নিরাপদ সবজি উৎপাদন কৌশল
ড. হায়াত মাহমুদ১ মোঃ মহাসীন আলী২
মানব শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত করতে সবজি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থসহ অন্যান্য অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এসব পুষ্টি উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং খাবারে রুচি বৃদ্ধি করে। এ ছাড়াও শরীরের জন্য রঙিন শাকসবজিতে রয়েছে এন্টি অক্সিডেন্ট। শরীরের নানা রকম জৈবিক কর্মকা- পরিচালনা ও বুদ্ধির বিকাশেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে সবজি হতে হবে অব্যশই নিরাপদ। এফএও এর সূত্র মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫০০০ মে.টন পেস্টিসাইড এবং প্রতি হেক্টরে ১.৬৪ কেজি পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হয়। এসব পেস্টিসাইড প্রয়োগের পর সাধারণত কোনটি ৩ দিন, কোনটি ৭ দিন এবং কোনটি ২১ দিন পর্যন্ত অপেক্ষমাণ সময় লাগে সবজি সংগ্রহের ক্ষেত্রে। কিন্তু পেস্টিসাইড প্রয়োগ করে এই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই অধিকাংশ কৃষক সবজি বাজারে নিয়ে আসে। অথচ এসব শাকসবজি স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ করা সময়ের দাবি। এজন্য আমাদের নিরাপদ সবজি উৎপাদনের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
বালাই ব্যবস্থাপনা
শাকসবজির প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকার মধ্যে কুমড়াজাতীয় সবজির ফলের মাছি পোকা, বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা, টমেটো, বেগুন, ঢেঁড়সের সাদা মাছি, শিম, বেগুন, লাউ, বাঁধাকপি, টমেটো, শসা, কুমড়ার জাবপোকা উল্লেখযোগ্য। এসব পোকা আইপিএম বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে পোকা ধরে মেরে ফেলা, ফেরোমন ফাঁদ, হলুদ ফাঁদ, নীল ফাঁদ এবং বিষটোপ ফাঁদ ইত্যাদির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হব। পোকা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলেই কেবল অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক সময়ে, নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
ফেরোমন ফাঁদ
ফেরোমন ফাঁদ হচ্ছে এক ধরনের কীটপতঙ্গ দমন ফাঁদ যাতে ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করা হয়। পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করার জন্য স্ত্রী পোকা কর্তৃক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়, যা সেক্স ফেরোমন নামে পরিচিত। এ সেক্স ফেরোমনের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পুরুষ মাছি পোকা প্লাস্টিক পাত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ও সাবান পানিতে পড়ে আটকে পড়ে এবং মারা যায়। বাজারে এ প্লাস্টিকের ফাঁদ কিনতে পাওয়া যায়। কিউলিউর, ব্রিনজল লিউর ও ডায়মন্ড লিউর এই তিন প্রকার ফেরোমন ফাঁদ স্থাপনের ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি ১২-১৫টি ফাঁদ প্রয়োজন হয়, সেই ক্ষেত্রে কৃষককে জমির যে কোন এক পার্শ্বের আইল হতে ৫ মিটার ভেতর হতে ১০ মিটার পর পর বর্গাকারে ফাঁদ স্থাপন করতে হব। প্রতি ২.৫ শতাংশ জমির জন্য ১টি ফাঁদ ব্যবহার করা উচিত হবে। একটি টোপ এক মৌসুমের জন্য প্রযোজ্য। প্রতি ৪-৫ দিন অন্তর অন্তর ফাঁদের সাবান মিশ্রিত পানি পোকাসহ পরিষ্কার ও পরিবর্তন করতে হবে।
আঠালো ফাঁদ (হলুদ, সাদা ও নীল ফাঁদ)
পোকা দমনে আঠালো ফাঁদ একটি নিরাপদ, অবিষাক্ত ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি বা কৌশল। হলুদ ফাঁদ মূলত বিভিন্ন পোকা বিশেষ করে জাবপোকা, সাদা মাছি ও শোষক পোকাসহ অন্যান্য ছোট পোকা দমনে ব্যবহার করা হয়। নীল ফাঁদ থ্রিপস, জাবপোকা, শ্যামা পোকা এবং লিফ মাইনর পোকা দমনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সাদা ফাঁদ থ্রিপস, ফ্লি বিটল, রেড মাইট এবং প্লান্ট বাগ দমনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সবজি চাষে বিঘাপ্রতি ২৫-৩০টি হলুদ আঠালো ফাঁদ জমির ৩-৪টি জায়গায় দড়ি দিয়ে বা খুঁটির সাহায্যে লাগিয়ে দিলে প্রচুর পোকা আটকে মারা যাবে। সাদা এবং নীল আঠা ফাঁদ একইভাবে ব্যবহার করতে হবে।
নেট হাউজ
আমাদের দেশের কৃষক বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য সপ্তাহে প্রায় ৩-৪ বার কীটনাশক ব্যবহার করে থাক। তারপরও এ পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু নিরাপদ বেগুন উৎপাদনের ক্ষেত্রে নেট হাউজ একটি যুগোপযোগী আধুনিক প্রযুক্তি। অর্থাৎ নেটিং পদ্ধতিতে নাইলনের ৯ মিমি. ম্যাশ নেট দিয়ে বেগুন ক্ষেত ঘিরে দেয়া হলে বেগুনের ডগা ও ফলছিদ্রকারী পোকার প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে ফলে কীটনাশক প্রয়োগ করার মোটেই প্রয়োজন হয় না। বেগুন নিরাপদভাবে উৎপাদন করা এ প্রযুক্তিতেই সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে।
মালচিং সিট
সাধারণ মালচিং এর চেয়ে প্লাস্টিক মালচিং একটু ভিন্ন। পলিথিন জাতীয় এ সিটের উপরের রঙ সিলভার এবং নিচের রঙ কালো। সবজি চাষের ক্ষেত্রে এটি উপযোগী পদ্ধতি। বেলে ও দো-আঁশ মাটির ক্ষেত্রে প্লাস্টিকগুলো ৬-৭ বার একই ধরনের ফসলের চাষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা সম্ভব। সেচ সাশ্রয়, আগাছা নিয়ন্ত্রণ এবং জৈব কার্বন সংরক্ষিত হয়। জমি তৈরি করার পর বেড তৈরি করে সিট দিয়ে বেড ঢেকে দিয়ে সিট ছিদ্র করে চারা রোপণ করতে হবে।
নিরাপদ সবজি উৎপাদনে নি¤েœাক্ত উত্তম কৃষি চর্চাগুলো অনুসরণীয় : সুষম সার ব্যবহারসহ বিশুদ্ধ সেচের পানি ব্যবহার করতে হবে। সেচ, সার, বীজ/চারা রোপণ, বালাইনাশক প্রয়োগের সময়, তারিখ অবশ্যই লিখে রাখতে হবে, যাতে করে পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। ট্রাইকোডার্মা সম্বলিত বায়োপেস্টিসাইড ব্যবহারের মাধ্যমে মাটিবাহিত রোগ জীবাণু ও নেমাটোড দমন করা যায়। থ্রিপস, মাইটস এবং সাদামাছি দমনের জন্য জৈব বালাইনাশক হিসেবে স্পিনোসেড (ট্রেসার বা সাকসেস) ৪ মিলি/১০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করতে হবে। এটির জন্য ৫-৭ দিন অপেক্ষমাণ সময়ের প্রয়োজন হয়। থ্রিপস, জাব, সাদামাছি, জ্যাসিড পোকা দমনের জন্য অ্যাবামেকটিন-বায়োম্যাক্স-এম ১.২ ইসি ১ মিলি/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করেও এ পোকা দমন করা যায়। এটির জন্য ৫-৭ দিন অপেক্ষমাণ সময়ের প্রয়োজন হয়। বেগুন, টমেটো এবং বাঁধাকপির স্পোডপটেরা লিটুরা দমনের জন্য ফেরোমন ট্র্যাপ অর্থাৎ ৮০-৮৫টি লিউর/হে. স্থাপন করেও এ পোকা নিয়ন্ত্রন করা যায়। শিমের জাবপোকা, বেগুনের জাব ও জ্যাসিড পোকা দমনের জন্য ইমিটাফ ২০ এসএল ০.৫ মিলি/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করে পোকাটি দমন করা সম্ভব। রাসায়নিক বালাইনাশক সাইপারমেথ্রিন/আলফা-সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের জন্য ৪-৫ দিন, ম্যালাথিয়ন/ফেনিট্রোথিয়ন/ফেনথিয়ন/ফেনভেলারেট/ফেনথোয়েট গ্রুপের জন্য ৭-১০ দিন, ডায়াজিনন/কুইনালফস/ ক্লোরপাইরিফস/ইমিডাক্লোপ্রিড/থায়ামেথোক্সম গ্রুপের জন্য ১০-১৫ দিন, এসিফেট/কার্বারিল/কাটাপ/ ফিপ্রোনিল/ ডায়মিথোয়েট গ্রুপের জন্য ১৫-২০ দিন এবং কার্বোফুরান গ্রুপের জন্য ২০ ২৫ দিন অপেক্ষমাণ সময়ের প্রয়োজন হয়। লিটল লিফ অব ব্রিনজল, ঢলে পড়া, গোড়া পঁচা, বেগুনের ফোমোপসিস রোগ এবং কুমড়াজাতীয় ফসলের অ্যান্থ্রাকনোজ রোগ দমনের জন্য ডাইনামিক ২ গ্রাম/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ধারাবাহিকভাবে ৪ বার প্রয়োগ করতে হবে। সবজি ফসলের ভাইরাস রোগ দমনের জন্য রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে যেমন, ঢেঁড়সের হলুদ মোজাইক ভাইরাস প্রতিরোধী জাত (গ্রীন ফিংগার, মার্ভেলাস ওকে-১৮২০ ও বারি ঢেঁড়স-২); টমেটোর লিফ কার্ল ভাইরাস প্রতিরোধী জাত (বাহুবলী ও রাজাবাবু); বেগুনের লিটল লিফ অব ব্রিনজাল ভাইরাস প্রতিরোধী জাত (হাইব্রিড লুনা ও হাইব্রিড গ্রীনবল); পেপের হলুদ মোজাইক ভাইরাস প্রতিরোধী জাত (ইস্পাহানি কিং ও ইস্পাহানি কুইন ইত্যাদি)।
লেখক: ১অধ্যক্ষ (পিআরএল), কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঝিনাইদহ। ২অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কুষ্টিয়া। মোবাইল : ০১৭২৭১৮২৬১৫, ই-মেইল : mhyat81@gmail.com