Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পুষ্টিহীন এক শিশুর আত্মকথা

আমি শিশু রিমা। আমার বয়স ১০ বছর। খুলনা জেলার রূপসা উপজেলাধীন তালিমপুর গ্রামে আমাদের বাড়ি। আমরা ২ ভাই ও ২ বোন এবং পিতা-মাতা অর্থাৎ ৬ সদস্যের একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। আমার বাবা স্বল্প বেতনভুক্ত একজন সরকারি কর্মচারী এবং মা গৃহিণী। আমি গ্রামের এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি।


আমার মা বলেছেন, বুকে পর্যাপ্ত দুধ উৎপাদন না হওয়ার কারণে জন্মের পর আমি মায়ের বুকের দুধ খেতে পাইনি। শিশুকালেই কৌটার গুঁড়া দুধ এবং মাঝে মাঝে গরুর দুধ খেয়েছি। মা আরও বলেন, জন্মের পর থেকে পাঁচ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু দুধ খেয়েছি এবং পাঁচ মাস পর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার হিসেবে নরম ভাত, সুজি, সামান্য মাছ, ডাল ও শাকসবজি খেতে হয়েছে। পিতার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকার কারণে দুই বছর বয়সের পর থেকেই ভাত, ডাল, কখনও কখনও সামান্য মাছ বা মাংস এবং স্বল্প পরিমাণে শাকসবজি আর ফলমূল খেয়ে বেড়ে ওঠেছি। পর্যাপ্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ সুষম খাবার যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ এবং যথেষ্ট পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল এবং মায়ের বুকের দুধ খেতে পাইনি। এর  ফলে আমি অপুষ্টির শিকার হয়ে স্বাস্থ্যহীন ও দুর্বল হয়ে বেড়ে উঠেছি। শারীরিক বৃদ্ধি ঠিকমতো হয়নি। অপুষ্টির কারণে প্রায়ই নানা প্রকার রোগে ভুগে থাকি। খাবারে অরুচি হয় ও পড়াশোনায় মন বসে না এবং পড়া বেশিক্ষণ মনে থাকে না। এজন্য পরীক্ষায় ভালো ফলও করতে পারি না। অথচ মা-বাবার ইচ্ছা আমাকে লেখাপড়া শেখাবেন। এ অবস্থা শুধু আমার একার নয়, আমাদের স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রীই প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। তবে  ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি অপুষ্টির শিকার।


আমরা শিশু। সুস্বাস্থ্য নিয়ে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা ও বেঁচে থাকা আমাদের অধিকার। এজন্য আমাদের পুষ্টিকর খাবার খেতে দিতে হবে। আমাদের স্কুলের বিজ্ঞান বিষয়ের স্যার, আমার বাবা ও মা এবং এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে পুষ্টি সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা গেছে। তারা বলেন, পুষ্টিকর খাবার মানেই দামি খাবার নয়। অনেক কম খরচেও পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায়। সুতরাং স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য  প্রতিদিন আমরা পুষ্টিকর খাবার খাবো। তাহলে আমাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। আরও জানা যায়, শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধ পৃথিবীর সেরা পুষ্টিকর খাদ্য। প্রকৃতির দান এ মায়ের দুধ আমাদের অধিকার। তাই ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই আমাদের মায়ের বুকের প্রথম দুধ (শালদুধ) খেতে দিতে হবে। শালদুধ খুবই পুষ্টিকর, নিরাপদ ও রোগ প্রতিরোধক। জন্মের পর থেকে পাঁচ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ালে আমাদেরও অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। কারণ, মায়ের দুধে রয়েছে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান। জানা গেছে, মায়ের দুধ খেয়েছে এমন শিশুরা সুস্থ, সবল ও মেধাবী হয়ে বেড়ে উঠে এবং লেখাপড়ায় ভালো ফল করে।


আরও জানা যায়, পাঁচ মাস বয়স পূর্ণ হলে শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ আমাদের দেহের পুষ্টি চাহিদা মেটে না। এজন্য পাঁচ মাস পূর্ণ হলে শরীরের প্রয়োজন মেটানোর জন্য মায়ের দুধের  পাশাপাশি আমাদের অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারও খেতে দিতে হবে। এ সময় নরম ভাত, রান্না করা সুজি, নরম খিচুড়ি, নরম করে সিদ্ধ ডাল, মাছ, মাংস ও ডিম, গাঢ় সবুজ হলুদ রঙের শাকসবজি, পাকা কলা ও পেঁপে ফলের রস প্রভৃতি খেতে দেয়া উচিত। চাল, ডাল, শাকসবজি এবং অল্প তেল দিয়ে রান্না করা নরম খিচুড়ি আমাদের জন্য খুবই পুষ্টিকর খাবার। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে প্রোটিন বা আমিষের চাহিদা মেটানো একান্ত আবশ্যক। দুধ ছাড়া মাছ, মাংস ডিম, ডাল, শিমের বিচি এসব খাবার থেকে আমরা প্রোটিন পেতে পারি। এছাড়া খাদ্যে শর্করা স্নেহ জাতীয় খাবার ও থাকা দরকার। এজন্য আমাদের খাদ্য ভাত, ডাল, শিমের বিচি এসব খাবার থেকে আমরা প্রোটিন পেতে পারি। এছাড়া খাদ্যে শর্করা ও স্নেহ জাতীয় খাবারও থাকা দরকার। এজন্য আমাদের খাদ্যে ভাত, রুটি আলু, সুজি, ঘি মাখন ইত্যাদি থাকতে হবে। ভিটামিন রোগ প্রতিরোধে করে দেহকে সুস্থ রাখে। নানা রকমের ভিটামিন আছে। আমাদের চোখের সুস্থতার জন্য ভিটামিন ‘এ’  খুবই প্রয়োজন। জানা যায়, শরীরে ভিটামিন ‘এ’র অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায় এবং ১০ লাখ শিশু রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়। আমরা শিশুরা রাতকানা রোগের হাত থেকে বাঁচতে চাই। এজন্য আমাদের খাওয়াতে হবে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার যেমন- গাঢ় সবুজ ও হলুদ রঙের শাকসবজি এবং ফলমূল বিশেষ করে পাকা পেঁপে, আম, কাঁঠাল, কলা, আনারস, কচুশাক, ডাঁটাশাক, পাটশাক, লালশাক, মুলাশাক, পালংশাক, ধনেপাতা, গাজর, টমেটো, মিষ্টিকুমড়া এবং ডিমের কুসুম, কলিজা, মলা ও ঢেলা মাছ ইত্যাদি।


