Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

তোষা বা বগী বা গুটি পাটের আবাদ

পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। পাট আমাদের সোনালি আঁশ। আট থেকে দশ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট ও এ জাতীয় আঁশ ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭.৫-৮.০ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয় যা থেকে প্রায় ৮০ লাখ বেল পাট আঁশ উৎপন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বছরে উৎপাদিত পাট আঁশের শতকরা প্রায় ৫১ ভাগ পাট কলগুলোতে ব্যবহৃত হয়, প্রায় ৪৪ ভাগ কাঁচা পাট বিদেশে রফতানি হয় ও মাত্র ৫ ভাগ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারে কাজে লাগে। এ ফসল নিজেই মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে বেশি পরিমাণ উর্বর জমি খাদ্য শস্য চাষের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পাটের উর্বর আবাদি জমির পরিমাণ কম এবং ক্রমাগত প্রান্তিক ও অনুর্বর জমিতে পাট আবাদ স্থানান্তরিত হলেও জাতীয় গড় উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর প্রধান কারণ পাট চাষে বিজেআরআই উদ্ভাবিত আধুনিক প্রযুক্তি উচ্চফলনশীল জাত এবং উৎপাদন কলাকৌশলের ব্যবহার। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় শতকরা ১২ ভাগ পাট চাষ এবং পাটশিল্প প্রক্রিয়াকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও বিপণন কাজের সাথে জড়িত। এছাড়াও কাঁচা পাট ও পাট জাত দ্রব্য বাংলাদেশের রফতানি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস। পাট ফসল দেশের কর্মসংস্থানে, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিরাট সহায়ক ভূমিকা রাখছে। মোট কর্মসংস্থানের শতকরা প্রায় ১০ ভাগ পাট চাষ এবং চাষ পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়া পাট চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও বিপণন কাজের সাথে জড়িত। বিশেষ করে পাটের আঁশ পচার পর আঁশ ছাড়ানো, ধোয়া ও শুকানো কাজে কৃষক পরিবারের মহিলা সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি দেশের মহিলা কর্মসংস্থানের এক বিরল উদাহরণ। পাটের আঁশ বিক্রির টাকা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখে, গ্রামীণ জনপদে সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও পরবর্তী রবি শস্য চাষে আর্থিক মোকাবিলা করার সাহায্য করে এ পাট চাষ।


দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। বিপুল জনগোষ্ঠী ও প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খাদ্য ঘাটতি মেটানোর জন্য কৃষক ঝুঁকছে খাদ্য ফসল উৎপাদনের দিকে। ফলে পাট আবাদি জমি চলে যাচ্ছে প্রান্তিক ও অবহেলিত জমিতে। সত্তর দশকের আগে পর্যন্ত পাট আবাদের ক্ষেত্রে দেশি ও তোষা পাটের অনুপাত ছিল ৮০ ঃ ২০। উচ্চফলনশীল ও আগাম বপনযোগ্য (চৈত্র মাসে) তোষা পাটের জাত উদ্ভাবিত হওয়া এবং সারা দেশে তার উৎপাদন প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটানোর মাধ্যমে বর্তমানে ওই দেশী ও তোষা আবাদের অনুপাত দাঁড়িয়েছে ২০ ঃ ৮০। এ অনুপাতের প্রভাবেই পাটের গড় ফলনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সত্তর দশকের দিকে যেখানে পাট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল মোট আবাদি জমির প্রায় ৭-৮ শতাংশ ও জমির পরিমাণ ছিল ১০-১২ লাখ হেক্টর, কিন্তু খাদ্য ঘাটতি চহিদার জন্য আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে মোট জমির প্রায় ৪-৫ শতাংশতে। তাই নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রান্তিক ও অবহেলিত জমিতে বেশি ফলন নিশ্চিত করাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায়। বর্তমানে পাটের গড় ফলন হেক্টরপ্রতি প্রায় ২ টন। তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প উপায় নেই। এলক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা পাটের এবং বিশেষ করে তোষা পাটের ফলন বৃদ্ধির জন্য নিরলসভাবে কাজও করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত তোষা বা বগী বা গুটি পাটের জাত এবং তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হলো।


ও-৪ : এ জাতের বীজ ১ বৈশাখ বা ১৫ এপ্রিলের আগে বপন করা যায় না, কারণ এতে আকালে ফুল এসে যায়। এজন্য একে বৈশাখী জাতও বলা হয়। কা- সম্পূর্ণ হালকা-সাদাটে সবুজ। পাতা সরু, বর্শাফলাকৃতি, হালকা সবুজ। এ জাতের প্রতিটি গাছই নলাকৃতি, ডগার ব্যাস থেকে গোড়ার ব্যাসে কম পার্থক্য স¤পন্ন। বপনের উপযুক্ত সময় ১৫ এপ্রিল-১৫ মে (১-৩০ বৈশাখ)। হেক্টরপ্রতি বীজের হার ৫-৬ কেজি। জীবনকাল ১১৮-১২০ দিনের। হেক্টরপ্রতি ফলন ৪.৫১ টন এবং কৃষকের জমিতে গড় ফলন ২.৩২ টন পর্যন্ত হয়।
ও-৯৮৯৭ (ফাল্গুনী তোষা) : এ জাতের গাছ সুঠাম, দ্রুত বাড়ন্ত, পূর্ণ সবুজ। পাতা লম্বা, চওড়া, বর্শাফলাকৃতি গোড়ার দিক থেকে হঠাৎ মাথার দিক সরু হয়। ফল বেশ লম্বা এবং ফলের মাথা আধ ইঞ্চির (১ সেন্টিমিটার) মতো সরু শীষের মতো হয়ে থাকে ফলে অন্যান্য তোষা পাট জাতের মতো পাকলেই ফেটে গিয়ে বীজ ঝরে পড়ে না। বীজ আকারে ছোট, হালকা সবুজাভ। এ জাতের বীজ উৎপাদনের জন্য নাবি বীজ উৎপাদন পদ্ধতি অনুসরণ করা আবশ্যক। বপনের উপযুক্ত সময় ৩০ মার্চ-৩০ এপ্রিল (১৬ চৈত্র-১৬  বৈশাখ)।  তবে এ জাতের বীজ ১৬ চৈত্র (৩০ মার্চ) থেকে বৈশাখ মাসের শেষ (১৫ মে) পর্যন্ত বপন করা চলে। হেক্টরপ্রতি বীজের হার ৫-৬ কেজি। এ জাতের গাছে নির্ধারিত সময় বপন করা হলে ১৫০ দিনের পর ফুল আসে। তাই এ জাতের আঁশ ফসলের জন্য ফুল আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা দরকার হয় না। হেক্টরপ্রতি ফলন ৪.৬১ টন। তবে কৃষকের জমিতে গড়ে প্রায় ২.৭৩ টন-হেক্টর শুকনা আঁশ পাওয়া যায়।


ওএম-১ : এ জাতের গাছ লম্বা, সুঠাম, গাছের কা- ঘন সবুজ। পাতার আকার তুলনামূলকভাবে বেশ বড় এবং ডিম্বাকৃতি, উজ্জ্বল চকচকে পাতার উপরিপৃষ্ঠ, দেখলেই চেনা যায় এবং এটি এ জাতের বৈশিষ্ট্য। সম্পূর্ণ সবুজ, আলোক সংবেদনশীলতা কম, আঁশ উন্নতমানের, পাতা লম্বাকৃতির, চওড়া ও চকচকে। ফল পাকার পরে বীজ ঝড়ে পড়ে না। বীজের রঙ গাঢ় খয়েরি। কাজেই আঁশ ফসল হিসাবে ১২০ দিন বয়স হলেই বা প্রয়োজন হলে তার আগে ফসল কেটে আঁশ নেয়া যায়। এ জাতের বীজ উৎপাদনের জন্য নাবি বীজ উৎপাদন পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। বপনের উপযুক্ত সময় ২০ মাচ-৩০ এপ্রিল (৬ চৈত্র-১৬ বৈশাখ)। হেক্টরপ্রতি বীজের হার ৫-৬ কেজি। জীবনকাল ১৪০-১৫০ দিনের। হেক্টরপ্রতি ফলন ৪.৬২ টন হলেও কৃষকের জমিতে গড়ে ২.৪৯ টন পর্যন্ত শুকনা আঁশ পাওয়ার তথ্য আছে।


বিজেআরআই তোষা পাট-৪ (ও-৭২) : গাছ লম্বা, মসৃণ, ও-৯৮৯৭ এর চেয়ে আগাগোড়া অধিক সুষম, সম্পূর্ণ সবুজ এ জাতের গাছের পাতা ডিম্বাকৃতি, বড়, ওএম-১ জাতের মতো। তবে চকচকে নয় বরং গাঢ় সবুজ। অন্য দুটি আগাম বপনোযোগী জাতের চেয়ে নাবি বীজ উৎপাদন প্রদ্ধতিতে জাতে অধিক বীজ উৎপাদিত হয়। বীজের রঙ নীলাভ ধূসর, আগাম বপনযোগ্য। উপযুক্ত বপন সময় দেশে সর্বাধিক প্রচলিত জাত ও-৯৮৯৭ এর চেয়ে ১৫ দিন আগে অর্থাৎ ১৫ মার্চ থেকে (১ চৈত্র) সমগ্র বৈশাখ (১৫ মে পর্যন্ত) পর্যন্ত বপন করা যায়। হেক্টরপ্রতি বীজের হার ৫-৬ কেজি। এ জাতে ১৩০-১৪০ দিনে ফুল আসে। সর্বোচ্চ ফলন হেক্টরপ্রতি ৪.৯৬ টন এবং কৃষকের জমিতে ২.৯০ টন।


বিজেআরআই তোষা পাট-৫ (লাল তোষা-৭৯৫) : গাছ লাল বা লালচে, উপপত্র স্পষ্ট লাল। পাতার বোঁটার অংশ তামাটে লাল। পাতা লম্বা ও চওড়া। বীজের রঙ নীলাভ, আগাম বপনযোগ্য মার্চের ১০ তারিখে বপন করলেও আগাম ফুল আসার কোনো সম্ভাবনা নাই। কৃষক পর্যায়ে বিজেআরআই তোষা-৪ (ও-৭২) এর চেয়ে ফলন প্রায় ১০% বেশি। আঁশের রঙ উজ্জ্বল সোনালি এবং পাট কাঠি অন্যান্য জাতের তুলনায় শক্ত। বপনের উপযুক্ত সময় ১৫ মার্চ-১৫ এপ্রিল (১ চৈত্র-১ বৈশাখ)। হেক্টরপ্রতি বীজের হার ৫-৬ কেজি। এ জাতে ১৩০-১৪৫ দিনে ফুল আসে। হেক্টরপ্রতি ফলন ৫ টন। হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা ৩.৫-৪.০ লাখ রাখা গেলে কৃষকের জমিতে হেক্টরপ্রতি ফলন ৩.৪০ টন হয়।


বিজেআরআই তোষা পাট-৬ (ও-৩৮২০) : এ জাতটি বাংলাদেশের সমগ্র অঞ্চলে চাষ উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ জাতটির ছালে পুরুত্ব বেশি এবং পাটকাঠি তুলনামূলক শক্ত। গাছ লম্বা, কা- গাঢ় সবুজ মসৃণ এবং দ্রুতবর্ধনশীল। বীজের রঙ নীলাভ সবুজ। বপনের উপযুক্ত সময় চৈত্রের ২য় সপ্তাহ-বৈশাখের ২য় সপ্তাহ (এপ্রিল ১ম সপ্তাহ থেকে এপ্রিল শেষ সপ্তাহ)। হেক্টরপ্রতি বীজের হার ৫-৬ কেজি। এ জাত ১১০ দিনে ফসল কাটা যায়। হেক্টরপ্রতি ফলন ৫ টন। হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা ৪ লাখ রাখা গেলে কৃষকের জমিতে  গড়ে ৩ টন-হেক্টর ফলন পাওয়া যায়।


আঁশ উৎপাদন ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি
ভালো এবং অধিক ফসল পেতে হলে রোগমুক্ত, পরিষ্কার পরিপুষ্ট ও মানসম্মত বীজ ব্যবহার করতে হবে।

 

জমি নির্বাচন ও তৈরি : কম খরচে ভালো ফলন পেতে হলে এমন ধরনের জমি নির্বাচন করতে হবে। যেসব জমি  মৌসুমের প্রথমে বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায় না এবং বৃষ্টির পানি সরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে এমন জমি নির্বাচন করতে হয়। পাটের জন্য একটু উঁচু বা মধ্যম উঁচু জমি নির্বাচন করা প্রয়োজন। পাটের বীজ খুব ছোট বলে পাট ফসলের জমি মিহি এবং গভীর করে চাষ দিতে হয়। পাট চাষের জন্য খরচ কমাতে হলে যেসব জমিতে আলু বা সবজি করা হয় সেসব জমিতে একবার চাষ করে মই দিয়ে পাট বীজ বপন করেও ভালো ফসল পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এসব জমিতে আগাছা নির্মূলজনিত খরচ কম হয়। সারি করে সিড-ড্রিলের সাহায্যে বীজ বপন করা হলে বীজগুলো মাটির নিচে সমান গভীরতায় পড়ে বলে সমভামে অংকুরোদগম হয়।


সার ব্যবস্থাপনা : পাট গাছের বাড়বাড়তি এবং অাঁশফলন বাড়ানোর ক্ষেত্রে নাইট্রোজেন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ফসফরাস ও পটাশিয়ামের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। ফসফরাস আঁশের মান উন্নত করে এবং নাইট্রোজেন সদ্ব্যবহারের উপযুক্ততাকে বাড়িয়ে দেয়। টিএসপি এবং এমওপি একবার প্রয়োগ এবং ইউরিয়া দুইবার পৃথক প্রয়োগ পাট চাষের জন্য যথেষ্ট  সাফল্যজনক। বাংলাদেশের যেসব জমিতে সালফার এবং জিংক ন্যূনতায় রয়েছে সেখানে সালফার ও জিংক প্রয়োগ করে ফল পাওয়া যায়। বীজ বপনের দিন প্রয়োজনীয় পরিমাণের ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম এবং জিংক সালফেট সার জমিতে শেষ চাষে প্রয়োগ করে মই দিয়ে মাটির সাথে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তি (৪৫ দিনে) ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন মাটিতে পর্যপ্ত পরিমাণ রস থাকে। দ্বিতীয় কিস্তি প্রয়োজনীয় পরিমাণের ইউরিয়া সার কিছু শুকনা মাটির সাথে মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করা ভালো। ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রয়োগকৃত সার গাছের কচি পাতায় এবং ডগায় না লাগে। সার ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণ করাটা বিজ্ঞানসম্মত হলে বেশি ভালো। আঁশ উৎপাদনে রাসায়নিক সার হলো-


বীজের পরিমাণ ও গাছের ঘনত্ব প্রচলিত এবং জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে ছিটিয়ে বপন করা। সারিতে বপন করা কষ্টসাধ্য ব্যয়বহুল মনে হলেও এর উপকারিতা বেশি। এতে জমির সর্বত্র গাছের বিস্তৃত সমভাবে থাকে, পরিচর্যার সুবিধা হয়। সারিতে বপন করা হলে বীজের পরিমাণ কম লাগে এবং গজায়ও ভালো। ৩০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে সারি করে বীজ বপন করলে সবচেয়ে ভালো হয়। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব সব সময় ঠিক রাখা না গেলেও পরিমিত অবস্থায় ৭ থেকে ১০ সেন্টিমিটার ধরা হয়। সারিতে বীজ বপন করার জন্য বীজ বপন যন্ত্র বা সিডার ব্যবহার লাভজনক।


নিড়ানি ও পাতলাকরণ : বাংলাদেশের পাট ক্ষেতে ৩৯টি গোত্রের অন্তর্গত ৯৯টি গণ এর ১২৯টি প্রজাতির উদ্ভিদ আগাছা হিসেবে জন্মে। এদের মধ্যে ২৭টি প্রজাতি আগাছা হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এদের ঘনত্ব প্রতি ৩ বর্গফুটে ৫ থেকে ১০২টি আগাছা হতে পারে। পাটের আবাদে যে খরচ হয় তার একটা বড় অংশই নিড়ানি ও পরিচর্যার জন্য হয়। চারা গজানোর ১৫-২০ দিনের মধ্যে চারা পাতলা করা প্রয়োজন। সারিতে বপন করা হলে হাত দিয়ে বা ছিটিয়ে বপন করা হয়ে থাকলে আঁচড়া দিয়ে প্রাথমিকভাবে চারা পাতলা করা যায়। পাট গাছের বয়সের ৪০-৫০ দিনের মধ্যে একবার নিড়ানি দেয়ার সময় কৃষক কোনো কোনো ক্ষেতে চারা ও পাতলা করেন। তবে বয়স ৬০-৭০ দিনের মধ্যে যে চারা পাতলা করা হয় তা টানা বাছ নামে এবং বয়সের ৮৫-৯০ দিনের মধ্যে চারার গোড়া কেটে যে পাতলা করা হয় তা কাটা বাছ নামে পরিচিত। এ কচি গাছ না ফেলে পচিয়ে খুব উন্নত মানের পাট পাওয়া যায়, যা সুতা তৈরি করায় ব্যবহৃত হতে পারে।


পানি নিষ্কাশন : পাটের জমিতে জমে থাকা পানি নিকাশ অত্যন্ত জরুরি। জমিতে পানি জমলে মাটির ভেতর বাতাস প্রবেশ করতে পারে না ফলে গাছের শিকড়ের শ্বাস-প্রশ্বাস বিঘ্নিত হয়, গাছ স্বাভাবিকভাবে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না, ফলে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে না এবং শেষ পর্যন্ত গাছ মারা যায়। দেশী পাটের জাত চারা অবস্থায় পানি সহ্য ক্ষমতা থাকে না। তবে এ জাতের গাছের বয়স ও উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। কিন্তু তোষা পাট চারা অবস্থায় পানি সহ্য করতে পারে না, এমনকি বড় হলেও দাঁড়ান পানি বা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।


