খরাপ্রবণ এলাকায়
পাট চাষাবাদ
প্রযুক্তি
ড. এ. টি. এম. মোরশেদ আলম
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এ দেশে পরিবেশের বিরূপ আচরণের উন্মাদনাটা বোঝা যায় গ্রীষ্মকালে। সেচের জন্য পানি, খাদ্যের প্রয়োজনে পানি, জীবনের প্রয়োজনে পানি, সর্বোপরি জীবনে টিকে থাকার জন্য পানির তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় বিশেষ করে গ্রীষ্মের এ প্রচ- তাপদাহের সময়। জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের ভৌত কাঠামোতে যে অভাব পরিলক্ষিত হয় তা হলো ভূপৃষ্টের উপরিভাগ এবং ভূপৃষ্টের নিচে পানির অভাব। পানির স্থিতিশীল স্তর কমতে কমতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন অগভীর নলকূপ এবং হস্তচালিত নলকূপ পানি উত্তোলন ক্ষমতা হারিয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন পানির জন্য চলছে তীব্র হাহাকার। নদীমাতৃক এ দেশে পানির অভাব। এ কথা ভাবতে গেলেও আতঙ্কে গা শিউরে ওঠে। পানির অভাবে কৃষি ক্ষেত্রে প্রতি বছরই নেমে আসছে দুর্ভোগ। দেশ ধাবিত হচ্ছে মরুময়তার দিকে। ফলে পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে।
বর্তমানে সারা দেশে চলছে খরাজনিত আবহাওয়া। মাঠে অবস্থিত অন্যান্য ফসলের সঙ্গে পাট ফসলও খরায় আক্রান্ত হয়েছে। ফসলের মাঠ খরায় আক্রান্ত হলে মাটিতে রস কমে যায় বা মাটির রস নিঃশেষ হয়ে যায়। দিন-রাত্রি সব সময়ই গাছে প্রস্বেদন প্রক্রিয়া চলে। এই প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় গাছ মাটি থেকে রস শিকড়ের মাধামে শুষে নেয় এবং পাতার মাধ্যমে সেই পানি বের করে দেয়। মাটিতে রস না থাকলে গাছ শিকড়ের মাধ্যমে রস শুষে নিতে পারে না। কিন্তু অধিক তাপমাত্রার কারণে পাতার মাধ্যমে গাছ থেকে পানি ঠিকই বের হয়ে যায়। ফলে গাছে পানি শূন্যতা দেখা দেয় এবং গাছ ঢলে পড়ে। অন্যদিকে মাটি থেকে রস শুষে নেয়ার সময় গাছ প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানসমূহ শিকড়ের মাধ্যমে গ্রহণ করে। কাজেই, মাটিতে রস না থাকলে গাছ পুষ্টি উপাদানও প্রয়োজনমতো গ্রহণ করতে পারে না, ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। দীর্ঘ দিন খরা পীড়িত অবস্থায় থাকলে গাছ মারা যায়।
পাট পরিবেশবান্ধব ফসল। পাট ফসল চাষাবাদের মাধ্যমে পাট গাছ মাটির গুণগত মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাট গাছের মূল মাটির ১০-১২ ইঞ্চি বা তার চেয়ে বেশি গভীরে প্রবেশ করে এবং মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত “প্লাউপ্যান” বা লাঙ্গলস্তর ভেঙে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলী ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে। এ ছাড়া পাট গাছের পাতা জমিতে পড়ে পচে যায় এবং পাট কাটার পর জমিতে রেখে আসা শিকড়ও মাটিতে পচে মিশে যায়। এর ফলে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এতে মাটির ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণের উন্নয়ন ঘটে। যার ফলে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, মাটিতে আলো ও বায়ু চলাচল সহজ হয় এবং সর্বোপরি মাটির উর্বরতা শক্তি বেড়ে যায়। এ ভাবে পাট গাছ মাটির গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
পাট চাষের সময় বিরাজমান অধিক তাপমাত্রায় পাট গাছের কোন ক্ষতি হয় না কিন্তু মাটিতে রস না থাকলেই পাট গাছের বৃদ্ধি ও উন্নয়ন ব্যাহত হয়। চলমান খরা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সে জন্য পূর্ব প্রস্তুতি থাকা ভাল। মাটিতে যখন পর্যাপ্ত রস থাকে সাধারণত তখনই পাট বীজ বপন করা হয়। এর পর আর বৃষ্টি না হলেও মাটির ঐ রস দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করা সম্ভব। যেমন: মালচিং অর্থাৎ বীজ বপনের ১০- ১৫ দিন পর জমিতে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং উপরের মাটির চটা ভাল করে ভেঙে গুঁড়ো করে দিতে হবে।
সময়মতো মালচিং করে দিলে মাটিতে দীর্ঘ দিন রস জমা থাকে এবং পাটের চারা ঐ সংরক্ষিত রসের উপর দীর্ঘ দিন নির্ভর করে টিকে থাকতে পারে। পাট বীজ সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাসে বপন করা হয় এবং প্রতি বছরই বৈশাখ মাস থেকে খরা শুরু হয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সময় পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতে পারে। কাজেই বৈশাখ মাসে বৃষ্টি হওয়ার পর জমিতে জো অবস্থা আসার পর মালচিং এর ব্যবস্থা করতে হবে অর্থাৎ মাটির উপরি ভাগের চটা ভেঙে গুঁড়ো করে দিতে হবে। জমিতে আচড়া দিয়ে অথবা হো দিয়েও মালচিং করা যায়। সাধারণত জমির উপরিভাগের মাটি জমাট বেঁধে চটা গঠন করে। এরপর খরা হলে অধিক সূর্যতাপে উপরিভাগের মাটি সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং চটার গায়ে অনেক ফাটলের সৃষ্টি হয়। তখন ঐ ফাটল দিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই মাটি থেকে রস বাষ্পীভূত হয়ে বের হয়ে যায় এবং চারা অবস্থায় পাট গাছের শিকড় যতটা নিচে প্রবেশ করতে পারে ততদূর পর্যন্ত মাটি রসশূন্য হয়ে পড়ে। মাটিতে রস না থাকায় পাটের চারা গাছ মাটি থেকে রস গ্রহণও খাদ্য উপাদান নিতে পারে না। ফলে পাট গাছের চারা দূর্বল হয়ে নিচের দিকে ঢলে পড়ে। দিনের বেলায় সূর্য তাপে যদি চারা গাছের পাতা ও ডগা নিচের দিকে ঢলে পড়ে তাহলে বুঝতে হবে পাট ক্ষেতের মাটির রস শুকিয়ে গেছে। পাটের চারা গাছ মাটি থেকে রস ও খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করতে পারছে না। এ অবস্থা ৪/৫ দিনের বেশি থাকলে গাছ মরতে শুরু করবে। তখন অবশ্যই সেচের বাবস্থা করতে হবে। তবে উত্তপ্ত মাটিতে দিনের বেলায় অর্থাৎ বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সময়ে সেচ দেয়া যাবে না। এ সময় সেচ দিলে উত্তপ্ত মাটিতে সেচের পানি সূর্য্যের তাপে গরম হয়ে পাট গাছের চারার সূক্ষ্ম শিকড়গুলো সিদ্ধ হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। যার ফলে পাটের চারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কাজেই খুব সকালে, পড়ন্ত বিকেলে অথবা রাতে সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এমনভাবে সেচ দিতে হবে যেন সেচের পানি মাটির ৬-৭ ইঞ্চি পর্যন্ত গভীরে প্রবেশ করতে পারে বা পানি মাটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনই হালকা সেচ দেয়া যাবে না। একবার সেচ দেয়ার পর মাটিতে জো আসলেই পুনরায় মালচিং করে দিতে তা হলে খরা দীর্ঘ দিন থাকলেও মাটিতে রসের কোন অভাব হবে না। এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য পাট চাষিগণ স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এ ছাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস থেকে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত ও পাট চাষে অধিক ফলনের জন্য প্রতি মাসে করণীয়’ শীর্ষক লিফলেটটি সংগ্রহ করলেও তারা বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন। পরিশেষে পাট চাষিভাইদের প্রতি আহ্বান আপনার পাট ফসলের যত্ন নিন, নিজে লাভবান হোন এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখুন।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল ফোন ও নগদ নম্বর ঃ ০১৭৪০-৫৫৯১৫৫,