Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

হাইব্রিড সবজির বীজ উৎপাদন

অধিক ফলন, আকর্ষণীয় চেহারা, স্বল্প জীবনকাল, বিভিন্ন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা, রোগ ও পোকার অধিক সহনশীলতা, প্রায় একই সময়ে পরিণত হওয়া, বাজারে অধিক চাহিদা, পুষ্টিকর ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বর্তমানে হাইব্রিড সবজি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু সমস্যা হলো, বাজারে হাইব্রিড বীজের দাম সাধারণ বীজের চেয়ে অনেক বেশি। আবার যে কোনো কৃষক চাইলেও সাধারণ সবজি বীজের মতো হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করতে পারেন না। হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করতে গেলে বিশেষ দক্ষতা দরকার। তবে তা যে খুব কঠিন কিছু তা নয়। এর জন্য দরকার বিশেষ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা ও ধৈর্য। হাইব্রিড সবজির বীজ উৎপাদনকারীকে অবশ্যই তিনটি বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বিষয় তিনটি হলো- হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের মূলনীতি, তথা সবজির বংশগত ও কৃষিতাত্ত্বিক কিছু বিষয় সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান।


যে সবজির হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করতে হবে তার উদ্ভিদতত্ত্ব বিশেষ করে কখন ফুল ফোটে, কতক্ষণ গর্ভমুণ্ডের পরাগগ্রহীতা বজায় থাকে, পরাগধানীর বিদারণ কখন ঘটে ইত্যাদি।
 

এরপর জানতে হবে হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের কলা কৌশল, বিশেষ করে ইমাসকুলেশন বা ফুলের পরাগধানী অপসারণ, পরাগরেণু সংগ্রহ, পরাগায়ন বা সংকরায়ন পদ্ধতি ইত্যাদি। পরের দিন ফুটবে এমন ফুলের কুঁড়ির বৃতি উন্মোচন করে তার ভেতর থেকে চিমটা দিয়ে সাবধানে পরাগধানী অপসারণ করা হয়। এটাই ইমাসকুলেশন। এটা অনেকটা খাসি করার মতো ঘটনা। এরপর কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যের ফুল থেকে পরাগরেণু সংগ্রহ করা হয়। ফুল ফোটার দিন এ কাজ করা হয়। সংগৃহীত পরাগরেণু একটি স্বচ্ছ খামে রাখা হয়। এরপর পরাগরেণু ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ২৪ ঘণ্টা শুকানো হয়। এরপর এই রেণু সদ্য ফোটা স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে স্থাপন করা হয়। একে বলে হাত পরাগায়ন। বেশির ভাগ হাইব্রিড সবজি বীজ উৎপাদন করা হয় হাত পরাগায়নের মাধ্যমে। এখনো পর্যন্ত হাত দ্বারা সংকরায়ন করা বহুল প্রচলিত। যদিও এতে সময় ও শ্রম বেশি লাগে। পাশাপাশি বাণিজ্যিকভিত্তিতে প্রচুর পরিমাণে হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের জন্য এখন বিশেষ কিছু পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। যেমন পুং বন্ধ্যাত্ব ও ফুলে স্ব অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি। বেশ কিছু জটিল প্রক্রিয়া দ্বারা এ ধরনের কাজ করা হয়। বাণিজ্যিকভিত্তিতে হাইব্রিড বীজ উৎপাদনে ব্যবহৃত কৌশলগুলো নিচের তালিকায় উল্লেখ করা হলো-

কৌশল বাণিজ্যিকভাবে যেসব সবজির জন্য ব্যবহৃত হয়                        
হাতে পরাগধানী অপসারণ বা ইমাসকুলেশন + হাতে পরাগায়ন টমেটো, বেগুন, ঢেঁড়স, ক্যাপসিকাম, মরিচ ইত্যাদি
পুরুষ ফুল অপসারণ + হাতে পরাগায়ন করলা, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, শসা এসব                        
পুং বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি + হাতে পরাগায়ন টমেটো, মরিচ, ক্যাপসিকাম
পুং বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি + প্রাকৃতিক পরাগায়ন বাঁধাকপি, ব্রোকলি, ফুলকপি, গাজর, পিয়াজ, মরিচ
স্ব অসামঞ্জস্যতা + প্রাকৃতিক পরাগায়ন বাঁধাকপি, ব্রোকলি, ফুলকপি
পুরুষ ফুল অপসারণ + প্রাকৃতিক পরাগায়ন করলা, স্কোয়াশ


যেসব সবজির বাজারে তুলনামূলকভাবে দাম ও চাহিদা বেশি ও যেসব সবজি অধিক মাত্রায় হেটেরোসিস বা কৌলিতাত্ত্বিক বৈষম্য প্রদর্শন করে যেমন বেগুন পরিবারের সবজি (বেগুন, টমেটো, মরিচ), কুমড়া পরিবারের সবজি (শসা, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, করলা, স্কোয়াশ), কপি পরিবারের সবজি (ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি), কন্দজাতীয় সবজি (মুলা, গাজর, পিয়াজ), ফল জাতীয় সবজি  ঢেঁড়স) ইত্যাদি সবজির হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করা হয়। কয়েকটি সবজির হাইব্রিড বীজ উৎপাদন কৌশল নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
 

টমেটোর হাইব্রিড বীজ উৎপাদন
টমেটো সবজিতে ফলন, পরিপক্বতার সময়, রঙ ও আকার, গাছের তেজ, প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে হেটেরোসিস বা বৈষম্য বেশ দেখা যায়। শুধু ফলনের বেলাতেই ৩০-৫০% হেটোরোসিসের ঘটনা ঘটে। এই বৈষম্য কমানোর জন্য টমেটোর হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করা প্রয়োজন। এতে ফলন অনেক বাড়ে। বাণিজ্যিকভিত্তিতে টমেটোর হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের জন্য স্ত্রী ফুল থেকে পরাগধানী বা পুংকেশর সরানো ও হাতে পরাগায়নের মাধ্যমে হাইব্রিড বীজ উৎপাদনকে এখনো সবচেয়ে উপযুক্ত, ব্যয়সাশ্রয়ী ও কার্যকর বলে মনে করা হয়। অধিকাংশ বীজ কোম্পানি এ পদ্ধতিতে টমেটোর হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করে থাকে। দুই ধরনের টমেটো গাছ আছে। এক ধরনের টমেটো গাছ অবিরামভাবে লম্বা হতে থাকে। এসব গাছকে বলা হয় অবিরত গাছ বা ইনডিটারমিনেট টাইপ। আর এক ধরনের গাছ আছে যার বৃদ্ধি সীমিত, একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত গাছ লম্বা হয়। এসব গাছকে বলে সবিরত বা ডিটারমিনেট টাইপের গাছ। অবিরত গাছের ক্ষেত্রে হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করতে হলে গাছের ডালপালা ছেঁটে একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় রাখতে হবে। এ ধরনের গাছের ক্ষেত্রে সাধারণত গাছে একটি বা দুটি ডাল রাখা হয়। সবিরত গাছের বেলায় রাখা হয় তিনটি ডাল। প্রতিটি ডালের প্রথম থেকে চতুর্থ থোকার ফুল পর্যন্ত সাধারণত হাইব্রিড বীজের ইমাসকুলেশন করার জন্য নির্বাচন করা হয়। এসব থোকার যেসব ফুল পরদিন ফুটবে সেসব ফুলের পুংকেশর বা পরাগধানী চিমটা দিয়ে সরিয়ে ফেলা হয়। ইমাসকুলেশন করার সঠিক অবস্থা বুঝার জন্য কুঁড়িটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যেসব কুঁড়ির বৃতিগুলো পুরোপুরি খোলেনি, পুষ্পাক্ষ বরাবর প্রায় ৪৫ ডিগ্রি  কোণ করে অবস্থান করছে  সেগুলো নির্বাচন করতে হবে। এরূপ কুঁড়ির গোড়ায় ধরে একটি একটি করে সাবধানে পাঁপড়ি অক্ষত রেখে চিমটা দিয়ে ধীরে ধীরে খুলে ভেতর থেকে সবগুলো পরাগধানী সরিয়ে ফেলতে হবে। পরদিন এসব কুঁড়ির ফুল ফুটবে। তখন সেসব ফুলে কাক্সিক্ষত গাছ থেকে ভাইব্রেটর যন্ত্র দিয়ে সদ্য ফোটা ফুল থেকে পরিণত পরাগরেণু ঝাঁকিয়ে সংগ্রহ করতে হবে। পরাগধানী বিদারণের সময় ভাইব্রেটর দিয়ে রেণু সংগ্রহ করলে তার সজীবতা ও কার্যকারিতা থাকে সর্বোচ্ছ। ভাইব্রেটর দিয়ে পরাগরেণু সংগ্রহ করলে কেবল পরিণত পরাগরেণু ঝরে পড়ে। এরূপ পরাগরেণু কাঁচের নলে বা টেস্টটিউবে রাখা যায়। পাতলা প্লাস্টিকের খামে বা কাঁচের প্লেটেও রাখা যায়। এ পরাগরেণু স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে হাতের আঙুলে মাখিয়ে লাগিয়ে দিতে হবে। ব্রাশ দিয়েও লাগানো যায়। অবশিষ্ট রেণু ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য রাখা যাবে না। এতে রেণুর সজীবতা নষ্ট হয় বা কমে যায়। তবে শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পরাগরেণু শুকিয়ে প্রায় ২ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। তাতে সজীবতা নষ্ট হয় না। পরাগায়ন ঘটনোর পর সেসব ফুলের বৃতির ওপর থেকে অর্ধেক অংশ কেটে ফেলা হয় যাতে সংকরায়িত ফুলকে অপরাগায়িত বা অসংকরায়িত ফুল থেকে আলাদাভাবে পরে চেনা যায়। সাধারণত ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় পরাগরেণুর সজীবতা ও কার্যকারিতা ভালো থাকে। তাই দিনের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে থাকলে সংকরায়ন করা উচিত। তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পরাগরেণুর উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায় ও সংকরায়ন বিঘ্নিত হয়।


উপরোক্ত পদ্ধতিতে টমেটোর হাইব্রিড বীজ উৎপাদনে প্রচুর শ্রমিক ব্যয় হয়। মোট উৎপাদন খরচের প্রায় ৪০% ব্যয় হয় শুধু ইমাসকুলেশন করার কাজে। কাজেই এই খরচ কমানোর জন্য বর্তমানে বাণিজ্যিকভিত্তিতে টমেটোর হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের জন্য পুং বন্ধ্যা লাইন সৃষ্টি করে সংকরায়ন করা হচ্ছে। জিন মিউটেশন করে পুং বন্ধ্যা লাইন সৃষ্টি করা হয়। এসব লাইনের গাছে ফুল ফোটে, তবে ফুলের পরাগরেণু হয় নিষ্ক্রিয়। ফলে ইমাসকুলেশন করতে হয় না। শুধু কাঙ্খিত ফুলের পরাগরেণু এনে পরাগায়ন ঘটাতে হয়। এতে ইমাসকুলেশন করার খরচ ও শ্রম বেঁচে যায়।


সংকরায়নের পর ধীরে ধীরে ফল গঠিত হয়। সুপরিণত বা ভালোভাবে পাকা ফল বীজের জন্য তুলতে হবে। তোলার পর সেসব টমেটো পচাতে বা গাজাতে হবে। উষ্ণ তাপমাত্রায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টমেটোর গাজানো হয়, কিন্তু ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় টমেটোর ফার্মেন্টেশন বা গাজানোয় ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগবে। বেশিক্ষণ গাজালে বীজের রঙ বিবর্ণ হয়ে যাবে। হাইড্রোক্লোরিক এসিড বা সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ব্যবহার করেও টমেটোর গাজানো কাজ করা যায়। সেক্ষেত্রে প্রতি ৪ কেজি টমেটোর জন্য ১০ সিসি পরিমাণ ৩৬% হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও ৩০% সেডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ব্যবহার করতে হবে। টমেটোকে কেটে টুকরা করে তার সাথে এই রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে ১৫ মিনিট রাখতে হবে। এতে টমেটো বীজের সাথে থাকা জেলির মতো আঠালো দ্রব্য আলাদা হয়ে যাবে। গাজানোর পর টমেটোকে কচলে বা চটকে বীজ পানিতে ধুয়ে আলাদা করতে হবে। এরপর বীজ শুকিয়ে নিতে হবে। সাধারণত ১ কেজি টমেটো থেকে ৩-৪ গ্রাম বা ১০০০-১২০০টি হাইব্রিড বীজ পাওয়া যায়। এ হিসেবে ১ হেক্টরে হাইব্রিড বীজ উৎপাদন হয় প্রায় ৬০-৭০ কেজি।


বেগুনের হাইব্রিড বীজ উৎপাদন
বেগুনের প্রায় ৫০-১৫০% হেটেরোসিস ঘটে। বাংলাদেশে রশিদ ও সঙ্গীরা (১৯৮৮) বেগুনে ৫০% হেটেরোসিসের ঘটনা ঘটে বলে তাদের এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন। এর ফলে বেগুনের জীবনকাল, গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা, ফলের ওজন, ফুল ফোটার সময়, ফলন, আগাম পরিপক্বতা ইত্যাদির বেশ হেরফের ঘটে। হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে এ প্রভাব কমানো যায়। বেগুনে সাধারণত ইমাসকুলেশন ও হাত পরাগায়ন ঘটিয়ে সংকরায়ন বা হাইব্রিডাইজেশন করা হয়। ফুল ফোটার বা পরাগধানী বিদারণের একদিন আগেই বেগুন ফুলের স্ত্রী অঙ্গের গর্ভমু- পরাগ গ্রহণের জন্য তৈরি হয়ে যায়। এজন্য ফুল ফোটার অপেক্ষা না করে ফোটার পূর্ব দিনেই ইমাসকুলেশন করে সাথে সাথে পরাগায়ন ঘটিয়ে সংকরায়নের কাজ করা যায়। ওই দিনেই কাক্সিক্ষত ফুলের পরাগরেণু ভাইব্রেটর দিয়ে সংগ্রহ করে এ কাজ সম্পন্ন করতে হয়। এতে ভালো ফল ও অধিক বীজ উৎপন্ন হয়। ইমাসকুলেশন করা ফুলে আর প্রাকৃতিক পরাগায়ন ঘটার সুযোগ ঘটে না। কেননা এসব ফুলে আর মৌমাছি বা বোলতারা বসে না।  


ভালো মানের বীজ ও উত্তম ফলনের জন্য যেসব গাছে সংকরায়ন করা হবে সেসব গাছ ছেঁটে নেয়া উচিত। গাছে প্রথম যে ফুলটি ফোটে সেটি ছেঁটে ফেলে দিতে হবে। দ্বিতীয় ফুলটিও তুলে ফেলতে হবে। এতে পরে অধিক ও ভালো ফুলের জন্ম হবে। এসব ফুল থেকে গঠিত ফলে অধিক সংখ্যক বীজ হবে। বীজের উত্তম ফলনের জন্য  বেগুন গাছের শাখা-প্রশাখাও ছাঁটা উচিত। প্রথম ফুল ফুটলে তা অপসারণের সময় সেই ফুলের অবস্থানের নিচে পাশাপাশি থাকা দুটি সেরা ডাল রেখে উপরের বাকি সব ডাল ছেঁটে দিতে হবে। এতে পরে গাছের বৃদ্ধি ভালো হবে।  বেগুন একটি আলোকসংবেদী ফসল। ভালো ফুল-ফল ধরা ও বৃদ্ধির জন্য দিনের তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও রাতের তাপমাত্রা ৮-১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উত্তম। এতে পরাগরেণুর কার্যকারিতা ভালো হয়।


কৌলিতাত্ত্বিক পুং বন্ধ্যা সারি সৃষ্টি করেও বেগুনের হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করা যায়। তবে তা বাণিজ্যিকভিত্তিতে করা সফল নয়। এতে ফলধারণ কম হয়। সাধারণত ফুল ফোটার ৫০-৫৫ দিন পর পাকা বেগুন তোলা হয়। পরিণত হওয়ার পরও ভালোভাবে পাকার জন্য ১০ দিন গাছে বেগুন রেখে দেয়া হয়। বেগুন ভালোভাবে পেকে খোসা হলুদ হলে তা তোলা হয়। টমেটোর মতো বেগুনকে গাজানোর দরকার হয় না। তোলা বেগুন একদিন রেখে দিলে তা কুঁচকে নরম হয়ে যায়।  বেগুন না কেটে আস্ত বেগুনে হালকা মুগুর দিয়ে পেটালে ভেতরে শাঁসের মধ্যে থাকা বীজগুলো আলগা হয়ে যায়। তখন বেগুন চিরে বীজগুলো সংগ্রহ করতে হয়। বেগুনের কাটা টুকরোগুলো পানিতে ধুয়েও বীজ সংগ্রহ করা যায়। বীজ ২৮-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় বাতাসে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। এক হেক্টরে ১৫০-২০০ কেজি হাইব্রিড বীজ পাওয়া যায়। বেগুনের প্রতি ১০০০ বীজের ওজন ৪-৫ গ্রাম।
মিষ্টিকুমড়ার হাইব্রিড বীজ উৎপাদন


কুমড়াগোত্রীয় সবজি গাছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ফুল ফোটা দেখা যায়। এজন্য এর সংকরায়ন করতে গেলে সেসব গাছের ফুলের চরিত্র বিচার করে এ কাজ করতে হবে। প্রজাতি ও জাতের ওপর নির্ভর করে কুমড়াগোত্রী বিভিন্ন গাছে মোটামুটিভাবে তিন রকমের ফুল দেখা যায়- পুরুষ, স্ত্রী ও উভলিঙ্গী ফুল। লাউ, শসা, চালকুমড়া ইত্যাদি সবজির কিছু কিছু জাতের গাছে উভলিঙ্গী ফুল দেখা যায়। একটি গাছ কখনো কখনো এক ধরনের ফুল বহন করে, কখনো কখনো একাধিক রকমের ফুল বহন করে। যেসব গাছ মাত্র এক রকমের ফুল অর্থাৎ পুরুষ বা স্ত্রী ফুল ধারণ করে তাদের বলা হয় ভিন্নবাসী বা মনোসিয়াস গাছ, যেমন কাঁকরোল। যেসব গাছ পুরুষ ও স্ত্রী উভয় রকমের ফুল ধারণ করে তাদের বলে সহবাসী বা ডায়োসিয়াস গাছ, যেমন মিষ্টিকুমড়া। কিছু গাছে একই সাথে পুরুষ, স্ত্রী ও উভলিঙ্গী ফুল ফোটে। এদের বলা হয় ট্রাইমনোসিয়াস বা ত্রিবাসী গাছ। কুমড়াগোত্রীয় সবজির কোন গাছে কি ধরনের ফুল ফুটবে অর্থাৎ ফুলের লিঙ্গপ্রকাশ, গাছপ্রতি বিভিন্ন লিঙ্গের ফুলের সংখ্যা বা অনুপাত ইত্যাদি নির্ভর করে সে প্রজাতির গাছের জিন বৈশিষ্ট্য ও পরিবেশের ওপর। ফুলের এসব বৈশিষ্ট্যের ওপর পরিবেশের প্রভাবকে বিভিন্ন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে প্রভাবিত করা যায়। গাছের ভেতরে থাকা বিভিন্ন হরমোন যেমন অক্সিন, জিবারেলিন, সাইটোকাইনিন, ইথিলিন, এবসিসিক এসিড ইত্যাদি ফুল ফোটার জন্য দায়ী। কিছু বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক বা হরমোন রয়েছে যারা স্ত্রী ফুল ফুটতে সাহায্য করে, কিছু সাহায্য করে পুরুষ ফুল ফুটতে। স্ত্রী ফুল ফুটতে সাহায্য করে অক্সিন, ইথিলিন (ইথেফোন বা ইথ্রেল), ম্যালিক হাইড্রাজাইড (MH), ট্রাই-আয়ডোবেঞ্জোয়িক এসিড (TIBA), সাইটোকাইনিন, বোরন ইত্যাদি। পুরুষ ফুল ফুটতে সাহায্য করে জিবারেলিন, সিলভার নাইট্রেট, সিলভার থায়োসালফেট ইত্যাদি। কাজেই এসব হরমোন প্রয়োগ করে গাছে কাক্সিক্ষত ফুলের সংখ্যা বাড়িয়ে নেয়া যায়।
 

ভিন্নবাসী ও সহবাসী ফুলে পর-পরাগায়ন ঘটার মাধ্যমে ফল গঠন হয়। কিন্তু উভলিঙ্গী ফুলের বেলায় স্ব পরাগায়নের মাধ্যমে ফল গঠনের নিয়ম থাকলেও তা সচরাচর ঘটে না। কেননা কুমড়াগোত্রীয় অধিকাংশ উভলিঙ্গী ফুলের পরাগরেণু আঠালো হওয়ায় তা গর্ভমুণ্ডে নিজে নিজে ঝরে পড়তে পারে না। পরাগায়নের এসব ভিন্নতার কারণে কুমড়াগোত্রীয় সবজির ফল ধারণের হার কম হয়। যতো ফুল ফোটে ততো ফল হয় না। তাই হাতে পরাগায়নের মাধ্যমে ফল ধারণের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি করা যায়। গাছে বেশি ফল থাকলে তাতে নতুন ফল ধরা কমে যায়। এজন্য খাওয়ার উপযুক্ত ফল সব সময় গাছ থেকে তুলে নিলে অধিক ফল ধরে।


