Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

মিষ্টিআলুর পুষ্টি ও তুষ্টি

মিষ্টিআলুর ইংরেজি নাম Sweet potato এবং বৈজ্ঞানিক নাম Ipomoea batatus, পরিবার হলো Convolvulaceae. উৎপাদনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের খাদ্য ফসলসমূহের মধ্যে মিষ্টিআলুর স্থান চতুর্থ। মিষ্টিআলু চাষ বেশ লাভজনক। চাষে খরচ কম, লাভ বেশি। এতে পোকামাকড় ও রোগবালাই নেই বললেই চলে। উৎপাদন ক্ষমতাও তুলনামূলকভাবে বেশি। মিষ্টিআলু বিশ্বের অধিক ফলনশীল ফসলের মধ্যে অন্যতম। এ ফসলটি অত্যধিক খরা সহিষ্ণু। মিষ্টিআলু ভাত ও আলুর  চেয়ে অধিক পুষ্টিকর। মিষ্টিআলু প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে হালুয়া, পায়েশ, ফিরনি, চিপস, জ্যাম, জেলি, মিষ্টি, ভর্তা, তরকারি এসব তৈরি করা যায়। দুধের সঙ্গে মিষ্টিআলু মিশিয়ে খেলে অন্য রকম স্বাদ লাগে। নদীর চরের বালু প্রধান মাটিতেও মিষ্টিআলু অধিকতর উপযোগী ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। মিষ্টিআলুর পাতা বা শাক সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর তরকারি হিসেবে গ্রাম বাংলায় যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে শুঁটকি ছোটমাছ আর মাছের মাথা দিয়ে রান্না করলে বেশ স্বাদের হয়। মিষ্টিআলু জমি থেকে তুলে ৩-৪ মাস পর্যন্ত অনায়াসে রাখা যায়।


মিষ্টিআলুর পুষ্টিমান : অনেক ফসলের তুলনায় মিষ্টিআলুর পুষ্টিমান অনেক বেশি। খাবার যোগ্য প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টিআলুতে পুষ্টিমান রয়েছে- জলীয় অংশ ৬৮.৫ গ্রাম; আঁশ ০.৮ গ্রাম; খাদ্যশক্তি ১২০ কিলোক্যালরি; আমিষ ১.৫-২.০০ গ্রাম; চর্বি ০.৭ গ্রাম; শর্করা ১৯-২৩ গ্রাম; ক্যালসিয়াম ৪৬ মিলিগ্রাম; লৌহ ০.৮ গ্রাম; বিটা ক্যারোটিন (ভিটামিন এ) ৪০০-১২,৩০০ আন্তর্জাতিক ইউনিট; ভিটামিন বি-১ ০.০৬ মিলিগ্রাম; ভিটামিন বি-২ ০.০২ মিলিগ্রাম; ভিটামিন সি ২৪.০ মিলিগ্রাম। অনেক ফসলে তুলনায় মিষ্টিআলুর পুষ্টিগুণ অনেক বেশি।


মিষ্টিআলুর জাত
এক সময় যখন মিষ্টিআলু আরও বেশি জনপ্রিয় এবং আবশ্যকীয় ছিল তখন বর্তমানের মতো এত আধুনিক উচ্চফলনশীল জাত ছিল না। কিন্তু বর্তমানে মিষ্টিআলুর অনেক জাত রয়েছে। জাতগুলো বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) হতে এ পর্যন্ত ১৩টি উচ্চফলনশীল মিষ্টিআলুর জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্তায়ন করা হয়েছে। জাতগুলো হলো বারি মিষ্টিআলু-১ (তৃপ্তি), বারি মিষ্টিআলু-২ (কমলা সুন্দরী), বারি মিষ্টিআলু-৩ (দৌলতপুরী), বারি মিষ্টিআলু-৪, বারি মিষ্টিআলু-৫, বারি মিষ্টিআলু-৬, বারি মিষ্টিআলু-৭, বারি মিষ্টিআলু-৮, বারি মিষ্টিআলু-৯, বারি মিষ্টিআলু-১০, বারি মিষ্টিআলু-১১, বারি মিষ্টিআলু-১২, বারি মিষ্টিআলু-১৩। এবার জাতের বৈশিষ্ট্য এক এক করে বর্ণিত হলো।


বারি মিষ্টিআলু-১ (তৃপ্তি)
এ জাতের কাণ্ডের রঙ বেগুনি এবং লোমশ। কাণ্ডের অগ্রভাগ সবুজ, পাতা গাঢ় সবুজ। কন্দমূল সাদা, শাঁস হালকা হলদে ও নরম। মূলের ওজন ২০০-২৫০ গ্রাম, তবে কোন সময়ে একেকটি মূল ১.৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। কন্দমূল উপবৃত্তাকার। প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে প্রায় ৪৫০ আ. ইউ ভিটামিন-এ আছে। জীবনকাল ১৪০-১৫০ দিন। স্বাভাবিক অবস্থায় এর ফলন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৪০-৪৫ টন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাত চাষ করা যায়।


বারি মিষ্টিআলু-২ (কমলা সুন্দরী)
এ জাতের কাণ্ড সবুজ, পাতা কচি অবস্থায় বেগুনি, কাণ্ডের অগ্রভাগ বেগুনি ও পাতা বেগুনি, পাতার উল্টো দিকের শিরা বর্ণহীন। কন্দমূল লাল ও শাঁস কমলা বর্ণের। কন্দমূলের আকৃতি উপবৃত্তাকার। কন্দমূলের ওজন ১৮০-২২০ গ্রাম। শাঁস নরম। প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে প্রায় ৭৫০০ আ. ইউ ভিটামিন এ আছে। জীবনকাল ১৪০-১৫০ দিন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৪০-৪৫ টন ফলন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এটি চাষ করা যায়। প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য এ জাতটি উত্তম।

 

বারি মিষ্টিআলু-৩ (দৌলতপুরী)
এ জাতের কাণ্ড সবুজ, পাতা খাঁজকাটা ও সবুজ। কন্দমূল সাদা, শাঁস সাদা। কন্দমূলের আকৃতি লম্বাটে। কন্দমূলের ওজন ১৮০-২০০ গ্রাম। শুষ্ক বস্তুর পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগ। জীবনকাল ১৪০-১৫০ দিন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ফলন ৩০-৩৫ টন পর্যন্ত হয়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাত চাষ করা যায়। জাতটির মিষ্টিআলুর উইভিল আক্রমণরোধ ক্ষমতা আছে।


বারি মিষ্টিআলু-৪
এ জাতের কাণ্ড সবুজ, কাণ্ডের অগ্রভাগ বেগুনি, পাতা সবুজ, কচিপাতা বেগুনি। কন্দমূলের ওজন ১৭৫-১৯৫ গ্রাম ও আকৃতি উপবৃত্তাকার। প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে প্রায় ১০৫০ আন্তর্জাতিক ইউনিট ভিটামিন-এ আছে। জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ফলন হয় ৪০-৪৫ টন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাত চাষ করা যায়। জাতটিতে মিষ্টিআলুর উইভিল আক্রমণ কম হয়। বিশেষ করে যশোর ও খুলনায় এ জাতটি আগাম চাষ করা যায়।

 

বারি মিষ্টিআলু-৫
এ জাতের কাণ্ড ও কাণ্ডের অগ্রভাগ সবুজ ও কাণ্ড লোমশ হয়। পাতা সবুজ ও সামান্য খাঁজকাটা। কন্দমূলের ওজন ১৮০-২২০ গ্রাম। প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে প্রায় ১ হাজার আ. ইউ ভিটামিন-এ আছে। জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। সাধারণ অবস্থায় এর ফলন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৩৫-৪০ টন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাত চাষ করা যায়। জাতটিতে মিষ্টিআলুর উইভিল আক্রমণ কম হয়।

 

বারি মিষ্টিআলু-৬
এ জাতের কাণ্ড পুরু ও হালকা সবুজ। কাণ্ডের উপরিভাগ কিছুটা লোমশ। পাতা বড়, খাঁজ কাটা ও সবুজ। কন্দমূলের আকৃতি উপবৃত্তাকার। কন্দমূলের ত্বক হলুদ। শাঁস গাঢ় ক্রিম বর্ণের। শাঁস শুষ্ক এবং প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে প্রায় ৮০০ আ. ইউ. ভিটামিন-এ রয়েছে। কন্দমূলের গড় ওজন ২২০ গ্রাম। জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৪০-৫০ টন ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাত চাষ করা যায়। জাতটির মিষ্টিআলুর উইভিল আক্রমণ রোধ ক্ষমতা আছে। জাতটিতে লবণাক্ততা সহনশীল গুণাগুণ রয়েছে।

 

বারি মিষ্টিআলু-৭
এ জাতের কাণ্ড বেগুনি বর্ণের। পাতা সরল ও সম্পূর্ণ। কচি ও বয়স্ক পাতার রঙ সবুজ, কিন্তু পাতার উল্টো দিকের শিরা বেগুনি বর্ণের। কন্দমূলের আকৃতি উপবৃত্তাকার। কন্দমূলের ত্বক সাদা। শাঁস ক্রিম বর্ণের। শাঁস শুষ্ক এবং প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে প্রায় ৭০০ আ. ইউ. ভিটামিন-এ রয়েছে। জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৪০-৫০ টন ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাত চাষ করা যায়। একটি খরা সহিষ্ণু জাত। জাতটিতে উইভিলের আক্রমণ কম হয়। জাতটিতে লবণাক্ততা সহনশীল গুণাগুণ রয়েছে।


বারি মিষ্টিআলু-৮
এ জাতের লতা ও পাতার বর্ণ সবুজ। কন্দমূলের চামড়ার বর্ণ লাল, শাঁসের বর্ণ হলুদ। কন্দমূলের গড় ওজন ১৬০ গ্রাম। শুষ্ক বস্তুর পরিমাণ শতকরা ৩৫.৩ ভাগ। প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে প্রায় ৬৫০ আন্তর্জাতিক ইউনিট। ভিটামিন-এ রয়েছে। জীবনকাল ১২০-১৩৫ দিন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৪০-৫০ টন ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাত চাষ করা যায়। জাতটি খরা সহিষ্ণু। জাতটিতে উইভিলের আক্রমণ কম হয়।


বারি মিষ্টিআলু-৯
এ জাতের লতা ও পাতার বর্ণ সবুজ এবং পাতা সামান্য খাঁজ কাটা। কন্দমূলের চামড়ার বর্ণ গাঢ় হলুদ, শাঁসের বর্ণ মাঝারি কমলা। কন্দমূলের গড় ওজন ১৬০ গ্রাম। শুষ্ক বস্তুও পরিমাণ শতকরা ৩৫.৬ ভাগ। প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে প্রায় ৭৩০ আ. ইউ. ভিটামিন-এ রয়েছে। জীবনকাল ১২০-১৩৫ দিন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৪০-৫০ টন ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাত চাষ করা যায়। জাতটি খরা সহিষ্ণু। জাতটিতে উইভিলের আক্রমণ কম হয়। জাতটিতে লবণাক্ততা সহনশীল গুণাগুণ রয়েছে।


বারি মিষ্টিআলু-১০
জাতটির লতার কা- ও পাতা সবুজ, পাতার কিনারা, বোঁটা ও কা- হালকা বেগুনি রঙের। কন্দমূল উপবৃত্তাকার, চামড়া গাঢ় বাদামি, শাঁস হলুদাভ। কন্দমূলের গড় ওজন ১৮০-২০০ গ্রাম, শুষ্ক বস্তুর পরিমাণ ২৮.১১%, ভিটামিন-এ ৪০০ আ.এ./১০০ গ্রাম। জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। সাধরণ অবস্থায় এর ফলন হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ টন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতের চাষ করা যায়। জাতটিতে উইভিলের আক্রমণ কম হয়।


বারি মিষ্টিআলু-১১
লতার কা- বেগুনি ও পাতা সবুজ, কন্দমূলের চামড়া লাল ও শাঁস হালকা হলুদ, কন্দ মূলের গড় ওজন ১৮০-২০০ গ্রাম, শুষ্ক বস্তুর পরিমাণ ৩৫.৪৪%, ভিটামিন-এ ৫০০ আ. এ./১০০ গ্রাম। সাধরণ অবস্থায় এর ফলন হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ টন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতের চাষ করা যায়। জাতটিতে উইভিলের আক্রমণ কম হয়।

 

বারি মিষ্টিআলু-১২
লতার কা- ও পাতা সবুজ, কন্দমূলের চামড়া লালচে ও শাঁস কমলা রঙের, কন্দ মূলের গড় ওজন ১৬০-১৮০ গ্রাম, শুষ্ক বস্তুর পরিমাণ ২৯.৪৬%, ভিটামিন-এ ১২,৩০০ আ. এ./১০০ গ্রাম। সাধরণ অবস্থায় এর ফলন হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ টন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতের চাষ করা যায়। জাতটিতে উইভিলের আক্রমণ কম হয়।

 

বারি মিষ্টিআলু-১৩
লতার কা- বেগুনি ও পাতা সবুজ এবং খাজকাটা, কন্দমূলের চামড়া গাঢ় হলুদ ও শাঁস গাঢ় হলুদ রঙের, কন্দ মূলের গড় ওজন ১৬০-১৮০ গ্রাম, শুষ্ক বস্তুর পরিমাণ ২৮.৯৩%, ভিটামিন-এ ৮,৮০০ আ. এ./১০০ গ্রাম। জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। সাধরণ অবস্থায় এর ফলন হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ টন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতের চাষ করা যায়। জাতটিতে উইভিলের আক্রমণ কম হয়।


উৎপাদন প্রযুক্তি
মিষ্টি আলুর উৎপাদন প্রযুক্তি অনেক ফসলের তুলনায় সহজ এবং কম খরচি। একটু সচেতনভাবে চাষ করতে পারলে খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

 

মাটি ও জমি : মাটি পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত বেলে দো-আঁশ ও অপেক্ষাকৃত জৈবসারযুক্ত উঁচু ও উর্বর মাটিতে মিষ্টিআলু ভালো জন্মে। কাদা মাটি, ক্ষার ও লবণাক্ত মাটি মিষ্টিআলু চাষের জন্য উপযুক্ত নয়। নদীর চর অঞ্চলে পলিময় জমিতেও মিষ্টিআলু ভালো জন্মে। এ ফসলটি অত্যধিক খরা সহিষ্ণু। মিষ্টিআলু চাষের জন্য যে মাটিতে পানি জমে না এবং জমি থেকে পানি সহজে বের করে দেয়ার জন্য ভালো ব্যবস্থা আছে এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।


জমি তৈরি চারা উৎপাদন ও রোপণ : মিষ্টিআলুর জমি ৫-৬ বার চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করতে হবে। জমি থেকে আগাছা ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। রোপণের জন্য প্রয়োজন অনুসারে লতা উৎপাদন করতে হবে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ফসল সংগ্রহের পর মিষ্টিআলুর লতা অথবা কন্দ উঁচু জমিতে বীজতলায় রোপণ করে রাখতে হবে। রোপণ মৌসুমে এসব বীজতলা থেকে লতার শাখাকলম তৈরি করে জমিতে রোপণ করতে হবে। মিষ্টিআলুর বীজতলা উঁচু ও আলো-বাতাসময় হতে হবে। মিষ্টিআলুর লতাকে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা টুকরা করে বীজতলায় লাগাতে হবে। প্রত্যেকটি লতার ৩ ভাগের ১ ভাগ মাটির ওপরে রেখে বাকি ২ ভাগ মাটির নিচে লাইনে ঘন করে রোপণ করতে হবে। ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে বীজতলা লতায় ভরে উঠে এবং কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে মিষ্টিআলু উৎপাদনের জন্য এসব ডগার লতা জমিতে লাগাতে হবে। অধিক ফলন পেতে হলে কার্তিক হতে অগ্রহায়ণ মাসে মিষ্টিআলুর লতা জমিতে লাগাতে হবে। মিষ্টিআলু আমাদের দেশে সাধারণত শীতকালে চাষ করা হয়। লতার সাহায্যে মিষ্টিআলুর বংশবিস্তার করা হয়। হেক্টরপ্রতি লতার প্রয়োজন হয় ৫৬ হাজার। মিষ্টিআলুর লতা লাইন করে জমিতে লাগাতে হবে। লতা টুকরা করে কেটে রোপণ করতে হবে। লতার মাথা থেকে ১ম ও ২য় খণ্ড রোপণ করা উচিত। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৬০ সেন্টিমিটার এবং লতা থেকে লতার দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার। সমতল পদ্ধতিতে লাইন তৈরি করে লাগাতে হবে যাতে ২-৩টি গিঁট মাটির নিচে থাকে।


সারের পরিমাণ ও সার প্রয়োগ পদ্ধতি : মিষ্টিআলু যেহেতু মূল জাতীয় ফসল তাই মাটি ঝুরাঝুরা এবং বেশি পরিমাণে জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। আর ভালো ফলনের জন্য টিএসপি এবং এমওপি বেশি ব্যবহার করতে হবে। জমির অবস্থা উর্বরতা এবং প্রকৃতি ভেদে সারের বিভিন্ন মাত্রা ব্যবহার করতে হয়। সাধারণ গড় হলো প্রতি হেক্টর জমিতে মিষ্টিআলু চাষে যে পরিমাণ সার ব্যবহার করা প্রয়োজন তা হলো- গোবর ৮-১০ টন, ইউরিয়া ১৬০-১৮০ কেজি, টিএসপি ১৫০-১৭০ কেজি, এমওপি ১৮০-২০০ কেজি। সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার শেষ চাষের সময় জমিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া এবং এমওপি সার রোপণের ৬০ দিন পর লাইনের পাশ দিয়ে পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে।


সেচ : মিষ্টিআলুর লতা লাগানোর পর পরই জমিতে হালকা সেচের ব্যবস্থা করা গেলে লতা বেঁচে যায় ও তাড়াতাড়ি শিকড় ছাড়ে। জমির আর্দ্রতার ওপর নির্ভর করে ২-৩টি সেচ দিতে হবে। মিষ্টিআলু গাছ মাটিতে লেগে গেলে ৩০, ৬০ এবং ৯০ দিন পর সেচ দেয়া উচিত। খেয়াল রাখতে হবে কখনো যেন কোনোভাবে মিষ্টিআলু জমিতে পানি না জমে থাকে।


অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা : ইউরিয়া সার পার্শ্ব প্রয়োগের সময় ২ বার মাটি দিয়ে গাছের গোড়া বেঁধে দিতে হবে। চারা রোপণের ৫০-৬০ দিন পর থেকে মাসে অন্তত ১ বার লতা নেড়ে চেড়ে দিতে হবে। এতে মিষ্টিআলুর লতার পর্ব থেকে শিকড় গজানো তথা বাজারজাত অনুপযোগী কন্দমূল উৎপাদন এড়ানো সম্ভব এবং ফলশ্রুতিতে কন্দের আকার ও ফলন বাড়ে।


বালাই ব্যবস্থাপনা : আলুর তুলনায় মিষ্টিআলুতে তুলনামূলকভাবে কম বালাইয়ের আক্রমণ হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছু বালাইয়ের মধ্যে রয়েছে।
 

মিষ্টিআলুর বিছা পোকা : প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী বিছা পোকার মথ মিষ্টিআলু গাছের পাতায় ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে অসংখ্য বিছার জন্ম হয়। পাতা খেয়ে ফসলের বিশেষ ক্ষতি করে থাকে। এ পোকা দমনের জন্য ১২ লিটার পানিতে চা চামচের ৪ চামচ ভেপোনা ভালোভাবে মিশিয়ে ছিটানো যেতে পারে। তাছাড়া ডায়াজিনন তরল ওষুধও এ পোকা দমনে সাহায্য করে।


উড়চুঙ্গা পোকা : আমাদের দেশে মিষ্টিআলুর জমিতে উড়চুঙ্গা পোকার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। এ পোকা মিষ্টিআলুর গায়ে গর্ত করে খেতে থাকে। উড়চুঙ্গা পোকা দমনের জন্য ক্লোরোপাইরিফস ৪৮ ইসি প্রতি লিটার পানিকে ২ মিলিলিটার ওষুধ মাটিতে প্রয়োগ করলে বেশ ভালো ফল পাওয়া যায়।


