Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

অজৈব অভিঘাত ব্যবস্থাপনায় ন্যানোপার্টিকেলসের গুরুত্ব

অজৈব অভিঘাত ব্যবস্থাপনায় ন্যানোপার্টিকেলসের গুরুত্ব
ড. রিপন সিকদার
উদ্ভিদ তার জীবনচক্রে বিভিন্ন পরিবেশগত অভিঘাত মোকবিলা করে বেড়ে ওঠে যা উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবাদযোগ্য জমি হ্রাস, পানিসম্পদ হ্রাস, নগরায়ন, বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যা অদূর ভবিষ্যতে কৃষির উৎপাদনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। অজৈব অভিঘাত কৃষিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ যা ফসলের বৃদ্ধি, বিকাশ এবং ফলনকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে। উদ্ভিদকে প্রভাবিত করে এমন প্রধান প্রধান অজৈব অভিঘাতের মধ্যে খরা, লবণাক্ততা, তাপ, ঠা-া, ভারী ধাতু, বন্যা, রাসায়নিক বিষাক্ততা, অত্যধিক আলো, এবং অতিবেগুনি রশ্মি অন্যতম। এসব চ্যালেঞ্জ থেকে কৃষি খাতকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন কৃষিতে ক্রমাগত নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন যা প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন অভিঘাতপূর্ণ অবস্থায়ও ফসলের সম্ভাব্য ফলন নিশ্চিত করবে। যদিও অন্যান্য প্রযুক্তি যেমন- উদ্ভিদ প্রজনন বিদ্যা, রাসায়নিক সারের ব্যবহার, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কৃষিকে যেমন উন্নত করেছে তেমনি এ প্রযুক্তিগুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই, ক্রমবর্ধমান বিশ্ব খাদ্য চাহিদা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ন্যানো-প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  
কৃষিখাতের উন্নয়নের জন্য ন্যানোটেকনোলজি একটি অভিনব সম্ভাবনাময় উদ্ভাবনী পদ্ধতি যা বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অভিঘাতের বিরুদ্ধে সহনশীলতা প্রদানের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। পরিবর্তিত জলবায়ু, দূষিত পরিবেশ এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার যুগে টেকসই কৃষির লক্ষ্য অর্জনের জন্য কৃষিতে ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগ একটি লাগসই বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। ন্যানোটেকনোলজিতে জৈবিকভাবে সক্রিয় ১-১০০ ন্যানোমিটার আয়তনের ন্যানোপার্টিকেল (এনপি) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এনপিগুলোর নির্দিষ্ট ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য আছে যার মাধ্যমে উদ্ভিদ কোষে সরাসরি প্রবেশ করতে সক্ষম এবং উদ্ভিদও দ্রুত এই পার্টিকেলসগুলো সংশ্লেষণ করতে পারে। এনপি মাটিতে অথবা পাতায় প্রয়োগ করা যায়। এনপিগুলো উদ্ভিদে প্রয়োগ করা হলে উদ্ভিদ মূলের এপিডার্মিস বা পাতার বায়বীয় পৃষ্ঠের মাধ্যমে এপোপ্লাস্টিক অথবা সিমপ্লাস্টিক পথে কোষে প্রবেশ করে। উপকারী এনপিগুলো উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে পৌঁছানোর পর সালোকসংশ্লেষণের হার, বায়োমাসের পরিমাণ, ক্লোরোফিলের পরিমাণ, চিনির মাত্রা (সুক্রোজ, ফ্রকটোজ ইত্যাদি), অসমোলাইট (প্রোলিন, ফ্রি এমিনো এসিড, সলিউবল সুগার ইত্যাদি), কার্বহাইড্রেটের পরিমাণ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমূহের (অ্যাসকরবেট পারঅক্সিডেজ, ক্যাটালেজ, পারঅক্সিডেজ, সুপার অক্সাইড ডিজমিউটেজ ইত্যাদি) কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্ভিদের অভিঘাতজনিত ক্ষতি প্রশমন করে থাকে। পাশাপাশি এনপিগুলো নাইট্রোজেন বিপাকেও (হরঃৎড়মবহ সবঃধনড়ষরংস) সহায়তা প্রদান করে যা উদ্ভিদ কোষে ক্লোরোফিল ও প্রোটিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তবে উল্লেখ্য যে, ন্যানোপার্টিকেলের আকার, আকৃতি, পৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্য, স্থায়িত্ব, রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য, বিশুদ্ধতা, উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং প্রয়োগের মাত্রার ওপরও এদের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে। এ ছাড়াও, উদ্ভিদের প্রজাতি থেকে প্রজাতি এবং পরিবেশের পরিবর্তনের কারণেও ন্যানোপার্টিকেলগুলোর ভৌত ও রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন হতে পারে। কার্বন ন্যানোটিউব, মাল্টিওয়ালড কার্বন ন্যানোটিউব, ধাতব ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- সিলভার ও গোল্ড), স্ফটিক পাউডার ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রন, কোবাল্ট ও কপার) এবং ধাতব অক্সাইড ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রন অক্সাইড, টাইটেনিয়াম ডাই-অক্সাইড, জিংক অক্সাইড, সিলিকন ডাই-অক্সাইড, কিউপ্রিক অক্সাইড, সেরিয়াম অক্সাইড, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট) হলো কিছু উল্লেখযোগ্য উপকারী এনপিগুলো, যা অজৈব অভিঘাতের হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করে থাকে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ অজৈব অভিঘাত (অনরড়ঃরপ ংঃৎবংং) ব্যবস্থাপনায় ন্যানোপার্টিকেলসের ভূমিকা নি¤েœ আলোচনা করা হলো:
লবণাক্ততাজনিত প্রভাব : লবণাক্ততা একটি প্রধান অজৈব অভিঘাত যা ফসলের বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতাকে হ্রাস করে এবং টেকসই ফসল উৎপাদনের একটি প্রধান অন্তরায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী আবাদযোগ্য জমির প্রায় ২০ ভাগ লবণাক্ততার সম্মুখীন এবং এই পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ততার সমস্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সোডিয়াম ক্লোরাইড (ঘধঈষ) এর কারণে দেখা দেয়। লবণাক্ততা উদ্ভিদে প্রাথমিকভাবে অসমোটিক এবং আয়োনিক অভিঘাত সৃষ্টি করে। অসমোটিক অভিঘাত উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পানি এবং খনিজ পদার্থ গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস করে। অতিরিক্ত সোডিয়াম এবং ক্লোরিন আয়ন গ্রহণের ফলে অক্সিডেটিভ অভিঘাত সৃষ্টি হয়। লবণাক্ততাজনিত সৃষ্ট অজৈব অভিঘাতের ফলে উদ্ভিদের গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়াগুলোতে (যেমন- সালোকসংশ্লেষণ, প্রোটিন সংশ্লেষণ, লিপিড বিপাক ইত্যাদি) নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। ন্যানোপার্টিকেলের ব্যবহার লবণাক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান ব্যবহারের দক্ষতা বাড়াতে পারে। এনপিগুলো নির্দিষ্ট জিনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, অসমোলাইটসমূহ পুঞ্জীভূত, প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান এবং অ্যামাইনো এসিড সরবরাহের মাধ্যমে লবণাক্ততাজনিত অভিঘাত মোকাবিলা করতে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, লবণাক্ত পরিবেশে সিলিকন ডাই-অক্সাইড নামক ন্যানোপার্টিকেল প্রয়োগে স্কোয়াশের প্রস্বেদন হার, পানি ব্যবহারের দক্ষতা এবং কার্বনিক এনহাইড্রেজ নামক এনজাইমের কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢেঁড়সের পাতায় টাইটেনিয়াম অক্সাইড প্রয়োগের ফলে সালোকসংশ্লেষণ এবং বিভিন্ন এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। আমের চারার পাতায় জিংক অক্সাইড এবং সিলিকনের সম্মিলিত প্রয়োগের মাধ্যমে কার্বন এসিমিলেশন এবং পুষ্টি উপাদান গ্রহণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধির মাধ্যমে সার্বিক বৃদ্ধিতে ধনাদত্মক প্রভাব ফেলেছে।  
খরাজনিত প্রভাব : পরিবশগত অজৈব অভিঘাতগুলোর মধ্যে খরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিঘাত যা ফসল উৎপাদন ও ফলনের জন্য হুমকিস্বরূপ। এটি বিভিন্ন কারণে ঘটে থাকে তন্মধ্যে কম বৃষ্টিপাত, লবণাক্ততা, উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রা, উচ্চ আলোর তীব্রতা অন্যতম। খরা প্রকৃতপক্ষে একটি বহুমাত্রিক অজৈব অভিঘাত যা উদ্ভিদের শরীরবৃত্তিয়, জৈব-রাসায়নিক এবং আণবিক বৈশিষ্ট্যর পরিবর্তন ঘটায়।
