Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

খাদ্য নিরাপত্তায় তুলা চাষের অবতরণিকা

ড. মোঃ ফরিদ উদ্দিন১ মোঃ মাহমুদুল হাসান২

বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভরশীল দেশ। এ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে বর্তমান সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং খাদ্য নিরাপত্তায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।  বিশে^র কাছে বাংলাদেশ আজ খাদ্য নিরাপত্তায় রোল মডেল। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে মূলত দুটি বিষয়কে বোঝানো হয় একটি ‘খাদ্যের সহজলভ্যতা’ ও অপরটি ‘খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা’। কোনো একটি দেশের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা তখনই শতভাগ নিশ্চিত হবে যখন দেশটিতে তার জনগণের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য বিদ্যমান থাকবে এবং জনগণের খাদ্য ক্রয় করার সামর্থ্য থাকবে।


বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। দেশের অধিকাংশ জনগণ গ্রামে বসবাস করে যার অধিকাংশ প্রত্যক্ষভাবে কৃষি কাজের সাথে জড়িত। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবদি  কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন সমগ্র বিশ্বের কাছে আদর্শস্বরূপ। সাম্প্রতিক সময়ে দানাদার শস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, সাথে সাথে অন্যান্য ফসলের উৎপাদনও বেড়েছে লক্ষণীয় হারে। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে কৃষকের আয়। কিন্তু কৃষকের এই বর্ধিত আয় বাজারে খাদ্যের মূল্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। চাহিদার অতিরিক্ত পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদনের কারণে প্রতি বছর কৃষকদের বেশ বড় অঙ্কের ক্ষতি হচ্ছে। তাই খাদ্যশস্য উৎপাদনের পাশাপাশি বিভিন্ন অর্থকরী ফসল (তুলা, চা, পাট ইত্যাদি) উৎপাদন কৃষকদের এই ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে লাভের মুখ দেখাতে পারে।


বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল তুলা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প সম্পূর্ণভাবে এই তুলার ওপর নির্ভরশীল যার বেশির ভাগ অংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা আমদানিকারক দেশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের দেশে প্রায় ৮১ লাখ বেল তুলা আমদানি করা হয়েছে যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৪০,০০০ কোটি টাকা। তুলা একটি আঁশজাতীয় ফসল এবং এর বীজ হতে উপজাত হিসেবে ভোজ্যতেল ও খৈল পাওয়া যায়। তুলা বীজ হতে ১৫-১৭% ভোজ্যতেল ও ৮০% উন্নত মানের খৈল পাওয়া যায়। দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ১৮টি জিনিং শিল্পে প্রায় ১০০টি জিনিং মেশিন ও তুলার বীজ হতে তেল আহরণের জন্য ১৫-২০টি    ঊীঢ়বষষবৎ মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। অপরিশোধিত তেলকে পরিশোধনের মাধ্যমে ভোজ্যতেলে পরিণত করার জন্য কুষ্টিয়ায় বেসরকারি উদ্যোগে একটি রিফাইনারি স্থাপন করা হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ মেট্রিক টন ভোজ্যতেল উৎপাদিত হয়। তুলার খৈল মাছ ও গবাদি পশুর উৎকৃষ্ট মানের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তুলা ফসল উৎপাদনের পর তুলা গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কৃষক শুকনা তুলাগাছ জ¦ালানি হিসেবে ব্যবহার করে অর্থের সাশ্রয় করে অথবা তুলাগাছ জ¦ালানি হিসেবে বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। তুলার বীজ বপন থেকে শুরু করে বীজতুলা প্রক্রিয়াজাতকরণ ও জিনিং পর্যন্ত শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাছাড়া যে জমিতে তুলা চাষ করা হয় সে জমিতে তুলার পাতা পড়ে জমির ঊর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায় ফলে তুলা পরবর্তী ফসলের উৎপাদন খরচ কম হয় এবং ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়। কৃষক ১ হেক্টর তুলা চাষে ৭৫-৯০ হাজার টাকা খরচ করে ৩.৫-৪.৫ টন বীজ তুলা পায় যার বাজার মূল্য ২.২৫-২.৬২ লাখ টাকা। ফলে কৃষক ১ হেক্টর তুলা চাষ করে ১.৫-১.৯ লাখ টাকা (বিঘাপ্রতি ২০-২৫ হাজার টাকা) লাভ পায় ।   

কৃষক উক্ত টাকা দিয়ে খুব সহজে খাদ্য ক্রয় করে পরিবারের সুষম খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। অন্যান্য ফসলের  তুলনায় তুলা ফসলে ঝ্ুঁকি কম। তুলা মধ্যম মাত্রার প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনশীল ফসল। তুলা হালকা কাষ্ঠল (ঝযৎঁন) জাতীয় উদ্ভিদ বিধায় সামান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে তুলা ফসল তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়না যেখানে অন্যান্য ফসল বিশেষ করে সবজি জাতীয় ফসল নষ্ট হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে তুলা ফসলের টিকে থাকার নিশ্চয়তা বেশি। তুলা মধ্যম মাত্রার খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসল। প্রতিকূল পরিবেশে তুলা চাষ বেশ লাভজনক, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো-