পাট কাটা : বপনের ৬০-১২০ দিনের মধ্যে পাট ফসল কর্তন করা যায়, তবে আঁশের ফলন এবং মানের মধ্যে সমতা পেতে হলে ১০০-১২০ দিনের মধ্যেই পাট কাটার প্রকৃত সময়। সাধারণত পাট গাছে যখন ফুল আসা শুরু হয় তখন বা তার আগে প্রয়োজনমতো সুবিধাজনক সময় পাট ক্ষেত কাটা হয়। কৃষক অনেক সময় ফলন বেশি পাওয়ার জন্য দেরিতে পাট গাছ কাটেন।
০১. পর্যাপ্ত পানি থাকা অঞ্চল : পর্যাপ্ত পানি থাকা অঞ্চলের জন্য পাট পচন প্রক্রিয়াকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে-
ক. বাছাইকরণ : পাট কাটার পর ছোট, বড়, মোটা ও চিকন গাছকে পৃথক করে আলাদা আলাদা আঁটি বাঁধতে হয়। একটি আটির ওজন ১০ কেজির হবে। ছোট ও চিকন এবং মোটা ও বড় পাটের গাছেরগুলোকে পৃথক পৃথকভাবে জাক দিতে হবে। পাটের আঁটি কখনও খুব শক্ত করে বাঁধা যাবে না। এতে পাট পচতে বেশি সময় লাগে। কারণ শক্ত আঁটির মাধ্যে পানি পচনকালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু ভালোভাবে প্রবেশ করতে পারে না।
খ. পাতা ঝরান : আঁটি বাঁধা শেষ হলে সেগুলোকে ৩-৪ দিন জমির ওপর স্তূপ করে রাখতে হয়। এ সময়ের মধ্যে পাতা ঝরে যাবে এবং গাছগুলো কিছুটা শুকিয়ে যাবে। পাতাগুলোকে জমির ওপরে ছড়িয়ে দিতে হয়। পাট গাছগুলো কিছুটা শুকানো ফলে পানিতে ডুবানোর পর গাছের ভেতর তাড়াতাড়ি পানি প্রবেশ করতে পারে।
গ. গোড়া ডুবান অথবা গোড়া থেতলান : আঁশ শুকানোর পর দেখা যায় গোড়ার দিকে কিছু অংশ ছালযুক্ত অবস্থায় রয়ে গেছে। এ ছালযুক্ত অংশকে কাটিং বলে। পাতা ঝরার পর পাট গাছের গোড়ার দিকে প্রায় ৪৫ সেন্টিমিটার বা দেড় ফুট পরিমাণ অংশ ৩-৪ দিন পানির নিচে ডুবিয়ে রাখতে হয়। এতে গোড়ার অংশ অনেক নরম হয়ে যাবে। পাট গাছের গোড়ার প্রায় ৪৫ সেন্টিমিটার বা দেড় ফুট পরিমাণ অংশ একটি কাঠের হাতুড়ির সাহায্যে সামান্য থেতলানোর পর আঁটিগুলোকে পানির নিচে ডুবিয়ে দিতে হয়।
ঘ. পানি নির্বাচন : যে পানি খুব পরিষ্কার এবং তার মধ্যে অল্প স্রোত থাকে সে পানি পাট পচনের জন্য সবচেয়ে ভালো। কোনো নিকটবর্তীস্থান এ ধরনের পানি থাকলে সে পানিতে পাট পচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঙ. জাক তৈরি ও ইউরিয়া ব্যবহার : জাক তৈরির সময় পাটের আঁটিগুলোকে প্রথম সারিতে লম্বালম্বিভাবে সাজাতে হবে। দ্বিতীয় সারিতে আড়াআড়িভাবে সাজাতে হবে। তৃতীয় সারিতে আবার লম্বালম্বিভাবে সাজাতে হবে। এভাবে জাক তৈরি করলে পানি এবং পচন জীবাণু জাকের মধ্যে সহজে চলাফেরা করতে পারে। বদ্ধ পানিতে বা ছোট পুকুর বা ডোবার পাট পচালে ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হবে। এতে পাট তাড়াতাড়ি পচে এবং আঁশের রঙ ভালো হয়। প্রতি ১০০ আঁটি কাঁচা পাটের জন্য প্রায় ১ কেজি ইউরিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে। ইউরিয়া সার কোনো পাত্রে গুলে পানিতে মিশেয়ে অথবা সরাসরি জাকের আঁটির সারিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।
চ. পচন নির্ণয় : পাট পচনের শেষ সময় ঠিক করা অর্থাৎ পচন সমাপ্তি নির্ণয় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পাট খুব বেশি পচলে আঁশ নরম হয় আবার খুব কম পচলে আঁশের গায়ে ছাল লেগে থাকে। কাজেই এমন সময় পচন থামাতে হবে যখন আঁশগুলো একটার সাথে আর একটা না লেগে থাকে কিন্তু শক্ত থাকে। জাক দেয়ার ৮-১০ দিন পর থেকে জাক পরীক্ষা করা উচিত। ২-৩টি পাট জাক থেকে বের করে ধুয়ে আঁশ পরীক্ষা করলে পচনের শেষ সময় ঠিক করা যায়। পচা পাটের মধ্যাংশ থেকে ১ ইঞ্চি বা আড়াই সেন্টিমিটার পরিমাণ ছাল কেটে ছোট শিশির ভেতর পানি দিয়ে ঝাঁকানোর পর শিশির পানি ফেলে আবার পরিষ্কার পানি দিয়ে ঝাঁকিয়ে যদি দেখা যায় যে আঁশগুলো বেশ পৃথক হয়ে গেছে তখন তখন বুঝতে হবে যে পচন শেষ হয়েছে। বেশি পচনের চেয়ে একটু কম পচন ভালো।
০২. অপর্যাপ্ত পানি অঞ্চলে পাটের ছাল পচন পদ্ধতি :  বিরন পদ্ধতি : ক. রিবন পদ্ধতিতে কাঁচা থাকাবস্থায় গাছ থেকে ছাল পৃথক করে নেয়া। ছালগুলোকে তিনভাবে পচানো যায় ক. বড় মাটির চাড়িতে ছালগুলোকে গোলাকার মোড়া বেঁধে সাজিয়ে রেখে পরিষ্কার পানি দিয়ে চাড়িটি ভরে দিতে হবে। একটি বড় চাড়িতে প্রায় ৩০ কেজি ছাল পচানো যায়। খ. যদি আশপাশের ছোট ডোবা বা পুকুর বা খাল বা কম গভীরতা স¤পন্ন জলাশয় থাকে তবে ছালগুলোকে গোলাকৃতি মোড়া বেঁধে একটা লম্বা বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে পচানো যাবে। গ. বাড়ির আশপাশে অথবা ক্ষেতের পাশে ১৫-১৬ ফুট লম্বা, ৬-৮ ফুট প্রস্ত এবং ২ ফুট গভীর গর্ত খুঁড়ে গর্তের তলা ও কিনারা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিয়ে যে কোনো স্থান থেকে পরিষ্কার পানি দিয়ে গর্তটি ভরে সেখানে ছালগুলো পচানো যায়। সম্ভব হলে কচুরিপানা দিয়ে ছালের মোড়াগুলো ঢেকে দেয়া যায়।
আঁশ ছাড়ানো প্রক্রিয়া : পচন শেষে শুকনা জায়গায় বসে একটা একটা করে আঁশ ছাড়ানো যেতে পারে অথবা, পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে বাঁশের আড়ার সাহায্যে এক সাথে অনেকগুলো গাছের আঁশ ছাড়ানো যায়। যে পদ্ধতিতেই আঁশ আঁশ ছাড়ানো হোক না কেন আঁশ ছাড়ানোর সময় গাছের গোড়ার আঁশের পচা ছাল হাত দিয়ে চিপে টেনে মুছে ফেলে দিলে গোড়ার শক্ত অংশের পরিমাণ অনেক কম হয়। এছাড়া আঁশ ছাড়ানোর সময় পাট গাছের গোড়ার অংশ এক টুকরা শক্ত কাঠ বা বাঁশ দিয়ে থেতলে নিলে আঁশের কাটিংসের পরিমাণ অনেক কম হয়। গাছ থেকে একটি একটা করে আশ ছাড়ালে আঁশের গুণাগুণ ভালো হয়।
কম সময়ে ছাল পচানো : পচন সময় দুইভাবে কমানো যায়Ñ১. প্রতি ১০০ মণ বা ৩৭৩২ কেজি কাঁচা ছালের জন্য ০.৫ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার করুন। ২. অথবা একটা ছোট হাঁড়িতে দুই একট পাট গাছ ছোট ছোট টুকরা করে পচিয়ে নিন এবং পরে ছাল পচাবার সময় ওই পানি ব্যবহার করুন। ছাল পচতে খুব কম সময় লাগে, কাজেই ছাল পানিতে ডুবানোর ৭-৮ দিন পর থেকে পরীক্ষা করতে হয়। দু-একটা ছাল পানি থেকে তুলে ভালো করে ধুয়ে দেখতে হবে যদি আঁশগুলোকে বেশ পৃথক পৃথক মনে হয় তখনই বুঝতে হবে পচন সময় শেষ হয়েছে। সাধারণত ছাল পচনে ১২-১৫ দিন সময় লাগে। মনে রাখতে হবে পাট আঁশের গুণাগুণের ওপরই প্রকৃত মূল্য পাওয়া নির্ভর করে।
আঁশ ধোয়া ও শুকানো : আঁশ ছাড়ানোর পর আঁশগুলোকে পরিষ্কার পানিতে ধোয়া উচিত। ধোয়ার সময় আঁশের গোড়া সমান করে নিতে হবে। এমনভাবে আঁশ ধুতে হবে যেন কোনো রকম পচা ছাল, ভাঙা পাট-খড়ি, অন্য কোনো ময়লা, কাদা আঁশের গায়ে লেগে না থাকে। কারণ এতে পাটের মান নষ্ট হয় এবং বাজারে এসব আঁশের চাহিদও কমে যায়। আঁশ ধোয়ার পর খুব ভালো করে আঁশ শুকানো উচিত। আঁশ কখনও মাটির ওপর ছড়িয়ে শুকানো উচিত নয়, কারণ তাতে আঁশে ময়লা, ধুলো-বালি লেগে যায়। বাঁশের আড়ায়, ঘরের চালে, ব্রিজের রেলিং বা অন্য কোনো উপায়ে ঝুঁলিয়ে ভালোভাবে আঁশ শুকাতে হবে। ভেজা অবস্থায় আঁশ কখনই গুদামজাত করা উচিত নয়। কারণ এতে আঁশের মন নষ্ট হয়ে যায়।

কৃষিবিদ ড. মো. মাহবুবুল ইসলাম*
*মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বিজেআরআই, ঢাকা-১২০৭;
mahbub_agronomy@yahoo.com

বিস্তারিত
খাদ্যে পুষ্টি আমাদের কাঙ্ক্ষিত তুষ্টি

জীবনে বাঁচার জন্য আমরা খাবার খাই। খাবারের মধ্যে আছে সস্তা খাবার, বাজে খাবার এবং পুষ্টিসম্মত সুষম খাবার। আবার দামি ও সস্তা খাবারও আছে। সবচেয়ে বেশি ভালো পুষ্টিসম্মত সুষম খাবার। অনেকে মনে করেন পুষ্টিসম্মত সুষম খাবার খেতে হলে খরচ বেশি পড়বে অনেক দামি হবে। কথাটা কিন্তু মোটেই ঠিকনা। বুদ্ধি জ্ঞান দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে বিবেচনা আর ভেবে-চিন্তে তালিকা করলে কম দামেই প্রয়োজনীয় সুষম পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের জোগান দেয়া যায় খাওয়া যায়। খাবারের প্রতি আমাদের যেমন অতি রসনা বিলাস আর আগ্রহ আছে পুষ্টির প্রতি কিন্তু তেমনটি নেই। সে কারণেই পুষ্টি নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় অহরহ। আমাদের দেশে পুষ্টিতে যেমন ভুগছি আবার অতিপুষ্টিতেও ভুগছি কেউ কেউ। এ শুধু পুষ্টি জ্ঞানের অভাবেই এমনটি হয়। একটু বিবেচনা পরিকল্পনা আর মেধা দক্ষতা খাটালে আমরা নিয়মিত পরিমিত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খেয়ে ভালোভাবে সুস্থ সবল হয়ে বেঁচে থাকতে পারি, হাজারো অসুখ-বিসুখ রোগবালাই থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি। আসলে আমাদের প্রয়োজন দৈহিক, মানসিক আর বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজনে খাদ্য গ্রহণ।


বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও শিশু ও মাতৃপুষ্টি নিশ্চিতকরণ এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যের সমন্বয়ে পরিপূর্ণ পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ এখনও বিরাট চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে শিশু পুষ্টির জন্য মায়ের দুধ পান ও পরিপূরক খাবার গ্রহণের হার এখনও অপ্রতুল। ব্যক্তির খাবারে খাদ্য উপাদান যথাযথ পরিমাণে না থাকা  বা অতিরিক্ত থাকা অপুষ্টি এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ। সুষম খাদ্য নির্বাচন ও গ্রহণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলো সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। খাদ্যের সাথে সুস্বাস্থ্যের সম্পর্ককে সঠিকভাবে প্রকাশ করার জন্য এখনও গবেষণার প্রয়োজন। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বর্তমানে ২ রকমের অপুষ্টির শিকার। খাদ্যের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা এবং খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক  রোগগুলো। খাদ্যের অভাবজনিত উল্লেখযোগ্য পুষ্টিহীনতার মধ্যে রয়েছে খর্বকায়, নিম্ন ওজন এবং কৃশকায়। খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগগুলো হলো স্থূলতা, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার ও বেশি বয়সে হাড় নরম হয়ে যাওয়া।


খাদ্য গ্রহণের  সাথে জড়িত অপুষ্টি এবং খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি রোগের হার কমানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, নিজস্ব খাদ্যাভ্যাসের সাথে মিল রেখে প্রতিটি দেশের একটি খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন। জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টিনীতি এবং বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা ১৯৯৭ এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা প্রকাশ। খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলোর মৃত্যুহার অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর হারের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এজন্য বাংলাদেশ জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি ও পুষ্টি সংক্রান্ত বিনিয়োগ পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) এবং জাতীয় পুষ্টিনীতি ২০১৫ তে জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা প্রকাশকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এছাড়াও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিটি জাতিকে নিজস্ব খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকায় বিশেষ কতগুলো তথ্যযুক্ত করার পরামর্শ দেয়। সাম্প্রতিক খাদ্যের অভাবজনিত অপুষ্টির চিত্র, খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি রোগের হার, সাম্প্রতিক খাদ্য গ্রহণের ধরন, এছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকাশিত বিভিন্ন বয়সের খাদ্য উপাদানের চাহিদা, মৌসুমি খাবার এসব অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বর্তমান খাদ্য উপাদানের চাহিদা, মৌসুমি খাবার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বর্তমান খাদ্য নির্দেশনা করা হয়েছে। গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রণীত খাদ্য গ্রহণ নির্দেশনা উন্নত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে সাহায্য করবে।


আঞ্চলিক খাদ্যাভাসের সাথে খাদ্য বৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দেয়া দরকার। মৌলিক খাদ্যগুলো অর্থাৎ ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, দুধ ডিম, ডাল, শাকসবজি ও ফলমূল সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে। খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য বিনিময় ও পরিবেশনের ওপর গুরুত্ব দেয়া জরুরি। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রত্যেক খাদ্য বিভাগ থেকে পরিমিত পরিমাণে খাদ্য গ্রহণকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। পুষ্টিসম্মত খাদ্য গ্রহণের লক্ষ্যগুলো হলো- বাংলাদেশের জনগণের পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়ন এবং পুষ্টি উপাদনের অভাবজনিত রোগগুলো প্রতিরোধ করা; গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী মায়েদের যথাযথ পুষ্টিগত অবস্থা বজায় রাখা; শিশুদের সঠিকভাবে মায়ের দুধ ও পরিপূরক খাবার  খাওয়ানো  নিশ্চিত করা; খাদ্যাভ্যাসের সাথে সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলো প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা; বয়স্কদের সুস্বাস্থ্যের সাথে আয়ুষ্কাল বাড়ানো। বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশের বেশি শিশু প্রোটিন ও ক্যালরিজনিত পুষ্টিহীনতায় ভোগে, যার মধ্যে খর্বাকৃতি ৩৬ শতাংশ, কৃষকায় ১৪ শতাংশ এবং নিম্ন ওজনে রয়েছে ৩৩ শতাংশ। গড়ে এক চতুর্থাংশ মহিলা দীর্ঘস্থায়ী ক্যালরিজনিত অপুষ্টিতে ভোগে, যাদের অধিকাংশেরই দেহে একই  সাথে জিংক, আয়রন ও আয়োডিনের স্বল্পতা রয়েছে। এসব আমাদের সর্তকতার সাথে লক্ষ রাখতে হবে।
 

আদর্শ খাদ্য গ্রহণের জন্য...
জনগণের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য খাদ্য গ্রহণ ১০টি নির্দেশাবলি এবং পুষ্টিবার্তা আছে। যা সাধারণ জনগণের জন্য সহজবোধ্য । এটি পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে  সময়োপযোগী ধারণার প্রেরণা জোগাবে। এর মাধ্যমে জনগণ কোন খাদ্য কি পরিমাণ গ্রহণ করবে, প্রতিদিন কি পরিমাণ তেল, লবণ, চিনি ও পানি গ্রহণ করবে সেই সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা পাওয়া যাবে। এতে বিভিন্ন খাদ্যের সুফল ও কুফল সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়া  হয়েছে। নির্দেশাবলিতে নিরাপদ খাদ্য ও রান্না সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা  দেয়া হয়েছে, যা প্রয়োগ করলে খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের অপচয় রোধ হবে এবং  সুস্বাস্থ্য বজায় থাকবে। প্রতিদিন সুষম ও বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য গ্রহণ; পরিমিত পরিমাণে তেল ও চর্বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ; প্রতিদিন সীমিত পরিমাণে আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ; মিষ্টিজাতীয় খাদ্য সীমিত পরিমাণ গ্রহণ; প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে  নিরাপদ পানি ও পানীয় পান; নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ; সুষম খাদ্য গ্রহণের  পাশাপাশি নিয়মিত শারীরিক শ্রমের মাধ্যমে আদর্শ ওজন বজায় রাখা; সঠিক পদ্ধতিতে রান্না, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং সুস্থ জীবনযাপনে নিজেকে অভ্যস্তকরণ; গর্ভাবস্থায় এবং স্তন্যদানকালে চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি খাদ্য গ্রহণ; শিশুকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ দিন এবং ৬ মাস পর বাড়তি খাদ্য প্রদান।

 

প্রতিদিনের সুষম ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পুষ্টি...
প্রতিদিন চাহিদা অনুযায়ী ভাত, রুটি বা অন্যান্য শস্যজাতীয় খাদ্য গ্রহণ; ভাত ও রুটির সাথে ডাল-মাছ-মাংস-ডিমজাতীয় খাবারের সমন্বয়ে তৈরি খাদ্য গ্রহণ; চাল অতিমাত্রায় না ধুয়ে বসাভাত রান্না ও গ্রহণ; লাল চাল ও লাল আটা হলো প্রোটিন, আঁশ, তেল, খনিজ লবণ ও ভিটামিনের উৎস সে জন্য পারতপক্ষে এগুলো বেশি করে গ্রহণ। প্রতিদিন মাঝারি আকারের ১-৪ টুকরা মাছ-মাংস এবং ১ থেকে ১/২ কাপ ডাল (৩০-৬০ গ্রাম) গ্রহণ; প্রাণিজ প্রোটিনের অনুপস্থিতিতে ভাত ও ডাল অথবা মুড়ি ও ছোলার ওজনের আদর্শ অনুপাত ৩:১ বজায় রাখা; প্রতিদিন কমপক্ষে ২টি মৌসুমি ফল (১০০ গ্রাম) গ্রহণ করা। ১টি চাপা কলা, ১টি আমড়া এসব খাওয়া; খাদ্য গ্রহণের পর আয়রনের পরিশোষণ বাড়ানোর জন্য ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন আমলকী, পেয়ারা, জাম্বুরা, পাকা আম খাওয়া; প্রতিদিন অন্তত ১০০ গ্রাম বা  ১ আঁটি শাক এবং ২০০ গ্রাম বা ২ কাপ সবজি গ্রহণ; সুস্থতার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ১ কাপ (১৫০ মিলিলিটার) দুধ বা আধা কাপ দই গ্রহণ; বৃদ্ধকালে ননিতোলা দুধ এবং সয়াদুধ গ্রহণ করুন।


তেল ও চর্বিজাতীয় পুষ্টিবার্তা : প্রতিদিন প্রাপ্ত বয়স্ক জনপ্রতি গড়ে ৩০-৪৫ মিলিলিটার বা ২-৩ টেবিল চামচ তেল গ্রহণ; রান্নায় প্রধানত উদ্ভিজ তেল  যেমন- সরিষা, সয়াবিন, রাইসব্রান তেল ব্যবহার; ঘি, ডালডা ও মাখন যথাসম্ভব কম ব্যবহার; অতিরিক্ত ভাজা এবং তৈলাক্ত খাবার বর্জন; নিয়মিত উচ্চ চর্বিযুক্ত বেকারির খাদ্য কেক, পেস্ট্রি, ফাস্টফুড, হটডগ, বার্গার, উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাদ্য পরোটা, কাচ্চি, বিরিয়ানি, পোলাও, কোরমা, রেজালা, প্রক্রিয়াজাত মাংস, গ্রিল চিকেন এসব পরিহার করা। এ খাবারগুলোতে ট্রান্সফ্যাট থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; বাজারের সনদবিহীন খোলা তেল গ্রহণ থেকে বিরত থাকা আবশ্যকীয়।


আয়োডিন ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্যের পুষ্টিবার্তা   প্রতিদিন ১ চা চামচের কম পরিমাণ আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ; খাবারের সময় বাড়তি লবণ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা; উচ্চমাত্রার লবণাক্ত খাদ্য বাদ দেয়া বা সীমিত পরিমাণে গ্রহণ; টেস্টিং সল্ট গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা। দৈনিক ২৫ গ্রাম বা ৫ চা চামচ এর কম পরিমাণে চিনি গ্রহণ করা; মিষ্টি কোমল পানীয় বর্জন করা;  বেকারির তৈরি খাবার বিস্কুট, কেক, জ্যাম জেলি, চকলেট, ক্যান্ডি মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্য সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা; বিভিন্ন প্রকার মৌসুমি ফল খেয়ে প্রাকৃতিক চিনি গ্রহণকে উৎসাহিত করা। আর পানি গ্রহণ সংক্রান্ত পুষ্টিবার্তা হলো- প্রতিদিন ১.৫-৩.৫ লিটার অর্থাৎ ৬-১৪ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করা; কোমল পানীয় এবং কৃত্রিম জুসের পরিবর্তে ডাবের পানি অথবা টাটকা ফলের রস পান করা বেশি পুষ্টিসম্মত।