উইভিল পোকা : মিষ্টিআলুর উইভিল পোকা প্রায় সব দেশে ফসলকে আক্রমণ করে ক্ষতি করে থাকে। আমাদের দেশেও এ পোকার আক্রমণ মিষ্টিআলু সংরক্ষণের সময় বেশি দেখা যায়। এ পোকা মিষ্টিআলু খেয়ে প্রচুর পরিমাণে ছিদ্র করে থাকে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত আলুগুলো মানুষ ও পশু খাদ্যের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। গ্রীষ্মকালে এ পোকার আক্রমণ বেশি দেখা যায়। মিষ্টিআলু গাছের গোড়ার আলুতে মাটি তুলে দিলে এ পোকা দমন করা যায়। আক্রান্ত মিষ্টিআলু ভালো আলুর সঙ্গে রাখা যাবে না। জমি তৈরির সময় হেক্টরপ্রতি কার্বোফুরান ৫ জি বা ডায়াজিনন ১৪ জি প্রয়োগ করে হালকা সেচ দিতে হবে। ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার করে এ পোকার আক্রমণ বহুলাংশে কমানো যায়।


ইঁদুরের আক্রমণ : ইঁদুরের গর্তে বিষাক্ত আলুমিনিয়াম ফসফাইড বড়ি দিয়ে গর্তের মুখ ভালো করে বন্ধ করে দিলে ইঁদুর মারা যায়। এজন্য নতুন গর্তে গ্যাস বড়ি দিয়ে আশপাশের সকল গর্তে-নালার মুখ মাটি দিয়ে শক্ত করে বন্ধ করে দিতে হবে।


মিষ্টিআলুর কালচে রোগ : কালচে রোগ মাঠের গাছকে অথবা সংরক্ষণকালে মিষ্টি আলুকে আক্রমণ করে থাকে। আক্রান্ত মিষ্টি আলুর ওপর ঘন কালো গোলাকার দাগের সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে তা সমস্ত আলুতে ছড়িয়ে পড়ে এবং আলুতে পচন ধরায়। যে কোনো ছত্রাক প্রতিরোধক ওষুধ ব্যবহার করলে এ রোগ দমন করা যায়।
 

সংগ্রহ ও ফলন : চারা রোপণের পর ১৩০-১৫০ দিনের মধ্যে মিষ্টিআলু উঠাতে হবে। ফসল লাগানো থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত প্রায় ৫ মাস সময় লাগে। মিষ্টিআলুর ফলন নির্ভর করে আলুর জাত, আবহাওয়া ও উৎপাদন পদ্ধতির ওপর। আমাদের দেশে মিষ্টিআলুর গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ১০-১৫ টন। আমাদের দেশে মিষ্টিআলু চাষে তেমন একটা যত্ন নেয়া হয় না। যদি ধান, পাট, গোল আলুর মিষ্টিআলু উৎপাদনে যত্ন নেয়া হতো তাহলে আমাদের দেশে মিষ্টিআলুর উৎপাদন অনেকগুণ বৃদ্ধি পেত। সামান্য যত্ন নিলে আমাদের দেশে যেখানে প্রতি হেক্টরে ১৫ থেকে ২০ টন মিষ্টিআলু উৎপাদন হয়ে থাকে। উন্নত জাতের মিষ্টি আলু উন্নত পদ্ধতিতে উৎপাদন করলে হেক্টরপ্রতি ফলন আমাদের দেশে ৪০ থেকে ৫০ টন পর্যন্ত হতে পারে।


মিষ্টি আলু অপ্রধান ফসল হলেও প্রধান ফসলের চেয়ে বেশি উপকার করে। অনেক ফসলের তুলনায় কম খরচ কম ঝামেলাবিহীন কিন্তু বেশি লাভজনক এ ফসলটিকে আরও যত্ন আন্তরিকতা আর সতর্কতার সঙ্গে আবাদ করতে পারলে আমরা আমাদের উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারতাম। আশা করি মিষ্টিআলুর চাষ এলাকা বাড়বে এবং বেশি উৎপাদন করে বেশি খেয়ে আমরা আরও পুষ্টিসমৃদ্ধ হব।

 

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
সাগর উপকূলে সি-উইড চাষ

মেরিন ম্যাক্রোঅ্যালজি যা সি-উইড নামে বহুল পরিচিত। এটি সাগরের এক প্রকার তলদেশীয় জলজ উদ্ভিদ। সি-উইড বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ, পুষ্টিগুণের বিচারে যা বিভিন্ন দেশে খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রাচ্যে বিশেষত জাপান, চীন ও কোরিয়ায় সনাতনভাবেই দৈনন্দিন খাদ্যে সি-উইড ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে এবং দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ইউরোপে এর ব্যবহার বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। মূলত ৩ ধরনের সি-উইডের ভেতর বাদামি অ্যালজি (৬৬%), লাল অ্যালজি (৩৩%) ও সবুজ অ্যালজি (১%) খাদ্য হিসেবে সমাদৃত। মানব খাদ্য হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও ডেইরি, ওষুধ, টেক্সটাইল ও কাগজ শিল্পে সি-উইড আগার কিংবা জেল জাতীয় দ্রব্য তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া জমিতে সার, প্রাণী খাদ্য ও লবণ উৎপাদনেও সি-উইড ব্যবহার করা হয়। সি-উইডে প্রচুর পরিমাণে খনিজ দ্রব্য বিদ্যমান থাকায় খাদ্যে অনুপুষ্টি হিসেবে এর ব্যবহার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

 

বাংলাদেশের উপকূলে সি-উইড
বঙ্গোপসাগরের উপকূলে কক্সবাজার জেলার টেকনাফসহ সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও বাকখালী মোহনার আশপাশের পাথুরে ও প্যারাবন এলাকায় জোয়ার-ভাটার অন্তর্বর্তী স্থানেই অধিকাংশ সি-উইড দেখতে পাওয়া যায়। সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রায় ১৪০ ধরনের ও বাকখালী-মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় ৫ প্রজাতি এবং প্যারাবন এলাকাতে ১০ প্রকারের সি-উইড পাওয়া যাওয়ার কথা শোনা যায়। সি-উইড জন্মানোর জন্য কিছু ভিত্তির প্রয়োজন পড়ে। সাধারণত বড় পাথর, প্রবাল, শামুক-ঝিনুক-পলিকিটের খোসা, প্যারাবনের গাছ-শিকড়, শক্ত মাটি কিংবা অন্য যেকোন শক্ত বস্তুর উপর সি-উইড জন্মে কক্সবাজার ও পার্বত্য অঞ্চলের রাখাইন ও অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠী সালাদ ও চাটনী হিসেবে সি-উইড আহার করে থাকে। স্থানীয় ভাষায় সি-উইড ‘হেজালা’ নামে পরিচিত। এ দেশে বাণিজ্যিকভাবে সি-উইড উৎপাদনের তথ্য পাওয়া না গেলেও বহু আগ  থেকে  উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাপ্য সি-উইড পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হওয়ার কথা শোনা যায়। বাংলাদেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার ১৪৭টি উপজেলায় প্রায় ৩ কোটি লোক বসবাস করে যাদের অধিকাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের সঙ্গে জড়িত। তদুপরি এদেশে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা পূরণে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের উপকূলীয় ৫০ মিটার গভীরতায় মহীসোপান অঞ্চলের আয়তন প্রায় ৩৭,০০০ বর্গকিলোমিটার। এ বিশাল সমুদ্র জলসিমা অত্যন্ত উর্বর এবং এখানে রয়েছে মৎস্যস¤পদসহ প্রচুর সামুদ্রিক সম্পদ। এসব সামুদ্রিক সম্পদ নবায়নযোগ্য হওয়ায় টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় অনন্তকাল পর্যন্ত ব্যবহার করা সম্ভব। এ প্রেক্ষাপটে এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের উপকূলে সি-উইড চাষের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।


সি-উইড গবেষণা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মো. জাফর ২০০৭ সালে এদেশে সি-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষণা বিশেষত সমুদ্র উপকূলে শৈবাল চাষ প্রযুক্তি বিষয়ে কাজ করেন। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র ২০১২ সাল হতে সি-উইড শৈবাল নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এর আগে সেন্টমার্টিন দ্বীপে সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে গবেষণা পরিচালিত হলেও ইনস্টিটিটিউটের সামুদ্রিক শৈবাল গবেষকদল কক্সবাজার সদর উপজেলার বাকখালী-মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় নুনিয়ারছড়া থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত সৈকত সংলগ্ন জোয়ার-ভাটা এলাকা ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন সি-উইডের প্রাকৃতিক উৎপাদন ক্ষেত্র শনাক্ত করেছে। প্রাপ্যতা ও স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে মানানসই প্রজাতিগুলোর পুষ্টিমান যাচাই এবং বাণিজ্যিক গুরুত্বের আলোকে খাদ্য উপাদান হিসেবে ব্যবহারের নিমিত্তে সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, কক্সবাজার কাজ করছে। বিজ্ঞানীরা সেন্টমার্টিন দ্বীপ, বাকখালী মোহনা ও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, শাপলাপুর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টি সি-উইডের নমুনা সংগ্র্র্রহ করে গবেষণাগারে সংরক্ষণ করেছে। এসব সামুদ্রিক শৈবালের মধ্যে প্রায় ১০টি প্রজাতি বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে Enteromorpha (সাগর পাতা), Caularpa racemosa (সাগর আঙুর), Hypnea spp. (সাগর সেমাই), Sargassum oligocystum (সাগর ঘাস), Padina tetrastromatica (সাগর ঝুমকা), Hydroclathrus clathratus (জিলাপি শেওলা), Catenella spp. (শৈবালমূললতা) এবং Porphyra spp. (লাল পাতা) অন্যতম। সেই সঙ্গে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ৫টি নির্বাচিত সি-উইড প্রজাতি- ঝ. oligocystum, ঊ. intestinalis, চ.tetrastromatica, ঈ. racemosa ও ঐ. musciformis পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হচ্ছে। নারিকেলের রশি ও নাইলনের মাছ ধরার জাল ব্যবহার করে হরাইজনটাল নেট পদ্ধতিতে সি-উইড চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রজাতি ভেদে ৩-৪ মাসে প্রতি বর্গমিটার জালে কাঁচা শৈবালের উৎপাদন ৩০-৮০ কেজি। সারগাসামের লতা বা গাছ বড় হওয়ায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদন পাওয়া যায়। চাষকৃত স্থানে জালের ভিত্তি স্থাপন করার ১ মাস পর থেকে প্রতি মাসে একবার সি-উইড আংশিক আহরণ করলে বেশি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। উপকূলের লেগুন বা আশ্রয়যুক্ত স্থান যা সাগরের প্রবল ঢেউ ও স্রোতের প্রভাবমুক্ত, দূষণমুক্ত পানি এবং জনউপদ্রব কম এমন জায়গা সামুদ্রিক শৈবাল চাষের জন্য উপযুক্ত। আমাদের জলবায়ুতে স্থানভেদে নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় ৬ মাস সি-উইড চাষ করা যেতে পারে। তবে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের সর্বোচ্চ অনুকূল অবস্থা বিদ্যমান থাকে জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাস। সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের পাশাপাশি কোস্ট ট্রাস্ট নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে সি-উইড চাষে সফলতা পেয়েছে।


সি-উইডের পুষ্টিমান
কক্সবাজার উপকূলে উৎপাদিত সি-উইডের প্রাথমিকভাবে ৬টি প্রজাতির সাধারণ পুষ্টিমান নির্ণয় করা হয়েছে (সারণি-১)।


সারণি- : নির্বাচিত সি-উইডে বিদ্যমান সাধারণ পুষ্টিমান (%)

                   

Hypnea sp

Hypnea musciformis

Padina tetrastromatica

Caulerpa racemosa

Sargassum oligocystum

Jania rubens

আর্দ্রতা

১৭.৪৫

২৪.৩১

১৫.৬৮

১৬.৩৬

২১.০৯

৮.৫৮

খনিজদ্রব্য

৩.৯৬

৯.৭৬

২৭.৯৫

৯.৯০

১২.৯৪

১৬.২৭

আমিষ

২২.৩১

১৩.৭৩

১২.২৯

২২.২৫

৮.১৯

৫.৭০

তৈল

০.৭৮

০.৩৪

০.৯৮

২.৬৫

০.৮৩

০.৪১

আঁশ

৪.১০

৫.৬০

৬.৮০

৪.৮০

৫.২০

৫.৯০

শর্করা

৫১.৪০

৪৬.২৬

৩৬.৩০

৪৪.০৪

৫১.৭৫

৬৩.১৪

 

উপরোক্ত সারণি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নির্বাচিত সামুদ্রিক শৈবালের প্রত্যেকটিই প্রচুর পরিমাণে অনুপুষ্টিস¤পন্ন। নির্বাচিত সব সামুদ্রিক শৈবালেই প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও লৌহ বিদ্যমান। বিভিন্ন মাছে যে পরিমাণ বিভিন্ন অনুপুষ্টি পাওয়া যায় (৫০-১,৪০০ পিপিএম) সি-উইডে তার থেকে বহুগুণ বেশি অনুপুষ্টি বিদ্যমান, যা আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে।

 

সি-উইডের খাদ্য
সি-উইডের প্রডাক্ট তৈরির জন্য ৩টি প্রজাতি- Hypnea, C. racemosa ও ঝ. crassifolium ব্যবহার করা যায়। C. racemosa (সামুদ্রিক আঙুর নামে পরিচিত) ভালোভাবে পরিষ্কার করে তাজা অবস্থায় সালাদ হিসেবে খাওয়া যায়। আমাদের খাদ্যকে সামুদ্রিক শৈবালসমৃদ্ধ করার জন্য হিপনিয়া প্রজাতিটি ব্যবহার করা হচ্ছে। যে কোনো খাদ্যে অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে অল্প পরিমাণে হিপনিয়ার পাউডার বা সিদ্ধ করা তরল সামুদ্রিক শৈবালের সামান্য পরিমাণ ব্যবহার করে খাদ্য উপাদানের পুষ্টিমান বৃদ্ধি করার ওপর গবেষণা কার্যক্রম চলমান। প্রাথমিকভাবে সামুদ্রিক শৈবালসমৃদ্ধ খাদ্য আইটেমগুলো হলো- সালাদ, স্যুপ, আচার, পিঠা, চানাচুর, জেলি, সস ইত্যাদি। সি-উইড কেবল খাদ্য বা শিল্পে কাঁচামাল নয় ডেকরেশন আইটেম হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। সি-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল চাষ প্রযুক্তি আমাদের দেশে সামুদ্রিক স ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নতুন উদ্যোগ। সামুদ্রিক শৈবাল চাষের প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে উপকূলীয় জলাশয় চাষের আওতায় আনা সম্ভব। এতে দরিদ্র জনসাধারণের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটবে। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা পূরণে সি-উইড খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।

 

. মো. ইনামুল হক*
* মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, কক্সবাজার

বিস্তারিত
লজ্জাবতীর উপকারিতা ও চাষ

মাইমোসা বা লজ্জাবতী লতা অনেকটা লতা জাতীয় উদ্ভিদ। আমাদের দেশে অম্লভাবাপন্ন মাটিতে এক জাতের কাঁটাযুক্ত লজ্জাবতী অহরহ লক্ষ করা যায়। এগুলো আকারে অনেটা ছোট। লজ্জাবতী অতি স্পর্শকাতর। কোনোভাবে নাড়া দিলে ছড়ানো পাতা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে অনেক সময় মশা বা ক্ষুদ্র আকৃতির পোকামাকড় পাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার চাপে মারা যায়। অন্যান্য ডাল জাতীয় ফসলের মতো লজ্জাবতীর শিকড়ে ‘নডিউল’ গঠন হয়। ফলে মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে নাইট্রোজেন ও জৈব পদার্থ সরবরাহ করায় মাটির উর্বরতা বাড়ে। মাইমোসা বা লজ্জাবতীর লতাপাতা ও ফুলফল পুষ্টিতে অতিসমৃদ্ধ। এতে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিনসহ সব ধরনের খাদ্য উপাদান। বিশেষ করে এটি ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাসিয়াম ও নিয়েসিনে ভরপুর। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় সালাদ, সবজি ও নানা প্রকার স্যুপ হিসেবে ‘মাইমোসা’ আহারের প্রচলন খুব জনপ্রিয়।


আফ্রিকার অনেক অধিবাসী চা ও কফির বিকল্প হিসেবে মাইমোসার লতা-পাতা, ফুল ও কচি ফলের নির্যাস পান করে থাকে। ইন্দোনেশিয়ায় ‘জায়েন্ট মাইমোসা (কাঁটাবিহীন)’ মহিষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার প্রচলন আছে। ‘ওয়াটার মাইমোসা’র শিকড় ও কচি পাতা শিং, মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া ও অনুরূপ মাছের প্রিয় খাবার। অনেক দেশে মাইমোসার যথেষ্ট চাহিদা আছে। চট্টগ্রামের কয়েকজন ব্যবসায়ী আমাদের দেশের লজ্জাবতীর লতা-পাতা সংগ্রহ করে তা শুকিয়ে জাপানে রপ্তানি করে থাকে।
 

ঔষধি গুণাগুণ : লজ্জাবতীর ঔষধি গুণাগুণ অত্যন্ত বেশি। নানা রোগের চিকিৎসায় হারবাল মেডিসিন তৈরিতে এর ব্যবহার যুগযুগ ধরে চলে আসছে। নাক, কান, দাঁত ও ক্ষুদ্রনালির ঘা সারাতে লজ্জাবতীর শিকড় লতা-পাতার ব্যবহার দেশে বিদেশে বহুল প্রচলিত। জন্ডিস, অ্যাজমা, টিউমার, হুপিংকফ, চর্মরোগ, ডায়াবেটিক্সসহ, হার্ট, লিভারের নানা রোগ সারাতে মাইমোসার ঔষধি গুণাগুণ খুব বেশি।


লজ্জাবতীর উৎপত্তি স্থান : অনেকে মনে করেন মেক্সিকো লজ্জাবতীর উৎপত্তি স্থান। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, আমেরিকার উত্তর-দক্ষিণ কোস্টাল বেল্টে আফ্রিকার অনেক দেশে ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর লজ্জাবতী দেখা যায়। ট্রপিক ও সাব-ট্রপিকের আওতাধীন সব দেশে লজ্জাবতী ভালো জন্মে। ভারতের রাজস্থানে বিভিন্ন বাগানে কভার ফসল হিসেবে ও গ্রিন ম্যানুয়ারিং ফসল হিসেবে চাষ প্রচলন আছে।


জাত : পৃথিবীতে অনেক রকম জাতের লজ্জাবতী দেখা যায়। তবে জায়ান্ট মাইমোসা (কাঁটাবিহীন লজ্জাবতী) ডাঙ্গায় এবং ওয়াটার মাইমোসা অগভীর পানিতে চাষের প্রচলন বেশি দেখা যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এ দুটি জাতের চাষাবাদে চাষিদের আগ্রহ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। তবে আস্ট্রেলিয়ার কোনো কোনো এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে তা অত্যাধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ক্ষতিকারক ঘাস হিসেবে চিহ্নিত।


বংশ বিস্তার : প্রধানত: দুইভাবে, বীজ থেকে অথবা পুষ্ট লতা কেটে তা রোপণের মাধ্যমে চাষাবাদ করা যায়। আগস্ট মাস হতে লতায় ফুল ধরা আরম্ভ করে এবং ক্রমান্বয়ে সেপ্টেম্বর হতে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ফল পাকা আরম্ভ করে। এ সময় পাকা ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা যায়। বীজের জীবনী শক্তি খুব বেশি। সংরক্ষিত বীজে ৫০ বছর পর্যন্ত অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বজায় থাকে। মাইমোসার বীজ খুব ছোট। প্রতি ১০০০টা বীজের ওজন প্রায় ৬ গ্রাম।