ক. খরাপ্রবণ অঞ্চলে তুলা চাষ  : বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলটি খরাপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। এই উঁচু বরেন্দ্র ভ‚মি রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত যা তুলা চাষের জন্য উপযুক্ত। বরেন্দ্র ভ‚মিতে মোট ৫.৮২ লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য জমির ৮৪% এক ফসলি, উক্ত অঞ্চলে ফসলের নিবিড়তা মাত্র ১১৭%। অতিরিক্ত খরার জন্য খাদ্য শস্য উৎপাদন তেমন একটা লাভজনক হয় না। কিন্তু তুলা খরাসহিষ্ণু হওয়ায় মৌসুমি বৃষ্টিপাতও সম্পূরক সেচে উক্ত অঞ্চলে তুলা চাষ করার মাধ্যমে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।


খ. পাহাড়ি অঞ্চলে তুলা চাষ : প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় ঝুম পদ্ধতিতে তুলা চাষ হয়ে থাকে। ঝুম পদ্ধতিতে তুলার ফলন কম হয় ফলে কৃষকদের লাভের পরিমাণ কম হয়। বর্তমানে তুলা উন্নয়ন বোর্ড বিগত কয়েক বছর গবেষণার মাধ্যমে পাহাড়ের ঢালে আন্তঃফসল পদ্ধতিতে দুই সারি ধান ও এক সারি আপল্যান্ড জাতের তুলা চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে যার মাধ্যমে উক্ত এলাকার চাষিরা ধান ও তুলা উভয়ের অধিক ফলন পেয়ে লাভবান হচ্ছে। এছাড়া পাহাড়ের ঢালে (ঠধষষবু) মাটিরাঙ্গা, খাগড়াছড়ি, লামা, বান্দরবান এলাকায় প্রচুর পরিমাণে তামাক চাষ হয়। সে সমস্ত ঠধষষবু তে তুলা চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব অঞ্চলের কৃষকেরা তামাক থেকে তুলা চাষের দিকে ঝুঁকছে। পাহাড়ি অঞ্চলে লাভজনকভাবে তুলা চাষ করে উপজাতিদের জীবনমান উন্নত করা হচ্ছে এবং খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে।


গ. লবণাক্ত এলাকায় তুলা চাষ : বাংলাদেশের আবাদি জমির একটি বিরাট অংশ দখল করে আছে উপকূলীয় এলাকা (২৮.৫ লাখ হেক্টর)  যা দেশের সমগ্র আয়তনের ২০%। উপক‚লীয় এলাকার মাটি লবণাক্ত হওয়ার কারণে সকল প্রকার খাদ্যশস্য খুব একটা ভালো হয় না। তুলা মধ্যম মাত্রার লবণাক্ততাসহিষ্ণু ফসল হওয়ায় আমন ধান কাটার পর পতিত জমিতে রবি মৌসুমে তুলা চাষের গবেষণাও সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে উপক‚লীয় এলাকার    কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে।


ঘ. চরাঞ্চলে তুলা চাষ : বাংলাদেশের নদ-নদীর অববাহিকায় জেগে উঠা চরাঞ্চলের মাটি বেলে প্রকৃতির হওয়ায় এর উর্বরতা ও পানি ধারণক্ষমতা কম। এই কারণে চরাঞ্চলসমূহে কৃষকরা খাদ্যশস্য চাষাবাদ করে তেমন লাভবান হয় না। তুলা গভীরমূলী ফসল হওয়ায় দেশের বিভিন্ন চরাঞ্চলে তুলা চাষ করা হচ্ছে। তাছাড়া চরাঞ্চলে তুলা চাষের ফলে জমিতে তুলার পাতা যোগ হয়ে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চরাঞ্চলে তুলা চাষ হতে পারে কৃষকদের অধিক আয়ের একটি সম্ভাবনাময় ফসল ।


ঙ. কৃষি বনায়ন জমিতে তুলা চাষ : বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় আম, পেঁপে এবং লিচু বাগানের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে (বর্তমানে প্রায় ৭০০০০ হেক্টর জমি ফলদ ও বনজ বাগানের আওতাভুক্ত)। এসকল ফলজ বা বনজ জমিতে গাছের বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে ২-৩ বছর সফলভাবে তুলা চাষ করার লক্ষ্যে তুলা উন্নযন বোর্ড বিগত কয়েক বছর যাবত নব্যসৃজনকৃত বাগানে তুলাচাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এর ফলে কৃষকরা তাদের ফলদ ও বনজ বাগানে তুলা চাষ করে অধিক লাভবান হতে পারবে।


তাই যেসব প্রতিক‚লতার কারণে অন্যান্য ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয় সেখানে খুব সহজে তুলা চাষ করে কৃষক লাভবান হয় এবং খাদ্য ক্রয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষকের অধিক আয় নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে। পরিশেষে বলা যায় বাংলাদেশের কৃষকদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে তুলা একটি সম্ভাবনাময় ফসল।

১নির্বাহী পরিচালক, ২তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ফোন : ৫৫০২৮৩৫৫, ই-মেইল : mfaridcdb@gmail.com