Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ফসল বৈচিত্র্যায়নে মাটির ডাক্তার

কৃষিবিদ শাহ্ মো. গোলাম মওলা

ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তনয়া     মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। খোরপোষের কৃষি থেকে বর্তমানে আমরা বাণিজ্যিক কৃষির দিকে যাত্রা শুরু করেছি। কৃষির এ নবযাত্রায় ফসল বৈচিত্র্যায়নে সুফলা মাটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মাটি আমাদের মায়ের মত। মায়ের স্বাস্থ্য আমাদের নিকট যেমন গুরুত্ববহ, ঠিক তেমনি মাটির স্বাস্থ্য। টেকসই কৃষি উন্নয়নে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
মাটির বুকেই মানুষের জন্ম। মাটির উপরই মানুষের যাপিত জীবন। কবির ভাষায়-‘যার বুকে তুই জন্ম নিলি তারে চিনলি না। মাটির মঙ্গল করো রে ভাই, মাটি যে তোর মা।’ অথচ মাতৃসম মাটির সাথে মানুষের অসমীচীন ব্যবহারের ফলে মাটি স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়ছে-যা বর্তমানে দুঃশ্চিন্তার কারণ।
বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ উর্বর মাটি নানাভাবে দূষণের শিকার। মৃত্তিকা দূষণের কারণে মাটির উৎপাদিকা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। ফলে ফসলের ফলন আশাতীত হচ্ছে না। মাটি দূষিত বা বিষাক্ত হয়ে গেলে জীব বৈচিত্র্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। মাটিতে বসবাসকারী উপকারী অনুজীব মারা যাবে-এতে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিভিন্ন কারণে আজ প্রতিক‚লতার মুখে এই বৃহৎ প্রাকৃতিক সম্পদ। মৃত্তিকা দূষণ এখন একটি নীরব ঘাতক। দূষণের উৎস হিসেবে দেশের      গৃহস্থালি বর্জ্য, কল কারখানার কঠিন ও তরল বর্জ্য, ল্যান্ডফিলগুলো (ময়লার ভাগাড়) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছভাবে রাসায়নিক সার এবং মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারের কারণে মৃত্তিকা দূষণ হচ্ছে।
মাটির স্বাস্থ্য বলতে ফসল উৎপাদনের জন্য মাটি কতটুকু উপযোগী তা বোঝানো হয়ে থাকে। মাটির উর্বরতা মাটির স্বাস্থ্য পরিমাপের মাপকাঠি। যে মাটিতে অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি থাকে না এবং যা ফসল উৎপাদনের উপযুক্ত তাকে স্বাস্থ্যবান মাটি বলে।
টেকসই উন্নয়ন অভিলক্ষ্য ২০৩০ [ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং-২০৩০] স্বপ্ন পূরণের অভিযাত্রায় মৃত্তিকা সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। টেকসই কৃষি উন্নয়নের অন্যতম অনুষঙ্গ সুফলা মাটি। কেননা           কৃষকের স্বপ্ন বুননের আধার মাটি। সেই স্বপ্ন ফিকে হয়Ñযদি না থাকে স্বাস্থ্যকর মাটি। সবুজ বিপ্লবের হাওয়ায় বেড়েছে কৃষি উৎপাদন, অন্যদিকে কমেছে মাটির উর্বরতা। অথচ এই মাটি থেকেই আমরা জীবন ধারণের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সব কিছুই পেয়ে থাকি। খাদ্যের জন্য আমরা মাটিতে অনবরত ফসল ফলাই। কিন্তু মাটির সঠিক যতেœর অভাবে সুফলা মাটি তার ভারসাম্যতা হারাচ্ছে এবং স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। নানা কারণে মাটির এ অবস্থা হয়ে থাকে।
া    মাটির অ¤øত্ব বৃদ্ধি অ¤øধর্মী ইউরিয়া, অ্যামোনিয়া সালফেট প্রভৃতি নাইট্রোজেন সার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহারে মাটির অ¤øত্ব বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রায় ৪.৬ মিলিয়ন হেক্টর আবাদি জমি বিভিন্ন মাত্রায় অ¤øত্বের শিকার।
া    মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি উজানে ফারাক্কা বাঁধের কারণে বিভিন্ন নদীতে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে আসা, ঘন ঘন সামুদ্রিক ঝড়, জলোচ্ছ¡াস-সিডর, আইলার আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোনা পানির অনুপ্রবেশ, চিংড়ি ঘেরে লোনা পানিতে চিংড়ি চাষ, সুষ্ঠু সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থার কারণে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৮টি জেলার ৯৬টি উপজেলা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় আক্রান্ত। বিগত চার দশকে লবণাক্ত আক্রান্ত জমির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে উপক‚লবর্তী অঞ্চল ছাড়িয়ে এই লবণাক্ততা ক্রমে বেড়েই চলছে। লবণাক্ততার কারণে এ এলাকায় শস্য নিবিড়তা মাত্র ১৩৩ শতাংশ।
া    আমাদের অধিকাংশ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ২ বা ২-এর কম। জৈব পদার্থের ঘাটতিজনিত কারণে মাটির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে থাকে।
া    গাছের/ফসলের প্রয়োজনীয় ১৬টি উপাদানের যে কোনো একটি যদি মাটিতে সঠিক মাত্রায় ও সহজলভ্য আকারে না থাকে; তবে মাটির স্বাস্থ্যের ব্যত্যয় ঘটে।
