ফসলের পোকামাকড় দমন কৌশলও আগামীর নিরাপদ কৃষি
কৃষিবিদ মোহাম্মদ সাইফুল আলম সরকার১ ড. মোহাম্মদ মোবারক হোসেন২ হিতৈষী খীসা৩
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে উত্তরোত্তর উন্নতি করেই যাচ্ছে। এই যেমন কৃষির কথাই ধরা যাক, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যেখানে সাত কোটি মানুষের দু’বেলা খাবারের চাহিদা মেটানোই কঠিন ছিল সেখানে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে প্রতিনিয়ত কমে আসা চাষযোগ্য জমিতে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাবারের চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশ এখন একটি খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। অতীতে বাংলার কৃষকের জীবন অতিষ্ঠকারী দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা ইত্যাদি শব্দগুলো এখন শুধুমাত্র অভিধানেই খুঁজে পাওয়া যায়। কৃষিতে নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে যেমন উচ্চফলনশীল ও রোগপ্রতিরোধী বিভিন্ন ফল ফসলের জাত আবিষ্কৃত হয়েছে ঠিক তেমনি উন্নত প্রযুক্তি বর্তমানে কৃষির ধরনকেও আমূল পাল্টে দিয়েছে। এক সময়ের হালের বলদ আর লাঙল সরিয়ে চাষাবাদের উন্নত সব যন্ত্রপাতি এখন কৃষকের হাতের নাগালে। এইতো কিছু দিন আগেও এক হেক্টর ধান রোপণ থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ করা পর্যন্ত শত শ্রমিকের রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে দিন রাত মাঠে পরিশ্রম করতে হতো। রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার, সিডার, হার্ভেস্টারসহ আধুনিক সব কৃষি যন্ত্রপাতি এখন এক নিমেষেই শত শ্রমিকের কাজ করে ফেলছে অন্যদিকে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের (কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, ইঁদুরনাশক ইত্যাদি) ব্যবহারে ফলন বেড়েছে অনেক গুণ।
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষির এই অগ্রগতি কতটুকু নিরাপদ? প্রতিনিয়তই সংকুচিত হয়ে আসা চাষযোগ্য জমিতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমাদেরকে নির্বিচারে রাসায়নিক সারের দিকে ঝুঁকে পড়তে হচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফসলে নতুন ধরনের পোকামাকড় ও রোগব্যাধিসহ অন্যান্য উপদ্রব দেখা দিচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের মাত্রা বিগত দিনের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ ষাটের দশকের পূর্বে বাংলাদেশে কীটনাশকের ব্যবহার তেমন দেখা যেত না। ১৯৫৭ সালে বৈদেশিক সহযোগিতা হিসাবে পাওয়া ৩ টন এনড্রিন নামক কীটনাশক দিয়ে বাংলাদেশের ফসলে বালাইনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সরকার শতভাগ ভর্তুকি দিয়ে কৃষদেরকে বিনামূল্যে ফসলে বালাইনাশক ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করত। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সরকার প্রদত্ত ৫০% ভর্তুকি মূল্যে কৃষকদেরকে বালাইনাশক সরবরাহ করা হতো। কৃষি পরিসংখ্যান তথ্য মতে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকার বালাইনাশক ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন, যা ১৯৫৭ সালের তুলনায় প্রায় ১৩.৫ হাজার গুণ বেশি। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ২০০৩ সালে কৃষিতে বিভিন্ন প্রকার বালাইনাশক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল মোট ১৮,০৮০.৪০ মেট্রিক টন যা প্রতিনিয়ত বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে ২০২১-২০২৩ সালে এসে ৪০২৭০.৬১ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে (চিত্র ১)। এত অধিক পরিমাণ বালাইনাশক উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখলেও আমাদের কাক্সিক্ষত ফসলের পাশাপাশি পরিবেশকেও বেশ অনিরাপদ করে তুলেছে। ব্যবহৃত বালাইনাশকের সবটুকুই আমদানি নির্ভর হওয়ায় প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে ।
ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের আক্রমণই কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়ার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। উদ্ভিদ সংগনিরোধ শাখা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সম্প্রতি বিভিন্ন ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের তালিকা করার জন্য বাংলাদেশের ১৪টি এলাকায় জরিপ পরিচালনা করে। এতে দেখা যায় যে, ৮৩২ ধরনের পোকামাকড় ফসলের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতি করে থাকে। শুধুমাত্র দানাশস্যেই ১৩৩ ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণ শনাক্ত করেছে। উক্ত তালিকায় আরো উল্লেখ করা হয় যে ডাল, তেল, সবজি ও ফল যথাক্রমে ৮৩, ১২৫, ২২৯ ও ৩১৩ ধরনের পোকামাকড়ে আক্রান্ত হয়। কীটতত্ত্ববিদদের মতে বাংলাদেশে সবজি ফসলের ৩০-৪০% উৎপাদন কম হয় শুধুমাত্র পোকামাকড়ের আক্রমণের কারণে। তা ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবহাওয়ার পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণে ফসলে পোকামাকড়ের আক্রমণ হার অনেকগুণ বেড়ে গেছে। অবস্থা এমন যে, কীটনাশক ব্যবহার করা ছাড়া ফসল উৎপাদন যেন প্রায় অসম্ভব। সঙ্গতকারণেই কৃষকেরা পোকামাকড়ের হাত থেকে তাদের কষ্টে লালিত ফসলকে রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে বিভিন্ন প্রকারের কীটনাশক ব্যবহার করছে। এজন্যই কৃষিতে যত পরিমাণ বালাইনাশক ব্যবহার করা হয় তার এক- তৃতীয়াংশই হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের কীটনাশক (চিত্র ২)।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সবজিতে কীটনাশক ব্যবহারের তীব্রতা বিশেষভাবে বেশি পাওয়া গেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সবজির সামগ্রিক রপ্তানি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ টমেটো, বেগুন, শিম, লাউ, ফুলকপি এবং কুমড়ার জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের ১৬-৫১% পর্যন্ত উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে (চিত্র ৩)। বিভিন্ন এলাকায় ৮২০ জন কৃষকের উপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৭০% কৃষক সবজি ফসলে এমনসব কীটনাশক ব্যবহার করে যেগুলো অত্যন্ত ক্ষতিকারক শ্রেণীর এবং ৪৭% কৃষকই নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক ব্যবহার করে। উক্ত সমীক্ষায় আরো দেখা গেছে যে, একজন কৃষক তার বেগুন ক্ষেতে এক মৌসুমে ১৪০ বারের অধিক অর্থাৎ পুরো উৎপাদন মৌসুমজুড়ে প্রায় প্রতি দিনই কীটনাশক প্রয়োগ করছে। উক্ত সমীক্ষার সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্যটি হচ্ছে প্রতিদিনই কীটনাশক ব্যবহারকারী এমন ৮৭% কৃষকই কীটনাশক প্রয়োগের সময় কোন সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করে না। চাষাবাদের সময় সবজি ক্ষেতে এমন অপরিকল্পিত ও নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগের ফলে বিশেষত রান্না ছাড়াও সালাদ হিসাবে কাঁচা খাওয়া যায় এমন সবজিগুলো মানবদেহের জন্য যেন এক বিষের ভা-ার।
অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি প্রধান ফসল ধান উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষকরা প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে কীটনাশক ব্যবহার করে পোকামাকড় দমন করতে গিয়ে বরং আমরা একদিকে উপকারী বহু পোকামাকড়কে মেরে ফেলছি অপরদিকে ক্ষতিকারক পোকামাকড়কে কীটনাশক প্রতিরোধী করে তুলছি। যেমনঃ ধানে যে সব ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করে তার অন্যতম হচ্ছে নিওনিকোটিনয়ডেস (ইমিডাক্লোপ্রিড, থায়ামেথক্সাম, ক্লোথিয়ানিডিন এবং ডিনোটেফুরান), ফেনাইলপাইরাজোলস (ফ্লুফিপ্রোল এবং ইথিপ্রোল), কার্বামেটস (আইসোপ্রোকার্ব), পাইরিডিন অ্যাজোমেথিন ডেরিভেটিভস (পাইমেট্রোজাইন) ইত্যাদি। ধান চাষে বহুল ব্যবহৃত এইসব কীটনাশকের বিরুদ্ধে অধিকাংশ পোকামাকড়ই বেশ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। আর্থ্রোপড পেস্টিসাইড রেজিস্ট্যান্স ডেটাবেস এর রেকর্ড অনুসারে, ধানের বাদামি ঘাসফড়িং কীটনাশকের ৩৩টি সক্রিয় উপাদানের বিরদ্ধে প্রতিরোধ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬০০ ধরনের পোকামাকড় আছে যারা এক বা একাধিক কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে গেছে।