মিষ্টি কুমড়াসহ কুমড়াগোত্রীয় অন্যান্য অধিকাংশ সবজির সহবাসী বৈশিষ্ট্যের কারণে পর পরাগায়ন ঘটে। এসব সবজির ইনব্রিড ডিপ্রেশন কম। কাঁকরোল ও পটোল সবজি দুটো ভিন্নবাসী হওয়ায় শতভাগ পর পরাগায়ন ঘটাতে হয়। এ দুটো সবজিতে প্রচুর ইনব্রিড ডিপ্রেশন দেখা যায়। এমনকি এক মৌসুমের পরই মূল জাতের বৈশিষ্ট্যের অনেক কিছু হারিয়ে যায়। এজন্য কুমড়াগোত্রীয় সবজির ইনব্রিড লাইন তৈরি করে তা থেকে কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যের পরাগরেণু সংগ্রহ করে সংকরায়ন ঘটানো কঠিন। পৃথক পৃথকভাবে এক একটি সবজি নিয়ে এজন্য কাজ করতে হয়। কুমড়াগোত্রীয় সবজির হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের সাধারণ ধাপগুলো হলো-


ইনব্রিড লাইন সৃষ্টি করে তা দ্বারা ৩-৫ প্রজন্ম ইনব্রিডিং করা; হাইব্রিড উৎপাদন ক্ষমতা দেখে মাতৃ ইনব্রিড নির্বাচন করা; হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করা; মাতৃইনব্রিডকে রক্ষণাবেক্ষণ করা।


মিষ্টিকুমড়ার ফুল খুব সকালে ফোটে ও পরাগরেণুর বিদারণ ও ঝরে পড়া সকালেই হয়। গর্ভমুণ্ডের পরাগগ্রহীতা বজায় থাকে দুপুর পর্যন্ত। মিষ্টি কুমড়ার হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করতে হলে প্রথমে ইনব্রিড লাইন সৃষ্টি করতে হবে। শীতকালের ফসলের জন্য বীজ বোনা হয় নভেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে, গরমকালের ফসলের জন্য বীজ বুনতে হয় প্রথম বৃষ্টির পর। গাছ থেকে গাছ ও সারি থেকে সারির দূরত্ব দিতে হয় ১০.৬ মিটার। প্রতিটি গাছকে আলাদা মাচা তৈরি করে তাতে লতিয়ে দিতে হবে। একটি মাচা থেকে আর একটি মাচার মধ্যে ১ মিটার ফাঁক রাখতে হবে। পরাগধানী বিদারণের বা ফুল ফোটার একদিন আগে পুরুষ ও স্ত্রী কুঁড়িগুলোকে আলাদাভাবে ব্যাগিং করতে হবে। এমনকি পরাগায়ন ঘটানোর পরও ২ দিন এভাবে ব্যাগিং করে রাখতে হবে। এভাবে উপর্যুপরি ৪-৫ প্রজন্ম একাজ করে উপযুক্ত তেজ ও বৈশিষ্ট্যর ইনব্রিড লাইন খুঁজে নিতে হবে।


মিষ্টিকুমড়ার হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের জন্য মাতৃ ইনব্রিড লাইনের স্ত্রী ও পুরুষ গাছ ৪ঃ১ অনুপাতে লাগাতে হবে। গাছের ২-৩ পাতা অবস্থায় সেসব গাছের গোড়ার গিঁটগুলোতে অধিক পরিমাণে স্ত্রী ফুল উৎপাদনের জন্য গাছে প্রতি লিটার পানিতে ৫০ থেকে ১০০ মিলিলিটার ইথেফোন গুলে স্প্রে করতে হবে। গাছকে মাচার উপর লতিয়ে দিতে হবে। প্রতিদিন বিকেলে ফুল ফোটার আগে প্রতিটি স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ব্যাগিং করে ঢেকে দিতে হবে। স্ত্রী ফুলে কাক্সিক্ষত পরাগরেণু দিয়ে পরাগায়ন ঘটানোর পর পুনরায় ব্যাগিং করে দুদিন রেখে দিতে হবে। পরাগায়নের ৬০ দিন পর পাকা ফল সংগ্রহ করতে হবে। ফল বা কুমড়া কেটে ভেতর থেকে বীজ আলাদা করে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এরপর সেসব বীজ নিম্ন তাপমাত্রায় (৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে) ৩-৪ দিন শুকাতে হবে। এরপর আবার ৩-৪ দিন রোদে শুকাতে হবে। বদ্ধ পলিপ্যাকেটে ৪-৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ করতে হবে।

চাল কুমড়ার হাইব্রিড বীজ উৎপাদন
চালকুমড়ার ফুল ফোটে খুব ভোরে, ভোর ৩ থেকে ৫টার মধ্যে। ফুল ফোটার পরপরই গর্ভমু- পরাগ গ্রহণের জন্য তৈরি থাকে। তবে গর্ভমুণ্ডের পরাগগ্রহীতা বজায় থাকে ফুল ফোটার পর ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত। পরাগরেণুর সজীবতা থাকে পরাগধানী বিদারণের ২-৩ ঘণ্টা পূর্ব থেকে ১২ ঘণ্টা পর পর্যন্ত। সাধারণত গোড়ার দিকের গিঁটে যেসব ফল ধরে সেসব ফল থেকে ফলন বেশি হয়। চালকুমড়ার হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের জন্য মাতৃ ইনব্রিড লাইনের স্ত্রী ও পুরুষ গাছ ৪ঃ১ অনুপাতে লাগাতে হবে। খাড়া দেয়ালের মতো মাচা করে তাতে বা জালে গাছ লতিয়ে দিতে হবে। ফুল ফোটার আগে প্রতিটি স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ব্যাগিং করে ঢেকে দিতে হবে। স্ত্রী ফুলে কাক্সিক্ষত পরাগরেণু দিয়ে পরাগায়ন ঘটানোর পর পুনরায় ব্যাগিং করে দুদিন রেখে দিতে হবে। ইনব্রিড জাতের ওপর নির্ভর করে বীজ বপনের ৭০ থেকে ৯০ দিন পর পাকা চালকুমড়া সংগ্রহ করতে হবে। পাকা চালকুমড়া গাছ থেকে তুলে কেটে তার ভেতর থেকে সুপুষ্ট বীজ সংগ্রহ করে পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর বীজ শুকাতে হবে। বদ্ধ পলিপ্যাকেটে নিম্ন  তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ করতে হবে।

 

লাউয়ের হাইব্রিড বীজ উৎপাদন
লাউয়ের হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, লাউ যেন গরমকালেও ধরে, গাছ খাটো হয়, যেন লাউয়ের মাচা তৈরির খরচ বেঁচে যায়, ফলন যেন বেশি হয়, গাছ ও লাউয়ের বৃদ্ধি যেন চমৎকার ও আকর্ষণীয় হয়।  লাউয়ের হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করতে হলে প্রথমে ফুলের কিছু চরিত্র সম্পর্কে জানতে হবে। লাউয়ের ফুল সাধারণ ভোর ৫টা থেকে ৮টার মধ্যে ফোটে। এ সময়ের মধ্যে হাইব্রিডাইজেশনের কাজ করা উত্তম। তবে পরাগরেণুর বিদারণ ও গর্ভমু-ের পরাগগ্রহীতা ফুল ফোটার পর ১৮-২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বজায় থাকে। এ সময়ের মধ্যেও এ কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু ফুল ফোটার পর পরাগরেণু বিদারিত হলে সেই সতেজ পরাগরেণু দিয়ে হাইব্রিডাইজেশন করা উত্তম। হাইব্রিডাইজেশনের জন্য কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যের ইনব্রিড লাইন সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য ঈপ্সিত বৈশিষ্ট্য রয়েছে এমন বৈশিষ্ট্যের লাউ গাছ জন্মাতে হবে। সেই গাছে ফুল ফোটার আগেই স্ত্রী ও পুরুষ ফুল আলাদাভাবে ব্যাগিং করতে হবে। ফুল ফোটার পর পরাগরেণুর বিদারণকালে সেই সতেজ পরাগরেণু দিয়ে স্ত্রী ফুলে প্রজনন ঘটিয়ে স্ত্রী ফুলে আবার ব্যাগিং করতে হবে। এভাবে ব্যাগিং করে ২-৩ দিন রেখে দিতে হবে। এতে স্ত্রী ফুলে অন্য পরাগযোগ হবে না। এ ফুল থেকে গঠিত ফলের বীজ দিয়ে ৪-৫ মৌসুমে লাউ চাষ করতে হবে। চাষের সময় কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যের গাছ ও ফল রেখে দুর্বল বৈশিষ্ট্যের গাছ ও ফল বাদ দিতে হবে। এভাবে ইনব্রিড লাইনের পুরুষ ও স্ত্রী মাতৃ গাছ সৃষ্টি হবে।


এবার ৪:১ অনুপাতে জমিতে স্ত্রী ও পলিনেটর পুরুষ ইনব্রিড গাছ লাগাতে হবে। ফুল ফোটার আগে তথা পরাগরেণু উন্মুক্ত হওয়ার আগেই স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ব্যাগিং করতে হবে। সাধারণত ফুল ফোটার ২ দিন আগে ব্যাগ দিয়ে স্ত্রী ফুল ও পুরুষ ফুল ঢেকে রাখা হয়।  ফুল ফোটার পর সতর্কতার সাথে পরাগায়ন ঘটিয়ে স্ত্রী ফুল আরও ২ দিন ব্যাগিং করে ঢেকে রাখতে হয়। এ ফুল থেকে ফল গঠিত হয় ও ধীরে ধীরে তা বড়ো হতে থাকে। গাছ মারা যাওয়ার পর পাকা ফল তুলে তার ভেতর থেকে হাইব্রিড বীজ সংগ্রহ করা হয়। বীজ ভালো করে ধুয়ে শুকানো হয়। শুষ্ক হাইব্রিড বীজ পলিথিনের প্যাকেটে বদ্ধ করে নিম্ন তাপমাত্রায় মজুদ করতে হয়।


হাইব্রিড বীজের অনেক দাম। সাধারণ কৃষকের পক্ষে তা উৎপাদন করা সম্ভব নয়। কেননা হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের কাজটা খুব সহজ নয়। কিন্তু এ কাজে প্রশিক্ষিত কৃষক বা প্রতিষ্ঠান হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করতে পারে।

 

মৃত্যুঞ্জয় রায়*

*উপপ্রকল্প পরিচালক, আইএফএমসি প্রকল্প, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা

বিস্তারিত
সরিষার রোগ ও তার প্রতিকার

সরিষা বাংলাদেশের প্রধান তেল ফসলের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের প্রায় ৬.৮৮ লাখ হেক্টর জমিতে তেল ফসলের চাষ করা হয় এবং এর মধ্যে ৪.৬২ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ করা হয় যার মোট উৎপাদন ৪.৮৯ লাখ মেট্রিক টন (তথ্য ডিএই-২০০৯-১০)। সরিষা আবাদ করতে গিয়ে কৃষক নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। তার মধ্যে রোগের আক্রমণ অন্যতম। বাংলাদেশে প্রায় ১৪টি রোগ দ্বারা সরিষা আক্রান্ত হয়ে থাকে, এর মধ্যে ৯টি ছত্রাকজনিত, ১টি ব্যাক্টেরিয়াজনিত, ২টি ভাইরাসজনিত, ১টি নেমাটোড এবং ১টি সম্পূরক উদ্ভিদ (অরোবাংকি)। এদেশে পাতা ঝলসানো, ডাউনি মিলডিউ, ক্লোরোসিয়ানা কাণ্ড পচা এবং সম্পূরক উদ্ভিদ (অরোবাংকি) প্রধান। এ ছাড়া আবহাওয়া ও জলবায়ুর তারতম্যের কারণেও অন্যান্য রোগ দেখা যায়। নিচে সরিষার বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-


১. পাতা ঝলসানো রোগ (Alternaria blight)
রোগের কারণ, উৎপত্তি ও বিস্তার : Alternaria brassicae এবং Alternaria brassiaicola নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগের সৃষ্টি হয় এবং বীজ বিকল্প পোষক ও বায়ুর মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬৭% এর অধিক এবং তাপমাত্রা ১২-২৫ ডিগ্রি সে. ও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়।


রোগের লক্ষণ
১. এ রোগ প্রাথমিক অবস্থায় সরিষা গাছের নিচের বয়স্ক পাতায় ছোট, বাদামি গোলাকার দাগ আকারে আক্রমণ করে। পরবর্তীতে এ দাগ আকারে বড় হতে থাকে।
২. পরবর্তীতে গাছের পাতা, শুটি, কাণ্ড ও ফলে গোলাকার গাঢ় বাদামি বা কালো দাগের সৃষ্টি হয়। দাগগুলো ধূসর, গোলাকার সীমা রেখা দ্বারা আবদ্ধ থাকে। অনেকগুলো দাগ একত্রিত হয় বড় দাগের সৃষ্টি করে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝলসে যায়।
৩. আক্রান্ত শুঁটি থেকে পাওয়া বীজ ছোট, বিবর্ণ এবং কুঁচকে যায় এবং ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।


রোগের প্রতিকার
১. রোগ সহনশীল জাত ব্যবহার করতে হবে। তৈলবীজ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত দৌলত, বারি সরিষা ১০, বারি সরিষা ১১ ইত্যাদি জাতগুলো এ রোগ সহনশীল।
২. সঠিক সময়ে বীজ বপন করতে হবে অর্থাৎ অক্টোবরে  শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বীজ বপন করতে হবে।
৩. সুস্থ সবল  জীবাণু মুক্ত এবং প্রত্যয়িত বীজ বপন করতে হবে।
৪. সরিষার মাঠে সময়মতো আগাছা পরিষ্কার করতে হবে বিশেষ করে বথুয়া পরিষ্কার করতে হবে।
৫. অনুমোদিত মাত্রায় পটাশ সার ব্যবহার করলে পাতা ঝলসানো রোগের আক্রমণ কম হয়। জমিতে পূর্ববর্তী ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং ফসল কর্তনের পর আক্রান্ত গাছের পাতা জমি থেকে সরিয়ে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৬. প্রতি কেজি বীজ ২.৫ গ্রাম হারে প্রভে´ ২০০ ডব্লিউ পি দ্বারা শোধন করে বপন করতে হবে।
৭. ১০০ গ্রাম নিমপাতায় সামান্য পানি দিয়ে পিষিয়ে তার রস ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত ফসলে ১০ দিন অন্তর ৩ বার গাছে প্রয়োগ করলে রোগের আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করা যায়।
৮. এ রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে রোভরাল-৫০ ডব্লিউপি শতকরা ০.২ ভাগ হারে (প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম ছত্রাকনাশক) পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর ৩ বার পুরো গাছে ছিটিয়ে স্প্রে করলে এ রোগের আক্রমণ থেকে ফসলকে অনেকাংশে রক্ষা করা সম্ভব।

 

২. ডাউনি মিলডিউ রোগ (Downey mildew)
রোগের কারণ, উৎপত্তি ও বিস্তার : Peronospora parasitica নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়। এ ছত্রাক গাছের আক্রান্ত অংশে এবং বিকল্প পোষক ও স্পোর হিসেবে বেঁচে থাকে। ঠাণ্ডা (তাপমাত্রা ১০-২০ ডিগ্রি সে.) এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় (৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা) এ রোগ সহজে বিস্তার লাভ করে। এছাড়া গাছের সংখ্যা বেশি হলে এ রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।


রোগের লক্ষণ
১. গাছের চারা অবস্থার পর থেকে যেকোনো সময় এ রোগে গাছ আক্রান্ত হতে পারে।
২. আক্রান্ত পাতার নিম্নপৃষ্ঠে সাদা পাউডারের মতো ছত্রাক দেখা যায় এবং পাতার উপরের পৃষ্ঠ হলদে হয়ে যায়।
৩. অনুকূল আবহাওয়ায় এ ছত্রাকের বংশ দ্রুত বৃদ্ধি পায়; ফলে পাতা আকারে ছোট হয়ে যায়।
৪. এ রোগ পরবর্তীতে সরিষার শুঁটি আক্রমণ করে এবং বীজ হতে খাদ্য গ্রহণ করার ফলে উৎপাদন বহুলাংশে কমে যায়।

 

রোগের প্রতিকার
১. সুস্থ সবল ও জীবাণু মুক্ত বীজ বপণ করতে হবে।
২. ন্যাপাস জাতীয় সরিষা এ রোগ সহনশীল।
৩. সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার এবং সেচের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. শস্য পর্যায়ক্রম করতে হবে।
৫. ফসল কর্তনের পর ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৬. বীজ বপনের আগে বীজ শোধন (প্রোভে´ ২০০ ডব্লিউ পি ২.৫ গ্রাম বা ব্যাভিস্টিন ২ গ্রাম/ কেজি বীজ) করে লাগাতে হবে।
৭. রোগ দেখা দেয়া মাত্র রিডোমিল এম জেড-৭২ বা ডাইথেন এম-৪৫ শতকরা ০.২ ভাগ হারে (প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম ছত্রাশনাশক) ১০ দিন অন্তর ৩ বার পুরো গাছে ছিটিয়ে প্রয়োগ করলে ফসলকে এ রোগ থেকে রক্ষা করা যায়।

 

৩. স্ক্লেরোসিনিয়া কাণ্ড পচা রোাগ (Sclerotinia stem rot)
রোগের কারণ, উৎপত্তি ও বিস্তার : Sclerotinia sclerotiorum নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়। এই ছত্রাক মৃত অথবা জীবন্ত উদ্ভিদে সাদা মাইসেলিয়া তৈরি করে এবং উদ্ভিদের আক্রান্ত অংশে এবং মাটিতে কালো দানার মতো স্ক্লেরোসিয়া তৈরি করে বেঁচে থাকে। এ ছাড়া আক্রান্ত বীজের মাধ্যমেও এরা বিস্তার লাভ করে থাকে। সাধারণত আর্দ্রতা অধিক (৯০-৯৫%) এবং ১৮-২৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় বায়ু প্রবাহের ফলে এ রোগের প্রাদুর্ভব বেশি হয়।
 

রোগের লক্ষণ
১. প্রাথমিক অবস্থায় সরিষার গাছের কাণ্ডে পানি ভেজা দাগ লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় যা পরবর্তীতে তুলার মতো সাদা মাইসেলিয়া সৃষ্টি করে।
২. আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে আক্রান্ত কাণ্ড বিবর্ণ হয়ে যায় এবং টিস্যু মারা যায়।
৩. সরিষা গাছে অকাল পক্বতা পরিলক্ষিত হয় এবং গাছ হেলে পড়ে, শুকিয়ে যায় ও মারা যায় এবং ফলন মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়।
৪. কাণ্ডের মধ্যে শক্ত কালো স্ক্লেরোসিয়া সৃষ্টি হয় এ স্কে¬রোসিয়া অনেক সময় কাণ্ডের ওপরে দেখতে পাওয়া যায়।

 

রোগের প্রতিকার
১. সুস্থ সবল রোগমুক্ত প্রত্যয়িত বীজ বপন করতে হবে।
২. গ্রীষ্ম মৌসুমে গভীরভাবে জমি চাষ দিতে হবে।
৩. জমিতে আক্রান্ত ফসলের অবশিষ্টাংশ পরিষ্কার অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৪. এ রোগের পোষক নয় এমন ফসল দ্বারা শস্য পর্যায়ক্রম করতে হবে যেমন- গম, যব, ধান এবং ভুট্টা।
৫. জমিতে ট্রাইকোডারমা ভিরিডি অথবা ট্রাইকোডারমা হারজেনিয়াম প্রতি হেক্টর জমিতে ২.৫ কেজি হারে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৬. কারবেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক ০.১ ভাগ হারে (প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম ছত্রাকনাশক) ফুল আসার সময় ২০ দিন অন্তর ২ বার পুরো গাছে ছিটিয়ে প্রয়োগ করলে এ রোগ থেকে রক্ষা করা যায়।

 

৪. সপুষ্পক পরজীবী উদ্ভিদ (Orobanche প্রজাতি) রোগের কারণ, উৎপত্তি ও বিস্তার : Orobanche Spp. নামক এক প্রকার সপুষ্পক শিকড়-পরজীবী উদ্ভিদ যার বংশ বৃদ্ধি সরিষার ওপর নির্ভরশীল। মাটি, ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, সেচের পানি প্রভৃতির মাধ্যমে রোগের বিস্তার লাভ করে। প্রতি বছর একই জমিতে সরিষা পরিবারের কোনো ফসলের চাষ করলে এ পরজীবী উদ্ভিদের বিস্তার ঘটে।


