Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার ও টেকসই ভবিষ্যৎ

পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার ও টেকসই ভবিষ্যৎ
স্বপ্নীল বড়–য়া১  মো. এনায়েত উল্ল্যাহ রাফি২
নীলনদকে ঘিরে প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা গড়ে উঠার পেছনে অন্যতম নিয়ামক ছিল পানি, সুপেয় পানি। পৃথিবীর মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে স্বাদু পানির উৎসকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক মানবসভ্যতা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও কৃষি।
পৃথিবী পৃষ্ঠের শতকরা ৭১ ভাগ পানি দ্বারা আচ্ছাদিত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এইটাও সত্য যে, পৃথিবীর মাত্র ২.৫ শতাংশ পানি মানুষের জন্য ব্যবহারযোগ্য, যা দিয়েই কৃষি, শিল্পসহ যাবতীয় প্রয়োজন মিটানো হয়। মানবদেহের শতকরা ৫০ ভাগ পানি দ্বারা পূর্ণ। শারীরতাত্ত্বিক যাবতীয় কার‌্যাবলী পানির উপস্থিতি ছাড়া অসম্পূর্ণ। তাই খাদ্যের ছয়টি মৌলিক উপাদানের মধ্যে পানি অন্যতম। পানি ছাড়া যেমন খাদ্য অসম্পূর্ণ ঠিক তেমনি পানির প্রয়োজন রয়েছে শিল্পসহ সকল সেক্টরে।
কিন্তু সুপেয় পানির উৎস ক্রমহ্রাসমান। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সুপেয় পানির অভাব বোধ করছে। পৃথিবী জুড়ে প্রায় ২.৪ বিলিয়ন ব্যক্তি খড়াপ্রবণ অঞ্চলে বাস করে। তাদের মধ্যে অগণিত কৃষক পানির উৎসের অপ্রতুলতার কারণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগীদের মধ্যে আদিবাসী, অভিবাসী ও উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী অন্যতম। রূঢ় বাস্তবতা হলো যে এই মহামূল্যবান সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা প্রতিনিয়ত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, ফলে  দুর্বল সম্প্রদায়গুলো নিরাপদ পানির অভাবে ভুগছে। পরিসংখ্যান বলে বিগত দশকে জনপ্রতি বিশুদ্ধ পানির উৎস শতকরা ২০ ভাগ কমেছে। যার বিরূপ প্রভাব প্রতীয়মাণ হয়েছে বাংলাদেশেও। ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৩৮.৩ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ উৎস থেকে পানি পান করে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত কমতে থাকা, ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতির কারণে নিরাপদ পানির সন্ধানে উপকূলবাসীদের কলসি, বোতল, ড্রাম নিয়ে নৌকা বা ভ্যানে করে দূরপাল্লার পথ পাড়ি দিতে হয়। নদীমাতৃক দেশ হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর থেকে দেশের জলাভূমি ৭০ শতাংশ কমেছে। অনেক নদীও শুকিয়ে গিয়েছে। ইতোমধ্যে সারাদেশে অন্তত আট হাজার কিলোমিটার নৌপথ হারিয়ে গেছে। এই ক্রমহ্রাসমান পানির উৎসের পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাব পড়েছে মানবসভ্যতা, কৃষি, খাদ্য ও শিল্প উৎপাদনে। ফলে, খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। মানুষের অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা, ভুগর্ভস্ত পানির যথেচ্ছ ব্যবহার, পানি দূষণমূলক কর্মকা-, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি, পরিপূর্ণ পুনঃব্যবহারের অভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিদ্যমান পানির উৎসসমূহকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতেও (এসডিজি)’  প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পানির অপরিসীম এই গুরুত্বকে, যার ষষ্ঠ লক্ষ্য হলো ‘নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন’ সকলের জন্য পানি ও স্যানিটেশন টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যে এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘পানি জীবন, পানিই খাদ্য। কেউ থাকবে না পিছিয়ে।’ এই মূল প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আগামী  ১৬ই অক্টোবর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩’ উদযাপিত হবে। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-র ২০তম সাধারণ সভায় হাঙ্গেরির তৎকালীণ খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী  ড. প্যাল রোমানি বিশ্বব্যাপী এই দিনটি উদ্্যাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৮১ সাল থেকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিষ্ঠার দিনটিতে (১৬ অক্টোবর, ১৯৪৫) দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিবারণের  লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এ বছরেও বিশ্বব্যাপী নানা  আয়োজনের  মধ্যে দিয়ে  বিশ্ব খাদ্য দিবস উদ্যাপিত হতে চলেছে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নগরায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির প্রাপ্যতাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে পানি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়ানোই হবে এ দিবস উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য।
নিরাপদ পানির সহজলভ্যতা পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার উল্লেখযোগ্য পরিমাপক, যা নিশ্চিতকরণে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং এফএও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থায়নে Program on Agricultural and Rural Transformation for Nutrition, Entrepreneurship, and Resilience in Bangladesh (PARTNER) প্রণয়নে এফএও, বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে, যার ১০টি  Disbursement Linked Indicator (DLI) এর মধ্যে একটি হলো ঊভভরপরবহঃ ওৎৎরমধঃরড়হ গধহধমবসবহঃ, অর্থাৎ দক্ষ সেচব্যবস্থা। তাছাড়াও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা, পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্ট প্রযুক্তির প্রবর্তন ও প্রশিক্ষণসহ জাতীয়পর্যায়ে পানির সদ্ব্যবহার এর মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশ সরকারকে এফএও প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রদান করে চলেছে।
ই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর কৃষি মন্ত্রণালয়  এবং এফএওর  যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন  কর্মশালা ও কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ব খাদ্য দিবস উদযাপন করা হয়ে থাকে। এই বছরও ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩’ উদযাপন উপলক্ষ্যে সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে পানির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে মুঠোফোনে খুধেবার্তা পাঠানো, বিটিভি ও অন্যান্য বেসরকারি টেলিভিশনে টকশো আয়োজন, বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩ এর  প্রতিপাদ্য বিষয় সম্বলিত পোস্টার, বিলবোর্ড এবং তথ্যচিত্র প্রচার, ৫-১৯ বছর বয়সী শিশু এবং কিশোরদের মাঝে পোস্টার অঙ্কন প্রতিযোগিতা, কৃষিকথা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশসহ নানাবিধ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩’ বর্ণাঢ্যভাবে আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য দিবসের জন্য দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল ক্ষুধা ও দারিদ্র্য হ্রাস করে এবং সমস্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের মাধ্যমে জীবন ও জীবিকার কেন্দ্রস্থল হিসেবে তুলে ধরেছেন পানির ভূমিকা। এই বিশ্ব খাদ্য দিবসে, সবার জন্য বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। পানি যাতে দূষিত না হয় সে ব্যবস্থা নেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন কমাতে এবং গৃহস্থালি ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে ভূপৃষ্ঠের পানির সর্বোচ্চ ব্যবহারে মনোযোগ দিতে হবে। পানি আমাদের খাদ্য ব্যবস্থাপনার সুতিকাগার। এই পৃথিবীতে জীবের অস্তিত্ব নির্ভর করবে সাশ্রয়ী পানি ব্যবস্থাপনার উপর। আমাদের আজকের পানি সাশ্রয়ী কর্মকা-ই নির্ধারণ করবে আগামীর টেকসই ভবিষ্যৎ।

লেখক : ১টিম অ্যাসিস্টেন, ২প্রোগ্রাম সাপোর্ট অ্যাসিস্টেন, এফএও, বাংলাদেশ। মোবাইল : ০১৭৬৬৮৩১০৩০, ই-মেইল :swapnil.barua@fao.org