ওয়াটার মাইমোসা
এটি অগভীর পানিতে ভালো জন্মে। খাল-বিল, নালা-নর্দমা ও পুকুরে সহজেই ওয়াটার মাইমোসার চাষ করা যায়। পুকুর পাড়ের পানির উপরিভাগে ২ থেকে ৩ ফুট দূরত্বে চারা বা কাটিং লাগালে তা দ্রুত কলমির মতো ছড়িয়ে পড়ে। এ গাছের লতা সাধারণত ১০ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত ছাড়াতে দেখা যায়। এছাড়াও লতার শাখা প্রশাখা দুইধারে বাড়তে থাকে। লতার প্রতি গিঁটে যে পাতা মঞ্জুরি বের হয় তার প্রতিটির উভয় পাশে জোড়ায় জোড়ায় ২০-৪০টা ক্ষুদ্র পাতা গজায় এবং পানির উপরিভাগে বৃদ্ধি পেয়ে ভেসে থাকে। লতার প্রতি গিঁট থেকে প্রচুর গুচ্ছমূল গজায়।


চাষ সম্প্রসারণ : যেসব এলাকায় বিশেষ করে উত্তর অঞ্চলের বরেন্দ্র এলাকার অগভীর পুকুরের পানি প্রখর রোদে গরম হয়ে যায়। এর প্রভাবে মাছ ও জলজ প্রাণীর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব পুকুর পাড়ে ওয়াটার মাইমোসা চাষের মাধ্যমে এ প্রতিকূলতা দূর করা যায়, পানিকে ঠা-া রাখা সহজ হয়। ওয়াটার মাইমোসার গুচ্ছ শিকড়ের ভেতর কৈ, তেলাপিয়া মাছে ডিম পাড়ে এবং তা ছোট মাছের আশ্রয় স্থান হিসেবে কাজে লাগে। মাগুর, শিং, কৈ, তেলাপিয়া জাতীয় পুকুরের সব মাছ মাইমোসার শিকড়, কচি লতা-পাতা ও ফুল খেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। উত্তরাঞ্চলের খরা প্রধান এলাকায় ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় এ জাতের মাইমোসা পুকুর ও নালায় চাষ করে এর সুফল আহরণ করা প্রয়োজন।


বীজ বপন/চারা রোপণ : চারা তৈরি করে নিয়ে অথবা লতার কাটিং এপ্রিল/মে মাসে লাগানোর উপযোগী। পুকুর পাড়ে পানির স্তরের ৮-১০ ইঞ্চি উপরে রসালো মাটিতে ২-৩ ফুট দূরুত্বে চারা/কাটিং রোপণ করতে হয়। লাগানোর অল্প সময়ের মধ্যে তা বাড়তে থাকে।


পরিচর্যা : ওয়াটার মাইমোসা এপ্রিল/মে মাসে হতে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দ্রুত বাড়ে। এ সময় চাহিদা মতো লতা-পাতা রেখে কিছু ছেঁটে দিয়ে মাছ ধরা ও মাছের অবাধ চলাচল সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে লতায় ফল ধরে এবং শীতে বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় পুরাতন লতা কমিয়ে দিয়ে সেগুলো জ্বালানি বা জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পুকুরে অতিরিক্ত ছড়ানো ওয়াটার মাইমোসা, চাষকৃত মাছের অবাধ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা, আলো বাতাস ও সরবরাহকৃত খাদ্য গ্রহণে মাছের জন্য যেন অন্তরায় না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা অত্যাবশ্যক। বাড়ন্ত মৌসুমে কলমির মতো ওয়াটার মাইমোসার কচি লতা-পাতা, ফুল-ফল সবজি হিসেবে আহারের প্রচলন করার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তাতে সাধারণ জনগণ এ পুষ্টিকর সবজি আহার সুবিধা পাবে এবং পুকুরে এ মাইমোসা অত্যাধিক ছড়ানো রোধ হবে।


জায়ান্ট মাইমোসা
দ্রুত বর্ধনশীল কাঁটাবিহীন এ জাতটি বাংলাদেশে সম্প্রসারণে উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। ভারতের রাজস্থানে ও কেরালায় খরাপ্রবণ এলাকায় বাগানের ভেতরে কভার ক্রপ হিসেবে জায়ান্ট মাইমোসার চাষ প্রচলন খুব বেশি। দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তর বরিশাল ও খুলনার উপকূলবর্তী এলাকায় বিশেষ করে বাগানে এ জাতের মাইমোসার চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া দরকার। এ দেশের উত্তরাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকার ফল বাগানে জায়ান্ট মাইমোসা চাষ সম্প্রসারণ যথেষ্ট সুযোগ আছে। রাস্তা ও বাঁধের ধারে, রেল লাইনের পাশে, নদীর পাড়ে এবং বাগানে (আম, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল) জায়ান্ট মাইমোসা চাষের জন্য উপযোগী।


চারা-কাটিং রোপণ : চারা উৎপাদন ও কাটিং তৈরি পদ্ধতি ওয়াটার মাইমোসার অনুরূপ। মার্চ/এপ্রিল মাসে ২-৩ ফুট দূরত্বে চারা কাটিং রোপণ করতে হয়। গ্রীণ ম্যানুয়ারিং করার ক্ষেত্রে এক ফুট দূরত্বে অনেকটা ঘন করে চারা-কাটিং রোপণ করতে হয়। রোপণের পর হতে আগস্ট মাস পর্যন্ত বহু বর্ষজীবী এ গাছ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়ে মাটিকে ঢেকে ফেলে।


চাষ সম্প্রসারণ ও ব্যবহার : বরেন্দ্র এলাকায় যেভাবে আম বাগান নতুনভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে সেগুলোর মাঝে এ জাতের মাইমোসা চাষ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এ ব্যবস্থায় বাগানের আগাছা দমন, মাটির রস সংরক্ষণ ও জৈবসার সরবরাহ নিশ্চিত হবে। মাটির ক্ষয়রোধ ও তা ধরে রাখার জন্য বাঁধের ও উঁচু রাস্তার ধারে জায়ান্ট মাইমোসা সম্প্রসারণ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এ জাতের মাইমোসা মার্চ-এপ্রিল মাস হতে অক্টোবর মাস পর্যন্ত খুব বাড়ে, চারদিকে প্রচুর লতা-পাতা ছড়ায়। সেপ্টেম্বর মাস থেকে ফল পাকা আরম্ভ হলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। এজন্য এপ্রিল-মে মাসে লাগানো চারা জুন-জুলাই মাসে সবুজ সার তৈরি করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির সুযোগ হয়। শীতের শুরুতে গাছের গোড়া বরাবর কেটে তা জ্বালানি হিসেবে এবং ঝরে পড়া পাতাগুলো ফল গাছের গোড়ায় মালচিং হিসেবে ব্যবহার করা যায়।


মহিষের খাদ্য হিসেবে জায়ান্ট মাইমোসার ব্যবহার মালায়শিয়ায় প্রচলিত আছে। তাই এ দেশেও তা মহিষের খাবার বা ফডার হিসেবে চাষের ব্যবস্থা নেয়া যায়। এছাড়াও অন্য খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার উপযোগিতা পরীক্ষান্তে অনুকূল ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ায় ও কিছু আফ্রিকান দেশে সবজি হিসেবে মাইমোসা ব্যবহার প্রচলন অত্যধিক। আমাদের দেশেও মাইমোসা শাকসবজি হিসেবে আহারের ব্যবস্থা জনপ্রিয় করার উদ্যেগ নেয়া যায়। তাতে দ্রুতবর্ধনশীল অতি পুষ্টিকর এ মাইমোসা বেশি আহার করে দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠী সস্তায় পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ সুযোগ পাবে।


মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, আগাছা দমন, ভূমিক্ষয় রোধ, ঔষধি ও সবজি হিসেবে ব্যবহার, সুফল আহরণের লক্ষ্যে, অতি সম্ভাবনাময়ী এ ফসলটির সম্প্রসারণ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সবারই প্রচেষ্টা নেয়া অত্যাবশ্যক।

 

এম. এনামুল হক*
* সাবেক মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

 

বিস্তারিত
দারিদ্র্য বিমোচনে আখ চাষ

খাদ্য নিরাপত্তা জনগণের মৌলিক এবং প্রাথমিক চাহিদা। আমাদের কারিগরি শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের অভাব, নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরিতে ইচ্ছা ও পুঁজির স্বল্পতা, উন্নত প্রযুক্তি সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় না পৌঁছানো, সর্বোপরি বিভিন্ন প্রতিকূল কারণে উপযোগী না হওয়ায় উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণে সাধারণ কৃষাণ-কৃষাণীদের অনিচ্ছাই আমাদের দারিদ্র্যের মূল কারণ।
দেশের সরকার, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষকরে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো দারিদ্র্য হ্রাসকরণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট আখের নতুন নতুন উন্নত জাত উদ্ভাবন ও লাভজনক পদ্ধতিতে আখ চাষ বিষয়ক বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং তা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর মাধ্যমে চিনি ও গুড় এর চাহিদা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনে বেশ ভূমিকা রেখে চলেছে।


আখ চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সহজেই সম্ভব। শুধু এ বিষয়ে আমাদের সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের তৎপরতা দরকার। কারণ আখ চাষের জন্য বিশেষত চিনিকলবহির্ভুত গুড় উৎপাদন এলাকায় কিংবা চিবিয়ে খাওয়া আখ উৎপাদন এলাকায় আখ চাষ নিয়ে কথা বলার জন্য সাধারণত কেউ থাকে না। তাই আখ চাষ করে যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায় তা অনেকেরই অজানা। অতএব প্রথমেই বলি কর্মসংস্থান সৃষ্টি নিয়ে।


আখ এমন একটি ফসল যার রোপণকাল থেকে পরিপক্বতা পর্যন্ত ১০-১৪ মাস সময় প্রয়োজন হয়। এ সময়ে বিভিন্ন পরিচর্যার ওপর আখের সঠিক বৃদ্ধি ও গড় উৎপাদন নির্ভর করে। আখের পরিচর্যা শ্রমিক নির্ভরশীল বিধায় আখচাষের মাধ্যমে কৃষি শ্রমিকদের সারা বছর কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। এক হেক্টর আখের জমি লাগানো থেকে কাটা পর্যন্ত প্রায় ৬০০ শ্রমিক-দিবসের প্রয়োজন হয়। অন্য কোন ফসল আবাদের জন্য এত শ্রমিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। করে দেশের দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা, যেখানে কৃষি শ্রমিকদের কাজ ধানচাষের উপর নির্ভরশীল, আগস্ট থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তারা (কৃষি শ্রমিকরা) কাজের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করে, সেখানে আখচাষের মাধ্যমে বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।


চিনিকলবহির্ভূত এলাকায় আখ ও সাথীফসল চাষ বৃদ্ধির মাধ্যমে যেমন কৃষি শ্রমিকদের কাজের নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব তেমনি উৎপাদিত আখ, গুড় উৎপাদনে ব্যবহার করে চিনিকলের ওপর চাপ কমানোর মাধ্যমে গুড় শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে দেশের চিনি ও গুড়ের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখা সম্ভব। এতে গুড় শিল্পে মানুষের কাজ করার সুযোগ বৃদ্ধির সাথে সাথে চিনি আমদানির পরিমাণ কমিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বাঁচানো সম্ভব।


আখ ফসলের কোন অংশই ফেলনা নয়। আখক্ষেত পরিচর্যাকালীন যে সমস্ত শুকনো পাতা ও মরাগাছ মাঠ থেকে অপসারণ করা হয় তা বিক্রি করে আখচাষি কিছু নগদ অর্থ উপার্জন করতে পারে। কারণ বর্ষা মৌসুমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। আখচাষের মাধ্যমে প্রয়োজনের সময় এসব জ্বালানির জোগান পাওয়া সম্ভব। আর তাছাড়া আখ কাটার সময় আখের যে তাজা পাতা পাওয়া যায় গবাদিপশুর জন্য তা সবচেয়ে উপযোগী খাবার। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আখের পাতা খাওয়ানোর ফলে গবাদি পশুর দুধের পরিমাণ বেড়ে গেছে।


প্রথমত: দেখা যাক অতি দরিদ্র পরিবারের আয় বাড়াতে আখচাষ এর ভূমিকা কী। আমাদের দেশের গ্রাম-শহর সর্বত্রই চিবিয়ে খাওয়ার উপযোগী আখ জাতের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যে সমস্ত পরিবার দৈনিক মজুরির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে যাদের বসতভিটা ছাড়া আবাদি কোন জমি নেই। পরিবারের কর্তা-ব্যক্তিটি সকালে কাজের সন্ধানে বের হয়ে যায়, কাজের বিনিময়ে পাওয়া মজুরি দিয়ে পরিবারের সবার চাল-ডালের সংস্থান করতেই হিমশিম খায়; তার পক্ষে সন্তানদের জন্য ১টি আখ ২০ টাকা দিয়ে কেনা খুবই কষ্টকর। ওই ব্যক্তিটি যদি তার বসতভিটার আশেপাশে ১০০টি চিবিয়ে খাওয়ার আখের চারা সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে লাগিয়ে রাখে এবং পরিবারের সদস্যরা সঠিক পরিচর্যা করে তবে রোপণকৃত ১০০টি চারা থেকে কমপক্ষে ৬০০টি সুস্থ সবল আখ পাওয়া সম্ভব, যা সর্বনিম্ন বাজারদরে বিক্রি করে ১২,০০০/- টাকা আয় করা সম্ভব। আর এজন্য যে পরিচর্যা দরকার তা বাড়ির মহিলারাই করতে পারে। অর্থাৎ মাসে ১০০০ টাকা আয় করতে বাড়ির কর্তা ব্যক্তিকে কোন চিন্তা করতে হয় না। অথবা ৬০০টি আখের মধ্যে কিছু আখ বিক্রি করে টাকা আয় করতে পারে এবং অবশিষ্টগুলো শিশুদের খেতে দিলে তাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়।


দ্বিতীয়ত : দেখা যাক অল্প জমির মালিকরাও আখ চাষ করে কিভাবে অনেক বেশি উপার্জন করতে পারে। আজকাল সারাদেশে সারাবছর উপজেলা শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত প্রতিটি বাজারের কোনায় কোনায় চিবিয়ে খাওয়া আখ বিক্রি ব্যাপকহারে শুরু হয়। যার বাজারদর এলাকা ভেদে ২০ টাকা থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রতিটি আখের দাম অপেক্ষাকৃত কম হলেও মধ্য, দক্ষিণ ও পাহাড়ি অঞ্চলে দাম ও চাহিদা খুবই বেশি। এক বিঘা জমিতে ৩০০০টি চিবিয়ে খাওয়া ইক্ষুর চারা রোপণ করা যায়। (এক্ষেত্রে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ১মিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৪৫ সে.মি.। এক বিঘা অর্থাৎ ১৩৪৯ বর্গমিটার জমিতে ওই মাপে লাগানো হলে ২৯৯৮ বা ৩০০০টি চারা লাগানো যাবে। সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে এটা রোপণ করে, সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে গাছ প্রতি কমপক্ষে ৫টি কুশি পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে ঝাড় প্রতি ১টি মাতৃগাছ এবং ৫টি কুশি অর্থাৎ ৬টি আখ পাওয়া যাবে। সুতরাং ৩০০০টি ঝাড়ে ৩০০০x৬=১৮০০০টি আখ পাওয়া যাবে।) তা থেকে ১৮০০০টি সুস্থ ও সবল আখ উৎপাদন করা সম্ভব। সর্বনিম্ন বাজারদরে (১৮০০০x১০টাকা=১,৮০,০০০ টাকা) তা বিক্রি করেও এ থেকে ১,৮০,০০০/-টাকা আসবে যার চাষাবাদ থেকে বিক্রি পর্যন্ত মোট খরচ হয় প্রায় ২৫০০০ থেকে ৩০০০০ টাকা। অর্থাৎ নিট লাভ হয় ১,৫০,০০০ টাকা। এটা গেল আখের হিসাব। আখ ছাড়াও ওই জমিতে সাথী ফসল চাষ করে প্রায় ১০,০০০-১৫০০০ টাকা নিট লাভ হবে। এ টাকা দিয়ে চাষি তার আখ চাষের ওই খরচ মিটাতে পারবে। যদিও বলা হয় আখ ১২-১৪ মাস মাঠে থাকে কিন্তু এর পরিপক্বতার জন্য ১০-১২ মাসই যথেষ্ঠ। তদুপরি যদি চিবিয়ে খাওয়ার আখ হয় তাহলে তা ৭-৮ মাসেই বিক্রির উপযোগী হয়। এক বিঘার মতো এত অল্প জমি ব্যবহার করে শুধুমাত্র সঠিক জাত ও প্রযুক্তির মাধ্যমে আখ ও সাথী ফসল চাষ করে এত বেশি আয় শুধু আখ চাষের মাধ্যমেই তুলে আনা সম্ভব। সেকারণেই সঠিক জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আখ চাষ করে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার করা যেমন সম্ভব তেমনি সম্ভব অধিক উপার্জন এর মাধ্যমে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করা এবং এভাবেই সম্ভব দেশের দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার দারিদ্র্য বিমোচনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা।


তৃতীয়ত : দেখা যাক আখের রস বিক্রেতাদের জীবিকা নিয়ে সারা বছরই দেশের সব উপজেলা শহরের অলি-গলিতে দেখা যায় আখের রস বিক্রেতাদের। এরা ছোট ছোট হস্তচালিত মাড়াই মেশিনে তৎক্ষণিকভাবে আখ মাড়াই করে রস বিক্রি করে। জাতের এবং সময়ের তারতম্য অনুসারে একটি আখ থেকে প্রায় ৬-৮ গ্লাস রস হয়। প্রতি গ্লাস আখের রস স্থান ভেদে ৫-১০ টাকা বিক্রি হয়। অর্থাৎ ওই ব্যক্তি ১০ টাকার আখ থেকে সর্বনিম্ন ৩০ টাকার রস বিক্রি করে আখ প্রতি কমপক্ষে ২০ টাকা লাভ করে। প্রতিদিন এরা মৌসুম ভেদে গড়ে প্রায় ২৫-৫০টি আখ বিক্রি করে ৫০০-১০০০ টাকা নিট লাভ করে। এসব রস বিপণন কাজে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর জন্য অধিক রস উৎপাদন উপযোগী আখ চাষ বৃদ্ধি করতে হবে, সারা বছর আখের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং রস উৎপাদনের মেশিনটিকে একটু সংস্কার করে স্বাস্থ্যসম্মত করতে হবে। তাহলেই সাধারণ জনগণের জন্য আখের রসের চাহিদা পূরণ করা যাবে। পাশাপাশি রস বিপণন কাজে আরো বেশি সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এতে একদিকে দারিদ্র্য বিমোচনে যেমন অপরিসীম ভূমিকা পালন করবে, তেমনি পুষ্টি উপাদানের জোগানও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।


চতুর্থত : দেখা যাক বড় চাষিরা আখ চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে কি ভূমিকা পালন করতে পারে। বড় চাষিদের দায়িত্বও বড়। তারা যদি বাণিজ্যিকভাবে আখ ও সাথী ফসল চাষ করে তা চিনিকলে দেয়ার জন্য, গুড় তৈরির জন্য কিংবা চিবিয়ে খাওয়ার জন্য যে কারণেই করুক না কেন, আখ যেহেতু সারা বছরব্যাপী মাঠে থাকে তাই শ্রমিকের কর্মসংস্থানও সারাবছরব্যাপী করতে পারে। তাছাড়া আখ পরিবহনে, গুড় তৈরিতে, এবং গুড় বাজারজাতকরণে যে পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থান হয়, অন্য কোন একক ফসলে এত কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ নেই। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন এত মানুষের কর্মসংস্থান করার পর গুড় তৈরি করে তা কি লাভ হবে? অবশ্যই হবে। কারণ বাজারে চিনির চেয়ে গুড়ের দাম বেশি। আর যদি ভেজালমুক্ত গুড় তৈরির প্রমাণ করতে পারেন এবং সেই গুড়ের একটা ব্র্যান্ড/ট্রেড মার্ক তৈরি করতে পারেন তবে তার সে ব্যবসাটি হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং অধিক লাভজনক।


পঞ্চমত : দেখা যাক আখ চাষের মাধ্যমে বড় কোন উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়টি। অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশেও এখন আখের রস বোতলজাত করে বাজারজাত করার প্রযুক্তি রয়েছে। আখের রসের ভেষজ গুণ, পুষ্টিমান এবং স্বাদের কারণে এর চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা যে কোন কোমল পানীয়ের চেয়ে অনেক বেশি। অতএব অল্পকিছু বিনিয়োগের করে আখের রস বোতলজাত করার মাধ্যমেও একটি উন্নতমানের ব্যবসা শুরু করা যেতে পারে। এক্ষেত্রেও অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। এমনকি তা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সুযোগ রয়েছে। এসব ছাড়াও আখ থেকে বায়োফুয়েলসহ আরো অনেক শিল্প স্থাপনেরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