গর্ভবতী নারীর জন্য...
গর্ভাবস্থায় আয়রন সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন মাংস, বুটের ডাল, পাটশাক, কচুশাক, চিড়া গ্রহণ; এ সময় মৌসুমি ফল বিশেষ করে খাবারের পর পর খাওয়া; চা, কফি প্রধান দুই খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে গ্রহণ; গর্ভাবস্থায় সঠিক ওজন বৃদ্ধি বজায় রাখা; একবারে খেতে না পারলে বারে বারে খাওয়া; খাবার সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার এড়িয়ে চলা; নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও চেকআপ করানো।

 

শিশুদের জন্য...
শিশু জন্মের পর ১ ঘণ্টার মধ্যে শাল দুধ পান করানো; শিশুর বৃদ্ধির জন্য ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো; প্রসূতি মায়ের জন্য পারিবারিকভাবে আন্তরিক সহযোগিতা ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা; শিশুর ৬ মাস পূর্ণ হলে মায়ের দুধের পাশাপাশি যথাযথ পরিপূরক খাবার আলুসিদ্ধ, ডিমসিদ্ধ, পাকাকলা, খিচুড়ি দেয়া এবং ২ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানো; ১ বছর বয়স থেকে শিশু নিজে নিজে খাবে, জোর করে খাওয়ানো ঠিক নয়; শিশুকে কোমল ও মিষ্টি পানীয় দেয়া থেকে বিরত রাখা কেননা এগুলো দাঁতের ক্ষয় ঘটায়; স্তন্যদাত্রী মাকে ধূমপান, মদ্যপান, তামাক ও ক্ষতিকর ওষুধ সেবন থেকে বিরত রাখা।


পুষ্টিসম্মতভাবে রান্না...
সবজি রান্নার জন্য উচ্চ তাপে ও কম সময়ে রান্নার পদ্ধতি অনুসরণ করা; ভাঁপানো এবং সেঁকা খাবার বেশি পুষ্টিসম্মত; কাটার পরে ফল ও সবজি বাতাসে খোলা অবস্থায় না রাখা; রান্নার সময় ঢাকনা ব্যবহার করা; কম পানিতে কম মশলায় রান্না করা; ভাজায় ব্যবহৃত তেলে পুনঃব্যবহার এড়িয়ে চলা; রান্নার পর খাদ্যাভাসের জন্য : খাবার সময়মতো গ্রহণ এবং অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ এড়িয়ে চলা; খাবার ভালোমত চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস কার; খাবারের শেষে মৌসুমি ফল খাওয়া; কম বয়সী ও বৃদ্ধদের অতিরিক্ত খাবার খাওয়ানো থেকে বিরত রাখা।

 

সুস্থ জীবনযাপনে...
খাবারের পরপরই ঘুমানোর অভ্যাস বাদ দেয়া এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য দৈনিক ৬-৮ ঘণ্টা সুনিদ্রার অভ্যাস করা; দৈনিক কমপক্ষে ৩০-৪৫ মিনিট  শারীরিক পরিশ্রম করা; ধূমপান, মদ্যপান, তামাক এবং সুপারি চিবানোর মতো অভ্যাসগুলো বাদ দেয়া; খাওয়ার আগে, খাওয়ার পরে, রাথরুম ব্যবহারের পরে এবং বাইরে থেকে বাড়িতে ঢুকে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করা; প্রতি সপ্তাহে একবার নখ কাটা; ২ বছর বয়স থেকে প্রত্যেকে (গর্ভবর্তী মা ব্যতীত) ৬ মাস পরপর একবার কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাবারের পর গ্রহণ করা; বছরে অন্তত একবার পুরো শরীর মেডিকেল চেকআপ করানো আবশ্যকীয়।

 

নিরাপদ খাদ্য গ্রহণে...
বাসি, পচা ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের ফলে মানুষের মারাত্মক অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাকের আক্রমণ খাদ্য ও পানীয়কে বিষাক্ত করে তোলে। ইঁদুর ও বিষাক্ত পোকামাকড় খাদ্যকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। খাদ্য তৈরিতে নিয়োজিত ব্যক্তির উন্মুক্ত কাটাস্থান ও ক্ষত এবং ব্যক্তিগত অপরিচ্ছন্নতার কারণে খাদ্য দূষিত হয়। ধুলাবালি, মশামাছিও খাদ্যকে দূষিত করে। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর স্থানে মুরগি ড্রেসিং এর সময় জীবাণু  দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। অতিরিক্ত  হরমোন প্রয়োগে গরু ও মহিষ মোটাতাজা করা হয়, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। বাদুড় ও পাখি খেজুর ও তাল গাছের রসকে বিষাক্ত করে ফেলে যা জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। অনেক সময় জুস, খোলা সরবত ও কোমল পানীয় তৈরিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মানা হয় না। যার ফলে খাদ্যবাহিত বিভিন্ন রোগ টাইফয়েড, ডায়রিয়া, আমাশয় এসবে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও খাদ্যে ভেজাল দ্রব্য মিশ্রণ, অনুমোদনবিহীন ও মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রঙ ও গন্ধের ব্যবহার করা হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।


ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ও রঙ ব্যবহারের মাধ্যমে নষ্ট, বাসি ও নিম্নমানের খাবরকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। টিনজাত ও প্যাকেটজাত খাদ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ যেমন- টেস্টিং সল্ট, ট্রান্সফ্যাট ছাড়াও অনুমোদনবিহীন ও মাত্রাতিরিক্ত  খাদ্য সংযোজন দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, যা দেহে স্থূলতা, স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। আমাদের দেশে অধিক মুনাফার জন্য শাকসবজি ও ফলফলাদি মৌসুমের আগে বাজারজাত করার জন্য অননুমোদিত কিংবা মাত্রাতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়। অন্যদিকে শাকসবজি ফলফলাদি, মাছ এসব পচনশীল খাদ্যে ফরমালিনের অপব্যবহার হয়ে থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্রাকৃতিকভাবে পরিপক্ব ফল ও শাকসবজিতেই পুষ্টিগুলো পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায়। খাবার প্রস্তুত ও গ্রহণকালে খাদ্য নির্বাচন, লেবেল, খাদ্য সংরক্ষণ, উৎপাদন ও মেয়াদ, খাদ্য হস্তান্তর এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত জ্ঞান ও ধারণা খাদ্যকে নিরাপদ করে এবং সুস্বাস্থ্য অটুট রাখতে সাহায্য করে।


নিরাপদ পুষ্টিবার্তা : ভরা মৌসুমে পরিপক্ব শাকসবজি ও ফলমূল ক্রয় করুন যা  পুষ্টিতে পরিপূর্ণ এবং সাশ্রয়ী; খাদ্য গ্রহণের আগ পর্যন্ত পচনশীল খাদ্যকে ফ্রিজে বা ঠা-া জায়গায় রাখা; দূষিত পানি দ্বারা তৈরি এবং জীবাণুযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা; মাছ, মাংস, শাকসবজি ও ফলমূল ক্রয় করার সময় যথাসম্ভব রঙ, গন্ধ ও আকার যাচাই করা; কাটা, ক্ষতযুক্ত খাদ্যদ্রব্য ও পাখি দ্বারা দূষিত খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা; ঢাকনাবিহীন বা খোলা খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের সাথে শারীরিক কসরতের ও প্রয়োজন আছে অনেক। কেননা সুস্থ থাকার জন্য নিয়মিত ও পরিমিত ব্যায়াম করা খুব জরুরি। সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিদিন শারীরিক পরিশ্রম করা একান্ত প্রয়োজন। সেজন্য আমাদের প্রতিদিন- গৃহস্থালির কাজকর্ম করা; যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা; প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটে ২-৩ মাইল হাঁটা, ব্যায়াম করা; লিফট বা চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহারের পরিবর্তে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। সুষম খাদ্য গ্রহণ এবং শারীরিক শ্রমের সমন্বয়ে আদর্শ ওজন বজার রাখা; প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪৫ মিনিট বিভিন্ন শারীরিক শ্রম যেমন- হাঁটা, দৌড়ানো ব্যায়াম করা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা এসবে অভ্যস্ত হওয়া: খাদ্য গ্রহণের পরে হালকা শারীরিক শ্রম যেমন  হাঁটা অথবা ঘরের কাজকর্ম করা খুব দরকার।
প্রাপ্ত বয়স্কদের খাবার পুষ্টিসম্মত এবং পুষ্টিবিদ অনুমোদিত হওয়া দরকার। পুষ্টিবিদরা বলেন প্রতি বেলায় প্লেটে একজন বয়স্ক মানুষের জন্য খাবারের তালিকায় থাকবে ৪০০ গ্রাম ভাত (৫৩ শতাংশ); ৫০ গ্রাম মৌসুমি ফল (৭ শতাংশ); ২০০ গ্রাম মিশ্রিত সবজি (১৫ শতাংশ); ২০ গ্রাম ডাল (৪ শতাংশ); ৫০ গ্রাম মাছ-মাংস-ডিম (৬ শতাংশ); ১০০ গ্রাম শাক (১৫ শতাংশ)। এভাবে হিসাব করে খেলে আমরা পুষ্টিসম্মত খাবার খেয়েছি বলে ধরে নেয়া হবে এবং আমরা সুস্থ থাকব। আসলে নিয়ম মেনে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খেলে আমরা সুস্থ থাকব প্রতিদিন প্রতীক্ষণ।
খাদ্য গ্রহণে আমাদের অনেক বদঅভ্যাস আছে। যেমন যে খাবারটি আমরা বেশি পছন্দ করি তা বেশি খাই সব সময় খাই। খাবার টেবিলে আমাদের খাদ্যে ডাইভারসিটি কম। কিন্তু জরুরি দরকার বেশি সংখ্যক খাদ্যের সমাহার। প্রতিদিন প্রতি বেলায় কিছু শাকসবজি, ফল, আমিষ এসবের সাথে ভাত থাকতে পারে। এসবের প্রতি আইটেম কিছু কিছু খেলে রুচিও বদলাবে সাথে পুষ্টির সমাহারে আমরা উপভোগ করতে পারব। আমাদের আরেকটি ত্রুটি হলো আমার ৩ বেলা বেঁধে খাই। সকাল দুপুর রাত। কিন্তু নিয়ম হলো দিনভর সময় সুযোগ পেলে হালকা কিছু খাবার সব সময় খাওয়া। এতে পুষ্টিশক্তি সুষমতা রক্ষা পায় অনায়াসে। সতেজ বিষমুক্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের প্রতি আমাদের যেন বেশি নজর থাকে সে দিকে সতর্কতার সাথে লক্ষ রাখতে হবে। পুষ্টিসম্মত খাবার খেয়ে আমরা পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হব এটাই হোক আমাদের নিত্য এবং আন্তরিক ও কার্যকর অঙ্গীকার।

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*

*উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫ Subornoml @gmail.com

 

বিস্তারিত
খাবার ও জীবনাচরণে স্বাস্থ্যঝুঁকি

অতিথিপরায়ণতা আর রসনা বিলাসিতায় আমাদের সুনাম বিশ্বজুড়ে। এখনও দিনের অধিকাংশ সময়জুড়ে আমাদের চিরায়ত পারিবারিক রান্নাবান্নায় দাদি, নানি, মা, খালারা রান্নাঘরে  কাটান। মাটির চুলা জ্বালানোর জ্বালায় তাদের চোখের পানি আর নাকের পানি একাকার হয়ে যায়। চুলার কালো-ধূসর ধোঁয়া খেতে খেতে অকাতরে  তারা ভোজনবিলাসীদের জন্য ‘কচি পাঁঠা, বৃদ্ধ মেষ/দৈইয়ের আগা, ঘোলের শেষ’ তৈরি ও পরিবেশনে হেসে খেলে হেঁসেলের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে জীবন যৌবন অতিবাহত করেন। শেষকালে কাশি- হাঁপানিসহ  নানা  কষ্টকর রোগে ধুঁকে ধুঁকে ভোগা কপালের লিখন মনে করেন। বিজ্ঞজনের পরিসংখ্যান মতে, না খেয়ে যত না মানুষ মরে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি মরে খেয়ে বা বেশি খেয়ে।
 

গোপাল ভাঁড়ের ভাষ্য : ‘খাবার শুরু তিক্ত দিয়ে, সমাপ্তি মিষ্ট দিয়ে’। এখানে তিক্ততা মানে উচ্ছে বা করলার তিতা। স্বাস্থ্য সচেতন সনাতন প্রথানুসারে কেউ কেউ এখনও সকালে খালি পেটে চিরতা, ত্রিফলাসহ নানা ভেষজের তিক্তকষায় পানীয় অবলীলায় পান করেন। বাঙালি সংস্কৃৃতিতে ‘পহেলা বৈশাখ’ এর নাগরিক ঐতিহ্য ‘পান্তা-ইলিশ’ এখন বেশ সরগরম আইটেম। পান্তা গ্রাম বাংলার আদি ও অকৃত্রিম অনুসঙ্গ। মহার্ঘ্য ইলিশ; তার স্বাদ, জৌলুষ আর সৌরভের চেয়ে, পণ্য হিসেবে বেশি ধন্য। আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ওঠে এসেছে, ১২ ঘণ্টা পানিতে ভেজানো পান্তা ভাতে পুষ্টি উপাদন আয়রন, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের মাত্রা সাধারণ ভাতের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যায়। আধুনিক জীবনাচরণের কারণে বেড়ে চলা এসিডিটি, উচ্চ রক্তচাপ,  হৃদরোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, নিদ্রাহীনতাসহ নানা রোগ। পক্ষান্তরে ক্ষতিকর সোডিয়ামের পরিমাণ সে হারে কমে আসে। পান্তা যে শতভাগ ভালো, তা নয়। তবে এর দোষ তামাক আর অ্যালকোহলের ক্ষতির মাত্রার তুলনায় গনায় আনাই যায় না।
আমাদের জীবনযাত্রায় তামাকের অবাধ বিচরণ, আর অ্যালকোহল রেখে ঢেকে। বিশ্বে ক্যান্সারের প্রধান কারণ তামকজাত পণ্য। এর মধ্যে আছে ধূমপান এবং জর্দা গুলের মতো তামাক পাতা সরাসরি গ্রহণ। যদিও ক্যান্সারের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও অজানা। তবু যেসব কারণকে ক্যান্সারের জন্য দায়ী করা  হয়; তার অন্যতম কারণ তামাক গ্রহণ এবং বদলে যাওয়া জীবনাচরণ। পুরুষদের মুখে ও  ফুসফুসে ক্যান্সারের হওয়ার বড় কারণ ধূমপান। তা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ধূমপায়ী  বা  অন্য কোন ধোঁয়ার কাছাকাছি থাকার কারণেও মুখে ও  ফুসফুসে ক্যান্সার আক্রমণের শিকার হতে পারে। সঠিক জীবনযাপনের মাধ্যমে তিন ভাগের একভাগ ক্যান্সার থেকে নিরাপদে বাঁচা যায়। গ্রামে প্রাচীন বটের মতো যেসব মুরুব্বিজনরা এখনও বেঁচে আছেন, তাদের ঘরে ঢুকতেই যে ঘ্রাণ নাকে ঢুকবে, তা হলো সাদাপাতা তথা শুকনা তামাক পাতা আর পান সুপারির মঁ মঁ মন মাতানো গন্ধ। শতকরা ৮৫ ভাগ ক্যান্সার হয় তামাক পাতা ব্যবহারের জন্য। এর সাথে অ্যালকোহল যোগে বাড়ে আরও ঝুঁকি। যদিও  মুখে ও গলার ক্যান্সার রোগ; ক্যান্সার, ভাইরাস, রেডিয়েশন বা বংশগত কারণেও হতে পারে। সম্প্রতি (২০১৬-১৭) দেশের সর্বাধিক করদাতার আয়ের প্রধান উৎস জর্দা ব্যবসায়। যার মূল উপাদান প্রক্রিয়াজাতকরণকৃত তামাক পাতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় জানা যায়, বিড়ি সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যে ৪০০০ এর বেশি ক্ষতিকর উপাদান আছে, যার মাঝে ৪৩টি সরাসরি ক্যান্সার সৃষ্টির সাথে জড়িত। ৩০ ভাগ ক্যান্সারের জন্য দায়ী ধূমপানসহ তামাক সেবন। তাই ২০০৬ সাল থেকে ৪ ফ্রেরুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস হিসাবে পালন করছে। ১৯৮৮ সাল থেকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বজুড়ে তামাকের  ব্যবহার কমানোকে উৎসাহিত করার জন্য ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করে আসছে। জরুরি পদক্ষেপ নেয়া না হলে ২০৩০ সাল নাগাদ  বিশ্বে তামাকজনিত কারণে প্রতি বছর মারা যাবে। আমাদের দেশের আদিবাসী ও গ্রামাঞ্চলে তামাক এবং তামাক সামগ্রীর ব্যবহার  ব্যাপক। পান সুপারিতে মরণব্যাধি ক্যান্সারের উদ্দীপক বিদ্যমান। কারও মতে, পান রুচি বর্ধক, ক্যান্সার প্রতিরোধক। সুপারি  স্ট্রোকসহ নানা রোগ প্রতিকারে সহায়ক। চুনে আছে ক্যালসিয়াম। হাঁড় ও  দাঁত গঠনে যা অপরিহার্য। শরীরে এসিডিটির ভারসাম্যে  তার প্রয়োজন। চা, কফিও  উদ্দীপক। কিন্তু অধিক হারে এসব দেহের জন্য খুব একটা সুখকর নয়।
ভেজা বা আর্দ্র বাসি পচা খাবারে মৃতজীবী  ছত্রাকের আফলা টক্সিন নামের বিষ অধিক্ষেপের সম্ভাবনা  প্রচুর। চাল, গম ভুট্টা ১২ শতাংশ বেশি আর্দ্রতায় বেশ কিছু দিন  থাকলে  তাতে আফলা টক্সিন অধিক্ষেপ পড়তে পারে। সাধারণভাবে পান যে ভেজা পাত্রে  মুড়িয়ে রাখা হয় তাতে দু-একটি পাতা পচে মৃতজীবী ছত্রাকের বাহনের কাজ করে। আর আমাদের মাঝে যারা বেশি পান খান তাদের বেশ একটি অংশ কাঁচা সুপারি পছন্দ করেন। কেউ কেউ আবার বেশ কয়েক দিন পানিতে ভিজিয়ে মজা গন্ধযুক্ত সুপারি পানের সাথে চিবানো পছন্দ করেন। তাছাড়াও পাকা সুপারি কাটার সময় দোকানিরা  কাটার সুবিধার জন্য সুপারি নরম রাখতে আর অসাধু বেপারিরা ওজন বাড়াতে সুপারিকে ভিজিয়ে রাখে। তাতে সাদা, মেটে বা সবুজ রঙের  আফলা টক্সিন/ফাইটো টক্সিন জন্মানো বিচিত্র কিছু নয়।
আধুনিক জীবনে অতিরিক্ত উচ্চ ক্যালরিযুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবারে মুখরোচক করার জন্য চাইনিজ লবণ, ঘন চিনি ও  অতি ভাজা তেলের পরিমাণ থাকে প্রচুর। তাতে ফাইবার থাকে খুবই কম। কোমল পানীয় এবং মিষ্টিজাতীয় খাবারে চিনির বাড়তি ব্যবহার দেহের ওজন ও স্থূলতা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। রেডমিট বা  লাল মাংশ অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়াও  স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম কারণ। মাছ, হাঁস মুরগির মাংশ বা আমিষ  নিরাপদ। তাই গ্রাম বাংলার বিধবা এবং বয়স্করা অধিক তেল-মশলা ও প্রাণিজ আমিষ যথাসম্ভব এড়িয়ে অনেকটা  নিরামিষভোজী। যা অধুনা পুষ্টি বিশেষজ্ঞগণের মতাদর্শের সাথে দারুণভাবে মিলে যায়। পুষ্টিকর খাবারও আজকাল নানা দোষে দুষ্ট। ইঙ্গ-পাক আমলের শোষণের পরেও ষাটের দশক অবধি, গ্রামের সাধারণ কৃষকের ছিল গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ। জমিতে যেসব ফসল ফলতো সার বলতে ছিল গোবর,  চুলার ছাই, খড় পেড়ানো  আর সরিষার খৈল। অর্থকরী ফসল পাটের পাতা ও ধানের নাড়া ‘প্রকৃতির লাঙ্গল’ কেঁচো  জমিতে পচিয়ে  জমির উর্বরতা বাড়িয়ে দিত। শিয়ালের লোভ  ছিল গৃহস্থের খোয়াড়ের হাঁস মুরগি। জমিতে ইঁদুর  খেকো পেঁচা বসার জন্য কলা গাছ এবং পোকা দমনে খাদক পাখির  বসার জন্য কঞ্চি পুঁতে দেয়া হতো। পশুপাখিদের ভয় দেখাতে বসানো হতো কাকতাড়ুয়া। ফসল তোলার পর নাড়া পুড়িয়ে উফরাসহ নানা রোগজীবাণু ও পোকার বংশ ধংশ করে মাটি শোধন এবং  পটাশ সারের জোগান দেয়া হতো। পর্যায়ক্রমিক ফসল আবাদ মাটি ও পরিবেশবান্ধব ছিল। অগ্রহায়ণের নবান্নের চাল কোটা হতো ঢেঁকিতে । ঢেঁকিছাঁটা  চালে  থেকে যেতো  পুষ্টি উপাদন। তা ছিল অরগানিক কৃষির স্বর্ণ যুগ, আর আবাহমান বাংলার প্রকৃত রূপ।

