Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

বারি পাতা পেঁয়াজ-১ উৎপাদন কলাকৌশল

পাতা পেঁয়াজ (Allium fistulosum খ.) একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মসলাজাতীয় ফসল। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এটি খুবই জনপ্রিয় মসলা। দেশভেদে এর নামের বৈচিত্র্যতা রয়েছে। এটি Japanese bunching onion, Welsh onion, Yard onion, Stem onion, Stone onion, Salad onion, Ceboule ইত্যাদি নামেও পরিচিত। পাতা পেঁয়াজের উৎপত্তিস্থান এশিয়াতে (সাইবেরিয়া, চীন)। পাতা পেঁয়াজের প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলো হলো জাপান, তাইওয়ান, শ্রীলংকা, ভারত, কোরিয়া, চীন, ইউরোপ, আমেরিকা ও সাইবেরিয়া। গুরুত্বের বিবেচনায় জাপানে এ ফসলটি বাল্ব পেঁয়াজের পরে দ্বিতীয় স্থান দখল করে আছে। উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের বসতভিটায় ব্যাপকভাবে এ পেঁয়াজের চাষ করে থাকে। এ প্রজাতির গাছের মূলত দুইটি অংশ-সবুজ পাতা ও সাদা মোটা সিউডোস্টেম (Blanched pseudostem)। এ জাতীয় পেঁয়াজে সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের (Allium cepa খ.) মতো বাল্ব উৎপাদন হয় না। তবে সাদা সিউডোস্টেমের গোড়ায় বাল্বের মতো বৃদ্ধি (Bulb enlargement) পরিলক্ষিত হয়। এ প্রজাতির গাছ বহুবর্ষজীবী তবে একবর্ষ বা দ্বিবর্ষ হিসেবে চাষ করা হয়ে থাকে। বীজ বা কুশির মাধ্যমে পাতা পেঁয়াজের বংশবিস্তার হয়ে থাকে। এ ফসলটির কুশি উৎপাদনের প্রবণতা খুবই বেশি। এ প্রজাতিটি পার্পল ব্লচসহ বিভিন্ন রোগ সহিষ্ণু/প্রতিরোধী (Tolerant/Resistant)। তাই পাতা পেঁয়াজ সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের সঙ্গে সঙ্কর করে রোগমুক্ত উন্নত জাত উদ্ভাবন করা যায়। এর পাতা ও ফুলের দণ্ড (Scape) ফাঁপা। এর স্বাদ ও গন্ধ প্রায় সাধারণ পেঁয়াজের মতো। এ প্রজাতির পেঁয়াজে এলাইল সালফাইড নামক উদ্বায়ী পদার্থের কারণেই গন্ধের সৃষ্টি হয়। এ মসলাটি রন্ধনশালায় (Culinary) ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর মূল বা হলুদ পাতা ছাড়া ফুলের দ-সহ সব অংশই বিভিন্ন খাদ্যদ্রবকে রুচিকর ও সুগন্ধপূর্ণ করার মাধ্যমে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য খাওয়া হয়। ইহা সালাদ হিসেবে কাঁচা অথবা বিভিন্ন তরকারি/অন্যান্য খাবারের সঙ্গে সিদ্ধ করে খাওয়া হয়ে থাকে। সাধারণত মোটা সাদা সিউডোস্টেম  গোশত বা অন্যান্য তরকারিতে এবং সবুজ পাতা সালাদ হিসেবে অথবা সুপ, নুডুলস, স্যান্ডউইজ ইত্যাদি খাবারকে সুগন্ধ করার জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। ইহার যথেষ্ট পুষ্টিগুণ রয়েছে। পাতা পেঁয়াজের প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য অংশে আর্দ্রতা ৭৮.৯%, আমিষ ১.৮%, চর্বি ০.১%, খনিজ পদার্থ ০.৭%, শর্করা ১৭.২%, ক্যালসিয়াম ০.০৫%, ফসফরাস ০.০৭%, লোহা ২.৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-এ ৩০ আই ইউ, ভিটামিন-বি১ ০.২৩ মি.গ্রাম, ভিটামিন-সি ১১ মি.গ্রাম ও এ্যানার্জি ৩৪ কিলোক্যালরি আছে। সাদা সিউডোস্টেমের তুলনায় সবুজ পাতায় পুষ্টিগুণ বেশি থাকে। এর অনেক ঔষধি গুণাবলিও রয়েছে। তা পারিপাক ক্রিয়ায় সহায়তা করে এবং চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে। মাথাব্যথা, ক্ষতের ব্যথা ও ঠাণ্ডাজনিত রোগ থেকে উপশমে সহায়তা করে। হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এ পেঁয়াজ খেলে রোগ থেকে উপশম পেয়ে থাকেন। সৌন্দর্যবর্ধক হিসেবে গোছা (Clump) আকারে পাতা পেঁয়াজের যথেষ্ট আকর্ষণ রয়েছে। বিদেশি জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশে চাষ উপযোগী ‘বারি পাতা পেঁয়াজ-১’ নামক একটি উন্নত জাত ২০১৪ সনে মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, বগুড়া কর্তৃক কৃষকপর্যায়ে চাষাবাদের জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ দেশে বাল্ব পেঁয়াজের যথেষ্ট ঘাটতি থাকার কারণে পেঁয়াজের সারাবছর চাহিদা মিটানোর লক্ষ্যে বসতভিটাসহ মাঠপর্যায়ে সারা বছর (Year-round) চাষ করা সম্ভব। আশা করা হচ্ছে এ জাতের পাতা পেঁয়াজ চাষের মাধ্যমে একদিকে সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের পরিবর্তেও এটি ব্যবহার করা যাবে এবং অন্যদিকে সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের সঙ্গে সংকরায়নের মাধ্যমেও রোগমুক্ত উন্নত হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে। নিচে এ জাতের পেঁয়াজের উৎপাদন কলাকৌশল বর্ণনা করা হলো।


মাটি ও আবহাওয়া
পাতা পেঁয়াজ সব ধরনের মাটিতে জন্মে থাকে তবে বেলে-দো-আঁশ ও পলি-দো-আঁশ মাটিতে ভালো ফলন দিয়ে থাকে। তবে উচ্চ এসিড ও ক্ষার মাটিতে ভালো জন্মে না। গাছ সুন্দরভাবে বৃদ্ধির জন্য মাটির pH ৫.৮-৬.৫ থাকা ভালো। প্রচুর পরিমাণে জৈবপদার্থ সমৃদ্ধ মাটিই উত্তম। জমিতে জলাবদ্ধতা থাকলে এর মূল মারা যায়। তাই পাতা পেঁয়াজের জমিতে সুনিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। ইহা ঠাণ্ডা ও গরম উভয় তাপমাত্রায় জন্মাতে পারে। এর বীজ অংকুররোদগম এবং গাছের বৃদ্ধির জন্য ১৫-২৫ক্ক সে. তাপমাত্রা উত্তম। অন্যান্য Allium spp. প্রজাতির তুলনায় এ প্রজাতির পেঁয়াজের গাছ ভারি বৃষ্টির প্রতি অনেক সহিঞ্চু। জমিতে প্রতিষ্ঠিত পাতা পেঁয়াজের গাছ খরার প্রতিও সহিঞ্চু। দিবা দৈর্ঘ্য বেশি হলেও এ পেঁয়াজের গাছের বৃদ্ধি হতে থাকে অর্থাৎ আমাদের দেশে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালেও এ পেঁয়াজের চাষ করা যায়। এ প্রজাতির পেঁয়াজে নিম্ন তাপমাত্রা ও ছোট দিনে ফুল আসে।

জাত
বারি পাতা পেঁয়াজ-১ জাতের বৈশিষ্ট্য হলো : প্রথম বছর গাছের উচ্চতা ৪০-৫০ সেমি. প্রতি গোছায় গড়ে কুশির সংখ্যা ৪-৫টি, প্রতি কৃশির গাছে পাতার সংখ্যা ৬-৮টি, বাল্বের মতবৃদ্ধি অংশের উচ্চতা ১.৫০-২.০০ সেমি. ও ব্যাস ১.০০-১.৫০ সেমি., সাদা সিউডোস্টেমের (Blancbed pseudastem) দৈর্ঘ্য ৬-৭ সেমি., ফুলদণ্ডের উচ্চতা ৫০-৫৫ সেমি., আম্বেলের ব্যাস ৩.৫০-৫.০০ সেমি. পাতার শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ ৯.৫০-১১.০০%, পাতার ফলন ৭৫০০-৮৫০০ কেজি/হেক্টর, বীজরে ফলন ৭০০-৯০০ কেজি/হেক্টর, প্রতি ১০০০টি বীজের ওজন গড়ে ২.২৫-২.৭৫ গ্রাম এবং বীজের অংকুরোদম ক্ষমতা গড়ে শতকরা ৮০-৯০ ভাগ। বহুবর্ষজীবী হিসেবে চাষ করলে প্রতি গোছায় কুশির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।

বীজ বপন ও চারা উত্তোলন
মে-জুন বা অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন করা হয়। সারি পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি হেক্টর জমির জন্য ৪-৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বপন করলে হেক্টরপ্রতি ৮-১০ কেজি বীজের দরকার হয়। বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে পরে ১২ ঘণ্টা শুকনা পাতলা কাপড়ে বেঁধে রেখে দিলে বীজের অংকুর বাইরে হয়। বীজতলায় পচা গোবর সার দিয়ে ঝুরঝুরে করে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন ধরনের পোকা ও ক্রিমি দমনের জন্য বীজতলায় ফুরাডান ব্যবহার করাই ভালো। পরে বীজতলায় বীজ সুষমভাবে ছিটিয়ে দিয়ে আর ওপর ০.৪-০.৫ সেমি. ঝুরঝুরে মাটি প্রয়োগ করে কলাগাছ/হাত দিয়ে বীজতলা চাপ দিতে হয়। বীজতলায় আগাছা নিড়ানোসহ অন্যান্য পরিচর্যা করা হয়। চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে মূল জমিতে লাগোনো উপযোগী হয়। চারা উত্তোলনের পর চারার ওপর থেকে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছেঁটে ফেলে দিয়ে চারা লাগাতে হয়। এর ফলে লাগানোর পরে চারা থেকে কম পরিমাণে পানি বের হয়ে (Transpiration) চারা জমিতে ভালোভাবে লেগে উঠে।

জমি তৈরি ও চারা রোপণ
মূল জমিতে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। চাষের আগে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পচা গোবর সার দিতে হয়। এ প্রজাতির  পেঁয়াজে কুঁশি উৎপাদনের প্রবনতা বেশি থাকায় সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের তুলনায় রোপণ দূরত্ব বেশি দিতে হয়। এর চারা বা কুশি ২০ সেমি.x১৫ সেমি. অথবা ২০ সেমি.x২০ সেমি. দূরত্ব বজায় রেখে রোপণ করা হয়। চারা একটু গভীরে লাগানো ভালো।

সার প্রয়োগ
পাতা সংগ্রহের কারণে পাতা পেঁয়াজে বেশি সারের প্রয়োজন হয়। জমির উর্বরতার ওপর ভিত্তি করে সারের পরিমাণ নিরূপণ করতে হয়। এ জাতের পেঁয়াজ চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ নিম্নরূপ-
সারের নাম    পরিমাণ (কেজি/হেক্টর)
পচা গোবর    ৫০০০-১০০০০
ইউরিয়া    ২৫০-৩০০
টিএসপি    ২৫০-৩০০
এমওপি    ২০০-২৫০
জিপসাম    ১০০-১২০

জমি চাষের আগে সম্পূর্ণ পচা গোবর সার এবং শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া সার সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া সার সমান দুইভাগ করে চারা রোপণের ৩০ ও ৬০ দিন পর উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর প্রয়োজন হলে পানি সেচ দিতে হবে। তবে প্রতিবার পাতা সংগ্রহের পর ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা ভালো।

আগাছা নিড়ানো ও পানি সেচ
আগাছা দেখা দিলে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং মাঝে মাঝে গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে। আগাছা নিড়ানো ও গোড়ায় মাটি দেয়া ৪-৫ বার প্রয়োজন হতে পারে। সার প্রয়োগের পরপর বা অন্য কোনো সময় পানি দরকার হলে জমিতে সেচ দিতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে পানি সেচ বেশি দিতে হয়। জমিতে অতিরিক্ত পানি জমতে দেয়া যাবে না। প্রয়োজনে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

রোগবালাই দমন
পাতা পেঁয়াজ পার্পল বচ ও অন্যান্য ব্লাইট রোগের প্রতি সহিষ্ণু/প্রতিরোধী। তাই রোগ হয় না বললেই চলে। তবে কোনো রোগ দেখা দিলে রিডোমিল গোল্ড/ডায়থেন এম-৪৫/রোভরাল এর যে কোনো একটি বা একাধিক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ২-৩ বার ১৫ দিন পরপর স্প্রে করা যেতে পারে। থ্রিপস ও কাটুই পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। এসব পোকা দমনের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে। থ্রিপস দমনের জন্য এডমায়ার বা টিডো (১ মিলি/লিটার) ১৫ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। তাছাড়া রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য আগাছা পরিষ্কার, আবর্জনা আগুনে পোড়া, শস্যাবর্তন ইত্যাদি সমন্বিত ব্যবস্থ্যা করা উত্তম।

ফসল সংগ্রহ ও ফলন
পাতা পেঁয়াজ সংগ্রহকালীন সময় এর মাটির ওপরের সম্পূর্ণ অংশ সবুজ ও সতেজ থাকতে হবে। চারা রোপণের দুই মাস পরেই প্রথমে পাতা সংগ্রহ করা যায়। মে-জুন মাসে বীজ বপন করলে নভেম্বর পর্যন্ত গাছ থেকে গড়ে ২-৩ বার পাতা খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করা যায়। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বীজ বপন করলে সেখান থেকে পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। কারণ ডিসেম্বর থেকে ফুল আসা শুরু হয়। প্রথম সংগ্রহের ২০-২৫ দিন পরপর পাতা সংগ্রহ করা যায়। সাদা সিউডোস্টেমসহ গাছের সব অংশ খাওয়ার জন্য হাত দিয়ে সম্পূর্ণ গাছটি টেনে তুলতে হয়। গাছটি তুলে মূল এবং হলুদ পাতা কেটে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। পাতা পেঁয়াজ সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গেই বাজারজাত করা উচিত। ছোট ছোট আঁটি বেধে বাজারে বিক্রয় করা যায়। হেক্টরপ্রতি পাতার ফলন ৭.৫০-৮.৫০ টন কিন্তু সবুজ পাতা ও সাদা সিউডোস্টেমের একত্রে ফলন হেক্টরপ্রতি ১২-১৫ টন।

বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ
মে থেকে নভেম্বর মাসের যখনই বীজ বপন করা হউক না কেন মূল জমিতে রোপণের পর ডিসেম্বর মাসে পাতা পেঁয়াজের ফুল আসা শুরু হয়। তবে বীজতলায় ঘন আকারে চারা থাকলে সিউডোস্টেম ও পাতার উপযুক্ত বৃদ্ধির অভাবে সহজে গাছে ফুল আসে না। ফুল আসার সময় হেক্টরপ্রতি অতিরিক্ত ১০০ কেজি করে ইউরিয়া এবং পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। ইহা পরপরাগায়িত ফসল। তাই জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য একটি জাতের মাঠ থেকে অন্য জাতের মাঠের দূরত্ব কমপক্ষে ১০০০ মিটার বজায় রাখতে হবে। সকল আম্বেলের বীজ একসঙ্গে পরিপক্ব হয় না। তাই কয়েক দিন পরপর পরিপক্ক আম্বেল সংগ্রহ করা হয়। একটি আম্বেলের মধ্যে শতকরা ১০-১৫টি ফল ফেটে কালো বীজ দেখা গেলে আম্বেলটি কেটে বা ভেঙ্গে সংগ্রহ করতে হবে। এভাবে মাঠে ঘুরে ঘুরে আম্বেল সংগ্রহ করতে হবে। মাঠের সব আম্বেল সংগ্রহ করতে ৪-৫ দিন সময় লাগতে পারে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সামান্য দেরিতে বীজ সংগ্রহ করলে আম্বেল থেকে সব বীজ ঝরে মাটিতে পড়ে যায়। পাতা পেঁয়াজের বীজ সাধারণত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিল মাসে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। তবে এর পরেও কিছু বীজ সংগ্রহ করা যেতে পারে। বীজ আম্বেল সংগ্রহ করার পর রোদে শুকিয়ে হালকা লাঠি দ্বারা পিটিয়ে বীজ বের করা হয়। পরে বীজ রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে ছিদ্রবিহীন পলিথিন বা টিনের পাত্রে সংরক্ষণ করা উত্তম। হেক্টরপ্রতি ৭০০-৯০০ কেজি বীজ উৎপাদন হয়ে থাকে।
 

 

মো. আলাউদ্দিন খান*
মো. মোস্তাক আহমেদ**


* উধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, লালমনিরহাট, ** বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, লালমনিরহাট

বিস্তারিত
বাংলাদেশে তুলা চাষ সম্প্রসারণে চীনা প্রযুক্তির ব্যবহার
বস্ত্রশিল্প দেশের বেকার জনশক্তির কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে আসছে এবং বস্ত্র শিল্পে বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ (রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকসহ) শ্রমশক্তি নিয়োজিত রয়েছে। অর্থনৈতিক মূল্য সংযোজনের ক্ষেত্রে বস্ত্রশিল্প মোট শিল্প আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং জাতীয় আয়ের ১০ শতাংশ অবদান রেখে আসছে। বস্ত্র ও তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে ১৯৯৫-৯৬ সালে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ ছিল ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৩-১৪ সালে ২৫.৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাঁড়িয়েছে; যা রপ্তানি খাতে দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ। এ বস্ত্রশিল্পের মূল কাঁচামাল তুলা। প্রতি বছর প্রায় ৪০-৪২ লাখ বেল কাঁচাতুলার প্রয়োজন হয়- যার মূল্য আনুমানিক ১২,০০০ কোটি টাকা। দেশীয় উৎপাদন মাত্র ১,৫০,০০০ বেল যা জাতীয় চাহিদার ২-৩% মাত্র। বাংলাদেশে তুলা চাষের উপযোগী জমির পরিমাণ প্রায় ২.৫ লাখ হেক্টর। এ উপযোগী জমিতে উন্নত প্রযুক্তির প্রসার ঘটিয়ে জাতীয় চাহিদার ৩০% মেটানো সম্ভব। তুলা উন্নয়ন বোর্ড তুলা চাষ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব পালন করে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪টি রিজিয়ন, ১৩টি জোন, ১৮০টি ইউনিট ইউনিট অফিসের মাধ্যমে ৩৩টি সমতল জেলা এবং ৩টি পাহাড়ি জেলায় তুলা চাষ সম্প্রসারণের কাজ পরিচালিত হচ্ছে। তাছাড়া ৫টি গবেষণা খামারে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও গবেষণা কার্যক্রম চলছে। বর্তমান সরকার বাংলাদেশে তুলা চাষ সম্প্রসারণ ও গবেষণার কথা বিবেচনা করে ৩টি কর্মসূচি ও ১টি প্রকল্প তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে। তাছাড়া অতি সম্প্রতি ১৯/০৮/২০১৪ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১০৫ কোটি টাকার ‘সম্প্রসারিত তুলা চাষ, ফেজ-১’ শীর্ষক একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছেন যার মাধ্যমে ৪৬টি জেলায় ১ লাখ হেক্টর জমি তুলা চাষের আওতায় আনা হবে। তাছাড়া বর্তমান সরকারের সময়ে তুলা চাষের এলাকা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নে ২০০৮-২০০৯ মৌসুম হতে ২০১৪-১৫ মৌসুমের তুলা চাষের অগ্রগতি দেখানো হলো (দ্বিতীয় পৃষ্ঠায়)।
 
