Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বীজ আর্দ্রতার সাতকাহন

শীতকালে অনেকের চামড়া বা ঠোঁট ফেটে যায়। এঁটেল ও পলিমাটিতেও তা ঘটে। এর অন্যতম কারণ শরীর বা মাটির উপরিভাগের জলীয়কণা বা আর্দ্রতা শুকিয়ে যাওয়া। আর্দ্রতা বা জলীয় ভাগ ইংরেজি ময়েশ্চার নামে অভিহিত। পানি দেহ কোষ গঠনে দরকারি। বেশি পানি কোষের কাঠামো নষ্ট করে। পানির কণা এর নির্দিষ্ট পরিমাণ কোষের আঠালোভাব ধরে রাখায় সহায়ক। তাই শীতকালে তেল বা এজাতীয় কিছু মেখে বা কিছু দিয়ে ঢেকে চামড়া বা মাটির ছিদ্রপথে বন্ধ করে কিংবা মাটির আর্দ্রতা চলাচলের  ভারসাম্য রক্ষা করে। আদিকাল থেকে জমিতে পরিমিত পানি বা সেচ দিয়ে মাটির আর্দ্রতা বাড়িয়ে ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। আবার প্রয়োজনে জমির অতিরিক্ত পানি শুকিয়ে নেওয়া বা নিষ্কাশন করা হয়। বিভিন্ন ফসল শুকিয়ে তার আর্দ্রতা কমিয়ে অনেক দিন সংরক্ষণ করে রাখা কৃষকের আদিম ঐতিহ্য। আর্দ্রতার প্রভাব কৃষি কাজে বেশ ব্যাপক অংশ জুড়ে বিদ্যামান। আমাদের শরীরর মতো ধান ও অন্যান্য ফসলের বীজে জলীয় ভাগের ভিন্নতার পরিমাণ এর মানউন্নয়নে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। বীজমান নিশ্চিত করতে না পারলে সে বীজ ভালো হয় না। তাই মান নিশ্চিতকরণ বীজ প্রযুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বীজের মান নিশ্চিতকরণের জন্য বীজ ফসলের মাঠমান এবং বীজ সংরক্ষণাগারে বীজমান বজায় রাখায় আর্দ্রতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করে ১৫% থেকে ২০% উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
চাষের জন্য ব্যবহৃত গাছের যে কোনো অঙ্গকে কৃষিকাজে বীজ বলা হয়। যেমন ধান বা গমের দানা বা বিচি বা প্রকৃত বীজ, গোল আলু, আদা, রসুন, কচুর প্রভৃতির কন্দ। দেশের বীজ আইনে বলা আছে: ‘বীজ’ অর্থ মাদকদ্রব্য বা চেতনানাশক হিসেবে ব্যবহার ব্যতীত, পুনরায় উৎপাদন এবং চারা তৈরিতে সক্ষম যে কোনো জীবিত ভ্রƒণ বা বংশ বিস্তারের একক (প্রপাগিউল), যেমন- খাদ্যশস্য, ডাল ও তেলবীজ, ফলমূল এবং শাকসবজির বীজ, আঁশজাতীয় ফসলের বীজ, চারা, কন্দ, বাল্ব, রাইজোম, মূল ও কাÐের কাটিংসহ সব ধরনের কলম এবং অন্যান্য অঙ্গজ বংশ বিস্তারের একক।
বীজের জলীয়ভাগ ৪০% এর কাছাকাছি বা তার বেশি হলে এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে, সম্ভাব্য ফলাফল হিসেবে বীজ অঙ্কুরিত হতে পারে। কিন্তু বীজের জলীয় ভাগ ১৮% - ২০% হলে, বীজ এবং বীজে উপস্থিত ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বীজ গরম হয়ে যেতে পরে, গজাবে না। বীজের  জলীয়ভাগ ১২%-১৪% হলে, বীজের উপরিভাগ ও অভ্যন্তরে ছত্রাক জন্মাতে পারে, গজাবে না। তবে ধান, গম প্রভৃতি বীজের আর্দ্রতা কমানো গেলে চমৎকার ফলাফল পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, বীজ সংরক্ষণের ওপর প্রবাদতুল্য দুটি মতবাদ ব্যক্ত করেছেন হ্যারিংটন-১৯৭০ সালে। প্রথমত, সংরক্ষণাগারে বীজের তাপমাত্রা প্রতি ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড কমানোর ফলে বীজের সংরক্ষণকাল দ্বিগুণ হবে। এ নিয়ম ৫০ ডিগ্রি থেকে শূন্য ডিগ্রি  সেলসিয়াস সীমার মধ্যে প্রযোজ্য। দ্বিতীয়ত, সংরক্ষণাগারে বীজের জলীয় ভাগ (আর্দ্রতা) ১% কমানোর ফলে বীজের সংরক্ষণকাল দ্বিগুণ হবে। এ নিয়ম বীজের ১৪ - ৪% জলীয় ভাগ সীমার মধ্যে প্রযোজ্য ।  কথা দাঁড়ায়, ১১% আর্দ্রতায়, ধান, গম প্রভৃতি বীজ অন্তত ২৪ মাস বা ২ বছর সংরক্ষণাগারে রাখা যাবে। আর ১২%, ১৩% ও ১৪% আর্দ্রতায় যথাক্রমে অন্তত ১২, ৬ ও  ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। ধান ও গম যখন কাটা হয় সাধারণত তাতে ২০-২২% এর বেশি আর্দ্রতা থাকে না। বৃষ্টি পেলে বা বর্ষার ভিজে আবহাওয়ায় এর পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। পুষ্ট তবে অধিক ভেজা শস্য উপযুক্ত পরিবেশ পেলে, প্রথমে তা ফোলে এবং পড়ে তার মধ্যে জৈবিক প্রক্রিয়ায় গজানোর কাজ শুরু করে। এ তথ্য মাথায় রেখেই ধান, গম, ডাল প্রভৃতি শস্য কাটা ও মাড়াইয়ের পর পরই রোদে বা কৃত্রিম উপায়ে শুকিয়ে আর্দ্রতা কমিয়ে আনা হয়। তাই আর না ভিজলে এবং ১৪% আর্দ্রতায়  তা প্রায় ৩ মাস সংরক্ষণ করা যায়। পরে জৈবিক, জীবাণু ও তাপমাত্রার আধিক্যের কারণে পচে যেতে পারে কিন্তু গজাবে না। আর যদি ১৪% আর্দ্রতা কিছু দিনের মাঝে আরো কমিয়ে নেয়া যায় তা হলে তো হ্যারিংটন এর-১৯৭০ সালের সে মতবাদ অনুসারে প্রতি ১% আর্দ্রতা কমানোর জন্য সংরক্ষণ কাল দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। আবার বীজের আর্দ্রতা নির্ধারিত হারের চেয়ে কমে গেলে বীজাবরণ ফেটে আর্দ্রতার অভাবে গজানো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। একবার বীজের মান নষ্ট হলে তা ফিরিয়ে আনা যায় না।
প্রায়শ: দায়ে পড়ে জেনেশুনে কোনো কোনো দরিদ্র কৃষক ধান কাটা-মাড়াইয়ের পর পরই ২০-২২% আর্দ্রতার ধান বিক্রয় করে ফেলে, সে ওজনের হারে বেশি পরিমাণ ধান কড়ায়-গÐায় ফাও হিসেবে ফড়িয়ারা নিয়ে নেয়। পরে তা শুকিয়েই বিপণন করে। আর্দ্রতার দায় বিক্রেতার ঘাড়ে বর্তায় বটে, পরে তা শুকায়ে সুদাসলে মুনাফা উসুল করে মধ্যস্বত্বভোগী। কেউ কেউ বলে থাকেন, কৃষক ময়েশ্চার কী তা জানে না।  সে কারণে ভিজাধান কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্য অধিদফতর কিনতে  অনাগ্রহী। অনেক কৃষক ময়েশ্চার এ ইংরেজি শব্দটির অর্থ জানতে না পারলেও এর মর্মার্থ ও কার্যকারিতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত।
কৃষকসমাজের অনেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অক্ষরজ্ঞানহীন বা অর্ধাক্ষর হতে পারেন, কিন্তু  তারা স্ব-শিক্ষায় ও অভিজ্ঞতায় বিপুলভাবে সমৃদ্ধ। তাদের প্রকৃতিলব্ধ লোকজ জ্ঞানকে ছোট করে দেখা একদিকে একপেশে অপরদিকে দুঃখজনকও। কবি সুনির্মল বসুর কথায় ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,/সবার আমি ছাত্র,/নানানভাবে নতুন জিনিস/শিখছি দিবারাত্র ...।’ প্রকৃতি থেকে শেখা এমনি আমাদের তৃণমূলের খনা, লালন, হাসনেরা। এখনো অনেক গবেষক কৃষকদের থেকে লোকজ জ্ঞান নিয়ে সমৃদ্ধ হন।  
প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি জমি থেকে শস্য তোলার পর এর বিশাল অংশ সংরক্ষণ করার আগে বেশ কয়েক দিন ধরে রোদে শুকিয়ে নেয়া কৃষাণীদের স্বাভাবিক কর্ম। উল্লেখ্য, এখনো গ্রামাঞ্চলে বছরের একটা সময়ে ঐতিহ্যবাহী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে শস্য ও বীজসম্পদ সংগ্রহের অন্যতম উৎস হিসেবে। আর প্রতিটি কৃষকের বাড়িই এক একটা শস্য ও বীজ ব্যাংক। শস্য ও বীজ ছাড়া কৃষকের বাড়ি অচিন্তনীয়। ছাই, শুকনা বালু, গাছ-গাছালির পাতা শুকিয়ে বা মরিচের গুঁড়া প্রভৃতি রকমারি বীজ বা শস্যের সাথে মিশিয়ে থাকেন। যেসব বাঁশ অথবা বেতের ঝুড়ি বা ডোলে বীজ বা শস্য সংরক্ষণ করা হয়, সেসব ঝুড়ি বা ডোলের গায়ে আঠালো কাদার সাথে ধানের তুষ মিশিয়ে ঝুড়ির গায়ে লেপে ভালো করে রোদে শুকিয়ে নেয়া হয়। যার প্রধান উদ্দেশ্য, পাত্রকে আলো এবং বাতাস তথা আর্দ্রতা রোধকরণ। যদিও এখন অনেকে গোলা হিসেবে প্লাস্টিক বা ধাতব পাত্রাদি ব্যবহার করে।
অভিজ্ঞজন ধান, গম, ডাল, পাটবীজ, তেলবীজ প্রভৃতি শস্যস্ত‚পের মাঝে হাতের তালু ঢুকিয়ে বা মুঠোয় শস্য নিয়ে ওপর থেকে বীজস্ত‚পে ফেলে এর প্রতিধ্বনি শুনে বুঝতে পারেন; তা কেমন শুকনো। ধান, গম প্রভৃতি শস্য দাঁত দিয়ে চাপ দিলে, যদি তা কট শব্দ করে ভেঙে যায়, তবে বর্তমানে নিশ্চিত হয় যে তা সংরক্ষণের উপযুক্ত। আর্দ্রতামাপক যন্ত্রে শস্যের শুকানো মান আর অভিজ্ঞ চাষির ধারণা মানের মধ্যে অধিকাংশই সাযুজ্য পাওয়া যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপজেলা ও প্রকল্পভ‚ক্ত মাঠ এলাকায়, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সীর মাঠ অফিস, বেসরকারি বীজ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, বিএডিসির বীজ ক্রয় কেন্দ্র, খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্য ক্রয় কেন্দ্র প্রভৃতি স্থানে আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র সহজলভ্য। এ যন্ত্র ধান, গম বীজ প্রক্রিয়াজাত ও কেনা বেচা  ব্যবসায়ীদের হাতের নাগালেও পাওয়া যায়।
পরিশেষে, একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, কৃষকের উৎপাদনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সুখে থাকা, তাই তাদের উৎপাদন ব্যবস্থায় আমাদের এখনো অনেক করণীয় আছে। আর্দ্রতার মারপ্যাঁচে ফসল বিপণনের ক্ষতির দায়ভাগ আমাদেরও বহন করতে হবে, যার যার অবস্থান থেকে। তা ধান, পাট, আলু বা যে কোনো কৃষিপণ্যই হোক। বাংলার কাদা মাটিতে মিশে থাকা বঙ্গবন্ধুর উক্তি: ‘যদি পারি দেশের জনগণের জন্য কিছু করব....য়

 কৃষিবিদ এ এইচ ইকবাল আহমেদ

পরিচালক (অব.), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী, বাসা কলমিলতা #৪, এলেনবাড়ি সরকারি অফিসার্স কলোনি, তেজগাঁও, ঢাকা-১২১৫,  
সেল: ০১৬১৪৪৪৬১১১, ahiqbal.ahmed@yahoo.com