Wellcome to National Portal
  • 2025-03-12-16-25-15c95fd3ae0d740427f19c779208b30b
  • 2025-03-12-16-16-b41688fcb8ac3df55c13eb5c82b62083
  • 2025-01-05-17-19-232bbb16275acb0da535d705c9b6f6d8
  • 2024-12-15-10-13-de23faa6fead7deef93b5973ae193323
  • 2023-12-28-06-44-fad1b3dffb04c90c1f14863ef06978d5
  • ICT Ebook
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধির কৌশল

2021-02-17-15-13-133346e6ce8ebb381f6e2e4cf78b3a98

ড. মো. আলাউদ্দিন খান১  কৃষিবিদ মো. মুশফিকুর রহমান২

পেঁয়াজ (Allium cepa L.) বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারের প্রতিদিনের খাবারের অত্যাবশ্যকীয় অংশ। ফলে চাহিদার ভিত্তিতে (জনপ্রতি দৈনিক ৩৫ গ্রাম) মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। উৎপাদনের বিবেচনায়ও এ মসলা ফসলটি প্রথম স্থানে আছে।  কিন্তু পেঁয়াজ একটি পচনশীল পণ্য। সংগ্রহ মৌসুমে পেঁয়াজ এর ব্যাপক সরবরাহ থাকার কারণে কৃষক খুবই কম মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রয় করে থাকে। উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় চাষ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে কৃষক ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে। পেঁয়াজ উৎপাদন ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত কৃষি প্রযুক্তি (Good Agricultural Practices) প্রয়োগ না করার কারণে উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০-৪০ শতাংশ অপচয় হয়ে যায়। এমনকি পেঁয়াজের গুণাগুণও নষ্ট হয়ে যায়। কখনো কখনো বিভিন্ন কারণে এ ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হয়ে থাকে। যা পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীলতার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশে বছরে ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়ে থাকে। বছরে পেঁয়াজ অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ৫-৬ লক্ষ মেট্রিক টন। এখানে উল্লেখ্য যে, সরকার দেশের পেঁয়াজের ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে প্রায় ১০ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। গুণগতমান বজায় রেখে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্টোরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে সঠিক মূল্যে বিক্রয় করা ও বাজার স্থিতিশীল রাখা সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য। এছাড়া পেঁয়াজ সংরক্ষণের  মাধ্যমে ভোক্তার নিকট বছরব্যাপী পেঁয়াজ সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। পেঁয়াজের প্রকৃত বীজ (True seed) সাধারণত বীজ কন্দ (Seed bulb) থেকে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। বীজ কন্দকে ভালো রাখাও সংরক্ষণের আরেকটি উদ্দেশ্য। স্টোরে পেঁয়াজ জীবিত অবস্থায় থাকে। তাই পেঁয়াজের শারীরবৃত্তীয় (প্রস্বেদন, শ^সন, অংকুরোদগম/মূল গজানো, পেঁয়াজের খোসা খসে পড়া) এবং বিপাকীয় (এনজাইমের কার্যকারিতা, টিস্যু নরম হওয়া) কার্যক্রম চলতে থাকে। ভালো কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ ও উপযুক্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে পেঁয়াজের শারীরবৃত্তীয় ও বিপাকীয় কার্যাবলী বন্ধ করে বা নিম্ন পর্যায় রেখে এবং ছত্রাক/ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতাকে বন্ধ করে বা সুপ্তাবস্থায় রেখে পেঁয়াজের সংরক্ষণ কালকে বৃদ্ধি করাই পেঁয়াজ সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মূল চ্যালেঞ্জ। পেঁয়াজের  সংরক্ষণজনিত ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায় রাখা এবং সংরক্ষিত পেঁয়াজের গুণগতমান বজায় রাখার জন্য নিম্নলিখিত প্রযুক্তি প্রয়োগ করা জরুরি।


পেঁয়াজের উৎপাদন মৌসুম
খরিপ মৌসুমে উৎপাদিত পেঁয়াজে স্বভাবতই পানির পরিমাণ বেশি থাকে। স্টোরে এ মৌসুমের পেঁয়াজের অংকুরোদগম ও পচন হার খুবই বেশি। এ পেঁয়াজ ১.৫-২.০ মাস সংরক্ষণ করলে প্রায় ৫০-৬০% পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। তাই খরিপ পেঁয়াজ সংরক্ষণ না করে বাজারজাত করাই ভাল। রবি পেঁয়াজে পানির পরিমাণ কম থাকে বিধায় দীর্ঘ দিন (৮-৯ মাস) সংরক্ষণ করা যায়। এ সময়ে রবি পেঁয়াজের প্রায় ৩০-৪০% নষ্ট হয়ে যায়।

 

পেঁয়াজের জাত নির্বাচন
সংরক্ষণাগারে পেঁয়াজের পচন, অঙ্কুরোদগম ও ওজন হারোনোর পরিমাণ জাতভেদে কম বেশি হয়ে থাকে। দৃঢ় ও আঁটসাঁটে, ঝাঁঝ বেশি, পানি কম, আকারে মধ্যম, গলা চিকন, উচ্চ  শুষ্ক পদার্থ সম্বলিত বৈশিষ্ট্যের জাতের সংরক্ষণ ক্ষমতা বেশি। যেমন- বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-৪। হাইব্রিড জাত অপেক্ষা স্থানীয় জাতের সংরক্ষণ ক্ষমতা ভাল। যে পেঁয়াজের  শুষ্ক শল্কপত্রের পরিমাণ বেশি থাকে সে পেঁয়াজের সংরক্ষণকাল বেশি হয়। কিউরিং করলেই শুস্ক শল্কপত্রের পরিমাণ বাড়ে। হলুদ ও সাদা রংবিশিষ্ট জাতের পেঁয়াজের তুলনায় লাল রং বিশিষ্ট পেঁয়াজের ফিনোলিক এসিড,  এন্থোসায়ানিন, ফ্লাভোনয়েড (কুয়েরসিটিন, ক্যাম্পফেরল), পলিফেনল নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট বেশি থাকে। বারি পেঁয়াজ-৪ জাতের পেঁয়াজে এন্টিঅক্সিডেন্ট বেশি থাকে। তবে লাল রং এবং সাদা রং বিশিষ্ট পেঁয়াজের তুলনায় হালকা লাল রং বারি পেঁয়াজ-১ বিশিষ্ট পেঁয়াজে শ^সন হার কম হয়।  রোপণ পদ্ধতি


হালি পেঁয়াজের (চারা থেকে পেঁয়াজ চাষ) তুলনায় মুড়িকাটা পেঁয়াজ  (ছোট কন্দ থেকে পেঁয়াজ চাষ) অত্যধিক ফুল হওয়ার কারণে মুড়িকাটা পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না। মুড়িকাটা পেঁয়াজে পানির পরিমাণও বেশি থাকে। অতি আগাম পেঁয়াজের চারা রোপণ করলে প্রায় ৬০-৭৫ শতাংশ গাছে ফুল আসতে পারে। যাহা সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। পেঁয়াজের বীজ বপনের উপযুক্ত সময় কার্তিক মাসের ১৫-৩০ (নভেম্বর ১-১৫) তারিখ। পেঁয়াজের রোপণ দূরত্ব বেশি হলে গলা মোটা হয়ে যায় এবং পেঁয়াজ ফেটে যায়। সরাসরি বীজ বপনকৃত পেঁয়াজের তুলনায় চারা রোপণ পদ্ধতিতে উৎপাদিত পেঁয়াজে তুলনামূলকভাবে বোল্টার (ফুল উৎপাদনকারী কন্দ) ও বহুকোষী পেঁয়াজের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে।


সার ব্যবস্থাপনা
গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, সাধারণত ৩০ টন পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য এ ফসলটি হেক্টরপ্রতি ৮৫ কেজি নাইট্রোজেন, ৩৬ কেজি ফসফরাস  এবং ৬৮ কেজি পটাশ মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। তাই জমির ধরন বুঝে পর্যাপ্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার (ইউরিয়া) প্রয়োগ করলে পেঁয়াজের গলা মোটা হয়ে যায়, পেঁয়াজ ফেটে যায় এবং সংরক্ষণাগারে পেঁয়াজের অংকুরোদগম হয় ও পচে যায়। গলা মোটা পেঁয়াজের রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়ে থাকে। পেঁয়াজ সংগ্রহের ২৫-৩০ দিন আগেই নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করা বন্ধ করতে হবে। এই সময়ের ভিতর নাইট্রোজেন সার উপরি প্রয়োগ করলে ছত্রাক ও ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে সংরক্ষণাগারে বাল্ব পচে যায়। পেঁয়াজ চাষে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন প্রয়োগ করলে স্টোরে পেঁয়াজের আগাম অংকুরোদগম হয়ে যায়। কোন কারণে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করে থাকলে পরবর্তীতে পটাশ সার  (এমওপি) প্রয়োগ করলে পচনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাছাড়া পটাশ সার প্রয়োগে কার্বহাইড্রেট ভাঙনকারী এনজাইমের কার্যকারিতা কমিয়ে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ায়। পটাশ সার অংকুরোদগম ও পানি অপচয় রোধেও সহায়তা করে।


