Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বাণিজ্যিক-আম- বাগানে-এ-সময়ের

বাণিজ্যিক আম 
বাগানে এ সময়ের 
যত্ন ও পরিচর্যা
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন
আম  এ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল এবং জনপ্রিয় মৌসুমি ফল। ছোট-বড় সকলের কাছে এ ফলটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে আম বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সারাদেশে আমের উৎপাদন হলেও দেশের ২৩টি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন হচ্ছে। গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনের জন্য এ সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আমচাষি বা উদ্যোক্তাগণ আম গাছে পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়ার পর যত্ন-পরিচর্যা শুরু করে থাকেন। আবার অনেকে আম গাছে গুটি বাঁধার পর আম বাগান পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রকৃতপক্ষে আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদের ক্ষেত্রে আমবাগানে সারা বছরই কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। কোন সময় বাগানের কাজকর্ম তুলনামূলক বেশি আবার কোন কোন সময় কম থাকে। সময়ের কাজ সময়ে সম্পাদন করলে গাছের সুষম বৃদ্ধি ও গুণগত মানসম্পন্ন ফলন নিশ্চিত হয়। যেমন-আম বাগানে সার প্রয়োগ। এটি অবশ্যই আম সংগ্রহের পরপরই করতে হবে। কেহ যদি অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সার প্রয়োগ করেন তবে কোনোভাবেই ভালো ফলাফল পাবেন না। সুতরাং সার প্রয়োগের কাজটি অবশ্যই সময়মতো ও নির্দেশিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। আমগাছে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য এ সময়ের যত্ন-পরিচর্যাসমূহ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যা ধারাবাহিকভাবে নি¤েœ আলোচনা করা হলো।
পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়ার পূর্বে যত্ন-পরিচর্যা
সাধারণত বর্ষাকালে আম বাগানে প্রচুর আগাছা জন্মাতে দেখা যায়। অনেক আগাছা বর্ষাকালেই তাদের জীবন চক্র সম্পন্ন করে। ফলে পরবর্তী মৌসুমেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এজন্য বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সাথে সাথে জমির আগাছা সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করতে হবে। সম্ভব হলে আগাছার ডালপালা, শাখা-প্রশাখা, শেকড় আচড়া দ্বারা সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুঁতে দিতে হবে অথবা পুড়ে ফেলতে হবে। তবে কিছু কিছু আগাছা আছে যেগুলো শাখা-প্রশাখা দ্বারা বংশবিস্তার করতে পারে না, সেগুলো মালচ বা জাবড়া হিসেবে আম গাছের গোড়ায় ব্যবহার করা যেতে পারে। আম বাগানে আগাছা দমন করা সম্ভব না হলে সেই বাগান হতে রোগ ও পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আগাছা অনেক রোগ ও পোকার আবাসস্থল/আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। আমগাছে পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়ার পূর্বে আমগাছকে জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। এ জন্য আমগাছে পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়ার আনুমানিক ১৫-২০ দিন পূর্বে একটি ভালোমানের কীটনাশক (ইমিডাক্লোপ্রিড/কার্বারিল/ ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন গ্রুপের) এবং একটি ছত্রাকনাশক (মেনকোজেব/ কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের) নির্দেশিত মাত্রায় মিশিয়ে সমস্ত গাছ ভালোভাবে ধুয়ে দিতে হবে। এর ফলে আম গাছে বসবাসকারী রোগ-জীবাণু, পোকার ডিম, লার্ভা, পিউপা ও পূর্ণাঙ্গ পোকা ধ্বংস করা সম্ভব হবে। আমগাছে বসবাসকারী এসকল রোগ ও পোকা পরবর্তীতে পুষ্পমঞ্জরিতে আক্রমণ করে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পুষ্পমঞ্জরি নষ্ট করে, ফলে সেই পুষ্পমঞ্জরিতে আর ফল ধারণ সম্পন্ন হয় না। ফলশ্রুতিতে আমের ফলন মারাত্নকভাবে কমে যায়।
পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়ার পর যত্ন-পরিচর্যা
আমবাগানে ফুল আসার পূর্বে যত্ন-পরিচর্যাসমূহ সঠিকভাবে সম্পাদন করলে সতেজ ও রোগমুক্ত পুষ্পমঞ্জরি বের হয়। এ পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়া থেকে আমের গুটি বাধা পর্যন্ত ২৫-২৮ দিন সময় লাগে। এ সময়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং রোগ ও পোকার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। বিশেষ করে হপার বা ফুদকি পোকা এবং এ্যানথ্রাকনোজ রোগ পুষ্পমঞ্জরির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। এগুলো দমন করার জন্য পুষ্পমঞ্জরির দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেমি. হলে একটি কীটনাশক (ইমিডাক্লোপ্রিড/ কার্বারিল/ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন/সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের) এবং একটি ছত্রাকনাশক ম্যানকোজেব গ্রুপের) নির্দেশিত মাত্রায় একত্রে মিশিয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় স্প্রে করতে হবে। এই স্প্রেটি গাছের পুষ্পমঞ্জরি, পাতা ও কা-ে করতে হবে। গাছের পাতা ভেজা অবস্থায় স্প্রে করা ঠিক হবে না। কারণ পাতা ভেজা অবস্থায় স্প্রে করলে ব্যবহৃত বালাইনাশক খুবই দ্রুত পাতা হতে গড়িয়ে পড়ে এবং ব্যবহৃত বালাইনাশকের কার্যকারিতা কমে যায়। বিগত কয়েক বছর কোন কোন আমবাগানে ইনফ্লোরোসেন্স মিজ পোকার আক্রমণ লক্ষ করা যাচ্ছে। এ পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হলে ফিপ্রোনিল/(সাইপারমেথ্রিন +ক্লোরপাইরিফস) গ্রুপের কীটনাশক নির্দেশিত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে। এ সময় শুধুমাত্র পুষ্পমঞ্জরি ও পাতায় স্প্রে করতে হবে। আমরা সবাই জানি, ফুল ফোটা অবস্থায় স্প্রে করা উচিত নয়, তবে রোগ ও পোকার আক্রমণ বেশি হলে এবং ফলন বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ফুলেও স্প্রে করা যেতে পারে। এ ছাড়া ফুল ফোটা শুরু হলে প্রথম ৭ দিন পুষ্পমঞ্জরিতে কোন উভয়লিঙ্গ ফুল না ফোটার কারণে স্প্রে করতে কোন বাধা নেই। 
আমের গুটির যত্ন-পরিচর্যা
আমের পুষ্পমঞ্জরির অর্ধেকের নিচের অংশে সাধারণত গুটি আসে না বা খুবই কম আসে। গুটি মূলত পুষ্পমঞ্জরির অর্ধেকের উপরের অংশে বেশি আসে। একটি পুষ্পমঞ্জরির ৭০-৮০ ভাগ ফুল ফোটার পর আমের গুটি বাঁধতে দেখা যায় এবং ৯৫ ভাগ ফুল ফোটার পর কাক্সিক্ষত গুটি বাঁধা সম্পন্ন হয়। আমের গুটি নাকফুল বা সরিষা দানাকৃতি হলে গুটি রক্ষার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় গুটিতে এ্যানথ্রাকনোজ এবং হপার পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। আমের গুটিকে রোগ ও পোকামুক্ত করতে হলে একটি ভালো কীটনাশক (ইমিডাক্লোপ্রিড/সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের) এবং একটি ছত্রাকনাশক কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের নির্দেশিক মাত্রায় স্প্রে করতে হবে। এরপরও গুটিতে কোন অনাক্সিক্ষত দাগ দেখা দিলে নিকটস্থ কৃষি অফিস বা আম গবেষকবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমের গুটির বয়স ২২ দিন অতিবাহিত হলে ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দেখা যায় এবং ৪৫ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে হলে (সাইপারমেথ্রিন+ক্লোরপাইরিফস)/ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন/ সুমিথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক নির্দেশিত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে। আমের গুটি ঝরা বন্ধ হলে ফ্রুট ব্যাগিং করেও এ পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা যায়। এর পরবর্তী সময়ে শুধুমাত্র রুটিনমাফিক (সেচ, ব্যাগিং, রোগবালাই দমন, আম সংগ্রহ) ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করলেই ভালোমানের আম উৎপাদন সম্ভব হবে। 
আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ বিজ্ঞানভিত্তিক এবং প্রত্যেকটি কাজকর্ম গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে করা হয়। সুতরাং গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি কাজকর্ম সময়মতো ও যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হবে। ফলশ্রুতিতে বাণিজ্যিক আম বাগান হতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালোমানের আম উৎপাদন নিশ্চিত হবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর, মোবাইল নং-০১৭১২১৫৭৯৮৯