এসব কারণেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভিত্তিক আখ চাষ করা জরুরি প্রয়োজন। আখ চাষে জমির মালিকের লাভের পাশাপাশি অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। যদিও চিনিকল এলাকার আখচাষিরা আখ সরবরাহ করে সময়মতো আখের দাম না পাওয়াতে হতাশায় ভোগেন, তবে দেরিতে হলেও সেখানে আখের মূল্যটি কিন্তু নির্দিষ্ট থাকে। অন্য ফসলের মতো ওঠানামা করে না। আর চিনিকলবহির্ভূত গুড় উৎপাদন এলাকায় আখ চাষিরা অপেক্ষাকৃত বেশি দামে আখ বিক্রি করে থাকেন। অন্যদিকে চিবিয়ে খাওয়া আখ উৎপাদনকারীগণ লাভ করেন সবচেয়ে বেশি। ফলে শেষোক্ত দুই এলাকার আখ চাষিদের আখ চাষে কোনো হতাশা নেই। তাই সারা দেশের সকল ধরনের জমিতেই আখের আবাদ বিস্তৃত করা যেতে পারে। বিশেষ করে চাষের জন্য প্রতিকূল জমি এবং দুযোগপূর্ণ আবহাওয়ায় একমাত্র আখই নিশ্চিতভাবে চাষিকে ফসলহানির আশংকা থেকে মুক্ত রাখে। এখানে তারই কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো।


খরাপীড়িত এলাকা
দেশের উত্তরাঞ্চলের খরাপীড়িত এলাকার কথা বলি। আখ ফসল সবচেয়ে বেশি খরায় টিকে থাকতে পারে। শুধু তাই নয় যেখানে অন্য সব ফসল পানির অভাবে মারা যায় সেখানেও আখ ফসল বেঁচে থাকতে পারে এবং পানি পেলে তা আবার পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে ওঠে। সেজন্যই উত্তরাঞ্চলের খরাপীড়িত এলাকায় আখ চাষের ব্যাপকতা বেশি। শুধু আখই নয়, খরাপীড়িত এলাকার জন্যও আখের সাথে সাথী ফসল চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।


চরাঞ্চলের বালিময় পতিত জমি
চরের বালিময় পতিত জমিতে যেখানে অন্য কোন ফসল চাষ করে লাভ করা যায় না, সেখানেও আখ চাষ করে, আখের সাথে সাথী ফসল করে এবং গুড় তৈরি করে যথেষ্ট লাভ করার সুযোগ রয়েছে। এর কারণ আখের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত গভীরে চলে যেতে পারে। তাছাড়া চরে অন্যান্য ফসল চাষ করে চাষিরা ঝুঁকিতে থাকেন। কারণ বন্যায় তা ডুবিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অথচ আখ এমন একটি ফসল যা ১২-১৫ ফুট লম্বা হয় এবং বন্যায় এর নিম্নাংশ ডুবে থাকলেও কোন ক্ষতি হয় না। আবার চরে যেসব স্বল্পমেয়াদি ফসল হয় সেগুলোকে সাথী ফসল হিসেবে আখের সাথে চাষ করা যায়। ফলে আখ থেকে গুড় তৈরি করে মূল লাভের পাশাপাশি আরো বেশি লাভ করা সম্ভব হয়।


দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকা
যেখানে লবণাক্ততার কারণে অন্য কোন ফসল উৎপাদন করা যায় না সেখানেও আখ ফসল তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায় উচ্চমাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করার মতো প্রচলিত ফসলধারায় অন্য কোন ফসল নেই। সম্প্রতি অবমুক্ত কেবলমাত্র দুটি ধানের জাত (বিনা ধান ১০ প্রতি মিটারে ১২ ডিএস এবং ব্রি ধান ৬৭ প্রতি মিটারে ৮ ডিএস) ওই মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। কিন্তু আখ ফসল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই প্রতি মিটারে ১৫ ডিএস মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাই লবণাক্ত এলাকারও লাভজনক ফসল আখ।


পাহাড়ি এলাকা
পাহাড়ি এলাকায়ও এক বিঘা জমিতে ৩০০০টি চিবিয়ে খাওয়া আখের চারা সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে রোপণ করে তাহলে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে তাথেকে ১৮০০০টি সুস্থ ও সবল আখ উৎপাদন করা সম্ভব। পাহাড়ি এলাকায় আখের বাজার দর অপেক্ষাকৃত বেশি। ফলে সর্বনিম্ন বাজারদরে তা বিক্রি করেও ৩,০০,০০০/- টাকা উপার্জন করা সম্ভব। অল্প জমি ব্যবহার করে সঠিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আখ ও সাথী ফসল চাষ করে এত বেশি আয় করা শুধু আখ চাষের মাধ্যমেই সম্ভব। একইভাবে পাহাড়ি এলাকায় গুড়ের দামও বেশি। তাই ওখানকার মানুষ গুড় করেও বেশি লাভ করতে পারেন।


পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকা
হাওড় এলাকার অনেক জায়গাই রয়েছে যেখানে অল্প কিছুদিন পরেই পানি নেমে যায়। এসব জায়গাগুলো নির্বাচন করে সেখানে জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু আখের জাত রোপণ করা যেতে পারে। যেমন- ঈশ্বরদী ৩৭, ঈশ্বরদী ৩৪, ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ২১ প্রভৃতি।


দুযোর্গ এর ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকা
সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকা যেখানে প্রায় প্রতি বছরই সিডর-আইলার মতো মারাত্মক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হানা দিয়ে ক্ষেতের সব ফসল লণ্ডভণ্ড করে দেয়, সেখানে আখফসল থাকলে তা ওই এলাকার জীবনরক্ষাকারী ফসলে পরিণত হয়। কারণ ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড সবকিছুতে রান্না করার উপকরণও চলে যায়, ঘরের শুকনা খাবারও (যদি থাকে) শেষ হয়ে যায়, আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় পানীয় জলের। অন্যদিকে ঢাকা তথা দেশের দূর-দূরান্ত থেকে পানীয় জল কিংবা খাদ্য সাহায্য পৌঁছাতেও সময় লাগে। আর এ সময়েই পানির অভাবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় ওই এলাকার শিশুরা, এমনকি তাদের জীবনহানিরও আশংকা দেখা দেয়। অথচ ওই এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে চিবিয়ে খাওয়া আখ থাকলে, ঝড়ে তা যত ক্ষতিগ্রস্তই হোক না কেন, তা থেকে পানি ও পুষ্টি উভয়ই পাওয়া যেতে পারে। সংকটকালীন ওই সময়ে বাড়ির শিশুদের জন্য তা হয় জীবনরক্ষাকারী খাদ্য। সেকারণেই সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকার প্রতিটি বাড়িতেই চিবিয়ে খাওয়া আখের আবাদ করতে হবে।


অর্থাৎ সারাদেশেই আখ চাষ করা এখন জরুরি প্রয়োজন। বরং উল্টা করে বলা যায় আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে যখন বিজ্ঞানীরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন পরিবর্তন সহিষ্ণু ফসল, সেখানে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন সহিষ্ণু ফসল হচ্ছে আখ। আখের রস যেমন পুষ্টিকর, আখের চাষও তেমনি লাভজনক। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হচ্ছে এলাকাভিত্তিক আখের জাত নির্বাচন করে তার ভালো বীজের সরবরাহ বৃদ্ধি করা। এটা করতে পারলেই আখ চাষ সম্প্রসারণ করা অনেক সহজ হবে, কারণ আখ সম্প্রসারণের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ভালো বীজের অভাব। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে আখ চাষের উপকরণ, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি জ্ঞান এবং উৎপাদিত কাঁচামালের বাজার সবই আমাদের দেশেই যথেষ্ট ভালো রয়েছে। তাই দেশের যে কোন এলাকায় আখচাষে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। আর এটা করতে পারলেই দেশের চিনি ও গুড় এর জোগান নিশ্চিত করার পাশাপাশি অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য বিমোচনেও যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখা সম্ভব।

ড. সমজিৎ কুমার পাল*
* মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী-৬৬২০, পাবনা

বিস্তারিত
কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য

কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর চাল ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম।


বর্তমান সরকারের পরপর দুই মেয়াদে চার দফায় সারের দাম কমানো হয়। ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়, সেচের পানির ভর্তুকির টাকা সরাসরি কৃষকের একাউন্টে ট্রান্সফার করা হয় এবং সেই সঙ্গে ১ কোটি ৮২ লাখ কৃষকের মাঝে উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। যুগান্তকারী এসব পদক্ষেপের ফলে কৃষিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য।


সরকার কৃষকদের সম্ভাব্য সব রকম উপকরণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের প্রবর্তিত কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেশে ও বিদেশে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশের অনুসরণে ভারত সরকার কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের ৩৫টি জেলায় ২৫ শতাংশ ভর্তুকিতে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, হারভেস্টরসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। কৃষি পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। আউশে প্রণোদনা প্যাকেজও অব্যাহত আছে।


স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে। সরকারের যুগোপোযোগী পরিকল্পনা, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে দুই টন চাল উৎপাদিত হতো। এখন হেক্টর প্রতি উৎপাদন হচ্ছে চার টনেরও বেশি। ধান ধরে হিসাব করলে তা ৬ টন। তাছাড়া হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বিশ্বে গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। খাদ্যশস্যে প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন উৎপাদন করে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের পরে রয়েছে আর্জেন্টিনা, চীন ও ব্রাজিল। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ।


বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে
আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। কৃষির এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বে গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় তিন টন। আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ শ্রীলংকায় প্রথমবারের মতো চাল রফতানি শুরু করে সরকার। দুই দফায় প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল রপ্তানি করা হয়। এছাড়া সাম্প্রতিক ৬ মে ২০১৫ বাংলাবান্ধা বন্দর দিয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প কবলিত নেপালে ১০ হাজার টন চাল সাহায্য হিসেবে পাঠানো হয়েছে। এটা দেশের চাল উৎপাদনের সামর্থ্যরেই বহিঃপ্রকাশ।


দেশ আজ সবজি উৎপাদনে তৃতীয়
দেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে গত এক যুগে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। একসময় দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরেই কেবল সবজির চাষ হতো। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই সবজির চাষ হচ্ছে। এখন দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে, এ কৃষক পরিবারগুলোর প্রায় সবাই কমবেশি সবজি চাষ করেন। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার স্ট্যাটিসটিক্যাল ইয়ারবুক-২০১৩ অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে বাংলাদেশে, বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। পাশাপাশি একই সময়ে সবজির মোট উৎপাদন বৃদ্ধির বার্ষিক হারের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে ২০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি খাওয়া বা ভোগের পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) হিসাবে, গেল বছর দেশে মাথাপিছু সবজি ভোগের পরিমাণ হয়েছে ৭০ গ্রাম।


মাছ উৎপাদনে চতুর্থ বাংলাদেশ
একসময় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা বাস্তব। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মাছ রফতানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাছের উৎপাদন ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের হিমায়িত মৎস্য রফতানির পরিমাণ ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়ে চার হাজার ১৪৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। জাটকা সংরক্ষণসহ নানা উদ্যোগের ফলে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ৫২ হাজার টন বেড়ে সাড়ে তিন লাখ টন হয়েছে। মাছের দাম সাধারণ ক্রেতার সামর্থ্যরে মধ্যে থাকায় গত দশ বছরে দেশে মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ শতভাগ বেড়েছে।


ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ
ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। বাংলাদেশের ব্লাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

 

আম উৎপাদনে সপ্তম বাংলাদেশ
বিশ্বে মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। ফলটির উৎপাদনে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। গত দুই বছরে প্রায় দশ লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ মূল্যায়নে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দেশে আমের উৎপাদন ছিল ৭ লাখ ৮১ হাজার টন। সেখানে ২০১১-১২ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টনে উন্নীত হয়। দেশে প্রায় দেড় কোটি আম গাছ রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট গত মে ২০১৫ হতে বাংলাদেশের আম কিনতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের আম্রপালি ও ল্যাংড়া আম বিলেতে অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।


আলু উৎপাদন সাফল্যের এক বিস্ময়
এক দশক আগেও উৎপাদন ছিল অর্ধলাখ টনের নিচে। এখন তা এগোচ্ছে কোটি টনের দিকে। এ সাফল্য বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে আলু উৎপাদনকারী শীর্ষ দশ দেশের কাতারে। স্বীকৃতিটি দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। সম্প্রতি সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে ৮২ লাখ ১০ হাজার টন উৎপাদন নিয়ে বাংলাদেশ রয়েছে অষ্টম স্থানে। উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্যই কেবল নয়, আলু এখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসলও। মাধ্যম হয়ে উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও। গত বছর ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের আলু রফতানি হয়েছে। অথচ এর আগে বিশ্বের ২০টি দেশ থেকে বাংলাদেশকে আলু আমদানি করতে হতো।

 

ফসলের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশ

ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) বেশ কয়েকটি জাত ছাড়াও এরই মধ্যে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) বিজ্ঞানীরা মোট ১৩টি প্রতিকূল পরিবেশে সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্যে লবণসহিষ্ণু নয়টি, খরাসহিষ্ণু দুটি ও বন্যাসহিষ্ণু চারটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন তারা। ২০১৩ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এতগুলো প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম জেনেটিকেলি মোডিফাইড ফসল বিটি বেগুনের চারটি জাত অবমুক্ত করে। যার মধ্যে বেগুনের প্রধান শত্রু ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী জীন প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মাধ্যমে আলুর নাবি ধসা রোগের প্রতিরোধী জিন প্রতিস্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে।


গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ই-কৃষি খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার জানালা। কৃষি তথ্য সার্ভিস দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে ২৪৫টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) স্থাপন করেছে। এছাড়া ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ইনফো-সরকার ২৫৪টি উপজেলার ২৫৪টি আইপিএম/ আইসিএম কৃষক ক্লাবকে এআইসিসিতে রূপান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষি তথ্যকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনলাইনে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে মুঠোফোনের জোয়ারে ভাসছে এদেশ। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুয়ায়ী ১০ শতাংশ মোবাইল ফোনের ব্যবহার বাড়লে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ হারে বাড়ে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের ১৬১২৩ নম্বরে যে কোনো মোবাইল থেকে ফোন করে নামমাত্র খরচে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য বিষয়ে কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট অফলাইন/অনলাইনে সার সুপারিশ নির্দেশিকা প্রদান করছে। আখ চাষিরা মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে ই-পুর্জি সেবা গ্রহণ করছেন। এমনকি ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেশ-বিদেশের কৃষি তথ্য সেবা পাওয়া যাচ্ছে।


এক সময় বলা হতো ‘দুধে ভাতে বাঙালি’ কিংবা বলা হতো ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। বর্তমান সরকার তার সুপ্রসারিত কৃষি নীতিতে শুধু দুধে ভাতে বা মাছে ভাতে সীমিত নয় পুষ্টিতে বাঙালি হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হতে চায়। সরকার ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ অনুয়ায়ী ২০১৩ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও বর্তমান জনগণবান্ধব সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলার এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ (এ যাবৎ কালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ)। পরিশেষে বলতেই হয়, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যত অর্জন আছে, তার মধ্যে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো। এটা বিশ্বের যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য উদাহরণও বটে।

 

কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম*

* আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রংপুর অঞ্চল, রংপুর

 

বিস্তারিত
মুলার বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি

মুলা বাংলাদেশের একটি অতি প্রচলিত শীতকালীন সবজি। সবুজ পাতায় প্রচুর পরিমাণে খাদ্যপ্রাণ ‘এ’ পাওয়া যায় যা বিশেষ করে শিশুদের রাতকানা রোগ নিরাময়ে ভূমিকা রাখে। এছাড়া মুলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যপ্রাণ ‘সি’ রয়েছে। খাদ্যপ্রাণ ছাড়াও মুলায় প্রচুর পরিমাণে আঁশ, আমিষ, শর্করা, চর্বি, ক্যালসিয়াম, লৌহ এবং ঔষধি গুণাগুণ বিদ্যমান। ভক্ষণযোগ্য (অপরিপক্ব) প্রতি ১০০ গ্রাম মুলায় শ্বেতসার ২৫.০০ গ্রাম, আমিষ ২.৫০ গ্রাম, ভিটামিন ‘বি-১’ ৩.১০ গ্রাম, ভিটামিন ‘বি-২’ ০.৩০ গ্রাম, ভিটামিন ‘সি’ ০.৯০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৯০ গ্রাম, আয়রন ১.৪০ গ্রাম এবং ক্যারোটিন ৯০০০ আন্তঃএকক বিদ্যমান।
 

জলবায়ু ও মাটি

মুলা প্রধানত শীত মৌসুমের সবজি। মুলা চাষের জন্য ১০০-১২০ সে. তাপমাত্রা ও কিঞ্চিৎ আর্দ্রতা সবচেয়ে উপযোগী। গ্রীষ্ম মৌসুমে চাষ করলে মুলা ঝাঁঝালো ও ফলন কম হয়। পানি সেচের ব্যবস্থা আছে এমন বেলে দো-আঁশ মাটি মুলা চাষের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট। তবে পলি দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিসহ প্রায় সব মাটিতেই পরিমিত সার ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করলে লাভজনকভাবে মুলা চাষ করা যেতে পারে। মুলার জমির মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রস থাকা বাঞ্ছনীয়।

জাত
কিছুদিন পূর্বেও বাংলাদেশে জাপানি মুলা মিনোআর্লী, মিয়াশিগি ইত্যাদি জাতের মুলার চাষ করা হতো যেগুলো শংকর জাতের এবং এদেশের আবহাওয়ায় বীজ হয় না। এখন বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট মুলার চারটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলো স্থানীয় আবহাওয়ায় বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম।

 

বারি মুলা-১ (তাসাকীসান মুলা)
এ জাতের মুলা ধবধবে সাদা এবং বেলুনাকৃতি। মুলা গড়ে ৪০ সেমি. লম্বা এবং ৭ সেমি. বেড় হয়। বীজ বপনের ৪৫ দিনের মধ্যেই মুলা বিক্রির উপযুক্ত হয়। হেক্টরপ্রতি মুলার ফলন গড়ে ৭৫ টন (৩০০ কেজি/শতাংশ)। স্থানীয় আবহাওয়ায় বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম। বীজের ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৫-২ টন (৬-৮ কেজি/শতাংশ)।

 

বারি মুলা-২ (পিংকি)
নলাকৃতি এ মুলা আকর্ষণীয় গোলাপি রংয়ের। গড়ে ৩০ সেমি. লম্বা এবং ৭ সেমি. ব্যাসযুক্ত। বীজ বপনের ৫০ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা যায়। এ জাতের মুলার ফলন হেক্টরপ্রতি ৬০ টন (২৪০ কেজি/শতাংশ)। এ দেশের আবহাওয়ায় বিশেষ করে উত্তারাঞ্চলে (রংপুর, দিনাজপুর) গড়ে প্রায় ১.০ টন (৪ কেজি/শতাংশ) বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম। এটি কিছুটা নাবি জাতের মুলা

 

বারি মুলা-৩ (দ্রুতি)
এ জাতের মুলার রং ধবধবে সাদা ও আকৃতি অনেকটা নলাকার। এ জাতের মুলা বর্ধনশীল এবং ৪০-৪৫ দিনের মধ্যেই খাবার উপযোগী হয়। মুলার গড় ওজন ৫০০ গ্রাম ও লম্বা ২৫ সেমি.। মুলার গড় ফলন ৫৫ টন (২০০ কেজি/শতাংশ) প্রতি হেক্টরে। এ দেশের আবহাওয়ায় বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম। বীজের ফলন হেক্টরপ্রতি ১.২ টন (৫ কেজি/শতাংশ)।

 

