Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পরিবেশবান্ধব ব্রি সৌরশক্তি চালিত আলোক ফাঁদ

কীটনাশক ছাড়া কীটপতঙ্গ দমনের জন্য প্রচলিত আলোক ফাঁদ বৈদ্যুতিক শক্তি/জ্বালানির সাহায্যে চালানো হয়। আলোক ফাঁদ ব্যবহারের জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ফাঁদটি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এটি তদারকি করা যেমন  শ্রমসাধ্য তেমনি সময়ের  অপচয় হয়। কৃষকের ফসল, বাগান বা সবজির ক্ষেতে বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকলে বৈদ্যুতিক শক্তি চালিত আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা যায় না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিকল্প শক্তি দরকার যা নিরবচ্ছিন্নভাবে আলোক ফাঁদে আলো জ্বলতে শক্তি সরবরাহ করবে। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এবং দেশের কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এর কীটতত্ত্ব বিভাগের সহযোগিতায় ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি (এফএমপিএইচটি) বিভাগ ফসলের মাঠে ব্যবহার উপযোগী সৌরশক্তি চালিত একটি আলোক ফাঁদ উদ্ভাবন করেছে। আলোক ফাঁদটি ফসলের মাঠে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পোকামাকড় দমনের জন্য একটি কার্যকরী প্রযুক্তি। কীটপতঙ্গ সনাক্তকরণ, পর্যবেক্ষণ ও দমনের জন্য এটি একটি সহজ ও জনপ্রিয় পদ্ধতি। এটি ব্যবহার করে দানাদার, ডাল, শিম, বেগুন, বরবটি, করলা ইদ্যাদি সবজি এবং অন্যান্য শস্যের কীটপতঙ্গ দমন করা যায়। সৌরশক্তি ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করা যায় বিধায় এটি একটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং ফসলের মাঠে কীটনাশকের ব্যবহার কমে যাবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।কৃষক পর্যায়ে প্রযুক্তিটি পোকামাকড় দমনে সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। প্রযুক্তিটি একটি সোলার প্যানেল (১৬.৮ ভোল্ট/২০ ওয়াট), একটি ব্যাটারি (ডিসি ১২.৮ ভোল্ট, ৭.৫ এম্পায়ার এবং পি০৪ টাই পলিথিয়াম আয়রন ফসফেট), একটি কণ্ট্রোলার (ডিসি ১২ ভোল্ট), একটি বৈদ্যুতিক বাতি (ডিসি ১২ ভোল্ট, ৮ ওয়াট), একটি প্লাস্ট্রিকের গামলা এবং একটি স্ট্যান্ডের সমন্বয়ে তৈরি আলোক ফাঁদ তৈরি করতে প্রায় ২০৩ সেমি দৈর্ঘ্য এবং ৫ সেমি ব্যাসের একটি লোহার স্ট্যান্ডের (এমএস পাইপ) প্রয়োজন হয়, যার উপরে ৩৬ সেমি প্রস্থ এবং ৪৮.৫০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটি এঙ্গেলবার দ্বারা গঠিত চতুর্ভুজ আকৃতির একটি ফ্রেমে সোলার প্যানেল বসানো থাকে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার কারণে ফ্রেমটিকে স্ট্যান্ডের উপরে ২৩.৫০ উত্তর-দক্ষিণ কোণে স্থাপন করা হয়। সোলার প্যানেলটিকে স্ট্যান্ডের সাথে শক্ত করে আটকে রাখতে ৪৩ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যরে একটি এমএস ফ্ল্যাটবার দ্বারা অতিরিক্ত সাপোর্ট প্রদান করা হয়। এই সাপোর্ট স্ট্যান্ডের মাথায় এবং সোলার প্যানেলের নিচে একটি ডিসি বাল্ব থাকে। বাল্বটিকে বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষার জন্য এমএস সিট দিয়ে ২৯ সেন্টিমিটার ব্যাসের চাকতি আকৃতির ঢাকনা তৈরি করা হয় এবং এটিকে ঢাকনার মাঝ বরাবর হোল্ডারের সাথে আটকে রাখা হয়। প্যানেলের ব্যাটারি স্ট্যান্ডের সাথে এমনভাবে লাগানো থাকে যেন বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা পায়। আলোক ফাঁদে আকৃষ্ট পোকামাকড় মারা যাওয়ার জন্য বাল্বের নিচে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ৪৯.৫ সেমি ব্যাসের একটি গোল চাকতির (এমএস ফ্ল্যাটবার) সাহায্যে প্লাস্টিকের গামলা বসানো হয়। পানি ভর্তি প্ল­াস্টিকের গামলা অতিরিক্ত পানির ভারে পড়ে না যায় সেজন্য ৪৪ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যরে দুটি স্ট্যান্ডের সাহায্যে গোল চাকতিকে সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়। লাইট জ্বলার পর পোকামাকড় আলোর আকর্ষণে লাইটের চারদিকে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে বাল্বের নিচে থাকা শ্যাম্পু বা ডিটারজেন্ট মেশানো পানির গামলায় পড়ে মারা যায়। পোকামাকড় ফসলের উপর ডিম পাড়ার কোনো প্রকার সুযোগ পাওয়ার আগেই মারা যাওয়ায় ফসল আর পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয় না। মরা পোকামাকড় যেন পানি ভর্তি গামলায় পচে গন্ধ ছড়াতে না পারে সে জন্য দুইদিন পর পর গামলার পানি পরিবর্তন করে দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে কোনো রকম জ্বালানির প্রয়োজন হয় না বলে এটি পরিবেশবান্ধব।


