Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

দেশি-ও-বিদেশি-ফল-বাগান-স্থাপনে-অর্থনৈতিক-ব্যবস্থাপনার-গুরুত্ব-ও-করণীয়

দেশি ও বিদেশি ফল বাগান স্থাপনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও করণীয়
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন 
বাণিজ্যিক কৃষিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বলতে জনবল ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে সবচেয়ে কম খরচে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোকে বোঝায়। বর্তমানে অনেক শিক্ষিত যুবক উদ্যোক্তা হিসেবে কৃষিতে বিনিয়োগ করছেন। বিনিয়োগ করার পূর্বে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিষয়টি ভালোভাবে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। না হলে গৃহীত উদ্যোগ সফল হবে এমনটি কারো কাম্য নয়।
বর্তমানে ফলের চাষ লাভজনক হওয়ায় দেশের শিক্ষিত যুবক বা বেকার যুবকগণ দেশি ও বিদেশি ফল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, পাশর্^বর্তী চাষী বা উৎপাদনকারীর সফলতা দেখে তিনিও কোন একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। শুরু থেকে প্রত্যেকটি বিষয় আমলে নিয়ে এগিয়ে গেলে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। দেশে বর্তমানে ৭০-৮০ প্রজাতির ফল চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে সবগুলো চাষ করে বাণিজ্যিভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভবনা নেই। যে ফলগুলো দেশের বিরাজমান আবহাওয়ায় ভালো ফলন দেয়, দেশের মানুষ পছন্দ করে এবং রপ্তানির সম্ভবনা আছে সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা উত্তম। যেমন- আমের বিভিন্ন জাত (বারি আম-২, বারি আম-৩, বারি আম-৪, বারি আম-১১, বারি আম-১২, বারি আম-১৩, বারি আম-১৭, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি, আশি^না, কার্টিমুন, ব্যানানা ম্যাংগো ইত্যাদি), লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, নারিকেল, মাল্টা ইত্যাদি। বিদেশি ফল যেমন- ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরী, রাম্বুতান, অ্যাভোক্যাডো চাষ করা যেতে পারে। 
এদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিবেচনায় যে কোন একটি ফলের একক বাগান না করাই উত্তম। মৌসুমে আবহাওয়াগত তারতম্যের কারণে কোন একটি বছরে কোন কোন ফলের ফলন বিপর্যয় দেখা যায়। সেক্ষেত্রে জায়গার পরিমাণ এক একরের মতো হলে দেশি-বিদেশি ফল মিলে মিশ্র ফল বাগান স্থাপন করা ভালো। এ ছাড়াও মিশ্র ফল বাগান হতে সারা বছর ফলের ফলন পাওয়া যাবে। ফলের বাগান স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রথম কয়েক বছর জায়গার ব্যবহার ভালো হয় না। সেক্ষেত্রে ফল বাগানের ফাকা জায়গায় স্বল্পকালিন ফল, সবজি ও ডাল জাতীয় ফসল আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করলে বাড়তি আয় করা সম্ভব। 
বাজার বিশ্লেষণ
একজন চাষি বা উদ্যোক্তা দেশি বা বিদেশি যে কোন ধরণের ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য নির্বাচন করতে পারেন তবে সে ফলের মার্কেট যাচাই করতে হবে, ভোক্তার পছন্দ এবং ঐ ফসলের চাহিদার গ্রাফ পর্যালোচনা করতে হবে। যদি ফলাফল কাক্সিক্ষত হয় তবেই বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ
একটি ফসল উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের খরচ হয়। খরচ নিরূপণের সময় যেন কোন আইটেম/খাত বাদ না যায় সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ প্রত্যেকটি কার্যকলাপের জন্য খরচ হয়। যেমন- জমি লিজ, বীজ, কলমের চারা, বেড়া নির্মাণ, ঠেস দেয়া, জৈব সার, রাসায়নিক সার, সেচ প্রয়োগ, বালাইনাশক, শ্রমিক মজুরি, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, ক্রেইট, পরিবহন খরচ বিবেচনায় রাখতে হবে। উৎপাদন খরচ সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে পরিকল্পনা করলে ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ পেয়ারা চাষে উৎপাদন খরচ সারণি দ্রষ্টব্য।