তুলা চাষে বাংলাদেশে সম্ভাবনার মূল কারণ এর সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে এর বাজারজাতকরণ হয় সমগ্র বাংলাদেশে। তাছাড়া তুলার রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার-তুলা বীজ থেকে আঁশ ছাড়াও তৈল, খৈল ও জ্বালানি পাওয়া যায়। তুলা একটি গভীরমূলী ফসল হওয়ায় মাটির উর্বরতা রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মতো গবেষণা অংশটি ততটা শক্তিশালী নয়-তবে NARS এর আওতায় ২০১২ সনে আসার পর থেকে গবেষণা অংশ শক্তিশালী হতে চলেছে। এ পর্যন্ত গবেষণার মাধ্যমে ১৪টি সমতল ভূমির এবং ২টি পাহাড়ি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যার মধ্যে সিবি-১২, সিবি-১৩, সিবি-১৪ এবং এইচসি-২ ব্যপক সমাদৃত। তাছাড়া বেসরকারি বীজ কোম্পানির মাধ্যমে তুলা উন্নয়ন বোর্ড হাইব্রিড জাতের তুলা বীজ চাষি পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে এবং তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব উদ্যোগে হাইব্রিড জাত উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাছাড়া বর্তমান সরকার অচিরেই ‘বিটি তুলা’ চাষি পর্যায়ে সম্প্রসারণের এর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এত সম্ভাবনার মাঝে সীমাবদ্ধতা কিছু রয়েছে তুলা চাষ সম্প্রসারণ ও গবেষণায়। বিশেষ করে স্বল্পমেয়াদি জাত, অঙ্গজ শাখাবিহীন তুলার গাছ, উচ্চফলনশীল হাইব্রিড বিটি জনবল এবং জমির স্বল্পতা। বর্তমান তুলা উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থান এক নম্বরে। চীন উৎপাদনকারী, আমদানিকারক এবং ব্যবহারকারী এ তিনটি বিষয়ে তাদের অবস্থান এক নম্বরে।
 
ক্রম উৎপাদন মৌসুম তুলার প্রকার তুলা চাষ (হেক্টর) আঁশতুলার উৎপাদন (বেল)
১. ২০০৮-০৯ সমভূমির তুলা ১৮৩২০ ৪৪৩৬৫
পাহাড়ি তুলা ১৪২৮০ ৫৮১০
মোট ৩২৬০০ ৫০১৭৫
২. ২০০৯-১০ সমভূমির তুলা       ১৭০৪০ ৬৪০০০
পাহাড়ি তুলা        ১৪৪৬০ ৬০০০
মোট        ৩১৫০০ ৭০০০০
৩. ২০১০-১১           সমভূমির তুলা ১৮২৩০ ৭৩৫০০
পাহাড়ি তুলা        ১৫২৭০ ৬৫০০
মোট       ৩৩৫০০ ৮০০০০
৪. ২০১১-১২            সমভূমির তুলা ২০০২৫ ৯৬৬২৪
পাহাড়ি তুলা       ১৫৬৫০ ৬৮০০
মোট        ৩৫৬৭৫ ১০৩৪২৪
৫. ২০১২-১৩        সমভূমির তুলা ২৪০০০    ১২১৩৬০
পাহাড়ি তুলা       ১৫৭৫৬  ৭৬৪০
মোট        ৩৯৭৫৬ ১২৯০০০
৬. ২০১৩-১৪           সমভূমির তুলা ২৪৮৫৫ ১৩৬৫৬৯
পাহাড়ি তুলা       ১৬৬৪৩ ৮০৪৭
 মোট       ৪১৪৯৮  ১৪৪৬১৬
৭. ২০১৪-১৫        সমভূমির তুলা  ৩৪৫০০  ১৮৮৮০০
পাহাড়ি তুলা        ১৭৫০০ ১৬২০০
মোট       ৫২০০০ ২০৫০০০
  
তুলা গবেষণায় চীনের রয়েছে অসামান্য সাফল্য। তাদের উৎপাদিত হাইব্রিড জাতের বিটি তুলা বালাই প্রতিরোধী জাত চাষ হচ্ছে সর্বত্র। তাদের রয়েছে অঙ্গজ ও শাখাবিহীন গাছ, ৯৫ দিনের স্বল্পমেয়াদি জাত, খরা ও লবণাক্তসহিষ্ণু বিটি তুলার জাত যা অবমুক্তির অপেক্ষায়। তাছাড়া যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করার জন্য করেছে O type অর্থাৎ শাখাবিহীন তুলার গাছ। তাছাড়া তাদের একর প্রতি ফলন অনেক বেশি ৫-৮ টন এবং সার ব্যবস্থাপনায় তাদের রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। সবমিলিয়ে আমরা যদি চীনের গবেষণা থেকে সরকারের মাধ্যমে  সহযোগিতা আনয়ন করতে পারি তবে আমাদের দেশে তুলা চাষের ঘটবে একটি বিপ্লব এবং দেশীয় অর্থনীতির ভীত হবে অত্যন্ত মজবুত।

ড. মো. তাসদিকুর রহমান*
* উপপরিচালক (সদর দপ্তর), তুলা উন্নয়ন বোর্ড, খামারবাড়ি, ঢাকা
বিস্তারিত
বাংলাদেশে তুলা উৎপাদন ও এর সম্ভাবনা
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। সভ্যতার দিক থেকে বিবেচনায় বস্ত্রই হচ্ছে আমাদের প্রথম মৌলিক চাহিদা। এই বস্ত্র শিল্পের মূল ও প্রধান উপাদান তুলা। এক সময় বাংলাদেশের মসলিন ছিল বিশ্ব বিখ্যাত। এই মসলিনের তুলা এ দেশেই উৎপাদিত হতো। ব্রিটিশ শাসনামলে সেই তুলা ও মসলিন কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। বর্তমানে আবার বস্ত্র এবং গার্মেন্ট খাত বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। বাংলাদেশে বস্ত্র খাতের ৩৮৩টি সুতা কলের জন্য বছরে প্রায় ৪০ লাখ বেল আঁশ তুলার প্রয়োজন হয়, যার সিংহভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করে মেটানো হচ্ছে এবং এই চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিমাণ তুলা আমদানি করতে প্রতি বছর প্রায় ১২০০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে ৪০-৫০ ভাগ তুলা আমাদের দেশে উৎপাদন করা সম্ভব।

বিশ্বে তুলা উৎপাদন ও ব্যবহার
ইএসডিএ এর হিসাব মতে, ২০১৩/১৪ মৌসুমে বিশ্বে ৩৩.১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে তুলার আবাদ করে ১১৭.১ মিলিয়ন বেল তুলা উৎপাদন করে এবং গড় উৎপাদনের পরিমাণ ৭৬৬ কেজি/হে.। চীন পৃথিবীর বৃহত্তম তুলা উৎপাদনকারী দেশ। ২০১৩/১৪ মৌসুমে চীন ৫.১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে তুলার আবাদ করে এবং ৩২ মিলিয়ন বেল তুলা উৎপাদন করে। দ্বিতীয় পৃথিবীর বৃহত্তম তুলা উৎপাদনকারী দেশ ভারত ২০১৩/১৪ মৌসুমে ১১.৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে তুলার আবাদ করে এবং ২৯ মিলিয়ন বেল তুলা উৎপাদন করে।

বাংলাদেশে তুলা উৎপাদন
বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং জলবায়ু তুলা চাষের জন্য উপযোগী এবং ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড়ের জন্য প্রয়োজনীয় তুলা এ দেশেই আবাদ হতো বলে কথিত আছে। ১৯৭৩-৭৪ সনে বাংলাদেশে সমভূমির তুলাচাষ শুরু হওয়ার পর থেকে তুলা চাষ এলাকা ও উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিককালে হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল জাতের তুলাচাষ প্রবর্তনের ফলে তুলার ফলন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে তুলার বাজার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষিদের তুলা এখন একটি লাভজনক ফসল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বর্তমানে তুলা উন্নয়ন বোর্ড তুলা গবেষণা, এর সম্প্রসারণ, বীজ উৎপাদন ও বিতরণ, প্রশিক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও জিনিং এবং ঋণ বিতরণ প্রভৃতি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। বর্তমানে তুলা বাংলাদেশের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল এবং বস্ত্র শিল্পের প্রধান কাঁচামাল। বর্তমানে সমতল এলাকার ৩৪টি জেলায় সমভূমির জাতের তুলার আবাদ হচ্ছে এবং অতি সম্প্রতি ৩টি পার্বত্য জেলাতেও পাহাড়ি জাতের পাশাপাশি সমভূমির জাতের তুলার চাষাবাদ হচ্ছে।

তুলা উন্নয়ন বোর্ড অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে চাষিদের সঙ্গে নিয়ে তুলা উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং দিন দিন এর সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে চলেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যত অর্থকরী ফসল রয়েছে লাভের দিক দিয়ে তুলা অন্যতম। বিঘা প্রতি নিট লাভ ১৮,০০০-২০,০০০ টাকা এবং বিক্রির নিশ্চয়তা শতভাগ। ২০১৩/১৪ মৌসুমে প্রায় ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করে দেড় লাখ বেল আঁশ তুলা উৎপাদিত হয়। যা চাহিদার তিন ভাগেরও কম। সমভূমি জাতের তুলার আঁশ মাঝারি লম্বা এবং মসৃণ ধরনের। বাংলাদেশে উৎপাদিত তুলার গুণগত মান উজবেকিস্তান, ভারত ও পাকিস্তানের তুলার সমকক্ষ, যা স্থানীয় সুতা ও কাপড়ের কলে ব্যবহার হচ্ছে। অপরপক্ষে পাহাড়ি তুলার আঁশ মোটা, খাটো ও খস্খসে ধরনের। এ তুলা উপজাতীয়রা নিজস্ব তাঁতে ব্যবহার্য পোশাক তৈরিতে ব্যবহার করছে এবং কম্বল, পশমী কাপড় ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকায়, বরেন্দ্র এলাকায়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় ও চরাঞ্চলে তুলাচাষ উপযোগী ২.৪২ লাখ হে. জমি রয়েছে, যা তুলাচাষের আওতায় এনে সফলভাবে তুলাচাষ করা হলে স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৩০ ভাগ পূরণ করা সম্ভব হবে। এর ফলে দেশে তুলার আঁশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ভোজ্যতেলের কিয়দাংশ পূরণ হবে এবং গবাদিপশু ও মাছের খাদ্য হিসেবে খৈলের জোগান হবে। এতে তুলাভিত্তিক শিল্পের প্রসার ঘটবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ দেশে অর্থনৈতিক কর্মকা- জোরদার হবে।

জমি নির্বাচন ও তুলাচাষ
তুলাচাষের জন্য উপযুক্ত হচ্ছে উঁচু জমি যেখানে বন্যা বা বৃষ্টির পানি জমে থাকে না। উত্তম সুনিষ্কাশিত মাটি তুলাচাষের উপযোগী। তুলাচাষের জন্য উৎকৃষ্ট হচ্ছে- বেলে দো-আঁশ ও দো-আঁশ প্রকৃতির মাটি। এ ছাড়াও, এটেল দো-আঁশ ও পলিযুক্ত এটেল দো-আঁশ মাটিতে তুলাচাষ করা যায়। মাটির জো অবস্থা বুঝে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল ও ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। সারি থেকে সারি ৯০ সেমি. (৩ ফুট বা ২ হাত) এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪৫সেমি. (১.৫ ফুট বা ১ হাত) বজায় রেখে বীজ বপন করতে হয়। সারি বরাবর মাটি উঁচু করে ( ridge & furrow পদ্ধতি) তার ওপর বীজ বপন করা উত্তম।

তুলার জাত
তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক উদ্ভাবিত সিবি-১২, সিবি-১৩ ও সিবি-১৪ জাতের তুলাবীজ সারা দেশে চাষ করা হয়। এ ছাড়া বেসরকারি বীজ কোম্পানি কর্তৃক আমদানিকৃত হাইব্রিড বীজ (রূপালি-১, সৌরভ, ডিএম-২ প্রভৃতি) বর্তমানে বাংলাদেশে চাষ হচ্ছে। জাত ভেদে তুলার বীজ ১ আষাঢ় থেকে ১৫ শ্রাবণ পর্যন্ত (১৫ জুন থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত) বপনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তবে ৩০ শ্রাবণ অর্থাৎ ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বীজ বপন করা যেতে পারে। হাইব্রিড জাত আগাম বপন করা উত্তম। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব জাতের ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি ১.৫০ কেজি এবং হাইব্রিডের ক্ষেত্রে ৫০০-৬০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ বপনের আগে তুলাবীজ ৩-৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে শুকনো মাটি বা ছাই দিয়ে ঘষে নেয়া উত্তম।

সার ব্যবস্থাপনা
ভালো ফলন পেতে হলে তুলা ক্ষেতে উপযুক্ত সার সঠিক পরিমাণ ও নিয়মমাফিক ব্যবহার করতে হয়। মাটিতে জৈব ও রাসায়নিক উভয় প্রকার সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন । জৈবসার ব্যবহারে মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি পায়। ফলে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে, অনুজীবের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং অনুখাদ্যের পরিমাণ বাড়ে।
বিঘাপ্রতি ইউরিয়া সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ সময় তুলার জাত, প্রয়োগ পদ্ধতি, মাটির উর্বরতা শক্তি এবং উক্ত সময়ের আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে নিরূপণ করতে হবে। গাছের ৪০ দিন এবং ৬০ দিন বয়সে টিএসপি সারের পরিবর্তে ডিএপি সার পার্শ্ব প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে ইউরিয়া সার বিঘাপ্রতি ৫-৬ (১৮%) কেজি কম ব্যবহার করতে হবে।

সার প্রয়োগ পদ্ধতি
বেসাল সার বীজ বপনের জন্য তৈরি নালায় অথবা পৃথক নালা কেটে প্রয়োগ করতে হবে। পার্শ্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে সারি থেকে ৫-৬ সেমি. দূরে নালা কেটে সার প্রয়োগ করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। একবার সারির যে দিকে পার্শ্ব প্রয়োগ করা হবে পরে তার বিপরীত দিকে পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে। বেসাল সার প্রয়োগ কোনো কারণে সম্ভব না হলে তা চূড়ান্ত চারা পাতলাকরণের পর পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখ্য, তুলা ফসলে ফুল ধারণপর্যায় অধিক হারে খাদ্য গ্রহণ শুরু করে যা বোল ধারণ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

ফলিয়ার স্প্রে
গাছের বয়স ৫০-৬০ দিনের পর থেকে ১০০ দিন পর্যন্ত ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর ৩ থেকে ৪ বার মাত্রানুযায়ী ফলিয়ার স্প্রে করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে ইউরিয়া অথবা ডিএপি সার ২% হারে (প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া অথবা ডিএপি সার), এমওপি সার ১% হারে (প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম এমওপি সার), এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যেমন বোরণ, জিংক সালফেট ০.১০- ০.১৫ % হারে (প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০-১৫ গ্রাম সার) পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে গাছের পাতায় স্প্রে করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়।

কম্পোস্ট/গোবর সার প্রয়োগ

হেক্টরপ্রতি ১২.৫ টন কম্পোস্ট সার, ২.৫ টন ভার্মি কম্পোস্ট/পোল্ট্রির বিষ্ঠা অথবা প্রাপ্তি সাপেক্ষে ৫-৬ টন পচা গোবর সার জমিতে ছিঢিয়ে চাষ দিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। তুলার ফলন বৃদ্ধি ও মান উন্নয়নের জন্য জৈবসার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। কুইক কম্পোস্ট/ভার্মি কম্পোষ্ট তৈরির পদ্ধতি অনুসরণ করে সহজেই কম্পোস্ট সার তৈরি করা যায়।

সবুজ সার প্রয়োগ
ধৈঞ্চা ও শন-পাট সবুজ সারের জন্য উপযুক্ত। তুলার জমিতে জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম সপ্তাহে ৫০ কেজি/হেক্টর সবুজ সারের বীজ বুনতে হয় এবং ৪৫-৫০ দিন পরে জমিতে চাষ দিয়ে সবুজ অবস্থায় ধৈঞ্চা বা শন-পাটের গাছ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়। গাছগুলো মাটিতে পচে মিশে যাওয়ার পর তুলাবীজ বপন করতে হয়।

হরমোন স্প্রে
গাছের ফুল, কুঁড়ি ও বোল সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ৫০-৬০ দিন বয়সের পর থেকে ৭-১০ দিন পর পর ৩-৪ বার হরমোন যেমন- প্লানোফিক্র/ফ্লোরা ইতাদি গাছের পাতায় প্রয়োগ করা হলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। গাছের পাতা সবুজ রাখার জন্য সালফার সার প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

তুলার ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
আমাদের দেশে ক্ষতিকারক পোকার মধ্যে জ্যাসিড, জাবপোকা, স্পটেড বোলওয়ার্ম, আমেরিকান বোলওয়ার্ম ও সাদা মাছির নামই সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। এই পোকা দ্বারা তুলা ফসল আক্রান্ত হলে এবং সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ফসলের মারাত্মক ক্ষতিসাধিত হয় এবং তুলার ফলন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। বর্তমান বিশ্বে সমন্বিত/ফসল ব্যবস্থাপনার (ICM) মাধ্যমে ফসলকে পোকা-মাকড়ের ব্যাপক আক্রমণ থেকে রক্ষা করা হচ্ছে। সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা বলতে পোকামাকড় দমনের একের অধিক পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের আক্রমণকে প্রতিহত করে ফসলকে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়।

ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
বপনের পর জাতভেদে ১১০-১২০ দিনের মধ্যে তুলার বোল ফাটতে শুরু করে। ৩-৪ বারে সব তুলা সংগ্রহ করতে ৪০-৫০ দিন দরকার হয়। তুলার বোল সম্পূর্ণরূপে ফাটার পর ও ৭-১০ দিন গাছেই শুকানো উচিত। এতে আঁশ ও বীজের মান উন্নত হয়।

আয় ব্যয়ের হিসাব
তেত্রিশ শতকের এক বিঘা তুলা চাষ করলে পঁচিশ হাজার থেকে ত্রিশ হাজার টাকা আয় হয় এবং সব মিলিয়ে সাত হাজার থেকে আট হাজার টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ তেত্রিশ শতকের এক বিঘা তুলা চাষ করলে ছয় মাসে আঠারো হাজার থেকে বিশ হাজার টাকা নিট লাভ পাওয়া যায়।

বিঘা (৩৩ শতক) প্রতি সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি
সারের নাম

সারের পরিমাণ (কেজি/বিঘা)

 

 

   মন্তব্য

 

মোট পরিমাণ

জমি তৈরর সময় প্রয়োগ (বেসাল)

