Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

নিরাপদ সবজিসহ ফসল উৎপাদনে চরাঞ্চল

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ। আবহমানকাল হতে অসংখ্য নদনদী এ দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান। চলমান নদনদীর কোলজুড়ে রয়েছে অসংখ্য চর। ধারণা করা হয় বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ মিলিয়ন হেক্টর চর এলাকা রয়েছে। এসব চর এলাকায় প্রচুর সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে চরের সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের উন্নয়নে চর এলাকাগুলোর অবদান বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।


চর এলাকায় কৃষি উন্নয়নের অন্তরায়
চর এলাকার মাটিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের স্বল্পতা বিশেষ করে নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম, ফসফরাস, সালফার, বোরন এবং জিংক। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানেরও যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তবে বিশেষ করে নাইট্রোজেন এবং জিংকের অবস্থা বেশি শোচনীয়। ভূমির বন্ধুরতা ও মাটির প্রকৃতি উত্তম সেচ ব্যবস্থাপনার জন্য সহায়ক নয়। বেলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে সেচ সুবিধার অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হয়। চর এলাকায় চাষিদের মধ্যে রোগবালাই প্রতিরোধে উচ্চফলনশীল আধুনিক জাত ও ফসল উৎপাদন এবং সার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব বা অপ্রতুলতা রয়েছে। আধুনিক ও উচ্চফলনশীল জাতের মানসম্মত বীজের অভাব কৃষি উৎপাদনের অন্যতম অন্তরক। কৃষি তথ্য সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সঠিক সময়ে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম হওয়ায় কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ও কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণের সুফল চরবাসী পায় না। ফলে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে বহুকষ্টে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম থেকে তারা বঞ্চিত হয় বলে পরবর্তীতে ওই ফসল চাষে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদের এ চরাঞ্চলে আনতে পারে নতুন সম্ভাবনাময় কৃষি।


চর এলাকায় কৃষি উৎপাদন বাড়াতে করণীয় : চর এলাকার মাটি, আবহাওয়া ও স্থানীয় পরিবেশের সাথে মানানসই ফসল ধারা প্রবর্তন করতে হবে। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে চর এলাকার জন্য প্রয়োজনে আলাদা সার সুপারিশমালা প্রণয়ন করতে হবে।  অধিক উৎপাদনশীলতার জন্য চরে প্রত্যেক ফসলের ক্ষেত্রে মুখ্য ও গৌণ সারের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। চর এলাকায় চাষের উপযোগী খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু অধিক পুষ্টিমানসমৃদ্ধ (Bio-fortified) ও স্বল্পকালীন জাতের প্রবর্তন জরুরি। স্থানীয় জাতের পরিবর্তে উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের প্রবর্তন এবং সম্প্রসারণ করতে হবে। ভালো বীজের সংস্থান নিশ্চিত করাও দরকার। চর জেগে ওঠার সাথে সাথে যেহেতু কৃষিকাজ শুরু হয়ে যায়, কাজেই সময়মতো পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন বীজের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। জমি তৈরি, শস্য বপন, ফসল পরিচর্যা, শস্য কর্তন ও কর্তন পরবর্তী শস্য ব্যবস্থাপনায়  আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির প্রয়োগ বাড়াতে হবে। মিশ্র ফসল, আন্তঃফসল ও রিলে ফসল প্রবর্তনের মাধ্যমে শস্য বহুমুখীকরণ ও প্রচলিত পদ্ধতির উন্নয়ন করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক ও সমন্বিত কৃষি প্রযুক্তি প্রবর্তনের মাধ্যমে বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর পাশাপাশি সমন্বিত শস্য ও বালাই ব্যবস্থাপনার প্রবর্তন ও প্রায়োগিক সুফল বিষয়ক জ্ঞানের বিস্তার দরকার। রোগবালাই, বন্যা, খরা ও তাপসহিষ্ণু জাত নির্বাচন করতে হবে। উন্নত জাত, বিকল্প ফসল ধারার প্রবর্তন ও শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে তিন বা চার ফসলভিত্তিক শস্য বিন্যাস প্রবর্তন করে উৎপাদনশীলতা চরাঞ্চলে সহজেই বাড়ানো সম্ভব।