এই দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের করণীয় কি? হতাশ না হয়ে বরং সকলে মিলে বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে যে কোন সমস্যার একটি সমাধান বের করা যায়। জৈবিক পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব উপায়ে খুব সহজেই অনেক ক্ষতিকারক পোকামাকড়কে দমন করা যায়। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে কুমড়াজাতীয় ফসলকে মাছি পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায়। এটি একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব অন্যদিকে দামেও কীটনাশকের তুলনায় বেশ সাশ্রয়ী। তদ্রƒপ আলোক ফাঁদ ব্যবহার করেও অনেক ফসলকে পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। বর্তমানে বিভিন্ন গাছগাছালির নির্যাস দিয়েও পোকামাকড় দমন করার বিষয়টি বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। নিমপাতা, পাট ও মেহগনি বীজের নির্যাস দিয়ে অনেক পোকামাকড় দমন করা যায়। উন্নত বিশ্বে ন্যানো কীটনাশক আবিষ্কৃত হয়েছে যার ফলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে কীটনাশকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তবে বিজ্ঞানের এই শাখাটি এখনও পুরোদমে আমাদের দেশে কৃষিকাজে লাগনোর মতো বিকশিত হয়নি। এক কথায় বলা যেতে পারে যে সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই কীটনাশক ব্যবহারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে আগামীর কৃষিকে শতভাগ নিরাপদ ও ঝুঁিকমুক্ত করা সম্ভব। অ্যাডভান্সেস ইন এনটোমোলজি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধের তথ্য মতে আইপিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে টমেটো চাষে ৮৮-৮৯% পর্যন্ত কম কীটনাশক প্রয়োগ করে নিরাপদ ফসল উৎপাদন করা যায় (সূত্র: যঃঃঢ়ং://ফড়র.ড়ৎম/১০.৪২৩৬/ধব.২০১৯.৭২০০৪)।
আশার কথা হচ্ছে ফসলের মাঠে প্রয়োগকৃত মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে সকল কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক আইপিএম প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার বেশ কমেছে (চিত্র ৪)। কিন্তু স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিবেচনায় নিরাপদ ফসল উৎপাদনে আমাদের এ অগ্রগতি এখনও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে বহুদূর বাকি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন বিভিন্ন পোকামাকড়ের উপদ্রব (যেমন: ভুট্টার ফল আর্মিওয়ার্ম) দেখা দিচ্ছে। এজন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহকে পোকামাকড় আক্রমণ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন ধরনের জৈব বালাইনাশক আবিষ্কারের গবেষণা জোরদার করতে হবে। তা ছাড়া ফসলের মাঠে নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ আমাদের পরিবেশ তথা জনস্বাস্থ্যের উপর যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পত্রপত্রিকায় কীটনাশকের অপপ্রয়োগের ভয়াবহতার কথা লেখালেখির পাশাপাশি পাঠ্যক্রমেও এ সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরতে হবে যেন আগামী প্রজন্মের শিশুরাও সচেতন হতে পারে। ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে লড়াই তথা বালাইনাশকের ব্যবহার কমানোর এই প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ, কৃষক ও সর্বস্তরের জনসাধারণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ অতীব জরুরি।
লেখক : ১অ্যাসিস্ট্যান্ট রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র, মোবাইল: ০১৬৯-০০৫৭৫৭৭, ২ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইল: ০১৭১৪-৭৮২৭০৪, ৩হাব ম্যানেজার, বান্দরবান, আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্্র, মোবাইল: ০১৭১৫-৫৬৯৮৬৯, ইমেইল:h.khisa@cgiar.org