Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পেঁয়াজ মসলাফসল

পেঁয়াজ মসলাফসল
নাহিদ বিন রফিক
পেঁয়াজ মসলাফসল। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসাবে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
পেঁয়াজ এবং এর পাতা ও কলি পুষ্টিগুণে ভরপুর। আছে ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি। এ ছাড়া রয়েছে ক্যালসিয়াম, লৌহ, আমিষ, সালফার, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়াম।
পেঁয়াজ কেবল খাবারের স্বাদই বাড়ায় না, আছে যথেষ্ট ভেষজগুণ। ভেষজ বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত পেঁয়াজ খেলে চোখের  দৃষ্টিসমস্যা দূর হয়। এর রস নাকে টানলে সর্দি বেরিয়ে যায়। সেরে যায় জ¦রও। এ ছাড়া নাকের রক্তপড়া বন্ধ হয়। হার্টের জন্য উপকারী। অ্যাজমা নিরাময় হয়। প্রসাবের ধারণক্ষমতা বাড়ে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। হেঁচকি উঠা বন্ধ হয়। রূপচর্চায়ও এর ব্যবহারের কমতি নেই। 
জাত : পেঁয়াজের স্থানীয় এবং উচ্চফলনশীল বেশ কিছু জাত রয়েছে। অধিক ফলন পেতে অবশ্যই উচ্চফলনশীল জাত ব্যবহার করা চাই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত জাতগুলো হলো: বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-২, বারি পেঁয়াজ-৩, বারি পেঁয়াজ-৪ এবং বারি পেঁয়াজ-৫। শাক হিসেবে বারি পাতা পেঁয়াজ-১। বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-৪ এবং বারি পাতা পেঁয়াজ-১ এই তিনটি জাত রবি মৌসুমে আর বারি পেঁয়াজ-২, বারি পেঁয়াজ-৩ ও বারি পেঁয়াজ-৫ খরিফ মৌসুমের জন্য প্রযোজ্য। এ ছাড়া তাহেরপুরী, ঝিটকা, ফরিদপুরের ভাতি এবং কৈলাস নগরসহ আরো কিছু স্থানীয় জাত রয়েছে। বর্তমানে আমদানিকৃত হাইব্রিড জাতও ব্যবহার হচ্ছে। 
বীজ শোধন : বীজবাহিত রোগ যেন না হয়, সেজন্য বপনের আগে বীজ শোধন করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে ছত্রাকনাশক (রোভরাল/প্রোভেক্স-২০০) ব্যবহার করা যেতে পারে। 
মাটি ও জলবায়ু : পেঁয়াজ শীতল আবহাওয়া পছন্দ করে। সাধারণত ১৫-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উৎপাদন আশানুরূপ হয়। চাষের জন্য বেলে-দোআঁশ মাটি উত্তম। জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈবপদার্থ থাকলে ভালো হয়।  গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের ক্ষেত্রে উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে, যাতে বৃষ্টির পানি প্লাবিত না হয়। জমিতে অবশ্যই সেচ ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা চাই। পেঁয়াজ যেহেতু মাটির নিচের ফসল, তাই জমি বেশ কয়েকবার চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে ।  
বপন সময় : রবি মৌসুমের জন্য অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত জমি কিংবা বীজতলায় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।  খরিফ মৌসুমে জুলাই মাস চাষের উপযুক্ত সময়। আগাম চাষের ক্ষেত্রে মধ্য ফেব্রুয়ারি হতে মধ্য জুন পর্যন্ত বীজ বোনা যাবে। তবে মার্চের মধ্যে বপনকাজ শেষ করলে ভালো হয়। মূল জমিতে ৪০-৪৫ দিনের চারা লাগানো উত্তম। নাবি চাষের ক্ষেত্রে আগস্টের মধ্যে বীজ বপন করতে হবে। 
