Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বৈশাখ-মাসের-কৃষি-(১৪-এপ্রিল-১৪-মে)

বৈশাখ মাসের কৃষি 
(১৪ এপ্রিল- ১৪ মে)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
বৈশাখ মাস। ১৪৩১ বঙ্গাব্দের শুভ সূচনা হলো। শীত বসন্তে প্রকৃতিতে যে রুক্ষতা দেখা দেয়, বৈশাখে দেখা দেয় সবুজ সতেজ রঙিন প্রাণ। সাথে চলে বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। এসময়  বৈশাখী উৎসবের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তার কারিগর কৃষক, পুরনো বছরের ব্যর্থতাগুলো ঝেড়ে নতুন প্রত্যাশায় পুনরুজ্জীবিত হয়ে ফসল উৎপাদনে কাজে। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। সেই সাথে আসুন জেনে নেই বৈশাখে কৃষির করণীয় দিকগুলো।
বোরো ধান 
ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। নাবি বোরো ধানের থোড় আসার সময় পানির অভাব না হয় তাই আগে থেকেই সম্পূরক সেচের জন্য মাঠের এক কোণে মিনি পুকুর তৈরি করতে হবে। ধানের দানা শক্ত হলে জমি থেকে পানি বের করে দিতে হবে। এ মাসে বোরো ধানে মাজরা পোকা, বাদামি গাছফড়িং, সবুজ পাতাফড়িং, গান্ধিপোকা, লেদাপোকা, ছাতরাপোকা, পাতা মোড়ানো পোকার এবং এ সময় ধানক্ষেতে উফরা, বাদামি দাগ রোগ, ব্লাস্ট, পাতাপোড়া ও টুংরো রোগের আক্রমণ হতে পারে। বালাই দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। বালাই আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে প্রয়োগ করতে হবে। এ মাসে শিলাবৃষ্টি হতে পারে, বোরো ধানের ৮০% পাকলে তাড়াতাড়ি কেটে ফেলতে হবে।
আউশ ধান
আউশ ধানের জমি তৈরি ও বীজ বপনের সময় এখন। বোনা আউশ উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি এবং রোপা আউশ বন্যামুক্ত আংশিক সেচনির্ভর মাঝারি উঁচু ও মাঝারি নি¤œ জমি আবাদের জন্য নির্বাচন করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষের সময় শতাংশপ্রতি ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ৩০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টিনির্ভর বোনা আউশ এলাকায় ইউরিয়া দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করত হবে। প্রথম কিস্তি শেষ চাষের সময় এবং দ্বিতীয় কিস্তি ধান বপনের ৩০-৪০ দিন পর। জমিতে গন্ধক এবং দস্তার অভাব থাকলে শতাংশ প্রতি ১৩৫ গ্রাম জিপসাম ও ২০ গ্রাম জিঙ্ক সালফেট প্রয়োগ করতে হবে। আউশের উন্নত জাত হিসাবে বিআর২০, বিআর২১, বিআর২৪, ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৪৩ ও ব্রি ধান৮৩, ব্রি ধান ১০৬  এবং রোপা হিসেবে বিআর২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৮২, ব্রি ধান৮৫, ব্রি ধান৯৮ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৭ । এ ছাড়াও খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকাসহ, পাহাড়ি এলাকার জমিতে বিনা ধান-১৯, বিনা ধান-২১ চাষ করতে পারেন।
পাট
বৈশাখ মাস তোষা পাটের বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। ফাল্গুনী তোষা ও-৯৮৯৭, বিজেআরআই তোষা পাট-৫, বিজেআরআই তোষা পাট-৮ (রবি-১), বিজেআরআই তোষা পাট-৯ (খরিফ-১) ভালো জাত। 
দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে তোষা পাট ভালো হয়। বীজ বপনের আগে প্রতি কেজি বীজ ৪ গ্রাম ভিটাভেক্স বা ১৫০ গ্রাম রসুন পিষে বীজের সাথে মিশিয়ে শুকিয়ে নিয়ে জমিতে সারিতে বা ছিটিয়ে বুনতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ২৫-৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে ৩৫-৪০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। ভালো ফলনের জন্য  শতাংশপ্রতি ৮০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি সার শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে সালফার ও জিংকের অভাব থাকলে জমিতে সার দেয়ার সময়  শতাংশপ্রতি ৪০০ গ্রাম জিপসাম ও ৫০  কেজি দস্তাসার দিতে হবে। শতাংশপ্রতি ২০ কেজি গোবর সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের পরিমাণ অনেক কম লাগে।  
ভুট্টা (খরিফ) 
খরিফ ভুট্টার বয়স ২০-২৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রসের ঘাটতি থাকলে হালকা সেচ দিতে হবে। জমিতে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং একই সাথে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে।  