উদ্ভিদের খরাজনিত ক্ষতির বিরুদ্ধে গৃহীত বিভিন্ন কৌশলগুলোর মধ্যে ন্যানোপার্টিকেলসের ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন- উদ্ভিদের পাতায় আয়রন অক্সাইড ন্যানোপার্টিকেলস সরবরাহের ফলে খরাজনিত ক্ষতির প্রভাব হ্রাসের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। এনপিগুলো উদ্ভিদের পাতায় কার্বন এসিমিলেশনের মাধ্যমে সালোকসংশ্লেষণের পরিমাণ বৃদ্ধি করে যা খরাসৃষ্ট অজৈব অভিঘাতকে প্রশমিত করে। উদ্ভিদের মূলে অ্যাকুয়াপরিনসের পরিমাণ বৃদ্ধি, আন্তঃকোষীয় পানির বিপাকের পরিবর্তন, অসমলাইটসমূহের পরিমাণ বৃদ্ধি, আয়নিক হোমিওসটেসিস ইত্যাদি হলো খরাসৃষ্ট অসমোটিক চাপ প্রশমিত করার প্রধান কলাকৌশল যা এনপিগুলো করে থাকে।
তাপমাত্রাজনিত প্রভাব : বায়ুম-লীয় তাপমাত্রা পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ফসলের বৃদ্ধি ও ফলনের উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলছে। আইপিসিসি ২০১৪ অনুযায়ী, একবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বায়ুর তাপমাত্রা প্রতি দশকে ০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়ে বিদ্যমান স্তরের তুলনায় ১.৮-২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। তাপীয় অভিঘাত রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পেসিস (রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পেসিস এক ধরনের অস্থায়ী অণু যা অক্সিজেন ধারণ করে এবং কোষের অন্যান্য সাথে সহজেই বিক্রিয়া প্রদর্শন করে) এর কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয় যা উদ্ভিদে অক্সিডেটিভ অভিঘাত সৃষ্টি করে, যার ফলস্বরূপ লিপিড ঝিল্লির অবক্ষয়, কোষীয় ঝিল্লির অবক্ষয়ের মাধ্যমে প্রোটিনের অবক্ষয় ত্বরান্বিতকরণ এবং সালোকসংশ্লেষণ ও ক্লোরোফিলের পরিমাণ হ্রাস করে। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং দীর্ঘ তাপতরঙ্গ দ্বারা সৃষ্ট তাপীয় অভিঘাত থেকে উদ্ভিদকে রক্ষা করতে ন্যানো প্রযুক্তি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন- কম ঘনত্বের সেলেনিয়াম ন্যানোপার্টিকেল প্রয়োগের ফলে উদ্ভিদের পানি ব্যবহারের দক্ষতা এবং ক্লোরোফিলের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে তাপীয় অভিঘাতের প্রভাব হ্রাস পায়। টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইড ন্যানোপার্টিকেলস পাতার পত্ররন্ধ্র নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাপজনিত ক্ষতি হ্রাস করে। ন্যানো জিংক অক্সাইড অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অসমোপ্রোট্যাকট্যান্ট বৃদ্ধির মাধ্যমে মুগ ফসলের তাপীয় অভিঘাত প্রশমনের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।  
ন্যানোটেকনোলজি, একটি বহুমাত্রিক কৌশল বা পন্থা যা বিগত কয়েক বছরে কৃষিসহ ওষুধ, শিল্প, পরিবেশ, ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। ন্যানোপ্রযুক্তি কৃষির একটি হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এনপিগুলো উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিকাশ এবং ফলন বৃদ্ধিতে কার্যকরি এবং জৈব ও অজৈব অভিঘাতসমূহ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে বলে প্রমাণিত হয়েছে। সর্বোপরি, কৃষিক্ষেত্রে ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার গবেষণাগার হতে মাঠপর্যায়ে স্থানান্তর ও বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে কৃষির সর্বস্তরে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক : উপব্যবস্থাপক (উন্নয়ন), মহাব্যবস্থাপক (বীজ) দপ্তর, বিএডিসি, ঢাকা; মোবাইল : ০১৬২৭৩৩৮৭২৭, ই-মেইল :sikderripon@gmail.com