Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

জীবনমান উন্নয়নে পাহাড়ে ফল চাষ

মৃত্যুঞ্জয় রায়
বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাহাড়ি অঞ্চল। পাহাড় ছড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের কিছু অংশে, ময়মনসিংহের দক্ষিণাংশে, সিলেটের উত্তরাংশে, কুমিল্লার পূর্বাংশে, নোয়াখালীর উত্তর পূর্বাংশে ও পার্বত্য চট্টগ্রামে। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই আছে দেশের মোট জমির প্রায় ১০ শতাংশ জমি। এসব পাহাড়ের অনেকটা ভূমি বনাঞ্চল। বনের পাশাপাশি এসব পাহাড়ে রয়েছে কৃষি বা চাষাবাদের অপূর্ব সুযোগ। তিনটি পার্বত্য জেলায় যেখানে আমন ধানের চাষ হয় প্রায় ৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেখানে বিভিন্ন রকম উদ্যান ফসলের চাষ হয় ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে কলা, ১১ হাজার হেক্টর জমিতে আম ও ৮ হাজার হেক্টর জমিতে আনারস চাষ উল্লেখযোগ্য। ভূমি বৈচিত্র্যের জন্য মাঠ ফসলের চেয়ে উদ্যান ফসল চাষের জন্য পাহাড় বেশি উপযোগী। উদ্যান ফসলের মধ্যে বহু রকমের ফল পাহাড়ে চাষ করা যায়। পাহাড়ে অন্তত কুড়ি রকমের ফল খুব ভালোভাবে চাষ করা যায়। কিছু নতুন বিদেশি ফল চাষেরও সম্ভাবনা রয়েছে। মাল্টা ও ড্রাগন ফল খুব ভালোভাবে হচ্ছে। বর্তমানে পাহাড়ে বেশ কয়েক রকমের ফলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। ব্যাপকভাবে চাষ করা হচ্ছে আম, কলা, কাঁঠাল, লেবু ও আনারস। নতুন ফলের মধ্যে মাল্টা ও কমলা চাষ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। বান্দরবানের রামুতে চাষ করা হচ্ছে কাজুবাদাম। খাগড়াছড়িতে প্যাসন ফল চাষের সফলতাও দেখা গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৮৯ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এর মধ্যে প্রায় ৭৮ শতাংশের অবস্থান চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে। অধিকাংশ আদিবাসী জুম চাষ অথবা সীমিত আকারে ফল চাষ করে নিজেদের খাদ্য যোগায়। কাজেই তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একদিকে যেমন খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, তেমনি তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য দরকার আয় বৃদ্ধি করা। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির সহজ উপায় হলো পাহাড়ে ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ সম্প্রসারণ, উৎপাদিত সেসব ফলের উপর ভিত্তি করে প্রক্রিয়াজাত শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃজন, ফল ও ফলজাত পণ্য দেশ-বিদেশের বাজারে বিক্রির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি।
পাহাড়ে ফল চাষের গুরুত্ব
পাহাড়ে অনেক অনাবাদী বা পতিত জমি আছে। সেসব জমিতে সমতলের মতো ধান, গম, আলু করা যায় না। অথচ ফল চাষ করা যায়। পাহাড়ে ফলগাছের দুর্যোগজনিত ঝুঁকি কম।
পাহাড়ের মাটি ও আবহাওয়া অনেক রকমের ফল চাষের উপযোগী। অন্য ফসলের তুলনায় ফল চাষ অধিক লাভজনক। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আয় বাড়াতে ফল চাষ সাহায্য করতে পারে।
ফল পাহাড়ি জনগোষ্টীর পুষ্টির উত্তম উৎস।
পাহাড়ে ফল চাষের ফলে সেখানকার জনগোষ্ঠীর অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে। সমুদ্র ও বিমান বন্দর কাছাকাছি থাকায় বিদেশে ফল রপ্তানির ভালো সুযোগ রয়েছে।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য সারা বছর ফলপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।
পাহাড়ি এলাকার বসতবাড়িতে ফলের বাগান বা ফলগাছ লাগালে হাতের কাছেই ফল পাওয়া যায়। পাখিসহ অনেক জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ফলগাছ সাহায্য করতে পারে। অনেক ফলের জার্মপ্লাজম সংরক্ষিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
পাহাড়ি এলাকার উপযোগী ফল ও ফলের জাত
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবনে বিভিন্ন ফলের মধ্যে বেশি হয় কাঁঠাল, আম, আনারস, কলা, লিচু, তরমুজ, পেঁপে, লেবুজাতীয় ফল বিশেষ করে মাল্টা, কমলা, বাতাবিলেবু ও অন্যান্য লেবু। সবচেয়ে বেশি হয় কলা ও কাঁঠাল। অতিরিক্ত পরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাঙ্গামাটি অঞ্চল, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, ২০১৫-১৬ সালে এ তিনটি জেলায় মোট ৫৭৭৬২৪ টন কলা, ২৬০১৯৮ টন কাঁঠাল, ১৭৪৯০৩ টন পেঁপে, ১৪৮১৩০ টন আম, ৩৪৭৭৪ টন লেবু, ৩১৭৭৯ টন লিচু, ৩০৭৮৭ টন বাতাবি লেবু, ১৮৮১৩ টন তরমুজ ও ২৯৫৪৫৬ টন অন্যান্য ফল উৎপাদিত হয়েছিল।
পাহাড়ি এলাকায় দুই রকমের স্থানে ফল চাষের সুযোগ রয়েছে- বসতবাড়ির আঙ্গিনায় ও পাহাড়ের ঢালে। বসতবাড়িতে চাষের জন্য আম, কাঁঠাল, বাতাবি লেবু, পেয়ারা, লিচু, তেঁতুল, পেঁপে, লটকন ইত্যাদি ফলগাছ লাগানো যায়।
পাহাড়ি ঢালে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য ভালো কলা, আনারস, মাল্টা, কমলা, পেঁপে, আম, কাঁঠাল ইত্যাদি। এছাড়া রাম্বুটান, ড্রাগন ফল, প্যাসন ফল, স্ট্রবেরি, কাজুবাদাম ইত্যাদি বিদেশি ফলেরও উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। নিচে পাহাড়ি এলাকায় চাষের উপযোগী ফলের তালিকা দেয়া হলো-
পাহাড়ে ফলচাষ সম্প্রসারণে করণীয় : সরকার ইতোমধ্যে পাহাড়ে বিশেষ করে তিনটি পার্বত্য জেলায় ফল চাষ সম্প্রসারণের নানামূখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যে কারণে বিগত দশকে পাহাড়ে ফলের উৎপাদন যথেষ্ট বেড়েছে। বিশেষ করে আমের উৎপাদনে এক অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। আ¤্রপালি জাতের আম চাষে পাহাড়ে বিপ্লব ঘটেছে, তেমনি হাইব্রিড জাতের পেঁপে রেডলেডি চাষের ক্ষেত্রেও বিপ্লব ঘটেছে। পাহাড়ি অঞ্চলে ফলের চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধির চমৎকার সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে আরও কিছু বাস্তবমুখী বিষয় বিবেচনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন-
পাহাড়ি অঞ্চলে ফল চাষ নিয়ে গবেষণা জোরদার করা দরকার। এ অঞ্চলের উপযোগী বিভিন্ন ফল ও আরও বেশি ফলেরজাত উদ্ভাবন করা দরকার। যে পাহাড়ে ও এলাকায় যে ফলের চাষ খুব ভালো হয় সে ধরনের ফল চাষ সম্প্রসারণে জোর দিতে হবে। ভালো হয়, যদি ফ্রুট জোনিং করা যায়। যে ফল যেখানে ভালো হয় সেখানে বেশ কিছুটা এলাকা জুড়ে শুধু সে ফলের বাণিজ্যিক চাষাঞ্চল গড়ে তোলা যায়। এতে সেসব ফলের বাজারজাত করা যেমন সুবিধা হয়, তেমনি সেই ফলভিত্তিক প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা যায়।
উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শুধু ফল নয়, ফলের জাত নির্বাচনে গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন আগাম জাত বারি আম ৫ ও নাবি জাত বারি আম ৪ জাতের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে আম প্রাপ্তির সময়কালকে দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে। স্থানীয় জাতের জায়গায় যদি উন্নত জাতের কাঁঠাল ‘বারি কাঁঠাল ৩’ জাতটি সম্প্রসারণ করা যায় তাহলে ফলন বাড়তে পারে ৩-৪ গুণ, অসময়েও কাঁঠাল উৎপাদন করে অধিক লাভবান হওয়া যেতে পারে। তেমনি কলা চাষেও আধুনিক জাতের ব্যবহার করা উচিত। বাংলা কলা পাহাড়ে খুব পরিচিত ও জনপ্রিয় জাত। এ জাতের উন্নয়ন ঘটিয়ে উদ্ভাবন করা হয়েছে বারি কলা ৩ জাত। এ জাতের কলা চাষ করে হেক্টর প্রতি ৪০-৫০ টন কলা পাওয়া যেতে পারে যা পাহাড়ে কলা চাষের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে।
ফলের উন্নত জাত সমূহের চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সেসব জাতের চার কলম উৎপাদন ও তা সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সরকারিভাবে হর্টিকালচার সেন্টার সমূহের মাধ্যমে ও বেসরকারি নার্সারি দ্বারা এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেতে পারে। ফলচাষিদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকা দরকার।
পাহাড়ে লাগানো ফলগাছ সমূহের আধুনিক নিয়মে ব্যবস্থাপনা করা দরকার। পাশাপাশি উন্নত পদ্ধতিতে ফলগাছ লাগানো ও তার যতœ নেয়া দরকার। ইতোমধ্যে সেখানে যেসব আমগাছ লাগানো হয়েছে তার অধিকাংশই খুব ঘন করে লাগানো। এরূপ বাগানের গাছ কিছু সরিয়ে পাতলা করা উচিত।  
পাহাড়ে ফলগাছে সেচ দেয়া এক অন্যতম প্রধান সমস্যা। পাহাড়ে যে বছর এপ্রিলে কম বৃষ্টি হয় বা হয় না সে বছর আম, লিচু ইত্যাদি ফল ঝরা বেড়ে যায়। ক্রমাগতভাবে পাহাড়ি বন উজাড়ের ফলে বৃষ্টি কম হয় ও পাহাড়ের ঝিরিসমূহে পানির সঞ্চয় থাকে না। ফলে ঝিরি বা পাহাড়ের খাদে জমা জলাশয়ের পানি থেকে পাম্প করে ফলগাছে সেচ দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে অল্প পানি থাকলেও ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে ফলগাছের গোড়ায় সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করা দরকার। আম ও অন্যান্য ফলে ফ্রুট ব্যাগিং করা যেতে পারে। আম ও পেয়ারায় সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করা যায়। সারা বছর ধরে আনারস উৎপাদনের জন্য হরমোন ব্যবহারসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনা কাজ করা যেতে পারে। অসময়ে ফলানো আনারসের দাম বেশি পাওয়ায় তা পাহাড়ি কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।
ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলতে হবে এবং সেখান থেকে দেশের সব জায়গায় বিক্রির ব্যবস্থা বা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে কাজুবাদাম চাষের ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বর্তমান অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কাজুবাদাম দামি ফল। একে প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করলে লাভ বেশি হতে পারে। এ আশায় রাঙ্গামাটিতে প্রক্রিয়াজাত শিল্প স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সারাবছর সেখানে কাঁচামাল পাওয়া যায় না। তাহলে সে কারখানার শ্রমিকদের কিভাবে ধরে রাখা যাবে, শিল্প সচল কিভাবে থাকবে? তাই শিল্প স্থাপনে সেটা সারা বছর যাতে সচল থাকে এমন বিবেচনা ও পরিকল্পনা করতে হবে।
ফলগাছ থেকে শুধু ফল সংগ্রহ নয়, গাছের বহুমুখী ব্যবহারের দিকেও নজর দেয়া যেতে পারে। যেমন আনারস গাছের পাতা থেকে আঁশ উৎপাদন করে তা থেকে রশি বানানো ও বস্ত্র বয়ন, বিভিন্ন ক্র্যাফট সামগ্রী তৈরি করা যায়। অথচ আনারসের পাতা ফেলে দেয়া হয়।
ফলের উপযুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড় থেকে বাজারে ফল আনার জন্য যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ, সংগৃহীত ফলসমূহ বিক্রির পূর্ব পর্যন্ত তার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংগ্রহোত্তর অপচয় কমানো, সংরক্ষণ বা মজুদের যথাযথ সুবিধা গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে গুরত্ব দেয়া দরকার। য়
প্রকল্প পরিচালক, আইএফএমসি প্রকল্প, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮-২০৯১০৭