পার্শ্ব প্রয়োগ

 

 

 

 

১ম (বপনের ২০-২৫ দিন পর)

২য় (বপনের ৪০-৫০ দিন পর)

৩য় (বপনের ৬০-৭০ দিন পর

৪র্থ (বপনের ৭০-৮০ দিন পর)

 

ইউরিয়া

 ২৫-৩০

 ২.৫-৩.৫

 ২.৫-৪.০

 ৭.৫-৯.০

 ৭.৫-৯.০

 ৫-৬

হাইব্রিড জাতের জন্য সার কিছু বেশি লাগবে।

টিএসপি

 ২৫-৩০

 ১০-১২

 ৮-৯

 ৮-৯

 -

 -

এমওপি

 ৩৫-৪০

 ৩-৪

 ৫-৬

 ৯-১০

 ৯-১০

 ৪-৫

জিপসাম

 ১৪-১৬

 ৪-৫

 -

 ৬-৭

 ৪-৫

 -

বোরণ

 ২.৫-৩

 ১-১.৫

 ১

 -

 ০.৫০

 -

জিংক

 ২.৫-৩

 ১-১.৫

 ১

 -

 ০.৫০

 -

ম্যাগনেশিয়াম সালফেট

 ২.৫-৩

 ১-১.৫

 ১

 -

 ০.৫০

 -

গোবর/আবর্জনা
পচা সার 

 ৬০০-৮০০

 ৬০০-৮০০

 -

 -

 

 

চুন    ১০০-১৫০

বীজ বপনের ২০-২৫ দিন আগে   

অম্ল মাটির জন্য

                                                                                                
তুলার উপজাত
তুলা এমন একটি ফসল যার প্রতিটি অংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনÑআঁশ থেকে সুতা, বীজ থেকে খৈল ও খাওয়ার তেল পাওয়া যায়। গাছ থেকে জ্বালানি, কাগজ হার্ডবোর্ড বানানো যায়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি। যে জমিতে কোনো ফসল হয় না সেই জমিতে পর পর দুই মৌসুম তুলা চাষ করলে এর উর্বরতা শক্তি এমন বৃদ্ধি পায় তখন সর্ব প্রকার ফসল সহজেই ফলানো যায়।

শেষ কথা
বর্তমানে হাইব্রিড সীড প্রবর্তনের মাধ্যমে চাষিপর্যায়ে তুলা চাষের ব্যাপক সাড়া ফেলেছে যার মাধ্যমে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ৬ থেকে ৭ লাখ বেল তুলা উৎপাদন করা সম্ভব হবে এবং এর মাধ্যমে সরকারের ৪-৫ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং এই অর্থ বাংলাদেশের অন্য খাতে উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে এবং মধ্যম আয়ের উন্নত দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাশাপাশি বস্ত্রের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অত্যন্ত জরুরি এবং এর জন্য তুলা উন্নয়ন খাতে সরকার তথা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সুদৃষ্টি তথা সরাসরি অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ফিজিওলজিক্যালি তুলা লবণাক্ত ও খরা সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন ফসল। বরেন্দ্র এলাকায় ৫.০ লাখ হেক্টর এর বেশি জমি আছে। এ থেকে এক লাখ হেক্টর জমি তুলা চাষের আওতায় আনা সম্ভব। দেশের দক্ষিণ অঞ্চল অর্থাৎ খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে প্রাথমিক হিসাবে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে কম থেকে মাঝারি লবণাক্ত জমি আছে যার মধ্যে ২ হাজার হেক্টর জমি আগামী ৫ বছরের মধ্যে তুলা আবাদের আওতায় নিয়ে আসা যাবে। এসব এলাকার ফসল চাষের নিবিড়তা অনেক কম এবং শস্যবিন্যাস পতিত-পতিত-রোপা আমন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নদী অববাহিকায় আনুমানিক প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর এ ধরনের অধিক জমি আছে যেখানে কম আয়ের/মূল্যের ফসল আবাদ হয় তন্মধ্যে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে সহজেই তুলা চাষ সম্প্রসারণ করা যাবে। তুলা চাষের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ছোট ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করা তথা গ্রামীণ জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠন সম্ভব।

ড. মো. গাজী গোলাম মর্তুজা*

* কর্মসূচি  পরিচালক, নিবিড় তুলাচাষ কর্মসূচি, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, Email: mortuza01@yahoo.com

বিস্তারিত
কৃষিতে নারী

কথায় আছে Agriculture is the Pioneer of all culture and Women is the pioneer of Agriculture. রীর কোমল হাতের পরশে অতনু বীজ সর্বপ্রথম মাটির গভীরে প্রোথিত হয়েছিল, পরে তা অঙ্কুরিত হয়ে উজ্জীবিত হয়ে, শাখা প্রশাখা ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে মানুষের অন্ন বস্ত্র আশ্রয় সেবা ওষুধ পুষ্টি বিনোদনের সহায়ক হয়েছিল। দুদণ্ড শান্তির পসরা বিকোশিত করে দিয়েছিল মানুষের জন্য। নারী মমতাময়ী বলেই মাটির মতো মায়ের মতো এ ধরণীতে কেবল প্রশান্তির জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছে আজীবন আমরণ। নারীর উৎসর্গীপনা জীবন জীবনান্তে স্বর্ণ অক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। অথচ বাংলার নারী আজো অবহেলিত বিভিন্নভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে। কোথাও কোথাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী তার মর্যাদা পাওয়া শুরু করেছে। এ ধারা আরো বিকশিত হোক তীব্র হোক যৌক্তিকতা স্থায়ী হোক প্রত্যাশার ডালাভরে সে আশা করছি সেখানেই পৌঁছতে হবে আমাদের। কৃষি নারী ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য আলোকিত গল্প। নারীর অনেক কাজের মধ্যে কৃষিই উল্লেখযোগ্য। কৃষিতে নারীর ভূমিকা আর অবদান এবং সংশ্লিষ্ট সমস্যার সাথে তার উপযুক্ত সমাধানের অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগোতে পারলে আমরা সব কিছু নিয়ে আরো গর্বিত অর্জন করতে পারব আলোকিত সীমান্তে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবিতায় লিখেছেন ...


এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল, নারী দিলো তারে রূপ-রস-মধু গন্ধ সুনির্মল...।

তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ? অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শাজাহান।

জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য-লক্ষ্মী নারী, সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে সঞ্চারী। ...

...কোনোকালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।

রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী, রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি

...সাম্যের গান গাই-আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই !

...বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

বিশ্বে যা কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি, অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।

...শস্যক্ষেত্র উর্বর হলো, পুরুষ চালাল হাল, নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হাল, নারী বহে জল, সেই জল মাটি মিশে ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।

দেশে বর্তমান জনসংখ্যার অুনপাত পুরুষ:মহিলা হলো ১০৬ঃ১০০। আমাদের এ দেশে ৯২% পরিবার পুরুষ শাসিত আর মাত্র ৮% পরিবার মহিলা শাসিত। শহরের তুলনায় গ্রামের মহিলাদের প্রভাব একটু বেশি। সাধারণভাবে শিক্ষার হার পুরুষ ৪৫.৫% আর মহিলা ২৪.২%। শহরে একটু ভিন্ন। শহরে ৫২.৫% আর গ্রামে ২০.২০%। একই পরিমাণ সময় একসঙ্গে কাজ করার পর পুরুষরা মহিলাদের চেয়ে বেশি মজুরি পান, অথচ দেখা যায় মহিলারা পুরুষের তুলনায় বেশি কাজ করেন। মোট মহিলাদের মধ্যে ৭১.৫% কৃষি কাজে নিয়োজিত আর সে তুলনায় ৬০.৩% পুরুষ কৃষি কাজে নিয়োজিত। মোট কৃষি ৪৫.৬% বিনামূল্যে মহিলারা শ্রম দেন আর বাকি ৫৪.৪% অংশ শ্রম টাকার বিনিময়ে কেনা হয়।
 
যে নারী কৃষির অগ্রদূত, যে নারী আমাদের কৃষি সমাজ সংসারকে মহিমান্বিত করেছে জীবনের সবটুকু বিনিয়োগ দিয়ে তার কষ্টগাথা আসলেই এখনো অমানবিক। এ দেশে ৮৫% নারীর উপার্জনের স্বাধীনতা নেই। মাত্র ১৫% নারী নিজের ইচ্ছায় উপার্জনের স্বাধীনতা পান। আর যারা আয় করেন তাদের প্রায় ২৪% এরই নিজের আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে গ্রামের তুলনায় শহুরে নারীদের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা বেশি। দেশে ৮৫% নারী কোনো না কোনো কারণে ভিন্নতর নির্যাতনের শিকার। বিবিএসের জরিপে জানা যায় ৯২% খানার প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামী। আর মাত্র ২.২% নারী পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তবে অল্পসংখ্যক স্বামীই নারীকে উপার্জনের স্বাধীনতা দেন। সেসব স্বামীর ৯৩.১৯% স্ত্রীর উপার্জন করার বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখেন না।
 
জমির মালিকানায় পুরুষের আছে ৮১%। আর নারীর মাত্র ১৯%। বাড়ির মালিকানা ক্ষেত্রে ৮৬% পুরুষের বিপরীতে নারীর হার মাত্র ১৪%। ৪৬% নারীর স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ার জন্য স্বামীর অুনমতি নিতে হয়। এখনো মেয়ে জন্ম দেওয়ার কারণে ৬% নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আমাদের নারীরা আমাদের দুমুঠো অন্ন জোগাবার জন্য জ্বালানি সংগ্রহের জন্য যত্ন আত্তি সেবা দেওয়ার জন্য আকুল থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, মাস পেরিয়ে বছর এবং আজীবন আমরণ।
 
 নারী শ্রম শক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সাথে জড়িত। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে কৃষিকাজে সবচেয়ে বেশি নারী নিয়োজিত রয়েছেন। ফসলের প্রাক বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এমন কি বিপণন পর্যন্ত অনেক কাজ নারী এককভাবেই করে। বলা চলে কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে কৃতজ্ঞচিত্তে নারীর এ উপস্থিতির কোনো হিসাবে স্বীকৃতি নেই। এমনকি কৃষি কাজে জড়িত এ বিপুল নারী শ্রমিকের তেমন কোনো মূল্যায়নও করা হয় না। এখনো গ্রামীণ সমাজে কৃষি ও চাষের কাজকে নারীর প্রাত্যহিক কাজের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়। সেখানে মজুরি প্রদানের বিষয়টি অবান্তর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামমাত্র মজুরি দেয়া হয়।  সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করলেও কৃষিখাতে নারী শ্রমিকের বৈধ পরিচিতি নেই। কাজ করে নারী নাম কেনে পুরুষ। এ ছাড়া অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অন্য নারী শ্রমিকের মতোই কৃষিখাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকেরাও তীব্রভাবে বৈষম্যের শিকার হন। কাজে স্বীকৃতির অভাব চরমভাবে লক্ষণীয়। এ ছাড়া নিয়মহীন নিযুক্তি, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, নারীর অধিক আন্তরিকতা, অল্প মজুরি, মজুরি বৈষম্য, দুর্ব্যবহার এবং আরো নানা ধরনের নিপীড়ন তো রয়েছেই।
 
২০০৫-০৬ সনের শ্রমশক্তির জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী। দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সাথেযুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির ৫০ লাখই নারীশ্রমিক। ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৯-২০১০ সময়ে দেশে কৃষি, বন ও মৎস্য, পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছচাষ, কৃষিকাজে নিয়োজিত নারীশ্রমিকের সংখ্যা ৩৭ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৮০ লাখ হয়েছে। এ বৃদ্ধির হার ১শ’ ১৬ শতাংশ। যদিও এসব নারীশ্রমিকের ৭২ শতাংশই অবৈতনিক পারিবারিক নারীশ্রমিক। ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এসব নারীর অবদানের স্বীকৃতি আলোচনার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। শ্রমিক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। অথচ এ সময় এ খাতে পুরুষশ্রমিকের সংখ্যা কমেছে ২.৩ শতাংশ। ২০০২-০৩ সময়ের তুলনায় বর্তমানে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতে পুরুষশ্রমিকের অংশগ্রহণ কমেছে ১০.৪ শতাংশ। বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, সম্প্রসারণকর্মী, গবেষক ও নারী নেত্রীরা মনে করছেন দেশের কৃষি ও কিষাণ-কিষাণীর সার্বিক উন্নতির স্বার্থে সামগ্রিক কৃষি সংস্কার কর্মসূচি জরুরিভিত্তিতে হাতে নিতে হবে। সে সাথে সরকারকে গ্রামীণ নারীশ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় প্রাতিষ্ঠনিক ব্যবস্থা ও কৃষিতথ্য পৌঁছে দেয়ার বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী কৃষিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত থাকলেও তাদের স্বীকৃতি সেভাবে নেই। কৃষিতে কিষাণীর অবদানের রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্বীকৃতি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
 
শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মানুষ যারা কাজ করছেন, কাজ করছেন না কিন্তু কাজ খুঁজছেন জনগোষ্ঠীর এমন অংশকেই শ্রমশক্তি হিসেবে ধরা হয়। গত এক দশকে ১ কোটি ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতেই যুক্ত হয়েছে ৩০ লাখ কর্মসংস্থান। অর্থনীতির উদ্বৃত্ত শ্রমের ধারণায় কৃষিতে পারিবারিক শ্রমের প্রাধান্য থাকায় শ্রমের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা কখনো কখনো শূন্য হয়ে দাঁড়ায়।  শ্রমশক্তির সংজ্ঞানুযায়ী, ২৯ শতাংশ নারীই কেবল শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বাকিরা নিশ্চিতভাবে নানান অবৈতনিক পারিবারিক কাজে নিয়োজিত থাকার পরও শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে অদৃশ্যই থাকছেন। সিএসআরএলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ নারী গৃহকর্মে সরাসরি অবদান রাখছেন। তাদের অনেকে কিষাণী, তবে তা শ্রমশক্তির বিবেচনায় অদৃশ্য। কৃষিখাতের ২১টি কাজের ধাপের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৭টি ধাপে অথচ কৃষি কাজে সেভাবে নারীর স্বীকৃতি মর্যদা সম্মান নেই। একজন গ্রামীণ নারী প্রতিদিন তার ঘর গোছানো রান্না পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা জ্বালানি সংগ্রহ সব মিলিয়ে অন্তত ১৫ থেকে ১৭ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি করেন। আমরা ভাবছি সে আমার মা, সে আমার বোন, সে আমার স্ত্রী কত কিছু করছেন? তার বিনিময়ে করুনা নয় তার যথাযোগ্য প্রাপ্যটুকু আমরা মেটানোর চেষ্টা করলেই তো অনেক হয়ে যায়। আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল টেকসই কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি কৃষক ও কৃষি শ্রমিক উভয়ের স্বার্থরক্ষা সম্ভব। নারী কৃষি শ্রমিকদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, একই ধরনের কাজে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, বেশি কাজে বেশি সম্মান স্বীকৃতি, সরকারি কৃষি কর্মকাণ্ডে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া, কৃষিকাজে নারী শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষিশ্রমিক তথা কৃষাণীদের অগ্রাধিকার দেয়াসহ আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেন।
 
কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল ১৯৮৪ কৃষিতে নারী, ১৯৯৯ অন্ন জোগায় নারী এ স্লোগান নির্ধারিত হয়েছিল। ১৯৯৫ সনে জাতিসংঘের উদ্যোগে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে ১৮৯টি দেশের প্রায় ৩০ হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সর্বসম্মতভাবে নারী উন্নয়নের সামগ্রিক রূপরেখা হিসেবে বেইজিং ঘোষণা ও প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন গৃহীত হয়। নারী উন্নয়নের বৈশ্বিক নির্দেশিকা হিসেবে এ প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশনের আলোকে নিজ নিজ দেশে নারী উন্নয়ন নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশনের মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পূর্ণ এবং সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের সব পরিম-লে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথে বাঁধাগুলো দূর করা। সে সাথে গৃহ, কর্মক্ষেত্র ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক সব পরিসরে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা এবং দায়দায়িত্ব সমবণ্টনের নীতি প্রতিষ্ঠিত করা। এরই আলোকে ২০১১ সনে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত ও মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে।
 
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ সনে মোট ৩টি ভাগে ৪৯টি অধ্যায় রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ১৬.১-বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের সব ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, ১৬.৮-নারী পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করা, ১৬.৯-সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিম-লে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা, ২৩-৫-সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়া,২৩.৭-নারী-পুরুষ শ্রমিকদের সমান মজুরি, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ও কর্মস্থলে সমসুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা, ২৩.১০-সরকারের জাতীয় হিসাবে, জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষি ও গার্হস্থ্য শ্রমসহ সব নারী শ্রমের সঠিক প্রতিফলন মূল্যায়ন নিশ্চিত করা, ২৬.১-নারী শ্রমশক্তির শিক্ষিত ও নিরক্ষর উভয় অংশের কর্মসংস্থানের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা, ২৬.৫-নারীর বাড়তি হারে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, অবস্থান ও অগ্রসরমানতা বজায় রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ গড়ে তোলা, ২৬.৬-নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব অইন, বিধি ও নীতির প্রয়োজনীয় সংস্কার করা, কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৃষির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
 
কৃষিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নারীর শ্রম ও অংশগ্রহণ বিশ্বব্যাপী সর্বজনবিদিত। ৩১.১-জাতীয় অর্থনীতিতে নারী কৃষি শ্রমিকের শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা, ৩১.২-জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে নারী কৃষি শ্রমিকদের সব রকম সহায়তা প্রদান করা, ৩১.৩-কৃষিতে নারী শ্রমিকের মজুরি বৈষম্য দূরীকরণ এবং সমকাজে সমমজুরি নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। এসব ধারা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে কৃষি নারী শ্রমিদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। শুধু তা-ই না এ দেশের কৃষি উন্নয়নসহ অন্যান্য উন্নয়ন সমৃদ্ধি আরো বেগবান হবে।
 
কোনো দেশে প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব দিলে বৈষম্য থেকে এ অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা সম্ভব। সমাজ তথা রাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতায়নে নারীর কাজের সামাজিক ও আর্থিক স্বীকৃতি আবশ্যক। রাষ্ট্রীয় সামাজিক বা পারিবারিকভাবে কৃষির সাথে জড়িত নারীর কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। সে সাথে এ খাতে নারীর মজুরি বৈষম্যসহ সব প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করা যায় না, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানকেও আজ অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষিখাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে দেশের কৃষি উৎপাদন কাজে নারীরা আরো আগ্রহী হবে। এর ফলে কৃষিখাতের উৎপাদন বাড়বে, জিডিপিতে কৃষির অবদানও বাড়বে। তাই কৃষিকাজে জড়িত নারী শ্রমিকদের মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
 
কৃষিতে নারীর সংশ্লিষ্টতা অবদান ব্যাপক ও বিস্তৃত। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হলোÑ বীজ সংরক্ষণ; বীজ বাছাই, শোধন ও অঙ্কুরোদগম বীজ শোধন; বীজতলায় বীজ বপন; চারা তোলা; চারা রোপণ; কৃষি পঞ্জিকা পুষ্টিসম্মত রান্না কৌশল; খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ; কর্তন উত্তর কৌশল; শস্য সংরক্ষণ; কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা; কৃষি শ্রমিক ব্যবস্থাপনা; জৈবকৃষি;  মুরগি পালন; হাঁস পালন; ছাগল পালন; গরু পালন; দুধ দোহন; গরু মোটাতাজাকরণ; ডিম ফোটানো; হাঁস-মুরগি পালন; বসতবাড়িতে শাকসবজি ফল  ফুল চাষ; ভেষজ চাষ; কবুতর পালন; কোয়েল পালন; নার্সারি ব্যবস্থাপনা; মাতৃগাছ ব্যবস্থাপনা; মৌচাষ ; শীতল পাটি হোগলা তৈরি; অঙ্গজ বংশবিস্তার; বায়োগ্যাস কার্যক্রম; বনসাই/অর্কিড/ক্যাকটাস চাষ; কুল বার্ডিং; খাঁচায় মাছ চাষ; পুকুরে আধুনিক উপায়ে মাছ চাষ; জ্যাম জেলি আচার কেচাপ স্যুপ আমসত্ত্ব তালসত্ত্ব; মাছের সাথে হাঁস-মুরগির চাষ; ভাসমান সবজি চাষ; ঘাস চাষ; উন্নত চুলায় রান্না; কুটির শিল্প; মাশরুম চাষ; আলুর কলার চিপস; চানাচুর তৈরি; ছাদে বাগান; বাহারি মাছ; পারিবারিক শাকসবজি সংগ্রহ; পারিবারিক শাক ফলমূল সংরক্ষণ; জ্বালানি সংগ্রহ; কৃষি বনায়ন; সামাজিক বনায়ন...। এর সবগুলোতেই নারী সংশ্লিষ্ট। কোনটাতে এককভাবে আবার কোনটাতে যৌথভাবে। উল্লেখ করলাম কিছু থেকে গেল তার চেয়েও বেশি। ভাবতে হবে নারী আমাদের উন্নয়ন সমৃদ্ধির আবশ্যকীয় অংশীদার। সুতরাং তাদের মান মর্যদা পাওনা স্বীকৃতি যৌক্তিকভাবে যথাযথভাবে দেয়া নিশ্চিত করতে পারলে আমরা আরো দূরের আলোকিত বাতিঘরে পৌঁছতে পারব কম সময়ের মধ্যে।
সিডিপির সংলাপে জানা যায় একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২.১টি কাজ করে ব্যয় করেন ৭.৭. ঘণ্টা। পুরুষ করেন ২.৭টিতে করেন ২.৫ ঘণ্টা। অর্থাৎ নারী পুরুষের তুলনায় ৩ গুণ বেশি কাজ করেন। জাতীয় আয়ে নারীর যে পরিমাণ কাজের স্বীকৃতি আছে তার চেয়ে ২.৫ থেকে ২.৯ গুণ কাজের স্বীকৃতি নেই। নারী যে পরিমাণ কাজে স্বীকৃতি আছে সে হারে ২.৫ গুণ কাজের স্বীকৃতি নেই। নারী ঘরে করে এমন কাজের আর্থিক মূল্য গত অর্থবছরের জিডিপির ৭৬.৮০ শতাংশ। চলতি টাকার মূল্যে তা ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। স্থায়ী মূল্যে এটা ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। আমাদের নারীদের গৃহস্থালির কাজ রান্না, বাড়িঘর পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা, সদস্যদের সেবা যত্ন পরিচর্যা সহায়তা এগুলোর কোনো মূল্য নেই। যদি এসব শ্রম কিনতে হতো তখন তা দাঁড়াতো জিডিপির ৮৭.২ যার আর্থিক মূল্য ১১ লাখ ৭৮ হাজার ২ কোটি টাকা। স্থায়ী মূল্যে এটি দাঁড়ায় ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। কত হাজার টাকার প্রয়োজন হতো। মজুরিবিহীন কাজে সম্পৃক্ত নারীদের তিন চতুর্থাংশ মজুরি পাওয়া যাবে এমন কাজ করতে চান না। শহরে এর সংখ্যা ৮০.১৭% আর গ্রামে ৭১.১১%। মজুরি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী নন এমন নারীদের ৬০% বলছেন পরিবার চান না তারা বাইরে কাজ করুক। মজুরির টাকা খরচ করেতে ৪০% নারীকে পরিবারের সাথে আলোচনা করতে হয়। আর ৫১.৭% নারী নিজেদের ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারেন। দেশের ৮৯% নারী অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত আছেন যারা কোনো মজুরি পান না।

আমাদের টোটাল মানসিকতা যৌক্তিকভাবে বদলাতে হবে; পুষ্টিতে তুষ্টিতে যুক্তিতে নারীর পাওনা অধিকারকে সমানভাবে প্রাপ্যতা অনুযায়ী সুনিশ্চিত করতে হবে; নারীকেই শিক্ষা প্রশিক্ষণ দিয়ে আরো দক্ষ করে তুলতে হবে; নারী বলে কোনো রকম বৈষম্য অবহেলা করা চলবে না; নারী আইনগত অধিকার, বিনিয়োগী অধিকার, অবদানের স্বীকৃতি যথাযথভাবে দিতে হবে; নারী যেমন পুরুষের কাজে সার্বিক আন্তরিক সহযোগিতা করে তেমনি নারীর কাজেও পুরুষের সার্বিক সহযোগিতা আবশ্যকীয়ভাবে করতে হবে; জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত জন্য জাতীয় হিসাব ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা; গৃহস্থালির কাজের ভার কমানোর জন্য সুনিদর্িৃষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ; নারীর মজুরি বাড়ানো; যারা আয় করেন তাদের ইচ্ছে মতো খরচ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে; ঘরে বাইরে কাজ করার পর নারীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম আবশ্যকীয়ভাবে দরকার; নারীর সব অবদান যথাযথভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে; নারীদের প্রকৃত মর্যদা দিতে হবে;
আমরা সবাই যদি সচেতন হই তাহলে অনেক এগিয়ে যেতে পারব এতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু প্রয়োজন আইন মতো, নীতি মতো, হক মতো এবং মনের আসল চাহিদার সাথে মিলিয়ে বিবেক মতো আমরা সব কাজে এগিয়ে যাবো, এগিয়ে নিয়ে যাবো। আমার মায়ের অবদান জাতীয় জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নারীকে অবহেলা করে দূরে রেখে বাইরে রেখে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কখনো সফল হবে না। আমাদের জাতীয় কবির সাথে একমত হয়ে বলি সেদিন সুদূর নয়-যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়। বাংলার নারীর সার্বিক কল্যাণ হোক মঙ্গল হোক।
 
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
বিস্তারিত
লাউ উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল
লাউয়ের পাতা সবুজ ও নরম। পুরুষ ও স্ত্রী ফুল যথাক্রমে রোপণের ৪২-৪৫ দিন এবং ৫৭-৬০ দিনের মধ্যে ফুটে। হালকা সবুজ রঙয়ের ফলের আকৃতি লম্বা (৪০-৪৫) এবং বেড় প্রায় ৩০-৩৫ সেমি.। প্রতি ফলের ওজন ১.৫-২ কেজি। প্রতি গাছে গড়ে ১০-১২টি ফল ধরে। চারা রোপণের ৬০-৭০ দিনের মধ্যে প্রথম ফল তোলা যায়। লাউ প্রধানত শীত মৌসুমের। শীতকালে ফলন বেশি। এটি উচ্চতাপ ও অতিবৃষ্টি সহিষ্ণু ফলে সারা বছরও জন্মানো যায়। বাংলাদেশের সব এলাকায় সারা বছরই এর চাষ করা যায়। শীতকালীন চাষের জন্য ভাদ্রের প্রথমে আগাম ফসল হিসেবে চাষ করা যাবে।

রোপণ : ভাদ্র-আশ্বিন।

জীবনকাল : ১২০-১৪০ দিন

ফলন : শীতকালে ৪৫-৫০ টন/হেক্টর (৬-৭ টন/বিঘা) এবং গ্রীষ্মকালে ১৮-২২ টন/হেক্টর (২.৫.৩ টন/বিঘা)

লাউয়ের পুষ্টিমান
লাউয়ে ১৭ ধরনের এ্যামাইনো এসিড, ভিটামিন সি, রাইবোফ্লাভিন, জিঙ্ক, থায়ামিন, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ এবং ৯৬% পানি রয়েছে। এতে ফ্যাট ও কোলস্টেরল নেই বললেই চলে।

উৎপাদন প্রযুক্তি
মাটি ও জলবায়ু
মাটি
জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ এঁটেল দো-আঁশ মাটি লাউ চাষের জন্য উত্তম।

জলবায়ু
বেশি শীতও না আবার বেশি গরমও না এমন আবহাওয়া লাউ চাষের জন্য উত্তম। বাংলাদেশের শীতকালটা লাউ চাষের জন্য বেশি উপযোগী। তবে বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা শীতকালে কখনো কখনো ১০০ সে. এর নিচে নেমে যায়, যা লাউ চাষের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। দিন ও রাতে তাপমাত্রার পার্থক্য ৮-৯০ হলে ভালো। লাউয়ের ফলন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়।

জীবনকাল
লাউয়ের জীবনকাল গড়ে ১৬৫-১৮৫ দিন।

বীজ বপনের সময় ও বীজের হার

আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। তবে বীজ উৎপাদনের জন্য অক্টোবরের শেষ দিকে বীজ বোনা উত্তম। বিঘাপ্রতি ৭০০-৮০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।

বীজ শোধন
বীজবাহিত রোগ প্রতিরোধ এবং সবল সতেজ চারা উৎপাদনের জন্য বীজ শোধন জরুরি। কেজিপ্রতি ২ ভিটাভেক্স/ক্যাপটান ব্যবহার করে বীজ শোধন করা যায়।

চারা উৎপাদন
বীজতলা তৈরি
লাউ চাষের জন্য নার্সারিতে পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করে নিতে হবে। এজন্য আলো বাতাস স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায় এমন জায়গায় ২০-২৫ সেমি উঁচু বেড করে নিতে হবে। বেড়ের ওপর ৪-৫.২ মিটার আকৃতির ঘর তৈরি করে নিতে হবে। ঘরের কিনারা বরাবর মাটি হতে ঘরের উচ্চতা হবে ০.৬ মিটার এবং মাটি হতে ঘরের মধ্যভাগের উচ্চতা হবে ১.৭ মিটার। এ ঘর তৈরির জন্য বাঁশ, বাঁশের কঞ্চি, ছাউনির জন্য প্লাস্টিক এবং এগুলো বাঁধার জন্য সুতলি বা দড়ি দরকার হবে

বীজ বপন
বীজ বপনের জন্য ৮x ১০ সেমি. বা তার থেকে কিছুটা বড় আকারের পলিব্যাগ ব্যবহার করা যায়। প্রথমে অর্থেক মাটি ও অর্ধেক গোবর মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নিতে হবে। মাটিতে বীজ গজানোর জন্য জো নিশ্চিত করে (মাটি জো না থাকলে পানি দিয়ে জো করে নিতে হবে) তা পলিব্যাগে ভরতে হবে। অতপর প্রতি ব্যাগে দুটি করে বীজ বুনতে হবে। বীজের আকারের দ্বিগুণ মাটির গভীরে বীজ পুঁতে দিতে হবে।

বীজতলায় চারা পরিচর্যা
নার্সারিতে চারার প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে। বেশি শীতে বীজ গজানোর সমস্যা হয়। এজন্য শীতকালে চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজ গজানোর পূর্ব পর্যন্ত প্রতি রাতে প্লাস্টিক দিয়ে পলিব্যাগ ঢেকে রাখতে হবে এবং দিনে খোলা রাখতে হবে। চারায় প্রয়োজন অনুসারে পানি দিতে হবে তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে চারার গায়ে পানি না পড়ে। পলিব্যাগ এর মাটি চটা বাঁধলে তা ভেঙে দিতে হবে।

বীজের সহজ অংকুরোদগম
লাউয়ের বীজের খোসা কিছুটা শক্ত। তাই সহজ অংকুরোদগমের জন্য শুধু পরিষ্কার পানিতে ১৫-২০ ঘণ্টা অথবা শতকরা ১% পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্রবণে এক রাত ভিজিয়ে অতপর পলিব্যাগে বুনতে হবে।

জমি তৈরি
জমি নির্বাচন ও জমি তৈরি
এসব ফসল চাষে সেচ ও নিকাশের উত্তম সুবিধাযুক্ত এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। একই জমিতে বার বার একই ফসলের চাষ পরিহার করতে পারলে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব কমানো যাবে। ব্যাপক শিকড় বৃদ্ধির জন্য জমি এবং গর্ত উত্তমরূপে তৈরি করতে হবে।

বেড তৈরি ও বেড থেকে বেডের দূরত্ব
বেডের উচ্চতা হবে ১৫-২০ সেমি.। বেডের প্রস্থ হবে ২.৫ মিটার এবং লম্বা জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে নিতে হবে। এভাবে পরপর বেড তৈরি করতে হবে। এরূপ পাশাপাশি ২টি বেড়ের মাঝখানে ৬০ সেমি. ব্যাসের সেচ নালা থাকবে এবং প্রতি ২ বেড অন্তর ৩০ সেমি প্রশস্ত শুধু নিকাশ নালা থাকবে।

মাদা তৈরি এবং বেডে মাদা হতে মাদার দূরত্ব
মাদার আকার হবে ব্যাস ৫০-৫৫ সেমি. গভীরতা ৫০-৫৫ সেমি. এবং তলদেশ ৪৫-৫০ সেমি.। বেডের যে দিকে ৬০ সেমি. প্রশস্ত সেচ ও নিকাশ নালা থাকবে সেদিকে বেডের কিনারা হতে ৬০ সেমি. বাদ দিয়ে মাদার কেন্দ্র ধরে ২ মিটর অন্তর এক সারিতে মাদা তৈরি করতে হবে। একটি বেরের যে কিনারা হতে ৬০ সেমি. বাদ দেয়া হবে, তার পার্শ্ববর্তী বেডের ঠিক একই কিনার থেকে ৬০ সেমি. বাদ দিয়ে মাদার কেন্দ্র ধরে অনুরূপ নিয়মে মাদা করতে হবে

সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
এসব ফসল দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে এবং অনেক লম্বা সময়ব্যাপী ফল দিয়ে থাকে। কাজেই এসব ফসলের সফল চাষ করতে হলে গাছের জন্য পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ নিশ্চির করতে হবে। এরা পর্যাপ্ত খাবার সংগ্রহের জন্য এর শিকড় অঞ্চল অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মাটি পরীক্ষাসাপেক্ষে সারের মাত্রা সুপারিশ করা হয়নি। কাজেই যেসব অঞ্চল এর জন্য সারের মাত্রা নির্দিষ্ট নেই সেসব অঞ্চল এর জন্য পরীক্ষামূলক প্রমাণের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত হারে সারের মাত্রা সুপারিশ করা হলো।

লাউ ফসলের সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি
জমি তৈরির সময় সারের যে মাত্রা সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে গোবর চাষের পর এবং টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও বোরক্স সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। মাদায় চারা রোপণের যে সারের মাত্রা সুপারিশ করা হয়েছে তা দেওয়ার পর পানি দিয়ে মাদার মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। তারপর ‘জো’ এলে ৭-১০ দিন পর চারা লাগাতে হবে।

চারার বয়স : বীজ গজানোর পর ১৬-১৭ দিন বয়সের চারা মাঠে লাগানোর জন্য উত্তম।

চারা রোপণ
চারাগুলো রোপণের আগের দিন বিকালে পানি দিয়ে ভালোবাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। পরের দিন বিকালে চারা রোপণ করতে হবে। চারাগুলো নার্সারি থেকে ট্রলি বা টুকরি করে মাঠে নিয়ে যেতে হবে। মাঠে প্রস্তুত মাদাগুলোর মাটি ভালোভাবে ওলটপালট করে, এক কোপ দিয়ে চারা লাগানোর জন্য জায়গা করে নিতে হবে। অতপর পলিব্যাগের ভাঁজ বরাবর ব্লেড দিয়ে কেটে পলিব্যাগ সরিয়ে মাটির দলাসহ চারাটি নির্দিষ্ট জায়গায় লাগিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে। চারা লাগানোর পর গর্তে পানি দিতে হবে। পলিব্যাগ সরানোর সময় এবং চারা রোপণের সময় সাবধান থাকতে হবে যাতে চারার শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত হলে গাছের বৃদ্ধি দেরিতে শুরু হবে।

পরবর্তী পরিচর্যা
সেচ দেয়া
লাউ ফসল পানির প্রতি খুবই সংবেদনশীল। প্রয়োজনীয় পানির অভার হলে ফল ধারণ ব্যাহত হবে এবং ফল আস্তে আস্তে ঝরে যাবে। কাজেই সেচনালা দিয়ে প্রয়োজন অনুসারে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। লাউয়ের জমিতে কখনো সব জমি ভিজিয়ে প্লাবন সেচ দেয়া যাবে না। শুধুমাত্র সেচ নালায় পানি দিয়ে আটকে রাখলে গাছ পানি টেনে নেবে। শুষ্ক মৌসুমে লাউ ফসলে ৪/৫ দিন অন্তর সেজ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে।

বাউনি দেয়া
লাউয়ের কাক্সিক্ষত ফলন পেতে হলে অবশ্যই মাচায় চাষ করতে হবে। লাউ মাটিতে চাষ করলে ফলের একদিক বিবর্ণ হয়ে বাজারমূল্য কমে যায়, ফলে পচন ধরে এবং প্রাকৃতিক পরাগায়ন কমে যায়। ফলে ফলনও কমে যায়।

মালচিং
সেচের পর জমিতে চটা বাঁধে। চটা বাঁধলে গাছের শিকড় অঞ্চলে বাতাস চলাচল ব্যাহত হয়। কাজেই প্রত্যেক সেচের জর হালকা মালচ, করে গাছের গোড়ার মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে।

আগাছা দমন
কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির ঘাস লাউতে বোটল গোর্ড মোজাইক ভাইরাস নামে যে রোগ হয় তার হোস্ট। কাজেই চারা লাগানো থেকে শুরু করে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত জমি সব সময়ই আগাছামুক্ত রাখতে হবে। এ ছাড়াও গাছের গোড়ায় আগাছা থাকলে তা খাদ্যোপাদান ও রস শোষণ করে নেয়।
সার উপরিপ্রেয়োগ
চারা রোপণের পর গাছপ্রতি সার উপরিপ্রয়োগের যে মাত্রা সারণিতে উল্লেখ করা আছে তা প্রয়োগ করতে হবে।

সারের নাম  মোট পরিমাণ(হেক্টরপ্রতি) প্রতি গর্তে  জমি তৈরির সময়
পচা গোবর      ১০০০ কেজি                   ১০ কেজি   সমুদয় গোবর, টিএসপি, এমওপি, বোরন
ইউরিয়া           ৫০০ কেজি                   ৫০০ গ্রাম   এবং ১/৫ অংশ ইউরিয়া পিট বা গর্ত
টিএসপি           ৪০০ কেজি                   ৪০০ গ্রাম    তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। বাাকি এমওপি
এমওপি           ৩০০ কেজি                  ৩০০ গ্রাম   ও ইউরিয়া ৪ কিস্তিতে বছরে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
বোরন              ২ কেজি                     ০২ গ্রাম