প্রয়োজনমতো ফসফরাস সার (টিএসপি) প্রয়োগ করলে সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফসফরাস সার বেশি দিলে পেঁয়াজ বহুকোষী হয়ে যায়। পরিমাণমতো জিপসাম (সালফার/ক্যালসিয়াম সার) প্রয়োগ করলে পেঁয়াজে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে কন্দ দৃঢ় হয় এবং পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। বোরন জাতীয় সার প্রয়োগ করলে পেঁয়াজ দৃঢ় ও আঁটসাঁট হয়ে সংরক্ষণাগারে ভালো থাকে। জৈবসার প্রয়োগে শুষ্ক পদার্থ বৃদ্ধির মাধ্যমে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । ফলে পারতপক্ষে পেঁয়াজের জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করা খুবই ভালো।


সেচ ব্যবস্থাপনা
জমির ধরন ও আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে পেঁয়াজের জমিতে ৪-৫ টি সেচ দিতে হয়। অতিরিক্ত সেচ দিলে অথবা মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহের ১৫-২০ দিন আগে সেচ বন্ধ না করলে পেঁয়াজের গলা পচা (
Neck rot) রোগের মাধ্যমে পচনের হার বেড়ে যায়। পেঁয়াজ সংগ্রহের সময় পানি পেলে ঐ পেঁয়াজ সহজেই অংকুরোদগম হয়ে যায়। তাছাড়া অতিরিক্ত সেচের কারণে গলা মোটা হয়ে যায়। আবার পেঁয়াজে সেচের পরিমাণ কম হলে পেঁয়াজের অংকুরোদগম হার বেড়ে যায় এবং পেঁয়াজ ফেটে গিয়ে সংরক্ষণ ক্ষমতা কমে যায়। নালা সেচ পদ্ধতির তুলনায় প্লাবন সেচে রোগবালাইর পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে স্টোরে পেঁয়াজ পচনের হার বেশি হয়ে। তবে ড্রিপ (Drip) সেচ পদ্ধতি সবচেয়ে ভাল কিন্তু ইহা ব্যয়বহুল পদ্ধতি।  


রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
স্টোরের পেঁয়াজে সাধারণত ছত্রাকজনিত ব্লাক মোল্ড (
Aspergillus niger), গলা পচা বা গ্রে মোল্ড (Botrytis allii), ব্যাসাল রট (Fusarium oxysporum f. sp. cepa) এবং ব্যাক্টেরিয়াজনিত নরম পচা (Erwinia carotovora/ Pseudomonas gladioli) রোগ হয়ে থাকে। এ রোগগুলো পেঁয়াজের মাঠ থেকেই শুরু হয়। স্টোরে বøাক মোল্ডে আক্রান্ত পেঁয়াজের গলা ও কন্দ কালো হয়ে যায়। ব্যাসাল রট রোগের মাধ্যমে মাঠের পেঁয়াজের নিচের দিকে আক্রমণ করে এবং পেঁয়াজের ভেতরে নষ্ট হয়ে যায়। নরম পচা রোগে প্রথমে পেঁয়াজের মাঠে পাতা ভেঙে যায়। পরে স্টোরের পেঁয়াজে পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। বেশি আক্রান্ত হলে পেঁয়াজ হলদে বাদামি রং ধারণ করে নরম হয়ে পচে যায় এবং আক্রান্ত পেঁয়াজ থেকে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। নরম পচা রোগটি পেঁয়াজ পরিবহণের সময়েও দেখা দেয়। স্টোরে ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগের কারণে আক্রান্ত সম্পূর্ণ পেঁয়াজ পচে যেতে পারে। পোকামাকড় বা অন্য কোন কারণে মাঠে পেঁয়াজের ক্ষত হলে এ সমস্ত রোগ সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। এ সমস্ত রোগ থেকে পেঁয়াজকে মুক্ত রাখার জন্য পরিষ্কার পরিছন্ন চাষাবাদ, ভালো নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন ছত্রাক ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা খুবই জরুরি। সঠিক পরিপক্বতার সময়ে মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহ করলে এই সমস্ত রোগ থেকে পেঁয়াজকে রক্ষা করা যায়। পেঁয়াজের বীজ এবং চারার গোড়া ছত্রাকনাশক দ্বারা শোধন করে বপন/রোপণ করা উচিত। প্রতি কেজি বীজ ২ (দুই) গ্রাম ছত্রাকনাশক (রোভরাল/ডায়থেন-এম ৪৫ ইত্যাদি) দ্বারা শোধন করলে এবং ছত্রাকের দ্রবণে পেঁয়াজের চারার মূল ২ (দুই) মিনিট ডুবালে ছত্রাকজাতীয় রোগের আক্রমণ কমে যায়। কোন পেঁয়াজের মাঠে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থার মাধ্যমে সময়মতো রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রোগাক্রান্ত পেঁয়াজ সংরক্ষণাগারে অতি তাড়াতাড়ি পচে যায়। পার্পল বøচসহ অন্যান্য রোগের জন্য রোভরাল/রিডোমিল গোল্ড/ডায়থেম এম-৪৫/নাটিভো ইত্যাদি বালাইনাশক ২.০-২.৫ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে পর্যায়ক্রমে ১৫-২০ দিন পর পর এবং থ্রিপস দমন করার জন্য কুইনালফস ২৫ ইসি/ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি ২.০-২.৫ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে পর্যায়ক্রমে ১৫ দিন পরপর প্রয়োগ করতে হয়।


প্রতি বছর একই জমিতে পেঁয়াজ/রসুন না করাই ভালো। পেঁয়াজ সংরক্ষণাগারে চারিদিক থেকে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকলে সংরক্ষিত পেঁয়াজে এ সমস্ত রোগের আক্রমণ কম হয়। পেঁয়াজ সংরক্ষণের আগে অবশ্যই রোগাক্রান্ত  ও ক্ষতিগ্রস্ত পেঁয়াজ বাছাই করতে হবে। রোগাক্রান্ত পেঁয়াজের শুষ্ক পদার্থ, মোট কঠিন পদার্থের পরিমাণ কমে যায় এবং রং নষ্ট হয়ে বাজার মূল্য কমে যায়।


মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহ
মাঠের ৬০-৭০ শতাংশ পেঁয়াজের গাছ ভেঙে পড়লে মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহ করা উচিত। আগাম অপরিপক্ব পেঁয়াজ সংগ্রহ করলে সংগৃহীত পেঁয়াজে বেশি পানি থাকার কারণে ব্যাক্টেরিয়া/ছত্রাকজনিত রোগ দেখে দেয় এবং স্টোরে বাল্ব থেকে পাতা গজায় (অংকুরোদগম)। আবার দেরিতে পেঁয়াজ সংগ্রহ করলে বাল্বের খোসা পড়ে গিয়ে সংরক্ষণাগারে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। পেঁয়াজের রং নষ্ট হয়ে যেতে পারে।  অন্যদিকে  আগাম বৃষ্টিতে পেঁয়াজ ভিজে গিয়ে স্টোরে পেঁয়াজের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে।


মাঠ থেকে সংগৃহীত পেঁয়াজ শুকানো
সাধারণত বাংলাদেশের কৃষকগণ পেঁয়াজের কিউরিং না করেই পেঁয়াজ স্টোরে সংরক্ষণ করে থাকেন। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহের পর পাতাসহ ০৫-০৭ দিন হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে পেঁয়াজকে শুকাতে হয়। পেঁয়াজ সংগ্রহের সময় আগাম বৃষ্টিতে পেঁয়াজ ভিজে গেলে দ্রুততার সাথে শুকানোর ব্যবস্থা করতে হয়। প্রয়োজনে ফ্যানের বাতাসে শুকাতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, পেঁয়াজকে রোদে শুকালে ব্যাপক ক্ষতি হয়। শুকানোর পর পেঁয়াজের ৪-৫% ওজন হ্রাস পায় যাতে পেঁয়াজ দৃঢ় ও আঁটসাঁটে হয় এবং পেঁয়াজের গলা সংকুচিত হয়ে ছত্রাক এবং ব্যাক্টেরিয়া প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিউরিং এর ফলে শ^সন হারও কমে যায়। অপর্যাপ্ত কিউরিং এর ফলে রোগের পরিমাণ বেড়ে যায়। কিউরিং করার কারণে পাতা শুকিয়ে গাছের বৃদ্ধি বাধাদানকারী হরমোন পেঁয়াজে (কন্দ) প্রবেশ করে যাহা পেঁয়াজের সুপ্ততার মেয়াদ বৃদ্ধি করে। পেঁয়াজের সংরক্ষণক্ষমতা বৃদ্ধি ও গুণগতমান বজায় রাখার জন্যেই পেঁয়াজকে পাতাসহ শুকানো হয়। হালকা ছায়ায় শুকানোর কারণে পেঁয়াজের রং উজ্জ্বল হয়। পেঁয়াজ শুকানোর পর বাল্বের উপরের গলা ২.০-২.৫ সে. মি (সর্বোচ্চ ১ ইঞ্চি) রেখে পাতা কেটে দিতে হয়। পরে বাল্বের মূল কেটে পরিষ্কার করে পেঁয়াজ স্টোরে সংরক্ষণ করা হয়।


উল্লেখ্য, রোগবালাই, থেঁতলানো, গলা মোটা, বোল্টার, পচা, ক্ষত ইত্যাদি মুক্ত একক দৃঢ় বাল্ব সংরক্ষণের জন্য বাছাই করা হয়। খুবই ছোট/বড় বাল্ব সংরক্ষণের জন্য একসাথে না রাখাই ভালো।


পেঁয়াজ পরিবহণে মোড়কের ধরন
ভালো মোড়ক পেঁয়াজ পরিবহণ ও বাজারজাতকরণের সময় পেঁয়াজের ক্ষতি যেমন ক্ষত, রোগবালাই, পানির অপচয় রোধ করে। পেঁয়াজের ক্ষত সৃষ্টি হলে ঐ পেঁয়াজে মূল/অংকুরোদগম হয়। তাছাড়া ক্ষত পেঁয়াজ পচে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনুপযুক্ত মোড়কে পেঁয়াজ পরিবহণ করলে পেঁয়াজের রং নষ্ট হয়ে যায়, যা ভোক্তার নিকট অপছন্দনীয়। পেঁয়াজ পরিবহণে চটের বস্তা, নাইলনের বস্তা ও প্লাস্টিক ক্রেট (
Crate) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে ছিদ্রযুক্ত ব্যাগ ব্যবহার করলে বাতাস চলাচলের মাধ্যমে পেঁয়াজ খুবই ভালো থাকে।


হরমোন/রেডিয়েশনের ব্যবহার
স্টোরে পেঁয়াজের অংকুরোদগম বন্ধ করার জন্য ফসল সংগ্রহের ১৫-২০ দিন আগে বিভিন্ন প্রকার হরমোন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে ম্যালেইক হাইড্রাজাইডই সবচেয়ে বেশি কার্যকরি। এ ধরনের বৃদ্ধি প্রতিরোধী হরমোন ব্যবহারের মাধ্যমে সংরক্ষণকৃত পেঁয়াজের কোষ বিভাজন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অংকুরোদগম ক্ষমতা হ্রাস পায়। মাঠের শতকরা ১০ ভাগ পেঁয়াজ গাছ ভেঙে পড়লে প্রতি লিটার পানিতে ২৫০০-৩০০০ মি. গ্রাম ম্যালেইক হাইড্রাজাইড এর দ্রবণ তৈরি করে স্প্রে করা হয়। তবে হরমোনকে পানিতে মেশানোর আগে অ্যালকোহলে দ্রবীভূত করে নিতে হয়। হরমোনের দ্রবণে আঠা জাতীয় পদার্থ মিশিয়ে স্প্রে করা ভালো। অনেক সময় গামা রেডিয়েশনের মাধ্যমে অংকুরোদগম বিলম্বিত করে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি করা হয়।


সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা
বিশ্বে সাধারণত ০৩টি পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে যথা- কোল্ডস্টোরেজ (তাপমাত্রা ০-২/৪  ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬৫-৭০%), অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ/হিট স্টোরেজ (সাধারণ তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬৫-৭০%) এবং কন্ট্রোল্ড অ্যাটমোসফিয়ার স্টোরেজ (অক্সিজেন ১-২%, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ৩% ও তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)। নিম্ন তাপমাত্রা অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহের জন্য কোল্ডস্টোরেজ উপযুক্ত পদ্ধতি। বাংলাদেশের মতো গরম অঞ্চলের দেশেসমূহে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করাই উপযুক্ত পদ্ধতি, যাকে অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ (
Ambient storage) বা হিট স্টোরেজ (Heat storage) বলে। অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজে ২৫-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণকৃত পেঁয়াজে অংকুরোদগম/মূল উৎপাদনকারী হরমোন (সাইটোকাইনিন) উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের দেশে অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ সাধারণত বাঁশের তৈরি হয়ে থাকে। বাঁশ দ্বারা এক বা দুই স্তর বিশিষ্ট মাচা/চাং তৈরি করা হয়। পেঁয়াজের মাচা বাঁশের বানা দিয়ে তৈরি করা হয়। স্টোর ঘরের চাল বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। খড়ের/অ্যাসবেসটস দ্বারা নির্মিত চাল থেকে টিন দ্বারা নির্মিত চালে বেশি তাপ উৎপন্ন হয়ে থাকে। সংরক্ষণাগারের চাল টিনের হলে টিনের নিচে অ্যালুমিনিয়াম ইনসুলেটর দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তাছাড়া পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থার জন্য পেঁয়াজের মাচার চারিদিক থেকে ভেন্টিলেটারের ব্যবস্থা করতে হয়।


বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা না থাকলে অরিরিক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে গুদামজাত রোগ বøাক মোল্ড/গ্রেমোল্ড এবং নরম পচা রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যেতে পারে। টিন দ্বারা নির্মিত সংরক্ষণাগারে স্তুুপীকৃত পেঁয়াজের পুরুত্ব ৩০ সেমি. (১২ ইঞ্চি) এবং খড় বা অ্যাসবেসটস দ্বারা নির্মিত সংরক্ষণাগারে স্ত‚পীকৃত পেঁয়াজের পুরুত্ব ৩৭ সেমি. (১৫ ইঞ্চি) এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা ভালো। দৈনন্দিন রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য প্লাস্টিক বা বাঁশের তৈরি র‌্যাকে ১৫ সেমি. (৬ ইঞ্চি) পুরুত্বে সংরক্ষণ কর যায়।     

                                                           
এখানে উল্লেখ্য যে, অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজের  স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও আর্দ্রতা ৬৫-৭০%। যা পেঁয়াজের গুণাগুণ, রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পায়। স্টোর থেকে ১৫-২০ দিন পর পর পেঁয়াজ নামিয়ে পচা, অংকুরোদগমকৃত এবং রোগাক্রান্ত বাল্ব আলাদা করে পুনরায় সংরক্ষণ করতে হয়। এভাবে মাঝে মাঝে বাছাই না করলে পেঁয়াজের ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। পেঁয়াজ সংরক্ষণের মেয়াদ বাড়ার সাথে সাথে পেঁয়াজের ওজনেরও হ্রাস পেতে থাকে। আবহাওয়াজনিত কারণে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বছর থেকে বছরে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কৃষকপর্যায়ে ৪০০-৫০০ মন পেঁয়াজ সংরক্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিস্তর বিশিষ্ট একটি অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ তৈরি করতে প্রায় ৩-৩.৫ লক্ষ টাকা প্রয়োজন হবে। এ ধরনের স্টোর প্রায় ২০-৩০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত এ ভাবে ভালো কৃষি প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পেঁয়াজের সংরক্ষণজনিত ক্ষতির পরিমাণ গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যে রাখা সম্ভব।

১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর, মোবাইল : ০১৭২৩৭৯৪৫৩৮, ই-মেইল : musfiqur.bari@gmail.com, ২ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর