Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পাটভিত্তিক শস্যবিন্যাস অনুসরণ করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি

পাটভিত্তিক শস্যবিন্যাস অনুসরণ করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি
ড. এ. টি. এম. মোরশেদ আলম
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কৃষিভিত্তিক এই অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ফসল খাত। এ দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৩%। কৃষি খাতের এই ১৩% জিডিপির মধ্যে ফসল খাতের অবদান প্রায় ৭%। বাংলাদেশের সংবিধানের  ১৫ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিকের খাদ্যের চাহিদা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। আর এই মৌলিক দায়িত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কৃষিতে শস্যনিবিড়তা (ঈৎড়ঢ়ঢ়রহম ওহঃবহংরঃু) বৃদ্ধি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
 বাংলাদেশের মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৮ লাখ ২৯ হাজার ২৬৬ হেক্টর। আর মোট ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ১৬০ লাখ ৫৬ হাজার ৮১৬ হেক্টর যা এ দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশের বর্তমান         কৃষিবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিতে জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য একটি অনুশাসন প্রদান করে বলেছেন -“এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে”। সুতরাং কৃষিদরদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়ন করার জন্য কৃষিতে ফসল চাষের নিবিড়তা  বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। ফসল চাষের নিবিড়তা  (ঈৎড়ঢ়ঢ়রহম ওহঃবহংরঃু) বলতে আমরা বুঝি বছরে একটি নির্দিষ্ট জমিতে কয়টি ফসল চাষ করা যায়। ফসল চাষের নিবিড়তা  কোন একক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল নয়। এটি ফসল উৎপাদনের সাথে জড়িত একাধিক উপাদানের উপর নির্ভর করে।  কোনো এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, মাটির বৈশিষ্ট্য, সেচ সুবিধা, কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ততা, বর্গা চাষ, অকৃষি খাতে উপার্জন বৃদ্ধি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, কৃষকের আর্থিক অবস্থা, ফসলের ন্যায্যমূল্যের নিশ্চিয়তা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের উপর জমির শস্যনিবিড়তার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। পাট ও পাটজাতীয় ফসল আঁশ ফসলকে শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধি করে ফসল উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
ফসল পর্যায়ক্রম/শস্যবিন্যাস (ঈৎড়ঢ় জড়ঃধঃরড়হ) বলতে একখ- জমিতে এক বছরে পর পর কোন কোন ফসল পর্যায়ক্রমে চাষাবাদ করা হয় সেই বিন্যাসকেই বুঝায়। বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষি অঞ্চলগুলোতে এক ফসলি, দুই ফসলি, তিন ফসলি শস্যবিন্যাস বিদ্যমান আছে। তবে মোট ফসলি জমির প্রায় ৬১ হাজার ৮২২ হেক্টর জমিতে চার ফসলি শস্যবিন্যাস অনুসরণ করে ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭১-৭২ সালে শস্যনিবিড়তা ছিল ১৫৩.৭৪%। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ২০৫% (ডিএই ২০২০-২১)। বর্তমানে  তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২১৫%। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফসল চাষের নিবিড়তা নিচের সারণিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সারণি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কৃষি অঞ্চলগুলোর মধ্যে শস্যনিবিড়তা সবচেয়ে বেশি  (২৩৬%) বগুড়া ও যশোর অঞ্চলে এবং সবচেয়ে কম (১৩৮%) রাঙ্গামাটি অঞ্চলে। আবার, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে যেখানে নদ-নদী ও খাল-বিলের সংখ্যা বেশি সেসব জেলায় ফসল চাষের নিবিড়তা জাতীয় গড়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম। বর্তমানে বাংলাদেশে শস্যনিবিড়তা ২১৫% (ডিএই ২০২২-২৩)। পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলকে শস্যবিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করে পাটের অপ্রচলিত এলাকায় ফসল চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষি অঞ্চলে পাট ফসলভিত্তিক প্রায় ৯৪টি শস্যবিন্যাস চিহ্নিত করা হয়েছে যার অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। উদাহরণস্বরূপ, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় খরিফ-১ মৌসুমে শুধুমাত্র রোপা আমন ধান চাষ করা হয়। কিন্তু এসব অঞ্চলে যদি বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত লবণাক্ত সহিষ্ণু দেশী পাটের জাত ‘বিজেআরআই দেশী পাট ১০’ বর্তমানে বিদ্যমান একফসলি জমির শস্যবিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাহলে লবণাক্ত এলাকার বিস্তর একফসলি জমিতে দুটি ফসল আবাদ করা সম্ভব হবে। এর ফলে লবণাক্ত এলাকার একফসলি জমি দোফসলি জমিতে রূপান্তরিত হবে এবং ফসল উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে ঐসব অঞ্চলের কৃষক অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হবে। আবার, বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্যবিন্যাসটি বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলায় মাঝারি উঁচু শ্রেণির ২.৩১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা হয়। ঐসব জমিতে বিদ্যমান দুই ফসলি শস্যবিন্যাসের স্থলে পাটকে অন্তর্ভুক্ত করে তিন ফসলি শস্যবিন্যাস অনুসরণ করা সম্ভব। কারণ, বোরোর পরে মাঝারি উঁচু জমিতে খুব সহজেই পাট ফসলকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এর ফলে দুই ফসলি শস্যবিন্যাস বোরো-পতিত-রোপা আমন-এর স্থলে তিন ফসলি শস্যবিন্যাস বোরো-পাট-রোপা আমন প্রবর্তিত হবে। তিন ফসলি শস্যবিন্যাস (বোরো-পাট-রোপা আমন) অনুসরণ করার মাধ্যমে বিদ্যমান শস্যবিন্যাস (বোরো-পতিত-রোপা আমন) অপেক্ষা ফসল চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে। শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধির ফলে ফসলের উৎপাদন বহুলাংশে  বেড়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে কৃষকের আয় প্রায় ৩০-৪০%  বাড়বে বলে বিজেআরআই-এর সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীগণ মনে করেন।
সম্প্রতি নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে পাট ও পাটশাকের সাথে অন্যান্য ফসলের সমন্বয় সাধন করে বছরে পাটভিত্তিক চার ফসলি শস্যবিন্যাস ‘আলু-পাটশাক-পাট-রোপা আমন’ উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ০.০২৮ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সাধারণত ‘আলু-পতিত-পাট-রোপা আমন’ শস্যবিন্যাস অনুসরণ করে চাষাবাদ করা হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে যেখানে তিন ফসলি শস্যবিন্যাস আলু-পতিত-পাট-রোপা আমন আবাদ করা হয় সেখানে অনায়াসেই চার ফসলি নতুন শস্যবিন্যাস ‘আলু-পাটশাক-পাট-রোপা আমন’ প্রবর্তন করা সম্ভব। এই নতুন শস্যবিন্যাসটি অনুসরণ করলে ফসল চাষের নিবিড়তা ও ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে  কৃষক অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভবান হবে। পাট ও পাট শাক এই শস্যবিন্যাসে অন্তর্ভূক্ত থাকায় মাটিতে জৈব পদার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে জমির উর্বরতা বজায় রাখবে এবং মানুষের পুষ্টি উপাদান যোগানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। কৃষক অনুসৃত তিন ফসলি শস্যবিন্যাসের চেয়ে পাটভিত্তিক চার ফসলি নতুন শস্যবিন্যাস ‘আলু-পাটশাক-পাট-রোপা আমন’ অনুসরণের ফলে ফসল চাষের নিবিড়তা ও ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়বে এবং সেই সাথে হেক্টরপ্রতি প্রায় ৫৯,৯৬০/- টাকা অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হবে (বিজেআরআই, ২০২০)।
মানুষের খাদ্যের মূল উৎস হিসেবে প্রাথমিক জোগানদাতা হলো কৃষি। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের জোগান শিল্প বা অন্য কোনো সেক্টর থেকে পাওয়া গেলেও ঐসব সেক্টর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় কৃষিকে আধুনিক, টেকসই এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্যের প্রাথমিক জোগানদাতা হিসেবে আরো শক্তিশালী করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রেখে আবাদযোগ্য সমস্ত জমি চাষের আওতায় এনে শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, সেই সাথে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।

লেখক :  মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল ফোন নম্বর ঃ ০১৭৪০-৫৫৯১৫৫, ই-মেইল ঃ morshedbjri@gmail.com