বর্তমানে অরগানিক আবাদের বদলে অধিক ফলন আর মুনাফার আশায় অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে নির্বিচারে রাসায়নিক  সার, বালাইনাশক, হরমোন প্রভৃতি রাসায়নিকের ব্যবহার করে মাটি, পানি, বায়ু ও ফসলকে ক্রমশ বিষাক্ত করে তুলছি। ইউরিয়ার বর্জ্য মিশে যাচ্ছে  জলাশয় ও ভূতলের পানিতে। বাড়ছে মিথেনসহ নানা বর্জ্য। পুষ্টি জোগানোর জন্য পয়সা দিয়ে  শাকসবজি, মাছ মাংশ, ফলফলাদি কিনছি। খাচ্ছি বিষ। পানির অপর নাম জীবন। আমাদের  শরীরের বিপুল অংশ পানি। বেদ, বাইবেল, কোরআন ধর্মগ্রস্থে পানি দিয়ে পবিত্রতার বর্ণনা আছে, আছে পানি নিয়ে নানা বাণী ও কাহিনী। মিথ যুগের ইলিয়ড, ওডিসি,  গিলগিমিশ, মহাভারত,  রামায়ণ, শাহনামা প্রভৃতি মহাকব্যে এমনকি স্মরণকালের মেঘনাথ বধ, কারাবালা গ্রন্থেও পানির সাথে মানুষের সম্পর্ক এসেছে নানাভাবে। ধর্মীয়ভাবে,  মুসলমানের কাছে জমজমের পানি এবং হিন্দুদের কাছে গঙ্গাজল মহাপবিত্র। বাস্তব জীবনে খাদ্য পুষ্টির অন্যতম উপকরণ পানি। পৃথিবীর শতকরা ৭৭ ভাগই পানি। এ পানির অতি, অতি  ও অতিখুদে অংশ আমাদের জীবনধারণে অতিব প্রয়োজনীয়। তাও  নানা  দূষণ  আমাদের  নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কৃষিতে, শিল্পে ও জীবনযাত্রার কাজে চাহিদার অতিরিক্ত হারে ভূতলের পানি উত্তোলন চলছে। মাটির স্বল্পতলের পানিতে আর্সেনিকসহ বিভিন্ন ভারি ধাতবলবণ মিশে পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে। অন্যদিকে কলকারখানার বর্জ্যে মাটি, পানি, বায়ু তথা পরিবেশ হচ্ছে সব প্রাণীর বাসের অযোগ্য। নদী ও জলাশয়ের পানি তলানিতে, সাগরের পানি বাড়ছে। আফ্রিকা ও ভারতে খাবার পানির জন্য মেয়েরা যোজন যোজন পথ পাড়ি দেয়। অনেকের ধারণা, পরবর্তী মহাযুদ্ধ হবে পানির দখলদারিত্ব নিয়ে। পবিত্র কোরআনের  ৬৭তম সুরা মুলকের ৩০তম আয়তে বলা আছে, যদি তোমাদের পানি ভূগর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে কে তোমাদের সরবরাহ করবে পানির  স্রোতধার।
যানবাহন, কলকারখানার ধোঁয়ার সিসা, কার্বন প্রভৃতি  গ্যাসবায়ু দূষণ বাড়িয়ে আয়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভূমি ও বন উজার করে বাড়াচ্ছি কার্বন, উষ্ণতা, সাগরের পানির তল। কমাচ্ছি অক্সিজেন, জীব বৈচিত্র্য, খাদ্য শৃঙ্খল, অনবায়নযোগ্য খনিজ। এয়ারকন্ডিশনার  ও  ফ্রিজার  থেকে  বেরুচ্ছে সিএফসি গ্যাস। দেয়ালের  ও নিত্য ব্যবহার্য্য প্রসাধন  থেকেও  বিচ্ছুরিত হচ্ছে  রেডনসহ কত অজানা বিষাক্ত উপকরণ। অদৃশ্য শত্রুর মতো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। মেলা, জনসভা, পর্যটন ও বনভোজন জনসমাগমে এমন কি বনবাঁদারে বা নদীতের পেট্রোকেমিক্যাল সামগ্রীর জঞ্জালে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে চলছে।  গবেষকদের তথ্যানুসারে পাখির ডিম পাড়া, মৌমাছির ফুলে পরাগায়ন, প্রাণিদেহে বৈকল্যতে চৌম্বকীয়-তড়িৎ ব্যবস্থাপনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ই-বর্জ্য সামনের দিনের আরেক আপদ। সব ভেষজ যে নিরাপদ তা নয়। অতিরিক্ত চা, কফি, পান, সুপারি অপকারী ভেষজের মতো সুস্থতাকে দারুণভাবে ব্যহত করতে পারে। ভেজাল  খাবার ও  ওষুধ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বদলে  রোগ ও যমের দোরগোড়ায় নিয়ে যায়। খাবার আগে হাত ধোয়া, নিরাপদ পানি ব্যবহার, খাবার ঢেকে রাখা, পচা-বাসি খাবার পরিহার, আগে রান্না করা খাবার গরম করে নেয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তবে, আইসক্রিম  বা দই মাঠা এ নিয়মের বাইরে। যা  আমাদের রোগ ব্যাধি থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করে। এসবের ছোটখাটো অবহেলা পরে অপরিমেয় ক্ষতির দ্বার প্রান্তে নিয়ে যেতে পারে।

চিকন দেহ মোটাতাজাকরণ, ওজন ও স্থূলতা হ্রাস, অনিদ্রা দূরীকরণ, বয়স ও রূপলাবণ্য ধরে রাখা, চুল পাকা  পড়া   ও পাকা রোধ, যৌবন ধরে রাখা, হজম, গ্যাস্ট্রিক, বিষন্নতা তাড়ন, স্ফূর্তি আনা প্রভৃতির জন্য কুখাদ্য, কুপণ্য মুড়ি-মুড়কির মতন খাদ্যের চেয়েও  বেশি দামে বিক্রয় হচ্ছে। যেহেতু এর চাহিদা বের্শি তাই তাতে ভেজালের পরিমাণও বেশি। অনেক সময়ে অসাবধানবশত তেল ভেবে কীটনাশক খাবারের সাথে মেশানো, রোগের ওষুধ মনে করে, তার্পিন, কেরোসিন, কীটনাশক বা অখাদ্য  রোগীকে খাওয়ানো বা কোন কারণে জীবনের প্রতি অনীহার বশবর্তী হয়ে  তা খেয়ে বিপদ ডেকে  আনে। অথচ রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, হলুদ, আদা, দারুচিনি, জিরা, মৌরি, তাজা দেশি শাকসবজি ও ফলমূলে অ্যান্টিঅক্সিডেটসহ অনেক দ্রব্যগুণ বিদ্যমান, যা ক্যান্সারসহ নানা রোগ নিরাময়সহ সুস্বাস্থ্যের  জন্য উপকারী। সাধারণ বাদামি ও সিদ্ধ  চালে যে পুষ্টি ও স্বাদ; আতপ ও পলিশ করা সাদা চালে সে পুষ্টি ও স্বাদ অনেক কম। পেকে যাওয়া মটরশুঁটিতে সবুজ রঙ, বিস্কিট, মিষ্টি, দই  আর ভাতে জর্দায় কৃত্রিম রঙ, মরা মাছের কানকোতে লাল রঙের প্রলপ এখন গা সহা। কিস্তু এ রঙের খেলায় যা ভয়ানক, তা হলো এসব কৃত্রিম রঙ অধিকাংশই  কমদামি কাপড়ে  রঙ। খাবার চকচকে দেখার জন্য  চামড়া রাঙানোর রঙের ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে। যা শরীরের জন্য মারাত্মক বিষ। খাবারে মেশানোর জন্য ফুড গ্রেড  নামে রঙ আছে। অবশ্য এর দাম কৃত্রিম রঙের তুলনায় আকাশ ছোঁয়া। চোখের খিদা মেটাতে আর অধিক লাভের জন্য  কমদামি কৃত্রিম রঙের  মারণানাস্ত্রে নিরাপরাধ মানুষের জীবন বিষিয়ে দিচ্ছে।  

ডায়াবেটিক রোগীর যেমন বেশি শর্করা বারণ, তেমনি বাত ব্যথায় ও আর্থাইটিসে শুধু লাল মাংশই নয় আমিষসমৃদ্ধ খাবার হিসেবে শিমের বিচি, শাকের ডগা; এসপারাগাস/শতমূলী, পুঁই,  টমেটো  এমনকি শাকের রাজা পালংশাক নিষিদ্ধ। কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মার মতো সংক্রামক এবং  আর্সেনিকোসিস, শ্বাসকষ্ট, রক্তচাপ, স্থূলতা, হার্ট ব্লকেজ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার প্রভৃতি অসংক্রামক রোগ থেকে জীবনাচরণ বদলিয়ে  সুস্থ থাকা যায়। খাবার  ও  জীনাচরণ  স্বাস্থ্যের  ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলে। দুধ প্রাকৃতিক ও পুষ্টিকর খাদ্য। বাচ্চা দেয়ার পর গবাদি প্রসূতির ওলানের শাল দুধ ফেলে দু-একদিন পরের দুধ বাচ্চাকে খাওয়নো হতো। এখন বলা হচ্ছে নবীন-শাবকের জন্য এ শাল দুধ  স্বাস্থ্যকর ও বেশ পুষ্টিকর। মানুষের বেলাতেও  তা সমভাবে প্রযোজ্য। পবিত্র কোরআনে পূর্ণ ২ বছর পর্যন্ত শিশুকে স্তন্যদানের  কথা বর্ণিত আছে (সুরা : ২, আল বাকারা; আয়াত-২৩৩/ সুরা :৩১, লুকমান; আয়াত :১৪)। গবেষণায় জানা গেছে, স্তন্যদানকারী মাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক  যেমন নিবিড় হয়, প্রজাতির পুষ্টি ও বর্ধনও  ঘটে আশানুরূপ। স্তন্যদানকারী মায়ের স্তন ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতার  হারও এবং গর্ভধানের সম্ভাবনাও কমে।
লাউ, কুমড়া, কাচকলা, পটোল তরিতরকারির খোসা রান্নার জন্য কাটাকুটির সময় ফেলে দেয় হয়। এতে পুষ্টি থাকে বেশি। ছোট করে তরকারি কুটায় এবং শাক ও তরকারি  কুটার আগে ধুলে ধোয়া পানির সাথে পুষ্টি চলে যায় না। অধিক হারে অনেকক্ষণ রান্নায় এবং ভাতের মাড় ফেলা ভালো নয়। টমেটো, গাজর, মুলা সালাদ হিসেবে কাঁচা খাওয়াই উত্তম। খোসাসহ আলু সিদ্ধ এবং খোসাসহ আপেল, পেয়ারা খেলে লাভ বেশি। শাক, কাঁচামরিচ প্রভৃতির আগা-ডগার দিকে পুষ্টি অধিক। চা সুস্বাদু করার জন্য চিনি, দুধ মেশানো কতটুকু ভালো তা ভাবা দরকার। লেবু একবার কাটলে অনেকক্ষণ খোলা বা আলোতে রাখলে ভিটামিন সি নষ্ট হয়। ফলের রস করে খাবার বদলে কামড়ে খাওয়া স্বাস্থ্যপ্রদ। গরম খাবার সাথে সাথে মুখবন্ধ পাত্রে ভরলে তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার; ফুড পয়জনিংজনিত বিষক্রিয়ায় ফলে কারখানায়, মজলিসে বা গণখাবার খেয়ে অনেকে অসুস্থ  হওয়া বা মৃত্যুর কারণ। ক্রমাগত শিল্প বর্জ্য ও  হেভি মেটাল বা ভারি ধাতু, কৃষি কাজের মাটি, নদী ও বদ্ধ জলাশয়ের পানি এবং নির্মল বায়ুকে বিষাক্ত করে তুলছে।  অনেক অসাধু  ব্যবসায়ী অতি মুনাফার লোভে  ট্যানারির হেভি মেটালযুক্ত বর্জ্য গবাদি ও পোলট্রি ফিডে মিশিয়ে বিক্রয় করছে। গরু সুস্থ ও মোটাতাজাকরণে মাছ আর হাঁস মুরগিক পুষ্ট রাখতে হরমোন, অ্যান্টিবায়েটিসহ এমনসব রাসায়নিক প্রয়োগ করছে। যার অক্ষয় ও অবশিষ্টাংশ খাদ্যচক্রের মাধ্যমে  মানবদেহে প্রবেশ করে, জমে জমে অনাকাক্সিক্ষত রোগের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক মানব দেহের জন্য বেশ ক্ষতিকর বিধায় নিষিদ্ধ। গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে ডাইক্লোফেনাক প্রয়োগ করা গবাদির মৃতদেহ খেয়ে শুকুনের ডিম নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ওরা বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় নাম লিখিয়েছে।  তাদের  জন্মহার বিলুপ্তর অন্যতম কারণ বিধায় এ ওষুধটি গবাধিপশুর জন্যও বর্তমানে নিষিদ্ধ।


 মেলা, জনসমাবেশ, রেল, সড়ক নৌপথে যাত্রাপথে  ঝাল মুড়ি, চানাচুর, সিদ্ধ ডিম, জিলাপি, কাটা শশা, আচারাদি খাবার ধুম পড়ে। এসব  পুরনো পত্রিকা, খাতার কাগজ, বইয়ের পাতার ঠোঙ্গায় পরিবেশন করা হয়। তাতে অখাদ্য ছাপার কালি এবং  জীবাণু স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলে দেয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। তার সাথে প্রতারক ও ঠকবাজের যুক্তক্রিয়া তাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে। তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে খাবার ও জীবনাচরণে সাবধানতা আবশ্যক। সাবধানের মার নাই।

কৃষিবিদ এ এইচ ইকবাল আহমেদ*
*পরিচালক (অব.), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী। ০১৫৫৮৩০১৯০৮
ahiqbal.ahmed@yahoo.com