                                                                           
বিশেষ পরিচর্যা
শোষক শাখা অপসারণ
গাছের গোড়ার দিকে ছোট ছোট ডালপালা হয়। সেগুলোকে শোষক শাখা বলা হয়। এগুলো গাছের ফলনে এবং যথাযথ শারীরিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়। কাজেই গাছের গোড়ার দিকে ৪০-৪৫ সেমি. পর্যন্ত ডালপালাগুলো ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে অপসারণ করতে হবে।

ফল ধারণ বৃদ্ধিতে কৃত্রিম পরাগায়ন
লাউয়ের পরাগায়ন প্রধানত মৌমাছির দ্বারা সম্পন্ন হয়। প্রাকৃতিক পরাগায়নের মাধ্যমে বেশি ফল ধরার জন্য হেক্টর প্রতি দুটি মৌমাছির কলোনি স্থাপন করা প্রয়োজন। নানা কারণে লাউয়ের সব ফুলে প্রাকৃতিক পরাগায়ন ঘটে না এবং এতে ফলন কমে যায়। হাত দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়ন করে লাউয়ের ফলন শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভর। লাউয়ের ফুল ঠিকমতো রোদ পেলে দুপুরের পর থেকে ফোটা শুরু হয়ে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত ফোটে। কৃত্রিম পরাগায়ন ফুল ফোটার দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত করা যায়। তবে পরদিন সকালে পরাগায়ন করলে ফল কম ধরে কিন্তু ফুল ফোটার দিন সন্ধ্যাপর্যন্ত যে কয়টা ফুলে পরাগায়ন করা হয় তার সবটিতেই ফল ধরবে। কৃত্রিম পরাগায়নের নিয়ম হলো ফুল ফোটার পর পুরুষ ফুল ছিঁড়ে ফুলের পাপড়ি অপসারণ করা হয় এবং ফুলের পরাগধানী (যার মধ্যে পরাগরেণু থাকে) আস্তে করে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে (যেটি গর্ভাশয়ের পেছনে পাপড়ির মাজখানে থাকে) ঘষে দেয়া হয়। একটি পুরুষ ফুল দিয়ে ২-৪টি স্ত্রী ফুলে পরাগায়ন করা যায়।

ফসল তোলা (পরিপক্বতা শনাক্তকরণ)
ফলের ভক্ষণযোগ্য পরিপক্বতা নিম্নোক্তভাবে শনাক্ত করা যায়।
১. ফলের গায়ে প্রচুর শুং এর উপস্থিতি থাকবে।
২. ফলের গায়ে নোখ দিয়ে চাপ দিলে খুব সহয়েই নোখ ডেবে যাবে।
৩. পরাগায়নের ১২-১৫ দিন পর ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়।

লাউয়ের ফলের লম্বা বোঁটা রেখে ধারালো ছুরি দ্বারা ফল কাটতে হবে। ফল কাটার সময় যাতে গাছের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। লাউ যত বেশি সংগ্রহ করা যাবে ফলন তত বেশি হবে।

ফলন : বারি লাউ-১ এবং বারি লাউ-২ যথাযথভাবে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ টন এবং বিঘাপ্রতি প্রায় ৪.৫-৫.০টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

বীজ উৎপাদন
বীজের জন্য ফল সংগ্রহ
বীজের জন্য অবশ্যই ভালোভাবে পরিপক্ব ফল সংগ্রহ করতে হবে। দুটি উপায়ে ফলের পরিপক্বতা বুঝা যাবে। যেমন-
১. ফল নাড়ালে ভেতরে বীজের শব্দ পাওয়া যাবে,
২. ফলের খোসা শুকিয়ে যাবে এবং শক্ত হয়ে যাবে কিন্তু ফলের ভেতর শুকাবে না। এই অবস্থায় বীজের সংগ্রহোত্তর পরিপক্বতার জন্য ফল ২-৩ সপ্তাহ রেখে দিতে হবে। বীজ উৎপাদনের জন্য জমির সবগুলো গাছের মধ্যে গাছের সতেজতা, ফলন ক্ষমতা এবং সুস্থতা দেখে কয়েকটি নির্দিষ্ট গাছ নির্বাচন করে তাতে নিয়ন্ত্রিত পরাগায়ন করতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচিত গাছগুলোর মধ্যে একই গাছের পুরুষ ফুল দিয়ে একই গাছের স্ত্রী ফুল অথবা একই জাতের এক গাছে পুরুষ ফুল দিয়ে অন্য গাছের স্ত্রী ফুল পরাগায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটার আগেই বাটার পেপার ব্যাগ দ্বারা বেঁধে রাখতে হবে যাতে অন্য জাতের পুরুষ ফুলের রেণু দ্বারা পরাগায়িত হতে না পারে এবং ফুল ফোটলে স্ত্রী ফুল পরাগায়িত করে আবার ব্যাগ দ্বারা স্ত্রী ফুল বেঁধে দিতে হবে। এই ব্যাগ দ্বারা ফল ৩-৪ দিন বেঁধে রাখতে হবে।

বীজের ফলন : হেক্টরপ্রতি ৫০০ কেজি।

ক্ষতিকর পোকামাকড়
লাউয়ের মাছি পোকা
এ পোকা লাউয়ের ফলের মধ্যে প্রথমে ডিম পাড়ে, পরবর্তীতে ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের ভেতরে খেয়ে নষ্ট করে ফেলে।

দমন ব্যবস্থা
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ : মাছি পোকর কীড়া আক্রান্ত ফল দ্রুত পচে যায় এবং গাছ হবে মাটিতে ঝরে পড়ে। পোকা আক্রান্ত ফল কোনোক্রমেই জমির আশেপাশে ফেলে রাখা উচিত নয়। পোকা আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেললে মাছি পোকার বংশবৃদ্ধি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদের যৌথ ব্যবহার
কিউলিওর নামক সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণে মাছিপোকর পুরুষ পোকা আকৃষ্ট করা সম্ভব। পানি ফাঁদের মাধ্যমে ওই ফেরোমন ব্যবহার করে আকৃষ্ট মাছি পোকাগুলোকে মেরে ফেলা যায়। বিষটোপ ফাঁদে পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষ মাছি পোকা আকৃষ্ট হয় এবং ফাঁদে পড়ে মারা যায়। ১০০ গ্রাম পাকা মিষ্টি কুমড়া কুচি কুচি করে কেটে তা থেঁতলিয়ে ০.২৫ গ্রাম মিপসিন ৭৫ পাউডার অথবা সেভিন ৮৫ পাউডার এবং ১০০ মিলি পানি মিশিয়ে ছোট একটি মাটির পাত্রে রেখে তিনটি খুঁটির সাহায্যে এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে বিষটোপের পাত্রটি মাটি থেকে ০.৫ মিটার উঁচুতে থাকে। বিষটোপ তৈরির পর ৩-৪ দিন পর্যন্ত ব্যবহার করে তা ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে তৈরি বিষটোপ ব্যবহার করতে হয়। সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদ কুমড়া জাতীয় ফসলের জমিতে ক্রমানুসারে ১২ মি. দূরে দূরে স্থাপন করতে হবে।

পামকিন বিটল : পামকিন বিটলের পূর্ণ বয়স্ক পোকা চারাগাছের পাতায় ফুটো করে এবং পাতার কিনারা থেকে খেতে খেতে সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে এবং বয়স্ক গাছের পাতার শিরা উপশিরা গুলো রেখে সম্পূর্ণ সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। এ পোকা ফুল ও কচি ফলেও আক্রমণ করে। এদের কীড়া শিকড় বা মাটির নিচে থাকা কা- ছিদ্র করে ফলে গাছ ঢলে পড়ে এবং পরিশেষে শুকিয়ে মারা যায়।

দমন ব্যবস্থা
১. চারা অবস্থায আক্রান্ত হলে হাত দিয়ে পূর্ণবয়স্ক পোকা ধরে মেরে ফেলতে হবে।
২. ক্ষেত সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
৩. চারা বের হওয়ার পর থেকে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত মশারির জাল দিয়ে চারাগুলো ঢেকে রাখলে এ পোকার আক্রমণ থেকে চারাগুলো বেঁচে যায়।
৪. আক্রমণের হার বেশি হলে চারা গজানোর পর প্রতি মাদার চারদিকে মাটির সঙ্গে চারাপ্রতি ২-৫ গ্রাম অনুমোদিত দানাদার কীটনাশক (কার্বফুরান জাতীয় কীটনাশক) মিশিয়ে গোড়ায় পানি সেচ দেয়।

রোগবালাই
মোজাইক
চারা অবস্থায় বীজ গজানোর পর বীজপত্র হলুদ হয়ে যায় এবং পরে চারা নেতিয়ে পড়ে। বযস্ক গাছের পাতায় হলুদ-সবুজ ছোপ ছোপ মোজাইকের মতো দাগ দেখা যায়। দাগগুলো অসম আকারের। দ্রুত বড় হয়। আক্রান্ত পাতা ছোট, বিকৃত ও নিচের দিকে কোকড়ানো, বিবর্ণ হয়ে যায়। শিরা-উপশিরাও হলুদ হয়ে যায়। ফুল কম আসে এবং অধিক আক্রমণে পাতা ও গাছ মরে যায়। আক্রান্ত ফল বেঁকে যায় ও গাছের কচি ডগা জটলার মতো দেখায়। ফলের উপরি অংশ এবড়ো-খেবড়ো দেখা যায়।

প্রতিকার ব্যবস্থা
১. আক্রান্ত গাছ দেখলেই প্রাথমিকভাবে তা তুলে ধ্বংস করা। ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার রাখা।
২. ক্ষেতে বাহক পোকা উপস্থিতি দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করে তা দমন করা।
৩. রোগাক্রান্ত গাছ থেকে কোনো বীজ সংগ্রহ ও ব্যবহার না করা।
 
কৃষিবিদ মো. মাহমুদুল হাসান খান*
*বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ প্রজনন), বিএআরআই, গাজীপুর। ই-মেইল : mhasan.bari12@gmail.com
বিস্তারিত
মিষ্টি আলুর চাষ
মিষ্টি আলু বাংলাদেশের একটি অবহেলিত ফসল হলেও গণচীন, পাপুয়া নিউগিনি এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এটি মানুষের প্রধান খাদ্য। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে এটি আলুর চেয়ে বেশি দামে বিক্রয় হয়। মিষ্টি আলুর পুষ্টিগুণ/খাদ্যমান, বাজারদর, সবজি এবং গোখাদ্য হিসেবে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। এফএও’র হিসাব অনুযায়ী সারা বিশে-এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল।

মিষ্টি আলুর গাছ একটি লতানো বিরুৎ। বৈজ্ঞানিক নাম Ipomeoa batatas. ইহা Convolvulaceac পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ইংরেজিতে একে Sweet Potato বলে। গ্রীষ্ম প্রধান জলবায়ুতে এটি দীর্ঘজীবী, একবার লাগালে বছরের পর বছর বেঁচে থাকে। রবি মৌসুমে মিষ্টি আলু চাষ লাভজনক। খরিফ মৌসুমে সবজি/শাক/গোখাদ্য হিসেবে চাষ করা লাভজনক।

জাত : বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা জাতের মিষ্টি আলুর চাষ হয়। স্থানীয় জাতের চেয়ে উন্নত জাতের ফলন অনেক বেশি। তৃপ্তি ও কমলা সুন্দরী জাত দুইটি উচ্চফলনশীল। যার ফলন হেক্টরপ্রতি ৩০-৪০ টন। জাতের কা- বেগুনি, পাতা গাঢ় সবুজ, ফল মূল সাদা, শাঁস হালকা হলুদ। এতে সামান্য পরিমাণ ক্যারোটিন আছে।

লতা/কাটিং প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ও কৃষি গবেষণা উপকেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব খামার, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের বিভিন্ন নার্সারিতে যোগাযোগ করতে পারেন।

চাষ পদ্ধতি  
স্থান ও মাটি : সারা দিন সূর্যের আলো পড়ে এরকম দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি মিষ্টি আলু চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। নদীর তীরের পলি মাটিতে এ আলু সবচেয়ে ভালো হয়।

কাটিং/লতা লাগানোর সময় : মধ্য অক্টোবর হতে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত লাগানোর উপর্যুক্ত সময়।
জমি তৈরি : জমি গভীর করে কর্ষণ করা উচিত। এজন্য বার বার চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুর করে বড় ঢেলা ভেঙে দিতে হয়। এতে মিষ্টি আলুর বাড় বাড়তি ভালো হয়।

চারা কাটিং/লতা লাগানো : প্রতি খণ্ড ২৫-৩০ সেমি. লম্বা হওয়া উচিত। আগার খণ্ড (অগ্রীয় কুঁড়িসহ) সবচেয়ে বেশি ফলন দেয়। আগার খণ্ড পাাওয়া গেলে মাঝখানের খণ্ড না লাগানোই উচিত। বেশি বয়স্ক খণ্ড বীজ/কাটিং হিসেবে ব্যবহার বর্জনীয়। মাঝখানের খণ্ড লাগানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে গোড়ার দিক মাটিতে পোঁতা হয়।

সারি থেকে সারি ৬০ সেমি., কাটিং থেকে কাটিং ৩০ সেমি. (উন্নত জাতের বেলায়) দূরত্বে লতা রোপণের জন্য প্রতি হেক্টরে কাটিং লাগে- ৫৫,৫৫৫টি, বিঘায় লাগে ৭,৭০৫টি। কাটিংয়ের ২/৩টি আক বা গিঁট মাটির নিচে থাকতে হবে ৩-৪ সেমি. গভীরে সমান্তরালভাবে শুইয়ে দিয়ে উপরের অংশ বাঁকিয়ে খাঁড়া করে দিতে হবে। রোপণের সময় আবহাওয়া শুকনো হলে কয়েকটি পাতা ছাঁটাই করে দিতে হবে। রস না থাকলে কাটিং/চারার গোড়ায় পানি দিতে হবে।

সার প্রয়োগ : আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকই মিষ্টি আলু চাষে কম পরিমাণ সার প্রয়োগ করেন। কাক্সিক্ষত ফলন পেতে হলে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। সারের মাত্রা হেক্টরপ্রতি গোবর ১০ টন, ইউরিয়া ১৪০ কেজি, টিএসপি ১০০ কেজি ও পটাশ ১৫০ কেজি।
কোন জমিতে সালফার ও দস্তার অভাব থাকলে প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার করতে হবে।

পানি সেচ : মিষ্টি আলু হচ্ছে খরা প্রতিরোধ সম্পন্ন ফসল। তাই সাধারণত সেচের কম। প্রয়োজনে সেচ দেয়া যেতে পারে।

পরিচর্যা : মিষ্টি আলুর ক্ষেত লতা দিয়ে পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে হবে।

ফসল : ১৫০ দিনের মাথায় ফসল সংগ্রহ করা হয়। তবে মার্চ মাসের মধ্য ফসল সংগ্রহ করা উচিত। হেচ্কা টান দিয়ে কন্দমূল লতা থেকে লতা আলাদা না করে ধারালো চাকু দিয়ে কেটে সংরক্ষণ করলে রোগাক্রান্ত হবে না।

হেক্টরপ্রতি ফলন : সাধারণ ২০-৫০ টন। তৃপ্তি স্থানভেদে ৮০ টন ফলন হয়। ইহা নির্ভর করে জাত বা চাষ পদ্ধতি, মাটির অবস্থা ও আবহাওয়ার ওপর।

পোকামাকড় ও রোগ : এ আলুর রোগবালাই খুবই কম, উইভিল নামক একটিমাত্র পোকা ছাড়া অন্যান্য পোকা ও রোগ গৌণ। এদের ক্ষতি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।

কাণ্ড ও কন্দমূলের শাঁস খেতে খেতে সুরঙ্গ/গর্ত করে পোকা থেকে ডিম ও বিষাক্ত পদার্থ বের হয়। যার ফলে  আক্রান্ত কন্দমূল খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। যেখানে বর্ষাকালে প্লাবিত হয় সেখানে এ পোকার উপদ্রব কম। শস্য পর্যায়ে অবলম্বনসহ হেক্টরপ্রতি ৫ কেজি হেপ্টাক্লোর অথবা ১৫ কেজি ফুরাডান প্রয়োগ করলে ভালো ফলনও পাওয়া যায়।

মিষ্টি আলু সংরক্ষণ : এ আলু সংরক্ষণ প্রক্রিয়া অনেকটা গোল আলুর স্থানীয় পদ্ধতির মতোই। ফ্রেস/ক্ষত/কাটাহীন আলু সংরক্ষণ করতে হবে। গুদামে রাখার আগে কন্দমূল ছায়ায় বিছিয়ে লতাপাতা দিয়ে কয়েক দিন ঢেকে রাখলে ভালো হয়।

পুষ্টি মূল্য : ইহা একটি স্টার্চ প্রধান খাদ্য, এজন্য প্রধান খাদ্য চালও গমের বিকল্প হিসেবে খাওয়া চলে। মিষ্টি আলুর পাতা একটি পুষ্টিকর শাক। যা সারা বছর পাওয়া যায়। তাছাড়া মিষ্টি আলু/লতা একটি উৎকৃষ্ট গোখাদ্য। (পুষ্টি উপাদান নিচের ছকে দেখুন)।

ব্যবহার : সিদ্ধ ও পুড়িয়ে খাওয়া যায়। সবজি হিসেবে কন্দমূল, পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়। পাতলা স্লাইসে সিদ্ধ করে রৌদ্রে শুকিয়ে পরে তেলে ভেজে ক্র্যাকার্স হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বরিশাল এলাকায় চিংড়ি ও ইলিশ মাছ সহযোগে এ তরকারি খুবই জনপ্রিয়। ভর্তা করেও খাওয়া যায়।

আমাদের করণীয় : আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা খাবার খাই দেহ রক্ষার জন্য। রসনা তৃপ্তির জন্য নয়। সুতরাং কৃষক ভাইসহ সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের অবহেলিত ফসলটি চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে নিজ দায়িত্ববোধ থেকে আরও এগিয়ে আসতে হবে যাতে আমাদের কৃষক ভাইরা অল্প পুঁজি ও কম ঝুঁকিপূর্ণ মিষ্টি আলু চাষের মাধ্যমে স্থায়ী কৃষিসহ আত্মসামাজিক উন্নয়নে একটি ইতিবাচক ফলাফল রাখতে পারে।

মিষ্টি আলুর কন্দমূল ও পাতা, গোল আলু এবং চালে পুষ্টির বিভিন্ন উপাদানের পরিমাণ (প্রতি ১০০ গ্রামে)

পুষ্টি উপাদান   কন্দমূল    পাতা    গোলআলু    চাল
পানি        ৭৫.০    ৮৫.০    ৭৮.০    ১৩.০
শ্বেতসার   ২৩.০    ১০.০    ১৯.৪    ৭৭.০
আমিষ      ১.২      ৪.০    ২.০    ৭.৫
স্নেহ          ০.২     ০.৮    ০.১    ২.০
ক্যারোটিন (আঃ ইউ) ৬০০০    ১০০০    নগণ্য    নগণ্য
থায়ামিন মিলিগ্রাম     ০.০৮    ০.০৭    .১১    ০.৩৬
রাইবোফ্লোবিন           ০.০৪    ০.২    ০.০২    ০.০৪
নায়াসিন                   ০.৬    ১.৫    ০.৫    ৩.৮
লৌহ                        ০.৮    ১০.০    ০.৯    ১.৪


