Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২০

কৃষিবিদ এ জেড এম ছাব্বির ইবনে জাহান
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। কিন্তু ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি থেকে দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য যোগান বর্তমানে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বন্যা, খরা, ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগবালাই ছাড়াও ইঁদুর প্রতিনিয়তই কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল এর মারাত্মক ক্ষতি করছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা রূপকল্প ২০২১ প্রণয়ন করেছেন। এ দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে যুগান্তকারী এই রূপকল্প বাস্তবায়নে বিশাল কর্মযজ্ঞের অন্যতম হলো দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা। দেশের জিডিপিতে কৃষি   খাতের অবদান ১৪.৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের গৃহীত পরিবেশবান্ধব কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিক সাফল্যে দেশ আজ দানাশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচেষ্টায় শস্যের নিবিড়তা বেড়েই চলেছে বিধায় জমিতে প্রায় সবসময় ফসল বিদ্যমান থাকে। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে প্রয়োজন কৃষি উৎপাদনে আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগ করে অধিক ফলন নিশ্চিত করা আর উৎপাদিত কৃষি পণ্যের বালাইজনিত ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা।


ইঁদুর নামক চতুর প্রাণীটি মানুষের খাদ্যে ভাগ বসিয়ে খাদ্য নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। ইঁদুর বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের অনবরত কাটাকাটির অভ্যাস বিদ্যমান। এর সদা বর্ধিষ্ণু দাঁত আছে। ক্ষয়ের মাধ্যমে দাঁতের এই বৃদ্ধিরোধ করার জন্য ইঁদুর সব সময় কাটাকাটি করে। একটি ইঁদুর প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ গ্রাম খাদ্য খেয়ে থাকে। এরা যা খায় তার ৪/৫ গুণ নষ্ট করে। শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। এরা যে শুধুই কাটাকুটি করে আমাদের ক্ষতি করে তাই নয়, এরা মানুষ ও পশুপখির মধ্যে প্রায় ৬০ প্রকার রোগ জীবাণুর বাহক ও বিস্তারকারী। ইঁদুর দ্বারা ফসলের যে ক্ষতি  হয় তা কমানো গেলে একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তা  নিশ্চিত হবে আবার অন্যদিকে আয়ও বাড়বে।  ইঁদুরের হাত থেকে গুদামের ফসল রক্ষা এবং খাদ্যে মলমূত্র ও লোম সংমিশ্রণ বন্ধ করা গেলে স্বাস্থ্য, নিরাপদ খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চিতের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের রোগের বিস্তারও কমে যাবে। পোকামাকড়ের তুলনায় ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা আপাত খুব কঠিন মনে হলেও অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় সঠিক জ্ঞান এবং কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে সম্মিলিত ও সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমন করলে এদের সংখ্যা কার্যকরভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব।
ইঁদুর যে কোন পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপখাইয়ে নিয়ে দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। উপযুক্ত এবং অনুক‚ল পরিবেশে একজোড়া প্রাপ্ত বয়স্ক ইঁদুর বছরে প্রায় ২০০০টি বংশধর সৃষ্টি করতে পারে এবং প্রতিবারে ৪-১২টি বাচ্চার জন্ম দেয়। জন্মের  ৪২-৫০ দিন পরেই বাচ্চা ইঁদুর পূর্ণবয়স্ক হবার মাধ্যমে প্রজননে সক্ষমতা লাভ করে। এই দ্রুত বংশবিস্তারকারী স্তন্যপায়ী মেরুদণ্ড প্রাণিটি আমাদের বিভিন্ন ফসল যেমন ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, বিভিন্ন ফল ও শাকসবজির মাঠে এবং গুদামে ক্ষতি করছে, আমাদের বাসা বাড়ির আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, জামা-কাপড়, বিছানাপত্র এবং বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতি করছে। এর পাশাপশি বাঁধ, রেললাইন, জাহাজ, বন্দর, অফিস, মাতৃসদন, সেচের নালাসহ সর্বত্র ইঁদুরের বিচরণ রয়েছে। এক কথায় কোন সম্পদই ইঁদুরের হাত থেকে রেহাই পায় না। দেশে শুধু ধান কর্তন থেকে গুদামে রাখা অবস্থায় ২-২৫ ভাগ পর্যন্ত ইঁদুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। গবেষণা থেকে জানা যায় তিন মাসের জন্য ধান গুদামে রাখা হলে ৫ খেকে ১০ ভাগ ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতি হতে পারে। বৃষ্টিনির্ভর ও সেচ সুবিধাযুক্ত ধানের জমিতে ফসল কাটার পূর্বে শতকরা ৫-১৭ ভাগ ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ৪-১২ ভাগ, গোলআলু ৫-৭ ভাগ, আনারস ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭% এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫% ক্ষতি করে। ইঁদুরের সমস্যা গ্রামের লোকজন সঠিকভাবে বুঝতে পারে না, সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয় কোন পদ্ধতিও পর্যাপ্ত নয়। তাই এই ক্ষতি স্বাভাবিক হিসেবেই গ্রহণ করে থাকে। গ্রামীণ মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর ইঁদুর যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা সঠিকভাবে বুঝে উপযুক্ত দমন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে পারাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।


এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১৯৮৩ সাল থেকে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক গত পাঁচ বছরে ইঁদুর নিধন অভিযান বাস্তবায়নের মাধ্যমে রক্ষা পাওয়া আমন ফসলের পরিমাণ, নিধনকৃত ইঁদুরের সংখ্যা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষক, ছাত্রছাত্রী ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারীর সংখ্যা নিম্নে বর্ণিত হল।
সূত্র ঃ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
বর্তমানে সারাবিশ্বে পোলট্রি শিল্প ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং পোলট্রি উৎপাদনকারীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে মুরগির ডিম ও ছোট বাচ্চা খেয়ে ফেলে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর অমেরুদণ্ড প্রাণী বিভাগের হিসাবে ইঁদুর দেশের প্রতিটি মুরগির খামারে বছরে ১৮ হাজার টাকার ক্ষতি করে। পোলট্রি শিল্পে ইঁদুর দ্বারা অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে লক্ষ্য রেখে মুরগির খামারিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমনে অংশগ্রহণ করে এবং খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২০ এর উদ্দেশ্য
*কৃষক, কৃষানি, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইপিএম/আইসিএম ক্লাবের সদস্য, সিআইজি, ডিএই এর বিভিন্ন কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহসহ সর্বস্তরের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা।
*ইঁদুর দমনের জৈবিক ব্যবস্থাপনাসহ লাগসই প্রযুক্তি কৃষি কর্মীগণের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো।
*ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্প কারখানা ও হাঁস-মুরগির খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
*আমন ফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা।
*গভীর ও অগভীর নলক‚পের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধ করা।
*রাস্তাঘাট ও বাঁধের ইঁদুর নিধনের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
* ইঁদুরবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা।
*সম্ভাব্য ক্ষেত্রে গণযোগাযোগ বিশেষ করে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপারে জোর দেয়া।

 

ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২০ এর উদ্বোধন
বর্তমানে করোনা ভাইরাসের আক্রমণের দরুন প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণজনিত কারণে ইঁদুর নিধন অভিযানের জাতীয় পর্যায়ে উদ্বোধন ৮ অক্টোবর জনসমাবেশ পরিহার করে ভার্চুয়ালভাবে সীমিত আকারে করা হবে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য পোস্টার, লিফলেট, স্মরণিকা সদর দপ্তরের বরাদ্দকৃত অর্থ দ্বারা কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে প্রস্তুত করে অঞ্চল, জেলা ও উপজেলায় প্রেরণ করার ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন পর্যায়ে কোন প্রকার উদ্বোধন অনুষ্ঠান, পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান, র‌্যালি, আলোচনা সভা ইত্যাদি করা যাবে না।
দেশে করোনা পরিস্থিতিতে ইঁদুর নিধন অভিযান
*ভার্চুয়ালভাবে সীমিত পরিসরে মাননীয় মন্ত্রী ও সচিব মহোদয়ের উপস্থিতিতে উদ্বোধন ঘোষণা।
*স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধু প্রকাশনার কাজ যেমন বুকলেট/স্মরণিকা/পোস্টার/লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণ, রেডিও/টিভিতে প্রচার প্রচারণা ইত্যাদি বাস্তবায়ন।
*জনসমাবেশ পরিহার করার জন্য ইঁদুর নিধন কর্মসূচির সকল ধরনের আনুষ্ঠানিকতা এ বছরের জন্য বন্ধ রাখা।
*এ বছর করোনাজনিত কারণে কোন পুরস্কার দেয়া হবে না।


ইঁদুর দমন পদ্ধতি পোকা ও রোগবালাই দমন পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইঁদুর চালাক প্রাণী এবং এখানে বিষটোপ ও ফাঁদ লাজুকতার সমস্যার কারণে রাসায়নিক বিষ ব্যবহারের ফলাফল প্রায়ই ব্যর্থ হয়। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ধারণার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মত আমাদের দেশেও পরিবেশসম্মত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জনপ্রিয় করা যেতে পারে। পরিবেশসম্মত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনায় জৈবিক দমন পদ্ধতিকে অন্তর্ভুক্ত করলে দীর্ঘ মেয়াদে ইঁদুর দমনে অধিক সফলতা আসতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে একজোড়া প্যাঁচার চার মাসের একটি প্রজনন চক্রে ৫০-৭০ গ্রাম ওজনের প্রায় ৩০০০-৫০০০টি পর্যন্ত ইঁদুর ভক্ষণ করতে পারে। তাই প্যাঁচার প্রাকৃতিক পরিবেশকে সংরক্ষণের পাশাপাশি এর প্রজনন ও প্রতিপালনে কৃষক  পর্যায়ে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ঘরবাড়ি, গুদাম, হাঁস-মুরগীর খামার, অফিস-আদালত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিনিয়ত ইঁদুরের উপস্থিতি যাচাই করে ইঁদুর নিধনের ব্যবস্থা করতে হবে। ইঁদুর দমনের কলাকৌশল অধিক সংখ্যক কৃষকের নিকট পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তার বøকের কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এছাড়া উপজেলা ও জেলা ভিত্তিক মাউস হান্টার বা পেশাজীবী ইঁদুর নিধনকারীদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করে তাদের মাধ্যমে এ অভিযানকে আরও কার্যকর করা যেতে পারে। এ কর্মসূচিতে ইঁদুর দমন প্রযুক্তি সম্পর্কিত তথ্য সংক্ষিপ্ত আকারে স্মরণিকায় সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া সরকার অনুমোদিত ব্রমাডিওলোন ও জিংক ফসফাইড গ্রæপের ইঁদুর নাশক (যেমনÑ ল্যানির‌্যাট, ব্রমাপয়েন্ট, রেটক্স, জিংক ফসফাইড ইত্যাদি) বিষটোপ যথেষ্ট পরিমাণে বালাইনাশক ডিলারের দোকানে মজুদ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কাজেই ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি রোধ, জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও দূষণমুক্ত পরিবেশের স্বার্থে ইঁদুরকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে আমাদের সম্প্রসারণকর্মীগণ এলাকার চাষি, ছাত্রছাত্রীসহ সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে একযোগে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করে এই কর্মসূচি সফল করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

 

পরিচালক, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। ফোন : ৯১৩১২৯৫ ই-মেইল :  dppw@dae.gov.bd