া    অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহারে মৃত্তিকা স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। মাটিতে পুষ্টি উপাদানের বিষাক্ততা দেখা দিচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ সেচের পানি ব্যবহার, রাসায়নিক সার, কীটনাশকে মাত্রাতিরিক্ত দূষক পদার্থের উপস্থিতি (লেড, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, মার্কারি, ক্রোমিয়াম নিকেল) মাটির দূষণ ঘটাচ্ছে।
া    সারা বছর জমিতে পানি পছন্দকারী ফসল চাষাবাদ করার কারণে মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলি পরিবর্তন হচ্ছে। এতে করে মাটিতে দস্তা ও সালফারের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ৩.৮ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে দস্তা এবং ৪.৬ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সালফারের অভাব দেখা দিয়েছে।
া    তামাক চাষে মাটির বুনট, গঠন বিন্যাস, পিএইচ লেভেল ও অনুজৈবিক কার্যাবলিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কেননা তামাক অত্যধিক রাসায়নিক সার,         কীটনাশক এবং শ্রমঘন ফসল। তামাক অন্যান্য ফসলের তুলনায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশ বেশি গ্রহণ করে (জুয়েল এবং ফাল্গুনী-২০১৫)। এ জন্য দেখা যায়, উন্নত দেশ অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে তামাক চাষ স্থানান্তর করছে।   
া    অপ্রয়োজনে বেশি সংখ্যক চাষের মাধ্যমে ও বেশি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির সংযুক্তি নষ্ট হচ্ছে।
া    পাহাড়ি এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে জুম চাষের কারণে ভূমিক্ষয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে ভূমি অবক্ষয় পরিবীক্ষণ টাস্কফোর্সের পরিচালিত ১৯৮৮ সালের এক জরিপ থেকে জানা যায়, পাহাড়ি জমির প্রায় ১৭ হাজার               বর্গকিলোমিটার এলাকা ভূমি ক্ষয়ের ঝুঁকির আশঙ্কায় রয়েছে।
া    সর্বোপরি অনেক কৃষক জেনে বা না জেনেই নগদ লাভের আশায় ফসলি জমির টপ সয়েল (১-১.৫ ফুট) ইট ভাটায় বিক্রি করে থাকে। এটি আমাদের কৃষির জন্য মারাত্মক অশনিসংকেত।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) মৃত্তিকার তথ্য ভাÐার সৃজন, গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি অনন্য সংস্থা। এসআরডিআই-প্রকাশিত ‘উপজেলা নির্দেশিকা’একটি তথ্যবহুল প্রকাশনা। উপজেলা নির্দেশিকার তথ্যকে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে ‘মাটির ডাক্তার’ শিরোনাম স্থানীয় উদ্যোক্তা তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদের স্থানভিত্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তা করা, পাশাপাশি স্থানভিত্তিক কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তর ও টেকসই কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের সীমিত ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদকে ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য সংরক্ষণ করা।
আমাদের শরীরের মতো মাটিরও রয়েছে শারীরিক কাঠামো। শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হই, ঠিক তেমনি মাটির বোবাকান্না নিরসনে তথা মাটির সুস্থতায় ‘মাটির ডাক্তার’।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই), বগুড়া জেলা কার্যালয়ের একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ ‘মাটির ডাক্তার’।  কৃষকের দোরগোড়ায় মাটির স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই পাইলটিং আকারে বগুড়া সদর উপজেলায় এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এটি একটি প্রত্যয়দীপ্ত ক্ষুদ্র প্রয়াস। এ কার্যক্রমের আওতায় এলাকার কৃষক/কৃষাণীর চাহিদামাফিক বিনামূল্যে মাটির স্বাস্থ্য সেবা তথা মাটির গুণাগুণ অনুসারে ফসল/ফসলবিন্যাসভিত্তিক সার সুপারিশ প্রদান, মাটির নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতি ও মাটি পরীক্ষাকরণে সহায়তা, জমির ধরন বুঝে উপযোগী ফসলের জাত নির্বাচন ও ভেজাল সার শনাক্তকরণে সহযোগিতা,            ভার্মি কম্পোস্টসহ অন্যান্য জৈবসার ব্যবহারে কৃষক উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে সেবা গ্রহীতা কৃষক ভাইদের সারের খরচে সাশ্রয় হচ্ছে গড়ে প্রায় ১০ ভাগ, পাশাপাশি ফসলের গড় ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় ২০-২৫ ভাগ।
কৃষক-কৃষাণীর মূল পুঁজি হচ্ছে কৃষি জমি। কৃষি জমির স্বাস্থ্য সুরক্ষা করেই আমাদের ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।  দানাশস্যে আমরা স্বয়ম্ভর হয়েছি বটে, তবে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদনে নয়। পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদনে সুস্থ মাটির গুরুত্ব অপরিসীম। য়

উদ্ভাবক ‘মাটির ডাক্তার’ কার্যক্রম, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এসআরডিআই, জেলা কার্যালয়, বগুড়া; মোবা: ০১৭১৭-৭১৫৬৫২,      ই-মেইল: moulasrdi@yahoo.com