Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনা ও সমলয়ে চাষাবাদ

বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনা ও সমলয়ে চাষাবাদ

কৃষিবিদ কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী

একটি নতুন সূর্য একটি নতুন দিনের আগমনকে নিশ্চিত করে। পরাধীনতার শেকলে বন্দী হয়ে অত্যাচারী শাসকের নির্মম কশাঘাতে বাংলার মাটি যখন নিষ্পেষিত তখনই বাংলার আকাশে অংশুমান হয়ে উদীত হন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির আবেগ ও আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দেন। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতা বিপ্লবের ডাক দেওয়া মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা পরবর্তী স্বপ্ন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়া।
হাজার বছরের অবহেলিত ও শোষিত ছিল এ বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন।  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করেছিলেন কৃষির উন্নতিই হচ্ছে কৃষকের অর্থনৈতিক মুক্তি। সে কারণেই স্বাধীনতার পরই তিনি সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। জাতির পিতা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে বলেছিলেন, “খাদ্যের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন অন্যের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার”। (সূত্র কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধু, ড. সামসুল আলম, পৃষ্ঠা-৪৩) সময়ের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ৩য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আম উৎপাদনে ৭ম, আলু ও পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম অবস্থানে রয়েছে। আবাদি জমি কমেছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণ কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু খাদ্য নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য তিনি বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তার পরিপ্রেক্ষিতগুলো ছিল- বঙ্গবন্ধু কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। ভূমিস্বত্ব আইন জারি করার মাধ্যমে পরিবার প্রতি ভূমি মালিকানা ৩৭৫ একর থেকে কমিয়ে সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা সিলিং আরোপ করেন। গরিব কৃষকদের সহায়তার উদ্দেশ্যে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রথম বার্ষিক বাজেটে  ১৯৭২-৭৩ সালে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল এর মধ্যে ১০১ কোটি টাকা শুধু কৃষি উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছিল। কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে তিনি প্রথম বাজেটে কৃষিখাতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেন। বাজেটে ভর্তুকি দিয়ে বিনামূল্যে কীটনাশক ও সার সরবরাহ করেন। এ ছাড়াও ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষিকর্মী নিয়োগ করেছিলেন তিনি। কৃষি পণ্য বিশেষ করে ধান, পাট, আখের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দিয়েছিলেন। গরিব কৃষকদের রেশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সবুজ বিপ্লব কর্মসূচির আওতায় খাদ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের ৩০ লাখ টন খাদ্যঘাটতি পূরণে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে ও স্বল্পমেয়াদে উন্নত চাষাবাদের প্রেক্ষিতে উন্নতবীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবারহ করেন। এ ছাড়াও কৃষি  ঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমির বিতরণের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান যেমন কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে এক দিকনির্দেশনামূলক ভাষণে কৃষি গ্র্যাজুয়েটদেরকে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান করেন।


কৃষি ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নতুন নতুন জ্ঞান অর্জন, কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার’ প্রবর্তন করা হয় ১৯৭৩ সালে।


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশ ও কৃষি উন্নয়নে বলেছিলেন ‘আমাদের আর্থসামাজিক কারণে দেশে দিনদিন জমির বিভাজন বেড়ে চলেছে। যদি সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তোলা না যায় তাহলে আমাদের কৃষি উন্নয়ন ব্যাহত হবে, আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব না।’ সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন গ্রামভিত্তিক বহুমুখী সমবায়। ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে ‘দেশ আমার মাটি আমার’ অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় তিনি গ্রামে  বহুমুখী কো-অপারেটিভ করার রূপরেখা তুলে ধরেন।


১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু সমবায় সংক্রান্ত তাঁর প্রস্তাবটি জনসমক্ষে তুলে ধরেন। এই বক্তৃতায় তিনি বলেন “আমি ঘোষণা করছি যে, পাঁচ বছরের প্লান (পরিকল্পনায়) প্রত্যেকটি গ্রামে কম্পলসারি (বাধ্যতামূলক) কো-অপারেটিভ হবে। বাংলাদেশে ৬৫ হাজার গ্রাম কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি মানুষ যে কাজ করতে পারে তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী        কো-অপারেটিভ করা হবে”। পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ার বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার জনবান্ধব সরকার কৃষিবান্ধবনীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। তিনি করোনা ভাইরাসজনিত বিশ্ব মহামারিতে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের নানা প্রতিক‚লতার মধ্যেও বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রেখেছেন এবং কৃষি ক্ষেত্রে এক অসাধারণ বিস্ময়কর সাফল্য অর্জিত হয়েছে।


মুজিববর্ষে উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি সমলয়ে চাষাবাদ (Syn-chronize Cultivation)
সমলয়ে চাষাবাদ নামে কৃষি মন্ত্রণালয় বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাতের অর্থ থেকে সমলয়ের চাষাবাদ নামের এ কর্মসূচিটি মাঠ পর্যায়ে প্রথমবারের মতো বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সারা দেশে ৬১টি জেলায় ৫০-৬০ একরের ৬১টি  বøক প্রদর্শনী হিসেবে বাস্তবায়িত হবে। পাশাপাশি জমি আছে এমন কৃষক-কৃষানির গ্রæপ নির্বাচন করতে হবে এবং গ্রæপে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী কৃষক অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।


চলমান বোরো মৌসুমে বোরো ধানের হাইব্রিড জাত যার ফলন হেক্টরপ্রতি ৪-৫ টনের বেশি এমন জাতের বীজ সংগ্রহ করতে হবে। সমলয়ে চাষাবাদের মাধ্যমে উৎপাদিত বীজ পরবর্তী মৌসুমে উপযুক্ত মূল্যে (বিএডিসি’র বীজের মূল্যের বেশি নয়) ক্রয় করে কৃষকদের মাঝে বিতরণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এবং বীজের গুণগত মান সম্পর্কে ব্রি, ডিএই ও এসসিএ’র কর্মকর্তা সমন্বয়ে গঠিত কমিটি প্রত্যয়ন প্রদান করবে। সমলয়ে চাষাবাদের প্রতিটি কার্যক্রমে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।


জমি তৈরি, ট্রেতে চারা উৎপাদন, রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের সাহায্যে চারারোপণ, সার, বীজ, বালাইনাশক, কম্বাইন্ড হারভেস্টারের সাহায্যে ফসল কর্তন, মাড়াই ইত্যাদি সকল কাজে আধুনিক কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং সরকার এসব কাজে সহায়তা প্রদান করবে। পরবর্তী বছরে সরকার Adapation এর জন্য বীজ সহায়তা প্রদান করবে। সমলয়ে চাষাবাদ কর্মসূচিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। অর্থাৎ কৃষি উৎপাদনে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার, উচ্চফলনশীল আধুনিক জাতের সম্প্রসারণ, কৃষি কাজে নারীর অংশগ্রহণ, সুষম সার ব্যবহার, সঠিক সময়ে সঠিকভাবে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার, আধুনিক সেচ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সুরক্ষায় পরিবেশবান্ধব উৎপাদন কৌশল প্রয়োগ এবং বাজার ব্যবস্থায় কৃষক গ্রুপের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সমলয়ে চাষাবাদের কর্মসূচিটি প্রাথমিকভাবে বোরো ধানের উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা হলেও বাংলাদেশের টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য এটিকে আরও সম্প্রসারিত করার প্রয়োজন রয়েছে।


আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষক ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং প্রান্তিক কৃষক। চাষের জমিগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত। ক্রমবর্ধমান জনঘনত্বের দেশে ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি। এ রকম বাস্তবতায় সমলয়ে চাষাবাদ কর্মসূচি টেকসই কৃষি উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (SDG) বাস্তবায়ন,  উত্তম কৃষি চর্চা, জাতীয় কৃষিনীতি-২০১৮সহ কৃষিবিষয়ক নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটি সময়োপযোগী কর্মসূচি।

পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, ফোন : ৫৫০২৮২৬০, ই-মেইল : dirais@ais.gov.bd