 
মুঃ আবদুল লতিফ ছিদ্দিকী*
* উপসহকারী কৃষি অফিসার, উপজেলা কৃষি অফিস, মতলব দক্ষিণ, চাঁদপুর, মোবাইল নং- ০১৭১৪৫০১০২৭
বিস্তারিত
মৎস্য হ্যাচারি ও নার্সারিতে রোগ সংক্রমণে করণীয়
অধুনা বাংলাদেশে আশাতীত দ্রুত গতিতে উন্নত প্রযুক্তির মৎস্য চাষের সম্প্রসারণ ঘটছে। পাশাপাশি মাছ চাষের জন্য মানসম্পন্ন পোনা প্রাপ্তিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি  বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্মর্তব্য যে, নব্বই দশকের শুরু থেকে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে বিপুল সংখ্যক মৎস্য হ্যাচারি গড়ে উঠে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৭৬টি সরকারি ও ৮৪৫টি বেসরকারিসহ মোট ৯২১টি মৎস্য হ্যাচারি এবং ১০,৪০২টি নার্সারি রয়েছে। লক্ষণীয় যে, এসব হ্যাচারি ও নার্সারিতে রোগ সংক্রমণ এখন প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে এবং নানা রোগে আক্রান্ত পোনার মৃত্যু ত্বরান্বিত হচ্ছে, যা নিয়ে খামারি ও পোনা চাষিদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
 
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, অন্যান্য প্রাণির মতোই শরীরের ইমিউনসিস্টেম মাছের রোগ প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ইমিউনসিস্টেম পানিতে বিরাজমান রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে অবিরত যুদ্ধ করে মাছকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
 
হ্যাচারি ও নার্সারিতে পোনা স্বভাবতই নাজুক অবস্থায় থাকে, ফলে অপরিপক্ব ইমিউনসিস্টেমের কারণে তারা অতিসহজেই নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া, রোগাক্রান্ত হ্যাচারি থেকে যেসমস্ত পোনা চাষের পুকুরে স্থানান্তর করা হয় তারা সেখানে রোগজীবাণু বহন করে নিয়ে আসে, যা পুকুরে মজুদকৃত মাছের পোনার অনিবার্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
 
মাছের হ্যাচারি ও নার্সারিতে সাধারণত (১) ছত্রাকজনিত রোগ (২) ভাইরাসজনিত রোগ (৩) ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ (৪) পরিবেশজনিত  রোগ (৫) পরজীবী ঘটিত রোগ (৬) মিক্সো সম্পরিডিয়াসিস (৭) উকুনজনিত রোগ (৮) ট্রাইকোডিনিয়াসিস ও (৯) কৃমিজাতীয় রোগ সংক্রমণ হয়ে থাকে।
 
ছত্রাকজনিত রোগ : ছত্রাক জনিত রোগে প্রধানত মাছের ডিম ও রেণু আক্রান্ত হতে দেখা যায়। হ্যাচারিতে ডিম স্ফুটনের সময় ছত্রাকের সংক্রমণ জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে। প্রথমে ছত্রাকগুলো মৃত ও অনিষিক্ত ডিমগুলোর শরীরে পাকা পোক্ত স্থান করে নেয় এবং ধীরে ধীরে সুস্থ সবল ডিমগুলোর ওপর ছড়িয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে সমুদয় ডিমই ধ্বংস করে দেয়।
 
ডিম ধৌত করে, নষ্ট ও অনিষিক্ত ডিমগুলো সরিয়ে পানির প্রবাহ বাড়িয়ে এবং ডিমের ঘনত্ব হ্রাস করে হ্যাচারিতে এ রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে। অ্যালাকাইট গ্রিন হচ্ছে ছত্রাক জনিত রোগের সর্বোত্তম ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা।
 
হ্যাচারিতে লালনকৃত ডিমগুলোকে ২৫০ পিপিএম ফরমালিন দিয়ে ধুয়ে অথবা আক্রান্ত মাছগুলোকে শতকরা ৩-৫ ভাগ ফরমালিন দিয়ে ২-৩ মিনিট গোসল দেয়া যেতে পারে। এছাড়া অ্যালাকাইট গ্রিন ০.১৫-০.২০ পিপি এম হারে পুকুরে প্রতি সপ্তাহে একবার করে ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রয়োগ করা হলে আশাব্যঞ্জক ফলাফল পাওয়া যায়।
 
ভাইরাসজনিত রোগ : গ্রাস কার্প হেমোরেজিক ভাইরাস চাইনিজ কার্পের পোনার মৃত্যুর জন্য দায়ী এ বিষয়ে নানা সূত্রে নির্ভরশীল তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া, টক হারপিস ভাইরাস নামক এক ধরনের ভাইরাস কমনকার্প ও কৈ কার্পের রোগ সৃষ্টি করে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সূত্র থেকে জানা গেছে, ভাইরাস জনিত রোগের মূলত কোনো চিকিৎসা নেই। একমাত্র পরিচ্ছন্নতা ও জৈব নিরাপত্তা পদ্ধতির নিয়মিত অনুসরণই হচ্ছে ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
 
ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ : বিভিন্ন প্রকার ব্যাকটেরিয়া যেমন, Motile, Aeromonas  ও Vibrio প্রায়শ মাছের হ্যাচারি ও নার্সারির পোনার মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকে। এসব ব্যাকটেরিয়া প্রাথমিক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু অথবা সুবিধাবোগী অনুপ্রবেশকারী জীবাণু হিসেবে রোগ সৃষ্টি করে। লেজ পচা ও পাখনাপচা জাতীয় রোগগুলো সাধারণত উল্লিখিত বিভিন্ন প্রজাতির জীবাণু দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। কার্পজাতীয় মাছের পোনার জন্য Aeromonas hydrophila ঘটিত ব্যাকটেরিয়াল হেমোরেজিক সেপটি সেমিয়া একটি গুরুতর সমস্যা।
 
পানির গুণাগুণ নষ্ট হওয়া, তাপমাত্রার তারতম্য, জৈব দূষণ এবং অধিক মজুদ ঘনত্ব মাছের পোনায় ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ব্যাকটেরিয়া বিশেষ করে পোনার পেটফোলা রোগের জন্য আক্রান্ত পুকুরে ৫ পিপিএম হারে পটাশ প্রয়োগ করে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যায়। এছাড়া খাবারের সাথে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ৫০-৬০ মি.গ্রা/ প্রতি কেজি মাছের ওজনের জন্য ১০দিন পর্যন্ত দেয়া যেতে পারে। এ ওষুধ ব্যবহারের ২৫ দিনের মধ্যে মাছ আহরণ করা মোটেই সমীচীন নয়।
 
পরিবেশজনিত রোগ : পুকুরে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের মাত্রাতিরিক্ত দ্রবণ এবং পুকুরের তলায় অধিক জৈব পদার্থের উপস্থিতির কারণে মাছের পোনা গ্যাস বাবল রোগের কবলে পড়তে পারে। নার্সারি পুকুরে মাঝে মধ্যে হাঁস পোকার আক্রমণ এবং হ্যাচারিতে অজ্ঞাত কারণে ব্যাপক হারে রেণু ও পোনার মৃত্যুর সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এছাড়া কোনো কোনো সময় অত্যধিক ঠাণ্ডা ও অক্সিজেন  স্বল্পতায় আকস্মিকভাবে রেণু মৃত্যুর সিকার হতে পারে।
 
পরজীবী ঘটিত রোগ : ইকবায়োপথিরিয়াসিস নামক এককোষী পরজীবী এ রোগ সৃষ্টি করে। এটিকে সাদা দাগ রোগও বলা হয়। কার্পজাতীয় মাছের পোনার ক্ষেত্রে ও রোগ সংক্রমণের তীব্রতা অধিক। এ রোগের ফলে মাছের পাখনা, ত্বক ও ফুলকায় সাদা সাদা দাগ দেখা যায়। পুকুরে অতিরিক্ত পোনা মজুদ এ রোগের অন্যতম সহায়ক কারণ। এ রোগ প্রতিরোধে আক্রান্ত পুকুরে পোনা না ছাড়াই উত্তম। পরজীবী আক্রান্ত পুকুরে ম্যালরাকাইট গ্রিণ, পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেট ও সোডিয়াম ক্লোরাইড দ্বারা এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব। আক্রান্ত মাছকে ম্যালাকাইট গ্রিণের ০.১৫-০.২০ পিপিএম দ্রবণে প্রতিদিন ১ ঘণ্টা করে ২/৩ দিন গোসল করালে সুফল পাওয়া যায়।
 
মিক্সোসম্পারিডিয়াসিস : মিক্সোবোলাস গণের কয়েকটি প্রজাতির সংক্রমণের কারণে এ রোগের উৎপত্তি হয়। পরজীবীগুলোর পূর্ণবয়স্ক স্পোর এ রোগের মূল কারণ হিসেবে মৎস্য বিজ্ঞানীরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সাধারণত কার্পজাতীয় মাছের পোনা এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আক্রান্ত মাছ পুকুর থেকে সরিয়ে ফেলা এবং পুকুর জীবাণু  মুক্তকরণ এ রোগ নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক ফলপ্রসূ পন্থা। মহুয়া খৈল দ্বারা চিকিৎসা করা হলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগে পানির অম্লত্ব দূরীভূত হয়। এ প্রক্রিয়ায় এক পর্যায়ে পরজীবীগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় এবং মাছে সুস্থতা ফিরে পায়।
 
উকুনজনিত রোগ : এ জাতীয় পরজীবী আঙ্গুলে ও বড় মাছসহ সব ধরনের মাছেরই ক্ষতিসাধন করে। নার্সারি পুকুর, লালন পুকুর ও মজুদ পুকুরে এ পরজীবীগুলোর ব্যাপক সংক্রমণ ঘটতে দেখা যায়। এ জাতীয় বহুকোষী পরজীবী দ্বারা সংঘটিত একটি প্রধান রোগের নাম আরগুলোসিস। এ পরজীবীকে মাছের উকুনও বলা হয়। এ রোগ প্রতিরোধে সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে পুকুরে পরজীবীটিকে ঢুকতে না দেয়া। এছাড়া আক্রান্ত পুকুরে বাঁশের খুঁটি পুতে রাখা যেতে পারে। যেখানে এরা ডিম নিঃসরণ করবে। কিছু দিন পর পর ডিমগুলো তুলে এনে ধ্বংস করে আরগুলোসিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আক্রান্ত পুকুরে ০.৫ পিপিএস হারে ডিপটারেক্স সপ্তাহে একবার করে পাঁচ সপ্তাহ অথবা সুমিথিয়ন ০.৮ পিপিএস হারে একই মেয়াদে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
 
ট্রাইকোডিনিয়াসিস : এটি একটি এককোষী পরজীবী দ্বারা সংঘটিত রোগ। ধানী পোনা ও আঙ্গুলে পোনার ক্ষেত্রে এ রোগের প্রয়োগ অত্যধিক। অপেক্ষাকৃত ছোট ও অগভীর জলাশয়ে এবং দূষিত পানিবাহিত পুকুরে এ রোগের দ্রুত সংক্রমণ ঘটে। নার্সারি পুকুরে অধিক সংখ্যক পোনার মজুদ এ রোগের একটি অন্যতম সহায়ক কারণ। এ রোগ প্রতিরোধে পানির গুণাগুণ সমুন্নত রাখার পাশাপাশি পোনার ঘনত্ব হ্রাস করা অত্যাবশ্যক। এছাড়া আক্রান্ত মাছকে ২৫০ পিপিএম ফরমালিনে ৩-৫ মিনিট গোসল দেয়া অথবা পুকুরে ৪ পিপিএম হারে পটাশ প্রয়োগ করে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। উপরন্ত মাছকে শতকরা ২-৩ ভাগ লবণ পানিতে কয়েক মিনিটের জন্য গোসল করালে এ রোগে প্রতিকার আশা করা যায়।
 
কৃমিজাতীয় রোগ : এই পরজীবীগুলো মূলত মাছের পাখনা, ফুলকা ও ত্বকে আক্রমণ করে। নার্সারি পুকুরে এ রোগ অতিদ্রুত বৃদ্ধি পায়।
অপরপক্ষে কৃমির আক্রমণে ত্বক ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে। ত্বকে বিন্দু বিন্দু রক্তক্ষরণ হয়। কার্পজাতীয় মাছের ৪-৫ গ্রাম ওজনের পোনায় এ রোগের আক্রমণ বেশি লক্ষ করা যায়।

কৃমিজাতীয় পরজীবী ঘটিত রোগের চিকিৎসার জন্য আক্রান্ত গাছকে ২৫০ পিপিএম ফরমালিন দ্রবণে গোসল করালে সন্তোষজনক ফল পাওয়া যায়। এছাড়া আক্রান্ত পুকুরে ১০-২০ পিপিএম হারে পটাশ প্রয়োগ করা যেতে পারে।

 
মাছের হ্যাচারি ও নার্সারিতে মাছের পোনার রোগ প্রতিরোধে করণীয়
(১) উৎপাদনের শুরুতে এবং চলমান সময়ে সব হ্যাচারি ইউনিট এবং সরঞ্জামাদি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করণ।
(২) নার্সারি পুকুর ও ব্রুড রাখার পুকুর নিয়মিত জীবাণূ মুক্ত করণ।
(৩) নিষিক্ত ডিম ও পোনাগুলোকে জীবাণুমুক্ত করণ।
(৪) গুণগতমান সম্পন্ন, দূষণ ও রোগজীবাণুমুক্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ।
(৫) সুষম ও জীবাণুমুক্ত খাদ্য সরবরাহ করা।
(৬) রোগের চিকিৎসার জন্য যথেচ্ছ-ড্রাগ ব্যবহার না করা।
(৭) মৃত ও অসুস্থ মাছ যথাশিগগিরর সরিয়ে ফেলা।
(৮) মাছ খাদক রাক্ষুসে প্রাণী নিয়ন্ত্রণ করা।
 
উল্লেখ্য যে, রেণু উৎপাদনের প্রায় ৯৯% আসে হ্যাচারি থেকে, পাশাপাশি নার্সারিতে উৎপাদিত হচ্ছে ৮২ হাজার লাখেরও অধিক পোণা। এরই প্রেক্ষাপটে নির্দ্বিধায় আশা করা যায়, হ্যাচারি ও নার্সারিতে উৎপাদিত রেণুও পোণা রোগমুক্ত রাখা সম্ভব হলে মাছের সার্বিক উৎপাদনও বেড়ে যাবে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে।
 
পরিশেষে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মাছ ও পোনার রোগ-ব্যাধি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়, সমাজে বহুল প্রচলিত এ প্রবাদ সর্বদাই চাষিদের মন মানসিকতায় লালন করতে হবে।
 
দলিল উদ্দিন আহমদ
* অবসরপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা, প্রযত্নে-মনি ফার্মেসি, ফতুল্লা রেলস্টেশন সংলগ্ন, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ, মোবাইল নং ০১৭২৪০৫০৪০৩
বিস্তারিত
গবাদি পশু-পাখির শীতকালীন রোগবালাই ও প্রতিকার

আসছে শীতকাল। এ সময় গরু ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ অন্যান্য গবাদিপশু-পাখির নানান রকমের রোগবালাই হয়ে থাকে। গবাদিপশু পাখির শীতকালীন কিছু কমন রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. প্রিয় মোহন দাস।

 
গামবোরো রোগ
গামবোরো একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এ রোগে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে ব্রয়লার, কক, সোনালী ও লেয়ার মুরগি মারা যায়। তাই এ রোগের মুরগির মৃত্যুর পাশাপাশি আক্রান্ত ফ্লক ইম্যুনোসাপ্রেশনে ভোগে। আর তাই এ রোগকে মুরগির এইডস বলা হয়। আর এ ধরনের ফ্লক থেকে কখনই আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায় না।
 
রোগের লক্ষণ
গামবোরো রোগের কিছু কমন লক্ষণ হলো পানি না খাওয়া, খাদ্য না খাওয়া, পাতলা পায়খানা হওয়া ইত্যাদি।
 
চিকিৎসা ও প্রতিকার
এন্টিবায়োটিক হিসেবে সিপ্রোফ্লক্সাসিন ১০% ব্যবহার করা যায়। এটি রক্তে তাড়াতাড়ি মিশে আর শরীরে থাকেও দীর্ঘক্ষণ। ফলে দ্রুত কাজ শুরু হয়ে যায়। ১ লিটার পানিতে ১ মিলি পরপর ৩-৫ দিন সবসময়ের জন্য পানিতে দিতে হবে। যে কোনো ভালো অর্গানিক এসিড কোম্পানি নির্দেশিত মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্গানিক অ্যাসিডগুলো কিডনি হতে ইউরেট দূর করতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে ভিনেগার ব্যবহার করা যায়।
 
গলাফুলা রোগ
গলাফুলা (hemorrhagic septicemia) এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপের কিছু দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যমান। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটি বেশি পরিলক্ষিত হয়। গলাফুলা একটি তীব্র প্রকৃতির রোগ যা গরু এবং মহিষকে আক্রান্ত করে। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, যা Pasteurella multocida দ্বারা সংঘটিত হয়। এ রোগে মৃত্যুর হার খুবই বেশি।
 
পশুর শরীরে স্বাভাবিক অবস্থায় এ রোগের জীবাণু বিদ্যমান থাকে। কোনো কারণে যদি পশু ধকল যেমন ঠাণ্ডা, অধিক গরম, ভ্রমণজনিত দুর্বলতা ইত্যাদির সম্মুখীন হয় তখনই এ রোগ বেশি দেখা দেয়। গলাফুলা রোগের প্রচলিত নাম ব্যাংগা, ঘটু, গলগটু, গলবেরা ইত্যাদি।
 
রোগের লক্ষণ
এ রোগ অতি তীব্র ও তীব্র এ দুইভাবে হতে পারে।
অতি তীব্র প্রকৃতির রোগে হঠাৎ জ্বর হয়ে মুখ ও নাক দিয়ে তরল পদার্থ বের হতে থাকে। পশু অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু ঘটে। তীব্র প্রকৃতির রোগে আক্রান্ত পশু ২৪ ঘন্টার অধিক বেঁচে থাকে। এ সময় পশুর এডিমা দেখা দেয় যা প্রথমে গলার নিচে, পরে চোয়াল, তলপেট এবং নাক, মুখ, মাথা ও কানের অংশে বিস্তৃত হয়।
 
গলায় স্ফীতি থাকলে গলার ভেতর ঘড় ঘড় শব্দ হয়, যা অনেক সময় দূর থেকে শোনা যায়। প্রদাহযুক্ত ফোলা স্থানে ব্যথা থাকে এবং হাত দিলে গরম ও শক্ত অনুভূত হয়। মুচ দিয়ে ছিদ্র করলে উক্ত স্থান হতে হলুদ বর্ণের তরল পদার্থ বের হয়ে আসে। অনেক সময় কাশি হয় এবং চোখে পিচুটি দেখা যায়। নাক দিয়ে ঘন সাদা শ্লেষ্মা পড়তে দেখা যায়। সাধারণত লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আক্রান্ত পশু মারা যায়।
 