বারি মুলা-৪ (দ্রুতি)
মুলা লম্বাকৃতি ও ধবধবে সাদা বর্ণের। পাতা খাঁজকাটাবিশিষ্ট (জাপানি সিনেআর্লী টাইপ)। প্রতিটি মুলার গড় ওজন ৭০০-৮০০ গ্রাম এবং লম্বায় ৩০-৩৫ সেমি.। হেক্টরপ্রতি মুলার ফলন ৬৫-৭০ টন। জাতটি দেশীয় আবহাওয়ায় হেক্টরপ্রতি ১.২-১.৫ টন বীজ উৎপন্ন হয়।

 

জীবনকাল
জাতভেদে জীবন কালের কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।

 

আগাম জাত : বীজ বপন থেকে মুলা উৎপাদন ৪৫-৬০ দিন।
 

নাবি জাত : বীজ বপন থেকে মুলা উৎপাদন ৭০-৭৫ দিন।
 

বীজ উৎপাদনের জন্য : বীজ বপন থেকে বীজ উত্তোলন পর্যন্ত ১৫০-১৮০ দিন।

 

বীজ বপনের সময়
আগাম ফসলের জন্য : সেপ্টেম্বর মাস

 

মাঝারি ফসলের জন্য : অক্টোবর মাস
 

নাবি ফসলের জন্য : নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস
 

বীজ উৎপাদনের জন্য : অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বীজ বপন করতে হবে।

 

বীজের মাত্রা
বীজের মাত্রা নির্ভর করে মুলার জাত, বপন পদ্ধতি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্বের ওপর। প্রতি এক হাজার বীজের গড় ওজন ১০-১২ গ্রাম। এ হিসাবে প্রতি হেক্টর মুলা চাষের জন্য বীজ প্রয়োজন ২.৫ কেজি (১০ গ্রাম/শতাংশ)


সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি (হেক্টর ও শতাংশপ্রতি)

 

 

সারের নাম

 

মোট সারের পরিমাণ

শেষ চাষের সময়

বীজ বপনের৩সপ্তাহ পর                          

বীজ বপনের ৫ সপ্তাহ পর 

হেক্টরে

শতাংশে

হেক্টরে

শতাংশে

হেক্টরে

শতাংশে

হেক্টরে

শতাংশে

গোবর/কম্পোস্ট

১০ টন

৪০ কেজি

১০ টন

৪০ কেজি

-

-

-

-

ইউরিয়া 

৩৭৫ কেজি

১.৫কেজি

১৮৭কেজি

৭০০ কেজি

৯৪ কেজি

৪০০ গ্রাম

৯৪ কেজি

৪০০ গ্রাম

টিএসপি

২২৫ কেজি

১ কেজি

২২৫ কেজি

১ কেজি

-

-

-

-

এমপি

২২৫ কেজি

১ কেজি

১১২ কেজি

৫০০ গ্রাম

৫৬ কেজি

২২৫ গ্রাম

৫৬ কেজি

২৫০ গ্রাম

জিপসাম

১০০ কেজি

৪০০ গ্রাম

১০০ কেজি

৪০০ গ্রাম

-

-

-

-

বোরাক্স

১০-১৫কেজি

৫০ গ্রাম

১০-১৫কেজি

৫০ গ্রাম

-

-

-

-

 

জমি তৈরি
মুলা উৎপাদনের জন্য গভীর করে উপর্যুপরি চাষ দিয়ে জমি উত্তম রূপে তৈরি করা দরকার। মুলা বীজ সরাসরি জমিতে বপন করা হয়। তাই জমি তৈরির ওপর মুলার ফলন অনেকাংশে নির্ভর করে।

 

বীজ বপন পদ্ধতি
মুলা বীজ সারিতে বপন করাই উত্তম। এজন্য জমি উত্তমরূপে তৈরি করার পর ৭৫ সেমি. প্রশস্থ ‘বেড’ তৈরি করতে হবে। বেডের উভয় কিনারে ১৫ সেমি. ছেড়ে দিয়ে বেডের লম্বালম্বি ৪৫ সেমি. দূরত্বে দুটি লাইন টানতে হবে। লাইন দুটি ১-২ সেমি. গভীর হতে হবে।
লাইনে ৩০ সেমি. দূরে দূরে ২-৩টি বীজ ফেলে যেতে হবে। বীজ বপনের সাথে সাথে দুইপাশের ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে বীজ ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে।
দুই বেডের মাঝে ৩০ সেমি. চওড়া ও ১৫ সেমি. গভীর নালা থাকতে হবে।
বীজ বপনের পরপরই একটি সেচ দেয়া উত্তম।

 

পরবর্তী পরিচর্যা
পাতলাকরণ : বীজ বপনের ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই ৩০ সেমি. দূরত্বে সবচেয়ে ভালো গাছটি রেখে বাকি সব গাছ পর্যায়ক্রমে উঠিয়ে ফেলতে হবে।

 

সেচ প্রয়োগ
মুলা চাষে প্রয়োজন মতো সেচ দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জমিতে রসের অভাব হলে ১০-১২ দিন পর পর মোট ৩-৪টি সেচ দেয়া মুলার বৃদ্ধির জন্য উত্তম।
আগাছা দমন ও মাটির চটা ভেঙে দেয়া
মুলার জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। এজন্য প্রয়োজনমতো নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার ও মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। এতে প্রচুর আলো বাতাস পেয়ে মুলা বৃদ্ধি পাবে।

 

ফসল সংগ্রহ ও ফলন
বীজ বপনের ৪৫ থেকে ৬৫ দিনের মধ্যে মুলা উত্তোলন করে বাজারজাত করা যায়। এ সময় মুলা গড়ে ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের হয়। এসব মুলা ৬০-৬৫ দিন পর্যন্ত আঁশহীন থাকে।

 

ফলন : প্রতি হেক্টরে ৬০-৭৫ টন (২৪০-৩০০ কেজি/শতাংশ)


বীজ উৎপাদন
মুলা পরপরাগী উদ্ভিদ। সেজন্য বীজ ফসলের চারদিকে ১০০০ মিটারের মধ্যে অন্য কোনো মুলার জাত চাষ করা যাবে না। জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য এ পৃথকীকরণ দূরত্ব অপরিহার্য।
বীজ ফসলের জন্য অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বীজ বপন করাই ভালো।

মুলার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে জমি থেকে সমস্ত মুলা উঠিয়ে জাতের বিশুদ্ধতা, আকৃতি, রোগবালাই ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে মুলা বাছাই করতে হবে।
বাছাইকৃত মুলার মূলের এক-তৃতীয়াংশ এবং পাতার দুই-তৃতীয়াংশ কেটে ফেলতে হবে। মূলের কাটা অংশ ডায়থেন এম-৪৫ (২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে) এর দ্রবণে ডুবিয়ে নিতে হবে।

পরে প্রস্তুত করা বেডে সারি পদ্ধতিতে ৪০ সেমি. x ৩০ সেমি. দূরত্বে মুলা গর্তে স্থাপন করে পাতার নিচ পর্যন্ত মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
এ পদ্ধতিতে পুনরায় রোপণকৃত গাছ থেকে অধিক পরিমাণে উন্নত মানের বীজ পাওয়া যায়।
বীজ-ফসলের জমিতে ১০-১৫ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে।

গাছে ফুল আসার পর হেক্টরপ্রতি অতিরিক্ত ১০০ কেজি ইউরিয়া ও ১০০ কেজি এমপি সার বেডে ছিটিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
প্রতিকূল আবহাওয়ায় বীজ-ফসল যাতে হেলে না পড়ে সেজন্য ঠেকনা দিতে হবে।

মুলার বীজ ফসলে জাবপোকা দেখা দেয়া মাত্র প্রিমোর-জোলন-ম্যালাথিয়ন কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২.০ মি.লি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর প্রে করতে হবে।
অল্টারনারিয়া লিফ স্পট যদি মুলার পাতায় ও পডে (চড়ফ) দেখা দেয় তবে বীজ পরিপুষ্ট না হয়ে চিটা হয় এবং বীজের ফলন কমে যায়। এর প্রতিকার হিসেবে প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম রোভরাল মিশিয়ে গাছে ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।

বীজ বপনের পর ৫-৬ মাসের মধ্যেই বীজ সংগ্রহের উপযুক্ত হয়।

 

বীজের ফলন : হেক্টরপ্রতি বীজের ফলন ১.৫-২.০ টন পর্যন্ত হতে পারে।

 

মো. রফি উদ্দিন*
*প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্যানতত্ত্ব), আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী, পাবনা

বিস্তারিত
মধুর উপকারিতা

মধু মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এক অপূর্ব নেয়ামত। স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং যাবতীয় রোগ নিরাময়ে মধুর গুণ অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ (সা.) একে ‘খাইরুদ্দাওয়া’ বা মহৌষধ বলেছেন। আয়ুর্বেদ এবং ইউনানি চিকিৎসা শাস্ত্রেও মধুকে বলা হয় মহৌষধ। এটা যেমন বলকারক, সুস্বাদু ও উত্তম উপাদেয় খাদ্যনির্যাস, তেমনি নিরাময়ের ব্যবস্থাপত্রও। আর তাই তো খাদ্য ও ওষুধ এ উভয়বিধ পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ নির্যাসকে প্রাচীনকাল থেকেই পারিবারিকভাবে ‘পুষ্টিকর ও শক্তিবর্ধক’ পানীয় হিসেবে সব দেশের সব পর্যায়ের মানুষ অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে ব্যবহার করে আসছে। মধুতে যেসব উপকরণ রয়েছে তন্মধ্যে প্রধান উপকরণ সুগার। সুগার বা চিনি আমরা অনেকই এড়িয়ে চলি। কিন্তু মধুতে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ এ দুটি সরাসরি মেটাবলাইজড হয়ে যায় এবং ফ্যাট হিসাবে জমা হয় না। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুর নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, এতে অ্যালুমিনিয়াম, বোরন, ক্রোমিয়াম, কপার, লেড, টিন, জিংক ও জৈব এসিড (যেমন-ম্যালিক এসিড, সাইট্রিক এসিড, টারটারিক এসিড এবং অক্সালিক এসিড), কতিপয় ভিটামিন, প্রোটিন, হরমোনস, এসিটাইল কোলিন, অ্যান্টিবায়োটিকস, ফাইটোনসাইডস, সাইস্টোস্ট্যাটিক্স এবং পানি (১৯-২১%) ছাড়াও অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে। ভিটামিন যেমন- ভিটামিন সি বা অ্যাসকরবিক এসিড, ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৫, বি-৬, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে, ভিটামিন-এ বা ক্যারোটিন ইত্যাদি বিদ্যমান। মধু এমন ধরনের ওষুধ, যার পচন নিবারক (অ্যান্টিসেপটিক), কোলেস্টেরলবিরোধী এবং ব্যাকটেরিয়াবিরোধী ধর্ম আছে। প্রতিদিন সকালে এবং বিকালে খালি পেটে চা চামচের দুই চামচ করে মধু ডান হাতের তালুতে নিয়ে চেটে খেতে হবে। নিয়মিত ও পরিমিত মধু সেবন করলে  যেসব উপকার পাওয়া যায়। তা হলো-


১. হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। রক্তনালি প্রসারণের মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে এবং হৃদপেশির কার্যক্রম বৃদ্ধি করে;
২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে;
৩. দাঁতকে পরিষ্কার ও শক্তিশালী করে;
৪. দৃষ্টিশক্তি ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে;
৫. মধুর রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা, যা দেহকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের হাত থেকে রক্ষা করে;
৬. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ও কোষকে ফ্রি রেডিকেলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে;
৭. বার্ধক্য অনেক দেরিতে আসে;
৮. মধুর ক্যালরি রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ায়, ফলে রক্তবর্ধক হয়;
৯. যারা রক্ত স্বল্পতায় বেশি ভোগে বিশেষ করে মহিলারা, তাদের জন্য নিয়মিত মধু সেবন অত্যন্ত ফলদায়ক;
১০. গ্লাইকোজেনের লেভেল সুনিয়ন্ত্রিত করে;
১১. আন্ত্রিক রোগে উপকারী। মধুকে এককভাবে ব্যবহার করলে পাকস্থলীর বিভিন্ন রোগের উপকার পাওয়া যায়;
১২. আলচার ও গ্যাস্ট্রিক রোগের জন্য উপকারী;
 ১৩. দুর্বল শিশুদের মুখের ভেতর পচনশীল ঘায়ের জন্য খুবই উপকারী;
১৪. শরীরের বিভিন্ন ধরনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং উষ্ণতা বৃদ্ধি করে;
১৫. ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ মধু স্নায়ু এবং মস্তিষ্কের কলা সুদৃঢ় করে;
১৬. মধুতে স্টার্চ ডাইজেস্টি এনজাইমস এবং মিনারেলস থাকায় চুল ও ত্বক ঠিক রাখতে অনন্য ভূমিকা পালন করে;
১৭. মধু কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে;
১৮. ক্ষুধা, হজমশক্তি ও রুচি বৃদ্ধি করে;
১৯. রক্ত পরিশোধন করে;
২০. শরীর ও ফুসফুসকে শক্তিশালী করে;
২১. জিহ্বার জড়তা দূর করে;
২২. মধু মুখের দুর্গন্ধ দূর করে;
২৩. বাতের ব্যথা উপশম করে;
২৪. মাথা ব্যথা দূর করে;
২৫. শিশুদের দৈহিক গড়ন ও ওজন বৃদ্ধি করে;
২৬. গলা ব্যথা, কাশি-হাঁপানি এবং ঠাণ্ডা জনিত রোগে বিশেষ উপকার করে;
২৭. শিশুদের প্রতিদিন অল্প পরিমাণ মধু খাওয়ার অভ্যাস করলে তার ঠাণ্ডা, সর্দি-কাশি, জ্বর ইত্যাদি সহজে হয় না;
 ২৮. শারীরিক দুর্বলতা দূর করে এবং শক্তি-সামর্থ্য দীর্ঘস্থায়ী করে;
২৯. ব্যায়ামকারীদের শক্তি বাড়ায়;
৩০. মধু খাওয়ার সাথে সাথে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে, ফলে শরীর হয়ে উঠে সুস্থ, সতেজ এবং কর্মক্ষম।

ড. কে এম খালেকুজ্জামান*
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব), মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া

বিস্তারিত
ফলের বাণিজ্যিক চাষ পদ্ধতি ও বাগান ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশের গ্রীষ্ম ও অবগ্রীষ্ম মণ্ডলীয় আবহাওয়া ফল ফসল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশে ফলের ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে এবং এখানে প্রায় ৭০ রকমের ফলের প্রজাতি জন্মে যার ক্ষুদ্র একটি অংশ বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয়। বাংলাদেশে জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বিবেচনায় যেসব ফল বেশি জমিতে এবং পরিমাণে জন্মে সেগুলো হলো কাঁঠাল, আম, লিচু, লেবুজাতীয় ফল, আনারস, কলা, কুল, পেঁপে, পেয়ারা এবং নারিকেল যেগুলো প্রধান ফল হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে অপ্রধান ফল জন্মে। বর্তমানে একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ফলের ২০০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে প্রাপ্যতা হলো মাত্র ৭৪.৪২ গ্রাম। সে হিসাবে ১৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে ফলের বার্ষিক চাহিদা ১১৬.৮০ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশে ১.৩৭ লাখ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৪৩.৪৭ লাখ মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয় (বিবিএস, ২০১২)। সে হিসেবে বর্তমান উৎপাদিত ফলে আমাদের চাহিদার মাত্র ৩৭.২২% পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। অপরদিকে আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলের ৬১ ভাগ পাওয়া যায় মে থেকে আগস্ট মাসে এবং বাকি আট মাস উৎপাদিত হয় অবশিষ্ট ফলের ৩৯ ভাগ। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল এ আট মাসে মাথাপিছু ফলের প্রাপ্যতা থাকে আরও কম।


ফল ফসলের সমস্যা, সম্ভাবনা এবং গাছের বৈশিষ্ট্য মাঠ ফসল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এজন্য ফল ফসলের চাষ তথা ফলের নতুন বাগান স্থাপনে মাঠ ফসল থেকে ভিন্ন ধরনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ফল উৎপাদনে বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-


* চাষোপযোগী জমির স্বল্পতা
* উচ্চফলনশীল, রোগ ও পোকামাকড় সহনশীল, প্রতিকূল আবহাওয়া উপযোগী উন্নত জাতের অভাব
* অনিয়মিত ফল ধারণ
* মৌসুমভিত্তিক প্রাপ্যতা
* অপর্যাপ্ত গুণগতমানসম্পন্ন রোপণ দ্রব্য
* পরিচর্যার অভাব ও রোগ ও পোকামাকড়ের উচ্চ প্রাদুর্ভাব
* উচ্চ সংগ্রহোত্তর অপচয়
* ফল চাষে কৃষকদের সচেতনতার অভাব
* প্রযুক্তি হস্তান্তরে ধীরগতি ও বাজারজাত করণে প্রতিবন্ধকতা

 

ফলের বাণিজ্যিক চাষ পদ্ধতি
বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষে কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। সঠিকভাবে এগুলো অনুসরণ না করলে কাক্সিক্ষত ফল লাভ হয় না এবং পরবর্তিতে বাগান ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। অধিকাংশ ফল দীর্ঘজীবী বিধায় বাগান তৈরির সময় কোনো ভুলত্রুটি থাকলে পরবর্তী কালে সেগুলো সংশোধন করা ব্যয়বহুল এমনকি অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বাণিজ্যিক ফলবাগান স্থাপনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে তাহলে -


প্রজাতি ও জাত নির্বাচন : বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের ক্ষেত্রে ফসলের প্রজাতি ও জাত নির্বাচন সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ড  নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত হলেও, অঞ্চল ভিত্তিক মাটি ও জলবায়ুর বৈচিত্র্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদের সম্ভাবনা ব্যাপক। যে এলাকায় বাগান স্থাপন করা হবে সেই এলাকার উপযোগী ফলের প্রজাতি ও জাত বেছে নিতে হবে। প্রজাতি/জাত নির্বাচন সঠিক না হলে কাক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না।

 

জমি নির্বাচন : অধিকাংশ ফলগাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। ফলে বন্যা বা বৃষ্টির পানি দাঁড়ায় না এমন জমি ফল বাগান স্থাপনের জন্য নির্বাচন করতে হবে। তবে কিছু কিছু ফলগাছ যেমন- আম, পেয়ারা, নারিকেল, কুল স¦ল্পকালীন জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। এসব ফল মাঝারি উঁচু জমিতে রোপণ করা যেতে পারে। ফলগাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে না পারলেও তাদের বৃদ্ধি ও কাক্সিক্ষত ফলনের জন্য নিয়মিত সেচ প্রদান অত্যন্ত জরুরি। তাই জমি নির্বাচনের পূর্বে সেচের সুবিধা সম্পর্কে খেয়াল রাখতে হবে। ফল চাষের ক্ষেত্রে মাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাগানের মাটি অবশ্যই ফল উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত হতে হবে এবং মাটির ঢ়ঐ অবশ্যই সর্বাপেক্ষা নিরপেক্ষ অবস্থায় (৬.৮ থেকে ৮.৫) থাকতে হবে। উর্বর বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের জন্য জন্য উপযোগী।


জমি তৈরি : গভীরভাবে চাষ ও মই দিয়ে উত্তমরূপে জমি তৈরি করতে হবে। আগাছা বিশেষ করে বহুবর্ষজীবী আগাছার মধ্যে উলু ও দুর্বা গোড়া ও শেকড়সহ অপসারণ এবং জমি সমান করতে হবে।


চারা-কলম নির্বাচন : পরীক্ষামূলক বাগান স্থাপনের ক্ষেত্রে সঠিক চারা-কলম নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চারা নির্বাচন সঠিক না হলে বাগান থেকে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাবে না। চারার বয়স, রোগ বালাইয়ের আক্রমণ, সতেজতা প্রভৃতি বিষয়ের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ এগুলো গাছের ফলন ক্ষমতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ভালো চারা-কলমের নিম্নল্লিখিত গুণাগুণ থাকবে-
* চারা-কলমটি হবে ভালো জাত ও অনুমোদিত উৎসের সায়ন বা বীজ থেকে উৎপন্ন
* চারা-কলমটির কা-ের দৈর্ঘ্য শিকড়ের দৈর্ঘ্যরে ৪ গুণের বেশি হবে না
* চারা-কলমের বয়স এক বা দেড় বছরের বেশি হবে না
* চারা-কলমে ফুল-মুকুল বা ফল থাকবে না
* চারাটি রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত হবে
* কলমের চারাটি হবে ২-৩টি সুস্থ-সবল শাখাযুক্ত
* জোড় কলমের চারার আদিজোড় এবং উপজোড়ের মধ্যে সংগতি থাকতে হবে এবং সঠিকভাবে জোড়া লাগতে হবে।


ফিল্ড লে-আউট : ফলদ বৃক্ষ বহুবর্ষজীবী এবং বৃহদাকার হওয়ায় ফিল্ড লে-আউট ও চারা রোপণে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে। প্রথমে রেজিস্টারে চারা রোপণের নকশা তৈরি করতে হবে। সাধারণত সমভূমিতে বর্গাকার, আয়তকার, তারকাকৃতি, ত্রিকোণী অথবা ষড়ভূজী পদ্ধতি এবং পাহাড়ি জমিতে কন্টুর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
 

বর্গাকার পদ্ধতি (Square system) : এ পদ্ধতিতে রোপিত গাছ থেকে গাছ ও সারি থেকে সারির দূরত্ব সমান থাকে এবং দুই সারির পাশাপাশি চারটি গাছ মিলে একটি বর্গক্ষেত্র তৈরি করে এবং প্রতিটি বর্গক্ষেত্রের কোণায় একটি করে গাছ লাগানো হয়। এ পদ্ধতিতে রোপিত প্রতিটি গাছের পাশে সমান জায়গা থাকায় গাছগুলো সুষমভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং বাগান দেখতেও সুন্দর হয়। এ পদ্ধতিতে সাধারণত আম, লিচু, নারিকেল ইত্যাদি লাগানো হয়ে থাকে।

 

আয়তকার পদ্ধতি (Rectangular system) : এ পদ্ধতি বর্গাকার পদ্ধতির অনুরূপ কিন্তু প্রধান ব্যবধান হচ্ছে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব সারি থেকে সারির দূরত্বের চেয়ে কম হয় বলেই দুই সারির পাশাপাশি চারটি গাছ মিলে একটি আয়তক্ষেত্র সৃষ্টি করে। এ পদ্ধতিতে লাগানো ফলবাগানে আন্তঃপরিচর্যা করা বেশ সুবিধাজনক। এ পদ্ধতিতে সাধারণত আম, কাঁঠাল, কুল, ফুটি, তরমুজ ইত্যাদি লাগানো হয়ে থাকে।


তারকাকৃতি পদ্ধতি (Quincunx system) : এ পদ্ধতিতে আম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি বহুবর্ষী গাছকে বর্গাকারে রোপণ করে পাশাপাশি দুই সারির চারটি গাছ সমন্বয়ে গঠিত বর্গক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে একটি দ্রুতবর্ধনশীল ছোট ধরনের গাছ লাগানো হয়। এ অস্থায়ী গাছটিকে ফিলার বা পূরক গাছ বলা হয়। রোপিত আসল গাছগুলো যখন বৃদ্ধি পেয়ে সম্পূর্ণ জমি দখল করে তখন পূরক গাছগুলোকে অপসারণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে ফিলার গাছ হিসেবে পেঁপে, কলা, পেয়ারা ফুটি, তরমুজ ইত্যাদি লাগানো হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে সাধারণত আম, কাঁঠাল, লিচু, ইত্যাদি লাগানো হয়ে থাকে।


ত্রিকোণী পদ্ধতি (Triangular system) : এ পদ্ধতিতে গাছ লাগালে পাশাপাশি দুই সারির তিনটি গাছ মিলে একটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ তৈরি হয় অর্থাৎ যদি ১ম, ৩য় ও ৫ম সারিতে বর্গাকার পদ্ধতিতে গাছ লাগানো হয় তবে ২য়, ৪র্থ ও ৬ষ্ঠ একান্তরক্রমিক সারিতে প্রথমোক্ত সারিসমূহের মধ্যবর্তী স্থানে গাছ লাগাতে হয়। এ পদ্ধতিতে রোপিত গাছ তিনদিক থেকেই সারিবদ্ধ দেখায়। এ পদ্ধতিতে সাধারণত আম, লিচু, পেয়ারা ইত্যাদি লাগানো হয়ে থাকে।


ষড়ভূজী পদ্ধতি (Hexagonal system) : এ পদ্ধতি একটি সমবাহু ত্রিকোনী পদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ এখানে পাশাপাশি দুই সারির তিনটি গাছ মিলে একটি সমবাহু ত্রিভূজ তৈরি হয় এবং পাশাপাশি তিন সারির ছয়টি গাছ মিলে একটি ষড়ভূজ তৈরি হয় যার কেন্দ্রেও একটি গাছ থাকে। একই দূরত্বে গাছ লাগালে সারি থেকে সারির দূরত্ব কমে যায়। ফলে নির্দিষ্ট জমিতে বর্গাকার পদ্ধতি অপেক্ষা এতে শতকরা ১৫টি গাছ বেশি সঙ্কুলান হয়। এজন্য এটিকে বাণিজ্যিক ফল বাগানে বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এ পদ্ধতিতে সাধারণত আম, লিচু, পেয়ারা, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি লাগানো হয়ে থাকে।

কন্টুর পদ্ধতি (Contour system) : সাধারণত ঢালসম্পন্ন পাহাড়ি এলাকায় যেখানে জমির ঢাল ৩% এর বেশি হয় সেখানে এ পদ্ধতি অনূসরণ করা হয়। ঢালু, বন্ধুরতা ও উচ্চতা অনুসারে ভূমি থেকে পাহাড়ের ঢালে মোটামুটি সমান উচ্চতায় সারিবদ্ধভাবে গাছ লাগানোর পদ্ধতিকে কন্টুর পদ্ধতি বলা হয়। সেখানে ভূমিক্ষয়ের সম্ভাবনা থাকে এবং সেচ দেয়া অসুবিধাজনক সেখানে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে সাধারণত রোপিত গাছের পারস্পরিক দূরত্ব কখনও সমান থাকে না।

 

চারা রোপণের সময় : মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য আষাঢ় এবং ভাদ্র-আশ্বিন মাস বেশির ভাগ ফলদ বৃক্ষ রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে সেচ সুবিধা থাকলে টবে বা পলিব্যাগে উৎপাদিত চারা-কলম বছরের যে কোনো সময় রোপণ করা চলে। শীতকাল বা খরার সময় গাছ লাগালে এর প্রতি অধিক যত্নশীল হতে হবে। নতুবা রোপিত চারা-কলমের মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

রোপণ দূরত্ব : জাতভেদে একই প্রজাতির ফলে রোপণ দূরত্ব ভিন্ন হতে পারে। নিম্নের সারণীতে কয়েকটি উন্নত জাতের ফলের রোপণ দূরত্ব এবং উপযোগী এলাকা উল্লেখ করা হলো-
 

সারণি : বিভিন্ন উন্নত ফল জাতের রোপণ দূরত্ব

জাত

রোপণ দূরত্ব

বারি আম    

১০ মি.x ১০ মি.  

বারি লিচু   

 ৮ মি.x ৮ মি. 

বারি কুল      

৫ মি.x ৫ মি. বারি

পেয়ারা-২         

৫ মি.x ৫ মি.

বারিনারিকেল-১,২  

৬ মি.৬ মি.

বারি কমলা-১   

৩ মি. x ৩ মি.

বারি কমলা-২      

২.৫ মি.৩ মি.

বারি লেবু-১       

৩ মি. x ৩ মি.

বারি লেবু -২, ৩   

২.৫ মি. x ২.৫ মি.

বারি বাতাবিলেবু-৩,

৪  ৬ মি. x ৬ মি.

বারি মাল্টা-১   

৪ মি. x ৪ মি.

বারি আমড়া-১   

৪ মি.x ৪ মি.

বারি আমড়া-২   

৭ মি. x ৭ মি.

বারি কাঁঠাল-১, ২   

১০ মি. x ১০ মি.

বারি সফেদা-১, ২,

৩  ৭ মি.x ৭ মি.

বারি জামরুল-১,২  

 ৫ মি.x ৫ মি.

বারি সফেদা-১, ২,

৩  ৭ মি.x ৭ মি.

বারিজামরুল-১,২   

৫ মি.x ৫ মি.

বারি আঁশফল-২   

৫ মি x ৫ মি.

বারি তেঁতুল-১   

৮ মি.x ৮ মি.

বারি জলপাই-১   

৮ মি.x ৮ মি.

বারি লটকন-১   

৭ মি.x ৭ মি.


মাদা তৈরি : চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে গর্ত চিহ্নিতকরণ খুঁটিকে কেন্দ্র করে মাদা তৈরি করতে হবে। বড় ও মাঝারি বৃক্ষের জন্য ১ মি.x ১ মি.x ১ মি. এবং ছোট বৃক্ষের জন্য ৬০ সেমি.x ৬০ সেমি.x ৬০ সেমি. আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে। চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পূর্বে গর্তের মাটির সঙ্গে অনুমোদিত হারে জৈব ও অজৈব সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। মাটিতে রসের ঘাটতি থাকলে পানি সেচ দিতে হবে।


চারা রোপণ ও পরিচর্যা : মাদা তৈরির ১০-১৫ দিন পর মাদার মাটি কুপিয়ে আলগা করে লে-আউট করার সময় দু’প্রান্তে পুঁতে রাখা খুঁটি বরাবর ফিতা ধরে ১ মিটার অভ্যন্তরে ১ম চারা এবং নির্ধারিত দূরত্বে অন্যান্য চারা লাগাতে হবে। চারা লাগানোর সময় খুব সাবধানে এর গোড়ার টব-পলিব্যাগ-খড় অপসারণ করতে হবে যাতে মাটির বলটি ভেঙে না যায়। চারা এমনভাবে লাগাতে হবে যাতে এর গোড়া একদম সোজা থাকে এবং মাটির বলটি মাদার উপরের পৃষ্ঠ থেকে সামান্য নিচে থাকে। এর পর হাত দ্বারা আলতোভাবে মাটি পিষে দিতে হবে। চারাটি যাতে হেলে না যায় এবং এর গোড়া যাতে বাতাসে নড়াচড়া করতে না পারে সেজন্য চারা লাগানোর পরপরই খুঁটি দিতে হবে। খুঁটিটি সোজা করে পুঁতে এর সঙ্গে শক্ত করে পাটের সুতলি বেঁধে চারাটি এমনভাবে বাঁধতে হবে যাতে চারা এবং খুঁটির মাঝে সামান্য দূরত্ব থাকে। গরু ছাগলের উপদ্রবের আশংকা থাকলে, সম্পূর্ণ বাগানে অথবা প্রত্যেক গাছে বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। লাগানোর পরপরই প্রতিটি চারায় পানি সেচ দিতে হবে। চারা রোপণের পর এক সপ্তাহ প্রতিদিন এবং এর পরবর্তী এক মাস ২-৩ দিন পরপর সেচ দিতে হবে।   


গাছের মুকুল/ফল ভাঙন : কলমের গাছ রোপণের পরবর্তী বছর থেকেই মুকুল আসতে শুরু করে এবং অনেক ক্ষেত্রে সীমিত হারে ফলও হয়। কিন্তু গাছের বয়স ২-৪ বছর না হওয়া পর্যন্ত মুকুল অথবা কচি ফল ভেঙে দিতে হবে। তবে জাত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য দু’একটি ফল রাখা যেতে পারে।

 

ডাল ছাঁটাইকরণ : কলমের গাছ রোপণের পর এর গোড়ার দিক অর্থাৎ আদিজোড় (Rootstock) থেকে নতুন ডাল বের হতে থাকে। এসব ডাল ভেঙে দিতে হবে। এছাড়া গাছকে সুন্দর কাঠামো দেয়ার জন্য গোড়ার দিকে বৃক্ষভেদে ০.৫-১.৫ মিটার কাণ্ড রেখে নিচের সব ডাল ছাঁটাই করতে হবে। অনেক সময় বীজের চারায় ডালপালা না হয়ে প্রধান কাণ্ড ওপরের দিকে বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে নির্ধারিত উচ্চতায় গাছের ডগা কেটে দিতে হবে। প্রতি বছর বর্ষার শেষে মরা, রোগাক্রান্ত ও দুর্বল ডালপালা কেটে দিতে হবে। এছাড়া গাছ বেশি ঝোপালো হলে অতিরিক্ত ডালপালা ছাঁটাই করে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।

 
আগাছা দমন : ফল বাগান সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। বর্ষার শুরুতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং বর্ষার শেষে আশ্বিন-কার্তিক মাসে বাগানে চাষ দিয়ে আগাছা দমন করা যায়। গাছের কাছাকাছি যেখানে চাষ দেয়া সম্ভব হয়না সেখানে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আগাছা দমন করতে হবে। এরপরও আগাছার উপদ্রব পরিলক্ষিত হলে বর্ষা মৌসুমে হাসুয়া বা বুশ কাটার দ্বারা কেটে এবং শীত মৌসুমে চাষ ও কোদাল দ্বারা পুনরায় আগাছা দমন করতে হবে। আগাছানাশক যেমন রাউন্ড-আপ, পির্লাক্ষন প্রয়োগ করেও বাণিজ্যক বাগানে আগাছা দমন করা যায়।


সার প্রয়োগ : বাড়ন্ত গাছের দ্রুত বৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দুই মাস অন্তর সমান কিস্তিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। অনুমোদিত মাত্রায় গাছের গোড়া থেকে সামান্য দূরে সার ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। ফলন্ত গাছে সাধারণত বছরে দুইবার সার প্রয়োগ করতে হয়। বর্ষার শুরুতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে দু’এক পশলা বৃষ্টি হওয়ার পর মাটিতে রস এলে ১ম কিস্তি এবং বর্ষার শেষে আশ্বিন-কার্তিক মাসে বৃষ্টির পরিমাণ কমে এলে ২য় কিস্তির সার প্রয়োগ করতে হয়। দুপুর বেলায় যে পর্যন্ত ছায়া পড়ে তার থেকে সামান্য ভেতরে নালা তৈরি করে নালায় সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। অথবা গাছের গোড়ার ১.০-১.৫ মিটার বাদ দিয়ে দুপুর বেলায় যে পর্যন্ত ছায়া পড়ে সেই এলাকায় সার ছিটিয়ে কোদাল দ্বারা কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়। সারের অপচয় রোধ রকার জন্য বর্ষা মৌসুমে ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ করা উত্তম। পেয়ারা, কুল, লেবু জাতীয় ফল প্রভৃতি গাছের নতুন ডালে ফুল ও ফল হয়। এসব ক্ষেত্রে শীতের শেষে মাঘ-ফাগুন মাসে আরও এক কিস্তি সার প্রয়োগ করা উত্তম।

 

পানি সেচ ও নিষ্কাশন : শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিশেষ করে ফল ধারনের পর এবং ফলের বাড়ন্ত অবস্থায় ২-৩টি সেচ প্রয়োগ করা আবশ্যক। প্লাবন সেচ না দিয়ে রিং বা বেসিন পদ্ধতি অবলম্বন করা হলে পানি সাশ্রয় হবে। বর্ষা মৌসুমে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করা অতীব জরুরি। এজন্য বর্ষার শুরুতেই বিভিন্নমুখী নিষ্কাশন নালা তৈরি করতে হবে।

 

রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন
ফলদ গাছের প্রতিষ্ঠাকালে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। এজন্য নিয়মিত বাগান পরিদর্শন এবং প্রতিটি গাছ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে রোগবালাই দমনের ব্যবস্থা নিলে বাণিজ্যিকভাবে বাগান স্থাপন লাভজনক হবে।

 

ড. মো. মসিউর রহমান*
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর

বিস্তারিত
মুরগির কিছু বদঅভ্যাস ও তার প্রতিকার

মুরগি পালন একটি লাভজনক এবং মহৎ পেশা। মানুষের খাদ্য সরবরাহ করা একটি পুণ্যময় কাজ। দেশের আমিষের ঘাটতি পূরণ সহায়ক এটা। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও একটা বিশেষ অবদান রাখা যায়। মহান আল্লাহর একটি সৃষ্টি পাখিকে বিশেষ যত্ন নেয়ার ফলে পরকালে রয়েছে মূল্যবান পুরস্কার। তাই মুরগি পালনের মাধ্যমে আর্থিক লাভ অর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে অশেষ সওয়াবও হাসিল করা যায়।


এ মুরগি পালনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অনেক বিষয়ের। সেজন্য মুরগির জীবন চরিত্র সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। কিছু বিষয় মুরগির উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক আর কিছু বিষয় মুরগির উৎপাদন হ্রাস করে। মারা যায়ও অনেক মুরগি। মুরগির এমন কিছু বদঅভ্যাস লক্ষ করা যায়, যার ফলে মুরগির কাক্সিক্ষত মান অর্জনে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এসব অবস্থার মধ্যে ক্যানাবলিজম, ডিম খাওয়া, কুচে হওয়া, পালক খাওয়া ইত্যাদি অন্যতম। তাই মুরগির এসব বদঅভ্যাসকে চিহ্নিত করে তা প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুব জরুরি। তাই এগুলো নিচে আলোকপাত করা হলো।


ক্যানাবলিজম : মুরগির বদঅভ্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং ক্ষতিকর হলো ক্যানাবলিজম। এটা যে কোনো বয়সের মুরগির হতে পারে। এটা খুবই ব্যয়বহুল সমস্যা, যা খামারির ক্ষতি সাধন করে থাকে কিন্তু অনেক সময় খামারি তা বুঝতে পারেন না। ক্যানাবলিজমের কয়েকটা ভাগ রয়েছে যেমন।
১. ভেন্ট পিকিং
২. ফিদার পিকিং
৩. টই পিকিং
ভেন্ট পিকিং : এটা মূলত বড় মুরগির ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় এবং লেয়ার মুরগির বদঅভ্যাস। এ অভ্যাসের কারণে মুরগির পায়ুপথের নরম মাংশে আঘাত করে রক্ত গ্রহণ করে। এর ফলে মুরগির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় এবং মুরগির উৎপাদন কমে যায়। অনেক সময় এর ফলে মুরগির মৃত্যও ঘটে থাকে। আর মুরগি যদি একবার রক্তের স্বাদ পায় তাহলে সে অন্য মুরগিকে ঠোকরাতে থাকে এবং এ অভ্যাসটা পুরো ফ্লকে ছড়িয়ে পড়ে।
নিম্নোক্ত এক বা একাধিক কারণে মুরগির ক্যানাবলিজম হয়ে থাকে-
. মুরগির ঘনত্ব বৃদ্ধি : মুরগিকে তার প্রয়োজন মতো জায়গা দিতে হয়। সেক্ষত্রে যদি তার জায়গার ঘাটতি হয় সেক্ষেত্রে এ বদঅভ্যাস শুরু হয়ে যেতে পারে। বাচ্চার জন্য নির্ধারিত জায়গা হলো-
প্রতি বাচ্চার জন্য (প্রথম ২ সপ্তাহ) ১/৪ স্কোয়ার ফিট, প্রতি মুরগির বাচ্চার জন্য (৩-৮ সপ্তাহ) ১/২ স্কোয়ার ফিট, প্রতি মুরগির জন্য (৮-১৬ সপ্তাহ) ১ স্কোয়ার ফিট, প্রতি মুরগির জন্য (১৬ সপ্তাহের পর থেকে) ১৫ স্কোয়ার ফিট। এর কম হলে ক্যানাবলিজম দেখা যায়।
. অতিরিক্ত তাপ : যখন মুরগির খামারে অসহ্য গরম দেখা যায় তখন মুরগির মধ্যে ক্যানাবলিজম মারাত্মক আকারে লক্ষ করা যায়। অতিরিক্ত তাপের ফলে মুরগির বিপাকক্রিয়া ভালো হয় না। যার ফলে মুরগির খাদ্যের প্রতি অনীহা দেখা যায়। গরমে একে অপরের সঙ্গে হিংসাত্মক ভাব প্রদর্শন করে। যার ফলে এক মুরগি অন্য মুরগিকে ঠোকর মারতে থাকে।  
. অপর্যাপ্ত খাদ্য পানির পাত্র : মুরগির জন্য সর্বদা পানির সরবরাহ রাখতে হয়। মুরগি তার প্রয়োজন মতো পানি পান করতে থাকে। পানিপাত্রের অভাব হলে মুরগির মধ্যে হিংসাত্মক ভাব প্রকাশ পায়। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পানি ও খাদ্য গ্রহণ করে। আর এসব অবস্থার জন্য মুরগির মধ্যে ক্যানাবলিজমের প্রভাব বেড়ে যায়।
. মুরগিকে শুধুমাত্র দানাদার খাদ্য খাওয়ানো : মুরগির খাদ্যে পিলেট ও ম্যাস উভয়ের মিশ্রণ থাকা খুব জরুরি। শুধু দানাদার খাদ্য খাওয়ালে মুরগির মধ্যে কিছু বদঅভ্যাস সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে ক্যানাবলিজম ও অন্যতম। মুরগির দানাদার খাদ্য খেতে খেতে ঠোকরানো প্রভাব বেশি হতে থাকে। তাই পরিমিত দানাদার ও ম্যাস ফিড (গুঁড়া খাবার) খাওয়ানো উত্তম।
. খাঁচায় অবস্থান সংকট : খাঁচায় মুরগি পালন করা হলে নিয়মমতো মুরগির জন্য স্থান প্রয়োজন। আর খাঁচায় যদি মুরগি পালন কালে জায়গার ঘাটতি পড়ে তাহলে খাদ্যের ঘাটতির সঙ্গে মুরগির প্রতিযোগিতা স্বরূপ একে অপরের সঙ্গে মারামারিসহ ঠোকরানো শুরু করে। ফলে ক্যানাবলিজমের প্রভাব বাড়তে থাকে।
. সময়মতো সঠিক চিকিৎসার অভাব হলে : মুরগি কোনো জীবাণু বা কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলে চিকিৎসার প্রয়োজন। অন্তত তাকে আলাদাকরণ খুব প্রয়োজন। আর এ চিকিৎসার যদি কোনো ঘাটতি হয় এবং যদি দেরি হয় তাহলে অন্য মুরগি সেই আক্রান্ত মুরগিকে নতুন করে ঠোকরানো শুরু করে। আর এ অবস্থায় যদি কোনোভাবে রক্তের স্বাদ পায় তাহলে সেই মুরগির মধ্যে এ ঠোকরানোর প্রবণতা বেড়ে যায়। এবং এটা খুব অল্প সময়ের মধ্যে খামারের অন্য মুরগির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যা সহজে রোধ করা কষ্টকর।
. পরজীবী উকুনের আক্রমণ : মুরগি খুব সংবেদনশীল পাখি। অল্পতেই যে বিরক্ত এমনকি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। গরম ঠাণ্ডার বেশি পার্থক্য হলেই অল্পতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর মুরগিতে পরজীবীর আক্রমণ খুব সাধারণ একটা বিষয়। পরজীবীর আক্রমণ হলে মুরগি খুব অশস্তি বোধ করে। এর ফলে আক্রমণের স্থান চুলকায়। যার কারণে সে নিজের ঠোঁট দিয়ে তা চুলকাতে চেষ্টা করে। এতে কাজ না হলে পরে অন্য কোনো শক্ত জিনিসের সঙ্গে নিজের শরীর লাগিয়ে দিয়ে সেই যন্ত্রণা হতে মুক্তির চেষ্টা করে। আর এ রকম অবস্থায় মুরগির পালক উঠে যায় এমনকি মুরগির রক্তক্ষরণও হতে পারে। যদি মুরগির সেই ক্ষরিত রক্ত কোনো মুরগি গ্রহণ করে তাহলে সেই মুরগির মধ্যে রক্তের নেশা লেগে যায়। ফলশ্রুতিতে অন্য সুস্থ মুরগিকে আক্রমণ করে রক্ত শোষণ করতে শুরু করে। পরে এক সময় তা ব্যাপক হারে মুরগির ফ্লকে ছড়িয়ে পড়ে।
. সময়মতো সঠিক মাত্রায় মুরগির ঠোঁট না কাটা : মুরগির ক্ষেত্রে ঠোঁট কেটে ছোট করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত লেয়ার (ডিম পাড়া) মুরগির ক্ষেত্রে। মুরগির ঠোঁট বেশি বড় থাকলে সে যেমন খাদ্যের অপচয় করে ঠিক তেমনি তার বড় ঠোঁটের বড়ত্ব দেখিয়ে অন্য মুরগিকে আক্রমণ করে থাকে। আর এ ধরনের মুরগির মধ্যে ডিম খাওয়ার প্রবণতাও বেশি থাকে। এর ফলে মুরগির উৎপাদনের অনেকটা ক্ষতি হয়।  
. দীর্ঘক্ষণ না খাইয়ে রাখা : মুরগিকে তার প্রয়োজনীয় খাবার সময় মতো খাবার দিতে হয়। দীর্ঘক্ষণ খাবার ছাড়া থাকলে মুরগির ভেতরে ফেদার পিকিং এর প্রবণতা বেড়ে যায়। খাবারের তাগিদে তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে।
১০. ঘরে আলোর তীব্রতা বেশি হলে : প্রয়োজন মতো আলো মুরগির জন্য খুবই জরুরি। এর চেয়ে মাত্রা বেশি হলে তা ক্ষতিতে রূপ নিতে থাকে।
১১. মুরগির বংশগত স্বভাব হলে : কিছু মুরগির বংশগতভাবে ফিদার পিকিং এ আক্রান্ত থাকে। যার ফলে খামারে তা রোধ করা সহজ হয় না।
১২. উচ্চ পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্য এবং কম ফাইবার যুক্ত খাবার : মুরগির ক্ষেত্রে অতি উচ্চশক্তির খাদ্য খাওয়ালেও এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। আর খাবারে ফাইবার কম থাকাটাও একটা অন্যতম কারণ। যার ফলে ক্যানাবলিজমের স্বভাব বৃদ্ধি পায়।


ক্যানাবলিজমের প্রতিকার : কথায় আছে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। ক্যানাবলিজমের ক্ষেত্রেও একই কথা। একবার ক্যানাবলিজম হলে খুব সহজেই তা দূর করা কষ্টকর। তবে কিছু বিষয়ের ওপর সজাগ দৃষ্টি দিলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যায় এর প্রভাবে ক্ষতির পরিমাণ কমানো। যে বিষয়ের ওপর বিশেষ যতœ নিতে হবে তা হলো-
. সুষম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে : মুরগিকে তার প্রয়োজনমতো সব পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি ঠিক রেখে সুন্দরভাবে খাদ্য প্রস্তুত করতে হবে। কোনো ঘাটতি যেন না থাকে সে ক্ষত্রে লক্ষ রাখতে হবে। ভিটামিন ও মিনারেলের ওপর সুনজর রাখতে হবে। আর মুরগি সাধারণত যে অর্গানিক উপাদানগুলো গ্রহণ করে থাকে তাই উৎপন্ন মাংস ও ডিমে সরবরাহ করে। তাই তার নিজের খাদ্যে যদি এগুলো উপাদানের ঘাটতি থাকে তাহলে সে দিনে দিনে ঘাটতিতে পড়ে যাবে। আর সব উপাদান ভালো মাত্রায় রাখলে এ ক্যানাবলিজমের পরিমাণ অনেকাংশেই হ্রাস পাবে।
. পর্যাপ্ত পানির খাদ্যের পাত্রের সরবরাহ বাড়াতে হবে : মুরগির সংখ্যা অনুযায়ী পাত্রের সংখ্যা নির্ধারণ করে তাতে পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। খাবারের জায়গা সবসময় পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। খাবার পরিমাণ মুরগির বয়স অনুযায়ী নির্ধারণ করে মুরগির সংখ্যার সঙ্গে তালমিলিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
. সময়মতো ডিবেকিং (ঠোঁট ছোট) করা : বর্তমানে সহজ উপায়ে মুরগির ক্যানাবলিজম দূর করার জন্য ডিবেকিংকেই একমাত্র প্রধান হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষত লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে ঠোটের এক-তৃতীয়াংশ কেটে দিতে হবে। আর এ সময় মুরগির রক্তক্ষরণ কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেমন- দক্ষ লোক দ্বারা এ কাজ সম্পন্ন করা,
* আইরন ব্রান্ড কে পর্যাপ্ত তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা,
সতর্কতার সঙ্গে মুরগিকে ধরা এবং মেশিনে স্থাপন করা,
* পরিমাণ মতো ঠোঁট কাটা বেশি না কাটা,
* ঠোঁট কাটার পর মুরগির স্ট্রেস (ধকল) কমানো জন্য ভিটামিন সি অথবা লেবু পানি খাওয়ানো।
৪. পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা করা : সব মুরগিকে তার নিজের সব কাজ সঠিকভাবে করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দিতে হবে।
৫. মুরগির ভিড় কমানো : বেশি মুরগি একসঙ্গে গাদাগাদি করে যেন না থাকে সে দিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে।
৬. পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. শেডের আলো সব জায়গায় যেন সমভাবে ব্যাপ্ত হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। লাইট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৪০ ওয়াটের ওপর বাল্প ব্যবহার করা উচিত নয়।
৮. পোলট্রি খাবারে যথেষ্ট পরিমাণে মিথিওনিন সরবরাহ করতে হবে। মিথিওনিন ক্যানাবলিজম প্রতিরোধ করতে বেশ সহায়তা করে
 ডিম খাওয়া
ডিম পাড়া মুরগির আরও একটি মারাত্মক বদঅভ্যাস হলো নিজের ডিম নিজে খাওয়া। এটা প্রায়ই লেয়ার খামারে দেখা যায়। এর ফলে খামারি তার লাভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না।
যেসব কারণ আছে ডিম খাওয়ার পেছনে-
দীর্ঘক্ষণ ডিম খাঁচায় রাখা।
যদি কোনো কারণে একবার ডিম ভেঙে যায় এবং সেই ডিম যদি মুরগি খেয়ে স্বাদ পায় তাহলে পরে সে নিজের ভালো ডিম খেতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
ডিমের খোলস যদি খুব পাতলা হয়। রক্ত বা ভেজা ভেজা অবস্থার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
মুরগির খাবারে যদি প্রোটিনের অভাব হয়।
সমাধান
১. মুরগিকে পরিমিত সব উপাদান দেয়া প্রয়োজন,
২. যত দ্রুত সম্ভব মুরগির ডিম অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে,
৩. মুরগির ঠোঁট কেটে দিতে হবে।
৪. মুরগির খাবারে অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের সরবরাহ বাড়াতে হবে। ক্যালসিয়াম ডিমের সেল গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
৫. মুরগির ডিম পাড়ার জায়গা তুলনামূলক ঢালু করে রাখতে হবে। এতে ডিম পাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নিচে চলে আসে।
৬. ডিম পাড়া স্থানে তুলনামূলক অন্ধকার হলেও এ অভ্যাসের প্রকোপ কমে।
৭. ডিম সংগ্রহের বিরতি কমাতে হবে।
ডিম লুকানো  
যদিও ডিম লুকানো অভ্যাস মূলত বন্য মুরগির ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। তারপরও জেনেটিক্যালি (বংশগত ভাবে) কিছু মুরগির মধ্যে এ অভ্যাস চলে আসতে পারে। আর এ অভ্যাসে আক্রান্ত মুরগি তাদের ডিম কে মানুষের চোখের অন্তরালে লুকিয়ে রাখে।
সমাধান
মুরগির মুক্ত চলাচলে বাধা প্রদান।
ডিম পাড়ার স্থানটা খামারের ভেতরেই রাখতে হবে সঙ্গে বালু বা খড় দিয়ে তা আরামদায়ক করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
মুরগির মধ্যে যাদের এ স্বভাব দেখা দেবে তাদের আলাদা করে খাঁচায় পালনের ব্যবস্থা করতে হবে।
পালক খাওয়া
কোনো কোনো মুরগি অস্বাস্থকর পরিবেশে পালক খাওয়া শুরু করে। যদিও এ সমস্যা খুব একটা মারাত্মক নয়। তারপরও এ অভ্যাস হতে আস্তে আস্তে ক্যানাবলিজমের দিকে ধাবিত হয়। আর একবার এ অভ্যাস হয়ে গেলে তা দূর করা খুব দুরূহ হয়ে পড়ে।
এ অভ্যাস কমানোর অন্যতম উপায় হলো মুরগির পরিবেশ ও বাসস্থান পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখা। খাবার দেয়ার সময় দানাদার ও গুঁড়া খাবার একসঙ্গে দেয়া উচিত।
কুচে হওয়া
ডিম পাড়া মুরগির খুবই পরিচিত সমস্যা এ কুচে লাগা। একটা নির্দিষ্ট সময় ডিম দেয়ার পর সেই মুরগি ডিম দেয়া বন্ধ করে দেয়।
ব্রুডি হেন (কুচে মুরগি) ডিম দেয় না কিন্তু সে তার জায়গা ধরে রাখে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ফলে অন্য মুরগির ডিম পাড়ার জায়গা দখল করে থাকে। কুচে মুরগি খুব আক্রমণাত্মক রূপ ধারণ করে এবং তাকে তার জায়গা হতে সরানো কষ্টকর।
কুচে হওয়া মুরগির সমাধান
তাকে আলাদ করে রাখতে হবে।
ডিম পাড়া মুরগির সামনে বেশি ডিম একসঙ্গে না রাখা। তার ফলে কুচে হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
কুচে লেগে বসে থাকা মুরগিকে বসে থাকতে না দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো। এটাও খুব সাধারণ ফলপ্রসূ নিয়ম।
উপযুক্ত খাবার সরবরাহ করা।
পিকা
মুরগি অনেক সময় যা খাওয়ার উপযুক্ত নয় তাও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। মুরগির এ স্বভাবকে পিকা বলা হয়। যেমন লিটার, পালক ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এ অভ্যাস আধুনিক মুরগির খামারে তেমন নেই বললেই চলে। অনেক সময় ফসফরাসের ঘাটতি হলে, পরজীবীর আক্রমণ হলে এ অভ্যাস লক্ষ করা যায়।
সমাধান : ভালো খামার ব্যবস্থাপনা এবং ফসফরাসের পরিমাণ ঠিক রেখে খাবার প্রদান করলে এ সমস্যার সমাধান খুব দ্রুত হয়।
গাছে উঠা : কিছু কিছু মুরগি তাদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা বাদ দিয়ে রাতের বেলায় গাছে উঠে থাকে। এটা গ্রামের মুরগির ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। এ সমস্যায় আক্রান্ত মুরগি অনেক সময় বনবিড়াল ও শিয়ালের আক্রমণের শিকার হয়। ভয় পেয়ে অনেক মুরগি তাদের ডিম উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এসব মুরগির ডানা অল্প পরিমাণে কেটে দিতে হবে যেন উড়ে গাছে উঠতে না পারে। আর সজাগ দৃষ্টি রেখে তা প্রতিহত করা যায়।
খামার করে লাভবান হতে হলে ওপরের বিষয়গুলো বিবেচনা করে তার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বদঅভ্যাসগুলো খামারে দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা কমাতে হবে। তাহলেই নিজের প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।

 

মো. মোস্তাফিজুর রহমান*
* শিক্ষার্থী, ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদ, ৪র্থ বর্ষ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর (১৪২২ কৃষিকথা)

মো. নুরুদ্দিন
নোয়াখালী
প্রশ্ন : ধান গাছের পাতা লম্বালম্বিভাবে মুড়িয়ে যাচ্ছে এবং পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলছে। কী করলে প্রতিকার পাব।
উত্তর : পাতা মোড়ানো পোকার কীড়া ধান গাছের পাতা লম্বালম্বিভাবে মুড়িয়ে ফেলে এবং পাতার ভেতরের সবুজ অংশ খায়। খুব বেশি ক্ষতি করলে পাতা পুড়ে যাওয়ার মতো দেখায়। এ পোকা দমনের জন্য-
* জমিতে ডালপালা পুঁতে পোকা খেকো পাখি বসার ব্যবস্থা করতে হবে।
* আলোক ফাঁদের সাহায্যে পোকা বা মথ দমন করতে হবে।
* আক্রান্ত পাতা কেটে নষ্ট করতে হবে।
-গাছে থোড় আসার সময় বা ঠিক তার আগে যদি শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে অনুমোদিত কীটনাশক সুমিথিয়ন, টাফগর ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।

 

শাওন দাস
জামালপুর
প্রশ্ন : পেঁপে গাছের পাতার ওপর হালকা হলুদ ও গাঢ় সবুজ রঙের ছোপ ছোপ দাগ পড়ে ও পাতা কুঁকড়ে যায়। এ থেকে বাঁচার উপায় কী?
উত্তর : মোজাইক রোগের কারণে পেঁপে গাছের পাতায় সবুজ ও হলুদ রঙের ছোপ ছোপ দাগ পড়ে। পাতা খর্বাকৃতির হয় ও কুঁকড়ে যায়। পেঁপে গাছের যে কোনো বয়সে এ রোগ দেখা যায়। চারা গাছ আক্রান্ত হলে বেশি ক্ষতি হয়। ফলন অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পায়। এর প্রতিকারের জন্য-
* আক্রান্ত গাছ তুলে পুঁতে ফেলতে হবে।
* রোগ মুক্ত বাগান থেকে বীজ সংগ্রহ করে চারা তৈরি করতে হবে।
* ভাইরাস রোগের বাহক পোকা জাবপোকা ও সাদামাছি দমনের জন্য বালাইনাশক (এডমায়ার, এসাটাফ, রগর ইত্যাদি) ব্যবহার করতে হবে।

 

মো. আলতাফ
পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : ধানের বাদামি গাছ ফড়িং দমনে করণীয় কী?
উত্তর : বাদামি গাছ ফড়িং ধান গাছের একটি মারাত্মক ক্ষতিকর পোকা। ফসল এ পোকা দ্বারা বেশি আক্রান্ত হলে ‘বাজপোড়া’ বা হপার বার্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাদামি গাছ ফড়িং দমনের জন্য-
* বোরো মৌসুমে ফেব্রুয়ারি এবং আমন মৌসুমে আগস্ট মাস থেকে নিয়মিত ধান গাছের গোড়ায় পোকার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
* ধান ক্ষেতের পাশে আলোক ফাঁদের ব্যবস্থা করতে হবে।
* ধান ক্ষেত দুইহাত পর পর ফাঁকা করে দিয়ে গাছের গোড়ায় রোদ ও আলো বাতাস লাগার ব্যবস্থা করতে হবে।
* অতিমাত্রায় ইউরিয়া সার ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
* পোকার আক্রমণ হলে জমির পানি সরিয়ে দিতে হবে।
* ধানের চারা নির্দিষ্ট দূরত্বে (২৫x ২০ সেমি.) রোপণ করতে হবে।
* আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক (মিপসিন ৭৫ ডব্লিউপি, প্লিনাম, একতারা) গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে।

 

রিংটু
নওগাঁ
প্রশ্ন : গরুর শরীরে আঁচিল হয়েছে কী করণীয়?
উত্তর : অটোজেনাস ভ্যাকসিন পশুর আঁচিল রোগের চিকিৎসায় কার্যকর।
অটোজেনাস ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়া-
ক. প্রথমে পশুর ত্বকের আঁচিল ও তার চারপাশ পরিষ্কার করে নিতে হবে। প্রায় ২ গ্রাম পরিমাণ আঁচিল ধারালো ও জীবাণু মুক্ত ছুরি দ্বারা কেটে একটি জীবাণুমুক্ত পাত্রে সংগ্রহ করতে হবে।
খ. এবার জীবাণুমুক্ত কেঁচি দিয়ে আঁচিল টুকুরা টুকরা করে কেটে মর্টার ও পেস্ট্ল সাহায্যে ৫০% গ্লিসারল স্যালাইনে প্রথমে পেস্ট করে পরে ২০ মি.লি. সিøসারিন স্যালাইনে ১০% টিস্যু সাসপেনশন তৈরি করতে হবে।
গ. এ সাসপেনশন টিউব নিয়ে ২০ মিনিট সেন্টিফিউজ করতে হবে (৩০০০ জচগ)। ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য ২০% টিস্যু সাসপেনশনে ০.৪% ফরমালিন এবং অ্যান্টিবায়োটিক (স্ট্রেপটোপেনিসিলিন) প্রয়োগ করতে হবে। অতঃপর টিউবের ওপরে ফ্লুইড সংগ্রহ করে ৫ মি.লি করে ত্বকের নিচে সপ্তাহে একবার করে মোট ৩টি ইনজেকশন দিতে হয়। এভাবে চিকিৎসা করলে ৮০%-৮৫% আক্রান্ত গরু সুস্থ হয়।
ঘ. আঁচিল যদি সংখ্যায় কম ও আকারে বড় হয় তবে তা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে ফেলা যায় অথবা নাইলনের সুতা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলে কয়েক দিনের মধ্যে খসে পড়বে।

