Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ফল উৎপাদনে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

ফল উৎপাদনে সমৃদ্ধ বাংলাদেশর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
মোঃ আসাদুল্লাহ
সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর উন্নত বাংলাদেশ তথা সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন কৃষি ও কৃষকবান্ধব একজন মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য কৃষির উন্নতির কোনো বিকল্প নাই। সেই লক্ষ্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ (পঞ্চাশ) বছর পূর্তিতে সীমিত সাধ্য নিয়ে অন্তত ১৩টি ক্ষেত্রে বিশ্বের দরবারে গৌরবোজ্জ্বল ও ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করেছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি) থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ১০টি কৃষি খাতে বিশ্বের শীর্ষ  দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান। তন্মধ্যে কাঁঠালে দ্বিতীয়, আমে অষ্টম ও পেয়ারায় অষ্টমসহ গোটা ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ সাফল্যের পরিচয় বহন করেছে ইতোমধ্যে। একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ আয়তনে বিশ্বের অন্যতম ছোট দেশ হলেও ফল উৎপাদনে সফলতার উদাহরণ হয়ে উঠেছে এই দেশ। এ মুহূর্তে বিশ্বে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড বাংলাদেশের। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। ২০ বছর আগে আম আর কাঁঠাল ছিল এই দেশের প্রধান ফল। এখন বাংলাদেশে ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। আগে যেখানে হতো ৫৬ প্রজাতির ফল চাষ।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ফল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশে ফলের ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে এবং এখানে প্রায় ৭০ রকমের ফলের প্রজাতি জন্মে যার ক্ষুদ্র একটি অংশ বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয়। বাংলাদেশে জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বিবেচনায় যেসব ফল বেশি জমিতে এবং পরিমাণে বেশি জন্মে সেগুলো হলো কাঁঠাল, আম, লিচু, লেবুজাতীয় ফল, আনারস, কলা, কুল, পেঁপে, পেয়ারা এবং নারিকেল যেগুলো প্রধান ফল হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে অপ্রধান ফল জন্মে। পছন্দ মতো ফল চাষ ও নির্বাচনের সুবিধার্থে এ দেশের আবহাওয়ায় উপযোগী ভূমির অবস্থান, স্থানীয় চাহিদা, আবাদে লাভজনক এসব দিকগুলো বিবেচনায় এনে দেশি-বিদেশি সব ধরনের ফল নির্বাচন করে উন্নত জাতের ফল বাগান সৃজনের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
 কোনো কোনো ফল গাছ রোপণের এক বছরের মধ্যেই ফুল ফল ধরা আরম্ভ করে। আবার কিছু ফল গাছ রোপণের পর ফল দিতে ৫-১০ বছর সময় লেগে যায়। রোপণের পর ফল ধরতে দীর্ঘ সময় লাগে সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে স্বল্পমেয়াদি ফল চাষ (কম উচ্চতা বিশিষ্ট) অথবা মৌসুমি ফসল আবাদ করে ফল ধরার অন্তর্র্বর্তীকালীন সময়ে বাড়তি ফসল প্রাপ্তি নিশ্চিত করে খরচ পুষিয়ে নেয়া যায়। অধিকন্ত এ ধরনের রিলে ফসল আবাদে পরোক্ষভাবে বাগানের যত্ন নেয়া হয়, তাতে ফল গাছ দ্রুত বাড়তে ও বেশি ফল দিতে সহায়ক হয়।
লাভজনক ফল : বেশ কিছু ফল আছে যেগুলো পরিকল্পিতভাবে উন্নত জাতের বাগান সৃষ্টি করলে এবং নিয়মিত পরিচর্যা গ্রহণ করলে সেগুলোর আবাদ অতি লাভজনক। এগুলোর মধ্যে কলা, পেঁপে তরমুজ,  আনারস, আম, কুল, পেয়ারা, কাগজিলেবু, কমলা, মালটা, লিচু, বেল, কদবেল, লটকন, শরিফা, আমড়া, মিষ্টি তেঁতুল, খাট জাতের নারিকেল অন্যতম।
দেশি ফল চাষের অবদান
যেহেতু দেশি ফল হতে আমরা নানা ধরনের পুষ্টিমূল্য পেয়ে থাকি তাই এর চাষ আমাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
অধিক আয় : অন্যান্য দানাদার খাদ্যশস্য অপেক্ষা দেশি ফলের গড় ফলন অনেক বেশি। সে হারে ফলের মূল্য বেশি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে আয়ও অনেক বেশি যেমন-এক হেক্টর জমিতে ধান গম চাষে আয় হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অথচ সমপরিমাণ জমিতে কলা ও আম চাষ করে যথাক্রমে আয় হয় ৭৫ হাজার ও ১ লাখ টাকা।
জাতীয় অর্থনীতিতে : বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ফলভিত্তিক আয়ের আনুমানিক প্রায় ১০ শতাংশ আসে ফল  থেকে। এ থেকে বোঝা যায় জাতীয় অর্থনীতিতে তথা দারিদ্র্য বিমোচনে ফল ও ফলদ বৃক্ষের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দেশি ফল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানিমুখী সম্ভাবনা
বিশ্বের ফল বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবদান খুবই কম। বিদেশে টাটকা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত ফলের প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে সীমিত আকারে টাটকা ফল রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিকৃত উল্লেখযোগ্য ফলগুলোর মধ্যে কাঁঠাল, আম, আনারস, লেবু, কামরাঙা, বাতাবিলেবু, তেঁতুল, চালতা উল্লেখযোগ্য। টাটকা ফল ছাড়াও হিমায়িত ফল ও সবজি (সাতকরা, কাঁঠাল বীজ, কাঁচকলা, লেবু, জলপাই, আমড়া ইত্যাদি) ইতালি, জার্মানি, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও বাহরাইনে রপ্তানি হচ্ছে। এতে ফল রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে ফল চাষ সম্প্রসারণ
বর্তমানে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ফলের চাহিদা ২০০ গ্রামের বিপরীতে প্রাপ্যতা হলো মাত্র ৭৪.৪২ গ্রাম। সারা বিশ্বে ফল একটি সমাদৃত ও উপাদেয় খাদ্য। ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর এ পর্যন্ত উষ্ণ এবং অবউষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে চাষোপযোগী ৩০টি বিভিন্ন প্রজাতির ফলের ৬৫টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে যেগুলোর অধিকাংশ কৃষকপর্যায়ে সমাদৃত হয়েছে এবং দেশীয় ফলের চাষ সম্প্রসারণসহ উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এসব উন্নত জাতের আরও ব্যাপক সম্প্রসারণ হওয়া অপরিহার্য।
ফল চাষ সম্প্রসারণে সমস্যাবলি
বাংলাদেশে ফল চাষে নানা ধরনের সমস্যা দেখা যায়। সমস্যা গুলো হলো- কৃষকদের ফল চাষ সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব। গুণগত মানসম্পন্ন কলম-চারার অভাব। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের ফল চাষ সম্পর্কিত জ্ঞানের অপ্রতুলতা। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ ও বিএডিসির সমন্বয়ের ঘাটতি। ব্যক্তি মালিকানাধীন নার্সারিতে ফলের উন্নত জাতের মাতৃগাছের অভাব। উন্নত জাতের গুণগত মানসম্পন্ন কলম-চারা উৎপাদন কলাকৌশল সম্পর্কে কৃষকের জ্ঞানের অভাব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বীজ থেকে ফল গাছ হওয়ায় ফলের ফলন ও গুণগতমান উভয়ই নিম্নমানের হয়। বাংলাদেশের চাষের জমি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফল পচনশীল বিধায় সংগ্রহোত্তর সঠিক পরিবহন ব্যবস্থা, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের অভাবে কৃষক প্রায়ই ন্যায্যমূল্য পায় না বিধায় প্রায় ২৫ শতাংশ ফল সংগ্রহোত্তর নষ্ট হয়ে যায়। বছরের কিছু সময় (মে-আগস্ট) ফলের সমারোহ থাকলেও অবশিষ্ট সময়ে (সেপ্টেম্বর-এপ্রিল) দেশীয় ফলের প্রাপ্যতা থাকে খুবই কম। ফল বৃক্ষের বাগান তৈরিতে উৎসাহ কম। অনেক সময় প্রতিকূল পরিবেশ ও বৈরী আবহাওয়াগত কারণে ফলন কম হয়। প্রচলিত ফলের পাশাপাশি অপ্রচলিত ফল চাষ তেমন গুরুত্ব পায় না তাই দেশ থেকে অনেক ফল বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি জমিতে ফল চাষ করা কষ্টকর বিধায় তা চাষের আওতায় আসছে না। ফল গাছ রোপণের পর ফল আসতে দীর্ঘ সময় লাগে বিধায় অনেকে ফল চাষে আগ্রহী হয় না।
উপরোল্লিখিত সমস্যাসমূহ সমাধান করে ফল চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে আরো গতিশীল করতে সরকারি পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রকল্প সহায়তা ও সরকারি প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষকপর্যায়ে বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করে আসছে। আশা করা যায়, একদিন এই ফল চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমেই ঘুচবে বাংলাদেশের বেকার সমস্যা, আর এর পাশাপাশি আমরা আয় করতে পারব বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। তাই এখন প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। য়
মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি,  ফোন : ৫৫০২৮৩৬৯, ই- মেইল : dg@dae.gov.bd