সাধারণভাবে হিসেব করলে দেখা যায় আট চল্লিশ হাজার টাকায় এক একর জমিতে পেয়ারা উৎপাদন করা যায় কিন্তু একটু ভালোভাবে উৎপাদন খরচ বিবেচনা করলে খরচ প্রায় একগুণ বেড়ে যায় অর্থাৎ উৎপাদন খরচ ভালোভাবে বিবেচনা না করলে লাভের পরিমাণ কমে যেতে পারে অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।
বাজারদর বিশ্লেষণ
ফসলের মূল্য নির্ভর করে মূলত ফসলের সরবরাহ ও ভোক্তার চাহিদার উপর। সরবরাহ যত বেশি হবে দাম তত কম হবে। স্থানীয় বাজারের তুলনায় দূরবর্তী বাজারে দাম বেশি পাওয়া যায়। আবার চেইন শপ মার্কেটে ফলের দাম বেশি হয়। ফসলের দাম বেশি পাওয়ার জন্য ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। আগাম মৌসুমে এবং অমৌসুমে ফলের দাম বেশি হয়। ফলে দেশি-বিদেশি যে ফলই হোক না কেন অসময়ে ফলের চাহিদা বেশি থাকে ফলে দামও বেশি পাওয়া যায়। ফলের গুণমাত মান ভালো হলেও দাম ভালো পাওয়া যায়। সুতরাং বাজার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ক্রেতা/ভোক্তার সাথে লিংকেজ স্থাপন
উৎপাদিত ফল যতই ভালো হোক না কেন ভোক্তার কাছে ভালোভাবে না পৌঁছালে ভারো দাম পাওয়া যাবে না। সুতরাং উৎপাদিত ফসল বা পণ্য কাক্সিক্ষত মার্কেটে বা ভোক্তার কাছে পৌঁছানের জন্য কার্যকরী সরবরাহ চেইন গড়ে তুলতে হবে। এ সকল ফল চাষির কাছে থেকে সরাসরি ভোক্তার কাছে অথবা চাষির কাছ থেকে সরবরাহ চেইনের মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছান যায়। বর্তমানে অনেক চাষি সরাসরি বিভিন্ন হোটেল/রেস্টুরেন্টে এ ফল সরবরাহ করে থাকেন। ফলে তারা মূল্য বেশি পান।
সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনা
ফল উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ সরবরাহ চেইনে যেন ফলের মান নষ্ট না হয় বা কমে না যায় সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, সরবরাহ চেইনে অব্যবস্থাপনার পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় ফলে ক্রেতাদের বেশি দামে ক্রয় করতে হয়। এত পণ্যের চাহিদা কমে যায়।
উৎপাদিত ফলের মান নিয়ন্ত্রন
ফলের গুণগত উৎপাদনকারীকে নিশ্চিত করতে হবে। ক্রেতা বা ভোক্তার চাহিদানুযায়ী সবচেয়ে ভালোমানের ফল উৎপাদন করবে। যে সকল ক্রেতা একবার এ সকল ফল খাবেন, পুনরায় সেগুলো খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করবেন। এ ভাবে উদ্যোক্তার সুনাম বৃদ্ধি পাবে, বাজারের এলাকা বাড়বে এবং ব্যবসায় সফলতা আসবে। বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে এর মার্ক ব্যবহার করা বা সার্টিফিকেট প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সার্টিফিকেট গ্রহণ করে তা ক্রেতা বা ভোক্তার কাছে প্রদর্শণের মাধ্যমে পণ্যের মান নিশ্চিত করা যায়।
বিপণন ও প্রচার
উৎপাদিত ফলের বিপণনের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। জেলা ও উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের কাছে ফলের প্রাপ্যতা ও গুণগত মান সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। সম্ভব হলে নিজ উদ্যোগে বিক্রয় কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। যদি সম্ভব না হয় তাহলে ফল ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সেখানে পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের প্রচলিত প্রচার মাধ্যমগুলোকে প্রচারের কাজে লাগাতে হবে। অনলাইন ও অফলাইন মাধ্যমে প্রচার করতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রচারেই প্রসার।
পরিশেষে বলা যায়, নতুন কোন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে আলোচিত সকল বিষয় বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করলে অবশ্যই সেই উদ্যোগ/ব্যবসা লাভজনক হবে এবং কৃষক বা উদ্যোক্তা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। উদ্যোক্তাদের ছোট ছোট উদ্যোগ সফল হলেই দেশের কৃষি ভিত্তি আরও শক্ত ও মজবুত হবে এবং জিডিপিতে আরও বেশি অবদান রাখবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর , মোবাইল- ০১৭১২১৫৭৯৮৯  ই-মেইল :sorofu@yahoo.com