বপন/রোপণ পদ্ধতি : তিন পদ্ধতিতে পেঁয়াজ চাষ হয়। জমিতে বীজ বপন করে। ছোট শল্ককন্দ সরাসরি জমিতে রোপণ করে। আর  বীজতলায় চারা তৈরির মাধ্যমে মূল জমিতে লাগিয়ে। তবে বীজ থেকে চারা তৈরি করে রোপণ করলে বেশি ফলন পাওয়া যায়। বীজ শোধন করে নিলে বীজবাহিত রোগের আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সার ব্যবস্থাপনা : রবি মৌসুমের জন্য হেক্টরপ্রতি সারের পরিমাণ হলো- জৈবসার ৫ টন, ইউরিয়া ২৪০ কেজি, টিএসপি ২৬০ কেজি এবং এমওপি ১৫০ কেজি। জৈবসার ও টিএসপির সম্পূর্ণ অংশ এবং ইউরিয়ার তিন ভাগের এক ভাগ আর এমওপির দুই ভাগের এক ভাগ শেষ চাষের সময় জমিতে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া ও এমওপি সার চারা রোপণের ২৫ এবং ৫০ দিন পর সমহারে পাশর্^প্রয়োগ করতে হয়। শল্ককন্দ এবং জমিতে সরাসরি বীজ বপনের বেলায়ও এই নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। খরিফ মৌসুমের জন্য হেক্টরপ্রতি সারের পরিমাণ হলো- জৈবসার ৫ টন, ইউরিয়া ১৫০ কেজি, টিএসপি ২০০ কেজি এবং এমওপি ১৭৫ কেজি, জিপসাম ১১০ কেজি এবং জিংক অক্সাইড ৩ কেজি। স্বাভাবিক সময়ে চাষের ক্ষেত্রে জৈব ও অজৈব সারের সম্পূর্ণ অংশ শেষ চাষের সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। আগাম চাষের ক্ষেত্রে জৈবসার, এমওপি, টিএসপি, জিপসাম এবং জিংক অক্সাইডের সম্পূর্ণ অংশ এবং ইউরিয়ার তিন ভাগের দুই ভাগ শেষ চাষের সময় জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর পাশর্^প্রয়োগ করতে হবে। তবে নাবিতে চাষ করলে ইউরিয়ার তিন ভাগের এক ভাগ আর অন্যান্য সব সার শেষ চাষের সময় মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়ার বাকি এক ভাগ রোপণের ২০-২৫ দিন পর এবং আরেক ভাগ ৫০-৫৫ দিন পর পাশর্^প্রয়োগ করতে হবে। (উৎস: কৃষি প্রযুক্তি হাতবই) 
সেচ ব্যবস্থাপনা : অন্যান্য ফসলের ন্যায় পেঁয়াজের ক্ষেতেও সেচের প্রয়োজন হয়। মাটিতে চারা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে আর্দ্রতার অবস্থা দেখে একাধিক বার সেচ দেয়া দরকার। অন্য সময় রসের অভাব দেখা দিলেই কেবল পানি দিতে হবে।  সেচের পর ক্ষেত নিড়ানি দিয়ে মাটি আলগা করে দিতে হয়। তা না হলে পেঁয়াজের গুণগতমান এবং সংরক্ষণক্ষমতা হ্রাস পায়।      
পরিচর্যা : পরিচর্যার মধ্যে আগাছা দমন অন্যতম। এরা ফসলের সাথে খাবারের ভাগ বসায়। এ ছাড়া অনিষ্টকারী পোকার আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাই জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। বীজতলায় বপনকৃত বীজ যাতে পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলতে না পারে, সেজন্য জমিতে সেভিন ছিটিয়ে দিলে ভালো হয়। এ ছাড়া ছাই কিংবা কেরোসিন ব্যবহার করা যেতে পারে। কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফুলের কুঁড়ি ভেঙে দিতে হয়।
বালাই ব্যবস্থাপনা : অন্য ফসলের ন্যায় পেঁয়াজেও কিছু রোগপোকার আক্রমণ হয়।  রোগের মধ্যে পার্পল ব্লচ বা বেগুনি দাগ, কা- বা কন্দ পচা, আইরিশ ইয়োলো স্পট, স্টেমফাইলিয়াম লিফ ব্লাইট, এস্টার ইয়োলো, ব্রোট্রাইটিস লিফ ব্রাইট রোগ, পেঁয়াজের গুদামজাত রোগ এবং  কা- ও কন্দ          কৃমি অন্যতম। আর ক্ষতিকর পোকাগুলো হলো- থ্রিপস, এফিড বা জাব পোকা, আম্বেল ছিদ্রকারী পোকা, লেদা পোকা এবং ঘোড়া পোকা।
