Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

করোনা অতিমারিতে খাদ্য নিরাপত্তায় ইঁদুর নিধন

করোনা অতিমারিতে খাদ্য নিরাপত্তায় ইঁদুর নিধন
মোঃ মেসবাহুল ইসলাম
করোনা অতিমারিতে খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশনা ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’- বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন দপ্তর সংস্থা ও কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সবার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় খাদ্যশস্যের নিবিড়তা বেড়েই চলেছে। স্বাধীনতার পর সর্বাধিক উন্নতি হয়েছে কৃষি সেক্টরে। দেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান জিডিপির ১৩.০২ শতাংশ। করোনা সংক্রমণের কারণে যখন দেশের সবকিছু স্থবির, তখনও সচল কৃষির চাকা। দুঃসময়ে কৃষিই দেখাচ্ছে সম্ভাবনার পথ। এ বছর বোরো মৌসুমে বিগত বছরের সকল রেকর্ডকে ভেঙে ২ কোটি ৭ লাখ মেট্রিক টনের অধিক ফলন হয়েছে যার আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এমন কি কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ব বাজার মন্দাভাব থাকলেও এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত    কৃষিপণ্য রপ্তানি আয় ৯.১% বেড়ে ৮২৪ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। শুধু করোনাই নয় গত ৫০ বছরে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, শীত, খরা, তাপদাহসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলিয়ে কৃষি বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এসেছে বিস্ময়কর সাফল্য ও অভাবনীয় উন্নতি। কৃষি খাতে অন্তত দশটির অধিক ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।   কৃষিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পাট রপ্তানিতে ১ম, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, ধান ও সবজি উৎপাদনে ৩য়, আম ও আলু উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম, সামগ্রিক ফল উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম স্থানে বাংলাদেশ। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণের পাশাপাশি পুষ্টিতেও বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হচ্ছে ও পরিচিতি লাভ করছে। মুজিববর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জোগান ও চাহিদা মিটিয়ে খাদ্য নিরাপত্তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা।


বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্তে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্য দানাদার ফসল উৎপাদন ও রক্ষার যাবতীয় কৌশল সুচারুভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ফসল উৎপাদন ও রক্ষায় অন্যান্য বালাইয়ের সাথে ইঁদুরকেও গুরুত্ব দিয়ে দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে ইঁদুরের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তবে এশিয়ার ধান উৎপাদনকারী প্রতিটি দেশে কৃষক, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা ইঁদুরকে গুরুত্বপূর্ণ বালাই হিসেবে বিবেচনা করে। শুধু ধান কর্তন থেকে গুদামে রাখা অবস্থায় ২-২৫ ভাগ পর্যন্ত ইঁদুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। একটি ইঁদুর প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ গ্রাম খাদ্য খেয়ে থাকে। আর যা খায় তার ৪-৫ গুণ নষ্ট করে। সব ধরনের ইঁদুর বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের ছেদন (সদা বর্ধিষ্ণু) দাঁত রয়েছে। ক্ষয়ের মাধ্যমে দাঁতের এই বৃদ্ধিরোধ তথা আকার ও আকৃতি সঠিক রাখার জন্য সারা জীবন কিছু না কিছু কাটাকুটি করে থাকে। কাটাকুটি করে ইঁদুর যে শুধুমাত্র দানাদার ফসলের ক্ষতি করে তা নয়, অন্যান্য ফসল ও ফলমূল, আসবাবপত্রের ক্ষতি সাধন করে। বৈদ্যুতিক তার ও যন্ত্রপাতি এর হাত থেকে রেহাই পায় না। এরা মানুষ ও পশুপাখির প্রায় ৬০টিরও বেশি বিভিন্ন রোগজীবাণুর বাহক ও বিস্তারকারী। তাছাড়া ইঁদুর বিভিন্ন ধরনের স্থাপনাও কেটে নষ্ট করে। ক্ষতির দিক বিবেচনায় রেখে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১৯৮৩ সাল থেকে জাতীয়ভাবে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করে আসছে। সে ধারাবাহিকতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ বছরেও ইঁদুর কর্তৃক ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে হ্রাস করার লক্ষ্যে ‘ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২১’ শুরু করতে যাচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জাতীয় সম্পদ রক্ষার্থে, ইঁদুর মারি একসাথে।’ আশা করি সমাজের সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ অভিযান সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে।

 

ইঁদুর বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের একটি প্রাণী। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ বাদে পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশে ইঁদুরের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রুত এবং বংশ বিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠাপানির এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশ বিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। বাংলাদেশে ইঁদুরের প্রায় ২২টিরও অধিক ক্ষতিকর প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এরা সব ধরনের পরিবেশে খাপখাওয়াতে পারে। উপযুক্ত এবং অনুকূল পরিবেশে একজোড়া প্রাপ্ত বয়স্ক ইঁদুর বছরে প্রায় ২০০০টি বাচ্চা জন্ম দিতে পারে। প্রতি ধানের মৌসুমে একটি স্ত্রী ইঁদুর অনুকূল পরিবেশে প্রায় ২৪টি বাচ্চা দিতে পারে। প্রতি বছর ইঁদুর ফসল ও কৃষকের শত্রু হিসেবে হানা দেয়। বাংলাদেশের অর্ধেক জমির ফসল ইঁদুরের আক্রমণের শিকার হয়। বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান, গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। গবেষণা থেকে জানা যায় তিন মাসের জন্য ধান গুদামে রাখা হলে ৫ থেকে ১০ ভাগ ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতি হতে পারে। বাংলাদেশে গড়ে প্রতি কৃষক পরিবারে প্রতি বছরে ২০০ কেজি ধান ইঁদুরের দ্বারা নষ্ট হয়। বৃষ্টিনির্ভর ও সেচ সুবিধাযুক্ত ধানের জমিতে ফসল কাটার পূর্বে শতকরা ৫-১৭ ভাগ ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধান শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ৪-১২ ভাগ, গোলআলু ৫-৭ ভাগ, আনারস ৬-৯ ভাগ নষ্ট হয়। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭% এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫% ক্ষতি করে। ইঁদুর শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচ নালাও নষ্ট করে থাকে। সেটা ফসলের উৎপাদনের উপর প্রভাব ফেলে। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে মুরগির ডিম ও ছোট বাচ্চা খেয়ে ফেলে। ইঁদুর বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে গর্ত করে এবং মাটি সরিয়ে বাঁধ দুর্বল করে ফেলে। ফলে বাঁধ ভেঙে পানি দ্বারা প্লাবিত হয়ে বাড়িঘর, ফসলাদি ও গবাদিপশুর  ক্ষতি সাধন করে, যার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক।


ইঁদুর দ্বারা ফসল ও সম্পদের যে ক্ষতি হয় তা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে একদিকে যেমন- খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে আবার অন্যদিকে আয়ও বাড়বে। সাধারণত ইঁদুর সবসময় দমন করা যায়। তবে ইঁদুর দমনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক। সে লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক ইঁদুর নিধন অভিযান এসময় বাস্তবায়ন করে থাকে। এ অভিযানের মাধ্যমে গত ৫ বছরে (২০১৬-২০২০) গড়ে প্রায় ১০০৯৬২.৮ মেট্রিক টন আমন ফসল রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ২০২০ সালে প্রায় ১,১৯,৩৪,৪৬৩টি ইঁদুর নিধনের মাধ্যমে প্রায় ৮৯,৫০৮ মেট্রিক টন আমন ফসল রক্ষা করা হয়েছে। ইঁদুর দমন পদ্ধতি ফসলের রোগ ও পোকামাকড় দমন পদ্ধতি থেকে কিছুটা ভিন্নতর। এরা সুকৌশলে দমনের ক্ষেত্র যেমন- বিষটোপ ও ফাঁদ এড়িয়ে চলে। এজন্য একক দমনের চেয়ে সমন্বিত দমন ব্যবস্থা অধিক কার্যকরী। মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনা করেই উপযুক্ত দমন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। সঠিক জ্ঞান এবং কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে এর সংখ্যা লাগসইভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব।


করোনা সংকট দীর্ঘায়িত হলে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হবে তা অনুমান করা কঠিন। তবে এখনই সতর্ক না হলে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে চলমান খাদ্য নিরাপত্তা বলয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে করোনা সংকটের সময় চলমান খাদ্য নিরাপত্তাকে ধরে রাখতে কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন দপ্তর সংস্থা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইঁদুর একক প্রচেষ্টায় নিধন করা একেবারেই সম্ভব নয়। বৈশ্বিক অতিমারি মোকাবিলার ন্যায় ইঁদুর নিধনেও সবার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, ‘সবাই সম্মিলিতভাবে ইঁদুর মারি, দেশের মূল্যবান সম্পদ রক্ষা করি’।

সিনিয়র সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা। www.moa.gov.bd