বিস্তারিত
টমেটোর রোগ ও প্রতিকার

টমেটো বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সবজি। তরকারি, সালাদ, স্যুপ, চাটনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়াও টমেটো বিভিন্নভাবে সংরক্ষণ ও বোতলজাত করা হয়। টমেটোতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি এবং যথেষ্ট বি ও ভিটামিন এ এবং খনিজ পদার্থ আছে। কিন্তু টমেটো উৎপাদনে রোগবালাই একটি প্রধান প্রতিবন্ধক। এ রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ফলন অনেক বাড়বে। টমেটোর কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
গোড়া ও মূল পচা  (
Damping off and root rot) রোগের কারণ : পিথিয়াম, রাইজোকটোনিয়া, ফাইটোপথোরা, ক্লেরোশিয়াম (Phythium, Rhi“otocnia, Phytophthora, Sclerotium etc.) ও অন্যান্য মাটিবাহিত ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার ও লক্ষণ : মাটি সব সময় স্যাঁতস্যাঁতে থাকলে ক্রমাগত মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া বিরাজ করলে এবং বায়ু চলাচলে বিঘ্ন ঘটলে এ রোগের আক্রমণের আশঙ্কা বেশি থাকে। রোগটি ছত্রাকের আক্রমণে বীজতলায় হয়ে থাকে। এটি একটি মারাত্মক রোগ। বীজে আক্রমণ হলে বীজ পচে যায়। বীজ অংকুরোদগমের পরেই প্রাথমিক পর্যায়ে চারা মারা যায় একে প্রিইমারজেন্স ড্যাম্পিং অফ বলে। পোস্ট-ইমারজেন্স ড্যাম্পিং অফের বেলায় চারার হাইপোকোটাইলের কর্টিক্যাল কোষ দ্রুত কুঁচকে যায় ও কালো হয়ে যায়। চারার কা- মাটির কাছাকাছি পচে চিকন হয়ে যায়। কাণ্ডের গায়ে ছত্রাকের উপস্থিতি দেখা যায়। চারার গোড়া চিকন, লিকলিকে হয়ে ঢলে পড়ে ও মারা যায়। সুনিষ্কাশিত উঁচু বীজতলা তৈরি করতে হবে যেখানে সূর্য্যালোক ও বায়ু চলাচল পর্যাপ্ত থাকে; রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে; বীজ বপনের ২ সপ্তাহ পূর্বে ফরমালডিহাইড দিয়ে বীজতলা শোধন করতে হবে; বায়োফানজিসাইড- ট্রাইগোডারমা দ্বারা বীজ শোধন করে বপন করতে হবে; অর্ধ কাঁচা মুরগির বিষ্ঠা বীজ বপনের ৩ সপ্তাহ আগে হেক্টরপ্রতি ৩-৪ টন হিসেবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে; কাঠের গুঁড়া বীজতলার ওপর ৩ ইঞ্চি বা ৬ সেমি উঁচু করে ছিটিয়ে দিয়ে আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে; বীজতলা রৌদ্রপূর্ণ দিনে সূর্য কিরণে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে কমপক্ষে ৩-৪ সপ্তাহ ঢেকে রাখতে হবে;  প্রোভেক্স-২০০ বা ব্যভিস্টিন (প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম) দিয়ে শোধন করে বীজ বপন করতে হবে; বীজ ৫২০ঈ তাপমাত্রায় গরম পানিতে ৩০ মিনিট রেখে শোধন করে নিয়ে বপন করতে হবে; রোগের আক্রমণ দেখা দিলে ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা কিউপ্রাভিট প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম হিসাবে মিশিয়ে চারার গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
আগাম ধসা (
Early blight) : রোগের কারণ ও বিস্তার : অলটারনারিয়া সোলানি (Alternaria solani)  নামক ছত্রাকের আক্রমণে হয়। ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, বিকল্প পোষক ও বীজে এ জীবাণু বেঁচে থাকে। উচ্চ তাপমাত্রা (২৪-২৮০ সেলসিয়াস) ও বেশি আর্দ্রতা (৮০% এর ওপরে) এ রোগ ঘটানোর জন্য সহায়ক। বৃষ্টির ঝাপটা ও বাতাসের মাধ্যমে এ রোগ সুস্থ গাছে ছড়িয়ে পড়ে। আলু, মরিচ এ রোগের বিকল্প পোষক হতে পারে। রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার : গাছের পাতা, কা- এমনকি ফলও আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত নিচের বয়স্ক পাতায় এ রোগের লক্ষ্মণ প্রথম দেখা যায়, পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে ওপরের পাতা আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত পাতার ওপর কাল কিংবা হালকা বাদামি রঙের বৃত্তাকার দাগ পড়ে। অনেক দাগ একত্রে মিশে পাতার অনেক অংশ নষ্ট করে ফেলে এবং পাতা হলদে বা বাদামি রঙ হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ে। কাণ্ডের ছোট ছোট, গোলাকার বা লম্বা এবং ডুবা ধরনের দাগ পড়ে। পুষ্প মঞ্জুরির বোঁটা আক্রান্ত হলে ফুল ও অপ্রাপ্ত ফল ঝরে পড়ে। বয়স্ক ফলেও বৃত্তাকার দাগের সৃষ্টি হয় এবং ফলটিকে নষ্ট করে ফেলে। রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে; প্রোভেক্স-২০০ বা ব্যভিস্টিন (প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম) দ্বারা শোধন করে বীজ বপন করতে হবে; সময়মতো সুষম সার ব্যবহার ও প্রয়োজন মতো পানি সেচ করতে হবে; গাছের পরিত্যক্ত অংশ ও আগাছা একত্রিত করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে; পাতায় ২/১টি দাগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে রোভরাল প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হিসাবে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।    
নাবি ধসা (
Late blight) : রোগের কারণ ও বিস্তার : ফাইটপথোরা ইনফেস্ট্যান্স (Phytophthora infestans) নামক ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। নিম্ন তাপমাত্রা (১২-১৫০ সেলসিয়াস), উচ্চ আর্দ্রতা (৯৬% এর ওপরে) ও মেঘাচ্ছন্ন স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া এবং গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলে রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। বাতাস ও সেচের মাধ্যমে এ রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
রোগের লক্ষণ ও  প্রতিকার : প্রাথমিক অবস্থায় পাতার উপর সবুজ কালো, পানিভেজা আঁকাবাঁকা দাগ পড়ে। আর্দ্র আবহাওয়ায় এসব দাগ সংখ্যায় ও আকারে দ্রত বাড়তে থাকে এবং বাদামি থেকে কালচে রঙ ধারণ করে। মাঝে মাঝে পাতার নিচের দিকে সাদা সাদা ছত্রাক জন্মে। আক্রান্ত পাতা পচে যায়। পাতা হতে কাণ্ডের এবং কাণ্ড হতে ফলে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে ফলের উপরিভাগে ধূসর সবুজ, পানি ভেজা দাগের আবির্ভাব হয়। ক্রমশ সে দাগ বেড়ে ফলের প্রায় অর্ধাংশ জুড়ে ফেলে এবং আক্রান্ত অংশ বাদামি হয়ে যায়। রোগের লক্ষণ দেখার পর নি¤œ তাপমাত্রা, আর্দ্র ও কুয়াশাচ্ছন্ন স্যাঁতস্যঁতে আবহাওয়া বিরাজ করলে ৩-৪ দিনের মধ্যে গাছ ঝলসে যায় ও দ্রুত মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ফসল উঠার পর জমির আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশগুলো একত্র করে পুড়ে ফেলতে হবে; রোগমুক্ত এলাকা হতে সুস্থ বীজ সংগ্রহ করতে হবে; আলু ও টমেটো গাছ পাশাপাশি লাগান উচিত নয় এবং আলু ও টমেটো ছাড়া জমিতে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে; রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে; নি¤œ তাপমাত্রা, উচ্চ আর্দ্রতা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া মাত্র মেলোডি ডিও প্রতি লিটার  পানিতে ২ গ্রাম ও সিকিউর প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে একত্রে মিশিয়ে গাছের পাতার ওপরে ও নিচে ভিজিয়ে ৭ দিন পর পর কমপক্ষে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।        
ফিউজারিয়াম ঢলে পড়া (
Fusarium wilt) : রোগের কারণ ও লক্ষণ : ফিউজারিয়াম অক্সিস্পোরাম এফ. এসপি. লাইকোপারসিসি (Fusarium oxysporum f. sp. lycopersici)  নামক ছত্রাকের আক্রমণে হয়। চারা গাছের বয়স্ক পাতাগুলো নিচের দিকে বেঁকে যায় ও ঢলে পড়ে। ধীরে ধীরে পুরো গাছই নেতিয়ে পড়ে ও মরে যায়। গাছের কাণ্ডে ও শিকড়ে বাদামি দাগ পড়ে।  গাছে প্রথমে কাণ্ডের এক পাশের শাখার পাতাগুলো হলদে হয়ে আসে এবং পরে অন্যান্য অংশ হলুদ হয়ে যায়। রোগ বৃদ্ধি পেলে সব পাতাই হলুদ হয়ে যায় এবং অবশেষে সম্পূর্ণ শাখাটি মরে যায়। এভাবে পুরো গাছটাই ধীরে ধীরে মরে যায়। সম্ভব হলে ফরমালিন দিয়ে মাটি শোধন করতে হবে; নীরোগ বীজতলার চারা লাগাতে হবে; আক্রান্ত গাছ ধ্বংস করতে হবে; জমিতে চুন প্রয়োগ করতে হবে; জমিতে উপযুক্ত পরিমাণে পটাশ সার প্রয়োগ করলে রোগ অনেক কম হয়; শিকড় গিট কৃমি দমন করতে হবে কারণ এটি ছত্রাকের অনুপ্রবেশে সাহায্য করে; রোগের আক্রমণ দেখা দিলে ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা কিউপ্রাভিট প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম হিসাবে মিশিয়ে চারার গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।  
ঢলে পড়া (
Bacterial wilt): রোগের কারণ ও বিস্তার : রালসটোনিয়া সোলানেসিয়ারাম (Ralstonia solanacearum) নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ হয়। গাছের পরিত্যক্ত অংশ, মাটি ও বিকল্প পোষকে এ রোগের জীবাণু বেঁচে থাকে। সেচের পানি ও মাঠে ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। উচ্চ তাপমাত্রা (২৮-৩২০ সেলসিয়াস) ও অধিক আর্দ্রতায় এ রোগ দ্রুত ছড়ায়।
রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার : গাছ বৃদ্ধির যে কোনো সময় এ রোগ হতে পারে এবং ব্যাপক ক্ষতি করে। আক্রান্ত গাছের পাতা ও ডাঁটা খুব দ্রুত ঢলে পড়ে এবং গাছ মরে যায়। গাছ মরার পূর্ব  পর্যন্ত পাতায় কোনো প্রকার দাগ পড়ে না। মাটির ওপরে আক্রান্ত গাছের গোড়া থেকে সাদা রঙের শিকড় বের হয়। রোগের প্রারম্ভে কাণ্ডের নিম্নাংশ চিরলে এর মজ্জার মধ্যে কালো রঙের দাগ দেখা যায় এবং চাপ দিলে তা থেকে ধূসর বর্ণের তরল আঠাল পদার্থ বের হয়ে আসে। এ তরল পদার্থে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া থাকে। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের গোড়ার দিকের কা- কেটে পরিষ্কার গ্লাসে পানিতে ডুবিয়ে রাখলে সাদা সুতার মতো ব্যাকটেরিয়াল উজ বের হয়ে আসতে দেখা যায়। রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে; বুনো বেগুন গাছের কাণ্ডের সাথে কাক্সিক্ষত জাতের টমেটোর জোড় কলম করতে হবে; শস্য পর্যায়ে বাদাম, সরিষা, ভুট্টা ফসল চাষ করতে হবে; রোগাক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র মাটিসহ তুলে ধ্বংস করতে হবে; টমেটোর জমি স্যাঁতস্যাঁতে রাখা যাবে না; হেক্টর প্রতি ২০ কেজি স্টেবল ব্লিচিং পাউডার শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে; স্ট্রেপ্টোমাইসিন সালফেট (অক্সিটেট্রাসাইক্লিন) ২০ পিপিএম অথবা ক্রোসিন এজি ১০ এসপি ০.৫ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৪-৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
পাতা কুঁকড়ানো (
Leaf curl) : রোগের কারণ ও বিস্তার : ভাইরাসের (Virus) আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। সাদা মাছি নামক পোকার আক্রমণে এ রোগ অসুস্থ গাছ থেকে সুস্থ গাছে সংক্রমিত হয়। রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার : গাছ খর্বাকৃতির হয়ে যায়। পাতার গায়ে ঢেউয়ের মতো ভাঁজ সৃষ্টি হয় ও পাতা ভীষণভাবে কুঁকড়িয়ে যায়। বয়স্ক কুঁকড়ানো পাতা পুরু ও মচমচে হয়ে যায়। আক্রমণের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে পাতা মরে যায়। গাছে অতিরিক্ত শাখা হয় ও গাছ সম্পূর্ণরূপে ফুল, ফল ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। রোগাক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে ধ্বংস করতে হবে; রোগাক্রান্ত চারা কোনো অবস্থাতেই লাগানো যাবে না; সুস্থ গাছ থেকে পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ সংগ্রহ করতে হবে; গাউচু নামক কীটনাশক (৫ গ্রাম/কেজি বীজ) দ্বারা বীজ শোধন করতে হবে; পোকা দমনের জন্য এডমায়ার কীটনাশক ১ লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
হলুদ মোজাইক (Mosaic) ভাইরাস : রোগের কারণ ও বিস্তার : ভাইরাসের (
Virus) আক্রমণে এ রোগ হয়। সাদা মাছি নামক পোকার আক্রমণে এ রোগ অসুস্থ গাছ হতে সুস্থ গাছে সংক্রমিত হয়। রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার : অল্প বয়সে টমেটো গাছ রোগাক্রান্ত হলে গাছ খর্বাকৃতির হয়। গাছের পাতার শিরার রঙ হলুদ হয়ে যায়।  আক্রান্ত পাতা স্বাভাবিক সবুজ রঙ হারিয়ে হালকা সবুজ ও ফ্যাকাশে হলুদ রঙের মিশ্রণ সৃষ্টি করে। পাতার অনুফলকগুলো কিছুটা কুঁচকিয়ে বিকৃত হয়ে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে পুরো পাতা হলুদ হয়ে যায়। আক্রান্ত গাছের ফলন কম হয় ও ফলের স্বাভাবিক আকার নষ্ট হয়ে যায়।    
সুস্থ গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে ও সুস্থ চারা লাগাতে হবে; রোগাক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে ধ্বংস করতে হবে; জমিতে কাজ করার সময় তামাক, বিড়ি, সিগারেট ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে; গাউচু নামক কীটনাশক (৫ গ্রাম/কেজি বীজ) দ্বারা বীজ শোধন করতে হবে; পোকা দমনের জন্য এডমায়ার কীটনাশক ১ লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
শিকড় গিট (Root knot) : রোগের কারণ ও বিস্তার  মেলোয়ডোগাইনি (Meloidogyne spp) প্রজাতির কৃমির আক্রমণে হয়। কৃমি মাটিতে বসবাস করে। সাধারণত মাটির উপরিভাগে এরা অবস্থান করে। উচ্চ তাপমাত্রা (২৫-২৮০ সে.) ও হালকা মাটি এদের বসবাস ও বংশবিস্তারের জন্য খুবই সহায়ক। বৃষ্টি ও সেচের পানি এবং কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে এদের বিস্তার হয়।
রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার : মাটিতে অবস্থানকারী কৃমির আক্রমণের ফলে আক্রান্ত স্থলের কোষগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পায় ও সে স্থান স্ফিত হয়ে নট বা গিটের সৃষ্টি করে। আক্রান্ত গাছ দুর্বল, খাট ও হলদেটে হয়ে যায়। আক্রান্ত গাছের বৃদ্ধি স্বাভাবিকের তুলনায় কম হয়। গাছের গোড়ার মাটি সরিয়ে শিকরে গিটের উপস্থিতি দেখে সহজেই এ রোগ শনাক্ত করা যায়। চারা গাছ আক্রান্ত হলে সব শিকড় নষ্ট হয়ে যায় ও দিনের বেলায় গাছ ঢলে পড়ে। ফুল ও ফল ধারণ ক্ষমতা একেবারেই কমে যায়। রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে; জমিতে সরিষা, বাদাম, গম, ভুট্টা প্রভৃতি শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে; শুষ্ক মৌসুমে জমি পতিত রেখে ২-৩ বার চাষ দিয়ে মাটি ভালোভাবে শুকাতে হবে; জমি পতিত রাখলে আগের ফসলের কৃমি মারা যায়, তাই সম্ভব হলে জমি পতিত রাখতে হবে; জমি জলাবদ্ধ রাখলেও কৃমি মারা যায়, তাই সম্ভব হলে জমি কয়েক সপ্তাহ হতে কয়েক মাস পর্যন্ত জলাবদ্ধ রাখতে হবে; বীজতলা রৌদ্রপূর্ণ দিনে সূর্য কিরণে স্বচ্ছ পলিথিন দ্বারা কমপক্ষে ৩-৪ সপ্তাহ ঢেকে রাখতে হবে; অর্ধ কাঁচা মুরগির বিষ্ঠা হেক্টরপ্রতি ৪-৫ টন চারা লাগানোর ২১ দিন আগে জমিতে প্রয়োগ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে; চারা লাগানোর সময়  হেক্টর প্রতি ৩০ কেজি ফুরাডান ৫ জি মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে।

কৃষিবিদ ড. কে এম খালেকুজ্জামান*
*এসএসও (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব), মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া ০১৯১১-৭৬২৯৭৮;
zaman.path@gmail.com

বিস্তারিত
সামুদ্রিক শৈবালের চাষ এবং রফতানি

শৈবাল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি মূল্যবান সামুদ্রিক সম্পদ। বিশ্বব্যাপী শৈবাল থেকে খাদ্যপণ্য, ঔষধিপণ্য, প্রসাধনী পণ্য, সার, বায়ো ফুয়েল ও পরিবেশ দূষণরোধক পণ্য উৎপাদন করছে। লবণাক্ত, আধা লবণাক্ত পানির পরিবেশে এটি জন্মে এবং সহজে চাষাবাদ করা যায়। জানা যায়, বাংলাদেশে ১৯টি উপকূলীয় জেলার ১৪৭টি উপজেলায় প্রায় ৩ কোটি লোক বসবাস করে। যাদের অধিকাংশেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে জড়িত। এদের ন্যূনতম একটি অংশকে শৈবাল চাষে লাগানো গেলে শৈবাল উৎপাদন এবং রপ্তানি করে প্রচুর আয় করা অতি সহজ। ঋঅঙ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর বিশ্বে সিউইডের বাজার ছিল ৭ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে চীনের দখলে ৫০ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার দখলে ৩৭ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ার প্রধান রপ্তানি দ্রব্যই হলো সিউইড। বাংলাদেশে সিউইডের উৎপাদনে ও রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এখানকার ৭২০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় শৈবাল চাষ করা গেলে ২-৩ বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের একটি অংশ সহজে দখল করা যাবে বলে মনে করেন ফ্যালকন ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোক্তা জনাব ওমর হাসান। তার হিসেবে ২ লাখ টন শুকনো শৈবাল রপ্তানি করতে পারলে রপ্তানি আয় দাঁড়াবে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সিউইড দিয়ে খাদ্য হিসেবে নুডলস জাতীয় খাবার, স্যুপ জাতীয় খাবার, সবজি জাতীয় খাবার, শরবত, সল্টেস দুধ, সমুচা, সালাদ, চানাচুর, বিস্কুট, বার্গার, সিঙ্গেরা, জেলি, ক্যান্ডি, চকলেট, পেস্টি, ক্রিমচিজ, কাস্টার্ড, রুটি, পনির, ফিশফিড,  পোলট্রিফিড, সামুদ্রিক সবজি এসব খাবার তৈরি ছাড়াও এগারএগার, কেরাজিনান, এলগ্যানিক এসিড, ক্যালসিয়াম মূল্যবান দ্রব্য ও উৎপাদন হয়। ওষুধ হিসেবে ডায়াবেটিসের ওষুধ, খাদ্য সংরক্ষণের জন্য, ল্যাবরেটরিতে ব্যাকটেরিয়া উৎপাদনের জন্য, চকলেটের উপাদান কোকোর বিকল্প হিসেবে, ক্যান্সারের ওষুধ, গ্যাসট্রিকের ওষুধ তৈরিতে ক্যারাজিনানের বহুবিদ ব্যবহার ছাড়াও আইসক্রিমের উপাদান, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট শৈবাল থেকে তৈরি করা যায়।
সিউইড বা শৈবালের ৫টি প্রজাতী থেকে গাড়ির ও বিদ্যুতের জ্বালানি হিসেবে বায়োফুয়েল, বায়োইথানল, বায়োহাইড্রোকার্র্বন, বায়োহাইড্রোজেন যা দিয়ে হেলিকপ্টারের জ্বালানি তৈরি করা যায়। এসবের উচ্ছৃষ্ট থেকে বায়োগ্যাস তৈরি হয়। এর উচ্ছৃষ্ট থেকে জৈবসারও তৈরি করা যায়। এদিকে ব্রিটেনের ঘোষণা আগামী ২০২০ সালে এনার্জির ৮০ শতাংশ সিউইড থেকে তৈরি করবে। প্রসাধনী তৈরিতে ও সিউইড ব্যবহৃত হয়। তানজানিয়া শৈবাল নির্ভর ২১টি কারখানা আছে যেখানে সাবান, টুথপেস্ট, প্রসাধনী ক্রিম, কৃত্রিম চামড়া, পেইন্ট, সিল্ক তৈরির ইনসুলেটিং দ্রব্য তৈরি হয়। সার তৈরিতে ও শৈবাল ব্যবহৃত হয়। যেমন চীন, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, জাপান, তানজানিয়া, ফ্রান্স, সার উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করে। জনাব ওমর হাসান ফ্যালকন ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী দীর্ঘ ৮ বছর ধরে শৈবাল নিয়ে চাষ গবেষণা করে চাষ করে ২০১৫ সালে মাত্র ১ মেট্রিক টন রপ্তানির মাধ্যমে ১৬ হাজার মার্কিন ডলার আয় করেন।
গত বছর পর্যন্ত তিনি ১টি প্রজাতীর চাষ করেছেন। এ বছর ২৬ প্রজাতীর শৈবালের চাষ শুরু করেছেন। তা একদম সমুদ্র উপকূলে। সরকার থেকে ৩৭ একর উপকূলীয় জায়গা লিজ নিয়ে পরীক্ষামূলক শৈবালের চাষ শুরু হয়। গত বছর ২০১৫ পর্যন্ত ৮ মেট্রিক টন সিউইড উৎপাদন হয় এবং এ থেকে ১ মেট্রিক টন রপ্তানি করে ১৬ হাজার ডলার আয় হয়। অবশিষ্ট সিউইড  গবেষণা কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এসব উৎপাদনে আমার খরচ হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এ বছর ২-৩ মেট্রিক টন রপ্তানির চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের সমুদ্রে ক্লোরেলা শৈবাল পাওয়া যায়। পাউডার অবস্থায় ১ কেজি ক্লোরেলার মূল্য ৩,৮০০০০ টাকা। এটিও চাষ করা যায়। তবে এটি শুধু ল্যাবরেটরিতে চাষ করা যায়।
বাংলাদেশে যে উৎস আছে তা কাজে লাগে পারলে আগামী ২-৩ বছরে ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সিউইড রপ্তানি করা যাবে তা হবে শুকনা সিউইড। সুইজারল্যান্ডের ঝএঝ ল্যাবরেটরির মতো একটি আইসোলেশন ল্যাবরেটরি করতে পারলে খাদ্য পণ্য ওষুধ শিল্পে ব্যবহারের জন্য এগারএগার, ক্যালজিনন, এলগেনিক এসিড, সাবান, টুথপেস্ট, বেভারিজ ব্যবহারের উপাদান যা বিদেশ থেকে আমদানি করে তৈরি করা যাবে। এসব দ্রব্যাদি এখন বিদেশ থেকে আমদানি করলে ও দেশে উৎপাদিত হলে দেশের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানিও করা যাবে। তবে আইসোলেশন ল্যাবরেটারি ছাড়া কিছুই হবে না।
বিশেষজ্ঞরাই শৈবাল থেকে খাদ্যপণ্য, ওষুধ, প্রসাধনী দ্রব্য তৈরি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে। এতে দেশের মূল্যবান মেধা দেশের উন্নয়নের জন্য শতভাগ ব্যবহার করা যাবে। বর্তমানে সিউইডের আন্তর্জাতিক বাজার ৭ বিলিয়ন ডলার।
উৎপাদিত শৈবাল সহজে বিক্রি করতে পারলে তাও শৈবাল বা সিউইড উৎপাদন করবে। সিউইড লাগানোর ১০ দিন পর হারভেস্ট করা যায় অর্থাৎ মাসে ৩ বার কাটা যায়। আর ১ কেজি সিউইড বা শৈবালের আন্তর্জাতিক বাজার দর ১৬ ডলার। ১ একরে একবার হারভেস্ট করে ১০-১৫ কেজি শুকনো শৈবাল পাওয়া যায়। সে হিসাবে এক মাসে ৩ বারে ৪০ কেজি ধরলে শুকনো শৈবাল মূল্য ৪০ঢ১৬ = ৬৪০ ডলার ৬৪০ঢ৮০ = ৫১,২০০/- টাকা। বছরে ৬ মাস চাষ করলে ৫১,২০০ঢ৬ = ৩,০৭,২০০/- টাকা সহজে আয় করা যায়। এখানে সার, কীটনাশক কিছুই লাগে না। আবার জমি হলো সমুদ্র। কোন টাকার দরকার নেই। শুধু শুকনো শৈবাল উৎপাদন করে ২ লাখ টন রপ্তানি করলে ১.৬ বিলিয়ন ডলার আয় করা যাবে। কোস্টট্রাস্ট, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, জাহানারা ইসলাম কক্সবাজার, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট শৈবাল বা সিউইড নিয়ে গবেষণা করছেন। গবেষণায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের বিজ্ঞানীরা গবেষণায় কোষ্টকাঠিন্যসহ পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, দেহের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে (পেটের মেদ) ওজন কমাতে, থাইরয়েড গ্রন্থির যে কোনো সমস্যা সমাধানে স্তন ও অন্ত্রের ক্যান্সার নিরাময় ও প্রতিরোধ, খনিজ ঘাটতি পূরণে, স্টেস, উচ্চরক্ত চাপ, হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সিউইড থেকে উৎপাদিত ঔষধিপণ্য অতি কার্যকর হিসেবে গণ্য করছেন এবং ঔষধিপণ্য উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন।
আধুনিক একটি আইসোলেশন ল্যাবরেটরি দরকার। এ ল্যাব এ আমরা সিউইড থেকেই মূল্যবান এলগ্যানিক এসিড তৈরি করেত পারব যা অনেক ডলার খরচ করে বিদেশ থেকে আমদানি করে ওষুধ শিল্পের জন্য। এছাড়া এগারএগার, ক্যারোজিনান এবং এলগ্যানিক এসিড বিদেশ থেকে আমদানি করে এটিও বন্ধ হবে। ফুড, বেভারিজ তৈরির জন্য এগারএগার এবং আইসক্রিম তৈরির জন্য ক্যারোজিনান ব্যবহৃত হয়। এসব আমরা সিউইড দিয়ে ল্যাব এ তৈরি করলে অনেক আমদানি খরচ বেঁচে যাবে। এটাও আমাদের আয় এবং এসব রপ্তানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। এছাড়াও মাত্র ২ লাখ টন সিউইড রপ্তানি করে ১.৬ বিলিয়ন ডলার আয় করা যাবে। ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত পণ্যের আয় হবে অতিরিক্ত অর্জন। সিউইড চাষ করা এত সহজ যে, বাচ্চারাও চাষ করতে পারে। এটি চাষের জন্য দরকার শুধু কিছু রশি ও বাঁশের খুঁটি। রশিতে ১০-২০টি সিউইড ১ ফুট দূরে দূরে বেঁধে দিয়ে বাঁশের সাথে দুই পাশের রশি বেঁধে দিলে হয়ে গেল। সমুদ্রের জোয়াভাটার অবস্থা বুঝে ৫-৬ হাত লম্বা বাঁশে ১ হাত পর পর ৪-৫টি রশি বাঁধা যায়। ১০ দিন পর এগুলো ১২-১৪ ইঞ্চি লম্বা হলে কেটে নিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নিলাম। শুকনো সিউইড রশিতে তৈরি হয়ে গেল। ৪-৫ ইঞ্চি করে মাতৃ সিউইড রেখে দিলাম। ১০ দিন পর আবার কাটা যায় এভাবে মাসে ৩ বার কাটতে পারে।
এ পণ্যটির গুরুত্ব অনেক বেশি এবং রপ্তানিতে এর স্থান পোশাক শিল্পের পরে হতে পারে। গবেষকদের মুখে শোনা সরকার যদি উপযুক্ত সুযোগ দেয় পোশাক শিল্পের চেয়ে বেশি আয় সমুদ্র শৈবাল বা সিউইড থেকে আসবে। এতে হাজার কোটি টাকা ঋণের দরকার নেই। শুধু প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন, গবেষণা, রপ্তানি নেটওর্য়াক ঠিক করা। কৃষি মন্ত্রণালয় ও মৎস্য মন্ত্রণালয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে; শৈবাল উৎপাদনে কৃষককে অনুপ্রাণিত করবে; উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ের জন্য ক্রেতাকে কম সুদে ঋণ এর ব্যবস্থা করে দেবে। যাতে কৃষক উৎপাদিত পণ্য হাতের নাগালে বিক্রি করে নগদ টাকা পায়; প্রতি কেজি শুকনো শৈবালের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে; রপ্তানির জন্য যা যা করার দরকার তা করতে হবে।

