ইঁদুরের চিবানো অভ্যাসের
কারণ ও ক্ষতির ধরন
মোছা: মাসুমা মমতাজ মীম১ ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ২
ইঁদুর “রাটাস” গণের এবং রডেনশিয়া বর্গের একটি দন্তুর স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইঁদুরের পা ৪টা, দুটি কান, দুটি চোখ আছে। রডেনট পরিবারের এই প্রাণীর দৈহিক গঠন ১২ সেমি অথবা ৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে (ছোট লেজযুক্ত ইঁদুরগুলিকে প্রায়শই ছোট ইঁদুর হিসাবে উল্লেখ করা হয়)। বৈজ্ঞানিক তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের ইঁদুরগুলো মূলত এশিয়া মহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্বের সংলগ্ন দ্বীপের রাটাস বংশের। কিছু প্রজাতি মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে তাদের স্থানীয় উৎপত্তি বা জন্মস্থানের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। বাদামি ইঁদুর, (যাকে নরওয়ে ইঁদুরও বলা হয়) এবং ঘরের ইঁদুর, (যাকে কালো ইঁদুর, জাহাজের ইঁদুর বা ছাদের ইঁদুরও বলা হয়), ঘন-বসতিপূর্ণ এলাকাতে বাস করে। উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে ইঁদুর বংশবৃদ্ধি এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে, বিশেষ করে শহুরে এলাকায় বাদামি ইঁদুরের প্রাধান্য থাকে। সারা পৃথিবীতে ২৭০০টির বেশি ইঁদুরজাতীয় প্রজাতি আছে।
বাহ্যিক গঠন
ইঁদুরের সাধারণত চিকন মাথা, বড় চোখ এবং বিশিষ্ট, পাতলা পশমযুক্ত কান থাকে। তাদের মাঝারিভাবে লম্বা পা এবং লম্বা, ধারালো নখর রয়েছে। তাদের সরু পশ্চাৎ পায়ের তলগুলো প্রজাতির উপর নির্ভর করে পরিবর্তনশীল আকারের মাংসল প্যাড ধারণ করে। বাদামি ইঁদুরের দেহ ঘরের ইঁদুরের চেয়ে বড় এবং এর লেজ শরীরের তুলনায় খাটো। তাদের দাঁত জোড়া ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান, ক্ষুর-তীক্ষè, খোলা শিকড়যুক্ত ইনসিসার ধরনের। এদের ১৬টি দাঁত থাকে। উভয় পাটিতে সামনে একজোড়া করে ছেদন দাঁত আছে, যা অত্যন্ত তীক্ষè ও ধারালো। তথ্য অনুসারে ইঁদুর প্রতি সেকেন্ডে ছয়বার কামড়াতে পারে এবং প্রতিটি কামড়ে এক বর্গ ইঞ্চির জন্য ৭,০০০ পাউন্ড শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।
ছেদনগুলো হলো ইঁদুরের প্রধান দাঁত কারণ তারা এই দাঁত দিয়েই খাবার চিবিয়ে খায়। এগুলো হল সামনের দাঁত, দুটি উপরের দিকে এবং দুটি মুখের নিচে। সাধারণত লম্বা হয় এবং মাড়ির নিচে প্রসারিত হয়। ছেদন দাঁত গজানোর পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। কাটাকাটি না করতে পারলে দাঁত বেড়ে চোয়াল দিয়ে বের হয়ে যায় এবং ইঁদুরের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দাঁত ঠিক রাখার জন্য ইঁদুর সর্বদা শক্ত জিনিস কাটাকাটি করে। ইঁদুরের দাঁতগুলো এক বছরে কয়েক ইঞ্চি বাড়তে পারে, যা প্রাণীর জন্য মারাত্মক ব্যথার কারণ হতে পারে। এজন্যই তারা জিনিসপত্র চিবিয়ে চিবিয়ে তাদের দাঁতকে ঠিক রাখে।
ক্ষতির ধরন
এদের চোয়ালের শক্তি অনেক বড় বড় প্রাণীর থেকেও বেশি । এজন্যই এরা সবধরনের জিনিস চিবিয়ে খেতে পারে। ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতি বিভিন্ন উপায়ে হয়ে থাকে যেমন : কাঠ, কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, মুদিখানার জিনিসপত্রের মধ্যে বাসা তৈরি করে এবং জিনিসপত্র কেটে নষ্ট করে। মাটির দেয়ালে ও ফসলি জমিতে গর্তের মধ্যে থেকে ফসলের ক্ষতি সাধন করে। ৪. প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, পানির বোতল এসব জিনিসও কেটে ফেলে। ধান, গম, ভুট্টাজাতীয় ফসলের বেশি ক্ষতি করে থাকে। বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং; যেমন টেলিভিশন, ল্যাম্প, এবং যন্ত্রপাতির তার এবং পুরনো বৈদ্যুতিক তার যেগুলো অ্যালুমিনিয়াম এর তৈরি এগুলোও কেটে ফেলে।