 

আরাফাত
দিনাজপুর
প্রশ্ন : ডেইরি ফার্ম করব। কয়েকটি দুধ উৎপাদনশীল গাভী সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : কয়েকটি দুধ উৎপাদনশীল গাভীর পরিচয়-
ক. হলস্টেইন ফ্রিজিয়ান : এ জাতের গরু আকারে বড়। গায়ের রঙ কালো সাদা মিশ্রিত। গাভীর ওজন ৬৫০-৬৭৫ কেজি ও ষাঁড়ের ওজন ৯০০-১০০০ কেজি পর্যন্ত হয়। গাভীর ক্ষেত্রে ১ম বাচ্চা প্রদানের বয়স ১৮-২৪ মাস ও গর্ভধারণকাল ২৮০-২৯০ দিন। বছরে গড় দুধ উৎপাদন ৮০০০-১২০০০ লিটার
খ. জার্সি : এ জাতের গরুর আকার অপেক্ষাকৃত ছোট ও গায়ের রঙ কালচে অথবা লালচে। গাভীর ওজন ৪০০-৫০০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৬০০-৭০০ কেজি পর্যন্ত হয়। বছরে গড় দুধ উৎপাদন ৪০০০-৫০০০ লিটার প্রথম বাচ্চা প্রদানের বয়স ৩০-৩৮ মাস ও গর্ভধারণকাল ২৮০-২৯০ দিন।
গ. শাহীওয়াল : হালকা লাল। বাদামি এবং সাদা রঙের শাহীওয়াল গরুর কুঁজ ও গলকম্বল বড় এবং ঝুলানো থাকে। গাভীর রঙ লাল এবং ওলান বেশ বড়। গাভীর গড় ওজন ৩০০-৪০০ কেজি এবং ষাঁড় ৪৫০-৫০০ কেজি পর্যন্ত হয়। বছরে গাভীপ্রতি গড় দুধ উৎপাদন ৪০০০-৫৫০০ লিটার, ১ম বাচ্চা উৎপাদন ৩০-৪০ মাস এবং গর্ভধারণকাল ২৮০ দিন পর্যন্ত হয়।
ঘ. হরিয়ানা : সাদা রঙের হরিয়ানা গরুর ঘাড় লম্বা ও সুগঠিত। গলকম্বল ছোট ও পাতলা, পা লম্বা, কুঁক বা চুট বেশ বড় ও প্রশস্ত। গাভীর ওজন গড়ে ৫০০-৫৫০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৬০০-৬৫০ কেজি পর্যন্ত হয়। বার্ষিক দুধ উৎপাদন ৩২০০ লিটার ও প্রথম বাচ্চা প্রসবকাল ৪৪ মাস।
ঙ. থারপারকার : সাদা বর্ণের থারপাচকার গরু মাঝামাঝি আকার, সুগঠিত দেহ, উঁচু কপাল, চোখের পাঁপড়ি কালো ও চোখ উজ্জ্বল বড়, শিংয়ের গোড়া মোটা। গাভীর গড় ওজন ৪০০-৪৫০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৫০০-৬০০ কেজি পর্যন্ত হয়। বছরের গড় দুধ উৎপাদন ৪০০০-৪৫০০ লিটার পর্যন্ত হয়।

 

এরশাদ আলি
জামালপুর
প্রশ্ন : শীত মৌসুমে মাছের ক্ষতরোগ বা ঘা দেখা যায়, কী করব?
উত্তর : শীত মৌসুমে পুকুরে পানির তাপমাত্রা কম থাকার কারণে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ বেশি হয়। ফলে মাছের গায়ে বিভিন্ন রকম ঘা, ক্ষতরোগ অথবা পাখনা বা ফুলকা পচা রোগ দেখা দেয়। এ জাতীয় রোগ দেখা দিলে প্রতি শতাংশ পুকুরে আধা কেজি চুন ও আধা কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হয়, ৭ দিন পর আবার একইভাবে দিতে হয়। বছরে ২Ñ৩ বার চুন প্রয়োগ করা ভালো পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট শতাংশপ্রতি ১৫ গ্রাম এবং চুন ও লবণ শতাংশপ্রতি ১ কেজি করে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ঘাযুক্ত মাছগুলো পুকুর থেকে তুলে পাত্রে ২০ লিটার পানি নিয়ে তাতে ২০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে পানিতে মাছগুলোকে ৫ মিনিট রাখতে হবে। অন্য একটি পাত্রে একই পরিমাণ পানি নিয়ে ৫ গ্রাম পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে ৫ মিনিটের জন্য মাছগুলোকে রাখতে হবে তারপর পুকুরে ছাড়তে হবে।
টেট্রাসাইক্লিন-টেরামাইসিন প্রতি কেজি খাদ্যে ২টা ট্যাবলেট ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে। বেশি ঘাওয়ালা মাছ ধরে পুঁতে ফেলতে হবে।
মাছের ক্ষতরোগের মাত্রা বেশি হলে চুন ১ কেজি/শতাংশ এবং লবণ ১ কেজি/শতাংশ হারে প্রয়োগ করতে হবে।
উপকূলীয় অঞ্চলে মাছ চাষের পুকুর বন্যায় প্লাবিত হলে ক্লোরাইডের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির (৩০ পিপিএমের বেশি) ফলে কেবল সিলভার কার্প মাছে ক্ষতরোগ দেখা যায়। এক্ষেত্রে আক্রান্ত পুকুরের তিন ভাগের দুই ভাগ পানি মিঠাপানির দ্বারা পরিবর্তন করতে হবে। প্রতি শতাংশে ৩-৪টি করে চালতা ছেঁচে সারা পুকুরে ছড়িয়ে দিতে হবে। পুকুরকে বন্যামুক্ত রাখতে হবে।

 

আহসান হাবিব
ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : মাছের ফুলকা পচা রোগ হলে কী করব?
উত্তর : প্রতি শতাংশে আধা কেজি চুন ৭ দিন পর পর দিতে হবে। চুন ১ কেজি/শতক হারে প্রয়োগ করতে হবে। ঘা যুক্ত মাছগুলো পুকুর থেকে তুলে কোনো পাত্রে ২০ লিটার পানি নিয়ে তাতে ২০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে পানিতে মাছগুলোকে ৫ মিনিট রাখতে হবে। অন্য একটি পাত্রে একই পরিমাণ পানি নিয়ে ৫ গ্রাম পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে ৫ মিনিটের জন্য মাছগুলোকে রাখতে হবে তারপর পুকুরে ছাড়তে হবে। প্রতি কেজি খাবারের সঙ্গে টেরামাইসিন ট্যাবলেট (৩ মিগ্রা.) একটি করে এক সপ্তাহ খাওয়াতে হবে।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*

* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
পৌষ মাসের কৃষি

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সবাইকে শীতের শুভেচ্ছা। হেমন্তের কাব্যিক উপাখ্যান শেষে ঘন কুয়াশার চাদরে মুড়িয়ে শীত এসে উপস্থিত হয়েছে আমাদের মাঝে। বাংলার মানুষের মুখে অন্ন জোগাতে শীতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় লেপের উষ্ণতাকে ছুঁড়ে ফেলে আমাদের কৃষকভাইয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন মাঠের কাজে। মাঠের কাজে সহায়তার জন্য আসুন সংক্ষেপে জেনে নিই পৌষ মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
 

বোরো ধান
* অতিরিক্ত ঠাণ্ডার সময় রাতে বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে এবং দিনে তুলে ফেলতে হবে। এতে চারার বৃদ্ধি ভালো হয়;
* আগাছা ও পাখির আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বীজ গজানোর ৪-৫ দিন পর বেডের ওপর ২-৩ সেমি. পানি রাখতে হবে;
* চারাগাছ হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এরপরও যদি চারা সবুজ না হয় তবে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম করে জিপসাম দিতে হবে;
* মূল জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে পানিসহ কাদা করতে হবে;
* জমিতে জৈবসার দিতে হবে এবং শেষ চাষের আগে দিতে হবে ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার;
* চারার বয়স ৩০-৪০ দিন হলে মূল জমিতে চারা রোপণ শুরু করতে পারেন;
* লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ২৫ সেন্টিমিটার এবং গোছা থেকে গোছার দূরত্ব ১৫ সেন্টিমিটার বজায় রেখে প্রতি গোছায় ২-৩টি সুস্থ চারা রোপণ করলে ফলন ভালো হয়;
* ধানের চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ৩০-৪০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি এবং ৫০-৫৫ দিন পর শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।

গম
* গমের জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ এবং প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে;
* চারার বয়স ১৭-২১ দিন হলে গমক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে হেক্টরপ্রতি ৩০-৩৫ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে এবং সেচ দিতে হবে;
* সেচ দেয়ার পর জমিতে জো আসলে মাটির ওপর চটা ভেঙে দিতে হবে;
* গমের জমিতে যেখানে ঘন চারা রয়েছে সেখানে কিছু চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে।

 

ভুট্টা
* ভুট্টা ক্ষেতের গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে;
* গোড়ার মাটির সঙ্গে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর সেচ প্রদান করতে হবে ;
* গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙে দিতে হবে;
* ভুট্টার সঙ্গে সাথী বা মিশ্র ফসলের চাষ করে থাকলে সেগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।

 

আলু
* চারা গাছের উচ্চতা ১০-১৫ সেন্টিমিটার হলে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
* দুই সারির মাঝে সার দিয়ে কোদালের সাহায্যে মাটি কুপিয়ে সারির মাঝের মাটি গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। ১০-১২ দিন পরপর এভাবে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে না দিলে গাছ হেলে পড়বে এবং ফলন কমে যাবে।
* আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে স্প্রেয়িং শিডিউল মেনে চলতে হবে। মড়ক রোগ দমনে দেরি না করে ২ গ্রাম ডায়থেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা ইন্ডোফিল প্রতি লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে ৭ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
* মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হবে।
* তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হবে।
* আলু গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির সমান করে গাছ কেটে দিতে হবে এবং ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে।
* আলু তোলার পর ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

তুলা
* তুলা সংগ্রহের কাজ শুরু করতে হবে। তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথমবার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয়বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে;
* রৌদ্রময় শুকনা দিনে বীজ তুলা উঠাতে হয়;
* ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ভালো তুলার সঙ্গে যেন খারাপ তুলা (পোকায় খাওয়া, রোগাক্রান্ত) কখনো না মেশে।


ডাল ও তেল ফসল
* মসুর, ছোলা, মটর, মাসকালাই, মুগ, তিসি পাকার সময় এখন;
* সরিষা, তিসি বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে;
* আর ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। এতে জমিতে উর্বরতা এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ বাড়বে।


শাকসবজি
* ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম, গাজর, শিম, লাউ, কুমড়া, মটরশুঁটি এসবের নিয়মিত যত্ন নিতে হবে।
* টমেটো ফসলের মারাত্মক পোকা হলো ফলছিদ্রকারী পোকা। এ পোকার আক্রমণে ফলের বৃন্তে একটি ক্ষুদ্র আংশিক বদ্ধ কালচে ছিদ্র দেখা যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত ফলের ভেতরে পোকার বিষ্ঠা ও পচন দেখা যাবে। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রতি বিঘা জমির জন্য ১৫টি ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। আধাভাঙ্গা নিম বীজের নির্যাস (৫০ গ্রাম এক লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে ১২ ঘণ্টা ভেজাতে হবে এবং পরে মিশ্রণটি ভালো করে ছাকতে হবে) ১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করে এই পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রমণ তীব্র হলে কুইনালফস গ্রুপের কীটনাশক (দেবিকইন ২৫ ইসি/কিনালাক্স ২৫ ইসি/করোলাক্স ২৫ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়।
* টমেটো সংগ্রহ করে বাসায় সংরক্ষণ করার জন্য আধা পাকা টমেটোসহ টমেটো গাছ তুলে ঘরের ঠাণ্ডা জায়গায় উপুড় করে ঝুলিয়ে টমেটোগুলোকে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। পরবর্তীতে ৪-৫ মাস পর্যন্ত অনায়াসে এ টমেটো ব্যবহার করা যাবে;
* শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদামাফিক নিয়মিত সেচ দিতে হবে;
* এ ছাড়া আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় মাটি তুলে দেওয়া, সারের উপরিপ্রয়োগ ও রোগবালাই প্রতিরোধ করা জরুরি।

 

গাছপালা
* গত বর্ষায় রোপণ করা ফল, ওষুধি বা কাঠ গাছের যত্ন নিতে হবে।
* গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
* প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে।
* রোগাক্রান্ত গাছের আক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করে দিতে হবে।
* গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে।

 

প্রাণিসম্পদ
* শীতকালে পোল্ট্রি তে যে সব সমস্যা দেখা যায় তা হলো-অপুষ্টি, রাণীক্ষেত, মাইকোপাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব। তাই প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে;
* মোরগ-মুরগীর অপুষ্টিজনিত সমস্যা সমাধানে ভিটামিন এ, সি, ডি, ই, কে ও ফলিক এসিড সরবরাহ করতে হবে। তবে সেটি অবশ্যই প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে, নাহলে অনেক সময় মাত্রা না জেনে ওষুধ বা ভিটামিন প্রয়োগে ক্ষতির আশংকা থাকে। এছাড়া খরচও বেড়ে যায়;
* শীতের তীব্রতা বেশি হলে পোল্ট্রি শেডে অবশ্যই মোটা চটের পর্দা লাগাতে হবে এবং বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে;
* উপকূলীয় অঞ্চলে অনেকেই হাঁস পালন করে থাকেন। এ সময় হাঁসের যেসব রোগ হয় সেগুলো হলো- হাঁসের প্লেগ রোগ, কলেরা রোগ এবং বটুলিজম। প্লেগ রোগ প্রতিরোধে ১৮-২১ দিন বয়সে প্রথম মাত্রা এবং প্রথম টিকা দেয়ার পর ৩৬-৪৩ দিন বয়সে দ্বিতীয় মাত্রা এবং পরবর্তী ৪-৫ মাস পরপর একবার ডাক প্লেগ টিকা দিতে হবে;
* গাভীর জন্য শীতকালে মোটা চটের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। নাহলে গাভীগুলো তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে যাবে;
* উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে সারা বছরের টিকা প্রদান এবং পরিচর্যা বিষয়ক পরিকল্পনা ও করণীয় কী সেসব বিষয়ে লিখিত পরামর্শ গ্রহণ করে তা মেনে চলতে হবে;
* গাভীকে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। গাভীর খাবার প্রদানে যেসব বিষয়ে নজর দিতে হবে তাহলো- সঠিক সময়ে খাদ্য প্রদান, গোসল করানো, থাকার স্থান পরিষ্কার করা, খাদ্য সরবরাহের আগে খাদ্য পাত্র পরিষ্কার করা এবং নিয়মিত প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া।
* গাভীর খাবারের খরচ কমাতে নিজেদের জমিতে ঘাস চাষাবাদ করতে হবে;
* শীতকালে ছাগলের নিউমোনিয়া রোগটি খুব বেশি হয়। যদি ৫ দিনের বেশি কাশি ও দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা হয় তবে বুঝতে হবে প্যারাসাইটের জন্য নিউমোনিয়া হয়েছে। নিউমোনিয়াতে সেফটিয়াক্সোন ও টাইলোসিন ব্যবহারে খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এছাড়াও পেনিসিলিন, অ্যামপিসিলিন, অ্যামোক্সিসিলিন, স্টেপটোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিন ব্যবহারেও ভালো সাড়া পাওয়া যায়।


মৎস্যসম্পদ
* শীতকালে মাছের বিশেষ যত্ন নেয়া দরকার। কারণ এ সময়ে পুকুরে পানি কমে যায়। পানি দূষিত হয়। মাছের রোগবালাইও বেড়ে যায়;
* শীতের সময় কার্প ও শিং জাতীয় মাছে ড্রপসি বা উদর ফোলা রোগ বেশি হয়। আর এ রোগটি বড় মাছে বেশি হয়। এ রোগ প্রতিরোধে মাছের ক্ষত রোগ যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ রোগের প্রতিকারে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন বা স্ট্রেপটোমাইসিন পরপর ৭ দিন খাওয়াতে হবে। সবচে ভালো হয় এ বিষয়ে আপনার কাছের উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ গ্রহণ করা।


সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি নিশ্চিত মৌসুম। যতবেশি যৌক্তিক বিনিয়োগ করতে পারবেন লাভও পাবেন তত বেশি। শুকনো মৌসুম বলে মাটিতে রস কম থাকে। তাই যদি প্রতি ফসলে চাহিদামাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে দেখবেন আপনার জমির ফলন কতখানি বাড়ে। একমাত্র কৃষির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক কৃষির সব কটি কৌশল যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারব। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
* তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
সম্পাদকীয় (অগ্রহায়ণ-১৪২২)

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। এ দেশের কৃষি ঋতুবৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ঋতু পরিক্রমায় অগ্রহায়ণ মাস হেমন্তকাল। এ মাসে একদিকে যেমন আমন ধান কাটার ধুম পড়ে যায় অন্যদিকে রবি ফসলের চাষাবাদের প্রস্তুতি চলে পুরোদমে। রবি মৌসুমে বোরোসহ হরেক রকমের শাকসবজি, তেলবীজ ফসল, ডাল জাতীয় ফসল, মসলা জাতীয় ফসল প্রভৃতির চাষাবাদ করা হয়ে থাকে। নাবি বন্যার কারণে রবি ফসলের চাষাবাদ পিছিয়ে যায়। এসব কারণে পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে যেসব ফসল চাষাবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যায় এবং সময়মতো ঘরে তোলা যায় এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ কথা সত্যি যে, দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা যেহেতু ক্রমবর্ধমান সেহেতু প্রতি বছর খাদ্যের চাহিদা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের খাদ্য ফসলের উৎপাদন সমানুপাতে বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হবে। আর একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শুধু দানাজাতীয় খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেই চলবে না, পুষ্টির দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এজন্য শাকসবজি, ফলমূল চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও গ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। আশার কথা, বিশ্বব্যাপী সি-উইড একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ, পুষ্টিগুণের বিচারে যা বিভিন্ন দেশে খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। চীন, জাপান ও কোরিয়ায় সনাতনভাবেই দৈনন্দিন খাদ্যে সি-উইড ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে এবং দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ইউরোপে এর ব্যবহার বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে সি-উইড ব্যবহার বিষয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসেছে বলে আমরা মনে করি। মানব খাদ্য হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও ডেইরি, ওষুধ, টেক্সটাইল ও কাগজ শিল্পে সি-উইড আগার কিংবা জেল জাতীয় দ্রব্য তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া, জমিতে সার, প্রাণী খাদ্য ও লবণ উৎপাদনেও সি-উইড ব্যবহার করা হয়। সি-উইডে প্রচুর পরিমাণে খনিজদ্রব্য বিদ্যমান থাকায় খাদ্যে অনুপুষ্টি হিসেবে এর ব্যবহার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আমরা আশা করি এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণে সচেষ্ট হবেন।

প্রিয় চাষিভাইয়েরা, অগ্রহায়ণ মাসে কৃষিকাজের ব্যাপকতা বেড়ে যায়, প্রয়োজন হয় কৃষি উপকরণ সংগ্রহ, কৃষি শ্রমিকের মজুরি, সেচ খরচ প্রভৃতি। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সময়মতো সম্পন্ন করে রাখলে সারা বছর সাচ্ছন্দে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সহজ হয়। আমরা চাই সুপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর ও মাঠের কর্মকা- সম্পন্ন করে নিজের জীবনমান ও কৃষির সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখুন, দেশকে আরও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যান।

বিস্তারিত