চর ও সমতলের কৃষির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে যেহেতু চরগুলো ডুবে বা নিমজ্জিত থাকে, তাই এসব চরের বেশিরভাগ এলাকায় কোনো ফসল থাকে না। কাজেই বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে সেখানে চাষবাস শুরু হয়। এ জন্য কৃষকের সুবিধার্থে চরসংশ্লি­ষ্ট এলাকার বাজারগুলোতে প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ যেমন- বীজ, সার, বালাইনাশক প্রভৃতির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। বাজার সংশ্লি­ষ্ট এলাকায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ফসল সংরক্ষণের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে ভ্যালু চেন তৈরির মাধ্যমে কৃষকেরা যাতে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে।


প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চর এলাকার কৃষকের মাঝে আধুনিক জাত ও উৎপাদন কলাকৌশল বিষয়ক কারিগরি জ্ঞানের প্রসার খুব বেশি প্রয়োজন। চর এলাকার পতিত জায়গাগুলোর  সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে চর এলাকায় প্রচলিত শস্যবিন্যাসে বিদ্যমান পতিত স্থানগুলো স্বল্পকালীন অথবা প্রতিকূল পরিবেশে হয় এমন ফসল দ্বারা উৎপাদনের আওতায় আনা দরকার। যেমন-বোরো ধান-পতিত ফসল ধারায় রোপা আমন অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, ভুট্টা- পতিত ফসল ধারার পরিবর্তে ভুট্টা/লালশাক/ডাঁটা, বাদাম-পতিত ফসল ধারার পরিবর্তে বাদাম/মসুর-তিল অথবা বাদাম-তিল/পাট অথবা বাদাম-রোপা আমন, মিষ্টিকুমড়া-পতিত ফসল ধারার পরিবর্তে মিষ্টি কুমড়া/করলা-রোপা আমন ফসল ধারার প্রবর্তন করা যেতে পারে। বর্ষা মৌসুমে অধিকাংশ চর এলাকা নিমজ্জিত থাকে বলে ওই সময়ে শস্য বহুমুখীকরণের সুযোগ সীমিত। কিন্তু বর্ষার পানি যখন ধীরে ধীরে নেমে যেতে থাকে তখন চরগুলো জেগে ওঠা শুরু করে। শুকনো মৌসুমে সেখানে শস্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। মিশ্র চাষ, আন্তঃফসল চাষ ও রিলে পদ্ধতি ব্যবহার করে শস্য নিবিড়তা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পেঁয়াজের সাথে বাদাম অথবা কালোজিরার মিশ্রচাষ, পেঁয়াজের সাথে রিলে ফসল হিসেবে কাউন, বাদাম ও মসুরের মিশ্র চাষ, পাট ও ভুট্টা, আলুর সাথে রিলে করলা ও ভুট্টা, ভুট্টার সাথে রিলে ফসল হিসেবে ডাঁটা, লালশাক, নাপাশাক, ধনিয়া, পাট প্রভৃতি, বেগুন, মরিচ ও ধনিয়ার মিশ্র চাষ, আখের সাথে আন্তঃফসল হিসেবে মিষ্টি আলু, লালশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, পাটশাক প্রভৃতি চাষ করে চর এলাকায় উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকের অতিরিক্ত আয় করার বিশাল সুযোগ রয়েছে। এছাড়া সাথী ফসল বিক্রি করে সংসারের খরচ পূরণের পাশাপাশি মূল ফসলের উৎপাদন খরচ মেটানো যায় ফলে সংসারের অতিরিক্ত খরচ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়।


নানা ধরনের প্রতিকূলতা নিয়েই চরের জীবন। এখানে একদিকে যেমন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তেমনি অফুরন্ত সম্ভাবনাও বিরাজমান। সম্ভাবনাগুলোকে খুঁজে বের করে কাজে লাগাতে হবে। চর এলাকার উন্নয়নের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রয়োজন। চরের সমস্যাগুলো চিহ্নিতকরণ, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপখাইয়ে চলার উপায়সমূহ নির্ধারণ, আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে চরের স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও সঠিক পরিকল্পনা।

মোঃ আমিনুল ইসলাম

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সগবি, বারি, গাইবান্ধা, মোবাইল ঃ ০১৮৪৭১৫৫১৪২, মেইল : amin.agron@gmail.com