এছাড়াও, ইঁদুর মাঠ থেকে শুরু করে ফসল কর্তনের পরে গুদামজাত অবস্থায় বা গোলায় তোলার পরেও ক্ষতি করে। ইঁদুর শুধু ফসল নয় মানুষের স্বাস্থ্য, সম্পদেরও ক্ষতি করে থাকে এবং রোগজীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে। ইঁদুর একটি চতুর স্তন্যপায়ী প্রাণী যার ক্ষতির ব্যাপকতা কৃষি প্রধান বাংলাদেশে অনেক বেশি।
ইঁদুর দ্বারা বৈদ্যুতিক তারের ক্ষতির কারণ
বৈদ্যুতিক তারের মধ্যে পাতলা ধাতু এবং রাবার বা প্লাস্টিক জাতীয় বিভিন্ন উপকরণ রয়েছে। ইঁদুরেরা তাদের দাঁত ঠিক রাখা ছাড়াও বিভিন্ন কারণে বৈদ্যুতিক তার চিবিয়ে খায়। তারা সাধারণত এমন জিনিস বা পথ বাছাই করে যা প্রতিদিনের চলাফেরা সময় তাদের পথে থেকে চলাফেরাতে সাহায্য করে। তারের উপর দিয়ে যাতায়াতের সময় কখনও কখনও তার কেটে ফেলে।
ইঁদুরের বৈদ্যুতিক তার চিবানোর আরেকটি কারণ হলো তারা তারের মধ্যে থাকা উপাদানগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু তারের নিরোধক সয়াভিত্তিক। অন্যান্য তারগুলো, বিশেষ করে গাড়ির তারগুলো, চীনাবাদামের তেল, চালের ভুসি এবং অন্যান্য উদ্ভিদভিত্তিক উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। যখন কিছু তার উষ্ণ হয়, তখন তারা ভ্যানিলার মতো একটি সুগন্ধ তৈরি করে থাকে, যা ইঁদুরকে আকর্ষণ করে।
কৃষিক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব
তথ্য অনুসারে, ইঁদুর কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে থাকে। বাংলাদেশে ইঁদুরের কারনে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ফসলের ৪-১২ ভাগ, গোল আলুতে ৫-৭ ভাগ এবং আনারস ৬-৯ ভাগ নষ্ট হয়। বাংলাদেশে ইঁদুরের কারনে ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট হয়। কৃষিজাত ফসলে আক্রমণ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচুর ক্ষতি করে থাকে। বীজতলায় গর্ত করে চারার বৃদ্ধি রহিত করে। শুধু মাঠ নয়, মাঠ ও গুদাম উভয় স্থানে গর্তে করে, ফসল খেয়ে ফেলে এবং পায়খানা প্রস্রাব, শরীরের লোম খাদ্যশস্যের সাথে মিশে যায়, যা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একটা ইঁদুর একরাত্রে ২০০-৩০০টি ধান বা গমের কুশি কাটতে সক্ষম। কিছু কিছু ইঁদুর সাঁতার কাটতে পারে। এরা ভাসা আমন ধানের জমিতে বাসা বাঁধে এবং ধানের ক্ষতি করে। সিলেটের হাওর অঞ্চলে এদের প্রাদুর্ভাব বেশি। ঘরের ইঁদুরগুলো সাধারণত গুদামজাত খাদ্য, ঘরে রাখা খাদ্যশস্য, ফলমূল, তরি তরকারি এসব খায় এবং কেটে নষ্ট করে। গম ক্ষেতে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব বেশি। গাছ ও গমের শিষ কেটে নষ্ট করে, ফসলের উৎপাদন কমে যায়। শুধু ধান বা গম নয়, ইঁদুরের উৎপাত সর্বত্রই, যেমন: ইক্ষু ক্ষেতে, নারিকেল বাগানে, আনারসে, আলুর ক্ষেতে, সবজি বাগানে, মুরগির খামারে, গুদামে ইঁদুর তার ধ্বংসাত্মক কাজ করে থাকে যা আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করে।
লেখক : ১শিক্ষার্থী ল্যাবরেটরি অব অ্যাপ্লাইড এন্টোমলজি এন্ড একারোলজি, (এমএস), কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২। ২অধ্যাপক, ল্যাবরেটরি অব অ্যাপ্লাইড এন্টোমলজি এন্ড একারোলজি, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২। মোবাইল: ০১৭১১৪৫২৪৯৬। ই-মেইল :ullahipm@bau.edu.bd