Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ : হাইব্রিড ভুট্টা

উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ : হাইব্রিড ভুট্টা
ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন
ভুট্টা আমাদের দেশ দিন দিন জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে বর্তমানে (২০২২-২৩) বাংলাদেশে আবাদকৃত ৫.১৯ লক্ষ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫৭.৫৩ লক্ষ টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়েছে। যার হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১১.০৮ টন।  ভুট্টা যদিও আমাদের দেশে প্রধান খাদ্যশস্য নয় কিন্তু বর্তমানে ইহার নানাবিধ ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধান দানাদার শস্য হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। হাইব্রিড ভুট্টার ফলন অন্য যে কোন দানাদার ফসলের চেয়ে অনেক বেশি । অধিকন্তু অন্য দানা ফসলের তুলনায় উৎপাদন খরচ কম এবং পরিবেশবান্ধব। এ ছাড়া সম্ভাবনাময় ফসল হিসাবে দেশের বর্তমান উৎপাদিত ভুট্টা থেকে প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার টন তেল উৎপাদন করা সম্ভব, যার বাজারমূল্য ৪,০০০ কোটি টাকারও বেশি।
জাত নির্বাচন
বর্তমানে অধিকাংশ হাইব্রিড ভুট্টার জাতের বীজ  বিদেশ হতে আমদানিকৃত। আবাদকৃত বাণিজ্যিক জাতগুলের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য : রবি মৌসুমের জন্য এন এইচ- ৭৭২০, পি- ৩৩৫৫, বালাজী এবং খরিপ মৌসুমের জন্য প্যাসিফিক-১৩৯, প্যাসিফিক-১৬৪, প্যাসিফিক-৩৩৯ প্রভৃতি। তবে আশার কথা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিডাব্লিউএমআরআই) বেশ কিছু রবি মেীসুমের  উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ভুট্টার জাত অবমুক্ত করেছে  যেগুলোর মধ্যে  হাইব্রিড ভুট্টা ১৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা ১৭, বিডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা ১ ও বিডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা ২ (অবমুক্তির বছর ২০২২)  অন্যতম  যাহা  কৃষকের মাঠে রবি মৌসুমে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ভবিষতে এজাতগুলোর বীজ ব্যবহার করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা সম্ভব। এজাতগুলোর মধ্য থেকে বিডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা ২ এর উপর দিনাজপুরে  গত  ১ মে ২০২৩ একটি মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মাননীয় কৃষি সচিব মহোদয় উপস্থিত ছিলেন যার ফলন প্রায় ১৪ টন/হেক্টর যা অন্য যে কোন বাণিজ্যিক জাতের চেয়ে ভাল ফলন দিতে সক্ষম ।
উচ্চমূল্যের ভুট্টা ফসল চাষাবাদের মাধ্যমে চাষিরা বর্তমানে অন্যান্য দানাদার ফসলের তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হচ্ছে। তাই আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করা একান্ত জরুরি। নি¤েœ এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
বীজের প্রপ্তিস্থান : বিডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টার জন্য স্থানীয় বিএডিসি অথবা বিডাব্লিউএমআরআই, নশিপুর, দিনাজপুর এছাড়া বাণিজ্যিক জাতসমূহের  বীজ স্থানীয় বীজ ডিলারের কাছে পাওয়া যাবে ।
বীজ শোধন : বপনের পূর্বে ছত্রাকনাশক প্রোভ্যাক্স-২০০ ডব্লিউপি @ ৩ গ্রাম/কেজি বীজ  এবং পরবর্তীতে বীজ বপনের ঠিক ১২-২৪ ঘণ্টা পূর্বে কীটনাশক ফরটেনজা @ ২.৫ মিলি লিটার/কেজি বীজ হারে শোধন করে বীজ বপন করলে বীজবাহিত রোগজীবাণুসহ চারা অবস্থায় প্রায় ২৫-৩০ দিন পর্যন্ত  সবচেয়ে ক্ষতিকারক পোকা  যেমন ফলআর্মিওয়ার্ম দমন করা সম্ভব। বিশেষত : খরিপ ভুট্টার জন্য ফরটেনজা দিয়ে  শোধন করা অপরিহার্য ।
বীজ বপনের উপযুক্ত সময় : বীজ  বপনের জন্য উপযুক্ত সময় মধ্য অক্টোবর-নভেম্বর /৩০ অশ্বিন-মধ্য অগ্রহায়ণ (রবি মৌসুম) এবং মধ্য মার্চ হতে এপ্রিল/১ ফাল্গুন-মধ্য চৈত্র পর্যন্ত (খরিপ মৌসুম) পর্যন্ত। এছাড়া ভুট্টা সারা বছরই চাষাবাদ করা য়ায। তবে রবি মৌসুমের ফলন সবচেয়ে ভাল এবং রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অনেক কম থাকে।
জমি তৈরি ও বীজ বপন : পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দ্বারা চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও আগাছামুক্ত করে জমি তৈরি করতে হবে। শেষ চাষের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণ সার প্রয়োগ করে একটি হালকা চাষ ও মই দিয়ে ৬০ সেমি. (২৪ ইঞ্চি) পর পর সারি করে ২৫ সেমি. (১০ ইঞ্চি) পর পর ১/২টি করে  বীজ বপন করতে হবে। দুটি করে বীজ বপনের ক্ষেত্রে বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর সবলটি রেখে দুর্বলটি তুলে ফেলা ।
সার প্রয়োগ : মাটি পরীক্ষা করে সারের মাত্রা নিরূপণ করে তা প্রয়োগ করা উত্তম তবে তা সম্ভব না হলে একর প্রতি ইউরিয়া-টিএসপি-এমওপি-জিপসাম-রোবন-জৈবসার-ফুরাডান যথাক্রমে ২৪০-১৪০-১০০-৮৫-৪-৩০০০-৮ কেজি (রবি মৌসুম) অথবা ১৮০-১০০-৮০-৬৫-৩-১৫০০-৮ কেজি (খরিফ মৌসুম) হারে শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে  ইউরিয়া সমান তিন কিস্তিতে (শেষ চাষের সময়, ৮-১০ পাতা অবস্থায় এবং ফুল ফোটার সময়)  এবং এমওপি দুই কিস্তিতে (দুই       তৃতীয়াংশ শেষ চাষের সময় এবং এক তৃতীয়াংশ ফুল ফোটার সময়) প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনমতো ম্যাগনেসিয়াম সালফেট. জিংক সালফেট এবং ডলোচুন ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে অম্ল মাটিতে ডলোচুন একবার প্রয়োগ করলে ৩ বছর আর প্রয়োগ করতে হবে না।
সেচ প্রয়োগ ও আগাছা দমন : মাটির প্রকারভেদে ভুট্টা চাষে সাধারণত ৩-৫টি সেচের প্রয়োজন হয়। যেমন ৩-৫ পাতা, ৮-১০ পাতা, ফুলফোটা এবং দানাবাধার সময়। সেচের পানি কোন অবস্থাতে জমিতে আটকিয়ে রাখা যাবে না । প্রথম সেচের পর ক্ষেত্র বিশেষে আগাছা দমন অপরিহার্য হয়ে উঠে । সেক্ষেত্রে সঠিক মাত্রায় অনুমোদিত আগাছানাশক অথবা নিড়ানী ব্যবহার করতে হবে।  
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন : ছত্রাকবাহিত রোগ যেমন পাতা ঝলসানো, পাতার দাগ প্রভৃতির জন্য অনুমোদিত মাত্রার ছত্রাকনাশক যেমন টিল্ট-২৫০ ইসি, অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউডিজি অথবা এমিস্টার টপ স্প্রে করা যেতে পারে। পাকামাকড়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফলআর্মিওয়ার্ম যা দমনের জন্য সমন্বিত দমনব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ পোকার  আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত মাত্রার কীটনাশক প্রোকলেইম, বেল্ট, ট্রেসার, কোরাজেন প্রভৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে কোন কীটনাশকই দুই বারের বেশি ব্যবহার না করা  ভালো কারণ সেক্ষেত্রে পোকা কীটনাশকের প্রতিসহনশীল ক্ষমতা  তৈরি হতে থাকে ।  
জীবনকাল : ভুট্টার জীবনকাল জাত ও অবস্থাভেদে তারতম্য হয়ে থাকে সাধারণত ১৪৫-১৫৫ দিন (রবি মৌসুম) এবং  ১১০-১১৫ দিন (খরিপ মৌসুম)।
ফসল সংগ্রহ : মোচার খোসা শুকনো খরের রং  ধারণ করলে ও দানার গোড়ায়  কালো দাগ হলে ফসল সংগ্রহের উপয়ুক্ত সময়  হয়েছে বলে বুঝতে হবে । অতঃপর দেরি না করে  মোচা থেকে খোসা সরাতে হবে ও মাড়াই মেশিন দিয়ে মারাই করে দানা শুকাতে হবে অথরা খোসা ছড়ানো মোচা রোদ্রে শুকানোর পর মাড়াই করতে হবে।  এর পর স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা অথবা সংরক্ষণ করতে হলে ভালভাবে রোদে শুকিয়ে ছায়ায় ঠান্ডা করে যখন দাঁতে কামড় দিলে কট কট শব্দ হয় অথবা ১৪% আর্দ্রতা  রয়েছে এমন অবস্থায় বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে রাখতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে হাইব্রিড ভুট্টার দানা  কোন অবস্থাই পরবর্তী বছরের জন্য বীজ হিসাবে ব্যবহারের জন্য রাখা যাবে না।
ফলন
উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভুট্টার ফলন ১৩-১৪টন/হেক্টর( রবি মৌসুম) এবং ৯-১০ টন/হেক্টর (খরিপ মৌসুম) পাওয়া সম্ভব।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর, মোবাইল : ০০৮৮-০১৭১৫৫৭২৫৬৭, ই-মেইল : mamunrwre@yahoo.com