রোগের লক্ষণ
১. অরোবাংকি এক প্রকার সপুষ্পক শিকড়-পরজীবী উদ্ভিদ যার বংশ বৃদ্ধি সরিষার ওপর নির্ভরশীল।
২. এর বীজ মাটিতেই অবস্থান করে।
৩. সরিষা গাছের শিকড়ের সাথে এ পরজীবী উদ্ভিদ সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে।
৪. ফলে আক্রান্ত সরিষার গাছ দুর্বল হয়, বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন হ্রাস পায়।

 

রোগের প্রতিকার
১. একই জমিতে প্রতি বছর সরিষা চাষ না করে অন্যান্য ফসল যেমন- ধান, গম জাতীয় ফসল (যাতে অরোবাংকি না হয়) পর্যায়ক্রমে চাষ করলে এ রোগের প্রাদুর্ভার অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
২. ফল আসার আগেই এ পরজীবী উদ্ভিদ জমি হতে উঠিয়ে ফেলতে হবে।
৩. বীজ বপনের পূর্বে জমি লাঙল দিয়ে গভীরভাবে চাষ করতে হবে। এতে পরজীবী উদ্ভিদের বীজ মাটির গভীরে চলে যায় এবং সরিষার শিকড়ের সংস্পর্শে না আসায় বীজ গজাতে পারে না।
৪. টিএসপি ২৫০ কেজি/হেক্টর প্রয়োগের মাধ্যমে রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো যায়।
৫. জমিতে ২৫% কপার সালফেট দ্রবণ স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

 

*বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী, পাবনা

মো. রাজিব হুমায়ুন*

বিস্তারিত
আলু ফসলের উন্নত জাত ও উৎপাদন কলাকৌশল

আলু বিশ্বের অন্যতম প্রধান ফসল। উৎপাদনের দিক থেকে ধান, গম ও ভুট্টার পরেই চতুর্থ স্থানে আছে আলু। বাংলাদেশে আলু একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। বাংলাদেশের সর্বত্রই এর চাষ হয়ে থাকে। অনুকূল আবহাওয়া ও বাজারজাতকরণের জন্য কিছু জেলায় এর চাষ ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে।


বাংলাদেশে আলু সাধারণত সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। বিভিন্ন তরকারির সাথে খেতে খুবই মুখরোচক। প্রক্রিয়াজাত আলু বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। আলু একটি স্টার্চ প্রধান খাদ্য এবং ভাতের বিকল্প হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। পৃথিবীর অন্তত ৪০টি দেশে আলু মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য। আলু একটি স্বল্পমেয়াদি উচ্চফলনশীল ফসল যা জমির স্বল্পতাহেতু বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।


বর্তমানে বাংলাদেশ আলু হেক্টরপ্রতি গড় ফলন মাত্র ১১ টন। আলুর উৎপাদন ২০ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। ফলন বাড়লে উৎপাদন খরচ কমে আসবে। ভাতের বদলে আলু খেলে চালের ওপর বাড়তি চাপ কমে আসবে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ভাতের বদলে যদি আলু মাঝে মাঝে খাওয়া হতো তাহলে চালের ওপর নির্ভরতা অনেক কমে যেত।


আলুর জাত নির্বাচন
ভালো জাতের আলুর চাষ করলে একদিকে চাষি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে আবার অন্যদিকে ফলনও  আশানুরূপ পাওয়া যায়। তাই জাত নির্বাচন অবশ্যই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশে যেসব জাতের আলুর চাষ হয়ে থাকে তা হলো দেশি জাত এবং উচ্চফলনশীল উন্নত জাত। বর্তমানে আলু চাষের মোট জমির শতকরা ৬৫ ভাগ জমিতে উন্নত জাতের আলু এবং ৩৫ ভাগ জমিতে দেশি জাতের আলুর চাষ হয়ে থাকে।


দেশি জাত
ফলন কম হলেও দেশি জাতের বৈশিষ্ট্য হলো দীর্ঘদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়। দেশি জাতের আলু ছোট ও ওজন  ৫ থেকে ৪৮ গ্রাম। কিছু দেশি জাত আছে যা উন্নত জাতের চেয়ে নাবি। দেশি জাতের আলু তুলনামূলকভাবে খেতে খুব সুস্বাদু। বর্তমানে বাজারমূল্যে উন্নত জাতের চেয়ে দেশি জাতের আলু বেশি দামে বিক্রি হয়। দেশি জাতসমূহের মধ্যে আউশা, চল্লিশা, দোহাজারী লাল, ফেইন্তাশীল, হাসরাই, লাল পাকরী, লালশীল, পাটনাই, সাদা গুটি শীল বিলাতী ও সূর্যমূখী। দেশি জাতগুলো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। দেখা গেছে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে দেশি জাতের আলুর ফলন কমে যায়। বীজের মাধ্যমেই এ রোগটি ছড়িয়ে থাকে। তাই দেশি জাত নির্বাচনের ক্ষেত্রে রোগমুক্ত বীজ সংগ্রহ করে লাগানো উচিত।


উচ্চফলনশীল
১৯৬০ সাল থেকে এ পর্যন্ত যেসব উন্নত জাতের আলুর চাষ হচ্ছে তার মধ্যে হিরা, আইলসা, পেট্রোনিস, মুল্টা, ডায়ামন্ট, কার্ডিনাল, মন্ডিয়াল, কুফরী সিন্দুরী, চমক, ধীরা, গ্রানোলা, ক্লিওপেট্রা ও চিনেলা জাতটি সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে। বারি টিপিক্রস-১ এবং বারি টিপিক্রস-২ নামে ২টি হাইব্রিড জাতের আলু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়াও বারি আলু-১ (হীরা), বারি আলু-৪ (আইলসা), বারি আলু-৭ (ডায়ামন্ট), বারি আলু-৮ (কার্ডিনাল), বারি আলু-১১ (চমক), বারি আলু-১২ (ধীরা), বারি আলু-১৩ (গ্রানোলা), বারি আলু-১৫ (বিনেলা), বারি আলু-১৬ (আরিন্দা), বারি আলু-১৭ (রাজা), বারি আলু-১৮ (বারাকা), বারি আলু-১৯ (বিন্টজে) এবং বারি আলু-২০ (জারলা) জাত রয়েছে। এসব জাত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা থেকে উদ্ভাবিত। এগুলো সবই উচ্চফলনশীল জাত।


উৎপাদন পদ্ধতি
বাংলাদেশের কৃষক আলু উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। কিন্তু এগুলো বিজ্ঞানসম্মত নয়। তাই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষ করলে একদিকে যেমন কৃষক লাভবান হবে অন্যদিকে ফলনও বাড়বে।


মাটি নির্বাচন
আলু চাষের জন্য বেলে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী।


উৎপাদন মৌসুম
বাংলাদেশে সাধারণত নভেম্বর মাসের আগে আলু লাগানো যায় না, কারণ তার আগে জমি তৈরি সম্ভব হয় না। নভেম্বরের পরে আলু লাগালে ফলন কমে যায়। এ জন্য উত্তরাঞ্চলে মধ্য-কার্তিক (নভেম্বর প্রথম সপ্তাহ), দক্ষিণাঞ্চলে অগ্রহায়ণ ১ম সপ্তাহ থেকে ২য় সপ্তাহ (নভেম্বর মাসের মধ্য থেকে শেষ সপ্তাহ)।


বীজের হার
প্রতি হেক্টরে ১.৫ টন। রোপণের দূরত্ব ৬০x২৫ সে. মি. (আস্ত আলু) এবং ৪৫x১৫ সে. মি. (কাটা আলু)। কৃষকেরা ঘরে সংরক্ষিত দেশি জাতের যে বীজ ব্যবহার করেন তা খুবই নিকৃষ্টমানের। কোনো কোনো সময় হিমাগারে থাকা অবস্থায় আলুর মাঝখানে কাল দাগ দেখা যায়। মাঠে থাকা অবস্থায় বা সংরক্ষণের সময় যদি উচ্চ তাপমাত্রায় (৩৫ ডিগ্রি সে. এর উপরে) থাকলে বা অক্সিজেন বিহীন অবস্থায়  থাকলে এমনটি হয়। এ রোগটিকে ব্লাকহার্ট রোগ বলে। আবার যদি হিমাগারের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সে. এর নিচে চলে যায় তাহলে আলু শীতলাঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের আলু গজাবে না। তাই কৃষক অবশ্যই এদিকটা বিবেচনা করে আলু বীজ সংগ্রহ করবেন।


বীজ শোধন
যদি সম্ভব হয় আলু বীজকে মারকিউরিক ক্লোরাইড এক গ্রাম নিয়ে ২ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১-২ ঘণ্টা ডুবিয়ে নিলে ভালো হয়। আবার বোরিক এসিডের ০.৫% দ্রবণে আলু বীজ ১৫-৩০ মিনিট ডুবিয়ে রাখলেও ভালো ফল পাওয়া যায়। কাটা বীজ বা গজানো বীজ শোধন করা যাবে না।


বীজের আকার
২৫-৩৫ গ্রাম ওজনের বীজ রোপণ করা সবদিক থেকে ভালো।


সারের পরিমাণ
কৃষকেরা যদি আলুর উচ্চফলন পেতে চান তাহলে সুষম সারের বিকল্প নেই। সাধারণ কৃষকের জন্য আলু চাষে নিম্নোক্ত হারে সার ব্যবহার করা প্রয়োজন।
ইউরিয়া            -   ২২০-২৫০ কেজি/হেক্টর
টিএসপি            -   ১২০-১৫০ কেজি/হেক্টর
এমওপি             -  ২২০-২৫০ কেজি/হেক্টর
জিপসাম            -   ১০০-১২০ কেজি/হেক্টর
জিংক সালফেট    -   ৮-১০ কেজি/হেক্টর
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট - ৮০-১০০ কেজি/হেক্টর  
(অম্লীয় বেলে মাটির জন্য)
বোরন             -   ৮-১০ কেজি/হেক্টর
গোবর             -   ৮-১০ টন/হেক্টর
জমিতে যদি সবুজ সার প্রয়োগ করা হয় তাহলে গোবরের প্রয়োজন নেই।


সার প্রয়োগ পদ্ধতি
গোবর, অর্ধেক ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও জিংক সালফেট আলু রোপণের আগেই মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ৩০-৩৫ দিন পর যখন আলুর নালা তৈরি করে মাটি তোলার সময় দিতে হবে।


জলবায়ু
আলু চাষের জন্য তাপমাত্রা ও আলোর প্রভাব খুবই প্রকট, দেখা গেছে ১৫ ডিগ্রি - ২০ ডিগ্রি সে. গড় তাপমাত্রা আলু চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ২০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার ওপরে গেলে ফলন কমতে থাকে আবার ৩০ ডিগ্রি সে. এ আলু উৎপাদন ক্ষমতা লোপ পায়। আবার ১০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার নিচে গেলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। এজন্য আলু লাগানোর সময় ২০ ডিগ্রি - ২৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ তাপমাত্রায় গাছ দ্রুত গজায়। আবার বাংলাদেশে দেখা গেছে যে বছর মেঘমুক্ত আকাশ ও তাপমাত্রা সঠিকভাবে থাকে সে বছর আলুর গড় ফলন ১০-১৫% বেড়ে যায়।


সেচ
আলু শীতকালীন সবজি। আর শীতকাল শুষ্ক এজন্য আলু চাষে সেচের প্রয়োজন হয়। পানির প্রাপ্যতা কম হলে আলুর ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বীজ আলু বপনের ২০-২৫ দিনের মধ্যে একবার সেচ দিতে হবে। ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় সেচ এবং ৬০-৬৫ দিনের মধ্যে আরেকটি সেচ দিতে হবে। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলে ৮-১০ দিন পর সেচ দিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়।


পরিচর্যা
আলু লাগানোর ৩০-৩৫ দিন পর গোড়ায় মাটি দেয়া দরকার এবং সেই সাথে আগাছা দমন করতে হবে।


রোগ ও পোকামাকড়
রোগের প্রতিকার

আলু মাঠে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন রোগ দেখা যায়। এর মধ্যে আলুর মড়ক রোগ, আলুর আগাম রোগ যা পাতা পোড়ানো বা কুঁচকে যাওয়ার মতো দেখায়, কাণ্ড ও আলু পচা রোগ, ঢলে পড়া ও বাদামি পচন রোগ, আলুর দাঁদ রোগ, আলুর মোজাইক রোগ, আলুর শুকনো পচা রোগ, আলুর নরম পচা রোগ অন্যতম।


রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।  রোগ দেখা দিলে সেচ দেয়া বাদ রাখতে হবে এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সাথে পরামর্শ করে বালাইনাশক দিতে হবে।


পোকামাকড় দমন
আলু ক্ষেতে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় দেখা যায়। এদের মধ্যে আলুর কাটুই পোকা অন্যতম। এ পোকার কীড়া বেশ শক্তিশালী ৪০-৫০ মিমি লম্বা হয়। এ পোকা চারা গাছ কেটে দেয় এবং আলুতে ছিদ্র করে এজন্য আলুর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাটুই পোকার প্রকোপ বেশি না হলে কাটা আলু গাছ দেখে তার কাছাকাছি মাটি উলটপালট করে কীড়া খুঁজে বের করে মেরে ফেলতে হবে। এছাড়াও প্রতি লিটার পানির সাথে ডারসবান ২০ ইসি ৫ মিলি হারে  মিশিয়ে গাছের গোড়া ও মাটি ভিজিয়ে ৩০-৪০ দিন পর স্প্রে করতে হবে। আলুর সুতলি পোকা ও আলু উৎপাদনে বাধাগ্রস্ত করে। এ পোকা দেখতে ছোট, ঝালরযুক্ত, সরু ডানা বিশিষ্ট ধূসর বাদামি রঙের হয়ে থাকে। পূর্ণাঙ্গ পোকা সাদাটে বা হাল্কা গোলাপি বর্ণের এবং ১৫-২০ মিমি লম্বা হয়। এ পোকা আলুর মধ্যে লম্বা সুড়ঙ্গ করে আলুর ক্ষতি করে থাকে। কৃষকের বাড়িতে রাখা আলু এ পোকা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


দমন
বাড়িতে রাখা আলুতে শুকনা বালি, ছাই, তুষ অথবা কাঠের গুঁড়ার পাতলা স্তর দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। যাতে পোকা আলুর সংস্পর্শে না আসে। আলু সংরক্ষণের পূর্বে সুতলী পোকায় খাওয়া আলু ফেলে দিতে হবে।


ফসল সংগ্রহ
আলু পরিণত হলে আলু গাছের কাণ্ড হেলে পড়ে এবং নিচের দিকের পাতা হলুদ হতে থাকে। আলু সংরক্ষণ করতে হলে অবশ্যই পরিপক্বতা লাভ করার পর ফসল সংগ্রহ করতে হবে। উচ্চফলনশীল জাতে ৮০-১০০ দিন লাগে পরিপক্বতা আসতে। দেশি জাতে সময় আরো বেশি লাগে। বাংলাদেশে উচ্চফলনশীল জাতের হেক্টরপ্রতি ফলন ১৩-১৪ টন এবং দেশি জাতে ৭-৮ টন। বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ করলে উচ্চফলনশীল জাতে ২০ টনের অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব।


রেফারেন্স : সবজি বিজ্ঞান (ড. মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ)
            বারি হাত বই।

 

কৃষিবিদ কামাল উদ্দিন আহাম্মেদ*

* বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী, পাবনা

বিস্তারিত
লবণসহিষ্ণু চীনাবাদামের চাষাবাদ পদ্ধতি

বাংলাদেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকার বেশির ভাগ জমির মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিতে বিভিন্ন মাত্রার (২.০ থেকে >১৬.০ ডিএস/মি) লবণাক্ততা বিদ্যমান থাকায় রবি মৌসুমে অর্থনৈতিকভাবে সব ফসল চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। তাই বেশির ভাগ জমি উক্ত মৌসুমে পতিত থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসব ফসল বৃষ্টিনির্ভর অবস্থায় চাষ করা যায় অর্থাৎ কোন বাড়তি সেচের প্রয়োজন হয় না সেসব ফসল লাভজনকভাবে উক্ত এলাকায় চাষ করা সম্ভব। এ রকমই একটি ফসল হলো চীনাবাদাম। চীনাবাদাম শিমগোত্রীয় ফসল বিধায় এতে নাইট্রোজেন সারসহ অন্যান্য রাসায়নিক সার কম লাগে। অধিকন্তু এর শিকড়ের গুটি, পাতা ইত্যাদি মাটিতে মিশে মাটির জৈব পদার্থের চাহিদা মিটায়। চীনাবাদামের দানায় প্রচুর পরিমাণে তেল (৪৮-৫২%), প্রোটিন (২৫-৩০%), শর্করা (২০-২৫%) ও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-ই থাকে। উপরের আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, চীনাবাদাম  চাষ বাংলাদেশের লবণাক্ত এলাকার মাটি ও মানুষের স্বাস্থ্য উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। চীনাবাদামের  গাছ একটি উত্তম গো-খাদ্য।


এক হিসাবে দেখা গেছে যে, চীনাবাদামের যে সমস্ত জাত অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় থেকে পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত ৮ ডিএস/মি লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। সে সমস্ত জাতের সাহায্যে লবণাক্ত এলাকার প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমি রবি মৌসুমে চাষের আওতায় আনা সম্ভব। উক্ত সম্ভাবনাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে এ পর্যন্ত পাঁচটি লবণসহিষ্ণু  চীনাবাদাম জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। জাতগুলো হলো বিনাচীনাবাদাম-৫, বিনাচীনাবাদাম-৬, বিনাচীনাবাদাম-৭, বিনাচীনাবাদাম-৮ বিনাচীনাবাদাম-৯। নিম্নে জাতগুলোর উদ্ভাবনের ইতিহাস ও প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো।


উদ্ভাবনের ইতিহাস
স্থানীয়ভাবে চাষকৃত জাত, ঢাকা-১ এর থেকে উদ্ভাবিত মিউট্যান্ট
Mut-3 কে পুনরায় ২৫০ গ্রে.মাত্রার গামা রশ্মি প্রয়োগ করে M6/25/54-20M6/25/54-82 নামের দুটি মিউট্যান্ট পাওয়া যায় যা মাতৃজাতের তুলনায় ১০-১৫% বেশি ফলন দেয় এবং ফুল আসা হতে পরিপক্ব পর্যায় পর্যন্ত ৮ডিএস/মি মাত্রার লবণ সহ্য করতে পারে। এ মিউট্যান্ট দুটিকে ২০১১ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড যথাক্রমে বিনাচীনাবাদাম-৫, বিনাচীনাবাদাম-৬ নামে অনুমোদন দেয়। এর পরে ঢাকা-১ জাতে ১৫০ গ্রে মাত্রার গামা রশ্মি প্রয়োগ করে D1/15/17-1 নামক অধিক ফলনশীল লবণসহিষ্ণু মিউট্যান্ট উদ্ভাবন করা হয়। স্প্যানিশ টাইপ জাত ঢাকা-১ এর সাথে ভ্যালেন্সিয়া টাইপ  জাত ঝিঙা বাদামের সংকরায়ণের মাধ্যমে GC-1-24-1-1-2 কৌলিক সারিটি পাওয়া যায়। এছাড়া পাবনার পাকশী এলাকায় চাষাবাদকৃত PK-1 জাতের বীজে ২৫০ গ্রে  মাত্রার গামা রশ্মি প্রয়োগ করে PK/25/3-1 নামের আর একটি মিউট্যান্ট পাওয়া যায়। এগুলোকে ২০১৫ সালে যথাক্রমে  বিনাচীনাবাদাম-৭,  বিনাচীনাবাদাম-৮ ও  বিনাচীনাবাদাম-৯ নামে জাতীয় বীজ বোর্ড লবণাক্ত এলাকাসহ সারাদেশে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন দেয়।


চাষাবাদ পদ্ধতি
মাটি

বেলে, বেলে-দোআঁশ, এঁটেল-দোআঁশ মাটি বাদাম চাষের জন্য উপযোগী। এঁটেল মাটিতেও চীনাবাদাম চাষ করা যায়। তবে এঁটেল মাটিতে চাষের ক্ষেত্রে চীনাবাদাম তোলার সময় মাটি শক্ত থাকলে পানি দিয়ে নরম করে নিতে হবে এবং গাছসহ চীনাবাদাম হতে লেগে থাকা কাদা পুকুর/ট্যাপের পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে আলগা পানি শুকানোর জন্য আটিগুলোর বাদাম উপরের দিকে ও গাছ নিচের দিকে  করে রেখে দিতে হবে।


বপনের সময়
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হতে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত অর্থাৎ পৌষ মাসের প্রথম সপ্তাহ হতে ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, রোপণের সময় মাটির লবণাক্ততা যেন অবশ্যই ৫.০ ডিএস/মি এর নিচে থাকে নতুবা চারা গজানো মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।


