মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ প্রযুক্তি
কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ
মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস পাওয়ায় ফসল উৎপাদন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। দেশের ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য একই মাটি থেকে বিরামহীনভাবে ফসল উৎপাদন করায় মাটিতে দ্রুত গাছের পুষ্টি ঘাটতি হচ্ছে। এ পুষ্টির ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতি বছর শতকরা ২০ ভাগ হারে রাসায়নিক সার প্রয়োগ বাড়াতে হচ্ছে। রাসায়নিক সার প্রয়োগে- মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলী নষ্ট হচ্ছে। খাদ্যের গুণগত মানও নষ্ট হচ্ছে। দেশের উত্তর অঞ্চলের জমির উর্বরতা আশংকাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। এই হ্রাস অব্যাহত থাকলে মাটির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাপক হারে কমার সম্ভাবনা আছে। মাটির উর্বরতা হ্রাস আগামী প্রজন্মের জন্য অশনি সংকেত। মাটির উর্বরতা বাড়ালে রাসায়নিক সার কম লাগবে। এতে মাটি ভালো থাকবে, উৎপাদন খরচ কম হবে এবং ফসলের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে।
মাটির উর্বরতা হ্রাসের উল্লেখযোগ্য কারণ হলো- নিবিড় ফসল চাষ, জৈবসার প্রয়োগ না করা, রাসায়নিক সার দেয়া, হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল জাতের ফসল চাষ করা, ভূমি ক্ষয়, ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে না রাখা, গবাদিপশুর সংখ্যা হ্রাস, জমিকে বিশ্রাম না দেয়া, মাটি দূষণ, শিম ও ডালজাতীয় শস্য চাষ না করা ইত্যাদি।
মাটির উর্বরতার প্রাণ হচ্ছে জৈব পদার্থ। আদর্শ মাটিতে শতকরা পাঁচভাগ জৈব পদার্থ থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশের মাটিতে আছে মাত্র শতকরা একভাগেরও কম। এই হার ক্রমেই কমছে। জৈব পদার্থ পচে জৈবসার তৈরি হয়। জৈবসারে একাধিক প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদান থাকে। এর একটি তালিকা নি¤েœ দেয়া হলো:
উৎস: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল
ফসল উৎপাদনের জন্য গাছের ১৭টি পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। এর মধ্যে ১৪টি উপাদানই গাছ মাটি থেকে গ্রহণ করে। গবেষেণায় দেখা গেছে, প্রতি হেক্টরে ৬ টন ধান উৎপাদন করতে ধান গাছ মাটি থেকে নাইট্রোজেন ১০৮ কেজি, ফসফরাস ১৮ কেজি, পটাশিয়াম ১২০ কেজি ও সালফার ১১ কেজি শোষণ করে। এভাবে যত ফসল উৎপাদন হচ্ছে তত পুষ্টি মাটি থেকে কমে মাটি অনুর্বর হচ্ছে। এজন্য মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
জৈব পদার্থ প্রয়োগ : জৈব পদার্থকে মাটির প্রাণ বলা হয়। জৈব পদার্থ মাটির ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের উন্নয়ন সাধন করে। এ ছাড়া জৈব পদার্থ গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান মাটিতে সরবরাহ করে গাছের বৃদ্ধি ও পরিপুষ্টিতে সহায়তা করে। সুতরাং মাটির উর্বরতা রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্য খামারজাতসার, আবর্জনা পচা সার, সবুজ সার, গোবর, খৈল, ছাই, হাড়ের গুঁড়া, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে নিয়মিতভাবে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি বছর প্রতি হেক্টরে ১০-১৫ টন জৈবসার প্রয়োগ করতে হয়। জৈবসার মাটিতে উপকারী জীবাণু বৃদ্ধি করে। বায়ু ও পানি চলাচল স্বাভাবিক রাখে। আয়ন বিনিময় ক্ষমতা বাড়ায়। মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করে।
সবুজ সার প্রয়োগ : ডাল ও শিমজাতীয় ফসল কচি অবস্থায় জমির মাটির সাথে মিশিয়ে সবুজসার তৈরি করা হয়। ডাল ও শিমজাতীয় শস্যের শিকড়ে রাইজোবিয়াম নামক এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া গুটি তৈরি করে তাতে বায়ুম-ল হতে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে সঞ্চয় করে। এসব গুটি মাটিতে পচে সঞ্চিত নাইট্রোজেন পরবর্তী ফসলের কাজে লাগে। প্রতি বছর প্রতিটি জমিতে অন্তত একবার সবুজ সার ফসল যেমন- ধৈঞ্চা, শনপাট, শিম ও ডালজাতীয় যে কোন ফসলের চাষ করা প্রয়োজন।
মাটিতে ডাল বা শিমজাতীয় (লিগিউমিনাস) শস্য চাষ করে ফুল আসার আগে সম্পূর্ণ গাছ পাওয়ার টিলার দিয়ে জমির মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেই সবুজসার প্রয়োগ করা হলো। সাধারণত দেশি ধৈঞ্চা, আফ্রিকান ধৈঞ্চা, মটর, শনপাট ইত্যাদি দিয়ে সবুজসার তৈরি করা হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে জমিতে চাষ দিয়ে খুব ঘন করে বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপনের দুই মাসের মধ্যে গাছ সবুজ ও নরম অবস্থায় কেটে মাটিতে শুইয়ে দিতে হয়। এরপর লাঙল বা কোদাল বা পাওয়ার টিলার দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ধৈঞ্চা পচতে ৩০-৩৫ দিন সময় লাগে। পচনের সময় ইউরিয়া দিলে দ্রুত পচে। ইহা উৎকৃষ্ট জৈবসার। অন্যান্য জৈবসারের চেয়ে ধৈঞ্চার সবুজসারে নাইট্রোজেন ও রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া মাটিতে মিশে মাটি উর্বর হয়। মাটির কণার সাথে সবুজ সার মিশে কণাসমূহকে আঠার মতো আটকিয়ে রাখে। ধৈঞ্চার সবুজ সার মাটিতে পুষ্টি বাড়ায়। মৃত্তিকার সঠিক আর্দ্রতা বজায় রাখে।
জমির আগাছা দমন : আগাছা ফসলের শত্রু। আগাছা ফসলের জন্য প্রয়োগকৃত পুষ্টি উপাদানে ভাগ বসায়। তাই মাটির উর্বরতা রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত ও সময়মতো আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
পর্যায় ক্রমিক ফসলের চাষ : বছরের পর বছর যদি একই ফসল বার বার চাষ করা হয় তবে মাটির একটা নির্দিষ্ট স্তরের পুষ্টি উপাদান শেষ হয়ে যেতে পারে। মাটির জৈব পদার্থ কমে যায়, মাটির রস ও বায়ুধারণ ক্ষমতাও কমে গিয়ে মাটির উর্বরা শক্তি বিনষ্ট হয়। তাই জমিতে একই ফসল বার বার চাষ না করে ৩-৪ বছর মেয়াদি শস্যপর্যায় অনুসরণ করে মটির উর্বরতা রক্ষা করা সম্ভব। এতে একটি গভীর মূলী ফসলের পর অগভীর মূলী ফসলের চাষ করতে হয়।
পানিসেচ ও নিকাশ ব্যবস্থা : গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো মাটিস্থ পানির মধ্যে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। উদ্ভিদ মূলরোমের সাহায্যে সেগুলো গ্রহণ করে। জমিতে যদি পানির অভাব হয় তবে গাছ খাদ্য উপাদানগুলো গ্রহণ করতে পারে না। আবার জমিতে অনেক দিন ধরে পানি জমে থাকলে উদ্ভিদ পুষ্টির অনেক অপচয় হয়। তাছাড়া মাটিতে অবস্থিত অনেক অণুজীবের কার্যাবলী বন্ধ হয়ে যায়।
সুষম সার ব্যবহার : উদ্ভিদ নানা প্রকার সার থেকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে থাকে। ফলে পরবর্তী ফসলে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। এক্ষেত্রে মাটির উর্বরতা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট থেকে মাটি পরীক্ষা করে মাটিতে সঠিক মাত্রায় প্রয়োজনীয় সুষম সার ব্যবহার করতে হবে।
জমির যথাযথ ব্যবহার : যে জমি যে ফসল চাষের উপযোগী সেই জমিতে সেই ফসল করা উচিত। তাছাড়া জমির ধরণ অনুযায়ী চাষ করতে হবে। যেমন পাহাড়ি এলাকায় ধাপ চাষ বা কন্টুর চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করে একদিকে যেমন জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও রক্ষা করা যায় অন্যদিকে ফসল উৎপাদন বাড়ানো যায়।
আধুনিক চাষাবাদ : সঠিক দূরত্বে, সঠিক সময়ে ও সারিতে বীজ বপন/চারা রোপণ, আন্ত:পরিচর্যা করলে মাটির পুষ্টি শোষণে গাছের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় না। ফলে মাটির পুষ্টি উপাদান সংরক্ষিত থাকে।
আচ্ছাদন শস্যের চাষ : কিছু কিছু পুষ্টি উপাদান রোদের তাপে নষ্ট হয়। এসব ক্ষেত্রে জমি লতাপাতায় ঢেকে থাকে এমন শস্য (যেমন-শসা, বাঙ্গী, তরমুজ, আলু, মিষ্টিকুমড়া, ক্ষিরা ইত্যাদি) চাষ করলে ঐসব পুষ্টি উপাদন সংরক্ষণ থাকে।
জাবরা প্রয়োগ : খড়কুটো, লতাপাতা বা কোন কিছু দিয়ে জমির মাটি দিয়ে ঢেকে রাখাকে জাবড়া প্রয়োগ বলে। কিছু কিছু ফসলে (আলু) জাবরা প্রয়োগ করতে হয়। এতে জাবরা দ্বারা মাটি ঢাকা থাকে ফলে পুষ্টির অপচয় হয় না, জাবরা উপকরণ পচে জৈব পদার্থ যোগ হয় ও মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণ থাকে।।
উত্তম কর্ষণ : মাটি চাষ যত বেশি হবে গাছের জন্য পুষ্টি উপাদান তত সহজলভ্য হবে এবং জৈব পদার্থ দ্রুত পচবে। ফলে মাটিতে পুষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
ফসলের অবশিষ্ট অংশ জমিতে রাখা : জমি থেকে শুধু ফসল সংগ্রহ করার পর খড়, শাখা, প্রশাখা ও লতাপাতা জমিতে রাখলে পরবর্তীতে ফসল চাষ করার সময় মাটিতে মিশালে মাটি উর্বর হয়।
রাসায়নিক সার প্রয়োগ : গাছ মাটি থেকে সব সময় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করায় মাটিতে পুষ্টির ঘাটতি হয়। এই ঘাটতি পূরণের জন্য পরিমিত মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয়। মুখ্য ও গৌণ ১৪টি পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি রাসায়নিক সারের মাধ্যমে পূরণ করা যায়। সার প্রয়োগের পর দ্রবীভূত হয়ে পুষ্টি উপাদান মাটির সাথে মিশে যায়। গাছ পুষ্টি গ্রহণের আগে উপাদানগুলোর আয়নিক গঠন হয়। রাসায়নিক সার প্রয়োগে মাটির উর্বরতা সাময়িক বাড়ে। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগে মাটি ও ফসলের জন্য ক্ষতি হয়। নাইট্রোজেন জাতীয় সার প্রয়োগে রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়ার কার্যাবলি বৃদ্ধি পায়।
জীবাণু সারের ব্যবহার : ইউরিয়া সারের পরির্বতে জীবাণুসার ব্যবহার করলে রাইজোবিয়াম ব্যাক্টেরিয়া বাতাস থেকে নাইট্রোজেন শোষণ করে। মাটিতে নাইট্রোজেন সংযোগ হয়ে মাটি উর্বর করে।
দ্রুত হ্রাসমান আবাদি জমি থেকে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও রক্ষার জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কৃষিশিক্ষা, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল, মোবাইল : ০১৭১১৯৫৪১৪৩