পার্পল ব্লচ রোগ : পেঁয়াজের জন্য এই রোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর আক্রমণে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। বীজবাহিত এ রোগটি ছত্রাকের কারণে হয়। প্রথমে পাতা এবং বীজবাহি কা-ে ছোট ছোট পানিভেজা কিংবা তামাটে রঙের দাগ দেখা যায়। দাগগুলো ধীরে ধীরে বড় আকার ধারণ করে। এর মাঝের অংশে প্রথমে লালচে বাদামি এবং পরে কালো বর্ণে রূপ নেয়। দাগের কিনারা বেগুনি রঙ হয়ে যায়।  আক্রান্ত পাতা উপরের দিক থেকে মরতে শুরু করে। এমন অবস্থায় ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে হলুদ হয়ে পাতা মরে যায়। বীজবাহি কা- কিংবা পাতা ভেঙে পড়ে। বীজ অপুষ্ট হয়। ফলন কমে যায়। আক্রান্ত বীজ, গাছের অবশিষ্টাংশ এবং বাতাস দ্বারা এ রোগ ছড়ায়। দ্রুত ছড়ানোর ক্ষেত্রে বৃষ্টিপাত অন্যতম কারণ।  রোগ যেন না হয়, সেজন্য অব্যশই বপনের আগে বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেইসাথে একই জমিতে পরপর  ৩-৪ বছর পেঁয়াজের চাষ না করা। ফসল সংগ্রহের পর গাছের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগ যদি হয়েই যায়, সেক্ষেত্রে আক্রমণের সাথে সাথে প্রতিলিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে রোভরাল/রিডোমিল গোল্ড/এন্ট্রাকল মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ৩-৪ বার ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। তবে বীজ উৎপাদনের বেলায় ৫-৬ বার স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ফলন : কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বারি উদ্ভাবিত জাতগুলোর হেক্টরপ্রতি ফলন ১২-২২ টন। আর পাতা উৎপাদন করলে হেক্টরপ্রতি ফলন ১০-১২ টন (আহারোপযোগী)। যদিও স্থানীয় জাতগুলোর ফলন কিছুটা কম। তবে হাইব্রিড জাত ব্যবহার করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। 
সংরক্ষণ : সাধারণত ৯০-১০০ দিনে উৎপাদিত পেঁয়াজ ভালোভাবে শুকিয়ে ৭-৮ মাস সংরক্ষণ করা যায়। তবে এজন্য কিছু করণীয় আছে। অধিক ঝাঁঝালো, বেশি সংখ্যক ত্বক এবং কম আর্দ্রতাবিশিষ্ট পেঁয়াজ বেছে নিতে হবে। সংরক্ষণের পূর্বে বাতাস চলাচলের সুবিধা আছে এমন শীতল ও ছায়াযুক্ত স্থানে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি পরিমাণ পুরু করে বিছিয়ে পেঁয়াজ শুকিয়ে নিতে হয়। মাঠ থেকে সংগ্রহের পর পেঁয়াজের সাথে থাকা গাছের আধা ইঞ্চি পরিমাণ অংশ রেখে দেয়া উত্তম। অপরিপক্ব পেঁয়াজ বাদ দিতে হবে। সনাতন পদ্ধতিতে বাঁশের পাতলা চটি বা বেতির উপর পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা শ্রেয়। ঘরের মেঝে হতে ২ ফুট উঁচুতে মাচা তৈরি করে কিংবা ঘরের সিলিংয়ে উভয় স্থানে রাখা যাবে। তবে সিলিংয়ে রাখা পেঁয়াজের উচ্চতা বা পুরুত্ব যেন ৮-১০ ইঞ্চির বেশি না হয়। বর্ষার সময় স্বাভাবিকভাবে বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকে। তাই সংরক্ষণকৃত পেঁয়াজের পচন যেন না ধরে এবং পানিতে ভিজে না যায়, সেদিক অবশ্যই খেয়াল রাখা চাই। এরকম হলে প্রয়োজনে পেঁয়াজ নামিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে শুকিয়ে পুনরায় সংরক্ষণ করতে হবে।

লেখক : টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল, মোবাইল: ১৭১৫৪৫২০২৬;