আশরাফুল আলম কুতুবী*
*লিয়াজোঁ অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, কক্সবাজার; মোবাইল ০১৮১৯৬৩৫৪৭৬

বিস্তারিত
মাছ চাষে করণীয়

মাছ আমাদের আমিষ জোগানের প্রধান উৎস। বাজার থেকে মাছ কিনে খাওয়ার চেয়ে নিজের পুকুরে জলাশয়ে মাছ চাষ করে নিজেরা খাওয়া যায়। অতিরিক্ত অংশ বিক্রি করে লাভবান হওয়া যায়। তবে মাছ চাষে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক বা আধুনিক প্রযুক্তি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। নিয়মিত ও পরিমিত যত্নআত্তি করলে মাছ চাষে লাভাবান হওয়া যায়। শীতকাল মাছ চাষে অতিরিক্ত কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। একটু সচেতন হলেই সেসব সমস্যা সমাধান করা যায় অনায়াসে। আমাদের দেশে শীতকালে মাছের বিশেষ কিছু কিছু রোগ দেখা যায়। এ সময় সঠিকভাবে মাছের যত্ন না নিলে এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে মাছ মরে যেতে পারে। শীতকালে মাছের ক্ষতরোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ, ফুলকা পচা রোগ এবং উদর ফোলা রোগ দেখা দিতে পারে। বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা করলে মাছের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়। শীতকালে মাছের বিশেষ যত্ন নেয়া প্রয়োজন। কারণ এ সময়ে পুকুরের পানি কমে যায়, পানি দূষিত হয়, মাছের রোগবালাই হয়। ফলে মাছের বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যাহত হয়। বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা করলে মাছের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়।


মাছের ক্ষতরোগ : এফানোমাইসেস ছত্রাকপড়ে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৩২ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছে এ রোগ হয়। যেমন- টাকি, শোল, পুঁটি, বাইন, কই, শিং, মৃগেল, কাতলসহ বিভিন্ন কার্পজাতীয় মাছে এ রোগ হয়। মাছের ক্ষত রোগ হলে প্রথমে মাছের গায়ে ছোট ছোট লাল দাগ দেখা যায়। লাল দাগে ঘা ও ক্ষত হয়। ক্ষতে চাপ দিলে দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ বের হয়। লেজের অংশ খসে পড়ে। মাছের চোখ নষ্ট হতে পারে। মাছ ভারসাম্যহীনভাবে পানির ওপরে ভেসে থাকে। মাছ খাদ্য খায় না। আক্রান্ত মাছ ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে মারা যায়। এ রোগে করণীয় হলো শীতের শুরুতে ১৫ থেকে ২০ দিন পরপর পুকুরে প্রতি শতাংশে ০১ কেজি ডলোচুন ও ০১ কেজি লবণ মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পুকুর আগাছামুক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। জৈবসার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। জলাশয়ের পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হবে। মাছের ঘনত্ব কম রাখতে হবে। ক্ষতরোগ হওয়ার আগে এসব ব্যবস্থা নিতে হবে। মাছ ক্ষতরোগে আক্রান্ত হলে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ৬০ থেকে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন ওষুধ দিতে হবে। অথবা তুঁত দ্রবণে মাছ ডুবিয়ে রেখে পুকুরে ছাড়তে হবে। আক্রান্ত মাছপুকুর থেকে সরাতে হবে।


লেজ ও পাখনা পচা রোগ : অ্যারোমোনাসে ওমিক্সো ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এ রোগ হয়। কার্প ও ক্যাটফিস জাতীয় মাছে বেশি হয়। তবে রুই, কাতলা, মৃগেলসহ প্রায় সব মাছেই এ রোগ হতে পারে। রোগের লক্ষণ হলো মাছের পাখনা ও লেজের মাথায় সাদা সাদা দাগ পড়ে।  লেজ ও পাখনা পচে খসে পড়ে। দেহের পিচ্ছিলতা কমে যায়। দেহের ভারসাম্য হারায় এবং ঝাঁকুনি দিয়ে পানিতে চলাচল করে। মাছ ফ্যাকাশে হয়। মাছ খাদ্য কম খায়। আক্রান্ত বেশি হলে মাছ মারা যায়। রোগ প্রতিরোধ বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। রোগ হওয়ার আগেই ওই ব্যবস্থাগুলো নিলে লেজ ও পাখনা পচা রোগ হয় না। আক্রান্ত পাখনা কেটে মাছকে শতকরা ২.৫ ভাগ লবণে ধুয়ে নিতে হবে। এক লিটার পানিতে ০.৫ গ্রাম তুঁত মিশিয়ে ওই দ্রবণে আক্রান্ত মাছকে এক মিনিট ডুবিয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে। মাছের পরিমাণ কমাতে হবে। আক্রান্ত মাছ পুকুর থেকে সরাতে হবে।


ফুলকা পচা রোগ : ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে অধিকাংশ বড় মাছে এ রোগ হয়। তবে সব প্রজাতির পোনা মাছেই এ রোগ হতে পারে। লক্ষণ হলো মাছের ফুলকা পচে যায় এবং আক্রান্ত অংশ খসে পড়ে।  শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়। মাছ পানির ওপর ভেসে ওঠে। মাছের ফুলকা ফুলে যায়। ফুলকা থেকে রক্তক্ষরণ হয়। আক্রান্ত মারাত্মক হলে মাছ মারা যায়। এ রোগ হলে করণীয় হচ্ছে শতকরা ২.৫ ভাগ লবণে আক্রান্ত মাছকে ধুয়ে আবার পুকুরে ছাড়তে হবে। এক লিটার পানিতে ০.৫ গ্রাম তুঁত মিশিয়ে ওই দ্রবণে আক্রান্ত মাছকে এক মিনিট ডুবিয়ে রেখে পুকুরে ছাড়তে হবে।


উদর ফোলা বা শোঁথ রোগ : অ্যারোমোনাস নামক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে কার্পও শিং জাতীয় মাছে ড্রপসি রোগ বেশি হয়। এ রোগ সাধারণত বড় মাছে বেশি হয়। লক্ষণ হলো দেহের ভেতর হলুদ বা সবুজ তরল পদার্থ জমা হয়। পেট খুব বেশি ফুলে। দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তরল পিচ্ছিল পদার্থ বের হয়। মাছ উল্টা হয়ে পানিতে ভেসে ওঠে। দেহে পিচ্ছিল পদার্থ কমে যায়। খাদ্য গ্রহণে অনীহা হয়। প্রতিকার হলো- আঙুল দিয়ে পেটে চাপ দিয়ে কিংবা সিরিঞ্জ দিয়ে তরল পদার্থ বের করতে হবে। প্রতি কেজি খাদ্যের সঙ্গে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন বা স্ট্রেপটোমাইসিন পরপর ৭ দিন খাওয়াতে হবে। অন্যান্য পরিচর্যা-১. পানির অক্সিজেন বৃদ্ধির জন্য বাঁশ দিয়ে অথবা সাঁতার কেটে অথবা পানি নাড়াচাড়া করতে হবে।
একরপ্রতি ০৫ থেকে ১০ কেজি টিএসপি দিলেও হবে। ২. পুকুরের পানিতে সরাসরি রোদ পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে পুকুরের পানি গরম হয় এবং প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয়। ৩. শেওলা, আবর্জনা, কচুরিপানা, আগাছাসহ সব ক্ষতিকর জলজ উদ্ভিদ পরিষ্কার করতে হবে। ৪. ১৫ দিন পরপর জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। ৫. পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস হলে চুন প্রয়োগ করতে হবে। ৬. পানি ঘোলা হলে ১ মিটার গভীরতায় ১ শতক পুকুরে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। ৭. পুকুরের পানি কমে গেলে পানি সরবরাহ করতে হবে। ৮. পুকুরের পানি বেশি দূষিত হলে পানি পরিবর্তন করতে হবে। ৯. সুষম খাদ্য নিয়মিত সরবরাহ করতে হবে। শীতকালে মাছের বিশেষ যত্ন নিতে হয়। কারণ এ সময়ে পুকুরে পানি কমে, পানি দূষিত হয়, পানি গরম হয়, অক্সিজেন কমে যায়, গ্যাস সৃষ্টি হয়, রোগবালাইসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়। এসব সমস্যার জন্য মাছের মড়ক দেখা দিতে পারে। এতে মাছ চাষি  ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমস্যার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে ও সমস্যা হওয়ার পরেও সমাধান করে মাছের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়।


খাবি খাওয়া : পানিতে অক্সিজেনের অভাব হলে মাছ পানির ওপর ভেসে ওঠে খাবি খায়। অর্থাৎ বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণের চেষ্টা করে। মনে হয় মাছ পানি খাচ্ছে। মাছ খুব ক্লান্ত হয়। এতে মাছের ফলন কমে। পানিতে সাঁতারকাটা, বাঁশ পানির ওপর পেটানো, হররা টেনে তলার গ্যাস বের করে দেয়া, পুকুরে পাম্প বসিয়ে ঢেউয়ের সৃষ্টি করা, পানি নাড়াচাড়া করে অক্সিজেন বাড়ানো যায়। নতুন পানি সরবরাহ করেও অক্সিজেন বাড়ানো যায়। প্রতি শতাংশে এক কেজি চুন দিলে উপকার পাওয়া যায়।
 

কার্বন-ডাই-অক্সাইডজনিত পানি দূষণ : পানিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে গেলে মাছের দেহে বিষক্রিয়া হয় এবং শ্বাসকষ্ট হয়। মাছ পানিতে ভেসে ওঠে। খাবি খাওয়া প্রতিকারের মতো পানি নাড়াচাড়া করে অক্সিজেন বাড়ালে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমে যায়। পুকুর তৈরির সময় অতিরিক্ত কাদা সরাতে হবে।
অ্যামোনিয়াজনিত সমস্যা : পুকুরে অ্যামোনিয়া বেড়ে গেলে পানির রঙ তামাটে অথবা কালচে রঙের হয়। এতে মাছের ছোটাছুটি বেড়ে যায়। মাছ খাদ্য খায় না। বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। মাছের মজুদ ঘনত্ব কমাতে হবে। সার ও খাদ্য প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। নতুন পানি সরবরাহ করতে হবে।

 

নাইট্রোজেনজনিত সমস্যা : পানিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেড়ে গেলে মাছের দেহে অক্সিজেন সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়ে বিষাক্ততার সৃষ্টি করে। এতে মাছের দেহ বাদামি রঙ ধারণ করে। মাছ খাদ্যগ্রহণ বন্ধ করে দেয়। পুকুরে মাছের ঘনত্ব কমাতে হবে। পুকুরে ২৫০ মিলিগ্রাম লবণ প্রতি লিটার হারে দিতে হবে।
 

পিএইচজনিত সমস্যা : পানিতে পিএইচ কমে গেলে মাছের দেহ থেকে প্রচুর পিচ্ছিল পদার্থ বের হয়। মাছ খাদ্য কম খায়। পিএইচ বেশি হলে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন কমে যায় এবং মাছের খাদ্য চাহিদা কমে যায়। দেহ খসখসে হয়। মাছ রোগাক্রান্ত হয়। পিএইচ কম হলে চুন, ডলোমাইড বা জিপসাম ১ থেকে ২ কেজি প্রতি শতাংশ পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। পিএইচ বেশি হলে পুকুরে তেঁতুল বা সাজনা গাছের ডালপালা তিনচার দিন ভিজিয়ে রেখে পরে তুলে ফেলতে হবে। তেঁতুল পানিতে গুলে দেয়া যায়।


পানির ওপর সবুজ স্তর : পুকুরের পানির রঙ ঘন সবুজ হয়ে গেলে বা পানির ওপর শ্যাওলা জন্মালে খাদ্য ও সার প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। প্রতি শতাংশে ১২ থেকে ১৫ গ্রাম তুঁতে বা কপার সালফেট অনেক ভাগ করে ছোট ছোট পোটলায় বেঁধে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পানির নিচে বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে রাখতে হবে। প্রতি শতাংশ পুকুরে ৮০০ থেকে ১২০০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে।
পানির ওপর লাল স্তর : পুকুরের পানির ওপর লাল স্তর পড়লে ধানের খড়ের বিচালি বা কলাগাছের শুকনো পাতা পেঁচিয়ে দড়ি তৈরি করে পানির ওপর দিয়ে ভাসিয়ে নিলে পরিষ্কার হয়।
পানির ঘোলাত্ব : পানি ঘোলা হলে মাছ খাদ্য কম খায়, চোখে দেখে না, প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় না, প্রজননে সমস্যা হয় ও রোগবালাই বেশি হয়। প্রতি শতাংশে ৮০ থেকে ১৬০ গ্রাম ফিটকিরি দিতে হবে। পুকুর তৈরির সময় জৈবসার বেশি দিলে স্থায়ীভাবে ঘোলা দূর হয়। পানিতে কলাপাতা ও কচুরিপানা রাখলেও ঘোলা কমে।

পানির ক্ষারত্ব : পানি ক্ষারীয় হলে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি কম হয়। মাছের দৈহিক বৃদ্ধি কমে যায়। মাছের দেহে পিচ্ছিল পদার্থ কমে যায়। পুকুর তৈরির সময় ওপরে শতাংশ প্রতি ১ থেকে ২ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হয়। লেবু কেটে দিলেও ক্ষারত্ব কমে। ছাই প্রয়োগেও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ হয়।
 

জলজ উদ্ভিদ : কচুরিপানা, কলমিলতা, চেচরা, পাতাঝাঝি, শাপলা, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ এসব জলজ উদ্ভিদ জলাশয়ে রোদ পড়তে বাধা দেয়, মাছের চলাচল, খাদ্য গ্রহণ, প্রজননে সমস্যা করে। এসব ক্ষতিকর জলজ উদ্ভিদ কাঁচি দিয়ে কেটে সব সময় পুকুরের পানি ও পুকুর পরিষ্কার রাখতে হয়।


রোগবালাই : শীতে মাছের ক্ষতরোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ ও ফুলকা পচা রোগ হয়। এসব রোগ প্রতিরোধের জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন তাহলো-
১. পুকুরের পরিবেশ ও পানির গুণাগুণ ঠিক রাখা; ২. জলজ আগাছামুক্ত রাখা; ৩. পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ার ব্যবস্থা করা; ৪. অনাকাক্সিক্ষত জলজ প্রাণী অপসারণ করা; ৫. অতিরিক্ত কাদা সরানো; ৬. দুই তিন বছর পর পর পুকুর শুকানো; ৭. নিয়মিত ও পরিমিত চুন প্রয়োগ করা; ৮. মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা; ৯. প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতি পরীক্ষা করা; ১০. হররা টানা; ১১. পাখি বসতে না দেয়া; ১২. জাল শোধন করে ব্যবহার করা; ১৩. রোগাক্রান্ত মাছ অপসারণ করা; ১৪. সব সময় ঢেউয়ের ব্যবস্থা রাখা; ১৫. পানি কমে গেলে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা; ১৬. ভাসমান খাদ্য প্রয়োগ করা; ১৭. পানি বেশি দূষিত হলে পানি পরিবর্তন করা; ১৮. পুকুরে বিভিন্ন স্থানে একটু গভীর বা গর্ত করা যাতে পানি কমে গেলে মাছ সেখানে আশ্রয় নিতে পারে।
শীত ও গ্রীষ্মে প্রতিদিন পুকুরে যেতে হবে। পুকুরের অবস্থা দেখতে হবে। সাত দিন পর পর মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। আর মাছ সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যা হলে উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এতে খরচ কমে যাবে, লাভ বেশি হবে।

ভুঁইয়া মো. মাহবুব আলম*
* মৎস্য চাষী, আমতলী, বরগুনা

বিস্তারিত
পোলট্রি পালনে জীব নিরাপত্তা ও রোগ দমন

বাংলাদেশের পুষ্টির অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো। অনেক ফ্যাক্টর এর পেছনে কাজ করছে। তবে আমিষের জোগানে পোলট্রি শিল্পকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে। পোলট্রি শিল্প এভাবে বিকাশ না হলে আমাদের পারিবারিক পুষ্টিতে আমিষের অবস্থান অনেক নিচে থাকত। দেশে পরিকল্পিতভাবে যেমন পোলট্রি শিল্প গড়ে উঠেছে আবার অপরিকল্পিতভাবেই অনেক পোলট্রি শিল্প গড়ে উঠেছে। সবাই কিন্তু সমানভাবে লাভ করতে পারে না। বিশেষ কিছু কারণ তো আছেই এর পেছনে। পোলট্রি শিল্প বিকাশে জীব নিরাপত্তা বিশেষ ভূমিকা পালন করে সব সময়।  বাংলাদেশ বাণিজ্যিক পোলট্রি বেশ বিকশিত হয়েছে। আর বিকাশমান এ ট্রেন্ডের কারণে পোলট্রি শিল্প অনেক এগিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের মানুষ আমিষ গ্রহণে আগের তুলনায় অনেক বেশি পুষ্টি পাচ্ছে। পোলট্রি পালনে মূল সমস্যা হচ্ছে খামার ব্যবস্থাপনা ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ রোগ প্রতিরোধ করা। যদি খামার ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জন করা যায় তবে পোলট্রি পালন লাভজনক হয়। খামার ব্যবস্থাপনার মূল বিচার্য বিষয় হচ্ছে খামারে জীব নিরাপত্তা জোরদার করা। জীব নিরাপত্তার কিছু প্রাথমিক বিচার্য হচ্ছে-
১. জীব নিরাপত্তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা বা থাকা;
২. জীব নিরাপত্তা বোঝার পর করণীয় নির্ধারণ।
মূলত এ দুইটি বিষয়কে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে পোলট্রি সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক রোগব্যাধি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
জীব নিরাপত্তা কী?
জীব নিরাপত্তা হচ্ছে এম কিছু ব্যবস্থার সমন্বয় যেখানে জীব বা প্রাণী স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত থাকে। পোলট্রির ক্ষেত্রে জীব নিরাপত্তা তা হলে পোলট্রি ফার্মের কিছু ব্যবস্থাপনা যা পোলট্রি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখে। পোলট্রি ফার্মে জীব নিরাপত্তার ক্ষেত্রে খামারের অবস্থান, ডিজাইন এবং এর স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে। পোলট্রি ফার্ম অবশ্যই শহর, বাজার এবং জনবসতিপূর্ণ এলাকার বাইরে স্থাপন করতে হয়। কারণ শহর, বাজার, জনবসতি থেকে হাজারো রকমের রোগব্যাধি ছড়ায় যা পোলট্রিবো সরাসরি আক্রান্ত করে। সুতরাং পোলট্রি ফার্ম অবশ্যই লোকালয় থেকে দূরে অবস্থিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। দ্বিতীয়ত খামারের ডিজাইন, সাধারণত পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচল করতে পারে এ বিষয়টি মাথায় রেখে পোলট্রি খামারের ডিজাইন করতে হয়। আমরা এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ দিকে সম্মুখভাগ বিচার করে থাকি। যদি দক্ষিণে খামারের সম্মুখভাগ নির্বাচন করা না যায় তবে পূর্ব পশ্চিম মুখো ঘরের ডিজাইন চিন্তা করা যেতে পারে। দক্ষিণ দিকে দৈর্ঘ্য এবং পশ্চিম দিকে প্রস্থ বিবেচনায় এনে পোলট্রি ফার্মের ডিজাইন করলে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের নিশ্চয়তা থাকে। আলো বাতাস রোগ নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখে। পোলট্রি খামার সবসময়ই আবর্জনা মুক্ত, পরিষ্কার থাকতে হয়। যদি এরকমভাবে খামারের স্থান ও ডিজাইন করা যায় তবে অবশ্যই খামারে রোগব্যাধির প্রকোপ কম হবে। এ হচ্ছে জীব নিরাপত্তার প্রথম বিষয়।
২. জীব নিরাপত্তা : জীব নিরাপত্তা মূলত খামারের সার্বিক ব্যবস্থাপনাকে বোঝায়। এখানে খামারে প্রবেশদ্বার থেকে খামারের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট থাকে। খামারে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া খামারে প্রবেশ ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য প্রবেশের  আগে জীবাণুনাশক ফুটবাথ থাকতে হয়। সাধারণত পটাশের পানি অথবা আইওসান জাতীয় জীবাণুনাশক খামারের গেটে ফুটবাথ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
খামারে পোলট্রির রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু রোগের প্রতিশেধক টিকা নিয়মিত প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে পোলট্রির রানীক্ষেত, গামবোরো এবং কলেরা রোগের টিকা দেয়া অত্যাবশ্যক। রানীক্ষেত ও গামবোরো রোগের টিকা সরকারি পর্যায়ে তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে বাচ্চা মুরগির রানীক্ষেত রোগের টিকা বাচ্চার বয়স ১ দিন থেকে ৫ দিনের মধ্যে চোখে ফোটা আকারে দিতে হয় এবং বাচ্চার বয়স ২১ দিন হলে দ্বিতীয় ডোজ টিকা চোখে দিতে হয়। এরপর বাচ্চার বয়স ৬ মাস হলে বয়স্ক মুরগির রানীক্ষেত রোগের টিকা (RDV) ১ সিসি করে মাংসপেশিতে প্রয়োগ করতে হয়। গামবোরো রোগের টিকা ১ ফোটা করে বাচ্চার বয়স ১-৭ দিনের মধ্যে চোখে দিতে হয়।
এছাড়া বেসরকারিভাবে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কিছু টিকা আছে যাকে আমরা Combined Vaccine বলি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই Combined  টিকা রানীক্ষেত ও গামবোরো অথবা রানীক্ষেত ও ইনফেকশাস ব্রনকাইটিসেট প্রতিরোধক্ষম সমন্বিত টিকা হিসেবে বাজারে পাওয়া যায়। আমদানিকৃত এসব টিকা সাধারণত বাচ্চার বয়স ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ফোটা আকারে চোখে প্রয়োগ করতে হয়। এভাবে টিকা প্রদানের মাধ্যমে আমরা রানীক্ষেত গামবোরো এবং ইনফেকশাস ব্রনকাইটিস রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। এছাড়া লেয়ার ফার্মের জন্য কলেরা রোগ প্রতিরোধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কলেরা রোগ দমনের জন্য সরকারি পর্যায়ে উৎপাদিত ফাউল কলেরা টিকা স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হয় এবং মুরগির বয়স ৭০-৭২ দিন হলে ২ সিসি টিকা রানের মাংসে প্রয়োগ করতে হয়।
এ হচ্ছে পোলট্রি ফার্মে অধিক গুরুত্বপূর্ণ সংক্রামক রোগ দমনের উপায়। এছাড়াও পোলট্রিতে সালমোনেলা, ককসিডিয়া, ই-কোলাই এসব অনেক সংক্রামক রোগ হয়ে থাকে। সঠিক জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এসব রোগ দম করতে পারি।
তা হলে জীব নিরাপত্তা বিষয়টি কী দাঁড়াল? খামারে প্রবেশ থেকে টিকা দান এবং পোলট্রি পালনে কিছু ব্যবস্থাপনা যেমন লিটার পদ্ধতিতে পোলট্রি পালন করলে ১০-১৫ দিন পরপর লিটার পাল্টে দেয়া। মাঝে মাঝে লিটারের আর্দ্রতা পরীক্ষা করা। যদি লিটার ভেজা মনে হয় তবে লিটার পরিবর্তন করে নতুন লিটার বিছিয়ে দিতে হবে। লিটার প্রসঙ্গে আরও কিছু তথ্য লিটার অবশ্যই কাঠের গুড়া, ধানের তুষ, শুকনো খড় এবং এর সাথে ১০ শতাংশ চুন মিশিয়ে লিটার প্রস্তুত করতে হয়। এছাড়াও মাঝে মাঝে খামারে জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হয়। এসব করার মধ্য দিয়ে সালমোনেলা, ইকোলাই এবং ককসিডিন্ডসিস রোগ দমন করা সম্ভব।
জীব নিরাপত্তার আরও কিছু বিষয় আছে, যেমন খামারে ব্যবহৃত পানির পাম্প, খাবার পাত্র এসব নিয়মিত পরিষ্কার করতে হয়। খেয়াল রাখতে হবে পোলট্রির জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা জীব নিরাপত্তার আর একটি দিক। এছাড়া খামারের ভেতরে পোকামাকড়, ইঁদুর, চিকা, কুকুর, বেড়াল, শেয়াল এসব প্রাণী যেন প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। এসব কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট সার্বিক বিষয়কে দক্ষভাবে ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে পারলে পোলট্রির অধিকাংশ রেখে দমন করা সম্ভব এবং পোলট্রি পালনকে অধিক লাভজনক করা সম্ভব। সুতরাং রোগ নিয়ন্ত্রণ, জীব নিরাপত্তা ও খামারের লাভ এ সবকিছু একটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এজন্যই পোলট্রি ব্যবসাকে লাভজনক করতে জীব নিরাপত্তা ও রোগ দমন ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হয়।  
তবে যাই করি না কেন আমরা যেন সুন্দর সুষ্ঠু একটা পরিকল্পনা করি। আর দক্ষ সার্ভিস প্রোভাইডারের সাথে পরামর্শ করে খামারের কার্যক্রম শুরু করি। তাছাড়া শিডিউল করে নিয়মিত এবং পরিমিতভাবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বা বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ পরামর্শ করে যাবতীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করি। তবেই আমাদের খামারভিত্তিক কার্যক্রম কম খরচে বৈজ্ঞানিক প্রযুুক্তি অবলম্বনে লাভজনক হবে। আমরা নিজেরা সমৃদ্ধ হব দেশকে দেশের কৃষিকে সমৃদ্ধ করতে পারব।

কৃষিবিদ ডা. এম এ সবুর*
*জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর

বিস্তারিত
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (BSRI)

(সাত বছরের সাফল্য)
পরিবর্তিত আবহাওয়া এবং জলবায়ুতে দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের স্বার্থে ইক্ষুর পাশাপাশি অন্যান্য চিনি উৎপাদনকারী ফসলের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিগত ৯ নভেম্বর ২০১৫ থেকে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (
Bangladesh Sugarcrop Research Institute) রাখা হয়। বর্তমান সরকারের আমলে বিগত ৭ (সাত) বছরে বিএসআরআইয়ের অর্জিত উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো-
ইক্ষু জাত উদ্ভাবন : এ সময় ৬টি উচ্চফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত ইক্ষু জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। যেমন- ঈশ্বরদী ৩৯, ঈশ্বরদী ৪০, বিএসআরআই আখ ৪১, বিএসআরআই আখ ৪২, বিএসআরআই আখ ৪৩ এবং বিএসআরআই আখ ৪৪। এ জাতগুলোর গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১০০ টনেরও বেশি এবং চিনি আহরণের হার ১২ শতাংশ এর ঊর্ধ্বে। এ জাতগুলো বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় বিশেষ করে লবণাক্ত এলাকায়ও চাষাবাদ উপযোগী। এছাড়া বিএসআরআই আখ ৪১ জাতটি চিনি ছাড়াও গুড়, রস তৈরি এবং চিবিয়ে খাওয়ার জন্য বিশেষ উপযোগী। এর গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১৫০ টনেরও বেশি। বিএসআরআই আখ ৪২ জাতটিও চিবিয়ে খাওয়ার উপযোগী এবং আকর্ষণীয়।
সুগারবিটের জাত নির্বাচন : বাংলাদেশের প্রধান চিনি উৎপাদানকারী ফসল আখ থেকে উৎপাদিত চিনি ও গুড়ের পরিমাণ দেশজ মোট চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত হওয়ায় তা পূরণের লক্ষ্যে ইক্ষুর পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি ট্রপিক্যাল সুগারবিটের চাষাবাদ প্রবর্তন করা হয়েছে। বাংলাদেশে চাষাবাদ উপযোগী ট্রপিক্যাল সুগারবিটের ৯টি জাত যথা- শুভ্রা, কাভেরী, এইচ আই-০০৪৪, এইচ আই-০৪৭৩, সিএস-০৩২৭, সিএস-০৩২৮, এসজেড-৩৫, পিএসি-৬০০০৮ এবং এসভি-১ প্রাথমিকভাবে সুপারিশ করা হয়েছে যা বাণিজ্যিকভাবে সুগারবিট চাষের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। পরবর্তীতে বিভিন্ন বীজ কোম্পানি  থেকে আরও কিছু ট্রপিক্যাল সুগারবিটের জাত সংগ্রহ করা হয়েছে এবং জাতগুলো নিয়ে গবেষণা-মূল্যায়ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
তাৎক্ষণিকভাবে পানি ও পুষ্টির জন্য ইক্ষুর রস ব্যবহার : বন্যা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর তাৎক্ষণিকভাবে পানি ও পুষ্টির জন্য ইক্ষুর রস ব্যবহার করার লক্ষ্যে বাড়ির আঙিনায় চিবিয়ে খাওয়া আখের কয়েকটি ঝাড় লাগিয়ে উৎপাদিত আখ সারা বছর ব্যবহার করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সাথীফসল ও মুড়ি ইক্ষু ব্যবস্থাপনা  সাথীফসলসহ ইক্ষু আবাদের ‘কৃষিতাত্ত্বিক প্যাকেজ গুলির’ উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
যেমন- এক সারি ইক্ষুর সাথে আলু/পেঁয়াজ/রসুন এবং জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে আলু/পেঁয়াজ/রসুন-মুগডাল/সবুজ সার। অধিক চিনি আহরণের জন্য এবং আখ চাষকে আরও লাভজনক করতে মুড়ি ইক্ষু ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি প্যাকেজের আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
অন্যান্য প্রযুক্তি ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ : ইক্ষুর সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি, সেচ ও পানি নিষ্কাশন, রোগ বালাই ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা, ইক্ষু চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতিগুলোর আধুনিকায়ন করা হয়েছে এবং এ সময় বিএসআরআই পাওয়ার উইডারের উদ্ভাবন করা হয়েছে।
এছাড়াও উল্লিখিত সময়ের ভেতরে বিএসআরআই থেকে যেসব প্রযুক্তিগুলো উদ্ভাবন করা হয়েছে তাহলো-
১. ইক্ষুতে বায়োলজিক্যাল নাইট্রোজেন ফিক্সিংয়ে সক্ষম দুইটি ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করা হয়েছে;
২. দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুগার বিটের গ্রানুলার গুড় উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে;
৩. সুগারবিট স্লাইসার যন্ত্রের উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে;
৪. সুগারবিটের উৎপাদিত গুড় ব্যাবহার করে পারিবারিক পর্যায়ে নাড়– মোয়া প্রভৃতি তৈরির মাধ্যমে সুগারবিটের ব্যবহারিক কলাকৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে;
৫. চরাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় চাষাবাদ উপযোগী লাভজনক গুড় উৎপাদনকারী এবং চিবিয়ে খাওয়া ইক্ষু জাত ও প্রযুক্তি বাছাই এবং গুড় উৎপাদন অথবা সরাসরি বাজারজাতকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে;
৬. ভেষজ পদ্ধতিতে পরিষ্কারকৃত হাইড্রোজবিহীন স্বাস্থ্যসম্মত আখের দানাদার গুড় উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে;
৭. নিপা ভাইরাসমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত খেজুরের সিরাপ, গোলপাতার স্বাস্থ্যসম্মত গুড় উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ প্রযুক্তির বিস্তার ঘটানো হয়েছে;
৮. ফলন বৃদ্ধি ও কাক্সিক্ষত চিনি আহরণ হার প্রাপ্তির লক্ষ্যে ইক্ষু এবং সুগারবিটের সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি সুপারিশ করা হয়েছে;
৯. ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ক্যালরিবিহীন মিষ্টিফসল স্টেভিয়া পাউডার, স্টেভিয়া রেডি টি ব্যাগ তৈরি করা হয়েছে এবং
১০. আখের টিস্যু কালচারকৃত চারা উৎপাদন ও বিস্তার ঘটানো হয়েছে।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন
বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের বায়োটেকনোলজি গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্প:  ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের আওতায় বায়োটেকনোলজি গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, জনবল সংগ্রহ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং বায়োটেকনোলজি ল্যাবরেটরি পরিমার্জন করা হয়েছে। বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে লালপচা  রোগ প্রতিরোধী ইক্ষুজাত এবং সুগারবিটের অঙ্গজ বৃদ্ধির মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।
তাল, খেজুর ও গোলপাতা উন্নয়নের জন্য পাইলট প্রকল্প : ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের আওতায় তাল, খেজুর ও গোলপাতার জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, চারা উৎপাদন প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্যসম্মত গুড় উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং এ যাবত ১,৭৮০০০ খেজুর এবং ৩৮,০০০ তালের চারা সড়ক বিভাগের রাস্তার পাশে রোপণ করা হয়েছে।
বৃহত্তর রংপুরের চরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ইক্ষু চাষ প্রকল্প : ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের আওতায় বৃহত্তর রংপুর এলাকার চরাঞ্চলে ইক্ষু চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ যাবত ২৭৫০টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, ইক্ষু চাষের সাথে সংশ্লিষ্ট ৫০০ জন সম্প্রসারণ কর্মকর্তা-কর্মী ও ৮০০০ জন চাষিকে প্রশিক্ষণ প্রদান, ১৫টি যন্ত্রচালিত উন্নত মানের ইক্ষু মাড়াইকল ও ১০০০ টন ইক্ষু বীজ বিতরণ করা হয়েছে। ফলে এসব চরাঞ্চলে ইক্ষু চাষ ও তা থেকে গুড় উৎপাদনের বিরাট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এবং কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বিএসআরআইকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২০ রৌপ্যপদকে ভূষিত করা হয়।  
বাংলাদেশে সুগারবিট চাষাবাদ প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য পাইলট প্রকল্প : ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের আওতায় সুগারবিট চাষাবাদের জন্য কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা হয়েছে। সুগারবিটের চারা তৈরি এবং মাইক্রোপ্রোপাগেশন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। সুগারবিটের গুণগত মান বিশ্লেষণের জন্য ল্যাবরেটরি স্থাপন-উন্নয়ন এবং সুগারবিট থেকে চিনি ও অন্যান্য উপযাত তৈরির উদ্দেশ্যে মাড়াই পরবর্তী প্রযুক্তি ও বাজারজাতকরণ পদ্ধতি উন্নয়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় লবণাক্ত এলাকাসহ ২৩টি উপজেলায় গবেষণায় নিম্নরূপ ফল পাওয়া গেছে।
ক. বাংলাদেশে সুগারবিটের ফলন হেক্টরপ্রতি ৮১-১৩৫ টন এবং চিনি ধারণক্ষমতা ১৪-১৫ শতাংশ।
খ. এক সারি ও জোড়া সারি পদ্ধতিতে আবাদকৃত আখের সাথে সাথীফসল হিসেবে সুুগারবিট আবাদ করা যায়।
গ. সুুগারবিট থেকে গুড় উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
ঘ. সুগারবিটের পাল্প থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ইক্ষু চাষ সম্প্রসারণ পাইলট প্রকল্প : পূর্বতন সময়ে গৃহীত চলমান এ প্রকল্পটিতে সর্বাধিক সফলতা এসেছে এ সময়ে। ওই এলাকার আখচাষিরা এখন আখের অর্থনৈতিক সুবিধা বুঝতে পেরে নিজেরাই চিবিয়ে খাওয়া আখ এবং গুড় উৎপাদন উপযোগী আখের চাষ করছেন। এ প্রকল্পের সাফল্য হলো ইক্ষু চাষের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার অনেক তামাক চাষি তামাক ছেড়ে ইক্ষুর চাষাবাদ শুরু করেছে তথা ইক্ষু চাষের মাধ্যমে তামাকের চাষ বহুলাংশে কমেছে।


*সংকলিত, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
কবিতা ফাল্গুন ১৪২৩

*আধুনিক কৃষি
শোয়াইব আলম*

কৃষি যদি কৃষ্টি হয় সব সমৃদ্ধির আধার
কৃষি ছাড়া উপায় নেই তোমার আমার কাহার
বীজ হলো প্রধান উপকরণ লাগে কৃষি কাজে
সাথে থাকবে সার সেচ ব্যবস্থাপনা সব সাজে
কথায় আছে সুবংশে সুসন্তান সুধীজনে কয়
মানলে কথা সুবীজে সুফলন পাবে নিশ্চয়
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা গুণের নাইকো শেষ
কম খরচে বালাই নিয়ন্ত্রণ নির্মল পরিবেশ
কৃষি বিশেষজ্ঞ বলেন তবে সারের রাজা জৈব সার
যত পার  প্রয়োগ করো গোবর কম্পোস্ট সবুজ সার
বেশি ফলন পেতে হলে বীজ সার সেচ যত্ন
গুণীজন বলেন তাই এই চারে মিলে রত্ন
এলসিসি এডব্লিওডি কৃষির নতুন প্রযুক্তি
যথাযথ অনুসরণ করলে আসবে সফল মুক্তি
ট্রান্সপ্লান্টার ড্রামসীডার পাওয়ার থ্রেসার আছে
যুক্তি পরামর্শ সবই আছে পাবেন ডিএই’র কাছে
বীজ শোধন অঙ্কুরোদগম এসব পরীক্ষা করো
বালাইয়ের বিরুদ্ধে কাজে লাগাও বুদ্ধি যত পারো
পরিকল্পিত সেচ দিলে বেশি ফলন হয়
কৃষি প্রযুক্তি পদ্ধতি কৌশল ঠকার কিন্তু নয়
সময় মতো কাটো ফসল পেকে যাওয়ার পর
সাবধানে শুকিয়ে ঝেড়ে তোলো গোলায় কিংবা ঘর
গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে ফলন হয় বেশি
মাটি পরীক্ষায় দিও সার দেশি কিংবা বিদেশি
জৈবসার মাটির প্রাণ যত বেশি দাও
মাটির স্বাস্থ্য ভালো করে ফলন বেশি নাও
সব কাজে পরামর্শ নিদের্শনা মেনে চল ভাই
কৃষি বিভাগ ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নাই
পরিবেশবান্ধব কৃষি করতে একটু সচেতন হও
কম খরচে লাভ বেশি এর বাহিরে নও
সবাই মিলে করব কৃষি দেশ সমৃদ্ধির জন্য
সুখে শান্তিতে থেকে মোরা হব খুশি ধন্য
কৃষিকথায় সমন্বিত সবার জন্য তথ্য আছে
পঞ্চাশ টাকায় বার সংখ্যার তথ্য কৌশল আছে  
বেতার টিভি আইসিটি হাত বাড়ালেই পাবে
সফল কৃষি করতে হলে সবার কাছে যাবে
আধুনিক কৃষি অনুসরণ করে দেশ হবে সমৃদ্ধ
ফলন উৎপাদনে এগিয়ে যাব দেশ হবে উন্নত
আসুন আমরা সবাই মিলে সোনার দেশ গড়ি
কৃষি সমৃদ্ধ দেশ গড়তে একযোগে কাজ করি।