শাকসবজি 
বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কলমিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, চাল কুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন। আগের তৈরি করা চারা থাকলে ৩০/৩৫ দিনের সুস্থ সবল চারাও রোপণ করতে পারেন। লতানো সবজির জন্য  মাচা তৈরি করে নিতে হবে। 
কুমড়াজাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোরবেলা সদ্য ফোটা পুরুষ ফুল সংগ্রহ করে পাপড়িগুলো ফেলে দিয়ে পরাগমু-টি স্ত্রী ফুলের গর্ভমু-ে ঘষে হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে। কুমড়াজাতীয় ফসলে মাছি পোকা দমনে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়। 
গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করতে চাইলে বারি হাইব্রিড টমেটো ৪, বারি হাইব্রিড টমেটো ৮, বারি হাইব্রিড টমেটো-১০ বারি হাইব্রিড টমেটো-১১ বা বিনা টমেটো ৩, বিনা টমেটো ৪-এর চাষ করতে পারেন। গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করতে হলে পলিথিনের ছাওনির ব্যবস্থা করতে হবে সে সাথে এ ফসলটি সফলভাবে চাষের জন্য টমেটোটোন নামক হরমোন প্রয়োগ করতে হবে। স্প্রেয়ারের সাহায্যে প্রতি লিটার পানিতে ২০ মিলি টমেটোটোন মিশিয়ে ফুল আসার পর ফুলের গায়ে ৫-৭ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
গাছপালা 
এ মাসে আমের মাছি পোকাসহ অন্যান্য পোকার জন্য সতর্ক থাকতে হবে। মাছি পোকা দমনের জন্য সবজি খেতে যে রকম বিষটোপ ব্যবহার করা হয় সে ধরনের বিষটোপ বেশ কার্যকর। ডিপটরেক্স, ডারসবান, ডেনকাভেপন সামান্য পরিমাণ দিলে উপকার পাওয়া যায়। এ সময় কাঁঠালের নরম পচা রোগ দেখা দেয়। এলাকায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব থাকলে ফলে রোগ দেখা দেয়ার আগেই ফলিকুর ০.০৫% হারে বা ইন্ডোফিল এম-৪৫ বা রিডোমিল এম জেড-৭৫ প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৩ বার স্প্রে করতে হবে। বাড়ির আঙিনায় সুস্থ সবল, উন্নত নারিকেল চারা এবং গ্রামের রাস্তার পাশে পরিকল্পিতভাবে খেজুর ও তালের চারা এখন লাগাতে পারেন। যতœ, পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে ৩-৪ বছরেই গাছগুলো অনেক বড় হয়ে যাবে। বৃষ্টি হয়ে গেলে পুরনো বাঁশ ঝাড় পরিষ্কার করে মাটি ও কম্পোস্ট সার দিতে হবে এবং এখনই নতুন বাঁশ ঝাড় তৈরি করার কাজ হাতে নিতে হবে।
চারা বা কলম রোপণ কৌশল
যারা সামনের মৌসুমে গাছ লাগাতে চান তাদের এখনই জমি নির্বাচন, বাগানের নকশা এবং চারা বা কলম রোপণ কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন।
া চারা রোপণের জন্য নির্বাচিত স্থানটি ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। 
া নির্বাচিত স্থানে বড় মাপের একটি গর্ত খনন করতে হবে।
া গর্ত খনন করার সময় নিচের মাটি একদিকে এবং উপরের মাটি অন্যদিকে রাখতে হবে।
া সবল সতেজ রোগমুক্ত চারা নির্বাচন করতে হবে। 
া সাবধানে পলিব্যাগ অপসারণ করতে হবে যাতে চারার গোড়ায় মাটির চাকা ভেঙে না যায়। চারার কোঁকড়ানো বা আঁকাবাঁকা শিকড় কেটে ফেলতে হবে। বীজতলায় যতটুকু অংশ মাটির নিচে ছিল রোপণের সময় ঠিক ততটুকু অংশ মাটির নিচে রাখতে হবে। সযতেœ চারাটিকে গর্তে বসিয়ে দিতে হবে। 
া চারার চারপাশের ফাঁকা জায়গায় প্রথমে উপরে উর্বর মাটি এবং পরে নিচে মাটি দিয়ে পূরণ করতে হবে। চারপাশের মাটি ভালোভাবে চেপে ঠেসে দিতে হবে যাতে কোনো ফাঁকা জায়গা না থাকে। চারা যাতে হেলে না পড়ে সে জন্য শক্ত খুঁটির সাথে চারা বেঁধে দিতে হবে। রোপণের পরপরই চারার গোড়ায় ও পাতায় পানি দিতে হবে। পরিশেষে খাঁচা দিয়ে চারাকে রক্ষা করতে হবে। 
প্রিয় পাঠক, বৈশাখ নতুন আবাহনের  সৌরভের পাশাপাশি নিয়ে আসে কালবৈশাখীকে। কালবৈশাখীর থাবা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কৃষিতে আগাম বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সুবিবেচিত লাগসই কৌশল আর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব বাধা ডিঙিয়ে আমরা কৃষিকে নিয়ে যেতে পারব সমৃদ্ধির ভুবনে। আপনাদের সবার জন্য নতুন বছরের শুভ কামনা। কৃষি সংশ্লিষ্ট তথ্য জানতে কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করুন। 
 
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল : বফরঃড়ৎ@ধরং.মড়া.নফ