বীজের পরিমাণ
বপন পদ্ধতি


বীজ সারিতে বপন করতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সেমি. (১০ ইঞ্চি) এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১৫ সেমি. (৬ ইঞ্চি)। বীজগুলো মাটির ২.৫-৪.০ সেমি. (১-১.৫ ইঞ্চি) নিচে পুঁতে দিতে হবে।


জমি তৈরি
জমির আগাছা ভালোভাবে পরিষ্কার করে ৩-৪টি চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।


সার প্রয়োগ
বপনের সময় প্রতি কেজি বীজের জন্য ৪০ গ্রাম জীবাণু সার দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। জীবাণুসার দিলে ইউরিয়া সার দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
ক্ষতিকর পোকামাকড় ও দমন ব্যবস্থাপনা


পিপীলিকা
জমিতে বাদামের বীজ লাগানোর পর পিপীলিকা আক্রমণ করে বীজ খেয়ে ফেলতে পারে। তাই বপনের পর ক্ষেতের চারদিকে সেভিন ডাস্ট ৮৫ এসপি ছিটিয়ে দিলে বীজ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে না।


পাতা মোড়ানো পোকা, বিছা পোকা ও জাবপোকা
এই পোকাগুলো দমনের জন্য সিমবুশ ১০ ইসি বা ক্লাসিক ২০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. বা রিপকর্ড ১০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি. মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।


উঁইপোকা
উঁইপোকা চীনাবাদাম গাছের শিকড় কাটে ও ক্ষত সৃষ্টি করে। ফলে গাছ মারা যায়। তাছাড়া মাটির নিচে বাদামের খোসা ছিদ্র করে বীজ খায়। উঁইপোকা দমনের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।


১. পানির সাথে কেরোসিন মিশিয়ে সেচ দিতে হবে।
২. পাট কাঠির ফাঁদ তৈরি করে এ পোকা কিছুটা দমন করা যায়। মাটির পাত্রে পাটকাঠি ভর্তি করে পুঁতে রাখলে তাতে উঁই পোকা লাগে। পাটকাঠি ভর্তি পাত্র তুলে এই পোকা মারা যায়।
৩. আক্রান্ত মাঠে ক্লাসিক-২০ ইসি ১০ লিটার পানিতে ৩০ মিলি. মিশিয়ে (প্রতি ৫ শতাংশের জন্য) জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।


রোগ ও দমন ব্যবস্থাপনা
পাতার রোগ

সার্কোস্পরা এরাচিডিকোলা ও ফেসারিওপসিস পারসোনাটা নামক দুটি ছত্রাক দ্বারা এ রোগ সৃষ্টি হয়। এ রোগের আক্রমণের ফলে পাতার ওপর হলদে রেখা বেষ্টিত বাদামি রঙের দাগ সৃষ্টি হয়। দাগ আকারে বড় হতে পাতার ওপর ছড়িয়ে পরে। গাছ দেরিতে আক্রান্ত হলে পাতার নিচে গাঢ় বাদামি হতে কালচে বর্ণের দাগ দেখা দেয়। পাতার বাকি অংশের সবুজ রঙ মলিন হয়ে ধীরে ধীরে পাতা ঝরে পড়ে।


প্রতিকার
১.  এ রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে গাছে ব্যাভিস্টিন ৫০ ডব্লিউ পি ১ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১ দিন অন্তর অন্তর ২-৩ বার ছিটিয়ে দিলে রোগের প্রকোপ কমে যায়। অথবা ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানির সাথে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়।
২.  ফসল সংগ্রহের পর আগাছা পুড়ে ফেলতে হবে।

সারের নাম হেক্টরপ্রতি (কেজি) একরপ্রতি (কেজি)
ইউরিয়া ৪০-৫০ ১৬-২০
টিএসপি ১৬৫-১৭৫ ৬৭-৭১
এমওপি ১৩০-১৪০ ৫৩-৫৭
জিপসাম ১১০-১২০ ৪৫-৪৯


মরিচা রোগ
পাকসিনিয়া এরাচিডিস নামক ছত্রাকের কারণে এ রোগ হয়ে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় পাতার নিচের দিকে মরিচা পড়ার মতো উঁচু বিন্দুর মতো দাগ দেখা যায়। দাগ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলে ফলন অনেক কমে যায়।


প্রতিকার
১.  এ রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে গাছে ব্যাভিস্টিন ৫০ ডব্লিউপি ২ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানি মিশিয়ে প্রতি ১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
২.  পরবর্তী গাছ থেকে গজানো গাছ, আগাছা এবং খড় পুড়ে ফেলে এ রোগের আক্রমণ কমানো যায়।


গোড়া পচা রোগ
এ রোগের আক্রমণের ফলে কাণ্ড পচে যায় এবং ধীরে ধীরে গাছ মরে যায়।


প্রতিকার
১.  রোগাক্রান্ত গাছ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হয়।
২.  প্লাবন সেচ দিয়েও আক্রমণ রোধ করা যায়।
৩.  শস্যপর্যায় অনুসরণ করে এ রোগের আক্রমণ কমানো যায়।
৪.  বপনের পূর্বে ৪ মিলিগ্রাম এগ্রোসান দিয়ে প্রতি কেজি বীজ শোধন করতে হবে।


ফসল সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণ
ভালো ও গুণগতমানের বীজ পেতে হলে ফসল যথাসময়ে সংগ্রহ করতে হবে। সঠিক সময়ে ফসল তোলার জন্য ফসলের পরিপক্বতা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকা আবশ্যক। যখন গাছের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ বাদাম পরিপক্ব হবে তখনই চীনাবাদাম তোলার উপযুক্ত সময়। পরিপক্ব হলে বাদামের খোসার শিরা-উপশিরাগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যায় এবং গাছের পাতাগুলো হলুদ রঙ ধারণ করে নিচের পাতা ঝরে পড়তে থাকে। বাদামের খোসা ভাঙার পর খোসার ভেতরে সাদা কালচে রঙ ধারণ করলেই বুঝতে হবে ফসল উঠানোর উপযুক্ত সময় হয়েছে। ক্ষেত থেকে তোলার পর বাদামের গায়ে লেগে থাকা কাদামাটি বা বালু পরিষ্কার করে আটিগুলো উপুর করে রোদে শুকাতে হবে। এতে করে বাদামের গায়ে লেগে থাকা পানি ঝরে যাবে। পরে গাছ থেকে বাদাম ছাড়িয়ে উজ্জ্বল রোদে দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা করে ৫-৬ দিন শুকাতে হবে। এ অবস্থায় বীজের আর্দ্রতা ৮-১০% হয়ে থাকে। শুকানোর পর খোসাসহ বাদাম ঠাণ্ডা করে পলিথিন আচ্ছাদিত চটের বস্তায় মাচার উপর সংরক্ষণ করতে হবে।

 

ড. মো: আবুল কালাম আজাদ* মো: কামরুজ্জামান**

*সিএসও ও **এসও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাকৃবি চত্বর, ময়মনসিংহ-২২০২ মোবাইল : ০১৭১০৭৬৩০০৩

বিস্তারিত
বীচিকলা চাষ

কলা বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফল। এ ফল সারা বছর ধরে পাওয়া যায়। আবাদি জমি ও ফলের উৎপাদনের দিক থেকে এ ফলের  অবস্থান বাংলাদেশে প্রথম স্থানে রয়েছে। পুষ্টিতে ভরপুর, ফল-সবজি উভয়ভাবে এ ফল আহার করা যায়। অন্যান্য ফলের তুলনায় কলার বাজারমূল্য কম। কাজেই এ ফল ধনী-দরিদ্র সবারই ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। একই কারণে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের অধিকাংশ পুষ্টির চাহিদা পূরণে কলার গুরুত্ব অপরিসীম। তরকারি হিসেবেও কলা অতি জনপ্রিয় পুষ্টিকর সবজি। তরকারি হিসেবে কলার থোড় ও মোচার কদর খুব বেশি। এমনকি কাঁচা কলার ছিলকা (উপরের অংশ) দিয়ে তৈরি ভর্তা অতি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। কলাগাছের বিভিন্ন অংশ পুড়িয়ে প্রাপ্ত ছাই দিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষ সিদ্ধ পানিতে কাপড় পরিষ্কার করে সাবানের খরচ বাঁচায়।


পুষ্টিগুণ ও ব্যবহার :  কলাতে প্রচুর পরিমাণে শর্করা, ক্যালোরি, ভিটামিন-বি২ ও ভিটামিন-সি রয়েছে। এতে আরও রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন-বি১, চর্বি ও আমিষ। ডায়রিয়া, পেটের পীড়া নিরাময়ে সহজে হজমযোগ্য খাদ্য হিসাবে রোগীদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ও দুর্বলতা দূরীকরণে কাঁচা কলার তরকারি আহার করার জন্য ডাক্তারগণ পরমর্শ দিয়ে থাকেন। হিন্দুদের পূজা পার্বন ও বিয়ের অনুষ্ঠানে কলা ও কলা গাছের প্রয়োজন হয়।


গরু-ছাগলের খাদ্য হিসাবেও কলাপাতা ও অন্যান্য অংশ ব্যবহার করা হয়। কেঁচো সার তৈরি করতে হলেও কলা গাছের বিভিন্ন অংশ অন্যতম উপকরণ হিসাবে কাজে লাগে। দেশের নিম্নাঞ্চলে প্রতি বছরই অতি বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়ে পথঘাট তলিয়ে যায়। এ সময় হাটবাজারে বা অল্প দূরত্বে চলা ফেরার প্রয়োজনে সহজ ও সস্তায় কলার ভেলা অন্যতম বাহন হিসাবে কাজ করে। বন্যাকবলিত নিম্নাঞ্চলে ভাসমান বীজতলা হিসাবে কলার ভেলা ব্যবহার করার সুবিধা আছে এবং এ প্রচলন দিন দিন বাড়ছে। নিম্নাঞ্চলে/হাওর এলাকায় বসতবাড়ি, রাস্তা ও বাঁধের ধারে মাটির ভাঙন রোধে ভূমি ক্ষয় রোধক হিসাবে কলাগাছ ব্যবহার করা হয়। এ ব্যবস্থায় কলাগাছ ঢেউয়ের আঘাত থেকে রাস্তা/বাঁধকে রক্ষা করে।


জাত : এ দেশে আবাদকৃত কলার জাত প্রচুর রয়েছে। গাছের আকার ভেদে ও উচ্চতা বিবেচনায় এগুলোকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো- ক. খাটো জাতের কলা, খ. মাঝারি উচ্চতা বিশিষ্ট জাতের কলা এবং গ. লম্বা জাতের কলা।


১. খাটো জাতের কলা সিঙ্গাপুরী, কাবুলী, মেহের সাগর (জয়েন্ট গর্ভারনার), এগুলো খাটো জাত দলভুক্ত কলা। এ সব জাতের গাছ লম্বায় কম হয় এবং কিছুটা ছায়া বা আধা ছায়ায় কলা ফলানো যায়। বসতবাড়ির আশ পাশে এ জাতের কলার তুলনামূলক আবাদ  বেশি। কেবল মেহের সাগর, রঙিন মেহের সাগর নামক অপর খাটো জাতগুলো বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। এ জাতের কলার আকার ও প্রকৃতি অনেকটা সাগর কলার মতো। তবে প্রতি কাঁদিতে সাগর কলার চেয়ে  ফলের সংখ্যা ২-৩ গুণ বেশি হয়। প্রতি কাঁদিতে ১৭০-২২০টা কলা ধরতে দেখা যায়।


মাঝারি আকার বিশিষ্ট জাত : অমৃত সাগর, সবরি, অনুপম, মালভোগ, মর্তমান, চাঁপা, অগ্নিশ্বর, কবরী এ দলভুক্ত জাত। বৃহত্তর রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ময়মনসিংহ এলাকায় বাগান আকারে মূলত সবরি, সাগর, মেহের সাগর ও বিভিন্ন তরকারি কলা চাষ করা হয়। তবে বৃহত্তর বরিশাল ও পার্বত্য জেলাতে  চাঁপা, সবরি ও বিভিন্ন জাতের তরকারি কলার  চাষ প্রচলন বেশি।


লম্বাকৃতির জাত : কাঁঠালি, আনাজি ও অন্যান্য তরকারি কলাসহ বীচিকলা, বাংলা কলা, গেঁড়া কলা লম্বা জাত দলভুক্ত। বীচিকলা দেশের সবখানেই রাস্তার ধারে অনেকটা বিনা যত্নে জন্মায়। কম আয়ের মানুষ বিশেষ করে মহিলারা এ জাতের কলা চাষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক কালে তরকারি কলা সীমিত আকারে কেবল বাড়ির আশপাশে পরিত্যক্ত জায়গায় চাষ করা হতো। বর্তমানে এ কলা তরকারি হিসাবে চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও  ভালো দাম পাওয়ার কারণে তরকারি কলার আবাদ প্রবণতা বাড়ছে। অনেক সময় এ কলা সাগর কলার চেয়েও বেশি দামে বেচাকেনা হয়। তাই এসব তরকারি কলা বাগান আকারে চাষ করতে চাষিরা যথেষ্ট আগ্রহী হচ্ছে। এক কালে পার্বত্য ও পাশের জেলাগুলোতে কেবল চাঁপা কলা কম যত্নে চাষ করার প্রচলন ছিল। এখন কলা চাষে ও জাত নির্বাচনে চাষিরা সচেতন। বর্তমানে এসব এলাকায় বাংলা কলা, তরকারি কলা ও কিছু পরিমাণ সবরি ও সাগর কলা বাণিজ্যিকভাবে আবাদ করার প্রবণতা চাষি পর্যায়ে বাড়ছে।


বীচি/এঁটেল কলা চাষ ও সম্প্রসারণ গুরুত্ব :  যুগ যুগ ধরে এ দেশে বীচিকলার চাষ দেশের সব জেলাতেই কমবেশি হয়ে থাকে। তবে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী জেলার রাস্তা ও বাঁধের ধারে বীচিকলার আবাদ  বেশি হয়। রাস্তার ও বাঁধের ধারে যে সব পরিবারের আবাসন গড়ে উঠেছে, তারা নিকটস্থ রাস্তার ধারে ২০-৩০টা করে বীচিকলার চারা রোপণ করে তার সুফল বছরব্যাপী ভোগ করে থাকে।


আবাদ সুবিধা : আবাদি জমিতে কেবল কিছু লাভজনক প্রচলিত জাতের কলা (সাগর, সবরি, বাংলা কলা, আনাজি) চাষ করা হয়ে থাকে। তবে এসব জাতের কলা ২-৩ বছরের বেশি জমিতে বাগান আকারে রাখা যায় না। অথচ বীচিকলা একবার রোপণ করে দীর্ঘকাল ধরে ফলন পেতে তেমন অসুবিধা হয় না। অন্যান্য কলার তুলনায় এ জাতের কলা গাছের উচ্চতা বেশি। তাই রোপণের কয়েক মাসের মধ্যেই ৫ - ৭ ফুট উচ্চতায় পৌঁছে। দ্রুত বৃদ্ধি ও গাছ লম্বা হওয়ার কারণে পাতা, ফুল, ফল সবই গরু-ছাগলের নাগালের বাইরে চলে যায়। বেড়া বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই এসব কলা গাছ বেড়ে উঠে। অন্য প্রচলিত কলার জাতগুলো সঠিক যত্ন ছাড়া সুফল আশা করা যায় না। অথচ বীচি কলা কম যত্নেও প্রতিকূল পরিবেশে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠে এবং তা থেকে ফুল, ফল, থোড় সব বিনা খরচে পাওয়া যায়। এ জাতের কলাগাছ বেশি লম্বা ও শক্ত হওয়ায় এ গাছ দিয়ে তৈরি ভেলা বেশি টেকসই হয়। একই কারণে ভাসমান বীজতলা তৈরির জন্য এ জাতের কলা বেশি উপযোগী ।


দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর পাশাপাশি হাওর অঞ্চলে ভাসমান বীজতলা তৈরি করে তাতে আমন ধানের চারা  তৈরি ও বিভিন্ন প্রকার সবজি ও মসলার চারা তৈরি করা এবং তার আবাদ জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। হাওর এলাকায় ভাসমান সবজি বীজতলা তৈরির জন্য প্রয়োজনমতো কচুরিপানা পাওয়া সহজ হয় না। একই কারণে কলার ভেলা তৈরি করে কচুরিপানার অভাব পূরণ করা যায়। এ কাজে সহজেই বীচিকলাগাছ বিকল্প  হিসাবে ব্যবহার সুবিধা বিরাজমান।


বীচিকলা ফল-সবজি হিসেবে ব্যবহার : গ্রামগঞ্জের মানুষের বীচি কলা ফল হিসাবে আহার করার যথেষ্ট কদর আছে। অন্য কলাতে বীজ নেই, অথচ এ জাতের কলা বীজসহ খাওয়ার সুবিধার কারণে বাড়তি প্রেটিন, শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় আঁশ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রাপ্তি যোগ হয়। একই কারণে আয়ুর্বেদী মতে সুস্বাস্থ্যের জন্য দরিদ্র জনসাধারণের জন্য কম খরচে ফলের পুষ্টি প্রাপ্তিতে বীচিকলা অন্যতম অবদান রাখে।


অন্য তরকারি কলার মতো বীচিকলা রান্না করে খাবার প্রচলন অনেক অঞ্চলে রয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে বীচিকলা মাছ দিয়ে রান্না করে সবজি হিসাবে মানুষ বিচিত্র স্বাদ আহরণ করে থাকে। কাঁচা কলা পানিতে সিদ্ধ করলে সহজেই  বীজগুলো আলাদা হয়ে যায়, রান্নায় ঝামেলা হয় না। অন্য কলার মোচা থেকে বীচি কলার মোচার আকার বড় ও আহার্য অংশ বেশি। কলা সংগ্রহ শেষে কলার থোড় রান্না করে খাওয়ার প্রচলন সব এলাকাতেই আছে। এছাড়া অন্য কলার চেয়ে বীচিকলার থোড়ের আকার, পরিমাণ ও স্বাদ বেশি।


বীচিকলা চাষ সম্প্রসারণ : অন্য কলার মতো বীচিকলা বাগান আকারে জমিতে চাষ করা হয় না। রাস্তা, বাঁধ ও রেললাইনের ধারের অব্যবহৃত অংশে এ জাতের কলা চাষের সুবিধা আছে। একই কারণে বিভিন্ন জেলার ছোট বড় রাস্তা/খালের ধারে বসবাসরত ভূমিহীন পরিবার কিছু সংখ্যক বীচিকলা গাছ লাগিয়ে তা থেকে সারাবছর ধরে পরিবারের ফল-সবজির চাহিদা পূরণ করে ও তা বিক্রি করে বাড়তি আয় করে থাকে। একবার বীচিকলা গাছ লাগিয়ে ৮-১০ বছর পর্যন্ত একাধারে তা থেকে অনেকেই সুফল আহরণ করে থাকে। এসব বিবিধ গুরুত্ব বিবেচনায় এনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারাদেশে প্রদর্শনী আকারে সুবিধামতো অব্যবহৃত কমিউনিটি স্থানে বীচিকলা সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রত্যেক ব্লকে ১০ ফুট দূরত্বে কম পক্ষে ১০টা বীচিকলার চারা বিশিষ্ট একটা করে প্রদর্শনী বাগান স্থাপন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে একটা সার্কুলার জারি করেছেন।


বংশবিস্তার :  কলা গাছের সাকার বা গাছের গোড়া থেকে গজানো চারা থেকে বংশবিস্তার করা হয়। এ পদ্ধতি অঙ্গজ হওয়ায় এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারায় মাতৃ গুণাগুণ বজায় থাকে। চাষাবাদে এ পদ্ধতির প্রচলন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। গাছের গোড়া থেকে দু’ধরনের চারা বা সাকার গজাতে দেখা যায়। এক ধরনের চারা লম্বাটে ও গোড়া মোটা হয়। এ চারা সোর্ড সাকার নামে পরিচিত, এ ধরনের চারা  রোপণ উপযোগী। অন্য চারার আকার একটু ছোট, পাতা চওড়া, চারার গোড়ার অংশ চিকন হয়। এ চারা ওয়াটার সাকার নামে পরিচিত। ওয়াটার সাকার দিয়ে কোন কলা বাগান স্থাপন করা উচিত হবে না।  


চারা সংগ্রহ :  নতুন বাগান থেকে সুস্থ সবল ৩-৪ মাস বয়স্ক সোর্ড সাকার সংগ্রহ করা প্রয়োজন। চারা সংগ্রহকালে মাতৃ কলা গাছ যেন বেশি আঘাত প্রাপ্ত না হয় এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। চারা সংগ্রহ শেষে গাছের ক্ষত অংশে কপার জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে ভেজাতে হবে এবং জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটি দিয়ে গাছের গোড়া উঁচু করে মাটি চেপে শক্ত করে ঢেকে দিতে হয়। চারা আলাদা করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন তা মাটির নিচের গোড়ার অংশ শিকড়সহ থাকে। কলা সংগ্রহ শেষে গাছ গোড়া থেকে সাবধানে অপসারণ করে নিয়ে তা আধা ছায়ায় ছত্রাকনাশক স্প্রে করে শোধন করে আবর্জনা দিয়ে ২-৩ সপ্তাহ ঢেকে রাখলে তা থেকে যথেষ্ট নতুন চারা গাজাবে। সেগুলো আলাদা করে নিয়ে ১৫-২০ সেমি. দূরত্বে বীজতলায় রোপণ করে রেখে দেয়ার এক মাস পর সেগুলো উঠিয়ে বাগানে রোপণ করতে হবে। রাস্তা/বাঁধের ধারে অনেক পরিবার নিজ ব্যবস্থাপনায় কিছু সংখ্যক বীচিকলা আবাদ করতে দেখা যায়। সেখান থেকে র্৩-র্৪ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট সুস্থ-সবল লম্বাকৃতির চারা (সোর্ড সাকার) সাবধানে সংগ্রহ করে তা দিয়ে প্রদর্শনী বাগান সৃষ্টি ও তা সম্প্রসারণের ব্যবস্থা সহজেই নেয়া যায়।  


স্থান নির্বাচন ও গর্ত তৈরি : রাস্তা/বাঁধের ধারে বীচিকলা চাষের জন্য স্থান নির্বাচনে যথেষ্ট সচেতন হতে হয়। রাস্তা/বাঁধের প্রধান অংশ অবস্থান ভেদে ৩ -৮ ফুট অংশ ছেড়ে ঢালু অংশে চারা রোপণের জন্য গর্ত তৈরি করতে হয়। একেবারে কাছাকাছি রোপণ করা হলে পরে চলাচল অসুবিধা হয়, গাছ স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়তে বাধাগ্রস্ত হয়। বর্ষাকালে যে পর্যন্ত পানি উঠে সে কিনারের ওপর বরাবর চারা রোপণ করা ভালো।


চারা রোপণের জন্য দুই ফুট চওড়া ও দুই ফুট গভীর করে গর্ত তৈরি করা প্রয়োজন। এ সময় সাবধান হতে হবে যেন উঠানো মাটি নিচে গড়িয়ে না পড়ে। ঢালু অংশের ওপরের ভাগ নিম্না অংশের চেয়ে গর্তের গভীরতা বেশি হতে হবে। অর্থাৎ হাফমুন টেরাস আদলে তা করা যেতে পারে। তাতে মাটি ক্ষয়রোধ হবে, গাছের শিকড় ঠিকমতো মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া যাবে। এ জাতের কলা আবাদে সার দেয়ার তেমন প্রচলন নেই। তবে সার প্রয়োগ করা হলে ফলন অনেক গুণ বেড়ে যায়। প্রতি গর্তে যে পরিমাণ সার দেয়ার প্রয়োজন তা হলো ঃ পচা গোবর বা আবর্জনা পচা ১০ কেজি, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ৩০০ গ্রাম, জিপসাম ২০০ গ্রাম, জিঙ্ক অক্সাইড ১০ গ্রাম, বরিক এসিড ১০ গ্রাম। সমস্ত সার উর্বর মাটির (টপ সয়েল) সাথে একত্রে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে তাতে পানি সেচ দিয়ে মাদা তৈরি করার কাজ শেষ করতে হয়।


চারা রোপণ :  কলার চারা মাদার মাঝখানে ছোট গর্ত করে এমনভাবে বসাতে হবে যেন সম্পূর্ণ গোড়ার অংশসহ আরও ১০-১৫ সেমি. কাণ্ডের অংশ মাটির নিচে থাকে। চারা রোপণ করে গোড়ার মাটি চেপে দিয়ে গাছকে সোজা থাকতে সহায়তা করতে হবে। বর্ষাকাল ছাড়া সারা বছরই চারা রোপণ করা যায়। বর্ষার শেষে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস অথবা বর্ষার আগে মে-জুন মাসে কলার চারা রোপণের জন্য উপযুক্ত সময়। এ সময় কলার চারা রোপণ করলে  গাছের বৃদ্ধি বেশি ও অধিক ফলন পাওয়া যায। তবে চারা রোপণ করে চারার গোড়া ছেড়ে নিচের অংশে এক ফুট তফাতে মাটি দিয়ে হাফমুন আকারে বাঁধ দিলে ভালো হয়। তাতে মাটির ক্ষয়রোধ হবে, বৃষ্টির পানি ও উর্বর মাটি গোড়ায় জমতে সহায়ক হবে। চারা রোপণের এক মাস পর পর প্রতি চারার গোড়ার চারদিকে পচা গোবর ৫ কেজি, ইউরিয়া ১০০ গ্রাম, টিএসপি ১৫০ গ্রাম এবং এমওপি ৭০ গ্রাম হারে সার দিতে পারলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। দুইমাসের ব্যবধানে গাছের গোড়ার চারধারে এ সারগুলো প্রয়োগ করা অব্যাহত রাখতে হয়। মাটিতে রস কম থাকলে অবশ্যই প্রত্যেক বার সার প্রয়োগের পর পর পানি সেচ দিয়ে গাছের গোড়া ভালোভাবে ভেজাতে হবে।


পানি সেচ ও নিকাশ :  বর্ষা মৌসুমে কোনো অবস্থাতে যেন কলাগাছের গোড়ায় পানি জমে না থাকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। মাটিতে রসের অভাব দেখা দিলে ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে নিয়মিত সেচ দেয়া ভালো। তবে বর্ষাকালে সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না।


পরিচর্যা :  কলাগাছের গোড়া সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছের পাতা হলুদ না হওয়া পর্যন্ত কাঁচা পাতা কেটে ফেলা যাবে না। গাছের গোড়ায় নতুন চারা গজালে ২-৩টা বিভিন্ন বয়সের সুস্থ-সবল চারা রেখে অবশিষ্ট গাজানো চারা মাটি বরাবর কেটে ফেলতে হবে। অন্যথায় রোপিত কলাগাছ কম বাড়বে, ফলনও কম হবে। গাছ বড় হলে পর্যায়ক্রমে রোপিত গাছের গোড়া থেকে গজানো বিভিন্ন বয়সের ২-৩টা  করে চারাকে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এ ব্যবস্থায় প্রথম কলা সংগ্রহ শেষে   ২-৩ মাসের ব্যবধানে তাতে (মুড়ি ফসলে) নিয়মিত ফুল-ফল ধরা অব্যাহত থাকবে। কাঁদিতে ফল ধরা শেষ হওয়া মাত্র কাঁদি থেকে মোচা কেটে দিতে হবে। অন্যথায় কলার বাড়-বাড়ন্ত কম হবে। কলার মোচাগুলো সময়মতো সংগ্রহ করে সবজি হিসাবে আহার বা বিক্রি করে বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করা যায়। কলার কাঁদি বড় হলে অনেক সময় রোদের তাপে ঝলসে যেতে পারে। এ জন্য কিছু সংখ্যক ছোট ছিদ্র বিশিষ্ট রঙিন (সবুজ/নীল) পলিথিন কভার দিয়ে কাঁদি ঢেকে দিতে হয়। এ ব্যবস্থায় একই সঙ্গে কিছু পোকার হাত থেকে কলা রক্ষা পাবে এবং কলার আকার ও রঙ আকর্ষণীয় হবে।


বিভিন্ন বয়সের ২-৩টা সুস্থ সবল চারা/গাছ রেখে অবশিষ্ট চারা নিয়মিত মাটি বরাবর ছেঁটে দেয়া অথবা অন্যত্রে তা উঠিয়ে রোপণ করে এ  জাতের কলা সম্প্রসারণ ব্যবস্থা নেয়া উচিত হবে। কলা পুষ্ট হলে তা যথাসময়ে সংগ্রহ করা জরুরি। অন্যথায় পাখি/বাদুড় ও অন্যান্য পোকামাকড়ের উপদ্রব বাড়বে। কলা সংগ্রহকালে কাঁদি কেটে নেয়ার পর ফলন্ত গাছ একবারে মাটি বরাবর কেটে নেয়া ঠিক হবে না। গাছের গোড়া থেকে ৪-৫ ফুট উপরে তেরছা করে কেটে ফল সংগ্রহ করে বাকি অংশ রেখে দেয়া ভালো হয়। এ ব্যবস্থায় ফল সংগ্রহীত গাছের যেসব খাদ্য সংরক্ষিত থাকে তা মূল গাছের গোড়া থেকে গজানো কলার চারা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এতে মুড়ি চারা দ্রুত বাড়ে ও বেশি ফলন দেয়।


পোকামাকড় ও রোগ :  বীচিকলাগাছে অন্য জাতের কলার তুলনায় পোকা ও রোগের উপদ্রব কম হয়। কাজেই চাষিরা এ জাতের কলা চাষে  রোগ পোকা দমনব্যবস্থা তেমন একটা নেয় না।  কলাতে বিটল পোকা ও কা- ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ মাঝে মধ্যে দেখা যায়। ফেনভেলারেট জাতীয় কীটনাশক (প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ গ্রাম) এবং বাসুডিন/ফুরাডন দলীয় দানাদার কীটনাশক (গাছ প্রতি ১৫-২০ গ্রাম) ব্যবহারে এসব পোকা দমনে সুফল পাওয়া যায়। অন্য জাতের কলাতে গুচ্ছ মাথা রোগ (বাঞ্চিটপ), পানামা, সিগাটোকা ও অ্যানথ্রাকনোজ নামক রোগের উপদ্রব দেখা গেলেও বীচিকলাতে এ ধরনের রোগের আক্রমণ কম হয়। এসব উপদ্রব রোধে ৩-৪ বছরের ব্যবধানে ফাঁকা অংশে নতুনভাবে রোগমুক্ত চারা রোপণ ব্যবস্থা নেয়া ভালো।  


কলা সংগ্রহ :  কলা ভালোভাবে পুষ্ট হলে সময়মতো কলার কাঁদি কেটে নেয়া দরকার। খেয়াল রাখতে হবে কাঁদি যেন কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। মাটিতে মাদুর, কাগজ বা পাতা বিছিয়ে কাঁদিগুলো খাড়া করে রাখতে হয়। কলা কোনোভাবে ঘসা খেলে সে অংশে কালো দাগ পড়ে। পরিবহনকালেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন অত্যাধিক ঝাকুনিতে কলা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কলার মোচা ধরা থেকে শুরু করে  কলা পুষ্ট হতে প্রায় ৩-৪ মাস সময় লেগে যায়। প্রতি কাঁদিতে প্রচুর  (প্রায় ২০০টা) কলা ধরে। একেক কাঁদির কলার ওজন প্রায় ১৫-২০ কেজি হয়।

কম যত্নে ও কম খরচে প্রচুর পুষ্টিকর ফল সবজির উৎস বীচিকলা চাষ সম্প্রসারণ উদ্যোগ গ্রহণ করা সবারই কর্তব্য।

 

এম. এনামুল হক*

*মহাপরিচালক (অব.), ডিএই এবং বিশেষজ্ঞপুল (APA) সদস্য, কৃষি মন্ত্রণালয়

বিস্তারিত
রঙধনু চার্টের পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তা

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী এক সীমাহীন দায়বদ্ধতা চলছে। ৬ বিলিয়নের বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত পৃথিবীতে অনাহারি মানুষের সংখ্যাই বেশি। আর বাংলাদেশের অবস্থা বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে অনেকভাবে তুলনীয়। এদের প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রয়োজন বলে আমরা খাদ্য উৎপাদন বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলছি অহরহ। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না নিরাপদ খাদ্য ব্যতিরেকে খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তুললে তা আরো বিপদ হয়ে যাবে। সুতরাং  খাদ্য নিরাপত্তার সাথে নিরাপদ খাদ্যের কথা ভাবতে হবে একান্তভাবে। গত বছরে প্রথমবারের মতো আলুর উৎপাদন ১০২ কোটি ১৫ লাখ টন হয়েছে। আগের বছরে আলুর উৎপাদন ছিল ৯৪ লাখ ৭৪ হাজার টন। ১ বছরে বেড়েছে ৭ লাখ ৪১ হাজার টন। অন্যান্য সবজি উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৩ লাখ মেট্রিক টন। এক বছরে সবজি উৎপাদন ১০ লাখ ৪৪ হাজার টন বা ৮ শতাংশ বেড়েছে (বিবিএস)। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। এফএওর হিসাব মতে, গত ৪৫ বছরে সবজি উৎপাদন বেড়েছ ৫ গুণ হারে। গত অর্থ বছরের সবজি রফতানি হয়েছে ৮৩৪ কোটি টাকার। কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে ৫ শতাংশ। ধানের বিকল্প হিসেবে সবজির আবাদ এ কারণে বেড়েছে।


বাংলাদেশের সবজি বিশ্বের ৫০টি দেশে রফতানি হয়। মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, সিঙ্গাপুর, ওমান এসব দেশে রফতানি হচ্ছে। রফতানিকৃত সবজির মধ্যে আছে আলু, বরবটি, চিচিঙ্গা, করলা, লালশাক, পুঁইশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালংশাক, টমেটো, পেঁপে, বেগুন, ঢেঁড়স, লাউ, কচুরলতি, মিষ্টিকুমড়া, শিমের বিচি, কাচকলা, কলারফুল, কচুশাক, কাঁঠালের বিঁচি, পটোল, ডাঁটাশাক এসব। গত ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে সবজি রফতানি করে আয় হয়েছিল ১৪ কোটি ৭৫ লাখ মার্কিন ডলার। ১৯৯১ সালে আগে বিশ্বের ২০টি দেশে আলু রফতানি হতো। বর্তমানে ২৭টি দেশে আলু রফতানি হয়। আমাদের বার্ষিক আলুর চাহিদা ৭০ লাখ মেট্রিক টন। সুতরাং প্রতি বছর আমরা অন্তত ৩০ লাখ মেট্রিক টন আলু রফতানি করতে পারি। আমাদের দেশে ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক সবজি উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট। জৈবকৃষি দিয়ে পরিবেশবান্ধব বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের ট্রেন্ড আস্তে আস্তে বাড়ছে। সবজি চাষের আওতায় জমি কমলেও আমাদের সবজি উৎপাদন ও ফলন বাড়ছে। বছরে একই জমিতে চারবার সবজি চাষ হচ্ছে। তবে সব বিষয় শেষে আমাদের সতর্কতার সাথে বিবেচনায় রাখতে হবে মানসম্মত গুণগত সবজি উৎপাদন। কেননা এখনও ৩০ শতাংশ সবজি অপচয় হচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে কৃষকের দিকে আরো বেশি নজর দিতে হবে।


হতাশার মাঝেও আলোর ঝিলিক আমাদের হাতছানি দেয়। এ সোনার দেশে কতো হাজারো বিজয়ী ইতিহাস আর ঐতিহ্যবাহী সম্পদ আমাদের হাতছানি দেয়, জমা আছে আমাদের গর্বিত ভা-ারে তার মূল্য জানিনা বলে সেগুলো কদর পায়না। খাদ্যের কথাই বলি, ভালো খাদ্য বলতে আমরা সাধারণত দামি বিদেশি খাবারকেই বুঝি। অথচ আমাদেরও আছে অনেক মূল্যবান ঐতিহ্যবাহী দেশীয় খাবার-দাবার। একটু পুষ্টিসচেতন হলেই আমরা পুষ্টি ও খাদ্যভিত্তিক সম্ভাবনাকে অনেকটুকু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। নিরাপদ খাদ্য দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।  


খাদ্য গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হলো সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা। যে কোনো খাবার খেলে পেট ভরে যায় মনের চাহিদা মেটে, একথা ঠিক। কিন্তু তাতে দেহের চাহিদা কোনো ভাবেই মিটিয়ে সুস্থ থাকা যায় না। সে জন্য প্রকৃত বা পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার সম্পর্কে আমাদের সবার পরিষ্কার জ্ঞান ও ধারণা থাকা দরকার। আমাদের দেশে এখন আর খাদ্য ঘাটতি নেই। তবে পুষ্টি সমস্যা এখনও আছে। আর পুষ্টিঘাটতির চেয়ে পুষ্টি জ্ঞান সমস্যা আরো ব্যাপক। এদেশের অনেকেই হয়তো পুষ্টি সমস্যায় ভুগছে। আশ্চর্যের কথা হলো কেউ ভুগছে অপুষ্টিতে পুষ্টি সম্মত খাবার না খেয়ে; আবার কেউ ভুগছে অতিপুষ্টিতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাবার খেয়ে। পুষ্টিহীনতার কারণে অনেকে অহরহ অসুস্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের গর্ভবতী মা, দুগ্ধদানকারী মা ও শিশুরাই এর বেশি শিকার। এদের ঘাটতি পূরণে দানাদার খাদ্যকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। অথচ এ ধরনের খাবার ছাড়া শাকসবজি, ফলমূল খাবারের যে বেশি ঘাটতি সেটা আমরা বুঝি না। বিশেষ করে শাকসবজি, ফলমূলে যে পুষ্টির আধার এটা আমরা অনেকেই বিশ্বাস করতে চাই না। পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে সুষম খাদ্য গ্রহণের প্রতি আমরা মোটেই সচেতন না। এ সব কারণে পুষ্টিশিক্ষা জ্ঞান আর প্রচারণার দরকার অনেক বেশি।


আমরাতো জানি নানা উপাদান দিয়ে গঠিত আমাদের শরীর। সুতরাং শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে নিয়মিত এবং পরিমিত উপযুক্ত খাবার আমাদের খেতে হবে। আমাদের জানতে হবে সব মানুষের খাবার একরকম না। পরিশ্রমী মানুষ, দুগ্ধপোষ্য মা, গর্ভবতী নারী, শিশু, বাড়ন্ত বয়স ছেলে মেয়ে, বয়স্ক সবার জন্য আলাদা হিসাব করে খাওয়া দিতে হবে। তবেই পুষ্টিসমৃদ্ধ জীবন যাপন করতে পারবে সবাই। যেমন গর্ভবতী, দুধপ্রদানকারী মা, শিশু, বাড়ন্ত ছেলে মেয়েদের জন্য আমিষ, ভিটামিন আর খনিজ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার বেশি দরকার। আবার যারা পরিশ্রমী তাদের শ্বেতসার  ও স্নেহজাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে। সহজে হজম হয় এমন খাবার বয়স্কদের জন্য বেশি দরকার। কিন্তু আমিষ ও স্নেহ জাতীয় পদার্থ খাবার বয়স্কদের বেশি দেয়া যাবে না। বরং যতকম দেয়া যায় তত ভালো। সুতরাং সব বয়সীদের খাদ্য নির্বাচনে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। আরেকটি কথা সমপুষ্টি পেতে দামি খাবারের চেয়ে কমদামি খাবার নির্বাচনও যে যুক্তিযুক্ত আমরা কিন্তু তা ভাবি না। এ ব্যাপারে আগ্রহী এবং অভিজ্ঞ হলে আমাদের জাতীয় লাভ বেশি হবে।


পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলেন দেহের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধিসাধন এবং দেহকে সুস্থ সবল ও নিরোগ রাখার জন্য নানাবিধ শাকসবজি ফলমূল খাওয়া অতি প্রয়োজনীয়। এগুলো ছাড়া সুষম খাবারের কথা চিন্তাও করা যায় না। খাদ্য বিজ্ঞানীদের মতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন প্রায় ২৫০ গ্রাম  শাকসবজি খাওয়ার প্রয়োজন। আর আমরা খেতে পারছি মাত্র ৫০-৬০ গ্রাম। ফল খাওয়া দরকার ১৪০ গ্রাম। আমরা খেতে পারছি মাত্র ৪০-৪৫ গ্রাম। তাহলে প্রাপ্তি আর সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান অনেক। এত ব্যবধানে সুস্থ সবল থাকার কোনো উপায় নেই। আমরা জানি, আমাদের শরীরকে সুস্থ সবল রাখার জন্য ৬টি খাদ্য উপাদান ঠিকমতো খাওয়া। এ ৬টি উপাদান হলো প্রোটিন বা আমিষ, শর্করা বা শ্বেতসার, স্নেহ বা চর্বি, ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ, মিনারেল বা খনিজ এবং পানি। পানি আর শ্বেতসার নিয়ে এখন আর কথা বলার নেই। কেননা এ দুটি পুষ্টি উপাদান আমাদের পর্যাপ্ততা আছে। তবে পানির ক্ষেত্রে পানির অপর নাম জীবন একথা না বিশ্বাস করে নিরাপদ পানির অপর নাম জীবন এটিকে বেদবাক্য মেনে পানি খাওয়া দরকার সচেতনভাবে। মোটামুটিভাবে তেলও আমরা ইদানীং গ্রহণ করছি প্রয়োজনের খুব কাছাকাছি। বেশি জোর দিতে হবে আমিষ, ভিটামিন আর খনিজ উপাদানের ওপর। এগুলোর মূল উৎস শাকসবজি ও ফলমূল।