চিকিৎসা ও প্রতিকার
আক্রান্ত পশুর চিকিৎসায় বিলম্ব হলে সুফল পাওয়া যাবে না। তাই রোগের উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এ রোগের চিকিৎসায় Ampicillin, Tetracycline, Erythromycin, Sulphonamide জাতীয় ইনজেকশন গভীর মাংসে দিয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 
এ রোগ উচ্ছেদ করা অসম্ভব কারণ এ রোগের জীবাণু স্বাভাবিক অবস্থায় পশুর দেহে থাকে। তবে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
  • রোগাক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করে সুস্থ পশুকে টিকা দানের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • মড়কের সময় পশুর চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
  • হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পশুর পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

ক্ষুরারোগ
এটি ভভইরাসজনিত একটি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি। দুই ক্ষুরওয়ালা সব প্রাণীই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া এ রোগের শিকার হয় বেশি। বাতাসের সাহায্যে এ রোগের ভাইরাস দূরবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।
 
রোগের লক্ষণ
  • প্রথম অবস্থায় শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
  • মুখ দিয়ে লালা ঝরে এবং লালা ফেনার মতো হয়। পশু খেতে পারে না এবং ওজন অনেক কমে যায়।
  • দুগ্ধবতী পশুতে দুধ অনেক কমে যায়। বাছুরের ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দেয়ার আগেই বাছুর মারা যেতে পারে।

চিকিৎসা ও প্রতিকার
আক্রান্ত প্রাণীর মুখ ও পায়ের ঘা পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট মেশানো পানি বা খাওয়ার সোডা মেশানো পানি দিয়ে দিনে ৩-৪ বার ধুয়ে দিতে হবে। ওষুধ মেশানো পানি দিয়ে ক্ষতস্থান ধোয়ার পরে সালফা নিলামাইড বা এ ধরনের পাউডার লাগাতে হবে। চার ভাগ নারকেল তেলের সাথে ১ ভাগ তারপিন তেল মিশিয়ে লাগালে ক্ষতস্থানে মাছি পড়বে না।
 
গরুর বাদলা রোগ
বাদলা রোগ গরুর ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ। ক্লস্ট্রিডিয়াম শোভিয়াই নামক ব্যাকটিরিয়া জীবাণু এ রোগের প্রধান কারণ-
 
রোগের লক্ষণ
  • তীব্র রোগে প্রথমে জ্বর হয় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পেছনের অংশে মাংসপেশি ফুলে যায়।
  • ফোলা জায়গায় চাপ দিলে পচ পচ শব্দ হয়।
  • আক্রান্ত অংশ কালচে হয়ে যায় ও পচন ধরে।
  • রোগাক্রান্ত প্রাণী দুর্বল হয়ে মারা যায়।

চিকিৎসা ও প্রতিকার
অ্যান্টিব্লাকলেগ সিরাম প্রতিটি আক্রান্ত পশুর শিরা বা ত্বকের নিচে ১০০-২০০ মিলিলিটার ইনজেকশন দিতে হবে (যদি পাওয়া যায়)  অ্যান্টিহিসটামিনিক জাতীয় ইনজেকশন যেমন- হিস্টাভেট, ডিলারজেন, ফ্লুগান ইত্যাদি দৈনিক ৬ সি.সি. করে ৩ দিন মাংসে ইনজেকশন দিতে হবে। প্রয়োজনে আক্রান্ত ক্ষতস্থান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পরিষ্কার করে টিংচার আয়োডিন গজ প্রয়োগ করতে হবে।
আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। মৃত পশুকে মাটির নিচে কলিচুন সহযোগে পুঁতে ফেলতে হবে। জীবাণুনাশক দিয়ে গোয়ালঘর পরিস্কার করতে হবে।

ফ্যাসিওলিয়াসিস রোগ
গবাদিপশুর যকৃতে ফ্যাসিওলা জাইগানটিকা ও ফ্যাসিওলা হেপাটিকা নামক পাতাকৃমি দ্বারা সৃষ্ট পশুর রোগকে ফ্যাসিওলিওসিস বলে। রক্তস্বল্পতা, ম্যান্ডিবুলের নিচে পানি জমা, যা দেখতে বোতলের মতো, ডায়রিয়া এবং ধীরে ধীরে কৃশকায় অবস্থায় পরিণত হওয়াই এ রোগের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে প্রায় ২১ ভাগ গরুতে এবং সিলেট অঞ্চলে প্রায় ২১.৫৪ ভাগ ছাগলে ফ্যাসিওলা জাইগানটিকা পাতাকৃমিতে হয়।
 
রোগের লক্ষণ
  • আক্রান্ত পশুর যকৃতে অপ্রাপ্তবয়স্ক কৃমির মাইগ্রেশনের ফলে যকৃত কলা ধ্বংস হয় এবং যকৃতিতে প্রোটিন সংশ্লেষণ হ্রাস পায়। এতে পশুর হাইপোপ্রিটিনিমিয়া তথা বটল জ্বর হয়।
  • বদহজম ও ডায়রিয়া দেখা দেয়। ক্ষুধামন্দা ও দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। চোখের কনজাংটিভা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
  • তীব্র যকৃত প্রদাহ এবং রক্তক্ষরণের ফলে লক্ষণ প্রকাশের আগেই পশুর হঠাৎ মৃত্যু ঘটে।

চিকিৎসা ও প্রতিকার
ট্রাইক্লেবেন্ডাজল বোলাস প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ থেকে ১৫ মিলিগ্রাম করে আক্রান্ত পশুকে খাওয়ালে ৯০ থেকে ১০০ ভাগ সুফল পাওয়া যায়। নাইট্রোক্সিলিন ইনজেকশন প্রতি ৫০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১.৫ মিলিলিটার হিসেবে গরু, মহিষ ও ছাগলের ত্বকের নিচে প্রয়োগ করে কার্যকরি ফল পাওয়া যায়। সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে দুর্বলতা ও রক্তস্বল্পতার জন্য ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ইনজেকশন দেয়া এবং মিনারেল মিকচার খাওয়ানো ভালো। পশুকে সন্দেহজনক স্থান যেমন নিচু জায়গা বা ড্রেনের পাশে ঘাস খাওয়ানো থেকে বিরত রাখতে হবে।

তড়কা রোগ
তড়কা গবাদিপশুর একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ। গবাদিপশু থেকে এ রোগে মানুষেও ছাড়ায়। এ রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত খাদ্য খেয়ে বিশেষ করে নদী-নালার পানি ও জলাবদ্ধ জায়গার ঘাস খেয়ে গবাদিপশু অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়।
 
রোগের লক্ষণ
  • দেহের লোম খাড়া হয়। দেহের তাপমাত্রা ১০৬-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়।
  • নাক, মুখ ও মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। পাতলা ও কালো পায়খানা হয়।
  • লক্ষণ প্রকাশের ১-৩ দিনের মধ্যে পশু ঢলে পড়ে মারা যায়।

চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
পেনিসিলিন/বাইপেন ভেট/জেনাসিন ভেট/ এম্পিসিন ভেট ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও স্ট্রেপটোমাইসিন/এন্টিহিস্টাভেট ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে। সুস্থ পশুকে সর্বদা পৃথক রাখতে হবে। মৃতপশুর মল, রক্ত ও ম্রৃতদেহ মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে।
 
মো. আব্দুর রহমান*
* শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২, মোবা: ০১৭৫৫-২৪৬৬৮৯
বিস্তারিত
কবিতা অগ্রহায়ণ-১৪২১
ভেজাল সার
মূয়ীদুল হাসান*
আছে সবার জানা
সার গাছের খাবার
বাড়-বাড়তি আর  ফলন বাড়াতে
যা ষোলো আনাই দরকার।
হরেকরকম খাবার যেমন
হরেকরকম সার।
পুষ্টি জোগায় গাছের দেহে
 যেমন আছে যার।
খাবারের যেমন ভেজাল এখন
সারেও আছে তেমন,
সহজ কিছু পরীক্ষাতেই
ধরা যায় তা কেমন।
সাদা সার ইউরিয়ার ভেজালে
 মেশায় ছোট-বড় দানা,
সহজ একটি পরীক্ষাতেই বুঝি
এতে ভেজাল আছে কিনা।
এক চামচ ভালো ইউরিয়াতে নিলে তিন চামচ পানি
সহজেই তার দ্রবণ হবে আমরা সবে জানি।
পাত্রের গায়ে হাত দিলে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে
চুন মেশানো থাকলে ভাতে ঝাঁঝালো গন্ধ জাগে।
টিএসপি আর এসএসপি
দেখতে একই রকম
টিএসপির ভেজালে তাই
এসএসপি থাকে বেশি কম।
টিএসপি নাকি এসএসপি
বুঝব কেমন করে
এজন্য সার দু’আঙুলে নিয়ে
চাপতে হবে জোরে।
 ভেঙে গেলে এসএসপি আর
না ভাঙলে টিএসপি সার,
ডাবের পানির রঙ ধরে
আধা গ্লাস পানিতে তার।
এসএসপি মেশানো হলে ঘোলা দ্রবণ করে
সারে ভেজাল ঠিকই আছে, তলানি যদি পড়ে।
ডিএপিতে টিএসপি বা এসএসপি সার মেশায়
মাটিও রঙ করে বেচে ঠকিয়ে লাভের আশায়।
 খোলা কাগজে ঘণ্টাখানেক বা মুঠোর ভেতর নিলে
ভিজে উঠবে সহজেই তা সঠিক সার হলে।
কয়েক দানা ডিএপি চামচে নিয়ে
ধরলে মোমের শিখায়
বুঁদবুঁদ হয়ে উয়ে গিয়ে
চামচে সাদা আঁচড় দেখায়।
আরও একটি সার এমওপির রঙ হলো লাল
লাল বালু, কাঁচ, ইটের গুঁড়া মিশিয়ে করে ভেজাল।
হাতের মুঠোয় ঘষলে পরে তার লাল রঙ করে
এক চামচ আধা গ্লাস জলে গুঁড়ার তলানি পড়ে।
আসল সার জিপসাম সাদা পাউডারের মতো
 ভেজা হলেই বুঝতে হবে ভেজাল আছে যত।
এক চামচ জিপসামে নিলে দশ ফোঁটা হাইড্রোক্লোরিক
বুঁদবুঁদ হলেই বুঝতে হবে সার নাই সঠিক।
ভেজাল জিংকে থাকতে পারে খাবারের লবণ
সঙ্গে আরও থাকতে পারে জিপসামের মিশ্রণ।
আসল জিংক মনোহাইড্রেট, ভেজালে জিংক হেপ্টা
মনোহাইড্রেট হলো দানাদার হেপ্টা সার চ্যাপ্টা।
 হেপ্টাহাইড্রেট পানিতে স্বচ্ছ দ্রবণ করে
মনোহাইড্রেটে পানির নিচে তলানি পড়ে।
বরিক এসিড বা সলুবর বোরণের আরেক নাম
 ভেজালে মেশায় কমদামি সালফেট বা জিপসাম
স্বচ্ছ সাদা মিহি পাউডার এই সার বোরণ
আধা গ্লাসের এক চামচে দেয় স্বচ্ছ দ্রবণ।
সার যত ভেজাল তত
তাই চিনতে হবে সঠিক সার,
সঠিক সময়ে সঠিক সার দিলে
চিন্তা নাই আর।
সহজ উপায়ে ভেজাল যত
সার চিনলে তবে
বাঁচবে টাকা বাড়বে ফলন
কষ্ট সফল হবে।

বাংলাদেশের চাষি
মো. আমীরুল ইসলাম**

মাটির সাথে যুদ্ধ করে ফলাও সবুজ হাসি
তুমি মোদের জগৎ সেরা বাংলাদেশের চাষি।।
কঠিন মাটির বুকে তুমি ফোটাও আশার ফুল
 শ্রেষ্ঠ তুমি দেশের সেরা নেই তো তোমার তুল।।
ফল ফলাদি ফসল ফলাও কঠিন পরিশ্রমে
সবুজ মাঠে সোনার হাসি হাসাও কঠিন শ্রমে।।
অন্নে পূর্ণ বাংলাদেশকে দেখতে যদি চাই
 সেই স্বপ্নেও তুমিই আশা তোমার জুড়ি নাই।।
সবার মুখের খাবার জোগাও শক্ত দুটি হাতে
দাম পেলে কি নাইবা পেলে নেই অভিমান তাতে।।
মাঠ ফসলের মিষ্টি সুবাস গর্বে ভরায় বুক
সবার খুশিই তোমার খুশি সবার মুখেই সুখ।।
মুখটি ভরা হাসি থাকুক গোলা ভরুক ধানে
 তোমার হাসি ছড়িয়ে পড়–ক দেশের সকল খানে।।
 তোমার পানে চেয়ে মোরা আশায় বাঁধি বুক
সুখের হাসি হাসবে সবাই রইবে নাকো দুখ।।
হাড় খাটুনি খেটেও তোমার মুখটি ভরা হাসি
তুমিই মোদের জগৎ সেরা বাংলাদেশের চাষি।

* কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার, কাপাসিয়া, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭৭১৭৭৮৮৮৫ ** এম এ এ ও, দেবিদ্বার, কুমিল্লা
বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর অগ্রহায়ণ-১৪২১
মো. জাহাঙ্গীর আলম
নাচোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন : কলাগাছের পাতা হলুদ হয়ে বোঁটার কাছে ভেঙে ঝুলে পড়ে ও আক্রান্ত গাছ আস্তে আস্তে মারা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিকার কী?
উত্তর : কলার তিনটি প্রধান রোগের মধ্যে পানামা রোগ অন্যতম। এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের প্রতিকার হিসেবে রোগমুক্ত গাছ লাগাতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ তুলে ফেলে দিতে হবে। রোগ প্রতিরোধ সম্পন্ন জাতের চাষ করতে হবে। যেমন- বারিকলা-১, বারিকলা-২। আক্রান্ত জমিতে পরের বছর কলা চাষ করা যাবে না। এ ছাড়া টিল্ট-২৫০ ইসি (০.০৪%) ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় আক্রান্ত গাছে প্রয়োগ করেও সুফল পাওয়া যেতে পারে।

আব্দুল সালাম
আগইলঝরা, বরিশাল
প্রশ্ন : পানের বরজে পান পাতা পচে যাচ্ছে, করণীয় কী?
উত্তর : পান চাষে সাধারণত গাছের গোড়া পচা, পাতা পচা রোগ বেশি দেখা যায়। এজন্য পান চাষের জমি উঁচু ও দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। বরজের আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া উচিত। এ রোগে ছাই ও নিমপাতার পানি স্প্রে করে ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা যায়। এছাড়া পচন রোধে রিডোমিল গোল্ড অথবা ডাইথেন এম-৪৫ ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় আক্রান্ত গাছে প্রয়োগ করতে হবে। পান চাষে নিয়মিত ১% বোর্দ্রো মিশ্রণ ১৫ দিন পর পর গাছে স্প্রে করলে সব রোগের উপশম হয়।
মেহেদী হাসান
গৌরীপুর, ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : লাউ কচি অবস্থায় পচে ঝরে যায়, কারণ কী?
উত্তর : ফলের মাছি পোকা বা ফ্রুট ফ্লাই অনেক সময় কচি ফলের গায়ে ছিদ্র করে ডিম পাড়ে ও তাতে অপরিপক্ব অবস্থায় ফল ঝরে পড়ে। এর প্রতিকার হিসেবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করা আক্রান্ত ফল পোকাসহ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ধ্বংস করা। ফল ধরার পর থেকে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত বাদামি কাগজের ঠোঙ্গা বা পেপার দিয়ে ফল ঢেকে রাখা। জমিতে বিষটোপ ফাঁদ ব্যবহার করা। এতে স্ত্রী মাছি ডিম পাড়ার আগেই মারা যেতে পারে বলে জমিতে মাছি পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমে যায়। এছাড়া কিউলিওর (সেক্স ফেরোমন) ফাঁদ ব্যবহার করা। জমিতে বিষটোপ ফাঁদ ও কিউলিওর ফাঁদ পাশাপাশি ব্যবহার করলে সবচেয়ে  কার্যকরভাবে এ পোকা দমন করা যায়।

মো. রাসেল
ঘোড়াঘাট, দিনাজপুর
প্রশ্ন : শিম গাছের চারা গোড়া ফেটে রস ঝরে, চারা মরে যায়, প্রতিকার কী?
উত্তর : এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের জীবাণু মাটিতে ও আগাছার মধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে। এটি শিম, লাউ, চিচিঙ্গা ফসলে বেশি দেখা যায়।
প্রতিকার :
মাদায় ১০০ গ্রাম করে ট্রাইকো-কম্পোস্ট ব্যবহার করা।
- রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা।
- শস্যপর্যায় অবলম্বন করা।
- অনুমোদিত ছত্রাকনাশক যথা-রোভরাল ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে গুলিয়ে সঠিক নিয়মে ১৫ দিন স্প্রে করা।

তৌফিকুর রহমান
রংপুর
প্রশ্ন :শীতের মৌসুমে মাছের ক্ষত রোগ বা ঘা দেখা যায়, কী করব?
উত্তর : শীতের মৌসুমে পুকুরে পানির তাপমাত্রা কম থাকার কারণে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ বেশি হয়। ফলে মাছের গায়ে বিভিন্ন রকম ঘা বা ক্ষত রোগ অথবা পাখনা বা ফুলকা পচা রোগ দেখা দেয়। এ ধরনের রোগ দেখা দিলে প্রতি শতাংশ পুকুরে আধা কেজি চুন ও আধা কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হয় ৭ দিন পর আবার একইভাবে লবণ দিতে হয়। বছরে ২-৩ বার চুন প্রয়োগ করা ভালো। পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট শতাংশপ্রতি ১৫ গ্রাম এবং চুন ও লবণ শতাংশপ্রতি ১ কেজি করে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

ঘাযুক্ত মাছগুলো পুকুর থেকে তুলে একটি বড় পাত্রে ২০ লিটার পানিতে ২০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে তাতে মাছগুলোকে ৫ মিনিট রাখতে হবে। অন্য একটি পাত্রে একই পরিমাণ পানি নিয়ে ৫ গ্রাম পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে ৫ মিনিটের জন্য মাছগুলোকে রাখতে হবে তারপর পুকুরে ছাড়তে হবে।

টেট্রাসাইক্লিন/টেরামাইসিন প্রতি কেজি খাদ্যের সঙ্গে ২টা ট্যাবলেট মিশিয়ে ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে। বেশি ঘাওয়ালা মাছ ধরে পুঁতে ফেলতে হবে।

মাছের ক্ষতরোগের মাত্রা বেশি হলে চুন ১ কেজি/শতাংশ এবং লবণ ১ কেজি/শতাংশ হারে প্রয়োগ করতে হবে।
উপকূলীয় অঞ্চলে মাছ চাষের পুকুর বন্যায় প্লাবিত হলে ক্লোরাইডের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির (৩০ পিপিএম এর বেশি) ফলে কেবল সিলভার কার্প মাছে ক্ষত রোগ দেখা যায়। এক্ষেত্রে আক্রান্ত পুকুরের তিন ভাগের দুই ভাগ পানি মিঠাপানির দ্বারা পরিবর্তন করতে হবে এবং প্রতি শতাংশে ৩-৪টি করে চালতা ছেঁচে সারা পুকুরে ছড়িয়ে দিতে হবে। পুকুরকে বন্যামুক্ত রাখতে হবে।