সোলার প্যানেলের সেলগুলো সৌরশক্তি গ্রহণের মাধ্যমে ব্রি সোলার লাইট ট্র্যাপের কার্যক্রম শুরু হয়। প্যানেলের সেলগুলোর গৃহীত সৌরশক্তিকে একটি রেগুলেটরের সাহায্যে ডিসি বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে। রেগুলেটরটি একই সাথে ব্যাটারিকে অতিরিক্ত চার্জের মাধ্যমে নিশ্চিত ক্ষতি থেকেও  রক্ষা করে। ডিসি বাল্ব সরাসরি ব্যাটারি থেকে শক্তি গ্রহণের মাধ্যমে চালিত হয়। যন্ত্রটির সুবিধা হলো, এটি মাঠে একবার স্থাপন করলে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে (দিনে) নিভে এবং সূর্যের আলোর অনুপস্থিতিতে (রাতে) জ্বলে।


যে কোনো ধরনের আলোতেই পোকা আকৃষ্ট হয় কিন্তু আলোর তীব্রতা ও রঙের উপর পোকার আকৃষ্টতা কম বেশি হয়। ব্রির এফএমপি এইচটি বিভাগের বিজ্ঞানীগণ দীর্ঘদিনের গবেষণায় বাল্বের তিনটি আলোর রঙের সর্বাধিক কার্যকারিতা পেয়েছেন, যেগুলো সাধারণ আলোর তুলনায় পোকামাকড় দমনে বেশি কার্যকরী। বাল্বের আলোর রঙ তিনটি হলো- নীলাভ, হলদেটে বা পীতাভ এবং ফিকে সবুজ বা সবুজাভ। ব্রি সোলার লাইট ট্র্যাপে নীলাভ রঙের বাল্ব ব্যবহার করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, নীলাভ রঙের বাল্বের আলোর দিকে পোকামাকড় আকর্ষিত হওয়ার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি; কারণ নীলাভ আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেশি।


ব্রি সৌরশক্তি চালিত আলোক ফাঁদের বৈশিষ্ট্য হলো, এটি পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই। সহজে এবং কম খরচে এটি তৈরি করা যায়। এজন্য জ্বালানি খরচ লাগে না এবং যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষতিকর পোকা দমন করা যায়। দানাদার, ডাল, সবজি এবং অন্যান্য শস্যের পোকা দমনের জন্য আলোক ফাঁদের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ । ধানের মাজরা ও কাইচথোড়কালীন যাবতীয় ফড়িং, বাদামি গাছফড়িং, সবজির ফল ছিদ্রকারী পোকা, শোষক পোকা, চিবানো পোকা এগুলোর আক্রমণ দেখা মাত্র জমিতে আলোক ফাঁদ বসাতে হবে। আলোক ফাঁদ জমিতে বসানোর প্রথমদিকে পোকামাকড় মারা যাওয়ার পরিমাণ বেশি দেখা যাবে এবং সময়ের সাথে সাথে কমতে থাকে। প্রতি একর জমির জন্য পৃথক পৃথকভাবে একটি আলোক ফাঁদ বসাতে হবে। পুকুরে মাছ চাষের সাথে আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা যাবে। আলোক ফাঁদের সাহয্যে মারা যাওয়া পোকামাকড়গুলো মাছ সম্পূরক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবে।


আলোক ফাঁদ স্থাপন ও সংরক্ষণে করণীয়
সোলার লাইট ট্র্যাপের নিচের অংশটিকে ভালোভাবে মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। সম্ভব হলে সিমেন্ট ও বালু দিয়ে স্থায়ীভাবে উত্তর-দক্ষিণ দিক বরাবর স্থাপন করতে হবে।
পোকার জন্য স্থাপিত বাল্বতিটিকে নিচ থেকে ২/৩ অংশ উপর বরাবর দুই থেকে তিনটি ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে। অন্যথায় বর্ষাকালে পুরো গামলাটি পানিতে ভরে যায় এবং লাইট ট্র্যাপ বাঁকা হয়ে পড়ে। এতে বাল্ব ও ব্যাটারি নষ্ট হতে পারে।


ফসলের মৌসুম শেষে লাইট ট্র্যাপটি ঘরে না রেখে মাঝে মাঝে চার্জ দিলে ব্যাটারি সচল থাকবে অন্যথায় চার্জ শূন্য হয়ে ব্যাটারি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রাতে উড়ন্ত পোকামাকড় দমনে ব্রি সোলার লাইট ট্র্যাপ একটি কার্যকর প্রযুক্তি। ব্রি সোলার লাইট ট্র্যাপ সৌরশক্তি ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করে বিধায় ফসলের মাঠে কীটনাশকের ব্যবহার কমে যাবে। ফলে ফসলের মাঠে যেমন কীটনাশকের ব্যবহার কমবে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে এবং পরিবেশ থাকবে নির্মল। বিষমুক্ত খাবার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রযুক্তিটি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

 

ড. মো. দুররুল হুদা১ড. মো. গোলাম কিবরিয়া ভূঞা২
বিধান চন্দ্র নাথ৩ ড. মো. পান্না আলী৪

১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ২,৩,৪ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিআরআরআই, গাজীপুর; যোগাযোগ : Kibria­­- 1971@yahoo.com (Mobile & b-kash: 01717902516)