Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বসতবাড়িতে পাটশাক উৎপাদন ও পারিবারিক পুষ্টির চাহিদাপূরণ

বসতবাড়িতে পাটশাক উৎপাদন
ও পারিবারিক পুষ্টির চাহিদাপূরণ
ড. এ. টি. এম. মোরশেদ আলম
বাংলাদেশের বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কৃষিকে টেকসই করার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। সে প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পতিত জমির যথাযথ ব্যবহারের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। উক্ত নির্দেশনায় তিনি বলেছেন-‘এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য বসতবাড়ির আশপাশের চাষযোগ্য পতিত জমিতে বছরব্যাপী বিভিন্ন প্রকার শাকসবজির চাষাবাদ করা একান্ত প্রয়োজন বলে  কৃষি সংশ্লিষ্ট সকলেই মনে করেন। এক্ষেত্রে বসতবাড়ির সবজি বাগানের একটি অংশে অথবা আশপাশের চাষযোগ্য পতিত জমিতে সারা বছর ধরে পাটশাক উৎপাদন করে সহজেই পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি প্রয়োজনের অতিরিক্ত পাটশাক বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।
বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত পুষ্টিসমৃদ্ধ পাটশাক : পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ৩০০ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। কারণ, শাকসবজিতে মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন, খনিজ লবণ ও আঁশ রয়েছে। এসব শাকসবজি কেবল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় না, বরং ভক্ষণকৃত খাদ্যকে হজম, পরিপাক ও বিপাকে সহায়তা করে এবং খাবারে রুচি বৃদ্ধি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শাকসবজির এসব গুণাগুণ বিবেচনা করে দেশের প্রাচীনতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট শাক হিসেবে ব্যবহারের জন্য পাটের তিনটি জাত উদ্ভাবন করেছে।  উক্ত জাতগুলোর মধ্যে বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ ও বিজেআরআই দেশি পাট শাক ৩। ১০০  গ্রাম পাটশাকে ক্যালসিয়াম ১.৯৭ গ্রাম, পটাশিয়াম ১.৬৮ গ্রাম, সোডিয়াম ০.১১৮  গ্রাম, ফসফরাস ০.৬২১ গ্রাম, আয়রন ৮৫৮ গ্রাম, আর্দ্রতা ৮৪.৭২ গ্রাম, প্রোটিন ৩.৬০ গ্রাম, শর্করা ১৭.৩৪ গ্রাম, বিটা ক্যারোটিন (মাইক্রো গ্রাম/১ গ্রাম) ১২২.২০ গ্রাম, ভিটামিন-সি (মিলিগ্রাম/ ১০০ গ্রাম) ৬৭.৭৩%।
বসতবাড়ির আশপাশে পাটশাক উৎপাদনের সুবিধা : পাট একটি পরিবেশবান্ধব ফসল। বসতবাড়ির আশপাশে বছরব্যাপী বিভিন্ন জাতের পাটশাক চাষাবাদের ফলে বসতবাড়ির পরিবেশ ভাল থাকে। কারণ, পাট ফসল বায়ুম-ল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং
বায়ুম-লে
অক্সিজেন ত্যাগ করে। এ ছাড়া সারাবছর পাটশাক চাষাবাদের উপকারিতা নিম্নরূপ-
নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী সারাবছর বিভিন্ন জাতের পাটশাক চাষ করা যায়; পাটশাক বিভিন্ন প্রকার পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ;  স্বাস্থ্যসম্মত ও বিভিন্ন বয়সের টাটকা পাটশাক সারা বছর পাওয়া যায়; পুষ্টির দিক থেকে অন্যান্য শাকসবজি অপেক্ষা পাটশাক উন্নতমানের হয়ে থাকে; বাড়ির আশপাশের পতিত জমির সর্বোত্তম ব্যবহার হয়ে থাকে; উৎপাদন কৌশল সহজ ও উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম; বাড়ির সদস্যরা সহজেই চাষ করতে পারে বিধায় শ্রমিক ব্যয় হয় না এবং সহজেই পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়।
বসতবাড়িতে পাটশাক চাষাবাদ কলাকৌশল
চাষ উপযোগী জমি : পলি দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটি বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ এর ফলন ভাল হয় বেলে দো-আঁশ ও  দো-আঁশ মাটিতে।
বপনকাল : শাকের ভাল ফলন পাওয়ার জন্য বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বপন করা যায়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ বপনের উপযুক্ত সময় ফাল্গুন মাসের ১ম থেকে মধ্য কার্তিক পর্যন্ত। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য আশি^ন পর্যন্ত বপন করা হয়। এছাড়াও পাটশাকের জাতগুলো সারা বছরই চাষ করা যায়।
জমি তৈরি : পাটশাকের প্রতিটি জাতের ক্ষেত্রে জমি তৈরির জন্য কোদাল দিয়ে কুপিয়ে জমি ভালভাবে চাষ করতে হয়। বাঁশ/কাঠের লাঠি দিয়ে মাটির ঢেলা গুঁড়া করে জমির মাটি মিহি করে প্রস্তুত করতে হয়।
বীজ বপন : ছিটিয়ে বা সারিতে উভয় পদ্ধতিতে পাটশাকের বীজ বপন করা যায়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সে.মি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৫-৬ সেমি. বজায় রাখতে হয়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ১৫-২০ সেমি. এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২-৪ সেমি. রাখতে হয়। তবে সারিতে বীজ বপন করলে গাছের পরিচর্যা করা সহজ হয় এবং এতে পাটশাকের ফলনও বৃদ্ধি পায়।
বীজের পরিমাণ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ ছিটিয়ে বপন করলে প্রতি শতাংশ জমিতে ৩০-৪০ গ্রাম বীজ  এবং সারিতে বপন করলে  ২৪-২৫ গ্রাম বীজ লাগে। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ ছিটিয়ে  বপন করলে প্রতি শতাংশে ৪০-৪৫ গ্রাম বীজ এবং সারিতে বপন করলে প্রতি শতাংশে ৩০-৩৫ গ্রাম বীজ লাগে। আবার, বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ ছিটিয়ে  বপন করলে প্রতি শতাংশে ৪০-৫০ গ্রাম বীজ  এবং সারিতে বপন করলে প্রতি শতাংশ জমিতে ৩০-৩৫ গ্রাম বীজ লাগে।
সার প্রয়োগের পরিমাণ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ চাষাবাদের ক্ষেত্রে গোবর সার প্রয়োগ না করলে প্রতি শতাংশ জমিতে ২৬৭ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি ও ১৬২ গ্রাম এমওপি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। পক্ষান্তরে বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২  এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ আবাদ করলে যদি জমিতে গোবর সার প্রয়োগ করা না হয় তাহলে  উভয়ের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশ জমিতে ৩০৩ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ টিএসপি ও ৫০ গ্রাম এমওপি সার জমি তৈরির সময় মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে যদি গোবর সার ব্যবহার করা হয় সে ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার অপেক্ষাকৃত কম লাগবে।
আন্তঃপরিচর্যা : বীজ বপনের ১-২ সপ্তাহ পর জমির জোঁ বুঝে আঁচড়া দিতে হবে। এ সময় চারার সংখ্যা ঘন হলে প্রাথমিকভাবে চারা পাতলা করে দিতে হয়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ এর ক্ষেত্রে গাছের বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ (ম্যাড়াশাক, লাল) ও বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ (ম্যাড়াশাক, সবুজ)-এর ক্ষেত্রে গাছের বয়স ২০-২৫ দিন হলে  একবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। এ সময় সুস্থ ও সবল গাছ রেখে দুর্বল ও চিকন গাছ তুলে ফেলতে হবে। সাধারণত  তিনটি জাতের পাটশাকে তেমন কোন রোগ ও পোকার আক্রমণ দেখা যায় না বিধায় কোনো প্রকার কীটনাশক/ছত্রাক নাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ (ম্যাড়াশাক, লাল) ও বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ (ম্যাড়াশাক, সবুজ)-এর গাছের ‘ক্যানোপি’ কম হওয়ায় অল্প জায়গায় অধিক সংখ্যক গাছের সংকুলান হয়।
পাটশাক সংগ্রহ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ এর ক্ষেত্রে গাছের বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ (ম্যাড়াশাক, লাল) ও বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ (ম্যাড়াশাক, সবুজ)-এর ক্ষেত্রে গাছের বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে তখন থেকেই শাক খাওয়া যায়। প্রথমে গাছ তুলে এবং পরবর্তীতে গাছের সংখ্যা কমে গেলে গাছের ডগা ছিঁড়ে শাক খাওয়া যেতে পারে। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ জাতের শাক একবার চাষ করে দীর্ঘ কয়েক মাস পর্যন্ত শাক সংগ্রহ করা যায়। বাড়ির ছাদে কয়েকটি টবে পাটশাক চাষ করে ছোট পরিবারের শাকের চাহিদা সহজেই পূরণ করা যায়। পক্ষান্তরে বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ (ম্যাড়াশাক, লাল) ও বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ (ম্যাড়াশাক, সবুজ) জাতের শাক গাছে দ্রুতই ফুল এসে যায় বলে এক-দুই ধাপেই শাক সংগ্রহ করা যায়।
পাটশাকের ফলন : বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ এবং বিজেআরআই দেশি পাট শাক ২ (ম্যাড়াশাক, লাল)-এর ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশ জমি থেকে প্রায় ১২-১৫ কেজি পাটশাক পাওয়া যায়। অপর দিকে বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ (ম্যাড়াশাক, সবুজ)-এর ক্ষেত্রে শাক পাতার ফলন প্রতি শতাংশ জমিতে প্রায় ১৫-২০ কেজি হয়ে থাকে।
বিজেআরআই-এর বিজ্ঞানীগণ মনে করেন পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় পাটের শাক অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন সুতরাং, নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সহজলভ্য ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য হিসেবে দৈনিক খাবারের তালিকায় পাটশাক অন্তর্ভূক্ত করা অত্যন্ত যুক্তিসংগত। এমতাবস্থায় পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মিটাতে বসতবাড়ির সবজি বাগানে/ আশপাশের পতিত জমিতে পাটশাকের আবাদ করা আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য।

লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৭৪০-৫৫৯১৫৫, ই-মেইল : atmmorshed65@gmail.com