Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

প্রাকৃতিক রং দ্বারা পাট ও পাটবস্ত্র রঞ্জিতকরণ

প্রাকৃতিক রং দ্বারা পাট ও পাটবস্ত্র রঞ্জিতকরণ
ড. ফেরদৌস আরা দিলরুবা
কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে পাটই প্রধান অর্থকরী ফসল। সুপ্রাচীন কাল হতে আমাদের দেশে পাটের আবাদ ও ব্যবহার শুরু হয়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে পাটই ছিল প্রধান রপ্তানি আয়ের পণ্য। এখানকার আলো, বাতাস ও জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ পাট চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তাই পাট চাষিগণ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের পাট চাষ করে আসতেছে।
পাট বহুবিধ কল্যাণমুখী গুণে গুণান্বিত, যেমন- পরিবেশবান্ধব, দ্রুত পচনশীল, সহজলভ্য ইত্যাদি। মূলত এ সমস্ত গুণগত বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশ্ববাজারে পাট পছন্দের তন্তু হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের ফলে সারাবিশ্বে কৃত্রিম আঁশের উদ্ভাবন এবং স্বল্প ব্যয়ে এর বহুমুখী ব্যবহারের ফলে বিশ্ববাজারে পাট আজ চরম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। তাই বিশ্ববাজারে পাটকে টিকিয়ে রাখার জন্য এর বহুমুখী ব্যবহার এবং সম্প্রসারণ অত্যাবশ্যক।
পাটের বহুমুখী ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পাটের কাপড়কে ব্লিচিং ও নরমীকরণ করে, রঙিন ডিজাইন বা নকশা তৈরির মাধ্যমে উহাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে দেশী-বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা অত্যন্ত জরুরি। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে “প্রাকৃতিক রং দ্বারা পাট ও পাটবস্ত্র রংকরণ পদ্ধতি” একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি।
প্রাকৃতিক রং : প্রাকৃতিক রং বলতে এমন কিছু উপাদানকে বোঝায় যা, প্রকৃতি বা আমাদের চারপাশের পরিবেশ থেকে সংগৃহীত এবং এর ব্যবহারের ফলে আমাদের পরিবেশ এর কোনো ক্ষতি হয় না।
বাংলাদেশ রং উৎপাদনকারী গাছের এক সম্পদশালী ভা-ার। দেশীয় জরিপে দেখা যায় যে, কৃত্রিম রং এর ক্ষতিকর প্রভাবে গ্রাম্য শিল্প লুপ্ত প্রায়। বর্তমানে সহজলভ্য কৃত্রিম রং প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ,নদী-নালার পানিতে মিশে ধ্বংস করছে জীববৈচিত্র্য। এর ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক রংয়ের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে। এই উপমহাদেশে তিন শতাধিক রং প্রস্তুতকারী গাছের নাম নানাবিধ ঐতিহাসিক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। উৎসগুলোর মধ্যে গাছের ছাল, গাছের পিন্ড, বীজ, ফুলের গুচ্ছ অন্তর্গত।
প্রাকৃতিক রংকরণ পদ্ধতি
ধৌতকরণ : পাটবস্ত্রের মাড় ও অন্যান্য ময়লা দূর করার জন্য প্রথমে ধৌত করা প্রয়োজন। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে কাপড় কাঁচা সোডা, গলিত সাবান, কষ্টিক সোডা ও পানি একত্রে গরম করা হয়। উক্ত দ্রবণে পাটবস্ত্র সিদ্ধ করা হয়ে গেলে প্রচুর পরিষ্কার পানিতে ধৌত করা হয়।
ব্লিচিং : যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে টেক্সটাইল দ্রব্য হতে প্রাকৃতিক রং জাতীয় পদার্থ বিনষ্ট করা হয় তাকে ব্লিচিং বলে।
রংকরণ : কাপড় রং দ্রবণে ডুবিয়ে সব জায়গায় সমানভাবে লাগানোর প্রণালীকে রংকরণ বলে।
মর্ডান্ট : একটি সাহায্যকারী বস্তু যা প্রাকৃতিক রং এর সাথে মিলে সুতার সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করে। বিভিন্ন মর্ডান্ট দ্বারা বিভিন্ন রং হয়। প্রাকৃতিক রং হইতে সূক্ষ্ম চমৎকার রং পাওয়া যায়। যাহার স্থায়িত্ব ও ঘনত্ব “মর্ডান্ট” দ্বারা বদলান যায়।
সারণি-২ : প্রাকৃতিক রং করার উপাদান (মর্ডান্ট)    
উপরোক্ত মর্ডান্ট বা উপকরণ ভিন্নভাবে ভিন্ন সময়ে ব্যবহার করতে হবে।
রংকরণ পদ্ধতির জন্য কিছু প্রয়োজনীয় ধাপ আছে যা ভালো ফলাফলের জন্য অবশ্যই পালন করতে হবে। সুতা/কাপড় মেপে নেওয়া (সকল কিছুর হিসাব সুতা/কাপড়ের ওজনের উপর করে নিতে হবে)। রং এর উপাদান ও মিনারেলের ওজন এবং এদের হিসেব করা। মর্ডান্ট এর দ্রবণ তৈরি করা। মর্ডান্টিং করা। রং এর উপাদান থেকে রং বের করা। রং করা। ডেভেলপিং করা এবং ধৌত করা।
ভালো ফলাফলের জন্য সুতা/পাটবস্ত্র প্রথমে ফিটকিরির দ্রবণে জ্বাল দিতে হবে। পানি গরম করে তাতে রং এর চাহিদা অনুযায়ী মিনারেল দিতে হবে এবং ভালো করে গলাতে হবে। ফিটকিরি দিয়ে ট্রিট করা সুতা/পাটবস্ত্র এই দ্রবণে দিয়ে আধাঘণ্টা জ্বাল দিতে হবে। এইভাবে সুতা/পাটবস্ত্র রং করার জন্য তৈরি হবে। পানি গরম করে এতে ১০০% রং এর উপাদান দিতে হবে। সাথে এক চিমটি কাপড় কাঁচার সোডা দিলে ভালো হয়। সম্পূর্ণ রং বের করার জন্য কমপক্ষে আধাঘণ্টা জ্বাল দিয়ে পরে সেটা পাতলা কাপড় দিয়ে ছেকে নিতে হবে।
মর্ডান্ট দ্রবণ থেকে সুতা/পাটবস্ত্র তুলে চিপে নিতে হবে যাতে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায়। তারপর এটাকে রং এর দ্রবণে আধাঘণ্টা জ্বাল দিতে হবে। রং করার পর সুতা/পাটবস্ত্র প্রচুর পানিতে খুব ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে যাতে আলগা রং সম্পূর্ণ উঠে যায়। পরিশেষে সাবান দিয়ে ধুয়ে ছায়ায় শুকাতে হবে।
প্রাকৃতিক রং খয়ের থেকে রং তৈরি
প্রথমে হামান দিস্তার সাহায্যে খয়েরের টুকরাকে ভেঙে গুঁড়া করে নিতে হবে। খয়েরের সাহায্যে ১০০ গ্রাম সুতা/পাটবস্ত্র রং করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ
সুতা/পাটবস্ত্র ১০০ গ্রাম; খয়ের ৩০% (৩০ গ্রাম, সুতা/কাপড়ের ওজনের ভিত্তিতে); তুতে ৫% (৫ গ্রাম, সুতা/কাপড়ের ওজনের ভিত্তিতে); পানি    : ২০ গুণ (১০০ গ্রাম সুতা/পাটবস্ত্রী২০ = ২০০০ গ্রাম = ২ লিটার); ফলাফল হবে খয়েরি রং এর সুতা/পাটবস্ত্র।
পদ্ধতি : প্রথমে খয়েরের গুঁড়া তুতেসহ গরম পানিতে দিয়ে ভালো করে গলাতে হবে যাতে সম্পূর্ণ গলে যায়। অতঃপর ছেঁকে নিয়ে পুনরায় চুলায় বসাতে হবে। এতে সুতা/পাটবস্ত্র ডুবিয়ে রং করতে হবে। রং করার সময় সুতা/পাটবস্ত্র ভালো করে নাড়তে হবে যাতে রং সর্বত্র সমানভাবে লাগে। আধাঘণ্টা রং করার পর সুতা/পাটবস্ত্র রং এর দ্রবণ থেকে তুলে নিতে হবে। এতে খয়েরি রং পাওয়া যাবে। রং করার পর প্রচুর পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে যাতে আলগা রং উঠে যায়। ধোয়ার পর ছায়ায় শুকাতে হবে।
উক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাট আঁশ দিয়ে নানাবিধ পণ্য তৈরি হচ্ছে। পাট আঁশ হতে উদ্ভাবিত নানাবিধ দ্রব্যের মধ্যে বিভিন্ন রং এর পাট উল, কম্বল, সুয়েটার, জায়নামাজ, হাল্কা শপিং ব্যাগ, পর্দার কাপড়, সোফার কভার ইত্যাদি হরেক রকমের পণ্য উল্লেখযোগ্য।
পরিবেশগত কোন দূষণীয় পদার্থ পাট ও পাটজাত দ্রব্যে নাই। অন্যদিকে পাট ও পাটজাত দ্রব্য অতি সহজেই পচনশীল। কাজেই সচেতন নাগরিক ও নতুন প্রজন্মদের পাট ও পাটজাত দ্রব্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
 

লেখক : পরিচালক (জুট-টেক্সটাইল), জুট-টেক্সটাইল উইং, বিজেআরআই, ঢাকা। মোবাইল নং - ০১৬৮০৯৭৮৬৫৮, ই-মেইল : drfdilruba70@gmail.com