এবার সংক্ষেপে জেনে নিই শাকসবজি ফলমূলভিত্তিক কোন কোন উপকরণে কোন কোন পুষ্টি উপাদান আছে। আমিষের যোগানের জন্য মাছ, মাংস, ডিম, দুধের সাথে সব ধরনের ডাল, শিম, মটরশুটি, বরবটি খেতে পারি, শ্বেতসার বা শর্করার উৎস হিসেবে ভাত রুটির সাথে আলু, মিষ্টিআলু, শাকআলু, কচু, মূলজাতীয় সবজি, আম, কাঁঠাল, পেঁপে খেতে হবে। স্নেহজাতীয় পুষ্টির জোগানে নারিকেল, তেলজাতীয় ফসল, কাজুবাদাম, চিনাবাদাম, জলপাই, কাঁকরোল, সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখী খেতে হবে। ক্যালসিয়ামের জন্য সব ধরনের শাকসবজি, কাচা পাকা কলা, জাম, লৌহের জন্য গুড়, শাকসবজি, তেঁতুল, তরমুজ, কলা এবং আয়রনের জন্য আনারস, বিভিন্ন শাকপাতা, আর বিভিন্ন ধরনের ভিটামিনের জন্য সব ধরনের রঙিন শাকসবজি, সব ধরনের ফল খেতে হবে।


পুষ্টিবিদরা বলেন প্রতিদিন যদি একজন মানুষ ৫ রঙের চার্ট অনুসরণ করে প্রতিদিনের খাবার খান তাহলে তার পুষ্টির কোনো অভাব হবে না। বিশ্ব পুষ্টি সমাধানের সাথে আমরাও আমাদের পুষ্টি নিয়ে ভাবছি এটা ঠিক। আমরাও পিছিয়ে নেই সেখান থেকে। পুষ্টির এ সমস্যা সমাধানে নতুন ধারণা সৃষ্টি করেছেন পুষ্টিবিদরা। তারা নাম দিয়েছেন ফাইভ কালারস এ ডে অর্থাৎ দিনে ৫ রঙের খাবার। আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে আমরা নাম দিতে পারি রঙধনু খাবার। ব্যাপারটি হলো যে কোনভাবে প্রতিদিনের খাবারে এ ৫ রঙের খাবার থাকতেই হবে। তবেই কেবল আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেয়ে যাবো অনায়াসে। ৫টি রঙ হলো লাল, হলুদ, সাদা, সবুজ এবং কালো। লাল রঙের খাবারের উৎস হলো লালশাক, বিট, টমেটো, ডালিম, তরমুজ, লাল ক্যাপসিকাম, মুশুর ডাল। হলুদ রঙের যোগানদাতা হলো গাজর, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টিকুমড়ার ফুল, পেঁপে, আম, কাঁঠাল, বেল, তাল, আনারস, কলা, কমলা, ডেউয়া, লটকন, বাঙ্গি, মুগ, মাশডাল, হলুদ ক্যাপসিকাম। সাদা রঙের মধ্যে আছে মাশরুম, ফুলকপি, মুলা, আলু, বেগুন, কচু, শালগম, ওলকপি, কুল, লিচু, পেয়ারা, নারকেল, শরিফা, আতা, জামরুল আমলকী, কামরাঙা। সবুজ রঙের খাদ্য আসবে বাঁধাকপি, সবুজ ফুলকপি, শিম, বরবটি, মটরশুটি, ঢেড়স, লাউ, সবুজ ক্যাপসিকাম, পুঁইশাক, পালংশাক, ধনিয়া, পুদিনা, চাল কুমড়া, কলমিশাকসহ অন্যান্য সবুজশাক থেকে। কালো রঙের যোগানদাতা খাদ্য হলো কালোজাম, কালো আঙুর, কালো পাতাকপি, কালো বেগুন। এভাবে পরিকল্পনা করে বেড়ে ওঠা শিশুসহ সবার জন্য খাদ্য তালিকা তৈরি করে প্রাপ্তি জোগান নিশ্চিত করে খাওয়াতে পারলে আমরা আমাদের দৈনিক জীবনে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেয়ে যাবো অনায়াসে, কমদামে, কাক্সিক্ষত বলয়ে। এ সহজ, সরল ব্যাপারটি মনে রেখে প্রতিদিনের খাবার খেলে খাবারভিত্তিক পুষ্টির দৈন্যতা আমাদের আর থাকবে না। আর রঙধনু কিংবা ফাইভ কালারস এ ডে ব্যাপারটি দারুণভাবে জনপ্রিয় করার সুযোগ আছে সবার মাঝে। বয়স, শ্রম, চাহিদা, অবস্থা অনুযায়ী খাবার নিশ্চিত করতে পারলে পুষ্টিগত লাভ বেশি হবে। সুতরাং আসুন না আমরা পুষ্টি অভিজ্ঞতা বাস্তবায়ন করি আমাদের পরিবারে বাস্তবায়নের এবং বিস্তৃতির মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালাই অন্য সবার পরিবারে, সার্বিকভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য। আরেকটি কথা এ রঙধনু চার্ট বা তালিকার কথা বেতারে, টেলিভিশনে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিসে, রাস্তায়, সিনেমায়, যানবাহনে, স্টেশনের, পত্রিকায়, প্রচারণায়, সব জায়গায় নিয়মিত এবং পরিমিত কৌশলে আবশ্যকীয়ভাবে উপস্থাপন করতে হবে এক সাথে। তবেই কার্যকারিতা বা ফলাফল আসবে কাক্সিক্ষত পরিসীমায়। মনে রাখতে হবে, সুস্থ নাগরিক মানে সুস্থ দেশ। আমাদের করণীয় হলো-


আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির আঙিনায় যেটুকু খালি, পতিত জায়গা আছে তা যথাযথভাবে পরিকল্পনা আর ব্যবস্থাপনার মাধ্যম প্রয়োজনীয় ফলমূল, শাকসবজির বাগান গড়ে তোলা এবং প্রয়োজন আর চাহিদা অনুযায়ী খাওয়া;
 যে কোনোভাবেই হোক প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ তাজা সতেজ বিষমুক্ত শাকসবজি ফলমূল খাওয়া;
বাজার থেকে যাচাই বাছাই করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিশেষ করে শাকসবজি ফল মূল কেনা;
তরিতরকারি কাটার সময় বাকল বা চামড়া না ফেলা, ফল খাওয়ার সময় যথাসম্ভব চামড়া না ফেলা, তবে ভালোভাবে পরিস্কার করে খাওয়া; রান্নার সাথে কালিজিরা, রসুন, পেঁয়াজ, মৌরি, ধনিয়া অনুপাত অনুসারে যোগ করা;
প্রতিদিন নিয়মিত ও পরিমিত পরিমাণ শাকসবজি পুষ্টি বুঝে খাওয়া;
প্রতিদিন কমপক্ষে ১/২টি করে দেশীয় ফল খাওয়া তা যে ওজনের, মাপের বা আকারের হোক না কেন;
পরিমাণ মতো পরিমিত খাওয়া অর্থাৎ শিডিউল করে পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের চাহিদা প্রয়োজন অনুযায়ী খাওয়া;
ফলমূল শাকসবজি কাটার আগে ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া; কাটার পরে কখনো না ধোয়া;
অনেকে বিভিন্ন কিছু রান্নার সময় সিদ্ধ করা পানি ফেলে তারপর তরকারি রান্না করেন এটি মোটেও ঠিক না;
যত বড় করে কাটা যায় তত বেশি ভালো;
রান্না করার সময় যত কম পানি ব্যবহার করা যায়  সেদিকে লক্ষ্য রাখা;
কম জ্বালে আস্তে আস্তে রান্না করা; যথাসম্ভব কম মশলা ব্যবহার করা;
রান্না করার সময় পাতিলের ঢাকনা দিয়ে রান্না করা;
রান্নার পর গরম গরম সতেজ খাওয়া; চর্বি জাতীয় রান্নায় ঢাকনা খুলে রান্না করা;
মিশ্ররান্না শরীরের জন্য, পুষ্টির জন্য বেশি লাভজনক, সুতরাং পারতোপক্ষে বিভিন্ন ব্যঞ্জনের সমন্বয়ে তরকারি রান্না। বেশি ভালো হয় যদি শাকসবজি রান্নার সময় কিছু পরিমাণ মুগ, খেসারি, মুশুর ডালের সাথে রান্না করা যায়;
ভাতের মাড় না ফেলে মাড়সহ ভাত রান্না করা;


ইদানীং কৃষি গবেষণা, উদ্ভাবন এবং কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনার কারণে বাজারে সময়ে অসময়ের শাকসবজি ফলমূল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। দাম যদিও আকাশচুম্বি। কিন্তু আমরা জানি না কি কিনছি আমরা বা কি কিনে খাচ্ছি? হয়তো এসব শাকসবজি, ফলমূলের মধ্যে রয়েছে মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান। যার কারণে আমাদের শারীরিক মানসিক, মানবিক বিভিন্ন বিপর্যয় ডেকে আনে অনায়াসে। আমাদের শ্রমের ঘামের বিনিময়ে কেনা এসব আবশ্যকীয় উপাদান। সেজন্য পারতপক্ষে নিজেরা যদি যে কোনো পরিসরেই হোক না কেন একচিলতে জমিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদামাফিক শাকসবজি উৎপাদন করা যায় তাহলে তো কথাই নেই। জমি ছাড়াও ছাদে বাগান, বাড়ির আঙিনায়, বারান্দায়, টবে, ড্রামে, কৌটায়, বস্তায় কোথায় না করা যায়!  শুধু প্রয়োজন ইচ্ছা শক্তিটাকে জাগিয়ে তোলা আর সে প্রেক্ষিতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করা। আমাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য চিন্তা ভাবনা ছাড়াই আমাদের দেশীয় শাকসবজি ফলমূলের ওপর একান্তভাবে নির্ভর করতে পারি। শুধু প্রয়োজন পরিকল্পনা, সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। একটি সুস্থ, সবল, সতেজ নির্ভেজাল জীবন আমাদের সকলের কাম্য। সে প্রত্যাশায় ফলমূল, শাকসবজি ও ফলমূলভিত্তিক ব্যবস্থাপনা আমরা নিশ্চিত করবো এবং অনুসরণ করবো এ হোক আমাদের অঙ্গীকার। আর পুষ্টিসমৃদ্ধ বিষমুক্ত প্রয়োজনীয় খাবার উৎপাদনের সাথে খাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারলে আমরা গর্বের সাথে বলতে পারবো পুষ্টিসম্মত খাবার খেয়ে নিরাপদ খাদ্য দিয়ে আমরা গড়বো আমাদের কাক্সিক্ষত খাদ্য নিরাপত্তা বলয়। তখন সুখে থাকবে বাংলার মানুষ, সুখে থাকবে বাংলাদেশ।

 

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
*অতিরিক্ত পরিচালক, ক্রপস উই, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা; subornoml@yahoo.com

বিস্তারিত
শাকআলুর সাতকাহন

শাকআলু এক প্রকার মূলজাতীয় সবজি। ইংরেজিতে এ সবজিকে Goitenyo, Goiteno, nupe, jacatupe বা Amazonian yam bean বলা হয়। শাকআলুর বৈজ্ঞানিক নাম pachyrhizus tuberosus যা ‘Fabaceae’ পরিবারভুক্ত। শাকআলুর পাঁচটি প্রজাতি আছে। এর মধ্যে Pachyrhizus tuberosus প্রজাতিটির শাকআলু বাংলাদেশে প্রচলিত। আলুর মতো গড়ন হলেও শাকআলু একদিকে ফলের মতো কাঁচা খাওয়া হয়, অন্যদিকে সবজির মতো রান্না করে খাওয়া হয়। তাই বিশেষজ্ঞরা একে সবজি ফসলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।


শাকআলুর উৎপত্তি মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকা। সেখান থেকে ধীরে ধীরে চীন, ফিলিপিন, ভারতবর্ষ প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে শাকআলুর চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, যশোর প্রভৃতি জেলায় শাকআলুর চাষ করা হয়।

শাকআলু চিরহরিৎ লতাজাতীয় শিম গোত্রীয় ফসল। এর লতা পাঁচ থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এটি অন্য কোন গাছকে অবলম্বন করে বেড়ে ওঠে। শিম গাছের মতোই পাতা ও লতা হয়। শিমের চেয়ে পাতা বড় ও পুরু। পাতা লম্বার চেয়ে চওড়া বেশি হয়। শিমের মতোই লম্বা ছড়ায় ফুল ফোটে। ছড়া ৪৫ সেমি. পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ফুলের রঙ নীলচে বা হালকা নীল ও সাদাটে। ফলও শুঁটির মতো, চ্যাপ্টা ও পশমযুক্ত। প্রতিটি শুঁটি বা ফলে ৮ থেকে ১০টি বীজ থাকে। পাকা বীজের রঙ হালকা বাদামি। বীজ থেকে গাছ হয়। পোকামাকড়ের মাধ্যমে এর পরাগায়ন ঘটে। এটি মাটিতে নাইট্রোজেন সংবন্ধন ঘটায়। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বীজ বপন করে নভেম্বের-মে মাসের মধ্যে আলু তোলা যায়। গাছের গোড়ায় মাটির নিচে নাশপতি বা শালগমের মতো আলু হয়। একটি গাছে দুই বা ততোধিক আলু হয়। সাধারণত প্রতিটি আলু ১৫ থেকে ২৫ সেমি.  লম্বা হয়। এ আলুর খোসা কাগজের মতো ও হালকা বাদামি বা হলদে। ভেতরের শাঁস কচকচে ও সাদা। অত্যন্ত রসালো ও মিষ্টি। এর খোসা ছাড়ানো খুবই সহজ। খোসা হাত দিয়ে টান দিলে সহজে উঠে আসে। খোসা ছাড়িয়ে এটি কাঁচা খাওয়া হয়। এ আলুর গায়ে হাত দিলে ঠা-া অনুভূত হয় বলেই পাহাড়িরা একে ঠাণ্ডা আলু বলে থাকেন। এ আলু কাঁচা চিবিয়ে খাওয়ার সময় প্রচুর পানি বের হয়। এজন্য কেউ কেউ শাকআলুকে জলপান আলু বলে থাকেন।


শাকআলু পুষ্টিকর ও সুমিষ্ট সবজি। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম শাকআলুতে ৮০.২৫ গ্রাম পানি, ০.৫ গ্রাম খনিজ লবণ, ১.৬ গ্রাম আমিষ, ০.১ গ্রাম চর্বি, ১৭ গ্রাম শর্করা, ০.৬ গ্রাম আঁশ, ১১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং কিছু পরিমাণ ভিটামিন এ, বি ও সি রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা শাকআলুতে ২.১ থেকে ১০.৭ গ্রাম স্টার্চ থাকে। শাকআলু গাছে যে শিম হয় তা ৩২% আমিষ সমৃদ্ধ। শিমও খাওয়া যায়। এর পাতায় ২০-২৪% আমিষ থাকে এবং এ পাতা খাওয়া যায়। তাছাড়া এতে ৭৫ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি থাকে। আমাদের দেহের পুষ্টি সাধনে এসব পুষ্টি উপাদানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।


প্রধানত শাকআলু কাঁচা খাওয়া হয়। তবে কোনো কোনো দেশে এটি টুকরা টুকরা করে কেটে লবণ, লেবুর রস ও মরিচের গুঁড়া মাখিয়ে সুস্বাদু করে খাওয়া হয়। এটি রান্না করেও খাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে শাকআলু সবজি ও সালাদ হিসেবে খাওয়া হয়। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় সালাদ তৈরিতে এ আলুর যথেষ্ট কদর রয়েছে। তবে শাকআলু কাঁচা অবস্থায় খাওয়াই উত্তম। এতে ভিটামিন বা খাদ্যমানের অপচয় হয় না।


বাংলাদেশে শাকআলু একটি অপ্রচলিত সবজি। অথচ এটি একটি লাভজনক ফসল। এর উৎপাদন খরচ খুব কম। বীজ বপনের ৭-৮ মাস পর থেকে শাকআলু সংগ্রহ করা যায়। প্রতি হেক্টর জমিতে ১৫-২০ টন শাকআলু উৎপন্ন হয়। সাতক্ষীরা, যশোর ও খুলনা জেলার হাটবাজার ছাড়া ফুটপাতেও শাকআলু বিক্রি করতে দেখা যায়। প্রতি কেজি শাকআলু স্থানভেদে ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে কৃষকেরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।


সুতরাং দেহের পুষ্টিসাধন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গ্রামীণ দারিদ্র্যবিমোচনে শাকআলুর আবাদ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।

 

মো. আবদুুর রহমান*

*উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা

 

বিস্তারিত
লাভজনকভাবে কোয়েল পালন

পোলট্রিতে এগারটি প্রজাতি রয়েছে, তন্মধ্যে কোয়েল একটি ছোট আকারের গৃহপালিত পাখি। অন্যান্য পোলট্রির তুলনায় কোয়েলের মাংস এবং ডিম গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট। আনুপাতিক হারে কোয়েলের ডিমে কোলেস্টেরল কম এবং আমিষ বেশি। একটি মুরগির পরিবর্তে ৮টি কোয়েল পালন করা সম্ভব। কাজেই বাড়ির আঙিনায় ঘরের কোণে ১০-২০টা কোয়েল অতি সহজেই পালন করা যায়। কোয়েল পাখি প্রতিপালন করে পারিবারিক পুষ্টি জোগানের সাথে সাথে অতিরিক্ত কিছু আয় করা সম্ভব। স্বল্প মূল্যে, অল্প জায়গায়, অল্প খাদ্যে কোয়েল পালন করা যায়।


কোয়েল পালনের সুবিধা
- কোয়েল দ্রুত বাড়ে, ৬-৭ সপ্তাহে ডিমপাড়া শুরু করে এবং বছরে ২৫০-২৬০ টি ডিম পাড়ে;
-ডিমে কোলেস্টেরল কম এবং প্রোটিনের ভাগ বেশি;
-কোয়েলের দৈহিক ওজনের তুলনায় ডিমের শতকরা ওজন বেশি;
-৮-১০টা কোয়েল একটি মুরগির জায়গায় পালন করা যায় এবং ১৭-১৮ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়;
-রোগবালাই খুব কম এবং খাবার খুবই কম লাগে;
-বাংলাদেশের আবহাওয়া কোয়েল পালনের উপযোগী;
-অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে অল্প দিনে বেশি লাভ করা যায়।


কোয়েলের জাত
পৃথিবীতে বর্তমানে ১৭-১৮ জাতের কোয়েল আছে। অন্যান্য পোলট্রির মতো কোয়েলের মাংস এবং ডিম উৎপাদনের জন্য পৃথক পৃথক জাত আছে। পৃথিবীতে কোয়েলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে ‘জাপানিজ কোয়েল’ অন্যতম। উল্লেখ্য বিভিন্ন জাতের কোয়েলের প্রকৃত উৎস জাপানিজ কোয়েল।


প্রজনন
শুধুমাত্র ডিম ফুটাতে চাইলে স্ত্রী এবং পুরুষ কোয়েল একত্রে রাখার প্রয়োজন। স্ত্রী কোয়েল প্রতিপালন অধিক লাভজনক। আশানুরূপ ডিমের উর্বরতা পেতে হলে ৩টি স্ত্রী কোয়েলের সাথে ১টি পুরুষ কোয়েল দেয়ার ৪ (চার) দিন পর থেকে বাচ্চা ফুটানোর জন্য ডিম সংগ্রহ করা উচিৎ। স্ত্রী কোয়েল থেকে পুরুষ কোয়েল আলাদা করার পর তৃতীয় দিন পর্যন্ত ফুটানোর ডিম সংগ্রহ করা যায়। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় কোয়েল ৬-৭ সপ্তাহ বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে এবং ৮-১২ মাস পর্যন্ত ডিম পাড়া অপরিবর্তিত থাকে। উপযুক্ত পরিবেশে প্রথম বছর গড়ে ২৫০-৩০০টি ডিম পাড়ে। দ্বিতীয় বছরের ডিমের উৎপাদন প্রথম বছরের উৎপাদনের শতকরা ৪৮ ভাগ। কোয়েল ডিমের উর্বরতা শতকরা ৮২-৮৭ ভাগ। ডিমপাড়া শুরুর প্রথম দুই সপ্তাহের ডিম ফুটাতে বসানো উচিত নয়। কোয়েলের ডিমের গড় ওজন ১০-১২ গ্রাম।


কোয়েলের বাচ্চার ব্রুডিং এবং যত্ন
সদ্য ফুটন্ত কোয়েলের বাচ্চা খুবই ছোট থাকে, ওজন মাত্র ৫-৭ গ্রাম। এ সময় যে কোনো রকম ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার প্রভাব স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি, ডিম উৎপাদন এবং বেঁচে থাকার ওপর পড়ে। এঅবস্থায় খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান এবং কাম্য তাপমাত্রা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বজায় রাখতে হবে। বাচ্চাকে ব্রুডিং বা তাপ দেয়া খাঁচায় এবং লিটারে করা যায়।


বাচ্চার বয়স তাপমাত্রা। প্রথম সপ্তাহ ৩৫০ সেন্টিগ্রেড (৯৫ ডিগ্রি  ফারেনহাইট) তৃতীয় সপ্তাহ ২৯.৫০ সেন্টিগ্রেড (৮৫ ডিগ্রি  ফারেনহাইট)। দ্বিতীয় সপ্তাহ ৩২.২০ সেন্টিগ্রেড (৯০ ডিগ্রি  ফারেনহাইট) চতুর্থ সপ্তাহ ২৭.৬০ সে. (৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। ইনকুবেটরে বাচ্চা ফুটার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্রুডিং ঘরে এনে প্রথমে গ্লুকোজ এবং এমবাভিট ডলিউ এস পানির সাথে মিশিয়ে পরপর তিনদিন খেতে দেয়া ভালো এবং পরে খাদ্য দিতে হবে। প্রথম সপ্তাহ খবরের কাগজ বিছিয়ে তার ওপর খাবার ছিটিয়ে দিতে হবে এবং প্রতিদিন খবরের কাগজ পরিবর্তন করতে হবে। এক সপ্তাহ পর ছোট খাবার পাত্র বা ফ্লাট ট্রে ব্যবহার করতে হবে। পানির পাত্রে বাচ্চা যাতে পড়ে না যায় সে জন্য মার্বেল অথবা কয়েক টুকরা পাথর খ- পানির পাত্রে রাখতে হবে। সর্বদাই পরিষ্কার পরিচছন্ন পানি সরবরাহ করতে হবে।


বাসস্থান
বাণিজ্যিকভাবে কোয়েল পালনের জন্য লিটার পদ্ধতির চেয়ে কেইজে পালন অধিক লাভজনক। বাচ্চা অবস্থায় প্রতিটি কোয়েলের জন্য খাঁচায় ৭৫ বর্গ সেন্টিমিটার এবং মেঝেতে ১০০ বর্গ সেন্টিমিটার জায়গায় দরকার। অন্যদিকে বয়স্ক কোয়েলের বেলায় খাঁচায় প্রতিটির জন্য ১৫০ বর্গ সেন্টিমিটার এবং মেঝেতে ২৫০ বর্গ সেন্টিমিটার জায়গা প্রয়োজন। কোয়েলের ঘরে পর্যাপ্ত আলো  বাতাসের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাপমাত্রা ৫০-৭০ ডিগ্রি  ফারেনহাইট হওয়া ভালো। স্ত্রী কোয়েল এবং পুরুষ কোয়েল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৃথক পথৃকভাবে রাখতে হবে।

 

খাঁচায় কোয়েল পালন
খাঁচায় ৫০টি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ১২০ সেমি. দৈর্ঘ্য, ৬০ সেমি. প্রস্থ এবং ৩০ সেমি. উচ্চতা বিশিষ্ট একটি খাঁচার প্রয়োজন। খাঁচার মেঝের জালিটি হবে ১৬-১৮ গেজি ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত বাচ্চার খাচার মেঝের জালের ফাঁক হবে ৩ী৩ মিলিমিটার এবং বয়স্ক কোয়েলের খাঁচায় মেঝের জালের ফাঁক হবে ৫ী৫ মিলিমিটার। খাঁচার দুই পার্শ্বে একদিকে খাবার পাত্র অন্যদিকে পানির পাত্র সংযুক্ত করে দিতে হবে। খাঁচায় ৫০টি কোয়েলের জন্য তিন সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ২৫ সেন্টিমিটার বা ১০ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট ২৮ বর্গ সেন্টিমিটার বা ৩ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন।

 

খাদ্য ব্যবস্থাপনা
বাচ্চা, বাড়ন্ত অথবা প্রজনন কাজে ব্যবহৃত কোয়েলের জন্য স্ট্যান্ডার্ড রেশন বাজারে সহজলভ্য নয়। কোয়েলের রেশনকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। স্টার্টার, বাড়ন্ত, এবং লেয়ার বা ব্রিডার। ডিম পাড়া কোয়েলের প্রতি কেজি খাবারে ২.৫-৩.০% ক্যালসিয়াম থাকতে হবে। ডিমের উৎপাদন ধরে রাখার জন্য গরমের সময় ৩.৫% ক্যালসিয়াম প্রয়োজন।

 

খাবার পাত্র
বাচ্চা অবস্থায় ফ্লাট ট্রে বা ছোট খাবার পাত্র দিতে হবে যেন খাবার খেতে কোনো রকম অসুবিধা না হয়। স্বাভাবিকভাবে প্রতি ২৮টি বাচ্চার জন্য একটি খাবার পাত্র (যার দৈর্ঘ্য ৫০ সেন্টিমিটার, প্রস্থ’ ৮ সেন্টিমিটার এবং উচ্চতা ৩ সেন্টিমিটার) এবং প্রতি ৩৪ টি বয়স্ক কোয়েলের জন্য একটি খাবার পাত্র (যার দৈর্ঘ্য ৫৭ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ১০ সেন্টিমিটার এবং উচ্চতা ৪ সেন্টিমিটার) ব্যবহার করা যেতে পারে। সকালে এবং বিকালে খাবার পাত্র ভালো করে পরিষ্কার সাপেক্ষে মাথাপিছু দৈনিক ২০-২৫ গ্রাম খাবার দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, প্রথম সপ্তাহ থেকে ৫ গ্রাম দিয়ে শুরু করে প্রতি সপ্তাহে ৫ গ্রাম করে বাড়িয়ে ২০-২৫ গ্রাম পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। প্রতিটি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ১.২৫-২.৫ সেন্টিমিটার (১/২ থেকে ১ ইঞ্চি) খাবার পাত্রের জায়গা দিতে হবে।

 

পানির পাত্র
সর্বদাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পানি সরবরাহ করতে হবে। প্রতিটি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ০.৬ সেন্টিমিটার (১/৪ ইঞ্চি) পানির পাত্রের জায়গা দিতে হবে। অটোমেটিক বা স্বাভাবিক যে কোনো রকম পানির পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতি ৫০টা কোয়েলের জন্য একটি পানির পাত্র দেয়া উচিত। নিপল ড্রিংকার বা কাপ ড্রিংকার ও ব্যবহার করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি ৫টি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ১টি নিপল বা কাপ ড্রিংকারও ব্যবহার করা যেতে পারে।

 

লিটার ব্যবস্থাপনা
তুষ, বালি, ছাই, কাঠের গুড়া প্রভৃতি দ্রব্যাদি কোয়েলের লিটার হিসাবে মেঝেতে ব্যবহার করা যায়। অবস্থাভেদে লিটার পরিবর্তন আবশ্যক যেন কোনো রকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি না হয়। মেঝেতে ডিপ লিটার পদ্ধতি অবলম্বন করা ভালো। প্রথমেই ৫-৬ ইঞ্চি পুরু তুষ বিছিয়ে দিতে হবে এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যেন লিটার ভিজা না হয়। স্বাভাবিকভাবে শীতকালে লিটার পরিবর্তন এবং স্থ’াপন করতে হবে, অন্য ঋতুতে লিটার পরিবর্তন এবং স্থাপন করলে লিটারের শতকরা ১-২ ভাগ কলি চুন মিশিয়ে দিতে হবে যেন লিটার শুষ্ক এবং জীবাণুমুক্ত হয়।

 

আলো ব্যবস্থাপনা
কাঙ্খিত ডিম উৎপাদন এবং ডিমের উর্বরতা বাড়ানোর জন্য দৈনিক ১৪-১৮ ঘণ্টা আলোর প্রয়োজন। শরৎকালে এবং শীতকালে দিনের আলোক দৈর্ঘ্য কম থাকে তাই কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়। পুরুষ কোয়েল যেগুলো প্রজনন কাজে ব্যবহার করা হয় না এবং যেগুলো শুধু মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় সেগুলোর জন্য দৈনিক ৮ ঘণ্টা আলোই যথেষ্ট।
 

রোগবালাই
 কোয়েলের রোগবালাই নেই বললেই চলে। সাধারণত কোনো ভ্যাকসিন অথবা কৃমিনাশক ওষুধ দেয়া হয় না। তবে বাচ্চা ফুটার প্রথম ২ সপ্তাহ বেশ সংকটপূর্ণ। এ সময় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কোয়েলের বাচ্চার যত্ন নিতে হয়। অব্যবস্থাপনার কারণে কোয়েলের বাচ্চা মারা যায়, তবে বয়স্ক কোয়েলের মৃত্যুহার খুবই কম।

 

কোয়েল পালনে আর্থিক লাভ
উৎপাদনের দিক থেকে কোয়েল অধিক উৎপাদনশীল। একটি মুরগির পরিবর্তে ৮টি কোয়েল পালন করা যায়। অল্প জায়গায়, বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায়, অল্প খরচে, পারিবারিক পর্যায়ে অথবা বাণিজ্যিকভিত্তিতে কোয়েল পালন দেশে পুষ্টি ঘাটতি মেটাতে এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম।

 

কৃষিবিদ ডা. ফারহান ইমতি ভূইয়া*
* বন্ধন, পীরেরবাগ, ঢাকা

বিস্তারিত
খাঁচায় মাছ চাষ ও সংরক্ষণ

জলাশয়ে উপযুক্ত পরিবেশে প্রয়োজনীয় আকারের খাঁচা যথাযথভাবে স্থাপন করে মাছ চাষ করা যায়। এটাই হলো মূলত খাঁচায় মাছ চাষ প্রযুক্তি। এভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মাছ চাষ করা যায়।
 

বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে খাঁচায়  মাছ চাষ শুরু হয়েছে বটে। তবে পৃথিবীর মৎস্য চাষের ইতিহাসে এটি নতুন ঘটনা নয়। চীনের ইয়াংঝি নদীতে প্রায় সাড়ে সাতশ’ বছর আগে খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয়। প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং বাণিজ্যিক কারণে খাঁচায় মাছ চাষ ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে।


প্রশ্ন হতে পারে যে, আমরা খাঁচায় মাছ চাষ কেন করবো। এ প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ। এই পদ্ধতিতে খাঁচাকে পুকুরের মতো ব্যবহার করা যায়। খাঁচায় মাছ চাষের মাধ্যমে বিভিন্ন জলাশয়ে অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন করা যায়।


নদীর পানিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে মাছ চাষ করা যায়। আবার মাছের বর্জ্য প্রবহমান নদীর পানির সাথে চলে যাওয়ায় নদীর পানি দূষিত হয় না। পানি প্রবহমান থাকায় খাঁচার ভেতরের পানি অনবরত পরিবর্তিত হতে থাকে এবং সে কারণে খাঁচায় অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা যায়। খাঁচার মাছের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে নদ-নদীতে প্রাকৃতিক প্রজাতির মাছের উৎপাদন বেড়ে যায়।


পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে খাঁচায় মাছ চাষ হচ্ছে। চীন দেশে এই প্রযুক্তি বেশ জনপ্রিয়। যতদূর জানা যায়-চীনেই প্রথম ছোট খাঁচায় বেশি ঘনত্বে মাছ চাষ শুরু হয়েছিল। সে দেশে সম্পূরক খাবার দিয়ে খাঁচায় তেলাপিয়া এবং কমন কার্প চাষ খুব জনপ্রিয়। তাইওয়ানেও খাঁচায় মাছ চাষ করা হয়। সেখানে ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম ওজনের তেলাপিয়া খাঁচায় চাষ করে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রামের তেলাপিয়ায় পরিণত করা হয় এবং পরে ফিলেট আকারে রফতানি করা হয়। দেশটি সেই ২০০৬ সালেই ২০,০০০ মেট্রিক টন ফ্রোজেন তেলাপিয়া এবং ৩,১০০ মেট্রিক টন তেলাপিয়ার ফিলেট রফতানি করে।


ইন্দোনেশিয়ায়ও খাঁচায় মাছ চাষ জনপ্রিয়, তবে জাভা অঞ্চলে এই প্রযুক্তির প্রচলন অনেক বেশি। জাভা অঞ্চলের ‘সিরাতা’ থেকে প্রায় ৩০,০০০ খাঁচায় মাছ চাষ করা হচ্ছিল।


থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে অতি সাধারণ জাল দিয়ে তৈরি খাঁচায় এক বছরের জন্য কোরাল বা ভেটকি মাছ চাষ করা হয়। সমুদ্রে ছোট মাছ ধরে তা খাঁচায় মাছের জন্য খাবার হিসেবে দেয়া হয়। ওদিকে, ভিয়েতনামে স্রোতহীন নদীতে খাঁচায় জলজ আগাছা খাদ্য হিসেবে দিয়ে গ্রাসকাপ এবং তেলাপিয়া মাছ চাষ করা হচ্ছে।


বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের ৬টি এলাকা-দিরাইয়ে সুরমা নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ করে দুই বছর আগেই দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে চাঁদপুর এলাকার ডাকাতিয়া নদীতে থাইল্যান্ডের প্রযুক্তি অনুসরণ করে খাঁচায় মাছ চাষ করা হচ্ছে। ২০০২ সাল থেকে মাত্র ছয় বছরের মধ্যে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদী এবং লক্ষ্মীপুর জেলার মেঘনা নদীর রহমতখালি চ্যানেলে প্রায় এক হাজার মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ করা হচ্ছে। এ থেকে বছরে ৭০০ মেট্রিক টন রফতানিযোগ্য তেলাপিয়া উৎপাদিত হচ্ছে। চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ করে বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে, আর তাই এখানকার ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন মডেলকে খাঁচায় মাছ চাষের ‘ডাকাতিয়া মডেল’ বলা হয়।


এ এলাকাগুলোতে মাছ চাষের মাধ্যমে আমিষের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। এ ধরনের মাছ চাষকে কেন্দ্র  করে এসব এলাকায় অনেকগুলো মাছের খাদ্যের দোকান গড়ে উঠেছে, সিলেট অঞ্চলে সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক এনজিও ‘হেলডেটাম সুইস ইন্টারকোঅপারেশন’ দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দুই বছরের মধ্যে এনজিওটির  সাফল্য দেখে অন্য এনজিওগুলো খাঁচায় মাছ চাষে এগিয়ে আসে।


২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নে সুরমা নদীতে ১৮টি খাঁচা তৈরি করে তাতে মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ শুরু হয়। এরপর দিরাই ও শাল্লা উপজেলায়  ৭০টি খাঁচা স্থাপন করা হয়। দশটি দলে ভাগ করে ১৪৮টি পরিবারের লোকজনকে খাঁচায় মাছ চাষের সুযোগ করে দেয়া হয়। এ সব পরিবারের লোকজন দারিদ্র্যমুক্ত হয়।
 

মাছ সংরক্ষণ
আমরা জাানি, ফরমালিন এক ধরনের সংরক্ষক,
Preservative যৌগ। এটা কাঠ, আসবাবপত্র কারখানায় সংক্রামক জীবাণুনাশক যৌগ, Disinfectant হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর বিষাক্ততা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল Volatile বৈশিষ্ট্যের কারণে এটা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক।    


দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে দেশের এক শ্রেণীর অসাধু মাছ ব্যবসায়ী মাছ টাটকা, শক্ত রাখা এবং দীর্ঘ সময় পচন থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে এ বিষাক্ত যৌগটি ব্যবহার করে থাকে। ফরমালিন দেয়া মাছ মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ফরমালিনের জন্য মানুষের চর্মরোগ, ডায়রিয়া, শ্বাসপ্রশ্বস সংক্রান্ত জটিল  সমস্যা, অন্ধত্ব, কিডনি সমস্যার এবং ক্যান্সারের মতো জটিল অসুখ হতে পারে। স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াও ফরমালিনের অপব্যবহারের কারণে দেশে মাছ উৎপাদনের উপর উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।


এ প্রসঙ্গে আরো বলা দরকার- ফরমালডিহাইড বা মিথানল গ্যাসের ৪০ শতাংশ জলীয় দ্রবণকে ফরমালিন বলা হয়। এ মিথানলকে পানিতে দিয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ জলীয় দ্রবণ বা ফরমালিন তৈরি করা হয়। এ হচ্ছে এক ধরনের কার্বনাইল যৌগ তবে কার্যকর জীবাণুনাশক। ফরমালডিহাইড সাধারণ তাপমাত্রায় এক ধরনের বর্ণহীন গ্যাস, তবে এটা তীব্র গন্ধযুক্ত এবং দাহ্য পদার্থ।


যারা ফরমালডিহাইডের সংস্পর্শে থেকে দীর্ঘকাল কাজ করে তাদের রক্তের লিম্ফোসাইট পরিবর্তন এবং নাসিকা টিস্যুতে মিউটেটিভ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাদের নাকে প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট, চর্ম প্রদাহ এবং অ্যাজমার উপসর্গও দেখা দিতে পারে। কিন্তু অল্প সময় সংস্পর্শে থাকার কারণে সমস্যা নাও হতে পারে। ফরমালিন ফুসফুস ক্যান্সারের কারণও হতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ভ্রুণের অস্বাভাবিকতা, গর্ভপাত, সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা  হ্রাস এবং  প্রসবজনিত অন্যান্য জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে।


এ অবস্থায় সংরক্ষক হিসেবে ফরমালিনের অপব্যবহার বন্ধ করবার লক্ষ্যে মাছ ব্যবসায়ী মৎস্যজীবী, মৎস্য ভোক্তা, মাছ ক্রেতা বিক্রেতা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সবার মধ্যে এই যৌগটির বিষাক্ত ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গণসচেতনতা অভিযান চালাতে হবে। এ প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য সংরক্ষণে ফরমালিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও গণসচেতনতা সৃষ্টি প্রকল্পের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। প্রকল্পটির কাজ এখনো অব্যাহত রয়েছে।


প্রাকৃতিকভাবে মাছ পচনশীল। তবে আহরণের পর সঠিক সংরক্ষণ এবং পরিচর্যার মাধ্যমে হ্রাস করা যায়। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। মাছ পচন রোধে গবেষণার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া, মাছ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দ্রুত পরিবহনের ব্যবস্থা নিতে হবে। সে ব্যবস্থা নিতে পারলে মাছের পচনহ্রাস পাবে।
 

ফরমালিন শনাক্তকরদের আধুনিক কিটবক্স উপযুক্ত দূরত্বের এলাকাগুলোতে সরবরাহ করা আবশ্যক, অত্যাধুনিক কিটবক্সের সাহায্যে সহজেই ফরমালিন শনাক্ত করা যায়। এ কিটবক্স বেশ ব্যবহারবান্ধব এবং সহজেই বহনযোগ্য। এর ওজন মাত্র ১৭০ গ্রাম।


এবার ফরমালিন অপব্যবহার প্রতিরোধেই কিছু সমস্যার কথা আলোচনা করা দরকার। দেশে ফরমালিন সম্পর্কিত গবেষণা তথ্যের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়া সঠিকভাবে যাচাই না করে কোনো কোনো বাজারকে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তীকালে যথাযথ মনিটরিং করা হয় না। এছাড়া, জনগণের মধ্যে ফরমালিন অপব্যবহারের পরিণাম সম্পর্কে জ্ঞানের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, আরো প্রতিবন্ধকতা আছে, গবেষণার মাধ্যমে সেগুলো নিরূপণ করা আবশ্যক।


এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে সত্যিকার অর্থে ফরমালিনমুক্ত বাজার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব নয়। তবে  সে লক্ষ্যে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। এসব ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে-


১. ফরমালিন পরীক্ষার জন্য তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত উপযুক্ত স্থানগুলোতে কিটবাক্স সরবরাহ।
২. ফরমালিন ব্যবহারকারী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ।
৩. ফরমালিনবিরোধী অভিযানে নিয়োজিতদের মধ্যে উপযুক্ত সমন্বয়।
৪. ব্যাপক প্রচারের জন্য লিফলেট, পোস্টার, ফেস্টুন, বুকলেট এগুলো যথাযথভাবে ব্যবহার।
৫. মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের সাহায্যে সঠিকভাবে ব্যাপক প্রচারণা।
৬. ফরমালিন ব্যবহার সম্পর্কিত আইন আধুনিকায়নের মাধ্যমে অপব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।

 

খাদ্যসামগ্রীতে ফরমালিনের অপব্যবহার রোধ এবং মাছসহ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চলমান সরকারি বেসরকারি কার্যক্রম আরো বেগবান করা হলে আশাতীত সাফল্য অর্জন করা যাবে এ আশা অবশ্যই করা যায়।

 

অ্যাডভোকেট কাজী শফিকুর রহমান*
*বাসা ২৩, রোড ৩০, ব্লক ডি, মিরপুর-১০, ঢাকা-১২১৬, ফোন : ৯০৩২৮৪৮, ০১৫৫২৪৫৭৬৬৩, ০১৮২৩৬৩৬৫৯২

বিস্তারিত
কবিতা (মাঘ ১৪২৪)

আলুর কথকতা

কৃষিবিদ এ এইচ ইকবাল আহমেদ*

নিত্য যারে লাগে আর বেশ দরকার
বলুনতো তার নাম, ওর পরিবার
সোলানেসি। তবে নয়, টমেটো বেগুন
বা ঝাল মিষ্টি মরিচ। উত্তর শুনুন-

কেউ বলে গোল আলু কেউ বলে আলু
পলি মাটি তার প্রিয়, মেশা যাতে বালু।
রবি খন্দে জন্মে নেয়। হিমাগারে রেখে
সারাবর্ষে তারে পাই অতি কাছ থেকে।

বৃদ্ধিকালে আলু দেহ  সূর্যালোক পেলে
সবুজ- বিষাক্ত হয়, দেয়া লাগে ফেলে।
পাটের মতোন  আলু অর্থকরী পণ্য
জোগায় নগদ অর্থ কৃষকের জন্য।

ধান , গম তারপরে  আসে নাম তার
যা দিয়ে তৈয়ার হয় বিচিত্র খাবার।
সিঙাড়া,  আলুরদম, প্রিয় নয় কার!
শুধু পোড়া আলু কিংবা  সিদ্ধও মজার।

পান্তা বা গরম ভাতে তার সাথে মিলে
হাতের নাগালে সস্তা, রুচি যোগ দিলে
আলু ভর্তা, ভাজি। মাংশ কিংবা মাছে
সহজে মানিয়ে নিতে আর কি বা আছে!
    