রাজীবুল হাসান
রাজশাহী
প্রশ্ন : মাছের উকুন রোগ হলে কী করব?
উত্তর : এ রোগের লক্ষণ হলো ফুলকার পাশে পোকা থাকে এবং রক্ত চুষে খায়। চুলকানির কারণে মাছ লাফায়। গোবর বা হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা বেশি দিলে এ রোগ হয়।
প্রতিকার : সুমিথিয়ন বা মেলাথিয়ন প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট পানির গভীরতার জন্য ২ মিলি. প্রথম সপ্তাহে দিতে হবে ও এভাবে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে।
ডিপটোরেক্স প্রতি শতাংশে ৫-৮ গ্রাম প্রতি ফুট পানির গভীরতার জন্য ৭ দিন অন্তর ৩ বার দিতে হবে।
উকুনের ডিম পাড়ার স্থান যেমন- বাঁশ, চাটাই, কঞ্চি, তক্তা এসব তুলে ফেলতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য বায়োকেয়ার ৮০-১২০ মিলি. প্রতি শতকে ৭ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হবে তবে রোগ নিরাময়ের জন্য পর পর ২ দিন ১২০-১৬০ মিলি. প্রতি শতক হারে দিতে হবে।

মাহিনুল ইসলাম
লালমনিরহাট
প্রশ্ন : মাছের ফুলকা পচা রোগ হলে কী করব?
উত্তর : শতাংশে আধা কেজি চুন ৭ দিন পর পর দিতে হবে। চুন ১ কেজি প্রতি শতক হারে প্রয়োগ করতে হবে। ঘাযুক্ত মাছগুলো পুকুর থেকে তুলে একটি বড় পাত্রে ২০ লিটার পানির সঙ্গে ২০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে তাতে মাছগুলোকে ৫ মিনিট রাখতে হবে। অন্য একটি পাত্রে একই পরিমাণ পানি নিয়ে ৫ গ্রাম পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে ৫ মিনিটের জন্য মাছগুলোকে রাখতে হবে, তারপর পুকুরে ছাড়তে হবে।

প্রতি কেজি খাবারের সঙ্গে টেরামাইসিন ট্যাবলেট (৩ মিগ্রা.) একটি করে এক সপ্তাহ খাওয়াতে হবে।

লুৎফর রহমান
দিনাজপুর
প্রশ্ন : গরুকে কুকুর কামড় দিয়েছে কী করণীয়?
উত্তর : কামড়ানো জায়গা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণ দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। রেবিসিন ১০ সিসি. ১০০ কেজি ওজনের জন্য প্রথম দিন ৪ সিসি., সপ্তম দিন ৩ সিসি. ও ২১তম দিন ৩ সিসি. ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে।

রবিউল ইসলাম
রাজশাহী
প্রশ্ন :বাছুরের নাভীতে ঘা করণীয় কী?
উত্তর : এন্টিসেপটিক দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে।
- ইঞ্জেকশন এসপিভেট ০.৫ গ্রাম/৩ সিসি. পানিতে মিশিয়ে বাছুরের রানের মাংসে দিতে হবে।
- ইঞ্জেকশন অ্যাসটাডেট-৩ সিসি. ৫ দিন রানের মাংসে দিতে হবে।

আল আমিন
গাজীপুর
প্রশ্ন : মুরগির রক্ত আমাশয় হয়েছে কী করণীয়?
উত্তর : কসুমিক প্লাস পাউডার ১০০ মুরগির জন্য ২৫ গ্রাম হারে পানিতে মিশিয়ে ১২ ঘণ্টার মধ্যে বারবার খাওয়াতে হবে।

মিলন ইসলাম
রংপুর
প্রশ্ন : হাঁস-মুরগির কৃমির সমস্যায় কী করণীয়?
উত্তর : পাইপ্যারাজিন সাইট্রেট ১০০টি পাখির জন্য ১০ গ্রাম ওষুধ খাবার বা পানির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। প্রতি ৩-৪ মাস পর পর পুনরায় খাওয়াতে হবে।
 
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ
* কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৫৫২৪৩৫৬৯১
বিস্তারিত
পৌষ মাসের কৃষি-১৪২১
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সবাইকে শীতের হিমেল শুভেচ্ছা। শীতের গরম ভাঁপা পিঠা আর খেজুরের রসের পায়েস দিয়ে শুরু হয় আমাদের গ্রামবাংলার সকাল। আর সারা বাংলার বাজারগুলোতে দেখা য়ায় বিভিন্ন ধরনের সবজি। শীতকাল কৃষির একটি ব্যস্ততম মৌসুম। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই  পৌষ মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোনো কাজগুলো আমাদের করতে হবে।

ফসল  / অবস্থা/বিবরণ / করণীয়  

বোরো ধান
বীজতলার যত্ন
শীতকালে বোরো ধানের বীজতলায় চারার যত্ন নিতে হবে। বিশেষ করে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় যাতে চারাগুলোর বাড়বাড়তি ঠিকমতো হয় সেজন্য চারার বৃদ্ধির বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
এ সময় স্বল্প পরিমাণ ইউরিয়া সার এবং জিপসাম সার বীজতলায় প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়। এছাড়া শুষ্ক বীজতলার মাধ্যমে চারা উৎপাদন করলে শীতের প্রকোপ থেকে চারাকে রক্ষা করা যায়। শুষ্ক বীজতলায় চারার বাড়বাড়তিও ভালো হয়। আর লবণাক্ত প্রবণ এলাকায় ব্রি ধান৪৭ এবং ব্রি ধান৬১ চাষাবাদ করা দরকার। এতে উপকূলীয় অঞ্চলে যেমন ধানের ফলন বাড়ানো যায় তেমনি খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করাও সম্ভব হয়।

জমিতে চারা রোপণ
চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে মূল জমিতে চারা রোপণ শুরু করতে পারেন। এজন্য জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে পানিসহ কাদা করতে হবে। চাষের আগে জমিতে জৈব সার দিতে হবে এবং শেষ চাষের আগে দিতে হবে ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার। ধানের চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ৩০-৪০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি এবং ৫০-৫৫ দিন পর শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বীজতলা থেকে সাবধানে চারা তুলে এনে মূল জমিতে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ২৫ সেন্টিমিটার এবং গোছা থেকে গোছার দূরত্ব ১৫ সেন্টিমিটার বজায় রেখে প্রতি গোছায় ২-৩টি সুস্থ চারা রোপণ করলে ফলন ভালো হয়।

গম
সার প্রয়োগ ও সেচ প্রদান    
গমের জমিতে ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগ এবং প্রয়োজনীয় সেচ দেয়ার উপযুক্ত সময় এখন। চারার বয়স ১৭-২১ দিন হলে গম ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে হেক্টরপ্রতি ৩০-৩৫ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে এবং সেচ দিতে হবে। সেচ দেয়ার পর জমিতে জো আসলে মাটির উপর চটা ভেঙে দিতে হবে। তাছাড়া গমের জমিতে যেখানে ঘন চারা রয়েছে সেখানে কিছু চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে।

ভুট্টা    
আন্তঃপরিচর্যা    
ভুট্টা ক্ষেতের গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে এবং গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর সেচ প্রদান করতে হবে এবং গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙে দিতে হবে। ভুট্টার সাথে সাথী বা মিশ্র ফসলের চাষ করে থাকলে সেগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।

আলু    
সার প্রয়োগ ও    
চারা গাছের উচ্চতা ১০-১৫ সেন্টিমিটার হলে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। দুই সারের মাঝে সার দিয়ে কোদালের সাহায্যে মাটি কুপিয়ে সারির মাঝের মাটি গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। ১০-১২ দিন পরপর এভাবে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে না দিলে গাছ হেলে পড়রে এবং ফলন কমে যাবে।

পরিচর্যা    
আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে স্প্রেয়িং শিডিউল মেনে চলতে হবে। তবে বালাইনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা দরকার। এছাড়া বালাইনাশক কেনার আগে তা ভালোমানের কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে। মড়ক রোগ দমনে দেরি না করে ২ গ্রাম ডায়থেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা ইন্ডোফিল প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হবে। আলু  গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির  সমান করে গাছ কেটে দিতে হবে এবং ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে। আলু তোলার পর  ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

তুলা    
সংগ্রহ ও সংরক্ষণ    
এ সময় তুলা সংগ্রহের কাজ শুরু করতে হবে। তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে। রৌদ্রময় শুকনা দিনে বীজ তুলা উঠাতে হয়। ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ভালো তুলার সাথে যেন খারাপ তুলা (পোকায় খাওয়া, রোগাক্রান্ত) কখনো না মেশে।

ডাল ও তেল ফসল    
সংগ্রহ    
মসুর, ছোলা, মটর, মাসকালাই, মুগ, তিসি পাকার সময় এখন। সরিষা, তিসি বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে। আর ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। এত জমিতে উর্বরতা এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ বাড়বে।

শাকসবজি    
পরিচর্যা    
শীতকাল শাকসবজির মৌসুম। নিয়মিত পরিচর্যা করলে শাকসবজির ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম, গাজর, শিম, লাউ, কুমড়া , মটরশুঁটি এসবের নিয়মিত যতœ নিতে হবে। টমেটো ফসলের মারাত্মক পোকা হলো ফলছিদ্রকারী পোকা। এ পোকার আক্রমণে ফলের বৃন্তে একটি ক্ষুদ্র আংশিক বদ্ধ কালচে ছিদ্র দেখা যাবে। ক্ষত্রিগ্রস্ত ফলের ভেতরে পোকার বিষ্ঠা ও পচন দেখা যাবে। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পুরুষ মথকে ধরে সহজে এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রতি বিঘা জমির জন্য ১৫টি ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। আধাভাঙা নিম বীজের নির্যাস (৫০ গ্রাম এক লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১২ ঘণ্টা ভেজাতে হবে এবং পরবর্তীতে মিশ্রণটি ভালো করে ছাকতে হবে) ১০ দিন পর পর ২/৩ বার স্প্রে করে এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রমণ তীব্র হলে কুইনালফস গ্রুপের কীটনাশক (দেবীকইন ২৫ ইসি/কিনালাক্স ২৫ ইসি/করোলাক্স ২৫ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়। এ সময় চাষিভাইরা টমেটো সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে পারেন। আধা পাকা টমেটোসহ টমেটো গাছ তুলে ঘরের ঠাণ্ডা জায়গায় উপুড় করে ঝুলিয়ে টমেটোগুলোকে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। পরবর্তীতে ৪-৫ মাস পর্যন্ত অনায়াসে টমেটো খেতে পারবেন। আর শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদামাফিক সেচ দিতে হবে। তাছাড়া আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া, সারের উপরিপ্রয়োগ ও রোগবালাই প্রতিরোধ করা জরুরি।

গাছপালা    
পরিচর্যা        
গত বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা কাঠ গাছের যত্ন নিতে হবে। গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। রোগাক্রান্ত হাছের আক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করে দিতে হবে। এ সময় গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে।

প্রাণিসম্পদ    
হাঁস-মুরগির যত্ন   
শীতকালে পোলট্রিতে যে সব সমস্যা দেখা যায় তা হলো-অপুষ্টি, রানীক্ষেত, মাইকোপাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা। মোরগ-মুরগির অপুষ্টিজনিত সমস্যা সমাধানে ভিটামিন এ, সি, ডি, ই, কে ও ফলিক এসিড সরবরাহ করতে হবে। তবে সেটি অবশ্যই প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে, নাহলে অনেক সময় মাত্রা না জেনে ওষুধ বা ভিটামিন প্রয়োগে ক্ষতির আশংকা থাকে। এছাড়া খরচও বেড়ে যায় । শীতের তীব্রতা বেশি হলে পোলট্রি শেডে অবশ্যই মোটা চটের পর্দা লাগাতে হবে এবং বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে অনেকেই হাঁস পালন করে থাকেন। এ সময় হাঁসের যেসব রোগ হয় সেগুলো হলো- হাঁসের প্লেগ রোগ, কলেরা রোগ এবং বটুলিজম। প্লেগ  রোগ প্রতিরোধে ১৮-২১ দিন বয়সে প্রথম মাত্রা এবং প্রথম টিকা দেয়ার পর ৩৬-৪৩ দিন বয়সে দ্বিতীয় মাত্রা পরবর্তী ৪-৫ মাস পরপর একবার ডাক প্লেগ টিকা দিতে হবে।

গরু-বাছুরের যত্ন   
গাভীর জন্য শীতকালে মোটা চটের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি।  নাহলে গাভীগুলো তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে যাবে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে সারা বছরের টিকা প্রদান এবং পরিচর্যা বিষয়ক পরিকল্পনা ও করণীয় কি সেসব বিষয়ে লিখিত পরামর্শ গ্রহণ করে তা মেনে চলতে হবে। তাছাড়া গাভীর খাবার প্রদানে যেসব বিষয়ে নজর দিতে হবে তাহলো- সঠিক সময়ে খাদ্য প্রদান, গোসল করানো, থাকার স্থান পরিষ্কার করা, খাদ্য সরবরাহের আগে খাদ্য পাত্র পরিষ্কার করা এবং নিয়মিত প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। তবে গাভীর খাবারের খরচ কমাতে সবচেয়ে ভালো হয় নিজেদের জমিতে তা চাষাবাদ করা। আর একটি কাজ করলে ভালো হয় সেটি হলো-সমবায় সমিতি করে ওষুধ ও চিকিৎসা করানো। এতে লাভ হয় বেশি। খরচ যায় কমে।
 
শীতকালে ছাগলের নিউমোনিয়া রোগটি খুব বেশি হয়। এ রোগে ফুসফুস আক্রান্ত হয়, এতে বারবার ব্যথাযুক্ত কাশি হয়ে থাকে। প্রায় সব বয়সের ছাগলে এ রোগটি হয়ে থাকে। তবে ১ দিন থেকে ৩ মাস বয়সের ছাগলের বাচ্চার এ রোগটি বেশি হয়। এ রোগ হলে প্রথমে  অল্প অল্প জ্বর হবে কিন্তু সব সময় নয়। ছাগল বারবার হাঁচি ও কাশি দেবে, কাশির সময় পাঁজর ওঠানামা করবে । শ্বাস নেয়ার সময় কষ্ট হবে। এ সময় ছাগল খাবার গ্রহণ বন্ধ করে দেয়, নাক ও মুখ দিয়ে সর্দি ও কাশি বের হয় এবং এক পর্যায়ে ১০৪-১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বর হবে। যদি ৫ দিনের বেশি কাশি ও দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা হয় তবে বুঝতে হবে প্যারাসাইট এর জন্য নিউমোনিয়া হয়েছে। নিউমোনিয়াতে সেফটিয়াক্সোন ও টাইলোসিন  ব্যবহারে খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এছাড়াও  পেনিসিলিন, অ্যামপিসিলিন, অ্যামোক্সিসিলিন, স্টেপটোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিন ব্যবহারেও ভালো সাড়া পাওয়া যায়।

মৎস্যসম্পদ    
মাছের যত্ন  
শীতকালে মাছের বিশেষ যত্ন নেয়া দরকার। কারণ এ সময়ে পুকুরে পানি কমে যায়। পানি দূষিত হয়। মাছের রোগবালাইও বেড়ে যায়। সে কারণে কার্প ও শিং জাতীয় মাছে ড্রপসি বা উদর ফোলা রোগ বেশি হয়। আর এ রোগটি বড় মাছে বেশি হয়। এ রোগের লক্ষণগুলো হলো-দেহের ভেতর হলুদ বা সবুজ তরল পদার্থ জমা হওয়া; পেট খুব বেশি ফুলে যাওয়া। দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা। তরল পিচ্ছিল পদার্থ বের হওয়া। মাছ উল্টা হয়ে পানিতে ভেসে ওঠে। খাবার গ্রহণে অনীহা হয়। আর এ রোগের প্রতিকারে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন বা স্ট্রেপটোমাইসিন পর পর ৭ দিন খাওয়াতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় এ বিষয়ে আপনার কাছের উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ গ্রহণ করা।

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি নিশ্চিত মৌসুম হলেও শুকনো মৌসুম বলে মাটিতে রস কম থাকে। তাই যদি প্রতি ফসলে চাহিদা মাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে দেখবেন আপনার জমির ফলন কতখানি বাড়ে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক কৃষির সবক’টি কৌশল যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে পারব। আপনাদের সবার জন্য নিরন্তন শুভ কামনা। কৃষির সমৃদ্ধিতে আমরা সবাই গর্বিত অংশীদার।

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
বিস্তারিত
সম্পাদকীয় অগ্রহায়ন-১৪২১
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো কৃষি। এজন্য কৃষির সার্বিক উন্নয়নে সুপরিকল্পিতভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এ দেশের সরকার, কৃষি গবেষক, সম্প্রসারণবিদ, কৃষিকর্মী, কৃষক-কৃষাণি সবাই। পরিবর্তিত আবহাওয়া ও বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিবেশ আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে কৃষিতে অবশ্যই সাফল্য লাভ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন করে আসছে। প্রতিবারের মতো এবারও বাংলাদেশে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়েছে এ দিবসটি। এবারের এ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘পারিবারিক কৃষি : প্রকৃতির সুরক্ষা, সবার জন্য খাদ্য’। দিবসটি পালন উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে পারিবারিক কৃষির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আর পারিবারিক কৃষির কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো অগ্রহায়ণ মাস। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় কৃষকের বাড়িকে কেন্দ্র করে যে বহুমুখী কৃষি খামার গড়ে তোলা হয় তাকেই আমরা পারিবারিক কৃষি খামার বলে থাকি। এ খামারে বাড়ির সদস্যরা সবাই মিলে কাজ করতে পারে। এজন্য উৎপাদন খরচ কম হয়, জৈব কৃষি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সহজ হয় এবং পারিবারিক পুষ্টি সরবরাহের পথ সুগম হয়। এক কথায়  কৃষি ও কৃষকের আর্থসামাজিক উন্নয়নের একটা সম্ভাবনাময় মাধ্যম হলো পারিবারিক কৃষি। তাই আসুন, সুপরিকল্পিতভাবে পারিবারিক কৃষি খামার গড়ে তুলে নিজের ও দেশের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হই।
 
     চাষি ভাইরা, আপনারা জানেন ঋতু বৈচিত্র্যের প্রেক্ষাপটে অগ্রহায়ণ মাস আমাদের দেশে নবান্নের মাস বলে পরিচিত। এ সময় নতুন ধানের আগমন আর শীতকালীন ফসলের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের আভাস কৃষক-কৃষাণির মনে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়। রবি মৌসুম আমাদের কৃষির জন্য একটি সম্ভাবনাময় মৌসুম হলেও এ সময় মাটিতে রস কম থাকে। তাই ফসলের ক্ষেতে চাহিদামাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া উন্নতমানের উচ্চফলনশীল বীজ ও ফসল উৎপাদনের সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক উপায়ে অন্যান্য কৃষি কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি পারিবারিক কৃষির সফল বাস্তবায়ন আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
বিস্তারিত

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon