Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

প্রতিদিনের সুষম ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পুষ্টি

বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। কিন্তু পুষ্টি নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। পুষ্টিকর খাবারের  মাধ্যমে আমরা এটি অর্জন করতে পারি। এজন্য খাদ্যশস্য আর প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনে আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে। পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা স্বাস্থ্যবান জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। এজন্য প্রথমেই আমরা কী খাচ্ছি এবং সেটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটুকু দরকারি, সে খাবার থেকে কতটুকু পুষ্টি অথবা শক্তি পাব সেটি ভাবতে হবে। কারণ খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি-এই তিনটি শব্দ একটি আরেকটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ মনের জন্য প্রতিদিন পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যের প্রয়োজন। দেহের জন্য  প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হলে একজন ব্যক্তির জন্য সুষম খাদ্য নির্বাচন, খাদ্যের সহজলভ্যতা ও পুষ্টিমূল্য বজায় রেখে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অবস্থা, খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির ওপরও পুষ্টি অনেকটাই নির্ভর করে।


খাদ্যের কয়েকটি উপাদান যেমন- শকর্রা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করাই হলো সুষম খাবার। শর্করা শরীরে শক্তি ও কার্যক্ষমতা জোগায়। চাল, গম, যব, আলু,   মিষ্টিআলু, কচু, চিনি, মধু, গুড় ইত্যাদিতে প্রচুর শর্করা পাওয়া যায়। প্রতি গ্রাম শর্করা থেকে ৪ কিলোক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। প্রোটিন হলো দেহ গঠন ও ক্ষয়পূরণকারী খাদ্য। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, বিভিন্ন ডাল, বরবটি, শিম, মটরশুঁটি ইত্যাদি দেহ গঠনে সহায়তা করে। প্রতি গ্রাম প্রোটিন থেকে ৪          কিলোক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। চর্বি বা ফ্যাট দেহের কর্মদক্ষতা বজায় রাখে এবং ত্বক সুন্দর ও মসৃণ রাখে। সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, তিলের তেল, ঘি, মাখন, চর্বিযুক্ত মাছ, মাংস, ডিম ও কলিজা ইত্যাদি চর্বিযুক্ত খাদ্য। প্রতি গ্রাম চর্বি থেকে ৯ কিলোক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। পানি শরীরকে পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা করে এবং শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। দিনে কমপক্ষে ৮-১০ গøাস পানি পান করা দরকার। এ ছাড়া বিভিন্ন ফলের রস, পানিজাতীয় খাবার গ্রহণ করা দরকার। আঁশ দেহের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ওজন নিয়ন্ত্রণ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, অন্ত্রনালির সুস্থতা বজায় রাখে। খাদ্যের আঁশ উদ্ভিজ খাদ্য থেকে পাওয়া যায়। যেমন-লাল আটা, যব, ভুট্টা, যবের ছাতু, শিম, শিমের বিচি, ডাল ও ডালজাত খাদ্য, খোসাসহ ফল যেমন-কালোজাম, আঙুর, পেয়ারা, আপেল, নাশপাতি ও সব ধরনের    শাকসবজি। খনিজ লবণ যেমন-ফসফরাস, লৌহ, আয়োডিন, জিংক যা দেহ গঠন, ক্ষয়পূরণ, পরিপোষণ, দেহের শরীরবৃত্তীয় কাজ করে। আয়োডিন গলগÐ রোগ প্রতিরোধ করে। লৌহ রক্তস্বল্পতা দূর করে; হাত ও দাঁতের গঠন মজবুত করে। জিংক মানসিক বৃদ্ধি ও হাড়ের  বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ভিটামিন এ, ডি, ই, কে,    ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি সব রকমের সবুজ ও রঙিন শাকসবজি, ফল, টকজাতীয় ফল, ডিম, দুধ, কলিজা, ছোট মাছ, লেবু চা ইত্যাদি খাদ্যে ভরপুর এবং রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্য। ভিটামিন ‘এ’ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘ডি’ রিকেট রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স ত্বকের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘সি’ স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করে।
আঞ্চলিক খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে খাদ্য বৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দেয়া দরকার। মৌলিক খাদ্যগুলো অর্থাৎ ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ডাল, শাকসবজি ও ফলমূল সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে। খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য বিনিময় ও পরিবেশনের ওপর গুরুত্ব দেয়া জরুরি। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রত্যেক খাদ্য বিভাগ থেকে পরিমিত পরিমাণে খাদ্য গ্রহণকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। পুষ্টিসম্মত খাদ্য গ্রহণের লক্ষ্যগুলো হলো- বাংলাদেশের জনগণের পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়ন এবং পুষ্টি উপাদনের অভাবজনিত রোগগুলো প্রতিরোধ করা; গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী মায়েদের যথাযথ পুষ্টিগত অবস্থা বজায় রাখা; শিশুদের সঠিকভাবে মায়ের দুধ ও পরিপূরক খাবার  খাওয়ানো  নিশ্চিত করা; খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলো প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা; বয়স্কদের সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে আয়ুষ্কাল বাড়ানো। বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশের বেশি শিশু প্রোটিন ও ক্যালরিজনিত পুষ্টিহীনতায় ভোগে, যার মধ্যে খর্বাকৃতি ৩৬ শতাংশ, কৃষকায় ১৪ শতাংশ এবং নিম্ন ওজনে রয়েছে ৩৩ শতাংশ। গড়ে এক চতুর্থাংশ মহিলা দীর্ঘস্থায়ী ক্যালরিজনিত অপুষ্টিতে ভোগে, যাদের অধিকাংশেরই দেহে একই  সঙ্গে জিংক, আয়রন ও আয়োডিনের স্বল্পতা রয়েছে। এসব আমাদের সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে।
আদর্শ খাদ্য গ্রহণের জন্য...
জনগণের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য খাদ্য গ্রহণের ১০টি নির্দেশাবলি এবং পুষ্টিবার্তা আছে। যা সাধারণ জনগণের জন্য সহজবোধ্য। এটি পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে  সময়োপযোগী ধারণার প্রেরণা জোগাবে। এর মাধ্যমে জনগণ কোন খাদ্য কী পরিমাণ গ্রহণ করবে, প্রতিদিন কী পরিমাণ তেল, লবণ, চিনি ও পানি গ্রহণ করবে সেই সম্পর্কে     বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা পাওয়া যাবে। এতে বিভিন্ন খাদ্যের সুফল ও কুফল সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়া  হয়েছে। নির্দেশাবলিতে নিরাপদ খাদ্য ও রান্না সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা  দেয়া হয়েছে, যা প্রয়োগ করলে খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের অপচয় রোধ হবে এবং  সুস্বাস্থ্য বজায় থাকবে। প্রতিদিন সুষম ও বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য গ্রহণ; পরিমিত পরিমাণে তেল ও চর্বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ; প্রতিদিন সীমিত পরিমাণে আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ; মিষ্টিজাতীয় খাদ্য সীমিত পরিমাণ গ্রহণ; প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে  নিরাপদ পানি ও পানীয় পান; নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ; সুষম খাদ্য গ্রহণের  পাশাপাশি নিয়মিত শারীরিক শ্রমের মাধ্যমে আদর্শ ওজন বজায় রাখা; সঠিক পদ্ধতিতে রান্না, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং সুস্থ জীবনযাপনে নিজেকে অভ্যস্তকরণ; গর্ভাবস্থায় এবং স্তন্যদানকালে চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি খাদ্য গ্রহণ; শিশুকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ দেয়া এবং ৬ মাস পর বাড়তি খাদ্য প্রদান।
প্রতিদিনের সুষম ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পুষ্টি...
প্রতিদিন চাহিদা অনুযায়ী ভাত, রুটি বা অন্যান্য শস্যজাতীয় খাদ্য গ্রহণ; ভাত ও রুটির সঙ্গে ডাল-মাছ-মাংস-ডিমজাতীয় খাবারের সমন্বয়ে তৈরি খাদ্য গ্রহণ; চাল অতিমাত্রায় না ধুয়ে বসাভাত রান্না ও গ্রহণ; লাল চাল ও লাল আটা হলো প্রোটিন, আঁশ, তেল, খনিজ লবণ ও ভিটামিনের উৎস সেজন্য পারত পক্ষে এগুলো বেশি করে গ্রহণ। প্রতিদিন মাঝারি আকারের ১-৪ টুকরা মাছ-মাংস এবং ১ থেকে ১/২ কাপ ডাল (৩০-৬০ গ্রাম) গ্রহণ; প্রাণিজ প্রোটিনের অনুপস্থিতিতে ভাত ও ডাল অথবা মুড়ি ও ছোলার ওজনের আদর্শ অনুপাত ৩:১ বজায় রাখা; প্রতিদিন কমপক্ষে ২টি মৌসুমি ফল (১০০ গ্রাম) গ্রহণ করা। ১টি চাপা কলা, ১টি আমড়া এসব খাওয়া; খাদ্য গ্রহণের পর আয়রনের পরিশোষণ বাড়ানোর জন্য ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন- আমলকী, পেয়ারা, জাম্বুরা, পাকা আম খাওয়া; প্রতিদিন অন্তত ১০০ গ্রাম বা  ১ আঁটি শাক এবং ২০০ গ্রাম বা ২ কাপ সবজি গ্রহণ; সুস্থতার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ১ কাপ (১৫০ মিলিলিটার) দুধ বা আধা কাপ দই গ্রহণ; বৃদ্ধকালে ননিতোলা দুধ এবং সয়াদুধ গ্রহণ করুন।
তেল ও চর্বিজাতীয় পুষ্টিবার্তা : প্রতিদিন প্রাপ্ত বয়স্ক জনপ্রতি গড়ে ৩০-৪৫ মিলিলিটার বা ২-৩ টেবিল চামচ তেল গ্রহণ; রান্নায় প্রধানত উদ্ভিজ তেল  যেমন- সরিষা, সয়াবিন, রাইসব্রান তেল ব্যবহার; ঘি, ডালডা ও মাখন যথাসম্ভব কম ব্যবহার; অতিরিক্ত ভাজা এবং তৈলাক্ত খাবার বর্জন; নিয়মিত উচ্চ চর্বিযুক্ত বেকারির খাদ্য কেক, পেস্ট্রি, ফাস্টফুড, হটডগ, বার্গার, উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাদ্য পরোটা, কাচ্চি, বিরিয়ানি, পোলাও, কোরমা, রেজালা, প্রক্রিয়াজাত মাংস, গ্রিল চিকেন এসব পরিহার করা। এ খাবারগুলোতে ট্রান্সফ্যাট থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; বাজারের সনদবিহীন খোলা তেল গ্রহণ থেকে বিরত থাকা আবশ্যকীয়।
আয়োডিন ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্যের পুষ্টিবার্তা : প্রতিদিন ১ চা চামচের কম পরিমাণ আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ; খাবারের সময় বাড়তি লবণ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা; উচ্চমাত্রার লবণাক্ত খাদ্য বাদ দেয়া বা সীমিত পরিমাণে গ্রহণ; টেস্টিং সল্ট গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা। দৈনিক ২৫ গ্রাম বা ৫ চা চামচ এর কম পরিমাণে চিনি গ্রহণ করা; মিষ্টি কোমল পানীয় বর্জন করা;  বেকারির তৈরি খাবার বিস্কুট, কেক, জ্যাম জেলি, চকলেট, ক্যান্ডি, মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্য সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা; বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফল খেয়ে প্রাকৃতিক চিনি গ্রহণকে     উৎসাহিত করা। আর পানি গ্রহণ সংক্রান্ত পুষ্টিবার্তা হলো- প্রতিদিন ১.৫-৩.৫ লিটার অর্থাৎ ৬-১৪ গøাস বিশুদ্ধ পানি পান করা; কোমল পানীয় এবং কৃত্রিম জুসের পরিবর্তে ডাবের পানি অথবা টাটকা ফলের রস পান করা বেশি পুষ্টিসম্মত।
আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। শিশুর জন্য জন্মের ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধই যথেষ্ট এবং ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী অধিক পুষ্টিকর পরিপূরক খাবার দিতে হবে। সেই সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশে খাদ্য পরিবেশন করা হয়। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু, মা ও বৃদ্ধরা পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক ও মানসিক বিপর্যয় ডেকে আনে। শিশু মৃত্যুর কারণ হিসেবে পেটের অসুখ, হাম, নিউমোনিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর মধ্যে দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি না ঘটার কারণে আত্মকেন্দ্রিকতা, অবসাদ, ব্যক্তিত্বহীনতা দেখা যায় এবং মেধাশক্তি বিকশিত হতে পারে না। ফলে এসব ছেলেমেয়ে অলস ও উদাসীন, পরনির্ভর নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে।

জি এম আবদুর রউফ
উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ঝিনাইদহ, ফোন : ০৪৫১৬২৪৯৮ ddaejhenidah@gmail.com