নোনা  কিংবা ঝাল হলে আলু কয়েকটা
ছেড়ে দিলে ঝোলে তার, স্বাদু হয় ওটা।
পুড়ে গেলে চামড়ায়  আলু পেষা দিলে
ওতে পরম আরাম ক্ষণকালে  মিলে।

ফ্রেন্স ফ্রাই, পাউরুটি, চিপস বা চপ
পুষ্টি- রুচি বৃদ্ধি করে খেলে টপা টপ।
বিশ্বজুড়ে আছে তার ভীষণ কদর
পশুখাদ্য হিসেবেও  চাহিদা জবর।

পুষ্টিবিদ বলেছেন; খোসাসহ আলু
সিদ্ধ হলে বেড়ে যায় পুষ্টি আর ভ্যালু।
আলু খেলে ভুড়ি হয়, এটা সত্য নয়
ডায়াবেটিকে আলুর  খাদ্যে নাই ভয়।
খাদ্য, ওষুধ, কোহল, প্রসাধনে আর
কত শত রকমারি ব্যবহার তার;
জ্বালানি  খাবার ছাড়া নানাবিধ পণ্য
আলু থেকে তৈরি হয়, তালিকা অগণ্য।

আদি ভূমি আন্দিজে। সে পর্বত থেকে
নাবিকেরা ইউরোপে নিয়ে আসে একে।
আইরিশ পটেটোর পরিচয় নিয়ে
ছড়ায় বিভিন্ন নামে দেশে দেশে গিয়ে।

আয়ারল্যান্ডে এককালে মড়কের ফলে
অধিকাংশ আলু ক্ষেত  যায় রসাতলে।
ইতিহাসে ‘আইরিশ  পটেটো ফেমিন’
স্মরণীয় কাল দাগে, বিষাদে মলিন।

আধেক মরেছে দেশে;  ভেগে দেশান্তরে
আমেরিকা ও অন্যত্র বাড়িঘর গড়ে
আইরিশ শরণার্থী, নামিদামি জন
কতেক ইউএসের  প্রেসিডেন্ট হন।

বেশি হয় আলু বিশ্বে  চীন ও ভারতে।
এশিয়ায় তৃতীয়  ও  সপ্তম জগতে
 আমাদের স্থান। তবে, মাথাপিছু তার
 অনেক দেশের পিছে  রয় তালিকার।

মৌসুমে শ্রমিক, ক্ষেতি, ব্যবসায়ী কত
ব্যস্ত রয় তারে নিয়ে সবে অবিরত।
এখন দেশের সীমা  ছাড়িয়ে বিদেশে
আলুর চালানে ব্যাংক ভরে তোলে ক্যাশে।

ভেনগগ এঁকেছেন ‘আলু খায়’ ছবি*
এর চাষ করেছেন  আমাদের রবি।**
আলুর প্রসঙ্গ নিয়ে  এবারের তরে
যবনিকা পাত করি  বাকি কথা পরে ।।

* ‘দি পটেটো ইটারস’- ভেনগগ।
**  ‘আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ’- রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

 *পরিচালক (অব.), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, সেল ০১৫৫৮৩০১৯০৮ <ahiqbal.ahmed@yahoo.com>

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর (কৃষিকথা ১৪২৪)

ছবি বিশ্বাস, গ্রাম : মনোহরপুর, উপজেলা : মনিরামপুর, জেলা : যশোর
প্রশ্ন :  ঘেরের পাশে কুমড়া লাগিয়েছি, গাছে ফল ধরেছে। কিন্তু কচি অবস্থায় ফল পচে যাচ্ছে। কী করলে উপকার পাব?
উত্তর : কুমড়া গাছে কচি ফলগুলোতে ফলের মাছি পোকা আক্রমণ করলে কচি অবস্থায় ফল পচে ঝরে পড়ে। সেজন্য কচি কুমড়ায়  নেট কাপড় বা পলিব্যাগ দিয়ে ব্যাগিং করা প্রয়োজন। ব্যাগিং করলে ফলের মাছি পোকা কচি ফলে আক্রমণ করে ফলের ভেতরে ডিম পাড়তে পারে না এবং ফলও নষ্ট হয় না। যে ধরনের ব্যাগই ব্যবহার করা হোক না কেন? খেয়াল রাখতে হবে ব্যাগটি বড় হতে হবে। কারণ ব্যাগটি কমপক্ষে কুমড়া ফলটিকে মাসখানেক ঢেকে রাখতে হবে। তারপর কুমড়া ফলের খোসা হাতের নখ দিয়ে টিপলে যদি সহজে না বসে যায়। তবে বুঝতে হবে এ অবস্থায় ফলের মাছি পোকার আক্রমণ করা সম্ভব না। সেক্ষেত্রে ব্যাগটি কুমড়া ফল  থেকে খুলে ফেলতে হবে। এছাড়া ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করেও আমরা ফলের মাছি পোকা দমন করতে পারি। সেক্ষেত্রে তিন শতক জমিতে একটি ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করতে হয়। এভাবে কুমড়া ফসলের ব্যবস্থাপনা করলে অনেক বেশি লাভবান হবেন।

মো. রাশেদ, গ্রাম : মাথাভাঙ্গা, উপজেলা : পোরশা, জেলা : নওগাঁ
প্রশ্ন : ফসফেট সার ও দস্তা সার একত্রে জমিতে ব্যবহার করলে ফসলের কী ক্ষতি হয়?
উত্তর : ফসফেট সার ও দস্তা সার একত্রে জমিতে প্রয়োগ করলে ফসলের কোনো ক্ষতি হয় না। তবে খেয়াল রাখতে হবে এ দুটো সার ফসলের জন্য নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি না হয়। কারণ অতিরিক্ত ফসফেট সার দস্তা সারের সহজলভ্যতাকে কমিয়ে দেয়। মাটির প্রকারভেদে ও মাটির পিএইচ এর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সারের মাঝে নানা ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। আর সে কারণেই সুষম সার ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ। সুষম সার প্রয়োগের জন্য অবশ্যই মাটি পরীক্ষার বিকল্প নেই। এজন্যই বলে সুষম সারের মাত্রা জেনে, ফসল করো নিয়ম মেনে।  


মো. জয়নাল উদ্দীন, গ্রাম : লক্ষীরপাড়, উপজেলা : বিশ্বম্বপুর, জেলা : সুনামগঞ্জ
প্রশ্ন : শিমের গায়ে বাদামি-কালো রঙের কালো দাগ পড়ে এবং শিমগুলো পচে যাচ্ছে। কী করলে উপকার পাব?

উত্তর : শিমের গায়ে বাদামি-কালো রঙের দাগ পড়ে শিম পচে যায় অ্যানথ্রাকনোজ রোগের জীবাণু আক্রমণ করলে। এ সমস্যার সমাধানে প্রপিকোনাজল গ্রুপের  যেমন টিল্ট ১ মিলিলিটার ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করলে সুফল পাবেন। কিংবা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের যেমন টপসিন ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে শিম গাছে বিকেল বেলা স্প্রে করলে ভালো ফলাফল পাবেন। এছাড়া এ রোগ প্রতিরোধে রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা প্রয়োজন। আর শিম গাছ ও বাগানকে সবসময় পরিচ্ছন্ন রাখলে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অনেক কমে যাবে। আর অনেক বেশি ফলনও পাওয়া যাবে।


মো. রফিকুল ইসলাম, গ্রাম : ইসলামপুর, উপজেলা : চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, জেলা : চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন :  লেবু গাছের আগা মারা যাচ্ছে। এ সমস্যাটির প্রতিকার সম্পর্কে জানাবেন।  

উত্তর : লেবু গাছের আগা মরে যাওয়া রোগ হলে প্রথমে লেবু গাছের যে অংশটুকু মরে গেছে সেখান থেকে কিছু সুস্থ অংশসহ ধারালো চাকু দ্বারা সুন্দরভাবে কেটে ফেলতে হবে। তারপর কাটা অংশে বর্দোপেস্ট এর প্রলেপ দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ১ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম তুঁত ও ১০০ গ্রাম চুন মিশিয়ে বর্দোপেস্ট তৈরি করতে হয়। এছাড়া কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রুপের যে কোনো ছত্রাকনাশক ৪ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পরপর ১/২ বার স্প্রে করা। সেসাথে লেবু বাগানটিকে সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। এসব নিয়ম মেনে চললে লেবু গাছের আগা মরা রোগ দমন করতে পারবেন।  


তানিয়া সুলতানা, গ্রাম : পায়রাবন্দ, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : আমগাছের নতুন পাতাগুলোর গোড়া থেকে পোকায় কেটে দিচ্ছে, প্রতিকারের উপায় কী?

উত্তর : আমগাছের নতুন পাতাগুলো গোড়া থেকে কেটে দেয় যে পোকা। তার নাম আমের পাতা কাটা উইভিল। এ পোকা দমনে আম গাছে কচি পাতা দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের যেমন রিপকর্ড ১ মিলিলিটার ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে বিকেল বেলা স্প্রে করা। অথবা ফেনথিয়ন গ্রুপের যেমন লেবাসিড ১ মিলিলিটার ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে একই নিয়মে স্প্রে করা। তাহলেই আপনি সুফল পাবেন।


মো. আব্দুর রাজ্জাক, গ্রাম : চকগৌরী, উপজেলা : পত্নীতলা, জেলা : নওগাঁ
প্রশ্ন :  বোরো ধানের বীজতলা কিভাবে প্রস্তত করব?

উত্তর : বোরো ধানের বীজতলা তৈরির জন্য বীজতলার জমি ২ থেকে ৩টি চাষ দিয়ে মাটি আলগা করে প্রয়োজনীয় পানি সেচের মাধ্যমে থক থকে কাদা করে এক বা একাধিক মই দিয়ে সমান করতে হবে। তারপর  ১ মিটার প্রস্থ  রেখে এবং সুবিধামতো দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট বেড তৈরির মাধ্যমে আদর্শ বীজতলা তৈরি করতে হয়। পাশাপাশি দুইটি বীজতলার মাঝখানে ১ ফুট প্রশস্ত নালা রাখা দরকার। নালা রাখলে বীজতলায় সেচ, অতিরিক্ত পানি নিকাশ, পরিচর্যা এবং রোগবালাই দমনে বালাইনাশক স্প্রে করা সহজ হয়। প্রতি শতকে ২.৫ কেজি অঙ্কুরিত বীজ বপন করতে হয়। এতে করে বীজতলায় চারা সুস্থ ও সবল হবে। সুস্থ সবল চারা মানেই বেশি ফলন সুনিশ্চিত। এভাবে বোরো ধানের বীজতলা করলে অবশ্যই আপনি ভালো ফলন পাবেন।


বাবুল চন্দ্র রায়, গ্রাম : কালিগঞ্জ, উপজেলা : জলঢাকা, জেলা : নীলফামারি
প্রশ্ন : গরুর সারা শরীরে আঁচিল হয়েছে। কী করব? পরামর্শ চাই।  

উত্তর : অটোহিমোথেরাপি দিতে হবে। বড় ও মাঝারি গরুর জন্য জগুলার শিরায় ১০ থেকে ১২ মিলিলিটার রক্ত সিরিঞ্জের মাধ্যমে সংগ্রহ করে সংগৃহীত রক্ত তাড়াতাড়ি রানের মাংস পেশিতে দিতে হবে। এভাবে পর পর ৩টি ইনজেকশন ৫ থেকে ৭ দিন দিলেই এ রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত পরামর্শ পাওয়ার জন্য আপনার কাছের উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে  যোগাযোগ করতে পারেন।


মো. ফারুক হোসেন, গ্রাম : ভাটখোর, উপজেলা : গোমস্তাপুর, জেলা : চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন : গাভীর জরায়ু বের হয়ে আসে। এ সমস্যা থেকে কিভাবে মুক্তি পেতে পারি?

উত্তর : ৩০ থেকে ৪০ গ্রাম সকেঠিল পাউডার পানির সাথে মিশিয়ে বের হয়ে আসা জরায়ু ভালোভাবে পরিষ্কার করে আবার ভেতরে ঠেলে দিতে হবে। ক্যাল ডি মেগ ইনজেকশন ১০০ থেকে ২০০ মিলিলিটার শিরায় আস্তে আস্তে প্রয়োগ করলে জরায়ু ভেতরে ঢুকে যাবে। উক্ত ইনজেকশন দেয়ার পর যদি ৭ থেকে ৮ দিনের মধ্যে কাজ না হয় তাহলে আবার উক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ করতে হবে। এ বিষয়ে আরো পরামর্শ গ্রহণের জন্য আপনার কাছের উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করতে পারেন।  


মো. মোর্শেদ আলী, গ্রাম : চন্তিপুর, উপজেলা : শ্যামনগর, জেলা : সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : চিংড়ির ফুলকায় কালো দাগ ও পচন দেখা যাচ্ছে এবং খাদ্য গ্রহণে অনীহা দেখা যাচ্ছে কী করব?

উত্তর : পুকুরের তলদেশে জৈব পদার্থের পচন বৃদ্ধি পেলে এবং কুসোরিয়াম ও স্যাপ্রোলেগমিয়া ছত্রাক এ রোগের কারণ। এ রোগ প্রতিরোধে হররা টেনে দ্রুত পানি পরিবর্তন করতে হবে। অ্যাসকরবিক এসিড ২০০ মিলিগ্রাম ১ কেজি খাদ্যে মিশিয়ে খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এছাড়াও প্রতিষেধক হিসেবে ভাইরেক্স এবং টেট্রাভেট জীবাণুুনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।  

 

মো. আলমগীর হোসেন, গ্রাম : টেপীবাড়ি  উপজেলা : ভুয়াপুর, জেলা : টাঙ্গাইল
প্রশ্ন : মাছের পেট ফোলা রোগ হয়েছে এবং মাছ মারা যাচ্ছে। কী করব?

উত্তর : মাছের পেট ফোলা রোগ হলে প্রথমে আক্রান্ত মাছগুলোকে আলাদা করতে হবে এবং সিরিঞ্জ দিয়ে মাছের পেট থেকে পানি বের করে দিতে হবে। মাছের খাবারের সাথে টেরামাইসন ক্যাপসুলের গুঁড়া ১ গ্রাম ১ কেজিতে মেশাতে হবে। অক্সিজেনের অভাবে এ রোগ হয়। মাছের ঘনত্ব কমিয়ে চুন প্রয়োগ ও জাল টেনে বা হররা টেনে অক্সিজেন তৈরি করে এ সমস্যার প্রতিকার করা যায়।


কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে  কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।

 

কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন*
* উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এল আর, সংযুক্ত কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫ suman_arefin@yahoo.com

বিস্তারিত
ফাল্গুন মাসের কৃষি (মাঘ ১৪২৪)

ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে আমাদের মাঝে। নতুন পাতার বর্ণিল রঙে প্রকৃতিতে লেগেছে নানা রঙের ছোঁয়া। ঘনকুয়াশার চাদর সরিয়ে প্রকৃতিকে নতুনভাবে সাজাতে, বাতাসে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে দিতে ফাল্গুন আসে। নতুন প্রাণের উদ্যমতা আর অনুপ্রেরণা প্রকৃতির সাথে আমাদের কৃষিকেও দোলা দিয়ে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন ফাল্গুনের শুরুতেই সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেই বৃহত্তর কৃষি ভুবনে করণীয় দিকগুলো।
 

বোরো ধান
ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে;
ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে;
পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে) ধানক্ষেত বালাই মুক্ত রাখতে হবে;
এ সময় ধান ক্ষেতে উফরা, ব্লাস্ট, পাতাপোড়া ও টুংরো রোগ দেখা দেয়;
জমিতে উফরা রোগ দেখা দিলে কৃমিনাশক ফুরাডান ৫ জি বা কিউরেটার ৫ জি প্রয়োগ করতে হবে;
ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে এবং একরপ্রতি ১৬০ গ্রাম ট্রুপার বা জিল বা নেটিভ ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দুইবার প্রয়োগ করতে হবে;
জমিতে পাতাপোড়া রোগ হলে অতিরিক্ত ৫ কেজি/বিঘা হারে পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে এবং জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিতে হবে;
টুংরো রোগ দমনের জন্য এর বাহক পোকা সবুজ পাতা ফড়িং দমন করতে হবে।

 

গম
এ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম পাকা শুরু হয়; গম শীষের শক্ত দানা দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে গম কাটার সময় হয়েছে; সকালে অথবা পড়ন্ত বিকেলে ফসল কাটা উচিত;
বীজ ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে তাড়াতাড়ি মাড়াই ঝাড়াই করে ফেলতে হবে। সংগ্রহ করা বীজ ভালো করে শুকানোর পর ঠাণ্ডা করে সংরক্ষণ করতে হবে।

 

ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে; বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করে ফেলতে হবে;
সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে;
মোচা সংগ্রহের পর উঠানে পাট বিছিয়ে তার ওপর শুকানো যায় অথবা জোড়া জোড়া বেঁধে দড়ি বা বাঁশের সাথে অথবা অনেকে টিনের চাল বা ঘরের বারান্দায় ঝুলিয়ে শুকানোর কাজটি করা যায়।

 

ভুট্টা (খরিফ)
খরিফ মৌসুমে ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই বীজ বপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে;
ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫ এসব।

 

পাট
ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়;
পাটের ভালো জাত-ও-৯৮৯৭, ওএম-১, সিসি-৪৫, বিজেসি-৭৩৭০, সিভিএল-১, এইচসি-৯৫, এইচ এস-২৪;
স্থানীয় বীজ ডিলারদের সাথে যোগাযোগ করে জাতগুলো সংগ্রহ করতে পারেন;
চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫/৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে।
সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ১৭ থেকে ২০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ২৫-৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়।
পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭-১০ সেন্টিমিটার;
ভালো ফলনের জন্য একরপ্রতি ৬ কেজি ইউরিয়া, ৭ কেজি টিএসপি, ৯ কেজি এমওপি সার শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে;

 

শাকসবজি
বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কলমিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষ করতে হবে;
মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন;
সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে জৈব সার ব্যবহার করলে সবজি ক্ষেতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না।

 

গাছপালা
আমের মুকুলে অ্যানথ্রাকনোজ রোগ এসময় দেখা দেয়। এ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে টিল্ট-২৫০ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি আথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রের করতে হবে। এছাড়া আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার স্প্রে করতে হবে;
এ সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে পুরো গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কাঁঠালের ফল পচা বা মুচি ঝরা সমস্যা এখন দেখা দিতে পারে। কাঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার বোর্দ্রাে মিশ্রণ বা ডায়থেন এম ৪৫ অথবা রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ফলিকুর নামক ছত্রাকনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছে ফুল আসার পর থেকে ১৫ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে;
বাডিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করতে পারেন। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হবে এবং পরে উন্নত বরই গাছের মুকুল ছাঁটাই করে দেশি জাতের গাছে সংযোজন করতে হবে;

 

প্রাণিসম্পদ
এ সময় মুরগির রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে প্রয়োজনীয় টিকা প্রদান করতে হবে; খাবারের সাথে ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই সরবরাহ করতে হবে;
গবাদিপশুকে প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিতে হবে এবং কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।
গবাদিপশুকে উন্নত খাবার সবুজ ঘাস, ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র, ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক এসব খাওয়াতে হবে।

 

মৎস্যসম্পদ
মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি ও সংস্কার করার উপযুক্ত সময় এখন;
পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশপ্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে;
পানিভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠাণ্ডা করে দিতে হবে। এছাড়া শতাংশপ্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি একসাথে মিশিয়ে পানিভর্তি পুকুরে দিতে হবে;


শীতের পর এ সময় মাছের বাড়বাড়তি দ্রুত হয়। তাই পুকুরে প্রয়োজনীয় খাবার দিতে হবে এবং জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক, কৃষিকথায় প্রতি বাংলা মাসেই কৃষি কাজে অনুসরণীয় কাজগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষিবিশেষজ্ঞ, মৎস্যবিশেষজ্ঞ ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্ঠা কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের শীর্ষে। আবার কথা হবে আগামী মাসের কৃষিকথায়। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon