Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

লাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রতিরোধে করণীয়

লাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রতিরোধে করণীয়
ডা: সুচয়ন চৌধুরী
লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) একটি ভাইরাসঘটিত রোগ যা মূলত গৃহপালিত গরু এবং মহিষকে আক্রান্ত করে। প্রাণীর গায়ে ফোসকা দেখে প্রাথমিকভাবে এই রোগ শনাক্ত করা হয়। লাম্পি স্কিন ডিজিজ ছড়িয়ে পড়লে গরু পালনের সাথে জড়িত সকলে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে প্রান্তিক খামারিরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এই রোগের ফলশ্রুতিতে গরু থেকে মাংস উৎপাদন এবং দুধ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে আসে গর্ভপাত এবং অনুর্বরতার মতো বিষয়গুলো।
লাম্পি স্কিন ডিজিজ নির্দিষ্ট পোষকের দেহে আক্রমণ করে। এই পোষকের মধ্যে আছে গরু এবং এশিয়ান মহিষ (ইঁনধষঁং নঁনধষরং)। তবে মহিষে আক্রান্ত হওয়ার হার খুব কম। কিন্তু গরুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
লাম্পি স্কিন ডিজিজ ছড়ানোর কারণ
লাম্পি স্কিন ডিজিজ ছড়ানোর প্রধান কারণ হতে পারে এক খামার থেকে অন্য খামারে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এমন কি এক দেশ থেকে অন্য দেশে গরু নিয়ে যাওয়া। মূলত এই গরু স্থানান্তরের মাধ্যমে অনেকদূর পর্যন্ত এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর মশা, মাছির মাধ্যমে কাছাকাছি স্থানগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মূলত যে মশা, মাছিগুলো পোষকের দেহ থেকে রক্ত পান করে তারাই এ রোগের জীবাণু বহন করে। এক এক এলাকায় একেক ধরনের বাহকের মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে। তবে এই রোগের ভাইরাসটি সাধারণত বাহকের শরীরে বংশবিস্তার করে না। সাধারণত কিছু মাছি (যেমন-ঝঃড়সড়ীুং পধষপরঃৎধহং), মশা (অবফবং ধবমুঢ়ঃর), আঁঠালো (জযরঢ়রপবঢ়যধষঁং ধহফ অসনষুড়সসধ ংঢ়ঢ়) এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
সাধারণত সরাসরি স্পর্শের কারণে এই রোগ ছড়ায় না। প্রাণী আক্রান্ত হওয়ার পর ভাইরাস রক্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে তবে তা অল্প কয়েক দিন থাকে। কিন্তু কিছু কিছু প্রাণীতে এই রোগের সংক্রমণ মারাত্মক হলে এই অবস্থা দুই সপ্তাহ থাকতে পারে। যে সমস্ত প্রাণীর চামড়ায় ক্ষত দেখা যায় এবং নাক মুখ দিয়ে লালা ঝরে তার মাধ্যমে প্রাণীর সামনের খাবার এবং পানি সংক্রমিত হতে পারে।
অসুস্থ প্রাণীর শরীর থেকে যখন ফোসকাগুলো খসে পড়ে তখন সেখানে যে ভাইরাস থাকে তা নতুন করে রোগ তৈরি করার সামর্থ্য রাখে। অসুস্থ ষাড়ের বীর্যেও এই ভাইরাস থাকতে পারে। তাই এই ষাঁড় দিয়ে যদি প্রজনন করানো হয় তাহলে গাভীটিও আক্রান্ত হতে পারে। অসুস্থ গাভী থেকে দুধের মাধ্যমে অথবা ওলানের বাঁটের ক্ষতের মাধ্যমে দুধ খাওয়া বাছুরকে আক্রান্ত করতে পারে।
আক্রান্ত প্রাণীতে ব্যবহৃত নিডল (সুচ) যদি অন্য সুস্থ প্রাণীতে পুশ করা হয় সেক্ষেত্রেও এই রোগ ছড়ানোর একটা আশঙ্কা থাকে।
এলএসডি রোগের লক্ষণ
প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করার চার থেকে সাত দিনের মধ্যে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় সাধারণত প্রথমে নাক এবং চোখ দিয়ে পানি পড়ে; শরীরের কিছু কিছু স্থানে লসিকা গ্রন্থিগুলো ফুলে উঠে, যা সহজে অনুভব করা যায়; খুব বেশি জ্বর থাকতে পারে। যা টানা এক সপ্তাহও হতে পারে; দুগ্ধবতী গাভীর হঠাৎ করে দুধ উৎপাদন কমে যায়; তাছাড়াও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুটি দেখা দেয়। এই গুটিগুলোর ব্যাসার্ধ ১০-১৫ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে এই গুটির পরিমাণ কম বেশি হতে পারে। মুখে, গলায়, তলপেটে, ওলানে এবং পায়ে এই গুটি এবং ক্ষত বেশি দেখা যায়। এই গুটিগুলো ভেতরের দিকে প্রথমে চামড়া থেকে শুরু করে পরবর্তীতে সাবকিউটেনিয়াস স্তরে এমনকি চামড়া নিচে মাংসপেশিতেও পৌঁছে যেতে পারে। মুখের বা নাকের ভেতরে যেই গুটিগুলো উঠে সেগুলো ফেটে গিয়ে ক্ষত হতে পারে। সেখানে দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজও হতে পারে। এই সময় নাকমুখ দিয়ে তরল ঝরতে পারে। সাধারণত যে গুটি উঠে তার মাঝখানে ঘা হতে পারে, যা পরবর্তীতে খোসা আকারে উঠে আসে। চামড়ার এই গুটিগুলো অনেক সময় কয়েক মাসও থেকে যেতে পারে। মাঝে মধ্যে দুই চোখের কর্নিয়াতে ঘাঁ হতে পারে যাতে খুব ব্যথা থাকে। পায়ে বা হাঁটুতে যে ক্ষত হয় তা অনেক সময় ২য় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়াল ইকফেকশনের কারণে চামড়ার নিচে গভীর ক্ষত তৈরি করতে পারে। যার ফলে পশু খোঁড়াতে শুরু করে।
এলএসডি রোগের সাদৃশ্যপূর্ণ অন্য রোগ
রোগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেই ক্ষেত্রে সন্দেহজনক প্রাণীগুলো থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পিসিআর পদ্ধতিতে নিশ্চিতভাবে এই রোগ নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা হয়। এলএসডির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নি¤েœ সে রকম কিছু রোগ নিয়ে আলোচনা করা হলো-
১. সিউডো লাম্পি স্কিন ডিজিজ/বোবাইন হারপিস ম্যামিলাইটিস (ইড়ারহব যবৎঢ়বং ারৎঁং ২) রোগের ফলে চামড়ায় যে লক্ষণ হয় তা অনেক সময় লাম্পি স্কিন ডিজিজের সাথে একই রকম মনে হতে পারে। তবে এই রোগের ক্ষেত্রে ক্ষতটি চামড়ার বেশি ভিতরে প্রবেশ করে না এবং এই রোগটির স্থায়িত্বে লাম্পি স্কিন ডিজিজের চেয়ে অনেক কম এবং তীব্রতাও অনেক কম।
২. সিউডো কাউপক্স (চধৎধঢ়ড়ীারৎঁং) ভাইরাসের সংক্রমণে যে লক্ষণ দেখা যায় তাও লাম্পি স্কিন ডিজিজের সাথে সাদৃশ্যপূর্র্ণ। কিন্তু সিউডো কাউপক্সের ক্ষেত্রে শুধু প্রাণীর ওলানে এবং বাঁটে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ দেখা যায়।
৩. পোকামাকড়ের কামড়, ছুলি/আমবাত এবং আলোক সংবেদনশীলতার কারণে চামড়ায় যে লক্ষণ দেখা যায় তা অনেক সময় লাম্পি স্কিন ডিজিজের সাথে মিল থাকতে পারে। তবে এই ক্ষেত্রেও ক্ষত তেমন গভীর হয় না। এই রোগের তীব্রতাও অনেক কম যা এলএসডির চেয়ে অনেক কম সময়ে সেরে যায়।
৪. ডার্মাটোফিলোসিস হলেও চামড়ায় ক্ষত দেখা যেতে পারে তবে সেটা ঘাঁ হয় না ।
৫.  ডেমোডিকোসিস হলে সাধারণত গলায় এবং তলপেটের চামড়ায় ক্ষত থাকে। আর এই রোগে শরীরের পশম পড়ে যায়। এই রোগের চামড়া থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করলে মাইট পাওয়া যায়।
৬.  বোবাইন পেপুলার স্টোমাটাইটিস (চধৎধঢ়ড়ীারৎঁং) এর ক্ষত শুধু মুখের ঝিল্লিতে দেখা যায়।
৭.  বেসনয়টিওসিস হলে সেক্লরাল কঞ্জাংক্টিভা এবং চামড়ার যে ক্ষত হয় সেখানে লোম পড়ে যায়।
লাম্বি স্কিন ডিজিজ প্রতিরোধে করণীয়
খামার জীবাণুুমুক্তকরণ : লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাসটি খুব ঠা-া এবং শুষ্ক পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে যেখানে পি,এইচ ৬.৩- ৮.৩। এলএসডি আক্রান্ত প্রাণীর ক্ষতস্থানে খসে পড়া গুটির খোসায় এই ভাইরাসটি টিকে থাকতে পারে কয়েক মাস। তাই এলএসডি আক্রান্ত খামার, খামারে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি এবং নিযুক্ত লোকজনসহ সবকিছু ভালো করে জীবাণুমুক্ত করা প্রয়োজন। এলএসডি ভাইরাসটি প্রায় সকল জীবাণুুনাশক এবং ডিটারজেন্টের প্রতি সংবেদনশীল। ভালোভাবে জীবাণুুমুক্ত করার জন্য খামারের গোবর, খড়কুটো আগেই সরিয়ে নিতে হবে। জাতীয় সংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার (ঋঅঙ) অহরসধষ ঐবধষঃয গধহঁধষ ড়হ চৎড়পবফঁৎবং ভড়ৎ উরংবধংব ঊৎধফরপধঃরড়হ নু ঝঃধসঢ়রহম ঙঁঃ (ঋঅঙ, ২০০১) এ খামার জীবাণুুমুক্ত করার ব্যাপারে কিছু ব্যবহারিক নির্দেশনা দিয়েছে।
খামারে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ : খামারে ঠিক মতো মশা মাছি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এই ভাইরাসে চলাচল অনেকটুকু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কিন্তু স¤পূর্র্ণ রূপে এই রোগের প্রতিরোধ করা যাবে না। যে সব খামারে প্রাণীকে সম্পূর্ণরূপে বেঁধে পালন করা হয় সে সমস্ত খামারে মশার উৎপাত কমানোর জন্য মশারি বা নেট ব্যবহার করা যায়। আবার প্রাণীর গায়ে মশা মাছি না বসার জন্য ঔষধ ব্যবহার করে সাময়িকভাবে মশামাছি এবং আঁঠালি প্রতিরোধ করা যায়।
যখন কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তখন খেয়াল রাখতে হবে যেন তার অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ক্ষতি না হয় এবং অন্যান্য উপকারী কীটপতঙ্গ যেন ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। কীটপতঙ্গ যেখানে প্রজনন করতে পারে যেমন- জমানো পানি, ময়লা, গোবর ইত্যাদি স্থান ভালোভাবে পরিষ্কার করলে কীট পতঙ্গের পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়।
বায়োসিকিউরিটি : এলাকায় লাম্পি স্কিন ডিজিজ দেখা গেলে খামারে কোন নতুন প্রাণী প্রবেশ না করানোই উত্তম। আর যদি প্রাণী আনতেই হয় তাহলে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে সংগ্রহ করা উচিত। আর এই প্রাণী ক্রয় করার আগে ভালো করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত এবং খামারে আনার পরও কমপক্ষে ২৮ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা উচিত।
খামারে দর্শনার্থী প্রবেশ খুব নিয়ন্ত্রিতভাবে করতে হবে। খামারের প্রয়োজনীয় যেকোন যানবাহন বা দ্রব্যাদি খামারে প্রবেশের আগে ভালো করে ধুয়ে  নিতে হবে।
চিকিৎসা : লাম্পি স্কিন ডিজিজ একটি ভাইরাস গঠিত রোগ তাই এর সরাসরি কোন চিকিৎসা নেই। তবে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধ করার জন্য লক্ষণ দেখে চিকিৎসা প্রয়োগ করতে হয়। এই ক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
লাম্পি স্কিন ডিজিজে জ্বর এবং গায়ে ব্যথা থাকলে কিটোপ্রোপেন বা প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথানাশকগুলো ব্যবহার করা যাতে পারে। রোগ খুব তীব্র হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে। গুটিগুলো ফেটে গেলে পটাশ বা আয়োডিন সলিউশন দিয়ে ক্ষতস্থান ধুতে হবে নিয়মিত। তাছাড়া ঘা হয়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের সালফার পাউডার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ক্ষত স্থানে ব্যবহার করতে হবে।

লেখক : উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, মানিকছড়ি, খাগড়াছড়ি। মোবাইল : ০১৭১৮৬৩০২৬৮ ই-মেইল : ঝঁপযধুধহথপযু@ুধযড়ড়.পড়স