Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পুষ্টি-নিরাপত্তা-ও-অর্থনৈতিক-উন্নয়নে-নিরাপদ-ফল-চাষ-সম্প্রসারণ

পুষ্টি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে 
নিরাপদ ফল চাষ সম্প্রসারণ 
কৃষিবিদ বাদল চন্দ্র বিশ্বাস
ফল শুধু খাদ্য হিসেবেই নয়- মানবদেহের পুষ্টি সাধন, ভিটামিনের চাহিদাপূরণ, শারীরিক বৃদ্ধি, মেধার বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধে ফলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাছাড়া ফলের ভেষজ গুণাবলিও অনেক। আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বিশেষত ভিটামিন, খনিজ এর অন্যতম উৎস ফল। এ ছাড়াও ফলে রয়েছে জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান, যেমন- ক্যারোটিন, সেলুলোজ, অ্যান্টি অক্সিডেন্টগুলো ও পানি। ফল রান্না করতে হয় না এবং কাঁচা-পাকা উভয় অবস্থাতেই সরাসরি খাওয়া যায়। ফলে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের অপচয় কম হয়। তাই পুষ্টির নিশ্চয়তায় ফলই উত্তম। 
ফলই বল। তাই পুষ্টিবিদরা দৈনিক মাথাপিছু ১০০-২০০ গ্রাম বিভিন্ন প্রকারের ফল খাবার পরামর্শ দিয়েছেন কিন্তু গড়ে আমরা প্রতিদিন মাথাপিছু প্রায় ৯৫.৪ গ্রাম ফল খেয়ে থাকি, যা দৈনিক চাহিদার প্রায় ৪৮ শতাংশ (ঐওঊঝ-২০২২)। বাকিটুকু যদি খাওয়ার অভ্যাস করতে পারি, তাহলে আমাদের ফলের উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে।
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ খুব ছোট দেশ হলেও এদেশের মাটি ও আবহাওয়া ফল চাষের জন্য খুবই অনুকূল।  দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চার শতাধিক প্রজাতির ফল জন্মে। এর মধ্যে ফলসম্ভারে পরিপূর্ণ  বাংলাদেশেই খাওয়ারযোগ্য ফল জন্মে ১৩০টি, তবে বর্তমানে ৭০-৮০ প্রজাতির বিভিন্ন জাতের ফলের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ১০-১২ প্রজাতির ফল প্রধান যেগুলোর চাষ বাণিজ্যিকভাবে করা হয়। ফলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এতে একদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এবং ফল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে ।  
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এর তথ্য মতে গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে এবং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ৩টি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে নবম ও পেয়ারায় অষ্টম, এ ছাড়াও মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে। বিগত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে  ফলের আওতাধীন জমির পরিমাণ (বাণিজ্যিক ফল বাগান ও বসতবাড়ি বাগানসহ) ছিল ৯.৩৬ লাখ হেক্টর এবং তা থেকে ১০৩.৪১ লাখ মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফল চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে ৭.৬৬ লাখ হেক্টর হয়েছে কিন্তু ফলের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ১৫০.৩৩ লাখ মেট্রিক টন। 
উত্তরাঞ্চলের ‘শস্যভা-ার’ খ্যাত বরেন্দ্র অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সমন্বিত মিশ্র ফল চাষ পদ্ধতি। একে অন্যের দেখা দেখি উৎসাহিত হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। আম ও লিচু চাষ করে এই অঞ্চলের কৃষকরা স্বাবলম্বি হয়েছেন অনেক আগেই। তবে বর্তমানে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা গড়ে তুলেছেন আম, পেয়ারা, পেঁপে, মাল্টা, লেবু, কলা এবং উন্নত জাতের বরই গাছের মিশ্র ফলের বাগান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের উন্নত চাষপদ্ধতি বিষয়ক পরামর্শ নিয়ে লাভবানও হচ্ছেন তারা। 
ফল উৎপাদনে সম্প্রতি অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে পাহাড়ি এলাকা। ভূমি বৈচিত্র্যের জন্য বহু রকমের ফল পাহাড়ে চাষ করা যায়। দুই দশক আগেও পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ হতো না। ২০০৪ সাল থেকে মূলত বাণিজ্যিকভাবে ফলের বাগান করা শুরু হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ফলবাগানের সংখ্যা। পাহাড়ি জমিও ফল চাষের আওতায় আসতে থাকে। ২০১৭ সালে প্রায় ৯২ হাজার হেক্টর জমিতে ১৫ লাখ ৫৯ হাজার টন ফল উৎপাদিত হয়। ছয় বছরের মাথায় উৎপাদন ১৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায়  ২০ লাখ টনে। ফল চাষে জমির পরিমাণ ১ লাখ হেক্টর। তিন পার্বত্য জেলায় সবচেয়ে বেশি ফল উৎপাদিত হয় বান্দরবান জেলায়। গত বছর প্রায় ৯ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছে এই জেলায়। ফল উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থান রাঙ্গামাটির, প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন। আর খাগড়াছড়িতে উৎপাদিত হয় প্রায় ৪ লাখ টন। তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় ৪০ হাজার ছোট-বড় উদ্যোক্তা ফল চাষে যুক্ত হয়েছেন। তাদের হাত ধরে পাহাড়ি এলাকায় আম, কলা, কাঁঠাল, পেঁপে, আনারস, কমলাসহ ৪৪ জাতের ফল উৎপাদিত হচ্ছে। সারা দেশে উৎপাদিত ফলের প্রায় ১৫ শতাংশ এখন আসে এই তিন পার্বত্য জেলা থেকে।  তিন পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত মোট ফলের প্রায় ৮১ শতাংশই ছয়টি ফল-আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস ও কমলা। এই ছয়টি ফল ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫৯৪ টন উৎপাদিত হয়ে থাকে। এসব ফল ছাড়াও এখন ড্রাগন, রাম্বুটান, কাজুবাদাম, জলপাই, আপেলকুলসহ ৩৮টি ফল উৎপাদিত হয়। এসব চাষাবাদের বাইরেও এখনও পাহাড়ে ৫ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি পড়ে আছে, যেখান থেকে নির্দিষ্ট ফসল চাষ করে বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। মধুপুরের পাহাড়ি এলাকার জমিতে প্রচুর আনারস উৎপাদিত হয়। এবারও ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে। এর মধ্যে নতুন জাত এমডি-২ আনারস চাষ করা হয়েছে ১২ হেক্টরে। সংরক্ষণ সময় অধিক তাই বিদেশের বাজার ধরার জন্য নতুন জাতের এমডি-২ আনারস চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কারণ এই আনারস পাকার পর প্রাকৃতিকভাবেই এক মাস সংরক্ষণ করা যায়। গারো পাহাড়ের মাটির একটি বিশেষ গুণ রয়েছে, তা হলো পানি আটকে থাকে না। তাই এখানে সাম্মাম বা রকমেলন ফল চাষ হচ্ছে। 
দেশের মোট আয়তনের ২০ শতাংশ উপকূলীয় জমিকে প্রচলিত দেশীয় ফলের উৎপাদন হাব তৈরি করে সফেদা, মাল্টা, নারিকেল, কলা, আমরুল, বৈচি, বিলাতি গাব, পেঁপে এবং তরমুজের বাণিজ্যিক চাষ বৃদ্ধি করার বিশেষ সুযোগ রয়েছে। 
ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষিতে বর্তমান সরকারের দূরদর্শী নেতৃত্বে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। 
বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়নের জন্য আম প্রাপ্তির সময় বৃদ্ধিতে গৌড়মতি, জাদুভোগসহ বিবিধ নাবী জাতের নতুন নতুন আমের জাতের সম্প্রসারণের ফলে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত আম পাওয়া যাচ্ছে যেখানে দেশে পূর্বে এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত আম পাওয়া যেত। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের কাটিমন জাতের আম চাষ সম্প্রসারণের ফলে সারা বছরই আম প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি বছর ১৬ শতাংশ হারে আমের উৎপাদন বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কতৃক সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নর ফলে বর্তমানে সারা বছরই পেয়ারা পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও দেশে শুধু বর্ষা মৌসুমে পেয়ারা পাওয়া যেতো। বিগত ১০ বছরে দেশে পেয়ারা উৎপাদন হয়েছে দ্বিগুণ। দেশে উৎপাদিত পেয়ারার ৭০ শতাংশই থাই জাতের পেয়ারা। বলসুন্দরী কুল একটি উচ্চফলনশীল জাত এবং ফলের গড় ওজন প্রায় ১০০ গ্রাম। পাকা ফলের মিষ্টতা অন্যান্য সকল কুল অপেক্ষা বেশি। এই কুল টেবিল ফ্রুট (ঞধনষব ঋৎঁরঃ) হিসেবে আপেলের পরিবর্তে খাওয়া যায়। প্রকল্পের মাধ্যমে বলসুন্দরী কুল চাষ সম্প্রসারণের ফলে দেশে আপেল আমদানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।
চারা-কলমের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্যমান হর্টিকালচার সেন্টারগুলো সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ ও নতুন নতুন হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপনের কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে। 
দেশের প্রচলিত ও অপ্রচলিত এবং চাষ উপযোগী দেশি ও বিদেশি ফলের জাত সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ৩টি জার্মপ্লাজম সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এ সকল জার্মপ্লাজম সেন্টারে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ প্রচলিত ফল এবং আমড়া, চালতা, আতা, কুলের বিবিধ জাতসহ অপ্রচলিত ফল ও দেশে চাষ উপযোগী বিদেশী ফল যেমন: রাম্বুটান, আরবি খেজুর, পার্সিমন, লংগান, অ্যাভোক্যাডো ইত্যাদি ফলের আধুনিক ও উন্নত জাতের চারা/কলম রোপণ করা হয়েছে। হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর মাধ্যমে সারা দেশে এ সকল ফলের চারা/কলম বিতরণ সহজলভ্য হবে।
দেশের হারিয়ে যাওয়া বিশেষ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ অপ্রচলিত যেমন- আতা, ডেউয়া, লটকন, বাতাবিলেবুসহ অন্যান্য ফলের ফলন বৃদ্ধিসহ দেশের ১১ কোটি শতক পতিত জমিতে দ্রুত বর্ধনশীল ফলগাছ এবং দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি ফল গাছের সমন্বয়ে মিশ্র ফলবাগান সৃষ্টি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলের বাণিজ্যিকীকরণে নিরাপদ ফল উৎপাদনের জন্য উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মানসম্মত আমের বর্তমান অবস্থা হতে ৫% বৃদ্ধি করাসহ রফতানি আয় বৃদ্ধি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন সাধনের প্রচেষ্টা চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩০৪৫.৪৬৭ মে.টন আম রপ্তানি করা হয়েছে।
ফল সংরক্ষণ এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং এ জন্য সরকার সারাদেশে কোল্ডস্টোরেজ সুবিধা চালুর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ম্যাংগো গ্রেডিং, ক্লিনিং ও কুলিং শেড নির্মাণ, ম্যাংগো প্লাকার ও হাইড্রোলিক ম্যাংগো হারভেস্টার সরবরাহ করছে। সেই সাথে নিরাপদ ফলের বাণিজ্যিকীকরণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্যাকিং হাউজকে শক্তিশালী করে এতে আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক প্যাকিং হাউজ ও ল্যাবের মাধ্যমে আমদানিকারক দেশের আমদানি শর্তানুযায়ী ২৫-৩০% রপ্তানি বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নিয়েছে।
সর্বোপরি, বাংলাদেশে ফলের ফলন সাড়ে ১১ শতাংশ হারে বাড়ায় মানুষের মাথাপিছু ফল গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। ২০০৮-০৯ সালে দেশের ফলের উৎপাদন ছিলো প্রায় ১ কোটি টন আর বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ১ কোটি ২২ লাখ টন এর পেছনে রয়েছে সরকারের দূরদর্শী পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই দেশে নীরবে ঘটে চলেছে ফলবিপ্লব। বাণিজ্যিক চাষাবাদ সম্প্রসারণ করা গেলে পুষ্টির চাহিদা তো পূরণ হবেই, আমদানি কমিয়ে বাঁচানো যাবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও। এ অর্জন কারও একার নয় বর্তমান সরকারের দূরদর্শী নেতৃত্বে সকল স্তরের কৃষিনির্ভর ব্যক্তিবর্গ এ সাফল্যের অংশীদার। 

লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি,     ঢাকা-১২১৫। ই-মেইল : dg@dae.gov.bd