আমাদের দেহকে রোগমুক্ত রাখার জন্য প্রতিদিন ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় খাবার যেমন- আমলকী, পেয়ারা, কাগজিলেবু, পাতিলেবু, কামরাঙা, কুল ও বাতাবিলেবুর রস খেতে দিতে হবে। এছাড়া সহজলভ্য মৌসুমি ফলমূল ও গাঢ় সবুজ রঙের শাকসবজি থেকেও ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায়। ভিটামিন বি-২ (রাইবোফ্লেবিন) এর অভাবে আমাদের মধ্যে প্রায়ই মুখের দুই কোণে ঘা হয়। মুখের দুই কোণে যাতে ঘা না হয়, সেজন্য আমাদের ভিটামিন বি-২ ও লৌহ সমৃদ্ধ খাবার যেমন- কলিজা, ডিমের কুসুম, দুধ, মাছ, মাংস, ডাল, শিম, আটার রুটি, ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত, গুঁড়া, কাঁচকলা, কচুশাক, লালশাক, ডাঁটাশাক, পুইশাক, এবং অন্যান্য সবুজ রঙের শাকসবজি ও টাটকা ফলমূল ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে খেতে দিতে হবে। হাড় ও দাঁতের স্বাভাবিক গঠন ও সুস্থতার জন্য আমাদের খাদ্যে ভিটামিন ‘ডি’ ও ক্যালসিয়াম থাকা খুবই প্রয়োজন। তৈলাক্ত মাছ, ডিমের কুসুম, মাখন ও চর্বিযুক্ত খাদ্য থেকে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন ‘ডি’ পাওয়া যায়। খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও সূর্যালোক ভিটামিন ‘ডি’ এর অন্যতম উৎস। মাছ, মাংস, ডিমের কুসুম, দুধ, কলিজা, ডাল, সবুজ-শাকসবজি ও ফলমূলে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে। তাই আমাদের প্রতিদিন এসব খাবার খাওয়া দরকার। খাবারে লৌহের অভাবে আমাদের বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের রক্তশূন্যতা দেখা যায়। কলিজা, ডিমের কুসুম, মাছ, মাংস, কচুশাক, ডাঁটাশাক, লালশাক, ধনেপাতা, কাঁচকলা, গুড়, ডাল ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে লৌহ পাওয়া যায়। আয়োডিনের অভাবে শারীরিক বিকলাঙ্গ এবং দৈহিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। সামুদ্রিক মাছ ও মাছের তেল ছাড়াও শাকসবজি ও তাজা ফলমূলে প্রচুর আয়োডিন থাকে। তাছাড়া বর্তমানে বাজারে  আয়োডিনযুক্ত লবণ পাওয়া যায়। এজন্য আমাদেরও সব ধরনের খাবার তৈরি করার সময় আয়োডিন মিশ্রিত লবণ ব্যবহার কারা উচিত। দেহের প্রধান উপাদান পানি। পানি ছাড়া দেহে কোনো কাজ ভালোভাবে চলে না। খাবার হজম করতেও পানি দরকার। পানির সাহায্যে দেহের দূষিত পদার্থ মলমূত্র ও ঘামের আকারে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। পানি কম পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। তাই প্রতিদিন আমাদের অন্তত ৬ থেকে ৭ গ্লাস নিরাপদ পানি পান করা উচিত। আমরা ‘এমন খাবার পানি চাই, যে পানিতে আর্সেনিক ও রোগ-জীবাণু নেই’।


পুষ্টি  চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে মানসিক বিকাশের জন্যও আমাদের উপযুক্ত যত্ন নিতে হবে। এর জন্য মা ও বাবাসহ আমরা পরিবারের সবার বিশেষ করে বড়দের আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা চাই। আর ছোটবেলা থেকেই আমরা কন্যাশিশুরা একটু আলাদাভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা পেতে চাই। এর ফলে আমরা শিশুরা ভবিষ্যতের জন্য সুস্থ, সবল কর্মক্ষম ও মেধাবী হয়ে বেড়ে ওঠে সমাজ এবং দেশকে আলোকিত করে তুলতে সক্ষম হবো।
তাই আমাদের সবার শিশুর আজকের স্লোগান হলো-


‘অপুষ্টির সম শত্রু নাই,
সব শিশুর জন্য পুষ্টি চাই।
পুষ্টিকর খাবার খাব,
সুস্থ জীবন গড়ব।’

 

মো. আবদুর রহমান*
* উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা