লিচুর গান্ধী পোকার ক্ষতি ও প্রতিকার
শ্রীমা মন্ডল বর্ষা১ ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ২
লিচু বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ও সুস্বাদু গ্রীষ্মকালীন ফল, যা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলায় বেশি পরিমাণে লিচু উৎপন্ন হয়। তবে বর্তমানে লিচু চাষে অন্যতম প্রধান বাধা হলো লিচুর গান্ধী পোকা। এই পোকাটি বিশেষ করে গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলে লিচু গাছের ওপর আক্রমণ করে থাকে। লিচুর গান্ধী পোকার বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে, এদের মধ্যে ঞবংংধৎধঃড়সধ লধাধহরপধ প্রজাতিটির আক্রমণ বাংলাদেশে দেখা গিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয়, এই প্রজাতিটি আফ্রিকার কিছু অংশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি হেমিপটেরা বর্গের অন্তর্ভুক্ত। লিচু গাছ ছাড়াও কাঠলিচু, ডালিম, পামেলো, মহুয়া, কুসুম, রাম্বুটান, ক্যাস্টর এবং ইউক্যালিপটাস গাছে এই পোকা আক্রমণ করে।
বাদামি বা লালচে বাদামি রঙের এই পোকা লিচুর কুঁড়ি, ফুল এবং ফল আক্রমণ করে এবং রস শোষণ করে। পোকাটি যখন গাছে আক্রমণ করে তখন লিচুর কুঁড়ি ও ফুল শুকিয়ে যায় এবং ফল ঝরে পড়ে। এর ফলে ফলের গুণগত মান ও উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হয়। পোকার প্রভাব বেশি হলে পুরো গাছও শুকিয়ে যেতে পারে। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে এরা বেশি সক্রিয় থাকে, যখন গাছে ফুল ও কচি ফল থাকে। পোকাটি গাছের বিভিন্ন অংশ আক্রমণ করার সময় একটি বিশেষ ধরনের গন্ধ ছড়ায়, যা অন্যান্য পোকা থেকে এটিকে আলাদা করে। লিচুর গান্ধী পোকা নিয়ন্ত্রণে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হলেও, প্রাকৃতিক পদ্ধতি (যেমন প্রাকৃতিক শত্রু পোকা ব্যবহার ও জৈবিক কীটনাশক) পরিবেশের জন্য বেশি উপযোগী। এই পোকার প্রাদুর্ভাব একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি এবং লিচু ফল রক্ষার জন্য কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবনের জন্য জরুরি প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন। নিয়মিত বাগানের পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লিচুর গান্ধী পোকা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
লিচুর গান্ধী পোকার জীবনচক্র
লিচুর গান্ধী পোকার জীবনচক্র মোট তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়। ডিম, নিম্ফ এবং পূর্ণবয়স্ক পোকার পর্যায়।
ডিম : গান্ধী পোকা সাধারণত গাছের পাতা বা ফলের উপরের বা নিচের অংশে গুচ্ছাকারে ডিম পাড়ে। সাধারণত প্রতি গুচ্ছে ৩-৪টি সারিতে ১১-১৪টি ডিম থাকে। ডিমগুলো গোলাকার এবং ফ্যাকাশে গোলাপি বা বাদামি রঙের হয়। সাধারণত ১২-১৪ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
নিম্ফ: নিম্ফ পর্যায়টি পূর্ণাঙ্গ পোকায় রূপান্তরের আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ডিম ফুটে বের হলে, এটি এ পর্যায়ে প্রবেশ করে। নিম্ফের বৃদ্ধি স্বতন্ত্র পাঁচটি ধাপে ঘটে। নিম্ফগুলো ধীরে ধীরে আকারে বৃদ্ধি পায়। এরা সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে খুব ছোট, প্রায় ৩- ৪ মিমি লম্বা। পরবর্তীতে ২০ মিমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। নিম্ফ পূর্ণবয়স্ক পোকাগুলোর মতো নয় এবং তাদের দৈহিক বৈশিষ্ট্যেও পার্থক্য দেখা যায়। নিম্ফদের ডানা থাকে না বা থাকলেও তা অসম্পূর্ণ এবং ছোট আকারের। ডানাগুলো কেবলমাত্র পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় সম্পূর্ণভাবে গড়ে ওঠে। নিম্ফের দেহে দাগ বা চিহ্ন দেখা যায়। নিম্ফ সাধারণত গাছের পাতায় বা ফলের উপর থাকে এবং এই সময়ে এটি গাছের রস শোষণ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে এরা একত্রে থাকে এবং গাছের নির্দিষ্ট অংশে আক্রমণ করে, যা গাছের ক্ষতি বাড়িয়ে তোলে। নিম্ফগুলো পূর্ণবয়স্ক পোকায় রূপান্তরিত হওয়ার আগে একাধিকবার ত্বক পরবর্তন করে। প্রতিটি ত্বক পরিবর্তনের পর তারা ধীরে ধীরে আকারে এবং রঙে পরিবর্তিত হয়। নিম্ফ পর্যায়টি সাধারণত ২ মাস স্থায়ী হয়, যা তাপমাত্রা এবং পরিবেশের উপর নির্ভর করে। এই সময়ের মধ্যে তারা পাঁচটি স্তর অতিক্রম করে, যা তাদের পূর্ণবয়স্ক পোকায় রূপান্তরিত হতে সাহায্য করে।
পূর্ণবয়স্ক পোকা : পূর্ণবয়স্ক লিচুর গান্ধী পোকা সাধারণত ২৪ থেকে ২৮ মিমি লম্বা হয়। এদের দেহ চ্যাপ্টা ও প্রশস্ত, যা দেখতে ঢাল আকৃতির। দেহের ওপরের অংশটি চামড়ার মতো মসৃণ এবং কিছুটা শক্ত। পোকার দেহের রঙ সাধারণত বাদামি এবং কিছু পোকা লালচে বাদামি বা কমলা রঙেরও হতে পারে। পূর্ণবয়স্ক পোকাটির মাথা ছোট এবং এতে একটি শুঁড় থাকে, যা লম্বা ও সূচালো। এই শুঁড়ের সাহায্যে তারা গাছের পাতা, ফুল, এবং ফলের রস শোষণ করে। শুঁড়টি প্রয়োজন অনুসারে ভাঁজ করে রাখা যায় এবং এটি পোকাটির খাদ্য সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। পূর্ণবয়স্ক পোকার ডানা থাকে এবং তারা উড়তে সক্ষম। ডানাগুলো স্বচ্ছ বা হালকা বাদামি রঙের হয় এবং পোকার দেহের প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এরা ডানার সাহায্যে গাছের বিভিন্ন অংশে চলাফেরা করতে এবং খাদ্যের উৎস খুঁজে নিতে পারে। এদের শরীর থেকে এক ধরনের দুর্গন্ধযুক্ত রাসায়নিক নির্গত হয়, যা তাদের আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। পূর্ণবয়স্ক পোকা সাধারণত ৬০-৬৫ দিন বয়সে বাচ্চা দেয় এবং এই সময়ের মধ্যে অনেক লিচুর ক্ষতি করতে পারে।
ক্ষতির ধরন: লিচুর গান্ধী পোকার আক্রমণে লিচু চাষিরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। এই পোকা লিচু গাছের ফুল এবং কুঁড়ির রস শোষণ করে, ফলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। পোকাটি ফলের রস শোষণ করার ফলে লিচুর আকার ছোট হয়ে যায় এবং রঙ পরিবর্তিত হয়। ফল দেখতে অনাকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ও লিচুর স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, যা বাজারমূল্য কমিয়ে দেয়। গাছের কুঁড়ি, ফুল, এবং পাতা আক্রমণ করার ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং সম্পূর্ণ গাছটি শুকিয়ে যেতে পারে। এরা লিচুর রস শোষণ করার সময় একটি বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে, যা গাছের কোষগুলোকে নষ্ট করে দেয়, এর ফলে গাছের বৃদ্ধি বাধা পায়। এরা দিনের বেলায় খুব সক্রিয় থাকে এবং বিশেষ করে সকালে ও বিকালে লিচুর গাছে আক্রমণ করে।
লিচুর গান্ধী পোকা সাধারণত মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে লিচু গাছে আক্রমণ করে। এই সময়ে লিচু গাছে ফুল ফোটে এবং ফল ধরা শুরু হয়, যা পোকার জন্য আদর্শ খাবারের উৎস তৈরি করে। এ কারণে চাষিদের এসময় গাছের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে। এরা গরম ও শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে, তাই তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার পরিবর্তন পোকার আক্রমণের সময় ও তীব্রতার উপর প্রভাব ফেলে। তাপমাত্রা যত বেশি থাকে, ততই পোকাটি সক্রিয় থাকে এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। বাণিজ্যিকভাবে যারা লিচু চাষ করেন, তাদের জন্য গান্ধী পোকার আক্রমণ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যখন পোকার সংখ্যা বেশি হয়, তখন লিচুর উৎপাদন এবং মান কমে যাওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয়।
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: লিচু গাছের নিচের অংশ এবং আশপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখতে হবে। আগাছা এবং পাতা পোকা বাসা বাঁধার জন্য আদর্শ স্থান, তাই এগুলো পরিষ্কার রাখা উচিত। গাছের কুঁড়ি, ফুল এবং পাতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পোকার আক্রমণ শুরু হলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছকে সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত সার ও পানি সরবরাহ করতে হবে। এতে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং পোকার আক্রমণ কম হয়।
যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ : বাগানে নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং গাছের পাতা বা ফুলের উপর থাকা পোকাগুলো সংগ্রহ করে ধ্বংস করা একটি সহজ পদ্ধতি। সকাল বা বিকাল বেলা এই কাজ করা সবচেয়ে কার্যকর।
জৈবিক নিয়ন্ত্রণ: গান্ধী পোকার প্রাকৃতিক শক্র যেমন পাখি, ব্যাঙ, লাল পিঁপড়া এবং কিছু বিশেষ ধরনের পোকা বাগানে আনায়ন করা যেতে পারে। এরা গান্ধী পোকার ডিম ও লার্ভা খেয়ে ফেলে, যা পোকার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এছাড়া কিছু জৈবিক কীটনাশক যেমন নিম তেল ব্যবহার করে গান্ধী পোকার আক্রমণ কমানো যায়। এগুলো ব্যবহার করলে গাছের উপর খারাপ প্রভাব পড়ে না এবং ফলের গুণমান অক্ষুণœ থাকে।
রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ : যখন গান্ধী পোকার আক্রমণ অনেক বেশি হয়ে যায় এবং জৈবিক বা প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি কার্যকর হয় না, তখন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে, রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের সময় সঠিক ডোজ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। কিছু সাধারণ রাসায়নিক কীটনাশক রয়েছে যা গান্ধী পোকা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। ক্লোরপাইরিফোস এবং সাইপারমেথ্রিনের মিশ্রণ(১০:১) লিচুর গান্ধী পোকার নিম্ফ এবং পূর্ণাঙ্গ পোকার নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী এবং অত্যন্ত কার্যকর কীটনাশক।
এটি গাছের রসে প্রবেশ করে এবং পোকা মেরে ফেলে। তবে এটি ব্যবহারের সময় সাবধান থাকতে হবে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে পরিবেশের ক্ষতি না হয় ও অন্য উপকারী পোকামাকড়ের ক্ষতি না হয়।
তবে, যে কোন কীটনাশক প্রয়োগের আগে ও প্রয়োগের সময়ে লেবেলে উল্লেখিত সতর্কতা অবলম্বেন করতে হবে। এ ছাড়া প্রি-হারভেস্ট ইন্টারভ্যাল মেনে চলতে হবে।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা : এ পদ্ধতিতে পরিচ্ছন্ন বাগান, জৈবিক ও রাসায়নিক কীটনাশকের সমন্বয় করে পোকা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা এবং প্রাকৃতিক শক্র পোকা ব্যবহারের মাধ্যমে লিচুর গান্ধী পোকা নিয়ন্ত্রণে অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যাতে লিচু চাষিরা দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হতে পারে এবং দেশের লিচু উৎপাদন সুরক্ষিত থাকে।
লেখক: ১শিক্ষার্থী (এমএস), ২অধ্যাপক, ল্যাবরেটরি অব অ্যাপ্লাইড এন্টোমলজি এন্ড একারোলজি, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২। মোবাইল: ০১৭১১৪৫২৪৯৬। ই-মেইল :ullahipm@bau.edu.bd