Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পাটের-ফলন-বৃদ্ধি-ও-পরিবেশ-ভারসাম্য- রক্ষায়-ন্যানো-সারের-ব্যবহার

পাটের ফলন বৃদ্ধি ও পরিবেশ ভারসাম্য 
রক্ষায় ন্যানো সারের ব্যবহার
ড. মো. আবু সায়েম জিকু
বাংলাদেশে পাট ফসল আবাদ করার জন্য বপনের সময়, জমি নির্বাচন, জলবায়ু, সঠিক আন্তঃপরিচর্যা এবং পরিমাণ মতো সার প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। অন্যথায় পাট ফসলের কাক্সিক্ষত ফলন সম্ভব নয়। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন, চরম আবহাওয়া, শিল্পায়ন, সেইসাথে ক্রমবর্ধমান মানব জনসংখ্যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি স্থায়িত্বের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহার অর্থনৈতিক বোঝা, মাটি, পানি এবং বায়ুম-লীয় দূষণ বৃদ্ধি করে। ন্যানো-সারগুলো মাটির উর্বরতা, শস্য উৎপাদন এবং ন্যূনতম বা কোন পরিবেশগত লেনদেন ছাড়াই তাদের টেকসই ব্যবহারের জন্য দুর্দান্ত সম্ভাবনা রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে, ন্যানো-সারগুলো সরবরাহযোগ্য ‘পুষ্টির স্মার্ট সিস্টেম’ হিসেবে বিবেচিত হয়। 
কৃষি-ইকোসিস্টেমের সমস্যাগুলো বিদ্যমান উন্নয়নের চেয়ে বিস্তৃত। উদাহরণস্বরূপ মাটি, আর্দ্রতা এবং অন্যান্য কৃষি-বাস্তÍসংস্থানিক অবস্থার বিভিন্ন ভৌত রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যে পুষ্টি সরবরাহ করা এখনও বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ।
ন্যানো সার হলো অত্যাধুনিক কৃষি প্রযুক্তির একটি উদ্ভাবন, যা মূলত প্রচলিত সারের চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র কণার আকারে তৈরি করা হয় এবং সারের কণাগুলো সাধারণত ১০০ ন্যানোমিটারের (১ ন্যানোমিটার = ১ঢ১০-৯ মিটার) চেয়ে ছোট হয়। এটি উদ্ভিদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে পুষ্টি সরবরাহ করে, ফলে ফলন ও গুণগত মান উন্নত হয়। তথ্য মতে, ১৯৯০-এর দশকে, ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উন্নয়ন বৃদ্ধি পায় এবং ২০০০-এর দশকের শুরুতে, কৃষি বিজ্ঞানীরা ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভিদের পুষ্টি শোষণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে কৃষি গবেষণায় এর ব্যবহার শুরু করেন। এই ন্যানো সার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমন- 
ন্যানো-ফসফেট : উদ্ভিদের ফসফরাসের চাহিদা পূরণ করে। 
ন্যানো-জিঙ্ক : উদ্ভিদের জিঙ্কের চাহিদা পূরণ করে, যা পাতা ও শিকড়ের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। 
ন্যানো-আয়রন : উদ্ভিদের আয়রনের চাহিদা পূরণ করে, যা ক্লোরোফিল উৎপাদনে সহায়তা করে। 
ন্যানো-নাইট্রোজেন : উদ্ভিদের নাইট্রোজেনের চাহিদা পূরণ করে, যা প্রোটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিডের উৎপাদনে সহায়তা করে। 
পাটের জমিতে ন্যানো সার প্রয়োগের সঠিক পদ্ধতি উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও ফলন বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যানো সারের ব্যবহার এবং প্রয়োগ পদ্ধতি সাধারণ সারের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। 
পাটের জমিতে ন্যানো ফারটিলাইজার প্রয়োগের কিছু সাধারণ নির্দেশনা 
এটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে জমি ভালোভাবে চাষ দিতে হবে এবং মাটি সমানভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। মাটির পিএইচ, পুষ্টি স্তর এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নেয়া ভালো। সারের উপাদান এবং মাত্রা সম্পর্কে জেনে নিয়ে ফসলের প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত ন্যানো সার নির্বাচন করতে হবে (যেমন : ন্যানো-ফসফেট, ন্যানো-জিঙ্ক, ন্যানো-আয়রন, ন্যানো-নাইট্রোজেন)। নির্দিষ্ট মাত্রায় ন্যানো সার পানিতে মিশ্রিত করে স্প্রে বা ড্রিপ সিস্টেমের মাধ্যমে প্রয়োগ করা যায়। সাধারণত প্রতি লিটার পানিতে ১-১০ গ্রাম ন্যানো সার মিশ্রিত করা হয়। ন্যানো সারের দ্রবণ স্প্রে মেশিনের সাহায্যে পাটের গাছে সকালে বা সন্ধ্যায় স্প্রে করতে হবে। কারণ এই সময় তাপমাত্রা কম থাকে এবং বাষ্পীভবন কম হয়। এ ছাড়াও ড্রিপ ইরিগেশন সিস্টেমের মাধ্যমে ন্যানো সারের দ্রবণ সরাসরি মাটিতে প্রয়োগ করা যায়। কারণ ড্রিপ সিস্টেম মাটির গভীরে পুষ্টি সরবরাহ করে এবং পুষ্টি অপচয় কমায়। তবে পাট গাছের বৃদ্ধি এবং বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে ন্যানো সার প্রয়োগ করা ভালো তবে বীজ রোপণের আগে, গাছের চারা অবস্থায় এবং গাছ পূর্ণবয়স্ক হলে বিভিন্ন সময়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
পাটের ফলন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ন্যানো সার
ন্যানো সার পাটের উৎপাদনশীলতা ও গুণগত মান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি পাট চাষের বিভিন্ন ধাপে প্রয়োগ করে ফলন বৃদ্ধি এবং ফসলের মান উন্নত করতে সহায়তা করে। নি¤েœ ন্যানো সারের ভূমিকা বিশদভাবে আলোচনা করা হলো-
পুষ্টি সরবরাহের কার্যকারিতা বৃদ্ধি : ন্যানো সারের কণাগুলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র হওয়ায় উদ্ভিদ সহজেই এটি শোষণ করতে পারে। ফলে উদ্ভিদ পুষ্টি দ্রুত ও কার্যকরভাবে গ্রহণ করে, যা পাটের বৃদ্ধি এবং ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। ন্যানো সার ধীরে ধীরে মাটিতে পুষ্টি সরবরাহ করে, যা দীর্ঘ সময় ধরে উদ্ভিদকে পুষ্টির  জোগান দেয়। এটি পাটের সুষম বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
মাটির পুষ্টি ধরে রাখা এবং উন্নতি : ন্যানো সার মাটির পুষ্টি ধরে রাখে এবং মাটির উর্বরতা বাড়ায়, যা পাটের শিকড়ের উন্নতিতে সহায়ক হয়। এ ছাড়াও ন্যানো সার মাটির পিএইচ সমন্বয় করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি : ন্যানো সার উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ন্যানো সার উদ্ভিদের শিকড়ের শক্তি বৃদ্ধি করে, পাটের স্থায়িত্ব ও স্থায়িত্বশীলতা বাড়ায় ফলে উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি। 
পরিবেশ সংরক্ষণ : ন্যানো সার পরিবেশবান্ধব হওয়ায় মাটিতে কম পরিমাণে জমা হয় এবং কম দূষণ সৃষ্টি করে। এটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল উৎপাদনশীলতা ও পরিবেশ সংরক্ষণ করে। পাশাপাশি মাটির জীবাণু এবং মাইক্রোবায়াল কার্যকলাপ বাড়ায়।
অর্থনৈতিক সুবিধা : ন্যানো সার প্রচলিত সারের তুলনায় কম পরিমাণে ব্যবহার করতে হয়। ফলে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে।
ন্যানো সারের ব্যবহারে পাটের ফলন বৃদ্ধি নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা এবং পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া গেছে, উল্লেখযোগ্য কিছু গবেষণা ফলাফল দেওয়া হলো :
ভারতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থা (ওঈঅজ) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ন্যানো সার প্রয়োগ করলে পাটের উৎপাদনশীলতা ২০-২৫% বৃদ্ধি পেতে পারে। এই গবেষণায় ন্যানো-জিঙ্ক এবং ন্যানো-নাইট্রোজেনের ব্যবহার উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা পাটের পুষ্টি শোষণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইঅট) পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ন্যানো সার ব্যবহারে পাটের ফলন ও গুণগত মান উন্নত হয়েছে। পাটের জমিতে ন্যানো সার প্রয়োগ করে ১৫-২০% বেশি ফলন পাওয়া গেছে এবং গাছের উচ্চতা ও তন্তুর মান উন্নত হয়েছে।
পরিশেষে ন্যানো-সার ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির ক্ষয়রোধ ও রাসায়নিক ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। সেই সাথে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার (পানি, সার ও অন্যান্য), টেকসই            কৃষি অনুশীলনে দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনশীলতা এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্য উন্নত হবে। মূলত কেমিক্যাল সারের ব্যবহারকে প্রশমিত করে ন্যানো সারের ব্যবহারকে উদ্বুদ্ধ করবে। 

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা বিজ্ঞান শাখা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৭১৭৫৬২৬৭৩, ই-মেইল :jikuly@gmail.com or sayem@bjri.gov.bd