বহুরূপী জলবায়ু
মো. জুন্নুন আলী প্রামাণিক**

জলবায়ু বহুরূপী রূপধারণে প্রকাশ তার,
অবস্থার প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠার স্বভাব তার।
তাপানলে ভয়ানক ক্ষিপ্ত রূপের তা-ব আসে,
ভূমিপৃষ্ঠে তাপদাহ্য অগ্নি গড়ার খেলায় হাসে।
তরুলতা ছারখার মাটি শুকিয়ে বালু কণা উড়ে,
বাতাসের তীব্রতায় বালু উড়ায় আনন্দে ঘুরে।
মহাকষ্ট জীবনের যাত্রা পথের বাধায় পড়ে,
শূন্যতার চিত্রপটে ধু ধু প্রান্তর মরুতে ভরে।
অবস্থান তাপহীন সূর্য কিরণ সামান্য যেথা,
ভয়াবহ তীব্রতায় শীত বর্ষণে বরফ সেথা।
বিরাজিত পরিবেশে তৈরি রূপের তা-ব হাতে,
প্রস্তুতির ভাবনায় ক্ষেপা দৃষ্টির নকশায় মাতে।
সূর্যালোকে জলাবায়ু দ্রুত চলার সুপথ দেখে,
উষ্ণতায় ভারসাম্যে ভূমিপৃষ্ঠের স্বরূপআঁকে।
প্রচলিত জীবজন্তু টিকে থাকার লড়াই করে,
জীবিকার অন্বেষণে ব্যস্ত নয়নে তাকায় ফিরে।
প্রখরতা কোমলতা মৃদু নতুবা সঠিক ত্যাজে,
জমিনের ভাবমূর্তি ফুটে তুলতে ভীষণ সাজে।
ভূগর্ভের বদুগ্যাস মাটি কাঁপিয়ে ফাটিয়ে উঠে,
অফুরন্ত ধূম্ররজালে যন্ত্র ধোয়ায় দূষণ ঘটে।
শোধনের বন্দোবস্তে যারা প্রস্তুত তারাও ব্যর্থ,
জলবায়ু গোলযোগে মত্ত্ব দেখে না মানব স্বার্থ।
ভয়ানক দুর্যোগের ছবি তৈরিতে আকৃষ্ট থাকে,
অনাবৃষ্টি ঘূর্ণিঝড় বন্যা প্রবল প্রতাপে ডাকে।
কৃষকের আদরের নানা ফসল বিপদে ডুবে,
স্নেহময় জলবায়ু ভারী হিংস্র বিচিত্র ক্ষোভে।
সব সর্তকতায় খবর নেব আবহাওয়া দপ্তর হতে
পরিত্রাণ পাব দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাব যাতে।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর **গ্রাম-বিদ্যাবাগীশ, উপজেলা-ফুলবাড়ি, জেলা-কুড়িগ্রাম। ০১৭৩৫২০২৭৯৮

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর কৃষিকথা ১৪২৩ (নিয়মিত বিভাগ)

ওমর ফারুক, গ্রাম-বিছন্দই, উপজেলা-হাতিবান্ধা, জেলা-লালমনিরহাট
প্রশ্ন : আলু গাছের পাতা খসখসে হয়ে যায় এবং ওপরের দিকে মুড়ে যায়। এর প্রতিকার কী?

উত্তর : এটি আলুর একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এ রোগ হলে পাতা খাঁড়া ও ওপরের দিকে মুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রঙ হালকা সবুজ হয়ে যায়। কখনও কখনও পাতার কিনারা লালচে বেগুনি রঙের হয়ে যায়। গাছ আকারে খাটো হয় কেননা এ রোগে গাছের বাড়বাড়তি বন্ধ হয়ে যায়। ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ কমে যায় কারণ আলুর আকার যেমন ছোট হয় তেমনি আলুর সংখ্যাও অনেক কম হয়। এ  রোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য আলুর রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। এক লিটার পানিতে ২ মিলিলিটার এজেড্রিন/নোভাক্রন/ মেনেড্রিন অথবা ১ মিলিলিটার ডাইমেক্রন মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর জমিতে স্প্রে করতে হবে। আক্রান্ত গাছ আলুসহ তুলে ফেলতে হবে।

 

সেলিম রেজা, গ্রাম- মমিরা, উপজেলা- গাংনী, জেলা-মেহেরপুর
প্রশ্ন : মসুর গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে যায়, গাছের গোড়ায় পচন দেখা যায়। কী করলে এ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে?

উত্তর : এটি মসুরের একটি ছত্রাকজনিত রোগ। চারা ও বয়স্ক অবস্থায় এ রোগের আক্রমণ হয়।  পাতা আস্তে আস্তে হলুদ হয়ে গাছ ঢলে পড়ে এবং শুকিয়ে যায়। মাটি যদি ভেজা থাকে তাহলে গাছের গোড়ায় সাদা  তুলার মতো বস্তু ও সরিষার দানার মতো গুটি দেখা যায়। এ রোগের দমনের জন্য ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে কারণ রোগের জীবাণু এ অংশ বা মাটিতে বেঁচে থাকে এবং পরের বছর ফসলে আক্রমণ করে। আক্রমণ বেশি হলে রোভরাল ২ গ্রাম-লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে মাটিসহ গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। আক্রান্ত ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করা যাবে না। বপনের আগে প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম প্রভ্যাক্স বা কার্বেন্ডাজিম মিশিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। ভেজা স্যাঁতসে্যঁতে মাটিতে এ রোগ বেশি হয় বলে জমিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মাটিতে জৈবসারের ব্যবহার বাড়িয়ে দিতে হবে। ফসল তোলার পর জমিতে কয়েকবার অন্য ফসল চাষ করে আবার মসুর চাষ করলে রোগ আক্রমণের সম্ভাবনা কমে যায়। জমি চাষ দিয়ে কিছুদিন ফেলে রাখতে পারলে ভালো।

 

শাসুল আলম, গ্রাম- বলনামপুর, উপজেলা- হরিণাকুণ্ডু, জেলা-ঝিনাইদহ
প্রশ্ন : আমার মুরগির পাতলা পায়খানা হয়েছে, পায়খানার দেখতে সবুজ। মুরগিগুলো কিছু খায় না, শুধু ঝিমায়। কী ওষুধ ব্যবহার করব ?
উত্তর : মুরগির যে রোগটি হয়েছে তাকে ফাউল কলেরা বলে। এর চিকিৎসা হিসেবে মুরগিগুলোকে প্রতি দুই লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হিসেবে সিপ্রোসিন ভেট-এনফ্লক্স ভেট সল্যুশন মিশিয়ে ৩ দিন খাওয়াতে হবে। এর সাথে প্রতি ২ লিটার পানিতে ১ গ্রাম হিসেবে রেনালাইট-ইলেকট্রোমিন পাউডার তিন দিন খাওয়াতে হবে। এ রোগ থেকে বাঁচার জন্য মুরগিকে নিয়মিত টিকা দিতে হবে। কলেরার টিকা মুরগির ৫০ দিন বয়সে প্রথম ডোজ এবং ১১৫ দিন বয়সে দ্বিতীয় ডোজ দিতে হয়।

 

সুরুজ আলী, গ্রাম- খয়েরবাড়ি শ্যামপুর, উপজেলা- পীরগঞ্জ, জেলা- রংপুর
প্রশ্ন : আমি আমার গরুকে মোটাতাজা করতে চাই, কীভাবে করতে পারি?

উত্তর: গরুকে  প্রতি ৭৫ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য একটি করে এন্ডেক্স-এলটি ভেট বোলাস খাওয়াতে হবে। এর তিন দিন পর  থেকে ১৫ মিলিলিটার করে তিন সপ্তাহে তিনটি মেটাফস/কেটোফস ইনজেকশন এবং সাথে ১০ মিলিলিটার করে এমাইনোভিট/ভি  প্লেক্স  ইনজেকশন দিতে হবে। গরুকে প্রতিদিন দানাদার খাবার, ইউরিয়া মিশ্রিত খড় ও কাঁচা ঘাস খাওয়াতে হবে। ইউরিয়া মিশ্রিত খড় তৈরির জন্য  ১০ কেজি খড় ছোট ছোট করে কেটে পলিথিনের ওপর বিছাতে হবে। এরপর ১০ লিটার পানির সাথে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে তা খড়ের সাথে ভালোভাবে মিশ্রিত করে সে খড় পলিথিন দিয়ে বেঁধে প্লাস্টিকের ড্রামে অথবা বাঁশের ডোল অথবা মাটির গর্তে বায়ুশূন্য অবস্থায় ৭ দিন রেখে দিতে হবে। ৭ দিন পর থেকে এটা গরুকে খাওয়াতে হবে। গরুর ওজন ৫০-৯৯   কেজি হলে  ইউরিয়া মিশ্রিত খড়, কাঁচা ঘাস ও দানাদার খাবার খাওয়াতে হবে যথাক্রমে ২ কেজি, ৪-৫ কেজি ও ২.৫-৩ কেজি। ১০০-১৫০ কেজি ওজনের গরুর জন্য এ পরিমাণ যথাক্রমে  ৩ কেজি, ৭ কেজি ও ৩-৩.৫ কেজি। আর ১৫০-২০০ কেজি ওজনের গরুর জন্য এ পরিমাণ যথাক্রমে  ৪ কেজি, ৮-১০ কেজি ও ৪-৪.৫ কেজি।

 

মো. আবু হানিফ, গ্রাম- বসুখালী, উপজেলা- আশাশুনি, জেলা-সাতক্ষীরা
প্রশ্ন :  মাছের শরীরে ক্ষত দেখা দিয়েছে, পুকুরে মাছ মারা যাচ্ছে ও পানির ওপরে ভেসে উঠছে কী করব?

উত্তর: শীতের মৌসুমে পুকুরে পানির তাপমাত্রা কম থাকার কারণে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মাছের শরীরে বিভিন্ন রকম ঘা ও  ক্ষত দেখা দেয়।  সংক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ক্ষত স্থান থেকে পুঁজ বের হয় ও দুর্গন্ধ ছড়ায়। মাছের ক্ষত রোগ হলে পুকুরে চুন ও লবণ প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি শতাংশ পুকুরে আধা কেজি  করে চুন ও লবণ প্রয়োগ করার ৭ দিন পর আবারো একইভাবে  আধা কেজি  করে চুন ও লবণ প্রয়োগ করতে হবে। আক্রমণের পরিমাণ বেশি হলে শতাংশপ্রতি  ১৫ গ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট এবং ১ কেজি করে চুন ও লবণ প্রয়োগ করলে ফল পাওয়া যায়। প্রতিকারের আরেকটি উপায় হলো ঘাযুক্ত মাছগুলো পুকুর থেকে তুলে ২০ লিটার পাত্রে পানি নিয়ে তাতে ২০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে পানিতে মাছগুলোকে ৫ মিনিট রাখতে হবে। অন্য একটি পাত্রে একই পরিমাণ পানি নিয়ে ৫ গ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে ৫ মিনিটের জন্য মাছগুলোকে রাখতে হবে তারপর পুকুরে ছাড়তে হবে। এসবের পাশাপাশি  প্রতি কেজি খাবারে ২টি টেট্রাসাইক্লিন অথবা টেরামাইসিন ট্যাবলেট মিশিয়ে ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে। শরীরে ঘা এর পরিমাণ বেশি হলে মাছ উঠিয়ে নিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। এ রোগ প্রতিরোধের জন্য শীতের শুরুতে প্রতি শতাংশে ৩-৪টি করে চালতা ছেঁচে পুকুরে ছড়িয়ে দিতে হবে। শীতকালে পুকুরে যেন পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরকে বন্যামুক্ত রাখতে হবে। পুকুরে ২-৩ মাস পরপর চুন প্রয়োগ করা ভালো।

 

মো. বেলাল, গ্রাম- ভোলাহাট, উপজেলা- ভোলাহাট, জেলা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন : মাছ অবিরত পানিতে সাঁতার কাটছে, মাঝে মধ্যে লাফালাফি করছে, পুকুরের কিনারায় যে ডালপালা আছে সেগুলোর সাথে শরীর ঘষছে, মাছের আঁশ ঝড়ে যাচ্ছে  মাছগুলো তুলে আনার পর গোলাকার দাগ বা ছোট আকারের ক্ষত দেখা যাচ্ছে। কী করব?

উত্তর : মাছের শরীর উকুন দ্বারা সংক্রমিত হলে এমন হয়। রোগের নাম ফিশ আরগুলোসিস। মাছের ক্ষেত্রে সাধারণত রুই এবং অন্যান্য কার্প মাছ এ পরজীবী দ্বারা সংক্রমিত হয়। এটা খালি চোখে দেখা যায়। উকুন মাছের পিঠে ও পাখনায় থাকে। এ রোগ হলে  ৩-৫ ফুট গভীরতার পুকুরে শতক প্রতি ২-৩ মিলিলিটার সুমিথিয়ন অথবা ম্যালাথিয়ন ৭ দিন পরপর ৩ বার প্রয়োগ করতে হবে কারণ উকুন মারা গেলেও ডিম বেঁচে থাকতে পারে। পুকুর থেকে সংক্রমিত মাছ অপসারণ করতে হবে। একরপ্রতি ১০০ কেজি  হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে জৈবসারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। যদি সম্ভব হয় তাহলে আক্রান্ত মাছগুলোকে পটাশ দ্রবণে (২০গ্রাম/লিটার) ২০-৩০ সেকেন্ড ডুবিয়ে পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। এ রোগ প্রতিরোধ করার জন্য পুকুরে মাছের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়ার সাথে সাথে পুকুরে পানি যাতে দূষিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পুকুরে কখনই হাঁস মুরগির বিষ্ঠা প্রয়োগ করা যাবে না।
সুপ্রিয় পাঠক বৃহত্তর কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির ব্যতীত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে।

 

তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৬ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।

কৃষিবিদ ঊর্মি আহসান*
*উপজেলা কৃষি অফিসার (এলআর), সংযুক্ত কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
চৈত্র মাসের কৃষি ১৪২৩

আমরা ১৪২৩ বঙ্গাব্দের শেষ অংশে চলে এসেছি। চৈত্র বাংলা বছরের শেষ মাস হলেও কৃষির শেষ বলে কিছু নেই। বরং এ মাসে রবি ফসল ও গ্রীষ্মকালীন ফসলের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম এক সাথে করতে হয় বলে বেড়ে যায় কৃষকের ব্যস্ততা। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, কৃষিতে আপনাদের শুভ কামনাসহ সংক্ষিপ্ত শিরোনামে জেনে নেই এ মাসে কৃষিতে কী কী গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো-
বোরো ধান
যারা শীতের কারণে দেরিতে চারা রোপণ করেছেন তাদের ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। জমিতে গুটি ইউরিয়া দিয়ে থাকলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে না;
সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে;
এলাকার জমিতে যদি সালফার ও দস্তা সারের অভাব থাকে এবং জমি তৈরির সময় এ সারগুলো না দেয়া হয়ে থাকে তবে ফসলে পুষ্টির অভাবজনিত লক্ষণ পরীক্ষা করে শতাংশপ্রতি ২৫০ গ্রাম সালফার ও ৪০ গ্রাম দস্তা সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩-৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে;
পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করতে পারেন;
এসব পন্থায় রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
গম
দেরিতে বপন করা গম পেকে গেলে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে;
শুকনো বীজ ছায়ায় ঠাণ্ডা করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসিতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে;
বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করতে হবে; সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (খরিফ)
গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ মাসে বীজ বপন করতে হবে;
শতাংশপ্রতি বীজ লাগবে ১০০-১২০ গ্রাম;
প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ৩৬৫ গ্রাম, টিএসপি ২২২ গ্রাম, এমওপি ১২০ গ্রাম, জিপসাম ১৬০ গ্রাম এবং দস্তা সার ১৬ গ্রাম সার দিতে হবে।
পাট
চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপন করা যায়;
পাটের ভালো জাতগুলো হলো ও-৯৮৯৭, ওএম-১, সিসি-৪৫, বিজেসি-৭৩৭০, সিভিএল-১, এইচসি-৯৫, এইচ এস-২৪;
পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫-৬টি চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করতে হবে;
সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ১৭ থেকে ২০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। ছিটিয়ে বুনলে প্রয়োজন হয় ২৫-৩০ গ্রাম বীজ;
পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭-১০ সেন্টিমিটার রাখা ভালো;
ভালো ফলনের জন্য শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি সার শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে সালফার ও জিংকের অভাব থাকলে জমিতে সার দেয়ার সময় ৪০০ গ্রাম জিপসার ও ২০ গ্রাম দস্তা সার দিতে হবে;
চারা গজানোর ১৫ থেকে ২০ দিন পর শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করেত হবে। এর ৩০ থেকে ৪০ দিন পর দ্বিতীয়বারের মতো শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করেত হবে।
অন্যান্য মাঠ ফসল
রবি ফসলের মধ্যে চিনা, কাউন, আলু, মিষ্টি আলু, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন যদি এখনও মাঠে থাকে তবে দেরি না করে সাবধানে তুলে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এ সময়ে বা সামান্য পরে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পচনশীল ফসল সেজন্য তাড়াতাড়ি কেটে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
শাকসবজি
গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি চাষ করতে চাইলে এ মাসেই বীজ বপন বা চারা রোপণ শুরু করতে হবে;
সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে;
এসময় গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ঢেঁড়স, বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, শসা, ওলকচু, পটোল, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লালশাক, পুঁইশাক এসব সবজি চাষ করতে পারেন ।
গাছপালা
এ সময় বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রসের পরিমাণ কমে আসে। এ অবস্থায় গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
আম গাছে হপার পোকার আক্রমণ হলে অনুমোদিত কীটনাশক যেমন- সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি প্রভৃতি প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
এ সময় আমে পাউডারি মিলডিউ ও এ্যান্থাকনোজ রোগ দেখা দিতে পারে। টিল্ট, রিডোমিল গোল্ড বা ডায়থেন এম ৪৫ অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
কলা বাগানের পার্শ্ব চারা, মরা পাতা কেটে দিতে হবে; পেঁপের চারা রোপণ করতে পারেন এ মাসে।
নার্সারিতে চারা উৎপাদনের জন্য বনজ গাছের বীজ রোপণ করতে পারেন।
যাদের বাঁশ ঝাড় আছে তারা বাঁশ ঝাড়ের গোড়ায় মাটি ও জৈব সার প্রয়োগ করতে পারেন।
প্রাণিসম্পদ
শীতকাল শেষ হয়ে গরম পড়ার সময়টিতে পোলট্রি খামারি ভাইদের বেশ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ শীতকালে মোরগ-মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়। সে কারণে রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। তাই আগ থেকেই টিকার ব্যবস্থা করতে হবে।
ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই এর অভাব দেখা দিতে পারে। তাই খাবারের সাথে ভিটামিন সরবরাহ করতে হবে।
চৈত্র মাসে বেশ গরম পড়ে, তাই গবাদিপশুর এ সময় বিশ্রামের প্রয়োজন। গবাদিপশুকে ছায়ায় রাখতে হবে এবং বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে, সে সাথে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। গবাদিপশুর গলাফুলা, তড়কা, বাদলা রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
মাছের আঁতুর পুকুর তৈরির কাজ এ মাসে শেষ করতে হবে; পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাঁদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশপ্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে।
পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠাণ্ডা করে দিতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক প্রতি বাংলা মাসেই কৃষিকথায় কৃষি কাজের জন্য অনুসরণীয় শিরোনামে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞ, মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। আপনাদের সবাইকে নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা।

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ 
manzur_1980@yahoo.com

বিস্তারিত

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon