পানি ব্যবহার করার সময় সেই পানি গড়িয়ে যে জায়গায় পড়ে তার আশেপাশে সব সময় ভেজা ও স্যাঁতসে্যঁতে থাকে। পরিকল্পিতভাবে সেখানে পানি কচু/লতি কচু চাষ করা সম্ভব।
অফলা গাছ
বসতবাড়িতে বিদ্যমান বিভিন্ন অফলা গাছ যেমন জিগা, বাবলা, মাদার ইত্যাদি গাছের গোড়া হতে পৌনে ১ মিটার দূরে মাদা তৈরি করে অফলা গাছকে বাউনি হিসাবে ব্যবহার করে মৌসুম ভেদে বিভিন্ন সবজি যেমন: শিম-ঝিঙা, দেশি শিম-ধুন্দল অথবা গাছআলু-চিচিঙ্গা ইত্যাদি ফসল বিন্যাস অনুযায়ী চাষ করা যায়।
আংশিক ছায়াযুক্ত স্থান  
বসতবাড়িতে বিদ্যমান বড় গাছের নিচে, মাচার নিচে বা ঘরের পেছনে যেখানে ভালোভাবে সূর্যের পূর্ণ আলো পৌঁছায় না, সেখানে ছায়া সহনশীল সবজি ও মসলাজাতীয় ফসল যেমন- ওল কচু, মৌলবী কচু, মানকচুু, আদা, হলুদ, মিষ্টি আলু, বহুবর্ষী মরিচ ইত্যাদি উৎপাদন করা যায়।
বাড়ির সীমানা
বসতবাড়ির চারিদিকের সীমানা প্রায়ই অলক্ষ্যে পতিত অবস্থায় পরে থাকে। এ স্থানে কিছু কিছু সবজি ও স্বল্প মেয়াদি ছোট ক্যানপি বিশিষ্ট ফল গাছ লাগিয়ে অনায়াসেই দীর্ঘ দিন সবজি ও ফল উৎপাদন করা যায়। যেমন- পেঁপে, মাল্টা, লেবু, পেয়ারা কুল, বড়ই ইত্যাদি। এ ছাড়া এ স্থানে তুলসী, কালমেঘ, গন্ধভাদালী ইত্যাদি ঔষধি গাছের পাশাপাশি এক কোনায় এক ঝাড় চিবানো জাতের আখ লাগানো যেতে পারে।
বাড়ির পেছনের পরিত্যক্ত স্থান
বসতবাড়ির পেছনে কিছু পরিত্যক্ত জঙ্গলময় স্থান থাকে যা তেমন কোন কাজে আসে না। এ ধরনের জায়গায় বড় আকারের ফল ও সবজি গাছ লাগিয়ে তা থেকে প্রতি মৌসুমেই কিছু বাড়তি ফসল পাওয়া যেতে পারে। যেমন -সজিনা, লাইজনা, কাঁচকলা, সুপারি, আম ইত্যাদি।
বসতবাড়ির ফসল উৎপাদনে অন্যান্য পরিচর্যা
  বসতবাড়ির বিভিন্ন জৈব উচ্ছিষ্ট (শাকসবজি বা মাছ-মাংসের উচ্ছিষ্ট, পশুপাখির মলমূত্র, বাড়ি ঘরের আবর্জনা, আশেপাশের আগাছা) পচিয়ে তৈরি ক¤েপাস্ট সার ব্যবহার করে শাকসবজি উৎপাদন করলে রাসায়নিক সার তেমন একটা লাগে না।
    চরাঞ্চলের বসতবাড়িতে সেচ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। বাড়ির রান্নার কাজে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত পানি অর্থাৎ সবজি, মাছ, মাংস ইত্যাদি ধোয়ার কাজে ব্যবহৃত পানিও সেচের কাজে ব্যবহার করা উওম। স্বল্প মূল্যের ট্রেডেল পা¤প (পা চালিত সেচযন্ত্র) বসিয়ে নিলে খাবার পানির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সেচ ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা সম্ভব।
    খরার সময় মাদা বা বেডে খড়ের জাবরা প্রয়োগ করলে খরা মৌসুমে গাছকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
    সবজি বাগান ও এর চার পাশে সবসময়ই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে যাতে করে রোগ পোকা বাসা বাঁধতে না পারে।
    বসতবাড়ির সবজি বাগানে পোকামাকড় দমনের জন্য যতটা সম্ভব ঔষধ প্রয়োগ না করা ভালো। তাই আক্রমণের শুরুতে পোকা সংগ্রহ করে মেরে ফেলে, আক্রান্ত ডগা ও ফল সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলে, বিষটোপ/আকর্ষক ফাঁদ ব্যবহার করে এবং প্রয়োজনে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে সহজেই পোকামাকড় দমন করা যায়।
    সবজি বাগানে যেন ছায়া সৃষ্টি না হয় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে। প্রয়োজনে ছায়া সৃষ্টিকারী গাছের কিছু ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে।
বসতবাড়িতে শাকসবজির বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ  
চরাঞ্চলে শাকসবজির বীজ সহজলভ্য নয়। তাই বসতবাড়িতে স্থিতিশীল সবজি বাগানের জন্য চাষি পর্যায়ে বীজ উৎপাদন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ প্রয়োজন। বীজ সংগ্রহ করার জন্য রোগপোকা মুক্ত সুস্থ সবল গাছ আগে থেকেই নির্বাচন করে রাখতে হবে। শাকজাতীয় সবজির ক্ষেত্রে গাছ পরিপক্ব হলে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। ফলজাতীয় সবজির ক্ষেত্রে পূর্বেই নির্বাচিত গাছ থেকে সুস্থ সবল পুষ্ট ও বড় আকারের পরিপক্ব ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে পরিষ্কারের পর ৫-৬ দিন ধরে আলো-ছায়া রোদে অল্প অল্প করে ভালোভাবে শুকাতে হবে। রোদে শুকানো বীজ ঠা-া করে বোতলে/ পলিথিনসহ টিনের পাত্রে ভরে শক্তভাবে পাত্রের মুখ এটে রাখতে হবে যাতে পাত্রে বাতাস ঢুকতে না পারে।
বসতবাড়িতে শাকসবজি উৎপাদনে পরিবারের সদস্যগণই সুবিধা মোতাবেক শ্রম দিয়ে থাকে। এতে বছরব্যাপী উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি খাওয়া ও বিতরণ বাদে অতিরিক্ত সবজি বিক্রি করে বছরে দুই হাজার টাকার বেশি নিট আয় করা সম্ভব। বসতবাড়ির বিভিন্ন জৈব উচ্ছিষ্ট পচিয়ে তৈরি ক¤েপাস্ট সার ব্যবহার করে শাকসবজি উৎপাদন করলে খরচ কম হবে এবং গুণগতমান বৃদ্ধির ফলে বেশি দামে বিক্রি করে বেশি টাকা আয় করা যেতে পারে। এ ছাড়া বসতবাড়ির সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে পুষ্টি নিরাপত্তার পাশাপাশি, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থ ও সবল জীবনযাপন সম্ভব।

লেখক : ১এসএসও, সগবি, বিএআরআই ২এসএসও, সগবি, বিএআরআই, ৩পিএসও, সগবি, বিএআরআই, রংপুর, মোবাইল : ০১৭১৭৮৩৭৮১৮, ই-মেইল : ংধসরসসড়ষষধ@মসধরষ.পড়স

 

বিস্তারিত
আমের ফুল ও ফল উৎপাদনের সমস্যা ও সমাধান

আমের ফুল ও ফল উৎপাদনের সমস্যা ও সমাধান
ড. মো. সদরুল আমিন
বর্তমানের জনপ্রিয় আম চাষ করে নিরাপদ লাভজনক পরিপুষ্ট আম উৎপাদনে সফলতা পেতে হলে কয়টি প্রযুক্তি সম্পাদন করতে হবে। যেমন: মাটি তৈরি ও চারারোপণ, ফুল উৎপাদন ও সংরক্ষণ, ফল সুরক্ষা, পুষ্টি সরবরাহ, বালাই দমন, পরিচর্যা ও সংগ্রহ।
মাটি তৈরি ও চারারোপণ : উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে সেখানে গর্তে সার ও মাটি তৈরি করে চারা রোপণ করতে হবে। জৈবসার হিসাবে কম্পোস্ট বা ভার্মিকম্পোস্ট দিয়ে চারা রোপণ করতে হবে।
ফুল উৎপাদন : জাতভেদে আমের ফুল উৎপাদন আগাম নাবী হয়ে থাকে। ফুল প্রধানত স্ত্রীলিঙ্গ তবে মঞ্জুরির গোড়ার দিকে কিছু সংখ্যক পুরুষ ফুল হয়ে থাকে যা পরাগায়নের পর স্বাভাবিকভাবে ঝরে যায়।
ফুল ও ফলের সংখ্যা : একটি গাছে যে পরিমাণ ফুল আসে তার খুবই সামান্য সংখ্যক গুটি তৈরি করে এবং শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। সুতরাং এ সময়ে ঝরে পড়া ফুলের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ নাই। ফুল ফোটাকালীন রোগ দমনে ইন্ডোফিল (২ গ্রাম/লি. পানি) বা নাটিভো প্রয়োগ করতে হবে। কীটনাশক হিসাবে ইমিটাফ দিতে হবে। সপ্তাহান্তর ২বার স্প্রে দিতে হবে।
আমে সুষম সার প্রয়োগ : বছরে ২-৩ কিস্তি বর্ষার আগে-পরে, অণুসার ও মিরাকুলান হরমোন প্রয়োজনে স্প্রে করতে হবে। গাছের বয়সের ভিত্তিতে সারের পরিমাণ সারণি দ্রষ্টব্য।
সারণি : গাছের বয়সের ভিত্তিতে সারের পরিমাণ
ম্যাগনেসিয়াম গাছের ক্লোরোফিলের মূল পরমাণু হিসেবে কাজ করে। ম্যাগনেসিয়াম সার গাছের পাতার আকার বাড়ায়। ফসলের মান বৃদ্ধি করে। ক্যালসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম সার/ডলোচুন ব্যবহার করলে এর অভাব দূর হয়। বিঘাতে ৫০-৭০ কেজি ডলোচুন জমি তৈরির সময় দিতে হয়। ম্যাগনেসিয়াম সালফেট  স্প্রে করেও ম্যাগনেসিয়াম সমস্যা দূর করা যায়।
গাছে ফুল ফোটার পর সলুবর বোরন ও লিবরেল জিংক স্প্রে করতে হবে। প্রয়োজনে পূর্বের অনুরূপ ২য় দফা রোগনাশক ও কীটনাশক দিতে হবে। এ সময়ে মিরাকুলান জাতীয় হরমোনও (০.৫-১ মিলি/লি. পানি) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
রোগের প্রতিকার : আমের পাতার সুটি মোল্ড, ফুলের পাউডারি রোগ ও অ্যানথ্রাকনোজ দমনের জন্য কুমুলাস ও অটোস্টিন দিতে হবে (২ গ্রাম/লি. পানি)। আমের অ্যানথ্রাকনোজ গ্লোমেরেলা/কলেটোট্টিকাম, স্টিগমিনা সিংগুলেটা, ছত্রাকসমূহের কারণে হয়ে থাকে।
পোকা দমন
হপার শোষক আমের জন্য খুবই ক্ষতিকর। প্রধানত ২টি প্রজাতির হপার এদেশে বেশি। যেমন-১. আমৃতটোডাস এটকিনসোনি ২. ইডিওস্কোপাস নিটিডুলাস। এদের সৃষ্ট মধুকণা থেকে সুটিমোল্ড গাছের পাতার ক্ষতি করে থাকে। এ সকল পোকা দমন করার জন্য যথাক্রমে এসাটাফ (৫ গ্রাম/লি. পানি) বা টাফগর (২ মিলি/লি. পানি)ও রেলোথ্রিন/রিভা (১ মিলি/লি. পানি) প্রয়োগ করতে হবে।
আমের অন্যান্য পোকা হলো চেলে পোকা বা উইভিল ও ফল মাছি। উইভিল পোকা ও ফল মাছি (স্ত্রী ও পুরুষ) ব্যাক্ট্রোসেরা ডরসালিস অরিয়েন্টাল, দমনের জন্য ফেরোমন ফাঁদ ও ব্যাগিং পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়।
পরিচর্যা : পুষ্টি ঘাটতির লক্ষণ দেখে পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ফুল ফোটা সময়ে বা পরাগায়নে সময়ে বালাইনাশক দেওয়া যাবে না। ফুল ফোটার পর খরা হলে সেচ দিতে হবে। মুকুল হওয়ার আগে সেচ ক্ষতিকর এবং সেক্ষেত্রে মুকুল না হয়ে নতুন পাতা বের হতে পারে। আমের মুকুল এসে গেলে একবার ও আমের গুটি মটর দানার আকৃতি ধারণ করলে আরো  একবার বেসিন পদ্ধতিতে সেচ করতে হবে।
হাইব্রিড কলম চারা গাছে রোপণের পর ৩-৬ মাসে মঞ্জুরি আসলে তা ভেঙ্গে দিতে হবে।
বর্ণিত প্রযুক্তিসমূহ যথাযথভাবে আমের পরিচর্যা করলে অবশ্যই সফলতা আসবে।

লেখক : প্রফেসর (অব.), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, দিনাজপুর। মোবাইল : ০১৯৮৮৮০২২৫৩, ই-মেইল :sadrulamin47@gmail.com

বিস্তারিত
পশুর খাদ্য তালিকায় কাঁচাঘাস

পশুর খাদ্য তালিকায় কাঁচাঘাস
ডা: সুচয়ন চৌধুরী
পশু খাদ্যের অন্যতম উপাদান হলো ঘাস। মাঠের সবুজ ঘাস পশুর খুব পছন্দের খাবার। পশুর বেঁচের থাকার জন্য এবং বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপাদান লুকিয়ে রয়েছে এই ঘাসের মধ্যে। তাছাড়া বর্তমান বাজারে দানাদার খাদ্যের চেয়ে কাঁচা ঘাসের দাম অনেক অনেক কম। তাই পশু খাদ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে দৈনিক খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে তরতাজা কাঁচা ঘাস।
আমাদের দেশের যে ঘাসগুলো পাওয়া যায় তাদের মধ্যে কিছু হলো স্থায়ী ঘাস আবার কিছু হলো অস্থায়ী বা মৌসুমি ঘাস। স্থায়ী ঘাসগুলো একবার লাগালে কয়েক বছর বেঁচে থাকে এবং বছর বছর ঘাস সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু মৌসুমি ঘাসগুলো এক মৌসুম বেঁচে থাকে এবং একবার কেটে খাওয়ালেই শেষ। স্থায়ী ঘাসের মধ্যে রয়েছে নেপিয়ার, জার্মান পারা, ডেসমোডিয়ার ইত্যাদি। আবার অস্থায়ী ঘাসের মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, সরগম মাসকলাই ইত্যাদি। এই সমস্ত ঘাসের মধ্যে কিছু আবার নডিউল যুক্ত। যেমন- খোসারি, শিম ইত্যাদি।
বর্তমানে বিভিন্ন উন্নত জাতের ঘাস চাষের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে অনেক কৃষকদের মধ্যে। যা কিনে নিয়ে নিজের খামারে গরুকে খাওয়াচ্ছে খামারি। খামার লাভবান করতে হলে দানাদার খাদ্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বেশি বেশি কাঁচা ঘাস খাওয়াতে হবে। যা পশুর দেহের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দেয়।
ঘাসের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে তার ড্রাইমেটার বা শুষ্ক অংশ কতটুকু। কাঁচা ঘাসের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে থাকে পানি। এই পানি বা জলীয় অংশ বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো ড্রাইমেটার বা শুষ্ক অংশ। মূলত খাদ্যের পাঁচটি উপাদান শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন, মিনারেল এবং আঁশ জাতীয় বিভিন্ন উপাদান থাকে এই অংশে।
ঘাসের জলীয় অংশের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় যে শর্করা বা কার্বহাইড্রেড থাকে তা সহজে ঘাস থেকে রুমেনে চলে আসে। এই শর্করা রুমেনের মাইক্রোফ্লোরাগুলোকে দ্রুত শক্তিশালী করে তুলে। ফলে রুমেনে যে ঘাসজাতীয় খাদ্য থাকে তার হজমপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। এই শর্করাই সাইলেজের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় ফলে এর পুষ্টিমান বৃদ্ধি পায়।
ঘাস থেকে পাওয়া প্রোটিন অনেক সহজলভ্য। পশু খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং দামী উপাদান হলো আমিষ বা প্রোটিন। আমদানি করা প্রোটিনের চেয়ে ঘাস থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন অনেক সস্তা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। ঘাসে যে প্রোটিন পাওয়া যায় তা মূলত ক্রড প্রোটিন যেখানে নাইট্রোজেনের পরিমাণ প্রায় ৬.২৫ গুণ বেশি। এই ক্রুড প্রোটিনের ৮০% হল ‘ট্রু প্রোটিন,’ অবশিষ্ট অংশটুকু হলো নন-প্রোটিন-নাট্রোজেন। দুই ধরনের প্রোটিনই পশুর শরীরে ব্যবহৃত হয়। তবে ট্রু প্রোটনটি পশুর শরীরে মাংস এবং দুধ বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়তা করে। আর নন-প্রোটিন-নাইট্রোজেনের বেশির ভাগ অংশ পশুর শরীর থেকে বের হয়ে যায়।
ক্রুড প্রোটিন রুমেনে দুইভাবে বিভক্ত হয়, যার একটি অংশ রুমেনের অণুজীব  দ্বারা ভেঙ্গে মাইক্রোবিয়াল প্রোটিনে পরিণত হয়। যা পরবর্তীতে মাইক্রোবসের সাথে সাথে হজম হয়ে যায়। আর বাকি অংশ রুমেনে হজম না হয়ে ক্ষুদ্রান্তে চলে আসে এবং সেখানে হজম হয়।
ঘাসে ক্রুড প্রোটিনের পরিমাণ নির্ভর করে ঘাসের জাতের উপর। আবার ঘাস চাষের পদ্ধতির উপরও এর পরিমাণ নির্ভর করে। যেমন ঘাস চাষের সময় কতটুকু নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করা হয়েছে আবার ঘাসটি কোন বয়সে কাটা হলো তার উপর ঘাসের ক্রুড প্রোটিনের পরিমাণ নির্ভর করে। নাট্রোজেন সার প্রয়োগের পর ট্রু প্রোটিন সমৃদ্ধ ক্রুড প্রোটিনের পরিমাণ কম থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে ঘাসগুলো যখন বাড়তে থাকে তখন নন প্রোটিন নাইট্রোজেনগুলো ট্রু প্রোটিনে রূপান্তরিত হতে থাকে ফলে ঘাসে ট্রু প্রোটিনের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
সাইলেজে ট্রু প্রোটিনের পরিমাণ ফার্মেন্টেশনের উপর নির্ভর করে। সাইলেজের ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন যত ভালো হবে তত ট্রু প্রোটিনের পরিমাণ বেশি হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পশু যে পরিমাণ প্রোটিন গ্রহণ করে তার ২০% মাত্র শরীরে কাজে লাগে বাকিগুলো বর্জ্য হিসেবে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। মূলত ট্রু প্রোটিনটি পশুর কাজে লাগে।
পশুর খাদ্য উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো আঁশ বা ফাইবার। রুমেনে খাদ্য নড়াচড়া করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ফাইবার। এটাই রুমেন উদ্দীপনা তৈরি করে। ফলে রুমেন নড়াচড়া করে এবং খাদ্য পরিপাক ত্বরান্বিত হয়। কিছু ফাইবার রুমেনে হজম হয়, তবে ধীরে। এটিও রুমেনে এবং ক্ষুদ্রান্তে শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।
ঘাসে ফাইবারের পরিমাণ কি রকম হবে তা নির্ভর করে ঘাসটি কখন সংগ্রহ করা হলো তার উপর। ঘাস যখন কচি থাকে তখন ফাইবারের পরিমাণ কম থাকে। ঘাস পরিপক্ব হয় তখন ফাইবারের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং পরিপক্ব ঘাস কম হজম হয়।
পশু খাদ্যে আঁশজাতীয় খাদ্য পর্যাপ্ত থাকলে রুমেনে খাদ্যের পরিপাক সঠিক সময়ে শেষ হয় তাই পশুর নিজে থেকে খাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। এই জন্য খাদ্যে ড্রাই মেটারের ৩০-৪০% আঁশ থাকা প্রয়োজন। এক কথায় বলতে গেলে ফাইবের ৬০-৭০% রুমেনে পরিপাক যোগ্য হতে হবে। যখন ঘাসে আঁশের পরিমাণ এই লেভেলের নিচে নেমে যায় তখন খাবারে সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ফাইবার যুক্ত করতে হবে। যাতে খাবার খুব দ্রুত রুমেন থেকে বের হয়ে যেতে না পারে।
যখন সাইলেজ বানানো হয় তখন খেয়াল রাখতে হবে যাতে ঘাস প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে না যায়।
এবার আসি পশু খাদ্যের অন্য একটি উপাদানের আলোচনায় যা ঘাসে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান এবং গাভীর প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সেটি হলো “লিপিড”। ঘাসে যে লিপিড পাওয়া যায় তার বেশির ভাগ হলো পলিআনসেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড (পি ইউ এফ এ)। এগুলো ভালো ফ্যাটি এসিড নামে পরিচিত। যাদেরকে আমরা ওমেঘা-৩ এবং ওমেঘা-৯ ফ্যাটি এসিড নামে চিনে থাকি। মানুষের শরীরে এবং পশুর শরীরে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।
পশুর শরীরে ‘পিইউএফএ’ এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে পশুর প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই ফ্যাটি এসিডের প্রভাবে পশুর মাংস দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত ভালো থাকে এবং মাংসের রং দীর্ঘক্ষণ সুন্দর রাখে। ঘাসের শুষ্ক অংশে যে পরিমাণ ফ্যাটি এসিড থাকে তার পরিমাণ পশুর শরীরে ২.৫ থেকে ৫% হতে পারে যার ৬৫-৭০% হলো ‘পিইউএফএ’।
লিপিডে শর্করার চেয়ে দ্বিগুণ শক্তি পাওয়া যায় এবং এটি পশুর শক্তির একটি বড় উৎস। তাই পশু খাদ্যে অধিক শক্তি উৎপাদনের জন্য লিপিড জাতীয় খাদ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। শুকনো খাবারের চেয়ে ফ্রেশ কাঁচা ঘাসে পিইউএফ এ এর পরিমাণ বেশি।
পশুর সুস্বাস্থ্য এবং সঠিক বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন এবং মিনারেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পশুকে নিয়মিত ঘাস খাওয়ালে বাড়তি ভিটামিন মিনারেল খাওয়ানোর প্রয়োজন হয় না। সাইলেজে ভিটামিন এবং মিনারেলের পরিমাণ তেমন পরিবর্তন হয় না। তবে শস্য কর্তনের সময় বেশি আর্দ্র থাকলে গুণগত মান হ্রাস পায়। যদিও রুমেনের অণুজীবগুলো অনেক ভিটামিন সিনথেসিস করে কিন্তু কিছু ফ্যাট সল্যুবল ভিটামিন পশুকে গ্রহণ করতে হয় সরবরাহকৃত খাদ্য থেকে।
সবুজ ঘাস ক্যারটিনের একটি ভালো উৎস। যা ভিটামিন এ এর প্রিকার্সর হিসেবে কাজ করে। ভিটামিন ‘এ’ দৃষ্টি ভালো রাখা, মিউকাস ম্যামব্রেনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। দুধ দানের সময় প্রায় ২০০০ আইইউ ভিটামিন এ দুধের মাধ্যমে বের হয়ে যায়।
আবার লিগুমিনাস যুক্ত ঘাসের ৮-১২ % ডাই ক্যালসিয়াম ফসফেট (ডিসিপি) এবং ৪৫-৬০% টোটাল ডাইজেস্টিভ নিউটিয়েন্ট , যা পশুর শরীর বৃত্তীয় কাজের জন্য খুব প্রয়োজন।
এত এত গুণ থাকার পর এক কথায় বলা যায় পশু খাদ্য হিসেবে কাঁচা ঘাসের কোন বিকল্প নেই। উৎপাদন খরচ কমিয়ে, পশুর শরীরের যথাযথ পুষ্টির জোগান নিশ্চিত করতে পশু খাদ্যের দৈনিক তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচাঘাস যুক্ত করা খুবই জরুরি।

লেখক : উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, মানিকছড়ি, খাগড়াছড়ি। মোবাইল : ০১৭১৮৬৩০২৬৮, ই-মেইল :ulo:manikchari.dls@gmail.com

বিস্তারিত
পশুর খাদ্য তালিকায় কাঁচাঘাস

পশুর খাদ্য তালিকায় কাঁচাঘাস
ডা: সুচয়ন চৌধুরী
পশু খাদ্যের অন্যতম উপাদান হলো ঘাস। মাঠের সবুজ ঘাস পশুর খুব পছন্দের খাবার। পশুর বেঁচের থাকার জন্য এবং বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপাদান লুকিয়ে রয়েছে এই ঘাসের মধ্যে। তাছাড়া বর্তমান বাজারে দানাদার খাদ্যের চেয়ে কাঁচা ঘাসের দাম অনেক অনেক কম। তাই পশু খাদ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে দৈনিক খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে তরতাজা কাঁচা ঘাস।
আমাদের দেশের যে ঘাসগুলো পাওয়া যায় তাদের মধ্যে কিছু হলো স্থায়ী ঘাস আবার কিছু হলো অস্থায়ী বা মৌসুমি ঘাস। স্থায়ী ঘাসগুলো একবার লাগালে কয়েক বছর বেঁচে থাকে এবং বছর বছর ঘাস সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু মৌসুমি ঘাসগুলো এক মৌসুম বেঁচে থাকে এবং একবার কেটে খাওয়ালেই শেষ। স্থায়ী ঘাসের মধ্যে রয়েছে নেপিয়ার, জার্মান পারা, ডেসমোডিয়ার ইত্যাদি। আবার অস্থায়ী ঘাসের মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, সরগম মাসকলাই ইত্যাদি। এই সমস্ত ঘাসের মধ্যে কিছু আবার নডিউল যুক্ত। যেমন- খোসারি, শিম ইত্যাদি।
বর্তমানে বিভিন্ন উন্নত জাতের ঘাস চাষের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে অনেক কৃষকদের মধ্যে। যা কিনে নিয়ে নিজের খামারে গরুকে খাওয়াচ্ছে খামারি। খামার লাভবান করতে হলে দানাদার খাদ্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বেশি বেশি কাঁচা ঘাস খাওয়াতে হবে। যা পশুর দেহের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দেয়।
ঘাসের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে তার ড্রাইমেটার বা শুষ্ক অংশ কতটুকু। কাঁচা ঘাসের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে থাকে পানি। এই পানি বা জলীয় অংশ বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো ড্রাইমেটার বা শুষ্ক অংশ। মূলত খাদ্যের পাঁচটি উপাদান শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন, মিনারেল এবং আঁশ জাতীয় বিভিন্ন উপাদান থাকে এই অংশে।
ঘাসের জলীয় অংশের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় যে শর্করা বা কার্বহাইড্রেড থাকে তা সহজে ঘাস থেকে রুমেনে চলে আসে। এই শর্করা রুমেনের মাইক্রোফ্লোরাগুলোকে দ্রুত শক্তিশালী করে তুলে। ফলে রুমেনে যে ঘাসজাতীয় খাদ্য থাকে তার হজমপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। এই শর্করাই সাইলেজের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় ফলে এর পুষ্টিমান বৃদ্ধি পায়।
ঘাস থেকে পাওয়া প্রোটিন অনেক সহজলভ্য। পশু খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং দামী উপাদান হলো আমিষ বা প্রোটিন। আমদানি করা প্রোটিনের চেয়ে ঘাস থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন অনেক সস্তা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। ঘাসে যে প্রোটিন পাওয়া যায় তা মূলত ক্রড প্রোটিন যেখানে নাইট্রোজেনের পরিমাণ প্রায় ৬.২৫ গুণ বেশি। এই ক্রুড প্রোটিনের ৮০% হল ‘ট্রু প্রোটিন,’ অবশিষ্ট অংশটুকু হলো নন-প্রোটিন-নাট্রোজেন। দুই ধরনের প্রোটিনই পশুর শরীরে ব্যবহৃত হয়। তবে ট্রু প্রোটনটি পশুর শরীরে মাংস এবং দুধ বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়তা করে। আর নন-প্রোটিন-নাইট্রোজেনের বেশির ভাগ অংশ পশুর শরীর থেকে বের হয়ে যায়।
ক্রুড প্রোটিন রুমেনে দুইভাবে বিভক্ত হয়, যার একটি অংশ রুমেনের অণুজীব  দ্বারা ভেঙ্গে মাইক্রোবিয়াল প্রোটিনে পরিণত হয়। যা পরবর্তীতে মাইক্রোবসের সাথে সাথে হজম হয়ে যায়। আর বাকি অংশ রুমেনে হজম না হয়ে ক্ষুদ্রান্তে চলে আসে এবং সেখানে হজম হয়।
ঘাসে ক্রুড প্রোটিনের পরিমাণ নির্ভর করে ঘাসের জাতের উপর। আবার ঘাস চাষের পদ্ধতির উপরও এর পরিমাণ নির্ভর করে। যেমন ঘাস চাষের সময় কতটুকু নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করা হয়েছে আবার ঘাসটি কোন বয়সে কাটা হলো তার উপর ঘাসের ক্রুড প্রোটিনের পরিমাণ নির্ভর করে। নাট্রোজেন সার প্রয়োগের পর ট্রু প্রোটিন সমৃদ্ধ ক্রুড প্রোটিনের পরিমাণ কম থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে ঘাসগুলো যখন বাড়তে থাকে তখন নন প্রোটিন নাইট্রোজেনগুলো ট্রু প্রোটিনে রূপান্তরিত হতে থাকে ফলে ঘাসে ট্রু প্রোটিনের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
সাইলেজে ট্রু প্রোটিনের পরিমাণ ফার্মেন্টেশনের উপর নির্ভর করে। সাইলেজের ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন যত ভালো হবে তত ট্রু প্রোটিনের পরিমাণ বেশি হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পশু যে পরিমাণ প্রোটিন গ্রহণ করে তার ২০% মাত্র শরীরে কাজে লাগে বাকিগুলো বর্জ্য হিসেবে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। মূলত ট্রু প্রোটিনটি পশুর কাজে লাগে।
পশুর খাদ্য উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো আঁশ বা ফাইবার। রুমেনে খাদ্য নড়াচড়া করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ফাইবার। এটাই রুমেন উদ্দীপনা তৈরি করে। ফলে রুমেন নড়াচড়া করে এবং খাদ্য পরিপাক ত্বরান্বিত হয়। কিছু ফাইবার রুমেনে হজম হয়, তবে ধীরে। এটিও রুমেনে এবং ক্ষুদ্রান্তে শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।
ঘাসে ফাইবারের পরিমাণ কি রকম হবে তা নির্ভর করে ঘাসটি কখন সংগ্রহ করা হলো তার উপর। ঘাস যখন কচি থাকে তখন ফাইবারের পরিমাণ কম থাকে। ঘাস পরিপক্ব হয় তখন ফাইবারের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং পরিপক্ব ঘাস কম হজম হয়।
পশু খাদ্যে আঁশজাতীয় খাদ্য পর্যাপ্ত থাকলে রুমেনে খাদ্যের পরিপাক সঠিক সময়ে শেষ হয় তাই পশুর নিজে থেকে খাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। এই জন্য খাদ্যে ড্রাই মেটারের ৩০-৪০% আঁশ থাকা প্রয়োজন। এক কথায় বলতে গেলে ফাইবের ৬০-৭০% রুমেনে পরিপাক যোগ্য হতে হবে। যখন ঘাসে আঁশের পরিমাণ এই লেভেলের নিচে নেমে যায় তখন খাবারে সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ফাইবার যুক্ত করতে হবে। যাতে খাবার খুব দ্রুত রুমেন থেকে বের হয়ে যেতে না পারে।
যখন সাইলেজ বানানো হয় তখন খেয়াল রাখতে হবে যাতে ঘাস প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে না যায়।
এবার আসি পশু খাদ্যের অন্য একটি উপাদানের আলোচনায় যা ঘাসে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান এবং গাভীর প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সেটি হলো “লিপিড”। ঘাসে যে লিপিড পাওয়া যায় তার বেশির ভাগ হলো পলিআনসেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড (পি ইউ এফ এ)। এগুলো ভালো ফ্যাটি এসিড নামে পরিচিত। যাদেরকে আমরা ওমেঘা-৩ এবং ওমেঘা-৯ ফ্যাটি এসিড নামে চিনে থাকি। মানুষের শরীরে এবং পশুর শরীরে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।
পশুর শরীরে ‘পিইউএফএ’ এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে পশুর প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই ফ্যাটি এসিডের প্রভাবে পশুর মাংস দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত ভালো থাকে এবং মাংসের রং দীর্ঘক্ষণ সুন্দর রাখে। ঘাসের শুষ্ক অংশে যে পরিমাণ ফ্যাটি এসিড থাকে তার পরিমাণ পশুর শরীরে ২.৫ থেকে ৫% হতে পারে যার ৬৫-৭০% হলো ‘পিইউএফএ’।
লিপিডে শর্করার চেয়ে দ্বিগুণ শক্তি পাওয়া যায় এবং এটি পশুর শক্তির একটি বড় উৎস। তাই পশু খাদ্যে অধিক শক্তি উৎপাদনের জন্য লিপিড জাতীয় খাদ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। শুকনো খাবারের চেয়ে ফ্রেশ কাঁচা ঘাসে পিইউএফ এ এর পরিমাণ বেশি।
পশুর সুস্বাস্থ্য এবং সঠিক বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন এবং মিনারেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পশুকে নিয়মিত ঘাস খাওয়ালে বাড়তি ভিটামিন মিনারেল খাওয়ানোর প্রয়োজন হয় না। সাইলেজে ভিটামিন এবং মিনারেলের পরিমাণ তেমন পরিবর্তন হয় না। তবে শস্য কর্তনের সময় বেশি আর্দ্র থাকলে গুণগত মান হ্রাস পায়। যদিও রুমেনের অণুজীবগুলো অনেক ভিটামিন সিনথেসিস করে কিন্তু কিছু ফ্যাট সল্যুবল ভিটামিন পশুকে গ্রহণ করতে হয় সরবরাহকৃত খাদ্য থেকে।
সবুজ ঘাস ক্যারটিনের একটি ভালো উৎস। যা ভিটামিন এ এর প্রিকার্সর হিসেবে কাজ করে। ভিটামিন ‘এ’ দৃষ্টি ভালো রাখা, মিউকাস ম্যামব্রেনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। দুধ দানের সময় প্রায় ২০০০ আইইউ ভিটামিন এ দুধের মাধ্যমে বের হয়ে যায়।
আবার লিগুমিনাস যুক্ত ঘাসের ৮-১২ % ডাই ক্যালসিয়াম ফসফেট (ডিসিপি) এবং ৪৫-৬০% টোটাল ডাইজেস্টিভ নিউটিয়েন্ট , যা পশুর শরীর বৃত্তীয় কাজের জন্য খুব প্রয়োজন।
এত এত গুণ থাকার পর এক কথায় বলা যায় পশু খাদ্য হিসেবে কাঁচা ঘাসের কোন বিকল্প নেই। উৎপাদন খরচ কমিয়ে, পশুর শরীরের যথাযথ পুষ্টির জোগান নিশ্চিত করতে পশু খাদ্যের দৈনিক তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচাঘাস যুক্ত করা খুবই জরুরি।

লেখক : উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, মানিকছড়ি, খাগড়াছড়ি। মোবাইল : ০১৭১৮৬৩০২৬৮, ই-মেইল :ulo:manikchari.dls@gmail.com

বিস্তারিত
নতুন জাতের মাছ সুবর্ণ রুই ব্যাপক সম্ভাবনার হাতছানি

নতুন জাতের মাছ
সুবর্ণ রুই ব্যাপক সম্ভাবনার হাতছানি
মোঃ তোফাজউদ্দীন আহ্মেদ
বিগত কয়েক দশকে দেশে মাছচাষে ব্যাপক সফলতা এসেছে, চাষের অধীনে মাছ উৎপাদনে সারা বিশে^র মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ম স্থান অব্যাহত রয়েছে। দেশের চাষের অধীনে যে মাছ উৎপাদন হয় তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত কার্পজাতীয় মাছই বেশি (প্রায় ৩০%) কার্পজাতীয় মাছের মধ্যে রুই মাছের অবস্থান অন্যতম। বর্তমান সময়ে পুকুরে রুই মাছকে প্রাধান্য দিয়ে কার্পের মিশ্র চাষের সম্পসারণ ঘটেছে সারা দেশব্যাপী। প্রধানত সরকারি বেসরকারি হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার ওপর নির্ভর করে এ চাষ পদ্ধতি বিকশিত হয়েছে। কিন্তু নানাবিধ করণে বিশেষ করে রুই মাছের ব্রুডের কৌলিতাত্ত্বিক অবক্ষয়, অন্তঃপ্রজনন, হ্যাচারিসমূহের অব্যবস্থাপনার কারণে রুই মাছের বর্ধন আগের তুলনায় কমে গেছে। যেহেতু পুকুরসমূহে রুই মাছকে প্রাধান্য দিয়ে (বিঘাতে ৩০০টি পোনা মজুদের মধ্যে ২০০টিই রুই) মাছচাষ হচ্ছে এ জন্য রুই মাছের কৌলিতাত্ত্বিক উন্নয়ন সময়ের চাহিদা বিবেচনা করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট দীর্ঘ ১০ বছর গবেষণা করে ২০২১ সালে সুবর্ণ রুই নামে একটি জাত উন্নয়ন করে সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যা মাছচাষিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এবং রুইজাতীয় মাছের ব্যাপক সম্ভাবনার দার উদঘাটন হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। ইতোমধ্যে এ মাছ সারা দেশে চাষিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য ৮ বিভাগের মৎস্য অধিদপ্তরের সরকারি ১০টি খামারে মোট ২০,০০০টি পোনা প্রদান করা হয়েছে এবং এ পর্যন্ত ১০০ কেজি সুবর্ণ রুই মাছের রেণু বেসরকারি হ্যাচারি ও মাছচাষিদের মাঝে সরবরাহ করা হয়েছে। প্রথমিক ফলাফলে মাছচাষিদের মাঝে এ মাছের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। আগামী বছর (২০২৪) হতে সরকারি বেসরকারি হ্যাচারিতে এ মাছের পোনা উৎপাদন শুরু হবে। এ মাছের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, সুবিধা ও এর চাষ পদ্ধতির বিষয়ে একটি ধারণা দেবার জন্য আজকের এ প্রয়াশ।
সুবর্ণ রুই মাছের পরিচিতি
তিনটি পৃথক নদী উৎস (পদ্মা, মেঘনা এবং হালদা) থেকে রেণু সংগ্রহ করে সেখান থেকে ব্রুড উৎপাদন করে পরস্পর ক্রস ব্রিডিং ও নির্বাচিত প্রজনন পদ্ধতিতে অনুসরণ করে ৪র্থ প্রজন্মকে (৪ঃয এবহবৎধঃরড়হ) সুবর্ণ রুই হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সাধারণ রুই মাছ থেকে এ মাছের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো : এ মাছ অন্তঃপ্রজনন মুক্ত; কৌলিতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ (এবহবঃরপধষষু ঐরময ঠধৎরধনষব); গায়ের রং আকর্ষণীয়, লেজ ও পাখনার রং লালচে গোলাপি; বর্ধনহার ২০% এর বেশি; তুলনামূলক বেশ শক্তিশালী; নার্সারিতে পোনার বাঁচার হার তুলনামূলক বেশি; পুকুর ও ঘেরে চাষ করা যায়।    
বাংলাদেশে মাছের উৎপাদনে একক প্রজাতি হিসাবে রুই মাছের অবস্থান
মৎস্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশনা (এফআরএসএস ২০২০-২১) অনুযায়ী দেশে মাছের মোট উৎপাদন ৪৬.২১ লক্ষ মেট্রিক টন। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ জলাশয় (নদী, বিল, প্লাবনভূমি, পুকুর, বাঁওড়, চিংড়ি ঘের, পেন ইত্যাদি) হতে উৎপাদিত মাছের পরিমাণ ৩৯.৪০ লক্ষ মে.টন (৮৫.২৬%), যার মধ্যে প্রজাতি হিসেবে রুই মাছের অবদান ৪.৪৬ লক্ষ মে.টন (১১.৩২%) এবং একক প্রজাতি হিসবে অবস্থান শীর্ষে। অপরদিকে চাষের পুকুরে উৎপাদিত মাছের মোট পরিমাণ ২০.৯১ লক্ষ মে.টন, এর মধ্যে রুই মাছের অবদান ২.৯৪ লক্ষ মে.টন (১৪.১০%) এবং একক প্রজাতি হিসবে একইভাবে শীর্ষে অবস্থান (এফআরএসএস ২০২০-২১) করছে।
বাণিজ্যিকভাবে কার্পজাতীয় মাছের মিশ্রচাষে রুই মাছের অবস্থান
রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জসহ দেশের অনেক জেলাতে বর্তমান অগ্রসর মাছচাষিগণ বাণিজ্যিকভাবে কার্প মোটাতাজাকরণ পদ্ধতিতে বড় আকারের রুইজাতীয় মাছ উৎপাদিত করছেন, যা দেশের বড় বড় শহরের বাজারসমূহে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা বিশেষ করে রাজশাহী জেলার পবা, পুটিয়া, দুর্গাপুর, মোহনপুর; নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাশপুর, বড়াইগ্রাম, লালপুর; সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, তাড়াশ ও রায়গঞ্জে এবং নওগাঁ জেলার সদর, মান্দা উপজেলায়  এ ধরনের বড় আকারের কার্পজাতীয় মাছের মিশ্রচাষ দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও স্বল্প পরিসরে হলেও এ পদ্ধতিতে মাছচাষ শুরু হয়েছে। বড় আকারের মাছ উৎপাদনের এ কৌশল এসব অঞ্চলে মাছচাষে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। উৎপাদিত বৃহৎ আকারের (৪-২০ কেজি) মাছ জীবন্ত অবস্থায় রাজধানী ঢাকার বাজারসহ দেশের অন্যান্য বৃহৎ শহরগুলোতে পৌঁছে যাচ্ছে। বড় আকারের মাছের চাহিদা সারা বছরই একই রকম থাকে এবং এর বাজারমূল্যও খুব বেশি উঠানামা করে না। ফলে কার্পজাতীয় মাছের এ ধরনের চাষপদ্ধতি দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে। এ মাছ চাষপদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এ পদ্ধতি প্রকৃত পক্ষে রুই প্রধান মাছচাষ অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে রুই মাছের সংখ্যা মোট মজুদের প্রায় ৫০-৭০% । সাধারণত পুকুরে মাছের মজুদ ঘনত্ব চাষিভেদে বিভিন্ন রকম হয় (সারণি দ্রষ্টব্য)।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে চালু হয়েছে পৃথিবীর সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাছচাষ আইপিআরএস (ওহ-ঢ়ড়হফ জধপবধিু ঝুংঃবস)। এ পদ্ধতিতে অনেকগুলো প্রজাতির মাছচাষ করায় রুই মাছই সবদিক থেকে ব্যবসা সফল। ১০০% রুই মাছের একক চাষ করা হয়ে থাকে।  
সুবর্ণ রুই মাছচাষে সফলতা পেতে করণীয়
অন্যান্য মাছ চাষের মতো সুবর্ণ রুই মাছ চাষের ক্ষেত্রে উত্তমভাবে পুকুর প্রস্তুত করে নি¤েœর বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
পোনা সংগ্রহ : যেহেতু সুবর্ণ রুই মাছের বর্ধন সাধারণ রুই মাছের থেকে বেশি সে জন্য এ মাছের পোনা বিক্রয়ে বিক্রেতাগণ সাধারণ পোনাকে সুবর্ণ রুই বলে বিক্রয় করতে পারে। এ জন্য এ মাছের পোনা বিশ^স্ত উৎস থেকে যাচাই বাছাই করে সংগ্রহ করতে হবে।
পোনার আকার : বর্তমান সময়ে সকলেই বড় আকারের মাছ উৎপাদন করতে চায়। এজন্য চেষ্টা করতে হবে ২০০ গ্রামের বড় আকারের সুস্থ সবল পোনা মজুদ করার। এ আকারের পোনার বাঁচার হার বেশি হয়ে থাকে। এ আকারের মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং স্বল্প সময়েই বাজারজাত করা যায়।
পোনার মজুদ ঘনত্ব : মাছ চাষে মজুদ ঘনত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুকুরে পোনার মজুদ ঘনত্ব চাষির মাছ চাষ পদ্ধতির ওপরই সাধারণত নির্ভর করে। তবে আগের টেবিলে যে মজুদ ঘনত্ব উল্লেখ করা হয়েছে তার যে কোন একটি মডেল অনুসরণ করার চেষ্টা করতে হবে।
মাছের খাদ্য প্রদান : পুকুরে পোনা মজুদের পরের দিন হতে নিয়মিত খাবার দিতে হবে। মাছের মোট ওজনের ৩-৪% হারে প্রতি দিন খাবার দিতে হবে। মাছের খাদ্যে ২২-২৫% আমিষ থাকা প্রয়োজন। পুুকুরে মাছের বৃদ্ধির জন্য প্রতিদিন দুইবার (সকাল-বিকাল) মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। সকাল ৯-১০ ঘটিকার মধ্যে একবার এবং বিকাল ৪-৫ ঘটিকার মধ্যে আর একবার। তবে দিনে একবার ডুবন্ত খাবার দিয়েও মাছ চাষ করা যেতে পারে। ডুবন্ত খাবার দুই রকম হতে পারে। বাজারের পিলেট খাবার এবং পুকুরের পাড়ে তৈরি ভিজা খাবার।
খাবার প্রয়োগ পদ্ধতি : আগেই বলা হয়েছে রুই মাছ পানির মাঝের স্তরে বাস করে। এ জন্য খাবার প্রয়োগের সময় বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। অনেকেই এ বিষয়ে গতানুগতিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন যা মাছের খাদ্যের সঠিক ব্যবহারের প্রতিবন্ধক। পুকুরে প্রদত্ত সমস্ত খাবার নির্ধারিত কয়েকটি স্থানে ভাগ করে দিতে হবে। খাবার প্রদানের ২-৩ ঘণ্টা পরে খাবার অবশিষ্ট আছে কি না পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী খাবার বাড়াতে বা কমাতে হবে।
খাদ্যে অনুপুষ্টি সংযোজন : রুই মাছের চাহিদা ও দাম বেশি সুতরাং মাছের বর্ধন ভালো পাবার জন্য ৬-৭ দিন পরপর প্রতি কেজি খাদ্যে ১-২ গ্রাম ভিটামিন ও ১-২ গ্রাম লবণ এবং ফিশফিড সাপ্লিমেন্ট বা গাট-প্রোবায়োটিক ১-২ গ্রাম মিশ্রিত করে প্রয়োগ করা যেতে পারে। মাছের খাবারের সাথে বাড়তি ফিড এডিটিভস (এ্যামিনো এসিড) এবং বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন প্রিমিক্স মিশিয়ে খাওয়ালে মাছের খাদ্যের পুষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করা যায়, খাদ্যের হজম বা পরিপাক ত্বরান্বিত হয় এবং খাদ্যের আত্তিকরণ বাড়িয়ে খাদ্যের মাংসে রূপান্তর হার (ঋববফ ঈড়হাবৎংরড়হ জধঃরড়-ঋঈজ) বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি এ সকল উপকরণ মাছের খাদ্য গ্রহণের রুচি বাড়িয়ে দেয় এবং পিলেট ও ভাসমান খাদ্যের পানিতে স্থায়িত্বকালও (ডধঃবৎ ঝঃধনরষরঃু) বাড়িয়ে দেয়। এভাবে অনুপুষ্টির অভাব পূরণ করা গেলে মাছের বর্ধন হার বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় ও মাছ ভালো থাকে।
সার প্রয়োগ : পুকুরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগের পাশাপশি প্রাকৃতিক খাবারের প্রাচুর্যতা বৃদ্ধির জন্য পুকুরে নিয়মিত জৈব-অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। এসব প্রাকৃতিক খাবার মাছের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখা এবং মাছের মাংসের স্বাদও বৃদ্ধি করে। সাধারণত পুকুরে শতকে ১০০-১৫০ গ্রাম হারে  ইউরিয়া ও টিএসপি সারপ্রয়োগ করতে হয়। জৈবসার হিসেবে সরিষার খৈল ব্যবহারই উত্তম। কারণ সরিষার খৈলে রুই মাছের পছন্দের জুপ্লাংটনের প্রাচুর্যতা বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। তবে মনে রাখা দরকার যেসব পুকুরে নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ করা হয় সেসব পুকুরে ইউরিয়া সার কম দিতে হবে এবং যেসব পুকুরে নিয়মিত ভিজা খাবার প্রয়োগ করা হয় সেসব পুকুরে সাধারণত ইউরিয়া সার প্রয়োগ না করাই ভালো। কেবল টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। কারণ এসব পুকুরে মাছের পায়খানা থেকে পর্যাপ্ত নাইট্রোজেন ঘটিত যৌগ পদার্থ নিয়মিত পুকুরের পানিতে যুক্ত হয়। ফলে অনেক সময় নাইট্রোজেনের এ প্রাচুর্যতা পুকুরে ফাইটোপ্লাংকটনের ব্লুম ঘটিয়ে পুকুরে অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। পানি হালকা সবুজ বা হালকা বাদামি রঙ থাকা ভালো। পানি গাঢ় সবুজ হলে সার দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। পুকুরের পানির রঙ এবং জুপ্লাংকটনের উপস্থিতি দেখে পুকুরে সার দেবার প্রয়োজন আছে কি না বুঝতে হবে। সরিষার খৈল ২৪ ঘণ্টা পর্যাপ্ত পরিমাণ পানিতে ভিজিয়ে রেখে পুকুরে প্রয়োগের সময় ভালোভাবে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। বৃষ্টির দিনে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। টিএসপি ব্যবহারের আগে ১০-১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে গুলিয়ে নিতে হবে, দানাদার অবস্থায় টিএসপি সার পুকুরে ব্যবহার করা ঠিক নয়। সার প্রয়োগ ছাড়াও পুকুরে পর্যাপ্ত জুপ্লাংটন তৈরির জন্য ইস্ট মোলাসেস পদ্ধতিও অনুসরণ করা যেতে পারে।
পুকুরে চুন প্রয়োগ : পুকুরের পানির পরিবেশ ভালো রাখার জন্য মাছচাষ চলাকালে প্রতি মাসে একবার বিঘাপ্রতি ৫-৬ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে। পানির পিএইচ ৭.৫-৮.৫ বজায় রাখতে হবে। ক্ষারীয় পরিবেশে সারের কার্যকারিতা ভালো হয়। মাছ থাকা অবস্থায় পুকুরের পানিতে চুন ভিজানো মাছের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পুকুরে সকাল ৭-৮ ঘটিকার মধ্যে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন অধিক সময় ধরে ভিজিয়ে রাখলে চুনের কার্যকারিতা কমে যায়। চুন প্রয়োগের আগে পুকুরের পানির পিএইচ অবশ্যই মেপে নিতে হবে। পিএইচ ৭ এর উপরে থাকলে পুকুরে চুন প্রয়োগের প্রয়োজন নাই। মেঘলা দিনে পুকুরে চুন প্রয়োগ না করাই ভালো।
মাছের বাজার দরের সাথে মাছের উৎপাদন খরচের সমন্বয় নাই বলে অনেক চাষিগণ মনে করেন। এমতাবস্থায় মাছ চাষে  লাভবান হতে মাছের উন্নতজাতের কোনো বিকল্প নাই। রুই মাছ চাষের সাথে আমাদের মাছচাষিগণ আগে থেকেই পরিচিত। সুবর্ণ রুই মাছের পোনার প্রাপ্যতা সহজ করাই এখন সময়ের দাবি। আশা করা যায় চাষিরা এ মাছ চাষে বর্ধিত উৎপাদন পেয়ে অধিক লাভবান হবেন।  

লেখক : উপপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, খুলনা। মোবাইল: ০১৯৮৮১১০২৪২, ইমেইল:tofaz2010@gmail.com

বিস্তারিত
সবজি রপ্তানি বৃদ্ধিতে উত্তম কৃষি চর্চা

সবজি রপ্তানি বৃদ্ধিতে উত্তম কৃষি চর্চা
প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
বাংলাদেশে গত এক যুগে সবজি উৎপাদনে ঘটে গেছে এক নীরব বিপ্লব। বর্তমানে বছরে প্রায় দুই কোটি টন সবজি উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বে সবজি উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। এটা দেশের কৃষি ও কৃষকের জন্য এক বিশাল অর্জন ও গর্বের বিষয়। দেশে বর্তমানে প্রায় শতাধিক ধরনের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এই সবজি উৎপাদনের সঙ্গে দেশের ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষি পরিবার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশের কৃষি গত পাঁচ দশকে খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তোরণ ঘটেছে। এখন আমাদেরকে রপ্তানিমুখী কৃষির দিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ৫০টিরও বেশি দেশে সবজি রপ্তানি হচ্ছে। সবজি রপ্তানি বাড়াতে হলে কৃষকদের উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণপূর্বক নিরাপদ সবজি উৎপাদন করতে হবে। এতে  কৃষক যেমন লাভবান হবেন, তেমনি দেশের মানুষ থাকবেন রোগমুক্ত, পরিবেশ থাকবে নিরাপদ এবং অর্জিত হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস বা উত্তম কৃষি চর্চা সংক্ষেপে গ্যাপ (এঅচ) নামে পরিচিত। এটি হলো সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রমে অনুসরণকৃত একগুচ্ছ নীতি-বিধি ও প্রযুক্তিগত সুপারিশমালা যা সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন, সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি পরিবহনের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োগ করা হয়। উত্তম কৃষিচর্চা নীতি, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পণ্যের মান উন্নয়ন ও কৃষিশ্রমিকের সুস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশ উন্নত করে থাকে। ইউরোপের সুপারশপে কৃষিপণ্য সরবরাহকারীদের উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে ইউরোপগ্যাপ কার্যক্রম শুরু হয়, যা ২০০৭ সালে গ্লোবালগ্যাপ নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব উত্তম কৃষি চর্চা বা গ্যাপ কার্যক্রম চালু করে। আমাদের দেশেও বাংলাদেশ গ্যাপ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আশা করি অচিরেই এর সার্টিফিকেশন শুরু হবে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নিরাপদ ফসল উৎপাদনসহ রপ্তানি বাজারে প্রবেশের জন্য গ্যাপ অনুসরণ অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ গ্যাপ বাস্তবায়নের ফলে উৎপাদিত  কৃষি পণ্য নিরাপদ, উন্নত ও মানসম্পন্ন হবে, আয় বৃদ্ধি ও অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারসহ টেকসই পরিবেশ ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এ লক্ষে প্রণয়নকৃত দলিলটি ‘বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা-২০২০’ নামে ডিসেম্বর ২০২০ থেকে কার্যকর হয়।
উত্তম কৃষি চর্চার উদ্দেশ্য হলো নিরাপদ ও খাদ্যমান সম্পন্ন ফসলের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিতকরণ; ফসল উৎপাদনে সহনীয় পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং কর্মীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও কল্যাণ সাধন; খাদ্য শৃঙ্খলের সকল স্তরে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করা; ভোক্তার স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মানসম্পন্ন উচ্চমূল্য ফসল উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি করা। বিশ্বব্যাপী খাদ্যসামগ্রী আমদানি ও রপ্তানির ফলে খাদ্য শৃঙ্খলে জীবাণুসমূহের সংক্রমণ এবং বিস্তৃতি ঘটার আশঙ্কা থাকে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণের মাধ্যমে এ ঝুঁকি মোকাবিলা করা যায়। সবজি ফসল উৎপাদনে নিরাপদ খাদ্য সংশিষ্ট বিষয়সমূহ হলো প্রয়োগকৃত রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ, দূষণকারী বস্তুর উপস্থিতি, পোকামাকড়, রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব, বাহ্যিক সংক্রামক ইত্যাদি। এছাড়াও ফসলে অনেকসময় ভারী ধাতব বস্তু যেমন আর্সেনিক বা বিষাক্ত দ্রব্যের উপস্থিতি দেখা যায়। নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিপত্তি /ঝুঁকি খাদ্য শৃঙ্খলের যে কোনো পর্যায়ে ঘটতে পারে। তাই খাদ্য শৃঙ্খলের প্রত্যেক স্তরেই নিরাপদ খাদ্য সংক্রান্ত সমস্যা প্রতিরোধ বা দূরীভূত করা প্রয়োজন। খাদ্য শৃঙ্খলের সকল স্তরে সুনির্দিষ্ট অনুশীলনসমূহ সঠিকভাবে অনুসরণ করাই হচ্ছে উত্তম কৃষি চর্চার মূল ভিত্তি। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষক পর্যায় থেকে প্রতিটি স্তরে প্রত্যেক কর্মীকে তার নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়ে দায়িত্বশীল থেকে সকল কার্যক্রমের বিবরণ যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করা আবশ্যক। উৎপাদনকারীকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে উৎপাদিত পণ্য খাদ্য হিসেবে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ। এক্ষেত্রে উৎপাদকের পাশাপাশি প্যাকেজিং, সরবরাহ, পরিবহন, গুদামজাতকরণ ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় সকলেরই দায়িত্ব খাদ্যকে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন রাখা। উত্তম কৃষি চর্চা বাস্তবায়নের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ।
উত্তম কৃষি চর্চা সারা পৃথিবীতে নিরাপদ কৃষি পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিষয়টি কঠোরভাবে অনুসরণ করে এবং ইহা সবার নিকট গ্রহণযোগ্যও বটে। পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশেও রয়েছে নিরাপদ খাদ্যমান নিশ্চিতকরণের নিজস্ব উত্তম কৃষি চর্চা। মানবস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক বিবেচনায় নিরাপদ খাদ্য ক্রমাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জনগণকে খাদ্যজনিত অসুস্থতা থেকে রক্ষার পাশাপাশি বিশ্ব রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতার কারণে নিরাপদ ফসল উৎপাদন জরুরি।
উত্তম কৃষি চর্চা-নিরাপদ ও মানসম্মত খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পরিবেশ এবং সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।কৃষিকার্যে ব্যবহৃত উপকরণ যেমন ঃ বালাইনাশক, জৈব ও রাসায়নিক সার, পানি ইত্যাদির পরিমিত ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব ফসল ব্যবস্থাপনাকে উত্তম কৃষি চর্চা উৎসাহিত করে। সবজি উৎপাদনের উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করলে-ভৌত, রাসায়নিক বা অনুজীবিয় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সবজি চাষ করা যাবে না। গুণগত মানসম্পন্ন বীজ বা চারা লাগাতে হবে। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজনমাফিক সার দিতে হবে। সেচের ক্ষেত্রে নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে হবে। বালাই দমনে আইপিএম বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ বালাইনাশক ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও রাসায়নিক বালাইনাশকের ক্ষেত্রে অবশ্যয় সংগ্রহপূর্ব অপেক্ষমানসময় মেনে চলতে হবে। বালাইনাশক ও বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিকের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহার থেকে কৃষি কাজে নিয়োজিত কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ফসল সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর কাজে নিয়োজিত কৃষিশ্রমিকদের হাইজিন বা ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং এসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কৃষিকাজের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া শাকসবজি চাষের খুবই উপযোগী। দেশে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির ফলন বেড়েই চলেছে। তাই সময় এসেছে এখন নিরাপদ সবজি উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি বাড়ানোর। আর এর জন্য যে বিষয়টি খুবই জরুরি তা হলো গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস বা গ্যাপ অনুসরণে ফসল উৎপাদন। গ্যাপ অনুসরণে ফসলের উৎপাদন করলে উৎপাদন খরচ কমে এবং কৃষি কার্যক্রম টেকসই হয়। পাশাপাশি পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে।

লেখক : চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, মোবাইল : ০১৮১৯৮২৩০৩০, ই-মেইল : nomanfarook@yahoo.com         

 

বিস্তারিত
বাংলাদেশে লিলিয়াম চাষ : বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

বাংলাদেশে লিলিয়াম চাষ : বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
ড. ফারজানা নাসরীন খান১ আফরোজ নাজনীন২ কারিমাতুল আম্বিয়া৩
বর্তমান বিশে^ ফুল বাণিজ্যে লিলিজাতীয় ফুলের চাহিদা অনেক। কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে লিলির বেশ কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে লিলিয়াম অন্যতম। লিলিয়াম লিলিয়েসি পরিবারভুক্ত একটি বর্ষজীবী কন্দ জাতীয় ফুল যাকে মূল লিলি  হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আন্তর্জাতিক কাট ফ্লাওয়ার বাণিজ্যে শীর্ষ ১০টি ফুলের মধ্যে এ ফুল ৪র্থ স্থান দখল করে আছে। লিলিয়ামের অন্যতম আকর্ষন এর বর্ণবৈচিত্র, দীর্ঘস্থায়িত্ব ও সুগন্ধ যা সৌন্দর্য বাড়াতে, বৈচিত্র্য আনতে ও পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলতঃ দুধরনের লিলিয়াম পাওয়া যায়-এশিয়াটিক ও অরিয়েন্টাল লিলিয়াম। এশিয়াটিক লিলিয়াম গন্ধহীন কিন্তু বর্ণের বৈচিত্র অনেক বেশি এবং এর চাষাবাদ তুলনামূলকভাবে সহজ। অন্যদিকে অরিয়েন্টাল লিলিয়াম সুগন্ধযুক্ত, তুলনামূলকভাবে বেশি নি¤œ তাপমাত্রা পছন্দ করে। ব্যাপক চাহিদার জন্য পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে চীন থেকে এ ফুলটি অনেক দিন থেকেই এদেশে আমদানী হচ্ছে এবং উচ্চমূল্যে এদেশের ফুলপ্রেমীদের কাছে বিক্রি হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষকৃত ফুলের সাথে সংযোজন হয়েছে লিলিয়াম নামক ফুলটির। অত্যন্ত আশার কথা যে, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটিতে স্বল্প পরিসরে বাণিজ্যিকভিত্তিতে লিলিয়ামের চাষ শুরু হয়েছে এবং অধিক মুনাফা অর্জনের দিক থেকে অন্যান্য ফুলের চেয়ে এটি বেশ লাভজনক।
এদেশে এ ফুলটির ব্যাপক চাহিদার কথা চিন্তা করে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফুল বিভাগের বিজ্ঞানীরা লিলিয়াম ফুলের উপর সর্বপ্রথম গবেষণা শুরু করেন। ২০১৭ সালে এনএটিপিয়ের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ফুল বিভাগ লিলিয়াম ফুলের বিভিন্ন জাত সংগ্রহ, মূল্যায়ন, বৈশিষ্ট্যকরণ ও কন্দ সংরক্ষণের উপর গবেষণা করে সফলতা লাভ করে যার ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে বারি লিলিয়াম-১ এবং বারি লিলিয়াম-২ নামে দু’টি লিলিয়ামের জাত অবমুক্ত করা হয়। বর্তমানে এ ফুলের দ্রুততম সময়ে ভালো মানের কন্দ উৎপাদনসহ বেশ কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে বিশেষ করে কৃষক পর্যায়ে লিলিয়াম চাষ জনপ্রিয়করণ করার লক্ষ্যে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে যার মাধ্যমে ইতিমধ্যে ফুল চাষীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ বৎসরের শীত মৌসুমে  ঢাকা (সাভার), গাজীপুর, রংপুর এবং যশোরে প্রশিক্ষক ও কৃষকদের মাঝে এ ফুলের উৎপাদন কলাকৌশল, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, আপদ ব্যবস্থাপনা, বাল্ব/কন্দ উৎপাদন ও সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং বর্তমানে এসব স্থানে লিলিয়াম ফুলের উপর প্রদর্শনী চলমান রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে গত মৌসুমে প্রদর্শনীপ্রাপ্ত ফুলচাষিরা এ বৎসর পূর্ববর্তী বাল্ব/কন্দ ব্যবহার করে লিলিয়াম চাষ করছেন এবং আকর্ষনীয় মূল্যে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন যা ভবিষ্যত লিলিয়াম চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবনারই ইঙ্গিত বহন করে।   
লিলিয়াম চাষের জন্য মৃদু আবহাওয়া প্রয়োজন। ভালো মানের ফুল উৎপাদনের জন্য দিনের তাপমাত্রা ২০-২৫০ সে. এবং রাতের তাপমাত্রা ১০-১৫০ সে. হওয়া বাঞ্ছনীয়। ৫০% আলো প্রতিরোধ করতে পারে এমন টঠ পলিথিন/এগ্রো শেড নেট ব্যবহার করলে ভালো মানের ফুল উৎপাদন করা যায়। তবে বর্তমানে অল্প দামের মশারী নেট ব্যবহার করেও লিলিয়াম চাষ করা যাচ্ছে। সুনিষ্কাশিত এবং পর্যাপ্ত জৈবসার সমৃদ্ধ বেলে  দো-আঁশ মাটি লিলিয়াম এর জন্য উপযোগী। সাধারণত এশিয়াটিক লিলিয়ামের জন্য মাটির ঢ়ঐ ৬-৭ এবং অরিয়েন্টাল লিলিয়ামের জন্য ঢ়ঐ ৫.৫-৬.৫ থাকা ভালো।
লিলিয়াম সাধারণত বাল্ব/কন্দের মাধ্যমে বংশবিস্তার করা হয়। উৎকৃষ্ট মানের কন্দ তৈরি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আন্তর্জাতিক বাজারে যে কন্দ বিক্রি হয় তা সাধারণত টিস্যু কালচার পদ্ধতির মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় যাতে ভাইরাসমুক্ত কন্দের মাধ্যমে ভালো মানের ফুল উৎপাদন করা সম্ভব হয় এবং বাণিজ্যিক চাষাবাদের জন্য এ পদ্ধতি সবচেয়ে উত্তম। এতে অল্প সময়ে প্রচুর সংখ্যক রোগমুক্ত কন্দ পাওয়া যায়। তাছাড়াও শল্ক (ঝপধষব), গুঁড়ি কন্দ (ইঁষনষবঃং), বুলবিল (ইঁষনরষং) ইত্যাদির মাধ্যমেও বাল্ব/কন্দ উৎপাদন করা সম্ভব। যদিও এক্ষেত্রে সময় কিছুটা বেশি প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশে অক্টোবর-ডিসেম্বর মাস লিলিয়াম বাল্ব লাগানোর উপযোগী সময়। রোপণ সময়ের তারতম্যের মাধ্যমে বেশি সময় ধরে ফুল পাওয়া যায় যার মাধ্যমে চাষিরা বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হতে পারেন। তাছাড়া একই সময়ে বেশি ফুল ফুটে গেলে বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি হয় বলে ফুলের দাম বেশ কমে যায়। বড় (৩-৫ সেমি), পরিষ্কার এবং রোগমুক্ত কন্দ ১৫ সেমি ী ১৫ সেমি দূরত্বে এবং ১০-১২ সেমি গভীরে রোপণ করলে ভাল মানের ফুল পাওয়া যায়।
লিলিয়াম চাষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ কোকোডাষ্ট মিশাতে হবে যাতে জমির ২৫-৩০ সেমি নিচ পর্যন্ত কোকোডাস্ট পাওয়া যায়। কোকোডাস্ট ব্যবহারের ফলে মাটি ঝুরঝুরা থাকে এবং মাটিতে বাতাস চলাচল করতে পারে। লিলিয়াম জলাবদ্ধতা একদমই পছন্দ করে না এবং এ অবস্থায় বিভিন্ন রোগ জীবাণুর আক্রমণ হয়। ফলে সেচের বিষয়ে খুব সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত এবং বেড করে চাষ করা প্রয়োজন।
ভালো মানের লিলিয়াম ফুল উৎপাদনের জন্য সঠিক পরিমাণ সারের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা জলবায়ূ, মাটির প্রকৃতি, সেচ প্র্রয়োগ পদ্ধতি, জাত, বাল্বের আকার ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। ভালো ফলন পেতে হলে লিলিয়ামের জমিতে বেশি পরিমাণে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। লিলিয়াম কন্দজ ফুল হওয়ায় এর কন্দের মধ্যেই অধিকাংশ পুষ্টি উপাদান সঞ্চিত থাকে। তাই কন্দ রোপণের প্রথম ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত মাটিতে কোন সার প্রয়োগ না করাই ভাল। কন্দ রোপণের প্রথম ৩ সপ্তাহ পর ঘচক ৩০:২০:২০ গ্রাম/প্রতি বর্গ মিটারে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। পরবর্তী ৩ সপ্তাহ পর প্রতি ১০০ বর্গ মিটারে ১ কেজি ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এবং ৬ সপ্তাহ পর প্রতি ১০০ বর্গ মিটারে ১ কেজি পটাসিয়াম নাইট্রেট প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। নাইট্রোজেনের অভাব দেখা দিলে ফুল কাটার ৩ সপ্তাহ পূর্বে প্রতি ১০০ বর্গমিটারে ১ কেজি পরিমাণ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট উপরিপ্রয়োগ করা যেতে পারে। বাণিজ্যিক লিলিয়াম চাষে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ নাইলনের তৈরি সাপোর্টিং নেট দেয়া যাতে গাছ লম্বা হয়ে হেলে না যায়। গাছের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে সাপোর্টিং নেটকেও উপরে উঠিয়ে দিতে হবে।
জাতভেদে বাল্ব/কন্দ রোপণের ৬০-৯০দিন পরে ফুল সংগ্রহের উপযোগী হয়। স্টিকের নিচের দিকের ২-৩টি ফ্লোরেটে হালকা রং দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ফুল সংগ্রহ করা উচিত। ফুল পুরোপুরি ফোটার পর ফুল সংগ্রহ করলে পরিবহনের সময় ফুল নষ্ট হয়ে যায়। মাটির নিচে বাল্বের যথোপযুক্ত বৃদ্ধির জন্য ভূমি থেকে স্টিকের ১০-১২ সেমি উপরে কাটতে হবে।
গাছে ফুল দেয়া শেষ হলে ভালো মানের বাল্ব তৈরির জন্য বাল্বকে ৬-৭ সপ্তাহ মাটিতে রেখে দিতে হবে। বিশেষ করে যখন পরিত্যক্ত কা- শুকিয়ে যায় তখনই বাল্ব তোলার উপযুক্ত সময়। মাটি থেকে শুকনো কা-সহ কন্দ এমনভাবে তুলতে হবে যাতে কন্দ কোনভাবেই আঘাত প্রাপ্ত না হয়। উত্তোলনের পর বড়, রোগমুক্ত, ভালো কন্দসমূহকে সংরক্ষণের জন্য বাছাই করে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে অটোস্টিনে (২ গ্রাম/লিটার পানি) শোধন করে ছায়ায় শুকাতে হবে। বাল্ব/কন্দ সংরক্ষণের জন্য কোল্ডস্টোরেজের সুবিধা থাকতে হবে। শুকানোর পরপরই কন্দ প্লাষ্টিক ক্রেটে আর্দ্র কোকোডাস্ট/কাঠের গুড়া/কোকোডাস্ট ও কাঠের গুড়া -এ রেখে কোল্ডস্টোরেজে ২-৩ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ৬-৮ সপ্তাহ সংরক্ষণ করতে হবে। বেশিদিন সংরক্ষণ করতে হলে উক্ত তাপমাত্রায় ২ সপ্তাহ রেখে পরবর্তীতে -১ ডিগ্রি সে. এ রাখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিক লিলিয়াম চাষের প্রধান অন্তরায় ভালো মানের কন্দ উৎপাদন ও সংরক্ষণের সুবিধার অভাব। তাই কন্দ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় যাতে প্রচুর সময় এবং অর্থের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া কন্দ আমদানির জন্য এলসি বিষয়ক জটিলতার জন্য সময়মতো কন্দ আমদানি করা সম্ভব হয় না। যেহেতু বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটিতে সাফল্যজনকভাবে লিলিয়াম চাষ হচ্ছে এবং অধিক মুনাফা অর্জনের দিক থেকে অন্যান্য ফুলের চেয়ে এটি বেশ লাভজনক। সর্বোপরি এদেশে এ ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে তাই গবেষণার পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হলে দেশেই ভালো মানের কন্দ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করা সম্ভব। ফলে এদেশে বাণিজ্যিক লিলিয়াম চাষ সম্প্রসারিত হবে এবং বাজার চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে এবং সেই সাথে লিলিয়াম কন্দ ও ফুল আমদানি অনেকাংশে হ্রাস পাবে।

লেখক : ১পিএসও, ২-৩এসও, ফুল বিভাগ, উগকে, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৯১০০৪৭১৯১, ই-মেইল : kham_farjana@yahoo.com

বিস্তারিত
তরমুজের আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল

তরমুজের আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল
ড. একেএম কামরুজ্জামান
তরমুজ বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় ফল সমূহের একটি। এটি বেশ পুষ্টিকর এবং উপাদেয় ফল। বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদশের বিভিন্ন জায়গায় এর চাষ হয়ে থাকে। তরমুজের উল্লেখযোগ্য পুষ্টি সমূহ হচ্ছে- ভিটামিন, মিনারেল ও এন্টিঅক্সিডেন্ট। প্রতি ১০০ গ্রাম তরমুজে ৯২% পানি, ৩০ কিলোক্যালরি শক্তি, ০.৬১ গ্রাম আমিষ, ০.১৫ গ্রাম চার্বি, ০.৪ গ্রাম আঁশ, ৬.২ গ্রাম শ্বেতসার, ২৩০ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন, ৫৬৯ ওট ভিটামিন এ, ০.৪৯৮ মিলি গ্রাম ভিটামিন বি, ৮.১ মিলি গ্রাম ভিটামিন সি, ১১২ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ৭ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১১ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ০.২৪ মিলিগ্রাম লৌহ রয়েছে।
জলবায়ু ও মাটি : বেশি শীতও না, আবার বেশি গরমও না এমন আবহাওয়া তরমুজ চাষের জন্য উত্তম। তরমুজের ভালো ফলনের জন্য সবচেয়ে অনুকূল তাপমাত্রা হলো দিনের বেলায় ২৫-২৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং রাতের বেলায় ১৮-২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। মেঘলা আবহাওয়ায় তরমুজরে ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ মাটিই এর চাষের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট।
জাত ও বীজের হার : বারি তরমুজ-১, বারি তরমুজ-২, পাকিজা, সুইট ক্রাঞ্চ, ব্ল্যাক চ্যাম্প, কারিশমা। বীজের পরিমাণ ৫০০-৭০০  গ্রাম/হেক্টর  
শোধন ও বপনের সময় : প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম অটোস্টিন ব্যবহার করে ভালোভাবে ঝাকিয়ে বীজ শোধন করা যায়। বীজ শোধনের ফলে তরমুজের এ্যানথ্রাকনোজ, লিফস্পট, ব্লাইট ইত্যাদি রোগ ও বপন পরবর্তী সংক্রামন রোধ সম্ভব হয়।
জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা বছরই এই জাতের তরমুজ চাষ করা যায়। এই জাত বছরে ৩ বার চাষ করা যায় যেমন- জানুয়ারি, মে ও সেপ্টেম্বর মাসে বীজ বপন করা যায় এবং ৪ মাসের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়।
চারা উৎপাদন, বীজ তলায় চারার পরিচর্যা ও চারার সংখ্যা :
পলিথিন ব্যাগে চারা তৈরি করাই উত্তম। এতে বীজের খরচ কম লাগে। পলিথিন ব্যাগে চারা উৎপাদন করতে হলে প্রথমে অর্ধেক মাটি ও অর্ধেক গোবর মিশিয়ে মাটি তৈরি করে পলিব্যাগে ভরতে হবে। অতঃপর প্রতি ব্যাগে ১টি করে বীজ বুনতে হবে। নার্সারিতে চারার প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে। বেশি শীতে বীজ গজানোর সমস্যা হয়। এজন্য শীতকালে চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজ গজানোর পূর্ব পর্যন্ত প্রতি রাতে প্লাস্টিক দিয়ে চারা ঢেকে রাখতে হবে এবং দিনে খোলা রাখতে হবে। চারাগাছে ‘রেড পামাকিন বিটল’ লালচে পোকার ব্যাপক আক্রমণ হয়। হাতে ধরে এ পোকা সহজে দমন করা যায়। চারার বয়স ২২-২৫ দিন হলে মাঠে প্রস্তুত গর্তে লাগাতে হবে। ২.০ মি প্রশস্ত বেডে এক সারিতে গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ১.৫ মি. হয়ে থাকে। হেক্টর প্রতি চারার সংখ্যা ২৯০০টি।  
জমি ও বেড তৈরি : এসব ফসল চাষে সেচ ও নিকাশের উত্তম সুবিধাযুক্ত এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। বেডের উচ্চতা হবে ১৫-২০ সেমি.। বেডের প্রস্থ হবে ২.০ মিটার এবং লম্বা জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে সুবিধামত নিতে হবে। এভাবে পরপর বেড তৈরি করতে হবে। এরূপ পাশাপাশি দুইটি বেডের মাঝখানে ৩০ সেমি. ব্যাসের সেচ নালা থাকবে।
বর্ষাকালে চাষ
যদি বর্ষাকালে অর্থাৎ জুন-সেপ্টেম্বর মাসে চাষ করা হয় তাহলে বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাচাতে চাষ করা যায়। সেক্ষেত্রে ৩.০ মিটার বেডের দুই পার্শ্বে ১.০ মিটার দূরত্বে মাদা তৈরি করতে হবে এবং গাছ রোপণ করতে হবে।   
চারার বয়স ও রোপণ : বীজ গজানোর পর ২২-২৫ দিন বয়সের চারা মাঠে লাগানোর জন্য উত্তম। মাঠে প্রস্তুত মাদাগুলোর মাটি ভালোভাবে ওলট-পালট করে, এক কোপ দিয়ে চারা লাগানোর জন্য জায়গা করে নিতে হবে। অতঃপর মাটির দলাসহ চারাটি নির্দিষ্ট জায়গায় লাগিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে। চারা লাগানোর পর পানি দিতে হবে। চারা রোপণের সময় সাবধান থাকতে হবে যাতে চারার শিকড় ক্ষতিগ্রস্থ না হয় নতুবা শিকড়ের ক্ষতস্থান দিয়ে ঢলে পড়া রোগের (ফিউজারিয়াম উইল্ট) জীবাণু ঢুকবে এবং শিকড় ক্ষতিগ্রস্থ হলে গাছের বৃদ্ধি দেরিতে শুরু হবে।
সার ব্যবস্থাপনা : সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি সারণি দ্রষ্টব্য।
পরবর্তী পরিচর্যা : তরমুজ পানির প্রতি খুবই সংবেদনশীল। প্রয়োজনীয় পানির অভাব হলে ফল ধারণ ব্যাহত হবে এবং যেসব ফল ধরেছে সেগুলোও আস্তে আস্তে ঝরে যাবে। কাজেই সেচ নালা দিয়ে প্রয়োজন অনুসারে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে ৫-৭ দিন অন্তর সেচ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। গাছের সঠিক বৃদ্ধির জন্য কালো রঙের মালচিং পেপার ব্যাবহার করলে বেশ উপকার পাওয়া যায়। যেমন- আগাছা নিয়ন্ত্রণ, সেচের পানি সাশ্রয় ও রোগ পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। জমি সবসময়ই আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। গাছের গোড়ায় আগাছা থাকলে তা খাদ্যোপাদান ও রস শোষণ করে নেয়। চারা রোপণের পর গাছ প্রতি সারের উপরি প্রয়োগের যে মাত্রা উল্লেখ করা আছে তা প্রয়োগ করতে হবে। যদি মালচ পেপার ব্যবহার করা হয়, তাহলে ইউরিয়া ও এমওপি সার মাত্রা অনুযায়ী পানিতে গুলিয়ে (১-সার :১০০-পানি) অনুপাতে সার যুক্ত পানি মালচিং পেপার গাছ এর গোড়ায় দিতে হবে।
ফল ধারণ বৃদ্ধিতে কৃত্রিম পরাগায়ন : হাত দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়ন করে ফলন শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাছাড়া ফল ধরার জন্য হেক্টর প্রতি ২-৩ টি মৌমাছির কলোনী স্থাপন করা প্রয়োজন।
বিশেষ পরিচর্যা : গাছের গোড়ার দিকে ছোট ছোট ডালপালা হয়। সেগুলোকে শোষক শাখা বলা হয়। এগুলো গাছের ফলনে এবং যথাযথ শারীরিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়। কাজেই গাছের গোড়ার দিকে ৪০-৪৫ সেমি. পর্যন্ত ডালপালাগুলো ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে অপসারণ করতে হবে। সময়মতো সেচ দিয়ে অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ নিড়ানি দিতে হবে।  
ফসল তোলা (পরিপক্বতা শনাক্তকরণ) ও ফলন : একটি গাছে ৩-৪টি ফল ধরলে তা যথেষ্ট। ফলের গায়ে টোকা দিলে যদি ডাব ডাব শব্দ হলে তবে ফল পরিপক্ব হয়েছে বলে প্রতীয়মান হবে। ফলের বিপরীত দিকে আকর্ষী গুলো যদি শুকিয়ে যায় তবে ফল পরপিক্ব হয়েছে বলে প্রতীয়মান হবে। জাত ও মৌসুম ভেদে পরাগায়নের ৪২-৪৫ দিন পর ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়। বিঘা প্রতি ৪-৫ টন ফলন হয়।
বীজ উৎপাদন : বারি তরমুজ ১ ও বারি তরমুজ ২ স্বপরাগী জাত হওয়ার কারনে এদের বীজ কৃষক নিজেই উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারবে। তরমুজের একই গাছে পুরুষ ও ċŪ ফুল ভিন্ন ভিন্ন থাকে। তরমুজের ফুল সকালে ফোটে। এক্ষেত্রে পুরুষ ও ċŪ ফুল ফোটার আগের দিন বিকালে কাগজের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যাতে অন্য জাতের পুরুষ ফুলের পরাগ রেণু দ্বারা পরাগায়িত হতে না পারে। পরের দিন সকাল নয়টার মধ্যে পুরুষ ফুল ছিড়ে এনে ċŪ ফুলের গর্ভমু-ে স্পর্শ করে পরাগায়ন ঘটাতে হবে। পরাগায়িত করার পর আবার ব্যাগ দ্বারা ċŪ ফুলটি ২-৩ দিন ঢেকে রাখতে হবে এবং লাল বা অন্য কোন রঙের ফিতা বেধে দিতে হবে।
বীজ সংগ্রহ : ফল যখন সম্পূর্ণ পরিপক্ব হয়ে যায়, তখন মাঠ থেকে নিয়ে আরো ৫-৭ দিন ঘরে রেখে দিতে হবে। এরপর তরমুজ কেটে বীজ বের করতে হবে। সংগ্রীহিত বীজ রোদে ভালো করে শুকিয়ে বায়ু নিরোধক পাত্রে ঠা-া ও শুকনো জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।
ক্ষতিকর বালাই দমন ব্যবস্থাপনা
মাছি পোকা : সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদের যৌথ ব্যবহার করা প্রয়োজন। ফেরোমন ৫০-৬০ দিন পর্যন্ত কার্যকরী থাকে বলে ব্যবহারের ৬০ দিন পর প্রয়োজনানুসারে পুরাতন ফেরোমন পরিবর্তন করে নতুন ফেরোমন ব্যবহার করতে হবে। বিষটোপ ফাঁদে পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষ মাছি পোকা আকৃষ্ট হয় এবং ফাঁদে পড়ে মারা যায়। সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদ কুমড়া জাতীয় ফসলের জমিতে ক্রমানুসারে ১২ মি: দূরে দূরে স্থাপন করতে হবে।
পামকিন বিটল : চারা অবস্থায় আক্রান্ত হলে হাত দিয়ে পূর্ণবয়স্ক পোকা ধরে মেরে ফেলা যায়। চারা বের হওয়ার পর থেকে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত মশারির জাল দিয়ে চারাগুলো ঢেকে রাখলে এ পোকার আক্রমণ থেকে গাছ বেঁচে যায়। আক্রমনের হার বেশি হলে চারা গজানোর পর প্রতি মাদার চারদিকে মাটির সাথে চারা প্রতি ২-৫ গ্রাম অনুমোদিত দানাদার কীটনাশক (কার্বফুরান জাতীয় কীটনাশক) মিশিয়ে গোড়ায় পানি সেচ দেয়া।
জাব পোকা : ক্ষেতে হলুদ আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করা প্রয়োজন। আক্রমণের শুরুতে বায়োনিম প্লাস (অুধফরৎধপঃরহ) @ ১মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত পাতায় ¯েপ্র করতে হবে। স্থানীয়ভাবে সুপারিশকৃত জৈব কীটনাশক (ফাইটোক্লিন, বায়োমেক্স এম, সাকসেস ২.৫ এস সি) ব্যবহার করা যেতে পারে। আক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি হলে imidacloprid গ্রুপ এর অনুমোদিত কীটনাশক  প্রয়োগ করে তা দমন করা যায়।
এনথ্রাকনোজ : রোগমুক্ত ভালো বীজ ব্যবহার করতে হবে। অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ব্যাভিষ্টিন/নোইন বা একোনাজল আক্রমণের শুরুতেই প্রয়োগ করতে হবে।
ফিউজারিয়াম উইলট : প্রতি ১ লিটার পানিতে ২ গ্রাম ডাইথনে এম এবং রিডোমিল গোল্ড ৭ দিন পর পর স্প্রে করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা।   

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সবজি বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সিটিউট, মোবাইল : ০১৭৫৪১১২০৫০, ই-মেইল :akmqzs@gmail.com

বিস্তারিত
গ্রীষ্মকালীন টমেটোর নীরব বিপ্লব

গ্রীষ্মকালীন টমেটোর
নীরব বিপ্লব
ড. মো. জামাল উদ্দিন
টমেটো শীতকালীন সবজি হলেও কৃষির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে এবং বিজ্ঞানীদের নব নব উদ্ভাবনে এটি এখন গ্রীষ্মকালেও চাষাবাদ হচ্ছে ব্যাপকভাবে। মে থেকে জুলাই মাসে লাগানো জাতের টমেটো শীতের আগ পর্যন্ত সময়েও বাজারে পাওয়া যায়। ভারত থেকে গ্রীষ্মকালীন টমেটো আমদানি হলেও বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বারির সরেজমিন গবেষণা বিভাগের সহায়তায় দেশজুড়ে বারি উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন হাইব্রিড জাতের টমেটো কৃষক পর্যায়ে বিস্তার ঘটছে চোখে পড়ার মতো। টমেটো চাষে কৃষকের সফলতার গল্পও শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এ যাবৎ বেশ কিছু গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব জাতের মধ্যে বারি হাইব্রিড টমেটো-৪, হাইব্রিড টমেটো-৮, হাইব্রিড টমেটো-১০ ও হাইব্রিড টমেটো-১১ দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তারমধ্যে বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ সর্বোচ্চ শিখরে রয়েছে বলে জানা যায়। বিগত কয়েক বছর থেকে মাঠ পর্যায়ে এসব জাতের বিস্তারও ঘটছে উল্লেখযোগ্যভাবে। কৃষকও চাষাবাদ করে লাভের মুখ দেখছে।
টমেটো একটি পুষ্টিকর সবজিও বটে! ইউরোপে টমেটোর গুণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘টমেটো যদি লাল হয়, চিকিৎসকের মুখ হয় নীল।’ অর্থাৎ নিয়মিত টমেটো খেলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার দরকার হয় না। বারি সূত্র মতে, টমেটোতে রয়েছে আমিষ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘সি’সহ অনেক প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। ইয়ুথ হেলথ ম্যাগ ও টাইমস অব ইন্ডিয়া তথ্য সূত্রে, টমেটোতে রয়েছে বয়স প্রতিরোধী বিশেষ প্রভাব। টমেটোতে থাকা লাইকোপেন প্রোস্টেট, কলোরেকটাল বা পেটের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমিয়ে দেয়। শরীরের ত্বক কুঁচকে যাওয়া, ভাঁজ পড়া বা বলিরেখা পড়া দূর করতে পারে। টমেটো হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা দূর করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। টমেটোর মধ্যে থাকা ভিটামিন ‘বি’ ও পটাশিয়াম রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। চোখের দৃষ্টি উন্নত করতে টমেটোর ভূমিকা অপরিসীম। তাই শিশুদের ডায়েটে টমেটো রাখতে পারলে উপকার মিলবে।
বর্তমানে দেশে বছরে ১৫ হাজার মেট্রিক টন গ্রীষ্মকালীন টমেটো উৎপাদিত হচ্ছে, পাশাপাশি বিদেশ থেকে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন টমেটো আমদানি করতে হচ্ছে জানিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর মহাপরিচালক  ড. দেবাশীষ সরকার, গাজীপুরে অনুষ্ঠিত ‘বারি উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন হাইব্রিড টমেটো উৎপাদন ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, দেশে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উৎপাদন বাড়ানো গেলে কৃষকেরা যেমন লাভবান হবে একই সাথে আমাদের টমেটো আর আমদানি করার প্রয়োজন হবে না। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ হচ্ছে। এ বছর আমরা বারির পক্ষ থেকে আমাদের নিজেদের উৎপাদিত হাইব্রিড টমেটোর বীজ কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করেছি এবং আগামীতেও আমরা কৃষকদেরকে গুণগত মানসম্পন্ন বীজ তুলে দিতে চাই। আমরা আশা করছি দেশে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আমরা টমেটো রপ্তানির দিকে এগিয়ে যাবো।
গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন সাতক্ষীরার কৃষক। এ জেলার উৎপাদিত টমেটো স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা খুশি। ফলে দিন দিন  দেশের বহু জেলায় গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ বাড়ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রীষ্মকালীন উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাতের বারি টমেটো চাষের খুবই সম্ভাবনাময় জেলা সাতক্ষীরা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলায় ৭১২.৫০ বিঘা জমিতে উচ্চফলনশীল গ্রীষ্মকালীন বারি টমেটো চাষ হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক  ড. মো. জামাল উদ্দিন এর মতে, উচ্চফলনশীল গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ খুবই লাভজনক একটি ফসল। তবে এটি উৎপাদন খরচের পরিমাণও অনেক বেশি। তার পরও হেক্টরে ৮/৯ লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব। উক্ত সূত্রমতে, সাতক্ষীরা জেলা কাঁচামাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রহমান বলেন গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় টমেটো আমদানি বন্ধ থাকায় দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি কেজি গ্রীষ্মকালীন টমেটো ৮০-৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সাতক্ষীরা ছাড়াও সিলেট, মৌলভীবাজার, যশোর, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলাসহ দেশের বিভিন্ন উপজেলায় এর বিপুল সাড়া পড়েছে। এক কথায় বলা যায় নীরব বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। এটি গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষিদের জন্য একটি সুখবরই বটে! সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, দৌলতপুর, খুলনার প্রধান  বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হারুনর রশিদ জানান সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় বর্তমানে বারি হাইব্রিড জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ এক হাজার বিঘা ছাড়িয়েছে যা ২০১৮ সালে ২৫ বিঘা ছিল। এক বিঘা জমিতে ‘গ্রীষ্মকালীন টমেটো’ চাষ করতে খরচ হয় এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। ফসল আসে তিন-চার লাখ টাকার। কখনো কখনো পাঁচ লাখও ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়। এই মুহূর্তে অন্য কোনো ফসল এত লাভজনক নয়। তাই কৃষক বা উদ্যোক্তারা ঝুঁকছেন গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর গ্রামের উচ্চশিক্ষিত তরুণ কৃষি উদ্যেক্তা আহমদ নুর চলতি বছর পরীক্ষামূলকভাবে ১০ শতাংশ জায়গায় গ্রীষ্মকালীন বারি টমেটো-৮ চাষ করে এই পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কেজি টমেটো বিক্রি করেন। প্রতি কেজি টমেটো পাইকারি ৮০ টাকা দরে এবং খুচরা ১২০ টাকা দরে বিক্রি করতে পেরে তিনি বেশ খুশি। তিনি বলেন শীতকালীন টমেটোর চাইতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ অনেক লাভজনক। স্থানীয় কৃষি বিভাগের কাছ থেকে তিনি সকল ধরনের উপকরণ ও কারিগরি সহায়তা পেয়েছেন বলে জানান। তার দেখাদেখি অনেক কৃষক এ জাতের টমেটো চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে মন্তব্য করেন হাটহাজারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন সিকদার। শুধু হাটহাজারী নয় পার্বত্য জেলা বান্দরবানেও এর চাষ শুরু হয়েছে। এ জাতের টমেটো চাষে উপজাতি          কৃষকদেরও বেশ সাড়া মিলছে।
দেশের চাহিদার আলোকে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়াতে ‘বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর অভিযোজন পরীক্ষা, উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও কমিউনিটিভিত্তিক পাইলট প্রোডাকশন কর্মসূচি’ শীর্ষক সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারির তিন বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় দেশের বিভিন্ন জেলার ৩৩টি উপজেলায় এ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন ঘটছে। গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে আগ্রহী করে তুলতে প্রকল্প থেকে নিয়মিত হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ, উপকরণ সহায়তা, মাঠ দিবস ও উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়। বারির সিনিয়র বিজ্ঞানী ও উক্ত কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. ফারুক হোসেন বলেন চাষের ব্যবস্থাপনা উল্লেখ করে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষের ব্যবস্থাপনা শীতকালীন টমেটো চাষের ব্যবস্থাপনা থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। দুটো পদ্ধতিতে এ গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়ানো যায়। একটি হলো পলিশেড দিয়ে অপরটি হলো মাটিতে পলিথিনের মালচিং বিছিয়ে। শেষের পদ্ধতি খরচ সাশ্রয়ী। আর্লি উইন্টারে এ টমেটো পাওয়া যাবে, দামও বেশি পাবে। গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়ানো গেলে পতিত জমিও চাষের আওতায় নিয়ে আসা সহজ হবে এবং জমির উত্তম ব্যবহারও সুনিশ্চিত হবে। এ ধরনের কর্মসূচির ব্যাপকতা বাড়ানো গেলে বারি উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন টমেটোর জাতসমূহ মাঠ পর্যায়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে এবং সারা বছরব্যাপী টমেটো সরবরাহ বাড়বে।
বারি উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটো কৃষক পর্যায়ে দ্রুত বিস্তার ঘটাতে হলে এর উৎপাদন খরচ কমাতে নি¤েœাক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তা হলো: কৃষক পর্যায়ে বারি হাইব্রিড জাতের টমেটোর গ্রাফটেড চারা ও বীজ উৎপাদনে কৃষককে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ করে তুলে কমিউনিটি এপ্রোচের মাধ্যমে এগোতে হবে; বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে এসব জাত ও উৎপাদন কলাকৌশলের ওপর ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার; বেশি বৃষ্টিপাতকে এড়িয়ে কম বৃষ্টিপাতের সময়ে পলিশেড ছাড়াই পলি-মালচিং প্রয়োগ করে চারা লাগালে খরচ সাশ্রয় হবে; উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কৃষক দলভিত্তিক কার্যকর বিপণন চ্যানেল তৈরি করে টমেটো বাজারজাত করতে পারলে লাভবান হবে বেশি; দেশীয় উৎপাদন বাড়লে আমদানি সীমিত রাখা এবং লাগসই উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা কার্যক্রম চলমান রাখা দরকার মনে করেন।
জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় কৃষকের আয় বাড়াতে, পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বারি জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়ানো গেলে টমেটোর বছরব্যাপী দেশের চাহিদা পূরণ হবে এবং আমদানি নির্ভরতা কমবে। সে সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বারি, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। মোবাইল নং: ০১৮১৫৪২৫৮৫৭, ইমেইল: jamaluddin1971@yahoo.com

বিস্তারিত
ফাল্গুন মাসের তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা

ফাল্গুন মাসের তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
বোরো ধান
    ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরি প্রয়োগ করুন।
    ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখুন।
    রোগ ও পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শণ করুন এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (আলোর ফাঁদ পেতে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে) ধানক্ষেত বালাই মুক্ত রাখুন।
গম
    এ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম পাকা শুরু হয়। গম শীষের শক্ত দানা দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে গম কাটার সময় হয়েছে। রোদেলা দিন দেখে রিপার/রিপার বাইন্ডারের মাধ্যমে কম খরচে, স্বল্প সময়ে গম সংগ্রহ করুন।
    বীজ ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে খুবই তাড়াতাড়ি মাড়াই ঝাড়াই করুন।
    সংগ্রহ করা বীজ ভালো করে শুকানোর পর ঠান্ডা করে সংরক্ষণ করুন।
ভূট্টা (রবি)
    জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রং কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করুন।
ভূট্টা (খরিপ)
    খরিপ মৌসুমে ভূট্টা চাষ করতে চাইলে এমাসেই বীজ বপন করুন এবং প্রয়োজনীয় যত্ন নিন।
    অধিক ফলনের জন্য উচ্চফলনশীল আধুনিক জাত চাষ করুন।
    ভূট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি হাইব্রিড ভূট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভূট্টা-১০, বারি হাইব্রিড ভূট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভূট্টা-১৫ এসব।
পাট
    ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
    সারিতে পাট বীজ বপন করুন, আন্তপরিচর্যা সহজ হবে, ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি পাবে।
    ফাল্গুন মাসে বপন উপযোগী পাটের ভালো জাতগুলো হলো সিসি-৪৫, বিজেআরআই দেশী পাট শাক-১ (বিজেসি-৩৯০), তোষা পাট (ও ৯৮৯৭, ও-৭২)।
শাক-সবজি
    এ মাসে বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরী করে ডাঁটা, কমলিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে।
    মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন।
গাছপালা
    আমের মুকুলে এ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে প্রোপিকোনাজল আথবা মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে ¯েপ্র করুন। এছাড়া আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার ¯েপ্র করুন।
    হপার নিম্ফ দমনে আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক পানির সাথে মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে ¯েপ্র করুন।
    কাঁঠালের ফল পঁচা বা মুচি ঝরা রোধে কাঁঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করুন। মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার বোর্দ্রাে মিশ্রণ বা মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন।
বিবিধ
    উচ্চমূল্যের ফসল আবাদ করুন, অধিক লাভবান হন।
    স্বল্পকালীন ও উচ্চফলনশীল জাত নির্বাচন করুন অধিক ফসল ঘরে তুলুন।
    শ্রম, সময় ও খরচ সাশ্রয়ে আধুনিক কৃষি যন্ত্রের মাধ্যমে আবাদ করুন।

লেখক : তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১১০১৯৬১০, ই-মেইল : manzur_1980@yahoo.com

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর

কৃষিবিদ মোঃ আবু জাফর আল মুনছুর

কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
পারভেজ মোশারফ, গ্রাম: পো: পিরগাছা, উপজেলা : নলডাঙ্গা, জেলা : নাটোর।
প্রশ্ন : পেঁয়াজের পাতায় লম্বাটে সাদা দাগ দেখা যাচ্ছে, করণীয় কী?
উত্তর : এই জমিতে পেঁয়াজের থ্রিপস পোকার আক্রমণ হয়েছে। প্রথমে প্রতি লিটার পানিতে ৩-৫ গ্রাম সাবানের গুঁড়া মিশিয়ে স্প্রে করা। আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ডাইমেথোয়েট ২মিলি., কট্্ ২০ ইসি সিপাসিন ২ গ্রাম ইত্যাদি বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।
মো: মতিয়ার রহমান, গ্রাম : হরিপুর, পো: দৌলতগঞ্জ, উপজেলা : জীবন নগর, জেলা : চুয়াডাঙ্গা।
প্রশ্ন : পেয়ারার গায়ে কালো/বাদামি দাগ।
উত্তর : অ্যান্থ্রাকনোজ নামক রোগের কারণে এমনটা হয়। গাছের নিচে ঝরে পড়া পাতা, ফল সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে ফলিকুর/নাট্রিজো নামক ছত্রাক নাশক ১ মিলি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৩/৪ বার ১৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
শামীম আহমেদ, গ্রাম : বড়ইটুপি, পো: দূর্বাচারা, উপজেলা : কুষ্টিয়া সদর, জেলা : কুষ্টিয়া।
প্রশ্ন : আমের ঝাঁকড়া পুষ্প বা বিকৃতি বা ফুলের মতো পাতা বের হয়, করণীয় কী?  
উত্তর : - গাছের আক্রান্ত অসুস্থ অংশ ছাঁটাই করা।
- নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি ইউরিয়া (১-২)% স্প্রে করতে হয়।
- মুকুল ধরার তিন মাস আগে ঘঅঅ ০.০২% স্প্রে করতে হবে।
- টিল্ট নামক ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে ০.৫ মিলি. দিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কাজী হায়াত, গ্রাম : উ. দৌলতপুর, পো: মোহনগঞ্জ, উপজেলা : মোহনগঞ্জ, জেলা : নেত্রকোনা।
প্রশ্ন : লিচু গাছে মুকুল আসছে না এক্ষেত্রে করণীয় কী?
উত্তর : গাছের ডাল ছাঁটাই করতে হবে। চষধহঃ মৎড়ঃিয যড়ৎসড়হব ব্যবহার করতে হবে এবং সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।
আপন কুমার, পো : কামারাঙ্গীচড়, উপজেলা : মোহাম্মদপুর, জেলা : ঢাকা।
প্রশ্ন : পাথুরে চুন ও ব্লিচিং পাউডার জমিতে প্রয়োগের নিয়ম?
উত্তর : বিঘায় ৪-৫ কেজি চারা রোপণের ১ মাস আগে ব্যবহার করতে হবে।
মো: আতিকুর রহমান, পো : কিশোরগঞ্জ, উপজেলা : কিশোরগঞ্জ, জেলা : নীলফামারী।
প্রশ্ন : কীটনাশক ও রাসায়নিক সার একসাথে ব্যবহার করা যায় কী?
উত্তর : একত্রে স্প্রে করা যায় না। আলাদা দিনে, বিকেলে স্প্রে করতে হবে।
প্রশ্ন : করলা গাছের পাতাগুলো ছোট ছোট গুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। করুন বড় হয় না, গাছের বৃদ্ধি নাই।  
উত্তর : আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে নষ্ট অথবা পুড়ে ফেলতে হবে। এটা করলার পাতার গুচ্ছ রোগ বা মাইকো প্লাজমা রোগ। ভাইরাসের মতো মাইকোপ্লাজমা রোগ বাহক পোকা দ্বারা বিস্তার লাভ করে। বাহক পোকা ধ্বংস করার জন্য ইমিডাক্লোসিড গ্রুপের ওষুধ ১০-১২ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
মো: আতিকুজ্জামান, গ্রাম+পো : কিশোরগঞ্জ, উপজেলা : কিশোরগঞ্জ, জেলা : নিলফামারী।
প্রশ্ন : পোকা ধানক্ষেতের পাতার রস চুষে খায়। পোকাগুলো কা- ও খোলের মধ্যবর্তী জায়গায় থাকে?
উত্তর : এটা হপার পোকার আক্রমণ আক্রান্ত গাছ তুলে ধ্বংস করে দিতে হবে। পোকা দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ৩ মিলি কার্বোসালফান গ্রুপের ওষুধ আক্রান্ত স্থানে ১০-১২ দিন পর পর স্প্রে করে দিতে হবে।
সিরাজুল ইসলাম, গ্রাম: নানদিয়া, পো : পাটিকাবাড়ি, উপজেলা : কুষ্টিয়া সদর, জেলা : কুষ্টিয়া
প্রশ্ন : ১০ কাঠায় গম বুনেছে। গমের জমিতে ঘাসমারা ওষুধ দিচ্ছেন ১৭ দিন বয়সে। ঘাসমারা ওষুধ আরো দিতে চাই। বাইতু ঘাস। আগাছানাশক দিতে চাচ্ছি আবার।
উত্তর : যদি গাছের বয়স ১০-১২ দিনের বেশি হয় তাহলে আগাছানাশক দেয়া যাবে না। হাত দিয়ে তুলে ফেলতে হবে।

লেখক : তথ্য অফিসার (উদ্ভিদ সংরক্ষণ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৪১০৪৮৫৩; ই-মেইল: iopp@ais.gov.bd

বিস্তারিত
চৈত্র মাসের কৃষি (১৫ মার্চ-১৩ এপ্রিল)

চৈত্র মাসের কৃষি
(১৫ মার্চ-১৩ এপ্রিল)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
চৈত্র বঙ্গাব্দের শেষ মাস। এ মাসে বসন্ত ঋতু নতুন করে সাজিয়ে দেয় প্রকৃতিকে। চৈতালী হাওয়ায় জানান দেয় গ্রীষ্মের আগমন। রবি ফসল ও গ্রীষ্মকালীন ফসলের প্রয়োজনীয় কাজ করতে বেড়ে যায় কৃষকের ব্যস্ততা। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন আসুন আমরা জেনে নেই এ মাসের কৃষিতে আমাদের করণীয় কাজগুলো।
বোরো ধান
যারা শীতের কারণে দেরিতে চারা রোপণ করেছেন তাদের ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ক্ষেতে গুটি ইউরিয়া দিয়ে থাকলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে না। সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। এলাকার জমিতে যদি সালফার ও দস্তা সারের অভাব থাকে এবং জমি তৈরির সময় এ সারগুলো না দেয়া হয়ে থাকে তবে ফসলে পুষ্টির অভাবজনিত লক্ষণ পরীক্ষা করে শতাংশপ্রতি ২৫০ গ্রাম জিপসাম ও ৪০ গ্রাম দস্তা সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করতে পারেন। এসব পন্থায় রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রং কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করতে হবে। মোচা থেকে দানা সংগ্রহ করতে প্রয়োজনে ভুট্টা মারাই যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (খরিফ)
গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ মাসে বীজ বপন করতে হবে। খরিফ মৌসুমের জন্য ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড  ভুট্টা-১৭ প্রভৃতি। শতাংশপ্রতি বীজ লাগবে ১০০-১২০ গ্রাম। প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ৩৬৫ গ্রাম, টিএসপি ২২২ গ্রাম, এমওপি ১২০ গ্রাম, জিপসাম ১৬০ গ্রাম এবং দস্তা সার ১৬ গ্রাম সার দিতে হবে ।
অন্যান্য মাঠ ফসল
রবি ফসলের মধ্যে চিনা, কাউন, আলু, মিষ্টি আলু, চিনাবাদাম, পেয়াজ, রসুন যদি এখনো মাঠে থাকে তবে দেরি না করে সাবধানে তুলে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এ সময়ে বা সামান্য পরে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য পচনশীল ফসল তাড়াতাড়ি কেটে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
শাকসবজি
গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি চাষ করতে চাইলে এ মাসেই বীজ বপন বা চারা রোপণ শুরু করা প্রয়োজন। সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। এ সময় গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ঢেঁড়স, বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, শসা, ওলকচু, পটোল, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লালশাক, পুঁইশাক এসব সবজি চাষ করতে পারেন ।
গাছপালা
এ সময় বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রসের পরিমাণ কমে আসে। এ অবস্থায় গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়। আম গাছে হপার পোকার আক্রমণ হলে অনুমোদিত  কীটনাশক যেমন- সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ফাইটার ২.৫ ইসি প্রভৃতি প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ ফাইটার ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে ¯েপ্র করা প্রয়োজন। এ সময় আমে পাউডারি মিলডিউ ও এ্যান্থ্রাকনোজ রোগ দেখা দিতে পারে। টিল্ট, রিডোমিল গোল্ড, কানজা বা ডায়থেন এম ৪৫ অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। কলা বাগানের পার্শ্ব চারা, মরা পাতা কেটে দিতে হবে। পেঁপের চারা রোপণ করতে পারেন এ মাসে। নার্সারিতে চারা উৎপাদনের জন্য বনজ গাছের বীজ বপন করতে পারেন। যাদের বাঁশ ঝাড় আছে তারা বাঁশ ঝাড়ের গোড়ায় মাটি ও  জৈবসার প্রয়োগ করা ভালো।

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল:editor@ais.gov.bd

 

বিস্তারিত

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon